নভেম্বর ২০১৭ পরবাসিয়া পাঁচালী

প্রচ্ছদ
প্রচ্ছদশিল্পী - রুমেলা দাস

সম্পাদকের কথা

পুজোর রেশ কাটতে না কাটতে গুটি গুটি পায়ে হাজির হয়েছে শীত। গাছের পাতাঝরা দেখতে দেখতে বেরিয়ে পড়ছে লেপ-কম্বল-মাফলার-সোয়েটার। সঙ্গে দোসর অসময়ের নিম্নচাপ। উত্তুরে হাওয়া খবর দিল রসগোল্লার একচেটিয়া অধিকার বাংলারই, যদিও ‘কানাঘুসো’ শোনা যাচ্ছে কপিরাইট আসলে মিলেছে ‘বাংলার রসগোল্লা’র। বেশ কিছু দিন ধরেই এ নিয়ে জল্পনা চলছিল, যদিও তাতে রসগোল্লার বিক্রি কম বা বেশি কিছু হয়নি। রসগোল্লা নিজে কখনও ‘আমার জন্ম কোথায়’ বলে মেগাসিরিয়ালের নায়কের মতো কৌতূহলী হয়ে উঠবে— সে সুযোগ পায়নি।

শহরে আগুন

চিন্ময় বসু



আকাশে জেগে কিছু গির্জা
আর মন্দিরের চুড়ো,
আর কিছু নেই— সব গ্যাছে পুড়ে,
জননেতার গরম বুলিতে ছারখার
গলি রাস্তা বাড়ী ঘর সব কিছু সব কিছু।
আর আমি পুড়ে যাওয়া শহরের
মৃত্যুর ইতিহাস লিখেছি গলিত চর্বিতে।
এক অসহায় মোমবাতির ধোঁয়াটে অশ্রুতলে মোমের থেকেও ঘন ভাষায়
আমি ছিঁড়ে যাওয়া তারের মত
বিশ্বাসের কথা বলেছি।

গল্পের এবড়ো খেবড়ো নুড়িপাথরের
উপর সারাদিন ঘুরে ঘুরে
মিথ্যুক দেওয়ালের সামনে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধুই
চমকিত আর মর্মাহত হওয়া।
টিয়ার মাথাখোঁড়া চড়া ডাক
আকাশে পাথর ভাঙ্গে।
এত আগুনের মধ্যেও
দিব্বি সাদা তুলোর গাঁটরির মত
মেঘগুলো ফেটে ছড়িয়ে যায় আকাশে।
যীশুর পায়ে হাঁটা ধোঁয়া ওঠা
সমুদ্রের বুক নিয়ে আমি ডুকরে বলি
কাঠের জগত যদি ব্যর্থ হয়ে যায়
তো মানুষ কেন মোমের মত
গাঢ় অশ্রু ঝরিয়ে কাঁদবে।

এ শহরে কাগজই গাছের পাতা,
কিন্তু পাহাড়, সে তো অটুট বিশ্বাসের
মত আজো খাড়া থাকে, আছে।
ক্লান্ত চরণ বালকের কাছে
সবুজ পাতার মত হল সবুজ নিশ্বাস
যাতে মৃত ভালবাসা প্রাণ পায়।
যত মৃত্যু আর দীক্ষার আশীর্বাদে জেগে
খুঁড়িয়ে চলে, বয়ে চলে এ পোড়া শহর।

অলংকরণ - প্রমিত নন্দী



তারা খসার পালা

সঞ্চয়িতা দাস

হয়তো

সূচনা ঘোষাল


হয়তো...
ভীষণ সহজে দাম-দর করে কিনে ফেলেছিস,
রাস্তায় ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো নারীদেহকে
বেশ কায়দা করে নিয়েও এসেছিস নিজের
বিলাসবহুল বহুতলের ফ্ল্যাটে...
জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ানো মেয়েটার বয়স,
খুব বেশী হলে ওই তেরো কী চোদ্দো...
তোর বয়স আমার হিসাবে পঁয়তাল্লিস এখন!
বেশ পটু হাতে কাছে টেনে নিলি ওই নরম মাংসপিন্ডটাকে
তোর স্পর্শের আঘাতে বিদ্ধ হতে থাকল অপ্রাপ্ত নারীমন
জানিয়ে দিলি, পৌরষত্ব কী, পুরুষের আকর্ষণ কেবল শরীর
যৌনসুখে মাতাল হয়েছিলিস তুই সেই রাতে
তোর অত্যাচারে চাপা পড়ে ছিল কচি মেয়েটার আর্তনাদ
তোর... প্রেমিকা তখন ফোনের ওপারে ভালোবাসা জানাতে প্রস্তুত
তুই তখন আদর নামক বিষে আক্রান্ত!
তোর নামী প্রেমিকা জানলোই না তোর চাহিদা কিসে মেটে
আবারও তুই খেলে চললি আর একটা
প্রাপ্ত বয়স্কা নারীমনের সাথে, দিনের পর দিন
সেও যে তোকে শরীর দেয়নি তা নয়,
দিয়েছে... হয়তো সুখী হসনি তুই তাতে...
সকাল হতে ক্ষতবিক্ষত যোনী দেখে ভয়ে,
কেঁদে ওঠে ওই বছর তেরোর মেয়েটা!
তুই তখন আরাম ঘুমে ব্যাঘাত শুনে ধমকে উঠলি
“ন্যাকামি মারাস না,এটা তোদের পেশা”
কথাটা শুনে কেমন যেন চুপ হল মেয়েটা
সত্যিই তো! এটা তো ওর পেশা...
বাড়িতে না খেতে পেয়ে মরতে বসা পেটের সংখ্যা চার!
বাবার জুয়ার টাকা জোগাড়ে আর ওদের
পেট বাঁচাতে বাবা তাকে বেচে দিলো এই নরকে!
তাও তো সেই ঘটনা একবছর হয়ে গেল!
প্রথম প্রথম বাড়ির জন্য আর শরীরের যন্ত্রনায় ছটফটাতো মন
এখন সবটা সয়ে গেছে...
এও জানে একটুপর এই বাবুও কটা টাকা
মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে তাড়িয়ে দেবে!
মেয়েটার গন্তব্য হবে আবার সেই স্যাঁতস্যাতে গলি আর রাস্তার ধার
আর... তুই... ঘুম থেকে উঠে শুরু করবি অভিনয়
সৎ থাকার অভিনয়, না ঠকানোর অভিনয়
বাড়িতে... প্রেমিকার কাছে সব জায়গায়
প্রয়োজন হবে তোর দক্ষতাযুক্ত অভিনয়ের!
তারপর রাত হলে আবার যাবি রাস্তায় ধরে আনবি
আর একটা কচি মনের নারীদেহকে...
আবারও তৃপ্তি পাবি, উল্লাসে মেতে যাবি সব ভুলে...
তবে, একদিন শেষ হবে, তুইও পাপের সীমা অতিক্রম করবি
পাপ ছুঁয়ে যাবে তোর বাঁচানো পরিবারেও
তখন রেহাই পাবিনা তুই... কেঁদেও ছাড়া পাবি না
ডুবে যাবি পাপের সাগরে, আরো অতলে
তুলে আনবে না কেউ, ওটাই তোর শাস্তি হবে!
পাপের বিনাশ যে যুগ পাল্টালেও নিয়ম বদলায় না!

অলংকরণ - আইন এম

বিজয়া

তন্ময় দাস (উন্মাদ)


শরীরী লজ্জাহারা

সায়ন রায়

গম্ভীরতম সূর্য দেখিনু মেঘবাদলের কোলে
শঙ্কিত তব মেঘমালা দেখো সেজেছে রঙের দোলে
চমকিত সেই উত্তাপ দেয় অভাগিনীটির কোলে
শত শত সুখ ফেলে এসে দুখ শুকায় অশ্রুজলে।

বাঁচবে না কোন অস্ত্রহীনা বস্ত্রহীনের পরে
বঙ্গের বধু অঙ্গের মধু বেচে অমধুর দরে
অমলিন চাঁদ পেতে রাখা ফাঁদ পা দেয় তাতে কারা
দংশন জ্বালা মেটাবে আজি শরীরী লজ্জাহারা।

কামনা, বাসনা, স্বপন ছাওয়ায়
নীলাচলে স্মৃতি দাপিয়ে বেড়ায়
অম্বরে তার রেশ থেকে যায়
অযথা বেদন মাথানত হয়

ঝমঝম করে অন্তর ভরে ঘটিকা গণক গোনে ডান কড়ে
নৃত্য কুশলি কৌশল করে মত্ত চিত্তে বীর্য ভরে
মাথানত করে মান দান করে কুণ্ঠ নমস্কারে
বাঁচবে না কোনো বস্ত্রহীনা অস্ত্রহীনের পরে।

অলংকরণ- নীলাভ বিশ্বাস



একটি সময়ের মৃত্যু ও ফিদেল কাস্ত্রো

শবনম সুরিতা


ফিদেল কাস্ত্রো মারা গেছেন। নব্বই বছর বয়েসে এসে দৈহিক সামর্থ্যের কাছে হেরে গেছেন তিনি। কিন্তু তবুও সারা বিশ্বের ছোট-বড় সমস্ত সংবাদ মাধ্যম তাঁর মৃত্যুর পর এক অদ্ভুত তাড়াহুড়োয় ফেটে পড়ছে কাস্ত্রো সম্বন্ধে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে। যেন এই বুঝি কেউ এসে খবরদারি শুরু করল বলে! কেউ সোজাসুজি আক্রমণ করছেন তাঁর আদর্শ, জীবনযাত্রাকে তো কেউ নির্লিপ্ত, কেঠো স্মৃতিচারণেই গল্পে দাঁড়ি টানছেন। যেন কাস্ত্রোর মৃত্যু আসলে কোন ঘটনাই নয়। তাঁর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ জনগণের সামনে তাদের নিজেদের কাস্ত্রো-ভিত্তিক অবস্থান।

আমি অবশ্য এই তাড়াহুড়োর দলে পড়ি না মোটেও। বেড়ে ওঠার নানা সময়ে কাস্ত্রো বা তাঁর সমগোত্রীয় অনেক মানুষ সম্বন্ধে আমার অবস্থানগুলির মধ্যে মোটামুটি একটা স্থিরতা ছিল। যেমন ছোটবেলায় টেলিফোন রাখার টেবিলের ওপর পরপর আমার ঠাকুর্দা, বাবার পিসিমা, মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও, কাস্ত্রো, রবীন্দ্রনাথ সারিবদ্ধ ছবিতে বন্দী হয়ে থাকতেন। গৃহস্থবাড়ির নিয়ম মেনে সব ছবির গায়ে লাগা ধুলো এক কাপড়েই মোছা হত। আমার তখনও বোঝার বয়েস হয়নি এদের মধ্যে ঠিক কাদের লাশে লাল পতাকা জড়ানো হতে পারে। আর এই না-জানার অবস্থান থেকে বেড়ে ওঠার, বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছি অনেক পরে, কলেজে ভর্তি হবার পর। বাম ছাত্র রাজনীতি করতে গিয়েই গলা ফাটিয়ে বলতে শিখেছি ‘El pueblo unido jamas cera vencido’ (ঐক্যবদ্ধ মানুষের জয় নিশ্চিত)।

স্কুলজীবনে

এবং সেখান থেকেই একটু একটু করে শিখেছি অবস্থানের প্রয়োজনীয়তার। আবার এই প্রয়োজনীয়তা মেটাতে গিয়েই আস্তে আস্তে সারিবদ্ধ ছবির মুখগুলির সাথে নাম যুক্ত করতে শিখেছি। শিখেছি কীভাবে দেশে দেশে মানুষ একই লক্ষ্যের লড়াইয়ে জানকবুল করে দিতে দু’বার ভাবে না। তবে শেখা, জানা-বোঝা ওই পর্যন্তই। ছবির সাথে নাম আর নামের সাথে বামের সাঁকো গড়তে ঠিক যতটুকু জ্ঞানের প্রয়োজন হয়, ততটুকুতেই থেমে গিয়েছিলাম আমি আমার সমসাময়িক আরো অনেকের মত। কিন্তু পারিনি। নিজের কাছে নিজের অবস্থান জানার প্রয়োজনীয়তা থেকেই থেমে যেতে পারিনি, হাঁটতে থেকেছি। কেন হেঁটেছি সেটা হাঁটা শুরু করার সময় অত বুঝিনি, এখনও বুঝি না। তবে কেন হেঁটে যেতে হবেই, থামা চলবে না, হাঁটার দায়িত্ব কতখানি, এটা এখন জানি। এটুকু অন্তত ফিদেল মারা গিয়ে শিখিয়ে দিয়েছেন আমায়। কীভাবে তা করেছেন, সেটাই লিখতে চাই এখানে।

একুশ শতাব্দীর সন্তান আমি। আমার জন্ম খোলামেলা ভারতবর্ষের এক প্রান্তিক শহরে হলেও প্রাপ্তবয়স্কতা লাভ করেছি দেশের অন্যতম মেট্রোপলিটান নগরীতে। লেখাপড়ার সুবাদে পাড়ি দিয়েছি উন্নত বিশ্বের নাকউঁচু ভূখণ্ডে। বয়েসের হিসেবে ফিদেল কাঁটায় কাঁটায় আমার ঠাকুমার সমান, সুতরাং বলাই বাহুল্য আমাদের মাঝের ফারাকটুকু নেহাত কম নয়। কেবল বয়েসের সীমারেখাই যে আমাদের দুজনকে আলাদা করে রেখেছে তা নয়। অভিজ্ঞতা থেকে ভূগোল— দূরত্ব আমাদের প্রবল। তবুও অনেক বাঘা বাঘা লোকেরা যা করে উঠতে পারেননি, ফিদেল সেটা পেরেছিলেন। এক বাক্যে বলতে গেলে, ফিদেলের প্রধান কাজ ছিল মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব ঘোচাবার। সে দূরত্ব হোক টাকার, ক্ষমতার, আদর্শের বা সম্পর্কের— এই লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অনড়। মানুষের সাথে মানুষের সকল প্রকার দূরত্বের প্রথম ধাপ চিরকালই অজ্ঞতায় টইটম্বুর হয়ে থাকে। পাশের মানুষটিকে চেনার কোন চেষ্টা না করে, না জেনে ঘোষণাসূচক বাক্য উচ্চারণ নির্দ্বিধায় অসভ্যতার সাক্ষ্যপ্রমাণ হয়ে ওঠে। কিন্ত ফিদেল সম্পর্কে একথা বলতে পারব না একদম এই প্রসঙ্গে মাথায় রাখতে হবে, যে যুগের সন্তান তিনি ছিলেন, সেই যুগের অপরনাম জেটযুগ নয়। মাউসের ক্লিক বা অনলাইন লাইব্রেরীর সাহায্যে এক লহমায় পৌঁছানো যেত না বিশ্বের প্রতিটি কোনায়। এতকিছুর পরেও ফিদেল পেরেছিলেন কিউবা থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভারতবর্ষকে জানতে। ১৯৫৩ সালে কতজন ভারতীয় কিউবা সম্বন্ধে জানতেন সে তথ্য আমার অজানা, তবে ফিদেল ভারত সম্বন্ধে বেশ ভালো মতই খোঁজ রাখতেন (অন্তত তার আভ্যন্তরীণ রীতি-নীতির চলন তাঁর পরিচিত ছিল) এটুকু জানি। শুধু তাই নয়, নিজের বক্তব্যে ভগবত গীতা ও শ্রীকৃষ্ণের উল্লেখ করে ন্যায়-অন্যায়কে সংজ্ঞায়িত করার স্পর্ধা রাখতেন ফিদেল কাস্ত্রো। আমার অজ্ঞতা লজ্জায় ফেলে দেয় আমাকেই। আমি অসভ্য। সত্যিই ফিদেল আমার সময়ের মানুষ ছিলেন না। একুশ শতকের সব জানার, বুঝে ফেলার সময়ের সামনে ফিদেল এক অন্য সময়ের সুদৃঢ় প্রতিনিধি। তাঁর মৃত্যুতে অনেককেই দেখলাম বলতে কেন তাঁর মৃত্যু জানিয়ে দিয়ে যায় যে বিংশ শতাব্দীর মৃত্যু অবশেষে ঘটেই গেছে।

কিউবার বিপ্লবের সূচনা, 1953

একটা প্রশ্ন জাগে নিজের ভেতর। ফিদেলের মৃত্যু কি শুধুই এক যুগের অবসানের সূচকমাত্র? নাকি তাঁর মৃত্যু স-জ্ঞান রাজনীতির মরে যাবার বার্তাও নিয়ে আসে বগলদাবা করে? ইন্টারনেটে ফিদেল সম্পর্কে নানা রকমের ছবি-কার্টুন দেখতে পাচ্ছিলাম তাঁর মৃত্যুর খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর। এক জায়গায় দেখলাম বেশ সুচিন্তিতভাবে আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদে জয়লাভকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ফিদেলেরই উচ্চারিত বাক্যে, “I will not die until America is destroyed”— সূক্ষ্ম হিউমার ছুঁচের মত ফুটল সারা গায়ে, দুনিয়া জানতে পারল আসলেই কেন ফিদেল দেহরক্ষা করেছেন এতদিনে।

আমেরিকার বিনাশ বলতে ফিদেল কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তা আমরা কেউই আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারব না, আন্দাজ করতে পারব কেবল। কিন্ত সেই আন্দাজেও রয়ে যাবে ফাঁকফোকর নির্ঘাৎ। কারণ ফিদেল মারা গেছেন। আর মৃত্যু-পরবর্তী কোন ব্যক্তিত্বকে উদ্ধৃতিতে বন্দী করা যায় ঠিকই, উদ্ধৃতির উদ্দেশ্যের রহস্য সম্পূর্ণরূপে উন্মোচন করা যায় না।

ঐতিহাসিক জয়ের পর

সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে ভালো করেই জানি নেতা, জনতা আর জননেতার মধ্যে পার্থক্য কী। শুধু তাই নয়, আমি এও জানি, যে কোন নেতা বা বিশেষ করে জননেতা যখন মারা যান বা বুদ্ধিশক্তি হারিয়ে ফেলেন, ব্যক্তিত্বহীন নেতা বা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জনতার দল সদর্পে জননেতার ভাষ্যের পাঠোদ্ধারে উপনীত হন। এছাড়াও একদল গবেষক বা একাডেমিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা ক্রমাগত চেষ্টা করে যান জননেতার ‘আসল রূপ’ চেনাতে। এই প্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ ফিচেল আঙ্গিকে নিজেই নিজেকে তাহলে কিছুটা তাত্ত্বিক, কিছু অযৌক্তিক এবং  স্বল্প মাত্রায় আত্মঘাতী একটি প্রশ্ন করাই যায়— ফিদেল, তুমি কার? কে বলবে তোমার কথা? আর সেটা যে তোমারই কথা থাকবে, সে বিচার করবে কে?

সজ্ঞানতায় পরিপূর্ণ কোনো উত্তর খুঁজতে আমি যাচ্ছি না কারণ এমন উত্তর আমার অজ্ঞ মাথা থেকে কখনোই বেরোবে না। অতএব হার স্বীকার করে নিয়েছি সানন্দে। একজন অত্যন্ত অমনোযোগী, চঞ্চলমতি ছাত্রী হিসেবে ধারণা করার ধৃষ্টতাটুকু করতে পারি আমি বরং।

ফিদেলকে উত্তরের মধ্যে খুঁজতে যাওয়াটাই কেন জানি না আমার জন্য দারুণ ব্যর্থতার গন্ধ নিয়ে আসে। আঁচ করতে পারি, ফিদেল কোন উত্তর নন। তিনি একাধারে প্রশ্ন, প্রশ্নকর্তা, প্রশ্ন করবার সাহস। মার্কসবাদী ফিদেল আসলে দ্বন্দ্বের, দ্বন্দ্বের পক্ষে যুক্তির প্রতিনিধিত্ব করে গিয়েছেন আমৃত্যু, এবং তার পরেও। সুতরাং ফিদেলকে খুঁজে যেতে হবে লড়াইয়ের ঠিক মধ্যিখানে কোথাও। ভবিষ্যতের সাথে অতীতের দ্বন্দ্বরূপী যে লড়াই, ফিদেল যেন সেই লড়াইয়ের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। হয়ত এর নামই শখ করে তিনি রেখেছিলেন বিপ্লব। সাজিয়ে গুছিয়ে আমার এতকিছু বলা যে আসলেই ফিদেল প্রসঙ্গে এক অদ্ভুত অজ্ঞ, ছড়িয়ে থাকা রোমান্টিকতার প্রমাণ, তা স্বীকার করি। আর ফিদেল যেন আমার এই Exotic অজ্ঞতার মুখোমুখি মারাত্মক রকম পরিশীলিত জ্ঞানের আজব অ্যান্টি-থিসিস হয়ে উঠতে থাকেন। আমি আরো আরো লজ্জায় পড়ে যাই। আমার সময় লজ্জায় পড়ে যায় তার সাথে।

‘মার্চ টু হাভানা’, 1959

আমি নিজে ডায়রি লিখি। অন্য কারো প্রয়োজনে নয়, নিজের সময় কাটাতে, নিজেকে আরেকটু ভালো করে চিনতে চেষ্টা করি— তাই লিখি, যা মাঝে মাঝে আমার ব্লগে জায়গা করে নেয়। মাঝে মাঝে ফিরে যাই পুরনো লেখায়। কাটাকুটি করে ফেলে আসা ‘আমি’-কে বদলাবার চেষ্টায় লাগি। পারি কি না জানিনা, তবে গত দেড় বছরের খান ষাটেক ব্লগপোস্টে একটা আমিত্বের ধারাবাহিকতা টের পাই। সাদায়-কালোয় লিখে রাখলে খানিকটা হলেও একটা মানুষ স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে বলে আমি মনে করি। নাহলে তো পৃথিবীর দু’পেয়েরা রয়েই যেত নিজেদের সব রহস্য-রোমাঞ্চ থেকে অধরা চিরকাল। শব্দ আমায় মানুষ চেনায়। আর মানুষ চিনতে শেখা, নিজেকে চিনতে শেখাই এখন আমার নিত্যদিনের অভ্যেস।

যাই হোক, ফিদেল প্রসঙ্গে লিখতে বসে মানুষ ফিদেল ও তাঁর জীবনের স্পষ্ট-অস্পষ্টের কথা মনে পড়িয়ে দিল আমার এই প্রাত্যহিক অভ্যাসটি। কোথায় যেন পড়েছিলাম ফিদেল কাস্ত্রোর একটা মহাভারত-সমান জীবনী আছে। বাড়িতেই ছিল বাবার কাছে, খোঁজ নিয়ে জানলাম। হুশ করে মাথায় খেলে যায় চিন্তা। ফিদেলও কি কখনো ফিরে যেতেন নিজের ফেলে আসা জীবনের কাছে? চাইতেন ফিরে যেতে? মোনালিসা বা যে কোন পাকা দাবাড়ুর মত চালাক হাসি হাসতেন কি আশেপাশের অজ্ঞতা দেখে? দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন তাঁর বক্তব্যের অসমাপ্ত পাঠের প্রেক্ষিতে? নাকি একদম পেছনে তাকাতেন না ফিদেল? শ্যেনদৃষ্টি সর্বদা সামনে, খোলা আসমানের দিকে থাকত তাক করা? এই কৌতূহল মেটাতে বইয়ের একটি অনলাইন সংস্করণ বাগে আনলাম, আর মাথার ভেতর একটা নতুন জগত খুলে গেল।

নিউ ইয়র্ক, 1959

ইগন্যাসিও র‍্যামোনেতের শতঘন্টাব্যাপী দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে ফিদেল কাস্ত্রোর যে একটি জীবনী রচিত হয়েছিল, সে কথা অনেকেই জানেন। কিন্ত আমার মত জানা সত্ত্বেও সেই বিশাল, পেটমোটা বইটি শেষ পর্যন্ত পড়ে উঠতে পারেননি, এমন মানুষের সংখ্যাও নেহাত ফেলনা নয়। মানুষ হিসেবে, এবং বিশেষ করে একুশ শতাব্দীর সন্তান, আমি অন্তত ধৈর্যের সাথে কিছুই শেষ করে উঠতে পারিনা ভালো মত। সেই কারনেই পড়া হয়ে ওঠেনি পুরো বইটা আজ অবধি। তুলনায় ফেসবুকের ওয়াল থেকে ওয়ালে আমার আঙুল দ্রুত নেচে বেড়াতেই যেন অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ্য। তবুও সাহস করে সেই বইটির কিছু অধ্যায় পড়বার চেষ্টা করেছি। এবং পড়তে পড়তেই মাথার ভেতর আচমকা ইগন্যাসিও’র প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা জেগে উঠেছে। একজন মানুষের ঠিক কতখানি অধ্যবসায় থাকলে ১০০ ঘন্টার সাক্ষাতকার নিতে পারে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে অবাক হয়েছি। এক প্রশ্ন থেকে আরেক প্রশ্নে যাওয়া শুধু নয়, এক ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের, কর্মজীবনের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর তথ্য থেকে কীভাবে নিংড়ে তুলে আনতে পারে একটা সময়ের ইতিহাস, ভেবেছি সেটা। অবশেষে ইগন্যাসিও’র প্রতি একটা প্রণাম না ঠুকে পারলাম না। কিন্ত মনের প্রশ্ন এখানেই থামল না। মাথার ভেতর ডায়ালেক্টিক্স খাটিয়ে বুঝতে পারলাম যে এহেন সিন্থেসিস একা ইগন্যাসিও’র ক্ষমতায় হয়নি। আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে বিপরীতে থাকা উত্তরদাতার নাম ফিদেল কাস্ত্রো। যার জীবনবর্ণনা যতটা উত্তেজক, তার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী তাঁর বাচনশক্তি। ভূতের রাজার বর পেয়েছিলেন কি না জানি না, তবে ফিদেলের বক্তৃতা আর গুপী-বাঘার যুগলবন্দী যে একই রকম জনতাকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে দিতে পারত, এ কথা আর নতুন করে প্রমাণ করবার দাবী রাখে না। শোনা যায়, ঘন্টার পর ঘন্টা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারতেন তিনি হাজার হাজার জনতাকে স্রেফ তাঁর অনবদ্য শব্দ-কথার গাঁথুনিতে।

তাঁর দীর্ঘ জীবনে এমন কতই না বক্তৃতা ফিদেল করেছিলেন। তবে তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচ্য নিঃসন্দেহে ১৯৫৩ সালে গ্রেফতার হবার পর বিচারাধীন সময় আদালতে উচ্চারিত ‘ইতিহাস আমাকে মুক্ত করবে’ বক্তৃতাটি। আত্মরক্ষার্থে করা এই বিখ্যাত, তাৎক্ষণিক অথচ টানা চার ঘন্টাব্যাপী বক্তৃতাটি পরবর্তীকালে ফিদেল প্রকাশ করেছিলেন। মূল বক্তব্যে যে বাক্যটি তিনি একদম পরিশেষে উচ্চারণ করেন, তা ছিল “History will absolve me”, যা পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে সংগঠিত বাম আন্দোলনের অন্যতম সর্বাধিক ব্যবহৃত উদ্ধৃতিতে পরিণত হয়। এখানে, এই বাক্যে ব্যবহৃত “absolve” শব্দটির প্রতি আমি খানিকটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

অভিধান অনুসারে absolve শব্দের অর্থ মুক্তিপ্রাপ্তি, ক্ষমা অথবা শোধ করা। এখন প্রশ্ন উঠছে ফিদেল কি শুধুই মুক্তিপ্রাপ্তির অর্থে এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, নাকি এর পেছনে এবং পরবর্তী রূপগুলিতে ধরা পড়লেও পড়তে পারে অন্য কোন ভাষ্য? দ্বিতীয়ত, যদিও বা তিনি মুক্তি অর্থেই এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে সেই মুক্তির আদল আসলেই কেমন, তা ফিদেলকে বুঝে উঠতে পারার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রয়োজনীয় বলে আমি অন্তত মনে করি।

বনাম সিআইএ, 1961

সংস্কৃতি, রাজনীতি ও বৃহত্তর সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে আমি সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করি যে কোন একমুখী ভাষ্যকে। যুক্তি ও চিন্তার দিশা যে সর্বত্রই একপথগামী হবে, তাঁর বিন্যাসের পূর্ণরূপ যে বহুরূপী ও স্তরীভূত নয়, তাও আমি মানতে নারাজ। সে কারণেই বোধহয় আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় অনেকান্তিক সত্যে। কিছুদিন যাবত কলকাতার বিশিষ্ট নাট্যকার ও গবেষক সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের সাথে একটি কাজে সাহায্য করবার সুযোগ পেয়ে পড়াশোনা করার অভ্যেসে ফিরে গেছি। ফলত, বেশ কিছু আশ্চর্য চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট বোধ করছি আচমকা। এমনই এক সুযোগে পড়ে ফেলি বাখতিন। সোভিয়েত চিন্তক মিখাইল বাখতিন যে কোন ভাষ্যের ‘হেটেরোগ্লোসিয়া’ (বাংলায় যার সবচেয়ে কাছাকাছি অনুবাদ ‘অনেকান্ত’ ছাড়া কী দাঁড়ায়, আমার একদমই জানা নেই) প্রসঙ্গে এমনই এক চিন্তাধারার কথা বলেন। তাঁর মতে, যখন কোন ভাষ্য বা বক্তব্যের জন্ম হয়, সেই ভাষ্যের অর্থ বা উদ্দেশ্য প্রায়শই থাকে একের বেশি। অর্থাৎ, দ্বৈত বা নানা স্বরে ধ্বনিত হতে থাকে একটি ভাষ্য, যাকে তিনি polyphony হিসেবেও বোঝাতে চেয়েছেন বারবার। বাখতিন এটাও বলেন যে এমন বহুমুখী উচ্চারণ ধরা পড়ে বিশেষত নানাবিধ পারফর্মেন্সের ক্ষেত্রে, যেমন সঙ্গীত বা নাট্যের পরিসরে। এবং যেহেতু জনসমক্ষে ও একান্তে সংগঠিত ফিদেলের বক্তৃতাগুলি আসলে একপ্রকার রাজনৈতিক সম্ভাবনাময় পারফর্মেন্স, অতএব তাঁর বক্তৃতাকেও এই ছাঁচে ফেলার চেষ্টা করা যেতেই পারে। কিন্ত সহজ করে বোঝাতে গেলে উদাহরণ দরকার। এক্ষেত্রে যদি লালনের বা রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গেও আমরা আসতে পারি, তাহলেও কিছু সমগোত্রীয় ব্যবহার আমাদের চোখে পড়বে। লালনের গানসমূহ মূলত শ্রুতি-পরম্পরায় বাহিত। সে অর্থে কোন লিখিত রূপ না থাকার ফলে অর্থ বা ‘মিনিং’-এর অন্বেষণে তাঁকে নানা রকমের দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যেমন তাঁর একটি গানের পংক্তি, “সিরাজ সাঁই ডেকে বলে লালনকে/ কুতর্কের দোকান তুই করিস না আর/ ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার”- এই শেষ পংক্তিটির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে যে লিখিত ভাষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন যতিচিহ্নের প্রয়োগে এর অর্থ এদিক-ওদিক হতে পারে সহজেই। “ভবে মানুষ, গুরু-নিষ্ঠা যার” বা “ভবে মানুষ-গুরু, নিষ্ঠা যার” অথবা “ভবে মানু্‌ষ, গুরু, নিষ্ঠা যার”- এই তিনটির মধ্যে যে কোন একটি হয়ে যেতে পারে বক্তব্যের উদ্দেশ্য। তাহলে প্রশ্ন ওঠে কোনটা মান্য করা হবে। কিন্ত যদি আমরা বাখতিনের পথে হাঁটতে যাই, লালনের একই সাথে তিনটি অর্থের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকট হয়ে আসে। আসলে লালনের গান লালন নিজে খাতায়-কলমে লিখে যাননি, উচ্চারণ করেছিলেন শুধু। যারা মুদ্রণে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তারাই লালনের হয়ে গানের অর্থ খানিকটা হলেও নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। এবং সেই প্রক্রিয়ায় কিছুটা হলেও লালনের ভাষ্য খণ্ডিত হয়ে পড়েছে বলা যেতে পারে।

একই ভাবে ফিদেলের হাতে গোনা কয়েকটি বক্তৃতা ছাড়া, নিজ হাতে সেই বক্তব্যের অনুলিখন ফিদেল করেননি। করেছেন বিভিন্ন সরকারী, বেসরকারী আধিকারিকেরা বা অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ। সুতরাং ফিদেল আসলেই যখন উচ্চারণ করেন যে “History will absolve me”, তিনি কোন অর্থে absolve বলেছিলেন, তা ফিদেল নিজে ছাড়া আর কেউই সম্পূর্ণ সঠিকভাবে বলতে পারেন না। আমরা কেবলই নিজেদের মত করে ধরে নিতে থাকি বিভিন্ন একমুখী সত্যকে ও মেতে থাকি সেই সত্যের উদযাপনে। আমাদের এযুগের তাড়াহুড়োয় কোথাও গিয়ে তাই ফিদেল রয়ে যান মিথের মতন অধরা, আংশিকভাবে স্পষ্ট।

এই একই উক্তির প্রেক্ষিতে আমরা ভাবতে বসি, তাহলে শেষ পর্যন্ত ফিদেলের মোক্ষ কোথায়? ওনার মুক্তি কি তাহলে শুধুই সমাজতন্ত্র কায়েমের স্বপ্নেই সীমাবদ্ধ? নাকি দূরদ্রষ্টা ফিদেল অল্প হলেও আঁচ করতে পেরেছিলেন ইতিহাসের ফেরে কোন অন্য মুক্তির কথা? এই মুক্তি কেমন? কী থেকে মুক্তি? বন্ধন, শৃঙ্খল থেকে মুক্তি? নাকি এই মুক্তি আসলে রূপকার্থে ব্যবহৃত, যার অর্থ সময়ের সাথে ক্রমাগত বদলে যেতে বাধ্য?

কমিকজগতের সুপারহিরো স্পাইডারম্যানের ভাষায় “With great power, comes great responsibility” এপ্রসঙ্গে মাথায় ঘোরে। ফিদেলের সুযোগ্য, বলিষ্ঠ নেতৃত্বে যে বিপ্লব বাস্তবায়িত হয়েছিল, তার পরবর্তীতে তিনি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রবল ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। এবং ক্ষমতার কান টানলে দায়িত্বের মাথা সমেত সুবিশাল বপু এসে ধরা দিয়েছিল তাঁর কাছে। ফলত, যে শৃঙ্খল থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে বিপ্লবের পথে কাস্ত্রো হাঁটতে শুরু করেছিলেন, পরের দৃশ্যে সেই বিপ্লবই তাঁকে বেঁধে রেখেছিল ক্ষমতার আসনে। যার ফলস্বরূপ একনায়কতন্ত্রের আভাস তাঁর কার্যকলাপে প্রচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল সাময়িকভাবে। ক্ষণের মুক্তি এভাবেই ফিদেলের জীবনে পরিণত হয় ক্ষমতার প্রতি পরাধীনতায়।

খরুশ্চেভের সঙ্গে, মস্কো, 1963

কিন্তু ইতিহাস থেমে থাকে না, থাকতে পারে না। এবং যেহেতু সময় পালটায়, ফিদেলের সেই উক্তিটিকেও উল্টেপাল্টে দেখার সময় এসে গেছে। ইতিহাসের হাতে, ইতিহাসের থেকে মুক্তি চাওয়া ফিদেল কাস্ত্রোকে এখনের সময়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে গেলে absolve শব্দের কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন গতি নেই। মানুষ ফিদেলকে উদ্ধার করতে তিনি নিজেই পারতেন, এখনও তাই। এক্ষেত্রেও ধরে নিতে হবে অনেকান্তের সত্যতা আর প্রশ্ন করতে হবে প্রতিদিন, এই উক্তির উদ্দেশ্য আসলেই কী? নিজের বিচ্যুতির জন্য ইতিহাসের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা? নাকি এসবের বাইরে গিয়ে নিজের বক্তার আসন থেকে, ক্ষমতার থেকে মুক্তির কামনা? ফিদেল কি তাহলে চাইতেন বক্তার আসনের চূড়ান্ত গণতান্ত্রিকীকরণ? যেখানে তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ হয়ে উঠবে আসলে অনেকগুলি ক্ষীণকন্ঠের সমাহারে সমৃদ্ধ?

আমরা জানব না, কারণ ফিদেল নিজেই আজ ইতিহাস হয়ে গেছেন। তিনি মুক্ত। কিন্তু তাঁর দায়ভার রয়েই গেছে, একই সাথে উত্তরাধিকারও। আর এখনও, এতগুলি ফেলে আসা বছরের মতই, absolve হওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রেখে যাচ্ছেন। আর এই সময়ে দাঁড়িয়ে ফিদেলের মৃত্যু আমাদের চিরপরিচিত সব সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করার জোগান দিয়ে যায়— ফিদেল কই? ইতিহাস কী ও কেন? মুক্তি কোন পথে? আর বিপ্লবের সময় ঠিক কখন?

ফিদেলের মৃত্যু বড় অসময়ে এলো। এমন একটা সময়ে তিনি মারা গেলেন যখন তাঁর মারা যাওয়া আলাদা করে কিছু ঘটিয়ে দিয়ে যায় না চারপাশে। এখন এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি যখন কোন মানুষের মৃত্যু নতুন করে আমাদের অন্তরাত্মাকে আন্দোলিত করতে ব্যর্থ হয়। আমরা কাঁদি না, হাসি না। নীরব দর্শকের মত শুধু সাক্ষী থেকে যেতে পারি। ফিদেলের মৃত্যুও ঠিক তেমনি আমাদের আর তেমনভাবে আন্দোলিত করে না। এই সময়ের গুণগত মাপকাঠিতে তিনি বহুযুগ আগেই মরে গেছেন। এমন বর্ণাঢ্য, ঐতিহাসিক জীবনের অধিকারী ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর আরো অনেক শোরগোল প্রাপ্য ছিল। কিন্তু এমনটা মোটেও হয়নি। বড়জোর তিন-চারদিনের খবরের কাগজের প্রথম পাতা, তারপর টিভি চ্যানেলের সপ্তাহান্তের গোটা দুয়েক বিশেষ অনুষ্ঠান বরাতে জুটবে এই মৃত্যুর। তাহলে হঠাৎ এখন কেন লিখছি এই মানুষটিকে নিয়ে?

লিখছি, কারণ ফিদেলের মৃত্যু আরো একবার জানান দিয়ে যায় তিলে তিলে মরে যেতে থাকা একটা সময়ের কথা। অসম্ভব স্বপ্নালু একটা সময়ের মরে যেতে থাকার কথা। আবার অন্যদিকে চরম হতাশার, স্বপ্নভঙ্গের সময়কেও ধরিয়ে দিয়ে যায় আমাদের ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যু।

ভিয়েতনাম, 1973

এখন অন্তত ফিদেলের মৃত্যু কাউকে অপরাধী করে দেয় না। বরং তাঁর থেমে যাওয়া আরো অনেককে বাঁচিয়ে রেখে যায়। আমার জানা মতে, তিনি মরণোত্তর দেহদান করে যাননি, সুতরাং তাঁর দেহের অংশবিশেষ অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না চাইলেও। দৈহিক খণ্ডনের বিপরীতে থেকেও থিসিয়ুসের জাহাজের আখ্যান মনে পড়ায় আমাদের এই বিপ্লবীর মৃত্যু। বেশ কিছু মানুষ দেখলাম বিভিন্ন মাধ্যমে বিদায় জানাচ্ছিলেন ফিদেলকে। আমি জানাইনি। কারণ আমি শিখেছি বাস্তববাদী কমিউনিস্টদের দৈহিক মৃত্যুতে অশ্রু ঝরাতে নেই। অন্তত সেই ব্যক্তি যদি হন ফিদেল কাস্ত্রো। কাস্ত্রোর মুক্তি মৃত্যুতে ঘটতে পারে শুধু একটি মাত্র দিক থেকে। ইতিহাসের ফেরে দেশে দেশে যেভাবে ফ্যাসিবাদী শক্তি নব নব রূপে ফিরে আসছে পৃথিবীর সর্বত্র, কোথাও গায়ে গেরুয়া তো কোথাও মুখের চামড়ার রঙে হালকা কমলা-গেরুয়ার আভাস, ঐকিক নিয়মে তাঁর বিপরীতে দাঁড়াবার জন্য গুটিকয়েক ফিদেল ফিরে আসবেই। কে জানে, ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদের নিত্য নতুন ভাষ্যের বিরুদ্ধে আবার কোন ফিদেল জন্মান কি না নতুন কোন মুক্তির লক্ষ্যে।

মানুষের মৃত্যুতে কাঁদা যেমন যুক্তিহীন, স্মৃতির মৃত্যুতে অনড় থাকা তেমনই অমানবিক। সুতরাং মানুষ ফিদেলের মৃত্যুতে ব্যথিত হবার যত কারণ আছে, তা মেনে নেওয়া কোন যৌক্তিক মস্তিষ্কের পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। ২০১৬ সালে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ ফিদেলের শারীরিক অবস্থার প্রেক্ষিতে এই মৃত্যু অবধারিত ছিল। কিন্ত এসব মস্তিষ্কের কথা কেবল। তাঁর সাথে হৃদয়ের, স্মৃতির, স্মৃতির রোমান্টিকতার কোন যোগ নেই। কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র, গ্রান মা’তে ফিদেল বিষয়ক কিছু লেখা পড়ছিলাম। আলফন্সো গার্সিয়া নামের একজনের লেখা চোখে পড়ল। লেখাটির শিরোনাম বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “কাছ থেকে ফিদেলকে দেখেনি আমার পরিবার”। লেখকের বাবা-মা ১৯৫০-এর দশক থেকেই কিউবা নিবাসী। ভগবানে প্রবল বিশ্বাসী গার্সিয়া দম্পতি সমাজতন্ত্র কী জানেন না। কমিউনিজম দিয়ে কী হয় জানার কোন প্রয়োজন পড়েনি তাঁদের জীবনে। দৈনন্দিন টানাপোড়েনে দিনের শেষে লেডি অফ এল কোব্রে দেবীর মূর্তির নীচে নত হলেও, কোথাও একটা তাঁরা যেন জানতেন ফিদেল নামক ছেলেটা আদতে মুশকিল আসান, মসীহা গোছের কেউ একটা। যখন এই লেখাটা পড়ছিলাম, আমার সামনে টিভি চলছিল। পর্দায় এক হিরোকে দেখতেই মাথায় খেলে গেল অদ্ভুত সামঞ্জস্য। রজনীকান্ত। যার দয়ায় দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র বাস্তব-অবাস্তবের ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিতে বসেছে প্রায়।


অদ্ভুত তুলনা বলতেই পারেন মানুষজন, কিন্ত এই দুজনেরই একটা মারাত্মক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে, সে কথা মানতেই হবে। কাস্ত্রো ও রজনীকান্ত নিজেদের মত করে, পৃথিবীর দুটি সম্পূর্ণ অন্য গোলার্ধে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে স্বপ্ন দেখিয়ে এসেছেন। বাস্তবে-অবাস্তবের নায়ক এরা দুজনই। এদের হাত ধরেই মানূষ কখনো চিনতে শেখে বাস্তব-অবাস্তবের ফারাকটুকু, আবার আরেকজন নিজের স্বার্থেই ক্ষণিকের জন্য হলেও পেরোতে শেখে স্বপ্ন আর সত্যের মাঝের চৌকাঠ। মানুষ যখন জীবনের চরম অপ্রাপ্তি, হতাশা, না-পাওয়া থেকে দূরে যেতে আশ্রয় খুঁজতে থাকেন, কেউ পেয়ে যান রূপোলী পর্দা, আবার কারোর হাতে উঠে আসে কোন লাল নিশান। দু’পক্ষই স্বপ্ন দেখে চরম রোমান্টিকতার বাস্তবায়নের। পর্দার হিরোর মত কখনো এই মানুষ চায় প্রেয়সীকে অতি সহজেই নিজের করে নিতে। চায় সব গুণ্ডাকে একা হাতে দাবড়াতে, কিন্ত বাস্তবের মাটিতে তা পারেনা। অন্যদিকে আরেক দল মানুষ উদ্দীপিত হন কোন নেতার জাদুকরী বক্তব্যে। ঘন্টার পর ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে রক্ত গরম করা বাণী শুনে তাদেরও বুকে বিপ্লবের স্পন্দন জাগতে থাকে। আর সেই বুক ঠুকে তাঁরাও হতে চান এক একজন লেনিন, কাস্ত্রো। আবার এই দুই ক্ষেত্রেই ক্যামেরা সরলে উঠে যায় মেকাপ। চড়া রঙ (লাল কি না জানি না) মুছে গেলে ধরা পড়ে বার্ধক্যের বলিরেখা। যা স্বপ্নের হিরোর সাথে রক্তমাংসের মানুষের সব দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। স্বপ্নভঙ্গ হয় কি না জানিনা, তবে হিরোর মানবায়ন যে ঘটেই এটুকু নিশ্চিত। আর দেবতার মানবায়নের মতই এক্ষেত্রেও ধরা পড়ে মানুষের ঐকান্তিক টানাপোড়েন, ব্যর্থতা ও প্রবল দীর্ঘশ্বাস। শেষ দৃশ্য, তেনারা বৃদ্ধ হন আর উচু বনস্পতি গাছের মত ছায়ার সৃষ্টি করে যেতে থাকেন অবিরাম।

লুই আর্মস্ট্রঙ্গের কথাও যে কেন মনে পড়াচ্ছেন ফিদেল আমায় এতকিছুর পর, বুঝে উঠতে পারছি না। আমার অন্যতম প্রিয় সঙ্গীতস্রষ্টা, গায়ক ও স্যাক্সোফোনবাদক এই ব্যক্তিটির একটি অবিস্মরণীয় উদ্ধৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। যাদবপুরে স্নাতকস্তরে পড়াকালীন আফ্রো-আমেরিকান সঙ্গীত পড়েছিলাম কিছুদিন। পরীক্ষার আগের রাতে ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ কিছুতেই মাথায় ঢোকাতে পারছিল না গভীর তত্ত্বকথার আগাগোড়া কোনকিছুই। এই ব্যক্তিটির কথা পড়তে গিয়ে সেই উদ্ধৃতিটি চোখে পড়ল, আমি তড়াক করে জেগে উঠলাম। শেষ বয়েসের লুই-কে প্রশ্ন করা হয় তাঁর মৃত্যুর পর জ্যাজ-ব্লুজ সঙ্গীতের ভবিষ্যত প্রসঙ্গে। প্রশ্নকর্তা জানতে চান কীভাবে একই গান এত বছর ধরে গেয়ে-বাজিয়ে যাচ্ছেন অক্লান্ত লুই। ওই একটাই পথ, একটাই যন্ত্র, আর একটাই জীবন। জ্যাজের সুর বেসুর ঠেকে না কখনোই? তাঁর কি ক্লান্তি নেই? শিল্পীর কি আসলেই কোনো ক্লান্তি থাকে না? উত্তরে লুই বলেন, “How can I get tired? I don’t do anything. I just stand here. But my blues keep walkin”

ফিদেল প্রসঙ্গে এতগুলি মানুষের কথা মনে পড়ল, তাঁদের কথা লিখলামও। কিন্তু তাঁদের সাথে ফিদেলের যে কতটুকু যোগাযোগ বাস্তবের মাটিতে থাকা সম্ভব জানিনা। আসলে থাকার কথাও নয়। বাস্তবে এসব কিছুই হবার কথা নয়। আমি যতগুলি কথা লিখলাম, তাঁর কোনটাই কি আসলে বাস্তবে লিখছি? লিখতে পারছি? বাস্তব কি এতই সহজবোধ্য যে আমি শব্দে-কথায় বুঝিয়ে উঠতে পারি সত্যি অর্থে ঠিক কী বোঝাতে চাইছি? হয়ত পারছি না। পারছি না, কারণ একজন একুশ শতকের চব্বিশ বছরের মানুষের কাছে বাস্তব যথেষ্ট পরিমাণে উত্তেজনা নিয়ে আসতে পারে না।

বাস্তবের উত্তেজনা, বাস্তবের স্বপ্ন যে সময়টায় বেঁচে ছিল, সেই সময়ে ফিদেল বেঁচে ছিলেন। বিংশ শতকে বাস্তবের স্বপ্ন থাকত। তখন স্বপ্নের মত হাওয়ায় দুর্গগড়া বাস্তব ছিল না, যেখানে একদিকে রক্তমাংসের মানুষের বাস্তবের চেয়ে বেশি দামী হয়ে ওঠে কাল্পনিক দেশপ্রেম। এযুগের প্রতিনিধি আমার কাছে তাই বিংশ শতক মানে স্বপ্ন, স্বপ্নের হেরে যাওয়া, আর তারপরও নতুন স্বপ্ন দেখতে পারার সাহস। তবে তাঁর চেয়েও বেশি বিংশ শতাব্দী মানে বুঝব স্রেফ মানুষের শতাব্দী, বাজারের নয়। আর ফিদেল মানুষ ছিলেন। আনন্দ, উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা, স্বপ্ন, বিদ্রোহ, রাগ, ঘৃণা, অনুতাপ, মোহ, লজ্জা— সব মিলিয়েই ফিদেল কাস্ত্রো একটা নয়, অনেকগুলি মানুষ একসাথে হতে পেরেছিলেন।

আর এমন মানুষকে নিয়ে লিখতে বসলে ধরে নিতেই হবে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। মুক্তির পথে, মুক্তির ইতিহাস লিখতে লিখতে বুড়ো হাত থেমে গিয়েছিল। কারণ সেই হাত একা ছিল না। সেই পা পথে পথে একা হাঁটেনি। সেই শরীর একটা জীবনের গ্লানির বোঝা নিয়ে চলেনি কখনোই। সুতরাং তিনি ক্লান্ত হয়েছেন। এবং শরীরের ক্লান্তি মেনে ধরেই নিচ্ছি তিনি এখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। বা থেমে দম নিচ্ছেন কোথাও কোনো রাস্তার মোড়ে। উনি জানেন কিনা জানি না, অনেকগুলি ফিদেল ঠিক হাঁটছে। পৃথিবীর কোণে কোণে তাঁরা নিশ্বাস ফেলছে প্রতিদিন। আর এতকিছুর পরেও, ৬৪০ বার থামিয়ে দেবার চক্রান্তের পরেও ক্লান্ত ফিদেল আর্মস্ট্রং-এর জ্যাজের মত সঙ্গীত হয়ে ঝরে পড়ছেন সর্বত্র।

অবশেষে, তিনি আজ মুক্ত।

[মূল লেখাটি ‘মুক্ত ফিদেল’ শিরোনামে ১১ই ডিসেম্বর, ২০১৬, দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ-এ প্রকাশিত]

কুটুম কাটাম

রুমেলা দাস


ভাবনার ঘুলঘুলি

আমি ও আমিত্ব

অথৈ

অন্তর্দহন

অনিমেষ গুপ্ত

শোকের ছায়া লেগে থাকলেও অনেকের হৈ-হট্টগোল আর কথাবার্তায় ক’টাদিন সরগরম ছিল বাড়ীটা। শ্রাবণীই বরং একটু স্পেস চাইছিল একলা হওয়ার জন্য, চাইছিল প্রবালের স্মৃতিতে ডুবে থাকতে।

শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটে যাওয়ার পরে হঠাৎই খালি হয়ে গেল বাড়ী। শুধুমাত্র ঝুনুপিসি আর লতিকামাসী আরো আধবেলা থেকে শ্রাবণীর জিনিসপত্র একটু গোছগাছ করে ফিরে গেলে ওপর-নীচে দুটোতলার মাঝে বড় ধাপের ঘোরালো সিঁড়ি, ছোট বড় পাঁচটা ঘর আর প্রবালের ছেড়ে যাওয়া মাঝ দুপুরের শূন্যতার মধ্যে শ্রাবণী তখন একেবারে একা।

অমলের আর্তনাদ

কৃশানু চন্দ


জেল থেকে বেরোবার আগে অমল একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

২০৩৯ সাল। রাষ্ট্র সরকারের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভালো রাজ্যে আজ আলোর ঝলকানি।চারিদিকে বাজি পুড়ছে। কালো রাজ্য এবং ভালো রাজ্যের মাঝের ৫০ মিটার লম্বা কংক্রিটের পাঁচিলটা যেন দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থেকে ভালো রাজ্যেকে কালো শহরের কলুষতা থেকে রক্ষা করছে।

অযাচিত

চিন্ময় মহান্তী


প্রথম পরিচ্ছেদ

দ্বিপ্রহর হইতে সারাক্ষণ বৃষ্টি ঝরাইয়া মেঘগুলি কাজল বর্ণ হারাইয়া শুভ্র শ্বেত বর্ণ ধারণ করিয়াছে, তাহাদের উজ্বলতা হইতে কিরণ আসিয়া বর্ষণ ধৌত ধরিত্রী বক্ষের ঔজ্জ্বল্য স্বল্পমাত্রায় বাড়িয়া উঠিয়াছে; ইহা সকল লোকের নিকট ‘কনে দেখা আলো’ নামে বহু পূর্বকাল হইতেই পরিচিতি পাইয়াছে। কিঞ্চিত অদূরে সন্ধ্যাকাল অপেক্ষারত রহিয়াছে, সময় আসিলেই আপন স্থান লইয়া লইবে।

এমত সময়ে সুখেন কোথা হইতে আসিয়া উঠানের এক অঙ্গুলি কাদা সুকৌশলে অতিক্রম করিয়া ঘরে ঢুকিল, দেখিল তাহার বধূ দীপা মেঝের মধ্যিখানটিতে বহুল ব্যবহারে জীর্ণ মাদুরিটি পাতিয়া লইয়া শুইয়া রহিয়াছে। এই অকাল শয়ন দেখিয়া সে খানিক বিস্মৃত হইয়া বধূর শিয়রে মাদুরির একটি কোনা দখল করিয়া বসিল, জানিতে চাহিল, “দীপা তোমার কি হয়েছে ?” প্রত্যুত্তরে দীপা লজ্জিতা মুখটি বিপরীত পানে ফিরাইয়া লইল। সুখেন ইতস্তত ছড়াইয়া ছিটাইয়া থাকা বধূর কেশরাশির উপর আঁকিবুকি কাটিতে কাটিতে পুনরায় জানিতে চাহিল, “তোমার কি হয়েছে ?” দীপা এইবার উত্তর করিল, লজ্জিতা ওষ্ঠটি মৃদু কাঁপাইয়া বলিল, “তোমার মায়ের কাছে জানবে যাও।” সুখেন বুঝিতে পারিয়াছে তথাপি আপন বধূর মুখ হইতে শুনিতে ইচ্ছা করিতেছিল। তাহার সেই ইচ্ছা পূর্ণ হইল না। নারীজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অলংকার লজ্জা, তাহা দীপার বদন হইতে বিচ্যুত হইল না।

বৃষ্টি ভেজা বালিয়াড়ি

অর্পিতা সরকার


সেদিনও ঠিক এমনি এলোমেলো বাতাস বইছিল। আকাশ ছেয়েছিল মেঘের ঘনঘটায়। সঞ্চিতা একা দাঁড়িয়ে ছিল হোটেলের ব্যালকনিতে। ব্যালকনি থেকেই দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের অবিরত ঢেউয়ের আসা যাওয়া। পুরীর সি-বিচে সব সময় লোকের মেলা, তাই নির্জনতা খুঁজতে পুরীতে আসেনি সঞ্চিতা। ও এসেছে দূর থেকে মানুষের ভিড় দেখতে। মানুষের উপচে পড়া আনন্দকে দূর থেকে উপভোগ করে চলেছে ও।সাথে সমুদ্রের গর্জন ওকে কিছুতেই একলা হতে দেয় না। এই কারণেই বছরে একবার পুজোর ছুটিতে সঞ্চিতা চলে আসে পুরীতে।

ভিতরে ভিতরে যে মানুষ সম্পূর্ণ একা, তাকে নীরবতা আর টানে না। সঞ্চিতা প্রথম পুরী এসেছিল বাবা-মায়ের সাথে তখন ওর বয়েস তিন। তারপর কলেজ এক্সকারসনে। বাবা কিছুতেই ছাড়তে চায়নি ওকে। তবুও বন্ধুদের গোটা গ্রুপের করুণ আর্তির সামনে শেষ পর্যন্ত বাবার মত পেয়েই গিয়েছিল।

ঝলকানি

অনিমেষ ভট্টাচার্য্য



পারমিতা পড়ল মহা ফাঁপরে। গত কয়েক মাস থেকেই সুবিমল উইকেন্ডের এক-আধ দিন করে বাড়িতে থাকত না। কখনও কখনও উইকডেজেও দেরি করে ফিরত। চাকরির চাপ আছে, তারপর খামখেয়ালি মানুষ। এদিক ওদিক ঘুরতে ভালবাসে। তাই পারমিতা অত গা করে নি।

আজ বাইশ বছর ধরে সংসার করছে। বাড়িতে ছেলে মেয়ে আছে। মেয়েটার সেকেন্ড ইয়ার হবে। আর রঙিনের ক্লাস ফাইভ। এরকম বয়েসে এসে অন্য কোন মেয়েমানুষের সঙ্গে লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম-পিরিতি – ব্যাপারটা ধর্তব্যের মধ্যেই আনে নি সে। ঐ বাংলা সিরিয়ালটা দেখতে দেখতেই মনে হল...