অরোরা বরিয়ালিস

পারিজাত ব্যানার্জী


“যাই হোক না কেন, পৌঁছতে হবে।”

“যাঃ, ‘যাই’ দিয়ে আবার কোনো গল্প শুরু হয় নাকি! ছোটবেলায় পড়নি, ‘যে’, ‘যা’ এসব দিয়ে কিছু শুরু হয় না!”

হো হো করে হেসে উঠল আরশি। “ওইসব এবড়োখেবড়ো ‘ব্যাকারণ মানি না!’ তবে পৌঁছতেই হবে, জানি। দেরী করলে চলবে না।”

ক্লান্ত লাগে অয়ন্তিকার। পা দুটো হঠাৎ বড় শিথিল হয়ে যায় তার। ইশ! এভাবে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে! মুখে অবশ্য অন্য কথাই ফুটে ওঠে, হয়তো নিজের অজান্তেই। যদিও নিজের কোটরে বাসা বাঁধা এত ন্যানো সেকেন্ডের এত কথা আর কতটাই বা জানতে পারে কেউ!

“পথ যে এখনও অনেক বাকি আরশি! এতটা পথ যেতে সময় তো লাগবেই। সময় তো দিতেও হবে খানিক, না হলে যাওয়ার পথটাই তো ফুরিয়ে যাবে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই!”

আরশি চোখ টিপে হাসে এবার। তার প্রাণবন্ত মুখের সমস্ত রেখায় দুষ্টুমি মেখে যায় ভাল করে। “পথে কত বাধা থাকবে জানো? কত বাঘ, কত ভাল্লুক, কত মন্ত্রণা, কত উপদেশ! এসব থেকে বাঁচতে গেলে একটাই উপায়; তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে হবে পথটাই! বুঝলে? বেশী দেরী করলে ঘোড়া ছোটালেও আর গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেনা। কোনোদিনই!”

মনে পড়ে অয়ন্তিকার। হ্যাঁ, ঘোড়া! তার ঘোড়াটা কোথায়। তার সেই ধূসরাভ ‘তেজস্বিনী’? অনেকক্ষণ ধরে তো হেঁটেই চলেছে সে। কই, তেজস্বিনীর দেখা তো নেই! তবে কি ভুল পথ ধরল ও? এ পথে বিষধর শাপ আছে, জঞ্জাল রয়েছে, পা জড়িয়ে যায় প্লাস্টিকের স্তূপে কিন্তু সুলুকসন্ধান হয় না! কোথায় সেই ‘অরোরা বরিয়ালিস’! কোথায় সেই মায়াবী আলোর খেলা! এবার যে পা চালাতেই হবে! এত অনুষ্ঠান, এত আয়োজন— সব যে না তো শেষ হয়ে যাবে, শুরু হওয়ার আগেই!

কি বুঝল আরশি কে জানে! আড়চোখে তাকালো সে শুধু। “ওই দূরে পাথুরে বাঁকটা দেখতে পাচ্ছো, ওটা পেরোলেই গভীর সুড়ঙ্গ দেখতে পাবে। মাটির বুক বরাবর কাটা ওই পথ। অতটা পথ একাই যেতে হবে। তারপর মিলবে তেজস্বিনীর দেখা। আদিমতম গুহামুখের সামনেই রয়েছে ওদের আস্তাবল। রাত শেষের আগে না পৌঁছতে পারলে কিন্তু বিপদ।”

শঙ্কিত হয় অয়ন্তিকা। “কি বিপদ? সেই বাঘ ভাল্লুক? সেই মৃত্যু?”

“ওমা! মৃত্যুতে আবার ভয় কি? ভয় তো এই বেঁচে থাকাকেই!” নিরুদ্বেগে চকচক করে ওঠে আরশি।

“মানে!” বাঁকের আগেই দাঁড়িয়ে পড়ে অয়ন্তিকা। মাথার দুদিকের শিরা দুটো দপদপ করছে তার। উফ! আবার ওই মাইগ্রেনের ব্যথা কি তবে ফিরে এলো? এই তো বেশ ফুরফুরে লাগছিল কিছুক্ষণ আগেই। সত্যিই, সবই কি ভীষণ ক্ষণস্থায়ী!

“আরে, তুমি তো দেখছি এ যাত্রায় সবই ডোবাবে! কত করে বলছি যে চলো! দেরী করো না! যত দেরী করবে, বিচলিত হবে, তত এক পা এক পা করে পিছিয়ে পড়বে তুমি! কিছুতেই শেষরাতে দৌড়েও কিনারায় উঠতে পারবে না তখন। খেয়াল রেখো, পথ কিন্তু দুর্গম!”

অয়ন্তিকা আশপাশটা আর একবার দেখে। কই, তার তো তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। প্রথমদিককার অসুবিধেগুলো পেরিয়ে পথ এখন অনেকটাই প্রশস্ত। অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়ায় এখন আর ততটা অস্বস্তিও হচ্ছে না!

তার মনের কথা টুক করে পড়ে নিলো আরশি। খুব বাজে স্বভাব এটা ওর। বরাবরের। “এখন অসুবিধা হচ্ছেনা ঠিকই। কিন্তু এই নিজেকে সইয়ে নেওয়াটাই বড় বিপদের, সেটা মানো তো! যতক্ষণ তুমি বিবাদ প্রতিবাদে থাকবে, চিৎকার করবে, অসহযোগিতা করবে, কিছুতেই মেনে নেবে না কিছু, ততক্ষণই শান্তি। চারদিকে এই যে সব মৃতদেহ পড়ে, পিশাচেরা গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছে রক্তের গোগ্রাসে গিলবে বলে সব, অথচ তুমি কেমন মানিয়ে নিয়েছো, ভবিতব্য বলে উড়িয়ে দিচ্ছ আমার কথা ক’টাও, চিন্তা এখানেই। চেয়ে দেখো, অর্ধেক পথও কিন্তু পাড়ি দিইনি আমরা এখনও! সুড়ঙ্গ শেষে রক্তাভ নদীর উৎসে ঠাণ্ডা জমাট বরফের দুর্ভেদ্য পাহাড়ের প্রাচীর, সে খেয়াল আছে তো! হামাগুড়ি দিয়ে, খুব আস্তে আস্তে সেই পথটুকু কিন্তু পেরোতে হবে! তবে সাবধান, পিছন ফিরে চাইবে না। তেজস্বিনী থাকবে তোমার পিছনে। চিন্তার কিছু নেই।”

“আর তুমি?”

“আমি? আমার কি আর ঠিক আছে গো! কখন আছি, কখন নেই! এই সুড়ঙ্গের কত খানাখন্দ, সব কি আর আমি নিজেও জানি? কখন কোথায় ঠোক্কর খাবো, তলিয়ে যাব মহাশূন্যে! তুমি তা বলে আবার থেমে যেও না! তোমার যা স্বভাব! একটুতেই অমনোযোগী হয়ে পড়ো। এপথে কিন্তু একদম ওসব নয়! খেয়াল রাখবে, শুধু ভোরের আলো ফুটতে দেওয়া যাবে না। ওই অতিপ্রাকৃত আলোর জাল থেকে তোমারও তখন নিস্তার হবে না কিন্তু! বুঝলে, ওসব আলো দূর থেকে দেখাই ভালো, নিজের মধ্যেই বিচ্ছুরণ শুরু হলে কিন্তু মুশকিল! খাঁচায় আটকানো বন্য জন্তুর মতো অবস্থা হবে তখন। জল, খাবার সব বসে বসেই পেয়ে যাবে, অথচ কোথাও বড় একটা গরমিল থেকে গেল, ঠিক ধরতে পারবে!”

অয়ন্তিকা বুকে-হাঁটা শুরু করে। সমস্ত জাগতিক বস্তুর ভর এখন তার বুকের উপর সুস্থির। হাত পা ছড়ে যাচ্ছে, কপালটাও ঠুকে গেল শূন্যে জমাট বাঁধা একতাল বরফে! কুচিকুচি বরফরাশি জমা হয়ে এমন পুরু দেওয়াল উঠল কবে? কই, আরশি তো বলেনি এর কথা আগে!

ঝনঝন করে শব্দ হল। তবু অয়ন্তিকা পিছন ফিরে চাইল না আর। আরশি মানা করেছিল। ফেলে আসা সবকিছু ঠিকই থাকবে। যেমনটা থাকে আর কি! ‘ঠিক’, ‘ভুল’ বলে তো আর কিছু হয় না। সবই হতে হয়, তাই হয়। যেমন এই অভিযাত্রায় সামিল হওয়া তার ভবিতব্য, এরও কি আর খারাপ ভালো আছে? সমগ্র চেতনা জুড়ে এই যে অপরিসীম কষ্ট, আবার অ্যানাসথেসিয়ার ঘোরে সব শুনতে বুঝতে পারলেও দিব্যি অভিব্যক্তিহীন থাকা যাচ্ছে, এই তো ঢের!

অয়ন্তিকার হাতের উষ্ণতায় বরফের প্রাচীর গলে জল হয়ে গেল একসময়। তবু, সময়ে যে সব শেষ হবে না আর তাও আর একবার মালুম হল বইকি! এতটা এসে ফেরাও সম্ভব নয়, সে রাস্তায় গুমোট দমচাপা আলো আঁধার! এধার থেকেই দেখা যায় সে পথও। না দেখা যাওয়াটাই যদিও ঠিক হতো বোধহয়!

ওই, ওই তো সুড়ঙ্গ শেষ! ওই তো তেজস্বিনীর টানা টানা দুটো চোখ! কিন্তু আদিম এই গহ্বরের মুখের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে কেন ও? ওখান দিয়েই তো অয়ন্তিকার বেরোনোর কথা! “এই যা! সরে যা! আলো দেখব। ‘অরোরা বরিয়ালিস’! তার আগে কত কাজ বাকি রয়ে গেছে! সেরে ফেলতে হবে তো! কোটি কোটি বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা শৃঙ্গজয় করতে হবে, ভাসতে হবে রক্তাভ নদীর প্রাণরস সুধায়— সর, সরে যা বলছি! আহ! অমন জোরে ডাকিস না। সবাই শুনতে পেয়ে যাবে! ছুটে আসবে। আমার এদেশে আসার ভিসা দেখাতে বলবে! আমি যে সব তার কেটে পালিয়ে এসেছি! নাঃ, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার! চুপ কর! একদম চুপ! নাতো—নাতো এই নে!”

সামনেই পড়ে থাকা স্বচ্ছ বরফের ধারালো অস্ত্র তুলে নেয় অয়ন্তিকা। তারপর কোপাতেই থাকে এলোপাথাড়ি আর কিছু না ভেবে। কোপাতেই থাকে, যতক্ষণ না সব ডাক নিস্তব্ধ হয়ে যায় একেবারে।

বাড়ির পাশের গাছটায় সব পাখিরা একসাথে ডেকে ওঠে কাকভোরে। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে অয়ন্তিকা। উফ কি বীভৎস স্বপ্ন! চোখদুটো ভালো করে মুছে আড়মোড়া ভাঙে সে। যাঃ, ভোরের আলো যে ফুটে গেল! সেই আরশি বলেছিল না—

ঘরের এককোণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কাঁচের টুকরোগুলো। কি জানি কোন অদেখা ঝোড়ো হাওয়ায় অমন করে ভেঙে গেল আয়নাটা! নাকি বরফের প্রাচীরের ওই বেসামাল ধাক্কাই কেড়ে নিলো আরশিকে! ও যে বড্ড পলকা! দোকানের ওই কর্মচারীটা অবশ্য আগেই বলেছিল!

নাঃ, এবার একটু দাম দিয়ে দেখেশুনে কিনতে হবে আয়না। ওকে আর ভাঙতে দেওয়া যাবে না! নাহলে যে ‘অরোরা বরিয়ালিস’-এর এই গোলকধাঁধা খেলা শেষ আর হবে না কিছুতেই!

অলংকরণ - মার্গারেট জন উলম্যান (শাটারস্টক)