বর্ষা ২০১৮


প্রচ্ছদশিল্পী - কর্ণিকা বিশ্বাস


(প্রতিটি লেখা Hyperlink করা আছে। লেখার ওপর ক্লিক করে পড়ুন।)



গল্প

মণিময় দারোগা সুস্মিতা কুণ্ডু
মোবাইল মোঃ ফুয়াদ আল ফিদাহ
মোহর বৃত্তান্ত অনন্যা দাশ
অলৌকিক সেই খেলা সায়ন্তনী পলমল ঘোষ
বুম্বা অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
ওরা কাজ করে প্রতিম দাস
রাজ-হাঁচি বিভাবসু দে
নিশিপুরাণ সায়নদীপা পলমল
ঘোষেদের চর্চা অনিন্দ্য রাউত
বাড়িটা ধূপছায়া মজুমদার
রাস্তা উইলিয়াম হোপ হজসন/ঋজু গাঙ্গুলী
এক রাতের গল্প সহেলী চট্টোপাধ্যায়
হঠাৎ বর্ষা আর আবছা বিপিন রবীন বসু
অকুস্থল এড়ানো যায় না পারিজাত ব্যানার্জী
মাতৃ স্নেহ মধুমিতা সেনগুপ্ত
একটি আঠালো কাহিনী প্রমিত নন্দী

অনুবাদ কমিকস


সমালোচনা


কবিতা



সম্পাদকের কথা

প্রিয় পাঠকবন্ধুরা,

দীর্ঘ তিন মাস বিরতির পর আবার আগমন ঘটল পরবাসিয়াদের। বিশেষ নববর্ষ সংখ্যার পর পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে পত্রিকার উর্ধ্বমুখী গ্রাফ বজায় রাখতে আমরা মাসিক থেকে ত্রৈমাসিক প্রকাশ করব বলেছিলাম। এখন সে কাজে আমরা সফল না ব্যর্থ তা আপনারাই বিচার করবেন।

কলকাতা তথা ভারতের অনেক জায়গায় এখন বর্ষাকাল, যদিও গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কৃপায় হাঁসফাঁস করা গরম থেকে মুক্তি মেলেনি। এর মধ্যে গা ছমছমে ভূতের গল্প পড়তে তো দারুণ লাগে। আর তার মাঝে মাঝে কিছু মজার গল্প থাকে? কিংবা এমন কিছু যাতে রয়েছে দুইয়ের একটা জমজমাট মিশেল? এই সব কিছু নিয়েই এবারের বিশেষ অলৌকিক ও হাস্যকৌতুক সংখ্যা। ছোট বড় মিলিয়ে ১৬টা গল্প থাকছে এই সংখ্যায়। নিয়মিত বিভাগে আছে কিছু কবিতা। এছাড়া এই সংখ্যার বিশেষ আকর্ষণ জুনজি ইতোর বিখ্যাত মাঙ্গা ‘The Enigma of Amigara Fault’-র অনুবাদ যা পড়া ও অনুবাদ করতে গিয়ে এই সম্পাদক মশায়ের গায়ের লোম খাড়া, ঘাম ছুটে যাওয়া মানে প্রচন্ড ভয় পেলে মানুষের যা যা হয় সবই হয়েছিল। এই সংখ্যাকে সর্বাঙ্গসুন্দর করেছেন শিল্পী সুমিত রায়, অরিজিৎ ঘোষ আর সুমন মান্না। এছাড়া অনেকদিন পর প্রচ্ছদ এঁকেছেন আমাদের সবার প্রিয় কর্ণিকাদি।

তাহলে আর দেরি কেন, পড়তে শুরু করে দিন। কেমন লাগল অবশ্যই জানাবেন।

ধন্যবাদান্তে,

সমালোচনা : পেনি ড্রেডফুল

জয়িতা সাহা

আপনি কি অপয়া? বা অলক্ষুনে? কোনোদিন এরকম কি হয়েছে আপনার সাথে, যাতে হাত দিচ্ছেন তাই পন্ড? যদি কারুর সাথে এমনটা ঘটে তবে কি বলা হবে তার উপর অশুভের ছায়া পড়েছে? আমাদের এই জটিল জীবনে শুভ অশুভের মধ‍্যে প্রভেদই বা কতখানি। নিজের সর্বস্ব দিয়ে যদি শূন‍্য জোটে কারও ভাগ‍্যে, সে ভাগ‍্য কি পরমপিতা লিখেছেন না শয়তান!

লুসিফার যখন ঈশ্বরকেই স্বর্গের আসনচ‍্যুত করার স্পর্ধা করে তার কপালে জোটে পাতালে নির্বাসন। ধরা যাক লুসিফার একা ছিলো না, সহোদর ড্রাকুলাও নির্বাসিত হলো মর্ত‍্যে। তবে অসহায় জীবদের শাসন করে , তাদের পদতলে পিষ্ট করে আর কতদিন! ড্রাকুলা আর লুসিফার চায় সৃষ্টির উপর একাধিপত‍্য। যা কেবলমাত্র মাদার অফ্ ইভিলের সান্নিধ‍্যেই সম্ভব। ভাবছেন মাদার অফ্ ইভিল আবার কে? মার্ভেল কমিকসের মিস্ট্রেস ডেথ নাকি! ব‍্যাপারটা, একটু খোলসা করেই তাহলে বলি।

 উনিশ শতকের ভিক্টোরিয়ান লন্ডন। অভিজাতদের ছাপিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষেরাই শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তার সাথে বাড়ছে দৈনন্দিন অপরাধ। এই সময় মানুষের সাহিত্য আর বিনোদনেও এসে পড়লো এক পরিবর্তন। খবর কাগজ বা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বেরোতে লাগলো অলৌকিক অপরাধ মূলক চটুল সব গল্প। জ‍্যাক দ‍্য রিপার খুব সম্ভব এই সময়ই লন্ডন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমাদের খুব পরিচিত এই সময়কার অলৌকিক কাহিনী সুইনি টড : দ‍্য ডেমন বারবার অফ্ ফ্লীট স্ট্রিট। এই সব গল্পের দাম তখন হতো মাত্র এক পেনি। চার্লস ডিকেন্স বা ওই শ্রেণীর সাহিত‍্যিকদের লেখা এক শিলি়ং দিয়ে না কিনে লন্ডনের জন সাধারণ ওই রহস্য খুন ভূতুড়ে আখ‍্যানে মন দিলেন। এক পেনির বিনিময়ে হাড় হিম করা ভয় : পেনি ড্রেডফুল। 

এই ভিক্টোরিয়ান লন্ডনেই আছে এক পরীর মতো মেয়ে ভেনেসা। তবে সে একা নয়। সংগী তার স্টোকা্রস এর জনপ্রিয় চরিত্র দুর্ধর্ষ ড্রাকুলা আর মেরী শেলীর কালজয়ী সৃষ্টি ফ্র্যাংকেনস্টাইন ও তার মনস্টার। অস্কার ওয়াইল্ড এর ডোরিয়ান গ্রে আর রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ডক্টর জেকিল। পাগলের প্রলাপ মনে হচ্ছে? আজ্ঞে না। শো টাইম এর বিখ্যাত সিরিজ পেনি ড্রেডফুলের কয়েকজন চরিত্রের সাথে আপনার পরিচয় করালাম মাত্র। জন লোগানের এই সিরিজে ভয়, প্রেম, ঈর্ষা, প্রতিশোধ সব কিছু মিলে মিশে আছে অলৌকিক কাহিনীর মোড়কে। মিশরীয় মাইথোলজির আমুন রা আর আমাদের পরিচিত শয়তান লুসিফার এর উল্লেখ যেমন আমরা পাই, তার সাথে আছে সমাজে মেয়েদের অবস্থান, অভিজাতদের লালসা ইত‍্যাদি সমসাময়িক বিষয়ের উল্লেখ ও। পেনি ড্রেডফুল এর বিশেষ বৈশিষ্ট‍্য অতি প্রাকৃত ঘটনার প্রেক্ষাপটে কাহিনী হওয়া সত‍্যেও প্রায় কখনোই বিভৎস দৃশ‍্য বা জাম্প স্কেয়ারের মাধ‍্যমে দর্শককে উত্যক্ত না করে সিচুয়েশনাল হরর বা ঘটনার পরতে পরতে ভয় মেশানো। অপূর্ব আর্ট ওয়ার্ক আর সিনেমাটোগ্রাফি, অনবদ‍্য ডায়লগের বুনন এই সিরিজের সম্পদ। এত কিছুর পরেও প্রথম সিজ্নে গল্পের দানা বাধতে দেরী হওয়া, গোটা সিরিজ জুড়েই কাহিনীর বিক্ষিপ্ত বিন‍্যাস, থার্ড সিজ্নে ‘ব্লেড অফ্ গ্রাস্’ এপিসোডে ওই উচ্চতায় পৌছেও অযাচিত ভাবে শেষ করে দেওয়া মেনে নেওয়া যায় না। তবে অলৌকিক সংখ্যাতে টিভি সিরিজ এর কথা বলতে এইটেকেই বেছে নিলাম কেন?

সাহিত্যের বিখ‍্যাত সব নাম আর উনিশ শতকের লন্ডনের আবেদন উপেক্ষা করতে না পেরে নাকি ভেনেসা আইভস্ এর চিরকালীন প্রেমে পড়ে গিয়ে! ওই যে শুরুতে অপয়ার প্রসঙ্গ এনেছিলাম, ভেনেসাকে জানতে হলে এক অভাগার যন্ত্রনা অনুভব করতে হবে। ভেনেসা এই সিরিজের মধ্যমণি। এক এমন চরিত্র যেকোনো সময়ের যেকোনো মেয়ের সাথে কোনো না কোনোভাবে ঠিক একাত্ম হয়ে গিয়েও সে একলা। ইথানের সাথে প্রেম, ডোরিয়ানের  সাথে লাস‍্য, ভিক্টরের প্রতি বাৎসল‍্য, জনের সাথে সখ‍্যতা, লুসিফারের প্রতি ক্রোধ অথবা ড্রাকুলার কাছে সমর্পন এই সবেতেই আমরা অন‍্য অন‍্য ভেনেসাকে পেয়েছি যে নিজেকে খুজে চলেছে অনবরত। শুভ অশুভের লড়াইয়ে বলি হতে হতে ঈশ্বরের উপর থেকে তার বিশ্বাস চলে গেছে, জীবন তাকে এক পৈশাচিক জয়যাত্রার কান্ডারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে, নিজেকেই সে ভাবছে ‘টাচড বাই দ‍্য ডেভিল.’ ঠিক যেমন সেই সৃষ্টির শুরু থেকে মেয়েদের কেই আমরা ডাইনি, সতী, বেশ‍্যা, ধর্ষিতা আরো কত রূপে দেখেছি! ভেনেসা তবু লড়ছে, গুরু তার জোয়ান অফ্ আর্ক! নাকি একজন মনোবিদ! লড়াইটা কোথায়? সেই ভিক্টোরীয় লন্ডনে না ভেনেসার মনে! গোটা সমাজ টাই যেখানে নরক সেইখানে যুঝতে যুঝতে শয়তানের স্নেহধন‍্যা ভেনেসা সেই নরকের সম্রাজ্ঞী হয়ে ওঠে! কিন্তু মুক্তি, প্রেম, শান্তি এই সব কি আর মেলে? ভেনেসা আইভস্ এর চরিত্রে ইভা গ্রীন অসামান্য। ভূতে পেয়ে হাড় হিম করা প্রলাপ বকার দৃশ‍্যেও নিজের অরা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। শুধু উনার অলৌকিক সৌন্দর্য এবং অপার্থিব অভিনয়ের জন্যেই ২৭টা এপিসোড দেখে ফেলা যায়। আরেকটি নারী চরিত্র লিলি ফ্র্যাংকেনস্টাইন এর ও উল্লেখ করি। লিলির চরিত্র আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করিয়েছে যে নারী যদি ক্ষমতায় আসে সেও অত‍্যাচারী হবেই। কারণ সে আজন্ম কাল থেকে দেখে এসেছে যার হাতে শক্তি তার অস্ত্র স্বৈরাচার! তাই নারীও যেদিন ক্ষমতা পাবে সে নিজের স্বাভাবিক কোমলতা, সহনশীলতা বর্জন করবে।  আরেকজনের অভিনয়ের কথা না বললেই নয়, ফ্র্যাংকেনস্টাইন এর মনস্টার বা ক্রিয়েচারের চরিত্রে ররি কিনিয়ার মুগ্ধ করেছেন। পেনি ড্রেডফুল সিরিজে ভয় আর দু্ঃখের এক চমৎকার সহাবস্হান। এই দুঃখের এক কান্ডারী যদি ভেনেসা হয় অপরজন নিঃসন্দেহে ক্রিয়েচার বা জন ক্লেয়ার। ‘ব্লেড অফ্ গ্রাস’ এপিসোডের একটি দৃশ‍্যে রুগ্ন, প্রহৃত ভেনেসাকে জন সামান‍্য প্রসাধনে সাজিয়ে দেয়! এত যন্ত্রণার অথচ পরিপূর্ণ দৃশ‍্য আমি সারাজীবন মনে রেখে দেবো। ভেনেসার সাথে জনের সব সংলাপের  দৃশ‍্যগুচ্ছই কবিতাকে হার মানায়। পোয়েট্রি অবশ‍্য পেনি ড্রেডফুলের এক বড় সম্পদ। ভয়, প্রেম, যন্ত্রনা সবকিছুর নিরবিচ্ছিন্ন দৃশ‍্যায়ন কবিতাই মনে করায়। অন্তিম এপিসোডে ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ এর ওড : ইন্টিমেশনস অফ ইম্ মর্টালিটি তে তারই সমাপতন হয়। মিস আইভস্ আমাদের মনে চিরকালীন জায়গা করে নেন।

এতক্ষণ যদি এই প্রলাপ মন দিয়ে পড়লেনই, তাহলে আর দেরী করবেন না! বৃষ্টিময় গা ছমছমে সন্ধেয় এক পেনির ভয় নেহাৎ মন্দ লাগবে না।


অ্যামিগারা পাহাড়ের রহস্য

জুনজি ইতো তাঁর হরর মাঙ্গাগুলির জন্য বিখ্যাত। তাঁর The Enigma of Amigara Fault এর ভাষান্তর এখানে পরিবেশিত হলো।
বি.দ্র. - মাঙ্গায় সাধারণত প্যানেলগুলি ডান দিক থেকে বাম দিকে পড়তে হয়। কিন্তু অনুবাদের সময় পাঠকদের সুবিধার্থে পাশ্চাত্যের মতো বাম থেকে ডান দিক পড়ার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।

রাস্তা


মূল গল্প “দ্য গেটওয়ে অফ দ্য মনস্টার” প্রথম প্রকাশিত হয় The Idler পত্রিকায় 1910 সালে। সেই সময়ে গল্পের অলংকরণ করেছিলেন Florence Briscoe - যা এই অনুবাদের সঙ্গে পরিবেশিত হয়েছে।

কারনাকির কাছ থেকে গল্প, থুড়ি ওর অভিযানের রোমাঞ্চকর আখ্যান শোনার কয়েকটা নিয়ম আছে।

আমাদের কাছে কার্ড মারফৎ আমন্ত্রণ আসবে। কার্ডে লেখা দিনটিতে, ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে সময়মতো ৪২৭ নম্বর চেইন ওয়াক-এ ওর বাড়িতে পৌঁছতে হবে। খাওয়াদাওয়া হবে, তবে সেই সময় মূল ব্যাপার নিয়ে কিচ্ছুটি বলা যাবে না। খাওয়ার পর কারনাকি মুখ খুলবে।

সেদিনও তাই হল। ওর কার্ড পেয়ে আমি, জেসপ, টেলর, আর কার্টরাইট ওর বাড়িতে পৌঁছলাম। আদর্শ গৃহস্বামীর মতো কারনাকি আমাদের আপ্যায়ন করল। জমিয়ে ডিনার সারা হল। হাতে চুরুট, পাইপ, কফি এইসব নিয়ে ফায়ারপ্লেসের কাছে বসা হল।

কারনাকি, যাকে ইদানিং অনেকেই কিছুটা ব্যঙ্গ, আর কিছুটা সম্ভ্রম মিশিয়ে ‘গোস্ট-ফাইন্ডার’ বলছে, শুরু করল ওর সাম্প্রতিকতম ভূতান্বেষণের কাহিনি। চোস্ত গল্প-বলিয়ের কথার ওপর আমার কলম চালানো সাজে না, তাই ও যা-যা বলেছিল, সেটাই লিখে দিলাম এখানে।

 

“আমি কোথায় গেছিলাম সেটা বলা যাবে না। এমনকি ক্লায়েন্টের নামটাও বলা বারণ, তবে ধরে নাও তাঁর নাম… হেন্ডারসন।

হেন্ডারসন আমার কাছে এসেছিলেন একটা সমস্যা নিয়ে। লন্ডন থেকে বেশ কিছুটা দূরে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে একটা বিশেষ ঘর আছে। ঘরটাতে নাকি ভূতুড়ে উপদ্রব চলে। এর বেশি কিছু হেন্ডারসনের কথা থেকে বোঝা গেল না। তবু, আমি বলে দিয়েছিলাম, ব্যাপারটা নিয়ে তদন্ত করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।

নিজের মতো করে ওই বাড়ির সম্বন্ধে একটু খোঁজখবর নিয়ে আমি দু’দিন পর হেন্ডারসনের বাড়িতে পৌঁছলাম। তখন সন্ধে নামছে। বাড়িটা যে বহু-বহু পুরোনো, সেটা দেখেই বুঝতে পারছিলাম। ওই বাড়ির সবচেয়ে প্রাচীন বাসিন্দা, বাটলার… ধরে নাও, তার নাম পিটার, আমার অপেক্ষায় ছিল। হেন্ডারসন তাকে বলে রেখেছিলেন, আমাকে যেন সব রকম ভাবে সাহায্য করা হয়।

একা-একা ডিনার সারা, তাও আবার ওইরকম একটা চুপচাপ বাড়িতে, বড়োই কঠিন কাজ। সময় কাটানোর জন্যই আমি পিটারকে সেই ঘরটা নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করে দিয়েছিলাম। তার কথা শুনে বুঝলাম, ‘গ্রে রুম’ নামে পরিচিত ওই ঘরের সমস্যা দুটো।

প্রথমত, প্রতিদিন সকালে দেখা যায় যে ওই ঘরের বিছানার চাদর কুঁচকে-মুচকে ঘরের এক কোণে পড়ে আছে।

দ্বিতীয়ত, এবং আসল সমস্যা হল, ওই ঘরের দরজা মাঝরাতে খুলে যায়, আর তারপর দড়াম করে বন্ধ হয়। কখনও একবার, কখনও একাধিকবার! আর এই পুরো ব্যাপারটা হয় যখন ঘরের দরজায় তালা তো দেওয়া থাকেই, সেই তালার একমাত্র চাবিও ঝোলে প্যান্ট্রিতে রীতিমতো নজরদারদের চোখের সামনে।

আমাকে কথাগুলো বলতে গিয়ে পিটারের ঘাম ছুটে গেছিল। ও খুব স্পষ্টভাবেই স্বীকার করেছিল, প্রায়ই এমন হয় যে না ঘুমিয়ে ও কান পেতে অপেক্ষা করে সেই মুহূর্তটার জন্য যখন তালাবন্ধ গ্রে রুমের দরজাটা খুলে যাবে, আর সপাটে বন্ধ হবে, একবার, দুবার, তিনবার…!

আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ঘরটা সেই রাতেই একবার দেখতে হবে।

আমার কথা শুনে প্রথমে পিটার ভেবেছিল, আমি বোধহয় ঠাট্টা করছি। সেটা করছি না বুঝতে পেরে ও প্রাণপণে আমাকে থামাতে চেয়েছিল। আমি আগেই জানতাম, বেশ কয়েক শতাব্দী ধরেই রাত নামলে ওই ঘরে ঢোকা নিষেধ। তবু আমি একগুঁয়ে হয়ে ওকে বলেছিলাম, ঘরটা তখনই দেখব আর কয়েকটা জায়গায় সিল লাগাব, যাতে কেউ বদমায়েশি করলে সেটা চট করে ধরে ফেলা যায়।

“আপনি বরং দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিন।” আমি হেসেই বলেছিলাম, “আমার পিছু-পিছু ওই ঘর থেকে অন্য কিছুও যাতে বেরিয়ে না আসে।”

“ওই ঘর থেকে কখনও কিছু বেরিয়ে আসে না স্যার।” ক্ষয়াটে গলায় বলেছিল পিটার, “আমাদের এই বাড়ির মতো … কিছু আপনি কোথাও পাবেন না।”

অস্বীকার করব না, যাবতীয় অভিজ্ঞতা নিয়েও আমার বুকটা ধুকপুক করছিল।

 

ঘরটা বিশাল। দেওয়ালে মাথা ঠেকানো একটা বড়ো খাট, দেওয়ালে ঝোলানো কয়েকটা অযত্নে বেরঙা ফটো, ফায়ারপ্লেস, কয়েকটা কুলুঙ্গি, একটা সোফা, আর তিনটে টেবিল, এছাড়া আর কিচ্ছু ছিল না ঘরটায়। ওই টেবিল আর ম্যান্টেলপিসে যেক’টা মোমবাতি ছিল, সবগুলো জ্বালানোর পর ঘরের অসহ্য দমবন্ধ পরিবেশটা একটু হালকা হল। আমি চারপাশে এক চক্কর লাগিয়েই জানলা, কুলুঙ্গি, ফায়ারপ্লেস, ফটো, সবকিছুর ওপর রিবন লাগিয়ে মোম আর গালা দিয়ে সিল করা শুরু করলাম।

এই পুরো সময়টা পিটার দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি ওকে ভেতরে আসতে বললাম, ও এল না। আমি ওকে বললাম চলে যেতে, কিন্তু কর্তব্যের খাতিরেই হোক বা হেন্ডারসনের ভয়ে, ফ্যাকাশে চেহারাতেও ও দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। তবে পিটারের মুখ থেকে বেরোনো টুকরো-টাকরা শব্দ থেকেও বুঝতে পারছিলাম, ও বলতে চাইছে, এই ঘরটা যে ঠিক কতটা বিপজ্জনক, সেটা আমি বুঝতে পারছি না।

বিশ্বাস করো, একে তো ঘরে ঢোকার পর থেকেই মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে গেছিল, তার ওপর পিটারের এই বিড়বিড় শুনে আমার স্নায়ুর ওপর চাপ আরো বাড়ছিল। তবু, নিরেট দেওয়াল ছাড়া আর সবকিছু আমি রিবন আর সিল দিয়ে ঢেকে দিলাম, যাতে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে কেউ ও ঘরে ঢোকার চেষ্টা করলেই সেটা ধরা পড়বে।

এইসব করতে যে কতটা সময় লাগবে, সেটা ঠিক বুঝতে পারিনি। হঠাৎ, বারান্দার বড়ো ঘড়িতে এগারোটা বাজার শব্দ শুনতে পেয়ে চমকে উঠলাম। তখন পিটারের অবস্থা যদি তোমরা দেখতে! যদি ঘরে ঢোকার সাহস ওর থাকত, তাহলে ও বোধহয় আমার ঘাড় ধরে ঘর থেকে টেনে বের করত।

আমি কোটটা খুলে সোফায় রেখে কাজ শুরু করেছিলাম। পিটারের মুখচোখ দেখে বুঝলাম যে এরপর আমি ঘরে থাকলে ওরই হার্ট অ্যাটাক হবে। ধীরেসুস্থেই কোটটা পরছিলাম। কিন্তু পিটার প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, “আপনি এক্ষুনি বেরিয়ে আসুন স্যার! আপনি বুঝতে পারছেন না, সামনে … খুব বিপদ!”

ম্যান্টেলপিসের ওপরের একটা মোমবাতি তখনই নিভে গেল!

সত্যি বলছি, পিটারের কথার সঙ্গে মোমবাতিটার এই বেমক্কা নিভে যাওয়া মিলে আমার এমন অবস্থা করেছিল, মনে হয়েছিল এক লাফে ঘরের বাইরে চলে যাই! কিন্তু জানতাম, যত ভয়ই পাই না কেন, সেটা প্রকাশ করা যাবে না। তাই নিজেকে সংযত করে, যথাসাধ্য দ্রুত হেঁটে আমি আগে ম্যান্টেলপিসের ওপর থেকে তখনও জ্বলতে থাকা মোমবাতিটা তুলে নিলাম। তারপর অন্য মোমবাতিটা, আর ঘরে জ্বলতে থাকা বাকি মোমগুলোর কাছে গিয়ে সেগুলো নিভিয়ে সবক’টা মোমকে হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

এই সময়টায়, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, ঘরের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা বাতাসের ছোঁয়া পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, যেন কোনো একটা অদৃশ্য জানলা কেউ খুলে দিয়েছে। এমনকি গ্রে রুমের দরজাটা বন্ধ করার জন্য টানতে গিয়েও আমার মনে হল…

মনে হল, যেন কেউ দরজাটা ঘরের ভেতর থেকে টেনে ধরেছে।

তবু, গায়ের জোরে আমি দরজাটা বন্ধ করলাম, লক করলাম, সিল করলাম, এমনকি চাবির ফুটোটার ওপর আমার একটা কার্ডও সেট করলাম যাতে ভেতর থেকে কেউ লক নিয়ে কারিকুরি করলেই সেটা বোঝা যায়।

পিটারকে সঙ্গে নিয়ে আমি যখন নীচে নামলাম, তখন ওর ফ্যাকাশে মুখ, আর প্রায় কাঁপতে থাকা চেহারা দেখে আমি আরেকবার বুঝলাম, ও বেচারাও এতক্ষণ ধরে কী সাংঘাতিক চাপ সহ্য করেছে!

ঘুমোনোর জন্য তৈরি হতে-হতে প্রায় মাঝরাত হয়ে গেল। ইতিমধ্যে, যাতে অন্য কোনো ঘরের দরজা খুলে বা বন্ধ করে কেউ আমাকে চমকাতে না পারে, সেজন্য আমি করিডরে গ্রে রুম আর আমার ঘরের মাঝের সবক’টা দরজায় সিল মেরে এসেছিলাম। ক্লান্তি, আর স্নায়ুর ওপর একটু অপ্রত্যাশিত রকমের চাপ, দুয়ের বশে ঘুম আসতে দেরি হল না।

 

বেশ কিছুক্ষণ পরে, সেটা কতক্ষণ আমি জানি না, গভীর ঘুমের মধ্য থেকেও আমি জেগে উঠলাম। প্রথমে বুঝতে পারিনি, কেন ঘুমটা ভেঙেছে। তারপরেই করিডরের কোথাও দড়াম করে একটা দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ পেয়ে মাথাটা একদম পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম, ঘুমের মধ্যেও আমি এমন একটা আওয়াজ পেয়েছিলাম।

এক হাতে মোমবাতি, অন্যটায় পিস্তল নিয়ে দরজা খুললাম। ঠিক করেই রেখেছিলাম, গ্রে রুমে গিয়ে একটা এসপার-ওসপার করব কিন্তু… যা কখনও হয়নি, সেটাই হল তখন।

তোমরা জান, আমি ভীতু নই। ভীতু হলে এই লাইনে আমি টিঁকতে পারতাম না। কিন্তু করিডরে দাঁড়িয়ে দারুণ ভয়ে আমি প্রায় জড়বৎ হয়ে গেলাম!

না! আমি কিছু দেখিনি। অন্তত তখনও কিছু হয়নি দেখার মতো। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, যেন নরক থেকে উঠে আসা একটা নোংরা, কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে ওই ঘরটার কাছেই। ফলে ঘরটার দিকে আমি এক ইঞ্চিও এগোতে পারছিলাম না।

কিছুক্ষণ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করার পর আমি আর পারলাম না। সুবোধ বালকের মতো নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লক করলাম, খাটে এসে বসলাম, আর সারা রাত জেগে ওই ঘরের দরজার সপাটে বন্ধ হওয়ার শব্দ ও তার প্রতিধ্বনি শুনলাম।

 

অবশেষে আকাশের গা থেকে কালো কম্বলটা সরিয়ে ভোর এল। তার প্রায় ঘণ্টাখানেক আগেই দরজা সপাটে বন্ধ হওয়ার ব্যাপারটা থেমেছিল। ভোর হওয়ামাত্র আমি ফ্রেশ হতে শুরু করেছিলাম। আমি জানতাম যে এমন ঘটনার মাঝে ভয় পেয়ে যাওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। অনেক সময় আমাদের অবচেতন মন এই ভয় পাইয়ে দিয়েই আমাদের অনেক কিছু সম্বন্ধে সতর্ক করে। কিন্তু তবু ভয় পেয়ে নিজের ঘরে খাটের ওপর বসে রাত জাগার পর আমি যে বেশ মুষড়ে পড়েছিলাম, সেটা অস্বীকার করব না।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখি পিটার ট্রে-তে আমার জন্য কফি নিয়ে উঠে আসছে। বেচারির চেহারা দেখে বুঝতে পারছিলাম, সারারাত ও-ও ঘুমোয়নি। আমি হাসিমুখে কফির জন্য ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, “রাতভোর না ঘুমিয়ে দরজার শব্দ শোনার পর এটা না হলে বিপদ ছিল।” শুনে পিটার বলেই ফেলল, “ঈশ্বর আপনাকে সুবুদ্ধি দিয়েছেন স্যার। আমি তো ভেবেছিলাম, আপনি ঝোঁকের মাথায় না রাতে ওই ঘরে আবার ঢুকে পড়েন!

পিস্তল দিয়ে রক্তমাংসের দুশমনের মোকাবিলা করা যায় স্যার, কিন্তু ওই ঘরে যা আছে…!”

আমি আর কথা না বাড়িয়ে গ্রে রুমের দিকে এগোলাম, পিটারও পিছু নিল।

দরজার কাছে গিয়ে দেখলাম, চাবির ফুটোর ওপর লাগানো আমার কার্ডটা যেমন ছিল, তেমনই আছে। কিন্তু দরজার সিলটা ভেঙে গেছে। সেটাকে পুরোপুরি সরিয়ে আমি, খুউব সাবধানে, দরজা খুলে ঘরে ঢুকলাম।

ঘরে এক নজর বুলিয়ে মনে হল, সব ঠিকঠাক আছে। জানলাগুলো দিয়ে তখন আলো ঢুকছিল। আসবাব সব ঠিকঠাক জায়গাতেই ছিল। আমি একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলতে যাব, তখনই পিটার চেঁচিয়ে বলল, “বিছানার চাদরগুলো দেখুন স্যার!”

তাই তো! বিছানার চাদরগুলো কেউ বিছানা থেকে তুলে ঘরের এককোণে ছুড়ে ফেলেছে।

তার মানে, কাল রাতে এই ঘরে কেউ, বা কিছু ছিল!

পিটার চাদরগুলো তুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আমি ওকে আটকালাম। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আমি ঘরের আগাপাস্তালা পরীক্ষা করে বুঝলাম, আমার একটি সিলও কেউ ভাঙেনি। মানুষী বদমাইশির কোনো চিহ্ন না পেয়ে আমি পিটারকে বললাম ঘর গুছিয়ে ফেলতে। ও বিছানা আবার পরিপাটি করে সাজানোর পর আমরা বেরিয়ে এলাম।

ব্রেকফাস্ট, ও এক রাউন্ড হাঁটাহাঁটির পর মাথাটা একটু সাফ হল। ঠিক করলাম, আরো খুঁটিয়ে ঘরটা দেখতে হবে। পিটার, আর একটি কাজের মেয়ের সাহায্য নিয়ে আমি ঘর থেকে সব আসবাব, খাট, এমনকি দেওয়ালের ফটোগুলো অবধি বের করে দিলাম। তারপর আতস কাচ দিয়ে ঘরের ইঞ্চি-ইঞ্চি জায়গা দেখে নিশ্চিত হলাম, সত্যিই ওই ঘরে এমন কেউ বা কিছু আগের রাতে কোনোভাবে এসেছিল, যে পায়ের ছাপ বা আঁচড়, কিছুই ফেলে না!

সবকিছু আগের জায়গায় রেখে দিয়ে, আবার সর্বত্র সিল আর রিবন লাগিয়ে আমি ঘরটা তালাবন্ধ করলাম। ডিনারের পর, পিটারের সাহায্য নিয়ে আমি গ্রে রুমের ঠিক উলটোদিকের দরজায় আমার ক্যামেরা আর ফ্ল্যাশলাইটটা ফিট করলাম। লেন্সের ঢাকনা খুলে আমি সবকিছু একেবারে তৈরি করে রাখলাম, যাতে দরজা খোলা হলেই একটা সুতোয় টান পড়ে, ফ্ল্যাশ ঝলসে ওঠে, আর দরজার ওপাশে যে বা যাই থাকুক না কেন, তার ছবি উঠে যায়।

তারপর শুরু হল আমার অপেক্ষা।

 

মোমবাতি জ্বালিয়ে, ঘড়িতে রীতিমতো অ্যালার্ম দিয়ে, শুতে গেছিলাম। ফলে ঠিক রাত বারোটায় আমার ঘুম ভেঙে গেল। ড্রেসিং গাউনের পকেটে পিস্তল নিয়ে আমি দরজা খুললাম। হাওয়ায় নিভে গেলে বিপদে পড়ব ভেবে আমি একটা ঢাকা লণ্ঠনের ব্যবস্থা করেছিলাম। সেটারই মৃদু আলোয় বাইরেটা দেখে নিলাম।

করিডর শুনশান! বাড়ি নিস্তব্ধ।

আমি নিজের ঘরের দরজায় গুছিয়ে বসলাম। মুখ রইল গ্রে রুমের দিকে, যেখানে আমার ক্যামেরা অপেক্ষা করছিল কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য।

প্রায় ঘণ্টাদেড়েক পর মনে হল, আমার মাথার পেছনদিকটায় কেমন একটা… অনুভূতি হচ্ছে! মনে হচ্ছে, যেন কিছু একটা ফুঁটছে সেখানে। আমার হাত ঘামতে শুরু করল। মনে হল, কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

আর তখনই ফ্ল্যাশলাইটের চোখ-ধাঁধানো আলোয় করিডরটা সাদা হয়ে গেল!

তারপরেই এল অন্ধকার। ওই সাদা আলোর তীব্র ঝলকের পর আমার হাতে ধরা লণ্ঠনের আলোটা হাস্যকর লাগছিল। তবু তাতেই আমি বোঝার চেষ্টা করলাম, গ্রে রুম থেকে কেউ, বা কিছু, বেরিয়ে আসছে কি না।

দরজাটা সপাটে বন্ধ হল তখনই।

শব্দটা বাড়িটাকে তো বটেই, মনে হচ্ছিল যেন আমার হাড়ে, দাঁতে, মগজে, সবকিছুতে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে। একটু ধাতস্থ হওয়ার আগেই দরজাটা আবার আওয়াজ তুলল, দড়াম! দড়াম!! দড়াম!!!

তারপর সবকিছু চুপচাপ হয়ে গেল।

তারপর কতক্ষণ কাটল, খেয়াল নেই। কয়েক মিনিট, কয়েক ঘণ্টা, কয়েক যুগ… কিন্তু ওই নিস্তব্ধতা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না! মনে হচ্ছিল, অন্ধকারে, আমার দৃষ্টির আড়ালে, কিছু একটা যেন গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।

হঠাৎ আমার হাতে ধরা লণ্ঠনটা নিভে গেল!

সত্যি বলছি, ভয় নয়। আমার তখন অন্য একটা কথা মনে হল।

কী সাংঘাতিক বোকামি করছি আমি! আমার শত্রু কে তা না জেনে, তার শক্তি সম্বন্ধে কিচ্ছু না বুঝে, আমি অন্ধকারে তার সামনে নিজেকে বলির পাঁঠার মতো পেশ করেছি!

উঠে দাঁড়ানো, এক লাফে নিজের ঘরে ঢোকা, আর দরজাটা সপাটে বন্ধ করা, এই কাজগুলো আমি প্রায় যন্ত্রের মতো করে ফেলেছিলাম। ভাগ্যিস! নইলে দরজা দিয়ে কিছু একটা জিনিসের আমার দিকে এগিয়ে আসার অনুভূতি, তারপর দরজাটা বন্ধ করার মুহূর্তে আমার খুব কাছে একটা মৃদু গলা-খাঁকড়ানোর মতো শব্দ শোনার পর আমার অবস্থা, এসব মাথায় রাখতে গেলে আমি পুতুলের মতো অনড় হয়ে যেতাম, আর তারপর যে কী হত…!

নিজের বিছানায় বসে, দরজার দিকে পিস্তলটা তাক করে যখন বসেছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, আমার হাত-পা সব রবার দিয়ে বানানো। পিস্তলটাও মনে হচ্ছিল খেলনা। আমি বুঝতে পারছিলাম, হ্যাঁ, আমি খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছিলাম যে দরজার ওপাশে কিছু একটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে… যার সামনে আমার গায়ের জোর, বা এই পিস্তলটাও তুচ্ছ।

শেষ অবধি ওইভাবে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। এক টুকরো চক দিয়ে ঘরের মেঝেতে একটা পেন্ট্যাকল, মানে পঞ্চভুজ আঁকলাম, তারপর সেই জায়গাটাতে ঢুকে বসে রইলাম যতক্ষণ না ভোর হয়। এই সময়টা গ্রে রূমের দরজা, কিছুক্ষণ পর-পর, সপাটে বন্ধ হচ্ছিল। সেই আওয়াজ আমার হাড়পাঁজরা কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু আমি নড়িনি।

অবশেষে সেই অসহনীয় রাতটা শেষ হল। অন্ধকার পাতলা হওয়ার পর দরজাটা আর আওয়াজ তুলছিল না। পুরোপুরি আলো ফোটার আগে আমি একরকম মরিয়া হয়ে গ্রে রুমের উলটোদিকে রাখা আমার ক্যামেরার লেন্সের ক্যাপটা আটকানোর জন্য এগোলাম। সত্যি বলছি, ভয়ে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল! কিন্তু কিছু করার ছিল না। লেন্সের ক্যাপটা না আটকালে ভোরের আলোয় প্লেটটা নষ্ট হয়ে যেত। আমি কোনোক্রমে সেটুকু করে, ঘরে ফিরে, পেন্ট্যাকলটা মুছে খাটে বসে রইলাম।

আধ ঘণ্টা পর পিটার কফি নিয়ে আমার ঘরের দরজা খটখটাল।

 

আমরা দুজনেই ওই ঘরে গিয়ে দেখেছিলাম, এক কোণে কুঁচকে পড়ে থাকা বিছানার চাদর ছাড়া ঘরের বাকি সব কিছু, যেখানকার যা সব সেখানেই আছে। একটা সিলও ভাঙেনি। এত কষ্ট করে ফটো তোলার চেষ্টা করেও প্লেটটা ডেভেলপ করে দেখলাম, তাতে আধখোলা দরজাটা ছাড়া আর কিছুই আসেনি। একে তো রাতজাগার ফলে স্নায়ুর ওপর চাপ, তায় প্লেটে কিছু না পাওয়ার হতাশা, সর্বোপরি ঘরটায় ঢুকে সিলগুলো পরখ করার সময়েও একটা অদ্ভুত অস্বস্তি… সব মিলিয়ে আমার একদম ভালো লাগছিল না। কিন্তু এও বুঝতে পারছিলাম, পালিয়ে যাওয়া যাবে না। গভীর রাতে এই ঘরে যেই আসুক না কেন, তার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া না করে আমি শান্তি পাব না।

দুপুরের খাওয়া সেরে, নিজের সাজসরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে আমি আবার গেলাম গ্রে রুমে।

নতুন করে কয়েকটা জায়গায় সিল লাগালাম। তারপর একটা কাজ করলাম যেটা তখন খুব দরকারি বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন ভাবতেও খারাপ লাগছে।

একটা ছোট্ট ঝুড়িতে, নরম বিছানা বানিয়ে, একটা বেড়ালের বাচ্চাকে তার মধ্যে শুইয়ে দিলাম। সেটা গা-হাত চেটে চটপট ঘুমিয়েও পড়ল। ঝুড়িটা ঘরের এক কোণে আমার নজরের মধ্যেই রাখার সময় আমার মাথায় এটা ছিল যে পশুপাখি অনেক সময় সতর্ক করে দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেয়, কিন্তু…

যাইহোক। আগের রাতে লাগানো রিবন, আর ক্রিসক্রস করে থাকা সুতোগুলো সরিয়ে দিলাম সবচেয়ে আগে। তারপর ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে ঠিক একুশ ফিট ব্যাসের একটা বৃত্ত মেপে নিলাম। জায়গাটা হিসপ, মানে এক ধরনের সুগন্ধি লতা দিয়ে বানানো ব্রাশ দিয়ে সাফ করলাম। তারপর জায়গাটা চক দিয়ে আঁকা একটা বৃত্ত দিয়ে চিহ্নিত করে নিলাম। ঠিক করে নিলাম, গ্রে রুমের অনাহূত অতিথির সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য ওই বৃত্তাকার জায়গাটাই হবে আমার দুর্গ।

যেসব তন্ত্রমন্ত্রের সাহায্য নিয়ে আমি আমার ওই দুর্গকে সুরক্ষিত করলাম, তার বিস্তারিত বিবরণ তোমাদের কাছে ক্লান্তিকর ঠেকবে। শুধু এটুকু বলি যে পুরোনো বইয়ের পাতা ঘেঁটে জানা সবকিছু দিয়েও যে সবসময় ওই ধরনের… জিনিসের মোকাবিলা করা যায় না, সেটা জানা ছিল বলে আমি পেন্ট্যাকল, ওয়াটার সার্কল, এসব করেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। ঠিক তখনই, ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো করে একটা কথা আমার মাথায় চিড়িক দিয়ে উঠল!

প্রফেসর গার্ডার তাঁর ‘এক্সপেরিমেন্টস উইথ আ মিডিয়াম’ বইয়ে বেশ স্পষ্ট করে বলেছিলেন, মিডিয়ামকে কোনোভাবে একটা ইলেকট্রিকাল ফিল্ডের মধ্যে রাখতে পারলে তার শক্তি একদম চলে যায়। মনে হয় যেন চেতনার অতীত যে জায়গাটার সঙ্গে তার সংযোগ ছিল, সেই জায়গাটা থেকে মিডিয়াম একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সেই সময়ে।

বিস্তর মাথা খাটিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বাঁচতে চাইলে আমাকে ইলেকট্রিসিটির সাহায্য নিতেই হবে। তবে শুধু আলো জ্বালানো নয়। মন বলছিল, যে জিনিসের সামনে পড়তে চলেছি তার হাত থেকে বাঁচতে গেলে আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জেনে আসা তথাকথিত ‘ম্যাজিক ফিগারটা’ না জুড়লে বিপদ ঠেকানো যাবে না।

ঠিক করলাম, এমনভাবে ভালভ আর ব্যাটারি দিয়ে জিনিসটা সাজাব, যাতে তার প্রতিটি কোণ চক দিয়ে আঁকা পঞ্চভুজাকৃতি নক্ষত্র, মানে পেন্ট্যাকলের কোণের সঙ্গে মিশে যায়। তাই করলাম। সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করলাম, যাতে আমার ‘ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকল’-এর যেগুলো ভ্যালি, মানে ভেতরে ঢুকে আসা নীচু জায়গা, সেগুলো যেন ওয়াটার সার্কলের নানা জায়গায় রাখা আশীর্বাদী জলের শিশিগুলোর সঙ্গে পেন্ট্যাকল তথা বৃত্তাকার জায়গার কেন্দ্রের সঙ্গে এক রেখায় থাকে।

এসব করতে-করতে দিনের আলো ফুরিয়ে কখন যে রাত নেমেছে, টেরও পাইনি। তবে আঁধার ঘনাচ্ছে বুঝেই চটপট ওয়াটার সার্কলের নানা জায়গায়, বেশ হিসেব কষে রাখা মোমবাতিগুলো জ্বালালাম। তারপর ব্যাটারি জ্বালিয়ে আমার ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকলকে সচল করলাম।

বৃত্তের মধ্যে বসে দেখে নিলাম, আমার ক্যামেরা আর ফ্ল্যাশলাইট, দুটোই ঠিকঠাক আছে। পিস্তলটা সামনে রেখে, চারপাশের আলো দেখে এক মুহূর্তের জন্য বেশ নিশ্চিন্ত লাগল।

 

বেশ কিছুক্ষণ পর, ঘড়ি দেখিনি বলে বলতে পারব না তখন কত রাত, আমার মনে হল, ঘরের মধ্যে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে! মনে হল, বন্ধ ঘরের মধ্যেও আমি যেন ঠান্ডা, অনেকটা থেঁতলানো রসুনের মতো গন্ধের একটা বাতাসের উপস্থিতি টের পাচ্ছি। মোমবাতির শিখাগুলো সেই অদ্ভুত হাওয়ায় দুলে উঠছে, ঘরের মধ্যে আলোর পরিমাণটাও একরকম না থেকে যেন বাড়ছে-কমছে!

বুঝতে পারলাম, ঘরের যে কোণে বিছানার চাদরগুলো কুঁচকে পড়ে থাকতে দেখেছি দু’বারই, সেখান থেকেই যেন হাওয়াটা আসছে। কিন্তু কীভাবে…

আর তারপরেই মোমবাতিগুলো নিভে যেতে শুরু করল।

মনে হল, যেন চোখের পলক ফেলার আগেই ওই বৃত্তের সীমা বরাবর জ্বালিয়ে রাখা সবক’টা মোম নিভে গেল। ঘরের আর বাইরের অন্ধকারের বিরুদ্ধে বৃত্তের মধ্যে বন্দি আমার সঙ্গে রইল শুধু ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকলের হালকা নীলচে আভাটুকু।

ওই অল্প আলোয় ঘরের মধ্যে বেশিদূর নজর চলে না। তার মধ্যেও মনে হল, ওই অদ্ভুত বাতাসটার সঙ্গে মিশে যেন একতাল অন্ধকার চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে বৃত্তের চারপাশে। মাঝেমধ্যেই আমি অন্ধকারটাকে ঘরের সর্বত্র ঘন হয়ে ওঠা ছায়ায় হারিয়ে ফেলছিলাম। তখন মনে হচ্ছিল, যেকোনো মুহূর্তে একটা কিছু আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়তে পারে। ঘেমে ওঠা হাতেও আমি পিস্তলটাকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে একটু সাহস জোগাতে চেষ্টা করছিলাম।

হঠাৎ একটা মৃদু, কোনো সরীসৃপের বুকে হেটে এগোনোর মতো আওয়াজ পেলাম।

দারুণ ভয়ে আমার চুল খাড়া হয়ে উঠেছিল। তবু, মাথা ঠান্ডা রেখে বুঝতে পারলাম, বিছানার চাদরগুলোকে কেউ ধীরে-ধীরে সরিয়ে দিচ্ছে। জঘন্য কোনো অপরাধ করার আগে যেভাবে অপরাধী তার শিকারের দিকে এগিয়ে যায়, ঠিক সেভাবেই যেন কেউ চাদরগুলোকে টেনে নিচ্ছে নিজের দিকে।

সব থেমে গেল কিছুক্ষণের জন্য। আমার চোখে পলক পড়ছিল না। বিছানার চাদরগুলো অনড় হয়ে কিছুক্ষণ পড়ে রইল খাটের ওপর। তারপর আবার শুরু হল ধীরলয়ে, একটা তেলতেলে মেঝেতে সাপের এগিয়ে যাওয়ার মতো করে চাদরগুলো টেনে নেওয়া।

আমার স্নায়ুগুলো জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় এসে গেছিল। তার মধ্যেও আমার মনে পড়ল, আমার নাগালের মধ্যেই আছে একটা ফ্ল্যাশলাইট, আর একটা ক্যামেরা। বিছানা থেকে নজর না সরিয়েই ক্যামেরার দিকে হাত বাড়ালাম।

তখনই, একটা মারাত্মক রকমের রাগ আর হিংস্রতার সঙ্গে বিছানার চাদরগুলো ছুড়ে ফেলা হল ঘরের ওই বিশেষ কোণে!

ঠিক কীরকম ছিল আমার তখনকার মানসিক অবস্থা, সেটা বুঝিয়ে বলতে পারব না। চোখের সামনে ওই ঘটনাটা ঘটতে দেখে আমার মতো পোড়খাওয়া লোকও… তার চেয়েও বড়ো কথা কী জান? সেই রাতের আসল খেল তখনও শুরুই হয়নি!

আমি যখন ভাবার চেষ্টা করছি, এরপর আমার কী করা উচিত, তখনই মনে হল, আমি যেন দরজার কাছে কিছু একটা আওয়াজ শুনলাম। অনেকটা… অনেকটা কোনো পোকার চিটিরপিটিরের মতো। তারপরেই বুঝলাম, ব্যাপারটা কী।

ঘরের দরজায় লাগানো সিলটা কেউ ভেঙেছে!

ক্যামেরাটা আমি হাতে নিলাম, কিন্তু কিছু করার সুযোগ পেলাম না। ঠিক তখনই দরজাটা বন্ধ হল! সপাটে। মনে হল, যেন আমার কানের গোড়ায় বাজ পড়ল। ফাঁকা ঘরের মধ্যে সেই বিশাল আওয়াজের ধাক্কা সামলানোর আগেই অন্য একটা আওয়াজ আমার কানে এল।

আমি শুনতে পেলাম, বেড়ালের বাচ্চাটা যে ঝুড়িতে রাখা ছিল, সেটা থেকে হালকা ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ উঠছে। পরমুহূর্তেই বেড়ালটা একটা বীভৎস আর্তনাদ করে উঠেই থেমে গেল!

আমি ফ্ল্যাশলাইট জ্বালালাম। দেখলাম, ঝুড়িটা উলটে গেছে। বেড়ালের বাচ্চাটার শরীর যেভাবে তার থেকে বেরিয়ে ঝুলেছিল, তা থেকে এটাও স্পষ্ট হচ্ছিল যে তার শরীরে আর প্রাণ নেই।

চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়ে গেলাম, ঘরের মধ্যে যে এসেছে সে অশুভ, এবং চরম ক্ষতিকর।

আলোটা গরম হয়ে উঠছিল। সেটা নেভাতে বাধ্য হলাম। তৎক্ষণাৎ মনে হল, পেন্ট্যাকলের ওই মৃদু নীলাভ আলো ছাড়া ঘরের সর্বত্র যেন একটা অন্ধকারের সমুদ্র তৈরি হয়েছে। দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, সেই সমুদ্রে ঢেই তোলার মতো করে কিছু একটা ঘুরছে বৃত্তের চারপাশে।

ধীরে, অতি ধীরে, আমার চোখ সেই অন্ধকারেও মানিয়ে নিল। তখন আমি ওটাকে দেখতে পেলাম!

ওয়াটার সার্কেল, মানে আশীর্বাদী জলভরা ছোটো শিশিগুলো বসিয়ে যে বৃত্তাকার জায়গাটা আমি চিহ্নিত করেছিলাম, তার কাছ দিয়ে ঘোরাঘুরি করছিল ওটা। মনে হচ্ছিল, যেন অন্ধকারেরই কিছুটা অংশ জমাট বেঁধে একটা প্রকাণ্ড মাকড়সার আকার নিয়েছে! তবে খুব কাছে এগিয়ে আসার চেষ্টা করলেই ছ্যাঁকা লাগার মতো করে ওটা ছিটকে পিছিয়ে যাচ্ছিল আবার।

ঘুরেই চলছিল ওটা। বারবার। কিন্তু একটা সময়ে, সেটা কতক্ষণ পর তা আমি সত্যিই বলতে পারব না, কারণ মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরে ওটা আমার চারপাশে ঘুরছে, ওটা ঘুরপাক খাওয়া বন্ধ করল।

দেখে নয়, বরং অনুভব করছিলাম, জিনিসটা আরো জমাট বাঁধছে। একটা মরিয়া চেষ্টা করার আগে যেমন পাঁয়তারা কষা হয়, তেমন করে ওটা যেন নিজেকে তৈরি করছে।

তারপর ওটা আমার দিকে ধেয়ে এল!

আমি হাঁটু মুড়ে বসেছিলাম। কী ঘটছে সেটা ভেবে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পাইনি। কিন্তু তবু, আমার শরীর নিজে থেকেই ছিটকে গেল পেছন দিকে। ঘেমে যাওয়া ডান হাত দিয়ে আমি পিস্তলটা তুলে তাক করার চেষ্টা করলাম। তবে যখন দেখলাম… যখন দেখলাম যে আমার ওয়াটার সার্কেল আর অন্যসব বাধা পেরিয়ে জিনিসটা সোজা আমার দিকে আসছে, আমি বোধহয় ভয় পেয়ে চেঁচিয়েই উঠেছিলাম!

একেবারে শেষ মুহূর্তে, জিনিসটা যখন আমার থেকে বড়োজোর কয়েক ফুট দূরে, ওটাকে ছিটকে পিছিয়ে যেতে দেখলাম আমি! মনে হল, যেন কিছু একটা শক্তি, যার জোর ওই জমাট বাঁধা অন্ধকারের চেয়েও বেশি, জিনিসটাকে দূর করে দিল আমার সামনে থেকে।

ঠিক কতক্ষণ লেগেছিল স্বাভাবিক হতে, বলতে পারব না। একটু-একটু করে বুঝতে পারলাম, আমি নিরাপদ!

তলিয়ে দেখে বুঝলাম, আমার নড়াচড়ার ফলে কোনো এক সময় একটা জলভরা শিশি উলটে গেছিল। তার ফলেই জিনিসটা ওয়াটার সার্কেল ভেঙে এগোনোর সুযোগ পেয়েছিল। সামান্য ওই শিশিটুকুই উলটে গিয়ে, আমার ‘দুর্গে’ ঢোকার মতো একটা রাস্তা বানিয়ে দিয়েছিল জিনিসটার জন্য।

আরো বুঝলাম, জিনিসটা আসলে একটা বিশাল হাত!

অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকেও আমি হাতটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু টের পাচ্ছিলাম, ওটা আছে। ঘরের মধ্যেই আছে। আর সুযোগ খুঁজছে, যাতে আমার নাগাল পাওয়া যায়।

মাঝে হাতটা মরা বেড়ালের বাচ্চাটাকে তুলে নিল। আর তারপর সেটাকে মাটিতে আছড়ে চলল! বিশ্বাস করো, সেই ভোঁতা আওয়াজটা শুনতে-শুনতে আমার মনে হচ্ছিল, যেন নরকবাস করছি!

কিছুক্ষণ পর সেটাও থেমে গেল। তারপর দরজাটা একটু খুলেই সপাটে বন্ধ হল। স্নায়ুর ওই টানটান অবস্থার মধ্যে দরজার আওয়াজটা একেবারে দাঁতে-দাঁত ঠেকিয়ে দিল আমার।

একটু পরেই হাতটা আবার আমার দিকে ধেয়ে এল!

না, আমাকে কোনোভাবে তৈরি হওয়ার সুযোগ দেয়নি হাতটা। অসাবধানে আমার একটা হাত রাখা ছিল ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকলের একটা বাহুর ওপর। ঠিক সেই বরাবর হাতটা আমার দিকে ছুটে এসেছিল।

অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে আমি হাতটা সরিয়ে পেছনদিকে ঠিকরে গেলাম।

হাতটাও ঠিক পেন্ট্যাকলের ওপর এসে শক খাওয়ার মতো ছিটকে সরে গেল।

বুকের ভেতর এত জোরে আওয়াজ হচ্ছিল, যে মনে হচ্ছিল উত্তেজনা আর ভয়েই আমার কিছু একটা হয়ে যাবে। হাতটার আর আমার নাগাল পাওয়ার দরকার হবে না। তবু, সেই অবস্থাতেও, আমি একটু তলিয়ে ভাবার চেষ্টা করলাম, এই নিয়ে পরপর যে দুটো ‘দুর্ঘটনা’ হাতটাকে আমার কাছ অবধি পৌঁছতে দিল, সেগুলো কি সত্যিই ঘটনাচক্রে হয়েছিল?

নাকি, আমার অজান্তেই হাতটা আমাকে দিয়ে এমন কিছু করাচ্ছে, যাতে ও আমার নাগাল পায়?

কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থেকে আমি হঠাৎ নিজের পা-টা লম্বা করে দিলাম। ভাবটা করলাম, যেন আমার অজান্তেই পা-র ধাক্কা লেগে একটা জলভরা শিশি উলটে গেছে। শিশিটা কাত হয়ে একটু জল পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু সতর্ক ছিলাম বলে সেটাকে চটপট সোজা করে দিতে পেরেছিলাম আমি।

তবু, সেই সময়টুকুতেও হাতটা আমার দিকে এগিয়ে এসেছিল। আমার মুখ থেকে খুব সামান্যই দূরত্বে ছিল ওটা, তবে কোনো কারণে, কিছু একটাতে ধাক্কা খেয়ে, ওটা আবার ছিটকে গেছিল পেছনে। আমার নাগাল না পেলেও জিনিসটার সঙ্গে জড়িত একটা হিংস্র, অশুচি, অশুভ শক্তি আমার চেতনায় এমনভাবে ঘা দিয়েছিল যে মনে হয়েছিল… আমি আর কোনোদিন আমার ভেতরের শুদ্ধতাকে ঠিক আগের মতো চেহারায় ফিরে পাব না!

পেন্ট্যাকলের মাঝে গুঁড়ি মেরে আমি আবার অপেক্ষা করতে থাকলাম। এবার শুধু হাতটাকে নয়, আমি নিজেকেও সতর্ক নজরে রাখছিলাম। একটু আগের ঘটনা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমার দুর্বল হয়ে আসা স্নায়ুর ওপর কোনোভাবে জোর খাটিয়ে ওয়াটার সার্কেলকে ভাঙা হচ্ছে। ফলে হাত-পা টানটান করতে গেলে, বা বসার ভঙ্গিটা বদলাতে গেলেও মনে হচ্ছিল, আমাকে দিয়ে কিছু করানো হচ্ছে না তো?

হাতটা আমার চারপাশে ঘুরছিল। ঘরের মধ্যে সেই হাওয়াটাও বইছিল, যেটা আমি পেয়েছিলাম আগের রাতে। ঠান্ডা, একটা অদ্ভুত গন্ধমাখা, গায়ের প্রতিটি লোম খাড়া করে দেওয়া সেই হাওয়া আমার শরীর-মনের ওপর যে কী ভয়াবহ অত্যাচার চালিয়েছিল তা … তা আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না।

অবশেষে ভোর হল। সবচেয়ে আগে বন্ধ হল ওই হাওয়া। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই আমি বুঝতে পারলাম, হাতটা ঘরের কোথাও নেই। আলো বাড়ল, আকাশ থেকে চুঁইয়ে নেমে এসে সেই আলো ঘরকেও ভরিয়ে তুলল। ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকলের মৃদু নীল আলোটা প্রায় অদৃশ্য হয়ে এসেছিল। তবু, পুরোপুরি দিন না হওয়া অবধি আমি আমার দুর্গ ছেড়ে বেরোনোর কোনো চেষ্টা করিনি। বেশ কিছুক্ষণ পর, যখন শুধু আলো নয়, অন্যান্য আওয়াজ থেকেও বুঝতে পারছিলাম যে রাত, এবং তার আড়ালে ওত পেতে থাকা বিভীষিকাটি বিদায় নিয়েছে, তখনই আমি চক দিয়ে আঁকা ওই বৃত্তের বাইরে বেরোলাম। বেশি কিছু করার অবস্থায় ছিলাম না। কোনোক্রমে গ্রে রুম থেকে বেরিয়ে দরজাটা লক করলাম। নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুলাম। পিটার এল কিছুক্ষণের মধ্যেই। ওর আনা কফিটা নিঃশব্দে শেষ করলাম। পিটার নিজেও কোনো কথা বলল না, চুপচাপ কাপটা নিয়ে চলে গেল। আমি বিছানায় শুলাম। তারপর ঘুমোলাম না অজ্ঞান হলাম, অত জানি না।

 

দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল হব-হব করছে, তখন আমার ঘুম ভাঙল। ফ্রেশ হয়ে, অত বেলায় লাঞ্চের বদলে যা পাওয়া যায় তাই খেয়ে, আবার গ্রে রুমে ঢুকলাম। আমার প্রথম কাজ ছিল মৃত বেড়ালটার একটা সদ্গতি করা, নইলে পিটার এবং ওই বাড়ির অন্যদের শুধুশুধু ভয় আর কষ্ট পেতে হবে। ওটাকে বাড়ির পেছনের জংলা জায়গায় পুঁততে গিয়ে ছায়ারা আরো লম্বা হয়ে গেল। তারপর ওই ঘরে ঢুকে আমি ঘরের ওই কোণটার ওপর মনোনিবেশ করলাম যেখানে বিছানার চাদরগুলো ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। সেই বিশেষ হাওয়াও যেহেতু ওই কোণ থেকেই এসেছিল, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এখানেই কিছু একটা আছে।

সাদা চোখের খোঁজাখুঁজিতে কিছু পেলাম না। কিন্তু দেওয়ালের গায়ে লাগানো প্যানেল আর মেঝের জোড়ের জায়গায় কয়েকটা গর্ত করে সেখানে সরু শিক ঢুকিয়ে দেখতে গিয়েই একটা জিনিস পেলাম! বেশ কসরত করে ওটাকে দেওয়ালের নীচের সেই গর্ত থেকে বের করে জানলার কাছে নিয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম, জিনিসটা একটা আংটি!

একটা অদ্ভুত ধূসর ধাতু দিয়ে পঞ্চভুজাকৃতি তারার আকারে বানানো হয়েছে আংটিটাকে। তবে তাতে কোণগুলো উঠে নেই, বরং একেবারে মসৃণ হয়ে রয়েছে। যাঁরা এই জগতটা নিয়ে চর্চা করেন তাঁরা জানেন, পঞ্চভুজাকৃতি নক্ষত্রের পাঁচটা শীর্ষদেশ যদি ঠিকঠাক আগলানো হয়, তাহলে সেটা একটা রক্ষাকবচ। কিন্তু এই আংটিটা তা নয়। যদি এতে ওই পাঁচটা কোণ উঁচু হয়ে থাকত, তাহলে এটা উপত্যকাকে পাঁচটা পাহাড় দিয়ে ঘিরে রাখার মতো করে ধারককে সুরক্ষিত করত। তার বদলে এটা কিছু একটার জন্য রাস্তা হিসেবে কাজ করছে!

তার মানে, একদা হেন্ডারসন পরিবারের সম্পত্তি, এবং দীর্ঘ অদর্শনে প্রায় কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া তথাকথিত ‘লাক রিং’ বা সৌভাগ্যের আংটি আমি খুঁজে পেয়েছি!

হেন্ডারসন পরিবারের কোনো এক পূর্বপুরুষ ক্রুসেডে গিয়ে এই আংটিটা নিয়ে এসেছিলেন। যে অবস্থায়, যেখান থেকে আংটিটা পাওয়া গেছিল তাই নিয়ে বিস্তর গল্প আছে। আমি এই পরিবার, তথা গ্রে রুম নিয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়েই সেগুলো শুনেছিলাম। এই আংটিটা এক কালে বংশানুক্রমে বাবা থেকে ছেলের কাছে যেত, তাতে নাকি পরিবারের সৌভাগ্য অটুট থাকত। কিন্তু আংটিটা যেন কখনও পরা না হয়, এ ব্যাপারে একেবারে কড়া আদেশ ছিল।

শুধু, স্যার হালবার্ট, হেন্ডারসনের এক পূর্বপুরুষ, এই আদেশ মানেননি। নেশার ঘোরে বাজি ধরে ভদ্রলোক একরাতে আংটি পড়ে শুতে যান। এই গ্রে রুমটিই ছিল তাঁর শোয়ার ঘর। পরদিন সকালে হালবার্টের স্ত্রী এবং শিশুপুত্রের মৃতদেহ পাওয়া যায় এই ঘরের খাটে। বীভৎসভাবে গলা টিপে মারা হয়েছিল দু’জনকেই! সবার সন্দেহ এসে পড়ে হালবার্টের ওপর। লোকে ভাবে, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাগে বা বিরক্তিতে তিনিই দুজনকে মেরেছেন। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য হালবার্ট এই ঘরেই পরের রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরও একই দশা হয়। তারপর থেকেই গ্রে রুমে রাত কাটানো বন্ধ হয়ে যায়। পাকেচক্রে আংটিটাও হারিয়ে যায়।

 

কমে আসা আলোয়, জানলার ধারে আংটিটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময় আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা দানা বাঁধতে শুরু করল।

আমি জানতাম, গ্রে রুমে যদি আমি রাত কাটাই, তাহলে সেই রাতে একটা চরম চেষ্টা হবেই আমার নাগাল পাওয়ার জন্য। আমি এও জানতাম, যদি কোনোভাবে অশুভ শক্তি, মানে যেটা দানবিক হাতের আকারে ওই ঘরে জেগে উঠছে অন্ধকার নামলে, এই আংটিটা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে সে আমার নাগাল পাবে না।

আমি তৈরি হলাম সেই রাতের জন্য।

তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও আমার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করতে, বিশেষ করে ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকলটিকে ঠিকঠাক সাজাতে প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। যখন আমি আংটিটা নিয়ে পেন্ট্যাকলের মধ্যে ঢুকে বসলাম, তখন রাত নেমেছে। আমার প্রবল অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু প্রাণের মায়া ছিল বলেই পিস্তল হাতে নিয়ে, মোমবাতির হলুদ আর পেন্ট্যাকলের হালকা নীল আলোয় আলোকিত পরিবেশে বসে আমি ঘরের ওই কোণটার দিকে তাকিয়ে রইলাম, যেখান থেকে বাতাস বয়েছিল আগের রাতে।

প্রায় ঘণ্টাদুয়েক কাটল। মাঝে কয়েকবার আমার মনে হয়েছিল, বিপদ আমার খুব কাছে এসেছে। কিন্তু সতর্ক থেকেও আমি কিছু দেখতে বা শুনতে পাইনি।

রাত তখন বারোটা। আমার হঠাৎ মনে হল, সেই হাওয়াটা অনুভব করছি।

আর… সেটা আসছে আমার পেছন থেকে!

দারুণ আতঙ্কে আমার চুল খাড়া হয়ে উঠল। শক খাওয়ার মতো করে পেছনে ফিরে আমি বুঝতে পারলাম, হাওয়াটা আসছে ওই আংটি থেকে।

ওই দানব যে রাস্তা দিয়ে এই ঘরে, এই দুনিয়ায় ঢোকে, আমি সেটাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছি!

নিজের ভুল নিয়ে আক্ষেপ করার সময়টুকুও আমার কাছে ছিল না। চেষ্টা করছিলাম আংটিটা তুলে নিয়ে সেটাকে আমার ‘দুর্গের’ বাইরে ছুড়ে ফেলতে। কিন্তু একটা জীবন্ত জিনিসের মতো সেটা পিছলে বেরিয়ে গেল আঙুলের ফাঁক দিয়ে! আরেকবার সেটা তুলতে গিয়েই মনে হল, কিছু একটা জিনিসে ধাক্কা খাচ্ছি।

দেখতে পেলাম, হালকা কুয়াশা, বা কালো ধোঁয়ার মতো করে কিছু একটা বেরিয়ে আসছে আংটিটা থেকে, ওই হাওয়ায় ভর দিয়ে। বুঝলাম, সেই দানবিক হাতটা, আমার পাশেই, ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকল তথা ওয়াটার সার্কলের মধ্যে, জমাট বাঁধছে!

না। আমি আর কিছু ভাবিনি। অতটা ভয় পেলে হয়তো অন্য কেউ জড়বৎ হয়ে যেত। কিন্তু আমি এক লাফে পেন্ট্যাকলের ভালভ, জলের শিশি, চক দিয়ে আঁকা বৃত্ত, সব পেরিয়ে বাইরে এসে পড়লাম।

হাতটা কোনো প্রকাণ্ড শিকারি প্রাণীর মতো থাবা মারল আমার দিকে। কিন্তু আগের রাতে ঠিক যা হয়েছিল, এবারও তাই হল। একটা অদৃশ্য প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে হাতটা আবার পিছিয়ে গেল পেন্ট্যাকলের মধ্যে।

আমি গ্রে রুমের দরজাটা খোলার চেষ্টা করলাম! সাপের চোখে চোখ রেখে স্থির হয়ে যাওয়া প্রাণীর মতো ওই হাতটা থেকেও আমি নজর সরাতে পারছিলাম না। তবু, কোনোভাবে, আমি দরজাটা খুলে করিডরে বেরিয়ে আসতে পারলাম। দরজাটা সজোরে বন্ধ করা, পকেট হাতড়ে চাবিটা বের করা, সেটা দিয়ে দরজাটা তালাবন্ধ করা, প্রায় দৌড়ে নিজের ঘরে ঢোকা, আর ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের বিছানায় কুঁকড়ে শুয়ে পড়া: এই কাজগুলো আমি ভেবে করিনি, কারণ ভাবতে গেলে হয়তো পারতাম না। হয়তো অজ্ঞানই হয়ে যেতাম!

তবে একটা দৃশ্য আমার মনে ছিল, আছে, থাকবে।

একটা বিশাল, কালো হাত বারবার চেষ্টা করছে পেন্ট্যাকলের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসতে, কিন্তু পারছে না!

 

আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বা, একথাই বলা ভালো যে অবসাদ, ক্লান্তি, ভয়, সাংঘাতিক বিপদের হাত থেকে শেষ মুহূর্তে রক্ষা পাওয়ার অনুভূতি, সব মিলিয়ে আমার শরীর আর মনের ওপর অচেতনতার একটা পুরু চাদর টেনে দিয়েছিল। পিটার কফি নিয়ে এসে আমাকে না তুললে আমি কতক্ষণে উঠতাম, কে জানে!

কফি খেয়ে, ফ্রেশ হয়ে, আমি পিটারকে নিয়ে গ্রে রুমে গেলাম।

ঘরের মোমবাতিগুলো তখনও জ্বলছিল। পেন্ট্যাকলের নীল আলোগুলো নিষ্প্রভ হয়েও টিঁকে ছিল। আমার গড়া সেই দুর্গের মধ্যে নিতান্ত সামান্য চেহারায় পড়ে ছিল আংটিটা।

ঘরের অন্য কিচ্ছুটি ছোঁয়া হয়নি।

দানবটা ইলেকট্রিক পেন্ট্যাকলের ওই গণ্ডি পেরোতে পারেনি!

আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। দরজাটা তালাবন্ধ করলাম। আরো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, ফ্রেশ হয়ে, ব্রেকফাস্ট সেরে, আমি বেরোলাম কিছু জরুরি জিনিস নিয়ে আসতে। দুপুরের মধ্যেই আমি সেসব নিয়ে ফিরে এলাম ওই বাড়িতে। জিনিসগুলো ছিল একটা অক্সি-হাইড্রোজেন জেট, আর দুটো সিলিন্ডার। আমি সেসব নিয়ে গ্রে রুমে ঢুকলাম, পাঁচ মিনিটে আংটিটা একটা গরম ধাতুর পিণ্ডে পরিণত হল।”

 

কারনাকি কথা থামিয়ে, কোটের পকেট থেকে একটা কাগজে মোড়া কিছু একটা জিনিস বের করে আমায় দিল। আমি সযত্নে কাগজের মোড়কটা খুলে দেখলাম, তার মধ্যে রয়েছে ধাতুর একটা ছোট্ট বলের মতো জিনিস। অনেকটা সীসার মতো রঙ সেটার, কিন্তু অনেক বেশি উজ্জ্বল।

“হুম!” জিনিসটা আমরা সবাই নেড়েচেড়ে দেখার পর আমি জানতে চাইলাম, “তা এরপর কি ঘরটাতে আর কিছু… মানে আর কোনো সমস্যা হয়নি?”

“নাঃ!” পাইপে তামাক ঠেসতে-ঠেসতে বলল কারনাকি, “আমি সেই রাতে, এবং তারপর আরো দু’রাত ওই ঘরেই ঘুমিয়েছিলাম। প্রথমে তো পিটারের হার্ট অ্যাটাকই হয়ে যাচ্ছিল আমার পরিকল্পনা শুনে, কিন্তু তৃতীয় রাতের মধ্যে ও অভ্যস্ত হয়ে গেছিল। আমার তো মনে হচ্ছিল, ঘরটা একেবারে সাধারণ, আর পাঁচটা ঘরের মতোই হয়ে গেছে বলে বেচারি একটু মুষড়েই পড়েছে!

আসলে রাস্তা! একটা রাস্তা খোঁজে শুধু ওরা। সেটা পেলেই দানব হোক বা মানব, অন্ধকার ঢুকে পড়তে পারে আমাদের ঘরে, আমাদের দুর্গে!”


মণিময় দারোগা


অলংকরণ - সুমিত রায়
(১)

এলেম আছে বটে মণি দারোগার! আশেপাশের পাঁচ-সাতটা গাঁয়ের লোক একবাক্যে তাঁর নামে সেলাম ঠোকে। মণি দারোগা যাকে বলে এক্কেরে নয়নের মণি সকলের। হ’বেন নাই বা কেন! যবে থেকে তিনি বটুকপুর থানার অফিসার-ইন-চার্জ হয়েছেন তবে থেকে এ তল্লাটে আর একটাও চুরি ডাকাতি হয়েছে বলে দেখাতে পারবে কেউ? গেরস্ত মানুষেরা দরজা জানালা হাট করে খুলে নিশ্চিন্তে নাক ডেকে ঘুমোন। একটা স্টিলের গেলাস কিংবা ছেঁড়া গামছাটুকুনও চুরি হয়না।

বটুকপুরের দোকানগুলোতেও আজকাল আর তালা চাবি বিক্রি হয় না। সেই সেবার মদন চাটুজ্জের সদ্য বিয়ে হওয়া ছোটোজামাই কী বিপদেই না পড়ল। অষ্টমঙ্গলায় মেয়ে বাপের বাড়ি এসেছে জোড়ে, সেখান থেকে সটান যাবে বর্ধমান। ফেরার দিন হ’ল চিত্তির। সাধারণত বড় বড় সুটকেস তো সব বাসের মাথাতেই তুলে দেয় কন্ডাকটার-রা। এদিকে সুটকেসের ছোট্ট পিচ্চি তালাটা গেছে ভেঙ্গে। দোকানে দোকানে ঘুরে মদন চাটুজ্জে তালা আর পায়না। শেষমেষ নতুন জামাইকে নারকেল দড়ি দিয়ে বাঁধা সুটকেস নিয়েই বর্ধমান যেতে হ’ল।

নিন্দুকে অবশ্য বলে মণিময় দারোগা তন্ত্রমন্ত্র জানেন, তাঁর নাকি পোষা ভূত আছে একগণ্ডা। সেই ভূতেরাই তো সব চোর ডাকুদের শায়েস্তা করে রাখে। যেমন মণিময় মুকুজ্জে দারোগা হয়ে আসার মাস খানেক পরের কথাটাই ধরুন না। রামাপদ চোর তার সিঁধকাঠিটি নিয়ে হরনাথ মল্লিকের গোয়াল ঘরের মাটির দেওয়ালে ঝুরঝুর করে মাটি খুঁড়তে শুরু করেছিল সবে। হরনাথ সম্পন্ন কৃষক, সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ মানুষ। তিন চারটে জার্সি গরু পোষা রয়েছে, দাম কম নয় সেগুলোর। গোয়ালঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে বাড়ির মধ্যে চলে যাওয়ার পথ রয়েছে। রামাপদ তাই সিঁধ দিয়ে ভেতরে ঢুকে তারপর গরু নিয়ে গোয়ালঘরের দরজা খুলে পালানোর মতলব ভেঁজেছিল। কিন্তু যেই না আদ্ধেকটা শরীর ফুটো দিয়ে গোয়ালের ভেতর গলিয়েছে ওমনি ওপাশ থেকে কে যেন কানের কাছে বলে উঠল,

-“ছ্যা ছ্যা রামাপদ শেষমেষ তুমি গরু চুরি করবে! তোমার বাবা কৃষ্ণপদ কত বড় চোর ছিলেন, জমিদারের গিন্নির গলার সীতাহার চুরি করে তোমার মা-কে উপহার দিয়েছিলেন। তোমার ঠাকুর্দা হরিপদ, ইংরেজ দারোগার কোমর থেকে পিস্তল চুরি করে শ্রীপতি ডাকাতকে দশটা মোহরের বিনিময়ে বেচে দিয়েছিলেন। এইসব নমস্য ব্যক্তিদের বংশধর হয়ে তুমি শেষটায় গরু চুরি করবে?”

আদ্ধেক শরীর নিয়ে ঝুলন্ত ত্রিশঙ্কু অবস্থায় কেউ যদি অমন কানের পাশে ফিসফিস করে, তাহলে অতি বড় ঠাণ্ডা মাথার চোরেরও পিলে চমকে যেতে বাধ্য! রামাপদ তো কোন ছার! ভয়ের চোটে চেঁচিয়ে উঠল,

-“ক্কে কে ওখানে? কে কথা কইল?”

কিন্তু শুকনো গলা দিয়ে ‘কে’-এর পর বাকিটা শুধু ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ বেরলো। তারপর শুরু হ’ল বেদম কাশি। এদিকে রাতদুপুরে ওরকম কাশি আর ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে ভড়কে গিয়ে গোয়ালঘরের কোমলি ধবলি আর হেবলি, তিন জার্সি গাই মিলে গলার ঘন্টা প্রবল বেগে নাড়িয়ে, পা দাপিয়ে সে এক মহা শোরগোল শুরু করল। তাদের ক্ষুরের ঠোকায় গোয়ালঘরের মেঝেয় পড়ে থাকা গোবর খানিক ছিটকে এসে পড়ল রামাপদর মাথায়। রামাপদ কোনওমতে হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় করে সিঁধের গর্তটা থেকে গোয়ালঘরের বেরোতে চেষ্টা করতে গেল। গা ভর্তি তেলের গুণে পিছলে খানিকটা বেরলেও মাটি লেগে গিয়ে তেলতেলে ভাবটা উবে গেল আর হেথাহোথা বেশ ভালোরকমই ছড়ে গেল, ছাল চামড়া উঠে গেল। সেই অবস্থাতেই কোনওমতে ছুটতে শুরু করল রামাপদ। যতই ছুটুক না কেন একটা বিটকেল ‘হাঃ হাঃ হাঃ’ করে অট্টহাসিও যেন ওর পেছন পেছন ছুটতে লাগল। বাড়িতে ঢুকেই দরজায় খিল এঁটে, কান অব্দি কাঁথামুড়ি দিয়ে, শুয়ে পড়ল। তারপর তো দিন আষ্টেক আর কাজেই বেরোতে পারেনি বেচারা। খালি মনে হত যেন সেই অট্টহাসিটা পেছনে তেড়ে আসছে।

(২)

শুধু কি রামাপদ চোর? মাধব ডাকাতও কি ভুক্তভোগী নয় নাকি? এমনিতে মাধব বেচারা ডাকাতির বিজনেসে বড় একটা নাম করতে পারেনি। তবে মাধবের ওপর পূর্বপুরুষদের নামের বোঝা ছিলনা, রামাপদ চোরের মত। মাধবের পূর্বপুরুষরা আবার কলকাতা শহরের সব এক একটা আস্ত গাঁটকাটা, পকেটমার। মাধবেরও হাতে খড়ি হয়েছিল পকেট কাটাতেই। হাতের আঙুলের ফাঁকে আধখানা ব্লেড রেখে নরম লাউয়ের ওপর কাপড় জড়িয়ে, তাইতে দিনের পর দিন প্র্যাকটিস করেছিল মাধব। লাউয়ের খোলায় একটা আঁচড়ও পড়ত না এমনই নিপুণ হাত হয়েছিল মাধবের।

তা একদিন শ্যালদা স্টেশনে মাধব গেল পৈতৃক ব্যবসায় হাতেখড়ি করতে। সব ঠিকঠাকই চলছিল কিন্তু নির্জনে লাউয়ের খোলায় মকশো করা আর ওই ভিড়ে ঠাসা স্টেশনে, হকারের ঠেলা, ঠেলাগাড়ির গুঁতো, কুলির ধাক্কা খেয়ে ব্লেড চালানো আরেক জিনিস। একজন নাদুসনুদুস শেঠজি টাইপের লোকের হাতের আঙ্গুলে বেশ চকমকে পাথর বসানো সোনার আংটি, গলায় হার দেখে, পকেটে মোটা মানিব্যাগ থাকবে এই আশায়, আঙুলের ফাঁকে ব্লেডটা বাগিয়ে ধরে এগিয়েছিল পা টিপে টিপে। এমন সময় পেছন থেকে এক কুলি এসে হুড়মুড়িয়ে পড়ল ঘাড়ে, মাধবও ওমনি ছিটকে শেঠজীর বদলে পাশের মুশকোমত ষণ্ডামার্কা একটা লোকের ঘাড়ে পড়ল। হাতের ব্লেডটায় খোঁচা লেগে লোকটার সার্টিনের শার্টটা “ফ্যাঁঅ্যাঁসস্” করে আর্তনাদ করে অনেকটা ফেঁসে গেল। জামা তো ফাঁসলই, সেই সাথে ফেঁসে গেল বেচারা মাধব। লোকটা ঘুরে কপাৎ করে চেপে ধরল মাধবকে। তারপর যা হওয়ার তাই হ’ল, জনতা জনার্দন উত্তম মধ্যম পিটিয়ে, হাতের সুখ করে নিল।

কোনওমতে পকেটমারদের আড্ডায় ফিরে আসার পর মাধবের জীবিকাতুতো ভাই বেরাদররা তো বটেই, এমনকি মাধবের নিজের বাপ-কাকা অব্দি বেজায় হাসি ঠাট্টা করল ওকে নিয়ে। ওর নামই দিয়ে দিল সবাই “তালকানা মেধো”। তখনই মেধো মানে মাধব প্রতিজ্ঞা করেছিল এই পকেটমারীর অপমানের লাইনে থাকবে না মোট্টে আর। না না তাই বলে সৎ পথে করে কম্মে খাবে এতটাও বড় শপথ করেনি। কথায় বলে না ‘মারি তো গণ্ডার/ লুটি তো ভাণ্ডার’, তাই মেধো ঠিক করল ডাকাতির দল খুলবে। হ্যাঁ! ওইটে ভারি সম্মানের কাজ, লোকের পিটুনি খাওয়ার চেয়ে লোককে পিটুনি দেওয়ার সুযোগ বেশি। রণ-পা পরে হাঁটাটাও বেশ জম্পেশ হবে। আর ওই ‘হারে রেরে রেরে’ করে মশাল বল্লম নিয়ে তেড়ে যাওয়াটার মধ্যেও একটা বেশ ইয়ে মানে বীর বীর ব্যাপার আছে।

কিন্তু কলকাতা শহরের বুকে ডাকাতদল করাটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে, মাধব ভুলবশতঃ মার খেলেও বুদ্ধি যে একেবারেই নেই তা নয়। তাই চলে এল পিসির বাড়ি বটুকপুরে। এখানে দু’চারটে ছিঁচকে চোরের সাথে দোস্তি করল। তাদের একটু কলকাত্তাইয়া চুরি ডাকাতি পকেটমারির গল্প শুনিয়ে বেশ একটু সমীহ আদায় করল। তারপর জনা চারেক চ্যালা হ’তেই ডাকাতদল খুলল। এদিকে ডাকাতদল খোলায় পিসি ভারী অসন্তুষ্ট হয়ে মাধবকে দিল ঘর থেকে বার করে। তা ভালোই হয়েছে, ডাকাতদলের সর্দার পিসির বাড়িতে থাকে, পিসির পান সেজে দেয়, পুকুর থেকে জল বয়ে এনে দেয়, প্রয়োজনে আলু পটল ঝিঙে কেটে দেয় এমনটা কেউ শুনেছে কখনও? তার চে’ জঙ্গলের মধ্যে পোড়ো মন্দিরে বাস করা বেশি ভালো।

(৩)

তা দলবল গড়ার পর মন্দ ডাকাতি হচ্ছিল না। বিশু গাইনের যাত্রাদলের তাঁবুতে হামলা করে বেশ কিছু জরি চুমকি বসানো রাজা মন্ত্রীর পোশাক বাগিয়েছিল। সেগুলো মাঝেসাঝেই অঙ্গে গলিয়ে বসে থাকে মাধব। বেশ কেষ্টবিষ্টু লাগে নিজেকে। তারপর সেবার দুর্গাপুজোর ভাসানের পরেরদিন চণ্ডীমণ্ডপে হামলা করে প্যাণ্ডেলের বাঁশ কাপড় ত্রিপল সব খুলে এনেছিল। যদিও মাধবের ডানহাত ভেনো একবার বলার চেষ্টা করেছিল, এইসব ডাকাতিগুলোর সাথে ছিঁচকে চুরির আর পার্থক্যটা কোথায়! কিন্তু মাধব তাকে এক হুঙ্কার দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছিল।

এতবড় মূর্খ যে ডাকাতি আর ছিঁচকে চুরির মধ্যে তফাৎ বোঝে না হতভাগা। ইচ্ছে করে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে দল থেকে বার করে দেয়, কিন্তু নেহাতই দলের সবচেয়ে করিৎকর্মা ডাকাত ওই ভেনোটাই কিনা। আরে বাবা এই যে ডাকাতি করতে বেরনোর আগে স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র পরে মা কালীর ছ’ইঞ্চির বাঁধানো পটের সামনে যে বলি দেয়, এটা কোনও ছিঁচকে চোর করে? বলির ব্যাপারেও কত ফ্যাঁকড়া ভেনোর, বলে কিনা নরবলি না হোক নিদেনপক্ষে একটা পাঁঠাবলি হোক। মাধব কি মাংসের দোকানের কসাই নাকি যে পাঁঠা কাটবে। মাধব বিশুদ্ধ বৈষ্ণবমতে ডাকাত তাই সব্জি বলি দেয়। ঝিঙে চিচিঙে কুমড়ো আখ সব ওর হাতের কাঠারির এক কোপে দু’টুকরো হয়ে যায়।

যাকগে এভাবে মাধব আর মাধবের দলের বৈষ্ণবমতে নিরামিষ ডাকাতি ভালোই চলছিল কিন্তু গোল বাঁধল মণিময় দারোগা এখানে আসার কিছুদিন পরেই। অনেকদিন ধরেই মাধব ডাকাতির প্ল্যান ছকে রেখেছিল কালুরাম কলুর তেলের ঘানিতে। বেশ ক’টা জারিকেন ভর্তি সর্ষের তেল ডাকাতি করে আনতে পারলে কাজে দেবে। যদিও ভেনো এখানেও বাগড়া দিয়ে বলেছিল যে,

-“সর্ষের তেল কি ডাকাতি করার মত বস্তু?”

মাধবও খেঁকিয়ে উত্তর দিয়েছিল,

-“কেন সর্ষের তেল কোন কাজে লাগেনা শুনি? রান্না করতে, গায়ে মাখতে, প্রদীপ জ্বালাতে...”

-“নাকে দিয়ে ঘুমোতে...” মাধবের কথার মাঝেই ফোড়ন কেটেছিল ভেনো।

মাধব এইসব ছোটোখাটো বাধাতে পাত্তা না দিয়ে বলির কাজে মন দিয়েছিল। স্নান টান সেরে শুদ্ধ পট্টবস্ত্র পরে কপালে ইয়া লম্বা সিঁদুরের তিলক কেটে বলির কাঠারি নিয়ে রেডি হয়েছে। সামনের বেদীতে একটা একটা করে সব সব্জী সাজানো।

‘ওম হুম হ্রিং ক্রিং ট্রিং’ বলে কাঠারিটা তুলেছে, ওমনি কে যেন বলে উঠল,

-“দেখিস মাধব, লাউ কাটতে গিয়ে যেন আবার কারোর জামা কেটে ফেলিসনি!”

মাধব তো ভয়ানক রকমের হতভম্ব হয়ে ইতিউতি দেখতে লাগল, সব্বার আগে দেখল ভেনোর দিকে। নাহ্! সে ব্যাটা তো চুপটি করে বসে বসে নখ কামড়াচ্ছে। বাকি দুই মক্কেল গজা আর ভজা বসে বসে ঝিমোচ্ছে সব্জির ঝুড়ি নিয়ে। এক একটা করে সব্জি এগিয়ে বেদীতে রাখে, আর মাধব ঘ্যাঁচ করে কাটে। বেদীতে একটা কুমড়ো রেখে বসেছিল দু’জন। মাধবের কাঠারি মাঝ আকাশে থেমে যেতে গজা-ভজা বলে উঠল,

-“কী হ’ল সদ্দার! কী হ’ল সদ্দার!”

মাধব নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবল নিশ্চয়ই ভুল শুনেছে, বলল,

-“কিছু নয়! লাউটা সরিয়ে একটা আখ বসা দেখি।”

গজা-ভজা বলে উঠল,

-“লাউ কোথা সদ্দার? কুমড়ো তো! তোমার পিসির বাড়ির মাচা থেকেই তো তুলে আনলুম।”

-“অ্যাঁ কী সব্বোনাশ করেছিস! পিসি তো এবার আমাকেই কুমড়োর ছক্কা বানিয়ে ছেড়ে দেবে রে!”

মাধব দাঁত কিড়মিড় করে ফের কাঠারি তোলে, সামনে চেয়ে দেখে কুমড়ো কই? সবুজ চকচকে একটা লাউ সামনের বেদীতে। আর কানের কাছে ফিসফিসিনি আওয়াজ,

-“কাঠারি দিয়ে কাটবি মেধো নাকি আধখানা ব্লেড আনব?”

এইবার মাধব কাঠারি ফেলে এক লাফে বেদী থেকে তিন হাত দূরে সরে গেল। সেবারের মত বলি ক্যানসেল হয়ে গেল। মাধব ঘামতে ঘামতে পিসির বাড়ি গিয়ে জ্বর এসেছে বলে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল, পিসির চ্যাঁচানি শুনতে শুনতে।

-“কোন অলপ্পেয়ে হতচ্ছাড়া ড্যাকরা অমন নধর কুমড়োখানা মাচা থেকে তুলে নিয়ে গেল! পোড়ারমুকো! ওই কুমড়ো তোর পেটে সইবে না অনামুখো!”

তারপর থেকেই আর ডাকাতি করতে বেরোতে সাহস হয় না মাধবের। মাধবের দলের আরেক চ্যালা বগলা হ’ল গিয়ে গুপ্তচর। বগলা খবর আনল নতুন দারোগা মণিময় নাকি ভূত পোষেন। আর সেই ভূত বগলদাবা করে নিয়েই নাকি তিনি বটুকপুরে এসেছেন। এই ভূতই নাকি বটুকপুরের সব চোর ডাকাতদের অবস্থা টাইট করে রেখেছে।এই খবর পাওয়ার পর ভেনো ভজা গজা অনেক করে বললেও খুব একটা লাভ হয়নি। মাধব কিছুতেই আর বলিও দেয়নি, ডাকাতিও করতে বেরোয়নি।

(৪)

রামাপদ, মাধব, মাধবের স্যাঙাতরা, আরও এদিক ওদিকে গাঁয়ের চোরেরা সব বেজায় নাজেহাল অবস্থায় দিন কাটাতে লাগল। যেই কেউ চুরিচামারি বা অন্যায় কোনও কাজ করতে যায় ওমনি কানের কাছে সেই ফিসফিস। ওদিকে মণিময় দারোগা দিনদিন একটার পর একটা পদক বাগাচ্ছেন পুলিশ বিভাগ থেকে ওঁর অসামান্য কর্মকাণ্ডর জন্য, আর ভুঁড়িটিও সেই সাথে বাগাচ্ছেন। একেই বলে ‘ঝড়ে কাক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে।”

এই চোর ডাকাতদের দলবলের মধ্যে ভেনো বেশ বুদ্ধি ধরে, আট ক্লাস অব্দি পড়ালেখা করেছে। ভেনো চুপিচুপি বগলাকে ডেকে বলল,

-“হ্যাঁরে ব্যাটা বগলা! তোর হঠাৎ কেন মনে হল যে মণিময় দারোগা ভূত পোষে? ভূত কি গরু না ছাগল? ভূত দুধ দেয় গোবর দেয় যে লোকে পুষবে? আর পুষবে বললেই হ’ল? ভূত পাবে কোথায়? সে কি হাটে বাজারে পাঁচ হাজারটাকায় জোড়া কিনতে মেলে? যদিও বা মেলে, সে ভূত মানুষের পোষ মানবে কেন? উল্টে মানুষেরই ঘাড় মটকে মেরে ফেলবে।”

ভেনোর এত প্রশ্নে বগলা বেজায় রেগে গিয়ে বলল,

-“ত্ ত্ তবে কী আমি মিছে বলচি? ওই তো সেদিন থ্ থ্ থানার হাবিলদার ম্ ম্ মাণিকলাল আর প্ প্ প্ পুরন্দর হাটে এসেছিল। আমিও তখন ঘুরঘুর করছিলুম হাটের এদিক ওদিক, যদি কিছু হ্ হ্ হাতসাফাই করতে পারি সেই মতলবে। এমন সময় দেখলুম ওরা নিজেদের মধ্যে ব্ ব্ বলাবলি করছে। ‘বড়সাহেবের পোষা ভ্ ভ্ ভূত আছে।’ আমি নিজের কানে আ আ আড়ি পেতে শুনলুম।”

বগলা তোতলাতে তোতলাতে যা বলল সেটা সবাই একবাক্যে বিশ্বাস করলেও ভেনোর মনে সন্দেহ জাগল। ভেনো স্থির করল সরেজমিনে তদন্ত করেই দেখবে। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। সন্ধেবেলায় সূয্যিমামা পাটে যেতেই একটা কালো চাদর মুড়ি দিয়ে ভেনো চলল মণিময় দারোগার বাড়ির দিকে। বেশ বড়সড় সাদা বাড়ি, সরকার বাহাদুরের টাকায় তৈরি, বটুকপুরের দারোগার জন্য। বাড়ির চারদিকে উঁচু বেড়া দেওয়া। তবে বেড়ার গায়ে একটা বাবলাগাছ রয়েছে, তার ডালপালাগুলো বেড়া টপকে বেশ ভেতরে বাড়ির জানালার সামনে অব্দি চলে গেছে। ভেনো বহুকষ্টে কাঁটা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে একটা ডাল বেয়ে জানলার কাছে গিয়ে উঁকি মারল ঘরের ভেতর।

এই ঘরটা মনে হয় বৈঠকখানাই হবে। একটা মেহগনি কাঠের গোল টেবিলের ওপর ফুলদানি রাখা। একটা চেয়ার টেনে বসে আছেন মণিময় দারোগা। দারোগাগিন্নি একটা ট্রে-তে করে দু’কাপ চা এনে টেবলে রেখে, আরেকটা চেয়ার টেনে বসেন।

চা-টা খেতে গিয়ে দারোগাগিন্নি বলে ওঠেন,

-“এই যাহ্! বিস্কুটের কৌটাটা আনতে ভুলে গেলুম।”

মণিময় দারোগা হাঁকলেন,

-“সুখো, ওরে সুখময়! দে না বাবা বিস্কুটের কৌটোটা তাক থেকে পেড়ে এনে একটু।”

চোখ দুটো ছানাবড়ার মত করে ভেনো বাবলা গাছের ডালে বসে দেখল, একটা কৌটো হাওয়ায় উড়তে উড়তে এসে থামল মণি দারোগার মাথার কাছে, শূন্যে ভাসতে লাগল। আপনা আপনিই কৌটোর ঢাকনার প্যাঁচটা ঘুরে ঘুরে খুলে গেল। দুটো বিস্কুট বেরিয়ে এল কৌটোর ভেতর থেকে। সোজা ভেসে ভেসে দুলে দুলে ল্যান্ড করল মণি দারোগার প্লেটে। ফের দু’টো বিস্কুট একইভাবে উড়ে এসে জাঁকিয়ে বসল দারোগাগিন্নির প্লেটে। তারপর কৌটোর ঢাকনা বন্ধ হয়ে নিজে থেকেই যথাস্থানে চলে গেল। শুধু তাই নয়, ঘর ঝাড়ু দেওয়াও নিজে নিজেই করছে একটা মুড়ো ঝাঁটা। চা খাওয়া হ’তে টেবলের ওপরের কাপ প্লেটগুলোও ওই বিস্কুটের মত ভেসে ভেসে চলে গেল, রান্নাঘরের দিকে বোধ হয়।

কিন্তু এমন অশৈলী কাণ্ড দেখে ভেনো আর যথাস্থানে থাকতে পারল না। বাবলা গাছের কাঁটাভরা ডালে হাত পা ছিঁড়ে স্থানচ্যূত হয়ে পড়ল নিচের ঝোপে। ঝোপে পড়ামাত্র সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল, ভেনো হাড়ে হাড়ে মানে চামড়ায় চামড়ায় বুঝতে পারল বিছুটির ঝোপে পড়েছে। কিন্তু ঝড়ঝড় করে শব্দ হওয়াতে মণি দারোগা উঠে এসে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বাজখাঁই হাঁক ছেড়েছেন,

-“কে রে ওখানে?”

তাই বিছুটির ঝোপের মধ্যেই চুপ করে ঘাপটি মেরে বসে রইল ভেনো। কিছুক্ষণ পরে মণি দারোগা জানালার কাছ থেকে সরে যেতে, কোনওক্রমে উঠে গা চুলকোতে চুলকোতে দৌড় লাগাল কষে।

(৫)

পৈতৃক প্রাণটা হাতে নিয়ে ফিরে তো এল ভেনো কিন্তু বুঝতে পারল যে সুখো ভূতের জন্যই ওদের এই দুরবস্থা। কাজেই ওদের চুরি ডাকাতির ব্যবসা নির্বিঘ্নে চালাতে গেলে মণিময় দারোগার পোষা সুখময় ভূতের একটা গতি করতে হবে। মাধবের একার দ্বারা কিছু হবে বলে মনে হয় না। এলাকার সমস্ত চোর ডাকাতকে এক করতে হবে। এত সহজে ঘাবড়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ভেনো মস্তান নয়।

যেমন ভাবা তেমনি কাজ, চারপাশের এলাকার সব চোর ডাকাতদের জড়ো করে নিজের মতলবের কথা বলল ভেনো। মাধব দলের লিডার হ’লেও ভূতে বড্ড ভয় পায় তাই এ ব্যাপারে ভেনোর কর্তৃত্বই নির্বিবাদে মেনে নিল।

নির্দিষ্ট দিনে, বটুকপুরের জঙ্গলের পোড়ো মন্দিরে মাধব ডাকাতের আস্তানায় এসে হাজির হ’ল তান্ত্রিক ঘুটঘুটেশ্বর। অন্ধকারের মত কালো ঘুটঘুটে রঙ বলে তাঁর নাম ঘুটঘুটেশ্বর। তাঁর গুরু হ’লেন ফটফটেশ্বর, তিনি খড়ম ফটফটিয়ে হাঁটতেন কিনা। তাঁর গুরু হ’লেন কুটকুটেশ্বর। শোনা যায় যে তাঁর দাড়ি আর জটার এমন জঙ্গল ছিল মুখ আর মাথাময় যে সেখানে উকুন তো নস্যি, ছারপোকা, তেলেপোকাও বাস করত নাকি!

ভালোমত খোঁজখবর করেই তান্ত্রিক জোগাড় করেছে ভেনো। তান্ত্রিক এসেই হুঙ্কার ছেড়ে ডাকল,

-“নমোঃ গুরু ফটফটেশ্বর! নমোঃ তস্য গুরু কুটকুটেশ্বর! কোথায় তোদের দারোগার পোষা ভূত। এক্ষুনি তার দফা শেষ করব। বাঘে ছুঁলে আঠেরো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা, ঘুটঘুটেশ্বর ছুঁলে ঘায়ের ওপর ঘা! মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা! গোদের ওপর বিষফোঁড়া!”

বলতে বলতে উত্তেজনায় পোড়ো মন্দিরের গায়ের বুড়ো অশ্বত্থগাছের শেকড়ে প্রায় হুমড়ি খেয়েই পড়ে যাচ্ছিলেন তান্ত্রিক মহাশয়। বগলা ছুটে গিয়ে ধরল তান্ত্রিকমহাশয়কে।

-“ঘ্ ঘ্ ঘ্ ঘুট্ ঘুট্...”

বগলার জিভের এই ঘ্যাচাং করে ব্রেক লেগে ঘটঘটাং চিৎকারে তান্ত্রিক মহাশয় আর্তনাদ করে উঠলেন,

-“ওগো মাগো ঘ্যাঁঘা ভূতে ধরলো গো...”

ভেনো জলদি ছুটে এসে সামাল দেয়,

-“তান্ত্রিক ঠাকুর, ও ঘ্যাঁঘা ভূত হ’তে যাবে কেন! ও তো বগলা!”

তান্ত্রিক নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন,

-“জানি হে ছোকরা! আমি আবার ভূত চিনব না?! কোথায় তোদের সুখো ভূত? তাকে ঝেড়ে যদি দুখোভূত না করে দিয়েছি, তবে আমার নামটাই বদলে দিস।”

এই বলে নানারকম বিটকেল বিটকেল জিনিস ঝোলা থেকে বার করে যজ্ঞের আয়োজন করতে থাকেন ঘুটঘুটেশ্বর। গিরগিটির চোখ, কাকের পালক, শেয়ালের লেজ, ব্যাঙের ঘিলু, দেখে গা গুলিয়ে ওঠে সকলের। ‘হ্রিম ক্লিম ফট্ ফটাস’ করে মন্ত্র পড়তে থাকে ঘুটঘুটেশ্বর।

ওদিকে ভেনোর প্ল্যানমতো ভজা আর গজা দৌড়ে যায় থানায়। ভর দুপুরবেলায় ভুঁড়ির ওপর চেপে বসে থাকা বেল্টটা আলগা করে, চেয়ারে পা তুলে মিহি সুরে নাকটা ডাকতে শুরু করেছিলেন মণিময়। দুপুরে গিন্নি চারতলা টিফিন ক্যারিয়ারে চর্ব্য চোষ্য ভরে সুখময়ের হাতে করে আকাশপথে পাঠিয়েছিলেন। খাওয়াটা একটু অপরিমিতই হয়ে গেছে। ঠিক এমন সময় হাঁউ মাঁউ করে ভজা আর গজা এসে আছড়ে পড়ল মণি দারোগার দুই হাঁটুর ওপর। মণিময় চমকে বিষম খেয়ে মাথা চাপড়াতে লাগলেন।

ভেনোর দেওয়া ট্রেনিং অনুযায়ী ভজা আর গজা পালা করে করে বলে চলল,

-“হুজুর মাই বাপ!”

-“হুজুর ধর্মাবতার!”

-“বটুকপুরের জঙ্গলে...”

-“পোড়ো মন্দিরে...”

-“এক বিটকেল কাপালিক এসেছে...”

-“নরবলি দেবে বলে আয়োজন করেছে...”

-“হুজুর আপনি বাঁচান!”

-“হুজুর আপনি রক্ষা করুন!”

‘কাপালিক’, ‘নরবলি’, এসব শুনে তো বেজায় ভড়কে গেলেন মণিময় দারোগা। বিড়বিড় করে জপতে থাকলেন,

-“বাবা সুখময়! বাছা একটু দ্যাখো দিকিনি! কীসব নরবলি কাপালিক বলছে! ওগুলো তো তোমার ডিপার্টমেন্ট কিনা।”

এদিকে জোরে জোরে ভজা আর গজাকে বললেন

-“ঠিক আছে ঠিক আছে! তোরা যা আমি এক্ষুনি ফোর্স নিয়ে যাচ্ছি।

পুরন্দর! মাণিকলাল! বন্দুক লে আও!”

ভজা আর গজা মুখ টিপে হাসতে হাসতে থানা থেকে বিদেয় হ’ল।

ওদিকে সুখময় তখন গিন্নিমার আজ্ঞামত আসনে ফোঁড় তোলা, শুকনো জামা কাপড় তুলে এনে ইস্ত্রি করা, ভাঁজ করা, বিকেলের জলখাবারের লুচির ময়দা মাখা, জল তোলা, সুপুরী কাটা, সব কাজ একসাথে করছিল। অবশ্য সুখময়ের এসব বাম হাতের তর্জনীর কাজ। শুধু ইশারা করলেই কাজ হ’তে থাকে আপনা আপনি। হাত লাগাতে হয়না, যন্ত্রপাতি এমনিই চলে নিজে থেকে। তাই গিন্নিমা ওকেই সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে দুপুরবেলায় একটু গড়িয়ে নেন। দারোগা মশাই স্মরণ করতেই সুখময়ের ধোঁয়ার টিকি খাড়া হয়ে উঠল! ছুটল... ইয়ে মানে উড়ল বটুকপুরের জঙ্গলের পোড়ো মন্দিরের কাপালিকের সন্ধানে।

(৬)

পোড়ো মন্দিরে ততক্ষণে বিশাল এক আগুন জ্বেলেছে ঘুটঘুটেশ্বর। তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে নেত্য করে চলেছে আর মন্ত্র পড়ছে,

-“ওম দুম ফটাস! হিং ক্লিং চটাস! ফটফটায় পিড়িং! কুটকুটায় কিড়িং! ফট ফটাস! চট চটাস!”

ওই ফটাস আর চটাসগুলো অবশ্য মশা মারার শব্দ। কাপালিকের চারপাশে রামাপদ চোর, মাধব ডাকাত, ভেনো শাগরেদ, বগলা গুপ্তচর, ভজা-গজা, আশপাশের গাঁয়ের আরও খানক’তক চোর ডাকু, সব উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তান্ত্রিক কেমন করে মণি দারোগার পোষা ভূতটাকে ধরে সেটা দেখবে বলে।

হঠাৎ একটা জোরে ঝড় উঠল মন্দিরকে ঘিরে। চারপাশের গাছের পাতা উড়ে এসে পড়তে লাগল যজ্ঞের আগুনের ওপর। ধুলোয় ঢেকে গেল চারদিক। চারপাশের ভিড় নিমেষে পাতলা হয়ে এল। সবাই পোড়ো মন্দিরের ভেতরে গিয়ে ঢুকল এক লাফে। ভাঙ্গা দেউলের মধ্যে যদি ঠাকুর আগলায় ভূতের হাত থেকে। ওদিকে ঘুটঘুটেশ্বর তান্ত্রিক মনে মনে বেজায় ভয় পেলেও মুখের জোরটা বহাল রাখে,

-“কে রে হতচ্ছাড়া মর্কট ভূত! শিগগির দেখা দে। নাহলে এক্ষুনি মন্তর পড়ে তোকে নিকেশ করে যমের দক্ষিণ দোরে পাঠাব। জানিস আমি কে? আমি ঘুটঘুটেশ্বর তান্ত্রিক, আমার গুরু ফটফটেশ্বর তান্ত্রিক, তস্য গুরু কুটকুটেশ্বর ... ”

উড়ন্ত ধুলোগুলো আস্তে আস্তে একটা জমাট অবয়ব ধরে। সেই ধুলোর মূর্তি হা হা করে হেসে বলে ওঠে,

-“ও ঘুটঘুটে তান্ত্রিক! সে সব তো বুঝলুম তুমি বিশাল তান্ত্রিক।

কিন্তু আমি ভূত না মর্কট সেটা তো ঠিক করে দ্যাখো আগে। আর মরা ভূতকে মেরে যমের বাড়ি পাঠাবে! আমার বোধ হচ্ছে তোমার মাথায় ঘিলুর কিঞ্চিৎ অভাব ঘটেছে, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে এসেছে। দাঁড়াও আমিই তোমার ব্যবস্থা করি।”

এই বলে সেই ধুলোর মূর্তি মানে সুখো ভূত জোরসে ফুঁ দিল। ওমনি মাটিতে রাখা ব্যাঙের ঘিলু, গিরগিটির চোখগুলো সব উড়ে গিয়ে পড়ল ঘুটঘুটেশ্বরের মাথায়। সেসব মাখামাখি হয়ে একসা কাণ্ড! তান্ত্রিক তো রেগে লাল হয়ে আরও জোরে মন্ত্র পড়তে লাগল আর তাণ্ডব নৃত্য করতে লাগল। তখন সেই ধুলোর মূর্তি বেশটি করে গা ঝাড়া দিল। সব ধুলো ঝরে গিয়ে একটা ছাইরঙা ধোঁয়ায় গড়া মূর্তি বেরিয়ে এল। তার আবার মাথায় ধোঁয়ার টিকি, এটাই সুখময়ের আসল রূপ।

এবার সুখময় টিকটা টিং টিং করে নাড়াতেই কাকের পালকগুলো আর শেয়ালের লেজ উড়ে গিয়ে বেদম কাতুকুতু লাগাতে শুরু করল তান্ত্রিককে। সে ব্যাটা তো,

-“তবে রে! হা হা হি হি! দেখাচ্ছি মজা! উহুহু! ভুঁড়িতে নয় ভুঁড়িতে নয়! নচ্ছার ভূত! হো হো হো!”

এই বলে পরিত্রাহী চিৎকার করতে করতে তাণ্ডবনৃত্য ছেড়ে বাঁদরনাচ শুরু করল।

পোড়ো মন্দিরের ভেতর থেকে যত সব চোর ডাকাতের দল তো ভয়ে আধমরা হয়ে সুখো ভূতের হাতে ঘুটঘুটেশ্বরের এই দুর্দশা দেখতে লাগল। সুখো ওদের ভয় দেখানোর জন্য যেই একটু বিকট মূর্তি ধরে দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে গেল, ওমনি সবক’টা মিলে ‘বাবা গো মা গো’ করে পালাতে গিয়ে এমন ধাক্কাধাক্কি শুরু করল যে সেই পুরনো নড়বড়ে দেউলের দেওয়াল ভেঙ্গে হুড়মুড়িয়ে পড়ল ওদের ঘাড়ে।

ওদিকে মণি দারোগা সুখো ভূতকে স্মরণ করার খানিকক্ষণ পর ভাবল,

-“এতক্ষণে সুখো নিশ্চয়ই কাপালিক ব্যাটাকে জব্দ করে ফেলেছে। এবার তবে আমি নিশ্চিন্তে অকুস্থলে যেতে পারি।”

এই ভেবে পুরন্দর আর মাণিকলাল হাবিলদারকে সঙ্গে নিয়ে, ক’টা জংধরা গাদা বন্দুক নিয়ে রওয়ানা দিলেন।

বটুকপুরের জঙ্গলের পোড়ো মন্দিরে পৌঁছে দেখলেন এক বিকটদর্শন কাপালিক চিৎকার করে পাগলের মত নাচছে। শুধু তাই নয়, পোড়ো মন্দিরের দেওয়াল ভেঙ্গে পড়েছে আর তার তলায় একগাদা লোক চাপা পড়েছে। যে সে লোক নয়, এলাকার সব নাম করা চোর ডাকু। আর দেখলেন সুখময়ের ধোঁয়ার শরীরটা পাশের অশ্বত্থ গাছের ডালে বসে ধোঁয়ার ঠ্যাংদুটো দোলাচ্ছে।

তড়িঘড়ি চোর ডাকুগুলোকে আর সেই সাথে ফেরেব্বাজ তান্ত্রিককেও বেঁধে, থানায় নিয়ে গিয়ে সোওওজা হাজতে পুরলেন মণি দারোগা। সুখো ভূতের ভয়ে তাদের আর ট্যাঁ ফোঁ করারও ক্ষমতা ছিল না।

(৭)

এই ঘটনার পর বটুকপুর তো বটেই পুলিশের ওপর মহলেও সুখময় ভূতের কথা রাষ্ট্র হয়ে গেল। পুলিশের বড়কর্তারা ভাবলেন এবারে তো তবে মেডেল সুখময়কে দিতে হয়, মণিময় দারোগা কেন মিছে নাম কামাবেন। কিন্তু সমস্যা একটাই সুখময়ের ধোঁয়ার শরীরের হাওয়ার গলায় মেডেলটা ঝোলাবেন কীকরে। কেউ কেউ সমাধান জানাল, সুখময়ের জীবদ্দশার কোনও ছবি জোগাড় করে তাইতেই মেডেল ঝোলালে হয়। কিন্তু সে উপায়েও সমাধান হ’লনা। কারণ সুখময়ের মনেই নেই তার জীবদ্দশার কথা। মণিময় দারোগার বাড়ির বাগানে হঠাতই নিজেকে প্রেতদশাপ্রাপ্ত অবস্থায় আবিষ্কার করেছিল সুখময়, আর কিছুই মনে ছিলনা। কীভাবে মারা গেল, কী হয়েছিল, কোথায় বাড়ি, কিচ্ছু না! চোর ডাকাতের মুখ দেখে তাদের অতীত জেনে নিতে পারলেও সুখময় নিজের অতীত মনে করতে পারত না। কেজানে হয়ত নিজের মুখটা ধোঁয়াশা হয়ে গিয়ে, দেখতে পেত না, তাই হয়ত। গিন্নিমা প্রথমে বাড়িতে ভূতের আবির্ভাবে ভির্মি খেলেও পরে বেশ পোষা বেড়ালটির মত পোষ মানিয়ে নিয়েছিলেন সুখময়কে। ‘সুখময়’ নামটাও গিন্নিমারই দেওয়া, মণিময়ের সাথে মিলিয়ে।

অবশ্য যাকে মেডেল দেওয়ার জন্য এত চিন্তাভাবনা তার এই বিষয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। সুখো ভূত মাধবের পিসির বাড়ির খড়ের চালে বসে গান শুনতে ব্যস্ত। মাধবের পিসি ভাইপোর ডাকাতির জন্য ভিটেয় যে পাপ লেগেছে তাই শুদ্ধি করতে হরিনামের আসর বসিয়েছে। পিসির আবার ভূতে ভারী ভয় কি না।

“হরি দিন তো গেল ... সন্ধে হ’ল... পার করো আমারে!”

সুখময় চালে বসে তাল দিয়ে হরিনাম সংকীর্তন শুনতে থাকে আর ভাবতে থাকে নামগানের গুনে যদি প্রেতদশা থেকে উদ্ধার পায়। ব্যাটাচ্ছেলের এটাও মনে নেই যে ভূতেদের ‘হরিনাম’ শোনা মানা!


মোহর বৃত্তান্ত


অলংকরণ - সুমিত রায়

দুপিসবাবুর মামা নব্বই বছর বয়সে মারা গিয়ে দুপিসবাবুকে তিনটে জিনিস দিয়ে গেলেন। তার মধ্যে অবশ্য দুটোকে দেখতে পাওয়া যায় আর তৃতীয়টা শুধু বোঝা যায়, অথবা আক্ষরিক অর্থেই সেটা বোঝা! প্রথমটা একটা বাড়ি – সেটা পেয়ে দুপিসবাবু বড়ই প্রীত, কারণ উনি সারাজীবন কেরানিগিরি করে কলকাতা শহরে বাড়ি করে উঠতে পারেননি- করতে চানওনি। কিন্তু কেউ দিয়ে গেলে তো আর নিতে আপত্তি নেই। দ্বিতীয় জিনিসটা- নাহ জিনিসটা বললে ভুল হবে, জিনিসগুলো হল – দুটো মোহর। দুপিসবাবু কোনো দিন মোহর চোখে দেখেননি – আর দেখবেনই বা কী করে? যে লোক সপ্তাহে দুপিসের বেশি মাছ কেনে না তার আবার মোহর! বাজারে গেলেই মাছওয়ালা ওনাকে দেখে চিৎকার করে ওঠে, “আসেন দুপিসবাবু, আজকে আপনার জন্যে দুটো বড়ো বড়ো পিস রেখেছি।”

দুপিসবাবু ওর কথা শুনে শান্তভাবে বলেন, “না ভাই, অত বড়ো পিস আমি নেব না, বয়স হয়েছে তো- বদহজম হয়ে যাবে।”

বাজারে গিয়ে প্রতি সপ্তা ওই দুপিস মাছ নেন বলেই ওনার নাম দুপিসবাবু হয়ে গেছে। আসল নামটা অফিসে ব্যবহার হত, এখন রিটায়ার করার পর আর হয় না। মামার দেওয়া বাড়িতে উঠে এসে দু’হপ্তা বাজার করার পরেই এই নতুন তল্লাটে উনি দুপিসবাবু নামে পরিচিত হয়ে গেলেন। তবে লোকে ওনাকে কিপটে বললে ওনার রাগ হয় না। উনি বলেন, “সে যে যা বলে বলুক। আমার পয়সা আমি খরচ করি বা না করি তাতে অন্যের কী? কেউ তো আর আমাকে পয়সা দিতে আসবে না!” আরও বলেন, “আরে বাবা কিপটেকে কিপটে বলবে না তো কী বলবে? আমার বাপু পয়সা খরচা করতে একদম ভাল লাগে না।”

দুপিসবাবুর গিন্নি রমা সাদাসিধে মাটির মানুষ। রমা প্রচুর খাটতে পারেন বলে ভদ্রলোক এ যাত্রা বেঁচে গেলেন। রান্নাবান্না আর বাড়ির সব কাজই তিনি একা হাতেই করেন।

যাই হোক, তা মামার দেওয়া ওই দুটি মোহরের সাথে সাথে এল যে তৃতীয় বোঝাটি সেটা আর কিছুই নয় একটা রোগ। সেই রোগটাকে ইংরেজিতে বলে ‘ক্লেপ্টোফোবিয়া’, সোজা বাংলায় যেটা হল চোরের ভয়! সত্যি কথা বলতে কী মোহর দুটো পাওয়ার আগে দুপিসবাবুর বাড়িতে চুরি করার মতন কিছুই ছিল না। তাই মোহর পেয়ে একটা অজানা ভয় পেয়ে বসল ওনাকে – অত দামী জিনিসগুলোকে কোথায় রাখা যায়? অন্য দামী জিনিস তো বাড়িতে কিছু নেই। একমাত্র মেয়ে শোভা বিয়ে হবার আগে কয়েকদিন খুব টিভি টিভি করে নেচেছিল – তা দুপিসবাবু একদম পাত্তা দেননি। আজকে টিভি চাইছে, কালকে সিনেমা হল চেয়ে বসবে, তখন কী সেটাও কিনে দিতে হবে? গিন্নি ফ্রিজের কথা বললে বলেন, “কেন? টাটকা খাবার খেতে ভাল লাগে না? খাবার পুরনো করে খাওয়ার কী মজা বুঝি না বাপু!” তাই ফ্রিজও নাকচ। ভাগ্যিস গিন্নি গরিব-ঘরের মেয়ে তাই ওই সব বদ-অভ্যাস ছাড়াও কাজ চলে যায় তার। গরিব-ঘর থেকে বলেই তার গয়নাগাটিও তেমন কিছু নেই – যা ছিল তারও একগাছা চুড়ি আর সবসময় পরার একটা পাতলা হার ছাড়া সবই মেয়ে শোভাকে বিয়েতে দিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য এখানে বলে রাখা ভাল যে মেয়ে নিজেই প্রেম করে পালিয়ে গিয়ে পাড়ার একটা ছেলেকে বিয়ে করল, নাহলে যে আরও কত কী দিত হত! মেয়ের ওই কীর্তিতে প্রথমে খুব চটেছিলেন দুপিসবাবু, কিন্তু তারপর মনে হল মেয়ের বিয়ে তো দিতেই হত, - আর দেখাশোনা করে দিলে দেনাপাওনা আর অনুষ্ঠানের যা খরচা হত সেটা ভাবতেই যখন শরীর খারাপ লাগছে তখন সত্যি খরচা করতে হলে বোধহয় প্রাণটাই বেরিয়ে যেত। মেয়ে মনে হয় সেটা বুঝেছিল যে বাবার ভরসায় থাকলে খরচার ভয়ে কোনদিনও বিয়ে হবে না তাই নিজেই ব্যবস্থা করে নিল। আর ভালই ব্যবস্থা, কারণ যাকে বিয়ে করেছে সে পেশায় ডাক্তার। মা বাবা কেউ নেই। নিজের ফ্ল্যাট আছে। আগের পাড়ায় ভাড়া বাড়িতে থাকার সময় গিন্নি রোজ মেয়ের সঙ্গে দেখে করতে যেতেন বা মেয়ে চলে আসত – কাছাকাছি বাড়ি বলে, কিন্তু নতুন পাড়াতে আসার পর যাতায়াত একটু কমে গেছে – বাসভাড়া লাগে বলে। মেয়ের অবশ্য বাচ্চা হবে বলে শরীরটা ভাল নেই তাই সেও তেমন আসতে পারে না। জামাই আবার আয়া রেখেছে তার দেখাশোনার জন্যে – সে তার পয়সা আছে যা খুশি করুক।

এবার আসল কথায় আসা যাক। মোহরগুলো পাওয়ার পর দুপিসবাবু সেগুলোকে কোথায় রাখবেন ভেবে অস্থির হয়ে উঠলেন। গিন্নি বললেন, “কেন? ব্যাঙ্কে কীসব লকার বাক্স পাওয়া যায় দামী জিনিস রাখার জন্যে। শোভা তো একটা নিয়েছে, তা তুমিও নিতে পারো।”

দুপিসবাবু ভেবে দেখলেন লকারের বুদ্ধিটা মন্দ না কারণ ওই মোহরগুলো পাওয়ার পর থেকে রাতে ওনার আর ঘুম হয় না। তা যেমন ভাবা তেমনি কাজ। দুপিসবাবু পরদিন সকালেই পাড়ার ব্যাঙ্কে গিয়ে হাজির হলেন। লকার খুলতে চান শুনেই ওনাকে জিগ্যেস করা হল, “আপনার কী এই ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে?”

“না, তা তো নেই।”

“তাহলে আগে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে না হলে লকার দেওয়া যাবে না।”

“অ্যাকাউন্ট তো আমি খুলতে চাই না, আমার অন্য ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে।”

“তাহলে সেখানেই যান লকার খুলতে,” লোকটা মুখের ওপর বলে দিল। দুপিসবাবু রাগে গজগজ করতে করতে দুটো বাস বদল করে নিজের পুরনো পাড়ার ব্যাঙ্কে গিয়ে হাজির হলেন।

সেখানে তারাপদবাবুর সঙ্গে ওনার অল্পস্বল্প আলাপ আছে, মুখ চেনা আর কী। তারাপদবাবু লকারের রেজিস্টারটা দেখেন। দুপিসবাবুকে দেখে তারাপদবাবু একগাল হাসি হেসে বললেন, “আসুন আসুন মশাই! সেই যে বাড়ি পেয়ে এই তল্লাট থেকে চলে গেলেন তারপর তো দেখছি আমাদের ভুলেই গেছেন!”

দুপিসবাবু চমকে উঠলেন। বাড়ির কথাটা যখন সবাই জেনে ফেলেছে তার মানে মোহরের কথাটাও সবাই জানে নাকি? হেঁ হেঁ করে বললেন, “না,না, আপনাদের কাছেই তো আমার পেনসনের টাকা জমা পড়ে – আপনাদের ভুললে চলবে নাকি? এই দেখুন না এসে হাজির হয়েছি!”

“তা কী করতে পারি বলুন আপনার জন্যে?”

“আমি একটা লকার খুলতে চাই। আমার নতুন পাড়ার ব্যাঙ্ক বলল আমার যেখানে অ্যাকাউন্ট আছে সেখানে খুললেই নাকি সুবিধে, তা আপনি যদি আমার জন্যে একটা লকার খুলে দেন তো খুব ভাল হয়।”

“ও বাড়ি র সাথে গুপ্তধনও পেয়েছেন নাকি একঘড়া?” বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে ফেললেন তারাপদবাবু।

দুপিসবাবুর মুখ সাদা হয়ে গেল। আমতা আমতা করে বললেন, “না মানে, গিন্নি মানে...”

“আরে মশাই আমি জানি, গিন্নিদের সোনা কেনার বাতিক থাকে। কিন্তু লকার তো এখন খালি নেই।”

“লকার খালি নেই?”

“না, এখন লকারের খুব ডিমান্ড তো তাই পাওয়া খুব শক্ত। খালি তো নেইই, উল্টে লম্বা ওয়েটিং লিস্ট রয়েছে। তবে আপনি আমাদের চেনা লোক – আপনাকে ওয়েটিং লিস্টে রাখব না। পাঁচশো টাকা ডিপোসিট দিয়ে দিন। খালি হলেই লকার পেয়ে যাবেন।”

“পাঁচশো টাকা!” দুপিসবাবুর মাথায় বাজ।

তারাপদবাবু বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন দুপিসবাবুর কিপটেমির কথা, মনে পড়তেই বুঝতে পারলেন পাঁচশো টাকা বেশি বলা হয়ে গেছে – কিন্তু ধনুক থেকে তির আর বলে ফেলা কথা তো আর ফেরত নেওয়া যায় না – তাছাড়া নিজের ক্ষতি করেও লাভ নেই কারণ অন্য অনেকেই পাঁচশো টাকা দিতে রাজি।

তাই দুপিসবাবুর লকার ভাড়া নেওয়া আর হল না। মোহর দুটো ওনার কাছে ওনার বাড়িতেই পরে রইল আর বেড়ে চলল ওনার ক্লেপ্টোফোবিয়ার আকার। ওই কথাটা অবশ্য জামাইয়ের কাছ থেকে জানা। সেই মেয়েকে বলেছিল যে ওই অসুখের জন্যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়। গিন্নির মারফত ওই কথা জানতে পেরে দুপিসবাবু ফুঁসে উঠলেন, “কী করবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ? মোহর রাখার জন্যে লকার দেবে? তা তো দেবে না শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি ঘুমের ওষুধ দেবে আর প্রতি ভিসিটে গাদা গাদা টাকা নেবে!”

গিন্নির রান্নাঘরে একটা মশলার কৌটায় ভরে রেখে দিলেন মোহর দুটো। মনে মনে ভাবলেন চোর যদি জানতেও পারে যে মোহর রান্নাঘরে আছে তা হলেও সব কৌটো খুঁজে দেখতে দেখতে রাত কাবার হয়ে যাবে। কিন্তু তাও ভাবনাচিন্তায় ওনার রাতের ঘুমটার বারোটা বেজে গেল। গিন্নি সারাদিন খেটেখুটে ক্লান্ত থাকেন তাই মুহূর্তের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন কিন্তু দুপিসবাবু এপাশ ওপাশ করেন। আর রাতের বেলাতেই যত্তসব শব্দ – খুটখাট, ঠুংঠাং, খটখট লেগেই আছে। ভয়ে দুপিসবাবু রাতে বিছানার পাশে লাঠি নিয়ে শোওয়া শুরু করলেন। লাঠি নিয়ে শোয়ার প্রথম রাতেই ঘটনাটা ঘটে গেল। দুপিসবাবুর একটু তন্দ্রা মতন এসেছিল এমন সময় দুম করে একটা শব্দে ওনার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আঁতকে উঠলেন উনি। পাশে গিন্নি অঘোরে ঘুমোচ্ছেন – ওকে ডেকে আর লাভ নেই ভেবে লাঠি হাতে উঠে পড়লেন দুপিসবাবু। শব্দটা মনে হয় রান্নাঘর থেকেই আসছে – একটু আশ্চর্যই হলেন। চোর কী করে জেনে গেল যে ও দুটো রান্নাঘরেই আছে? সারা বাড়িতে যে কোনও জায়গাতেই তো থাকতে পারে। পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। অন্ধকারে কিছুই ঠিক করে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ দেখতে পেলেন ছায়ার মতন কী একটা নড়ছে – ব্যস আর যাবে কোথায়। অমনি লাঠি তুলে দিলেন এক ঘা, “ব্যাটা চুরি করবি!” পরক্ষণেই বিকট ক্যাঁও ম্যাঁওতে সব পাড়াপরশি ছুটে এল। পাশের বাড়ির সিকদার পরিবারের আদরের মেনিকে লাঠি পেটা করেছেন দুপিসবাবু! সিকদারবাবু আর তার গিন্নি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এলেন, “সোনাইকে ভাল করে বললেই ও চলে যেত – ওসব লাঠি টাঠি দিয়ে মারার কী আছে? পশুদের প্রতি ভাল ব্যবহার করা উচিত জানেন না? অবলা প্রাণী বলে যা খুশি তাই করবেন?”

বেড়ালের নাম সোনাই আর তাকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা দেখে দুপিসবাবুর গা পিত্তি জ্বলে গেল। উনি বললেন, “আমি ভেবেছিলাম চোর ঢুকেছে, আর ও তো এসেছিল চুরির উদ্দেশ্যেই!”

“আপনার বাড়িতে চুরি করার মতন কী আছে শুনি? সপ্তাহে তো আপনি দুপিসের বেশি মাছ কেনেন না। আমাদের সোনাই রোজ একাই দু পিস মাছ খায় জানেন?” সিকদার গিন্নি চিৎকার করে বলেলন।

দুপিসবাবুও কম জান না, উনিও চিৎকার করে বললেন, “সারা পৃথিবীতে কত লোক খেতে পায় না আর আপনি কিনা বেড়ালকে রোজ দুপিস মাছে খাওয়াচ্ছেন!”

সিকদার গিন্নি রাগে দুপিসবাবুকে এই মারেন তো সেই মারেন – অন্যরা সবাই কোনরকমে টেনে টুনে ওনাকে আর ওনার বেড়ালকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। সেই থেকে সিকদার পরিবারের সঙ্গে দুপিসবাবুদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হল।

পাড়ার ক্লাবে খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে সিধুকে দেখে দুপিসবাবুর হঠাৎ একটা কথা মনে হল – একটা বন্দুক কিনলে কেমন হয়? সেদিন যদি একটা বন্দুক থাকত ওনার হাতে তাহলে নিশ্চয়ই সিকদার গিন্নি অত কথা বলার সুযোগ পেতেন না। সিধু পাড়ার মস্তান, ওর কাছে নাকি অনেক রকম অস্ত্র আছে। সবাই তাকে সমঝে চলে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। সিধু ক্লাবঘর থেকে বেরতেই দুপিসবাবু পিছু নিলেন – সিধুকে ডাকলেন, “এই যে সিধুবাবু, শুনছ?” সিধু চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “কী চাই? আপনাকে তো চিনি বলে মনে হয় না।”

“আমরা নতুন এসেছি এই পাড়ায় – ওই যে ওই হলুদ গেট দেওয়া বাড়িটা আমার।”

“ও আপনিই তাহলে শচীদিদার বেড়ালটাকে আচ্ছা করে ঠেঙ্গিয়ে ছিলেন। শচীদিদা বলছিল বটে আপনাকে টাইট দিতে কিন্তু কী জানেন ওই বেড়াল জাতটাকে আমারও একদম পছন্দ নয় তাই আমি আপনার ওই ঠ্যাঙানিকে পুরোপুরি সাপোর্ট করি। তবে শচীদিদাকে বলবেন না যেন,” বলে খ্যা খ্যা করে হাসল সিধু।

“তা বলুন কী চান শচীদিদাকে টাইট দিতেও বলবেন না কিন্তু, দিদা মাস গেলে প্রচুর রান্নাবান্না করে খাওয়ায়।”

“না, না, আমি ওসব কিছু চাই না” বলে ওর কানের কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “আমাকে একটা বন্দুক জোগাড় করে দিতে পারবে?”

ওই কথা শুনে সিধুর চোখ গোল গোল হয়ে গেল, “বন্দুক নিয়ে কী করবেন দাদু? মেনি পুসিকে অক্কা পাওয়াবেন নাকি?”

“আরে না না, আমি ভাবছিলাম দিনকাল ভাল নয়...নিজের আত্মরক্ষার জন্যে...”

খুক খুক করে হাসল সিধু মস্তান। তারপর বলল, “জানেন তো দাদু বন্দুকে অনেক ঝামেলা। লাইসেন্স করো রে, হ্যান রে ত্যান রে। ভাল মাল পাওয়া যায় না আর পেলেও অনেক দাম লেগে যায়। লাইসেন্স না করলে আমাদের চলবে কিন্তু আপনাকে তো দাদু পুলিশ ধরবে – তার চেয়ে এই রকম একটা পকেটে রাখলে আপনার কোন ভয় ডর থাকবে না-“ বলে খ্যাচাং পকেট থেকে ইয়া বড় একটা ছুড়ি বার করে ফেলল। দুপিসবাবু ‘কোঁক’ করে ছিটকে তিন হাত পিছিয়ে গেলেন। থাক বাবা এই সব ডেঞ্জারাস লোকেদের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই ভেবে কোনোরকমে সিধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। আর অনেক দাম দিয়ে বন্দুক কেনার তো প্রশ্নই ওঠে না। তারপর থেকে সিধুর সঙ্গে দেখে হলেই সে বলে, “কী দাদু, কিনবেন নাকি একটা আট ইঞ্চি?”

দুপিসবাবু কোনোক্রমে হেঁ হেঁ করে পালিয়ে বাঁচেন। দিনে দিনে রোগটার মাত্রা বেড়েই চলেছে। দুপিসবাবু এখন বালিশের তলায় একটা দা নিয়ে ঘুমোতে যান, হাতের কাছে লাঠি, বিছানার তলায় দড়ি, কাঁচি ইত্যাদি। গিন্নি তো মেয়েকে আবার বলেই ফেললেন, “তোর বাবার মাথাটা সত্যি মনে হয় খারাপ হয়ে গেছে- কী করব জানি না বাপু। ডাক্তার তো কিছুতেই দেখাবে না। সারাদিন শুধু কীভাবে চোরকে ধরবে, জব্দ করবে তাই নিয়ে চিন্তা করে চলেছে!”

সেটা অবশ্য ষোলো আনার ওপর আঠেরো আনা সত্যি। দুপিসবাবু বিকল্প অস্ত্রের কথা ভেবে চলেছেন। শীতকালে এক বালতি ঠাণ্ডা জল গায়ে ঢেলে দিলে চোর নিশ্চয়ই জব্দ হবে। গরমকালে গরম জল- না গরমজলে সমস্যা আছে। প্রতি রাতে তো আর জল ফুটিয়ে বসে থাকা যায় না, খরচেও পোষাবে না। এদিক ওদিক পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ান নতুন নতুন অস্তর সন্ধানে। সব জোগাড় করে বাড়ির ছাদে সাজিয়ে রাখেন। রাতে ঘুম নেই, বাড়ির ভিতর এদিক সদিক করে বেড়ান – আর সেই করতে গিয়েই দ্বিতীয় ঘটানাটি ঘটে গেল।

অমাবস্যার দিনগুলোতে দুপিসবাবু একটু বেশিই সাবধান থাকেন কারণ ঘুটঘুটে অন্ধকারে চোরদের একটু বাড়তি সুবিধা হতে পারে। ওই রকম এক অমাবস্যার রাতে ওনার ঘুম আসছিল না। কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়লেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই চমকে উঠলেন, বাড়ির পিছনের চাতালে কারা যেন বসে আছে – মনে হচ্ছে ফিসফিস করে কথা বলছে। সিঁদ কাটছে নাকি? আজকালকার চোররা তো মডার্ন জিনিস নিয়ে কাজ করে শুনেছেন- ঝামেলা যাতে কম হয়। এই সব ভাবতে ভাবতে দুপিসবাবু ছাদে উঠে গেলেন। পাঁচিলের উপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখলেন। হ্যাঁ, দুই ছায়ামূর্তি তখনও বসে রয়েছে। দুপিসবাবু তার নবীনতম অস্ত্রটি পাঁচিলের ওপর তুলে ছায়ামূর্তি দুটির দিকে তাগ করে ছেড়ে দিলেন। পরক্ষণেই বিকট চিৎকার চেঁচামেচি। দুপিসবাবু তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলেন। পাড়ার লোক জড়ো হতে শুরু করেছে ততক্ষণে।

“ওরে বাবারে মেরে ফেলল রে” করে চিৎকার। বাড়ির পিছনের চাতালে প্রায় গড়াগড়ি খাচ্ছে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে তাদের সারা গা মাথাময় লেগে রয়েছে শেয়ালকাঁটার বীজ। অস্ত্র যে এত অব্যর্থ লক্ষভেদ করেছে দেখে বড়ই খুশি হলেন দুপিসবাবু। ছাদের ওপর থেকে এক বালতি শেয়ালকাঁটার বীজ ফেলেছিলেন ওদের ওপর। অনেক পরিশ্রম করে বনবাদাড় ঘুরে সংগ্রহ করা শেয়ালকাঁটা।

ছেলেটার নাম নাকি ফেকলু! নামটা শুনেই বিরক্ত হলেন দুপিসবাবু। মা-বাবা কী করে ওই রকম নাম দেয়? ওই নামের জন্যেই মনে হয় চৌর্যিবৃত্তিতে নেমেছে! আর মেয়েটার নাম রিয়া। ওরা নাকি পাড়ারই ছেলে মেয়ে। ফেকলু প্রায় কেঁদে কেঁদে যা বলল তার সারমর্ম হল – ও আর রিয়া বেশ কিছুদিন ধরেই প্রেম করছে। বাড়ির লোক জানে না বলে ওরা মাঝে মাঝে রাতের বেলা লুকিয়েই দেখা করে। রিয়া হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “মনিদাদু বুড়ো মানুষ, কানে ভাল শুনতেন না, তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তেন তাই আমরা এই বাড়ির পিছনটা বেছে নিয়েছিলাম। বাড়িতে অন্য লোক এসেছে জানি কিন্তু ওনারাও তো বয়স্ক তাই আমরা ভেবেছিলাম খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়বেন। আলোও তো সব নিভানো ছিল। তা দুপিসদাদু যে এই রকম কাজ করবেন তা কী করে বুঝব?”

ওর কথা শুনে দুপিসবাবু তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। মনে মনে ভাবলেন আহা ঢং দেখে আর বাঁচি না। প্রেম করার ইচ্ছে হয়েছে তো করো বাপু, কিন্তু আমার বাড়িতে কেন? মুখে বললেন, “আমি ভাবলাম চোর এসেছে তাই...”

একটা ছোকরা টিটকিরি কাটল, “কী দাদু বাড়িতে ব্ল্যাক-মানি রেখেছেন নাকি যে সবসময় চোরের ভয়?” আরেকজন বলল, “বেড়াল থেকে সোজা মানুষ মারায় নেমে পড়লেন দাদু? মাঝারি সাইজের কিছু একটা ট্রাই করলে ভাল করতেন না?”

উপস্থিত লোকজন মোটামুটি দুদলে ভাগ হয়ে গেল – এক দল বলে, “বেশ করেছে প্রেম করেছে! এই তো প্রেম করার বয়স, এখন করবে না তো কখন করবে, দুপিসবাবুর মতন বয়স হলে?” আরেক দল বলে, “বাড়িতে না জানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে অন্যের বাড়িতে গিয়ে প্রেম হচ্ছে – যত্ত সব লুজ ক্যারেকটার! ভাল হয়েছে শাস্তি হয়েছে – পুলিশে দিলেও কম শাস্তি ছিল!”

দ্বিতীয় দলের যুক্তি শুনে দুপিসবাবু বেজায় খুশি হলেন, বললেন, “ওদের ভাগ্য ভাল যে বাগানের বোলতার বাসায় ঢিল মেরে দিইনি। তাহলে হাসপাতালে পড়ে থাকতে হত।“

প্রথম দল সেই শুনে হাঁ-হাঁ করে উঠল, “তা হলে আপনাকে খুনের দায়ে জেলে দেওয়া হত!”

রিটায়ার্ড জজ মিস্টার সেন রায় দিলেন, “না, ট্রেসপাসিং মানে অনধিকার প্রবেশ দণ্ডনীয় অপরাধ – এখানে ফেকলু-রিয়াই দোষী।”

ততক্ষণে কিছু সহানুভূতিশীল লোকজন ফেকলু আর রিয়ার গা মাথা থেকে শেয়ালকাঁটা ছাড়িয়ে দিয়েছে। রিয়ার মা-বাবা খবর পেয়ে পড়ি-কি-মরি ছুটে এসে মেয়েকে টেনে নিয়ে চলে গেল। যাবার সময় দুপিসবাবুকে যে চাহুনিটা দিয়ে গেল তাতে মহাভারতের যুগ হলে তাঁর অনায়াসেই মৃত্যু হতে পারত। দুপিসবাবু মনে মনে ভাবলেন কী দিনকাল পড়েছে! আমার বাড়িতেই লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করবে তোমাদের মেয়ে আর চোখরাঙ্গানি কিনা আমাকেই খেতে হবে! সব ওই সব সিনেমা আর টিভি দেখার ফল!

রিয়া চলে যেতে ফেকলুও ধীরে ধীরে সরে পড়ল। যারা মজা দেখতে জড়ো হয়েছিল তাদেরও মনে হয় খেয়াল হল যে অনেক রাত হয়ে গেছে - দুপিসবাবু আর প্রেমিক যুগলের পিন্ডি পরের দিন চটকালেও চলবে, তাই তারাও তখন একে একে বাড়িমুখো হল। দুপিসবাবু দরজা টরজা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে শুলেন। গিন্নি গজগজ করতে লাগলেন, “রাতবিরেতে কী সব ঝুটঝামেলা ডেকে আনলে। কালকে আমাকে সকাল সকাল ডেকে দিও। শোভার ডাক্তার ওর সিজারের ডেট দিয়েছে। তোমার তো চোখে ঘুম নেই আমাকে বাপু সকাল সকাল ডেকে দিও। কতবার বলেছি একটা অ্যালার্ম ঘড়ি কিনে দিতে ...” বলতে বলতে রমা ঘুমিয়ে পড়লেন।

পরদিন ভোরবেলা গিন্নিকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে দুপিসবাবু মর্নিংওয়াকে বেরোলেন। ঘন্টাখানেক বাদে ফিরে এসে দেখলেন ছোকরা মতন একজন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চমকে উঠলেন দুপিসবাবু। এ আবার কে? মোহরের কথা জেনে ফেলেছে নাকি? দুপিসবাবুকে দেখতে পেয়ে সে এগিয়ে এসে বলল, “নমস্কার আপনিই কি গতরাতে প্রেমিক যুগলের ওপর শেয়ালকাঁটার বৃষ্টি করেছিলেন?”

“আপনার পরিচয়?”

“আমি ফেকলুর মামাতো দাদা। দৈনিক মশলা কাগজের প্রতিনিধি। আপনাকে কাল রাতের ঘটনাটার সম্পর্কে দুয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।”

দুপিসবাবু মাথায় বাজ। খবরের কাগজের লোকজনও এসে হাজির হয়েছে। আর বাঁচানো গেল না মোহরদুটোকে। মুখে শুধু বললেন, “তোমার ভাইয়ের ভাগ্য ভাল যে শুধু শেয়ালকাঁটা ফেলেছি, তুমি ওই ঘটনা নিয়ে কাগজে একটা কথাও লিখলে তোমার গায়ে বিছুটি দিয়ে দেব! যত্তসব!”

“তাহলে কি স্যার আপনি বিকল্প অস্ত্রের অস্ত্রাগার করেছেন? বিছুটি অস্ত্র – অসাধারণ হবে স্যার – ভেবে দেখুন স্যার প্লেনে করে শত্রুদের শিবিরের ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হল – ব্যস ওদের আর বন্দুক তোলার ক্ষমতা থাকবে না...” রিপোর্টার ছোকরা হয়তো আরও বকবক করত কিন্তু দুপিসবাবু হাতের লাঠিটা উঁচু করতেই পালিয়ে বাঁচল।

ঘরে ঢুকে গিন্নিকে দেখতে পেলেন না। মেয়ের কাছে চলে গেছেন তিনি। খুব খিদে পেয়েছিল দুপিসবাবুর। মুড়ির টিন থেকে কিছুটা মুড়ি বার করে খেলেন আর এক গেলাস জল। তারপর খবরের কাগজ পড়ার জন্যে ক্লাবের দিকে রওনা হলেন। বাড়ি খালি রেখে যেতে মনটা একটু খুঁতখুঁত করছিল কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল দিনেরবেলা এক গাদা কৌতূহলী প্রতিবেশীদের নজর এড়িয়ে চোরের ঢোকা মুশকিল।

খবরের কাগজ পড়ে বাড়ি ফেরার পথে পাড়ার পার্কে একটা বেঞ্চে বসলেন দুপিসবাবু। রমা তো মনে হয় সন্ধ্যের আগে ফিরবে না। একবার মনে হল কে জানে কেমন আছে মেয়েটা – কিন্তু ফোন নেই বাড়িতে তাই কোনও নম্বরও জানা নেই তাঁর। যাই হোক পার্কে বসে বাচ্চাদের খেলা দেখতে বেশ ভাল লাগছিল। পাশে বসা দুই বৃদ্ধ বকেই চলেছেন, দুপিসবাবুর কানে যাচ্ছিল কথাগুলো। তাদের মধ্যে একজন বলল, “ছেলেটাকে নিয়ে কী করব ভেবে পাচ্ছি না। জুয়ার নেশা ধরেছে, এমন নেশায় পেয়েছে যে বউমার গয়না বিক্রি করেও খেলছে”। দুপিসবাবু চমকে উঠলেন। আরে এই সহজ কথাটা আগে মনে আসেনি কেন? মোহরদুটকে বিক্রি করে টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখলেই তো হয়। ঘরে ওই আপদদুটো থাকলে কোনোদিনও ঘুমোতে পারবেন না। সোনার দাম বাড়ে ঠিকই কিন্তু ব্যাঙ্কেও তো সুদ পাওয়া যায়। দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে দুপিসবাবুর মাথা ঝনঝন করছিল – নাঃ ওই দুটোকে বেচে দেওয়াই ভাল। দুপিসবাবু ঠিক করলেন গিন্নি ফিরে আসার আগেই বউবাজারে গিয়ে মোহর দুটোকে বিক্রি করে দিয়ে আসবেন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। হুড়মুড় করে বাড়িতে ঢুকে রান্নাঘরে গিয়ে কৌটো কটা সব নামিয়ে মোহরের কৌটটা খুললেন দুপিসবাবু। আর খুলেই ৪৪০ ভোল্টের শক খায়ার মতন শক খেলেন। কারণ কৌটোতে মোহর নেই! রান্নাঘরের সব ডিবে খুলে দেখলেন কিন্তু মোহর পেলেন না। অথচ ওনার স্পষ্ট মনে আছে মোহর কোন কৌটোয় রেখেছিলেন। তাহলে কী গত রাতের গোলমালে কেউ...না, যতদূর মনে পড়ছে ওনার, সবাই বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল, ভিতরে তো কেউ ঢোকেনি। তাহলে? কোথায় যেতে পারে? সারা বাড়িময় মোহর দুটোকে খুঁজতে লাগলেন দুপিসবাবু।

***

রাত আটটা নাগাদ যখন গিন্নি ফিরলেন তখন বাড়ির অবস্থা শোচনীয়। সমস্ত জিনিস এদিক ওদিক ছড়ানো। ঘরে ঢুকেই আঁতকে উঠলেন গিন্নি, “ওমা বাড়ির একি দশা! কী হয়েছে? চোর এসেছিল বুঝি?”

দুপিসবাবু মুখ কালো করে একটা চেয়ারে বসে ছিলেন, বললেন, “তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। যাই থানাতে রিপোর্টটা করে আসি। মোহর দুটো চুরি গেছে। মনে হয় কাল রাতের ঝামেলাতেই কেউ ওগুলো সরিয়েছে। কাল রাতে যারা যারা এসেছিল তাদের নামের একটা লিস্ট করেছি মনে করে করে।”

“অ, মোহর খুঁজতে এত কিছু! তা মোহর হারিয়েছে বলে আর পুলিশের কাছে যেতে হবে না বাপু। ওই দুটো কোথায় আছে আমি জানি। আমিই তো আজ সকালে ওগুলো নিয়ে গিয়েছিলাম। যমজ হয়েছে গো তোমার মেয়ের। ডাক্তাররা আগেই বলেছিল কিন্তু বলা তো যায় না। একটা ছেলে, একটা মেয়ে – ঠিক যেন রাজপুত্র-রাজকন্যা। ওই দুটো মোহর দিয়েই তো ওদের মুখ দেখলাম। কী সুন্দর ফুটফুটে শিশু। মেয়েকে তো ওই দু-গাছি হার ছাড়া বিয়ের পর আর কিছুই দিতে পারিনি। তোমার পয়সা পয়সা বাতিকের জ্বালায় সে বেচারা পালিয়ে বিয়ে করল। তাহলে কী হবে জামাই আমাদের হিরের টুকরো ছেলে। আমাকে ট্যাক্সি করে পৌঁছে দিয়ে গেল এই মাত্র। ওই দুটো তো রান্নাঘরের কৌটতে পচছিল। তুমি রাতে ঘুমোতে পারছিলে না – সারাদিন ছাদে ছাইপাঁশ জমা করছিলে বলে আমি বিদেয় করে দিয়েছি। ওদের লকার আছে ওরা সামলাক বাপু!”

দুপিসবাবুর মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না। মাছের মতন শুধু মুখ খুলছিল আর বন্ধ হচ্ছিল কিছুক্ষণ খপ খপ করে। তারপর প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়লেন। অনেক কথাই বললেন কিন্তু গিন্নির অভ্যেস আছে এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেওয়ার তাই কোনও ফল হল না। রান্না করে খেয়ে দেয়ে গিন্নি ঘুম দিলেন। দুপিসবাবু সারা রাত জেগে থাকার জন্যে প্রস্তুত হতে যাচ্ছিলেন হঠাৎ মনে পড়ল তার তো দরকার নেই। গুম হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর বালিশের তলা থেকে দা-টা সরিয়ে অনেক দিন পর নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোলেন তিনি।

পরদিন সকালে উঠে দেখলেন গিন্নি হাসপাতালে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছেন। দুপিসবাবু তাকে বলেলন, “আজ তোমার সঙ্গে আমিও যাব!”

তাঁর ঘুম কেড়ে নেওয়া সম্পত্তির উত্তরাধিকারীদের একবার চোখে দেখা দরকার বৈকি!