নববর্ষ সংখ্যা

প্রচ্ছদশিল্পী - রুমেলা দাস


(প্রতিটি লেখা Hyperlink করা আছে। লেখার ওপর ক্লিক করে পড়ুন।)



গল্প

জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা মলয় রায়চৌধুরী
একটি প্লাবনের ইতিবৃত্তকথা দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
মেজদাদা আর কম্বক সিরাপ সহেলী চট্টোপাধ্যায়
কামধেনু দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
রিমেইনস টু বি সিন মোঃ ফুয়াদ আল ফিদাহ
ইঁদুরের স্বর্গীয় ভাণ্ডার বিভাবসু দে
অপেক্ষা পিনাকী ঘোষ
স্কুল শেষের দিনগুলো অনিন্দ্য রাউত
পায়ের ছাপগুলো সই
ঠাকুরঘরে কে? অনিমেষ ভট্টাচার্য্য

অন্যরকম


জীবনস্মৃতি


কুটুম কাটাম


ধারাবাহিক


কবিতা

বিশার্ত শুভদীপ সেন
আমার মা অনিমেষ গুপ্ত
ফাগুন অভিজিৎ খাঁ
সার্থকতা দেবার্ঘ সেন
মাতাল সুপ্রীতি বর্মন
আর্জি রজত দাস
কবিতা লেখার পাপ শুভঙ্কর দেবনাথ
বললেই বা কী? সায়ন রায়
আসা যাওয়ার মাঝে চিন্ময় বসু
বৃদ্ধি পুষ্পদিন অভিষেক ঘোষ
নতুন বছরে স্নেহাশিস পালিত
জন্মসূত্রে ধুলো বোর্ডের অংকে সোনালী মন্ডল আইচ
স্তন বিশ্বজিৎ সাহু
রক্তাক্ত হোলি তপন বাড়ৈ



সম্পাদকের কথা

প্রিয় পাঠকবন্ধুরা,

প্রথমেই সবাইকে জানাই নতুন বছরের বুকভরা ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা। আরো একটা বছর ঘুরে গেল। গরম অনেকদিন ধরেই পড়ে গেছে, এটা খালি সরকারি শিলমোহর পড়ল বলা যেতে পারে। বছরের মুষ্টিমেয় যে কটা দিন আমরা জাঁকজমক করে বাঙালিয়ানা পালন করি তার মধ্যে এটা একটা। আশা করছি সবাই খুব আনন্দ করেছেন। যদিও গত সারা বছর ধরেই ঘটে চলা নানা খারাপ খবর আমাদের ভালো থাকতে দেয়নি। আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি নতুন বছরে আমরা সকলে মিলে এই অমানিশা কাটিয়ে তুলতে সাহায্য করব।

গত বছরেই আমাদের আত্মপ্রকাশ। তারপর গুটি গুটি পায়ে পথ চলে প্রথম বড় পদক্ষেপ শারদীয়া সংখ্যা। পাঠকদের উৎসাহ আর ভালোবাসায় এক এক করে প্রকাশিত হয়েছে ১৩টি সংখ্যা। এবারে আমাদের নিবেদন বিশেষ নববর্ষ সংখ্যা। ছোট বড় মিলিয়ে থাকছে সর্বমোট ১২টি লেখা আর ১৪টি কবিতা। শ্রদ্ধেয় মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় এবারে আমাদের পত্রিকা ঋদ্ধ। নিয়মিত লেখকরা ছাড়াও বাংলা অনলাইন সাহিত্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সহেলী চট্টোপাধ্যায়, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য আর দ্বৈতা হাজরা গোস্বামীর ভিন্ন স্বাদের গল্পে আপনাদের মন ছুঁয়ে যাবেই। সঙ্গে থাকছে সবার প্রিয় কুটুম কাটাম বিভাগে ২ জন শিল্পীর কাজ আর নিয়মিত দুই ধারাবাহিক। বরাবরের মত অনবদ্য একটি প্রচ্ছদ উপহার দিয়েছেন রুমেলা দাস। আর এই সংখ্যা থেকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অন্যতম নিয়মিত লেখক বিভাবসু। তাকে লুব্ধক ও পরবাসিয়া পাঁচালী পরিবারের সকলের তরফ থেকে জানাই সাদর অভ্যর্থনা।

তাহলে আর দেরি কেন। উঠে বসুন পরবাসিয়ার পক্ষীরাজের পিঠে। কথা দিচ্ছি হতাশ হবেন না। খুব ভালো থাকবেন। আর সবাইকে ভালো রাখবেন। এবারের মতো এইটুকুই।

জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা

জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা
মলয় রায়চৌধুরী
অলংকরণ - হিমাদ্রি নায়ক



গীতায় সর্বজ্ঞ ভগবান বলেছেন বটে অনেক কিছু, কিন্তু যা-যা বলেছেন তার কেবল একটা করেই মানে হয় না, বুঝলি? পাঁচ হাজার ফিট থেকে কী ভাবে, ডানা না ঝাপটিয়ে, শুধু দুপাশে আলতো মেলে দিয়ে, বাতাসে সাঁতরে দশ হাজার ফিট ওপরে উঠে যাওয়া যায়, তা বংশের একমাত্র জীবিত সদস্য, নাতি শিলাদকে শেখাচ্ছিল বৃদ্ধ শকুন যাতুধান তরফদার।

যাতুধান তরফদারের মাথায় আর গলায় পালক থাকলে ওকে মনে হতো ঈগল, এই বয়সেও এমন দশাসই গড়নপেটন, উড়াল, ব্যক্তিত্ব, আচরণ, চালচলন আর কাছার সাদা পালকের মেলতাই। কিন্তু ও এই দেশের এক অতি বৃদ্ধ শকুন, এককালের বিশাল পরিবারের অভিজ্ঞ কুলপতি, যার পরিবারে যুবক নাতি শিলাদ ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই।

ল্যাজে মাথা রেখে ঘুমোতে-ঘুমোতে ফোঁপাচ্ছিল শিলাদ। একফাঁকে ওর ঘুমন্ত হাঁ-মুখের ভেতর দিয়ে ওর মগজে পা টিপে-টিপে যে মহাসাথীর মহাকংকাল ঢুকে পড়েছে, আর একটু-একটু করে হয়ে গেছে পেট্রল-কুঁয়োর ধোঁয়াক্কার আগুন বমি করতে থাকা দশ-ঠ্যাঙের পেল্লাই গর্ণাখ্যাঁদা চিনা ড্র্যাগন, তা টের পায়নি ও, শিলাদ। ঘুমের ভেতর ঘুম ভেঙে গেল শিলাদ তরফদারের।

ঘুমের ভেতর জেগে-ওঠা শিলাদ নামের ঘরেলু গিরগিটিকে ড্র্যাগন বলল, তুই তো আস্ত গাধা। তুই যাকে জঙ্গিলাজীবন ভেবে হাহুতাশ করছিস সে ঘরানা বহুকাল তামাদি হয়ে গেছে। দেশে-দেশে জঙ্গিলাদের এখন হুদোহুদো ঘরানা। তুই কি জানিস পেরুতে তেগু নামের তিন ফিটের গিরগিটি হয়; স্যালামানডাররা আসলে মাফিয়া ডন, মোটেই গিরগিটি নয়; মার্কিন গিরগিটিরা মাঝরাতে বেরোয়; মিশরের কোমোডো গিরগিটিরা দশ ফিট অব্দি হয়; অনেক গিরগিটির পা হয় না; আফ্রিকার গিরগিটিরা নিজেদের মধ্যে লড়লে কী হবে, সর্পরাষ্ট্রের গ্রাস থেকে বাঁচতে নিজের ল্যাজ মুখে পুরে পাক খায়; আফগানিস্তানের গিরগিটিদের সহজে ধরা যায় না, কাত হয়ে বালিতে পিছলে অনেকদূর চলে যায়? জঙ্গিলাজীবন আর রোমান্টিক নেই।

হামি সত্যিই কনফিউজড, ঘুমের মধ্যে ঘুমোতে-ঘুমোতে নিজেকে বলতে শুনল শিলাদ।

তোকে তো তোর দাদু বলেছিল যে ভাষ্যকার নিজের আর ক্লায়েন্টের স্বার্থ মাথায় রেখে বাক্য বুকনি বিপ্লব বড়বড়াঙ ব্যধি ব্যাখ্যা করে। তুই যদি জঙ্গিলা জীবনকে ওদের মতন অ্যাডভেঞ্চারাস চাকরি হিসাবে নিতিস, তাহলে এরকম বিপর্যস্ত হতিস না।

ভাবিনি এভাবে স্বপ্নভঙ্গ হবে, স্বপ্নের মধ্যে নিজেকে শ্লেষ্মামাখা ঘড়ঘড়ে গলায় বলল শরটবদন শিলাদ ।

উড়োনছু ড্র্যাগন পেট্রল-আগুনের ধোঁয়াক্কার শ্বাস ভলকে-ভলকে ছাড়তে-ছাড়তে বলল, স্বপ্নভঙ্গ বলে কিছু হয় না, অবস্হা বুঝে নিজেকে বদলাতে হয়। তার ফলে জীবনের উদ্দেশ্য আপনা থেকেই পাল্টি খায়। এই আমাকেই দ্যাখ না, ছিলুম মহাসাথী, হয়ে গেছি কুমিরঠেঙে ঘোড়ামুখো ড্র্যাগন। আমাকে কেউ শ্রদ্ধাভক্তি করে না, ওরা জাস্ট আমার কংকালটাকে ভয় পায়। কেননা কংকালটা হল আমার রাজনৈতিক জীবনের কিংবদন্তি।

আমার তাহলে কী হবে? জীবন তো দেখছি আটার ফেলিয়র। ইন্সটলমেন্টে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমের মধ্যে বলল শিলাদ।

ব্যর্থ হবে কেন? অভয় দিল দশপদ ড্র্যাগন। কয়েক ভলক কেরোসিনগন্ধী আগুনের বমি উগরে শুধোল, অন্য অনেক উপায় আছে, সেগুলো যাচাই কর। এভাবে ভেঙে পড়লে চলে নাকি।

আপনি আমায় সাহায্য করুন না; এভাবে হেরে যাওয়া গিরগিটি জীবনের চেয়ে কয়রা কেউটের ছোবলের সামনে শুয়ে আত্মহত্যা করা ঢের ভাল। কাল সকালে বেরিয়েই কোনো তেলককাটা চশমাপরা ময়ূরের নজরে পড়ে শহিদ হব। দেড় ঘনফিটের একটা শহিদস্তূপ তো অন্তত হবে, তা সে সুলভ শৌচাগার চত্বরে হলেও হোকগে।

ভেবে বল, তুই কী চাস। আমি তো হতে চেয়েছিলুম সমাজবদলকারী। হয়ে গেলুম সেলাম-নেয়া উড়োনছু কংকাল।

কেয়ার ফ্রি লাইফ চাই, কাঁধের ওপর উদ্দেশ্যপূর্তির নোংরা বস্তা যাতে না বইতে হয়। আই ওয়ান্ট টু জাস্ট ফ্রিক আউট, চিল আউট, হ্যাভ ফান।

তথাস্তু।

নিঃশ্বাসের আগুন সশব্দে নিভে গেল।

ঘুম ভেঙে গেল শিলাদ তরফদারের।

বুড়ো হয়েছে বলে কুঁকড়ে যায়নি যাতুধান; বার্ধক্যেও লম্বাণ এক মিটার, দুদিকে ডানা ছড়ালে চওড়ায় সাড়ে তিন মিটার। ওর চিন্তা করার ক্ষমতার মতনই, দৃষ্টিশক্তি প্রখর, ওষুধ-বিষুধ খেতে হয় না। হাওয়ায় সাঁতরে ওপরে, আরও ওপরে, তারও ওপরে, উঠে গিয়েও, টেলিস্কোপিক চোখে অনেকটা এলাকা দেখতে পায় যাতুধান, আবার ঠিক তলায় কোনো জিনিসকে, তা সে যতই ক্ষুদে হোক, আই গ্লাস নজর মেলে, বেশ কয়েক গুণ বড়ো করে দেখতে পারে। দেখার, পরখ করার, এই সব তরিকার তালিম শিলাদকে দিচ্ছে যাতুধান।

পালকের সাদা-কালো রুমাল গলায় বেঁধে, হাওয়ার সরের ওপর ভেসে বেড়াবার বয়সে পৌঁছে, মনমরা একাকীত্বে ভোগা আরম্ভ করেছে শিলাদ তরফদার। একদিন, বোধহয় দোলের সময়, পাঁচ হাজার ফিট উঁচু থেকে আকাশ চিরে কয়েক মুহূর্তে মাটির কাছাকাছি নেমে গিয়ে প্লাসটিকের জাপানি ঘুড়িকে, যেটাকে দেখতে শকুনকুমারীর মতন, প্রেম নিবেদন করে সাড়া পায়নি শিলাদ। প্রণয়ঘটিত এই অঘটন আবার ঘটেছিল বিশ্বকর্মাপুজোর ভরা দুপুরে। সেই থেকে যাতুধান ওকে সব ব্যাপারে প্রশিক্ষিত করার ভার নিয়েছে।

হাতেকলমে নানা কাজকারবার শেখার সময়কালে, পুরোনো পালক ঝরে গিয়ে সবে নতুন পালক গজিয়েছে শিলাদের, এসে পড়েছে যখন-তখন সঙ্গমের অবরোহী ঋতু, শকুন যুবতীর খোঁজে বহু ব্যর্থ ওড়াউড়ির শেষে, সাতসকালে, একজন বয়স্কা ভূবনচিল যখন বটগাছের ন্যাড়া ডালে বসে তৃপ্তি করে মুর্গিছানার হৃৎপিন্ড চোষায় মগ্ন, শিলাদ তার অন্যমনস্ক পিঠে আলতো করে নেমে, ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল। অসবর্ণ সঙ্গমের হবোহবো মুহূর্তে, ওই চিলগৃহিণীর পরিবারের লোকজন শিলাদকে ঘিরে ফেলে হৈ-চৈ বাধাতে, প্যাঁদানির ভয়ে মেঘের এগলি-সেগলি হয়ে ও পালায়, চিলেদের অনধিগম্য আকাশে, যেখানে ওকে হাঁপাতে দেখে, জেরা করে সবকিছু জানার পর, যাতুধান ওকে বুড়ি শঙ্খচিল, খুকি উটপাখি আর সোমত্ত টার্কিদের নামঠিকানা বাতলায়, যাদের ওপর আচমকা বসে তাড়াতাড়ি পায়ুসঙ্গম বা ধর্ষণ সেরে কেটে পড়া যায়, যদিও তাতে মন ভরবে না, উল্টে আনচান বেড়ে অসুখ করবে। বাট দেন, দ্যাট ইজ লাইফ।

গন্ধের সু-কু সম্পর্কেও শিক্ষা দিতে বাধ্য হয়েছে যাতুধান, কেননা মাঠে ফেলে দেয়া নিচু জাতের দেবী-দেবতার রঙচটা খোড়ো মূর্তিকে মানুষের লোভনীয় মড়া মনে করে একবার শীতকালে নেমে গিয়ে বোকা বনেছিল শিলাদ। যাতুধান বুঝিয়েছে যে মানুষের পুজো-করা কোনো জিনিসই শকুনদের মুখে তোলার মতন নয়। ওসব কাক-শালিকের মতন ছোটলোকরা খায়।

ওই যে দূরে ঘনসবুজ আর ফিকেসবুজ বনাঞ্চল, সেখানে যেতে বা তার ওপর দিয়ে উড়তে শিলাদকে বারণ করেছে যাতুধান। ওখানকার পাতাঢাকা গাছগুলো, জাম আমলকি পলাশ চম্পা গেঁদা নারিচা বরমালা উদল টুনকড়াই ধরমারা হরীতকী বহেড়া জলপাই নাগেশ্বর কদম চালতা বানরহোলা বাটনা শিমুল কলক জারুল উড়ি গর্জন গামারি সুন্দরী, ওগুলো শকুন-আবাসনের উপযুক্ত নয়। বাড়ি করার জন্যে সবসময় খুঁজতে হবে মরা দলছুট একা গাছ। যখন পরিবারের সবাই বেঁচেছিল, তখন একান্নবর্তী গু-মুতে মাস ছয়েক চান করিয়ে অমন একটা বাছাই-করা গাছকে একটু-একটু করে মেরে ফেলে কাঠপ্রাসাদ বানিয়ে নায়া যেত। প্রায় নির্বংশ হবার ফলে, আর তা সম্ভব নয়।

নবাবি আমলে, তার আগে সুলতানি আমলে, তার আগে গুলতানি আমলে, কেমন মন্ডামেঠাই পাওয়া যেত, ন্যাড়া ছালওঠা অর্জুনগাছের ডালে বসে, রোদে রোদানো শ্মশান ধোঁয়ায়, গোলাপি গর্বিত গ্রীবা উঁচিয়ে, শিলাদকে ওর পূর্বপুরুষের সুখি জীবনের গল্প শোনাচ্ছিল যাতুধান। সে-সময়ে নিচু জাতের, নিচু জাতের চেয়ে নিচু জাতের, তার চেয়েও নিচু জাতের, অঢেল দাসী বাঁদি চাকরানি ঝি কামিলনি নড়ি আমিনী কিংকরী ভাতুনি প্রেষিনী খানজাদনি পুষতো খানদানি লোকেরা। তারা মরে গেলে তাদের অচ্ছুৎ মড়া না পুঁতে না পুড়িয়ে ভাসিয়ে দিত নদীতে, যার ওপর আরাম করে বসে ভাবতে-ভাবতে হাসতে-হাসতে কাশতে-কাশতে ভাসতে-ভাসতে ঠাকুর্দার বাপ-পিতেমো চলে যেত অনেক-অনেক দূরে। কত ভাগাড় দেখা হতো। কত শ্মশান। কত তান্ত্রিকের যোগাড়যন্তর। স্বাদ বদলাতে একান্নবর্তী শকুনরা এক ভাসন্ত মড়া থেকে উড়ে আরেক ভাসন্ত মড়ায় গিয়ে বসত।

আজকাল যে-সব মড়া পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই গরু ছাগল আর ভেড়ার রুগি লাশ। গরু-মোষের স্বাস্হ্যবান মড়া হলে তার মাংসে এত কীটনাশক যে অক্কা অনিবার্য। ওসব খেয়েই তো শকুনরা আজ নির্বংশ। পার্টি-অপার্টির লোকেরা খুনোখুনি করে লাশ ফেললে পুলিশে তুলে নিয়ে যায়, আমাদের খেতে দেয় না। মর্গের বাইরে যে মড়াগুলো ফেলে দেয় সেগুলো চুরি করে নিয়ে যায় কংকালের ব্যাপারীরা। তার ওপর নতুন আপদ হয়েছে বিদ্যুতের চুল্লি। নাতিকে বোঝায় দাদু।

হাইল হাওড় বাওড় নদনদী খালবিল ঝিল পুকুর ডোবা, বহু জায়গার ওপর দিয়ে উড়েছে শিলাদ। ওড়ে প্রতিদিন। ব্রেকফাস্ট বা লাঞ্চ করার জন্যে একটাও ভাসন্ত লাশ দেখতে পায় না। ওড়াই সার। ডানার বগলে ব্যথা ধরে। অথচ দাদু বলেছে এবার দেবীর দোলায় আগমন বলে মড়ক লেগে অনেক ভাল-ভাল পচা লাশ পাওয়া যাবে। ভবিষ্যৎ নাকি উজ্জ্বল।

কিছুদিন আগে, মানুষের পায়ের বিষে হাপিস ঘাসের ধুলোপথের শেষে, ঝোপঝাড় কাদাবালির কিনারায়, পাতলা কুয়াশা ফুটো করে শিলাদ দেখতে পেয়েছিল একটা উদোম ল্যাংটো পোঁদ উপুড় করা লাশ। চাখবে বলে বাঁক নিয়ে নামতে যাচ্ছিল শিলাদ। ওকে অমন লোভী বাঁক নিতে দেখে, আকাশের শীত থেকে গরমে নামতে-নামতে চিৎকার করে উঠল দাদু, খাসনি খাসনি, মুখ দিসনি, ছুঁসনি, চলে আয় চলে আয়।

—কেন দাদু? ছালন তো বেশ সরেস মনে হচ্ছে।

—ওকে পোড়ালে ও হিঁদু হয়ে যেত আর পুঁতে দিলে মোচোরমান, তাই ওকে ওভাবে ফেলে দিয়েছে। ওর মড়া বদ-ভাবনার বাতাসে ভরা, খেলেই তোর বায়ু রোগ হতো। আর উড়তে পারতিস না।

সব ব্যাপারে দাদু বারণ করে বলে মেজাজ খিঁচড়ে থাকে শিলাদের। সকাল-বিকাল হ্যান করিসনি ত্যান করিসনি ওখানে যাসনি সেখানে বসিসনি। কোকিলের মশালা মিউজিক শোনা বারণ, বসন্ত বউরির হিপ-হপ শোনা নিষিদ্ধ, বুলবুলির র‌্যাপ শোনা যাবে না, পা নাচানো যাবে না হাড়িচাচার রক এন রোলের তালে, টুনটুনির জ্যাজ শুনলে কানে পালক দিতে হবে, বেনেবউ হাঁস ঘুঘু ময়ূরের বাংলাস্তানি ব্যান্ড শোনা হারাম। এই আকাশ ছেড়ে পালাতে ইচ্ছে করে শিলাদের।

দাদু বুঝতে পারে না যে হাওয়া এত নোংরা হয়ে গেছে যে রাগসঙ্গীত তাতে খেলতে পারে না। পাখিদের গলায় কীটনাশক বিষ আর ধোঁয়া আটকে এমন অবস্হা যে বাতাসে ধ্রুপদ-ধামার বিলোলেও তা পপ আর পেপি হয়ে যাবে। কে এসব বোঝাবে দাদুকে? রাতদিন গীতা বা চন্ডীপাঠ বা পদাবলী কেত্তন। মহালয়ার দিন সকালে বাজল, ব্যাস, যথেষ্ট।

একদম ভাল্লাগে না এখানে, নিজেকে জানার উপায় নেই, নিজেকে ব্যবহারের সুযোগ নেই, ধ্যাৎ, বোরিং, মানে হয় না কোনো। নিজেকে শুনিয়ে-শুনিয়ে বলছিল শিলাদ, বাজ পড়ে মুণ্ডকাটা তালগাছের টঙে বসে। পাশে, ফরহাদ মজহার মিয়াঁর সেগুনবাগিচার বাগানে, মুনিয়া বদরি বাবুই চড়ুই টিয়া বক দলপিপি তিতির ক্যানারি দোয়েল মিলে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছিল নন্দনতত্ত্বের কিচিরমিচির নিয়ে। এদের পচিয়ে আচার করে খেতে বলেছে দাদু; সবরকম রঙের প্রাণী খেলে স্বাস্হ্য নাকি ভাল থাকে। অথচ শিলাদের ইচ্ছে করে রোজ একটা রঙ বেছে নিয়ে সেই রঙের পাখির পিঠে বসে, মাথার চাঁদিতে চঞ্চু টিপে ধরে, দুপাশে ডানা নামিয়ে ইয়ে করে।

শিলাদের স্বগতোক্তি শুনে, পাশের তালগাছে ব্যাঙমালপো খেতে-খেতে তুরঘুন বাজপাখি, যার পূর্বপুরুষ আকবর বাদশার বাঁ হাতে বসে শিকারে যেত বলে গুজব, মুখ তুলে শুধোল, তুই বাঞ্চোত ডোমের পুত গিধই থেকে গেলি। মনে-মনে শিলাদ বলল, ছ্যাঃ, এদের সঙ্গে থাকা যাবে না; যেতেই হবে এখান থেকে; এখানে থাকলে দম বন্ধ হয়ে যাবে; যেদিকে দুডানা যায় চলে যাব।

মনমরা দেখে, মেঘের গলির রুপো বিক্রির দোকানগুলোর মাঝ দিয়ে শিলাদকে নিয়ে ডানা চালিয়ে হন-হন করে উড়তে-উড়তে যাতুধান বলল, গীতায় ভগবান কী বলেছেন তাতে কিছু এসে যায় না; আসল ব্যাপার হল ভাষ্যকাররা কী বলছেন!

—ভাষ্যকার? সে আবার কী?

—এই যেমন কাশ্মীরে বোমাবাজদের সম্পর্কে যে ধরনের ভাষ্য দেয়া হয়, ত্রিপুরার বোমাবাজদের সম্পর্কে তার চেয়ে গরম ভাষ্য দেয়া হয়। কেননা ত্রিপুরায় ভাষ্যকারের মেসো-জ্যাঠা-কাকা-মামা থাকে। কাশ্মীরে ভাষ্যকারের কেউ থাকে না।

—ধ্যাত্তেরি, তোমার ওই রাজনৈতিক ক্যালাকাকোলা আমার একদম ভাল্লাগে না।

—তোর ভালর জন্যেই বলছি। পরিস্হিতি বুঝে, হালচাল বুঝে, আখেরের কথা ভেবে, প্রতিটি ব্যাখ্যা তৈরি কর।

—ভাবাভাবির কী আছে। ফালতু!

—সব বলছি। এই যে শঙ্কর, রামানুজ, বল্লভাচার্য, শ্রীধরস্বামী, নিম্বকাচার্য, মাধবাচার্য, কেবলভক্তি, বলদেব বিদ্যাভূষণ, মধুসূদন সরস্বতী, ওনারা তো তোর-আমার জন্যে ভগবানের কথা ব্যাখ্যা করেননি; করেছেন নিজেদের আর চেলাদের জন্যে। তা তুইও তাই কর। লাইফ এনজয় কর। জমমে অব্দি আমায় দেখছিস তো? দুঃখও এনজয় করি।

গ্রীষ্মের এক-দুদিন আগে, হবু-হবু কালবৈশাখী এড়াতে, দাদু আর নাতি পা গুটিয়ে ডানা চালিয়ে দৌড়োচ্ছিল তপন ভেড়ার বানানো বনের বনায়ন পেরিয়ে নিমটোলার দিকে। ঝড় নয়, ঝাঁক-ঝাঁক মেমনয়েড পাখির উড়ন্ত যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝ-মদ্যিখানে পড়ে যাতুধানের কাছছাড়া হয়ে গেল শিলাদ। পুবপক্ষ ওকে পশ্চিমপক্ষের সেনাপতি মনে করে পায়ের ছোরাছুরি আর ঠোঁটের তরোয়াল চালিয়ে শিলাদকে আধমরা করে ফেলে দিল ,মাটিতে। রক্তাক্ত মরণাপন্ন শিলাদের মনে হল, ওর সামনে তরোয়াল হাতে, খালিগায়ে সোনার লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়ে মিশরের ন্যাড়ামাথা ফ্যারাও তৃতীয় আমেনহোতেপ, যার গল্প দাদুর কাছে অনেকবার শুনেছে। শকুনমাথা-মুকুট বাঁ হাতে মাটিতে নামিয়ে রাখল ফ্যারাও।

সম্রাটকে দেখে শিলাদের মনে পড়ল। দাদু বলেছিল, ট্রয়ের যুদ্ধে একিলিসের কাছে হেরে যাবার পর, মেমননের শব যখন চিতায় দাহ করা হচ্ছিল তখন ধোঁয়ার কুন্ডলি থেকে অজস্র মেমনয়েড পাখি জন্মেছিল, যারা দুটো পরস্পরবিরোধী অংশে ভাগ হয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করে দিয়েছিল। সেই থেকে ফিবছর মেমননের স্মৃতিতে একদল পাখি জেতে আর আরেকদল হারে।

শিলাদ পড়ে গিয়েছিল হেরোদের দলে। মৃত্যুমুখী শিলাদের আবছা সন্দেহ জাগল, তাহলে দাদু কি বিজয়ী দলে পড়ে গিয়েছিল?

আমেনহোতেপ বলল, তুমি তো মরতে চলেছ, তোমার শেষ ইচ্ছা কী?

শিলাদ নিজেকে বলতে শুনল, জাঁহাপনা, আমি একা, সঙ্গিনীহীন, উড়ে-উড়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সেক্স বলতে শুধু ইভটিজিং; আমি পুরোদমে নাইট-লাইফ এনজয় করতে চাই; জীবনের মানে খুঁজতে চাই। নিজেকে ডিফাইন করতে চাই।

মেমনয়েড পাখিরা যেমন ঝাঁক বেঁধে উদয় হয়েছিল তেমনই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল।

শিলাদ টের পেল ও একটা গাবগাছের গাছনির্মিত কোটরবাড়ির ভেনিশিয়ান জানালা থেকে মুখ বের করে, ঘন রাত হলেও, নাইটভিশান চোখ দিয়ে চারিদিক স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। আশেপাশের গাছের আর এই গাছটার ডালে-ডালে কোটরবাড়ির দরজায় পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে প্যাঁচাপেঁচি বুলেভার্দের দামি-দামি কলগার্ল। খুড়ুল্লে প্যাঁচা যার গায়ে বুটিদার বুটিক শাড়ি, ছাইরঙা টু-পিসে হুতুমনি, ফিল্ম স্টারের ডিজাইনার পোশাকে লক্ষ্মীপ্যাঁচা, বাদামি চুড়িদার কুর্তায় ভুতুমনি, খয়েরি মিনি স্কার্ট-ব্লাউজে কালোপ্যাঁচা। ঠোঁট দিয়ে গায়ের পোকা বেছে রূপটান দিচ্ছে ভুতুমনি।

সামনে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছিল শিলাদ, বিশাল দিঘিটায় ভাসছে পদ্মলতা পানিফল কচুরিপানা টোপাপানা কলমিশাক হেলেঞ্চা পাটিবেত শাপলা মাখানা বিষকাঁটা হিজজ বরকন উকল জাতের ভাসন্তি-ডুবন্তি লতাপাতা।ঘাই মারছে তেলাপিয়া। ব্যাঙানির পিঠে চেপে ফেরি পার হচ্ছে ব্যাঙ। চোর-পুলিশ খেলছে জলঢোঁড়া।
দাদু কোথায়? যুদ্ধ জিতে কি মেমনয়েডদের সঙ্গে উড়ে বিলীন হয়ে গেল? ফ্যারাও কি ফিরে গেল মিশরে, পিরামিডের গুপ্তকবরে? হেলেসপন্টের তীরে মেমননের দীর্ঘ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল ফ্যারাও। সকালের প্রথম সূর্যকিরণ তার ওপর পড়লে অলৌকিক সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা সেই আলো-কে আহ্বান জানাত। রাতের জীবন চেয়ে শেষে কি এই ঘন অন্ধকার জুটল? আমি এখন কোথায়? আমার পালকের রঙ এরকম কেন? মনে হচ্ছে যেন গ্রীবা নেই, ঠোঁট আর ডানা ছোট হয়ে গেছে। মাথা ঘুরিয়ে নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না। আমি কে? চিন্তায়, চিন্তার আক্রমণে, শিলাদ বিপর্যস্ত।

একটা ছুটকোছোট প্যাঁচা, মাপে কাঁচা, বয়সে পাকা, শিলাদের জানলার আলসেতে এসে বসল ফুড়ুৎ কায়দায়। গলা নামিয়ে, অভিবাদন জানিয়ে বলল, গুড মর্নিং স্যার উলুক, আমি আপনার পছন্দ-অপছন্দ জানি, সেই হাউস অব লর্ডসের দিনগুলো থেকে। আপনি তো লর্ড ধর্মঠাকুরের সেক্রেটারি। হ্যালি বেরি আর মার্লিন মনরো মেশালে যে অপরূপা হয়, তা-ই আছে স্যার, বসনিয়া আলবানিয়া ক্রোয়েশিয়া সার্বিয়া থেকে এনে টাটকা স্টক করা। আমরা এক্সট্রা বেনিফিটও দিই স্যার। আপনার অবৈধ প্রেম যাতে ব্রেকিং নিউজ হয় তার জন্যে নিউজ চ্যানেলদের বলে দেব, সে বাবদ এক্সট্রা দিতে হবে না, বিজ্ঞাপন থেকে কভার করে নেব।

আগন্তুকের গড়গড় করে বলা সেল্সম্যানীয় কথা শুনে নিজের সদ্য পাওয়া খ্যাতি আর আত্মপরিচয়ের মুখোমুখি হল শিলাদ তরফদার। গ্রেট গুডনেস, ও কিনা এখন একজন সুটেডবুটেড প্যাঁচা। কী হতে চেয়েছিল আর কী হয়েছে। ওর দীর্ঘশ্বাস-মাখা উক্তি, থ্যাৎ, ভাল্লাগে না। শুনে, ছুটকোছোট প্যাঁচা ওকে উৎফুল্ল করতে চাইল, ভাল্লাগবে স্যার উলুক, অবশ্যই ভাল্লাগবে, আমি দুবছরের গ্যারেন্টি আর তিন বছরের ওয়ারেন্টি দিচ্ছি, একবার এসে চোখ আর লিঙ্গ সার্থক করুন, তারপর বলবেন। ক্যাশ ডিসকাউন্ট আছে।

জলজমা ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে, ছুটকোছোটের পাশাপাশি উড়ে, পাঁচতলা মাল্টিপ্লেক্সের জানলায় বসানো অকেজো এসি মেশিনের খপ্পরে নেমে, সলমা-সিতারা বসানো দুধ-সাদা শিফন শাড়িতে, ঠোঁটে ল্যাকমে লিপস্টিক, চোখে কাজল, হাফল্যাংটি হাফমডেলি, কোলাব্যাঙি পারফিউম-মাখা যুবতী প্যাঁচার সান্নিধ্যে পোঁছে, ছোটকোছোট প্যাঁচাসুন্দরীকে বলল, কথাটথা বলে রফা করা নাও, আমি ভোররাতে আসব। তারপর শিলাদের দিকে ফিরে, ম্যাডামের নাম নিঋিতি কোনার।

কী ভাবে শুরু করবে ভাবছিল শিলাদ। কিছুক্ষণেই যার সঙ্গে শোবে, এমন সুশ্রী সুবেশা অপরিচিতার সঙ্গে কথা বলার মাত্রা ওর জানা নেই। ইতস্তত ভাবটাই বা কাটানো যায় কী ভাবে? নিঋিতির জানা আছে প্রেমিকদের প্রাথমিক সমস্যা; তাই ওই শুরু করল। আপনি আমাকে রিতি রিতু রিতা যে উচ্চারণ আপনার পছন্দ, সেই নামে ডাকবেন।

নিঋিতির কথাটা শেষ হতেই, গ্রেনেড ফাটার আর গুলি চলার শব্দে শিলাদকে চমকে উঠতে দেখে ও বলল, ও কিছু নয়, সম্ভবত সন্ত্রাসবাদীরা খুনোখুনি খেলতে বেরিয়েছে, কিংবা বোধহয় চিনের কয়লাখনিতে সাপ্তাহিক বিস্ফোরণ হল।

নিঋিতির বিছানাটা পালকের ছোট-ছোট ছুনিগুলি দিয়ে বানানো, তার ওপরে লাউডগা সাপের চামড়ার সবুজ চাদর পাতা। লইটা মাছের মুসল্লম আর ইঁদুরের মেটে-ভরা পরোটা খেতে দিয়ে নিঋিতি গা ঘেঁষে বসে শুধোল, আমাদের শাস্ত্রে বেশ্যাবৃত্তি নিষিদ্ধ, আমরা তাই সাময়িক বিয়ে করি।

এসোগো, তা-ই করি, বলে শুরু করতে গিয়ে, দীর্ঘ গলার বদলে গ্রীবাহীন হবার দুঃখ পেয়ে বসল শিলাদকে। ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকাতে গিয়ে বুঝল তা প্রায় অনুপস্হিত, চুমু খেতে গেলে মাথা ঠুকে যাবার যোগাড়; যা আছে তা শকুনের মতন বহু উদ্দেশ্যপূর্ণ নয়, পৃথিবীকে শবমুক্ত করারও অনুপযুক্ত।

শিলাদের অস্বস্তির ভিন্ন ব্যাখ্যা করে নিঋিতি বলল, তুমি কি প্রথমবার? দাঁড়াও দেখিয়ে দিচ্ছি কী ভাবে এগোবে। এই নাও কন্ডোম, এটা পরে নাও, ঝিঁঝির আন্তর্বাস-ডানা দিয়ে তৈরি মিউজিকাল কন্ডোম। তালে-তালে দ্রুতলয়ে সঙ্গীতের মূচ্ছনায় পোঁছে ঠিক সময়ে বিলম্বিত লয়ে নেমে আসতে হবে, আর তুমিও তখন নেমে আসবে। ডোন্ট ওয়ারি, বি হ্যাপি, ডানা দিয়ে শিলাদকে জড়িয়ে বলল নিঋিতি। অ্যারোবিক্স ক্যারামতির কাজ যখন শীর্ষে উঠে বিলম্বিত লয়ে ফুরিয়ে আসছে, নিঋিতি আশ্চর্য হবার নকল মুখভঙ্গী আর তৃপ্ত হবার খাঁটি দেহভঙ্গী করে জানাল, কন্ডোম তো ফেটে উপচে পড়ছে গো, কতকালের মজুতকরা ভাঁড়ার, মধুসাগরের দুকুলে যে প্লাবন! নামতে-নামতে শিলাদ বলল, প্রিয়ে, মাই লাভ, এখনও কয়েক সাগর রাবড়ির স্টক আছে, খেপে-খেপে সাময়িক বিবাহে খরচ করব অ্যাঁ?

এভাবে, সরকারি কর্মীর মতন, শিলাদের ঘুমিয়ে দিন যায়, জেগে রাত যায়। ভাঁড়ার মজুত হয় খরচ হয়, মজুত হয় খরচ হয়, মজুত হয় খরচ হয়, মজুত হয় খরচ হয়, মজুত হয় খরচ হয়। একদিন দুপুর একটা নাগাদ চড়াইপাখিদের চেঁচামেচিতে ওদের ঘুম ভেঙে গেল।লাউডগা সাপের সবুজ চামড়া-পাতা বিছানায় শুয়ে কোটরবাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে শিলাদ দেখল, বাবুইপাখির যে ঝুলন্ত বাড়িগুলো বাবলাগাছ থেকে ঝুলছে, তার বাইরে শ-খানেক চড়াইপাখি জোরে-জোরে স্লোগান দিচ্ছে, চলবে না চলবে না, চক্রান্তকারীর হলুদডানা গুঁড়িয়ে দাও গুঁড়িয়ে দাও, আমাদের আবাসন বানিয়ে দিতে হবে দিতে হবে, কুটোকাঠি এনে দিতে হবে দিতে হবে, বাবুইবাসা চলবে না চলবে না।

আরেকদিন, ওইরকম সময়েই, নিঋিতিকে ডানা জড়িয়ে উদোম শুয়ে আছে, আচমকা কাকমাগি আর কোকিলমাগির অশ্লীল চেল্লাচিল্লিতে ঘুম ভেঙে গেল শিলাদের। বাটামাছের কাঁটায় গড়া ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ড সরিয়ে দেখল, কাকমাগি অনুযোগ করছে যে কোকিলমাগি ওর চুবড়ি থেকে ডিম তুলে ফাটিয়ে দিয়েছে। জবাবে কোকিলমাগি বলছে, শিকনিখোরের বেসুরো ডিম ও বাঁ পা দিয়েও ছোঁবে না।

প্রতিদিন অমন কিচাইন। এর সঙ্গে যোগ হল একমাসের বেশি রোজ ভোরে ঘুমোতে যাবার সময় থেকে সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙার সময় পর্যন্ত ভোট, লোট আর ফোট উৎসবের ছ্যাঁচোড়দের এই ধরনের অবিরাম গলাবাজি । বাস্তুঘুঘুর বক্তৃতায়; ঘুঘুঘু আমাকে আমাকে ঘুঘুঘু। শহুরে কাকের কাকাকা কাকাকা আমাকে আমাকে কাকাকা। জালালি পায়রার বকবক বকম বকম আমাকে আমাকে বকবক বকম বকম। পাতিহাঁসের প্যাঁকপ্যাঁক আমাকে আমাকে প্যাঁকপ্যাঁক। হাড়িচাচার ঘ্যাঁচাঘ্যাঁচা আমাকে আমাকে ঘ্যাঁচাঘ্যাঁচা। জংলি মোরগের কোঁকোর কোঁ কোঁকোর কোঁ আমাকে আমাকে কোঁকোর কোঁ। জলে স্হলে অন্তরীক্ষে সর্বত্র এই বকুনিবাতেলার চোঙা।
দালাল ছুটকোছোট, যার নাম শিলাদ জেনেছে, মিস্টার কিছুলাল আধাকায়স্হ বলে, তাকে জানাল, ওহে, এই পয়সাঅলা ছোটলোকদের পাড়ায় তো টেকা দায়, আমি তো বোধহয় কালা হয়ে গেলুম; ব্যাঙের মেটিং গান, সাপ-সাপিনীর যৌননাচের ঝংকার, ছুঁচোর কেত্তন, ল্যাঠামাছের চাচাচা কিচ্ছু শুনতে পাই না।

নিঋিতির আশঙ্কা হল যে শিলাদের মন ভরে গেছে, এবার বোধহয় বিয়ের মেয়াদি করার ভেঙে অন্য কোনো মডেলের সঙ্গে লিভ টুগেদারের তাল করছে। শিলাদের মেজাজ ফুরফুরে করে তোলার জন্যে উন্দুরিয়ান, ছুঁচাম্বো, খরগোশ্ত, খানাপোনা, টিকটিকানো, ব্যাঙথাই, ওয়াটারঢোঁড়া ইত্যাদি নামের বিখ্যাত রেস্তরাঁ আর বারে নিয়ে গেল।

শিলাদের সত্যিই ভাল না-লাগার জ্বর আসতে লেগেছিল ধিকিধিকি; চিনন চিনন করে চাগিয়ে উঠছিল অনভিপ্রেত উদাসীনতা। শকুন হয়ে একরকমের যৌন-অযৌন একঘেয়েমির ক্লন্তি পোষণ করতে বাধ্য হতো; প্যাঁচা হয়ে লালন করতে হচ্ছে আরেক ধরনের। মাথার দুদিকে রোঁয়ার ধুচুনি টুপি-পরা ঢাউসবুক পিঙ্গলনয়না প্যাঁচামডেল, যে জোনাকির হার গলায় দেবদারু গাছের কোটরবাড়ি থেকে শিলাদকে ইশারা করে, ওই যুবতীর কাছে গিয়েও এই বোরডাম কাটবে বলে মনে হয় না।
দুজনে অন্য কোথাও বরং যাওয়া যাক। ইঁদুরচন্দ্রিমা করতে-করতে শিলাদ নিঋিতিকে বলল, হে প্যাঁচাতমা খড়িসুন্দরী, এখানে আর ভাল লাগছে না, চলো অন্য কোথাও গিয়ে ব্যাঙচন্দ্রিমা বা কাঠবিড়ালি-চন্দ্রিমা করি। নিঋিতি সায় দিল, হ্যাঁ চলো চলো, এবার আবার দেবীর দোলায় আগমন বলে মানুষের স্নেহধন্য ইঁদুরও এই অঞ্চলে ফুরিয়ে যেতে পারে; গাঁয়ে-গঞ্জে ভোট, লোট আর ফোট উৎসবের ফলে অনেক মানুষ ইঁদুরের বাড়ি থেকে ধান চুরি করছে তা তো আমরা স্বচক্ষে নাইটভিশানে দেখেছি।

ওরা আরও উঁচু বাড়িতে উড়ে গিয়ে এগারোতলার দক্ষিণমুখো অব্যবহৃত কাচের জানলার আলসেতে বাসা বাঁধল, যে বহুতলটা, ছুটকোছোট মিস্টার কিছুলাল আধাকায়স্হের বয়ান অনুযায়ী, বিশ্বব্যাঙ্কের স্হানীয় দপ্তর। নিঋিতি জানাল, এই জানলায় আমার বিলিতি ঠাকুর্দা আমার দেশি ঠাকুমার সঙ্গে মেয়াদি করারে বিয়ে করে তিন বচ্ছর ছিল। আমার মা মাসিরা মামারা তাই খুব ফর্সা, আমিও ঠাকুর্দার গায়ের রঙ পেয়েছি।

শিলাদ বুঝতে পারছিল যে খারাপ লাগার ক্রিয়াটা রয়েছে ওর নিজের প্যাঁচা-মস্তিষ্কে, ঘাপটি মেরে, তাতে ফর্সা-তামাটে-কালোর কিছু করার নেই, চব্বিশ ঘন্টার অহরহ সঙ্গম করেও তা যাচ্ছে না, নানা সুরের মিউজিকাল কন্ডোম পরা সত্বেও। আরও নরম বিছানা পেতেছে নিঋিতি। সামনের দিকে ড্যাবডেবে কাজলটানা চোখ হওয়ায়, পুরো মাথাটা ডাইনে-বাঁয়ে ঘুরিয়ে সংসারের কাজ করে ও। শিলাদেরও অমন চোখ, তাই পুরো মাথা ঘুরিয়ে নিঋিতির কাজকর্ম দ্যাখে। অদ্ভুত কায়দায় ও পেতেছে বিছানাটা।ওর দ্বিতীয় পাকস্হলীতে যা যায়, সে-সব হাড়-পালক-লোম জমা করে নিখুঁত ছোট-ছোট ছুনিগুলি বানিয়ে কেশে-কেশে বের করে। আর সেইসব গুলি দিয়ে বিছানা পাতে। এই বিছানা পাতার জন্যে রোজ ও একটা সাদা খরগোশ বা সাদা লক্কা পায়রা ধরে এনে নিজে খেয়েছে, শিলাদকে খাইয়েছে।

ভেতর থেকে কুরে-কুরে ভাল না-লাগার ব্যারামে, ভাল খাওয়া-দাওয়া করেও শিলাদ রোগা হয়ে যাচ্ছিল। ছুটকোছোট একদিন বেড়াতে এসেছিল, তখন নিঋিতি গেছে পি এন পি সি করতে, আর সেই সঙ্গে সবাইকে খবর দিতে যে ও শিগগিরই দুটো যমজ ডিম প্রসব করতে চলেছে, অশত্থগাছের নার্সিংকোটরে বেড বুক করা হয়ে গেছে, শিলাদের ডিগডিগে চেহারা দেখে বলল, এ কি স্যার উলুক, বিশ্ব ব্যাঙ্কের কোয়ার্টারে থেকেও আপনার এরকম দুর্ভিক্ষায়িত নাকনকশা মাসকাঠামো হয়ে গেছে!

ছুটকোছোট চলে যাবার পর, তখনও নিঋিতি বাড়ি ফেরেনি, তারাগুলো টিপটিপ করে অন্ধকার আকাশে পড়া আরম্ভ হয়েছে, শিলাদের শরীর জ্ঞান হারিয়ে এগারোতলা জানলা থেকে হাওয়ার সরের ওপর নেমে গেল। হাওয়ায় কেমন যেন পালকের মতন একবার ঢেউ খেয়ে এদিক আর একবার ঢেউ খেয়ে ওদিক ভাসতে-ভাসতে ও নামছে, আঁচ করল দুর্বলস্বাস্হ্য আচ্ছন্ন শিলাদ তরফদার। কে একজন দাড়িঝোলা পাকাচুল গরদপরা সাধু ওকে সুপারম্যানের কায়দায় ধরে ফেলে যাত্রাদলের ভুঁড়িভোম্বল অভিনেতার ঢঙে শুধোল, হে সম্ভো্চূড়ামণি, তোমার যৌনলীলার কোটা তো এখনও শেষ হয়নি, কস্তুরিরস জমে রয়েছে অঢেল; যেহেতু তুমি আমার পি.এ. কিছু একটা করতে হয়; লর্ড মাত্রেই তাদের পি.এ., পি.এস., স্ত্রী ছেলে মেয়ের জন্যে অনেক কিছু করে, যাতে তারা কয়েক পুরুষ বিলাস বৈভব ক্ষমতায় থাকে।

তন্দ্রার ঘোরে শিলাদ দাড়িঅলার পরিচয় জানতে চাইলে সে বলল, আমি ধর্মঠাকুর, তেত্রিশ কোটি লর্ডসভার সদস্য, লাউসেনের ইষ্টদেবতা। তুমি কি গর্ভপাত করানোর জন্য নার্সিংহোমের জমি চাও? মাগিবাজির হোটেলের সুউচ্চ ইমারত চাও? নারীপাচারের ঠিকেদারির বরাত চাও? কী চাও তাড়াতাড়ি বল।

আচ্ছন্ন স্মৃতিতে শিলাদের আবছাভাবে মনে পড়ল, দাদু ধর্মঠাকুরের কথা বলেছিল একবার। এই লর্ড উঠে এসেছিল পূর্ণচৈতন্যের সমুদ্র থেকে, চেহারা ধৌত কৃষ্ণেন্দু ধবল, বুকে কৌস্তুভ।

শিলাদ বলল, স্যার, আমি ওই সব পাওয়া আর পাইয়ে দেবার প্যাঁচাগোষ্ঠীর নই; প্লিজ, আমার সমস্যা বুঝুন, আমার এই জীবন এমনই সুখী যে ভীষণ রিপিটিটিভ হয়ে গেছে, প্লিজ ডু সামথিং, একদম ভাল্লাগছে না। এরকম খাও-দাও-সঙ্গম করো জীবনের মানে হয় না, আমি তো অন্যরকম জীবন চেয়েছিলুম।

দাড়িঅলা বলল, হে পীনপয়োধর-পরিসরমর্দন-চঞ্চলকর যুগশালী, তুমি এমন মাইন্ডসেট থেকে মুক্ত হবার জন্য কী চাও?

তন্দ্রার ঘোরে শিলাদ জবাব দিল, আমি একটা পারপাস চাই, অতিরঞ্জন চাই, কর্মব্যস্ততা চাই।

ধর্মঠাকুর: তুমি রঙ্গিলা হতে চাও না জঙ্গিলা?

শিলাদ: না, না, রঙ্গিলা নয়। জঙ্গিলা, জঙ্গিলা।

থপ।

শিলাদ শুনতে পেল শব্দটা। টের পেল ও সম্পূর্ণ সুস্হ সতেজ সচেতন, পড়ে রয়েছ রাস্তায়। ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের দিকে দেখল। আরে। ও তো ফিকে হলুদ ঘরেলু গিরগিটি হয়ে গেছে, চারটে পা, চার-চারটে পা, লম্বা ল্যাজ ডগার কাছে গিয়ে সরু হয়ে গেছে।

ওর ওপর ছায়া খেলতে, ওপর পানে তাকিয়ে শিলাদ দেখল, ছোঁ মেরে তুলে নেবার জন্যে ধেয়ে আসছে নিঋিতি কোনার। ওরেব্বাপ, পায়ের ছুঁচালো বেয়নেট তাক করে নেমে আসছে। ওর নিরলস প্রেমিককে আর ও চিনতে পারবে না। প্রেমিক এখন খাদ্যবস্তু। ভয়ে শিলাদের মাথা কমলারঙে রঞ্জিত হয়ে উঠল। পার্টিবাবাজিউদের ডাঁই করে রাখা ঠিকেদারি-বালির মধ্যে গোঁতা মেরে ঢুকে পড়ল। যাক, জঙ্গিলার আন্ডারগ্রাউন্ড মুহূর্ত শুরুতেই এসে গেল।

বালি ফুঁড়ে মুখ বের করে শিলাদ আকাশে তাকিয়ে নিঋিতি নেই আঁচ করে যখন নিশ্চিন্ত হতে চাইছিল, দেখল ওর দিকে দু-পায়ের ছুরি-চাকু তাক করে বাতাস চিরতে-চিরতে উল্লাসে সেই চিলটা নেমে আসছে, যার ও পায়ু ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল। আতঙ্কে ওর মাথা আবার অতিরঞ্জিত হল, আর লুকোবার জন্যে লাফ মারল ইঁটের পাঁজার ফাঁকে, যেখানে, দম নেবার জন্যে জিরোতে গিয়ে চোখাচুখি হল ইঁটের পাঁজার মালিক, মিলিটারি টুপি-পরা চুনিচোখ বুড়োটে-মার্কা কেউটে সাপের।

দেখামাত্র পেছন ফিরে দৌড় লাগাল শিলাদ।

দৌড় শেষে সামনে যে সুপার মার্কেট ছিল তার দেয়াল বেয়ে সরসরিয়ে তরতরিয়ে উঠে গেল শিলাদ, বেশ ওপরে, এদিক-সেদিক দেখল, একটা গুয়ে মাছি নজরে আসতে, ভয় কমাবার জন্যে সেটাই খেয়ে ফেলল গপ করে। তবু হাঁপাচ্ছিল। এত হাঁপাচ্ছিল যে উদ্বিগ্ন শিলাদ ভাবল শেষে আবার অন্ধ্রপ্রদেশে গিয়ে হাঁপানি সারাবার মাছ খাবার জন্যে না সাত ঘন্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়।

অবাকও হল শিলাদ। ঘনঘন আন্ডারগ্রাউন্ড হবার জঙ্গিলা জীবনের আতিশয্যে, পালিয়ে বেড়ানো থেকে মানসিক ক্লান্তি হতে পারে। চারপাশে তাকিয়ে, বিপদ-মুক্ত হয়েছে অনুমান করে, রাস্তায় নেমে, পেছনের ঝরনাবাগানের ঘাসে পৌঁছেছিল শিলাদ, ওর কানের পাশ দিয়ে একটা পাথরের টুকরো বেরিয়ে গেল। আশেপাশে তো পুলিশ আর মিছিল নেই, তার মানে ওকে থেঁতো করার জন্যেই কেউ ঢিলটা ছুঁড়েছে। শিলাদ লাফ মারল। সেঁধোল গাছের গোড়ায় শেকড়ফোলা গর্তে।

হাঁফ ছেড়ে, পেটে বুকে সূক্ষ্ম আঁশের সারি দেখে, নিজেকে ঘেন্না হল শিলাদের । এর চেয়ে তো সুটেড-বুটেড প্যাঁচা হয়ে স্মার্ট সৌম্যদেহ ভাল ছিল। কেন যে খারাপ লেগেছিল নিঋিতির খাওয়া বেড়ানো যৌনকর্মের নিত্যরুটিনে। সত্যি, গিরগিটিপনা তো এইটুকুতেই ক্লান্তিকর মনে হচ্ছে। জঙ্গিলা জীবনের লুকোচুরির চেয়ে বোধহয় রঙ্গিলা জীবনের হেলাফেলা ভাল। কী আর করা যাবে। এভাবেই কাটাতে হবে বাকি জীবন, জঙ্গিলা গিরি করে, পালিয়ে বেড়িয়ে।

গর্তের মুখে আরাম করছিল শিলাদ। ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে দেখল জঙ্গিলা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের গুপ্ত গুলছররা চলছে। মঞ্চে উঠে এক-এক করে নেতারা আত্মপরিচয় দিতে, শিলাদ জানতে পারল, সেখানে উপস্হিত রয়েছে একেশ্বরবাদী আরবিভাষী লালকালো গিলা, নিরাকারবাদী পুশতুভাষী ফিকেসবুজ অ্যানোল, বহু ঈশ্বরবাদী তামিল কালো-হলুদ জমিনগেকো, লোকঠাকুরবাদী ককবরক খয়েরি কুমিরপিঠ অ্যাগামিড, ধর্মভয় বাদী বাংলাস্তানি ফিকে লাল স্কিংক, অনীশ্বরবাদী নেপালি কালচে-হলুদ মনিটর, ঈশ্বরের প্রতিনিধিবাদী আইরিশ কালচে-সবুজ ল্যাসারটিড, একলষেঁড়ে ভগবানবাদী চেচনীয় ইগুয়ানিড, অজ্ঞাবাদী স্পেনীয় লম্বাল্যাজ টেজিড, ঈশ্বরপুত্রবাদী নাগা ল্যাজপাকানো ক্যামেলিয়ন, দেবী-দেবতাবাদী অহমি হলুদ-ফুটকি বড়চোখ আসল-গেকো, নিজভগবানবাদী তেলুগু হেলমেটমাথা ব্যাসিলিস্ক, একেশ্বরবাদী কাশ্মীরি নীল-জিভ টিলিকা প্রমুখ ইয়া-ইয়া দিগগজ।

সবাই ইংরেজিতে কথা বলছিল, তর্কাতর্কি করছিল, চাপানউতর করছিল; মনে হল ওটাই জঙ্গিলাদের পিতৃভাষা। মঞ্চের ওপর একপাশে রাখা রয়েছে, যাকে জঙ্গিলারা বলাবলি করছিল যে উনি হলেন উড়োনছু নামের বিখ্যাত গিরগিটির কংকাল।

একের পর এক দিগগজ নেতার তরল সান্দ্র গভীর সংঘাতী তঞ্চিত খামিরি মাতানো ধূমিত রসাল ভারিক লঘু চোহেল আবিল সতেজ শুটকো আধসেদ্ধ বিদগ্ধ বক্তৃতা শুনতে-শুনতে জঙ্গিলা-জীবন আর জীবনদর্শন সম্পর্কে খটকা লাগল শিলাদের। বিস্ফোরক বানানো, সেটাকে যার মাথায় ইচ্ছা ফাটানো, আর যার মাথায় ফাটানো হচ্ছে তাকে জঙ্গিলা শত্রু ঘোষণা করা, এইই মনে হচ্ছে মোদ্দা কথা।

জঙ্গিলা জীবনের কত কি জানত না শিলাদ। নানা রঙ্গিলার দেশে গিয়ে তাদের পয়সায় ডেঁড়েমুশে খেয়ে মৌজ করা, আর সেখানে লুকিয়ে থাকা যে জঙ্গিলার উদ্দেশ্য তা জানত না । ভ্যাবাচাকা গিলে-গিলে খেতে লাগল শিলাদ। এবার আবার দেবীর দোলায় আগমন; জঙ্গিলাদের মড়ক লাগলে কার লাশ কে গতি করবে কে জানে!

জঙ্গিলা দিগগজরা পরস্পরকে সাথি বা সাথিন বলে সম্বোধন করছিল। উড়োনছু ড্র্যাগনের বিচক্ষণ কংকালকে বলছিল মহাসাথীর মহাকংকাল। কোনো কিছু খুব ছোট হলে জঙ্গিলারা তাকে মহা পদবি দ্যায়, বোঝা গেল। বক্তৃতা শেষে মহাসাথীকে একইভাবে সেলাম ঠুকছিল প্রত্যেকে: ল্যাজ ঘুরিয়ে মুখের কাছে এনে সপাং।
পাশে দাঁড়ানো সবুজ-শাড়ি পরা গিরগিটি যুবতীর ল্যাজে ল্যাজ পাকিয়ে, জঙ্গিলা জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে শিলাদ জিগ্যেস করল, সাথিন, আপনার নাম কী? যার জবাবে সবুজ শাড়ি রুষ্ট হয়ে বলল, আমাদের নাম হয় না, ওরফে হয়।

আপনার ওরফেটা কী?

শাহিনা শেখ ওরফে কাকলি কলিতা ওরফে মৌ মাহাতো ওরফে বনু বর্মন ওরফে ললিং লেসি ওরফে সুজান সামার ওরফে সাবিনা সিকন্দর ওরফে… থাক থাক। এর পর কী কার্যক্রম মিস ওরফে? বলতে বলতে নিজের অকুস্হলকে সবুজ-শাড়ির অকুস্হলের প্রায় কাছাকাছি এনে ফেলেছিল শিলাদ, ল্যাজের পাক দিতে-দিতে।

ব্যাস ব্যাস ওই পর্যন্তই, তার পর আর আ্যালাউড নয়।

বাঃ, এর পরই তো জীবনের জয়গান। অতিরঞ্জন।

সাথী, নিজেকে সংবরণ করুন। জঙ্গিলাদের পুংচিজ স্ত্রীংচিজ থাকা অনুচিত। তাকে নিজেকে অচিজ বা নাচিজ করে তুলতে হবে। ওই অপবস্তুটি কেবল রঙ্গিলাদের জন্যে বরাদ্দ। বলার সময়ে নিজের ল্যাজকে শিলাদের ল্যাজের জাপট থেকে আলতো করে সরিয়ে নিল সবুজ-শাড়ি।

আমি জঙ্গিলাতত্ত্ব জানতে চাইনি, জানতে চাইছি এর পর কী? বিরক্ত প্রত্যাখ্যাত শিলাদ ঝাঁঝিয়ে উঠল, কেননা ও বুঝতে পারছিল যে জঙ্গিলা জীবনে ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, গিরগিটির আত্মধর্মতা সম্পর্কে হয়ে উঠছে সন্দিহান। ওহোহোহো। অনুৎসাহী, ক্লান্ত, উদ্বেগময়। জঙ্গিলা রকমসকম সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ, কাহিল, বেদনার্ত।

শিলাদের অভিভূতি সামাল দিতে, ল্যাজের পাক খুলে ওরফে নামের সাথিন ভিড়ে মিশে যাবার পর, আধঘোমটায় মুখ-ঢাকা স্কিংক সাথিন ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, অধৈর্য হবেন না সাথী; অ্যানোলসাথী এবার চরস গাঁজা আফিম কোকেন হেরোইন বিক্রির টাকা ডলার পাউন্ড ইয়েন রিয়াল রুবল লিরা দিরহাম ফ্রাঁ মার্ক আমাদের বিলি করবেন।

কী কী? আফিম-কোকেন বেচার লাভাংশ? আঁৎকে উঠল শিলাদ। আরেকটু হলেই চেঁচিয়ে ফেলত।

হ্যাঁ সাথী, তা না হলে আর্ডিএক্স মর্টার বাজুকা রকেট রাইফেল গ্রেনেড ডিটোনেটর কিনবেন কী করে? খালি হাতে কজনকেই বা মারবেন? আর চোখ কান বুজে মারতেই যদি না পারলেন তাহলে জীবনের উদ্দেশ্য কী করে পুরো হবে?

শুনে, দমে গেল, মুষড়ে পড়ল শিলাদ, হতাশ, মনোহত। জঙ্গিলা মানে কি মারা, মরা, মারা, মরা, মারা, মরা, মারা, মরা? ধুসশালা। ঘোমটা ঢাকাকে শিলাদ বলল, আপনার চোখ, ঠোঁট, ল্যাজের নকশা কিন্তু অসাধারণ; লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট হয়ে যাবার নিশ্চিত সম্ভাবনা।

বলে, শিলাদের মনে হল, এই পরিবেশে কথাগুলো বেমানান, এমন কি বেফাঁস। কথা ঘোরাবার চেষ্টা করল। এক কোণে লাল সবুজ গেরুয়া মুফতি ইত্যাদি রঙে বলের মতন কিছু জড়ো করা ছিল। শিলাদ জিগ্যেস করল, ওগুলো কী।

আমরা রঙ্গিলা ডিম চুরি করে এনে জন্মের আগে থেকে জঙ্গিলা বানাই। জঙ্গিলা গোষ্ঠীর রঙ অনুযায়ী সেই মতাদর্শের আরকে চোবাই। ডিম ফুটে বেরোলেই ওদের ইনডকট্রিনেট করে জীবন্ত অস্ত্রশস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে শত্রু নিধনে পাঠানো হয়। আপনার আত্মনে এখনও রঙ্গিলাভাব প্রচুর জমে আছে, ঝেড়ে ফেলুন। বলে, ঘোমটা-ঢাকা মিশে গেল জঙ্গিলা জমঘটে।

সবাইয়ের মতন, আফিম-কোকেন বেচার বখরা শিলাদকেও নিতে হল। গর্তের মুখের কাছে গিয়ে, এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে সবাই একে-একে সট সট করে বেরিয়ে গেল শত্রু এলাকায় আন্ডারগ্রাউন্ড হবার জন্যে। মহাসাথীর মহাকংকাল পড়ে রইল মহান অন্ধকারের মহাশয্যার মহাকন্টকে, যেমনকার তেমন। একটু বাইরে দিকে উঁকি মেরে শিলাদ দেখতে পেল জমিনগেকোকে ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে শাহিন বাজপাখি, ল্যাসেরটিডের পেট চিরে আমগাছের ডালে বসে নাড়িভুঁড়ির চাউমিন খাচ্ছে শঙ্খচিল। ওদের শহিদাত্মা-ল্যাজ কখনও জিজ্ঞাসাচিহ্ণের মতন, আবার কখনও বা বিস্ময়সূচক চিহ্ণের শেষ আকার নিচ্ছিল। রাতটা কাটুক, কাল দেখা যাবে, ভেবে শিলাদ সেখানেই শুয়ে রইল।

তন্দ্রা মতন এসেছিল। কিছুক্ষণ পর কেউ একজন আচমকা ওর ল্যাজ ধরে হিড়হিড় করে ভেতর দিকে টেনে নিয়ে চলল, তারপর যেখানে সভা চলছিল সেখানে থামল বটে, তবে নিজের ল্যাজের সঙ্গে ল্যাজ পাকিয়ে টুঁটি ধরে চাপিয়ে নিল নিজের ওপর। অন্ধকার চোখসহা হলে শিলাদ দেখল, আরে, এ তো সেই মিস ওরফে, যে তখন ঠ্যাকারে ল্যাজ ছাড়িয়ে নিয়েছিল।

ওরফে গরম-গরম উত্তেজিত স্বরে বলল, কী রে রঙ্গিলা স্পাই, টিপতে এসছিস মাই, নে, কত টিপবি; বি কুইক অ্যান্ড ফাস্ট।

আপনি তো আমার ল্যাজ প্রায় ছিঁড়ে ফেলেছিলেন; রঙ্গিলা কাজেও দেখছি জঙ্গিলাভাব। এই কাজটা একটা আর্ট ফর্ম। ফোর প্লে করতে দেবেন তো।

রঙ্গিলা জীবনে ল্যাজ নিয়ে করবিটা কী? কাউকে কায়দামাফিক সেলাম ঠুকতে হয় না। তোদের তো হেঁ হেঁ করলি, হাত কচলালি, ব্যাস, সেলাম হয়ে গেল।
আপনি ভুল করছেন। জঙ্গিলা আমি স্বেচ্ছায় হয়েছি। কেউ আমায় ভুল বুঝিয়ে, ফুসলিয়ে, লোভ দেখিয়ে, কেতাব পড়িয়ে বা বাড়ি থেকে চুরি করে এনে জঙ্গিলা বানায়নি।

নে, নে, অনেক কপচেছিস। এখন যে কাজটা করতে চলেছিস তা মন-প্রাণ-দেহ ঢেলে ভালভাবে কর। আমার হাতে-পায়ে বিশেষ সময় নেই।

ওদের দুজনের লুটোপুটি হুটোপাটি কামড়াকামড়ি ওলোটপালোট আর হুড়দঙ্গের ধামসাধামসিতে লাল সবুজ গেরুয়া মুফতিরঙা ডিমগুলো ফেটে গা-ময় লেগে যেতে পেছলা-পিছলি প্রণয় সেরে একে আরেকজনকে চেটে পরিষ্কার করে দিল; তাতে পেটও ভরল শিলাদের। যেন কিছুই হয়নি, এরকম ভাব দেখিয়ে মিস ওরফে দৌড়তে-দৌড়তে বেরিয়ে গেল গর্ত থেকে।

কাল সকালেই বেরোব, নিজেকে বলল শিলাদ, আর উড়োনছু কংকালের বিচক্ষণ কংকালের পাশে ল্যাজে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। সঙ্গমের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে দাদু যাতুধান বিশাল ডানা মেলে শিলাদের ওপর উড়তে-উড়তে বলল, কী রে, বড় যে আদিখ্যেতা করছিলি শকুন জীবন ভাল্লাগেনা; এবার বোঝো ঠ্যালা, র‌্যালা করেছ কি ঠেলা পোয়াও, কতবার বলেছিলুম তোকে।

নিঋিতি কোনার, সাদা শিফনের আঁচল উড়িয়ে, স্বপ্নে নেমে এসে শিলাদের পাশে বসে গাল ফুলিয়ে খিলখিলিয়ে হাসল, আর মন্তব্য ছুঁড়ল, কী নাগর, তুমি ভেবেছিলে মেয়াদি করারের বিয়ে ভেঙে পালিয়ে গিয়ে সুখে থাকবে, জীবনের আসল মানে খুঁজে পাবে। এখন বুঝছো তো কোন পুকুরে কত ব্যাঙ, বকের কেন নাচের ঠ্যাঙ!

ল্যাজে মাথা রেখে ঘুমোতে-ঘুমোতে ফোঁপাচ্ছিল শিলাদ। এক ফাঁকে ওর ঘুমন্ত হাঁ-মুখের ভেতর দিয়ে ওর মগজে পা টিপে-টিপে যে মহাসাথীর মহাকংকাল ঢুকে পড়েছে, আর একটু-একটু করে হয়ে উঠেছে পেট্রল-কুয়োঁর ধোঁয়াক্কার আগুন বমি করতে-থাকা পেল্লাই দশ ঠ্যাঙের গর্ণাখ্যাঁদা চিনা ড্র্যাগন, তা টের পায়নি ও, শিলাদ। ভয়ে ঘুমের ভেতর ঘুম ভেঙে গেল শিলাদ তরফদারের।

ঘুমের ভেতর জেগে-ওঠা শিলাদ নামের ঘরেলু গিরগিটিকে ড্র্যাগন বলল, তুই তো একটা আস্ত গাধা; তুই যাকে জঙ্গিলাজীবন ভেবে হাহুতাশ করছিস সে-ঘরানা বহুকাল তামাদি হয়ে গেছে। দেশে-দেশে জঙ্গিলাদের এখন হুদোহুদো ঘরানা। তুই কি জানিস পেরুতে তেগু নামের তিন ফিটের গিরগিটি হয়; স্যালামানডাররা আসলে মাফিয়া ডন, মোটেই গিরগিটি নয়; মার্কিন গিরগিটিরা মাঝরাতে বেরোয়; মিশরের কোমোডো গিরগিটিরা দশ ফিট অব্দি হয়; অনেক গিরগিটির পা হয় না; আফ্রিকায় গিরগিটিরা নিজেদের মধ্যে লড়লে কী হবে, সর্পরাষ্ট্রের গ্রাস থেকে বাঁচতে নিজের ল্যাজ মুখে পুরে পাক খায় আর গড়িয়ে-গড়িয়ে হাওয়ার সঙ্গে হাপিশ হয়ে যায়; আফগানিস্তানের গিরগিটিদের সহজে ধরা যায় না, কাৎ হয়ে বালিতে পিছলে সাঁই-সাঁই করে পিছলে অনেকদূর চলে যায়? জঙ্গিলাজীবন আর আগেকার কালের হিরো-জীবনের মতন রোমান্টিক নেই; এখন সবাই ধান্দাবাজ।

আমি সত্যিই কনফিউজড, ঘুমন্ত ঘুমে ঘুমিয়ে থাকা শিলাদ ঘুমের মধ্যে নিজেকে দিয়ে বলালো।

তোকে তো তোর দাদু বলেছিল যে ভাষ্যকার নিজের আর ক্লায়েন্টের স্বার্থ মাথায় রেখে বাক্য বুকনি বিপ্লব বড়বড়াঙ ব্যধি বাতেলা বায়ু ব্যাখ্যা করে। তুই যদি জঙ্গিলাজীবনকে ওদের মতন অ্যাডভেঞ্চারাস চাকরি হিসাবে নিতিস তাহলে এরকম কেলিয়ে পড়তিস না, বিপর্যস্ত হতিস না।

ভাবিনি এভাবে স্বপ্নভঙ্গ হবে, ঘুমের মধ্যে ঘুমিয়ে-থাকা ঘুমন্ত শরটবদন শিলাদ শ্লেষ্মামাখা ঘড়ঘড়ে গলায় বলল।

উড়োনছু ড্র্যাগন পেট্রল-আগুনের ধোঁয়াক্কার শ্বাস ভলকে-ভলকে ছাড়তে-ছাড়তে বলল, স্বপ্নভঙ্গ বলে কিছু হয় না, অবস্হা বুঝে নিজেকে অবিরাম বদলাতে হয়। তার ফলে জীবনের উদ্দেশ্য আপনা থেকে পাল্টি খায়। এই দ্যাখ না আমাকেই, ছিলুম মহাসাথী, হয়ে গেছি কুমিরঠেঙে ঘোড়ামুখো ড্র্যাগন। আর কেউ আমাকে শ্রদ্ধাভক্তি করে না, সবই লোকদেখানে-লোকঠকানো। আসলে ওরা আমার কংকালটাকে ভয় পায়, কেননা আমার কংকালটা আজ আমার কিংবদন্তি।

আমার তাহলে কী হবে? জীবন তো তার মানে ফেলিওর। ইন্সটলমেন্টে দীর্ঘশ্বাস ফেলে-ফেলে ঘুমের মধ্যে বলল শিলাদ।

ব্যর্থ হবে কেন? অভয় দিল দশপদ ড্র্যাগন। কয়েক ভলক কেরোসিনগন্ধী আগুনের বমি উগরে শুধোল, অন্য অনেক উপায় আছে, সেগুলো যাচাই কর। এভাবে ভেঙে পড়লে চলে নাকি!

আপনি আমায় সাহায্য করুন না; এভাবে হেরে যাওয়া গিরগিটি জীবনের চেয়ে কয়রা কেউটের ছোবলের সামনে শুয়ে আত্মহত্যা করা ঢের ভাল। কাল সকালে বেরিয়েই কোনো তেলক-কাটা চশমাপরা ময়ূরের নজরে পড়ে শহিদ হব। দেড় ঘনফিটের একটা শহিদস্তূপ তো অন্তত হবে, তা সে সুলভ শৌচাগার চত্বরে হলেও হোকগে।

ভেবে বল, তুই কী চাস। আমি তো হতে চেয়েছিলুম সমাজবদলকারী; হয়ে গেলুম সেলাম-গ্রহণকারী উড়োনছু কংকাল, ওই সব জঙ্গিলাগুলোর জন্যেই। কত ভাল-ভাল কথা শুনিয়ে জনগণকে বোকা বানিয়ে আমায় করে ফেললে উড়োনছু কংকাল আর নিজেরা দিব্বি আমোদ-প্রোমোদ নিয়ে মজা করে চালালে।

কেয়ার ফ্রি লাইফ চাই আমি, কাঁধের ওপর উদ্দেশ্যপূর্তির নোংরা বস্তা যাতে না বইতে হয়। আই ওয়ান্ট টু জাস্ট ফ্রিক আউট, জাস্ট চিল, হ্যাভ ফান।

তথাস্তু।

নিঃশ্বাসের আগুন সশব্দে নিভে গেল।

ঘুম ভেঙে গেল শিলাদ তরফদারের। তটিনীতে তটস্হ অবস্হায় ও টের পেল যে নানা রকমের মাপের রঙের আকৃতির মাছের ছানুবানু ঝাঁকে ও ভাসছে। তাহলে? ও কি আর ফিকে হলুদ ঘরেলু গিরগিটি নয়! তাই হবে হয়ত। গিরগিটি হলে এত গভীর জলে খাবি খেয়ে পেট ফুলে ডুবে মারা পড়ে ভেসে উঠত। আধ কুইন্টাল ওজনের একটা এলাকলাড়ি মাছের চোখের আয়নায় নিজের টেকনিকালার ফোটো দেখে বুঝতে পারল শিলাদ যে ও হয়ে গেছে নীল-কমলা রঙের মাছ। বুদবুদ উড়িয়ে আনন্দে শিস দিয়ে উঠল।

ওর শিস শুনে পাশে ভাসন্ত সাঁতরালু মাছেরাও নানা সুরে শিস দিয়ে উঠল। কে জানে এটা ঝিল বিল গাঙ খাল নদী না সমুদ্র, কেননা স্রোতের সঙ্গে ভাসার অভিজ্ঞতা ওর নেই। তবে জলের মিষ্টি নোনতা স্বাদ আর প্রতিবেশী সাঁতারু বোয়াল আড় গুজি রিটা কাত্তন বাচা ঘাউরা শিলং পাঙাস কালবোস শরপুঁটি এলেং টাটকিনি ঢেলা চাপিলা ফলুই ভেদা গুতুম রায়েক আর বেলের কখনও অলস আর কখনও ঝটিতি নাচ দেখে মনে হচ্ছে সমুদ্র খুব একটা দূরে নয়।

শিলাদ নিজে কী মাছ তা বুঝতে পারল না। হয়ত ওর কোনো আটপৌরে হেঁসেলি নাম নেই, যা আছে তা খটমট লাতিন-লোতেন ভাষায়। জলের বাসায় আত্মপরিচয় নিয়ে কি আর ধুয়ে খাবে?

সত্যিই বেশ দুর্ভাবনাহীন কেয়ারফ্রি জীবন, মনে হল শিলাদের। ঘুরে-ঘুরে সাইট-সিইং করা যায়। তটের কাছে নাগরদোলায় পোকা-দম্পতি দোল খেতে-খেতে উৎপলা-সতীনাথের রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে; টু-পিস মল্লিকা-শেরাবতি বিকিনি পরে ভেসে যাচ্ছে পিঠসাঁতারু পোকা, স্কিপিং খেলতে-খেলতে সত্যেন দত্তের পদ্য আওড়াচ্ছে জলমাকড়সা-মাকড়সি, কাদায় গোঁতাগুঁতি করছে শাসকদলের মাস্তান জলবিছে, জেলেদের পোঁতা বাঁশের ডগায় জুন ময়লা গঙ্গা-ফড়িং স্বচ্ছ ওঢ়না ওড়াচ্ছে, মুখ দিয়ে বুদবুদ ওড়াবার প্রতিযোগিতা চলছে জয় বাংলা কাঁকড়া-ক্লাবে, ব্যাঙানির খোঁজে লাফসাঁতার দিতে-দিতে উধাও হল অফিস-পালানো কটকটি ব্যাঙ , মাগবাড়ি যাবার আগে শ্যাওলার দিশি মদ খাচ্ছে কড়িকাইটা কাছিম। বাঃ, বেশ মনোরম। শিলাদের জীবন চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়। কোনো পিছুটান নেই, কোনো দায়দায়িত্ব নেই।

হঠাৎ একদিন, পাশ দিয়ে যেতে-যেতে ওরই মতন এক নীল-কমলা মাছ সতর্ক করে দিয়ে গেল, পাড়ে ভুঁড়োশেয়াল পড়েছে।

কাছাকাছি হলদে-সবুজ মাদি মাছকে শিলাদ জিগ্যেস করল, হ্যাঁ গো, শেয়াল পড়েছে মানে কী? শেয়ালটা কি জলে ডুবে মরে গেল? তাহলে তো আড় বোয়াল চিতল প্রতিবেশীদের বাড়ি ভুরিভোজ।

মাদি মাছ মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, মিনসের কথা শোনো; হাঁদাগঙ্গামাছ না কি তুমি? শেয়ালরা কাঁকড়া খেয়ে সাবাড় করছে। পাড়ের কাছে যেওনি। তোমাকেও এক গেরাসে চিবিয়ে হজম করে ফেলবে।

ছাঁৎ করে উঠল শিলাদের রঙিন বুক। বিশুদ্ধ কেয়ারফ্রি জীবন নয় তার মানে। গোপন শর্ত আছে, ক্ষুদে অক্ষরে লেখা। এ-জীবনেও ঘাপটি মেরে রয়েছে সন্দেহ সন্ত্রাস উৎকন্ঠা বিপদ সাবধানতার পরিসর। পাড়ের কাছে গিয়ে সাইট সিইং বাদ দিতে হল শিলাদকে।

জাগ-দেয়া পাটের আঁটি, ভাসন্ত মুলিবাঁশ, নৌকোর গলুইয়ের তলায়-তলায় সাইট সিইঙে নিত্যভ্রমণ শুরু করল শিলাদ। কিন্তু তাতেও যেচে পরামর্শ দিয়ে গেল আরেকজন নীল-কমলা মাছ। চিল বাজ কোড়া কালিম সরালি বেলেহাঁস নিশিবক নলঘোঙা কাস্তেচরা শামুকখোল পানকৌড়ি থেকে সাবধান; কপাৎ জলধিতলে হয়ে যাবে। অতএব এই বেড়ানোও ছাড়তে হল শিলাদকে। ওর মনে হল শকুন থাকতে এই রকম নিষেধ তো ছিল না। জল-স্হল-অন্তরীক্ষে স্বাধীন রাজত্ব ছিল।

এতদিন নানা স্বাদের শ্যাওলার রান্না খেয়ে বেড়াচ্ছিল কেওয়া গেওয়া হারগোজা রাহা আমুরা উড়ি ধানসি পশুর হেঁতাল বাইনের ওয়াটার রেস্তরাঁ বার হোটেলে ঘুরে-ঘুরে। গপাগপ ফপাফপ শপাশপ সুইট অ্যান্ড সাওয়ার প্ল্যাংকটন সুপ খেয়ে বেড়িয়েছে। দুদুটো হুঁশিয়ারির ধাক্কায় তা বন্ধ করতে হল।

শকুন থাকতে আকাশ ছিল অভয়াশ্রম। সে-কথা মনে পড়তে, একজন রঙিন মাছকে শিলাদ একদিন দুপুর একটা সাতচল্লিশ মিনিটে জিগ্যেস করল, দোস্ত, আমাদের কোনো অভয়াশ্রম আছে কি? সে বলল, ঝাঁকের ঠিক মাঝখানটায় ঢুকে থাকবে; তবে যে মাছ মানুষে খায় তার ধারেকাছে যেও না। এ জীবন হল সারভাইভাল অব দি ফ্লার্টেস্ট।

এ তো দেখছি অদ্ভুত সমস্যা, ভাবল শিলাদ তরফদার, কানকো ফাঁপিয়ে। কেয়ারফ্রি বলতে তার মানে নিজের জীবনের এলাকা নয়; নিছক জলে বিচরণের এলাকা। আবার ওর অখেয়ালি অবসন্নতায় আক্রান্ত হবার উপক্রম হল। রুপোলি বুদবুদ উগরে বলে ফেলল, কিচ্ছু ভাল্লাগছে না।

অবসাদে নিজেকে ভাসিয়ে রেখে, শিলাদের একদিন নজরে এল, জঙ্গিলার একটা বিশেষত্ব ওর থেকে গেছে। যে প্রবালের বা শৈবালের কাছে ও যায়, সেই সময়টায় ওর গায়ের রঙ সেই প্রবাল বা শৈবালের মতন হয়ে যায়। স্রোতের সঙ্গে ভাসবার এ এক নৈতিক সুবিধা। কিন্তু জঙ্গিলাদের জাতিপ্রথা মাছের সমাজেও লক্ষ্য করে ব্যাপারটাকে ভবিতব্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ওইটুকু জঙ্গিলা জীবনে ও দেখেছিল তাদের মধ্যে খয়রাতি জঙ্গিলা আর ভিখিরি জঙ্গিলার মাঝে বর্ণভেদ রয়েছে, তেমনই আছে বড়লোক জঙ্গিলা আর ছোটলোক জঙ্গিলার মাঝে, ডলার জঙ্গিলার সঙ্গে টাকা জঙ্গিলার, শাস্ত্রজ্ঞের সঙ্গে আনপঢ়ের, আস্তিকের সঙ্গে না-আস্তিকের, গোরার সঙ্গে কালার, বলিতে পাঠাও আর বলিদান দাও জঙ্গিলার মাঝে, বস্তিছাপ আর এয়ারকান্ডিশান জঙ্গিলার মাঝে।

মাছেদের সমাজে, টের পেল শিলাদ, রয়েছে যবাক্ষারজান জলের নিচড়া বর্গ, রোদবৃষ্টিমাখা জলের উচড়া বর্গের সঙ্গে মাঝামাঝি জলের নিচড়া বর্গ। অতি নিচড়া বর্গের গায়ে আঁশ নেই চোয়াল নেই ডানা নেই, তলানি খায়। নিচড়া বর্গের গায়ে হাড় নেই, সবই কার্টিলেজ, কানকোর জায়গায় খড়খড়ি; জলের বেসমেন্টে নামলে চোখের তলায় গর্ত দিয়ে শ্বাস নেয়। আর উচড়া বর্গ তো রোদে পাউডার চাঁদের ক্রিম আর শিশিরের পারফিউম মেখে চোপরদিন গোমরে ঝিকিমিকি। রঙিন বলে ওই সব বর্গের মাছেরা কেউই শিলাদকে নিজেদের লোক বলে মনে করে না, অথচ খুব হিংসে করে। রঙিন কাউকে দেখলেই ওদের পোঁদে হিং জমে।

বেসমেন্টে একদিন নেমেছিল শিলাদ, ডানা টিপে-টিপে, গায়ের রঙ পালটে। গিয়ে তো থ। দ্যাখে কি, গির্গিটবোমা অ্যানোলের পচাগলা লাশের মোরব্বা চেখে-চেখে খাচ্ছে মার্কিন কানিমাগুর আর ব্রিটিশ পাঁকাল। দেখে অব্দি মাছজীবনে বিতৃষ্ণা ধরে গেছে শিলাদের। এই কি শত্রুমিত্রের আকাঙ্খাপূর্তি? আর বেসমেন্টমুখো হয়নি। না হলে কী হবে, ওর জন্যে আরও ভয়ানক অভিঘাত সেই রাতে ঘটল, যখন, শৈবালের সবুজ মশারি থেকে বেরিয়ে শ্বাস নেবার জন্যে বাতাসে মুখ বাড়িয়েছিল। দেখল ভাসন্ত মুলিবাঁশের ওপর মিস ওরফেকে ল্যাংটো করে গেলবার তোড়জোড় করছে নিঋিতি কোনার।

সেই থেকে, যেটুকু এলাকায় কেয়ারফ্রি থাকা অনুমোদিত, যে জায়গায় রঙিন মাছেরা আফালি মারে, কেবল সেই পাড়াগুলোয় ঘুরে বেড়ায় শিলাদ।
তাতেও শান্তি নেই। এই রকম সতর্কবার্তা শুনতে হচ্ছে যখনতখন।

মৃগেলপোনা: ফলুই পাড়ায় কেউ যাবেন না, আড়কাঠিরা বেড়াজাল ফেলেছে। অপহরণ করে মাছগাছিতে বেচে দেবে।

খালুয়া কাছিম: পালাও, পালাও, দাগি ট্রলারের জলকাঁপন ঢেউ তুলেছে। কেউ বাঁচাতে আসবে না। নাগরিকরা নিজেদের সুরক্ষা নিজেরা করুন; জলরাষ্ট্রপতি হুকুম করেছেন।

ভোলাভেটকি: যে যেখানে পারো লুকিয়ে পড়ো। বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ করে দাও। ইরাবতী-শুশুক, তিলা-শুশুক, আর তরমুজমাথা শুশুকের বিরাট ডাকাত দল ডিগবাজি ভুটভুটিতে এদিকে আসতেসে।

ভাওয়া ব্যাঙ: সবাই সাবধানে থাকুন, সতর্ক থাকুন। জলবোড়া আর সবুজ ফানস কাছাকাছি কোথাও ঘাপটি মেরে আছে বলে বিশেষ সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। অন্ধকার হলে অ্যাটাক করবে।

পোয়াতি ইলিশ: মানুষরা চর দখল করে তাঁবু ফেলেছে। সঙ্গে এনেছে জগতবেড় বৈতিক ভাসাজাল শ্যাংলাজাল খালুই নৌকা তারিন্দা ধোচনা টেঁটা বিন্তি পলো কত কি। আর কারোর নিস্তার নাই। এবার শুরু হবে অপহরণ খুনখারাপি গণহত্যা সংহার বিনাশ অন্তর্জলি মহাযাত্রা। আমার ডিম পাড়া হয়নি এখনও, সিজারিয়ান করার ট্যাকাও নাই। পাশপুট থাকলে বাংলাস্তানে গিয়া ডিম পাড়তেম; খোকারা খেয়ে সাঁতরে বড়ো হতো। হায় গো হায়।

এই পরিবেশে কী করে সুখী থাকা সম্ভব। ভেবে-ভেবে পটকা চুপসে যাবার যোগাড় শিলাদের। মনীশ মলহোত্রার তৈরি রঙচঙে পোশাকের একজন মাছমডেলকে ওর পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু তার যৌনাঙ্গে চুমো দিতে-দিতে চারজন পুংমাছ অষ্টপ্রহর সাঁতরায়, এমনকি ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে। আরেকজন আছে রিতু বেরির নকশাকরা জারদৌসি আঁশে; তার তো বুকপাছার এতো ঠ্যাকার যে চুনোরঙিনদের পাত্তা দেয় না; মালদার কাউকে পাকড়াও করার তালে আছে। যারা পাত্তা পায় না তারা মাছকুমারীটাকে লক্ষ্য করে ফিচিক-ফিচিক বীর্য ছোঁড়ে।

শিলাদের অনেকটা জমে ভাঁড়ার থইথই টসটস রসরস, কিন্তু ছুঁড়ে অপচয়ের মানে হয় না বলে যোগ্য-অযোগ্য যে-কাউকে খুঁজে বেড়িয়েও জোটাতে পারেনি। নিঋিতি কোনারের সঙ্গে ইঁদুরচন্দ্রিমায় পুরো ভাঁড়ার সাফ হয়ে গিয়েছিল; তারপর মিস ওরফের সঙ্গে কুইকিতে অবশিষ্ট যা ছিল ঝাড়পোঁছ করে। আবার জমে-জমে আনচান। মাছসমাজে সমকামের গোপন গোষ্ঠীটার সাকিন-ঠিকুজি জানলে কিছুটা অন্তত দুঃখামৃত বেরিয়ে যেত।

কেয়ারফ্রি রঙ্গিলা জীবনে তো বস্তু-অবস্তু কিছুই তেমন পাওয়া হল না; সবই জলে-জলে জলক্ষয়। বিশুদ্ধ শান্তিকল্যাণও নেই, যত্তো সব দেখনদারি। শ্যাওলার স্কোয়াশ আর ভেসে আসা পান্তাপোকার পাস্তা খেয়ে একঘেয়ে ঘুলুরঘুলুর ঘুলুরঘুলুর ঘুলুরঘুলুর ঘুলুর ঘুলুর । হাই তুলে-তুলে চোয়াল আটকাবার রোগ হয়ে গেল। পটকা ঝুলে গেল হাহাকার জমে-জমে। উদ্বেগ উৎকন্ঠায় আঁশ ঝরে টাক পড়ে যাচ্ছে। অসিদ্ধির অনবস্হায় ফিকে হয়ে যাচ্ছে নীল-কমলা জ্যোতি। এরকম একটা জীবন নিয়ে আমি কী করব? পাথরের ফাটলে শুয়ে কাঁদতে থাকে শিলাদ।

বর্ষার অতিবন্যা আর ষাঁড়াষাঁড়ির বাড়াবাড়িতে পাড় ভেঙে ঘরসংসার ভেঙে জল এমন ঘোলাটে হয়ে গেল যে হাউহাউ-কান্না চাপাকান্না ফুঁপিয়ে-কান্না ককিয়েকান্না ডুকরেকান্না গুমরেকান্না মায় বুকফাটা কান্নাও মুশকিল হল শিলাদের। গরু মোষ ছাগল হাঁস কুকুর মুরগি শুয়োরের পচাফোলা দাঁদুড় লাশের বাড়বাড়ন্তিতে ওর শ্বাসকষ্ট দেখা দিল। জোয়ার-ভাটা টের পাওয়া কঠিন হল হুলুস্হুলু জলে। জলের তোড়ে কোথায় একানি খাল আর কোথায় ছিল মরানি খাল ঠাহর করা দায়। বোঝা মুশকিল দেয়ানি খালে ভাসছে না ভারানি খালে। এবার আবার দেবীর দোলায় আগমন; শেষে মহামারিতে না পটল তুলতে হয়।

কাঁদতে-কাঁদতে, শ্বাস নেবার জন্যে জলের ওপর মাথা উঁচিয়ে, শিলাদ দেখতে পেল, গরান গর্জন সুন্দরীদের সবুজাভ আবছা। স্পষ্ট যা, তা কিছুটা দূরে, বাতাসে এলোচুল শুকোচ্ছে ছনঘাসের জঙ্গল। ওর গলা বন্ধ হয়ে আরও কান্না পেল।

জলভিড়ের ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি একটু থিতিতে, চারিদিকে তাকিয়ে শিলাদ বুঝতে পারল, পরিচিত প্রতিবেশিদের অলিগলি ছেড়ে ও চলে এসেছে চেটাল জলের অপরিচিত পাড়ায়। ওর পাশে নিচে ওপরে খেলাখেলি করছে কারপরদাজি চিংড়ি কাঁকড়া সাগরকীট সি-আর্চিন সেপিয়া ললিগো কড়ি তারামাছ জেলিফিশ গুগলি শামুক ঝিনুক সাদাগেঁড়ি পরিবারের লোকজন, যারা অবাক হচ্ছে ওকে দেখে। নিজেকে বড্ডো একলা মনে হল শিলাদের, বড়ই একাকী, পরিত্যক্ত নিঃসঙ্গ নির্বাসিত ফেফাতুড়া অসহায় বন্ধুবান্ধবহীন।

জলের সঙ্গে কাৎরে সাঁৎরে এগিয়ে পেছিয়ে পাক খেয়ে ধাক্কা খেয়ে খাবি খেয়ে হাবুডুবু খেয়ে চরকি খেয়ে ঘাড়ধাক্কা খেয়ে অবসাদগ্রস্ত আর অবসন্ন আর বিষণ্ণ শিলাদ, ডানাজোড় করে প্রার্থনা করতে-করতে মাছের জীবন থেকে মুক্তি চাইল। হে বনবিবি উদ্ধার করো, হে ভিনমনসিয়াদেবী থই দাও, হে প্রভু অঘোরসিদ্ধি মোচনের পথ বাতলাও, জপে চলল চোখ বুজে, জল-বুদবুদের জপমালা ওড়াতে-ওড়াতে। হে চোরগণেশ হেরুকদেব চণ্ডরোষণ বজ্রবারাহী ডোম্বী ত্রিবর্চস শুনঃশেফ ব্যূষিতাশ্ব বহিষ্মর্তী বলে-বলে সবায়ের কাছে বিড়বিড়-ঠোঁটে বুদবুদ অঞ্জলি দিয়ে অনুনয়-বিনয়-আবেদন-নিবেদন করতে থাকে ও, বেচারা শিলাদ।

হাভাতে কাভাতে বানভাসিতে বয়ে-আসা অনাথ খুদকুঁড়ো পেলে দুডানা মুখে পোরে।

কেমন লোকমাছ হে আমি, আত্মচিন্তায় কানকো খচখচ করতে লাগল শিলাদ তরফদারের নীল-কমলা মুড়োয়, কেমনধারা আমার মেছো বাছবিচার! জগৎসংসারের মানে বের করে, তাকে যুক্তিপূর্ণ কায়দায় বুঝতে পারা কি সম্ভব ? নানা পর্বের ভেতর দিয়ে যেতে-যেতে সন্দেহ ধরে গেল যে জগৎসংসার সম্ভবত বোধগম্য, সুসংহত, আসঞ্জনশীল ব্যবস্হা নয়। উদাসীন পৃথিবীটা আমাকে লাথিয়ে-লাথিয়ে আমারই স্বাধীনতায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে, আর আমি, পাখনা চাপড়ে বিলাপ করতে বাধ্য হচ্ছি। সম্ভাবনার সুযোগ সুবিধের মধ্যেই আমাকে কাৎ মেরে-মেরে খতিয়ে বেরোতে হবে। না কি?

প্রার্থনা বজায় রাখল শিলাদ।

দিন কতকের বর্ষায়, খাঁড়ির গায়ে অমুক কোটি তমুক লক্ষ তুসুক হাজার ছোট-বড়-মাঝারি সোজা-সোজা বেঁকা-বেঁকা ঝিরিঝিরি ঝোড়োঝোড়ো বৃষ্টিফোঁটার পর, আকাশ যখন ঝকঝকিয়ে তকতকিয়ে নীল, শিলাদের লাঞ্চের সময়, দেখল পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে পদ্মপাতার ওপর ঝিনুকপ্রদীপে রাখা ঋতুমতী কোনো বাঘিনীর কয়েকফোঁটা গন্ধোত্তমা। যোনি থেকে ভাসিয়ে দেয়া ওই কয়েক ফোঁটা তরলচুনি কাছে আসামাত্র গিলে ফেলল শিলাদ।

বত্রিশ প্রহর পর খোঁয়ারি কাটলে, খাঁড়ির আবরা থেকে ডাঙায় ওঠার সময় ডমরুর মতন মাথা ঝাঁকিয়ে জল ঝাড়ল শিলাদ, তারপর গা কাঁপিয়ে আর ল্যাজের ঝাপট দিয়ে জলের ফোঁটা উড়িয়ে, অনেক বড় হাঁ-মুখ করে, মুখ বন্ধ করার সময় বলল, হা-লু-ম। ওর বদগন্ধ আর বদগর্জনে, ভয়ে ডানা ফড়ফড়িয়ে এডাল-সেডাল এগাছ-সেগাছ করে উঠল মাছমুরাল, গোবরে শালিক, সুইচোরা, সরালি, লোহারজঙ, মেছোবক, খুন্তেবক। দাঁত বের করে মুখ খিঁচিয়ে চেঁচামেচি লাফালাফি শুরু করল মধুখোর কাঁকড়াখোর ল্যাজতোলা রাঙাপোঁদা নস্যিলোম চিচকেরে বাঁদরেরা। শিলাদকে দেখে গ্রীবা উঁচিয়ে দলের সবাইকে সতর্ক করে জঙ্গলের ভেতরে পালাল হরিণের দল।

আত্মগর্বিত শিলাদ, কানের কলার তুলে, আরেকবার হালুম ফতোয়া জারি করে, ভাদাইল ধনিচা শোলা করচা বিন্না ঝোপের আড়ালে গিয়ে, আয়েসে হেঁতালগুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে শুয়ে, জিভ দিয়ে চেটে-চেটে গোঁফ থাবা আর লেংটু সাফ করতে লাগল।

রোদটা হেজিয়ে ম্যাড়মেড়ে হলে, রোদে রোদিয়ে, খানিক এগিয়েই তিতিবিরক্ত আর অপমানিত হল শিলাদ। কোন হাড়হাভাতে ছ্যাঁচড়া বুড়ো বাঘ ওর চত্বরের গাছগুলোয় মুতে দাদাগিরির সীমানা দেগে গেছে। ফোকলা হাবড়াটাকে দেখতে পেলেই দুচার থাবার কড়া মুঠকি দিতে হবে। শিলাদ তরফদার হাওয়া শুঁকতে-শুঁকতে এগোল, পা তুলে ছিড়িক-ছিড়িক মুতে-মুতে পুনর্দখল করতে থাকল তল্লাট। পেচ্ছাপ দিয়ে দখলের বছর আর কতকাল দখলে রাখবে তার দিনক্ষণসহ নিজের নাম লিখে বুড়ো বাঘটার চিহ্ণ মুছে ফেলার পর, ঘাসে পায়ের গন্ধ শুঁকে আরেকটু এগিয়ে বিরোধী বাঘটার এলাকায় ঢুকে কয়েকটা গাছে নিজের মুতের সংখ্যাছাপ এঁকে বাড়তি দখলের হুমকি দিয়ে রাখল ও। বলল, হা-লু-ম।

পুবের ক্যাঁকড়াঢল ভারানিখাল সাঁতরে পেরিয়ে শিলাদ দেখল, কিছুটা দূরে চিংড়ি-চাষিদের হইচই, গরু-ছাগল চরছে। ভালই। অভাব দেখা দিলে তুলে আনা যাবে। উত্তরদিকের জঙ্গল পেরিয়ে যে গাঙটার কাছে পৌঁছল, দেখল কয়েকটা হরিণ সাঁতরে ওপারে তলতাবাগানে যাচ্ছে। এরাই ওকে দেখে একটু আগে পালিয়ে পোঁপিত্তান দিয়েছিল। এপারে মানুষদের যে যাতায়াত আছে তা টের পাওয়া গেল মৌমাছির চাকের ঠিক তলায় পোড়া-মাটির ডাবুহাঁড়ি দেখে; পরে মধু আর মোম কেটে নিয়ে যাবে মৌয়ালিরা। রানিকে ঘিরে রাখা মৌমাছিদের কোর গ্রুপকে মৌয়ালিরা চটাতে চায় না বলেই ওই চাকটায় ফুটো করে ডাবু হাঁড়ি ঝুলিয়েছে, অনুমান করল শিলাদ তরফদার। উত্তর-দক্ষিণে হেঁতালের বন, ঘনবুনোটের গরান, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পশুর আর কেওড়া। ভালই মনে হচ্ছে। নির্বিবাদে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দায়া যাবে।
পেচ্ছাপের তরতিম লিখে সংরক্ষিত নিজের এলাকায় দিনে-রাতে টহল দিয়ে, খেয়ে, গোঁফে তা দিয়ে, আরামে একবাঘতন্ত্রী সময় কাটতে লাগল শিলাদের। হরিণের কলজের পরোটা, তলপেটের চাপড়ঘণ্ট, গলদা চিংড়ির চানাচুর, কাঁকড়াদাড়ার ফুলুরি, আড়মাছের চিলিচিকেন, ভেটকিমাছের লুচি, বাছুরমাংসের ভাত, হালুম ডাকলেই পাওয়া যায়। শুয়োর বাঁদর মানুষ এখনও খাওয়া হয়নি। তার কারণ অনভ্যাসে হা-লু-ম চেঁচিয়ে ফ্যালে। আর শোনামাত্র শিকার ভাগলবা। পিছু ধাওয়া করে হেরে যাওয়ার আশঙ্কায় এখনও ওদের তাড়া করেনি।

হারার কথা জানতে পারলে নিউজ চ্যানেলরা বলবে নিজের মুত্রাঙ্কিত নির্বাচনক্ষেত্রে শিলাদ তরফদারের কোনও প্রতিপত্তি নাই। ব্রেকিং নিউজের খাতিরে আজকাল তো ধর্ষকদের ক্যামেরার সামনে আবার ধর্ষণ করে ঘটনা তুলে ধরতে হয়, যাতে জনসাধারণ স্বচক্ষে দেখতে পায়। অবশ্য তার জন্যে সস্তার অভিনেতা-অভিনেত্রী ভাড়া করতে হয়। একদিন প্রায় তিরিশজন মাগিমরদ কোমরজলে নেমে ছাঁকনজাল দিয়ে চিংড়িপোনা ধরছিল যখন, শিলাদ আনন্দের অতিশয়োক্তির কারণে হালুম বলে ফেলায় ছাঁকনজাল আর হাঁড়ি ফেলেই লোকগুলো দেদ্দৌড়। পরের দিন সকালে থানার পেটমোটা পেটুক পয়সাখেগো ওসি আর বনবাবুদের নিয়ে লোকগুলো এসেছিল, গাছের আড়াল থেকে দেখেছে শিলাদ। থলথলে ঘাড়েগর্দান বনবাবু বলছিল, আরে ওখানে একটা আধফোকলা বুড়ো বাঘ থাকে যার এই বয়সে ম্যানইটার হওয়া অসম্ভব; আপনারা নিশ্চিত হয়ে চিংড়িপোনা ধরুন, আমরা তো আছি, ভয় কিসের।

বনের ভেতরে যে খাল নদী গাঙে, ওর, শিলাদের এলাকায়, চরপাটা খালপাটা আর বিন্দিজাল বেছান, সেগুলো সাবধানে দেখে এসেছে শিলাদ যাতে রাত-বিরেতে রোঁদে বেরিয়ে না ফেঁসে যায়। তবে, পাতরি পায়রাতলি মেদ ছোটভেটকি কাকিলা পারশে ভাঙন রামশোষ দাতিনা চাকা মাছ, যেগুলো এদিকে পাওয়া যায় বলে জাল ফেলা, সেসব মাছ খেয়ে ওর পেট ভরে না, খাবার হ্যাঙ্গামও অনেক, মুখে জল সেঁদিয়ে যায়। অহেতুক মুখ নষ্ট। ওসব মাছ শিলাদ খেতে নেমেছে জানতে পারলে খ্যাঁকশেয়ালরা কলঙ্ক রটাবে। এই তো কিছুকাল আগে, কৃষ্ণতৃতীয়ার রাতে, শেওড়ার জঙ্গলে, ফেউশেয়ালরা ওপর পানে তাকিয়ে হিমেশ রেশমিয়ার ঢঙে রাতভর হুঁক্কা-হুঁরুর হুঁক্কাহুঁরুউউউউউর গাইছিল নাকিসুরে।

মাতলা নদীর পুবপাড়ে টাইগার প্রোজেক্টের ওয়াচ টাওয়ারে বসে দূরবীন চোখে এদিকে নজর রাখে চাকুরিয়া দেখনদাররা। চামটা জঙ্গলে দেখনদাররা লঝঝড়ে সরকারি জিপে চেপে ঢোকে, হাতে ভয় কাটাবার বন্দুক যা থেকে শেষবার ইংরেজরা গুলি ছুঁড়েছিল। ওদের চোখে না পড়াই ভাল। নজরে পড়লেই সংবাদ মাধ্যমের ছোঁড়াছুঁড়িরা আজেবাজে কথা রসিয়ে-খসিয়ে লিখে দেবে। ও হয়ত বলল হা-লু-ম। ওরা লিখে দেবে শিলাদ তরফদার বলেছেন, মুখে হাগুম। তার চেয়ে মাতলা মোহনার দক্ষিণে ঠাকুরান, সপ্তমুখ আর মুড়িভাঙা নদীর আসেপাশে ঘোরাঘুরি কম বিপজ্জনক, কেননা শিকারী বাওয়ালি বাঘালি আর থলেট ডাকাতদের রমরমা ওখানে কম।
শিলাদের মুতের বদগন্ধের সৌরভ অনুসরণ ও অনুধাবন করে, কালো হলুদ জামদানিতে, গতরের তাপে গরম এক বাঘিনী, নখে শিশিরের নখপালিশ আর ঠোঁটে ছাগল-রক্তের লিপস্টিক মেখে, ওর, শিলাদের, এলাকায় এসে হাজির। বয়সে শিলাদের চেয়ে বড়ই হবে। কুছ পরোয়া নেই। অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে প্রচুর, কত প্রেমিককে খেলিয়েছে, তুলেছে-নামিয়েছে, তার ইয়ত্তা বনবাবুদেরও নেই। শিলাদের তো প্যাঁচা-প্রতিস্বের অভিজ্ঞতা আর গিরগিটির ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড, যার সঙ্গে বাঘ-বাঘিনীর কর্মকান্ডের দেহকান্ডের রসকেলির কোনো সম্পর্কই নেই। নিজের আবিসার গোঁফ চেটে, ল্যাজের কেতন উড়িয়ে, বাঘিনীর গায়ে গা ঘষে, শিলাদ জিগ্যেস করল, তোমার নাম কি ডার্লিং? সুরাইয়া না শেফালি?

কর্মজ্ঞ বাঘিনী মুচকি হেসে লিপ্সটিক চেটে বলল, আমার নাম সদুর্জয়া বৈরাগ্য, হালুম, তুমি আমাকে সদু বা সদুদি বলে ডাকতে পারো, হালুম, কিছু না ডাকলেও ক্ষেতি নেই, হালুম, কিন্তু হাই-হ্যালো ছাড়ো, আমি এসেছি হাওয়ায় জোয়ান তরতাজা মরদের বদগন্ধের সৌরভের খবর পেয়ে, হালুম, বয়েস হয়ে যাচ্ছে, হালুম, তাই তোমার বীজ সংগ্রহ করতে এলুম, হালুম, যত জোয়ান বাঘ এই এলাকায় ছিল, হালুম, সব কটাকে চিনের চোরাকারবারীরা হাড়মাসের লোভে নিকেশ করে নিয়ে চলে গেছে, হালুম, পড়ে আছে শুধু বুড়োগুলো, হালুম।

আমি তো ফার্স্ট-টাইমার। কি করে কী করতে হয়, তাই জানি না। ইউ হ্যাভ টু গাইড মি হাঊ টু ডু ইট উইথ এ সুইট টাইগ্রেস লাইক ইউ।

অত ইংরেজি না কপচালেও চলবে। ল্যাজের অবগুন্ঠন সরিয়ে আগে আমার স্ত্রীযন্ত্রের অগরু শোঁকো মুখপোড়া, হালুম, তবে তো বুঝবে, হালুম, আমি অনঘ-নিরঞ্জন হিটে আছি কি না, হালুম, নাক দিয়ে হৃদয়ে সৌরভবার্তা গেলেই, হালুম, দেখবে বাদবাকি কাজ আপনা-আপনি ঘটে যাচ্ছে, হালুম।

শিলাদ তাই করল, আর লো অ্যান্ড বিহোল্ড, নিজের অজান্তেই বাঘিনীর পিঠে সামনের দুই পা দিয়ে দাঁড়াল। নিজের অজান্তেই ওর পিছনের দুই পায়ের নখ মাটি আঁকড়ে ধরল আর কোমর মুহূর্মুহূ আগুপিছু হতে থাকল। সঙ্গে-সঙ্গে কিন্দম কিন্দম কিমাশ্চর্যম, নিজের অজান্তেই ওর ভাঁড়ার কিলবিলিয়ে সরসরিয়ে খালি হয়ে গেল। নিজের অজান্তে সামনের ঠ্যাঙ দুটো তৃপ্তিতে নেমে পড়ল। নিজের অজান্তে সদুর্জয়ার স্ত্রীযন্ত্র জিভ দিয়ে নিকিয়ে পরিষ্কার করে দিল।

শিলাদ যখন ভাবছে এবার দুজনে পাশাপাশি শুয়ে ঘুমোন যাবে, আর ব্যাপারটা অহরহ রিপিট করা যাবে, সদুর্জয়া হাসিমুখে বলল, হালুম, থ্যাংক ইউ মাই চাইল্ড, হালুম, পরের বছর দেখা হলেও হতে পারে, হালুম, যদি না চিনের ডলার-কমরেডরা তোমায়ও ধরে নিয়ে যায়, যাক, হালুম, ভারজিন যুবকের বীজ নিলুম, হালুম, আনন্দ নিলুম, হালুম, চললুম, হালুম।

সে কি? ব্যাস হয়ে গেল? আবার কোথায় বাঘিনী খুঁজতে যাব? এ কীরকম চোরপ্রপাত লোনলি প্ল্যানেট জীবন রে বাবা! সদুর্জয়া চলে যেতে শিলাদের মন খারাপ হয়ে গেল। তল্লাট ছাড়িয়ে রাতবিরেতে এ-জঙ্গল সে-জঙ্গল ঢুঁ মারল, যদি কোনো বাঘিনীর বদগন্ধের সৌরভ পাওয়া যায়। কত ঘোরা কত ফেরা কত এদিক কত সেদিক করেও কোনও বাঘিনীর দেখা পেল না। মেজাজ খিঁচড়ে গেল শিলাদের । ভাঁড়ার বাড়ছে বলে গায়ের বোটকা গন্ধও বাড়ছে, অথচ কোনো প্রেমিকার হিসি-হাগুর চিহ্ণমাত্র নেই ঘাসে।

নতুন বাঘিনীর খোঁজে বেরিয়ে একদিন বুড়ো চৌগোঁপপা বাঘের সঙ্গে দেখা হতে গোঁফে তা দিয়ে সামনের উরুতে পেছনের পা দিয়ে তালঠোকাঠুকির শেষে বুড়ো বাঘ বলল, এই মরসুমে বহু হালুম-হূলুম সত্বেও, বুড়ি-যুবতী-খুকি, খেঁদি-পেঁচি, নুলো-কানি কোনো বাঘিনী পায়নি। শিলাদ পেয়েছে শুনে বুড়ো বাঘ বলল, হ্যাঁ, আজকাল তো বয়স্কা বাঘিনীরা টয়বয় খোঁজে।

আরেকদিন খোঁজে বেরিয়ে, সাঁতরে ফেরার সময়ে, ঘুম ভাঙিয়ে ফেলার দরুন, কুমিরের খাঁজখোদরানো ভারিভরকম ল্যাজের ঝাপটানি খেয়ে গর্দানে ব্যথা ধরে গেল শিলাদের। এমন ব্যথা যে দিনপনেরো কেটে যাবার পরও গেল না; উল্টে বেড়ে গেল। ঘাড় বেঁকিয়েই কোনোরকমে একটা হরিণবাচ্চা ধরে কাজ চালাতে বাধ্য হল শিলাদ। তারপর বেশ কিছুদিন খালিপেটে চালাল। বাঘিনী না পেয়ে হাল ছেড়েই দিয়েছিল; আর এখন পেলেও বেঁকা ঘাড়ে ব্যথা নিয়ে কী করেই বা কী করবে। নিজেকে শুধোল শিলাদ, বাঘজীবন তো দেখছি প্যাঁচা গিরগিটি মাছের চেয়েও ফালতু। বাঘিনী মেলে না। তার ওপর ভাঙা ঘাড় নিয়ে আজেবাজে বাতিল মাছ খেয়ে সারাজীবন চালাতে হবে।

বিকেলের আগে একদিন, সকালে সূর্যগ্রহণ হয়ে গেছে, কাশাড় বনের উইংসের আড়াল থেকে ধুমসি শরভ-হরিণদের নৃত্যনাট্য দেখছিল শিলাদ। নিচু দিয়ে উড়তে-উড়তে একটা ফেকনতোলা টিয়া আরেকটা টিয়াকে বলল, এই বোটকা মালটা কোত্থেকে এল রে সুনন্দা, আমেরিকা না ইজরায়েল? সেই বুড়ো বাঘটার এলাকা গায়ের জোরে জবরদখল করে বসে আছে। এদিকে ভাবখানা এমন যে কতই না দুঃখ অবসাদ মনোকষ্ট। অন্যের মোতা গাছে পেচ্ছাপ করা তো মতাদর্শগত বিচ্যুতি।
সুনন্দা নামের টিয়া যা বলল , তা দূরে চলে যাবার দরুণ পুরোটা শুনতে না পেলেও এই কথা গুলো কানে এল শিলাদের, ‘নিজেকে আলেকজান্ডার কিংবা দারিয়ুস ভাবছে, মুতে-মুতে জবরদখল আর পাকাপাকি রাজ্যপাট, হাঃ হাঃ হাঃ…’

পিত্তি জ্বলে গেল শিলাদের। বুড়ো বাঘটা শিলাদের গর্দান ব্যথার খবর পরয়ে ওর এলাকায় আধ-খাওয়া শুয়োর ফেলে গেছে কোন ফাঁকে, ঠাট্টা করে, জানে যে শিলাদ এখন কোনো শিকার ধরতে পারছে না। শিলাদের মুত পুঁছে তার ওপর নিজের হিসি দিয়ে নাম আর এলাকাচিহ্ণ দিয়ে হক প্রতিষ্ঠার হুমকি দিয়ে গেছে।

গর্দানটা ঠিক হোক, ব্যথা কমুক, তারপর যে যে অপমান করেছে তার তার টেঁটা মটকে টিভি কোম্পানিদের রান্না শেখাতে পাঠাবে শিলাদ। এই সব সাত-পাঁচ সাত-সতেরো চিন্তার খেই নয়ছয় করে ওর মাথা ঘেঁষে উড়তে উড়তে ধীবরকান্তি সেনগুপ্ত নামের এক দাঁড়কাক পুচ করে মুখে হেগে দিয়ে বলে উঠল, হেঃ হেঃ, আমাগো বাপও কম্যুনিস্ট আছিল। থাবা দিয়ে মুখ পুঁছে নিল শিলাদ। দাঁত খেঁচানো ছাড়া আর উপায় নেই। থাকত শকুন তো এক লাথি মেরে আকাশ থেকে জলে ফেলে দিত। প্যাঁচা থাকলে মাঝরাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে কাউয়া তন্দুরি বানিয়ে অয়েস্টার সস দিয়ে খেত। গিরগিটি থাকলে বদ্যি বামুনটার ডিম ফি বছর খেয়ে-খেয়ে করে দিত নির্বংশ।

নিঃসঙ্গ একা নির্বান্ধব অসহিষ্ণু সাহেবান অন্তর্মুখী উপাংশু থাকাটা, শিলাদ অনুভব করল, বাঘ হবার বিড়ম্বনা; একলষেঁড়ে হয়ে থাকতে হবে, আর তা এনজয় করতে হবে। অথচ তেমন প্রক্রিয়া ঘটছে কই! এই জীবন তো আমি বাছাই করে নিইনি; এ তো অ্যাকসিডেন্টাল, ঘটনাক্রমের চাপিয়ে দেয়া, বরং বলা যায় নিছক রাসায়নিক দুর্ঘটনা।

ঘাড়ে ব্যথা সারছে না; কে জানে, হাড়ই ভেঙে গিয়ে থাকবে। বাঘ মাছ গিরগিটি প্যাঁচার জীবনে শকুনের মতন গ্রীবার গর্ব নেই । আর কি ফিরে শকুন হওয়া যায় না? লেসারস্কোপিক চোখ দিয়ে পরখ করে, মাথাসুদ্ধ পুরো গলা ঢুকিয়ে দেয়া যেত খাবারের হৃদয় অব্দি, মগজ অব্দি, কলজে অব্দি। জল স্হল অন্তরীক্ষ সবই তো দেখা হল।

বোয়াল-মাছের ভুনিখিচুড়ি আর ভেটকি ফ্রাই খেয়ে দুপুরের ন্যাপ নিচ্ছিল শিলাদ তরফদার। রাঙাপোঁদা বাঁদরদের মহাসমাবেশের স্লোগানধর্মী চেঁচামেচি শুনে চানাকানি ভাদাইল ঘাসের মাঝে আড়মোড়া ভেঙে উৎকর্ণ হতে বাধ্য হল। মানুষের পিতামহ-পিতামহীদের নিয়ে এই-ই সমস্যা, নিরিবিলিতে তিষ্ঠোতে দেয় না। কমান্ডো না রেখে বুনো মৌমাছিদের শ্রমিক টাস্কফোর্স হয়ত পিকনিক করতে গেছে ভাটফুলের শাহীবাগানে, আর সেই ফাঁকে মৌচাকে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে মধু আর মোম তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে রাঙাপোঁদারা।

কিন্তু না। চুলেল পানার শ্যাওলা সরিয়ে, সুন্দরীর আকাশমুখো শেকড়ে নৌকোর কাছি বাঁধছে জনা-আটেক তুন্দিভ ডাকাত। তিন জনের কাঁধে মাস্কেট, কোমরে বুলেটের বেল্ট। জমধর, ন্যাপালা, কিরিচ, কেঁচা, মুগুর, আসানড়ি, পেটো, নৌকোয় তেরপল চাপা দিয়ে রাখা আছে নিশ্চয়।

ডাকাতগুলো এখন পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত খাবে। তারপর ছ-জন নাক ডেকে ঘুমিয়ে রাতে বেরোবে গেরস্ত জেলেদের নৌকোসুদ্ধ বমাল ধরতে। কাদের ধরতে হবে সে খবর ওরা পঞ্চায়েতের লোকেদের ভাঙিয়ে জেনেছে। ছাপোষা জেলেগুলোকে ধরে একজনকে বলবে বাড়ি থেকে টাকা সোনাদানা এনে মানুষগুলোকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে। পুলিশে খবর দিলে সবাইয়ের গলার নলি কেটে গাঙে ভাসিয়ে দেবে। শকুন থাকলে সেসব লাশ খাওয়ায় নিষেধ ছিল না শিলাদের; কিন্তু বাঘ হবার ফলে মরা মানুষ খাওয়া যাবে না। জীবজগতের অবমাননা হবে তাতে।

এসব আন্তর্জাতিক ঝুঠঝামেলায় জড়িয়ে পড়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, নিজেকে বোঝাল শিলাদ। নয়তো বাঁটকুল ভুঁড়িদাস গদাইলস্করটাকে টুঁটি কামড়ে কেওড়াঝোপে তুলে নিয়ে গেলে সত্তর কিলোর মত গলস্তানি হাড়মাংস তো বটেই, দু কিলো গর্মাগরম চর্বিও খাওয়া যেত সুড়ুপ-সুড়ুপ করে। দুটো মাস্কেটধারী জেগে পাহারা দেবে, অতএব গতিক সুবিধের নয়। হাল্কা থাবায় ঘন জঙ্গলের ভেতর কেটে পড়ল ও, শিলাদ তরফদার। দাদু যে কেন এই জলজঙ্গলের ধারেকাছে না যেতে পইপই করে বলত, তা এখন টের পাওয়া যাচ্ছে।

বসন্তঋতুর মাঝ-দুপুরে, শিষে খালের দলুজে গলা অব্দি চুবিয়ে আমেজ নিচ্ছিল শিলাদ। দেবী দোলায় এসে চলে গেছেন ঘোড়ায় চেপে। মড়ক লেগেছে বটে, নয়তো এতো মাটিগলা রঙওঠা প্রতিমার খড়বিচালি আসছেই বা কোত্থেকে ? তার আগে বিশ্বকর্মার এসেছিল। সেদিনকে একটা আড়মাছ ধরেছিল শিলাদ; ছেড়ে দিতে হল। মহিষাসুরের গায়ের তিতকুটে সবুজ রঙ খেয়ে মায়ের দয়া হয়েছিল মাছটার।

ঘাড়ের আনচান ব্যথাটা ডানকাঁধ অব্দি ছড়িয়েছে। ফলে, গরম রক্তের ডিশ পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। ফাল্গুনের শেষাশেষি, গাছে-গাছে লাল-হলুদ ফুল, খালের কমজোরি সোঁতায় নিজেকে চুবিয়ে, যাতে বাঘিনী না পাবার তাপ কমে, শিমুল-পলাশের ডালে-ডালে ঠাকুরাল-বাঁদর শিক্ষক -শিক্ষিকাদের ছাত্র পড়ানো দেখছিল শিলাদ।প্রগতিশীল বাঁদর স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বেশ হোঁতকা-হোঁতকি রাঙা পোঁদা রাঙামুখো। কারোর চতুর্থ হাতে বিপত্তারিণির হর্তুকি, কারোর তৃতীয় হাতে জয় বজরংবলির মাদুলি, কারোর দ্বিতীয় হাতে রুপোর চেনে মাকলা-বাঁশের শেকড় বাঁধা। ছাত্র-ছাত্রীরা রোগা টিংটিঙে।
একজন টিচার বেশ ঠাটি, ফুটেক ল্যাজের ছড়ি উঁচিয়ে, মগডাল থেকে তাক-তিড়িং-তুং লাফ মেরে ক্লাসে নামল, তারপর, হেঁচকা মেরে, এক মাওরা ছাত্রীকে চামড়াসুদ্ধ এক-খাবলা লোম তুলে নিয়ে যেতে, বাকি শিক্ষক-শিক্ষিকারা পেছনের দুহাতে তালি বাজিয়ে বাহবা দিল। এরপর এক ধিঙ্গিনাচন শিক্ষিকা, পলাশের কাঁটাদার

জিঙ্গলকাঠি ভেঙে তিন হাত দিয়ে এক কচি ছাত্রকে দমাদম উত্তম-মাধ্যম দিতে, সে আধমরা হয়ে গাছের নমনা আঁকড়ে ঝুলতে লাগল। অন্যসব পিশিনচি শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রশংসায় এডালে-সেডালে হুপহাপ লাগাল। পরের ক্লাসের শিক্ষক অন্য গাছ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে তিন ছাত্রীকে বলল, চার হাতের মুঠোয় মৌমাছির ঝাঁক ধরে রাখতে; ছাত্রীদের অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখে হেসে-হেসে ছ্যাদলাপড়া দাঁত বের করে বাদবাকি শিক্ষক-শিক্ষিকারা হুটোপাটি-লুটোপাটি করতে লাগল। এবার তিনজন কেঁদো শিক্ষক মিলে এক ছাত্রকে কিল-চড়-থাপ্পড় মেরে-মেরে অজ্ঞান করে ফেলল। পুরো শিক্ষকমণ্ডলী আনন্দে ছৌনাচ নাচতে লাগল সরকারের এবং নিজেদের প্রগতিশীল শিক্ষাধারা অনুযায়ী।

শিলাদ তরফদার নিজেকে বোঝাল, ভাগ্যিস ও মানবজীবন চায়নি বা পায়নি। সেক্ষেত্রে ছাত্র আর শিক্ষক দুটো স্তরের রাঙাপোঁদা রাঙামুখো পর্ব পেরোতে হতো। শিক্ষকরা তো মানব গড়ার কারিগর।

চৈত্রের শুক্লা ত্রয়োদশীতে, চিংড়িচাষির পোষা দলছুট ছাগল ধরে এনে খেয়ে-দেয়ে খালের জলে আঁচিয়ে ঝিমোচ্ছিল শিলাদ। বিটকেল পেঁকো গন্ধ আর তার চেয়ে বিটকেল আওয়াজে তন্দ্রা কেটে গেল। ভোঁদাকালুটুয়া দুলকিপোঁদা দুটো শুয়োর গদাম-গদাম করে মারামারি করছে হিন্দি সিনেমার গাঁটকাটা তিলেখচ্চরদের ঢঙে। মজা দেখতে ভিড় করেছে জনাদশেক বয়স্ক শুয়োর-শুয়োরনি আর তাদের খানচল্লিশের অ্যান্ডাবাচ্চা। শুকনো ছনঘাসের ফিকেহলুদ পর্দার আবডাল থেকে ওদের গেঁতোমি ভালই দেখতে পাচ্ছিল শিলাদ।

খোটেল শুয়োর দুটো পেছিয়ে যাচ্ছে, তার পর নানা অভিযোগ তুলে কাঁচা খিস্তি দিতে-দিতে একজন আরেকজনের মাথায় দড়াম, আবার দড়াম, তারপর আবার দড়াম। অভিযোগের ফিরিস্তি শিলাদের কানে আসছিল: সুপারির ট্যাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করিস না, বিরোধী প্রার্থীকে মাস্তান সাপ্লাই দিয়েছিস, ধর্ষণে যাবার আগে আমাদের সঙ্গী করিস না, আমার এলাকায় ট্রাক লুটিস, পুকুর বোজাবার আমাদের গুয়ের গাড়ি ছিনিয়ে নিস, আমাদের এলাকার ঠিকেদারি নিয়ে নিস, পুজোয় তোলা আদায় করে পুরোটা রেখে নিস, আমার চুল্লুঠেকের খবর পুলিশকে দিস, আমাদের পাচারের মাগিদের পেছন শুঁকে বেড়াস, ইত্যাদি।

ওসব রাজনৈতিক চাপান-উতোর শুনতে-শুনতে নিদারুণ বিরক্ত শিলাদ হা-লু-ম হাঁক পেড়ে ভিড়কে ছত্রভঙ্গ করল। শুয়োর পাকড়াও করতে গেলে তেঁদুলে টুঁটির তল ভাঙা ঘাড় নিয়ে পারা যায় না বলে এই র‌্যাশান বড় একটা তোলে না শিলাদ। স্টক হিসাবে দেখে রেখেছে। কোনো কিছুই না পাওয়া গেলে তখন দেখা যাবে। আসলে পেট ফাঁসিয়ে কব্জা করলে পাঁক আর গুয়ের মিক্সচারের এমন পচা দুর্গন্ধ বেরোয় যে খেতে গেলে বমি পেয়ে যায়। ব্যাটাদের ধরে-ধরে মানুষদের হরিণবাড়িতে পাঠানো উচিত। অভাবী মানুষরা বাঁচুক খেয়ে-পরে।

শুয়োরের চেয়ে শকুন জীবন অনেক শ্রেয়। গু-গোবর ঘাঁটতে হয় না। নোংরা করার বদলে পরিষ্কার করার কাজে আত্মনিয়োগ করা যায়। আবার কি শকুন হওয়া সম্ভব? শিলাদের আফশোষ হয়। ইচ্ছে করে প্রায়শ্চিত্ত করতে। বাঘ হয়ে নীলাকাশ নেই, উড়াল নেই। প্যাঁচা থাকতে ছুটকো-ছাটকা উড়াল ছিল, সবই প্রায় অন্ধকারে। শকুনের ভাগ্যে কত আলো, কত রুপালি-সোনালি মেঘ, অফুরন্ত আকাশ। গিরগিটির কেবল পালিয়ে বেড়াও, লুকিয়ে বেড়াও; কোনো স্বাধীনতা নেই, পরোপকার নেই। মাছের তো খোলা হাওয়াও নেই, সবুজ প্রান্তর আর বন নেই, নিঃশেষ নীলিমা তো নেইই। মনমরা লাগে শিলাদের। নিজেকে নিজের কাছে, নিজের বাছবিচারের সম্ভবানার কাছে, বেঁচে থাকার খামখেয়ালি অথচ নির্বিকার স্রোতের কাছে, নিজেকে পরাজিত লাগে, হেরো, পরাভূত।

এই-ই উন্নততম প্রাপ্তি, মেনে নিয়ে, জঙ্গলে ঝোপে বাদায় খালে গাঙে নদীর চরে দ্বীপে একা-একা ঘুরে বেড়ায় শিলাদ তরফদার। মাঝে-মাঝে তাকায় আকাশপানে। দাদু এত দিনে বুড়ো থুথ্থুড়ে হয়ে গিয়ে মারা গিয়ে থাকবে; নিঋিতির সঙ্গে মেয়াদি করারের সংসার করে উড়ে গিয়ে থাকবে ওর একের পর এক স্বামীরা। মণীশ মলহোত্রা আর রিতু বেরির নকশায়িত পোশাকে দেশে-বিদেশে নানা নদী-সাগরে খাঁজের আলো-অন্ধকার দেখিয়ে চলেছে বুক-পাছা দোহারা আর কোমর একহারা ঝলমলে সুন্দরীরা, বা হয়ত ঘর বেঁধেছে প্রবালঘাটা-শৈবালঘাটায়। খোকাখুকু বাঘের সঙ্গে খেলছে সদুর্জয়া কোনো গরানবাগিচা বা সুন্দরী ফরেস্টে। রংবেরং ডিম ফুটে বেড়া টপকে গুবিস্ফোরক নিয়ে ঘাপটি মারছে জঙ্গিলারা ।

বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে, গাঙের টলটলে জলে, কুলকুচো করার জন্যে নেমেছিল শিলাদ। দুঃখ কষ্ট ক্রোধ ক্ষোভ গ্লানি উদ্বেগ উৎকন্ঠা অবসাদ বিরক্তি, মনের অবস্হা যেমনই হোক না কেন, বাঘ হয়ে ওর প্রতিবিম্বটা হাসিমুখ দেখায়, সম্ভবত নাকের দুপাশে গোঁফের ঢেউ-এর জন্য। প্রতিবেশি বলে তো কেউ নেই, বাঘ হবার ফলে তা থেকে ও বঞ্চিত; নয়তো তারা ওর মুখ দেখলে ভাবত যে শিলাদ বেশ আনন্দেই জীবন কাটাচ্ছে। কোথায় শকুনের টিকোলো নাক আর কোথায় বাঘের অতি-থ্যাবড়া নাক। চোখ দুটো ঘোড়েলের মতন; শকুনের দার্শনিক গাম্ভীর্য নেই।

প্রতিবিম্ব দেখতে মশগুল ছিল ও, শিলাদ তরফদার। শুকনো পাতার ওপর কিছু চলছে অনুমান করে পেছন ফিরে দেখতে চাইল। তখনই রাইফেলের বুলেটটা ওর কপালে লেগে খুলি ঝাঁঝরা করে দিল। তবু, দ্রুত বাঁক নিয়ে আক্রমণকারী যেদিকে সেইদিকে লাফ মারল। মাত্র পাঁচ ফিট উঠে ছিটকে পড়ল। পর-পর চারটে গুলি লাগল বুকে আর পেটে। শিলাদ বুঝতে পারল ও মরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর টের পেল ওর পা বাঁধা হচ্ছে নাইলনের দড়ি দিয়ে ; চোখে-মুখে আর বুলেটের চ্যঁদাগুলোয় মাছি বসছে, সেই সঙ্গে জঙ্গলি পিঁপড়েরা সার বেঁধে কুচকাওয়াজ করতে-করতে রক্তাক্ত আঘাতে ঢুকছে।

নিথর নিস্পন্দ মৃত শিলাদ আক্রমণকারীদের এই কথাগুলো বলতে শুনল:

—কপালে গুলি মারলি কেন? মাথার চামড়াটা ড্যামেজ হলে ভাল দাম পেতে অসুবিধা হবে জানিস না?

—আমি ঠিকই এইম করেছিলাম। টার্গেট হঠাৎ নড়ে যাওয়ায় মাথায় লেগে গেল।

—মাথায় লেগে বরং ভাল হয়েছে। বারো ফিট লম্বা শিকার। তিনশো কিলোর হেভি-বডির একখানা মরা থাবাও কাৎ করে দিতে পারত যে কাউকে।

—কারেক্ট। ও হল রয়াল বাঙালি টাইগার; ও জানে যে মানুষকে বিশ্বাস করা পাপ, জিন্নত-উল-বিলাদ বলে কথা।

—অলরেডি ডেড; রক্ত গরম থাকতে স্কিনটা বের করে নে।

—পেট থেকে লম্বালম্বি চিরবেন, জানেন তো?

—আরে ও যথেষ্ট অভিজ্ঞ। ওর নিজের পোচিং কিট আছে। রণথম্ভোর আর সারিস্কায় ও শিকারদের প্রতিবারেই ভালভাবে ছাড়িয়েছিল।

—হ্যাঁ, তিব্বতের সেই চিনেটা ভাল পেমেন্ট করেছিল। তবে ও ব্যাটা ছ্যাঁচড়া। ডলারে পেমেন্ট করতে চায় না, তার ওপর ওকে হাড় মাংস নাড়িভুঁড়ি সব শুকিয়ে সাপলাই দেবার ঝক্কি। ও সব ইউপি সাইডাররা করতে পারে। আমি বিজনেসে পরিচ্ছন্নতায় বিশ্বাস করি।

—এবারের পার্টি কুয়েতের শেখ, তাই চিন্তা নেই।

—সবাই মিলে টানতে-টানতে গাছের তলায় নিয়ে চলুন, নয়তো আকাশের দিকে তাকিয়ে বনবাবুদের সন্দেহ হবে।

শুকনো পাতার ওপর বেছানো বাঁশের টুকরো বা হেঁতালখুঁটির ওপর দিয়ে ওকে টেনে নিয়ে যাওয়া হল, পায়ের বাঁধন খুলে অতিযত্নে চামড়া ছাড়ানো হল, ওর ছাড়ানো দেহটা একইভাবে ঠেলে গাঙের জলে ফেলে দেয়া হল, ও চলে গেল জলের তলায়, সবই বুঝতে পারছিল শিলাদ।

জলের তলায় ওর পরিচিত মাছেরা কাঁকড়ারা পোকারা ওর টাটকা মাংস খেয়ে ঢেঁকুর তুলতে-তুলতে চলে গেল। জলে ডুবে থেকে, রক্ত বয়ে গিয়ে, কয়েক দিনে ফ্যাকাশে হয়ে ভেসে উঠল শিলাদ তরফদার।

বড়-বড় মাছেরা ঠোকরাতে থাকলে, ভাসতে-ভাসতে স্রোতের অপলকা ধারায় পড়ল শিলাদ। ও বুঝতে পারছিল খাল থেকে বেরিয়ে, নদীর ভাটার টানে পড়ে বয়ে চলেছে। সমুদ্রের দিকে।

কয়েকটা কাক এসে ওর ওপর বসল, ঠোঁটের কাঁটাচামচ দিয়ে ব্রেকফাস্ট খেয়ে, অন্য কাকদের বলতে গেল। অন্য কাকের দল এল। তাদের তাড়িয়ে কয়েকটা ভূবনচিল এল । তাদের তাড়িয়ে, বিশাল ডানা দুদিকে ছড়িয়ে ওর ওপর এসে বসল দীর্ঘদেহী, উন্নতনাসা এক শকুন।

বৃদ্ধ শকুন নিজের মনে বিড়বিড় করছিল, নাতিটা কোথায় যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, কোনো খোঁজখবর নেই, কত জায়গায় যে ওড়াউড়ি করলুম, কোথাও খুঁজে পেলুম না, কেমন আছে কে জানে।

দাদুকে চিনতে অসুবিধা হয়নি শিলাদের। দাদু-দাদু চিৎকার করেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারল না। নিজের শবের ওপর দাদুকে নিয়ে ভেসে চলল শিলাদ তরফদার।

একটি প্লাবনের ইতিবৃত্তকথা

একটি প্লাবনের ইতিবৃত্তকথা
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
অলংকরণ - মৈনাক দাশ


(এ লেখায় লোকজনের নামধাম বদলে দিয়েছি)

“গত শুক্রবার গঙ্গার জল বেড়ে মানিকচকের গোপালপুর এলাকায় বাঁধ ভেঙে জনবসতি অঞ্চলে ঢুকে পড়ে। ডুবে গেছে ১৫টি গ্রাম। জল বইছে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। ক্রমাগত বর্ষণে ডুবে গেছে মানিকচক, রতুয়া, হরিশ্চন্দ্রপুরের বেশ কিছু জনবসতি। সেচ বিভাগের কার্যনির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার শ্রী-----”

মানুষের নামগুলো বদলায়। বদলায় ১৫, ২৫ এই সংখ্যাগুলো। গোপালপুর কখনো হয়ে যায় ভুতনির চর, কখনো ইংলিশবাজার। গল্পটা কিন্তু একই থাকে। ২০১৩ সালের এই নিউজ রিপোর্টটা পড়ছিলাম আমার ট্যাবে খবরের কাগজের ইন্টারনেট এডিশনে। এর বাইশ বছর আগে প্রায় এই একই রিপোর্ট পাঠিয়েছিলাম রাইটার্সে। টেলিগ্রাফিক মেসেজে। প্রযুক্তি বদলেছে। আমি বদলেছি। বদলায়নি ওই মানুষগুলোর কপাল। ডেভেলপমেন্ট কাকে বলে কে জানে!

| ১ |

১৯৯১ সাল। বাড়ি ছেড়ে ২৫ বছুরে তরুণ মালদা গিয়ে ঠেকেছি জীবিকার তাগিদে। রাজ্যসরকারের সদ্যোনিযুক্ত আমলা। তখনো প্রবেশনের মধুচন্দ্রিমায় বুঁদ। খাইদাই অফিস যাই, হাতেকলমে কাজকর্ম শিখি গুরুজনদের সস্নেহ তাগিদে। দায়দায়িত্ব নেই বিশেষ। পরিসংখ্যান নিয়ে একটা সর্বভারতীয় পরীক্ষা দেয়ার জন্যে পড়াশোনা করছি জোরকদমে। এমনি একদিন কল্যানিতে মাস্টারমশাইয়ের কাছে আসব বলে শুক্কুরবারে সি.এল নিয়েছিলাম। পরীক্ষার তখন দিন কুড়ি বাকি। ডি.এম সাহেব লোকটি ভালো। বলে দিয়েছেন, কেরিয়ার অ্যাডভান্সমেন্টের জন্যে ছুটি কোন সমস্যাই নয়।

সেটা বর্ষাকাল। বুধবার সকাল থেকে বৃষ্টি নামলো। সে দিন গিয়ে পরের দিনও সে বৃষ্টির বন্ধ হবার কোন লক্ষণ নেই। শুক্কুরবার একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের মকদুমপুর ডাকবাংলোর সামনে এক হাঁটু জল জমে গেছে। এক বছরের সিনিয়র প্রবেশনার অনিমেষদা সেইদিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বললো, “তৈরি হয়ে যাও হে। লক্ষণ ভালো নয়। শুভ্ররা তো কালিয়াচকের দিকে অলরেডি রওনা হয়ে গেছে।”

“ভাল নয় মানে?”

“ভালো নয় মানে ভালো নয়। হরিশ্চন্দ্রপুরের বিডিও-দার সঙ্গে কথা হল সকালবেলায়। ডি.এম ডেকে পাঠিয়েছিল। এক ফাঁকে ডাকবাংলো থেকে ঘুরে গেছে এসে। ফুলহার ফেঁপেছে বলে গেল। বিপদসীমার পঁচিশ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে জল বইছে। গঙ্গাও অলরেডি বিপদসীমা ছুঁয়েছে। রিং ড্যামে বালির বস্তা ফেলবার কাজ শুরু হয়ে গেছে ওদিকে। যা বৃষ্টির রকম দেখছি তাতে এইবারে না ধরলে আজকের দিনটা কাটবে বলে মনে হচ্ছে না। সকালে উঠে মহানন্দার দিকে গেছিলাম হাঁটতে হাঁটতে। গিয়ে দেখে এসো একবার অবস্থাটা।”

একটা ছাতা মাথায় দিয়ে অভিরামপুর বাঁধ রোডে উঠে চমকে উঠলাম। মালদা টাউনের একটা দিককে ঘিরে দাঁড়ানো উঁচু বাঁধরাস্তাটার তলা দিয়ে ফুলে ফেঁপে যে জলধারা চলেছে তার সঙ্গে আমাদের এতদিনের চেনা শান্ত মহানন্দার কোন মিল নেই। সেই প্রথম নদীর গর্জন শুনেছিলাম। চাপা, গম্ভীর একটা একটানা শব্দ উঠে আসছে ছুটন্ত জলের ভেতর থেকে। শুনলে ভয় লাগে।

ন'টা নাগাদ অফিসে পৌঁছে পরপর দুটো সার্কুলার পেলাম। একটা সংক্ষিপ্ত। তাতে আগামী পনেরোদিনের জন্য সমস্ত আধিকারিকের ছুটি বাতিল আর সেই সঙ্গে প্রত্যেককে তাঁর অধস্তন কর্মচারীদের জন্য একই নির্দেশ দেয়ার আদেশ। অন্যটা বেশ লম্বাচওড়া। তাতে আগামী পনেরোদিনের জন্য সমস্ত আধিকারিকের ডিউটি রোস্টার। কন্ট্রোল রুম থেকে ত্রাণকার্য—হাজারো কাজের ভাগ সেখানে। সরকারী জগন্নাথের চাকা ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে আসন্ন বিপদের আশংকায়। হাজারো ত্রুটিতে ভরা সেই চাকাই তখন প্রধানত কালিয়াচক, মানিকচক, হরিশ্চন্দ্রপুর, ভুতনির চরের লক্ষ লক্ষ মানুষের একমাত্র ভরসা।

কালেক্টরেট বিল্ডিঙের তলায় দেখি বেশ কিছু খালি ট্রাক দাঁড়িয়ে। নাজারত ডেপুটি কালেক্টর ঘোষদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এত ট্রাক কীসের জন্য ?” ঘোষদা হলেন কালেক্টরেটের সকল কাজের কাজি। যাবতীয় পরিকাঠামোর দায়িত্ব তাঁর হাতে থাকে। এই ট্রাকের বহরও নিশ্চয় তাঁকেই জোগাড় করতে হয়েছে আগের রাত থেকে। ঘুমহীন লাল চোখদুটো ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে এক ধমক দিয়ে উঠলেন, “তা দিয়ে তোমার কী কাজ হে ছোকরা? ও আমায় চিতেয় তোলবার মিছিলে লাগবে আজকে।” আমি আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে বিদেয় হলাম।

আমার ভাগে প্রথমে কন্ট্রোল রুম ডিউটি পড়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখি ছোটখাটো একটা কর্মযজ্ঞ চলেছে। কালেক্টরির কনফারেন্স রুম জুড়ে দু তিনটে টাইপরাইটার, টেলিপ্রিন্টার, গুটি তিনেক টেলিফোন ঘিরে বসে গুঞ্জন তুলেছেন একদল মানুষ।

এই কন্ট্রোল রুম হল বন্যানিয়ন্ত্রণের স্নায়ুকেন্দ্রবিশেষ। প্রতিমুহূর্তে অজস্র খবরের আনা নেওয়া, বিভিন্ন নির্দেশের যাওয়া আসা, কলকাতায় রিপোর্ট পাঠানো, সাংবাদিকদের উদগ্র কৌতুহলের পাগলামোকে সামলানো সেই সবকিছুই চলে এইখানে বসে।

সেইখানে এসে বসলাম যখন তখন বেলা বারোটা হবে। জেলার একটা বিরাট বড়ো মানচিত্র টাঙানো রয়েছে দেয়ালে। তার গায়ে বিভিন্ন বিপদগ্রস্ত এলাকায় লালনীল কাগজের টুকরো সেঁটে সদাপরিবর্তনশীল বন্যাপরিস্থিতির আপডেট দেয়া চলেছে। শুভ্র এবং আরো দুতিনজন আধিকারিক সকালে উঠেই বেরিয়ে গিয়েছিল এদের মধ্যে একটা স্পটে। জায়গাটায় গঙ্গা থেকে কিছুটা দূরে দূরে দুটো রিং বাঁধ রয়েছে। তাদের মধ্যে যেটা একেবারে নদীর কাছে তাতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বালির বস্তা ফেলে ফেলে ফুঁসে ওঠা জলকে আটকাবার যুদ্ধ চলছে তখন।

সন্ধে ছটার কিছু পরে সেখান থেকে মেসেজ এলো, “এমব্যাংকমেন্ট ব্রিচড। ফলিং ব্যাক টু ইনার রিং।”

এইবার, বন্যার উন্মত্ত শক্তির বিরুদ্ধে তাদের শেষ দেয়ালটা বাঁচাবার যুদ্ধ। সাধারণত ইনার রিং আউটার রিং-এর মত তত শক্তিশালী হয় না। ডি.এম অফিস থেকে সামান্য সময়ের মধ্যেই আদেশ চলে এল। এমারজেন্সি ইভ্যাকুয়েশান শুরু করতে হবে সংশ্লিষ্ট এলাকায়। খবর পাঠানো হল সে ব্লকের বিডিও অফিসে। সেখানকার টেলিফোন কাজ করছে তখনও। প্রৌঢ় ভদ্রলোকের উত্তেজিত গলা ভেসে আসছিল তারের ওপার থেকে, “ট্রাক তো মোটে চারপাঁচটা আছে। গাড়ি পাঠান। ইমিডিয়েট—”
এইবার বুঝতে পারলাম কালেক্টরেটের তলায় জমিয়ে রাখা ট্রাকবাহিনীর রহস্যটা। ফোন রেখে ইন্টারকমে ঘোষদাকে ধরলাম। তিনি তৈরিই ছিলেন দেখা গেল। প্রতি বছরই মোটামুটি সেই একই নাটক চলে তো! জানা গেল ইতিমধ্যে আরো দুটো স্পট থেকেও ট্রাক চেয়ে পাঠানো হয়েছে। একটা আশ্চর্য তেলখাওয়া যন্ত্রের মত কাজ করছিল আমাদের রিকেট রুগির মত সরকারী মেশিনারি। ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যে গর্জন তুলে পথে বের হয়ে গেল আঠারোটা ট্রাক।

ওদিকে তখন তিনটে এলাকায় গঙ্গা ফুলহার আর পুণর্ভবার সঙ্গে মরণপণ লড়াই চলেছে মেরামতকর্মীদের। রাত সাড়ে বারোটার সময় প্রথম খবর এলো কালিয়াচকের দিক থেকে। শেষ বাধাটাও সরিয়ে দিয়েছে ক্ষেপে ওঠা নদী। জল ঢুকছে হুড়মুড় করে। তারপর একে একে বাকি জায়গাগুলো থেকেও একই খবর এসে পৌঁছোতে লাগল কন্ট্রোলরুমে। সুবিশাল প্রাকৃতিক শক্তির সামনে মানুষের তৈরি সামান্য বাধা সরে গেছে। সামান্য সরকারী সাহায্য কিছু মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে মাত্র। বাকিরা সেই উদ্দাম জলরাশির সঙ্গে নিজেরাই লড়ছে নিজেদের লড়াইটা। জলবন্দি হয়ে পড়েছেন অসংখ্য মানুষ।

| ২ |

ত্রাণদপ্তরের ডেপুটি কালেক্টর হরিময়বাবু লোকটি মোটাসোটা, গোলগাল। জীবনে অনেক সাধই তাঁর পূরণ হয়নি। দেখা হলেই অপূর্ণ সমস্ত সাধ আহ্লাদ, অশক্ত শরীর ইত্যাদি নিয়ে বিলাপ করে সময় কাটান। তা, বন্যা উপলক্ষে দেখা গেল তাঁর একটা সাধ পূর্ণ হওয়ার পথ হয়েছে। ব্যাপারটা খুলে বলা যাক।

বাঁধ ভাঙবার পর আরো দুটো দিন কেটে গেছে তখন। আক্ষরিক অর্থেই নাওয়াখাওয়া ঘুচে গেছে কালেক্টরেটের অতগুলো মানুষের। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আঠারো ঊনিশ ঘন্টাই কাজ চলে। ওরই মধ্যে একটু আধটু বিশ্রাম, এক আধ চুমুক ঘুম চুরি করে নেয়া সদা কৌতুহলী সাংবাদিকদের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে। দেখতে পেলেই তো কাগজে ছবি ছেপে যাবে। হরিময়বাবুর ওপরেও চাপ পড়েছে ভালোই। আর তার সঙ্গে সঙ্গে সমানুপাতিক হারে বেড়ে চলেছে তাঁর বিলাপ।

আগের দিন রাতে আমার ডিউটি পড়েছিল ইংলিশবাজার ব্লকের একটেরেতে। রামকৃষ্ণ মিশনের পেছনদিকটাতে খানিক নিচু জায়গা আছে। সেখানে মহানন্দা এসে ঢুকে পড়েছে। অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গাতে লোকজনকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, তাদের হাজারো বায়নাক্কা, মেডিকেল এমার্জেন্সি সামলানো—সেইসব সেরে ভোরভোর ডাকবাংলোতে ফিরে মুখহাত ধুয়ে শান্তির বানানো এককাপ চা খেয়ে ফের ছুটেছি কালেক্টরেটের কন্ট্রোল রুমে। সেখানে ছটা থেকে আমার ডিউটি সেদিন।

কন্ট্রোল রুমে পৌঁছোতে দাদা ডেকে বললেন, “আর্মির হেলিকপটার এসেছে। ত্রাণসামগ্রী এয়ারড্রপ হবে চারপাঁচটা সর্টিতে। একবার গিয়ে একটু দেখে আসবে?”

বৃষ্টি তখন একটু ধরেছে। নিচে নেমে হেলিকপটারের মাঠের দিকে যাবার জন্যে জিপে উঠতে যাবো তা দেখি হরিময়বাবু ছুটতে ছুটতে আসছেন। ভারী শরীরে দৌড়টা অবশ্য খুব দৃষ্টিনন্দন নয়। কাছে এসে বললেন, “হেলিপ্যাডে যাচ্ছ নাকি? আমি উঠে বসি?”

হেসে বললাম, “আরে দাদা, আপনি হলেন ত্রাণকর্তা। ত্রাণবিতরণের প্রাণপুরুষ। আপনি যাবেন না তো কে যাবে। হাঁসফাঁস করে জিপের পেছনদিকে চড়তে চড়তে হরিময়দা মুখটা হাসি হাসি করে বললেন, “আর ত্রাণকর্তা! আকাশে উড়ে উড়ে খাবারের প্যাকেট ফেলা। কম ঝামেলা! এই বুড়ো বয়সে এত কি সয় ?”

মুখের কথাগুলোর সঙ্গে অবশ্য তাঁর শরীরি ভাষার কোন মিল ছিল না। জীবনে সম্ভবত প্রথমবার হেলিকপটার চড়বার সম্ভাবনায় মুখটা উৎফুল্লই দেখাচ্ছিল তাঁর। মজা করে বললাম, “ঠিকই তো হরিময়দা। অত উঁচু থেকে কোনক্রমে যদি একবার নীচে গিয়ে পড়েন তাহলেই তো চিত্তির।”

“যা বলেছো। এই ডি.এম ছোকরার কি সে কাণ্ডজ্ঞান আছে ? নইলে একজন বয়স্ক মানুষকে এইভাবে”

“ডি.এম বুঝি আপনাকে হেলিকপটারে চড়ে ত্রাণ দিতে যেতে বলেছে ?”

“আরে ধুস্‌। বলবে আবার কী ? ডিপার্টমেন্টটা আমিই তো দেখভাল করি। আমি না গেলে হয় ? শেষে এই নিয়ে দু'কথা শুনিয়ে দেবে’খন। যা মুখ লোকটার!”

“তা বটে। কাউকে তো যেতেই হবে সঙ্গে। তা হরিময়দা আমি বলি কি, আপনার বদলে আমিই না হয় চলে যাচ্ছি। ডি.এম-কে আমি সামলে নেবো'খন। বলে দেবো আপনার হার্টের অসুখ আছে। আকাশে উড়লে টুড়লে শেষে—”

হরিময়বাবু সাত তাড়াতাড়ি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আরে না, না। তা কী হয় ? তুমি বাচ্চা ছেলে, কিছু বুঝবে টুঝবে না, শেষে না গোল বাধে একটা।”

বুঝলাম, মুখে যাই বলুন ফাঁকতালে হেলিকপটারে চড়বার সুযোগটা তিনি হাতছাড়া করতে মোটেই রাজি নন।

হেলিপ্যাডে পৌঁছে হাসি হাসি মুখে হরিময়দা তো তাতে চড়ে বসলেন। কিন্তু খানিক বাদে বায়ুসেনার এক জোয়ান পাইলটের কাছে এসে আরেক জওয়ান ফিসফিস করে কিছু বলতে তিনি ভুরু কুঁচকে হরিময়দার দিকে ফিরে বললেন, “আপনার যাওয়া হবে না স্যার।”

হরিময়দা মুখটা ভেংচে বললেন, “কেন? কেন? আমি এ বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেট, আমাদের ডি.এম আমাকে কাজই দিয়েছেন ত্রাণ বিলির দেখাশোনা করার। আমায় বাদ দিয়ে—”

পাইলট ছেলেটি গোঁফের নীচে একচিলতে হেসে বলল, “আপনার ওজন তো প্রায় নব্বই কিলো হবে স্যার। আপনি সঙ্গে গেলে নব্বই কিলো খাবার আমাদের কার্গোতে কম নিতে হবে। সেটা কিন্তু খুব ভালো হবে না। আমাদের এয়ার ড্রপিং-এর একটা ডেলি টার্গেট দেয়া হয়েছে আপনাদের ডি.এম অফিস থেকে। টার্গেট পুরো না করতে পারলে যদি এক্সপ্ল্যানেশান কল হয় তাহলে আমাদেরও বলতে হবে যে ত্রাণবিভাগের ভারপ্রাপ্ত অফিসারকে নিয়ে যাবার জন্য সেটা ঘটেছে।”

হরিময়বাবুর মুখটা কালো হয়ে গেল। ভেবেচিন্তে ফের একটা কিছু বলতে গিয়েছিলেন, তা পাইলট সব তর্কে জল ঢেলে দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, “সরি, কোন নন-এসেনশিয়াল পার্সনকে এ ফ্লাইটে নেয়া যাবে না। আপনি নেমে যান। নাহলে আমি ফ্লাইট শুরু করব না।”

অতএব ছোকরার দিকে একটা বিষ নজর নিক্ষেপ করে হরিময়বাবু হেলিকপটার থেকে নেমে এলেন। মুখটা তাঁর কালো হয়ে গেছে। ছোট ছোট শখ আহ্লাদ, ছোট ছোট নিরাশা— একান্তই মধ্যবিত্ত স্বার্থপরতার জলছবি ফুটছিল আমার চোখের সামনে। মানুষটা খারাপ নন। শুধু মহাপ্লাবনের ট্র্যাজেডির বিরাট সে ক্যানভাসটাকে তাঁর চোখের সামনে থেকে আড়াল করে রেখেছিলো চোখের সামনে দাঁড়ানো একটুকরো আনন্দের ব্যাক্তিগত লোভ। না, শুধু এইজন্য তাঁকে খারাপ লোক কিংবা একটি জীবন্ত কার্টুন আমি একেবারেই বলতে রাজি নই। দারিদ্রের প্লাবনে ডুবতে থাকা গোটা দেশটাকে নিচে ফেলে রেখে ব্যক্তিগত সাফল্যের হেলিকপটারে একচক্কর উড়ান, একটা মার্কিন ওয়ার্ক পারমিট, স্ত্রীপুত্রকে নিয়ে দামী হোটেলে একটা ডিনার, বা সস্তায় টিকেট ম্যানেজ হলে একচুমুক বিদেশ ভ্রমণ—আর কিছু না হোক একবার থাইল্যান্ড ট্রিপ— কেই বা না চায় তা! আমিও তো সে দলের বাইরে নই। হরিময়বাবুকে কেন তবে নাহক দোষ দিই?

গর্জন তুলে রোটরের ঘুর্ণনে ঝড় জাগিয়ে যন্ত্রফড়িং এবারে উড়ে গেল তার গন্তব্যের দিকে। ছবিটা মনে মনে দেখতে পাচ্ছিলাম। পায়ের নিচে জল থইথই দুনিয়া—একদিকে ফুলহার আর অন্যদিকে গঙ্গার প্লাবনের সাঁড়াশি আক্রমণে চিরপরিচিত জায়গাগুলো জলাভূমি হয়ে গেছে। তারই মধ্যে কোন কোন মাথা জাগিয়ে থাকা জায়গায় আটকে পড়া অজস্র মানুষ—আর তাঁদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া যন্ত্রের পেট থেকে ছিটকে আসছে খাবার, ওষুধের প্যাকেট। সঠিকভাবে নদীকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারবার মাসুল হিসেবে, মানুষের সব হারাবার বিনিময়ে সামান্য রাষ্ট্রীয় ভিক্ষার খেসারত।

|৩|

ততদিনে বৃষ্টির তীব্রতা কমে এসেছে। কোথাও কোথাও জমে থাকা জলে টানও ধরেছে, কিন্তু তখনো জলবন্দী মানুষজনের ঘরে ফেরবার অবস্থা আসেনি। নদীগুলোর জল সামান্য নেমেছে বটে কিন্তু ফের বৃষ্টি নামলে জল আবার বাড়বে। বঙ্গোপসাগরের ওপর তখন আরো একটা ঘুর্ণি তৈরি হয়েছে। আবহাওয়া দফতর তার গতিপ্রকৃতি নিয়ে প্রবাবিলিটির অংক কষে চলেছে অবিরাম। যদি ওড়িশার দিকে চলে যায় তা তাহলে বাঁচোয়া। কিন্তু যদি এদিকে ঘুরে আসে তাহলে ফের একবার বিপদ ঘনাবে এদিকে।

এ সময়টা সাধারণত খুব বিপজ্জনক হয় নানা কারণে। জলে কিঞ্চিৎ টান ধরায় বন্যার শিকার গাছপালা আর পশুপাখির মৃতদেহে পচন ধরে। তার থেকে মহামারী ছড়াবার আশংকা থাকে। খাদ্য, পানীয়, গরম পোশাকের সংকট তীব্র হয়। তীব্র হয়ে ওঠে মানুষের মনের অসন্তোষও। সীমিত আর্থিক ও পরিকাঠামোগত শক্তি নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো আর সরকারী দফতরের কর্মচারীরা মুখ বুঁজে কাজ করে যান এ সময় আর তার পাশাপাশি রাজনীতির দাদাদিদিরা এবং মিডিয়া নিজেদের পেশাগত উন্নতির সন্ধানে চালিয়ে যান ক্রমাগত ছিদ্রান্বেষণের কাজ।

এই সময় একদিন ডাক পড়ল ত্রাণ দিতে যাবার কাজে। গন্তব্য ভূতনীর চর। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল গঙ্গা আর ফুলহারের মাঝখানে স্যান্ডউইচ হয়ে থাকা এই এলাকাটা। প্রথমে গাড়িতে করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মানিকচক হয়ে মথুরাপুরের কাছাকাছি যদ্দুর যাওয়া যায় এগিয়ে গিয়ে তারপর ফুলহার পেরিয়ে নৌকায় যাত্রা। বন্যাদীর্ণ সে পথে যাত্রার বর্ণনা দিয়ে এ লেখাকে ভারাক্রান্ত করব না। ত্রাণসামগ্রী ভরা নৌকো নিয়ে সেখানে পৌঁছে প্রথম অভ্যর্থনা পেলাম জল ভেঙে এগিয়ে আসা একদল রেগে ওঠা মানুষের কাছে। হাতে লাঠিসোঁটা, দা কুড়ুল যা পেয়েছেন নিয়ে তাঁরা এগিয়ে এসেছেন সরকারী নৌকোর দেখা পেয়ে। অভিযোগ, আমরা হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মরছি, আর তোমরা কী সামান্য ত্রাণের বন্দোবস্ত করেছো আমাদের জন্য? অভিযোগ মিথ্যে নয়। কিন্তু সত্যি করে বলুন তো, এতক্ষণ যা পড়লেন তাতে আমাদেরই বা ঠিক কতটা ব্যক্তিগত ত্রুটি ছিল ত্রাণকর্মের এই অপ্রতুলতায়? কার্যনির্বাহী আধিকারিকরা তো পলিসিমেকারের হুকুমের চাকরমাত্র। পরিকাঠামোর সীমাবদ্ধতার জন্য তাঁদের দায়ী করা আর জিনিসের দাম ও মানের ত্রুটির জন্য কোম্পানির সেলসম্যানকে গাল দেয়া একই ব্যাপার। কিন্তু গ্রাহক সেটা বুঝলে তো!

কোনমতে তাঁদের বুঝিয়ে সুজিয়ে ঠান্ডা তো করা গেল। ত্রাণকর্মের প্রধান ঘাঁটি হয়েছে স্থানীয় একটা স্কুলবাড়িতে। তার ভিটে উঁচু। সেখানে বহু মানুষের আশ্রয়। সেখানে গিয়ে টেবিল চেয়ার সাজিয়ে বসে কাজ শুরু করতে নতুন বিপত্তি। এক উঠতি বিরোধী রাজনৈতিক নেতা তখন সেইখানে বন্যাপরিস্থিতি ও সরকারী ত্রাণকর্মের সরেজমিনে তদন্তে এসেছেন। দুর্মুখ ও ফায়ারব্র্যান্ড নেতা বলে তাঁর তখনই বেজায় সুনাম। কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না। কম্বল বিলি হচ্ছে তখন। হঠাৎ দেখা গেল পাশের টেবিলের সামনের লাইন থেকে এক বৃদ্ধ হাউমাউ করে চিৎকার করতে করতে নেতার কাছে গিয়ে হাজির। অভিযোগ, “এনারা আমার কম্বল মেরে দিয়েছেন।”

নেতার মুখে বর্ষার মেঘ জমে উঠল। সুযোগটা বেশ জম্পেশ। চোখদুটি ঘুরিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করে তিনি টেবিলে কর্মরত আধিকারিকটির সামনে গিয়ে রণং দেহি ভাব নিয়ে দাঁড়ালেন। অবস্থা বেগতিক দেখে আমাদের দলের মধ্যে সবচেয়ে পোড়খাওয়া আধিকারিকটি গিয়ে পড়লেন গন্ডগোলের মধ্যে।

নেতার কন্ঠে গোলাবর্ষণ হল, “ইনি এটা কী বলছেন?”

বয়স্ক আধিকারিকটি এমন অনেক নেতা দেখেছেন তাঁর দীর্ঘ কার্যকালে। বুদ্ধি না হারিয়ে শান্ত গলায় বললেন, “কাইন্ডলি আমাকে একটু দেখতে দিন।”

“দেখবেন আর কী ? আচ্ছা ঠিক আছে—দেখুন—”

আধিকারিক তখন বৃদ্ধের মুখোমুখি হলেন, “নাম কী?”

“ইছমাইল শেখ।”

“বাড়ি?”

ইছমাইল শেখ তাঁর ঠিকানা বললেন। রেজিস্টারের পাতায় খোঁজাখুঁজি করে খানিক বাদেই খুঁজে পাওয়া গেল, দিনদুই আগে আসা ত্রাণকর্মীদের থেকে জনৈক মুনির শেখ টিপছাপ দিয়ে দুটি কম্বল নিয়েছেন। ঠিকানা এক। বাবার নামের জায়গায় ইছমাইল শেখের নাম।

“এই তো তোমার ছেলে এসে কম্বল নিয়ে গেছে। তাহলে? এটা কি জাল?”

বৃদ্ধ একটু থতমত খেয়ে চুপ হয়ে গেলেন।

সুযোগটা নিলেন আমাদের সিনিয়র। বললেন, “তাহলে ডাকাই তোমার ছেলেকে? এসে সাক্ষী দিক? সরকারী কাজে মিথ্যে কথা বললে—”

বৃদ্ধ একটু অপ্রস্তুত ভাব করে তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। জোলো হাওয়া দিচ্ছিল তখন। বিকেল হয়ে এসেছে। একটা ছেঁড়া লুংগি আর গামছায় দুর্বল কাঠামোটা থরথর করে কাঁপছিল তাঁর। তারপর হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে বললেন, “দুটা কম্বল বাড়িতে নে যেতে সে মাগী দুটাই নিয়ে নেছে। একটা তার আর তার শৌহরের জন্যে আর অন্যটা ছাওয়ালগুলোর জন্য। আমাদের বুড়াবুড়ির কম্বল নাই।”

“কিন্তু, সরকারী নিয়ম যে চাচা। পরিবার পিছু দুটোর বেশি কম্বল আমরা দেবো কেমন করে? দেখো না কত লোক এখনো একটাও কম্বল পায়নি?”

নেতাও দেখা গেল ব্যাপারটার মর্মার্থ টের পেয়েছেন ততক্ষণে। বেশ একটা কিংকর্তব্যংবিমূঢ় অবস্থা চলছে তখন হঠাৎ ইসমাইল শেখ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলে, “বাপ মায়ের খেয়াল রাখতে পারেনা অমন ছাওয়ালে আমার কাজ নাই। লিখে নেন ওরে আমি ত্যজ্য করলাম আজ থিকে। আমার আর বিবির আলাদা পরিবার। লেখেন, নাম লেখেন। দুটা কম্বল আমাদের লাগে—”

একটা হাসির অট্টরোল উঠছিল চারদিকে। নেতার মুখের বজ্রবিদ্যুতও উধাও হয়ে গেছে ততক্ষণে। একটা তিক্ত, বিষাক্ত, অন্ধকার কমেডির সামনে দাঁড়িয়ে বুকের মধ্যে মোচড় দিচ্ছিল আমার। কেন মরতে এ চাকরি করতে এলাম আমি? ভালোই তো ছিলাম আমার শহরের চারদেয়ালের মধ্যে, আমার লিটল ম্যাগ, আমার রবীন্দ্রসদনের গান, আমার মার্কস, মাওসেতুং, রবীন্দ্রনাথ, মহীনের ঘোড়াগুলি, আমার সিস্টেমকে তীক্ষ্ণ ভাষায় গালাগাল করবার কাগুজে বিপ্লবকে সঙ্গে নিয়ে রঙিন একটা ইন্টেলেকচুয়াল ফানুসের ভেতর। কেন মরতে আমার দেশকে দেখতে এসেছিলাম এই নরকে?

সরকারী নিয়ম। তার হাকিম হেলে তো হুকুম হেলে না। অতএব বুড়োকে কম্বল দেবার অবস্থা তখন আমাদের নেই। অবশেষে সেদিন আমাদের মান বাঁচিয়েছিল এক নববিবাহিত কৃষকদম্পতি। তখনো সন্তান আসেনি তাদের ঘরে। নিজেদের ভাগের একটা কম্বল তুলে দিয়েছিল তারা ক্রন্দনরত বৃদ্ধের হাতে।

|৪|

এবং সাংবাদিককুল। কিছু মনে করবেন না। আপনাদের মধ্যে সত্যনিষ্ঠ অনেকেই আছেন। কিন্তু অন্যরকম মানুষেরও অভাব নেই। সেই প্লাবনের দিনগুলোতে একদিন হঠাৎ একটা কাগজে ছবিসহ রিপোর্ট দেখে চমকে উঠেছিলাম। তীব্রবেগে ছুটে যাওয়া জলরাশির ছবি সেখানে। তলায় ক্যাপশান, সরকারী অবহেলায় এইভাবেই ভেসে যাচ্ছে মালদার জনপদ।

ছবিটা যে জায়গায় তোলা সেটা আমার চেনা। সাংবাদিকটিকেও দেখেছি সর্বদাই কন্ট্রোল রুমের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে স্কোপ জোগাড়ে ব্যস্ত থাকতে। প্লাবিত জেলার কোন জায়গাতেই তিনি তাঁর মহামূল্যবান প্রাণটি নিয়ে খবর খুঁজতে যান নি। শুধু অভিরামপুর বাঁধ রোডের ওপর থেকে নিচে বয়ে চলা মহানন্দার একটা কৌশলী ছবি তুলে জুতমতো একটা ক্যাপশান লাগিয়ে দিয়েছেন নীচে। তখনো পোড়খাওয়া আমলা হয়ে উঠিনি তো, চামড়াটা খানিক পাতলা ছিল। তাই বড় বেজেছিল ঘটনাটা। লোকটাকে আর দেখিনি সেখানে কখনো। সম্ভবত নিরাপদে বাড়ি ফিরে গিয়ে তারপর এই ধাষ্টামোটা তিনি করেছিলেন আমাদের নিয়ে।

উত্তরকথন

এরপর দু’দশকেরও বেশি সময় কেটে গেছে। আমরা নাকি অনেক উন্নতি করেছি। বিদেশে চাকরি চলে যাবার আদুরে নাম হয়েছে হি হ্যাজ বিন ব্যাঙ্গালোরড! এতই প্রতাপ আমাদের এখন বিশ্ব অর্থনীতির বাজারে। গোল্ডেন কোয়াড্র্যাঙ্গল, রাস্তাঘাট, শিল্প, বাণিজ্য, ডিপ্রেশনের সফল মোকাবিলায় জগতজোড়া নাম হয়েছে এ দেশের। কিন্তু তবু বছর বছর ভারতের বহু জায়গার বর্ষা এলেই সেই একই খবর দেখতে পাই। জায়গার নাম বদলায়। সংখ্যাগুলো বদলায়। জলমগ্ন গ্রামের সংখ্যা, মৃত মানুষের সংখ্যা, ক্ষতি হয়ে যাওয়া ফসলের অর্থমূল্যের সংখ্যা—আরো কত সংখ্যাই বদলে বদলে যায় প্রতিবার। শুধু গল্পটা একই থাকে। শুরু করেছিলাম যেকথাটা দিয়ে, ফের সেই কথাটা দিয়েই তাই শেষ করি, ডেভেলপমেন্ট তাহলে কাকে বলে দাদা? কার ডেভেলপমেন্ট?

কামধেনু

কামধেনু
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
অলংকরণ - রুমেলা দাস


নন্দী শুয়ে শুয়ে আকাশপানে চেয়ে একমনে ঘাস চিবোচ্ছিলো। আহা কী স্বাদ। স্বর্গে এমন কচি কচি মিষ্টি ঘাস নেই। অমনি ভৃঙ্গী ছুটতে ছুটতে এসে বললো, “সব্বোনাশ হয়েছে। ঘোর সব্বোনাশ! কামধেনু খোওয়া গিয়েছে।”

নন্দী সেই কথায় তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললো, “ সে কী রে। এবারে বাবাকে মুখ দেখাবো কেমন করে? জমদগ্নি তো ভস্ম করে দেবেন। গোলকধামে শোরগোল পড়ে যাবে।”

ভৃঙ্গী কাঁদো কাঁদো মুখ ভেঙ্গিয়ে বললো, "তোর জন্যই তো হলো এমন। সক্কাল সক্কাল বাবা কে গিয়ে বললি কামধেনুর জিভে চড়া পড়ে গেছে তার একটু স্বাদবদল দরকার। যাই মর্ত্যে গিয়ে গরু চড়িয়ে আসি। বাবা তো সকাল সকাল ভাঙের মৌতাতে ত্রিনয়ন মুদে বসেছিলেন। অমনি তোকে পারমিশন দিয়ে দিলেন।”

চুক চুক চুক শব্দ করে নন্দী মাথা নাড়লো। তারপর কটমট করে ভৃঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বললো, “তা তুই কি করছিলিস। আটকাতে পারলিনা?”

“তোর যেমন বুদ্ধি, কামধেনুকে কেউ কোনোদিন আটকাতে পেরেছে। ও তো নিজের মর্জিতে চলে। তারপর মান অভিমান তিন লোকের মেয়েদের থেকেও বেশি। হঠাৎ করে চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমি তারপর কত্ত ডাকলাম, ধেনু।..কাম কাম কাম। গোলা ভরা পান দেব, বাটা ভরা ধান দেব। কিছুতেই এলো না।”

নন্দী বললো, “বাবা জানতে পারলে ভস্ম করে দেবে তোকে আর আমাকে। গোলোকধাম থেকে লিজে এক মহাপদ্ম বৎসরের জন্য বাবার গোশালায় রাখার অনুমতি পাওয়া গিয়েছিলো। যাতে স্বর্গবাসী-রা মনোরম বিচিত্র মিষ্টান্নের স্বাদ পায়। এবারে যে কী হবে ! তবে বেশিদূর যায়নি মনে হয়। চল একটু এগিয়ে খুঁজে দেখি।”

“সামনেই একটা গ্রাম মতো দেখতে পাচ্ছি। বাজার বসেছে। বাঁধাকপি টপি দেখতে পেয়ে ঐদিকেই গেছে বোধহয়। আগে গ্রামবাসীদের মতো পোশাক চাই। তারপর এক কাজ কর তুইও ডাক আমিও ডাকি। ডাকতে ডাকতে পথ হাঁটি।”

দুজনে মিলে এইভাবে গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলো।

নন্দী ডাকে, “সুরভী”, ভৃঙ্গী ডাকে, “সুরভী”

তারপর দুজন একসঙ্গে গলা মিলিয়ে ডাকে, “ সুরভী ই ই ই ই”

হঠাৎ একটা লোক ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। বেশ লম্বা চওড়া অসুরসুলভ চেহারা। বেরিয়ে এসে নন্দী ভৃঙ্গীকে আপাদমস্তক দেখে বললো, “সুরভী ঘুমোচ্ছে। কী দরকার ?”

ভৃঙ্গী বললো, “এতো বেলা করে সুরভী কক্ষনো ঘুমোয় না। সুরভী কে নিজের ঘরে রাখার আপনার কোনো অধিকার নেই। ওকে আমরা নিয়ে যেতে এসেছি।”

নন্দী বললো, “ঠিক। একটু অভিমানী, কিন্তু ওকে ছাড়া আমাদের চলবে না। বাবা কে কথা দিয়ে এসেছি।”

লোকটা বললো, “আচ্ছা একটু দাঁড়ান। সুরভী কে ডাকি।” তারপর ভেতর থেকে একটা ইয়াবড় বাঁশের লাঠি নিয়ে এসে তাড়া করলো। নন্দী ভৃঙ্গী তো পালিয়ে পথ পায় না।

লোকটা একটু চোখের আড়াল হতেই হাঁপাতে হাঁপাতে নন্দী বললো, “কী হলো বলতো? লোকটা হঠাৎ এমন ক্ষেপে গেলো কেন?”

ভৃঙ্গী বললো, “ ওর কাছে আমাদের সুরভী নেই। এরকম বদখত লোকের কাছে সুরভী থাকতেই পারে না।”

“তাহলে এবার কী করা যায়?” ভৃঙ্গী মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। নন্দীও আকাশ পাতাল ভাবতে শুরু করলো। তারপর বললো, “একটা কাজ করলে হয়না ? থানায় একটা খবর দিলে হয়না ?”

ভৃঙ্গী বললো, “ তোর যেমন বুদ্ধি! চোর ডাকাত অব্দি এরা ধরতে পারেনা। তখন বাবার কাছে মানত করে। আর সুরভীকে খুঁজে দেবে?”

নন্দী বললো “তবুও, একটা চেষ্টা তো করা যেতেই পারে। আজ সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে সুরভীকে যদি স্বর্গের গোশালায় পৌঁছে দিতে না পারি অনর্থ হয়ে যাবে।”

গ্রামের লোকেদের জিজ্ঞেস করে করে ঠিক দুক্কুর বেলায় ওরা থানা এসে পৌঁছলো।

ছোটবাবু বললেন, "বড়বাবুকে এখন বিরক্ত করা যাবে না। মাথা হেব্বি গরম।"

"কেন, কেন, কী হয়েছে ?"

"চল্লিশ জন ডাকাত বহু কষ্ট করে ধরেছিলেন। জেল থেকে পালিয়েছে। তারপর থেকেই মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।"

"আহা গো " ভৃঙ্গী চুক চুক আওয়াজ করলো মুখে।

" তোমরা তোমাদের বয়ান লিখে দিয়ে যাও। বড়বাবু ডাকলে এস।"

নন্দী-ভৃঙ্গী সেইমতো কাজ করলো। গ্রামের একটা লোককে ধরে বয়ান লেখালো।

কিছুক্ষন পরে বড়বাবু ডাকলেন," মুখার্জী, মুখার্জী "

ছোটবাবু দৌড়ে গেলেন।

বড়োবাবু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, "এসব গরুর রচনা কে লিখেছে? ডাকো তাদের।"

বড়বাবুর ঘরে দুজনকে ডাকা হলে নন্দী আমতা আমতা করে বললো," আমাদের সুরভী গরু নয়।"

বড়বাবু বিস্ফারিত চোখে বললেন, “তবে কী ?”

নন্দী চাপা গলায় বললো , "কামধেনু। "

“হোয়াট !!!”

ভৃঙ্গী নন্দীকে একটা কনুই এর গুঁতো মেরে বললো। “না, আজ্ঞে ও গরুর মতোই দেখতে কিন্তু ঠিক গরু নয়। মানে যে-সে গরু নয়।”
বড়বাবু এবার দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, “গরুর মতোই দেখতে কিন্তু গরু নয়। আমিও পুলিশের মতো দেখতে কিন্তু পুলিশ নই। আমি আলিবাবা চল্লিশ চোর যাত্রাপালার আলিবাবা। পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেব। ….মুখার্জী … মুখার্জী, এদের লকআপে ঢোকাও ।”

গোবর্ধন আর গোপীচাঁদ দুই ভাই। গ্রামে তাদের দুজনেরই মিষ্টির দোকান। এক দোকানের উল্টোমুখে আরেকটা দোকান। গোপীচাঁদের মিষ্টির দোকান রমরম করে চলে। ভালো ব্যবসা করে সে প্রচুর অর্থের মালিক। গোবর্ধন সিধেসাধা সরলমতি। তাকে ঠকিয়ে তার ভাই পৈতৃক বাড়িটাও হাতিয়ে নিয়েছে। কোনো মতে কষ্টেসৃষ্টে গোবর্ধনের সংসার চলে। তার মিষ্টির দোকানে বেশির ভাগ সময়েই বসে বসে মাছি তাড়াতে হয়। বেশির ভাগ খদ্দেরই ঢোকে গোপীচাঁদের প্রাসাদের মতো ঝলমলে দোকানে।

গোবর্ধনের দুটো হাড় জিরজিরে গরু আছে। গরুদুটোর নাম শ্যামলী আর ধবলী। পৈতৃক সম্পত্তি বলতে সে ঐটুকুই পেয়েছে। আর একটুকরো ধানজমি আছে। তাতে ভালো ফসল ফলে না। এ হেন গোবর্ধন যে মাঠে একটা স্বাস্থ্যবান ধবধবে সুন্দর গাই চড়তে দেখে বাড়ি নিয়ে আসবে তা বলাই বাহুল্য।

গোবর্ধনের আদর সৎকারে সন্তুষ্ট হয়ে সেও থেকে গেছে গোবর্ধনের বাড়িতে। কিন্তু তার আশ্চর্য ক্ষমতা সম্পর্কে গোবর্ধন জানতো না যদি না তার ছেলে সকাল সকাল ক্ষীর সন্দেশ খাওয়ার বায়না ধরতো। তার দোকানে পুঁচকে সাইজের রসগোল্লা আর চমচম ছাড়া এখন আর কিছুই হয় না পুঁজির অভাবে । দাদার দোকানে বিভিন্ন রকমের দেশি বিদেশী মিষ্টি, ছানার পায়েস, ছানার কেক কত্ত কী পাওয়া যায়। তাই দেখে তার একমাত্র ছেলে আনন্দ বায়না ধরেছিলো যে সে ক্ষীর সন্দেশ খাবে। জেঠুর দোকানের কর্মচারীরা তাকে গালিগালাজ দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ায় সে কাঁদতে কাঁদতে এসে মায়ের কোলের কাছটিতে বসেছিল। তার মা অমনি গোয়াল ঘরে গিয়ে দ্যাখে থালা ভর্তি ক্ষীরের সন্দেশ সাজানো। ছেলে তাই দেখে মহানন্দে গপগপ করে সন্দেশ খেয়ে জেঠুর ছেলে সুনন্দ দাদা কেও মিষ্টি দিতে গেলো। সুনন্দ আর আনন্দ এই দুই ভাইয়ের ভারী ভাব। গোপীচাঁদও দ্যাখে বেশ কয়েকদিন ধরে ভাইয়ের দোকানে কতরকম মিষ্টির আমদানি। সেই মিষ্টি যারাই একবার খাচ্ছে তারাই নেশাগ্রস্তের মতো বারবার খেতে চাইছে। আনন্দে তাদের চোখদিয়ে জল পড়ছে। কামধেনুর ক্ষীরের মতো দুধ থেকে তৈরী এই মিষ্টির নাম গোবর্ধন তার ছেলের নামে রেখেছে আনন্দমোহন।

ওদিকে স্বর্গে হুলস্থূল পড়ে গেছে। সাত দিন হয়ে গেলো কামধেনুর কোনো খবর নেই। নন্দী আর ভৃঙ্গী কোনো মতে থানা থেকে ছাড়া পেয়ে বিষ্ণুলোকের পথে রওনা দিলো। সাধ্যি কী মহাদেবের সামনে যাবে। নন্দী কেঁদে কেটে বিষ্ণুর পায়ে পড়ে বলে, “ আপনি তো ভগবান, আপনার কিছুই অজানা নয়। আমাদের সাহায্য করুন। নইলে অভিশাপের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।”

বিষ্ণু অর্ধনিমীলিত নেত্রে মৃদু হেসে বললেন, “আমার সব কিছুই সম্যক রূপে জ্ঞাত। বিশ্ব বৈকুন্ঠ চ্যানেলে সারাদিন তো এই একটাই সংবাদ। আর তাছাড়াও আমার চোখের দৃষ্টি স্বর্গ মর্ত্য পাতাল সব জায়গায়। আমি জানি কামধেনু কোথায়। কিন্তু ভুলটা যেহেতু তোমাদের, সংশোধনও তোমাদেরই করতে হবে। জমদগ্নি তোমাদের খুঁজে পেলেই মর্ত্যের গরু, ছাগল কিছু একটা বানিয়ে দেবেন। তখন অখাদ্য, কুখাদ্য খেয়ে থাকতে হবে।”

“প্রভু !!” ভৃঙ্গী ডুকরে কেঁদে উঠলো।

“চিন্তা কোরোনা । যার কাছে কামধেনু আছে সে ভালো, সরলমতি। তোমরা একটু ভালো করে বোঝালেই সে কামধেনু ফিরিয়ে দেবে।”

বিষ্ণুর কথামতো নন্দী ভৃঙ্গী উপস্থিত হলো গোবর্ধনের বাড়ি। কামধেনুর কথা জিজ্ঞেস করতেই সে তো কেঁদে কেটে একসা। গোপীচাঁদের মারফৎ জমিদারের কানে কামধেনুর খবর যায়। জমিদার জানতেন লোক পাঠিয়ে এই দৈবশক্তি সম্পন্ন কামধেনু ধরে আনা সম্ভব হবে না। তাই তিনি গোবর্ধনের একমাত্র ছেলে আনন্দ কে লোক পাঠিয়ে ধরে আনার ব্যবস্থা করলেন। আনন্দ তখন ভাই সুনন্দর সঙ্গে খেলছিল। পরে জমিদারের পেয়াদা গিয়ে গোবর্ধনকে বলে এলো, “ এক্ষুনি তোমার কামধেনু নিয়ে জমিদারের বাড়ি দিয়ে এস। নইলে ছেলে ছাড়া পাবেনা। আর থানা পুলিশ করলে কিন্তু ছেলের হদিশই পাবে না।”

গোবর্ধন শুনেছিলো জমিদার ভবেশ মজুমদার খুব একটা সুবিধের লোক নন। থানা পুলিশ সব তার হাতের মুঠোয়। চোখের জল মুছতে মুছতে সে তার কামধেনুটিকে জমিদারের গোয়ালে রেখে এসেছে।

“বড় ভালো গাই ছিল গো দাদারা। নাম রেখেছিলাম নন্দিনী। ধবলী আর শ্যামলীর সঙ্গে খুব ভাব হয়েছিল। আমার ছেলেটাও ওকে চোখে হারাতো। সে আমাদের সোনা দানা, খাবার দাবার সব দিয়েছে। এখন কোনো অভাব নেই। কিন্তু নন্দিনীর কথা ভাবলেই মন বড় খারাপ করে। গোবর্ধন চোখ মুছলো।”

ভৃঙ্গী বললো, “যাচ্চলে! এবার উপায়! আমাদের সুরভী এখন জমিদারের গোশালায়। সে তো খুব খারাপ লোক শুনলাম।” নন্দী বললো, “ খারাপ লোক হোক আর যাই হোক। আমাদের সুরভীকে আমরা চাইবো না? চলো ভাই এক্ষুনি চলো সেখানে। আর সময় নষ্ট করা ঠিক নয়।”

তিনটে মাঠ, ধানক্ষেত, মন্দির আর বিশাল দীঘি পেরিয়ে তারা উপস্থিত হলো জমিদার বাড়ি। জমিদার ভবেশ মজুমদার তখন দুপুরের ঘুম দিচ্ছিলেন। নন্দী আর ভৃঙ্গী তার মাথার কাছে বসে কানে সুড়সুড়ি দিতে আরম্ভ করলো। চমকে জেগে উঠে তিনি বললেন – “ক কে কে তোমরা? এখানে কী করে এলে। পেয়াদারা সব কোথায় ?”

নন্দী হেসে বললো, “ কিছু চিন্তা করবেন না। সে ব্যাটাদের কায়দা করে মহাদেবের স্পেশাল ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি। তিন ঘন্টার আগে তাদের ঘুম ভাঙবে না।”

“কী...কী চাও তোমরা?” বলে তিনি আঁতকে উঠলেন।

ভৃঙ্গী বললো, “কী চাই তুমি জানোনা ? ওই যাকে জোর করে গোবর্ধনের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসেছো, আমাদের স্বর্গের কামধেনু সুরভী। ফেরত দিয়ে দাও নয়তো মহাদেবের দিব্যি এমন কাতুকুতু দেব যে হাসতে হাসতে হার্টফেল করবে।”

“ না না কিছুতেই দেবোনা। গোবর্ধন ওকে নিজের হাতে আমার গোশালায় রেখে গেছে। আমি তো কেড়ে নিই নি। আর তোমাদের জিনিস তার প্রমান কী ?”

ভৃঙ্গী বললো, “ নন্দী বুড়োটার হাত দুটো একবার ভালো করে ধরতো। রামকাতুকুতু না দিলেই নয়।”

নন্দী ধরার উদ্যোগ করতে যাবে। অমনি চারিদিকে বোমা, গুলি চিৎকারের শব্দ।

জেল পালানো সেই চল্লিশ জন ডাকাত হানা দিয়েছে জমিদার বাড়িতে।

নন্দী বললো, “ এখন জমিদারকে ছেড়ে আমাদের সুরভী কে খোঁজা উচিত। গোশালাটা কোনদিকে চল সেটা দেখি গিয়ে।”

জমিদার বাড়ির বিশাল বড় গোশালা। কত রঙের যে গরু আছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কামধেনু একটিই হয়। তার গা থেকে আলো বেরোচ্ছিল আর আতপ চালের মতো গন্ধ। ডাকাতরা কামধেনুর কথা রাস্তাতেই শুনেছিলো। তাদের জমিদারবাড়ি আসার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কামধেনু। গোশালাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল বন্দুক কাটারি বিভিন্ন অস্ত্র হাতে প্রায় কুড়ি জন। কামধেনুর দিকে এগোতেই কামধেনু একটা অদ্ভুত ডাক ছাড়লো। চারদিক কেঁপে উঠলো। কামধেনুর গা থেকে বেরিয়ে এলো শয়ে শয়ে অস্ত্র হাতে লোক। ডাকাতদের সঙ্গে তাদের ভয়ঙ্কর লড়াই হলো। ধুলোয় ঢেকে গেলো চারদিক। নন্দী আর ভৃঙ্গী চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়েছিল। লড়াই থামতেই তারা দেখলো ডাকাতরা সব এখানে ওখানে পড়ে আছে ছিটকে। তাদের নড়ার ও ক্ষমতা নেই। কিন্তু কামধেনু কোথায় গেলো? সে তো নেই। নন্দী আর ভৃঙ্গী দৌড়োতে দৌড়োতে নন্দিনী, সুরভী, আরও কতরকম নামে কামধেনুকে ডাকতে লাগলো। তবু তার পাত্তা নেই। মাঠের মধ্যে এদিক ওদিক খোঁজার পর তারা দেখলো দূরে দীঘির ধারে একটা লম্বা কালো মতন ছেলে বসে বসে আখ চিবোচ্ছে। কামধেনুর গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। তারা হাঁপাতে হাঁপাতে ছেলেটার দিকে দৌড়োলো।

“এই ছেলে শুনছো ?”

ছেলেটা আখ চিবোতে চিবোতে তাকাল।

“এই যে এটা আমাদের গরু। আমাদের দিয়ে দাও।”

ছেলেটা অবাক হয়ে বললো, “বা রে ওকে আমি পেয়েছি। মাঠের মধ্যে একা একা চরছিলো।”

নন্দী মুখ ভেঙ্গিয়ে বললো, “মোটেও না। বেশি পাকামি কোরো না।”

ছেলেটা বললো, “ ঠিক আছে তবে এক দান পাঞ্জা লড়ে দেখাও। যে জিতবে গরু তার।”

ছেলেটার যা রোগা-পটকা না খেতে পাওয়া চেহারা, এক্ষুনি হেরে যাবে।

ভৃঙ্গী বললো, “বেশ তো চলে এস”। ওমা ছেলেটার হাত তো নয় যেন লোহা। এক চুলও নড়ানো গেলো না। বদলে সে ভৃঙ্গীর হাতটা এমন ভাবে ফেলে দিলো যেন শোলার তৈরী।

নন্দী বললো, “কী খাও ভাই ? গায়ে এতো জোর !”

ছেলেটা সাদা সাদা দাঁত বের করে হেসে বললো, “ফ্যান খাই ভাতের।”

তিন বার, চার বার, পাঁচবারেও যখন ছেলেটাকে হারানো গেলোনা তখন ছেলেটা বললো, “চু কিত্ কিত্ খেলবে?”

নন্দী বললো, “থাক ঢের হয়েছে।”

ছেলেটা এবারে আকাশ ফাটিয়ে হা হা হা করে হাসতে শুরু করলো। তারপর বললো, “ মূর্খের দল। বৈকুন্ঠ চললাম। কাল সুরভীকে কৈলাসে দিয়ে এস মনে করে।” বলে নন্দী-ভৃঙ্গীর হাঁ করা মুখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেলো।