মার্চ ২০১৮

প্রচ্ছদশিল্পী - মৈনাক দাশ

সম্পাদকের কথা

প্রিয় বন্ধুরা,

আবার চলে এলাম আমরা পরবাসিয়া পাঁচালীর একটা ঝকঝকে নতুন এক সংখ্যা নিয়ে। এমনিতে এই দিনগুলোতে মন উৎফুল্ল থাকে, কিন্তু এবারে মন ভালো নেই একদম। কারণ লুব্ধক নামক যে বিশাল ছাতাটার তলায় পরবাসিয়ার দল জড়ো হয়, তারই নাটক সংক্রান্ত কার্যক্রমে আমরা ইতি টানলাম এই মাসে। আই আই টি গুয়াহাটির ব্রহ্মপুত্র ছাত্রাবাসের music room এ যাত্রা শুরু। প্রথম নাটক আদ্যোপান্ত হাসির নাটক চোখে আঙুল দাদা। তারপর আরো দু খানা হাসির নাটক হারানো প্রাপ্তি আর সল্যুশন এক্স। তারপর নয় নয় করে নাট্যকারের সন্ধানে তিনটি চরিত্র, বিভাব, আন্তিগোনে, এবং ইন্দ্রজিৎ, মরাচাঁদ এর মত নাটক। মাঝে হয়েছে শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প অবলম্বনে দেবতার জন্ম আর সম্পূর্ণ মৌলিক নাটক অনার্য সভ্যতা। আর যাত্রা শেষ হল শম্ভু মিত্রের কৃষ্ণকৌতুক গর্ভবতী বর্তমান দিয়ে। তবে আমরা আশাবাদী এটা সমাপ্তি নয়, সাময়িক বিরতি। আপাতত লুব্ধক থাকবে দলের সবাই আর দর্শকদের সবার স্মৃতিতে। আর থাকবে পরবাসিয়া পাঁচালী, খুব শীঘ্রই আসছে যার বিশেষ নববর্ষ সংখ্যা। আপাতত এই সংখ্যা পড়ুন, অন্যকে পড়ান আর মতামত জানান কেমন লাগল। এবারের মত এইটুকুই।

অগ্ন্যুত্পাতের আগের ফেলে আসা সব কথাগুলো

পারিজাত ব্যানার্জী


এখন আমার সামনে শুধু পড়ে রয়েছে সেই সাদাপাতারা। নিশ্ছিদ্র, সুঠাম, মেদহীন। সেই কোন এক অবেলায় হঠাৎই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তালেগোলে। উঠেই দেখি সামনে নিশ্চিন্তে শীতের আলপনায় রোদ পোয়াচ্ছে এক দিস্তা পাতা। কিরকম ঝকঝকে, যেন একখণ্ড রোদকেই তারা ধরে রেখেছে তাদের কোটরে নির্নিমেষভাবে, হেলায়। পতপত করে উড়ছে তারা কখনও হাওয়ায়, যেন সমুদ্রের গা জোয়ারিতে ভেসে থেকেই তাদের উপচে পড়ছে সব সীমাহীন আনন্দধারা! বিছানায় বসেবসেই দেখলাম খানিক তাদের এলোমেলো চুলের গুচ্ছ — আনমনে যা উড়ে চলেছে দূর দরিয়ায়। সামনে গরাদ দেওয়া পুরোনো বাড়ির সবুজ জানালা— পড়ন্ত বিকেলের রোদকে যে ছায়ায় ধরে তরঙ্গের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিচ্ছে সাদা ওইসব পাতার অভ্যন্তরে। একেই কি বলে প্রতিসরণ? তেরছা হয়েই তো আলোটা পড়ল, তাই না? — আমি অবশ্য অপার্থিব চেতনের প্রতিসরণেরই খবরাখবর রাখি। পদার্থবিদ্যায় বরাবরই টলমল করে ওঠে আমার এই দুটো আপাদমস্তক ভেজা পা!

সেই কবের থেকে শুরু। আর ঠিক তখনই হয়তো শেষ! কারণ তারপর মনে আছে, ওই সাদা পাতাগুলোকে একরাশ নির্মম আক্রোশে আর সাদাই থাকতে দিইনি আমি। ওরা কেন অমন দুধবর্ণা হয়ে খেলে বেড়াবে, আরাম করবে অমন বিকেলবেলায়?

তবু আমার অবসর জুটবে না — কাদা লাগবে অবচেতনে — দুধসাদা ফেনিল দোটানায়? একদা যেই শূন্যই ছিল আমার নিজস্ব দণ্ডি কাটা প্রদেশ — সেই মাদুরের আস্তরণের মাঝের ছক ভাঙা ঘর থেকে আজ পড়তে পড়তে ধূলিকণা হয়ে মিশে যেতে হবে আমায় ছোট ছোট দূর্লভ কাঁকড়াবিছের দলে বালুকাবৃত হয়ে!

তাও ভালো অন্তত আঁচড় কাটার সুযোগটুকু ওরা কেড়ে নেয়নি এখনও! সুযোগের সদ্ব্যবহার করে কাটাকুটি তাই এঁকেই চলেছি অনবরত — কখনও সাদা পাতায়, কখনও ঝরাপাতায়, কখনও বালিয়াড়ির বুকে, কখনও আবার ছেঁড়া রোদেপোড়া কার্ণিসের দাওয়ায়।

স্বপ্ন নিয়েই ভাবছিলাম। ভাবতে ভাবতেই অতল কুয়াশা-সংকেতের নিস্তব্ধ চিৎকার — যা শেষ হওয়ার আগেই নেমে আসে ঘুম। মিনিট পাঁচেকের অতল গভীর ঘুম। ঘুমের জানালাগুলো খুলে যায় যেমনতেমন ভাবে। আমি বড় থেকে ছোট হতে হতে মিশে যাই স্কুলের উঁচু উঁচু গরাদওয়ালা গেটের ওপাড়ে। অচেনা স্কুল, অচেনা সব ছোটদের দল। তাইতো — আমার চেনা জগতটা যে আসলে না বলেকয়েই বড্ড বড় হয়ে গেছে আজ! এই মুখগুলির ভীড়ে তারা তাই আজ বেমালুম হয়ে যাওয়া ‘নেই’ এর দল!

দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যাওয়ার আগে ভেসে আসে কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদ। এমনিই, হাওয়ায় বা তার খামতিতেই বোধহয়। কানের গভীরে তার আলতো রেশ রেখেই তা আবার হারিয়েও যায় চিরতরে! তবুও ওই অদেখা মুহূর্তের হাহাকারই জানিয়ে দেয়, আমার ওই ছোট্ট আমিটার কোনো বন্ধু নেই আজ আর কোথাও। সবাই বলাবলি করে, এ ওর দিকে চায়, ফিসফিস করে জানিয়ে দেয় চরাচরকে সেই অমোঘ সত্য। আমি তাই টের পাই বিশাল হলঘরের শেষপ্রান্তে এক কাঠের বেঞ্চিতে বসে — একলাই। একাই একসময় বইখাতাও খুলে ফেলে দেখি আমার অন্য আমিটা। বড় তাড়াতাড়ি বেশ মানিয়ে গুছিয়েই নিল কেমন করে ওই দুদিকে বিনুনি বাঁধা মোটা পাওয়ারের চশমা পরা মেয়েটা? কই, আমি তো আজও শিখে উঠতে পারলামনা কিছু!

বড়বড় থামের আড়ালেই দাঁড়িয়ে থাকি চুপচাপ। আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখি, তখনও চলছে নাটকের শেষ দৃশ্যের মহড়া। সবাই দিব্যি হাসছে, সং সাজছে, চোখমুখ নাড়ছে কতরকম ভাবে — অথচ সবই ধোঁয়াটে — যেন রঙ আছে তবু তার ছিটে এসে লাগেনা আর আমার গালে, ঠোঁটে। আমার ছোট্ট আমিটা শুধুই অপেক্ষায় থাকে যবনিকা পতনের। আমার পিছনের বড় ভারী পর্দা যে আমাকেই নামাতে হবে একা — কারো সাহায্য ছাড়াই। তবু তার আগেই শুনে ফেলি সামনের বেঞ্চে বসা বড় বড়চোখ আঁকা মেয়েগুলোর আফসোস ধ্বনি, “ইশ! যদি থাকত ওর সেই বন্ধুটা আজ, তবে কি আর সব কাজ এমন করে একা সামলানোর দায় থাকত ওর?” আমিও অনেক ভাবি, কিন্তু সেই অদেখা প্রিয় মানুষের মুখটা আর কিছুতেই মনে করতে পারিনা। ততক্ষণে শুধু পরে থাকে যে শুধু অস্থিটুকু। তাতে সত্যকে আর পাওয়া যায় না। অবশ্য, পেলেও কি আর অবসাদ কমে? সব পুড়ে যাওয়ার পর ওসবে আর কোনো তাপ উত্তাপ হয়না।

ছোট্ট আমিটা করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌছে যায় মধ্যযৌবনে, গ্রামের এক পুরোনো কলেজ লাগোয়া থাকার জায়গায়। ওখানেই নতুন পাওয়া বান্ধবে মজে সে দুই হাত তুলে উড়ে যায়। উড়তেই থাকে, যতক্ষণ না এক দূরদেশের নৈশালোকিত জমায়েতে ছিটকে পড়ে তারা দুজন। প্রেমাষ্পদের পরণে সেই ঢোলা নীল পাঞ্জাবী, যেন ঠিক এমনটাই হওয়ার কথা ছিল বহুকাল। অনেক মাইল পার করে ভেসে আসা উপস্থাপকের গলায় তখন সভাসমাপ্তির অমোঘ আশ্বাস। তারপরেও চলে যদিও রঙখেলা। প্রেমিক চকিতে এই বড় আমিকে ইশারা করে বেড়িয়ে আসার। আমি কিছু বোঝার আগেই দেখি তুঁতে নীল রঙে উপচে যাচ্ছে ওর শরীর, মন, সব — যেন কোন অস্তিত্ব নেই তার কোথাও — কোনদিন ছিলওনা এমনভাবে। তাকে বাঁচাতে যেতেই উল্লাসের প্রহেলিকা ভেদ করে শুনতে পাই ওর ডাক —“পালাও। পালাও।” আমি ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে যেতেই রঙের আকুলতা উজাড় করে সেই দেখি ছলনা করে আবার কাছে টেনে নেয় আমায়! আমি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি হঠাৎ। স্লো মোশনে এগিয়ে আসতে থাকি নিজের কাছে নিজেরই হাত ধরে। পিছনে পরে থাকে রঙ, চিৎকার, তুঁতে রঙের বিভীষিকারা আর বাকি যা থাকার কথা নয়, তাও! নতুন শুরুটা আবার হওয়ার আগেই বিকল করতে হবে হৃৎযন্ত্র — আমি নিশ্চিন্তে অপেক্ষায় থাকি সেইসময়ের।

অলংকরণ - প্রমিত নন্দী

নয়-দীয়ার গপ্পো

তৃতীয় পর্ব
নয়-দীয়ার গপ্পো


মার্চ ১৫,২০১৫; রবিবার, রাত ১:১০

“হেমন্তের প্রভাত শিশিরে ছলছল করে গ্রাম চূর্ণী নদীতীরে”— কবির লেখা চেনা কয়েক লাইন মনে পড়ে যাচ্ছিল। তবুও পাড় ভাঙছিল। আছড়ে পড়ছিল এক, একাধিক বিক্ষিপ্ত ঢেউ। উন্মত্ত বিষের নিঃশ্বাস স্মৃতিবিজড়িত শ্যামল, সবুজ বাংলার মলাটে লাল কালির আঁচড় কেটে যাচ্ছিল। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। চাপ বাড়ে এক্সকেলেটরের। স্পিডের কাঁটা তিরতির করে হেলে পড়ে ৮০-র দিকে। শারীরিক উত্তেজনা, যান্ত্রিক যানে দাপট দেখাতে চায়।

সুবীরদার ফোন আসে সাড়ে ১২টা নাগাদ। অনলাইনে কয়েকটা লাস্ট আপডেট আপলোড করে সবে হালকা হচ্ছি তখনই। বাকিটা ঋক আর ঐশীর ঘাড়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ি। দ্রুত পিছিয়ে পড়া বসতি মুখে আঙ্গুল দিয়ে দাঁড়িয়ে। থমথমে বিষাদ লেগে ইঁটের পাঁজরে পাঁজরে। মাথায় দলা পাকাচ্ছিলো ফোনে শোনা কথাগুলো।
ছাপাখানার নৈশ প্রহরী রঘু জানায়, পায়ে হেঁটে ও মোটর সাইকেলে চেপে সাত-আটজন যুবক এসে সম্পাদকের খোঁজ করে। তাঁকে না পেয়ে ভাঙচুর শুরু করে। পরে রঘুকে আটকে রেখে ঘটনাস্থল থেকে পালায়। ও কাউকেই চিনতে পারেনি।

এত বছর ধরে এতগুলো ভায়োলেন্ট ম্যাটার ঘটে চলেছে একের পর এক। কোনো প্রতিকার নেই। দপদপ করে উঠছিল মাথার দু-পাশের ধমনী। দূরত্ব ১২২ কিমির সামান্য বেশি। পৌঁছে যাবার কথা ৪ ঘন্টায়। সময় এগোতে থাকে। পূবদিকের আকাশে একমাথা লাল সিঁদুর মেখে উঁকি দেয় গোল লালথালা। গাড়ি থামিয়ে চা খেতে নামি। প্রায় ৬টা। শালিখের তীক্ষ্ণ শিষ বোঝায় নদীপাড়ের মানুষগুলো ভালো নেই। ক্যানসারের বীজ একটু একটু করে সাম্রাজ্য বিস্তার করছে কোষে কোষে। সুবীরদা বলেছে, শিকড় সমেত উবড়ে আনতে। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে উঠে পড়ি গাড়িতে। কোয়ারির প্রথম গন্তব্যর ম্যাপটা জেনেই নিয়েছিলাম। আরো ৫২ মিনিট। মেন শহর থেকে। নদীয়া থেকে মাঝদিয়া পৌঁছলাম ৭টার কিছু পরে।

চা জলখাবারের দু-তিনটে দোকানে জিজ্ঞেসের পর এসে পৌঁছই। কি সাংঘাতিক অবস্থা দপ্তরের। একপাল হাতির দাপটে দেহ থেকে ধড় মুন্ড আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে, দৈনিক “নগর দর্পণ” পত্রিকার দপ্তর। কংক্রিটের একতলা একটা বাড়ি। সামনের সোজা সিঁড়ি উঠে গেছে ছাদে। কাছে গিয়ে দেখলাম, দাঁত বের হওয়া দরজা, গালা দিয়ে আটকানো। পুলিশ সীল করে গেছে। জানলার অবশিষ্ট আর কিছু নেই। উঁকি দিয়ে চোখে পড়লো চারদিকে ছড়ানো আসবাব, বেসিনসহ বিভিন্ন ফিটিংস, টেলিফোনের টুকরো।

ঘটনাটা ঘটেছে মাঝদিয়ার মাছের আড়ৎপট্টি আরামপাড়ায় অবস্থিত ‘রাই’ প্রিন্টার্স-এ। খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর নিত্যকর্ম সারতে আসা গ্রামবাসী দু-একজন নজরে পড়ে। আমার উপস্থিতিতে তাদের কৌতুহল বা আগ্রহ কোনোটাই দেখিনা। এলাকায় ভীতি এখনো।

রওনা দিই সম্পাদক রবীনবাবুর সাথে দেখা করতে। নাম্বারটা পেয়েছি সুবীরদার কাছে। তাই ওনার বাড়ি খুঁজতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। দপ্তরের ক্ষয়ক্ষতিতে ভেঙে পড়েছিলেন। বললেন হামলা কারা করেছে তা সকলেই জানলেও করার কিছুই নেই। পুলিশ শুধু ঘটনাস্থল ঘুরে ভেঙে যাওয়া জিনিসের তালিকা করেছে। আর একটু আধটু জিজ্ঞাসা করেছে রঘু গার্ডকে। আর কি! শ্লেষ টেনে আরো বললেন, “দু-দিন পরে দেখবেন বলে দেবে সোজাসুজি এরা আমার ব্যক্তিগত শত্রু।” থানা কোনো অভিযোগ নিতে চাইছেনা। ইনিয়ে বিনিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে। এমনটাই তো হয়ে থাকে। সমস্তটা যে ছক কষা বুঝেছেন। হামলার টেকনিক দেখলেই তা বোঝা যায়। অজ্ঞাত যুবকেরা লুকিয়ে ছিল কোনো এক সময় দপ্তরের গ্যারেজে। রবীনবাবু বেরিয়ে যাওয়ার পরই হামলাটা হয়। আর তাঁর খোঁজ নেওয়াটা স্রেফ ভয় দেখানো। দপ্তরের পুঙ্খানুপুঙ্খ তারা জানতো। কার্যালয়ে ওঠার সিঁড়ির দরজা বন্ধ থাকায় সেখান থেকে হামলাকারীরা ওপরে উঠতে পারেনি। এরপর দপ্তরে হামলা করে, এক পর্যায়ে রাখা কিছু ছাপা কাগজে আগুন ধরিয়ে দেয়। কোনোরকমে বাঁধন আলগা করে, রঘু চিৎকার করে। আশেপাশের গ্রামবাসী ছুটে এসে আগুন নেভায়।

এটুকু তো পরিষ্কার, বিষয়ের গ্রোথিত মূল আরো গভীরে। রবীনবাবু দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে নিতে বলেছিলেন তাঁর বাড়িতে। শরীর আর মনের অস্থিরতা সায় দেয়নি। আরো কিছু জায়গায় যাওয়ার ছিল। মাঝদিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্কেল), গৌতম রায়। থানাতেই পেয়ে যাই তাঁকে। তির্যক বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বোঝায় আমার উপস্থিতি তাঁর খুব একটা অভিপ্রেত নয়। ঠোঁটের কোণে হাসি এনে বলেন, কলকাতায় কি খবরের কমতি যে, রাতভর ড্রাইভ করে এ তল্লাটে খবর খুঁজতে এসেছি। টানা দুঘণ্টা খোঁচানোর সারমর্ম এটাই যে, পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে তবেই তাঁরা আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। ঘটনার তিনদিন কেটে গেছে কেউ নাকি লিখিত অভিযোগ জানায়নি। অথচ আমি তো উল্টোটাই শুনলাম। কথা আর বেশি বাড়ায়নি। মনের মধ্যে পাক খাচ্ছিল ঘিনঘিনে ভাবনাগুলো।
সন্ধ্যে ৭টা নাগাদ হাত পা টানটান করার একটা জায়গা পাই। খসে নগদ ১০০০ টাকা। হোটেল বলা ভুল। তেমনটা পাওয়ার আশাও করিনা। এক কামরার ঘর। চায়ের দোকানের পিছনে। মালিক সতীশ দলুই। দুটো রুটি আর খানিকটা খোসাসমেত আলুর তরকারি খাই। এইমাত্র সারাদিনের রেকর্ডিং কনভেরসেশনগুলো ফাইল বন্দি করলাম। চোখ টানছে। আজকের মত এটুকুই।

মার্চ ১৬, ২০১৫; সোমবার, রাত ৮টা

প্রতিবন্ধকতা! শব্দটা যেন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানীয় জলের চাহিদা ও সরবরাহের ফারাক ক্রমবর্ধমান। এখনকার হিসাবে, শহরের তুলনায় গ্রামীণ মানুষের চাহিদা অনেক কম। মাত্র ৪০লিটার। জাতিসংঘের (UNO) হিসাব বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে আমাদের দেশের জনসংখ্যা বর্তমানের চেয়ে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এর মানে, দেশের জল সঙ্কটাকীর্ণ এলাকার জনসংখ্যা বর্তমানের ৩২কোটির থেকে ২০৫০সালে বেড়ে দাঁড়াবে ৮৪কোটিতে। এটা সাধারণ হিসাব। যদি আরো গভীরে যাওয়া যায়, দেখা যাবে দেশের গৃহীত নীতি সমূহের কুফলগুলোর দিকে, তাহলে তো অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মত অবস্থায় পড়বো আমরা। নাহ, রচনার বইগুলোর মত লাইন দিয়ে সুফল, কুফল বিস্তারিত আলোচনায় যাবার কোনো অভিপ্রায় আমার নেই। তবে গোটা ২ দিনের নিরিখে বলি, আমরা প্রায় তলানিতে এসে পৌঁছেছি। যে ছারপোকাগুলো বসে বসে নিঃসাড়ে শুষে নিচ্ছে A টু Z সবটুকু। সেগুলোর সুতো গোটানো শুরু হলেই নির্মম, কদাকার যাপনচিত্রের ভয়াবহতা বেরিয়ে আসছে তার নখ, দাঁত সহ।

শুধুমাত্র দপ্তর, দপ্তরের ক্ষতির মোকাবিলা করতে আমি, শতরূপ সান্যাল মাঝদিয়ায় আসিনি। খাওয়া, দাওয়া, ঘুম আর বড়জোড় দু-চারটে না ঘটা ঘটনাকে, ঘটা করে ছাপতে পারলেই চলে, এমন মানসিকতাকে পেটের তাগিদে প্রশ্রয় দিতে হলেও আজ যখন বিলু আর রফিক মাঝির পরিবারকে দেখি একবাটি মুড়িকে জল দিয়ে ভিজিয়ে দু-বেলা কোনোমতে টেনে নেবার প্রয়াস। তখন তাবড় শহুরে মানসিকতা থেকে বেরিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে, কলম ছাড়া অন্য কোনো ভাবে কি আমি মানুষ হিসাবে এদেরকে মিনিমাম সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সাহসটুকু অন্ততঃ দিতে পারিনা।

অতিদরিদ্রের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পের আওতায় মাঝদিয়া, রানাঘাট ২নং ব্লকের উত্তরপাড়া, জাফরনগর, রঘুনাথপুর সীমানায় কিছু লোকদেখানো কাজ শুরু হয়েছে। উপজেলার হালালপুর, হিজুলী, বরেন্দ্রনগর, শান্তিনগর, আড়ংঘাটা, বাগানবাড়ি ইত্যাদি চূর্ণী নদী সংলগ্ন এলাকাতেও ইউনিয়নের ১৯০জন শ্রমিক অংশ নিচ্ছে। শোনা যাচ্ছে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য উপজেলায় একই ধরণের অভিযান চালানো হবে। কিন্তু নদীপাড়ে গড়ে ওঠা এই জনপদ শ্রীহীন হয়ে পড়লো কিভাবে! এ উপলক্ষে আজ নদীয়ার মাঝদিয়া রবীন্দ্রভবনে কৃষ্ণগঞ্জের বিধায়ক অঞ্জন মাইতি ও রানাঘাটের সাংসদ আবির বসু একটি সাধারণ সভা করেন। নেহাৎ ছেলে ভোলানো ছড়া। বড় মাপের মানুষগুলোর হম্বি তম্বি ঘিরে ইউনিয়নের ঝান্ডা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল গরম মেজাজের জনাবিশেক। কথা হচ্ছিল ওদেরই একজনের সাথে-

“আপনি দেখি সবু জানোক বাবু। এটাক জানোক নাই, পরাণের লাগি সব প্রাণীই যা করে, আমরাও তাই করতাছি। ”

“কিন্তু নদীর জলে কোমড়বাঁধে তো ক্ষতি হচ্ছে। ”

“আপনি কে কহেন দেখি, সামনে দিয়ে দেখে সরে আসেন। হাত দিবেন না, আর যদি যান এমন টুসকি দিবো যে... আকাশের শকুন ছাড়া কারো নজড়ে পড়বেক নাই। ”

রক্তচক্ষু দেখিয়েছিল ভারী চেহারার তামাটে গড়নের লোকটা। হাতখানেক দূরে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েক মাথা হেঁট করে। কেউ কেউ ফিচেল হাসি দিচ্ছিল এমন তামাশা দেখে। জেদটা চেপে বসছিল ক্রমশঃ। এরা হচ্ছে মাজদিয়ার রাজনীতিক মদতপুষ্ট একদল ইউনিয়ন গোষ্ঠী। হুমকি, দলবাজি, দাদাগিরি এদের বাঁ-হাতের খেল। ভারী চেহারার লোকটা হয়তো দলের লীডার। ওদের কথাবার্তায় বুঝলাম, নাম খুব সম্ভব অজয়।

ব্যাপারটা আরেকটু স্পষ্ট করে বলি, বৈশাখ মাস আসতে এখনো ৬০দিন বাকি। এখনই কবিগুরুর কবিতার ছোট নদীর মতো অবস্থা দাঁড়িয়েছে নদীয়া জেলার মাঝদিয়ায় একমাত্র জীবিকাবাহক নদী চূর্ণী। এই নদীকে ঘিরেই একসময় নদীতীরবর্তী এক বিশাল জনপদ তাদের জীবন জীবিকা চালাতো। আজ সমস্ত মৎস্য সম্পদ বিলুপ্তির পথে। বেকার হয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে এখনকার জেলে পরিবারগুলো। চূর্ণী এখন তাদের কাছে দূর আত্মীয়ের মত।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ১৯৬৮-৬৯ সালে ভারত গঙ্গার উপর ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ করে ও বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৫ সালের ২১শে এপ্রিল ভারত, ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করে। এরপর থেকেই মৌসুমী-বায়ূ প্রত্যাহারের পর অব্যাহতভাবে পদ্মার জল কমতে থাকে। ফলে তার বিরূপ প্রভাব পড়ে মাথাভাঙ্গা ও চূর্ণীর উপরেও। সেই থেকেই এই দুই নদীতে ক্রমান্বয়ে জলের প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় স্রোত কমে গিয়ে পলি পড়ে ভরাট হতে থাকে নদীর তলদেশ। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলার কারণে বর্তমানে চূর্ণী নদী মৃতপ্রায় হয়ে প্রায় খালের আকার ধারণ করেছে। চোখেও পড়লো তেমনটাই। কোথাও জল কমে হাঁটু সমান, কোথাও আবার সামান্য। জট পাকিয়ে আরো কয়েকটা জায়গায়।

হাঁসখালি গ্রামের বাসিন্দা বিলুকে রাজি করিয়ে ডিঙি নিয়ে গেছিলাম নদীর প্রায় মাঝ বরাবর। ভয়াবহ চিত্রগুলো চোখে পড়ে ওখানেই। নদীর স্বচ্ছতা কোথায় যেন হারিয়েছে। চূর্ণী প্রায় ৬০ কিলোমিটার বয়ে হুগলিতে পড়েছে। তবে বয়ে চলার স্বাভাবিক ছন্দ বিলীন। পচা দুর্গন্ধে টিকে থাকা দায়। মনে হচ্ছিল আমি কোনো ভ্যাটে এসে পড়েছি। চারপাশে কালো কালো কীসব ভেসে বেড়াচ্ছে। বিলু বললো, কারখানার বর্জ্য। জলে ভাসা কালো বস্তুগুলো জলের পোকা। আবর্জনায় জন্ম হয়েছে। বিলু বলেই চললো, আগে রুই, কাতলা, চিংড়ি, বেলে, পুঁটি, চিতলের মত মাছ পাওয়া গেলেও এখন কেবল লাটা, ফলুই, জিওলের মত কয়েকটা মাছ রয়েছে। তাইই ধরতে হচ্ছে। সে সবও দুর্গন্ধে ভরা। বিক্রি হয়না। তার উপর এই বাঁধ।

নদীর পাড় ও নদীসংলগ্ন রাস্তা ২০ কিলোমিটারের বেশী। ১০-১২টির ও বেশি স্থানে বাঁশের সাঁকোসহ আড়াআড়িভাবে বাঁধ। কোমড়বাঁধ, জংলা। কোমড়বাঁধ হলো, মাছ শিকারের জন্য গাছের ডাল ও কাটা বাঁশ পুঁতে খানিকটা জায়গা ঘিরে রাখা আর খুঁটির সাথে লাগোয়া জাল পাতা হলো জংলা। নষ্ট হচ্ছে মাছের বংশ। রেহাই নেই চারা মাছ এমনকি মাছের ডিমেরও। শুধু এতেই থেমে নেই।

চূর্ণীর দুইধারের মাটি কেটে নানারকম ফসলের আবাদ চলছে। ফলে নদীর পাশের আলগা মাটি বৃষ্টির জল ধুয়ে তলদেশ ভরাট হচ্ছে। তাজ্জব বনে গেছিলাম। বিলুকে বলেছিলাম, “তোমরা চুপ করে আছো কিসের জন্য? এমন দিনের পর দিন চলতে থাকলে তোমরা তো ভেসে যাবে। ”

-ও বলেছিলো- “পরাণটুকু যা রইছে, বাকি তো সব গ্যাছে। নালিশ শুনবার কেউ লাই।” অর্থাৎ বাঁধ তৈরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা রাজনৈতিক দলের পরিচয় বহন করে। অভিযোগ করেও কোনো লাভ নেই। কিছু একটা করার তাগিদ ভিতর থেকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল।

ডিঙি থেকে নেমে সোজা হাঁটা লাগিয়েছিলাম রানাঘাটের সাংসদ আবীর বসুর দপ্তরে। বললেন, “কি মশাই, এটুকুও খবর রাখেন না। বিকেল পর্যন্ত প্রায় গোটা পাঁচেক কোমড়বাঁধ অপসারণ করা হয়েছে।”

এমনকী অভিযানে বাধা দেওয়ায় সামসুল বলে এক ব্যক্তিকে ভ্রাম্যমান আদালত জরিমানা পর্যন্ত করেছে। আর তাছাড়া কিছুদিন পরেই মাছের প্রজনন ঋতু। তাই বাকি যে কটা বাঁধ আছে তা মাছেদের বংশ বৃদ্ধির জন্যই। মুখের উপর বলে দিতে ইচ্ছে করছিলো আমি পাক্কা ২টো ঘণ্টা ওখানেই ছিলাম। অর্থাৎ আপনার এই মনগড়া গপ্পো আমাকে শোনাবেন না। মাছের বংশবৃদ্ধিতে কোমড়বাঁধ কতটা সহায়ক তা ভালোমতেই বুঝেছি। ঘূণি জাল দিয়ে এমনভাবে কোমড়বাঁধ রয়েছে যাতে মাছের ডিমও উঠে আসে। ফলে এ অবস্থায় মাছের বৃদ্ধিতো দূরের কথা প্রকৃতপক্ষে দিনান্তে একটা মাছ পাওয়া গেলেও তা গরীব ঘরে মোহর পাওয়ার সমান হবে। কিছু ভালো লাগছেনা। চোখ বুজে শুধু বিলুর একটা কথাই মনে পড়ছে বারবার-

“চূর্ণী না বাঁচিলে আমরাও বাঁচবোক লাই। গোটা চৌহদ্দি শ্যাষ হইয়ে যাবেক। ”

মার্চ ২০, ২০১৫; শুক্রবার, রাত ১:২০

আজ নিয়ে চারদিন। রফিক জেলে লা-পাতা। কেউই কোনো খোঁজ দিতে পারছেনা। সকাল থেকে সন্ধ্যে শুধু চরকি পাকের মত ঘুরে চলেছি। তল পাচ্ছি না। ১৭ তারিখ ভোর রাতের দিকে রোজের মত মাছের আশায় বেরিয়েছিল রফিক। আলো ফোটার সাথে সাথে বেলা বাড়তে শুরু করলে রফিকের ভাই নিজাম নদীর পাড় ধরে খানিকটা গিয়েও যখন দেখা পায় না, তখন গ্রামবাসী কয়েকজনকে নিয়ে কাছাকাছি আড়ৎপট্টিতেও খোঁজ করে। কোথাও পাওয়া যায়নি জলজ্যান্ত মানুষটাকে।

ইদানিং মাছ পাবার আশা অনেকটা কমে গেলেও ভোরের দিকে অনেকেই নদীপাড়ের তীরবর্তী অঞ্চলে নিজেদের ডিঙি ভেড়ায়। কেউ কি দ্যাখেনি ওকে! বিলু? হ্যাঁ বিলু-তো ওর সাথে প্রায়ই থাকে। সেরকমই দেখেছি। এক চিলতে আশা নিয়ে গিয়েছিলাম বিলুর বাড়ী।

“মেইয়ার বিয়া বৈশ্যাখে। সদর গেল। আজ ফিরবেক লাই।” দায়সারা উত্তর। অথবা একেবারেই অজুহাত।

পরপর দুদিন বিলুর বাড়ী গিয়েও ফেরত এসেছি। কি করবো, কি করবো করতে করতে হটাৎ একটা বিষয় আবছা ছায়ার মতো আমার গুরুমস্তিষ্ক জুড়ে হানা দিলো। ঠিক করলাম কালই রাঘববোয়ালের খোঁজে বেরোবো।

মার্চ ২২, ২০১৫; রবিবার, সকাল ১১টা ২২মিনিট

মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে নিতেই আবছা শরীরটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল হ্যারিকেনের আলোয়।

বিলু!!!

যন্ত্রনায় কুঁকড়ে চিৎকার করে উঠতেই আবারো সবল হাতটা মুখের উপর গেঁথে বসেছিলো। ঝাঁঝালো গন্ধটায় মাথা তুলতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল কোনো অতলে হারিয়ে যাচ্ছি। গভীর, খুব গভীর, অতল, কালো অন্ধকার আর একটা গন্ধ... ঠিক এভাবে কতক্ষণ ছিলাম জানা নেই। চোখ খুলতেই একটার পর একটা শব্দ স্পষ্ট হচ্ছিল শব্দকোষে। ভারী শরীরটাকে কোনোমতে সোজা করে উঠবার চেষ্টা করতে, পায়ের ব্যথা নড়েচড়ে ওঠে। ডানপায়ের হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত মোটা কাপড়ের ব্যান্ডেজ। কোমরে অসহ্য যন্ত্রণা। শরীরের শিরায় শিরায় বিষ দাঁতের অণুরা মনে করিয়ে দেয়, কালরাতের সমস্ত। খাটের লাগোয়া টেবিলের তলা থেকে খুব ঝুঁকে ব্যাগ থেকে বার করি ডায়েরিটা।

যে ছকটা কষে নিয়েছিলাম মনে মনে, সেই মতোই বেরিয়েছিলাম কাল সন্ধ্যের দিকে। জীবনও, আমার পায়ে পায়ে এগিয়েছিল। সামনের দোকানটায় টুকটাক কাজ করে মালিকের হাতে হাতে। মাসোহারা ৫০০ টাকা। শিবনিবাসের মালোপাড়ায় মা আর ছেলের সংসার। আসা যাওয়ায় মোট ৬কিমি পথ। বাবা পেশায় মৎস্যজীবী ছিলেন। ব্যবসা মন্দ যাওয়ায় সুন্দরবনের মংলায় কখনো মাছ ধরতে যায়। তারপর থেকে আজও কোনো সংবাদ নেই। তিন বছর কেটে গেছে। ওরা ধরেই নিয়েছে হয়তো বাবা বেঁচে নেই। মা এদিক ওদিক সবজি বিক্রি করে, কিন্তু ৬ মাস হলো হাতে অসহ্য চুলকানি হওয়ায় কাজ করতে পারেনা। তাই ক্লাস ৫-এর পর, আর পড়া হয়নি জীবনের। গল্পগাছা করতে করতে এগিয়ে যাই চূর্ণীর পাড় ধরে। পাড়ের পচা বিশ্রী গন্ধ আর রাতের কালো মাঝদিয়ার চেহারাটা করে তুলেছে শ্বাপদের মত।
কিছুদূর এগোতেই মালোপাড়া ঢোকবার ঠিক আগের মুহূর্তে কিছু কথা কাটাকাটি কানে আসে। সামনের জমাট অন্ধকারে মিশে আছে আরো কয়েকটা কালো মাথা। চাপা গলায় কারা যেন রুষ্টভাবে কীসব বলাবলি করছে। আমি জীবনকে জোরে হেঁটে এগিয়ে যেতে বলি। মোবাইলে দেখি, রাত প্রায় ৯টা। কেমন একটা খটকা লাগছিলো। আশেপাশের দোকানগুলোর ঝাঁপ বন্ধ। মফস্বল এলাকায় রাত খুব তাড়াতাড়ি হয়। তার উপর এযাবৎ অরাজকতার দরুন মানুষজনও কম রাস্তায়। একটা মুদির দোকানের পাশে দাঁড় করানো বাঁশের আড়ালে নিজেকে আড়াল করি। বোঝার চেষ্টা করি ব্যাপারটা কি!

সব মিলিয়ে গোটা দশেক লোক। অন্ধকারে ঠিক মত ঠাওর করতে পারছিনা ঠিক কথাই তবু স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। সয়ে আসছে অন্ধকার। চারটে বেশ বড় আকারের বাক্সের উপর পা দিয়ে আন্দাজ বছর চল্লিশের একজন দাঁতচাপা রাগ প্রকাশ করছে। সামনে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে। আরে! এটাতো.... আর একটু কাছে এগোতে যাবো কি....তীক্ষ্ণ ছুরি যেন কেটে বসলো ডান পায়ের পাতায়। মনে হচ্ছে শরীর থেকে এক ঝটকায় ছিঁড়ে গেল যেন শিরা-উপশিরাগুলো। মুখ দিয়ে না চাইতেই বেরিয়ে এলো আর্ত, আতঙ্কের চিৎকার। সজোরে পা ছাড়াতেই দেখি, কুকুরটা তখনও কামড়ে ধরে রয়েছে জিন্সের খানিকটা। আমার চিৎকার ততক্ষণে নদীপাড়ের নিস্তব্ধতা ছিন্নভিন্ন করে উদ্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কানেও পৌঁছে গেছে।

হ্যারিকেন হাতে একটা লোক এগিয়ে আসছে। আমার মস্তিস্ক বললো, শতরূপ তুমি নিরাপদ নও। এমন পরিস্থিতি জীবনে নতুন নয়। কিন্তু যন্ত্রণা আর পায়ের অসাড়তা কনফিডেন্স-এ কিছুটা ঘাটতি আনছিল। আমাকে ফিরতে হবে। পিছনের শব্দ এগোচ্ছিল ক্রমশঃ। হাত দুয়েক দূরত্ব। কান, মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। অবশ হয়ে যাচ্ছে পা, পায়ের পাতা। টেনে চলছি, ছুটছি। ছুটতে পারছি কৈ! অশ্রাব্য গালিগুলো আমাকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে। হটাৎ একটা প্রবল টান সজোরে আমার শরীরকে হিঁচড়ে টেনে আনলো অন্ধকারের গভীরে।

আমি কি ধরা পড়ে গেলাম!!

পায়ের যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা শরীরে। কুঁকড়ে কঁকিয়ে উঠছিলো ধমনীগুলো। এ আমি কোথায় এলাম! খসখসে বিছানার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো সমস্ত শরীর। ঘরের কোণের ক্ষীণ আলোটা স্পষ্ট হচ্ছে....এ আমি কাকে.. .দেখলাম... এ তো...

আর তারপর আজ! এই ঘরে! জানলা খোলা! সকালের আলো রোদের প্রকোপ বাড়াচ্ছে... ওই লোকগুলো... ঝাঁঝালো গন্ধ... পায়ের আড়ষ্টতা... গলা শুকিয়ে আসছে... আর হয়তো কিচ্ছু লিখতে পারবোনা তাই... জীবননন..


(ক্রমশঃ)
অলংকরণ - মৈনাক দাশ

মানসী

বিভাবসু দে


সকাল থেকেই মনটা আজ বড় উদাসী হয়ে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে, কিছুতেই যেন বসতে চাইছে না ঠিক। ভাবলুম একখানা কবিতা লিখে ফেবুতে ছাড়ি; কিন্তু তাও হল না, ভাবগুলো শব্দের সাথে আঁড়ি করে বসে আছে। না, যাই বরং স্নান করি গে, যদি তাতে মনটা একটু থিতু হয়। এলাম স্নান করে, কিন্তু বেশ টের পাচ্ছি মন বাবাজীবন এখনও আগের মতোই কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন। সত্যিই বড় উতলা হয়ে আছে মনটা; সাপেদের খোলস ছাড়ার সময় বোধহয় এমনি উশখুশ করতে থাকে ভেতরটা! আজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বড় সাজতে ইচ্ছে করছে! ও হরি, এ আবার কী রোগে ধরলো, কখনও তো এমন আজব ইচ্ছে হয়নি আগে। যেই আমি কস্মিনকালে চুলে চিরুনি ঠেকাই না, এলোমেলো চুলেই ঘুরে বেড়াই সারাদিন, আজ পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে চলেছি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে; নিজেকে কেমন যেন বেশ সুন্দর লাগছে আজ! নিজেকে দেখে মুগ্ধ হওয়া, একে কি একটা যেন বলে মনোবিদ্যায়; সেই রোগে ধরলো নাকি! হঠাৎ আঁতকে পেছনে সরে এলাম, আরশির স্থির চিত্রপটটা কেমন যেন টলমল করে উঠল জলের মত! অবাক হয়ে দেখলুম, সেই আয়নার জলছবিতে টলমল করতে থাকা আমার মুখখানা কেমন যেন মেয়েদের মতো হয়ে এল; ছোট করে ছাঁটা চুলগুলো লম্বা হয়ে গিয়ে পড়েছে পিঠ ছেয়ে, খোঁচাখোঁচা দাঁড়িতে ভরা গালদুটো বেশ পালিশ গোলাপি হয়ে উঠেছে! বেশ ঘাবড়ে গেলাম, তাড়াতাড়ি মাথায়, গালে হাত বুলিয়ে দেখলাম... না, চুল দাঁড়ি সবই তো ঠিকই আছে আগের মতোই, তাহলে আজ ছায়াটা কায়ার অনুকরণ ছেড়ে এমন বিদ্রোহী হয়ে উঠল কেন? তাও আবার যে সে বিদ্রোহ নয়, একেবারে বিনা অপারেশনে লিঙ্গ পরিবর্তন! এবার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল... টলটলে জলের আরশি থেকে একটু একটু করে উঠে এল আমার ছায়াখানা। তবে এখন যে সে আর ছায়া নয়, রীতিমত সুতন্বী কায়াধারিণী তরুণী! গভীর কালো ডাগর দুটো চোখ, পিঠ অবধি নেমেছে চুলের ঢেউ, নীল শাড়িতে ওর গায়ের হলুদ রং যেন ঠিকরে পড়ছে; ঠিক যেন নীলাম্বরী রাধিকা! অবাক চোখে দুজনে দেখলাম একে অপরকে; কেন জানি না অপরিচিত এই তরুণীকে বড় বেশি পরিচিত মনে হতে লাগল আমার। আমি তখন চিরুনি হাতে বিছানায় বসে হাঁ করে তাকিয়ে আছি ওর দিকে, সে এসে বসলো পাশের সোফায়। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরতেই গা টা ছমছম করে উঠল কেমন; কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি ভূত?”

তরুণীর গোলাপি গালদুটো আরেকটু লালচে হয়ে উঠল লজ্জায়, হাসিমাখা মুখে সে বললে, “আমায় দেখে তাই মনে হয় বুঝি?”

এবার একটু সাহস পেয়ে বললাম, “কিন্তু তুমি ঠিক মানুষও তো নও, অমন আয়না ফুঁড়ে মানুষ তো বেরোতে পারে না! তুমি ঠিক কে বলো তো।”

—“আমি ছায়া গো।”

—“কার?”

—“কেন? তোমার...”

নিজের শরীরের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললাম, “সে কেমন কথা? আমি পুরুষ, তুমি মেয়ে, তুমি কি করে আমার ছায়া হবে শুনি?”

ছোট্ট একচিলতে হাসির রেখা দেখা দিল সেই মায়াবিনীর ঠোঁটের কোণে, “ছায়া বুঝি শুধু শরীরের হয়? মনের ছায়া হয় না বুঝি?”

—“মনের ছায়া!! সে আবার কি বস্তু? যদি হয়ও বা তবে সে খামোখা নারী হতে যাবে কেন?”

—“নারী হতে বুঝি ভারী আপত্তি তোমার?”

—“না, ইয়ে মানে, পুরুষ মানুষ হঠাৎ নারী হতে যাব কেন? আমার তেমন স্বভাব নয় মোটেই।”

পাতলা দুটো গোলাপি ঠোঁটের ফাঁকে মুক্তোর ঝিলিক খেলিয়ে সে বললে, “তোমার শরীরটা নাহয় পুরুষ, কিন্তু মনের লিঙ্গ নির্ণয় করলে কোন যন্তরে শুনি?”

মেয়েটির কথা কিছুই বুঝতে পারলুম না, “এ আবার কি হেয়ালি কথা?”

—“আমি হলেম তোমার মনের নারী।”

—“মানে?”

—“মনের নারী পুরুষ হয় না গো। সবার মনেই থাকে এই দুটো সত্ত্বা। যার মনে যেই সত্ত্বার জোর বেশি তার শরীরটা তেমনধারা রূপ পায়। তুমি পুরুষ হয়েছো কারণ তোমার মনে আমার যেই পুরুষ দোসর আছে সে আমাকে এতকাল দাবিয়ে রেখেছে; যদি উল্টোটা হত তবে আমার রূপেই রূপ পেতে তুমি।”

অবাক হয়ে শুনছিলাম ওর কথা, জিজ্ঞেস করলাম, “তা আজ হঠাৎ বেরিয়ে পড়লে কি করে?”

—“হাঁপিয়ে উঠেছিলাম গো, আমার ওই পুরুষের দাপাদাপিতে, তাই বেরিয়ে পড়লাম আজ প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে। ইচ্ছে হল বাইরের পুরুষের চোখ দিয়ে একবার ভেতরের নারীকে আর ভেতরের নারীর চোখ দিয়ে বাইরের পুরুষটাকে দেখি। বড় ইচ্ছে হয় গো মাঝে মাঝে, নিজের মতো করে তোমায় গড়ি।”

—“আচ্ছা, আমি যদি মেয়ে হতাম, তাহলে কি ঠিক তোমার মতোই হতাম দেখতে?”

—“হ্যাঁ গো, প্রকৃতির তাই তো নিয়ম।”

নিজের নারীত্বের রূপচ্ছটা দেখে বেশ অহংকার হল। মেয়ে হলে বেশ রূপসী সুন্দরীই হতাম তাহলে! নিজের মনের তরুণীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, তোমার আর মনের ভেতরের পুরুষটার কি সব সময় ঝগড়া চলে?”

—“না না, সেকি কথা গো? ঝগড়া হতে যাবে কেন? আমরা যে একই সত্ত্বা। হ্যাঁ তবে দড়ি টানাটানি খেলা বলতে পারো, আর সেটা সারাজীবন চলে। তাই তো শরীরে পুরুষ হয়েও মনের নারীত্বটা প্রবল হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে অনেকের মনে; দ্বৈত জীবনের বোঝা নিয়ে বাঁচে তারা, দেহে পুরুষ মনে নারী! উল্টোটাও হয়।”

—“হুম, তাই বুঝি আজকাল অনেকে লিঙ্গ পরিবর্তন করায়।”

—“হ্যাঁ গো। সে যে বড় ভীষণ লড়াই, শুধু কি মনের, সমাজের সাথেও যে লড়তে হয় তাদের। আজকাল তো তবু চিন্তাধারা উদার হয়েছে অনেক, আগেকার দিনে তো শুধু অপমান আর বিদ্রূপই জুটত এমন লোকেদের কপালে।”

—“এই বলছি, তুমি যে হঠাৎ এমন নিয়ম ভেঙে বেরিয়ে এলে, আমিও কি তবে এখন মেয়ে হয়ে যাব নাকি?”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠল সে, “না গো, আমি এমনি এসেছি, তোমায় দেখতে। চিন্তা নেই, তোমার মনে আমার যে পুরুষ দোসরটি আছে সে আমার চেয়ে ঢের জোরালো, ওর হাত থেকে রাশ কেড়ে নেবার সাধ্যি এজন্মে আমার হবে না।”

—“যাক বাবা, বাঁচালে! আচ্ছা, তোমার নাম কি?”

—“মনের আবার নাম হয় নাকি?”

—“ওহ, হ্যাঁ তাও ঠিক। তবু কিছু একটা বলে যদি ডাকি, এই ধরো মৃণালিনী নামটা কেমন?”

—“বড্ডো বুড়োমার্কা হয়ে গেল না?”

—“তাই বুঝি? তবে তুমিই বল না কি বলে ডাকা যায় তোমাকে।”

—“তুমি নাহয় মানসী বলে ডেকো আমায়।”

—“মানসী। বাহ্, সুন্দর নাম!”

—“আচ্ছা মানসী, মনের জগৎ ছেড়ে যখন বাইরে এসেছ, তখন একটা সম্পর্ক পাতালে কেমন হয়?”

—“কেমন শুনি?”

—“সেখানেই তো মুশকিল! মা নও, বোনও নও তুমি। আবার আমি আর তুমি পুরোপুরি আলাদাও নই যে তোমার সাথে প্রেম করা যাবে।”

—“আমি নাহয় সখী হব তোমার, মনের কথা বলবে আমাকে মন খুলে।”

—“সখীটা বেশ। কিন্তু তোমায় মনের কথা কি বলব বল, তুমি নিজেই তো আমার মনের অংশ, কিছু কি অজানা আছে তোমার?”

—“নেই আবার? কত কিছুই তো লুকিয়ে রাখো আমার কাছে। তোমার পুরুষ মনখানা কত দুঃখ ব্যথা লুকিয়ে রেখে আমার সামনে একগাল হাসি এঁটে খুশির ভান করে বেড়ায়। কত বলি মন খুলে কাঁদো, হাল্কা হয়ে যাক মনের বোঝা, সে এড়িয়ে যায় আমাকে।”

—“এমনটা তো ভাবিনি কখনও। সত্যিই তো কতবার এভাবেই নিজের মনে নিজেকেই ছলনা করেছি।”

—“হুম, আজ থেকে সখী মানলে তো? তাহলে এমন আর কোনোদিন আড়ালে রেখো না নিজের সখীকে।”

—“বেশ,তাই হবে। আচ্ছা, তুমি তো প্রথমবার এলে আমার কাছে, তোমায় কি দেই বলো তো?”

“দেবে আমায় কিছু?”, কাজলকালো চোখে হাসির ফোয়ারা যেন ছলকে পড়ল, কি সরল সেই চাউনি।

—“হ্যাঁ, কিন্তু কী যে দেব সখী তাই তো বুঝতে পারছি না!”

—“মনে আছে, তখন তুমি ক্লাস ইলেভেনে পড়তে, একটি মেয়েকে খুব ভালো লাগতো তোমার। একটি চিঠি লিখেছিলে তাকে দেবে বলে, কিন্তু দাওনি। আমি অনেক বুঝিয়েছিলাম, কিন্তু শোনেনি তোমার পুরুষ মন।”

পুরোনো দিনের কথায় হঠাৎ বুকের ভেতরে একটু যেন ঢেউ খেলে গেল, বললাম, “সবই তো জানো!”

—“তোমারই মনের অংশীদার গো আমি, জানবো না কেন? এখনও তো লুকিয়ে রেখেছো সেই চিঠিটা ‘গল্পগুচ্ছ’-এর ভেতর। যদি চাও, তবে সেটি দাও আমায়।”

—“চিঠিখানা? আচ্ছা বেশ, একটু বস, এক্ষুনি নিয়ে আসছি।”

ছুটে গেলাম পড়ার ঘরে, টেবিলের পাশেই রাখা ছিল ‘গল্পগুচ্ছ’, তারই পাতার ভাঁজে খুঁজে পেলাম সাত বছর পুরোনো সেই না-দেওয়া চিঠিখানা। কি আজব কাণ্ড, হবু প্রেমিকাকে দেব বলে লিখেছিলাম রাত জেগে, কিন্তু পারিনি দিতে আর আজ সেই চিঠি দিতে যাচ্ছি আমার মনের মানসীকে।

চিঠি হাতে ফিরে এলাম বসার ঘরে। কিন্তু একি, কোথায় মানসী, কোথায় গেল আমার সখী!! তন্নতন্ন করে খুঁজলাম সারা ঘর, কেউ তো নেই কোথাও। আয়নাটাও তো নিরেট হয়ে দাঁড়িয়ে, কই আর টলমল করছে না তো আগের মতো। কেউ তো নেই, খালি সোফায় শুধু চিরুনিখানা পড়ে আছে।

অলংকরণ - প্রমিত নন্দী
মূল ছবি - লিওন জার্নীতস্কি

গ্রান্টেড

অভিষেক মিত্র


অনেকদিন থেকেই একটা ভালো মোবাইল ফোন কেনার ইচ্ছে দীনেশের। কিন্তু ওদের অর্থনৈতিক যা অবস্থা তাতে আর ঠিক কেনা হয়ে উঠছিল না। টিউশনি করে যা পায়, তার প্রায় অর্ধেকটা খরচ হয়ে যায় কলেজের ফি দিতে। বাকিটা মাসের শেষে মায়ের হাতে তুলে দেয়, পাঁচ জনের সংসারে যতটা সাহায্য করা যায় আর কি। তবুও প্রতি মাসে একটু একটু করে টাকা জমায় ও। কখনও টিফিন না খেয়ে আবার কখনও ক্লাস তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলে হেঁটে বাড়ি ফিরে। কিন্তু তাতে আর কতই বা বাঁচে?

দীনেশ বাংলায় অনার্স করছে চারুচন্দ্র কলেজ থেকে। পড়াশোনায় যে খুব ভালো তা নয়, তবে একদম খারাপও নয় সে। মোটামুটি রেজাল্ট করেছে প্রথম বর্ষে, ৫১ শতাংশ। ওর ইচ্ছে বাংলায় এম. এ. করবে। কিন্তু এই অবস্থায় কতদিন আর পড়াশোনা চালাতে পারবে জানে না ও। চন্দ্র বলে, “তুই শুধু শুধু চিন্তা করিস। তোকে তো আগেই বলেছি, গ্রাজুয়েশনটা শেষ কর আমার কাকাকে ধরলে কোথাও ঢুকিয়ে দেবে ঠিক। এম. এ. করে কি করবি?”

দীনেশ বলে, “না রে ভাই, যতদিন পারব এম. এ. করার চেষ্টা চালিয়ে যাব। ওটা আমার স্বপ্ন রে।”

চন্দ্র হল দীনেশের প্রিয় বন্ধু চন্দ্র শেখর তিওয়ারী। ওই একই কলেজে পড়ে অঙ্কে অনার্স। ওদের অবস্থা বেশ ভালো। লেখাপড়ায়ও দীনেশের তুলনায় ঢের ভালো ও। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে গত বছর। দুজনের মধ্যে সামাজিক ফারাকটা একটু বেশি হলেও ওদের বন্ধুত্বের মাঝে কোনদিন তা আসেনি। কলেজে তো সবাই ওদের মানিক জোড় বলে ডাকে। তবু একটা কথা চন্দ্র শেখরকেও বলে নি দীনেশ, যে সুচন্দ্রাকে ও খুব ভালবাসে। ও জানে, বললেই চন্দ্র লেগে পড়বে জড়ি-মেকার হিসাবে আর সারা কলেজে রটে যাবে ব্যাপারটা। দীনেশ জানে, ওদের যা অবস্থা, তাতে প্রেম করা চলে না।

যাই হোক, গত এক বছর ধরে টাকা জমাচ্ছে ও, মোবাইল কেনার টাকা। কিন্তু এখনও সেটা দেড় হাজারেই আটকে। দীনেশ ভাবল, ‘এতে তো চায়না মোবাইলও হবে না’। মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর। ভেবেছিল পরীক্ষা শেষ হলে নতুন মোবাইল কিনবে। তৃতীয় বর্ষের নতুন ক্লাসে নতুন ফোন। কিন্তু তা আর হবে না মনে হয়। চন্দ্রকে কথাটা বলতে ও বলল, “সে কি রে! এ আবার কোন প্রবলেম নাকি? চল তোকে সস্তায় ভালো মোবাইল কিনিয়ে দিচ্ছি। সিগারেট খাওয়াতে হবে কিন্তু। গোল্ড ফ্লেক।”

দীনেশ রাজি হয়ে গেল। চন্দ্রের উপর ওর অগাধ বিশ্বাস। কলেজের পাশে হারুদার দোকান থেকে দুটো গোল্ড ফ্লেক কিনে একটা চন্দ্রকে দিয়ে বলল, “চল। কিন্তু জায়গাটা কোথায়?”

“খিদিরপুরের ফ্যান্সি মার্কেটে চ, অনেক কমে ভালো মোবাইল পেয়ে যাবি। আমার চেনা দোকান আছে।”

খিদিরপুর যে মাত্র চোদ্দশো টাকায় নতুন এন ৭২ পেয়ে যাবে সেটা দীনেশ স্বপ্নেও ভাবেনি। আনন্দে চন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে ও বলল, “থ্যাংকস ভাই। আর একটা সিগারেট খাবি? গোল্ড ফ্লেক?”

একটা সিম কার্ডও ওখান থেকেই কিনে নিল ও। তিরিশ টাকায় তিরিশ টাকা টক টাইম। কলেজে ফিরে নতুন ফোন দেখাল সবাইকে। সুচন্দ্রা তো প্রায় ভিরমি খাচ্ছিল দাম শুনে। সুচন্দ্রা হেসে বলল, “কেয়া বাত বস। কাঁপিয়ে দিলে তো।” দীনেশ কিছু বলে না। সুচন্দ্রার এই হাসিটা দীনেশের সবচেয়ে প্রিয়। ওকে হাসতে দেখলে ও যেন সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যায়।

ভালোই চলছিল, কিন্তু ঘটনাটা ঘটল সেইদিন রাতে। শুতে শুতে রোজই প্রায় বারোটা বাজে দীনেশের। সেইদিনও তাই হল। সবে আলোটা বন্ধ করেছে, ওমনি ফোনটা বেজে উঠল। ফোনে সুচন্দ্রা আর চন্দ্র ছাড়া কারুর নম্বরই সংরক্ষণ করা হয়নি। তাই ফোনটা চোখের সামনে এনে নম্বরটা দেখতে গেল ও। মোবাইলের স্ক্রিনে লেখা আছে জিরো কলিং। একটু অবাক হল দীনেশ। জিরো বলে আবার কার নম্বর সেভ হয়ে গেছে। ও নিজে তো সেভ করেনি এটা ওর স্পষ্ট মনে আছে। তবে কি চন্দ্র করল মজা করে। ভাবতে ভাবতে ফোনটা কেটে গেল। নম্বরটা দেখার জন্য কল লিস্টে দেখল দীনেশ। কই কোনও মিস্‌ড কল নেই তো? কি হল? নতুন ফোন গণ্ডগোল করছে ভেবে কান্না পেল দীনেশের। দোকানদার কেনার সময়ই বলে দিয়েছে, “দেখুন দাদা, এসব কাস্টমসে ধরা পড়া মাল। গ্যারান্টি নেই কিন্তু। ভালো করে চেক করে নিন।” কি করবে ভাবছে, এমন সময় আবার ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে সেই জিরো কলিং। ফোনটা কানে দিল দীনেশ।

“হ্যালো।”

ওর ‘হ্যালো’-র জবাব না দিয়ে একটা ভীষণ রকম গম্ভীর ও কর্কশ স্বরে ওপার থেকে কথা এল, “তুমি খুব ভাগ্যবান দীনেশ সেন যে এই ফোনটা তুমি পেয়েছ।”

একটু বিরক্ত হয়েই দীনেশ বলল, “দেখুন দাদা, অনেক রাত হয়েছে ফোনটা রাখুন। এটা মজা করার সময় না।”

এই বলে দীনেশ ফোনটা কেটে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আবার বেজে উঠল ফোনটা। ‘ধুর,’ বলে ফোনটা অফ করে দিল ও। মনে মনে বলল, “কর এবার যত করতে পারিস।”

দীনেশকে প্রায় চমকে দিয়ে আবার বেজে উঠল ফোনটা। এইবার একটু ভয় লাগলো ওর। এই কাণ্ড যে ঘটতে পারে সেটা স্বপ্নের ভাবেনি ও। এবার বেশ ভয়ে ভয়েই ফোনটা ধরল ও।

সেই একই রকম গলায় ওপার থেকে কথা ভেসে এল, “আমি জিরো মানে শূন্য। তার বেশি জেনে তোমার কাজ নেই। শুধু এটা জেনে রাখো যে আজ থেকে তোমার ভাগ্য পালটে যাবে।”

“মা- মানে?” দীনেশর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে।

“আমি তোমার চারটে উইস পূর্ণ করব। ভেবে চিনতে বল কি চাও, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমার একটা করে উইস পূর্ণ হলেই আবার আমার ফোন পাবে। কিন্তু একটা শর্ত আছে।”

“কি শর্ত?” একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল দীনেশ। শুধু ভয় নয়, মনে মনে একটু আনন্দও হচ্ছে ওর। ছোটবেলায় ঠাকুমার কাছে আলাদীনের গল্প শুনেছিল ও। আলাদীনের সেই আশ্চর্য প্রদিপের।

“শর্ত হল এই যে তুমি যা চাইবে আমি তার উল্টোটা করব। মানে অপোজিটটা। তাই ভেবে চিনতে বল তোমার প্রথম উইসটা কি?” একই রকম কর্কশ গলায় বলল ‘জিরো’।

দীনেশ চুপ করে আছে। কি চাইবে বুঝতে পারছেনা। একবার ভেবেছিল ফোনটা কেটে দিক। তার পর মুহূর্তে মনে হয়েছিলো সত্যি যদি ওর চারটে উইস পূর্ণ হয় তাহলে ওদের সব দুঃখ দুর্দশা ঘুচে যাবে। বেশ খানিকক্ষণ ভেবে দীনেশ বলল, “পরশু আমার রেজাল্ট, আমি যেন পরীক্ষায় লাস্ট হই।”

অপারের কর্কশ স্বর বলে উঠল, “গ্রাণ্টেড।”

ফোনটা কেটে যাওয়ার পর দীনেশ আবার চেক করেছিল কল লিস্টটা। কোন নম্বর নেই। সেই কলটার কোন চিহ্নই নেই। সেই ফোনের কথাটা সবার থেকেই চেপে গেল ও। চন্দ্রকেও বলল না।

এই ঘটনার দুদিন কেটে গেছে। আজ রেজাল্ট দীনেশদের। সকালবেলায় ঠাকুর প্রনাম করে, বেশ ভয়ে ভয়েই কলেজে গেল। ও। অষ্টম পেপারটা খুব একটা ভালো হয় নি ওর। রেজাল্টের টেনশনে রাতের ফোনটার কথা প্রায় ভুলেই গেল ও। রাস্তায় যানজট থাকার দরুন কলেজে পৌছতে আধ ঘণ্টা দেরী হয়ে গেল দীনেশের। রেজাল্ট টাঙিয়ে দিয়েছে এতক্ষণ। ‘কি জানি কি হবে’, এই ভেবে বেশ একটু চিন্তিত হয়েই কলেজে ঢুকল ও।

ওকে ঢুকতে দেখেই চন্দ্র দৌড়ে এল।

“কি গুরু পার্টি কবে হচ্ছে?”

“কিসের পার্টি?” বুকটা ধুকপুক করছে দীনেশের।

“আরে পাগলা, তুই যে ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট হয়েছিস রে। তাড়াতাড়ি বল, কবে দিচ্ছিস পার্টি। আমিনিয়ায় খাব কিন্তু।”

মনটা আনন্দে ভরে গেল ওর। মনে মনে ভাবল, ‘একটা উইস পূর্ণ হল। বাকি রইল তিন। অষ্টম পেপার যা দিয়েছিলাম, তাতে জিরো বাবাজির দৌলতেই এই রেজাল্ট।’

রাতে বাড়ি ফিরে ওর রেজাল্ট শুনে মা আনন্দে দিশেহারা হয়ে গেল। ছোট বোন বলল, “দাদা, ফাটিয়ে দিয়েছ কিন্তু।”

দীনেশের মাথায় কিন্তু অন্য কথা ঘুরছে। জিরো বলেছিল ‘একটা উইস পূর্ণ হলে সে আবার ফোন করবে দ্বিতীয় উইস জানতে।’ তার মানে আবার ফোন আসবে আজ রাতে। কিন্তু কি চাইবে আজ? ভাবতে লাগলো দীনেশ। না, আজ আর নিজের নয়, আজ পরিবার আর বাবার জন্য চাইবে ও। ঠিক রাত বারোটায় ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে লেখা জিরো কলিং।

“হ্যালো,” বলল দীনেশ।

আজকেও ওর ‘হ্যালো’-র কোন উত্তর পেল না। সেই একই গলা বলে উঠল, “তোমার প্রথম উইস পূর্ণ হয়েছে। বল, তোমার দ্বিতীয় উইসটা কি?”

আজকে দীনেশ তৈরি ছিল। বলল, “আমার বাবা আজ পনেরো বছর লটারির টিকিট কাটছে। কোনদিন এক পয়সাও প্রাইজ পায় নি। আমার দ্বিতীয় উইস হল, আমার বাবা যেন ‘বেঙ্গল বেস্ট’ লটারির প্রথম পুরষ্কার না পায়।”

ওপারের কর্কশ কণ্ঠ বলে উঠল, “গ্রাণ্টেড।”

এই ঘটনার প্রায় দু মাস কেটে গেল। এই দুমাসে বলার মত কিছুই ঘটে নি। সচন্দ্রাকেও কিছু বলে উঠতে পারেনি দীনেশ। একবার ভেবেছিল চন্দ্রকে বলবে সুচন্দ্রার ব্যাপারে। তারপর ভাবল না নিজেই বলবে সুচন্দ্রাকে যে ও ওকে ভীষণ ভালোবাসে। ওকে ছাড়া দীনেশ বাঁচবে না। অনেক ভেবে ও ঠিক করল যে আসছে সোমবার ও সুচন্দ্রাকে প্রপোজ করবে। এই সোমবার দিনটার বিশেষত্ব হল এই যে সোমবার ‘বেঙ্গল বেস্ট’ লটারির রেজাল্ট বেরবে। সুচন্দ্রা যদি প্রত্যাখ্যান করে তা হলে রাতে তো জিরোর ফোন আসছেই।

সোমবার সকালে বেশ সেজে গুজে কলেজে গেল দীনেশ। বেরনোর আগে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আজ ‘বেঙ্গল বেস্ট’ লটারির রেজাল্ট বেরবে না?” ছেলের এমন একটা প্রশ্নে বেশ অবাকই হল দীনেশের বাবা, শুভময় সেন।

কলেজে ঢুকতে না ঢুকতেই ওদের ক্লাসের শিবজিত দৌড়ে এল। বলল, “দিনু ভাই, আবার পার্টি।”

“আজ আবার কিসের পার্টি বস?” একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল দীনেশ।

“সে কি তুই চন্দ্র শেখরের বেস্ট ফ্রেন্ড আর তুই জানিস না?” হেসে বলল শিবজিত।

“এই শালা, হেঁয়ালি করিস না তো। কি হয়েছে সেটা বল,” একটু রেগেই বলল দীনেশ।

“আরে খিস্তি করছিস কেন? আমি কি করে জানব যে তুই খবরটা জানিস না। আরে চন্দ্র শেখর মাল তুলে ফেলেছে। আমাদের সুচন্দ্রা রে। শালা বুঝতেই দেয় নি, ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিল এতদিন।”

“কি যাতা বলছিস?” মাথাটা গরম হয়ে গেল দীনেশের।

“ভালো, যা নিজেই গিয়ে দেখে ওই ক্যান্টিনে বসে আছে হাত ধরে।”

শিবজিতের কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে ছুট লাগাল দীনেশ। রাগে মাথাটা ঝিমঝিম করছে ওর। বন্ধু হয়ে বন্ধুত্বের সম্মান রাখল না চন্দ্র। ও আবার বন্ধু। দীনেশকে ক্যান্টিনে ঢুকতে দেখে চন্দ্র দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল দীনেশকে। দীনেশ শুধু বলল, “কনগ্রাটস্‌, ভাই।”

দীনেশ আর দাঁড়াল না। ‘একটু কাজ আছে’ বলে বেরিয়ে গেল কলেজ থেকে। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াল। চন্দ্র যে ওর সাথে এই রকম করবে সেটা ও ভাবতেই পারে নি। রাগে ওর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো। চন্দ্রর উপর রাগ আস্তে আস্তে ঘৃণায় পরিবর্তিত হতে লাগলো। মনে মনে ঠিক করে ফেলল ও কি করবে। আজ তো ‘বেঙ্গল বেস্ট’ লটারির রেজাল্ট। তার মানে আবার ফোন আসবে রাত বারোটায়।

বাড়ি ফিরে দীনেশ দেখল হুলুস্থুল ব্যাপার। ঘরে ঢুকতেই ওর মা এসে ওর হাতটা ধরে বলল, “বাবা, তুই যত ইচ্ছে পড়। আমাদের সব দুঃখ ঘুচে গেছে রে। তোর বাবা লটারিতে পঞ্চাশ লাখ টাকা জিতেছে। এতদিনে ঠাকুর মুখ তুলে চাইলেন আমাদের দিকে।”

দীনেশ একটু হাসল মাত্র। এ তো ওর কাছে জানা খবর। ও চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল। মাকে বলল, “শরীরটা ভালো নেই গো। আজ আর খাব না।”

ওর মা দু-এক বার খেতে বলেছিল। দীনেশ তবু সে রাত্রে খেল না। বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন রাত বারোটা বাজবে। ঠিক রাত বারোটার সময় ফোনটা বেজে উঠল। ফোন কানে দিতেই ওপার থেকে জিরোর কর্কশ গলা শোনা গেল, “তোমার দ্বিতীয় উইসটা পূর্ণ হয়েছে। বল তোমার তৃতীয় উইসটা কি?”

“আমার বন্ধু চন্দ্র আমাকে বিটট্রে করেছে। আমার তৃতীয় উইস হল চন্দ্র যেন বেঁচে থাকে,” ভীষণ ঠাণ্ডা গলায় বলল দীনেশ।

ফোনের ওপার থেকে জিরোর গলায় শোনা গেল, “গ্রাণ্টেড।”

আজ গলাটা যেন একটু নরম আর ‘গ্রাণ্টেড’ বলার সময় যেন একটা হালকা হাসির রেশ ছিল। একটু অবাকই হল দীনেশ। যাই হোক, পরের দিন কলেজে গিয়ে শুনল চন্দ্রর নাকি আগের দিন রাত থেকে খুব শরীর খারাপ। সেদিন সকালে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে প্রচণ্ড পেটে ব্যাথা নিয়ে। সুচন্দ্রা বলল, “এই দীনেশ চল না একবার আমার সাথে। সাউথ ক্যালকাটা হসপিটালে ভর্তি আছে ও। চল না একবার দেখে আসি?”

সুচন্দ্রার কোন কথায় না করতে পারে না দীনেশ। তাছাড়া ওর নিজেরও খুব কৌতূহল হচ্ছিলো। দুজনে বাসে করে হাসপাতালে গিয়ে খবর পেল চন্দ্র বেশ অসুস্থ। লিভারে কি যেন একটা হয়েছে। বেশ সিরিয়াস। মুখে দুঃখ প্রকাশ করলেও মনে মনে ভীষণ আনন্দ পেল ও। এত তাড়াতাড়ি যে ওর উইসটা পূর্ণ হবে, সেটা ও ভাবতেও পারে নি। সুচন্দ্রা ভীষণ কাঁদছে। এই একটা জিনিস ওর একদম সহ্য হয় না। সুচন্দ্রাকে একটু সান্তনা দিয়ে উঠে পড়ল দীনেশ। মনে মনে ঠিক করতে লাগলো শেষ উইসে কি চাইবে। কি আবার সুচন্দ্রা আর কি? মনে মনে ঠিক করে নিল কি বলবে জিরো ফোন করলে। বলবে, “সুচন্দ্রা যেন আমাকে বিয়ে না করে।” ব্যস। আনন্দে মনটা নেচে উঠল দীনেশের।

রাতে খাটে শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন ফোন আসবে হাসপাতাল থেকে। কখন শুনবে আনন্দের খবরটা। ওর নিজের শরীরটাও ঠিক ভালো লাগছিল না। রাতে খাওয়ার পর থেকেই বুকে একটা ব্যথা ব্যথা করছে। দীনেশ ভাবল, অম্বল হয়ে গেছে মনে হয়। আর একটু দেখি তারপর না হয় ওষুধ খেয়ে নেব।
একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল দীনেশের। ঘুমটা ভাঙল ফোনের আওয়াজে। তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে দেখল, শিবজিত। ও আজ হাসপাতালে আছে। সুখবরের আসায় ফোনটা কানে দিল ও, “বল?”

“চন্দ্র শেখর এখন ভালো আছে রে। আউট অফ ডেঞ্জার। মনে হয় পরশুই ছেড়ে দেবে।”

“ও আচ্ছা। ভালো খবর।”

খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুটো কথা বলে ফোন কেটে দিল দীনেশ। ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল আবার। ভেবেছিল আজই সব মিটে যাবে কিন্তু না, আবার অপেক্ষা। পাশ ফিরে শুতেই আবার ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল স্ক্রিনে লেখা জিরো কলিং। ‘কি হল?’ একটু অবাক হল দীনেশ, ‘আজ তো ফোন আসার কথা নয়?’ ফোনটা কানে দিল ও, “হ্যালো।”

আজ কিন্তু হ্যালো-র উত্তর এল।

“হ্যালো, দীনেশ। আজ একটু আগেই ফোন করলাম। তোমার তৃতীয় উইসটা প্রায় পূর্ণ হয়ে এল। বল তোমায় শেষ উইসটা কি?”

দীনেশ একটু থমকে গেল। বলল, “কোথায়? এই তো হাসপাতাল থেকে ফোন এল চন্দ্র সুস্থ হয়ে উঠছে। কই ও মরল না তো?”

এবার যেন একটা হাল্কা হাসির শব্দ এল ওপাশ থেকে। জিরো বলল, “চন্দ্র মরবে কেন? মরবে তো তুমি।”

হঠাৎ ভীষণ একটা ভয় চেপে ধরল ওকে। কাঁপা গলায় দীনেশ বলল, “মা-মানে?”

ওপার থেকে কথা এল, “মনে কর তুমি কি বলেছিলে। তুমি বলেছ, ‘চন্দ্র যেন বেঁচে থাকে।’ আমি তো উল্টোটাই করছি। চন্দ্র-র উল্টো তো সূর্য। আর সূর্য মানেই দীনেশ। তাহলে উল্টোটা কি দাঁড়াল?”

দীনেশ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “দীনেশ যেন মরে যায়।”

ধড়ফড় করে উঠে বসল দীনেশ। বসতেই বুঝতে পারল, ওর নাক দিয়ে যেন একটা তরল গড়িয়ে পড়ছে। হাত দিতেই টের পেল ওটা রক্ত। ভয়ে সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল দীনেশের।

জিরো আবার বলে উঠল, “সময় কম দীনেশ। তাড়াতাড়ি বল চতুর্থ উইসটা কি?”

দীনেশ বুঝতে পারছে ওর বুকের ব্যথাটা যেন অনেকটা বেড়ে গেছে। নিশ্বাস নিতে পারছে না ও। বুকের উপর যেন একটা বিরাট পাথর বসিয়ে দিয়েছে কেউ। মৃত্যু ভয়ে দিশেহারা হয়ে গেল ও। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরচ্ছে না। শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে দীনেশ চেচিয়ে উঠল, “আমার কিচ্ছু চাই না, আমি বাঁচতে চাই। আমি বাঁচতে চাই।”

ফোনের ওপার থেকে অল্প হাসি মিশ্রিত কর্কশ গলায় কথা এল, “গ্রাণ্টেড।”

অলংকরণ - প্রমিত নন্দী

দ্য লেপিজ লাজুলি

পারমিতা বণিক


বচসাটা বাঁধল সেইবার শীতকালে। অর্ক যে ফ্ল্যাটে থাকে, তার নীচের ফ্ল্যাটে থাকা ভদ্রলোক নাকি সকালবেলায় দরজা খোলেননি। গৃহ পরিচারিকা সকালবেলায় অনেকবার বেল বাজানোর পরও কোন সাড়া-শব্দ না পেলে ব্যাপারটা এপার্টমেন্টে জানাজানি হয়। জানানো হয় সোসাইটির সেক্রেটারি মহোদয়কে। সোসাইটিতে থাকা অর্কের খুব প্রিয় একজন মানুষ বছর সত্তরের সত্যেন্দ্র মল্লিক। দাদু বলে ডাকে অর্ক। বছর তিনেক উনি এখানে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। উনিই ফোন করে জানালেন অর্ককে। খবর পেয়ে অর্কও ছুটে আসে। দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে দেখা গেল বেডরুমের দরজাটা আংশিক খোলা। ড্রয়িং রুম পেরিয়ে বেডরুমে ঢুকে দেখা গেল ভদ্রলোক বিছানায় শুয়ে। বাম হাতটা বুকের বাঁ দিকে রাখা। এপার্টমেন্টে থাকা কয়েকজনই পেশায় ডাক্তার। এনাদের মধ্যে একজন খুব ভালভাবে চেক-আপ করলেন উনাকে। তারপর বললেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন আকস্মিক। বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে মারা গিয়েছেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই খবর দেওয়া হয় পুলিশকে। পুলিশ না আসা পর্যন্ত কেউই উনাকে স্পর্শ করার সাহস করে উঠতে পারেনি। পেশায় ফটোগ্রাফার অর্কের চিরসাথী তার গলায় ঝুলানো ক্যামেরা। আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনাটির প্রত্যেকটি দিক সে খুঁটে খুঁটে ক্যামেরাবন্দী করল। সদলবলে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির পুলিশের কর্তাবাবু।

“তা এনার নিজের লোকেদের কোনও খবর দিয়েছেন আপনারা?” পুলিশের কর্তাবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

“আজ্ঞে উনার নিজের লোক বলতে নাকি কেউই নেই। বছর দেড়েক এই ফ্ল্যাটটি কিনেছেন। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে কাজ করার কাগজপত্তর সোসাইটি ফাইলে জমা দিয়েছিলেন। বড্ড ভাল মানুষ। এই দেড় বছরে কারোর সাথে কোনদিন কোনকিছু নিয়েই ঝামেলা বাধেনি রমাকান্তদার।” সোসাইটির সেক্রেটারি খুব সাবলীলভাবে বললেন।

আইনানুগ যাবতীয় কাজকর্ম শেষ করে ফ্ল্যাটটি তালাবন্দী করে দিল পুলিশ। সারা এপার্টমেন্টে একটা থমথমে ভাব। গলা দিয়ে যেন খাবার নামছে না কারোর। সত্যেন্দ্রবাবুর কথায় সেই রাতটা উনার সাথে উনার ঘরেই কাটাল অর্ক।উনি জানতেন যে রমাকান্তবাবুকে অর্ক ইউ. সি. বলে ডাকতো। মানে আঙ্কেল চকলেট। অর্ককে প্রায়ই চকলেট দিতেন কিনা! তাই।অর্ক যেন একটা ধাক্কা গেল ব্যাপারটায়। সবসময়ের ছটফটে অর্ক একেবারে চুপ করে গেল। সত্যেন্দ্রবাবু সেই রাতটা তাই একা ছাড়লেন না অর্ককে।

পরের দিন সকালেও অর্কর ছটফটানির পারদ কিছুতেই নামছে না। কোথায় যেন কি যেন একটা হিসেবে গন্ডগোল। না মেলা অঙ্ক ভেবে ছেড়ে দেবার পাবলিক অর্ক নয়। কিন্তু মেলাতে পারছে না কিছুতেই। নিয়মানুবর্তিতার অনুশীলনকারী এমন একজন মানুষ খুব কমই দেখা যায়। অর্কের সাথে খুব কথা হতো ইউ.সি.-র। হঠাৎ অর্কের স্মৃতিপটে ভেসে উঠল একটি ছবি।দৌড়ে গিয়ে ফ্ল্যাশ হয়ে আসা ছবিগুলো থেকে একটা ছবি বের করল। এবারে অর্কের গোয়েন্দা দিমাগ মাথাচারা দিয়ে উঠল। ইউ.সি.-র পাশে রাখা একটি বই। শরদেন্দু বন্দোপাধ্যায়ের কাহিনী, ব্যোমকেশ বক্সীর ‘সত্যান্বেষী’।

“ইমাজিনেশনের জগতে বিচরণ আমার কম্ম নয়। বিশেষ করে ডিটেকটিভ ফিকশন তো নয়ই।”, ইউ.সি.-র বলা কথাটি বার বার কানে বাজতে লাগল অর্কের।

ধোঁয়াশার ঘেরাটোপ থেকে যেন বেরিয়ে আসছিল জিনিসপত্র। তার মানে ব্যাপারটা এতো সরল নয়। সেই রাতে বিল্ডিং এর পেছনের পাইপ বেয়ে ব্যালকনি মাধ্যমে ইউ.সি.-র ঘরে ঢুকল অর্ক। টর্চের আলোয় দেখতে লাগল কোথাও কিচ্ছু যদি মেলে। বইয়ের তাকগুলো খুব সাজানো গোছানো। একেবারে পরিপাটি ঘরটাও। কোন কিচ্ছু পাচ্ছে না অর্ক। টেবিলের উপর রাখা ডাইরির ১৪ নম্বর পাতায় লেখা দেখল সি.বি.এল.। অর্কের মাথায় কিছুই ধরছিল না। কি হতে পারে এর মানে! একটু একটু করে পিছুতে পিছুতে আলমারিতে গিয়ে ঠেকে গেল অর্কের পিঠ। মিলে গেল সমীকরণ! কাপ-বোর্ড লকার। হুট করে ঘুরে কাপ-বোর্ডের দরজাটা খুলল। লকার খুলেই দেখে সেখানে রাখা নীল রঙের একটি ফাঁকা বাক্স। বাক্সের মুখটা খোলা। হয়তো কিছু একটা নেই সেখানে। ঘরে আর কিছু না পেয়ে ফাঁকা বাক্স নিয়ে নিজের ঘরে গেল অর্ক। ঘরে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। অর্কের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে।

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। কিছু দিন ধরে অর্কের ফোনে একটি সমস্যা হচ্ছে। সে কারোর সাথে কথা বলার সময় আরেকটি কল চলে যায় তার শেষবার কথা বলা নম্বরে। অনেকটা নিজে থেকে কনফারেন্স। ভাবতে ভাবতে আরও একটি সূত্র পেল অর্ক। খতিয়ে জানতে পারল শেষবার ইউ.সি.-র সঙ্গে কথা বলার সময় অর্কের বন্ধু আবিরের সাথে কলটা কনফারেন্সে কানেক্ট হয়েছিল। ছুটে গেল আবিরের বাড়ি। ঘরে ঢুকেই দেখে আবির একটি নীল রঙের পাথরের মতো কি একটা হাতে নিয়ে অবিরত হেসেই চলেছে।

ঘুরে তাকিয়ে আবির বলল- “তুই খুব বুদ্ধিমান। জানতাম কেসটা ধরে নিবি। কিন্তু ভাই এবার যে মালিকটা আমি।”

“মানে?”

“শোন। সেদিন ইউ.সি.-র সাথে কথা বলার সময় ফোনটা হঠাৎ কেটে গেছিল। মনে আছে?”

“হ্যাঁ। কিন্তু...”

“বলছি বলছি। ইউ. সি. সেদিন একটি বিশাল রহস্য উদঘাটন করেছিলেন। মানে এটা। যার নাম লেপিজ লাজুলি। যার কাছে এই লেপিজ থাকে, ব্রহ্মান্ডের মালিকানা তার। অপেক্ষা করতে হবে দু-দিন। দু-দিন আমার কাছে থাকলেই ব্যস! সারা ব্রহ্মান্ডের মালিকানা আমার। এই লেপিজ আমায় দেবে চন্দ্র-সূর্য কক্ষচ্যুত করার অসীম ক্ষমতা।”

“সৌরজগতের বাইরে নিয়ে যেতে পারে আমাকে এই লেপিজ। লেপিজের যা কিছু শক্তি সমপরিমাণ আমার হবে মাত্র আর কয়েক ঘন্টা বাদে। আমার গুলাম বানিয়ে রাখবো সবকিছুকে। বলতে বলতে আবিরের চোখ-দুটো লাল হয়ে এলো।

“মানুষতো ধূলিকণাসম মোটে। একেকটি গ্রহ, তথা ব্রহ্মান্ড আমার অঙ্গুলি নির্দেশনায় চলবে।”

হাঁ করে তাকিয়ে রইল অর্ক। “তার মানে এটা তুই চুরি করতে গিয়ে ইউ. সি.-কে মেরে ফেললি।”

“ঠিক তাই! তোর ইউ. সি. এখন স্বর্গ কিংবা নরক কোথাও একটা হবে। তোর ধম্মে সইছে না। তাই না? কিন্তু কিছু করার নেই আসলে। এবার থেকে আমার ইশারায় চলবে সব। মানে আর কয়েক ঘন্টা বাকী শুধু। একটা কাজ কর। একবার ধরে দেখ লেপিজকে। বন্ধু বলে কথা। এইটুকু তো তোর জন্য করতেই পারি।”

অর্ক লেপিজকে স্পর্শ করতেই লেপিজ থেকে বেরিয়ে এলো অজস্র নীলাভ রশ্মি। সারা ঘরে তখন নীল আলোর বন্যা। হঠাৎ একটি নীল রশ্মি যেন তেড়ে এলো আবিরের দিকে। ঝলসে গেল নিমেষে আবির। ঘরের সমস্ত রশ্মি ঘিরে ধরলো অর্ককে। চোখের পলকে রশ্মিজাল অর্ককে নিয়ে গেল ভূপৃষ্ঠের অনেকটা গভীরে। সেখানে গিয়ে অর্ক দেখল চারিদিকটা অন্ধকার। অন্ধকারের ব্যাপ্তি ছাড়া আর কিছুই ঠাহর করা যায় না। রশ্মিগুলো অর্ককে ছেড়ে একত্র হয়ে গেল। নিজে নিজেই ফর্মুলেট হল লেপিজ। লেপিজের আলো ঠিঁকড়ে পড়ছে চারিদিকে।

হঠাৎ একটা ঠক্ ঠক্ শব্দ কানে এলো অর্কের। মশাল হাতে কে যেন একটা এগিয়ে আসছে। চেহারাটা স্পষ্ট হতেই চক্ষু চরকগাছ অর্কের।

“কি নাতি! চোখগুলো দেখি একেবারে ফুটবল হয়ে গেল!”

“দাদু তুমি!”

“হ্যাঁ। আমি। বুঝতে পারছো না তো? ব্যাপারটা বলছি। শোনো।”

“তুমি যেখানে এখন আছো, সেটা ভু-পৃষ্ঠ থেকে দশ লক্ষ ফুট নীচে। কর্ডেক নামক এই জলমগ্ন পাতালের মাত্র এক বর্গ মিটার শুকনো। এটা আমার এলাকা। আর আমি হলাম ইউকোডা। এই ব্রহ্মাণ্ডের ভবিষ্যৎ অধিকর্তা! একদিন জানতে পারলাম আরও প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ ফুট নীচে রয়েছে এই লেপিজ। যা হাসিল করতে পারলে আমি রাজ করব গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। সেই লেপিজকে রক্ষা করে থাকে এক প্রহরী। তার মৃত্যু নেই। তাকে মারতে পারে কেবলমাত্র আর্গন এবং ক্রমিয়ামের সাথে ক্ল্যাসিয়ামের যুগলবন্দীতে তৈরী একটি কঠিন তিলসম পদার্থ। যা প্রহরীকে ছোঁয়ালেই সে অক্কা। ক্ল্যাসিয়াম আমি খুঁজে পাই এখান থেকে তিরিশ লক্ষ ফুট নীচে। তৈরী করলাম মারণাস্ত্র। এবার সেই লেপিজের কাছে পৌঁছাতে গেলে আমার চাই ব্লাকোডার তৈরী শিল্ড। সেটাও তৈরী করলাম রামধনুর সাতটি রঙ দিয়ে। পৌছে গেলাম সেখানে। প্রহরী তার রক্ষাকার্যে ব্যস্ত। আমার অস্ত্র তাকে ছোঁয়াতেই সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। লেপিজ আমার হাতে। কিন্তু নিয়মমাফিক এই লেপিজ নিয়ে আমাকে থাকতে হবে ভূ-পৃষ্ঠে পাঁচ বছর। একজন সাধারণ মানুষ হয়ে। সেখানে গিয়ে সত্যেন্দ্র মল্লিক হয়ে গেলাম। কিন্তু ঠিক বছর তিনেক পরেই হঠাৎ দেখি একদিন লেপিজ উধাও। কোনওমতেই কারোর কিছুই টের পাবার কথা নয়। ইউ.সি.-র কাছে লেপিজটা কি করে গেল সেটা আমার কাছে একটি রহস্য।”

পেছন ঘুরে জলন্ত মশালটা ঠক করে রাখল ইউকোডা।

“ভাবছো তো আবির এসবের মধ্যে কোথা থেকে এলো?”

বলে অর্কের দিকে ঘুরতেই অর্কের চক্ষু ছানাবড়া।

চেহারাটা আবিরের।

“আবির অন্য কেউ নয়। আমিই আবির। আমি একই সময়ে ভিন্ন রূপে দুই জায়গায় থাকতে পারি। আবির শুধু ভূ-পৃষ্ঠে থাকতে পারে। সে এখানে থাকার জন্যে নয়।

“অনেক তো শুনলে গল্প। তোমার দিমাগটা একটু বেশীই চলে। নাও! এবার তোমার ইউ.সি.-র কাছে যাও দেখি।”

বলেই মশালটা ছুঁড়ে মারল অর্কের শরীরে। দাউ দাউ করে আগুন ঘিরে ধরল অর্ককে। সারা শরীর আগুনের কবলে। নোনা হাসি ইউকোডার ঠোঁটে।

কিন্তু এবার যে ইউকোডার অবাক হবার পালা। জ্বলছে না অর্কের দেহ। সেই আগুনের ভিতর থেকে অগ্নিসম ক্রোধে অর্ক তাকিয়ে আছে ইউকোডার দিকে। আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল আগুনের লেলিহান শিখা থেকে। বেরিয়ে আসতে আসতে অর্কের দেহটা দুটো ভাগ হয়ে গেল। একটি চেহারা অর্ক, অন্যটি ইউ.সি। ইউকোডার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে।

অর্ক বজ্রকন্ঠে বলল, “এই যে ইউকোডা, শোন তোমায় এবার আমি পুরো ঘটনা বলি। লেপিজ তার নিয়মমাফিক ভূ-পৃষ্ঠে যাবার ঠিক তিন বছর পরে তৈরী করে নিয়েছিল সেখানে তার দুই রক্ষক। ইউ.সি. এবং অর্ক। আর লেপিজের এক রক্ষীর কাছে ঠিক তখনই সে পৌঁছে যায়। সাধারণ মানুষ হয়ে থাকতে হতো সেখানে দু-বছর। তারপরেই ছিল নিজের জায়গায় ফিরে যাবার পালা। এই দেহে কার্বন নেই। তাই জ্বালাতে তুমি পারলে না।”

বলতে বলতেই লেপিজ থেকে বের হয়ে এলো লক্ষ লক্ষ নীল রশ্মি। সেই নীলরশ্মির স্রোতে অর্ক এবং ইউ.সি.-র দেহ দুটো মিশে গেল। একটি নতুন নীলাভ দেহ তৈরী হল। এবারের চেহারাটা সম্পূর্ণ আলাদা।

ইউকোডার আকাশ-পাতাল এবার উলটে গেল।

ইউকোডা গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না যেন। “প্র-হ-রী!”

“হ্যাঁ। যে কিছুটা সময়ের জন্য বেহুঁশ হয়েছিল মাত্র।”

ইউকোডা কাঁপতে কাঁপতে বলল- “মানে তুমি ব্রহ্মান্ডের...”

প্রহরী গম্ভীরগলায় বলল, “না। আমি লেপিজের পাহারাদার। আর এটাই আমার কাজ।”

ইউকোডা কিছু ভাবতে পারার আগেই প্রহরীর হাতের তালুতে রাখা লেপিজ থেকে বেরিয়ে এল নীলাভ রশ্মির বন্যা। রশ্মিজালে আবদ্ধ করে ফেলল ইউকোডাকে।
ইউকোডা চিৎকার করে বলল, “আমি লেপিজের দিকে নজর দেব না। আমায়...”

বলতে বলতেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল ইউকোডার দেহ। উর্দ্ধমুখী শিখার সাথে অবসান হল এক লুসিফারের।

প্রহরী আবারও রক্ষাকার্যে ব্যস্ত।

আক্ষেপ

সোমা বিশ্বাস


অলীক আমার স্বপ্নরা
রৌদ্রপোড়া শরীর নিয়ে
এখনও কী হাতড়াও কিছু?
তোমার মত নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হয়েছি আমি
ক্ষ্যাপাটে জীবন কাটাব বলে

যাও তরঙ্গরা একে একে
নিস্তরঙ্গ হই আমি।
বাউল না হতে পারার অবুঝ কষ্টটাকে
আর আঙুলের ডগায় নাচিও না।

লোহার চেয়েও শক্ত

স্বরূপ মুখার্জ্জী

হাতের তালুতে জল ধরে রাখা হলো
আগুনের মুখ বন্ধ হয়ে গেলো,
ব্যক্তিগত কিছু কথা শ্যাম্পেনের জলে রঙীন হয়ে উঠল,
লোহার চেয়েও শক্ত কিছু ধাতব পাত আছে
অথচ সে লোহা নয়...
সুর্যের আলোতে ব্লেডের দেহ থেকে তির্যক ভাবে রশ্মি বের হয়
অথচ লোহাতে মরচে পড়ে,
ইস্পাতীয় কিছু সম্পর্ক মানুষের মধ্যেও আছে
সুর্য রশ্মি না পড়লে অস্তিত্ব বোঝা যায় না,
একটা উল্কা খন্ড বিবর্তনের পথে ঘুরছে
নিভন্ত আগুনের মুখে ছুঁড়ে মারব।

স্নেহ কৌটো

সম্রাট পাল


ঘুমানোর আগে,
প্রিয় মানুষদের হৃদয়ে ঘুরে আসি প্রতি রাতে একবার।
কড়া নাড়লে,
দরজা না খুলে দরজার ওপারে বসে কাঁদতে থাকা মানুষটার সিঁড়িতে ভালোবাসার বৃত্ত এঁকে দিয়ে যাই
ঘুমিয়ে গেলে আসে আমার হৃদয়ে সেই মানবী
জ্যামিতিক হিসাব সেরে ফিরে যায় আপন স্রোতে।

একবার ঘুরে আসি বাবা আর মায়ের হৃদয়ের থেকে,
আমার মত অকৃতজ্ঞ সন্তান পেয়েও যারা আহ্লাদে সওয়ারী বাজায় ।
তাদের বুকে চিন্তার বাতে মলম লাগিয়ে দিই

ঘুরে আসি বোন আর বড়দার হৃদয়ে,
স্নেহের কৌটো রেখে আসি তাদের কাছে সাবধানে
যেন টের না পায়!

নিজের ভিতর ঘুমিয়ে যাই হৃদয়ের গায়ে কম্বল জড়িয়ে।

একটি সমুদ্রকথা

সোমেন চক্রবর্তী


খোলা চুলের কথা ভাবতে ভাবতে
তোমাকে ভেবে নিয়েছি একটা সাগর,
ঢেউ খাচ্ছে সরল বাতাস,
সূর্যের উঠা নামা ও তারার পতন সামলে জলজ অধ্যায়,
সৈকতে দাঁড়িয়ে ভেঙে গুঁড়ো হচ্ছে আমার ঝিনুক মন,

একটা অন্য আমি অগোচরে ঢুকে গেছি ভিতরে,
অদ্ভুত অনুভব শিরা উপশিরায় শিহরণ জাগায়,
সাঁতরে যাই নিচে, আরো নিচে,
উপরে যতটা উত্তাল এখানে ততটা স্থিত,
আরো গভীরে গুমোট অন্ধকার
তারপর অনাবৃত রহস্য,
অজস্র ক্ষত দাগ, প্রবাল, শঙ্খ, একটা আলাদা জগৎ,
বহু নাবিকের ফেলে যাওয়া লালা
জাহাজের বীর্য,
তোমার শাড়ীর আঁচলে গাঢ় নীলরং,
চঞ্চল মলাটের খুব গভীরের অন্য ইতিহাস।

সৈকতে ফিরে এসে দেখি
খোলা চুল সরিয়ে এক মিষ্টি হাসি
ঢেকে দিচ্ছে সাগরের যাবতীয় নীল ঢেউ,
চেহারায় জ্বলছে এক অহংকারী সূর্য।

সুরতহাল

কল্যাণ মন্ডল

তদন্তের গতিপ্রকৃতি অাবহাওয়া নাজেহাল
লাশের উপর ফুলের মালা
ক্ষুরধার বিশ্লেষণে ঘটনার সুরতহাল।
ভেসলিন মাখা চোখের জল
অাঁচলতলে স্বস্তির শ্বাসে
শয়তান ঢাকে বহুরূপি খল।
মেঘের অাড়ালে ক্লান্ত সূর্য
অাঁতকে ওঠে সুখ তন্দ্রা
অাতর মেখে গন্ধ ছড়ায়
সুবাস হারায় রজনীগন্ধা।
দমকা হাওয়ায় নিভছে প্রদীপ
মরকের কবলে পারিজাত
চাঁদের অালো গভীর খাদে
অালোর দিশা জোনাকীরাত।

মনমরা

অঙ্কন ভট্টাচার্য্

অন্তরেতে সুখ লুকায়ে
সুখ খুঁজিছে বাহির পানে।
ঘৃণার ভীড়ে অটুট রহি
আত্মা মজে ঈর্ষা-গানে।
বিকিয়া যায় শুদ্ধ মেজাজ
ধর্ম-শ্রেণী বিভাজনে।
নীরব রোষে, অন্ধকারে,
মন মারা যায় বাঁচার টানে।।

অভিসন্ধি

স্নেহাশিস পালিত

যে সমীরণ দিয়েছিল প্রতিশ্রুতি,
স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় কুসুম ফোটাবে বলে।
কুঞ্জ ভরিয়ে দেবে মিষ্টি সুবাসে..
সে কথা রাখেনি -
হয়তো রাখতে পারেনি!

প্রকৃতির অনিবার্য নিয়মে সে বাঁধা..
গভীর নিম্নচাপের কড়া নির্দেশে
বইতে হল নির্মম গতিবেগে।
ঝঞ্ঝার বার্তা নিয়ে এল -
প্রলয়ের সমূহ সঙ্কেতে!

হয়তো বা নতুন কোন নির্দেশিকা
অবিদিত সঙ্কেতের মাঝে লুকানো..
সৃষ্টির আপাত সংহার তুচ্ছ সেখানে
বিধির গোপন বিধান -
রেখে যাবে ধ্বংসের আড়ালে!

কথা না রাখা কোন দোষের কিনা..
পরিস্থিতি আর প্রাধান্যের নিক্তিতে
দোষ-গুণ সবই আপেক্ষিক।
ভালোমন্দের নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ -
লেখা হয় কালের গভীরে।

আত্মলীন

মৌসুমী ভট্টাচার্য

যে নীল গভীরে ডুবে আছো
একবার শুধু উঠে এসো সেখান থেকে
নিশব্দ পদক্ষেপে যেমন চোখের আড়ালে
রাত আসে.. শিরা-উপশিরায় ছড়ানো থাকে
অন্ধকারের জলসায় সাজানো সুখটান!
ম্যাপল পাতার দিনগুলো ভাসতে ভাসতে
এখন অনেক দূরে.. আমি আপাতত
থেমে আছি কোন স্থির দীর্ঘশ্বাসের
অপেক্ষায়...
অশরীরী হাওয়ারা তোমায় ঘিরে ধরলে
নির্লজ্জ পৃথিবীর দিকে সব বিষ ছুঁড়ে দিয়ে
নির্বিষ নীলে নিজেকে আবারও
ঢেকে নেওয়ার আগে তুমি একবার সাড়া দিও

আমি একটা রাত মৃত্যুর জন্যে সযত্নে রেখেছি..

মনে রেখো

সোনালী মন্ডল আইচ

জলাভাব অথবা
যে কোনো ক্রাইসিস হলে
অত্যাবশ্যক কাজ হল
কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া

নিরিবিলি সময়ের ভাঁজে
একটা লম্বা শ্বাস, এতে
হৃদযন্ত্রের বিষের মাত্রা কমে

অহংকারী যৌবন পিছল
এক পা সঠিক
আর এক পায়ে অজস্র ভুল

সন্দেহের ঝাঁঝালো বৃত্ত
নামতে নামতে মাটি ছুঁয়ে
ক্যাকটাস জন্মায়

আসলে তা বাঘনখ
এই রকম সন্ধিক্ষণে
আলিঙ্গন মারাত্মক

ভালোবাসা ড্রাকুলা হয়ে
রক্ত চাইবে!
শরীরের স-ম-স্ত রক্ত!
ডেসডিমোনা সাক্ষী...

দ্বিতীয় অধ্যায় এক প্রাচীন ঘটনা এবং একটি আতঙ্ক

দ্বিতীয় অধ্যায়
এক প্রাচীন ঘটনা এবং একটি আতঙ্ক



দ্বিতীয় অধ্যায়- প্রথম পর্ব

মানুষটার সম্পর্কে প্রচলিত কিংবদন্তি, যেমনটা চার্লস শুনেছিল এবং যেসব তথ্য সে খুঁজে বার করে তার ভিত্তিতে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে জোসেফ কারওয়েন এক অত্যন্ত বিস্ময়কর, রহস্যময়, এবং ভীষণ রকমের ভয়ানক প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন। এমন একটা সময়ে সালেম থেকে প্রভিডেন্সে পালিয়ে এসেছিলেন মানুষটা যখন ডাইনী চর্চার গুজব ওখানে ছড়াতে শুরু করেছিল ব্যাপকভাবে। কারওয়েনের চলে আসার প্রধান কারণ তার নানাবিধ উৎকট রাসায়নিক বা অপরসায়ন গবেষণা। যার জন্য চারদিক থেকে অভিযোগ উঠছিল। এদিকে প্রভিডেন্সের এলাকা ছিল সব রকম অদ্ভুত, উদ্ভট এবং অতিরিক্ত মাত্রায় স্বাধীন মানসিকতার মানুষদের আশ্রয়স্থল- মুক্তাঞ্চল। সে সময় তার বয়স দেখে মনে হতো মোটামুটি তিরিশ। গায়ের রঙ ফ্যাকাশে। বিদ্যেবুদ্ধির জোরে খুব শীঘ্রই একজন কেউকেটা রূপে নিজেকে সবার সমানে মেলে ধরেন এবং প্রভিডেন্সে বসবাস করার যোগ্যতা লাভ করেন। এরপরে ওলনি স্ট্রিটের পাদদেশে গ্রেগরি ডেক্সটারের বাড়ীর উত্তর দিকে একটি বাড়ি কিনে নেন। বাড়িটা ছিল টাউনস্ট্রিট এর স্ট্যাম্পারস হিলের পশ্চিমে। পরবর্তী সময়ে যা ওলনিকোর্টের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ১৭৬১ সালে উনি ওই একই জায়গায় আগের বাড়ীটাকে ভেঙে আর একটা বড় ভবন নির্মাণ করেন। যা এখনও দেখতে পাওয়া যায়।

জোসেফ কারওয়েন সম্পর্কে প্রথম যে অদ্ভুত ব্যাপারটা মানুষের চোখে পড়ে তা হলো তার প্রভিডেন্স আগমনের পর থেকে বেশ কয়েক বছর কেটে যাওয়ার গেলেও বয়ঃবৃদ্ধির কোনো ছাপ তার শরীরে দেখা যায় না।

শুরু করেন জাহাজি ব্যবসা। কিনে নিয়েছিলেন মাইল-এন্ড কোভের একটা জাহাজ ঘাটা। ১৭১৩ সালে গ্রেটব্রিজ পুনর্নির্মাণে সাহায্য করেন। ১৭২৩ সালে পাহাড়ের উপর কংগ্রেগ্রেসন্যাল চার্চ প্রতিষ্ঠাতাদের দলে থাকেন। এতোগুলো বছর কেটে যাওয়ার পরেও কিন্তু উনাকে দেখে ত্রিশ বা পঁয়ত্রিশ বছরের বেশী বয়স্ক বলে কখনোই মনে হয়নি। কয়েক দশক ধরে একই অবস্থা বজায় থাকায় নিশ্চিতভাবেই ব্যাপারটা মানুষের মনে প্রশ্নের জন্ম দেয়। যার এর উত্তরে কারওয়েন সর্বদা একই কথা বলেছেন। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন খুব শক্ত পোক্ত কাঠামোর মানুষ এবং তিনি নিজেও খুব নিয়মনীতি মেনে জীবনযাপন করেন বলেই তার শরীরে বয়সের ছাপ পড়ে না। ঠিক কি ধরনের সরল এবং নিয়মে বাঁধা এই জাহাজি বণিকের জীবনযাত্রা তার অস্পষ্ট ছবিও শহরের কেউ কল্পনার চোখে আন্দাজ করতে পারতো না। যেমন বুঝতে পারতো না কেন সারা রাত ধরে কারওয়েন ভবনের সব জানালায় মিটমিট করে আলো জ্বলে। স্বাভাবিকভাবেই এইসব কারণেই তার দীর্ঘ সময় ধরে বেঁচে থাকা এবং শারীরিক পরিবর্তন না হওয়া নানান গুজবের জন্ম দেয়। এইসব রটনার বেশীর ভাগ অংশে থাকতো কারওয়েনের অবিরাম রাসায়নিক পরীক্ষা নিরীক্ষার গল্প। গুজব অনুসারে উনি নাকি তার জাহাজে করে লন্ডন এবং ইন্ডিজ এলাকা থেকে বিভিন্ন অদ্ভুত পদার্থ আনাতেন। সেসব জিনিষ কেনা হতো নিউপোর্ট, বস্টন এবং নিউইয়র্কের নানান বন্দর থেকে। ইত্যবসরে রেহোবথ থেকে এসে বৃদ্ধ ডাঃ জ্যাবেজ বোয়েন গ্রেটব্রিজের কাছে ইউনিকর্ন এবং মর্টারের সাইনওয়ালা বোর্ড টাঙিয়ে তার ঔষধের দোকান খুলে বসেন। আর সেই দোকানে কারওয়েনের অত্যধিক আনাগোনা জনগণের নজরে পড়ে। সাথেই গাদা গাদা মাদকদ্রব্য, অ্যাসিড এবং জানা অজানা ধাতু অবাধে কেনেন এবং অর্ডার দিয়ে আনানোর ব্যবস্থা করেন। মানুষজন ধরেই নেয় কারওয়েন নিশ্চিতভাবেই বিশেষ কোনো অদ্ভুত এবং গোপন চিকিৎসা দক্ষতার অধিকারী। অতএব সাহায্য লাভের আশায় বিভিন্ন প্রকারের রোগগ্রস্থ মানুষ ধরনা দিতে শুরু করে তার প্রাসাদে। এসবে বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে উনি আগতদের বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখার পথেই হাঁটেন এবং তাদের অনুরোধকে সম্মান দিয়ে সবসময় এক অদ্ভুত রঙের তরল ওদের দিতেন সেবন করার জন্য। যদিও সে পানীয় খেয়ে কারোর কোন লাভ বা ক্ষতি হয়নি। এভাবেই কারওয়েনের আগমনের পর থেকে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলো। বাকিদের বয়স বাড়লেও জোসেফ কারওয়েনের মুখাবয়ব এবং বাহ্যিক চেহারার বয়েস বাড়লো সাকুল্যে পাঁচবছর। এবার মানুষের আলোচনার ফিসফিসানি কল্পনার পাখা মেলে ক্রমশ অন্ধকার শয়তানি জগতের সাথে এর সম্পর্ক জুড়তে শুরু করলো। যার ফলেই উৎসাহী মানুষের অর্ধেকেরও বেশি ক্রমশ এক অজানা আতঙ্কে কারওয়েনের কাছ থেকে দূরে থাকাই সম্যক বোধ করলো। ঠিক এরকম একাকীত্বর বাসনাই কারওয়েন মনে মনে কামনা করতেন।

সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা নানান চিঠি এবং ডায়েরি থেকে বোঝা যায় যে, আরো অনেক কারণেই জোসেফ কারওয়েনকে দেখে মানুষ আশ্চর্য হয়ে যেতো ,ভয় পেতো এবং প্রায় প্লেগ রোগের মতো ঘৃণাও করতো। কবরস্থানের প্রতি মানুষটার আগ্রহ ছিল অপরিসীম। যে কোনও দিনে যেকোনো সময়ে তাকে একবার না একবার কবরখানায় দেখা যেতই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এরকম জায়গায় কাটানোর কারণে তার নামটার সাথে একটা ভয় জাগানো কুখ্যাতির ছাপ পড়ে গিয়েছিল। যদিও কেউ এটা বলেনি যে কবরখানায় কোন রকম অদ্ভুত বা ভয়ানক প্রেতচর্চা জাতীয় কিছু ঘটাতে তারা দেখেছে কারওয়েনকে। পটুয়েক্সট রোডে তার একটা খামার ছিল। যেখানে সাধারণত গ্রীষ্মের সময় উনি বসবাস করতেন। ওই এলাকায় তাকে দিন বা রাতে যে কোন সময়ে প্রায়ই ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। এই খামারের দেখাশোনা করতো ন্যারাগ্র্যান্সেট ইন্ডিয়ান উপজাতির দুজন বয়স্ক মানুষ। স্বামী স্ত্রী। স্বামী মানুষটা বোকা ধরনের দেখতে, সাড়া মুখে অদ্ভুতভাবে কাটাকুটির দাগ এবং বোবা। স্ত্রী এর মুখাবয়ব ততোধিক হতকুৎসিত। হয়তো নিগ্রো রক্তের প্রভাব। এই বাড়ির সাথেই ছিল এক ল্যাবরেটরি। যেখানে বেশিরভাগ রাসায়নিক পরীক্ষাগুলো করা হতো। সেই সব মানুষ যারা এখানে বোতল, ব্যাগ বা বাক্স জাতীয় মালপত্র ডেলিভারি দিতে আসতো, তারা পেছনের ছোট দরজাগুলির ভেতর দিয়ে কৌতূহলী চোখে উঁকি মেরে দেখতে পেতো অদ্ভুত আকৃতির সব ফ্লাস্ক, ক্রুসিবল, অ্যালেম্বিক্স, এবং চিমনী দিয়ে সাজানো ল্যাবের ভেতরটা। ওরা নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে আলোচনা করতো ওই কাইমিস্ট [মানে অ্যালকেমিস্ট আর কি] খুব শীঘ্র ফিলোজফার স্টোন বানিয়ে ফেলবে।

এই খামারের নিকটতম প্রতিবেশী ছিল –ফেনার্সরা , কোয়ার্টার মাইল দূরে ছিল ওদের বাড়ী। রাতে কারওয়েনের খামার থেকে ভেসে আশা অদ্ভুত উদ্ভট কিছু শব্দ শুনতে পাওয়ার কথা দৃঢ়ভাবে জানিয়েছিল। সেসব ছিল কান্নার মতো শব্দ বা একটানা পাশব হাউলিং। মাত্র তিনজন মানুষের জন্য বৃহৎ সংখ্যক গবাদিপশু পালন করাটাও, তাদের যেন কেমন কেমন লেগেছিল। তিনজন মানুষের কতটাই বা মাংস, দুধ এবং উল দরকার হতে পারে, এই প্রশ্ন তুলেছিল। কৌতূহলজনক আর একটা ব্যাপার এই যে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কিংস্টাউন কৃষকদের কাছ থেকে নতুন নতুন গবাদি পশু কিনতেন জোসেফ কারওয়েন। আগের দলের পশুগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যেত। এছাড়াও, ওই খামারে ছিল একটা বিরাট উঁচু পাথরের বাড়ী। যা নিচের দিকে জানলা বলতে কিছুই ছিল না। ওপরে কিছু ছোট ছোট গর্ত ছিল দেওয়ালের গায়ে জানলার পরিবর্তে।

শহরে ওলনিকোর্টের বাসভবন নিয়েও গ্রেটব্রিজের ভবঘুরেরা নানান কথা চালাচালি করতো। ১৭৬১ সালে নির্মিত নতুন বাসভবনের কথা নয়। ওরা কথা বলতো সেই বাড়িটার বিষয়ে যেখানে কারওয়েন প্রথমে বসবাস করতো। এই সময় মানুষটির বয়স প্রায় একশো ছুঁয়ে ফেলেছে। নিচু –ছাদের বাড়িটায় ছিল এক জানলাবিহীন চিলেকোঠা। যার ছাদ ছিল কাঠের। সেই সব কাঠ এক অজ্ঞাত কারণে কারওয়েন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পুড়িয়ে ছাই করে দেন। সেই অর্থে এই বাড়ীর আলোচনায় রহস্যর মাত্রা কমছিল। তবে এটাও সত্য যে ওই বাড়িতেও সময়ে অসময়ে জ্বলে থাকতো আলো। দুজন কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ পরিচারক ছিল সে বাড়ীতে যারা কারোর সাথে একটাও কথা বলতো না। অবিশ্বাস্য রকমের বয়স্ক ফরাসী গৃহকর্ত্রী বকরবকর করে অনেক কিছুই বলতো কিন্তু কিছুই বোঝা যেতনা। মাত্র চারজন লোক বাস করতো বাড়িটায় কিন্তু তাদের জন্য যে পরিমাণে খাবার আসতো তা মানুষের চোখ কপালে তুলে দেবার পক্ষে যথেষ্টই ছিল। অবরে সবরে বেশ কিছু অজানা মানুষের কণ্ঠস্বর এবং তাদের কথোপকথনের শব্দ শুনতে পাওয়া যেত। এসব মিলে মিশেই পটুয়েক্সট খামারের গায়ে লেপে দিয়েছিল যুগান্তকারী আতঙ্কের কালো দাগ।

চেনাশোনার গণ্ডিতেও কারওয়েনের বাড়ী নিয়ে আলোচনা খুব একটা কম হতো না। নবাগত অবস্থায় কারওয়েন ধীরে ধীরে শহরের গির্জা এবং চলমান জীবনের সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। শিক্ষার মাত্রা ভালোই ছিল ফলে স্বাভাবিকভাবেই তার সঙ্গ এবং কথোপকথন মানুষ উপভোগ করতো। তাঁর জন্ম ভালো বংশেই হয়েছিল বলে পরিচিত ছিল। কারওয়েন বা করউইন্স অফ সালেমদের আলাদা করে নিউ ইংল্যান্ডে নিজেদের পরিচয় যাচাই করে দেখানোর দরকার পড়েনি। একটু একটু করে এই ধারণা মানুষের মনে গেঁথে বসে যায় জোসেফ কারওয়েন প্রাথমিক জীবনে অনেক ভ্রমণ করেছেন। ইংল্যান্ডে কিছু সময়ের জন্য বসবাসও করেছেন এবং কমপক্ষে দু’বার প্রাচ্যভ্রমণ করেছেন। কথাবার্তা বলার সময় তিনি যে ভাষা ব্যবহার করতেন সেটা শুনেই বোঝা যেতো একজন মার্জিত শিক্ষিত ইংরেজের যা যা গুণ থাকা দরকার সবই তার আছে। কিন্তু কিছু বিশেষ কারণে কারওয়েন বর্তমান সমাজকে পাত্তা দিতেন না। যদিও কেউ দেখা সাক্ষাৎ করতে এলে প্রত্যাখ্যানও করতেন না। কিন্তু নিজের আচরণে সবসময় এমন এক গণ্ডি টেনে রাখতেন যে খুব বেশি কথা বলার সুযোগ কেউ পেতো না।

সবসময় রহস্যময়, অপ্রচলিত অহংকারে ভারাক্রান্ত হয়ে কারওয়েন চলাফেরা করতেন। মনে হতো নিজেকে ছাড়া বাকি মানুষদের যেন মানুষ বলে গণ্যই করতেন না। যেন অচেনাদের মাঝে আরও উন্নতমানের কোনও শক্তিশালী নিখুঁত সত্তা খুঁজে বের করতে চাইছেন। ১৭৩৮ সালে বিখ্যাত বুদ্ধিবাদী ডঃ চেকলে বোস্টন থেকে কিংস চার্চের রেক্টর হয়ে আসেন। ইতিমধ্যেই জোসেফ কারওয়েনের কথা তার কানে গিয়েছিল। নিজে যেচে দেখা করতে আসেন। কিন্তু খুব বেশী সময় কারওয়েন বাসভবনে উনি থাকতে পারেন নি। কারণ গৃহকর্তার আচার আচরণে এক ছদ্ম পাশবিক হাবভাবের ঢেউ তিনি অনুভব করেন। এক শীতকালীন সন্ধ্যায় কারওয়েনকে নিয়ে আলোচনা করার সময় চার্লস ওয়ার্ড তার বাবাকে বলে ছিল, তার খুব জানতে ইচ্ছে করে রহস্যজনক বৃদ্ধ ব্যক্তিটি সেই ধার্মিক মানুষটিকে ঠিক কি বলেছিলেন। যদিও প্রাপ্ত সব ডায়েরীর লেখা থেকে এটাই জানা যায় যে ডঃ চেকলে তাদের কথোপকথন বিষয়ে কিছু বলতেই চাননি। যে নাগরিক খ্যাতি তিনি অর্জন করেছিলেন সেটা খোয়ানোর কোনও ইচ্ছেই তার ছিল না যে কারণে উনি আর কোনোদিন জোসেফ কারওয়েনের নাম স্মরণ পর্যন্ত করেন নি।

জোসেফ কারওয়েনকে অন্য পেশা ও পছন্দের মানুষেরা কেন এড়িয়ে চলতে চাইতো তার আরো কিছু কারণ ছিল। একটি উদাহরণ দিলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ১৭৪৬ সালে মিঃ জন মেরিট, বয়স্ক ইংরেজ সাহিত্যিক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিভাধর ভদ্রলোক, নিউপোর্ট থেকে প্রভিডেন্সে এসেছিলেন। ওই সময়ে শহরটি অতি দ্রুততার সাথে তৎকালীন সময়ে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ রাখছিল। সমাজের বুকে বানিয়ে দিচ্ছিলো মানুষদের জন্য সেরা বাসস্থানের ঠিকানা। সেখানেই এক অট্টালিকা নির্মাণ করে চাকরবাকর সহযোগে এক আভিজাত্যের গমক দেখিয়ে বসবাস শুরু করলেন মিঃ মেরিট। নিজের টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ এবং ইংরেজি ও ল্যাটিন বইয়ের সম্ভারে সাজানো লাইব্রেরী নিয়ে প্রচুর গর্ব করতেন। প্রভিডেন্সের সেরা গ্রন্থাগারের মালিক হিসেবে কারওয়েনের নাম জানার পর ইনিও যেচে দেখা করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কারওয়েন ভবনে এর আগে যারা দেখা করতে এসেছে তাদের তুলনায় আরো বেশি আন্তরিক ভাবে মিঃ মেরিটকে অভ্যর্থনা জানালেন অহংকারী গৃহকর্তা। গ্রীক, ল্যাটিন এবং ইংরেজি ক্লাসিক ছাড়াও নানা দার্শনিক, গাণিতিক এবং বৈজ্ঞানিক বই দিয়ে সাজানো ছিল কারওয়েনের লাইব্রেরী। প্যারাসেলসাস, এগ্রিকোলা, ভ্যানহেলমন্ট, সিললয়াস, গ্লবার, বয়েল, বোরহেভ, বেলচার, স্টাহল সহ বিভিন্ন নামীদামী মানুষের লেখনীর এক অমূল্য সহাবস্থান। সেসব দেখে যারপরনাই মোহিত হলেন মিঃ মেরিট এবং বারংবার সেকথা বলতেও কার্পণ্য করলেন না। এসব শুনেটুনে জোসেফ কারওয়েন এর আগে যে কাজ কখনো করেননি সেটা করলেন। মিঃ মেরিটকে আমন্ত্রণ জানালেন ফার্ম এবং ল্যাবরেটরি দেখার। কিচ্ছুক্ষণ বাদেই দুজনে মিঃ মেরিটের ঘোড়ার গাড়ী করে রওনা দিলেন ফার্ম হাউসের উদ্দেশ্যে।

মিঃ মেরিট এটা সবসময় বলে এসেছেন যে ফার্মহাউসে তেমন কোনো ভয়ঙ্কর কিছু তিনি দেখতে পাননি। কিন্তু এটা স্বীকার করেছেন যে কারওয়েনের লাইব্রেরিতে একেবারে সামনের দিকে সাজিয়ে রাখা থ্যাউমেটারজিক্যাল, অপরসায়নবিদ্যা এবং ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক বিশেষ ধরনের শিরোনামযুক্ত বইগুলি দেখে তার মোটেই ভালো লাগেনি। ঘৃণাই হয়েছিল বলা যায়। সম্ভবত, ওই ধরনের বইগুলো দেখানোর সময় আত্মম্ভরি গৃহকর্তার মুখের অভিব্যক্তি তার জন্য দায়ী ছিল। ঈর্ষা করার মতো ভালো মানের একাধিক পুস্তকের বিস্ময়কর সংগ্রহের পাশাপাশি এই সব জঘন্য ধরনের বইগুলো দেখে উনি চমকে গিয়েছিলেন। সাধারণত ওই ধরনের পুস্তক ডেমোনোলজিস্ট এবং ম্যাজিশিয়ানদের কাছেই বেশী দেখা যায়। সন্দেহজনক অপরসায়ন এবং জ্যোতিষশাস্ত্র বিষয়ক বইয়ের অসাধারণ সংগ্রহ যে কারওয়েনের ছিল সেটাও জানিয়েছিলেন মিঃ মেরিট। মেসনার্ডের সংস্করণে হার্মিস ট্রিসমেজিস্টাস, টারবা ফিলোস্ফোরাম, জিবারের লাইবার ইনভেস্টিগেশনিস, এবং আর্টিফিউস এর কি অফ উইজডম যেমন ছিল, তেমনই ছিল ক্যাবালিস্টিক জোহার, পিটারজ্যামির রচিত অ্যালবারটাস ম্যাগনাসএর সেট, রেমন্ড লাল্লির আর্সম্যাগনা এট আলটিমার জেটজনারের সংস্করণ, রজার বেকনের থিসরাস কেমিকাস, ফ্লাডের ক্লাভিস আলকিমিয়া এবং ট্রাইথেমিয়াসের ডি ল্যাপিদে ফিলোসফিকো। মধ্যযুগীয় ইহুদীও আরব লেখকদের একাধিক বই ছিল সেখানে। এদের ভেতরেই মিঃ মেরিট ফ্যাকাশে মেরে গিয়েছিলেন কানুন-ই-ইসলাম এর মতো লেবেল লাগানো একটি বই নিজের হাতে নিয়ে দেখার সাথে সাথেই। কারণ আসলে ওটা ছিল সেই পাগল আরব আব্দুল আলহাজরেদের লেখা নিষিদ্ধ নেক্রোনোমিকন। এর বিষয়ে উনি শুনেছিলেন ম্যাসাচুসেটস-বে প্রদেশের কিংস্টপোর্টে এক জেলেদের গ্রামে, অদ্ভুত কিম্ভুত আতঙ্ক জড়ানো নানান নামহীন ধর্মাচরণের বিষয় সামনে এসে যাওয়ার পর।

কিন্তু অদ্ভুতভাবে, মিঃ মেরিট খুব সাধারণ একটা বিষয় দেখে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। ওখানে বিশাল মেহগনি কাঠের টেবিলের উপর রাখা ছিল একটি অতি ব্যবহার জীর্ণ বই। যার লেখক বোরিলাস। বইটার পাতায় পাতায় নানা লাইন চিহ্নিত করা আছে দাগ দিয়ে দিয়ে। সাথেই মার্জিনে কারওয়েনের হাতের লেখায় ভর্তি। বইটি খোলা ছিল মাঝামাঝি অবস্থায়। সেই পাতার একটি অনুচ্ছেদের রহস্যময় কালো-অক্ষরে লেখা কিছু লাইন অতিরিক্ত মোটা দাগে এমন ভাবে চিহ্নিত করা ছিল যে সেটা পড়ে দেখার লোভ সামলাতে পারেন নি মিঃ মেরিট। বিশেষ ভাবে দাগানো ছিল বলে নাকি ওই লেখা কথাগুলির রহস্যময় ছন্দময়তা নাকি বিষয়টার অন্তর্নিহিত অর্থ তিনি বলতে পারেননি; কিন্তু এই সবকিছুই একসাথে মিলে মিশে সম্ভবত তাকে খুব বিশ্রী এবং অদ্ভুতভাবে প্রভাবিত করেছিল। কথাগুলো তার স্মৃতিতে গেঁথে বসে গিয়েছিল। ডায়েরিতে সেগুলো লিখেও রেখেছিলেন এবং সেই কথাগুলো একবার তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডাঃ চেকলেকে পড়ে শোনানোর চেষ্টা করেন। যা শুনে রেক্টর মানুষটা অস্বস্তি বোধ করছেন তা বুঝতে পেরেছিলেন ভালো করেই।

মিঃ মেরিট যা পড়েছিলেন:
“প্রানীদেহাংশের সারবস্তু থেকে এমন এক বিশেষ ধুলো এতো ভালো ভাবে প্রস্তুত এবং সংরক্ষণ করা যেতে পারে, যার সাহায্যে যেকোনো একজন বুদ্ধিমান মানুষ তার নিজের পরীক্ষাগারে চাইলেই নোয়ার নৌকাতে যত জীবজন্তু ছিল সব কিছুকেই বানিয়ে নিতে পারে। পছন্দের যে কোনো পশুপাখির আকৃতি নিখুঁত রূপে নির্মাণ করাটা কোনো ব্যাপারই না। আর ঠিক এভাবেই মানুষের দেহাংশের ধুলো থেকে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি কোনরকম অপরাধমূলক প্রেতচর্চা না করেও তার মৃত পূর্বপুরুষের আকৃতি পুনর্নির্মাণ করতে পারে। মোদ্দা কথা মানব দেহাংশের ধুলো থেকে নতুন মানুষের সৃষ্টি করা সম্ভব।”

টাউনস্ট্রিটের দক্ষিণ উপকূলের বন্দরের কাছের এলাকায় জোসেফ কারওয়েন সম্বন্ধে সবচেয়ে খারাপ কথাগুলো উড়ে বেড়াতো। নাবিকেরা চিরকালই একটু অন্ধবিশ্বাসী ধরনের মানুষ এবং নানা অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া প্রকৃতির হয়। রামের নেশায় ডুবে থাকা পাঁড় মাতাল থেকে শুরু করে দীর্ঘদেহী ক্রীতদাস, ছোট সামুদ্রিক নৌকার মাঝি, যুদ্ধ জাহাজের সেনা, ব্রাউন, ক্রফোর্ডস, এবং টিলিংহাস্ট যে কোনও ধরনের মানুষ যখনই পাতলা চেহারার ফ্যাকাশে চামড়ার হলুদ চুলো কারওয়েনকে ডুবলুন স্ট্রিটের রাস্তা দিয়ে আসতে দেখতো তখন পারতপক্ষে কেউ চাইতো না মানুষটার মুখোমুখি হতে। অবশ্য কারওয়েনও তেমন কোনও নজর দিতেন না ওদের দিকে। দূরে জলে ভেসে থাকা বিশাল বিশাল জাহাজের ক্যাপ্টেনদের সাথে কথা বলার জন্য সোজা গটমট করে হেঁটে এসে ঢুকে যেতেন জাহাজ ঘাটার অফিসে। কারওয়েনের নিজস্ব ক্লার্ক ও ক্যাপ্টেন এবং মার্টিনিক, সেন্ট ইউসতেসিয়াস, হাভানা, বা পোর্টরয়্যাল থেকে খুঁজে আনা দোআঁশলা তার সমস্ত নাবিকরাও তাকে ঘৃণা ও ভয় করতো। বয়সের গাছপাথরহীন মানুষটার প্রতি সে ভয় আর ঘৃণার মাত্রা এতো বেশি ছিল যে ক্রমাগত নাবিকদের মুখের বদল হতে থাকতো। নাবিকের দল কিছু ঝামেলা করেছে জানতে পারলেই তাদের বিশেষ কাজ দিয়ে খামার বাড়ীতে পাঠিয়ে দিতেন কারওয়েন। আর তারপরেই দেখা যেত সেই দলের এক বা একাধিক মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেছে। যে কয়েকজন নাবিক পটুয়েক্সট এর খামার বাড়ী থেকে ফিরে আসতো তারা যে সব অভিজ্ঞতার কথা বলতো তাতে রহস্য আরো দানা বাঁধে। এর ফলে কারওয়েনের পক্ষে স্থানীয় কাজের লোক পাওয়াই সমস্যার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ কারণেই তাকে বাইরে নানা জায়গা থেকে নাবিক আমদানি করতে হতো। কিন্তু গুজব ছড়িয়ে যায় দূরে দূরান্তরে ফলে এই এলাকাতে কাজ করতে আসবে এমন লোক পাওয়া মুস্কিল হয়ে দাঁড়ায়। যা অন্যান্য জাহাজ মালিকদের ক্ষেত্রে সমস্যার জন্ম দেয়।

১৭৬০ সালের সময়ে জোসেফ কারওয়েনের নামটা একটা আতঙ্কস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। নাম উচ্চারণ করতেই ভয় পেত মানুষ। প্রায় একঘরে করে দেওয়া হয় ওকে। ধরেই নেওয়া হয় মানুষটার সাথে শয়তানের একটা যোগসাজশ আছে। মানুষ এমনটাও মনে করতো যে সেই সত্তা যার নাম উচ্চারণ করাই পাপ, যাকে বোঝা বুদ্ধি দিয়ে সম্ভব নয় বা যার অস্তিত্ব প্রমাণ করাও সম্ভব হয়নি সেই অজ্ঞাত সত্তাদের সাথে কারওয়েনের সম্পর্ক আছে।। এই সব গুজবের সাথেই যুক্ত হয় আরো বড় এক ঘটনার কথা। ১৭৫৮ সালের মার্চ এপ্রিল মাসে নিউফ্রান্সে যাওয়ার পথে দুটি রাজকীয় রেজিমেন্ট প্রভিডেন্সে এসে উপস্থিত হয়। আর তাদের ভেতর থেকে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দেখা যায় দিনের পর দিন ধরে বেশ কিছু সংখ্যক করে সৈন্য নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। নাবিকদের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার কারণে গুজবের মাত্রা এতোটাই মানুষকে প্রভাবিত করে রেখেছিল যে কারওয়েনকে ঐ লাল উর্দিধারি সেনাদলের ধারে কাছে দেখতে পাওয়া না গেলেও জনগণ ধরেই নিয়েছিল এর সাথেও ওই পৈশাচিক মানুষটার সম্পর্ক আছে। কিছুদিনের ভেতরে ওখান থেকে পাততাড়ি গুটানোর অর্ডার যদি ওপর মহল থেকে না আসতো তাহলে বাকি সেনাদের কি হতো কে জানে।

এদিকে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে দিন কে দিন কারওয়েনের উন্নতি হয়েই চলেছিল। সোরা, গোলমরিচ এবং দারুচিনি ব্যবসায়ের অপ্রত্যক্ষভাবে একচেটিয়া অধিকারী হয়ে বসেছিলেন। ব্রাসওয়ার, নীল, তুলো, উল, লবণ,লোহা, কাগজ এবং ব্রোঞ্জ সহ সবধরনের ইংরেজি পণ্য আমদানির ব্যবসাতেও নিজের থাবা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। চিপ সাইডের সাইনইন দ্য এলিফ্যান্ট এর মালিক জেমস গ্রিন, ব্রিজ এলাকা জুড়ে ব্যবসা করতে থাকা সাইনইন দ্য গোল্ডেন ঈগল এর মালিক রাসেলস রা অথবা নিউ কফি-হাউসের কাছের ফ্রাইং-প্যান এবং ফিস দোকানের ক্লার্ক এবং নাইটিংগেল এর মতো দোকানদারেরা প্রায় সকলকেই সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে হতো কারওয়েনের আমদানির ওপর। স্থানীয় মদ পরিবেশক থেকে শুরু করে নারাংগ্যান্সেটের গোয়ালা এবং ঘোড়া-বিক্রেতার দল বা নিউপোর্ট এর মোমবাতি প্রস্তুতকারকদের জন্য কারওয়েন পরিণত হয়েছিলেন কলোনীর প্রধান রপ্তানিকারক।

তার সম্বন্ধে নানান গুজব চারদিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল তবু সামাজিক ভদ্রতাকে মোটেই বিসর্জন দেন নি কারওয়েন। যখন কলোনি হাউস পুড়ে গেল তখন তাকে নতুন করে বানানোর জন্য যে লটারির আয়োজন করা হয় তার অনেক টিকিটই তিনি নিজে কিনে নেন। পুরাতন মেইন স্ট্রিটে, ১৭৬১ সালে নতুন ইট দিয়ে নির্মাণ করা সেই কলোনি হাউস আজও দণ্ডায়মান। একই বছরে উনি আবারও ভালো আর্থিক সাহায্য দান করেন অক্টোবর মাসের ঝড়ে ভেঙেচুরে যাওয়া গ্রেট ব্রিজ পুনর্নির্মাণ করার কাজে। কলোনি হাউসে লাগা আগুনের গ্রাসে পাবলিক লাইব্রেরির অনেক বই পুড়ে যায়। উনি সেখানেও মোটা অর্থ ব্যয় করেন নতুন বই কেনার জন্য। প্রচুর পরিমাণে লটারি কেনা শুরু করেন যাতে সেই টাকায় কাদায় ভর্তি থাকা মার্কেট প্যারেড এবং খানাখন্দে ভরা টাউনস্ট্রীটের সংস্কার করা যায়। একই সময়ে কারওয়েন নিজের জন্য একটা সাদাসিধে কিন্তু চমৎকার নতুন এক অট্টালিকা নির্মাণ করান। যার দরজার খোদাইয়ের কাজ আজও মানুষ দেখে মুগ্ধ হয়ে দেখে। ১৭৪৩ সালে হোয়াইটফিল্ডের সমর্থকরা ডঃ কটন এর হিল চার্চ ছেড়ে বেরিয়ে আসে তখন তাদের সাথে কারওয়েনও যোগ দিয়ে ছিলেন। এই সময়েই ব্রিজ এলাকায় ডিকন স্নো চার্চ এর প্রতিষ্ঠা হয়। যদিও কারওয়েনের উদ্যোগ এবং উপস্থিতি বেশিদিন দেখা যায়নি এ বিষয়ে। তবে খুব শীঘ্রই তিনি ভুলটা শুধরে নেন। কারণ বুঝতে পারছিলেন সেটা না করলে ওকে একঘরে করে দেওয়া হবে এবং যার আঁচ গিয়ে পড়বে তার ব্যবসার ওপরে।

দ্বিতীয় অধ্যায়-দ্বিতীয় পর্ব

প্রায় এক শতাব্দীর সমান বয়সের এই অদ্ভুত, শীর্ণকায়, মধ্যবয়স্ক দর্শনধারী মানুষটা চেষ্টা চালাচ্ছিলেন সমস্ত রকম নিন্দামন্দ, অপ্রীতিকর বিশ্লেষণ,অবজ্ঞা ভয় এবং ঘৃণার মেঘকে দূরে ঠেলে দিয়ে সমাজে একটা স্থান খুঁজে নেওয়ার। এই ধরনের কাজ একমাত্র সম্ভব হয় অঢেল সম্পদ বিতরণের দ্বারা। অর্থের শক্তিতে এসব থেকে সামান্য সময়ের জন্য অব্যাহতিও মেলে। নাবিকদের দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনাও অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে যায়। কবরস্থানে ঘুরে বেড়ানোর ক্ষেত্রেও অনেক গোপনীয়তার আশ্রয় নেন। বোঝাই যাচ্ছিলো উনি চাইছেন না অহেতুক গুজব তাকে নিয়ে চলতেই থাকুক। পটুয়েক্সট খামার থেকে আগত অস্পষ্ট গা শিউরানো শব্দগুলোও সহসাই আনুপাতিক হারে অনেক কমে গিয়েছিল। যদিও অস্বাভাবিকভাবে খাবারের খরচ এবং গবাদি পশুর বদলে যাওয়ার পরিমাণে কোন হেরফের ঘটেনি। তবে এসব খবর যতদিন না চার্লস ওয়ার্ড শেপলি লাইব্রেরিতে কারওয়েনের অ্যাকাউন্ট এবং ইনভয়েসগুলি পরীক্ষা করে, ততদিন অবধি অজানাই ছিল। এসব দেখতে দেখতেই একটা খবর চার্লসের নজরে আসে। ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত গায়না থেকে প্রচুর কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ আমদানি করেছিলেন জোসেফ কারওয়েন। যার ভেতর থেকে খুব অল্পকেই উনি বিক্রি করেছিলেন স্থানীয় ক্রীতদাস ব্যবসায়ীদের কাছে। বাকিদের কি হলো? বুঝতে পারা যাচ্ছে আপাত চকচকে অসাধারণ দানী মানুষটার পেছনে একটা ঘৃণিত চরিত্রের ধুরন্ধর বাস করতো। কিভাবে চতুরতা অবলম্বন করে সব দিক সামলাতে হয় সে জ্ঞান তার ভালোই ছিল।

নানান রকম সংস্কারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করার প্রভাব অবশ্য সামান্যই দেখা যায়। কারওয়েনের থেকে দূরে দূরে থাকা এবং অসন্তোষ অব্যাহত ছিল। আসলে এতো বয়েস হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তার অর্ধেকেরও কম বয়সের মতো যদি কাউকে দেখতে লাগে তা যথেষ্টই সন্দেহের জন্ম দেয়। উনি বুঝতেও পারেন এর প্রভাব আগামী দিনে তার ভাগ্যের ওপরেও পড়বে। যে বিস্তৃত অধ্যয়ন ও পরীক্ষানিরীক্ষা তিনি করে চলেছেন , তা সে যাই হোক না কেন, তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রচুর আয়ের প্রয়োজন। পরিবেশ যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তাতে যে ব্যবসায়িক সুবিধাগুলি তিনি লাভ করেছেন সে সব ধরে রাখা বেশ কঠিন হবে আগামী দিনে। এখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ভিন্ন অঞ্চলে নতুন করে ব্যবসা শুরু করা যেতেই পারে কিন্তু তার জন্য অনেক সময় লাগবে। সাথেই এতদিনের খাটনি বৃথা নষ্ট হবে। সব দিক চিন্তা করে কারওয়েন সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি প্রভিডেন্সের অধিবাসীদের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কটা মজবুত করার চেষ্টা করবেন সবার আগে। যাতে তার উপস্থিতি অহেতুক বাজে কথোপকথনের বিষয় হতে না পারে। মাঝে মধ্যে এদিকে ওদিকে ভ্রমণ নিয়ে অজুহাত দিতে না হয়। তাকে দেখলে যেন যে অস্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয় সেটা কেটে যায়। ব্যবসা ক্ষেত্রে তার ক্লার্কদের সংখ্যা এখন অনেক কমে গেছে। নতুন করে কেউ কাজের জন্য আসেও না। এটা একটা চিন্তার বিষয়। জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং বাকি কর্মীদের বিভিন্ন রকম প্রলোভনের লোভ দেখিয়ে আটকে রেখেছিলেন। যেরকম ভাবে পারতেন তাদের সাহায্য করতেন বা করার প্রতিশ্রুতি দিতে পিছপা হতেন না। অনেকক্ষেত্রেই দেখা গেছে ডায়েরী লেখকেরা আশ্চর্য হয়ে গেছেন এটা ভেবে যে কি করে কারওয়েন তার কর্মচারীদের পরিবারের নানা গোপনীয় খবরাখবর যোগাড় করতেন। এসব অনুসন্ধানের ব্যাপারে মানুষটার প্রায় অলৌকিক জাদুকরী শক্তি ছিল। তার জীবনের শেষ পাঁচবছরের কাজকর্ম দেখলে মনে হয় উনি বোধহয় সরাসরি মৃত মানুষদের সাথে কথা বলার পদ্ধতি জানতেন। যারা ওকে বিভিন্ন বিষয়ের খুঁটিনাটি দিক জানিয়ে দিতো।

ঠিক এই সময়েই অতি বুদ্ধিমান মানুষটা সমাজে নিজের জায়গা ফিরে পাওয়ার অভিলাষে চূড়ান্ত একটা পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এতদিন একাকী জীবনযাপনের পর ঠিক করলেন সুবিধাজনক চুক্তিতে বিয়ে করবেন। একজন মহিলার দরকার যে তার স্ত্রী হিসাবে এ বাড়ীতে আসবে এবং এ বাড়ী নিয়ে চলতে থাকা সব রকম গুজবের অবসান ঘটাবে। হয়তো এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে অন্য কোনো গভীর কারণ ছিল; এমন কারণ যা নিয়ে তার মৃত্যুর সার্ধশতবর্ষ পরে কাগজপত্র ঘেঁটে যে কেউ বুঝতে পারবে সেটা ছিল এক চরম সন্দেহজনক বিষয়। যদিও সেই অর্থে কিছুই পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়নি। কারওয়েন ভাল করেই জানতেন তার সম্বন্ধে চলতে থাকা ভয়াবহ গুজবগুলোর কারণে মোটেই সহজ হবেনা তার পক্ষে এই ভাবনাকে বাস্তবায়ন করা। তাকে খুঁজে বার করতে হবে এমন পরিবার যাদের ওপর উনি চাপ সৃষ্টি করতে পারবেন। যাতে ওই পরিবারের অভিভাবকেরা তাদের মেয়েকে এ বিয়েতে রাজি করাতে পারে। এইধরনের মেয়ে খুঁজে পাওয়া সহজ কাজ ছিল না। একই সাথে মেয়ের সৌন্দর্য, নম্রতা এবং পারিবারিক সামাজিক স্বীকৃতির ব্যাপারেও কারওয়েনের বিশেষ নজর ছিল। কিছুদিন খোঁজখবর চালাতেই তার দেখাও পেলেন। তারই কোম্পানিতে কাজ করে মেয়েটির বাবা। তার জাহাজগুলির ক্যাপ্টেনদের মধ্যে সব সেরা এবং বয়স্ক মানুষ। উচ্চ বংশজাত। স্ত্রী গত হয়েছেন অনেকদিন আগে। নাম ডুটি টিলিংঘাস্ট। যার একমাত্র মেয়ে এলিজা। মেয়েটি সব দিক থেকে সুযোগ্যা। ক্যাপ্টেন টিলিংঘাস্ট নানা সময়ে এতো অর্থ ধার করেছিলেন কারওয়েনের কাছে যে প্রায় তার বাঁধা চাকরে পরিণত হয়েছিলেন। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে কারওয়েন গেলেন হবু শ্বশুরের পাহাড় সংলগ্ন পাওয়ার লেনের বাড়ীতে। সেখানেই চুক্তি সম্পাদন হয়ে গেল এক অমানবিক ঘৃণ্যতম ভাবনাচিন্তার।

এলিজা টিলিংঘাস্ট এর সেই সময়ে বয়স আঠারো বছর। বাবার আর্থিক অবস্থা বুঝে সে সহজ সরল ভাবেই দিন কাটাতো। শান্ত মেয়েটির তেমন কোন চাহিদা ছিল না। কোর্ট-হাউসপ্যারেডের বিপরীতে অবস্থিত স্টিফেন জ্যাকসন স্কুলে সে পড়াশোনা করেছে। ১৭৫৭ সালে স্মল পক্সে মায়ের মৃত্যু হয়। তার আগেই অবশ্য তিনি যতটা পেরেছিলেন মেয়েকে গার্হস্থ্যজীবনে প্রয়োজন নানান কাজ কর্মের শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। ১৭৫৩ সালে ৯ বছর বয়সে এলিজার করা একটি সূচিশিল্প আজ ও রোড আইল্যান্ড হিস্টোরিয়াল সোসাইটির ভবনে দেখতে পাওয়া যায়। মায়ের মৃত্যুর পর মেয়েটির বাড়ি থেকে বেড়ানো বন্ধই হয়ে যায়। ওর দেখাশোনা করতো এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। কারওয়েনের সাথে বিয়ের ব্যাপারে বাবার সাথে তার ভালোই কথা কাটাকাটি হয়েছিল ধরে নেওয়া যেতেই পারে। যদিও সে বিষয়ে কোন তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নি। কথা কাটাকাটির অন্যতম কারণ, এলিজার সাথে ক্রফোর্ড প্যাকেট এন্টারপ্রাইজের দ্বিতীয় মেট তরুণ এজরা উইডেনের বিয়ের দিন কয়েক আগেই পাকা হয়েছিল। কিন্তু সে সম্পর্ক ভেঙ্গে দেওয়া হলো এবং জোসেফ কারওয়েনের সাথে ১৭৬৩ সালের ৭ই মার্চ তারিখে ব্যাপটিস্ট গির্জায় এলিজার বিবাহ সম্পন্ন হলো। শহরটি গর্ব করতে পারে এমন যেসব বিশিষ্ট সমাবেশগুলি এতদিন হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে জাঁকজমকদার ছিল এই অনুষ্ঠানটি। তরুণ যাজক স্যামুয়েল উইন্সর এই বিয়ের পৌরহিত্য করলেন। গেজেটে খুব সংক্ষিপ্তভাবে এই ঘটনাটির উল্লেখ করা হয়েছিল এবং যে সমস্ত কপি খুঁজে পাওয়া যায় সেই গেজেটটির তার সবগুলোতেই দেখা যায় বিয়ের খবরের স্থানটি কে বা কারা সযত্নে কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। অনেক খুঁজে পেতে ওয়ার্ড এক সংগ্রাহকের ব্যক্তিগত আর্কাইভ থেকে সেই খবরটা নিজের চোখে দেখার সুযোগ পায়। অবাক হয়ে যায় অর্থহীন ভাষার সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনটি পড়ে:

“গত সোমবার সন্ধ্যায়,এই শহরের একজন ব্যবসায়ী মিঃ জোসেফ কারওয়েন, ক্যাপ্টেন ডুটি টিলিংঘাস্টের কন্যা মিস এলিজা টিলিংঘাস্টকে বিবাহ করেছেন। কন্যাটি একজন যুবতী মহিলা যিনি সত্যিকারের শিক্ষিত, তার সাথে এক সুন্দর ব্যক্তির যোগসূত্র গঠিত হয়েছিল। আশা করা যায় এই বিবাহ বন্ধন চিরস্থায়ী হবে।”
উন্মাদ হয়ে যাওয়ার আগে চার্লস জর্জ স্ট্রীটের মেল্ভিল এফ পিটারসের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে ডারফি-আরনোল্ডদের লেখা বেশ কিছু চিঠি খুঁজে পায়। ওখান থেকেই জানা যায় এই অসাধারণ প্রকৃতির বিবাহ অনুষ্ঠান জনসাধারণের ভেতর কি মাত্রায় ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল।

টিলিংঘাস্টদের সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল ভালো মতোই। আর সেই সূত্র ধরেই জোসেফ কারওয়েন দেখতে পান সেই সমস্ত লোকের আনাগোনা ঘটছে তার বাড়ীতে যারা তার বাড়ীর ছায়াও মাড়াত না। স্বীকৃতি পাওয়ার দিকটা এর ফলে অনেকটাই সুসম্পন্ন হয়। অবশ্য নববধূকে সামাজিকভাবে কারওয়েনের এই জবরদস্তি উদ্যোগে ভালোই কষ্ট ভোগ করতে বাধ্য হয়। তবে সব মিলিয়ে যে অনীহার প্রাচীর জন্ম নিয়ে ছিল সেটা অনেকটাই অপসারিত হয়। স্ত্রীর প্রতি কারওয়েনের অতি সদাশয় আচার আচরণ দেখে এলিজা নিজে এবং সমাজের মানুষ যৎপরোনাস্তি অবাক হয়ে যায়। কিছু সময় কেটে যেতেই ওলনিকোর্টের নতুন বাড়িটাকে ঘিরে থাকা রহস্যময়তার বাতাবরণ প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। কারওয়েনও পটুয়েক্সট খামারে যাওয়া বন্ধ করে দেন। স্ত্রীকেও কোনদিন সেখানে নিয়ে যাননি। এতবছর এই শহরে বাস করার পর মানুষের মনে হচ্ছিল এবার জোসেফ কারওয়েন যেন প্রকৃতই সাধারণ নাগরিকে পরিণত হয়েছেন। কেবলমাত্র একজন মানুষ কিন্তু তার সাথে খোলা শত্রুতা বজায় রেখেছিল। ক্রফোর্ড প্যাকেট এন্টারপ্রাইজের দ্বিতীয় মেট তরুণ এজরা উইডেন। যার সাথে এলিজা টিলিংঘাস্টের বিবাহ প্রতিশ্রুতি ভেঙে দেওয়া হয়। এজরা এমনিতে শান্ত এবং স্বাভাবিক প্রকৃতির হালকা স্বভাবের মানুষ ছিল। কিন্তু কারওয়েনের জবরদস্তিভাবে স্বামীতে পরিণত হয়ে যাওয়াটা তার মনে একরাশ ঘৃণার জন্ম দেয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে স্পষ্টভাবে প্রতিহিংসা যে সে নেবে সেটা জানিয়েও দেয় শপথ করে।

১৭৬৫ সালের সাতই মে তারিখে, কারওয়েনের একমাত্র সন্তানঅ্যান জন্মগ্রহণ করে। কিংস চার্চের রেভারেন্ড জন গ্রেভস ওদের মেয়ের নামকরণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। বিরোধী মতবাদ থাকা সত্ত্বেও বিবাহের সূত্রে এই চার্চের সাথে স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ের যোগাযোগ সম্পন্ন হয়েছিল। অ্যানের জন্মের রেকর্ড এবং দুবছর আগে হওয়া বিয়ের নথিভুক্তির সবরকম রেকর্ড গির্জার এবং শহরের যেখানে যেখানে থাকার কথা, সে সব জায়গায় চার্লস গিয়েছিল। সব জায়গাতেই ও দেখতে পায় একই ব্যাপার, রেকর্ড গায়েব করে ফেলা হয়েছে। এর ফলে এলিজার পদবী পরিবর্তন খবর জানার পর উনার সাথে নিজের পারিবারিক সম্পর্কর সূত্র খুঁজে বার করার একটা নেশা ওকে পেয়ে বসে। একটা ঘোরের ভেতর সে এখানে ওখানে ছুটে বেড়ায় প্রমাণ সংগ্রহের তাড়নায়। যা পরবর্তীতে পাগলামির রূপ পরিগ্রহ করে। এভাবেই তার যোগাযোগ সাধিত হয় ডঃ গ্রেভসের উত্তরাধিকারীদের সাথে। যাদের কাছে পাওয়া যায় সেই সময়ের ডাক্তারি রেকর্ডের একটি ডুপ্লিকেট সেট। যা বিপ্লবের সূচনাকালে সঙ্গে করে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন ডঃ গ্রেভস। ওয়ার্ড এই উত্সটাকে খুঁজে বার করার সম্ভাব্য সব রকমের চেষ্টা চালিয়েছিল কেন না সে জানত পেরেছিল তার অতি অতি বৃদ্ধা ঠাকুমা অ্যান টিলিংঘাস্ট পটার একজন এপিস্কোপালিয়ান বা চার্চ পরিচালনা কমিটির সদস্যা ছিলেন।

কন্যার জন্মের অল্প কিছুদিন পর থেকেই জোসেফ কারওয়েন নিজের ওপর চাপিয়ে রাখা কাঠিন্যের খোলস ভেঙে স্বাভাবিক মানুষের মতো মেলামেশা শুরু করেন। ইচ্ছে জাগে একটি প্রতিকৃতি আঁকানোর। আর সেই দায়িত্ব উনি ন্যস্ত করেন খুব প্রতিভাধর স্কট শিল্পী কস্মো আলেকজান্ডারের ওপর। যিনি নিউপোর্টএর বাসিন্দা এবং গিলবার্ট স্টুয়ার্ট এর প্রথম দিকের শিক্ষক হিসাবে বিখ্যাত। ওলনিকোর্টের বাড়ির লাইব্রেরির দেয়াল-প্যানেলে এই ছবি টাঙানো ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু দুটি পুরাতন ডায়েরি ঘেঁটেও এই প্রতিকৃতি কোথায় গেল তার কোনও উল্লেখ খুঁজে পায়নি চার্লস।

এরপর থেকে অতিমাত্রার পণ্ডিত জোসেফ কারওয়েনকে কোন এক অজানা কারণে অস্বাভাবিকরকমের উৎকণ্ঠিত বলে মনে হতো। দিনের বেশির ভাগ সময়টা পটূয়েক্সট রোডের খামারে থাকতেন। দেখে মনে হতো চাপা কোনও উত্তেজনা বা রোমাঞ্চর অনুভূতি যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। মনে হতো অসাধারণ অস্বাভাবিক অদ্ভুত কিছু আবিষ্কারের দোরগোড়ায় যেন তিনি অবস্থান করছেন। যার সাথে ব্যাপকভাবে সম্পর্ক আছে অপরসায়নএবং প্রচলিত রসায়ন বিদ্যার। এই সব বিষয়ের সিংহভাগ বই নিজের বাসস্থান থেকে খামার বাড়ীতে নিয়ে চলে যান।

অবশ্য এসব করতে গিয়ে সামাজিক স্তরে সাহায্য করার ব্যাপারটা থেকে একটুও সরে আসেন নি। শহরের সাংস্কৃতিক স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনের প্রচেষ্টায় যারা কাজ করছিলেন সেই স্টিফেন হপকিন্স, জোসেফ ব্রাউন এবং বেঞ্জামিন ওয়েস্টের মতো নেতাদের সাহায্য করার জন্য যে কোনও সুযোগ তিনি দু হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরছিলেন। সে সময় নিউপোর্টের তুলনায় তার শহরের শৈল্পিক মান নিচের দিকেই ছিল। ১৭৬৩ সালে ড্যানিয়েল জেঙ্ককেসকে তার বইয়ের দোকানটি স্থাপন করায় সাহায্য করেন এবং নিজে ছিলেন সেখানকার এক নম্বর ক্রেতা। শেকসপিয়ারের মস্তক চিহ্ন সম্বলিত ধুঁকতে থাকা গেজেটকে নিজের পায়ে খাড়া হওয়ার জন্য নানাভাবে সাহায্য করেন। রাজনীতির জগতে তিনি ওয়ার্ডপার্টির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো গভর্নর হপকিন্সকে সমর্থনকরেন। ওয়ার্ড পার্টির প্রধান ঘাঁটি ছিল নিউপোর্ট। ১৭৬৫ সালে হ্যাকার হলের নর্থ প্রভিডেন্সকে একটি পৃথক শহর হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ানোর জন্য যে বক্তৃতা দেন তাতে তার বিরুদ্ধে হাওয়ায় ভেসে থাকা গুজবগুলো প্রায় ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। কিন্তু এজরা উইডেন, যে তার দিকে সব সময় নজর রেখেছিল, এসব কাজকে যথেষ্ট সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। সাথে সাথেই এইসব বাহ্যিক কার্যকলাপ যে আসলে জোসেফ কারওয়েনের ঘৃণ্য চরিত্রকে চাপা দেওয়ার একটা মুখোশ ছাড়া আর কিছু নয় এই বলে প্রকাশ্য নিন্দা করে চলেছিল। প্রতিশোধ নেওয়ার মানসিকতায় জারিত এজরা নিয়ম করে কারওয়েনের প্রতিটি পদক্ষেপ ও কার্যকলাপ দেখে যেতে থাকে। রাতের পর রাত অপেক্ষায় থেকেছে বন্দরে। কারওয়েনের জাহাজ ঘাটায় আলো জ্বলতে দেখলেই ছুটে গেছে কি ঘটছে দেখার জন্য। পিছু নিয়েছে সেই ছোট নৌকাটির যা মাঝে মধ্যেই চুপিসারে চলে যায় সমুদ্রের দিকে। পটুয়েক্সট খামারের দিকেও ছিল এজরার সতর্ক নজর। আর সেটা করতে গিয়ে খামারের দায়িত্বে থাকা ইন্ডিয়ান দম্পতিদের লেলিয়ে দেওয়া কুকুরের কামড়ও খেতে হয়েছে ওকে।

[ক্রমশঃ]

IT গাই

আলমগীর হোসেইন বৈদ্য

টানছে ঘানি –
ID গলায় IT গাই;

আনছে money
প্রাপ্তি লবডঙ্কাটাই!
কমছে জানি
বেঁচে থাকার তাগিদ ভাই;
ভুলতে পানি –
On-the-rocks আর কি চাই!

হপ্তাহান্তে – Cafe Ekante
পকেট সাফ!
সোমবার তাই – মিনিবাসে যাই
rough and tough!

মাসের শেষে
ধরবেই ঠেসে – loan গুলো;
করেছ পাপ?
পশ্চাতাপ – কান মলো।

জীবন চলে –
Excel এর ওই ধার ঘেঁষে;
প্রেয়সী ছলে –
MBA guy – Vegas এ!

বন্ধুরা সব
কেউ আমেরিকা প্যারিস কেউ;
অধমের job
তালা খোলে না Onsite এও!

দীর্ঘ জীবন –
নষ্ট হওয়ার প্রতীক্ষায়;
ধার্মিকজন –
কেয়ামতের ভয় দেখায়!

অধম তবু
ছাইপাঁশ গেলে – লেখেও তায়
কদাচিৎ কভু
কলম পেলে; ঠেকানো দায়..!

রাত্রি শেষে
হ্যাংওভার-ঘোর কাটলে ফের;
খানিক কেশে
মুখোমুখি হয় বাস্তবের।

ভরে ল্যাপ-ট্যাব
Free Ride ক্যাব
চেনা Knot-tie;

Promotion গ্লানি
টেনে চলে ঘানি
বুরবক শালা IT গাই!