ফলস্ নাইন - অনিন্দ্য রাউত

।। ১ ।।

কিশোর পল্লীপ্রীতি ক্লাব। এই বেহালা আর তার আশেপাশের অঞ্চলের সবচেয়ে বিখ্যাত ক্লাব। গড়পড়তা ধারণা অনুযায়ী একটি ক্লাব নানা সমাজসেবামূলক কাজের মধ্য দিয়ে নিজের অপরিহার্যতা বজায় রাখে। তার সাথে ফুটবল, ক্রিকেট, ক্যারম, তাস, দাবা টুর্নামেন্ট চলবে নিয়মমতো বছরের বিভিন্ন সময়ে। এছাড়া নানা সৃজনমূলক কাজ, পরিবেশ রক্ষা কর্মসূচী, কর্মশিক্ষা, নানা প্রদর্শনী হবে। দুর্গাপুজো, কালীপুজো, সরস্বতী পুজো মাস্ট। বিভিন্ন মনীষীর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁদের স্মরণ করা হবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। কিন্তু কিশোর পল্লীপ্রীতি ক্লাব বিশেষ ভাবে বিখ্যাত একটি অন্য কারণে। তারা একটি সংগঠন চালায় - 'মিলনে জীবন'। সঙ্গে খবরের কাগজের পিছনের কোণায় চোখ পড়ে যাবেই এরকম বিজ্ঞাপনের মতো ট্যাগলাইন - 

গ্যারান্টি! গ্যারান্টি! গ্যারান্টি! ১০০% গ্যারান্টি! আমাদের দরবারে এসে মিলিত হোন আর সুখী সংসারের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করুন। না হলে সমস্ত টাকা ফেরৎ আর কন্যার ভরণপোষণের দায়িত্ব আমাদের।


স্বভাবতই এরকম প্রস্তাবে সাড়াও মেলে প্রচুর। যেহেতু সুবিধাটা শুধু মেয়েদের এবং তাদের পরিবারের, তাই তারা তাদের বিবাহযোগ্যা কন্যার সি.ভি. নিয়ে এসে হাজির হয় 'মিলনে জীবন' দপ্তরে। এরপর সংগঠন সংগঠিত হয়ে চারজন উপযুক্ত ছেলের খোঁজ করে এবং তাদের মধ্যে সুপারলেটিভ ডিগ্রির উপযুক্ত ছেলের সঙ্গেই মেয়েটির বিয়ে হয়, মেয়েটির পছন্দ অনুসারে। সে এক জমজমাট ব্যাপারস্যাপার। আড়ালে যাকে সবাই বলে ‘আধুনিক স্বয়ম্বর’।



।। ২ ।।

“স্ট্রাইকাররা না থাকলে কী গোল হয়? তিনটে স্ট্রাইকার থাকলে জনতা আশা করে তিন গোল হওয়ার। আর স্ট্রাইকার না থাকলে যুযুধান প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে গোল করা সম্ভব হবে না। তাই আমাদের অন্তত দুটো স্ট্রাইকার চাইই 
চাই সৈকত অনেকটা ঘোষণার সুরে বলে দিলো আমাদের চারজনকে।
চাই বললেই তো আর গুপী-বাঘার মতো হাততালি মেরে স্ট্রাইকার পেয়ে যাবো না। এর জন্য সেই অসুরদের বা মুনি-ঋষিদের মতো তপস্যা করতে হবে, তাতে যদি ব্রহ্মা খুশি হয়ে দুটো স্ট্রাইকার হাজির করিয়ে দেন আমাদের সামনে।

“কিন্তু এখন কোত্থেকে স্ট্রাইকার পাবো? ভাড়া করে আনতে পারবো না। আমাদেরই ক্লাবের নিয়ম — ক্লাবের সদস্যরাই একমাত্র খেলতে পারবে এবং অবশ্যই আমাদের পাড়ার বা স্থানীয় হতে হবে।
 বিটনের গলাটা অনেকটা অনুযোগের মতো শোনালো। 

“তা তোমরা কেউ স্ট্রাইকার হতে পারোনি? সব শালা ডিফেন্স করতে জন্মেছ? আরে গোলটা করবে কে? সৈকত এবার সবাইকে একইভাবে ধমক দিতে চাইছে।

“সৈকত, মাথাগরম করিস না। এদের কিছু করার নেই। আমাদের স্ট্রাইকাররা নাচতে নাচতে মামার বাড়ি যাবে, পা ভেঙ্গে পড়ে থাকবে, এদের কি দোষ বল? আমি সৈকতকে থামিয়ে বললাম। 

“তা আমরা কী আমাদের ক্লাবের টুর্নামেন্ট থেকেই নাম তুলে নেব?”


“না, তা কেন? আমরা টিম নামাবো আর স্ট্রাইকার ছাড়াই খেলবো। হাতে এখনো পাঁচদিন আছে।”


“স্ট্রাইকার ছাড়া টিম নামিয়ে লোক হাসিয়ে লাভ কি?


“ফুটবল টিম গেম সৈকত। শুধু স্ট্রাইকার দিয়ে ফুটবল হয় না। আমরা খেলব। বিশ্বের সেরা দলের স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী খেলব। শুধু এদের একটু তৈরী করে নিতে হবে।


“মানে? কিভাবে? সৈকতের গলায় বিস্ময়।

“তিকি-তাকার নাম শুনেছিস?”


।। ৩ ।।

দূরে রাস্তার সারি সারি ল্যাম্পপোস্টের নরম হলুদ আলো ছাড়া চারদিকটা ভীষণ অন্ধকার। ঐ কমজোরি আলো এই দানবীয় অন্ধকারের কাছে বড় ক্ষুদ্র, যেন নিজের প্রাণটাকে কোনোমতে টিকিয়ে আছে। কিন্তু শুধু তাই কী? ঐ আলো তো কিছুটা অন্ধকারকে শুষে নিয়েছে, পথ দেখাচ্ছে, কোন এক জাদুবলে বাকি অন্ধকারকেও কাছে টানছে।


জীবনটাও ঠিক এরকম, আমরা সমস্ত দিক থেকে হেরে যেতে যেতে ধারণা হয় — শুধু হারটাই আছে। কিন্তু কোনো ধ্রুবতারা তখনও জেগে থাকে, আলোর মতো বোঝায় আমিও আছি আর আমার ক্ষমতা আছে ঐ সমস্ত হারের যন্ত্রণাকে ভুলিয়ে দেওয়ার। তুমি আমাকে কাছে টানো আর বুঝতে পারবে আমি তোমায় পথ দেখাচ্ছি, যে পথে শুধু চলতে হবে, বাকিটা হয়ে যায়।


দূরের ঐ নরম হলুদ আলো আর আকাশে ধ্রুবতারা দেখে আমার এসব মনে এলো, নিজেই একটু হাসলাম — না, এখনো হেরে যাইনি। এয়ারপোর্টের এদিকটায় সন্ধের পর কেউ তেমন আসে না। কিছু মাতাল আসে, কিন্তু তারা চলে যায় মাঠের আরও ভেতরে, আরো অন্ধকারের দিকে আর ঠেক বসায়। মদ-গাঁজার ঠেক। এই ঘাসের উঁচু ঢিবিটা আমাদের। আমি শুয়ে আছি তারই ওপর, নরম ঘাসের ওপর শুয়ে মনে হলো এরকমই হয়তো হয় পালঙ্ক। ঢিবিটা বেশ বড়, ৬-৭ জন অনায়াসে বসতে পারে চাপাচাপি না করেই। আমার সঙ্গে সৈকত আর টট্টরও আছে। কিন্তু পাহাড় প্রমাণ জমাট অন্ধকার ভেদ করে আমি ঠিক ঠাহর করতে পারছি না ওরা দুজন ঠিক কোথায় বসে, কতটা কাছে বা দূরে, কারণ তিনজনেই চুপ।

আমার মনে বারবার উঠে আসছে ছোটবেলার কথা। এই সুবিশাল এয়ারপোর্টের মাঠে আমরা সব বন্ধুরা খেলতে আসতাম। ভোরবেলায় ৫টা বাজতেই সাইকেল নিয়ে চলে আসতাম খেলতে। শীতকালে ক্রিকেট, গ্রীষ্ম-বর্ষায় ফুটবল। বিকেলেও খেলতাম সবাই মিলে। এই নিয়মের কোনো পরিবর্তন ছিল না। জুতো দিয়ে দুদিকে গোলপোস্ট বানিয়ে খেলতাম ফুটবল। স্কিলের বিচ্ছুরণ, ট্যাকল, পাস, শট আর গোল এই বুঝতাম আমরা। দিনের পর দিন কী মজায় কেটেছে। আমাদের মতো আরো অনেকে এই মাঠ জুড়ে খেলতো। এতবড় মাঠ যে তিন তিনটে ইডেন গার্ডেন্স ঢুকে যায় এর ভেতরে। কিন্তু বোধহয় সবকিছুরই পরিবর্তন থাকে, আমাদের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর পরই এই পরিত্যক্ত মাঠ আর এয়ারপোর্টের বিকল সংস্থাটিকে এক বেসরকারি কোম্পানি কিনে নেয় ফ্লাইং ক্লাব হিসেবে গড়ে তুলবে বলে। মাঠে যাওয়া, ভেতরে ঢোকা নিষেধ হয়ে গেল। চারদিকে উঁচু উঁচু পাঁচিল আর কাঁটাতারের ব্যারিকেড পড়লো। আর সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়লো সংস্থার গার্ডদের নজরদারি।


আমরা শুনলাম তিন বছর ফ্লাইং ক্লাব থাকার পর এটি একটি ডোমেস্টিক এয়ারপোর্ট হিসেবে গড়ে উঠবে। এই অনিশ্চিত ঘোষণার পরই এই এলাকার দাম বাড়তে লাগলো, জমির দাম আকাশছোঁয়া হল, আশেপাশের এলাকার রাস্তা চওড়া হল, আর ফাঁকা জায়গাগুলো সব বিশাল বিশাল কমপ্লেক্সে ছেয়ে যেতে আরম্ভ করলো।


এয়ারপোর্টের বাইরের এই একটুকরো অংশ দৈবাৎ পড়ে রয়েছে পরিত্যক্ত হিসেবে। বড় বড় ঘাসের ঢিবি, বকুল, কৃষ্ণচূড়া, অশ্বত্থ গাছ এই প্রাচীন এলাকাটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমার এই জায়গাটুকু খুব ভালো লাগে। একটুকরো সবুজ এই ধূসর শহরের মাঝে, একটু অক্সিজেন, প্রাণভরে নিঃশ্বাস, এক দমকা হাওয়া এইটুকুই। আশেপাশের এগিয়ে চলা দুনিয়ার থেকে আলাদা হয়ে বড় খুশিতে থাকা। এখানে এলে মনে হয় আমি ভীষণভাবে বেঁচে আছি। সারাটা দিন খেটে এসে একবার এখানে ঘাসের ঢিবিতে শুই, আকাশ দেখি আর আমার ক্লান্তি দূর হয়। কোনো কোনো সময় আরামে ঘুমিয়ে পড়ি। আজও হয়তো তাই হচ্ছিল, হঠাৎ টট্টর জোরে গলা খাঁকরিয়ে বলে উঠলো, 
জানিস, মিঠির বাবা মিঠির সি.ভি. জমা করেছে পল্লীপ্রীতিতে।

আমার ঘুমের ভাবটা ছোট করে কেটে গেল। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই সৈকত বেশ তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞেস করলো, তুই জানলি কি করে?

টট্টর যেন একটু কাছে এলো। তারপর বললো, আজ অফিসে বেরোবার সময় বাপটাকে দেখছিলাম ক্লাবে ঢুকতে, ‘মিলনে জীবন’-এর ঘরে। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল, তারপর আজ এখানে আসার আগে তেমাথার মোড়ে মিঠির ভাইটাকে পাকড়াও করে জানতে পারলাম।

“তুই শিওর? সৈকত সন্দিগ্ধ।

“১০০% — লক করে ফেল। ভাগ্যিস মিঠির কোনো প্রেমিক ট্রেমিক নেই, আর থাকলেও তার সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছে না। এখন ‘মিলনে জীবন’-এর দৌলতে আমার চান্সই সবচেয়ে বেশি। টট্টর বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললো।

“কেন? তোর চান্স সবার আগে হতে যাবে কেন? ওরা তো খুঁজবে।”

“খুঁজবেটা কে? কারা খোঁজে? সব ব্যাপার আছে বুঝলি। নগেন জেঠু। হে হে হে।
 বলে টট্টর উঠে দাঁড়ায়। “শোন, কাউকে এসব ফ্যাচকাস না। আমি যাই, আমার বাপটাকে ধরতে হবে।”

টট্টর চলে গেলে আমি উঠে বসলাম। বুঝলাম, সৈকত কোনো ভাবে মিঠির বাবার ‘মিলনে জীবন’-এ যাওয়ার ব্যাপারটা পছন্দ করেনি। কিন্তু কেন? যাইহোক, আমি ব্যাপারটা থেকে ওকে বের করতে বললাম, 
সৈকত, আর ৩ দিন বাকি টুর্নামেন্ট শুরু হতে। ছেলেগুলো আমার খেলানোর ধরণটা ঠিক বুঝছে না। তবে আমার বিশ্বাস আস্তে আস্তে পারবে। টুর্নামেন্ট হবে প্রায় তিন সপ্তাহ জুড়ে। তাই গ্রুপ স্টেজের ম্যাচগুলো নিয়ে চিন্তা। বিকেলের সঙ্গে সঙ্গে পুরো সকালটাও প্র্যাকটিস করাই, কি বলিস?

“কেন শালা? সেদিন তো অনেক বড় বাতেলা মারলি, স্ট্রাইকার ছাড়া খেলবি, জিতবি, তিকিতাকা, আর তুমি এখন বলছো কাকা, সব লাগছে ফাঁকা।


“দেখ সৈকত, আমি এখনো বলছি ওরা জিতবে। ওদের খেলার ধরণটা বুঝতে হবে। মাঝমাঠ থেকে খেলাটা ছড়াতে হবে, দরকার হলে আরও পেছন থেকে। পাস, পাস আর প্রচুর পাস। ছোট ছোট পাসে এগিয়ে যেতে হবে। আর সুযোগ তৈরি করতে হবে। প্রত্যেক প্লেয়ার কে জানতে হবে অন্য প্লেয়ার কোথায় বল দিতে পারে, যদি বিপক্ষের প্লেয়ার স্পেস কম দেয়, তাহলে স্পেস তৈরি করতে হবে তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে যাতে বল রিসিভ করতে পারে। আর থাকবে একজন ফলস্ নাইন। আর এই খেলায় দক্ষতা অর্জন করতে গেলে শুধু চাই সকাল-বিকেল প্র্যাকটিস।
 আমি একনিঃশ্বাসে বলে গেলাম। 

“সে তুই বোঝাস, আমার শালা কিছু ভালো লাগছে না। তুই বল, মিঠির তো তেমন বয়স হয়নি, এখন ওর স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর কথা। তা না ওর ঐ বাপ বিয়ের তোড়জোড় শুরু করেছে, আর বিয়ে মানে মিলনে জীবন ? নাম শুনলেই মনে হয় শুধু বিয়ে না, বাচ্চা করার ব্যাপারটাও করিয়ে দেবে।আর তার ওপর এই টট্টর। উফফফ।
 সৈকত চুপ করলো।

আমি কিছু বলার আগেই আবার সৈকত বলে উঠল, 
চল, একদিন মুতে দিয়ে আসি অফিসের দরজায়।


।। ৪ ।।

বল যাচ্ছে একজনের পা থেকে আরেকজনের পায়ে। নিখুঁত পাস। কোনো ভুল হচ্ছে না কারোর। আমি সাইডলাইন থেকে চেঁচাই, 
ছোটু ওঠ বাঁ দিক থেকে।

রাহুল বলটা নিয়ে এগোচ্ছে। ওকে বিপক্ষের তিনজন ঘিরে ফেলছে প্রায়। ঠিক সেইসময় রাহুল নিপুণ দক্ষতায় ব্যাকহিল করে পাস করে দিলো সুজয়কে। সুজয় ডিফেন্ডার হলেও অনেকটা উঠে এসেছে। আমার ভয় নেই। ওরা জানে কি করতে হবে। সুজয় বাঁ দিকে কোণাকুণি পাস দিলো ত্রিদিবকে। ত্রিদিব থেকে ছোটু। ছোটু বলটা নিয়ে কিছুটা এগিয়ে পেনাল্টি বক্সের সামনে বলটা ডজ করে তুলে দিলো ওপরে। রাহুল ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে ততক্ষণে জায়গায় পৌঁছে গেছে। বলটা মাটিতে পড়ার আগেই রিসিভ করে ডানপায়ে জোরালো শট নিলো। বলটা গোলকিপারের ডান হাতের ওপর দিয়ে বেঁকে গেল। নেট কাঁপিয়ে বুঝিয়ে দিলো বলটা, আই অ্যাম হোম নাও!”
সমীরণ জেঠু কোত্থেকে ছুটে এসে হাতটা নিয়ে জোরে হ্যান্ডশেক করে বললো, ভালো শিখিয়েছ তো এদের। আমরা তো ভাবলাম বিজু, পটলারা নেই। তাই গোলই হবে না। তবে এরকম মাঝমাঠে এত পাসের পর পাস আমাদের দেখতে মোটেই ভালো লাগে না। বড্ডো বোরিং। তুমি ভাব আমরা বড় হয়েছি মাঠের মধ্যে সাম্বা ডান্স দেখতে দেখতে। সে কী দারুণ খেলা। স্কিল, ড্রিবলিং, চার পাঁচজনকে শুধু পায়ের ভাঁজে মাটিতে শুইয়ে দেওয়া। উফফফ। তার সঙ্গে এসব কী যেন... কী যেন... বলো তোমরা... তার তুলনা হয়?

“তিকিতাকা

“হ্যাঁ, তিকিতাকার তুলনা হয়? তবে ক্লাব প্রথম ম্যাচ জিতছে। তাই তুমি চালিয়ে যাও। তবে... তবে বুঝলে, যদি হেরে যাও তাহলে এদিকে আর মুখ দেখাতে এস না। তুমি আর সৈকত এত জোর করেছিলে বলেই টিমটা নামিয়েছি। বুঝলে?”


শেষদিকে কথা গুলো বলার সময় সমীরণ জেঠুকে শাকালের থেকে কম ক্রুর লাগছিলো না। আর সৈকত, আজও ও মাঠে আসেনি। গেম সেক্রেটারি, একটু যদি টিমের খেয়াল রাখে, শুধু প্রশ্ন করতে ছাড়ে না। এর থেকে টট্টরকে সেক্রেটারি করলে কাজে দেবে। অন্তত কোনো প্রশ্ন করবে না। আর আজ টট্টর অব্দি মাঠে এসেছে। খেলা দেখছে।

আমি ঘাড় নাড়লাম। উনি চলে গেলেন। বুঝলাম, এরা ট্রফিটা চায়। গত পাঁচ বছর জেতেনি। এবারে হঠাৎ আমার কাছে এত চাপ দিয়ে... মাথাটা গরম হয়ে গেল। আমি এদের অধঃস্তন কর্মচারী নই, এভাবে প্রচ্ছন্ন হুমকি দেওয়ার মানে কী?


বাঁশি বাজলো। খেলা শেষ। রাহুল দূর থেকে দৌড়ে দৌড়ে আমার দিকে আসছে। পেছনে আরও সবাই। সবাই এসে একে একে জড়িয়ে ধরলো। রাহুল বললো, 
কি দাদা, পারলাম তো? বলো, ম্যাচে একমাত্র গোলটা কিন্তু আমারই।

রাহুল খুব ভালো খেলেছে আজ। তবে বেশি প্রশ্রয় দিলে আত্মতুষ্টিতে ভুগবে। বললাম, 
দেখ, আজ ঠিক আছে। কাল কিন্তু তোর দিন নাও হতে পারে। তখনও যদি তুই ভালো খেলার চেষ্টা করে টিমমেটদের সুযোগ করে দিস, জানবি তখনই তুই ভালো ফুটবলটা খেললি।

রাহুল মাথা নিচু করে ঘাড় নাড়লো।

আমি হাসলাম। আমার এই খুড়তুতো ভাইটা বড্ড আবেগপ্রবণ। আমিও ছোটবেলায় এর
মই ছিলাম। আমি নিচু হয়ে বসে শান্তগলায় বললাম, দেখ যে গোল করে সেই একমাত্র হিরো নয়। তুই কাল গোল করতে না পেরে ভালো খেললেও হিরোই থাকবি। বুক ফুলিয়ে গর্ব করতে পারাটাই সব নয়। অন্যের গর্বের পেছনের কারণ হতে পারাটাও বিশাল বড় ব্যাপার। এখন মাথা নিচু করে না দাঁড়িয়ে থেকে সব গুছিয়ে বাড়ি চল। কাকিমা হয়তো আজ সুজির হালুয়া করে রেখেছে।

রাহুল বাচ্চাদের মতো হেসে উঠলো।

মাঠ ফাঁকা হচ্ছে। সন্ধ্যে নামছে। সত্যি সমীরণ জেঠুর হুমকি নয়, আমাকে রাহুল, ছোটু, সুজয়, ত্রিদিবদের জন্য জিততে হবে। জিততেই হবে।



।। ৫ ।।

সৈকতের কথা 

মিঠি থাকে এ পাড়ার সবচেয়ে বড় বাড়িতে। লম্বায়-চওড়ায় কোনো প্যালেসের কম নয়। হালকা সবুজ রঙের বাড়িটা সবসময়ই ঝকঝকে আর গমগমে। ওরা জয়েন্ট ফ্যামিলি। বাবা-কাকা, জেঠু-জেঠিমা, দাদু-দিদিমা তাদেরও দাদার পরিবার নিয়ে প্রায় ৩০-৪০ জন থাকে। ঠাকুরের কোনো অসীম কৃপায় ওদের পরিবারের কেউ মারা যায় না। না, মানে আমি ওরকম ভাবি না। তবে ওদের পরিবারের লোকজনদের জীবনীশক্তি বেশ বেশি। সঞ্জীবনী রসের পান চলে হয়তো নিয়মিত।


তবে সে যাই হোক, আমি এ বাড়ির আশেপাশে দিয়ে যাই। বাজার যাওয়ার রাস্তা তেমাথার মোড়ে, ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে হলে অনেকটা ঘুরে যেতে হয়। তবুও এটাই তো আমার যাওয়ার শর্টকাট। এখানে এলেই রাস্তার আশেপাশের গাছপালা যেন আমাকে ছাওয়া দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়, কৃষ্ণ ও রাধা(চূড়া) মিলিত হয়ে ফুল রূপে ঝরতে থাকে আমার উপর, আকাশটা যেন আরো নীল হয়ে যায়, আমায় গোল করে ঠান্ডা হাওয়া ঘুরতে থাকে। আমি যাই এ রাস্তা দিয়ে আর আমার চোখ থাকে একটা ঝুলন্ত বারান্দার দিকে, ভাবি এই বুঝি কালো মেঘরাশি এলিয়ে পড়বে রেলিং দিয়ে, একটা ছোট্ট নদীখাত জেগে উঠবে ডান গালে, অনেকগুলো সাদা মুক্তো ঝরে পড়বে, সমুদ্রের জল টলমল করে উঠবে চোখের দৃষ্টিতে। সমুদ্রের জল টলমল করুক না করুক আমি একটু কেঁপে যাই এরকম বঙ্গশ্রী লটারি জেতার মতো দিনগুলো এলে। 


তবে কাঁহাতক একতরফা দেখা, ঘুরঘুর করা মানতে পারি, মানে আমি মানতে পারি কিন্তু এ মন মানে না। তাই কোয়েল মল্লিক দেবকে হাসির সূত্র পাঠায় আর মিঠি আমায়
 মিঠি আমায় দেখে হাসে, ঠিক কোনটা দেখে হাসতো জানি না, আমার কেঁপে যাওয়া কী টের পেত, কে জানে তবে একদিন হঠাৎই রোজকার মতো প্যালেসের পাশ দিয়ে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছিলাম আর দেখতে না পেয়ে মুখটা নিচু করে ওদের বাড়ির দরজার পাশ দিয়ে যেতে দেখি, ও গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। একটা ছোট্ট খাম টুক করে ফেলে দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে ভেতরে চলে গেল। ঐ খাম তুলতে তুলতে মনে হচ্ছিল চারদিক পিসার হেলানো মিনার, আমার বুকে তখন শুধু কার্বন ডাই-অক্সাইডই ছিল, না হলে ওরকম শ্বাসকষ্ট হতে যাবে কেন? 

আমি টুক করে খামটা নিয়ে ভীষণ স্পিডে সাইকেল চালিয়ে এয়ারপোর্টে চলে গেছিলাম। খামটা খুলে একটা ছোট্ট চিরকুট বেরিয়ে এসেছিল। লেখা — 
আজ ৬:৩০, কে. এফ. আর মাঠ।


***

শুরুর সেই দিনের পর আজ দেড় বছর কেটে গেছে। আমাদের দেখা ফুচকার ওপর উঠে, পাশে বসে গাজরের হালুয়া খাইয়ে দেওয়ার ছোট্ট ভালোবাসায় প্রবেশ করেছিল। ও আমাকে ভালোবাসে। ওর নরম নরম হাত আমার হাত ছুঁয়ে জানান দিত, পৃথিবীর সব খারাপের মিঠিও থাকে, আমার আলো, সব ভালোর যেখানে শুরু সেই নিরাপদ আশ্রয় হয়ে। 
তবে আজ আমাদের এই ছোট্ট লুকিয়ে থাকা নীড়টি ভেঙ্গে যাওয়ার মুখে। ওর বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে, টট্টর এসে প্রতিদিন ঘোষণা করে কালই পাকা কথা হয়ে যাবে। আর আমি ক্রমশ চুপসে যেতে থাকি। তার কারণ আমি জীবনে খুব বড় একটা কিছু করতে পারিনি। আমি এখানে একা থাকি। বাবা - মা ছেড়ে চলে গেছে আজ প্রায় চার বছর। আমার আত্মীয় বলতে শুধু আমার এক মামার পরিবার। কানপুরে থাকে। আমি কোনো বড় চাকরি করি না। যদি এক বেঁচে থাকা এক কারণ হয়ে থাকে তো দ্বিতীয় আমার আত্মবিশ্বাসের অভাব। নিজে গত এক বছরে এখানে অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু হয়নি। দু-তিনটে টিউশনি বেড়েছে, আর কিছুই না। যখন বুঝলাম মিঠি এত ভালোবাসে, খুব ভয় হতো সত্যি যদি কিছু করে উঠতে না পারি। কিন্তু মিঠি বিশ্বাস হারায় না। বলে, তুমি পারবেই, ঠিক পারবে। হয়তো আমায় বিশ্বাস দেওয়ার জন্যই বলে।
ঠিক এখন আবারো মিঠির বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছি। গত দুসপ্তাহ ওকে দেখি না, দেখতে পাইনি ঐ বারান্দায়। দেখা করার কথাও বলেনি, আমিও ফোন করতে পারি না ওকে, সব বাজেয়াপ্ত হয়েছে। কোনোভাবে ওর বাড়ির লোক টের পেয়েছে ওর জীবনে অন্য মানুষের গন্ধ, তাই এই বিয়ের তোড়জোড়। 


ভয়, খুব ভয় হচ্ছে আমার। একসময় আকাশ যখন আমার কাছে এসে ওর এই একই ভয়ের কথা বলতো, তখন আমি যন্ত্রের মতো বলে যেতাম, “
কিছু হবে না, ঠিক হয়ে যাবে সব। কিন্তু ঠিক হয়নি কিছু। আকাশ ফুটবল ছাড়া তেমন কিছু জানতো না। ও ফুটবলেই কিছু একটা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতো। কিন্তু সেই সময় বা সাপোর্ট কারোর থেকে পায় নি। এমনকি দিশারীর থেকেও নয়। দিশারীর বাড়ি থেকে বিয়ের কথা উঠতেই দিশারীও আর আকাশের পাশে দাঁড়ায়নি। রেগে বলে গেছিলো, তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না, তুমি একটা ব্যর্থ মানুষ। আমার জীবনটা নষ্ট হল তোমার জন্য।” আর আকাশের দিকে ফিরেও তাকায়নি।

আমারও কী ওরকমই হবে। না হতে পারে না। মিঠির সঙ্গে আমায় একবার যোগাযোগ করতেই হবে।

আমি মোড়টা ঘুরতে যাবো, এমন সময়ে টট্টর আর ওর বাড়ির লোক ওদের গাড়ি থেকে নেমে মিঠির বাড়ির দিকে যাচ্ছে। আমি দরদর করে ঘামতে লাগলাম। না আজ বলতেই হবে। এতদিন ধরে এই সম্পর্কটাকে প্রথম প্রকাশ্যে এনে ফেলার দরকার হয়েছে। আমি মাঠের দিকে গেলাম।



।। ৬ ।।

সৈকতের আগে আমি যেমন ছিলাম, সৈকতের পরেও তেমনই থাকবো।

বুঝলি টট্টর, এবার ক্লাব হয়তো নতুন কাউকে গেম সেক্রেটারি হিসাবে দেখতে চায়। সৈকত যা ঝোলাচ্ছে। ওর নিজের টিমের উপর ওর কোনো বিশ্বাস নেই। সবকিছু আমার উপর ছাড়তেও চায় আবার বাগড়াও দেবে।”


টট্টর একটু হেসে বললো, 
সে তুই যা বলেছিস। আজ সেমি ফাইনাল ম্যাচটাও জিতিয়ে দিলি। অনেক করছিস।

কিছু ভালো যদি করেও থাকি তার কোনো কৃতিত্বও আমার জুটবে না। সৈকত যেহেতু গেম সেক্রেটারি সব প্রশংসা ওই পাবে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

এটা খুব বাজে। নতুন কাউকে বানানো যায় গেম সেক্রেটারি এখনই, সৈকতের এসব কথা ক্লাবের সবাইকে বলে।”

হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। ফাইনালটা উতরে দিতে পারলে আমিই নতুন গেম সেক্রেটারির কথা বলবো। আর সেটা হবি তুই।”


হেঃ হেঃ কী যে বলিস! আমি আর ফুটবলটা কী বুঝি।
 টট্টর দাঁত বের করে হাসতে লাগলো।

না, না তোকে হতেই হবে। ঐ সৈকতের হাতে আর কিছু রাখা যাবে না। তুই জানিস, মালটা মিঠির প্রেমে হাবুডুবু খায়।”

টট্টর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা শুনলেও এতটা চমকাতো না, 
কী বললি ? শালা বামন হয়ে জন্মেছে, আর পেটে পেটে এত!”

হ্যাঁ, তাছাড়া আর কী! ঐ জন্যেই তো মালটা খেলাতেও মন দিতে পারে না। মিঠির বিয়ে হওয়ার কথা চলছে, সব কনসেনট্রেশন হারিয়ে বসেছে।”

টট্টর তিন চারটে অপাঠযোগ্য গালাগালি দিয়ে বললো, 
শালাকে বহুত ক্যালাবো। তবে আমি নগেনজেঠুর সঙ্গে সব ঠিক করে মিঠির বাড়ি গিয়ে পাকা কথা বলে এলাম। ও আর কি করবে?

“মানে? ‘মিলনে জীবন’-এর কি হলো? চারজন ছেলে, তারপর যোগ্যতা বিচার, তারপর তো!”

“আরে ধুস, নগেনজেঠুকে সব বলা আছে। বাকি এমন তিনজনের নাম জোগাড় করেছে, যাদের অস্তিত্বই নেই। আর এর জন্য বুড়োটা তিনলাখ টাকা হাতিয়েছে আমাদের থেকে। তবে ওটা কোনো ব্যাপার না। আমি মিঠিকে চেয়েছি। আর কব্জা করেই ছাড়বো। আর হ্যাঁ, তুই এসব কাউকে বলিস না।”


“না না সে কেন? তুই ভেবেছিস যখন, ঠিকই ভেবেছিস। আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে তাহলে তোকে একটা জিনিস জানানোর দরকার, সৈকত মিঠিকে নিয়ে পালানোর প্ল্যান করছে।”


টট্টর বাইক থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার ছেড়ে বললো, “আজই মালটার শেষ দিন তাহলে।” ও বাইকটা স্টার্ট করতে গেল।


আমি কোনোরকমে ওকে আটকে বললাম, “ওসব ঝামেলার মধ্যে যাস না। আমার মনে হয় সৈকত জানে ‘মিলনে জীবন’-এর কেসটা। ক্লাবের আরেক জ্যেষ্ঠ সমীরণ জেঠু তো ওকে খুব স্নেহ করেন। বুঝতেই পারছিস, একবার যদি সবাই জানতে পারে কি কেলেঙ্কারি হবে। তার চেয়ে বরং তুই কাল মিঠিকে নিয়ে কোথাও বেরোস। রাহুল বলছিল, কালই সৈকত ওকে নিয়ে পালানোর কথা ভাবছে। ওকে বাড়িতে রাখলে ঠিক কোনোভাবে সৈকত ওকে তুলে নিয়ে যাবে। কিন্তু মিঠি তোর সঙ্গে থাকলে ও সেই সাহস পাবে না। কি বলিস?”


টট্টর গদগদ হয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে বললো, “তুই আমার রিয়েল ফ্রেন্ড। কত কী ভেবে রেখেছিস।”


আমি একটু হেসে বললাম, “সৈকতের একটা শিক্ষা পাওয়া দরকার। এককালে আমায় অনেক বাঁশ দিয়েছে আর এখনো সেক্রেটারি থেকে... তবে তুই শুধু কাল ফাইনাল শেষ হবার আগে মাঠে আসিস। কালই তোকে সংবর্ধনা দিয়ে গেম সেক্রেটারি করার ব্যাপারটা করে দেব। আর আমায় যাবতীয় দায়িত্ব দিয়ে দিস। এতে আমি অফিসিয়ালি ক্লাবের ফুটববলের কোচ হতে পারবো। দু পয়সা কামাতেও পারবো।”


টট্টর সব দাঁত বের করে হেসে বললো, “আমি গেম সেক্রেটারি। হা হা। এবার সবাই আমায় গুরুত্ব দিতে বাধ্য হবে। আর হ্যাঁ, তুই যা চাস হয়ে যাবে। তোর ইচ্ছেগুলো কী ছোট ছোট। যাইহোক, শুধু ফুটবল না তোকে স্পোর্টসের যাবতীয় ব্যাপারে দায়িত্ব দিয়ে দেব। যতটা কামানোর কামিয়ে নিস।”


“আর তোকে আমি যে ব্যাপারটা নিয়ে সাবধান করলাম, মনে রাখিস।


“হ্যাঁ রে, আমি কালই মিঠির বাড়িতে গিয়ে বলে আসবো, কাল C.C.D.-এর সামনে দাঁড়াতে বিকেল পাঁচটায়।

টট্টর বাইক স্টার্ট করলো, আর কানফাটানো শব্দে ও কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ ভরে গেল।


।। ৭ ।।

“গো-ও-ল, আবারো গোল। পল্লীপ্রীতি ক্লাব ৩-০ -এ এগিয়ে গেল। একমাস আগে স্ট্রাইকারের অভাবে যে টিম মাঠে নামতে চাইছিল না, আজ আকাশদার কোচিংয়ে তারা কাপটাই জিততে চলেছে। হ্যাটস অফ টু আকাশ মুখার্জী। তোমার জন্যই আজ আমরা জিততে চলেছি


মাইকে সমিধের কথাগুলো শুনে আমার চোখটা কখন ভিজে গেছে বুঝতেও পারিনি। সত্যিই আমার দেখানো পথে ছেলেগুলো আজ জিতে গেল। বিশ্বাস হচ্ছে না ঠিক। পাশে সমীরণ জেঠু শক্ত করে আমার হাতটা ধরে রেখেছে। উনি বাচ্চাদের মতো লাফাচ্ছেন, খিলখিল করে হাসছেন। বেঞ্চে বসা ছেলেগুলো উদ্দীপনায় কাঁপছে, গ্যালারি জুড়ে অনবরত চিৎকার চলছে। আজ এতজনের খুশির পেছনে কিছুটা যে আমারও অবদান, ভাবতে পেরে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। হ্যাঁ এই মুহূর্ত আমারই। এখানে উপস্থিত সবার সব ভালোবাসাটুকু গ্রহণ করার সময় এখন।


মোবাইলটা আবারও বেজে উঠছে। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। ৫:৫০। পাশে বসা সমীরণ জেঠুকে বললাম, “আমি একটু আসছি।”


“কোথায় যাচ্ছ? তোমার এখন গেলে চলে? এখন কত সম্বর্ধনা বাকি।”


“জেঠু আমি ১০ মিনিটেই আসছি। ভীষণ দরকার।”


সমীরণ জেঠু কী বুঝলেন জানি না। হেসে বললেন, “যাও, তবে তাড়াতাড়ি ফিরো। খেলা শেষ হতে আর ১০ মিনিট বাকি। আশা করি কিছু অঘটন ঘটবে না। প্লেয়ার চেঞ্জ করানোর আছে?”


আমি হেসে বললাম, “আমি টট্টরকে সব বলে দিয়েছি। ও ঠিক করে নেবে। আর একজনকে চেঞ্জ করানোর কথা।”


এই মাঠের বাইরে দাঁড় করানো সাইকেলটার দিকে যেতে যেতে দেখলাম, বেঞ্চের কাছে বিটন, গোরাদের সঙ্গে গল্পে মশগুল আমাদের নতুন গেম সেক্রেটারি শ্রীমান টট্টরকুমার চক্রবর্তী।


সাইকেলে উঠে জোরে প্যাডেল চালালাম। মাঠের চত্বর থেকে একটু দূরে যেতে হবে।


***

সেদিন যখন মাঠে বসে রাহুল, ছোটুদের সেমিফাইনাল ম্যাচের আগে প্র্যাক্টিস করাচ্ছিলাম, তখন সৈকতকে মাঠে ঢুকতে দেখে ঠিক ভালো লাগেনি। একে তো ও কোনো খোঁজ রাখে না টিমের, আবার নানারকম ভাবে উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে আজকাল খোঁটা দিয়ে, আমার কোচিং সম্বন্ধে। অথচ ওই আমায় প্রথম আমাদের ক্লাবের ফুটবল টিমটার দায়িত্ব নিতে বলেছিল তিনমাস আগে।
ও যখন কাছে এগিয়ে আসে, ওর মুখ চোখ দেখে ওকে উদভ্রান্ত লাগছিল। ওকে জিজ্ঞেস করি, কি ব্যাপার।


ও বলে ওঠে, “আমি আর কারোর খেয়াল রাখি না, তাই না? আজ টিমটাকে তুই সেমিফাইনালে তুললি আর আমি একদিনও মাঠে আসিনি। আর এই আমি
-তুইই সারাক্ষণ মাঠে পড়ে থাকতাম।

আমি বুঝতে পারি এসবই ওর ভেতরের কোনো দুঃখ থেকে উঠে আসা ভাব বলাচ্ছে। আমি আবার জিজ্ঞেস করি, “কি হয়েছে তোর? সত্যি করে বলতো।”

ও হঠাৎই আমার হাত ধরে বলে, “আমি তোর মতো হতে পারবো না। আমি এত কষ্ট নিতে পারবো না। আমার সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। মিঠিকে আমি ভালোবাসি।”


অসংলগ্ন কথাগুলো শুনে কিছুটা বুঝে যাই। তারপর ও ঐভাবেই সবটা বলে ওঠে। ওর অনুভূতি, মিঠির চিঠি দেওয়া, দেখা করা আর তারপরের সবটা। পুরোটা শুনে আমার মনের মধ্যে আবারও এক পুরোনো রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। দুবছর আগে আমার সাথেও প্রায় একই জিনিস ঘটেছিল। আর আমার না পারাটাকে হাতিয়ার করে সে বলেছিল, তোমার দ্বারা জীবনে কিচ্ছু হবে না। তুমি আটকে গেছো।

কিন্তু যখন শুনলাম মিঠি সৈকতকে এত সাপোর্ট করে, সৈকতের না পারাটাকে মিঠি নিজের বিশ্বাস দিয়ে হারিয়ে দেয়, তখন মনে হলো সত্যি মিঠি-সৈকতের ভালো হওয়াটাকে আটকাতে নেই। তাই আমি সমস্ত কিছুটা কষে নিলাম মাথার ভেতর। তারপর কাল সৈকত এসে জানালো, ওর মামা কানপুরে ওর চাকরির একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছে, তাই অনায়াসে আমার কাজটাও আরও সহজ হয়ে গেল।
আমি জানতাম মিঠির বাড়িতে ঢুকে মিঠিকে বের করে আনা অনেক কষ্টসাধ্য, আর এতে প্রচুর ঝামেলা হতে পারে। তাই আমি টট্টরকে ধরলাম। দরকার ছিল, টট্টরকে বিশ্বাস করানো যে আমি ওর ভালোর কথাই ভাবছি। আর কিছুটা প্রশংসা ওকে সেই বিশ্বাস দিয়েছিল। 

সৈকতকে সরিয়ে টট্টরকে গেম সেক্রেটারি, সৈকতের ভয় দেখিয়ে টট্টরকে দিয়ে মিঠিকে বাড়ির বাইরে বের করানো, দুটোই ছিল গোলস্কোরিং পাস। টট্টর টোপ গিললো, আর মিঠির বাড়িতে বেরোনোর ব্যাপার বলে এলো। শুধু বাকি ছিল, মিঠিকে এই ভরসা দেওয়া যে টট্টর বেরোনোর কথা বললেও সৈকতও থাকবে আশেপাশে। সেই খবরটা আমি টট্টরকে বলার পর মিঠির কাছে পৌঁছে দিয়েছিল মিঠির ভাই ছোটু যে আমার টিমের নির্ভরযোগ্য সেন্ট্রাল এটাকিং মিডফিল্ডার।

অতঃপর আজ টট্টর মাঠে এলো বিকেল ৪টের সময় আর আমি আর টিমের সবাই ওকে এসিস্ট্যান্ট কোচের মতো ট্রিট করলো। সমীরণ জেঠু ওকে গেম সেক্রেটারিরূপে বরণ করলো ফুলের মালা পরিয়ে। টট্টর এতেই গদগদ হয়ে উঠলো। শুধু একটাই সন্দেহ ছিল, এই এত আয়োজনে টট্টর কী মিঠির বেরোনোর কথাটা ভুলে যাবে?
কিন্তু হ্যাঁ, তাই হল। মাখনের পর মাখন খেয়ে টট্টর মিঠিকে ভুলল আর সৈকত মিঠিকে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে স্টেশনের দিকে গেল।


দুবছর আগে আমার জীবনে ঘটা ঘটনা সত্যিই কোথাও আমাকে আটকে দিয়েছিল। তারপর তিনমাস আগে সৈকত জোর করে মাঠে নিয়ে এলো, ফুটবল টিমের দায়িত্ব দিতে চেয়ে। শুরু হলো আমার লড়াই।


নিজের জীবন থেকে একটা জিনিস বুঝে গেছিলাম, ভালোবাসাকে নষ্ট হতে দিতে নেই, করতে নেই। দুজন পছন্দের মানুষকে একসাথে থাকতে দিতে হয়। এটা যেমন ঐ দুজনেরও বোঝা উচিৎ, বোঝা উচিৎ বাকি সবারও। কারণ জীবনটা তাদের। আজ সেই মেয়েটা কোথায় আছে জানি না। আমার কোচিংয়ে টিম জিতে যাওয়া, আমার চেষ্টায় সৈকত-মিঠির এক হওয়া, আজ সকালে আমার কাকার খবর দেওয়া যে ইস্টবেঙ্গলের জুনিয়র টিমের কোচের জন্য লোক খুঁজছে, তার জীবনে হয়তো কোনো বদল আনবে না
 কিন্তু এই ঘটনাগুলো আমায় নিজের কাছে নিজেকে জিতিয়ে দিয়েছে। সে বিশ্বাস করে এতদিন থাকলে হয়তো আমরা দুজনে জিততাম সৈকত-মিঠির মতোই।

সৈকত আবার ফোন করেছে। আমি জানি, এতক্ষণে ওদের কানপুর যাওয়ার ট্রেন হাওড়া স্টেশন ছেড়ে দিয়েছে, আমি জানি আজ সন্ধ্যের পর থেকে পাড়া সরগরম উঠবে মিঠি-সৈকতের অন্তর্ধানে, ঝাঁপি খুলে যাবে ‘মিলনে জীবন’-এরও আমি জানি, টট্টর বুঝতে পারবে সৈকত ছিল ফলস্ নাইন, টট্টর নিজেকে টিমের মেইন স্ট্রাইকার ভাবলেও আমার পাস থেকে ডিপ মিডফিল্ড থেকে অনেক বাধা কাটিয়ে গোল করে গেছে সৈকত, আর এখন সব কিছুর পরে আমি এও জানি যে ভালো হওয়ার, করার আশা ছাড়তে নেই।
আকাশে বা আমাদের জীবনে যত বড়ই প্রশ্ন থাকুক না কেন, আমাদের উত্তর খুঁজে যেতে হয়, উত্তর পেতে হয়।

অনেকক্ষণ থেকে বেজে চলা ফোনটা কানে তুলে বললাম, “হ্যালো, কতদূর গেলি?”

ছবির সৌজন্যে - ইউরি শচিপাকিন (শাটারস্টক)