ফেব্রুয়ারী ২০১৮



প্রচ্ছদশিল্পী - রুমেলা দাস

সম্পাদকের কথা

বইমেলার পাট চুকল তাহলে। বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বণ। তাও জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবারের জন্য বাঙালির অপেক্ষা আর পাঁচটা পার্বণের মতো একদমই নয়। এখন ফ্লিপকার্ট আমাজন এর দৌলতে সারা বছরই বই কেনা হয়। আর সব চাহিদা মেটাতে কলেজ স্ট্রিট তো আছেই। কিন্তু কল্পনার জগতে হারিয়ে যাওয়ার এই উৎসবে বাঙালিকে নামমাত্র ছাড়ে বই কিনতে রুধিবে এমন সাধ্যি স্বয়ং মা দুর্গারও নেই। সারা বছর যে সমস্ত কবি সাহিত্যিকের লেখা পড়া হল কিংবা যাদের সঙ্গে ফেসবুকে আলাপ তাদের চাক্ষুষ দেখার সুযোগ, তাদের সইসম্বলিত বই হাতে বাড়ি ফেরার এই লোভ সত্যিই অসংবরণীয়।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাকি পার্বণের চরিত্র বদলেছে, বইমেলাই বা বাদ পড়ে কী করে? মেলা বই কিন্তু ফুড কোর্টে ধুলোমাখা বিরিয়ানিভক্ষকের লাইনগুলো মাঝে মাঝেই বইয়ের দোকানের ভিড়ের তেজকে বড্ডো বেশি। ভিড়ের চোটে মাঠের দূষণ মাত্রা প্রায়শই বিপদ সীমা পার করলেও বছরের বাকি সময়ের বেশির ভাগটাই বাঙালির সময় কাটছে স্মার্টফোনে মুখ গুঁজে। বাবা মায়েরা বুড়ো আংলাকে জোড়া বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে হ্যারি পটার কিনে দিতে ভীষণরকম আগ্রহী নইলে কিনা পাড়ায় ঠিক মুখ দেখানো যাবে না। কিছু বইয়ের বিক্রি আকাশছোঁয়া আর অধিকাংশ বই উই তাড়াচ্ছে। তাই বছর কে বছর মেলায় ভিড় বাড়লেও বাঙালির বই প্রীতি আসলে কতটা সেটা নিয়ে অনেকের মনেই অনেকখানি আশংকা।

আমরা পরবাসিয়ার দল মনে করি এত ভিন্ন স্বাদের বিনোদনের প্রলুব্ধকর হাতছানির মধ্যেও বইয়ের আবেদন কোনোদিনই কম হবে না। আর এই আশায় বুক বেঁধেই নিয়ে এসেছি পরবাসিয়া পাঁচালীর নতুন সংখ্যা। আশা করি সবার ভালো লাগবে। জানি বইমেলার কেনা বইগুলো চুম্বকের মত টানছে। তার মধ্যেও যদি সময় করে লেখাগুলো একটু পড়ে ফেলেন আশা রাখি নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। ভালো লেখা পড়ুন, ভালো লেখা পড়ান। এবারের মত এইটুকুই।

প্রদীপ ভাসানো ঘুমন্ত নদীর আশে পাশে

অভিষেক ঘোষ


কান্নার গাছ থেকে কান্নার ফল পড়লে, নড়ে ওঠে পাতা
যা বৃথা আছে এই ঘরের পরে,যা বৃথা ছিল না,
অযথা
জঙ্গলের কোকিল কাঁদলে ভোর হতে কেটে কেটে শিরা
ফিরেছি আমিও এই কুয়াশা বাষ্পে, ফিরেছে আমাদেরও
পড়শিরা,
সবাই ঘুমের নদীতে শান্ত স্রোতের স্বপ্নে, ডুবিয়েছিল ঘটি
তার চোখ ছড়িয়ে পড়লে, আলো হয়ে বত্রিশ হাজারকোটি
প্রদীপ জলে ভেসে ভেসে বুঝাল রাত্রিকে আমরা জ্বলে থাকতে
পারি, জলের উপর,
আর যে কোনো অসুবিধা হলে জলছায়াকে বলি
ফিরিয়ে দিতে তৃপ্তি...
যখন আগুন পড়ে কান্নার গাছ পুড়ে যায়, তখন শুধু তো ছাই হয় না,
হয় না
পোড়া হলুদ পাতাদের
নিমেষের কোনো দীপ্তি...

অলংকরণ: অভিষেক ঘোষ

তার পর থেকে

সোনালী মন্ডল আইচ


ফুরিয়ে যাওয়া পথের কিছুটা
খামে ভরে জিভ বুলিয়ে
নিয়েছো আঠায়

প্রাপ্তির গর্তে কাবুলিওয়ালা ব’সে
ভীষন তৃষ্ণায় হাপিত্যেস
গাঙচিলের ঝাঁক

সৈকত খুঁজে না পেয়ে
ব্যাঙমা ব্যাঙমীর আশায় আজ,
কাল, পরশু

জমিয়ে যাচ্ছি সবটুকু নগ্ন অতীত
লিওনের গাঢ় নীল মখমলে
স্কিৎজোফ্রেনিয়া ফেজ...

অলংকরণ : প্রমিত নন্দী
মূল ছবি : প্যাট্রিসিয়া কুইঞ্চ

চ্যাংরাবান্ধার পাড়াগাঁ

গোবিন্দ সরকার


মাটির সোঁদা সোঁদা গন্ধের টান,
পথের দুপাশে হাস্নুহানা,
কেতকীর গন্ধ মাখানো বাউল মন
মায়া ভুলিনি আজও, ফুটিয়া ওঠে দর্পণ।
ছুটে আসি তাই একতারাটি হাতে
আলবাঁধানো এলোমেলো ধুলোমাখা পথে—
দীনদরিদ্রের অলংকার অমৃতসম ধূলিকণা—
গায়ের সহস্র শ্রমে যায়গো ভালবাসা বোনা।
কিছুদূর গিয়েই তো পেত্নীদিঘির মাঠ,
নেমে গেছে পথ মাঠের বুক চিরে;
পথের দুব্বাঘাস নিজেকে করিয়া সমর্পন
ধূসরিত পথ বিধবামায়ের সিথীর মতন।
একতারা হাতে গেয়ে যাই মাটি মানুষের গান,
আহা! গাইলেই কি তৃপ্তি আসে হিয়ায়!
ছাতিম তলায় দিবানিদ্রা দিয়েছি কত,
স্নিগ্ধ শীতল মমতাময়ী, ভুবনভুলানো গাঁ
যতবারই আসি ততবারই লাগেগো নতুন—
চ্যাংরাবান্ধার নয়নজুড়ানো পাড়াগাঁ।
ছোট্ট ছোট্ট ঘরগুলি একচালা কুটির
উঠোনে দোপাটিফুলের আলপনা, যেন শান্তির নীড়।
মানুষেরা নম্র, শান্ত, সভ্যতার চালিকা
ঘর তাদের কুঁড়ে হলেও মনটা অট্টালিকা।
গরুর গাড়ি চেপে একতারা হাতে বকুলতলায়,
যেখানে বসত আগে বাউল গানের আসর
গাইতাম, “পথ হারানো পথিক ওরে...”
উপচে পড়ত মানুষের ভিড়।
এখন সে অতীত—
আর অতীত ইতিহাসের পাতাতেই শোভায়।
গড়িয়ে এল বিকেল, পড়ল ছুটির ঘন্টা
কচিকাঁচাদের দৌড়ঝাঁপ, সঙ্গে হাটুয়া ব্যাগটা।
কেউ বাজায় মিড-ডে মিলের থালা,
কেউবা আমের আঁটির ভেঁপু।
ওপাড়ার পাঁচু কামারের ছোট্ট ছেলে ফটিক,
চোখে তার কালশিটে দাগ—
সারা দেহে দীনতার ছাপ;
সুযোগ মেলেনি তার স্কুলে আসার
ভর্তি হয়েও স্কুলছুট, এ দারিদ্র্যতার অভিশাপ।
টায়ার চালিয়ে হাজির, বুকে পাহাড়প্রমাণ খুশি
হাঁপালেও দমেনি সে মুখে নজরকাড়া হাসি।
এদিক ওদিক তাকায় সে, পলকই ফেলেনা
দেখতে, পাশের বাড়ির ফুলুর ছুটি হয়েছে কিনা?
শিহরিয়া উঠিল বুক সহস্র খুশির মাঝে—
নিষ্পাপ বালকের এই করুণ অসহায়তা;
বেদনায় উঠিল বাজিয়া হৃদয়ের একতারাটা।

অলংকরণ : প্রমিত নন্দী

মৃত্যু

দেবলীনা দেব


যে মৃত্যু ভয়ংকর হয়,
সেই মৃত্যুর গল্প বিখ্যাত হয়;
প্রতি স্পন্দনে অক্সিজেনের অভাবে—
হৃৎপিণ্ড বিকল হবার যে গল্প জুড়ে পাশবিকতা,
সেই গল্প শিহরন জাগায়,
সেই গল্প নেশা ধরায়।

তবে শেষ নিশ্বাস কতটা নিঃস্ব সেই অনুভূতি নেই সেই গল্পে;
সে গল্প একটি মর্মান্তিক ঘটনার পাশবিক বর্ণনা মাত্র।
হৃৎপিণ্ডের শেষ লড়াই অপ্রকাশিত থাকে চিরকাল।
তাই রোজ রাতে, ফেসবুকের দেয়াল হতে গল্প গিলি আমরা,
আর প্রতি ভোরে জেগে উঠি সব ভুলে,
নতুন গল্পের খোঁজে।

অলংকরণ : নীলাদ্রি ভট্টাচার্য্য
মূল ছবি : কোয়াঙ হো শিন

দহন

বিশ্বজিৎ সাহু


নির্জীব কেটে যায় শীতল রাত; তারাদের পড়ন্ত আলোয়
বছর বছর ধরে ঠান্ডা বিছানার বয়স বাড়ে শ্রান্ত মোহনায়।
মনের মোম গড়তে আবশ্যিক জল আগুনের ভাবসম্মিলন
এখানে চাতকের প্রশ্ন বেমানান বৃষ্টি অফুরান থাকে যদি

যদি হাড়মাস কালি করে রাত্রি নামে অকাল, মৃত মন তবু
শরীর একটু গরম হলেই বুক ঠেলে আগুয়ান ফোটে তৃষ্ণা
অশরীরী পথে আগুন ছড়িয়ে আলো পেতে মরিয়া দৃঢ়তা
মত্তমিলনে আলগোছ জেনেও পোড়ার নিমন্ত্রণ সরাসরি

দহনের দুঃখ সবাই জানে, সুখের হাতছানিও নতুন নয়
শুধু প্রলাপ যদি না হয় তবে পুড়তে ভালোবাসেনা কে...

অলংকরণ : প্রমিত নন্দী
মূল ছবি : প্যাট্রিসিয়া কুইঞ্চ

চার্লস ডেক্সটার ওয়ার্ড এর আজব কাহিনী ১


এইচ পি লভক্রফট


“প্রানীদেহাংশের সারবস্তু থেকে এমন এক বিশেষ ধুলো এতো ভালোভাবে প্রস্তুত এবং সংরক্ষণ করা যেতে পারে, যার সাহায্যে যেকোনো একজন বুদ্ধিমান শিক্ষিত মানুষ তার নিজের পরীক্ষাগারে চাইলেই নোয়ার নৌকাতে যত জীবজন্তু ছিল সবকিছুকেই বানিয়ে নিতে পারে। পছন্দের যে কোনো পশুপাখীর আকৃতি নিখুঁতরূপে নির্মাণ করাটা কোনো ব্যাপারই না। আর ঠিক এভাবেই মানুষের দেহাংশের ধুলো থেকে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি কোনোরকম অপরাধমূলক প্রেত চর্চা না করেও তার মৃত পূর্বপুরুষের আকৃতি পুনঃনির্মাণ করতে পারে। মোদ্দা কথা মানব দেহাংশের ধুলো থেকে নতুন মানুষের সৃষ্টি করা সম্ভব।” —বোরিলাস


প্রথম অধ্যায়
ফলাফল এবং প্রাক কথন

প্রথম অধ্যায় – ১ম পর্ব

প্রভিডেন্স, রোড আইল্যান্ডের কাছে এক প্রাইভেট হাসপাতাল আছে। মূলত পাগলদের চিকিৎসা হয়। সেখানে থেকে একজন পালিয়ে গেছে। নাম চার্লস ডেক্সটার ওয়ার্ড। ওকে ওখানে ভর্তি করে দিয়ে গিয়েছিলেন ওর বাবা। দেখেই বোঝা গিয়েছিল এই কাজটা করার ফলে মানুষটিকে অসহনীয় দুঃখ একেবারে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল। কিন্তু করারও কিছুই ছিল না। কারণ তার ছেলে এক অদ্ভুত রকমের পাগল। আর সে পাগলামোর মাত্রা এতোটাই বেড়ে গিয়েছিল... এতোটাই অন্ধকার রহস্যময় জগতের পথে হাঁটা দিয়েছিল যে চার্লসের মধ্যে ক্রমশ এক খুনীর প্রবণতা জন্ম নিচ্ছিল বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে এক হিসাবকিতাববিহীন অদ্ভুত পরিবর্তন ছেলেটির চরিত্রে ছায়াপাত করছিল। ডাক্তাররাও স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে তারাও চার্লসের অন্ধকারাচ্ছন্ন মনের দিকটাকে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছেন না। স্পষ্টতই বিব্রত বোধ করছিলেন ওরা। ওদের মতে একইসাথে ওর ঘটনাটি ছিল শারীরবৃত্তীয় এবং মনস্তাত্ত্বিক ব্যতিক্রমের এক চুড়ান্ত নিদর্শন।

সবার আগেই চার্লসের বিষয়ে যা বলা প্রয়োজন তা হলো ওর বাহ্যিক শারীরিক কাঠামোর অদ্ভুত দিকটা। বয়স ছাব্বিশ কিন্তু দেখে বিস্ময়করভাবে মনে হতো অনেক অনেক বেশি বয়সের মানুষ সে।। এটা ঠিক যে মানসিক বিপর্যয় অনেক সময়েই মানুষের মুখে চোখে দ্রুত বয়স বেড়ে যাওয়ার ছাপ ফেলে দেয়। কিন্তু এই যুবকটির মুখমণ্ডল এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যা সত্যি সত্যিই ভালো মতো বয়স না হলে দেখতে পাওয়া যায় না।

দ্বিতীয় ব্যাপার হলো, চার্লসের শারীরিক জৈব প্রক্রিয়ায় সাহায্যকারী নানান অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অদ্ভুত আচরণ। যা চিকিৎসাজগতের সমস্ত অভিজ্ঞতাকে বানচাল করে দিয়েছিল। শ্বাসপ্রশ্বাস এবং হৃদস্পন্দনের মধ্যে ছিল সমঝোতার অভাব। জোরে শব্দ করে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে গিয়েছিল। কেবলমাত্র কিছু ফিসফিসে শব্দ করতে সক্ষম ছিল চার্লস। খাবার হজম করতে অবিশ্বাস্যরকম বেশী সময় লাগতো। সাথে সাথেই হজম করার ক্ষমতাও কমে গিয়েছিল। যেকোনো বিষয়ে স্নায়বিকউদ্দীপনাগত যে প্রতিক্রিয়া একজন সাধারন মানুষ দেখায় সেটাও ঠিকমতো কাজ করছিল না ওর ক্ষেত্রে। গায়ের চামড়া হয়ে গিয়েছিল শীতল এবং শুষ্ক। মরা শরীরের মতো। টিস্যুর অভ্যন্তরস্থ কোষগুলো যেন অতিরিক্ত পরিমাণে রুক্ষ হয়ে গিয়েছিল। সাথেই ওদের ভেতরে যে নিয়মমাফিক বন্ধন থাকে তাও বোধহয় ঢিলে হয়ে গিয়েছিল। চমকপ্রদভাবে ডান পাছায় বড়সড় জলপাই রঙের জড়ুল চিহ্নটা বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। উল্টে বুকের উপর এক অদ্ভুত কালো আঁচিল জন্ম নেয়। যেটা এর আগে মোটেই ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই, সমস্ত চিকিত্সকরা একমত হন যে চার্লসের মেটাবলিজম প্রক্রিয়া এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যা ইতিপূর্বে কোথাও কখনো দেখা যায়নি।

মানসিকভাবেও চার্লস ওয়ার্ড ছিল অনন্য। তাঁর পাগলামির মাত্রা এমন এক পর্যায়ের ছিল যা এর আগে অবধি অনেক চিন্তা ভাবনা বিবেচনার সাথে লেখা বইগুলির মধ্যেও কোথাও কোনোদিন কেউ লিপিবদ্ধ করেনি। চার্লস এমনই এক উচ্চমাত্রার মানসিক শক্তির অধিকারী ছিল যে পাগলামোর কারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হলে একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি বা একজন বড়সড় নেতা হওয়া থেকে কেউ ওকে আটকাতে পারত না। কিন্তু মানসিকতার বিকৃতি সব কিছুকে ঢেকে দিয়ে ভীতিকর কিম্ভুত রূপে পরিণত করে ওকে। ওয়ার্ডের পারিবারিক চিকিত্সক ডঃ উইলেট বলেন, চার্লসের মানসিক ক্ষমতা পাগল হওয়ার আগের তুলনায় নাকি অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে। এটা সত্যি যে চার্লস চিরকালই একজন পণ্ডিত গোছের মানুষ এবং পুরাতত্ববিদ। শেষ পরীক্ষার সময় তার লেখায় যে অসাধারণ উপলব্ধি এবং অন্তর্দৃষ্টি প্রদর্শিত হয়েছিল। যার ছাপ অবশ্য প্রারম্ভিক কাজের ভেতরে দেখতে না পাওয়া গেলেও চার্লসের বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে কোন সন্দেহই ছিল না কারোর। যে কারণে আইনগত ভাবে এরকম একটি মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করা নিয়ে কর্মকর্তারা একটু চিন্তাতেই পড়েছিলেন। শুধুমাত্র অন্যদের সাক্ষ্য প্রমাণ এবং তার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার প্রেক্ষিতে নানান অস্বাভাবিক আচরণ অবশেষে তাকে ওই উন্মাদ হাসপাতালে ভর্তি করানোর বাধা দূর করে। পালিয়ে যাওয়ার আগে অবধি তার বিষয়ে বলা যায় মানুষটা ছিল এক গোগ্রাসী পাঠক। কথা বলার অক্ষমতা সত্ত্বেও যে সমস্ত চিত্তাকর্ষক কথাবার্তা চার্লস বলতো তাতে যারা তাকে দিনের পর দিন দেখেছে তারা বলেছিল এরকম একটা মানুষকে বেশিদিন এখানে আটকে রাখা যাবে না।

কিন্তু ডঃ উইলেট, যিনি চার্লসকে এই জগতের আলো দেখিয়েছিলেন. তিনি একটু একটু করে দেখেছেন চার্লসের শরীর ও মনের অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি। সেই চার্লস এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে ভবিষ্যতে কি করে বসবে সে চিন্তায় ভীত হয়ে ছিলেন। আসলে এমন এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার উনি সাক্ষী, এমন এক ভয়ঙ্কর তথ্য উনি জানেন যা সন্দেহপ্রবণ সহকর্মীদের কাছে প্রকাশ করার সাহস তার হয়নি। আর ভেঙে যদি বলা হয় ডঃ উইলেট নিজেই এক ছোটখাট রহস্যময় চরিত্র এই কাহিনীর ভেতরে তাও মিথ্যে বলা হবে না। পালিয়ে যাওয়ার আগে ডঃ উইলেট একমাত্র মানুষ যিনি রোগীর সাথে শেষ বারের মতো দেখা করেছিলেন। এর ঠিক তিন ঘণ্টা বাদে চার্লস অদৃশ্য হয়ে যায়। যারা তাকে চার্লসের সাথে দেখা করে আসার পর ফিরে আসতে দেখেছিল তাদের কথানুযায়ী ডঃ উইলেটের মুখে একই সাথে আতঙ্ক এবং স্বস্তির ছাপ মিশে ছিল।

ডঃ ওয়েটের হাসপাতাল থেকে চার্লসের এই পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ছিল অপ্রত্যাশিত এবং অমীমাংসিত বিস্ময়কর ঘটনার মধ্যে অন্যতম। চার্লসকে যে ঘরে রাখা হয়েছিল সেই ঘরের জানলাটির অবস্থান ষাট ফুট ওপরে। সেটা খোলাই ছিল। কিন্তু ডঃ উইলেটের সাথে কথা বলার পর যুবকটির পলায়ন পর্ব বিষয়ে সেটা কোনও সমাধান ব্যাখ্যা করতে পারে না। মানুষকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করে বলার মতো কিছু সহজ তথ্য উইলেটের নিজের কাছেও ছিল না। যদিও মানুষের কথা অনুসারে আশ্চর্যজনক ভাবে চার্লসের পালিয়ে যাওয়ার আগের সময়ের তুলনায় পালিয়ে যাওয়ার পরে নাকি ডঃ উইলেটকে অনেক বেশী শান্ত দেখাচ্ছিল। অনেক মানুষ এটাও মনে করে যে প্রকৃতপক্ষে উইলেট আরো অনেক বেশি কিছু বলতে পারেন কিন্তু বলছেন না। হয়তো মনে করছেন মানুষ তার কথা বিশ্বাস করবেনা। উনি চার্লসকে তার ঘরের মধ্যেই দেখেছিলেন। তার প্রস্থানের কিছু সময় বাদে হাসপাতালের অ্যাটেন্ড্যান্টরা আর চার্লসের কোনো সাড়া শব্দ পায়নি অনেকক্ষণ ধরে। বার বার ডাকার পরেও যখন চার্লস কোনো সাড়া দিলো না তখন ওরা জোর জবরদস্তি করে দরজা খোলে এবং দেখে চার্লস ঘরের ভেতরে নেই। খোলা জানলাটা দিয়ে এপ্রিল মাসের ঠাণ্ডা বাতাস এসে ওদের ধাক্কা মারে। যে হাওয়ার ধাক্কায় ওরা দেখেছিল ঘরের ভেতর সূক্ষ্ম ধূসরনীল ধূলিকণার একটা মেঘ যেন ভাসছে। ওদের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল ওই ধুলোর ভেতরে। ওই ঘটনার কিছু সময় আগে নাকি কুকুরদের বেদম কান্নার শব্দে চারদিক মথিত হয়েছিল । সে সময় অবশ্য ঘরের ভেতরে ডঃ উইলেট ছিলেন। যদিও কুকুরগুলো কাউকে তেড়েও যায়নি বা কামড়ায় নি। যেমন হঠাৎ করেই করুণ চিৎকার শুরু করে আকাশ বাতাস মাতিয়ে দিয়েছিল ঠিক তেমন ভাবেই হঠাৎ করেই থেমে যায়।

ব্যাপারটা চার্লসের বাবাকে টেলিফোন করে জানানো হলো। কিন্তু বিস্মিত হওয়ার চেয়ে ওনার কথা বলার সুরে মিশে ছিল দুঃখবোধ। ইতিমধ্যে ডঃ ওয়েট, ডঃ উইলেটকে ডেকে পাঠান ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করার জন্য। দুজনেই এবিষয়ে একমত হলেন যে ঘটনাটা কি ভাবে ঘটেছে সে বিষয়ে তাদের কোনো ধারনা নেই। শুধু উইলেটের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সিনিয়র মিঃ ওয়ার্ডের কাছ থেকে কিছু সূত্র পাওয়া গেলেও সেগুলো সাধারণ বিশ্বাসের পক্ষে এতোটাই উদ্ভট রকমের যে সেসব নিয়ে আলোচনা হলোই না। বর্তমান সময় অবধি কেবলমাত্র একটা কথাই এবিষয়ে বলা যায় যে পালিয়ে যাওয়া বা অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পাগল ব্যক্তিটির আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

চার্লস ওয়ার্ড ছোটোবেলা থেকেই প্রাচীন জিনিষপত্র নেড়ে ঘেঁটে দেখতে ভালোবাসতো। ও যে শহরে বাস করতো সেই শহরটাও ছিল প্রাচীন। প্রস্পেক্ট স্ট্রীটের ওপর স্থিত পাহাড়ের গায়ে পৈত্রিক বাড়িটাও ছিল ততোধিক পুরোনো। সন্দেহের অবকাশ নেই যে এরকম একটা শহরে নানা রকম অতীতের নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। বছরের পর বছর এই সব প্রাচীন জিনিসগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে এসবের প্রতি তাঁর আগ্রহ ক্রমশই বৃদ্ধি পায়। যাতে ইন্ধন যোগায় ইতিহাস, বংশানুক্রমিকতা এবং ঔপনিবেশিক স্থাপত্য, নানান আসবাবপত্র এবং কারিগরি বিষয়ক দক্ষতার সম্পর্ক যুক্ত নানা পুস্তকের অধ্যয়ন। এই সব বিষয়গত চেতনা তার উন্মাদনার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নেয় বলেই মনে করা হয়। যদিও এগুলো সেই অর্থে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে নি। কিন্তু অপ্রত্যক্ষ ভাবে চার্লসের অবচেতনায় একটি বিশিষ্ট ভুমিকা পালন করে। লক্ষ্যনীয় বিষয় এটাই যে চার্লস তার সময়ের আধুনিক বিষয়ের তথ্য সেভাবে যেন জানতো না বলেই মনে করেছেন এক সময় তার পরীক্ষকেরা। অথচ বহির্বিশ্বের নানান গোপন জ্ঞান এবং আক্ষরিক অর্থেই প্রাচীন দিনের প্রায় সমস্ত জ্ঞান তার মাথায় যেন সঞ্চিত ছিল । অথচ সেই সব বিষয়ে কথা বলার আগ্রহ তার ছিলনা। একমাত্র ধৈর্য ধরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে গেলে এক আচ্ছন্নতার ঘোরে আবিষ্ট হয়ে অতীতের বিভিন্ন জ্ঞান গর্ভ তথ্য বলে যেত সে।

অদ্ভুত ব্যাপার এটাই যে যে প্রত্নতত্ববিদ্যা ছিল চার্লসের প্রিয় বিষয় সেটার প্রতি ওর আগ্রহ কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল এসব বিষয়ে সে এতো জেনে গেছে যে আর এ নিয়ে ভাবতে চায় না। এখন সে আধুনিক বিশ্বের খুচখাচ সব ধরনের সাধারণ ঘটনাগুলিকে বুঝে নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আধুনিক জগতের সব জ্ঞান এবার সে পান করতে চায় এক গন্ডুষে। তার মাথা থেকে যে বর্তমান সময়ের জ্ঞান কোন এক অজানা কারণে যেন মুছে গেছে। আর সেটাই সে যেন ঢেকে রাখার চেষ্টা করতো। তার এই পাগলসম জ্ঞান আহরণের প্রচেষ্টা সকলের চোখেই ধরা পড়তো। ১৯০২ সালে জন্মেছিল চার্লস। তার পরবর্তী ছাব্বিশ বছরের পটভুমিতে বিংশ শতাব্দীর এক জন মানুষ যা যা জানতে সক্ষম সে সব কিছু জেনে বুঝে নেওয়ার এক অসম প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল সে। এমনকি সে সময় স্কুলে কি শেখানো হয়েছিল সেটা জানার আগ্রহ ও তার কম ছিল না কিছুমাত্র। এইসূত্রেই যারা চার্লসের ঘটনা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছিলেন সেই বিশেষজ্ঞদের সামনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল, বাস্তব জগতের সঠিক জ্ঞান ছাড়া কি ভাবে ওই পালিয়ে যাওয়া রোগী আজকের জটিল জগতের সাথে মোকাবিলা করবে? আর এর থেকেই একটা ধারনা করে নেওয়া হয় আসলে চার্লস লুকিয়ে আছে। বর্তমানের সমস্ত তথ্যাদিসংগ্রহ না করে সে জনসমক্ষে দেখা দেবে না।

চার্লস ওয়ার্ডের পাগলামির ঠিক কবে শুরু হয়েছিল এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে ঐক্যমত্য নেই। বোস্টনের ডঃ লাইম্যানের মতে এর শুরু হয়েছিল ১৯১৯-১৯২০ সালে। সে সময়টা ছিল ওর মোসেস ব্রাউন স্কুলের শেষ বছর। হঠাৎ করেই চার্লস অতীত নিয়ে পড়াশোনা করা বন্ধ করে দিয়ে অকাল্ট বা অপ-রসায়ন নিয়ে মেতে ওঠে। এর জন্য সে কলেজের আর পড়াশোনা করতেও চায়নি। যুক্তি হিসাবে জানায় ওই শিক্ষার চেয়েও বড় কিছু নিয়ে ও এবার নাকি গবেষনা করছে। এই সময় থেকেই চার্লসের হাবভাবের প্রভুত পরিবর্তন দেখা যেতে থাকে। ১৭৭১ সালে একটি কবর খুঁড়ে ওঠানো হয়েছিল। সেটার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য শহরের আনাচে কানাচের কবরখানায় সে ছুটে বেড়ায়। কবরটা ছিল ওর এক পূর্ব পুরুষের। নাম জোসেফ কারওয়েন। ওই মানুষটার লেখা বেশ কিছু কাগজপত্র স্ট্যাম্পস হিলের ওলনি কোর্টের একটি পুরনো বাড়ির প্যানেলের পিছনে চার্লস খুঁজে পেয়েছিল বলে দাবি করেছিল। ওই বাড়ীটা কারওয়েন নির্মাণ করেছিলেন এবং বসবাস করতেন। ১৯২০ সালের শীতকালে ওয়ার্ডের চালচলনে যে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা যায় এটা সকলেই মেনে নেয়। যার কারণেই সে অকস্মাৎ তার সাধারণ পুরাতাত্ত্বিক কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে দেশে এবং বিদেশে অকাল্ট বিদ্যার গোপন বিষয় নিয়ে পাগলের মতো অনুসন্ধান চালাতে থাকে। সাথেই বজায় ছিল তার অতি বৃদ্ধ পূর্বপুরুষের কবরের অন্বেষণ।

উপরিউক্ত ওই চিন্তাভাবনার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেন ডঃ উইলেট। রোগীকে উনি দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন এবং নজর রেখেছিলেন যে কারণেই শেষের দিকে তিনি বেশ কিছু শিহরণ উদ্রেককারী খোঁজ চালিয়ে অনেক তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন। ওই সব খোঁজ আর তার ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য স্বয়ং ডাক্তারের ওপরে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। এবিষয়ে কথা বলতে গেলেই ওনার কণ্ঠস্বর কেঁপে কেঁপে উঠতো। যখন ভাবতেন এসব বিষয়ে লিখবেন হাতের কাঁপুনি থামতেই চাইতো না। উইলেট স্বীকার করেন যে ১৯১৯-২০ সালে যে মানসিক পরিবর্তনের সূচনা চার্লসের আচরণে হয়েছিল তা ১৯২৮ সালে এসে চরম রুপ নেয়। যার ফল হয় ভয়ঙ্কর...অপ্রাকৃত। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে উনি বিশ্বাস করেন যে বিষয়টিকে একটু আলাদাভাবেও দেখা প্রয়োজন। এটা উনি মেনে নেন যে ছেলেটি প্রথম থেকেই মানসিকভাবে সবসময় সামঞ্জস্যহীনতায় ভুগতো। যেকোনো বিষয়েই তার প্রতিক্রিয়া ছিল আনুপাতিকভাবে সন্দেহজনক এবং সাথে সাথেই অতিরিক্ত পরিমাণে উত্সাহী ছিল আশেপাশের ঘটে যাওয়া নানান অদ্ভুত ঘটনা নিয়ে চর্চা করার ব্যাপারে। কিন্তু উইলেট এটা স্বীকার করতে অস্বীকার করেন ওই সব কারণ থেকেই বর্তমান উন্মাদনার মূল পথটি খুলে যায়। এর প্রমান স্বরূপ উনি ওয়ার্ডের নিজস্ব মতামতের কথা জানান। চার্লস নাকি ওকে বলেছিল, সে এমন কিছু আবিষ্কার করেছে বা পুনরায় আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে যার কথা জানতে পারলে মানুষের আজ অবধি জানা সব সত্য উলট পালট হয়ে যাবে।

উনি নিশ্চিত ভাবে বিশ্বাস করেন প্রকৃতপক্ষে চার্লসের পাগলামি শুরু হয় আরো কিছু সময় বাদে। যখন সে কারওয়েনের প্রতিকৃতি এবং প্রাচীন কাগজপত্রগুলো খুঁজে পায়, তারপর থেকে। অজ্ঞাত কিছু বিদেশী অঞ্চল চার্লস ভ্রমণ করে... কিছু ভয়ানক অদ্ভুত আচার প্রথা পালন করে ... উচ্চারণ করে অজানা শক্তি আহরণের মন্ত্রাদি। এসব করার ফলে যে অভিজ্ঞতা তার হয় সেসব বিষয় নিয়ে অতি গোপনীয় পরিস্থিতিতে উন্মাদনাগ্রস্ত অবস্থায় সে এক চিঠি লিখেছিল। এসবের সাথেই সে সময়ে শোনা গিয়েছিল বেশ কিছু ভ্যাম্পায়ার জনিত আক্রমণের কথা এবং অশুভ লক্ষণ যুক্ত নানান পটুয়েক্সট গুজব। এই সময় থেকেই তার রোগীর স্মৃতি বিভ্রাট হতে শুরু করে। কমে যেতে থাকে কথা বলার ক্ষমতা। সাথেই সারা দেহ জুড়ে শুরু হয় নানান শারীরিক সূক্ষ্ম পরিবর্তন।

এই সময় থেকেই যে চার্লসের দুঃস্বপ্ন দেখার সূচনাও হয় সেটা ডঃ উইলেট নিশ্চিত ভাবে জানান। চার্লস ওয়ার্ড যে অদ্ভুত রকমের কিছু একটা আবিষ্কার করেছিল সেটার সুনিশ্চিত প্রমাণ বিদ্যমান এটা বুঝতে পেরে ডাক্তার মনে মনে ঠকঠকিয়ে কেঁপে উঠেছিলেন। প্রথমত, উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন দু’জন মানুষ জোসেফ কারওয়েনের প্রাচীন কাগজপত্র যে সত্যিই পাওয়া গিয়েছিল সেটা নিজের চোখে দেখে ছিলেন। দ্বিতীয়ত, চার্লস নিজেই একবার ডঃ উইলেটকে সেই কাগজপত্রগুলো এবং কারওয়েনের লেখা ডায়েরির একটি পৃষ্ঠা দেখিয়েছিল। সেই সব কাগজপত্রর ভেতরে কোনো কারচুপি ছিল না। যে গর্তের ভেতর থেকে ওই কাগজপত্র পাওয়া গিয়েছিল বলে সেটারও বাস্তবে অস্তিত্ব ছিল। উইলেট সেসব এমন অবস্থায় দেখেছিলেন যা বিশ্বাস করার পক্ষে নাকি বেশ কঠিন। প্রমাণ করাতো দূরের কথা কোনোমতেই নাকি সম্ভব নয়।

এর সাথেই ছিল অরনে এবং হাচিনসন এর রহস্যময় এবং প্রায় কাকতালীয় ভাবে প্রাপ্ত চিঠিগুলো। জোসেফ কারওয়েনের দুর্বোধ্য লেখনী সমস্যার সমাধান করে গোয়েন্দারা ডক্টর অ্যালেন সম্পর্কে জানতে পারেন। এই সব জিনিসগুলো এবং মধ্যযুগীয় হস্তাক্ষরে লেখা এক চিরকুট পাওয়া যায় উইলেটের পকেটে। চরম হাড় কাঁপানো অভিজ্ঞতা লাভের পরে চেতনা ফিরে এলে তিনি বুঝতে পারেন ওই সব জিনিষগুলো কোন এক অজ্ঞাত পথে ওর পকেটে চলে এসেছে।

এছাড়াও ছিল দুটো অবিশ্বাস্য রকমের জঘন্য ফলাফলের প্রমাণ। শেষ বারের মতো খোঁজ খবর করার সময় ডাক্তার খুঁজে পেয়েছিলেন এক জোড়া ফর্মুলা। সেই ফরমুলার ভিত্তিতে পরীক্ষা চালিয়ে যে ফলাফল লাভ হয় তা প্রমাণ করে চার্লস কথিত কাগজপত্রর সত্যতা এবং সেসবের গায়ের লোমখাড়া করে দেওয়া প্রয়োগ পদ্ধতির কথা। একই সাথে এটাও বুঝিয়ে দেয় যে এসব কাগজপত্রর বিষয়বস্তু মানুষের চিরাচরিত জ্ঞানসীমা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে।

প্রথম অধ্যায় – ২য় পর্ব

যে সময় চার্লস ওয়ার্ড প্রাচীন জিনিষপত্র এবং পুরাতত্ব নিয়ে মেতে ছিল সেই জীবনটার দিকে একটু ফিরে দেখা দরকার। ১৯১৮ সালের শরত্কাল, সেই সময়টায় সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার এক হুজুগ শুরু হয়েছিল। এই সময়েই চার্লস, মোজেস ব্রাউন স্কুলে তার জুনিয়র শিক্ষার বছর শুরু করে। স্কুলটা ওদের বাড়ির খুব কাছেই ছিল। ১৮১৯ সালে স্কুলের পুরানো প্রধান ভবনটির নির্মাণ করা হয়। সদ্য সদ্য পুরাতাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে মেতে যাওয়া চার্লসের মনে এই ভবন এক আলাদা অনুভূতির জন্ম দিতো। একাডেমী ভবনটির সাথে সংযুক্ত প্রশস্ত উদ্যান তার চোখকে দিতো এক স্বপ্নময় জগতের খোঁজ। আশেপাশের জগতের সাথে খুব একটা পরিচয় ছিল না ওর। বেশীরভাগ সময় কেটে যেত ঘরের ভেতরে। তার হাঁটাচলা সীমাবদ্ধ ছিল নিজের ক্লাস এবং ড্রিলস করার মাঠ, সিটি হল, স্টেট হাউস, পাবলিক লাইব্রেরী, অ্যাথেনিয়াম, হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি, ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন কার্টারব্রাউন অ্যান্ড জন হে লাইব্রেরীএবং বেনিফিট স্ট্রিটে সদ্য উদ্বোধন হওয়া শেপ্লে লাইব্রেরির এলাকায়। পুরাতাত্ত্বিক ও বংশগত তথ্য খোঁজার কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রাখতো চার্লস। এই সময়ে চার্লসের একটা ছবি যদি পাওয়া যায় তাহলে দেখতে পাওয়া যাবে লম্বা, পাতলা, সোনালী চুল, অধ্যয়নশীল চোখ এবং সামান্য জুবুথুবু ধরনের একটি ছেলেকে। পোশাক আশাক বিষয়ে কোন যত্ন নেই। দেখলে মনে হতো অজ্ঞানতারই যেন এক প্রতিমূর্তি। আকর্ষণীয় বলতে কিছুই নেই।

চার্লস নিজের মনেই এই পুরানো শহরের এক গৌরবময় ছবি কল্পনা করে নিয়েছিল। পুরাতত্বের খোঁজ চালাতে চালাতে সে আসলে এক অভিযান করতো সেই শতাব্দী প্রাচীন শহরে। শহরে বুক চিরে প্রবাহিত নদীটির পূর্বদিকে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত ওর নিজের বাসভবনটা ছিল একটি চমৎকার জর্জিয়ান প্রাসাদসম। সেই বাড়ির পিছনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে সে দূরবর্তী সন্নিহিত অঞ্চলের নিচু শহরগুলোর গম্বুজ, উঁচু নিচু ছাদ, বড় বড় তোরণ এবং বেগুনি পাহাড়ের ঝাপসা হয়ে থাকা দৃশ্য দেখতো এক মনে। এখানেই তার জন্ম। তার দেখাশোনা করতো যে আয়াটি সেই প্রথম ওকে গাড়ীতে চাপিয়ে এই সব দৃশ্য দেখিয়েছিল। এই শহর আক্রমণকারীরা দখল করে নেওয়ার অন্তত দুই শতাব্দী আগে নির্মিত ছোটো সাদা রঙের ফার্ম হাঊসের পাশ কাটিয়ে বেড়াতে যেত চার্লস। ছায়াময় রাস্তার এদিকে ওদিকে দেখা যেত পুরনোদিনের বর্গাকৃতি ইঁটের ঘর এবং সংকীর্ণ কাঠের কাঠামোগুলিকে যাদের সাথে যুক্ত ছিল ভারী-কলমযুক্ত ডোরিক বারান্দা। মাঝে মাঝেই খোলা উদ্যান এবং বাগান চার্লসকে নিয়ে যেত এক স্বপ্নের জগতে।

পাহাড় থেকে এক ধাপ নিচে নেমে এসে চার্লস পৌঁছে যেতো প্রায় ঘুমন্ত কংডন স্ট্রীটে। যে রাস্তার পূর্ব দিকে ছিল এলাকার সমস্ত ঘরবাড়ি। এখান কার প্রায় সব ছোট ছোট কাঠের বাড়ীই বয়সে প্রাচীন। কারণ এটাই ছিল এই পাহাড়ে ক্রমবর্ধমান শহর জন্ম নেওয়ার প্রাথমিক সূচনা স্থান। এখানে ঘুরে বেড়ানোর সময় চার্লস আদিম ঔপনিবেশিক গ্রামের অস্তিত্ব টের পেতো। এখানে আসার পর নার্সরা একটু বিশ্রাম নিত। প্রসপেক্ট স্ট্রীটের বেঞ্চে বসে ওরা ওখানকার পুলিশদের সাথে গল্প করতো। এসব এলাকার প্রথম স্মৃতিগুলির মধ্যে একটি ছবি চার্লসের মনে গেঁথে বসে গিয়েছিল। এক শীতকালীন বিকালে পশ্চিমাঞ্চলের সমুদ্রের ছবি। যার সাথে মিশে ছিল ঝাপসা ছাদ, গম্বুজ, টানা বিশাল প্রাচীর এবং দূর পাহাড়ের এক বেগুনী আভাযুক্ত রহস্যময় ঝাপসা দৃশ্য পট। সে দৃশ্যকে আরো বিস্ময়কর করে দিয়েছিল অস্তগামী সূর্যের লাল ও সোনালী আলো এবং উদ্দীপ্ত এক সবুজের বিস্তার। এই প্রেক্ষাপটের স্টেটহাউসের বিশাল মার্বেল গম্বুজটি সিলুয়েট হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওটার একেবারে ওপরে অবস্থিত মুকুট মূর্তিটি উজ্জ্বল রক্তাভ ছুঁয়ে মেঘেদের মাঝখানে নিজের অস্তিত্ব জাহির করছিল স্বমহিমায়।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে শুরু হয় তার চিরপরিচিত বিশেষ পদচারনা। প্রথম প্রথম তার সঙ্গে নার্সকে যেতে হতো। পরবর্তী সময়ে স্বপ্ন মাখা এক ধ্যানের ঘোরে একাই হেঁটে বেড়াতো সে। দূর থেকে দূরবর্তী পাহাড়ের গলিঘুঁজিতেপড়ে থাকা প্রাচীন শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতো চার্লস। সামান্য দ্বিধা না করেই খাড়া জেনেক্স স্ট্রিটের পথ ধরে ব্যাংকের দেয়াল এবং ঔপনিবেশিক বাড়িঘরের পাশ দিয়ে নেমে যেত ছায়ায় ঢাকা বেনিফিট স্ট্রিটে। ওখানেইছিল এক কাঠের বাড়ি যার দরজাটা ছিল অতীবসুন্দর কারুকাজের এক নিদর্শন। তার ঠিক পাশেই এক অতি প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক ছাদের খামারবাড়ি। জর্জিয়ান ঐতিহ্য গায়ে চাপিয়ে বিখ্যাত বিচারক ডারফির বাড়ীটার ধ্বংসাবশেষও ছিল এখানেই। এলাকাটিকে দেখে মনে হতো হত দরিদ্র বস্তির মতো। যদিও বিশাল বিশাল গাছের সারি স্থানটির প্রাচীনত্বর প্রমাণ দিতো নিজেদের ছায়া বিস্তার করে। চার্লস নামের ছেলেটি এই প্রাক-বিপ্লব যুগের বিরাট মাপের বাড়িগুলির পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতো দক্ষিন দিকে। পূর্বদিকে পাথরের ধাপে ধাপে অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছিল শহরটার বিস্তৃতি। চার্লস কল্পনার চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করতো সেই সময়ের ছবি যখন সদ্য এই সব রাস্তা তৈরি হয়েছিল। বাড়ীর দোতলায় অবস্থিত তেকোনা রঙ্গীন বারান্দায় দাঁড়য়ে থাকা মানুষদের পোশাক আশাক, লাল রঙের জুতো বা পরচুলাগুলোকেও কল্পনার দৃষ্টিতে স্পষ্ট দেখতে পেতো চার্লস।

পশ্চিম প্রান্তের পাহাড়টি প্রায় খাড়া নেমে গিয়েছিল পুরনো ‘টাউন স্ট্রিট’-এ। যা নির্মিত হয়েছিল ১৬৩৬ সালে নদী প্রান্ত ধরে। এই রাস্তার গা থেকে জন্ম নিয়েছিল অগণিত ছোটো ছোটো রাস্তা। সেই সময়ের অসংখ্য বাড়ীতে পরিপূর্ণ ছিল এলাকাটি। প্রাচীনতায় ভরপুর হয়ে থাকা এই অঞ্চল একই সাথে চার্লসকে যেমন মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করতো. সাথে সাথেই এক অজানা অজ্ঞাতআতঙ্ক ময়স্বপ্ন জগতের দ্বার উন্মোচিত হতে পারে এমন আশঙ্কাতেও শিহরিত করে রাখতো। সে হেঁটে যেত বেনিফিট স্ট্রীটের সেই এলাকা দিয়ে যার একপাশে ছিল সেন্ট জন এর লুকানো গির্জা অভ্যন্তরস্থ কবরখানার লোহার রেলিং। দেখা যেত ১৭৬১ সালে নির্মিত কলোনি হাউসের পিছনের দিকটা এবং ভেঙে চুরে পড়ে থাকা গোল্ডেন বল ইন এর শেষ চিহ্নাদি। মিটিং স্ট্রিটের কোনো এক সময়ের গাওল লেন এবং কিং স্ট্রিটের পূর্ব দিকে তাকালে দেখতে পেতো ক্রমশই ওপরের দিকে ধাপে ধাপে উঠে গেছে পুরাতন হাইওয়ে। আর পশ্চিমে নিচের দিকে দাঁড়িয়ে ছিল ইঁটের তৈরী ঔপনিবেশিক স্কুলঘরটি। তার সামনের রাস্তা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়তো শেকসপিয়ারের হাসিখুশি মুখের একটি ছবি। বিপ্লবের আগে ওখানেই প্রভিডেন্স গেজেট এবং কাউন্ট্রি-জার্নাল মুদ্রিত হতো। এর পরেই ছিল ১৭৭৫ সালে নির্মিত প্রথম ব্যাপটিস্ট চার্চ। অনিন্দ্য সুন্দর শিল্প কর্মের এক বিলাসবহুল নিদর্শন। এখান থেকে দক্ষিণ দিকে এগোলে আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট বোঝা যেত। কিন্তু তার মাঝেই এখনও সামান্য প্রাচীন রাস্তাঘাট ওখান থেকে পশ্চিমের দিকে নিচে নেমে গিয়েছে। সে সব রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে যেতে চার্লস দেখতে পেতো ভূতাত্ত্বিক ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করেও টিঁকে আছে ঐতিহ্যময় ইষ্ট ইন্ডিয়া শাসনের নানা চিহ্ন। যেখানে কোন এক সময়ে সুপ্রাচীন জল পথে নানা ভাষাভাষি মানুষের আনাগোনা ছিল। এখনো দেখা যায় সেই বন্দরগাহর ক্ষয়ে যাওয়া রুপ। এখানে ওখানে ঝুলে আছে স্মৃতি উস্কে দেওয়ার মতো সব জাহাজী ঝাড় লণ্ঠন। প্যাকেট, বুলিওন, গোল্ড, সিলভার, কয়েন, ডাবলুন, সোভারিন, গিলডার, ডলার, ডাইম এবং সেন্টের মতো নানা শব্দ আজও যেন ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে বাতাসে এরকমটাই মনে হতো চার্লসের।

সময়ের সাথে সাথে ওয়ার্ড উচ্চতায় যেমন বাড়লো তেমনি বাড়লো তার সাহসের মাত্রা। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর সাথে সাথেই যে ঢুকে পড়তো ভাঙা চোরা ঘরবাড়ীর ভেতরে... ভাঙ্গা জাহাজের অভ্যন্তরে ... উঠে যেত বা নেমে পড়তো ভগ্ন দশাপ্রাপ্ত সিঁড়ির ধাপ ধরে ... গিয়ে দাঁড়াতো ছাদের গায়ে অবস্থিত দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া রেলিং-এ... দেখে বেড়াতো বলিরেখাগ্রস্থ মানুষের মুখ এবং আঘ্রাণ করতো অজ্ঞাত নামহীন সব গন্ধদের যা ভেসে আসতো দক্ষিনের বাতাসে। ঘুরে বেড়াতো সেই সব প্রাচীন বন্দরে যেখানে আজও ছুঁয়ে যায় উপসাগরের জল। ভেসে আসে নানা প্রান্তের জলযান। আবার ফিরেও যায় উত্তরের দিকে। পেছনে ফেলে যায় গ্রেট ব্রীজের বিস্তৃত বর্গক্ষেত্র আকারের এলাকা এবং ঢালু ছাদওয়ালা ১৮১৬ সালের গুদামঘর। ওদের কাছেই দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে ১৭৭৩ সালের মার্কেট হাউস তার প্রাচীন খিলানগুলোকে নিয়ে । গ্রেট ব্রিজের এই বর্গাকার স্থানটিতে দাঁড়িয়ে চার্লস প্রাচীন শহরের বিস্ময়কর সৌন্দর্য পান করতো মন প্রাণ ভরে। দূরে পূর্ব দিকে শহরের গায়ে আপন মহিমায় অবস্থান করতো দুটো জর্জিয়ান ত্রিভুজাকৃতি চুড়া। যার সাথে ছিল সুবিশাল নতুন খৃস্টান সায়েন্সডোম। এ যেন সেন্ট পল লন্ডনকে মুকুট দ্বারা ভূষিত করেছেন। বেশিরভাগ সময়ে বিকেলের শেষ ভাগে এখানে আসতে পছন্দ করতো চার্লস। দিনের শেষ ভাগের তির্যক সূর্যালোক মার্কেট হাউসকে স্পর্শ করতো। সোনালী আভা মেখে আভিজাত্যের সাথে বসে থাকতো প্রাচীন পাহাড়, অট্টালিকার ছাদসমূহ এবং ঘণ্টাঘরগুলো। স্বপ্নের এক ঘূর্ণিঝড় যেন বয়ে যেত এলাকা জুড়ে। এই সেই সময় যখন প্রভিডেন্স বন্দরে ভারতীয় নাবিকেরা অজানা সুর তুলে জলে নামিয়ে দিতো নোঙর। যতক্ষন না চোখে সব কিছু ঝাপসা হতে শুরু করতো চার্লস ওখানেই থাকতো। তারপর ফিরে যেতো বাড়ির দিকে ঢালু পথ ধরে পুরানো সাদা গির্জা পেছনে ফেলে। দূরে অন্ধকারে তখন জানলায় জানলায় ঝিক মিক করে উঠতে শুরু করেছে হলদে আলোর ঝলক। আর উঁচুতে ঘুলঘুলির ফাঁকগুলো দিয়েও মিটমিটে আলোরা তাদের দৃষ্টি মেলছে। সে সব আলোর ছটা অদ্ভুত রকমের সব রট আয়রনের রেলিং-এ প্রতিফলিত হচ্ছে পাহাড়ের নানান ধাপে।

এর পরবর্তী সময়ে এবং পরের বছর গুলোতে চার্লস অজানা অচেনা আরও অনেক কিছুর খোঁজ করে বেরিয়েছে নিজের খেয়ালে। কখনো সে হেঁটে চলে গেছে তার বাড়ির উত্তরপশ্চিমের ভাঙা ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলির মধ্যে, যেখানে পাহাড় নেমে গেছে স্ট্যাম্পার হিলের নীচু এলাকায়। ওখানে যত রাজ্যের নিম্ন শ্রেনীর মানুষের বস্তী এবং নিগ্রোদের বসবাস। বিপ্লবের আগে এখান থেকেও বোস্টন স্টেজ কোচগুলো তাদের যাত্রা শুরু করতো। আবার কখনো সে চলে যেতো দক্ষিণপূর্ব প্রান্তের জর্জ, বেনিভোলেন্ট, পাওয়ার এবং উইলিয়ামস স্ট্রিটের দিকে। যেখানে প্রাচীন ঢালের গায়ে প্রাচীন অট্টালিকার সারি, প্রাচীর ঘেরা বাগান এবং সবুজ ঘাসে রাস্তা অপরিবর্তিত রয়ে গেছে আগের মতোই। অনেক স্মৃতির সুগন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে এই এলাকায়। এই বাধাবন্ধনহীন খামখেয়ালী পদচারনা, তারই সাথে অবশ্যই প্রাচীনকালের সাথে সম্পর্ক যুক্ত বিভিন্ন লোক কথার মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ই সম্ভবত একটা বড় কারণ যা চার্লস ওয়ার্ড এর মন থেকে আধুনিক বিশ্বের খবরাখবরকে মুছে দিয়েছিল। ১৯১৯-২০ সালের শীতকালে চার্লসের মনের মধ্যে প্রাচীন কালের বীজ প্রোথিত হয়ে যায়। আর তার থেকে যে মহীরুহের জন্ম হয় তা বড়ই অদ্ভুত এবং ভয়ানক ফল প্রদান করে । প্রাচীনকালের ধ্বংসাবশেষের প্রভাবে সেও যেন এক প্রাচীন মানুষে পরিণত হয়।

ডঃ উইলেট নিশ্চিত যে, এই অদ্ভুত শীতকালের আগে অবধি চার্লস ওয়ার্ডের প্রত্নতাত্ত্বিকতা বিষয়ে অন্বেষন সব রকম ঊন্মাদনা থেকে মুক্ত ছিল। এর আগে পর্যন্ত ঐতিহাসিক মূল্য ছাড়া কবরস্থানের সেই অর্থে কোন বিশেষ আকর্ষণ ওর কাছে ছিল না কোন রকম হিংস্র বা বর্বর প্রবৃত্তির আচরণের চিহ্ন মাত্র এর আগে কোনও দিন ওর ভেতরে দেখা যায়নি। অথচ ওই শীতকালের পরেই চার্লসের কুত্সিত আচরণের সূচনা হয়। আর এসবই শুরু হয়েছিল এক প্রাচীন পূর্বপুরুষের খোঁজ পাওয়ার পর পরই। তাঁর মায়ের পূর্বপুরুষদের মধ্যে জোসেফ কারওয়েন নামে এক জনের কথা জানতে পারে চার্লস। যিনি এক দীর্ঘজীবী মানুষ ছিলেন। ১৬৯২ সালের মার্চে সালেম থেকে তার আগমন হয়েছিল। মানুষটার সাথেই এসেছিল তার সম্বন্ধে প্রচলিত অনেক অদ্ভুত অবিশ্বাস্য পিলে চমকানো কাহিনী। গুজব না সত্যি তা জানা না থাকলেও মানুষ সে সব নিয়ে প্রায়শই কথা বলতো।

চার্লস ওয়ার্ডের অতি অতি বৃদ্ধ মাতামহ ওয়েলকাম পটার ১৭৮৫ সালে জেমস টিলিংঘাস্ট এবং মিসেস এলিজার কন্যা জনৈকা অ্যান টিলিংঘাস্টকে বিবাহ করেন। যদিও জেমসের পিতৃত্বের কোন প্রমাণ নাকি ছিল না পারিবারিক রেকর্ডে। ১৯১৮ সালের শেষের দিকে শহরের তথ্য নথিভুক্ত করনের এক পাণ্ডুলিপি পরীক্ষা করার সময় তরুণ চার্লস একটি বিষয় আবিষ্কার করে। দেখতে পাওয়া যায় পাণ্ডুলিপির ভেতরে পাওয়া যায় দুটো পাতা ইচ্ছাকৃত ভাবে আঠা দিয়ে আটকে রাখা আছে। শুধু তাই নয় পৃষ্ঠা সংখ্যাও বদলে দেওয়া হয়েছিল সুচতুর ভাবে। সাবধানে তাকে খোলার ব্যবস্থা করে সে। এর থেকে জানা যায় ১৭৭২ সালে একটি আইনসম্মত বৈধ নাম পরিবর্তন করার ঘটনা ঘটেছিল। মিসেস এলিজা কারওয়েন, জোসেফ কারওয়েনের বিধবা স্ত্রী তার সাতবছর বয়সী কন্যা অ্যান, কারওয়েন পদবী ত্যাগ করে টিলিংঘাস্ট পদবী গ্রহণ করছেন। কারণ হিসাবে জানানো হয়েছে যে মিসেস এলিজার স্বামীর নামের সাথে এমন এক অপমানজনক খবর ছড়িয়ে পড়েছে যা তার মৃত্যুর পর জানা গেছে। যা নিশ্চিতভাবেই একটি অদ্ভুত রকমের প্রচলিত গুজব, তবুও এই সন্দেহের সম্পূর্ণভাবে নিরসন না হওয়া পর্যন্ত উনি নিজেকে কারওয়েনের বৈধ স্ত্রী রূপে বিবেচনা করবেন না।

এর সাথে সাথেই চার্লস ওয়ার্ড স্পষ্ট বুঝতে পারে যে সে প্রকৃতপক্ষে তাদের বংশের এমন এক অজানা মানুষের খোঁজ পেয়েছে যে তার অতি অতি বৃদ্ধ মাতামহ। এই আবিষ্কার চার্লসকে দারুন ভাবে উত্তেজিত করে দেয়। কারণ সে ইতিমধ্যেই নানান অস্পষ্ট রহস্যময় কথা বার্তা শুনেছিল এই ব্যক্তিটির সম্পর্কে। মানুষটার সম্পর্কে এত কম তথ্য পাওয়া যায় যে চার্লসের মনে হয় কোন বিশেষ কারণে জনসাধারণের মন থেকে মানুষটার নাম মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যেন এক ষড়যন্ত্র। পুরো বিষয়টার এমন এক চরিত্র উদ্ঘাটিত হয় যেখানে যে কোনও মানুষ একটু কৌতূহলী হয়ে পড়বেই। জানার ইচ্ছে জাগবে কি এমন কারণ ছিল যাতে তৎকালীন উপনিবেশিক নথিকার লেখকেরা একে গোপন করার এবং ভুলে যাবার জন্য এতটাই উদগ্রীব ছিলেন। বা সন্দেহ জাগবে এসব করার পেছনের বৈধ কারণ কি ছিল।

এর আগে অবধি, ওয়ার্ড প্রাচীন কালের মানুষ জোসেফ কারওয়েন বিষয়ে তত গুরুত্ব দিয়ে কিছু ভেবে দেখেনি। কিন্তু যখন জানতে পারলো রোমাঞ্চকর চরিত্রটির সাথে তার একটা সম্পর্ক আছে তখন যেভাবে সম্ভব সেই গোপন ইতিহাস খুঁজে বার করার জন্য মেতে উঠলো। আর এই উত্তেজনাকর প্রচেষ্টায় তার প্রাপ্তির মাত্র হলো দারুন রকমের। পুরাতন চিঠিপত্র, ডায়েরি, এবং অপ্রকাশিত স্মৃতিচারন কাহিনীর নানা সম্ভার সে খুঁজে পেলো মাকড়শার জালে ঢেকে থাকা প্রভিডেন্স এর বেশ কিছু পুরনো চিলেকোঠায় এবং অনেক গোপন স্থানে। যে সব নষ্ট করে দেওয়ার কথা তৎকালীন সময়ে সেগুলো যারা লিখেছিলেন তারা চিন্তা করেননি। আরো এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগৃহীত চার্লস পেয়ে যায় দূরবর্তী নিউ ইয়র্ক এর এক প্রান্তিক এলাকা থেকে। ওখানে ফ্রন্সেস ট্যাভারন এর মিউজিয়ামে রোড আইল্যান্ডের ঔপনিবেশিক যোগাযোগ বিষয়ক কিছু তথ্যাদি সংরক্ষণ করা হয়েছিল। সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, কারণ ডঃ উইলেটের মতানুসারে ওয়ার্ড এখান থেকেই সুনির্দিষ্ট উৎসরূপে জানতে পারে যে ওলনি কোর্টের ভাঙা বাড়িটির প্যানেলের পিছনে কিছু আছে। যা সে খুঁজে বার করে অগাস্ট ১৯১৯ সালে। আর এটাই হয়ে দাঁড়ায় হিসাববিহীন অন্ধকার জগতের রাস্তায় প্রবেশ পথের দিশা।


(ক্রমশঃ)

অলংকরণ : নীলাদ্রি ভট্টাচার্য্য

নিখোঁজ ডায়েরী

অমিত ঠাকুর


চোখের পাতায় যখন ঘুমের ক্লান্তি না থাকে...
না চাইতে কত স্বপ্ন শুধু নিজের মনে আঁকে।
সময় কালের শিকল ভেঙে নিস্তব্ধ বিষণ্নতায়—
সেদিনগুলোয় চুপ থাকার কারণ জানতে চায়।

তার উত্তর আজ প্রতিদিন পথেঘাটে মেলে—
কি হবে আরও দু চার পা অন্ধকারে গেলে...
বাক্স বন্দী অতীত হয়ে মিউজিয়ামে স্থান পেয়ে—
আলতো ঘুমে নেমে আসে আমার দিকে চেয়ে...

মুখের কথা অন্যরকম আর অন্য কথা থাকে মনে,
তার দোহাই দিয়ে নতুন পথে হারিয়ে যায় গোপনে...
যে কথা সেদিন বলার ছিল তা মনেই রয়ে গেল—
সেই কথা না বুঝে নতুন কি আর খুজে পেল?
আজ আছি হয়ত কালও থাকবো শুধু ঠিকানা হারাবে—
কোনোদিন সে কথা বুঝতে পারে আমায় কি আর পাবে!

অলংকরণ : নীলাদ্রি ভট্টাচার্য্য
মূল ছবি : জ্যাকসন পোলক

শতরূপ সান্যালের DIARY ২


দ্বিতীয় পর্ব
ফাঁদ

ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৫; রাত ২টো

ঘটনাটাই এমন না লিখতে পারা অবধি আমার গলাধঃকরণ করা প্রায় মুশকিল হয়ে উঠেছে। অফিস থেকে ফেরার পথে, চক্রবেড়িয়া লেনের বাঁকটা নিতেই কমলকাকুর বাড়ির সামনে অসম্ভব জটলা দেখে অবাক হয়ে গেছিলাম। এ তল্লাটে চুপচাপ, শান্ত মানুষ বলতে তিনিই। পা চালিয়ে একটু দ্রুতই এগিয়ে গেছিলাম। সৌরভ আর মন্টু দাঁড়িয়ে ছিল কিছুটা দূরে। আমার দিকে চোখ পড়তেই ওরা মাথা নিচু করে নেয়। পাশ কাটিয়ে জটলা সরিয়ে এগোতেই দেখি- দুটো লোক ধরাধরি করে, কাপড়ে মোড়া একটা মানুষকে এম্বুলেন্সে তুলছে। অসম্ভব উৎকণ্ঠায় সদর দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকি। কাকু মাথায় হাত দিয়ে বসে। বিছানায় বসে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাকিমা, আমারই দিকে।

দীপ্র..?

সর্বনাশ! কিভাবে?

পরশুই তো কথা হলো ওর সাথে। অলিতে গলিতে ইঁট পেতে ক্রিকেট খেলা থেকে পাড়ায় রূপম আসার চরম উত্তেজনা সবেতেই শতরূপদা বলতে অস্থির। কি ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বলেছিলো, আমার প্রফেশনটা ওর দারুণ ইন্টারেস্টিং লাগে। ওরও এমন কিছু করার ইচ্ছে। মানে কোনো চার্মফুল জব। দশটা পাঁচটা ব্যাগ হাতে ছুটতে চায়না। কান মূলে দিয়ে বলেছিলাম আগে গ্র্যাজুয়েশন দে, তারপর ভাববি।

সাথে গেছিলাম। সবাই বলছিল, প্রেম ঘটিত কোনো কিছু হয়তো। দীপ্রকে দেখে কোনোদিন এতটা দুর্বল মনে হয়নি।

গলায় দড়ি?

ভাবতে পারছি না। মর্গের ডঃ অমল ভৌমিকের সাথে পরিচয় ছিল। বললেন, কোথাও আঘাত নেই। স্টমাকেও কোনো খাবার পাওয়া যায়নি। বাকিটা রিপোর্টে ডিটেলস-এ আছে। আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ হবার পর তবেই কাল সকালে বডি পাওয়া যাবে। ভালো লাগছে না কিচ্ছু। কেমন একটা শিথিলভাব পেয়ে বসছে আমায়।


ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৫; রাত ১২টা বেজে ৩০মিনিট

বাড়ি হোক কিংবা পরিচিত বন্ধু কেউই বিশ্বাস করতে পারছেনা দীপ্র, দীপ্র চ্যাটার্জী এমন একটা কাজ করতে পারে। ম্যাথস্ অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত, মিশুকে মনোভাব। একমাত্র সন্তান। কাকু রেলে আছেন। তাই আর্থিক অসচ্ছলতা আছে একথাও বলা যাবে না। তবে? কারণটা কি! এই মুহূর্তে কাকিমাকে খোলামেলা যে কোনো কথা জিজ্ঞেস করবো এমন পরিস্থিতি বা অবস্থা কোনোটাই নেই।

তাবড় তাবড় ঘটনার মাঝে দীপ্র-র ঘটনাটা হয়তো কারো কাছে খুব সামান্য মনে হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে তা নয়। এভাবে একটা জলজ্যান্ত মানুষ, কি করে! খটকা একটা লাগছে।

কাল মনে করছি, দীপ্র-র কলেজে যাবো।


ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৫; রাত ১১টা

তিস্তার নামটা, শুভ্র-র কাছে শুনেছিলাম। শুভ্র, দীপ্র-র ছোটবেলার বন্ধু। আমাদের পাড়াতেই থাকে। কলেজে তিস্তার সাথে দেখা করে যেটুকু জানলাম, তিস্তা আর দীপ্র-র বন্ধুত্ব খুব বেশিদিনের নয়। একসাথে একটা বছর। বন্ধুত্বটা স্বাভাবিকই ছিল। তবে লাস্ট ইয়ার শেষের দিকে, ডুয়ার্স বেড়াতে যাওয়ার পর থেকে দীপ্র, তিস্তাকে এড়িয়ে যেতে থাকে। সবসময় কেমন যেন আনমনা থাকতো। কলেজের অনেকের মুখেই তিস্তা শুনেছে দীপ্র নেশা করতো। অনেকবার জানতে চেয়েছিল, কিন্তু কিছুই বলেনি দীপ্র।

স্ট্রেঞ্জ!

যে ছেলেটার কলেজের স্যার, বাড়ি এমনকি পাড়ার কারুর কাছে কোনোদিন নালিশের নোটিশ যায়নি। সে একটা এমন অপরিণত কাজ কি করে করে! কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

সেদিন কাকিমা আমার হাতটা ধরে বলেছিল, শতরূপ জানতে পারবে কেন তোমার ভাইটা এমন করলো? ও শুধু বলতো আমি শতরূপদার মতো হবো।


ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৫; রাত ৮টা

‘স্নো’, ‘ফ্লেক’, ‘ব্লও’ বিক্রির জন্য ধরা পড়েছে চারটি ছেলে। আপাতত ভবানীপুর থানার আন্ডারে। সবকটারই বয়স ২০ থেকে ২৩-এর মধ্যে। এজেন্ট মারফত ঢুকে পড়েছে ছাত্র চত্বরে। ও.সি. সৌম্যদীপ সরকার জাঁদরেল মানুষ। জয়েন করেছেন গত সপ্তাহে। ধরপাকড় তাই ঘন ঘন হচ্ছে। কিন্তু এদের নেটওয়ার্ক জবরদস্ত। মামা, কাকা, মেসোর ফোনে ছুটকারা পেতেই পারে। সৌম্যদীপ স্যার বলেছেন এমনটা হবার নয়। বাপ, ঠাকুরদাদা যে যেখানেই থাকুক বেল পাওয়া মুশকিল।


২রা মার্চ, ২০১৫; রাত ১০টা ১৫মিনিট

দীপ্র বাজার থেকে প্রায় লাখ-খানেক টাকা ধার করেছিল। প্রাইভেট টিউটরের আগাম মাইনা নিয়েছিল ৬ মাসের, কাকিমার কাছ থেকে। ধারণার বাইরে ছিল বিষয়টা। চারদিক থেকে পাওনাদারের চাপ আস্তে শুরু করেছিল, এদিকে নেশার জেদ শরীরে গেঁথে বসেছিল।

প্রতুল নামে একটা ছেলে ধরা পড়েছে। উগড়েছে অনেক কথাই।

ড্রাগস্ দালাল ব্যবসায়ীরা প্রথমেই ভদ্র ঘরের ছাত্র-ছাত্রীদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে এবং এর জন্য তারা কোনো কোনো সময়, মেন ডিলারদের কাছ থেকে অনেক বেশি টাকার মুনাফাও পায়-এমন করে তারা। সাধারণ যুবক-যুবতীদের প্রথমে অন্যান্য সুখকর দুর্বল বিষয় সমূহের প্রতি আকর্ষণ করে উপকারী ঔষধ বলে খুবই অল্পদামে বিক্রি করে (যাকে ক্র্যাক কোকেন বলে এবং বেশিরভাগ ধূমপানের মতোই) পরে চড়া দামে দিয়ে উক্ত আসক্তকারী ওদের কাছ থেকে ড্রাগ কিনে নেয়। এভাবেই পৃথিবীর সেরা শহরগুলোতে বিশাল একটা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ওরা দখল করে নিয়েছে।

কথাগুলো লিখতে লিখতে, নিজের উপরই নিজের একটা ঘৃণা জন্মাচ্ছে। আমি বা আমরা বাস করছি এমন একটা সমাজে যেখানে দীপ্র-র মত ভদ্র পরিবারের ভালো ছেলের জীবন, কিভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে? শহুরে স্মার্ট মানসিকতায় কিভাবে ঢুকে পড়েছে বিষ। যা আমাদের তিল তিল করে খৈয়ে দিচ্ছে। পচন ধরাচ্ছে গোটা ভিতকে। রেজাল্ট, নম্বর, শতাংশের সেখানে কোনো ভূমিকা থাকে না। নাহলে পাওনাদারদের তাগিদ থেকে বাঁচতে, শুধু নেশার জন্য মরে যেতে হলো দীপ্র-কে। একবারও ভাবলো না কাকু, কাকিমা কোন মুখ নিয়ে সমাজে দাঁড়াবে!

পুলিশ কাস্টডিতে ধরা পড়া ওই চারটি ছেলে কিংবা প্রতুলের মতো ছেলেগুলোর কি শাস্তি হবে বা হতে পারে তা হয়তো রাজনীতির আড়ালে। বড়জোর একবছর থেকে দশ বছর জেল। তার বেশি কি? আবার অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে হঠাৎ বেলও হয়ে যেতে পারে। কতটা ঠেকাবেন সৌম্যদীপ সরকার?

কিন্তু আমি কি কখনো কাকিমার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে পারবো, ‘কাকিমা, দীপ্র অন্যায় করেনি? কোনো দোষ করেনি?’ হয়ত মাথা নিচু করে চলে যাবো পাশ কাটিয়ে। দীপ্র, নিজের সঙ্গে সঙ্গে আমাকে এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন করলো, যার থেকে একটা কথাই উঠে আসে, ‘লজ্জা’!

কারুর মত হয়ে উঠতে না পেরে দীপ্র পারতো না নিজের মত করে সত্যিকারের মানুষ হতে? অন্তত তেমনটাই তো ওর অভিভাবক চেয়েছিল।


(নাহ, কোনো টিভি সিরিয়াল বা সিনেমার দৃশ্যপট নয়, বিষয়ের সামগ্রিক মিল বাস্তবের সাথে। কিছু কাল্পনিক। কলম আপাতদৃষ্টিতে সেটাই বলছে, তাই শতরূপ সান্যালের পরবর্তী কলমকথার অপেক্ষা করতেই হচ্ছে)

(ক্রমশঃ)

অলংকরণ - মৈনাক দাশ

বাবা

বিয়র্ন্সটিয়ার্ন বিয়র্ন্সন
অনুবাদ : পিনাকী ঘোষ



যে লোকটার গল্প এখানে বলা হবে তিনি ছিলেন সেই এলাকার সবচেয়ে বিত্তশালী এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী লোক। তাঁর নাম ছিল থর্ড ওভার্যাস। একদিন তিনি ওই এলাকার পাদ্রীসাহেবের পড়ার ঘরে এসে হাজির হলেন। লম্বা, ভারিক্কী চেহারা।

“আমার একটা পুত্র সন্তান জন্মেছে।” তিনি বললেন, “আর আমি চাই দীক্ষাদানের জন্যে তাকে হাজির করতে।”

“তার নাম কী হবে?”

“ফিন -- আমার বাবার নাম অনুসারে।”

“ধর্ম পিতামাতা কারা হবেন?”

তাঁদের নামও বলা হল, এবং দেখা গেল তাঁরা ওই এলাকায় থর্ডের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো।

“আর কিছু?” প্রশ্ন করে পাদ্রীসাহেব তাঁর দিকে তাকালেন। প্রশ্ন শুনে থর্ড একটু ইতস্তত করলেন।

তারপর তিনি বলে উঠলেন, “আমি ভীষণভাবে চাই যে তার দীক্ষা তার নিজের দ্বারাই হোক।”

“সপ্তাহের মাঝের কোনো দিন?”

“পরের শনিবার। দুপুর বারোটায়।”

“আর কিছু?” আবার জিজ্ঞেস করলেন পাদ্রীসাহেব।

“না, আর কিছু না,” বলে থর্ড টুপিটাকে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে চলে যাবার উদ্যোগ নিলেন।

ঠিক তখনই পাদ্রীসাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “কিন্তু কিছু বাকি রয়ে গেল যে।” থর্ডের কাছে এগিয়ে গিয়ে তাঁর হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে তাঁর দিকে গভীরভাবে তাকালেন। বললেন, “ঈশ্বর মঞ্জুর করুন, এই সন্তান যেন আপনার আশীর্বাদক হয়ে ওঠে।”

ষোলো বছর পরে একদিন থর্ড আবার একবার পাদ্রীসাহেবের পড়ার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলেন।

“সত্যি থর্ড, আপনি কিন্তু এখনও আপনার বয়সটা বেশ ধরে রেখেছেন,” পাদ্রীসাহেব বললেন। তিনি দেখলেন তাঁর চেহারার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

“আমার তো কোনো ঝুটঝামেলা নেই, তাই বোধহয় এটা সম্ভব হয়েছে,” জবাব দিলেন থর্ড।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পাদ্রীসাহেব বললেন, “বলুন, আজ হঠাৎ কী মনে করে?”

“আমি এসেছি আমার ছেলের ব্যাপারে। আগামীকাল তার দীক্ষার দৃঢ়ীকরণ।”

“সে তো খুবই প্রতিভাবান ছেলে।”

“আগামীকাল থেকে চার্চে তার স্থান কততম হবে না জেনে আমার যে দক্ষিণা দিতে মন সরছে না।”

“তার স্থান হবে সর্বাগ্রে।”

“বেশ, আমি শুনলাম। আর এই রইল পাদ্রীসাহেবের জন্যে দশ ডলার।”

“আর কিছু কি আমি আপনার জন্যে করতে পারি?” থর্ডের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

“না, আর কিছু না।”

থর্ড চলে গেলেন।

এরপর আট বছর কেটে গেল। একদিন পাদ্রীসাহেবের পড়ার ঘরের দরজার বাইরে কিছু হইচই শোনা গেল। অনেক লোক সেদিকে এগিয়ে আসছে এবং তাদের নেতৃত্বে স্বয়ং থর্ড। তিনি সবার আগে ঘরে ঢুকলেন।

পাদ্রীসাহেব দেখেই চিনতে পারলেন। “আজ তো আপনি সদলবলে এসেছেন, থর্ড।”

“আজ আমি এসেছি আমার ছেলের বিয়ের নোটিশ জারি করার জন্যে অনুরোধ জানাতে। এই যে আমার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন গুডমাণ্ড, তাঁরই মেয়ে কারেন স্টরলিডেনের সাথে আমার ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

“কেন, সে তো এলাকার সবচেয়ে ধনী মেয়ে।”

“সবাই তো তাই বলে,” একহাতে চুলগুলো পিছনদিকে পাট করতে করতে বললেন থর্ড।

পাদ্রীসাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন, যেন গভীর চিন্তামগ্ন। তারপর তিনি কোনো কথা না বলে তাঁর খাতায় তাঁদের নাম লিখে নিলেন। নিচে তাঁরা সই করলেন। এরপর থর্ড টেবিলে তিন ডলার রাখলেন।

“সবকিছু নিয়ে আমার পাওনা এক ডলার মাত্র,” বললেন পাদ্রীসাহেব।

“আমি খুব ভালো করেই জানি সেটা। কিন্তু আমার তো এই একটিমাত্র সন্তান। তাই আমি সবকিছু লাগসই ভাবেই করতে চাই।”

পাদ্রীসাহেব টাকাটা তুলে নিলেন। “এই নিয়ে তৃতীয়বার, থর্ড, তুমি তোমার ছেলের জন্যে আমার এখানে এলে।”

“কিন্তু আমি তো এখন তার সঙ্গেই আছি,” থর্ড জবাব দিলেন। তারপর তাঁর পকেটবইটা বন্ধ করে বিদায় জানিয়ে তিনি চলে গেলেন। তাঁর দলবলও তাঁর সাথে চলে গেল।

এর দিনপনেরো পরে একদিন বাবা আর ছেলে মিলে নৌকা বেয়ে লেক পেরিয়ে যাচ্ছিল স্টরলিডেনের সাথে বিয়ের যোগাড়যন্ত্র করতে। শান্ত, স্থির একটা দিন।
“এই বসার জায়গাটা নিরাপদ নয়,” বলে ছেলেটা নৌকার মধ্যেই উঠে দাঁড়াল এবং তারপর যেটার ওপর বসে ছিল সেটাকে সোজা করতে গেল।

ঠিক সেইসময় নৌকার যে বোর্ডটার ওপর সে দাঁড়িয়ে ছিল সেটা হঠাৎ পিছলে গেল। আর সাথেসাথেই সে হাতদুটো ছুঁড়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠল আর টাল সামলাতে না পেরে জলে পড়ে গেল।

লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে হাতের দাঁড়টা বাড়িয়ে দিয়ে বাবা চিৎকার করে বলতে লাগলেন, “এই দাঁড়টা ধর!”

কিন্তু কয়েকবার ধরার চেষ্টা করার পরেই তার দেহ শক্ত হয়ে গেল।

“একটু অপেক্ষা কর!” বলে চিৎকার করতে করতে বাবা দাঁড় বেয়ে তার দিকে এগোতে লাগলেন।

ছেলে তখন হাবুডুবু খেতে খেতে একবার চিৎ হয়ে গেল আর তারপর তার বাবার দিকে তাকিয়ে জলের নীচে তলিয়ে গেল। থর্ডের যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। নৌকাটা স্থিরভাবে ভাসিয়ে রেখে তিনি ছেলের ডুবে যাওয়ার জায়গাটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন, যেন ওইখানেই ছেলে আবার ভেসে উঠবে। কিন্তু সেখানে প্রথমে কিছু বুদবুদ উঠল, তারপর আরো কিছু, এবং সবশেষে একটা বড়সড় বুদবুদ ভেসে উঠে ফেটে গেল। তারপর আবার লেকের জলটা আয়নার মতো মসৃণ এবং চকচকে হয়ে গেল।

এরপর তিনদিন তিনরাত ধরে লোকেরা দেখল বাবা ওই জায়গায় নৌকা নিয়ে চক্কর কাটছেন। না খাওয়া, না ঘুম। ছেলের দেহ খুঁজে পাবার জন্যে তিনি লেকটাকে ঢুঁড়ে ফেলছিলেন। তিনদিনের দিন সকালবেলা দেহটা তিনি পেলেন এবং তারপর সেই দেহ কোলে তুলে নিয়ে পাহাড়ের ওপর তাঁর খামারবাড়িতে গেলেন।

এই ঘটনার প্রায় বছরখানেক পর শরতের এক গভীর সন্ধেয় পাদ্রীসাহেব তাঁর দরজার বাইরের বারান্দায় কারুর যেন পায়ের আওয়াজ পেলেন। দরজা হাতড়ে যেন হাতলটা খোঁজার চেষ্টা চলছে। পাদ্রীসাহেব উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন। ঘরে ঢুকে এলেন একজন লম্বা, রোগাপাতলা চেহারার মানুষ। আনত ভঙ্গী, মাথার চুলগুলো পাকা। অনেকক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে পাদ্রীসাহেব তাঁকে চিনতে পারলেন। তিনি থর্ড।

“আপনি এতো দেরি করে হাঁটতে বেরিয়েছেন?” পাদ্রীসাহেব তাঁকে জিজ্ঞেস করে তাঁর সামনে চুপ করে দাঁড়ালেন।

“ও হ্যাঁ, দেরি হয়ে গেছে,” জবাব দিলেন থর্ড। তারপর তিনি একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।

পাদ্রীসাহেবও বসে পড়লেন। তিনি যেন অপেক্ষা করছেন। বেশ অনেকক্ষণ ধরে দুজনেই চুপচাপ। অবশেষে থর্ড বলতে শুরু করলেন,-- “আমার কাছে কিছু আছে যা আমি গরীবদের দান করতে চাই। আমি চাই সে সম্পত্তি আমার ছেলের নামে তাদের উত্তরাধিকার দিয়ে যেতে।”

তিনি উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলে কিছু টাকা রাখলেন। তারপর আবার বসে পড়লেন। পাদ্রীসাহেব টাকাগুলো গুনে দেখলেন।

“এ তো অনেক টাকা,” তিনি বললেন।

“এটা আমার খামারবাড়ির অর্ধেক টাকা। আজই সেটা বিক্রি করে দিয়েছি।”

পাদ্রীসাহেব অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর খুব শান্তভাবে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন,-- “আপনার এখন কী পরিকল্পনা, থর্ড?”

“আরও ভালো কিছু করার।”

তারপর আরও কিছুক্ষণ তাঁরা সেখানেই বসে রইলেন। থর্ডের দুচোখ নিচু। পাদ্রীসাহেব একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন থর্ডের দিকে। তারপর একসময় পাদ্রীসাহেব খুব মৃদুস্বরে বলে উঠলেন,-- “আমার মনে হয় আপনার ছেলে অবশেষে আপনার প্রকৃত আশীর্বাদক হয়ে উঠতে পেরেছে।”

“হ্যাঁ, আমি নিজেও তাই মনে করি,” মুখ তুলে জবাব দিলেন থর্ড। ততক্ষণে দুফোঁটা চোখের জল তাঁর দু”গাল বেয়ে নামতে শুরু করেছে।

অলংকরণ : প্রমিত নন্দী

ফুটবল

সাজিদ রহমান


তাসিন আজকাল সারাদিন ফুটবল নিয়েই থাকে। যেখানে যাবে ফুটবল থাকবে তার সাথে। অথচ বয়স বেশি কিছু না। বারো হবে। এর জন্য তার আম্মির কাছে দু'একবার মারও খেয়েছে। পড়ালেখায় সে খুব ভালো, ভালো সে ফুটবল খেলায়ও। ওরা থাকে ময়মনসিংহে। ওরা মানে তাসিন, সাথে আম্মি। ওর বাবা নেই। মানে আছে, তবে ওদের সাথে থাকে না। কখনও তাসিন তাই দেখেনি বাবাকে। বন্ধুরা যদি এই নিয়ে যখন প্রশ্ন করে, সে তখন শুধু তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। কেন নেই, এই প্রশ্ন করে না সে ওর আম্মিকে। তারচেয়ে ফুটবল নিয়ে থাকতে ভালবাসে সে। কম কথা বলা এই ছেলেটা মাঝে মাঝে একদম চুপ হয়ে যায়...শুধু ভাবে আর বলের দিকে তাকিয়ে থাকে। দূর থেকে ওর আম্মি সবকিছুই দেখে, কিন্তু কিছুই বলে না। সে জানে তার ছেলের এই চুপ হয়ে থাকার কারণ। মানুষটাকে সে ভালবেসে বিয়ে করে ছিল। কী দোষ ছিল তার, সে কিছুই জানেনা। হটাত করে হারিয়ে গেল নিজের জীবন থেকে। সে জানে যে মানুষটা বেঁচে আছে, কিন্তু কোনওদিন মন চায়নি তার খোঁজ নিতে! বড় অপমানিত হয়েছে সে নিজের কাছে, ছোট হয়ে গেছে ছেলের কাছে। তাই ছেলেকে কী বলবে, কিছু খুঁজে পায় না। সে নিজেও কম কথা বলে। তাই হয়তো ছেলেটা সারাদিন বল নিয়ে থাকে, বলের সাথে কথা বলে।

তবে যে যাই বলুক, তাসিন বল খেলে ভালো, এতো সুন্দর পাসিং এবং ডিবলিং এই বয়সে আর কেউ করে কিনা, জানা নেই আম্মির। তাই সবসময় সে চেষ্টা করে, ছেলেকে একটা ভালো দামী বল কিনে দিতে। আপনজন বলতে কেউই নেই ওর। আসলে, আছে অনেকেই, তবে কেউ খোঁজখবর নেয় না। যদি পাশে দায়িত্ব এসে ঘাড়ে চেপে বসে! এই ভেবে হয়তো এড়িয়ে চলে। সে নিজে তো তাদের বাড়ি যায়ই না, তাসিনও ওদের চেনেন! তাই ফুটবল নিয়েও ছেলেটাকে আর কিছু বলে না। আম্মি চায়, ফুটবলেই তার ছেলের শূন্যতা পূরণ হোক।

আজ তাসিনের জন্মদিন। ঘুম থেকে উঠেই সে আম্মিকে বলল, ‘আমাকে ডিম দিয়ে ভাত দাও।’

‘ডিম কেন খেতে চাও সবসময়? আজ অন্য কিছু খাও। আজ তো তোমার জন্মদিন, ভুলে গেছ? তোমার জন্য মজার কিছু রান্না করেছি আজ, খেয়ে তোমার ভালো লাগবে।’

‘হ্যাঁ, আমি ভুলে গেছি। আমি শুধু ফুটবল ম্যাচের কথা মনে রাখি। বাদবাকি সব ভুলে যাই। কিছু মনে রাখতে চাই না, আর মজার কিছুও চাই না। ডিম আর বল চাই...দুটোই চাই।’

‘এভাবে কথা বলতে হয় না, তুমি তো অনেক বড় খেলোয়াড় হবে। বড় মানুষ হবে। তাই ভালো করে কথা না বললে, সবাই তোমাকে কী বলবে জানো? আর বল এবং ডিম দুটো আলাদা জিনিষ। একসাথে মেলালে কিছুই হয় না।’ হাসতে থাকে আম্মি।

‘হাসবে না! জানো আম্মি , বলকে আমার পানকোঁড়ির মতো লাগে...পানকৌড়ি যেমন জলের মধ্যে ডুবে ভাসে আমিও বলের মাঝে ডুবি ভাসি... শুধু ভাসি আর ডুবি, ডুবি আর ভাসি...মজা না আম্মি?’

‘মানে বুঝলাম না।’

‘বুঝবে বুঝবে। একদিন সব বুঝবে...আমাকে ভাত দাও তাড়াতাড়ি।’

‘না আজ আমি তোমাকে নিজ হাতে খাওয়াবো, আমি যা যা রান্না করেছি সবকিছু দিয়ে খেতে হবে। তারপর তোমার যেখানে যাওয়ার যাবে। তবে অবশ্যই দুপুরে তোমাকে আমি বাসায় দেখতে চাই। এটা আমার হুকুম। আমার কথা না শুনলে আমি সব কিছু বন্ধ করে দিব তোমার। তখন কিন্তু কিছু বলতে পারবে না!’

‘আমি জানি আম্মি তুমি কিছুই বন্ধ করতে পারবে না, তবে আমি দুপুরে চলে আসব। পাক্কা প্রমিজ।’

‘আর যদি না আস...’

‘আসব আম্মি, আসব, ইন শা আল্লাহ্।’

ভাত খেয়ে বল নিয়ে দিল ছুট তাসিন, আম্মি এতো ডাকল পানি খাওয়ার জন্য, কিন্তু কে শুনে কার কথা!

এখন আর সে কারও কথা শুনবে না। কথা হবে শুধু বলের সাথে, শুধু বল।

দুপুরে ওদের বাসায় কিছু মেহমান এলো, আম্মি তাদের দাওয়াত করেছে তাসিনের জন্মদিন উপলক্ষে কিন্তু এদিকে তাসিনের দেখা নাই। মাঝে মাঝেই এমন করে তাসিন। তখন খুব ভয় পায়ে আম্মি। প্রিয় মানুষটি তার জীবন থেকে হারিয়ে যাবার পর থেকে এই রকম এক ভয় লাগা কাজ করে সবসময়।

তাসিন সেটা বুঝে না। ছোট মানুষ, বুঝবেই বা কীভাবে! আম্মি চিন্তা করে রেখেছে, আজ বাসায় ঢোকামাত্রই ছেলেকে অনেক বকাঝকা করবে। আবার এ-ও ভাবে, পারবে কি তাকে বকতে ?

বিকেলে বাসায় ঢোকা মাত্র আম্মি কোনও কথা না বলে তাকে বাথরুমে নিয়ে গোসল করাল। গোসল শেষ হতেই সে আম্মিকে জড়িয়ে ধরল, ‘জানো আজ কি হইছে?’

‘আমি তোমার কোনও কথা শুনব না, তুমি কথা দিয়ে কথা রাখ নাই। আমারই ভুল হয়েছে তোমাকে আজ বাহিরে যেতে দেওয়া। ঘরের আটকে রাখলে ভালো হতো। আর আমী তোমাকে এখন ভাত খাইয়ে দিব। খাওয়া দাওয়া শেষ করে একদম ঘরে বসে থাকবে। কোনওখানে যাবে না। তুমি মাঝে মাঝে খুব বেশী বাড়াবাড়ি করো, যা আমার একদম পছন্দ না।’

‘আম্মি কথাটা কী বলবো? যা আজ হইছে!’

‘না, এখন তুমি খাও, খাওয়ার সময় কোনও কথা না।’

‘বলি না, বললে কি হবে?’

‘আচ্ছা বলো।’

‘শুনো, প্রথমে বলটা নিয়ে দিলাম ছুট, দুজনকে কাটিয়ে সামনে দেখি আর একজন! কিন্তু তাকে আর কাটাতে ভাল লাগলো না, বলটাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে আমিও ভেসে গেলাম, পাখির মতো করে...তার মানে গোল, জানো আম্মি, উড়তে ভাল লাগে আমার... ডুবতে ভাল লাগে আমার...পাখি হয়ে ওপর থেকে সবকিছু দেখতে মন চায়। তাই গোল দেয়ার পর বন্ধুরা যখন উপরে তুলে ধরে ভালো লাগে, অনেক ভালো লাগে!

আম্মি জানো কাল একটা জটিল খেলা আছে...’

‘জটিল মানে?’

‘জটিল হলো, বড় দলের সাথে খেলা। খেলাটাতে আমাদের জিততে হবে। আমি কি পারব আম্মি? আমি জানি পারব। জিতেই আনন্দমোহন কলেজের পুকুরে ডুব দিব। ডুব দিব আর ভাসব, ভাসব আর ডুব দিব। বলের সাথে আমি...হা...হা...হা...’

‘না তুমি আনন্দমোহন কলেজের পুকুরে যাবে না, আমার একদম পছন্দ না। তাছাড়া ভর দুপুরে ওই পুকুরে যাওয়ার কোনও দরকার নাই। খেলা শেষ করে সোজা বাসায় চলে আসবে। না হলে আমি তোমার এই বাইরে গিয়ে ফুটবল খেলা একদম বন্ধ করে দিব। কথাটা কিন্তু মনে রাখবে।

‘আম্মি তুমি আজ এরকম রেগে আছো কেন? ’

‘তুমি বুঝবে না’। আম্মি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।’

***

আম্মি এখন বসে আছে আনন্দমোহন কলেজের পুকুর ঘাটে। কতক্ষণ এভাবে বসে আছে সে জানেনা। সব কিছুর জানার বাইরে চলে গেছে সে। এখন আর কিছু জানতে এবং মানতে চায় না এই মন। সে দেখতে পাচ্ছে তাসিনের প্রিয় বল ভাসছে, তার ছেলের অনেক শখের বল! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না, শুধু তার বেলায় কেন এমন হয়?

ডুবুরিরা, বন্ধুরা ডুবছে ভাসছে কিন্তু তাসিন! আম্মির কষ্ট হচ্ছে বলটি দেখে, প্রিয় বলটি তাসিন বিহীন ভাসছে, কোনদিন হয়নি এমন, কি জানি, এইভাবেই মনে হয় একা পথ চলা শুরু প্রিয় ফুটবলের!

অলংকরণ : প্রমিত নন্দী

ঠিক সন্ধে নামার আগে...

অনিমেষ ভট্টাচার্য্য


দর্মার বেড়া দিয়ে ঘেরা কফিকাপ;
ঠোঁট ছোয়ানোর আগে উষ্ণতার আভাস নিষিদ্ধ!
একটা কুয়াশার মতো রেলগাড়ি চলে গেল—
গভীরতাকে দু’গোল দিয়ে। তুমি ভাবছ, রাত।
আমি বলব, শীত।

আজকাল ভিড় বাড়লে বুঝি, কেউ হারাচ্ছে। শান্ত হতে চেয়েছিল
কপাল। তাতে জ্বর আসে, ভাঁজ হয়;
ঢেউ খেলে যায় গুনতে গুনতে।
আমার কপালে বসে তুমি ভিড় গুনছ, হারাবে বলে—
আমরা ভিড়ে অভ্যস্ত। হারানোতেও!

যেদিন শহরের একমাত্র নদীটা পাখি হয়ে যাবে,
যেদিন সরব উলুধ্বনিতে চাপা পড়ে যাবে প্রস্তুতি,
যেদিন কাগজের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা ছবি, বই হয়ে যাবে,
যেদিন...
থাক, সেইদিনটা আসার অনেক আগেই আমি বয়ে যাব।
তীরে বসে বই পড়বে তুমি। ছবির মতো...

অলংকরণ : প্রমিত নন্দী
মূল ছবি : প্যাট্রিসিয়া কুইঞ্চ

মুক্তির আশে

চিন্ময় মহান্তী



চলো যাই, রূপকথার ওই মাদুরে ভেসে
সোনার কাঠি রুপোর কাঠির দেশে,
চলো যাই, পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে
নিঝুম দেশের ওই পাষাণপুরে।
মাকড়সার জালে বেঁধে নেবো ছোট্টো কুঁড়ে
গাছের বাকল পরবো ওগো শান্ত লয়ে,
টিয়ার ঠোঁটে সূঁচ বানাবো, সুতো শ্যামা লতে ।
লোভ রিপু ভয় পাবেগো মোদের ব্যবহারে
মোহকে মোরা চাপা দেবো পাষাণের ওই স্তুপে ।
বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি লব,বেবাক দেশের বুকে
ষড় রিপুর আলিঙ্গন সেথা শীতল ভীষণ আগে।
ইন্দ্রজিৎ নামকুড়বো দুই মুঠি ভরে
মুক্তি লব এই ভুবনের আমার আমিত্ব হতে ।
চলো যাই, রূপকথার ওই কল্প সরোবরে
নাইবো সেথায় যৌবন নয় নির্মল মন যেচে,
দেহের এই মলিনতা ধুবোগো ওরেই জলে।
মাটির গান শুনবো সেথায় বোবা পাষাণ মুখে
এই ভুবনের রোষারোষি থাকনা অনেক দূরে,
মুক্তি তুমি এসো হে সেথা সাহসি দাম্ভিক পদে।

অলংকরণ : প্রমিত নন্দী

কুটুম কাটাম

জগন চক্রবর্তী





দুই চাকা

অনিন্দ্য রাউৎ



বিপ্রতীপের সাইকেলটা চলে ঘটাং ঘট, ঘটাং ঘট শব্দ করে। সকালে যখন ও বাড়ি থেকে সাইকেলটা নিয়ে বেরোয় তখন আশপাশের সবাই টের পায়, বিপ্রতীপ যাচ্ছে। এই মফঃস্বলে সব মানুষই প্রায় একে অপরকে চেনে। অদ্ভুতভাবে তাদের সকলেরই কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। কারোর কথা বলায়, কারোর হাঁটা চলায়, কারোর হাঁকডাকে, কারোর অঙ্গভঙ্গিতে। বিপ্রতীপের সেরকম কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, তাই হয়তো এই সাইকেলটাই ওকে চিনিয়ে দেয় আলাদা করে। সাইকেলটা ওর বাবার ছোটবেলার। এত পুরনো সাইকেলটা পাল্টানোর কথা ভাবে ও প্রায়ই। কিন্তু অতটা টাকা তো ওর কোনো মাসেই জমে না। তাই মাঝে মাঝেই সারাতে পারে শুধু সাইকেলটা। কিন্তু সারিয়ে বিশেষ লাভ হয় না, ঘুরে ফিরে আবার খারাপ। এত বছরের খাটনিতে সাইকেলটাও খুব নড়বড়ে হয়ে গেছে। সারাতে গেলে হারান প্রায়ই বলে ওঠে, “বিপু এই সাইকেল আর আনিস না। তুই আমার দোকান থেকে একটা সাইকেল নিয়ে যা। ৫০০ কম করে দেব।”

বিপ্রতীপ হাসে। ও জানে ও পারবে না। হয়তো পারতোও কিন্তু বাড়িতে বুড়ো মানুষটার খেয়াল আর শখ রাখতে টাকা আর জমে না।

সকালে ও যখন বেরোয় আলতো করে দরজা ঠেলে তখন খুব সচেতন থাকতে হয় ওকে, যাতে বাবার ঘুম ভেঙে না যায়। বাবা প্রতিদিন অনেক রাত অব্দি পড়াশোনা করে। নানা রকমের বই পড়া বাবার নেশা। রাত জেগে জেগে একই বই বারবার পড়ে। তবু রাতটুকুতে বাবার বই চাই। কোনোসময় অতিষ্ঠ হয়ে গেলে গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে। বোঝায় নতুন বই পড়তে চায়। বিপু তখন নিজের মাইনে থেকে জমানো টাকাগুলো দিয়ে বই কিনে আনে। লাইব্রেরি থেকে আনতে পারে না, কারণ কোনো বই বাবার হাতে গেলে ওটাকে তো বাবার কাছেই থাকতে হবে। আসলে কেন জানি মানুষটা রাতে আর ঘুমোতে পারে না চাকরি যাওয়ার পর থেকে। বিপ্রতীপ যখন ক্লাস ইলেভেনে তখন হঠাৎই ওর বাবার চাকরিটা চলে যায়। বেশ কিছু জায়গায় ঘোরাঘুরি করেও কিছুদিন পর যখন বাবা চাকরি জোটাতে পারেনি, তখন মানুষটা ভেতর থেকেই ভেঙে গেছিলো। তারপর হঠাৎ স্ট্রোক আর পক্ষাঘাত শারীরিকভাবেও মানুষটিকে বিপর্যস্ত করে দেয় আর তার থেকেও বেশি মানসিকভাবে। বিছানাই সঙ্গী হয়ে যায় বাবার। বাবা আর কথা বলে না তখন থেকে। আকার-ইঙ্গিত, ওটুকুই। এর কিছুদিনের মধ্যে ওর জীবনের সবচেয়ে বড় সঙ্গী মা’ও কলতলায় পড়ে গিয়ে মারা যায়। বাবা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল সেদিন মায়ের শোয়ানো দেহ। চোখ থেকে অবিরত জল গড়িয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছিল বালিশ। বিপুও কোনো অভিযোগ করেনি। ভেঙেও পড়েনি। চুপ থেকে শান্ত হয়ে সব কাজ করেছিল এক এক করে।

তারপরেই বিপু হয়ে যায় বাড়ির একমাত্র খুঁটি, আশ্রয়, সেই ১৭ বছর বয়সেই। বিপু যখন নদীর পাড় বরাবর কাঁচা রাস্তায় ঢিমে গতিতে সাইকেলটা চালায়, তখন মাঝে মাঝে এমনিই ওর মনে হয়, অবাক লাগে ভেবে যে দুঃখ, কষ্টগুলো কী নির্লজ্জের মতো আসে ওদের জীবনে। যেন অনাহুত অতিথি। আবার একইভাবে এই দুর্ঘটনা, দুঃখ, ভীষণ কষ্টগুলোই কীরকম যেন বাংলার ঋতু পরিবর্তনের মতো। যেন খুবই অবশ্যম্ভাবী, খুবই নিয়মিত।

“কিরে তিতু, তুই রেডি তো? আমি কিন্তু রেডি। ওদিকে শ্রমণাকে বলে রাখ, ১ ঘন্টার মধ্যেই যেন চলে আসে। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না।”

“মা, তুমি তো…”

তিতলির কথায় পাত্তা না দিয়ে রূপাদেবী বলতে থাকেন, “তোর বাবা আবার আমায় বলে রেখেছে, তোকে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসতে। আজ আবার ধীমানবাবুরা আইবুড়ো ভাত দেবে, তারপর আমাদেরও দেওয়ার আছে। অনেক জোগাড় করে রাখতে হবে। মালতিকে বলে রাখি এইবেলা। তুই রেডি হ।”

“মা, তুমি শুনবে না! তুমি তো বোঝো।”

“ঐ দেখ, ডাকাডাকি শুরু করেছে নীচ থেকে। আমি যে কতদিকে আর যাই! সবাইকে বলে রেখেছি মেয়ের সঙ্গে বেরোতে হবে পার্লারের জন্য, কিন্তু কে মনে রাখে! আর বিপুটাই বা কোথায় গেল? এসেছে ও? ওকে দিয়ে অনেক কিছু আনাতে হবে যে।”

তিতলি উঠে আসে বিছানা থেকে, মায়ের দু হাত চেপে ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “কেন এরকম করছো তুমি? কেন এড়িয়ে যাচ্ছ? আমি এই বিয়ে করতে চাই না। বলেছিলাম তোমাদের। কেউই গা করছো না। ছোটবেলা থেকে বন্ধু বলে বিয়ে করতে হবে? দীপ ভালো ছেলে। কিন্তু আমি তো চাই না ওকে। আর যাকে চাই তার মুখ অব্দি দেখতে চাও না! কেন? বাবা একবারও কিছু শুনলো না। আর তুমিও আমায় এখন সাহায্য করবে না?”

“কি বলবো আমি? দেখ তিতু, সম্ভব নয়। এই পাড়ায় তোর বাবার এক সম্মান আছে। তোর বাবার কথাকেই অনেকে শেষ কথা হিসাবে মানে। সেখানে কারোর কোনো ইচ্ছের জন্য সেই মানুষের সম্মানটাকে আমি খর্ব করতে পারবো না। বাবা যখন চেয়েছে দীপের সঙ্গে তোর বিয়ে, তাহলে তাই হবে। এটুকু বুঝে নে।”

তিতলির দু চোখ দিয়ে নিঃশব্দে জল ঝরতে থাকে। মায়ের দিকে হাজার প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে ও।

রূপাদেবী বেশিক্ষণ দেখতে না পেরে বেরিয়ে যান। “রেডি হয়ে নে।”

তিতলি চোখ মুছতে মুছতে ব্যালকনিতে আসে। ওর সমস্ত চাওয়া পাওয়াই ছোট থেকে বাবা মা পূরণ করে এসেছে আর আজ যখন জীবনের সবচেয়ে বড় উপহারটা চাইলো ও, তখনই না করে দিলো! কি করবে ও? কাল বিয়ের পিঁড়িতে বসে বাবা মা আর সবাইকে খুশি করবে না নিজে খুশি হবে? শেষ অব্দি যাই করুক, ও যে নিজেকেই সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেবে তা তিতলি বুঝতে পারে। হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মোছে ও।

ঘটাং ঘট ঘটাং ঘট শব্দ করে বিপুর সাইকেল ঢোকে। শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তিতলি দেখে বিপুকে। বিপু সাইকেল স্ট্যান্ড করিয়ে হাঁক দেয়।

“সোনামা, ও সোনামা। এসে গেছি। কি কি আনতে হবে বলো। আজ সাইকেলটার দশা আবার খারাপ। রিকশা করে যেতে হবে।”

রূপা দেবী বেরিয়ে আসেন। ফর্দ দিয়ে কিছু যেন বলে বিপুকে। তিতলি দোতলা থেকে ঠিক শুনতে পায় না।

বিপু বলে, “ঠিক আছে, আমি দোকানে দিয়ে আসি তাহলে। এখন শুধু এগুলো আনলেই হবে?”

তিতলি দেখে মা ঘাড় নেড়ে বলে, “হ্যাঁ, এগুলোই। এলে পর তোকে একটা জিনিস দেখাবো।”

মা হাসে। মা খুব ভালোবাসে বিপুকে। তিতলি জানে, ছোটবেলায় বিপুর মা আর ওর মা খুব ভালো বন্ধু ছিল। তাই এখন বিপুকে আগলে রাখে। বাবা সবদিকে খেয়াল না করলে অনেক বেশিই মাইনে পেত বিপু। তবুও বাবাকে লুকিয়ে মাঝে মাঝে মা টাকা গুঁজে দেয় বিপুর হাতে। বিপু বেশিরভাগ সময় ফিরিয়ে দিলেও সবসময় পারে না ওর মায়ের জেদের কাছে।

বিপু বেরিয়ে যায় সাইকেল নিয়ে। ও সরে আসে ব্যালকনি থেকে। পুরনো এক সালোয়ার বের করে। রেডি হতে হবে। সাজতে যেতে হবে। কাল যে ওর বিয়ে!

ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং। নদীর পাড়ের রাস্তা প্রায় শুনশান। হবে নাই বা কেন। রাত তো কম হয়নি। জ্যোৎস্নার রূপোলি আলোয় ধুয়ে গেছে চরাচর। নদীর ওপর যেন কোটি কোটি রূপো ছড়ানো। চিকমিক চিকমিক করছে। অন্য দিন হলে বিপ্রতীপ একটু সাইকেলটা থামিয়ে বসতো। কিন্তু এখন না। আজ যে ওর সাইকেল থেকে নামতেই ইচ্ছে করছে না। ও জোরে প্যাডেল শুরু করে। বিপ্রতীপ বড় খুশি। ও ভাবতেই পারেনি ওর জন্য সোনামা এই চমক রেখেছে।

ও যখন আজ রাশি রাশি বাজার করে বড়বাড়িতে পৌঁছায়, তখনই ওর নজর গেছিলো উঠোনে রাখা সাইকেলটার দিকে। ঝকঝকে তকতকে একটা নতুন হিরো সাইকেল। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ফুল ফুল নরম কভার লাগানো। ওখান থেকে আবার নানা রঙের সরু সরু লম্বা লম্বা ঝুরঝুরে সেলোফেন পেপার ঝুলছে। যেগুলো সাইকেল চললেই উড়তে থাকবে। উঁচু স্পঞ্জের কুশনওয়ালা সিট। মাডগার্ড চকচক করছে। আর সর্বোপরি একটা বড় বেল। ওর সাইকেলে কোনো বেল ছিল না। ও টানে বিহ্বল হয়েই সাইকেলের কাছে পৌঁছে যায়। রূপাদেবী সেটা দেখতে পেয়েছিল। অল্প হেসে বললো, “কিরে বাজার করে আনলি, এগুলো কে তুলবে? আমি?”

ও চট করে জিভ কেটে বললো, “না, সোনামা। আমিই... আমি নিয়ে যাবো।”

বিপ্রতীপ সব ঘরে ঢুকিয়ে ঠিক ঠিক জায়গায় রেখে দেয়। এই ঘরের সব কোণ ওর নখের গোড়ায় চেনা। কোথায় কি থাকে সব জানা। আর এখন তো সব ঠিকঠাক করে রাখতেই হবে। কাল তিতুর বিয়ে। সব রাখা হলে ও সোনামার কাছে যায়।

“আজ কিন্তু অনেক কাজ। তিতু এখন পার্লারে। ও ফিরে আসার আগেই ঘরগুলো গুছিয়ে রাখতে হবে। তুই একটু নবারুণকে বলে রাখ। ওদিকে সাইকেলটা কোন দোকানে দিলি? আর হ্যাঁ, নাপিতকে বলেছিলিস তো?”

“হ্যাঁ, সোনামা। সাইকেলটা হারানের দোকানেই দিয়েছি।” বলে বিপ্রতীপ হাসে।

“হাসছিস কেন রে?”

“এত সবদিকে চিন্তা তোমার। সব ঠিক করে হয়ে যাবে ভেবো না।”

“বুঝতিস তুই পারুলটা বেঁচে থাকলে। মা’দের এমনিই অনেক চিন্তা হয়।”

বিপ্রতীপ শুনে চট করে মাথা নিচু করে ফেলে।

রূপাদেবী সেটা দেখতে পেয়ে বলেন, “আরে মায়ের কথা ভেবে সবসময় মন খারাপ করতে নেই। ভালোগুলো ভাববি। আর আমি তো আছি। এমন মন খারাপ করে রাখলে কিন্তু বাইরের সাইকেলটা পচাকে দিয়ে দেব।”

বিপ্রতীপ শুনে বোকার মতো তাকায় ওর সোনামার দিকে।

“হ্যাঁ রে, সাইকেলটা তোর। আমি আনিয়েছি আজ। পুরনো ওই ঘটাং ঘট সাইকেল তোকে আর চালাতে হবে না।”

বিপ্রতীপ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। “না সোনামা, আমি কি করে নেব?”

“দেখ পাকামি করিস না, তোকে সেভাবে কিছুই দিতে পারি না। সামান্যটুকু পড়াতেও পারলাম না তিতুর বাবার জন্য। আমি মরে গিয়ে ওপরে তোর মায়ের সঙ্গে দেখা হলে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে হবে।” ও দেখে সোনামার চোখ ছলছল করে উঠেছে।

বিপু সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, “সোনামা, তুমি না থাকলে আমরা বাবা ছেলে বাঁচতামই না হয়তো। কাকু যেটুকু দেয় মাসে তার ওপরেই তো বেঁচে আছি। আমি নেব সাইকেলটা। অনেক তাড়াতাড়ি কাজগুলো করতে পারবো। আর তুমি কেঁদো না। কাল না তিতুর বিয়ে। আমার জন্য তুমি...”

“তুই থাম। যে বিয়েতে মেয়ের মত নেই, সেই বিয়েতে কী আর ও খুশি হবে! কাল সব ভালোয় ভালোয় মিটলে হয়।”

বিপ্রতীপ জ্যোৎস্নাভরা নদী, ফাঁকা মাঠ, রায়দের বাগান পাশে রেখে এগোতে থাকে বাড়ির দিকে। ওর ইচ্ছে করছে সাইকেলটা নিয়ে অনেক জায়গায় পাড়ি দিতে। ও যেন একবার শুনেছিল কে যেন সাইকেল নিয়ে পুরো বিশ্ব ভ্রমণ করেছে। এখন এই নতুন সাইকেল নিয়ে কী ও বেরিয়ে পড়তে পারে না সব দুঃখ, হতাশা, অতীত পেছনে ফেলে! পলকেই ভাবনা ভেঙে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও। না, ও পারে না। সাইকেলের গতি কমে যায়। রায়দের বাগানের পর বিশাল রায়দিঘি, এই হেমন্তেও জল টইটুম্বুর। দীঘির জলে লম্বা লম্বা গাছের ছায়া পড়েছে চাঁদের আলোয়। একটু দাঁড়ায় ও। জলের দিকে তাকায়। মা যখন বেঁচে ছিল তখন ওকে এই দীঘিতে নিয়ে আসতো, দুই পা দিয়ে ঝাপুস ঝুপুস করে সাঁতার কাটার চেষ্টা করতো ও আর মা ধরে রাখতো ওকে। ঐ হুল্লোড়ে ওর সঙ্গে মায়ের স্নানও হয়ে যেত। মা’র অবস্থা দেখে ও খুব হাসতো। মাও রাগ করে থাকতে পারতো না। ওর চোখটা জলে ভরে আসে। ভালোবাসার মানুষগুলো কেন চলে যায় একদিন? কেন এই নিয়ম? কেন এতটা অসহায় হয়ে কাটাতে হয় বাকি জীবনটা?

হঠাৎই সামনের অন্ধকার ফুঁড়ে আসা এক তীব্র আলোয় বিপ্রতীপের চোখ কুঁকড়ে যায়। আলোয় ধাঁধানো আর জলে ভরে থাকা চোখ কিছু দেখতে পেলো না, কিন্তু বুঝতে পারলো একটা গাড়ি ওর সামনে থেকে এসে ওকে পেরিয়ে চলে যাচ্ছে। গাড়ি চলে যেতে ও চট করে পেছন ঘুরলো।

এই রাতে বড়বাবুর গাড়ি এখানে? কে ছিল?

বিপু বাড়ির বাকি কাজের লোকদের সঙ্গে নিয়ে এই বিশাল বাড়ি সাজালেও ও যখন সন্ধ্যেবেলা এই বড়বাড়িতে আসে, জমকালো আলোর বাহার দেখে ওর নিজেরই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সারা বাড়ি আজ সোনালী আলোয় মোড়া। কোথাও একটুকু অন্ধকার নেই, একটুকু দুঃখের ছায়া নেই যেন। আর হবে নাই বা কেন? বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে। তিতুকে নিশ্চয়ই খুব সাজাবে আজ। ওর অনেক কাজ থাকলেও একবার সময় করে দেখতে হবে তিতুকে। তিতু আর ও যখন ছোট তখন ও মাঝে মাঝে তিতুর সঙ্গে খেলতো। বড়বাবু পছন্দ করতো না বিশেষ, তাই সীমারেখায় আটকে সেই খেলাও বন্ধ হয়ে গেছিলো। তবু স্মৃতি থেকে গেছে। তিতুর কিছু কী মনে আছে?

গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনে বর্তমানে ফেরে ও। বিপু দেখে, সামনের বড় গেট আজ খোলা। কত গাড়ি ঢুকছে একের পর এক। ওকে আর বাড়ির কাজের লোকদের নির্দেশ দেওয়া আছে, যাতায়াত বাড়ির পেছনে সরু গেট দিয়ে করতে। বিপু সব ভাবনা সরিয়ে ভেতরের দিকে যায়।

সময় কিছুটা অতিক্রান্ত, বর এসে বসেছে পিঁড়িতে। দেখতে বেশ গোলগাল। তিতুর সঙ্গে ঠিক মানায় না। যাইহোক, তিতু ভালো থাকলেই হলো। তবে কাল যেন সোনামা কিসব বলছিল। তিতুর মত নেই নাকি। ভাবনাটা আসতেই ও সরিয়ে দেয়। না, ওকে এসব ভাবতে নেই। ওর এতটা অধিকার নেই। এসময় হরিকাকা কিসের জন্য যেন ডাকে ওকে। ও পিছু পিছু যায়। পাশের পাড়ায় বৃদ্ধ কিরণ নাপিতের বাড়ি। ওর বাড়ি থেকে কিছু জিনিস আনতে হবে। ও নতুন সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে যায়। সাইকেলে যেতে ১৫ মিনিটের পথ। ও কিরণ নাপিতের বাড়ি থেকে জিনিসগুলো নেয়। মনে মনে ভাবে, ধুস এসময়ই এসবের দরকার পড়লো? তিতু নিশ্চয়ই নেমে এসেছে। দেখতে পাবে কি একবার? দেখতে পাবে না কি ছোট্ট ভীতু মুখ করে থাকা তিতুকে আজ কনের সাজে কেমন লাগছে? তবে ভেতরের দিকে গেলে যদি আবার কোনো কাজ ধরিয়ে দেয়! না, একটু সময় চেয়ে নেবে। জীবনে তো বেশি কেউ নেই, যারা ওর কথা একটু হলেও ভাবে। তিতু সেই গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে একজন। অন্তত বিয়েটা ও দাঁড়িয়ে দেখতে চায়, হয়তো আর কোনোদিন দেখাই হবে না তিতুর সঙ্গে। সাইকেলের গতি বাড়ায়। বেশ তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। ছোট গেটটা পেরিয়ে সাইকেলটা স্ট্যান্ড করতে করতেই ও বুঝতে পারে কিছু ভুলভাল ঘটে গেছে। ও এগিয়ে যায়। দেখে চারিদিকে বেশ কিছুজন ছোটাছুটি করছে। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। গুঞ্জন উঠেছে। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারে না ও এই ২০-২৫ মিনিটে কী হয়ে গেল? বাড়ির সবাই ঠিক আছে তো? ও এগোতে গিয়ে দেখে বড় গেটের বাইরে থেকে বড়বাবু আর দু চারজন ছুটে আসছে। ও মনে প্রশ্ন নিয়ে একটু এগিয়ে যায়।

বড়বাবু ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখ দিয়ে যেন জ্বলন্ত লাভা গলে গলে পড়ছে।

“তুই কোথায় ছিলি?”

“একটু বাইরে, ঐ কিরণ...”

বিপ্রতীপ কথা শেষ করতে পারে না, তার আগেই এক দুর্দান্ত আঘাত এসে পড়ে পেটে, ও মাটিতে পড়ে যায়। পেট ধরে ছটফট করতে থাকে। বুঝতে পারে না ঠিক কিভাবে ব্যাপারটা হলো। কে মারলো? পেট আর বুকের মাঝে শুধু তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। আর কোনো অনুভূতিই টের পাচ্ছে না। শ্বাসরোধ হয়ে আসছে যেন। এই কষ্ট কিছু ফিকে হওয়ার আগেই আরও কিল, লাথি, লাঠির প্রহার শুরু হয় ওর ওপর। অশ্রুসিক্ত চোখে ঠিক ঠাহর করতে পারে না তবে বোঝে বড় বাবু আর দুই তিনজন ওকে এলোপাথাড়ি ভাবে মারছে। এক দুটো কথা যন্ত্রণার বোধকে উপেক্ষা করে ওর মাথায় স্পন্দিত হয়।

“কোথায় তিতু… হারামজাদা? কোথায় রেখে এসেছিস? না বললে… মেরেই ফেলবো।”

একের পর এক আঘাতে বিপ্রতীপের শরীরের সমস্ত স্নায়ু যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। ও কথা বলতে চায়, জানাতে চায় চিৎকার করে যে ও কিছু জানে না, থেমে যেতে, ওকে আর মারতে না। কিন্তু কন্ঠ থেকে গোঙানি ছাড়া আর কিছুই বেরোয় না। এক মহিলার কন্ঠস্বরও ভেসে আসে। কান্নাযুক্ত আর্তি যেন। কিন্তু কি বলছে ওর বোধগম্য হয় না। ওর দেহের ছটফটানি ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে। আর প্রতিটা মার তেমন গায়ে লাগছে না। একই তীব্রতা সৃষ্টি করতে পারছে না। সোনালী আলোয় মোড়া চারিদিক আবছা হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। কেন মারছে এরা? মানুষ নয় তাই কী? না, মারতেই থাকুক। ও আর বাধা দেবে না। সমস্ত প্রতিরোধ ছেড়ে দেয়। মারুক, আরো মারুক। ঘুম আসবে তারপর? বিপ্রতীপ ছেঁড়া জামা প্যান্টে বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। আজ রাতের ক্ষিদে আর পাবে না। ঘুমিয়ে পড়বে এবার ও। মা আসবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে।

বিপ্রতীপ টের পায় আর ধস্তাধস্তি হচ্ছে না। কে যেন ওর মাথাটা তুলে নিচ্ছে হাতে করে। নরম কিছুতে শোয়ালো। কোল কী? হয়তো।

বিপু অস্ফুটে জিজ্ঞেস করে, “মা, একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে?”

“বিপু, ও বিপু, আছিস নাকি বাড়ি? একটু বাইরে আসবি?”

বিপ্রতীপ খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাইরে আসে। এখনো কিছুক্ষণ বসে থেকে হাঁটলে পায়ে আবার ব্যথা হয়।

“আয়, বস হারান।”

বারান্দায় রাখা দুটো মোড়ায় বসে ওরা।

“কেমন আছিস তুই এখন?”

“ঠিক আছি। তোর দোকান কেমন? শুনলাম, বড় শোরুম খুলেছিস বাজারে?”

হারান মাথা নিচু করে। “না রে, তেমন কিছু না, গলির দোকানটাকেই বাজারে নিয়ে গিয়ে একটু সাজিয়েছি।”

“বাহ, ভালো।” বলে বিপ্রতীপ চুপ করে যায়। বাইরের দিকে তাকায়। দুদিন আকাশের মুখ গোমড়ার পর আজ একটু হাসি দেখা যাচ্ছে, পড়ন্ত বিকেলের রোদ এসে পড়েছে ওর বারান্দায়।

“তুই এমন চুপ করে যাস কেন?”

“আমি তো কোনোদিনই তেমন কথা বলতাম না হারান। শুধু শুনতাম। শুনেছিলাম বোবাদের বেশি শত্রু নেই, তাও দেখ।” বিপ্রতীপ ওর পায়ের কালসিটে দেখায়।

“দেখ, কেউই তোর শত্রু নই। শুধু ঐ দিন...”

“আমি তো জানতে চাইনি, হারান। বল কি দরকারে এসেছিস?”

“না, তুই শুনতে না চাইলেও আমাদের বলতে হবে। নিজেকে এইভাবে সরিয়ে নিয়েছিস, যে আমরা ভেতরে মরে যাচ্ছি। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বাড়িতে এলি, তারপর আর একবারও এলি না।”

বিপু মোড়ায় দুহাত ভর দিয়ে মাথা নিচু করে সামান্য। হারান বলে যায়।

“দেখ, তোর ক্ষতি কেউ চায়নি। তিতলি, বড়মা তো নয়ই, আমি বা হরিকাকাও নয়। তিতলি বিয়েতে রাজি ছিল না। কলকাতায় পড়াকালীন ওর ওখানে একজনের সঙ্গে ভাব ভালোবাসা হয়। নিচুবর্ণের ছেলে। তাই যেদিন বড়বাবু জানতে পারেন সেদিনই ওনার ছোটবেলার বন্ধুর ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করিয়ে দেন। ছেলেটিকে একবারও চোখেও দেখতে চাননি। বড়মা বড়বাবুর জেদের কাছে চুপ করে গেছিলেন। কিন্তু শেষ অব্দি তিতলির খারাপ অবস্থা দেখে আর থাকতে পারেননি। স্বামীকে বোঝাতে পারতেন না। তাই ঠিক করলেন, মেয়েকে পালাতে সাহায্য করবেন। কিন্তু নজর এড়িয়ে বের করা সহজ না। বড়গেট দিয়ে বের করা যাবে না। একমাত্র পথ গলির সরু গেট। একটু আলো আঁধারি থাকে। সেইখানে সাইকেলে করে বেরোলে অতটাও সন্দেহ থাকে না। কিন্তু পুরোপুরি সন্দেহ নিরসন করার জন্য বড়মা বলেন, তোর পুরনো সাইকেলটা ব্যবহার করতে। ঘটাং ঘটাং শব্দ শুনে সবাই ভাববে, তুইই যাচ্ছিস। কেউ আর অত নজর করবে না। তাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন বড়মা বিয়ের আগের রাতে। তোর পুরনো সাইকেলটা আমার জিম্মায় ছিল। আমি যেন ওটাই সময়মতো পৌঁছে দিই। তারপর হরিকাকা তিতলিকে তোর সাইকেলে বসিয়ে ছেড়ে আসে স্টেশনে তুই ঐ সন্ধ্যেবেলা ঠিক বেরোনোর পরেই। ওখানে অপেক্ষা করছিল তিতলির প্রেমিক। সে তিতলিকে নিয়ে কলকাতায় যায়। ওদের বিয়েও হয়ে যায় তারপরের দিনই।”

হারান চুপ করতেই বিপু হোহো করে হেসে ওঠে। হাসির বেগ একটু থামতে ও জিজ্ঞেস করলো, “তোকে বড়মা এত গুছিয়ে বলেছে আমায় বলতে? আর কেন? সবাই খুব ক্ষমাপ্রার্থী?”

হারান কিছু বলে না। বিপু কিছু সেকেন্ড চুপ করে থেকে আবার বলে, “জানিস, ভাবতাম কিছু মানুষ মন থেকে ভালো চায় আমার।”

“ভালো চাই রে আমরা, বিশ্বাস কর। তাই তোকে জানানো হয়নি। যাতে তুই যে তিতলিকে নিয়ে পালাসনি, তার সাক্ষী থাকে। বড়বাবু অব্দি কিরণ জেঠুকে সম্মান করে। আর সত্যিই তুই কিরণ জেঠুর কাছে গেছিলিস। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমরা বুঝতে পারিনি বড়বাবু অত তাড়াতাড়ি বুঝে যাবে তিতলির যাওয়াটা আর তোকেই সন্দেহ করে ওরকমভাবে মারবে। একটু বিশ্বাস কর আমাদের।”

“আচ্ছা।” বলে বিপু চুপ করে থাকে। ওর গলাটা বুজে আসছে। কান্না পাচ্ছে। বুকে একটা পাথর ভেঙে যেতে চাইছে।

“বড়মা আমায় অনেকবার বলেছেন যাতে তোকে নিয়ে যাই বা যাতে তুই যাস।”

এইসময় বাইরে কিছু কচিকাচা হাঁক দেয়, “বিপুদা আজ পড়াবে না?”

“তুই আজকাল পড়াচ্ছিস?” হারান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

বিপু ঢোঁকের সঙ্গে কান্নাটা গিলে কষ্ট করে বলে, “হ্যাঁ।”

“তাহলে, আমি উঠি। তোকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল। বাইরে একটা বাইক দাঁড় করানো আছে। ওটা তোর জন্য। পায়ের এই অবস্থায় বেশি সাইকেল চালাস না।”

বিপু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। “না, হারান তুই ওটা নিয়ে যা। স্টেশন থেকে যে পুরনো সাইকেলটা ঐদিন নিয়ে এসেছিলিস, এটাই অনেক। আর কিছু চাই না। তুই বাইকটা নিয়ে যা।”

“তুই এখনো ক্ষমা করিসনি আমাদের? প্লিজ রাখ এটা। বড়মা খুব কষ্ট পাবে না নিলে। আমরা সবাই। প্লিজ।”

“ক্ষমা করার অধিকার নেই আমার। অনেক দিয়েছিস তোরা সবাই।”

“তাহলে প্লিজ বাইকটা রাখ।”

বাচ্চাগুলো ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। বিপ্রতীপ কথা না বাড়িয়ে বলে, “আচ্ছা, বাইকটা রেখে যা।”

হারান খুশি হয়। মনে এক শান্তি পায়। “কোনো দরকার হলে আমায় বলিস বিপু।” বলে বারান্দা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায়।

বিপ্রতীপ দেখে কচিকাচার দল বাইকটার চারপাশে ভিড় করেছে। ছোট্ট সুবীর বলে, “বিপুদা, বাইকটা তোমার?”

বিপু হাসে। “না রে। আমার না। শোন, আজ তোদের পড়াতে পারবো না। ঐ সেন্টারে যেতে হবে। কাল আসিস, কেমন?”

ছাত্রছাত্রীরা চলে গেলে ও কষ্ট করে বাইকটা বারান্দায় তুলে দেয়। ওকে এখুনি কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে যেতে হবে। বিকেলের শিফটের ছেলেটা থাকবে না। ওকেই সামলাতে হবে। ভাগ্যিস রাজ্য সরকার এই সেন্টার খুলে নতুন ছেলে খুঁজছিল। আর সৌভাগ্যক্রমে ও পেয়েও যায় এই ছোট্ট চাকরিটা। না, বিপু আর দাঁড়ায় না। ভেতরে গিয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা বাবার পাটা ছুঁয়ে বেরোয়। বাইকটার পাশে রাখা ওর পুরনো সাইকেলটা বের করে ও। ও এই বাইকটা ততদিন চালাবে না যতদিন এর দাম বড়মাকে দিতে পারে।

সাইকেলের সিটে বসে ও। প্যাডেল ঘোরায়। হাঁটুতে ব্যথা হচ্ছে অল্প। একটা কটকট আওয়াজ হয় কেন জানি হাঁটুতে চলতে ফিরতে। সাইকেল চলতে শুরু করে, ঘটাং ঘট ঘটাং ঘট।


অলংকরণ : প্রমিত নন্দী

পথটা আরও সোজা

সায়ন রায়



দশ হাজার লোক হেঁটে চলেছে রাস্তায়
একজনের মুখোশ শুধু খোলা
কলকাতার পথে পথে মৃতদেহ পরে আছে
সময়ের হাতে পাঠশালা।
স্বাধীন মানে, পরাধীনতা কম, কম করে
আজ বাধা গুনবে তুমি
বাহার সাজাতে কল্পনা চাই খালি
পালাতে লাগে স্থলভূমি।
যখন এসেছে প্রথম মানুষ, আদম ডাকো যাকে
হেসেছে কখনও আগে?
জল গড়ালেই কান্না হয় না
সুখ দেখাতে লাগে।
তবু হাঁটতে থাকে সবাই, সামনে আরও সামনে
কিন্তু সবার দু চোখ বোজা;
আবছায়া তাই, মরীচিকাতে জিরোয় শুধু বালি
পথটা আরও সোজা।

অলংকরণ : নীলাদ্রি ভট্টাচার্য্য

পেশেন্ট নাম্বার ইলেভেন

অর্ঘ্যদীপ ঘোষ


নির্মীয়মাণ নাকি পরিত্যক্ত বোঝা মুশকিল। অনেক উঁচু ওই ফ্ল্যাটবাড়িটার ধার ঘেঁষে এখন একটা নাম না জানা পাখি উড়ছে। দূর থেকে তাকে চিলের মতো দ্যাখায়। দু'টো ডানা টানটান করে মেলে রেখে, সে ভেসে থাকছে বাতাসে...

আমরা যারা উড়তে পারি না একটুও, অথচ দূরদর্শনে শক্তিমান দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম আশৈশব, এমন দৃশ্যে খানিকটা বিষণ্ণতা মিশিয়ে দিই ইচ্ছে করেই। তারপর মানানসই একটা ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর খুঁজতে খুঁজতে আমরা হারিয়ে যাই অনেক দূরের কোনও দেশে।

পথে দেখি, কুয়াশা ভেদ করে, কাশবনের ভেতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে হোগওয়ার্টস এক্সপ্রেস... আওয়াজ হচ্ছে টংলিং টংলিং টংলিং...আর তাকিয়ে তাকিয়ে সেই চলে যাওয়াটুকু দেখছে দুই মুগ্ধ ভাইবোন। ওদের জন্য ম্যাজিক শেখার ইস্কুল থেকে চিঠি নিয়ে কোনও প্যাঁচা আসে নি কখনও।

দেখতে পাই, খরগোশের গর্তে নেমে হারিয়ে গেছে অ্যালিস নামের যে মেয়েটি, তাকে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে শার্লক হোমস আর ডক্টর ওয়াটসন, আপাতত একটা ছোট্ট জাহাজে করে পারি দিয়েছেন টর্টুগার উদ্দেশ্যে। ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোর সেই কম্পাসটা ওদের খুব দরকার।

ফটিকচাঁদকে দেখি, ঘাড়গুঁজে কাজ করে চলেছে। সাততলার ওপরে মস্ত বড় অফিস। আজ নাইট শিফ্ট ওর। ডেস্কের ওপর, ল্যাপটপের একপাশে রাখা আছে তিনটে রঙিন বল। হারুণদার দেওয়া।

পাতালঘরের দরজা ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি হোডরকে। ভূতনাথদার মহাকাশযানটা বোধহয় এতক্ষণে ঠিক পৌঁছে গেছে লিটিল প্রিন্সের ফেলে আসা সেই গ্রহে। কিন্তু অনেক খুঁজেও, লিটিল প্রিন্সকে আমি দেখতে পাই না কোথাও।

আর এইভাবে দেখতে দেখতে, দেখতে দেখতে, শুধুই বয়স বেড়ে যায় আমার। নাম না জানা ওই পাখিটার মতো, ওই ফ্ল্যাটবাড়িটার মতোই দূরের মনে হয় সবকিছুকে। তারপর, হঠাৎই, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের অমোঘ নীরবতাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে একসময়ে ডাক আসে, "পেশেন্ট নাম্বার ইলেভেন, মিস্টার দীপ..."

আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি। হলদে পাখির পালক, কোনও ওষুধের দোকানে পাওয়া যায় না আজও।

অলংকরণ : হিমাদ্রি নায়ক