সম্পাদকের কথা

টুকটুক করে বছর শেষ হতে চলল । শীত বাবাজীবন গেছো দাদার মতো এই আছি, এই নেই করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেউ খবর পড়ছেন, কেউ খবর হচ্ছেন, বাকিরা ভালো আছেন। গুজরাত নির্বাচন, বিরাট বিবাহ, জঙ্গিহানা, শিল্পচর্চা, শিশুকন্যা ধর্ষণ, ম্যানহাটনে বিস্ফোরণ, নতুন ফোনের আমদানি, নেতাদের বকবকানি, মহাকর্ষ তরঙ্গের খোঁজ, বিক্ষোভ, মারামারি, এসব, স—অ—ব, হয়ে চলেছে একসাথে, বীভৎস দ্রুততায়। আর এই নীল গ্রহটা অধিবাসীদের সমস্ত পেঁয়াজি সহ্য করে বাঁই বাঁই করে পাক খেয়ে চলেছে ২০১৭ থেকে ২০১৮-এ।

নিরুদ্দেশী

ছন্দা মান্না পন্ডিত

হঠাৎ বিকেল শ্রান্তদেহী জানলা কাঁচে
নিরুত্তাপের দাবানলে এলোকেশী।
ছাই রেখে যায় বুকের ভেতর বুনট ছাঁচে
ঠিক অবিকল সেই চেহারা নিরুদ্দেশী।

ঈশানী কোন্ বাতাস এলে ছাই উড়ে যায়
স্পর্শে কেবল আঙুল আঁঠা জমতে থাকে।
খুব গোপনে বারুদ রাখো ঠোঁটের তলায়
উদাসিনী জ্যোৎস্না কিনে সাজতে থাকে।

বুকের ভেতর বেআব্রু মন হালকা তাপে
কাজলা নদী সরীসৃপের শরীর আঁকে।
ছাই রঙা হাত, মায়াবী চোখ চিবুক মাপে
উদাসিনী জ্যোৎস্না গায়ে ভিজতে থাকে।

বিষাদী মন যেই ছুঁয়ে নেয় ঠোঁটের পালক
দমকা আঁচে বারুদ তখন ঘ্রাণ মেখে নেয়।
নিরুদ্দেশীর ছাই উড়ে যায় আগুন জ্বালক
একলা মেয়ে বারুদ আঁচে বুক পেতে দেয়।

এমনি করেই রোজ জ্বলে যায় অভিমানী
আরেকটি বার নিরুদ্দেশীর ছোঁয়ার আশায়।
ছাই রঙা মন বৃষ্টিমেয়ের হৃদয় খানি
ভালবাসে জ্বালতে শুধুই অবহেলায়।

অলংকরণ - অভিষেক ঘোষ

অরোরা বরিয়ালিস

পারিজাত ব্যানার্জী


“যাই হোক না কেন, পৌঁছতে হবে।”

“যাঃ, ‘যাই’ দিয়ে আবার কোনো গল্প শুরু হয় নাকি! ছোটবেলায় পড়নি, ‘যে’, ‘যা’ এসব দিয়ে কিছু শুরু হয় না!”

হো হো করে হেসে উঠল আরশি। “ওইসব এবড়োখেবড়ো ‘ব্যাকারণ মানি না!’ তবে পৌঁছতেই হবে, জানি। দেরী করলে চলবে না।”

ক্লান্ত লাগে অয়ন্তিকার। পা দুটো হঠাৎ বড় শিথিল হয়ে যায় তার। ইশ! এভাবে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে! মুখে অবশ্য অন্য কথাই ফুটে ওঠে, হয়তো নিজের অজান্তেই। যদিও নিজের কোটরে বাসা বাঁধা এত ন্যানো সেকেন্ডের এত কথা আর কতটাই বা জানতে পারে কেউ!

“পথ যে এখনও অনেক বাকি আরশি! এতটা পথ যেতে সময় তো লাগবেই। সময় তো দিতেও হবে খানিক, না হলে যাওয়ার পথটাই তো ফুরিয়ে যাবে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই!”

আরশি চোখ টিপে হাসে এবার। তার প্রাণবন্ত মুখের সমস্ত রেখায় দুষ্টুমি মেখে যায় ভাল করে। “পথে কত বাধা থাকবে জানো? কত বাঘ, কত ভাল্লুক, কত মন্ত্রণা, কত উপদেশ! এসব থেকে বাঁচতে গেলে একটাই উপায়; তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে হবে পথটাই! বুঝলে? বেশী দেরী করলে ঘোড়া ছোটালেও আর গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেনা। কোনোদিনই!”

মনে পড়ে অয়ন্তিকার। হ্যাঁ, ঘোড়া! তার ঘোড়াটা কোথায়। তার সেই ধূসরাভ ‘তেজস্বিনী’? অনেকক্ষণ ধরে তো হেঁটেই চলেছে সে। কই, তেজস্বিনীর দেখা তো নেই! তবে কি ভুল পথ ধরল ও? এ পথে বিষধর শাপ আছে, জঞ্জাল রয়েছে, পা জড়িয়ে যায় প্লাস্টিকের স্তূপে কিন্তু সুলুকসন্ধান হয় না! কোথায় সেই ‘অরোরা বরিয়ালিস’! কোথায় সেই মায়াবী আলোর খেলা! এবার যে পা চালাতেই হবে! এত অনুষ্ঠান, এত আয়োজন— সব যে না তো শেষ হয়ে যাবে, শুরু হওয়ার আগেই!

কি বুঝল আরশি কে জানে! আড়চোখে তাকালো সে শুধু। “ওই দূরে পাথুরে বাঁকটা দেখতে পাচ্ছো, ওটা পেরোলেই গভীর সুড়ঙ্গ দেখতে পাবে। মাটির বুক বরাবর কাটা ওই পথ। অতটা পথ একাই যেতে হবে। তারপর মিলবে তেজস্বিনীর দেখা। আদিমতম গুহামুখের সামনেই রয়েছে ওদের আস্তাবল। রাত শেষের আগে না পৌঁছতে পারলে কিন্তু বিপদ।”

শঙ্কিত হয় অয়ন্তিকা। “কি বিপদ? সেই বাঘ ভাল্লুক? সেই মৃত্যু?”

“ওমা! মৃত্যুতে আবার ভয় কি? ভয় তো এই বেঁচে থাকাকেই!” নিরুদ্বেগে চকচক করে ওঠে আরশি।

“মানে!” বাঁকের আগেই দাঁড়িয়ে পড়ে অয়ন্তিকা। মাথার দুদিকের শিরা দুটো দপদপ করছে তার। উফ! আবার ওই মাইগ্রেনের ব্যথা কি তবে ফিরে এলো? এই তো বেশ ফুরফুরে লাগছিল কিছুক্ষণ আগেই। সত্যিই, সবই কি ভীষণ ক্ষণস্থায়ী!

“আরে, তুমি তো দেখছি এ যাত্রায় সবই ডোবাবে! কত করে বলছি যে চলো! দেরী করো না! যত দেরী করবে, বিচলিত হবে, তত এক পা এক পা করে পিছিয়ে পড়বে তুমি! কিছুতেই শেষরাতে দৌড়েও কিনারায় উঠতে পারবে না তখন। খেয়াল রেখো, পথ কিন্তু দুর্গম!”

অয়ন্তিকা আশপাশটা আর একবার দেখে। কই, তার তো তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। প্রথমদিককার অসুবিধেগুলো পেরিয়ে পথ এখন অনেকটাই প্রশস্ত। অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়ায় এখন আর ততটা অস্বস্তিও হচ্ছে না!

তার মনের কথা টুক করে পড়ে নিলো আরশি। খুব বাজে স্বভাব এটা ওর। বরাবরের। “এখন অসুবিধা হচ্ছেনা ঠিকই। কিন্তু এই নিজেকে সইয়ে নেওয়াটাই বড় বিপদের, সেটা মানো তো! যতক্ষণ তুমি বিবাদ প্রতিবাদে থাকবে, চিৎকার করবে, অসহযোগিতা করবে, কিছুতেই মেনে নেবে না কিছু, ততক্ষণই শান্তি। চারদিকে এই যে সব মৃতদেহ পড়ে, পিশাচেরা গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছে রক্তের গোগ্রাসে গিলবে বলে সব, অথচ তুমি কেমন মানিয়ে নিয়েছো, ভবিতব্য বলে উড়িয়ে দিচ্ছ আমার কথা ক’টাও, চিন্তা এখানেই। চেয়ে দেখো, অর্ধেক পথও কিন্তু পাড়ি দিইনি আমরা এখনও! সুড়ঙ্গ শেষে রক্তাভ নদীর উৎসে ঠাণ্ডা জমাট বরফের দুর্ভেদ্য পাহাড়ের প্রাচীর, সে খেয়াল আছে তো! হামাগুড়ি দিয়ে, খুব আস্তে আস্তে সেই পথটুকু কিন্তু পেরোতে হবে! তবে সাবধান, পিছন ফিরে চাইবে না। তেজস্বিনী থাকবে তোমার পিছনে। চিন্তার কিছু নেই।”

“আর তুমি?”

“আমি? আমার কি আর ঠিক আছে গো! কখন আছি, কখন নেই! এই সুড়ঙ্গের কত খানাখন্দ, সব কি আর আমি নিজেও জানি? কখন কোথায় ঠোক্কর খাবো, তলিয়ে যাব মহাশূন্যে! তুমি তা বলে আবার থেমে যেও না! তোমার যা স্বভাব! একটুতেই অমনোযোগী হয়ে পড়ো। এপথে কিন্তু একদম ওসব নয়! খেয়াল রাখবে, শুধু ভোরের আলো ফুটতে দেওয়া যাবে না। ওই অতিপ্রাকৃত আলোর জাল থেকে তোমারও তখন নিস্তার হবে না কিন্তু! বুঝলে, ওসব আলো দূর থেকে দেখাই ভালো, নিজের মধ্যেই বিচ্ছুরণ শুরু হলে কিন্তু মুশকিল! খাঁচায় আটকানো বন্য জন্তুর মতো অবস্থা হবে তখন। জল, খাবার সব বসে বসেই পেয়ে যাবে, অথচ কোথাও বড় একটা গরমিল থেকে গেল, ঠিক ধরতে পারবে!”

অয়ন্তিকা বুকে-হাঁটা শুরু করে। সমস্ত জাগতিক বস্তুর ভর এখন তার বুকের উপর সুস্থির। হাত পা ছড়ে যাচ্ছে, কপালটাও ঠুকে গেল শূন্যে জমাট বাঁধা একতাল বরফে! কুচিকুচি বরফরাশি জমা হয়ে এমন পুরু দেওয়াল উঠল কবে? কই, আরশি তো বলেনি এর কথা আগে!

ঝনঝন করে শব্দ হল। তবু অয়ন্তিকা পিছন ফিরে চাইল না আর। আরশি মানা করেছিল। ফেলে আসা সবকিছু ঠিকই থাকবে। যেমনটা থাকে আর কি! ‘ঠিক’, ‘ভুল’ বলে তো আর কিছু হয় না। সবই হতে হয়, তাই হয়। যেমন এই অভিযাত্রায় সামিল হওয়া তার ভবিতব্য, এরও কি আর খারাপ ভালো আছে? সমগ্র চেতনা জুড়ে এই যে অপরিসীম কষ্ট, আবার অ্যানাসথেসিয়ার ঘোরে সব শুনতে বুঝতে পারলেও দিব্যি অভিব্যক্তিহীন থাকা যাচ্ছে, এই তো ঢের!

অয়ন্তিকার হাতের উষ্ণতায় বরফের প্রাচীর গলে জল হয়ে গেল একসময়। তবু, সময়ে যে সব শেষ হবে না আর তাও আর একবার মালুম হল বইকি! এতটা এসে ফেরাও সম্ভব নয়, সে রাস্তায় গুমোট দমচাপা আলো আঁধার! এধার থেকেই দেখা যায় সে পথও। না দেখা যাওয়াটাই যদিও ঠিক হতো বোধহয়!

ওই, ওই তো সুড়ঙ্গ শেষ! ওই তো তেজস্বিনীর টানা টানা দুটো চোখ! কিন্তু আদিম এই গহ্বরের মুখের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে কেন ও? ওখান দিয়েই তো অয়ন্তিকার বেরোনোর কথা! “এই যা! সরে যা! আলো দেখব। ‘অরোরা বরিয়ালিস’! তার আগে কত কাজ বাকি রয়ে গেছে! সেরে ফেলতে হবে তো! কোটি কোটি বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা শৃঙ্গজয় করতে হবে, ভাসতে হবে রক্তাভ নদীর প্রাণরস সুধায়— সর, সরে যা বলছি! আহ! অমন জোরে ডাকিস না। সবাই শুনতে পেয়ে যাবে! ছুটে আসবে। আমার এদেশে আসার ভিসা দেখাতে বলবে! আমি যে সব তার কেটে পালিয়ে এসেছি! নাঃ, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার! চুপ কর! একদম চুপ! নাতো—নাতো এই নে!”

সামনেই পড়ে থাকা স্বচ্ছ বরফের ধারালো অস্ত্র তুলে নেয় অয়ন্তিকা। তারপর কোপাতেই থাকে এলোপাথাড়ি আর কিছু না ভেবে। কোপাতেই থাকে, যতক্ষণ না সব ডাক নিস্তব্ধ হয়ে যায় একেবারে।

বাড়ির পাশের গাছটায় সব পাখিরা একসাথে ডেকে ওঠে কাকভোরে। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে অয়ন্তিকা। উফ কি বীভৎস স্বপ্ন! চোখদুটো ভালো করে মুছে আড়মোড়া ভাঙে সে। যাঃ, ভোরের আলো যে ফুটে গেল! সেই আরশি বলেছিল না—

ঘরের এককোণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কাঁচের টুকরোগুলো। কি জানি কোন অদেখা ঝোড়ো হাওয়ায় অমন করে ভেঙে গেল আয়নাটা! নাকি বরফের প্রাচীরের ওই বেসামাল ধাক্কাই কেড়ে নিলো আরশিকে! ও যে বড্ড পলকা! দোকানের ওই কর্মচারীটা অবশ্য আগেই বলেছিল!

নাঃ, এবার একটু দাম দিয়ে দেখেশুনে কিনতে হবে আয়না। ওকে আর ভাঙতে দেওয়া যাবে না! নাহলে যে ‘অরোরা বরিয়ালিস’-এর এই গোলকধাঁধা খেলা শেষ আর হবে না কিছুতেই!

অলংকরণ - মার্গারেট জন উলম্যান (শাটারস্টক)

খোঁজ

সুদীপ্তা রায় চৌধুরী মুখার্জী

জানি এখনো কিছু অবাধ্য জলকণা ছড়িয়ে আছে আমার দুচোখে,
তবুও এ চোখে শরতের আল্পনা।
আয় আবার খুঁজতে থাকি তোকে,
তোকে হারিয়েছিলাম কত যুগ আগে,
খাজুরাহোর মন্দিরে,
সেই থেকে খোঁজ আজও চলেছে।
কখনো মরুপ্রান্তরে
কখনো পাহাড় শিখরে
আমি করে চলেছি তলাশ
আমি আজো হইনি হতাশ।।
আলতামিরার প্রাচীন বাইসন,
তারা জানে এই আকুল অন্বেষণ
তাজমহলে থমকে ছিল যে হাওয়া,
তারও প্রশ্ন, এখনো কি যায়নি তোকে পাওয়া?
দ্বাপর যুগেতে কাঁপতো বাঁশীতে বৃন্দাবন,
আজ অবাধ্য রিংটোন তুলছে ঝড়।।
ডাক সেই একই, শুধু ভাষা পাল্টেছে ঘর,
একুশ শতকে পাল্টালো সবকিছু,
তবু কিছু অবরোধ আজও পেলো না ছুটি,
বাঁকা চাহনি আজও করছে পিছু।।
রিয়ালিটি শো, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম
রাতের ইন্টারনেটে চলছে নিয়ম ভাঙার খেলা...
তোর খোঁজে প্রতিপলে হারাই নিজেকে,
জানিস তোর খোঁজটা একটা বাহানা...
আদতে আমি পালাতে চাই...
নিজের থেকে,
নিজের অসহায়তার থেকে,
নিজের ব্যর্থতা থেকে,
নিজের সকল বাধ্যতামূলক আপোষগুলির থেকে,
আমার ঘরজোড়া অন্ধকার থেকে,
আরো আরো অনেক অজানা ভয় থেকে...
জানিস আমায় ঘিরে মাথাচাড়া দিচ্ছে
মহাশূন্যের ব্ল্যাকহোল।।
আমি একটু একটু করে
অতলে তলিয়ে যাচ্ছি।।
কোনটা সত্যি?
তোর খোঁজ?
না আমার পলায়নপরতা?
সময় নিরুত্তর...

অলংকরণ - ক্রিস হাউইস (আলামী)

দেখবো বলে

রুমেলা দাস

চোখ বুজলেই মনে হয়,
মেঘ ধরছি দুহাতে
স্বপ্নালু নীল থেকে চুঁইয়ে নিই
আদুরে ওম্।
ধ্রুবতারার সত্যি থেকে
নির্যাস তোর ফিরে আসার।

জমা হওয়া গোল জল
দু-পায়ে লাফিয়ে
সেই দিনের আদর মাখি,
ধূলো মাখা রেলিঙে
লেগে থাকে আমাদের বাসিকথা।

তুই কি ফিরবি?
ফিরতে পারবি!
নখের অন্তিমে লুকানো ফোঁটা
পরতে পরতে সিমেন্ট আর সুরকির
আড়ত;
চোখ বুজলেই মনে হয়
আরো একবার
হাস্নুহানা ফুটলো বলে।

অলংকরণ - প্রমিত নন্দী

নামহীন

সই

রেল গাড়ি যাচ্ছে, মাঠ পেরিয়ে, রাস্তা ছেড়ে,
ওই নীল আকাশের সাথে, সর্ষে ক্ষেতের
পাশ দিয়ে মন যাচ্ছে ছুটে ছুটে, হলুদ মেখে।
হঠাৎ যদি বৃষ্টি নামায় লুকিয়ে থাকা কালো মেঘ,
হাত বাড়াবে জানালা থেকে তুমি, কি যেন নাম?
ধানসিঁড়ি! না সাঁঝবাতি! নাকি অন্য কোনো নাম!
চিকন কালো শাড়িতে তোমার নীল বিষের রঙ।
তৃষাতুর চোখে তোমার চাতকসম আকুলতা,
এলোমেলো বাতাসে তোমার এলোকেশ, সান্ধ্যমেঘ!
আড়াল করে, আড়াল করে আনন, জড়িয়ে ধরে
ঠোঁটের ভাঁজের গভীর খাদের শুষ্ক কিনারায়।
তখন আমি ডাকাত সাজি, হাওয়ার সাথে মিশে
যাত্রা করি তোমার অতলান্তে, নিশ্চুপে, বেহায়া আমি নির্লজ্জতায়;
মিশে যাই ল্যাম্পপোস্টের আলোয়, প্রেম হয়ে চুঁইয়ে পড়ি শরীর দিয়ে।
অন্ধকারে প্রহর গুণি, প্রমাদ হয়ে জরিপ করি তোমার ’পরে;
তোমার বিপ্রতীপে থাকি, আঁখিতে মিশে যাই,
পড়ে রই নিস্তেজ ভারহীন সূক্ষ্মতায় তোমার কুহেলিসম বুকে, ভীষণ গভীরে!

এক মুঠো বালিয়াড়ি

অনুপ বৈরাগী



যদি তুমি ফিরে আসো অবেলায়
দুমুঠো চাল রাখা আছে চুলোর ধারে

দুপুরস্নানের ফিসফাস কানে আসে
“খুন করে ফেরার হয়েছে মরদ”
এ’কদিনে গেছি জেনে
মানুষ কোতোল করে খুনি হতে হয়
সুখের মুখে ঝাঁটা মারে যারা
থাবার আঁচড় কাটে ভাতের থালায়
খিদের নোলায় ঢালে নুন জল
গলা টিপে মেরে ফেলে রাতঘুম
তারা নাকি কালজয়ী! সাধুপুরুষ!

জোনাকির পথ ধরে যদি ফিরে আসো
বাড়া ভাতের পাশে নুন রাখা আছে
হাতপাখা মুঠো করে বসে আছে ফাটা সিঁথি
ভাগাড়ে জমছে লাশ
লাঠি ঠুকে থানাদার বলে গেছে
খাল্লাস! খাল্লাস!

চোখের আগুনে ফুঁ দিয়ে চলে যেও
তুঁসের চাদরে পুষে রাখি
গলনের লীনতাপ
গোটা রাত

কুটুম কাটাম

দেবায়ন কর


পিকচার আভি বাকি হ্যায়

কেয়া রায়


প্রথম পর্ব

একেতেই আজ রবিবার। দুপুরের ভোজনপর্ব সেরে প্রায় সব বাঙালিই নাকে সরষের তেল ঢেলে ঘুম দিতে ব্যস্ত। ফলে শত দরকারের সময় কাউকে ফোনে পাওয়া বিশাল চাপের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অগত্যা নিজের ঘরের সামনের ব্যালকনিতে ইতস্তত ভাবে পায়চারি করছে কিংশুক। কোনও প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে মনে হল এখানে ওখানে। চুলগুলো উস্ক-খুস্ক, গালভর্তি দাড়ি, জিনসের ওপর পাঞ্জাবি পরা, বাঁ হাতে সিগারেটটা পুড়ছে আর ডান হাত পাঞ্জাবির পকেটে। বাইরের পরিবেশটাও গুমোট হয়ে আছে অনেকক্ষণ যাবত। কে জানে বৃষ্টি হবে হয়তো শেষ রাতের দিকে। কিংশুক পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে ডায়াল করল কাকে একটা যেন। ও প্রান্ত থেকে সেই ব্যক্তি কল রিসিভ করতেই কিংশুক বেশ ঝাঁঝিয়ে উঠল, “দেখুন সুজিত বাবু, আপনাকে ঠিক যতটুকু করতে বলেছি, ঠিক ততটুকুই করবেন। এর চেয়ে একচুল বেশি বা কম যেন না হয়। কাজ হলে বাকি ৭০% টাকাও পেয়ে যাবেন সময়মতই। ওকে বাই!”

ফোন রাখার পর কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিংশুক, “নাহ আর বেশি ভাবলে চলবে না, আব তো যো হোগা দেখা জায়েগা।” এইসব মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, ঠিক তখনই কিংশুকের স্ত্রী সায়নী চা নিয়ে ঘরে ঢুকল।

নেই তবু আছে

প্রতিম দাস




গত চার বছরে কতবার যে বাড়ি ভাড়া নিলো আর ছাড়লো ওরা তার ঠিক ঠিকানা নেই। তিনজনের সংসার । সোহিনী, সঞ্জয় আর ওদের আট বছরের মেয়ে সৃজা। বছর সাতেক আগে থেকে অবনতির শুরু। একের পর এক প্রতিকূল পরিস্থিতির চাপে পড়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে নিতে ব্যবসাটার বারোটা বাজিয়েছে সঞ্জয়। অবশ্য, কয়েকজন কর্মচারীর বেইমানিও দায়ী। আগে কাজের ক্লান্তি চাপ কমাতে দু পেগ করে মদ খেত সঞ্জয়। সেটা এখন নেশায় পরিণত হয়েছে। তার সাথে ছিল এবং আছে ক্রিকেট খেলা দেখার নেশা। একাধিক কেবল চ্যানেল এবং আই.সি.সি-র দৌলতে এখন তো বছরে ৩৬৫ দিন ক্রিকেট। এই দুই নেশার বাঁধনে পড়ে সঞ্জয়ের আর্থিক অবস্থা দিন দিন নিম্নগামী।

মদের নেশা ইদানীং হয়েছে। ক্রিকেটের নেশা আরও সাঙ্ঘাতিক। আট বছর আগের ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের দিনটার কথাই ধরা যাক। যেদিন সৃজার জন্ম হয়। খেলা দেখার উন্মাদনায় সোহিনীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়টা পর্যন্ত দিতে পারেনি সঞ্জয়। আর তার জন্য ঘটে যাওয়া ঘটনার সূত্রে সোহিনী কোনও দিনই সঞ্জয়কে ক্ষমা করতে পারবে না।

ফুল

নীলাঞ্জনা মন্ডল


–এই ফুলি, ফুলি কি সুন্দর গন্ধ রে মা এটায়! ওটা দে, ওটা দে.. আহ! কি খুশবু। এটা রাজা বল? আচ্ছা, তুই যে এগুলো পেড়ে আনিস, কেউ দেখলে কী হবে জানিস?

–কী হবে গো? ওরা তো কেউ নেয় না, তাই আমি নিই। জানো তো, ওই বাড়িতে একটা ছেলে আছে, একভাবে তাকিয়ে থাকে আমি ফুল পারলে। মাঝে মাঝে হাসলে লালা গড়ায়। কেমন জানো!

–ওরকম বলে না সোনা, ওর বোধহয় বড় অসুখ।

–ছাড়ো না মাসি, শোনো ও বাড়িতে খুব সুন্দর গন্ধরাজ লেবুও আছে জানো, কিন্তু হাত পাই না। খুব উঁচু.. কিন্তু চিন্তা নেই। আর বড়জোর ৭–৮ দিন, ততদিনে ঠিক নাগাল পেয়ে যাব। তোমার জন্য না ইয়াব্বড় লেবু নিয়ে আসব। ভাত দিয়ে মেখে খেলে দেখবে রাজা রাজা মনে হবে।

একটি প্রাগৈতিহাসিক গল্প

বিভাবসু দে


গল্পটা যে ঠিক কবেকার তা আমারও জানা নেই; কি করে জানব বলুন, সাল-তারিখের হিসেব যে তখনও শুরুই হয়নি। যীশু খ্রিষ্টের আসতে আরও আটষট্টি হাজার বছর বাকি, মানে গড়পড়তা প্রায় সত্তর হাজার বছর আগের কথা বলছি। না না, ভুল লিখিনি, সত্তরের পর তিনখানা শূন্য বসালে যা হয়, তাই বলছি। ইতিহাসের বইয়ে পাবেন না, ইতিহাসকার নামক মহাপুরুষেরা তখনও যে অবতীর্ণই হননি পৃথিবীর বুকে; এমনকি মহাকাব্যের গণ্ডিও অতদূর বিস্তৃত নয়। মোদ্দা কথা এটি একটি প্রাগৈতিহাসিক গল্প, যা শুধু ধরা দেয় কল্পনার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা কোনো কোনো উন্মাদোতর লেখকের প্রলাপে!

সে সময় পৃথিবী এক আজব রূপান্তরের মধ্য দিয়ে রোজ ঢেলে সাজাচ্ছে নিজেকে; হিমযুগ সবে শেষ হয়েছে, কিন্তু সেদিনের পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা আজকের থেকে অনেকটাই কম। সেদিনকার পৃথিবী গোটা একটা পৃথিবী ছিল, কাঁটাতারের বেড়া তখনও তাকে দেশে দেশে টুকরো করেনি। বিবর্তনের বহু ধাপ পেরিয়ে আধুনিক দেহকাঠামোযুক্ত মানুষেরা দেখা দিয়েছে পৃথিবীর বুকে, কিন্তু একুশ শতকের বিশ্বনিয়ন্তা মানুষ হতে এদের এখনও অনেক পথ-চলা বাকি। সভ্যতা বা পরিবার বলতে যা বোঝায় তা এখনও ঠিক শুরু হয়নি, তবে পারিবারিকতার বীজবপন হয়ে গেছে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের মধ্য দিয়ে। এই গোষ্ঠীজীবনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মিলে চলার, একতার মন্ত্র, যা আরও বহু হাজার বছরের দীর্ঘ যাত্রাপথের শেষে নিজেকে মেলে ধরবে এক মহান সভ্যতা রূপে, যার বুকের গভীরে সযত্নে সঞ্চিত থাকবে আত্মীয়তা, ভালোবাসা, সহানুভূতির নির্যাস।

মাতৃস্নেহ

অঙ্কন মুখোপাধ্যায়


১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি চার দফা দাবি পেশ করেন, এর কিছুদিন পর ২৫শে মার্চ উনি বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করেন। সেইদিনই, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে সেনা অভ্যুত্থানের নির্দেশ দেন, শুরু হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে নির্বিচারে গণহত্যা পর্ব।

পশ্চিম পাকিস্তানের, সেনাদলের রেজিমেন্টে একজন সাধারণ সৈনিক হিসাবে, আফজলের আগমন ঘটে। আফজল বয়সে পাকিস্তান রাষ্ট্রের থেকে মাত্র তিন বছরের বড়। অন্যান্য হাজারও সৈনিকের মতই, সে এদেশে হত্যালীলায় ঘাতকের ভূমিকায় অংশগ্রহণ করতে এসেছে। বয়স এতটা কম হলেও, মানুষ মারতে আফজলের হাত কাঁপে না । আসলে ওদের ওইভাবেই তৈরি করা হয়েছে, নির্মম, ক্ষমাহীন, হিংস্র।

আফজল পাকিস্তানের লাহোরে বড় হয়েছে, যদিও আশ্চর্যের বিষয়, ওর জন্ম যশোরে। বুনিয়াদী শিক্ষা, মৌলবাদী চিন্তাধারা, ধর্মের গোঁড়ামি ও ঠুনকো ঔদ্ধত্য এগুলো ছোটবেলা থেকেই পেতে শুরু করেছিল লাহোরে। এর উপর ওর মায়ের অনুপস্থিতি, বাবার ওর প্রতি ক্রুর ব্যবহার... সব মিলিয়ে ছেলেটার মধ্যে মানুষের প্রতি ভালবাসা, মানবতার উপর বিশ্বাস, মায়ামমতার ছিটেফোঁটা নেই।