একটি প্রাগৈতিহাসিক গল্প

বিভাবসু দে


গল্পটা যে ঠিক কবেকার তা আমারও জানা নেই; কি করে জানব বলুন, সাল-তারিখের হিসেব যে তখনও শুরুই হয়নি। যীশু খ্রিষ্টের আসতে আরও আটষট্টি হাজার বছর বাকি, মানে গড়পড়তা প্রায় সত্তর হাজার বছর আগের কথা বলছি। না না, ভুল লিখিনি, সত্তরের পর তিনখানা শূন্য বসালে যা হয়, তাই বলছি। ইতিহাসের বইয়ে পাবেন না, ইতিহাসকার নামক মহাপুরুষেরা তখনও যে অবতীর্ণই হননি পৃথিবীর বুকে; এমনকি মহাকাব্যের গণ্ডিও অতদূর বিস্তৃত নয়। মোদ্দা কথা এটি একটি প্রাগৈতিহাসিক গল্প, যা শুধু ধরা দেয় কল্পনার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা কোনো কোনো উন্মাদোতর লেখকের প্রলাপে!

সে সময় পৃথিবী এক আজব রূপান্তরের মধ্য দিয়ে রোজ ঢেলে সাজাচ্ছে নিজেকে; হিমযুগ সবে শেষ হয়েছে, কিন্তু সেদিনের পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা আজকের থেকে অনেকটাই কম। সেদিনকার পৃথিবী গোটা একটা পৃথিবী ছিল, কাঁটাতারের বেড়া তখনও তাকে দেশে দেশে টুকরো করেনি। বিবর্তনের বহু ধাপ পেরিয়ে আধুনিক দেহকাঠামোযুক্ত মানুষেরা দেখা দিয়েছে পৃথিবীর বুকে, কিন্তু একুশ শতকের বিশ্বনিয়ন্তা মানুষ হতে এদের এখনও অনেক পথ-চলা বাকি। সভ্যতা বা পরিবার বলতে যা বোঝায় তা এখনও ঠিক শুরু হয়নি, তবে পারিবারিকতার বীজবপন হয়ে গেছে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের মধ্য দিয়ে। এই গোষ্ঠীজীবনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মিলে চলার, একতার মন্ত্র, যা আরও বহু হাজার বছরের দীর্ঘ যাত্রাপথের শেষে নিজেকে মেলে ধরবে এক মহান সভ্যতা রূপে, যার বুকের গভীরে সযত্নে সঞ্চিত থাকবে আত্মীয়তা, ভালোবাসা, সহানুভূতির নির্যাস।

আচ্ছা, আপাতত দার্শনিকতা রেখে চলুন ফিরে যাই গল্পের যুগে।

সেই প্রাগৈতিহাসিক কালের একটি ছোট্ট দল, ছ’জন মানুষের; চারজন পুরুষ ও দু’জন নারী। এখনও সম্পর্কের জটিল গাণিতিক হিসেব কষতে শেখেনি ওরা, তাই এই দলে কার সাথে কার ঠিক কি সম্পর্ক তা বলা কঠিন। নারী-পুরুষের শাশ্বত আদিমতম সম্পর্কের বাইরে অন্যান্য তাত্ত্বিক সম্পর্কগুলোর সংজ্ঞা গড়ে উঠতে এখনও বহুদিন বাকি।

বেশ ভালোই কাটছিল দলটির দিন, হিমযুগ কেটে যাওয়ায় শিকারও এখন ভালোই জোটে ওদের কপালে। তীক্ষ্ণধার পাথরের ফলা মজবুত বাঁশের মুখে বেঁধে তাই দিয়ে পশুপাখি শিকার করে ওরা, আর তারপর দিনের শেষে আগুনে ঝলসানো সেই আধপোড়া মাংস ভাগ করে খায় সবাই মিলে। গ্রূবক এ দলের সর্দার, তাই মাংসের ভাগটাও ওর একটু বেশিই থাকে। বেশ বলিষ্ঠ দোহারা গঠন গ্রূবকের, শিকারেও অসাধারণ পটু সে।

আজ সকাল থেকেই দলে বেশ ব্যস্ততা, শিকারে বেরোতে হবে। ওদের পাহাড়ি গুহার পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে ছোট একটি নদী, পাথরের গা বেয়ে তরতর করে ছুটে চলেছে সেই হিমশীতল জল। তারই পাশে একটি পাথরের উপর বসে আছে গ্রূবক। পাথরে ঘষে বেশ ভালো করে শানিয়ে নিচ্ছে নিজের অস্ত্রের ফলাটা। আজ যে করেই হোক শিকার চাই নইলে ক্ষুধার জ্বালা সয়েই কাটাতে হবে পুরোদিন। নদীর জলে অস্ত্রের ফলাটা ডুবিয়ে একটু দূরেই বসেছিল সাগ্রীক। গ্রূবকের দিকে তাকিয়ে সে একটু উৎকণ্ঠিত স্বরেই বললে, “গ্রূবক, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ? জন্তু জানোয়ারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে পাহাড়ে, শিকার করা বেশ কঠিন হয়ে উঠছে দিন দিন।”

গ্রূবক রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকালো সাগ্রীকের দিকে, অস্ত্রের ফলার মতোই শানিত ওর চাউনি। বেশ রূঢ় কণ্ঠে বলল, “শীত আসছে, বুঝতে পারছ না? আর কয়েক হপ্তা পরেই বরফ পড়তে শুরু করবে পাহাড়ে, তখন জানোয়ার ছাড়ো পাখিও পাবে না এ তল্লাটে।”

নদীর ওপার থেকে প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলো ফ্রনিক– “পশ্চিমের পাহাড় বেয়ে বন্য শূকরের পাল নামছে, এখুনি চলো গ্রূবক।”

চকিতে উঠে দাঁড়ালো সবাই, চকচক করে উঠল শানিত পাথুরে ফলাগুলো; তীরবেগে ছুটে গেল ওরা ফ্রনিকের দেখানো পথ ধরে। পেটের তাগিদে দৌড়তে লাগল ওরা, আজ যে শিকার পেতেই হবে। জীবমাত্রের আদিমতম দৌড় চলল পাহাড় জঙ্গলের বুক চিরে। সত্তর হাজার বছর পরেও সমান তালে চলবে সেই দৌড়। হয়তো তখন অনেকাংশেই দৈহিক থেকে মানসিক হয়ে উঠবে তার গতিপথ, কিন্তু মূল তাগিদটা সেই একই, বাঁচার তাগিদ। যার জন্যে আজ অস্ত্র হাতে ছুটে চলেছে গ্রূবক, সাগ্রীকরা।

অন্যসময় হলে দলের দুই নারীও যেত শিকারে, কিন্তু নিনাল সন্তানসম্ভবা। হয়তো আর এক-দেড় সপ্তাহের মধ্যেই দলের নতুন সদস্য আসবে। তাই আপাতত ক’দিন নিনালকে একা রেখে সাকিয়াও শিকারে যাচ্ছে না।

বেলা গড়িয়ে দুপুর হল, সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিমমুখী হয়ে আসছে। বারবার অপেক্ষা-ভরা চোখে নদীর ওপারে তাকিয়ে দেখছে সাকিয়া। হঠাৎ দূরে চারটি অস্পষ্ট নরমূর্তি দেখা দিল, কাছে এগিয়ে আসতেই পরিষ্কার চেনা গেল ওদের। “ওরা শিকার পেয়েছে!”, নিনালের দিকে তাকিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠল সাকিয়া।

চার বীর শিকারি ক্লান্ত দেহে এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। আকাশের দিকে উঁচিয়ে আছে ওদের অস্ত্রের রক্তে ভেজা ফলাগুলো। সকলের গায়েই কমবেশি আঁচড়ের, আঘাতের দাগ। ফ্রনিকের হাতে বেশ গভীর ঘা লেগেছে বন্য শূকরের দাঁতের গুঁতোয়। তবে এই আদিম জগতে, যেখানে রোজ মূর্তিমান মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে নিজের জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয় সেখানে এসব আঘাত, ক্ষত নিত্যকার সঙ্গী। জীবনের পথে এগিয়ে যাবার ছাড়পত্রে মৃত্যুদেবতার দেওয়া সিলমোহর মাত্র।
নদী পার করে এলো চারজনে। গুহার সামনে এসেই হ্রীনিস কাঁধ থেকে সজোরে আছড়ে ফেলল আজকের শিকারের বোঝাখানা; একটা মাঝারি আকারের মৃত শূকর। শিকারের রক্তে সারা পিঠ লাল হয়ে আছে হ্রীনিসের, ঠিক যেন রক্তাভিষিক্ত কোনো ভৈরব মূর্তি। সাকিয়া ছুটে এসে বেশ উৎসাহে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল মৃত শিকারটিকে, “বেশ বড় আছে কিন্তু!”

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে হতাশার স্বরে গ্রূবক বললে, “হুম, খুব বড়! বলি কি হবে ওতে? আজকেই তো ফুরিয়ে যাবে ওটা।”

ফুরিয়ে তো যাবেই, কিন্তু তাতে অত আক্ষেপের কি আছে তা ঠিক বুঝতে পারে না সাকিয়া, নিনাল, হ্রীনিসও একটু অবাক দৃষ্টিতেই তাকে গ্রূবকের দিকে। যদিও সাগ্রীক আর ফ্রনিক ঠিকই বুঝতে পেরেছিল দলপতির ওই দীর্ঘনিঃশ্বাসের পেছনে লুকিয়ে থাকা উৎকণ্ঠার কারণ। তবে সেই মুহূর্তে কেউই আর গ্রূবকের সাথে তর্কে এগোল না। ওর রূঢ়ভাষী উগ্র মেজাজ সকলেরই জানা। তাছাড়া এটা সময়ও নয় বৃথা আলোচনার, শিকার এসেছে, সবাই সেটাকে নিয়েই ব্যস্ত। সাকিয়া আর ফ্রনিক একটা ধারালো পাথরের ফলা দিয়ে ওটাকে চিড়ে টুকরো টুকরো করতে লেগে গেল।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, চারিদিক ডুবে গেছে নিঝুম অন্ধকারে, হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করেছে সারা উপত্যকা জুড়ে। গুহার গভীরে চকমকির ঠোকরে জ্বলে উঠল আগুন; তারই আঁচে মাংসের টুকরোগুলো হাল্কা ঝলসে নিয়ে শুরু হল আজকের নৈশভোজন। পরম তৃপ্তিতে সুগঠিত চোয়ালের জোরে ওরা ছিঁড়ে নিতে লাগল আধপোড়া মাংসের টুকরো। আজকের জীবনযুদ্ধে ওরা জয়ী, তারই পুরস্কার ওদের হাতে; কাল কি হবে কেউ জানে না।

হলদে হয়ে আসা সুদৃঢ় দাঁতের টানে ছিঁড়ে নেওয়া একটুকরো মাংস চিবোতে চিবোতে গ্রূবক ওর সহজাত রূঢ়স্বরে বলল, “আমাদের এ জায়গা ছাড়তে হবে।”

সবাই খাওয়া থামিয়ে অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে, হ্রীনিস বলল, “কিন্তু কেন? যাবই বা কোথায়?”

গলার ঝাঁঝ আরেক কাঠি চড়িয়ে জবাব দিল গ্রূবক, “আহাম্মক কোথাকার, বুঝতে পারছ না যে শীত আসছে? যত দিন যাচ্ছে বাইরে হাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে আসছে আরও। শিকারও কমতে শুরু করেছে। পাহাড়ি মোষ, শূকর সব দলে দলে সরে যাচ্ছে দক্ষিণের দিকে। আর হপ্তা দুয়েক পরেই বরফ পড়তে শুরু করবে পাহাড়ে, তখন শিকার তো পাবেই না এমনকি গাছের পাতাও জুটবে না বরাতে, না খেয়ে মরবে সবাই।”

ফ্রনিক হাতে করে মাংসের টুকরোটা আরেকটু ঝলসে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলে, “কিন্তু যাব কোথায়?”

-“দক্ষিণে, যেদিকে সব জন্তু-জানোয়ারগুলো যাচ্ছে। কালই বেরবো আমরা।”

এবার অজানা আশংকায়, ভয়ে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল নিনালের, সেই কম্পন স্পষ্ট শোনা গেল ওর গলার স্বরেও, “কিন্তু এই অবস্থায় আমি যে অতদূর হাঁটতে পারব না গ্রূবক।”

নিনালের পাশে দাঁড়াল সাকিয়াও, “আর এক সপ্তাহ পরে বেরোলে হয় না? আগামী সপ্তাহেই ওর সন্তান জন্মাবে গ্রূবক, আর একটা সপ্তাহ দাও।”

পাথুরে ফলার মত সুতীক্ষ্ণ একটা নির্দয় দৃষ্টি গিয়ে পড়ল নিনাল আর সাকিয়ার দিকে। আদিম জীবনের সকল কঠোরতা যেন কানায় কানায় ছলকে পরে গ্রূবকের ওই নির্মম চাউনিতে। একটু সময় কি যেন ভেবে আবার সেই মেঘফাটা গলায় গর্জে উঠল গ্রূবক, “কিচ্ছু করার নেই। এক সপ্তাহ সময় নেই হাতে, আর একদিনও দেরি করলে শীতের আগে পৌঁছতে পারব না আমরা গরম জায়গায়; মাঝপথেই ঠাণ্ডায় আর ক্ষুধায় মরতে হবে সবাইকে। একজনের জন্যে সবাই তো আর মরতে পারে না। তাই যদি বাঁচতে চাও তো কালই বেরোতে হবে।”

নিনালের হাত-পা গুলো যেন অবশ হয়ে গেল আসন্ন মৃত্যুভয়ে। সাকিয়ার মনটাও খারাপ হয়ে গেল ওর কথা ভেবে, কিন্তু আর করবে সে, গ্রূবকের কথাও যে কঠিন বাস্তব। বাঁচতে গেলে যে এগোতেই হবে, পিছিয়ে পড়লেই মৃত্যু নিশ্চিত। রাত হয়েছে, সারাদিনের ক্লান্ত শরীরগুলো গুহার আঁধারে এলিয়ে পড়েছে ঘুমে। শুধু নিনালের চোখে ঘুম নেই আজ। আগামীদিনের বিভীষিকাময় অনিশ্চিত রাতগুলো দুঃস্বপ্নের মত জেগে উঠছে ওর চোখের সামনে। কাল সকালেই সবাই পা বাড়াবে দক্ষিণের পথে, তারপর এই গুহায় একা অসহায় পড়ে থাকবে নিনাল। হয়তো আগামীকালই এমন রাতের আঁধারে কোনো ক্ষুধার্ত বন্য পশু এসে ছিঁড়ে খাবে ওকে। আর যদি তা নাও বা হয় তবু ক্ষুধায় শীতে কতদিন প্রাণ টিকিয়ে রাখতে পারবে সে, জগতে আসার আগেই হয়তো জীবন ফুরিয়ে যাবে নিনালের সন্তানের। এমনই আরও কত দুঃস্বপ্নের ছবি ভিড় করে দাঁড়াতে লাগল ওর চোখের তারায়।

কিন্তু এই অতন্দ্র রজনীতে নিনাল আজ একা নয়, গুহার বাইরের নদীর ধারেও একজন জেগে বসে আছে সারারাত, সাগ্রীক। গ্রূবকের সিদ্ধান্ত কেন জানি না ওর চোখের ঘুমও কেড়ে নিয়েছে আজ। বারবার ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে নিনালের ভীত কাতর মুখখানি। কিন্তু কেন হচ্ছে এমনটা! নিনালের পেটে ওর দেহাংশ বেঁচে আছে বলেই কি শুধু এই টান! কিন্তু এই ঘটনা তো নতুন কিছু নয় সাগ্রীকের জীবনে, এর আগেও তো এমন কত নারীর সাথে মিলন ঘটেছে ওর, কতই তো জন্মেছে এমন সন্তান, তবে আজ কেন এমন উথাল পাথাল হচ্ছে বুকের ভেতরটা! জীবনে প্রথমবার দৈহিক চাহিদার ঊর্ধ্বে কোনোকিছুর অস্তিত্ব অনুভব করল সাগ্রীক। নদীতীরে সারারাত জেগেই কাটলো ওর।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। একটু পরেই ফ্রনিক, হ্রীনিস আর সাকিয়াকে সাথে নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এলো গ্রূবক –“চল সাগ্রীক, এগোতে হবে এবার।”

উঠে দাঁড়াল সাগ্রীক, কিন্তু পা দুটো নড়ল না ওর; দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “তোমরা যাও গ্রূবক, আমি যাব না।”

এমন জবাবে হঠাৎ চমকে উঠল গ্রূবক, চোখ দুটো রাগে রাঙা হয়ে উঠল ওর। কালবৈশাখীর আকাশভাঙা বজ্রনাদের মত গর্জে উঠল সে– “মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? মরতে চাও এখানে না খেয়ে? চল বলছি, শুধু শুধু সময় নষ্ট করো না, অনেক পথ যেতে হবে।”

–“নিনালকে এই অবস্থায় একা ফেলে আমি যাব না গ্রূবক, যাও তোমরা।”

গ্রূবকের রাগ এবার বাঁধ ভেঙে আছড়ে পড়ল। সাগ্রীকের বুকে সজোরে এক ধাক্কা মেরে চেঁচিয়ে উঠল সে– “পচে মর তবে এখানে।”

সাগ্রীক কোনো উত্তর দিলে না, ক্রমশ ছোট হতে হতে দিগন্তের পথে মিলিয়ে গেল চারটি মানবমূর্তি।

একটু পরে ধীরে ধীরে গুহায় গিয়ে ঢুকল সাগ্রীক। নিশ্চিত একাকীত্বকে জড়িয়ে এক অনিশ্চিত দিনের আশংকায় গুহার এককোণে বসেছিল নিনাল; হঠাৎ চমকে উঠল সে সাগ্রীককে দেখে।

–“তোমরা যাও নি এখনও?”

–“ওরা চলে গেছে। আমি যাব না।”

আর কোনো প্রশ্নের অবকাশ না দিয়েই অস্ত্রখানা নিয়ে দ্রুতপদে বেরিয়ে গেল সাগ্রীক।

অবাক চোখে তাকিয়ে রইল নিনাল, কেন শুধু শুধু এই নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে বুক পেতে দাঁড়াতে গেল সে! তবে কি শুধু আমার জন্যেই গেল না সাগ্রীক?

এতক্ষণ ধরে নিনালের মনের ভেতর যে ভয়, শঙ্কার ঝড় বয়ে চলেছিল নীরবে, হঠাৎ তা যেন শান্ত হয়ে গেল কোনো এক অজানা জাদুর ছোঁয়ায়। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওর এই মুহূর্তে, এমনটা কোনোদিন হয়নি এর আগে। ওর চোখের কোণে অকারণে একফোঁটা জল যেন চিকচিক করে উঠল। মৃত্যুর হাত যে এড়ানো যায়নি তা ভালোভাবেই জানে নিনাল; শিকার না পেলে কেউই বাঁচবে না। কিন্তু তবুও ওর বুকের পাষাণ ভারটা যেন সরে গেছে, কোন এক অনাবিল আনন্দে যেন ভরে উঠেছে ওর মনের অন্ধকার গুহাটি; কি আজব আজকের এই অনুভূতি! নিনালের জীবনে সত্যিই এ এক অচেনা ছবি।

গ্রূবকের কথা মিথ্যে হয়নি, বরফ পড়তে শুরু করেছে, শিকার পাওয়াও বেশ কঠিন হয়ে উঠছে দিনে দিনে। এমনকি গাছের ফল পাতাও ঝরে গেছে সব। এমন দুর্দিনের মাঝেই জন্ম নিলো নিনালের সন্তান; হাজার দুশ্চিন্তার ভিড়েও হাসি ফুটলো ওর মুখে। মুখে প্রকাশ না করলেও সাগ্রীকের মনটাও ভরে উঠেছে এক অপার্থিব আনন্দে। এর আগেও অনেকবার এমন সন্তান জন্মাতে দেখেছে সাগ্রীক কিন্তু এবারের অনুভূতিটা যেন একটু আলাদা; কোথায় যেন নিজের একটা অস্তিত্ব খুঁজে পেল সে ওই নবজাতকের মধ্যে, যেন ওই নবকলেবরে সে নিজেই পা বাড়ালো ভবিষ্যতের পথে।

কিন্তু এই দুঃসময় যে এক কঠিন সত্যের মত দাঁড়িয়ে আছে গুহার বাইরে; প্রতিটি হিমেল হওয়ার ঝাপটা বারবার ওদের মনে করিয়ে দিচ্ছে আসন্ন মৃত্যুর কথা। রাতগুলো আরও ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, বরফের চাদর পুরু হয়ে উঠছে দিনে দিনে। আজ দু’দিন হতে চলল, শিকার জোটেনি, খাবার পড়েনি দুজনেরই পেটে। নিনালের শরীর বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। সকাল থেকে খিদের জ্বালায় কাঁদছে দুধের শিশুটাও। প্রতি মুহূর্তে ঘনিয়ে আসা মৃত্যুকে হাড়ে হাড়ে অনুভব করছে ওরা। বাচ্চাটার কান্না আর সইতে পারল না সাগ্রীক, অস্ত্র হাতে ছুটে বেরিয়ে গেল গুহা থেকে। যদিও সে জানে শিকার পাবার আশা খুব কম, তবু ওকে খুঁজতেই হবে, বেঁচে থাকতে বাঁচার লড়াই ছাড়বে না সাগ্রীক। এখন যে শুধু একার নয়, আরও দুটি প্রাণের তাগিদ কাজ করে চলেছে ওর মধ্যে।

অনেকক্ষণ কেটে গেল, দেখা নেই সাগ্রীকের। সন্ধ্যা নেমে এসেছে, সোঁ সোঁ করে বইছে হাড়-কাঁপানো হিমেল বাতাস। এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে এসে গুহায় ঢুকল সে, হাতে একটা মাঝারি আকারের মরা পাখি; তবে এ সাগ্রীকের নয় শীতের শিকার। কিন্তু এইটুকু পাখিতে দুটো ক্ষুধার্ত পেট কিছুতেই ভরবে না। নিনাল ভেবেছিল সাগ্রীক হয়তো খিদের জ্বালায় একাই খেয়ে নেবে পাখিটা; কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল, সাগ্রীক পাখিটাকে আগুনের আঁচে ঝলসে নিয়ে পুরোটাই এগিয়ে দিল নিনালের দিকে। জীবন সংগ্রামের এই চরম মুহূর্তে যখন মৃত্যু পদে পদে কাছে এগিয়ে আসছে এক কঠোর বিভীষিকার মত তখন কোন স্বার্থে সাগ্রীক নিজের প্রাণের নিশ্চয়তা তুলে দিল নিনালের মুখে? সাগ্রীক নিজেও বুঝতে পারল না, এ কোন অনুভূতি যার জোরে আজ প্রথমবার এক আদিম গুহাবাসী পশু ক্ষুধার জ্বালাকে, নিজের বাঁচার তাগিদকেও উপেক্ষা করতে শিখল! এই জটিল মুহূর্তের ব্যাখ্যা ওদের দুজনেরই বোধের ঊর্ধ্বে।

কিন্তু আজ এই স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডা গুহার আলো-আঁধারির মাঝে কিছু একটা ঘটল বটে। এই বরফ-পড়া রাতটির গল্প কোনোদিনই লেখা হবে না কোনো ইতিহাসের বইয়ে। তবু সবার অলক্ষ্যে শুধু সময় সাক্ষী রইল দুই নারী পুরুষের স্বামী-স্ত্রী হয়ে ওঠার, এক বংশবিস্তারকারী পশুর পিতা হয়ে ওঠার এই গল্পের, গুহার আধো-অন্ধকারে সভ্যতার আরেকটি ধাপ রচনা হয়ে গেল আজ।


অলংকরণ - বিল জোসেফ মারকোরস্কি