সম্পাদকের কথা

টুকটুক করে বছর শেষ হতে চলল । শীত বাবাজীবন গেছো দাদার মতো এই আছি, এই নেই করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেউ খবর পড়ছেন, কেউ খবর হচ্ছেন, বাকিরা ভালো আছেন। গুজরাত নির্বাচন, বিরাট বিবাহ, জঙ্গিহানা, শিল্পচর্চা, শিশুকন্যা ধর্ষণ, ম্যানহাটনে বিস্ফোরণ, নতুন ফোনের আমদানি, নেতাদের বকবকানি, মহাকর্ষ তরঙ্গের খোঁজ, বিক্ষোভ, মারামারি, এসব, স—অ—ব, হয়ে চলেছে একসাথে, বীভৎস দ্রুততায়। আর এই নীল গ্রহটা অধিবাসীদের সমস্ত পেঁয়াজি সহ্য করে বাঁই বাঁই করে পাক খেয়ে চলেছে ২০১৭ থেকে ২০১৮-এ।

নিরুদ্দেশী

ছন্দা মান্না পন্ডিত

হঠাৎ বিকেল শ্রান্তদেহী জানলা কাঁচে
নিরুত্তাপের দাবানলে এলোকেশী।
ছাই রেখে যায় বুকের ভেতর বুনট ছাঁচে
ঠিক অবিকল সেই চেহারা নিরুদ্দেশী।

ঈশানী কোন্ বাতাস এলে ছাই উড়ে যায়
স্পর্শে কেবল আঙুল আঁঠা জমতে থাকে।
খুব গোপনে বারুদ রাখো ঠোঁটের তলায়
উদাসিনী জ্যোৎস্না কিনে সাজতে থাকে।

বুকের ভেতর বেআব্রু মন হালকা তাপে
কাজলা নদী সরীসৃপের শরীর আঁকে।
ছাই রঙা হাত, মায়াবী চোখ চিবুক মাপে
উদাসিনী জ্যোৎস্না গায়ে ভিজতে থাকে।

বিষাদী মন যেই ছুঁয়ে নেয় ঠোঁটের পালক
দমকা আঁচে বারুদ তখন ঘ্রাণ মেখে নেয়।
নিরুদ্দেশীর ছাই উড়ে যায় আগুন জ্বালক
একলা মেয়ে বারুদ আঁচে বুক পেতে দেয়।

এমনি করেই রোজ জ্বলে যায় অভিমানী
আরেকটি বার নিরুদ্দেশীর ছোঁয়ার আশায়।
ছাই রঙা মন বৃষ্টিমেয়ের হৃদয় খানি
ভালবাসে জ্বালতে শুধুই অবহেলায়।

অলংকরণ - অভিষেক ঘোষ

অরোরা বরিয়ালিস

পারিজাত ব্যানার্জী


“যাই হোক না কেন, পৌঁছতে হবে।”

“যাঃ, ‘যাই’ দিয়ে আবার কোনো গল্প শুরু হয় নাকি! ছোটবেলায় পড়নি, ‘যে’, ‘যা’ এসব দিয়ে কিছু শুরু হয় না!”

হো হো করে হেসে উঠল আরশি। “ওইসব এবড়োখেবড়ো ‘ব্যাকারণ মানি না!’ তবে পৌঁছতেই হবে, জানি। দেরী করলে চলবে না।”

ক্লান্ত লাগে অয়ন্তিকার। পা দুটো হঠাৎ বড় শিথিল হয়ে যায় তার। ইশ! এভাবে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে! মুখে অবশ্য অন্য কথাই ফুটে ওঠে, হয়তো নিজের অজান্তেই। যদিও নিজের কোটরে বাসা বাঁধা এত ন্যানো সেকেন্ডের এত কথা আর কতটাই বা জানতে পারে কেউ!

“পথ যে এখনও অনেক বাকি আরশি! এতটা পথ যেতে সময় তো লাগবেই। সময় তো দিতেও হবে খানিক, না হলে যাওয়ার পথটাই তো ফুরিয়ে যাবে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই!”

আরশি চোখ টিপে হাসে এবার। তার প্রাণবন্ত মুখের সমস্ত রেখায় দুষ্টুমি মেখে যায় ভাল করে। “পথে কত বাধা থাকবে জানো? কত বাঘ, কত ভাল্লুক, কত মন্ত্রণা, কত উপদেশ! এসব থেকে বাঁচতে গেলে একটাই উপায়; তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে হবে পথটাই! বুঝলে? বেশী দেরী করলে ঘোড়া ছোটালেও আর গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেনা। কোনোদিনই!”

মনে পড়ে অয়ন্তিকার। হ্যাঁ, ঘোড়া! তার ঘোড়াটা কোথায়। তার সেই ধূসরাভ ‘তেজস্বিনী’? অনেকক্ষণ ধরে তো হেঁটেই চলেছে সে। কই, তেজস্বিনীর দেখা তো নেই! তবে কি ভুল পথ ধরল ও? এ পথে বিষধর শাপ আছে, জঞ্জাল রয়েছে, পা জড়িয়ে যায় প্লাস্টিকের স্তূপে কিন্তু সুলুকসন্ধান হয় না! কোথায় সেই ‘অরোরা বরিয়ালিস’! কোথায় সেই মায়াবী আলোর খেলা! এবার যে পা চালাতেই হবে! এত অনুষ্ঠান, এত আয়োজন— সব যে না তো শেষ হয়ে যাবে, শুরু হওয়ার আগেই!

কি বুঝল আরশি কে জানে! আড়চোখে তাকালো সে শুধু। “ওই দূরে পাথুরে বাঁকটা দেখতে পাচ্ছো, ওটা পেরোলেই গভীর সুড়ঙ্গ দেখতে পাবে। মাটির বুক বরাবর কাটা ওই পথ। অতটা পথ একাই যেতে হবে। তারপর মিলবে তেজস্বিনীর দেখা। আদিমতম গুহামুখের সামনেই রয়েছে ওদের আস্তাবল। রাত শেষের আগে না পৌঁছতে পারলে কিন্তু বিপদ।”

শঙ্কিত হয় অয়ন্তিকা। “কি বিপদ? সেই বাঘ ভাল্লুক? সেই মৃত্যু?”

“ওমা! মৃত্যুতে আবার ভয় কি? ভয় তো এই বেঁচে থাকাকেই!” নিরুদ্বেগে চকচক করে ওঠে আরশি।

“মানে!” বাঁকের আগেই দাঁড়িয়ে পড়ে অয়ন্তিকা। মাথার দুদিকের শিরা দুটো দপদপ করছে তার। উফ! আবার ওই মাইগ্রেনের ব্যথা কি তবে ফিরে এলো? এই তো বেশ ফুরফুরে লাগছিল কিছুক্ষণ আগেই। সত্যিই, সবই কি ভীষণ ক্ষণস্থায়ী!

“আরে, তুমি তো দেখছি এ যাত্রায় সবই ডোবাবে! কত করে বলছি যে চলো! দেরী করো না! যত দেরী করবে, বিচলিত হবে, তত এক পা এক পা করে পিছিয়ে পড়বে তুমি! কিছুতেই শেষরাতে দৌড়েও কিনারায় উঠতে পারবে না তখন। খেয়াল রেখো, পথ কিন্তু দুর্গম!”

অয়ন্তিকা আশপাশটা আর একবার দেখে। কই, তার তো তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। প্রথমদিককার অসুবিধেগুলো পেরিয়ে পথ এখন অনেকটাই প্রশস্ত। অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়ায় এখন আর ততটা অস্বস্তিও হচ্ছে না!

তার মনের কথা টুক করে পড়ে নিলো আরশি। খুব বাজে স্বভাব এটা ওর। বরাবরের। “এখন অসুবিধা হচ্ছেনা ঠিকই। কিন্তু এই নিজেকে সইয়ে নেওয়াটাই বড় বিপদের, সেটা মানো তো! যতক্ষণ তুমি বিবাদ প্রতিবাদে থাকবে, চিৎকার করবে, অসহযোগিতা করবে, কিছুতেই মেনে নেবে না কিছু, ততক্ষণই শান্তি। চারদিকে এই যে সব মৃতদেহ পড়ে, পিশাচেরা গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছে রক্তের গোগ্রাসে গিলবে বলে সব, অথচ তুমি কেমন মানিয়ে নিয়েছো, ভবিতব্য বলে উড়িয়ে দিচ্ছ আমার কথা ক’টাও, চিন্তা এখানেই। চেয়ে দেখো, অর্ধেক পথও কিন্তু পাড়ি দিইনি আমরা এখনও! সুড়ঙ্গ শেষে রক্তাভ নদীর উৎসে ঠাণ্ডা জমাট বরফের দুর্ভেদ্য পাহাড়ের প্রাচীর, সে খেয়াল আছে তো! হামাগুড়ি দিয়ে, খুব আস্তে আস্তে সেই পথটুকু কিন্তু পেরোতে হবে! তবে সাবধান, পিছন ফিরে চাইবে না। তেজস্বিনী থাকবে তোমার পিছনে। চিন্তার কিছু নেই।”

“আর তুমি?”

“আমি? আমার কি আর ঠিক আছে গো! কখন আছি, কখন নেই! এই সুড়ঙ্গের কত খানাখন্দ, সব কি আর আমি নিজেও জানি? কখন কোথায় ঠোক্কর খাবো, তলিয়ে যাব মহাশূন্যে! তুমি তা বলে আবার থেমে যেও না! তোমার যা স্বভাব! একটুতেই অমনোযোগী হয়ে পড়ো। এপথে কিন্তু একদম ওসব নয়! খেয়াল রাখবে, শুধু ভোরের আলো ফুটতে দেওয়া যাবে না। ওই অতিপ্রাকৃত আলোর জাল থেকে তোমারও তখন নিস্তার হবে না কিন্তু! বুঝলে, ওসব আলো দূর থেকে দেখাই ভালো, নিজের মধ্যেই বিচ্ছুরণ শুরু হলে কিন্তু মুশকিল! খাঁচায় আটকানো বন্য জন্তুর মতো অবস্থা হবে তখন। জল, খাবার সব বসে বসেই পেয়ে যাবে, অথচ কোথাও বড় একটা গরমিল থেকে গেল, ঠিক ধরতে পারবে!”

অয়ন্তিকা বুকে-হাঁটা শুরু করে। সমস্ত জাগতিক বস্তুর ভর এখন তার বুকের উপর সুস্থির। হাত পা ছড়ে যাচ্ছে, কপালটাও ঠুকে গেল শূন্যে জমাট বাঁধা একতাল বরফে! কুচিকুচি বরফরাশি জমা হয়ে এমন পুরু দেওয়াল উঠল কবে? কই, আরশি তো বলেনি এর কথা আগে!

ঝনঝন করে শব্দ হল। তবু অয়ন্তিকা পিছন ফিরে চাইল না আর। আরশি মানা করেছিল। ফেলে আসা সবকিছু ঠিকই থাকবে। যেমনটা থাকে আর কি! ‘ঠিক’, ‘ভুল’ বলে তো আর কিছু হয় না। সবই হতে হয়, তাই হয়। যেমন এই অভিযাত্রায় সামিল হওয়া তার ভবিতব্য, এরও কি আর খারাপ ভালো আছে? সমগ্র চেতনা জুড়ে এই যে অপরিসীম কষ্ট, আবার অ্যানাসথেসিয়ার ঘোরে সব শুনতে বুঝতে পারলেও দিব্যি অভিব্যক্তিহীন থাকা যাচ্ছে, এই তো ঢের!

অয়ন্তিকার হাতের উষ্ণতায় বরফের প্রাচীর গলে জল হয়ে গেল একসময়। তবু, সময়ে যে সব শেষ হবে না আর তাও আর একবার মালুম হল বইকি! এতটা এসে ফেরাও সম্ভব নয়, সে রাস্তায় গুমোট দমচাপা আলো আঁধার! এধার থেকেই দেখা যায় সে পথও। না দেখা যাওয়াটাই যদিও ঠিক হতো বোধহয়!

ওই, ওই তো সুড়ঙ্গ শেষ! ওই তো তেজস্বিনীর টানা টানা দুটো চোখ! কিন্তু আদিম এই গহ্বরের মুখের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে কেন ও? ওখান দিয়েই তো অয়ন্তিকার বেরোনোর কথা! “এই যা! সরে যা! আলো দেখব। ‘অরোরা বরিয়ালিস’! তার আগে কত কাজ বাকি রয়ে গেছে! সেরে ফেলতে হবে তো! কোটি কোটি বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা শৃঙ্গজয় করতে হবে, ভাসতে হবে রক্তাভ নদীর প্রাণরস সুধায়— সর, সরে যা বলছি! আহ! অমন জোরে ডাকিস না। সবাই শুনতে পেয়ে যাবে! ছুটে আসবে। আমার এদেশে আসার ভিসা দেখাতে বলবে! আমি যে সব তার কেটে পালিয়ে এসেছি! নাঃ, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার! চুপ কর! একদম চুপ! নাতো—নাতো এই নে!”

সামনেই পড়ে থাকা স্বচ্ছ বরফের ধারালো অস্ত্র তুলে নেয় অয়ন্তিকা। তারপর কোপাতেই থাকে এলোপাথাড়ি আর কিছু না ভেবে। কোপাতেই থাকে, যতক্ষণ না সব ডাক নিস্তব্ধ হয়ে যায় একেবারে।

বাড়ির পাশের গাছটায় সব পাখিরা একসাথে ডেকে ওঠে কাকভোরে। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে অয়ন্তিকা। উফ কি বীভৎস স্বপ্ন! চোখদুটো ভালো করে মুছে আড়মোড়া ভাঙে সে। যাঃ, ভোরের আলো যে ফুটে গেল! সেই আরশি বলেছিল না—

ঘরের এককোণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কাঁচের টুকরোগুলো। কি জানি কোন অদেখা ঝোড়ো হাওয়ায় অমন করে ভেঙে গেল আয়নাটা! নাকি বরফের প্রাচীরের ওই বেসামাল ধাক্কাই কেড়ে নিলো আরশিকে! ও যে বড্ড পলকা! দোকানের ওই কর্মচারীটা অবশ্য আগেই বলেছিল!

নাঃ, এবার একটু দাম দিয়ে দেখেশুনে কিনতে হবে আয়না। ওকে আর ভাঙতে দেওয়া যাবে না! নাহলে যে ‘অরোরা বরিয়ালিস’-এর এই গোলকধাঁধা খেলা শেষ আর হবে না কিছুতেই!

অলংকরণ - মার্গারেট জন উলম্যান (শাটারস্টক)

খোঁজ

সুদীপ্তা রায় চৌধুরী মুখার্জী

জানি এখনো কিছু অবাধ্য জলকণা ছড়িয়ে আছে আমার দুচোখে,
তবুও এ চোখে শরতের আল্পনা।
আয় আবার খুঁজতে থাকি তোকে,
তোকে হারিয়েছিলাম কত যুগ আগে,
খাজুরাহোর মন্দিরে,
সেই থেকে খোঁজ আজও চলেছে।
কখনো মরুপ্রান্তরে
কখনো পাহাড় শিখরে
আমি করে চলেছি তলাশ
আমি আজো হইনি হতাশ।।
আলতামিরার প্রাচীন বাইসন,
তারা জানে এই আকুল অন্বেষণ
তাজমহলে থমকে ছিল যে হাওয়া,
তারও প্রশ্ন, এখনো কি যায়নি তোকে পাওয়া?
দ্বাপর যুগেতে কাঁপতো বাঁশীতে বৃন্দাবন,
আজ অবাধ্য রিংটোন তুলছে ঝড়।।
ডাক সেই একই, শুধু ভাষা পাল্টেছে ঘর,
একুশ শতকে পাল্টালো সবকিছু,
তবু কিছু অবরোধ আজও পেলো না ছুটি,
বাঁকা চাহনি আজও করছে পিছু।।
রিয়ালিটি শো, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম
রাতের ইন্টারনেটে চলছে নিয়ম ভাঙার খেলা...
তোর খোঁজে প্রতিপলে হারাই নিজেকে,
জানিস তোর খোঁজটা একটা বাহানা...
আদতে আমি পালাতে চাই...
নিজের থেকে,
নিজের অসহায়তার থেকে,
নিজের ব্যর্থতা থেকে,
নিজের সকল বাধ্যতামূলক আপোষগুলির থেকে,
আমার ঘরজোড়া অন্ধকার থেকে,
আরো আরো অনেক অজানা ভয় থেকে...
জানিস আমায় ঘিরে মাথাচাড়া দিচ্ছে
মহাশূন্যের ব্ল্যাকহোল।।
আমি একটু একটু করে
অতলে তলিয়ে যাচ্ছি।।
কোনটা সত্যি?
তোর খোঁজ?
না আমার পলায়নপরতা?
সময় নিরুত্তর...

অলংকরণ - ক্রিস হাউইস (আলামী)

দেখবো বলে

রুমেলা দাস

চোখ বুজলেই মনে হয়,
মেঘ ধরছি দুহাতে
স্বপ্নালু নীল থেকে চুঁইয়ে নিই
আদুরে ওম্।
ধ্রুবতারার সত্যি থেকে
নির্যাস তোর ফিরে আসার।

জমা হওয়া গোল জল
দু-পায়ে লাফিয়ে
সেই দিনের আদর মাখি,
ধূলো মাখা রেলিঙে
লেগে থাকে আমাদের বাসিকথা।

তুই কি ফিরবি?
ফিরতে পারবি!
নখের অন্তিমে লুকানো ফোঁটা
পরতে পরতে সিমেন্ট আর সুরকির
আড়ত;
চোখ বুজলেই মনে হয়
আরো একবার
হাস্নুহানা ফুটলো বলে।

অলংকরণ - প্রমিত নন্দী

নামহীন

সই

রেল গাড়ি যাচ্ছে, মাঠ পেরিয়ে, রাস্তা ছেড়ে,
ওই নীল আকাশের সাথে, সর্ষে ক্ষেতের
পাশ দিয়ে মন যাচ্ছে ছুটে ছুটে, হলুদ মেখে।
হঠাৎ যদি বৃষ্টি নামায় লুকিয়ে থাকা কালো মেঘ,
হাত বাড়াবে জানালা থেকে তুমি, কি যেন নাম?
ধানসিঁড়ি! না সাঁঝবাতি! নাকি অন্য কোনো নাম!
চিকন কালো শাড়িতে তোমার নীল বিষের রঙ।
তৃষাতুর চোখে তোমার চাতকসম আকুলতা,
এলোমেলো বাতাসে তোমার এলোকেশ, সান্ধ্যমেঘ!
আড়াল করে, আড়াল করে আনন, জড়িয়ে ধরে
ঠোঁটের ভাঁজের গভীর খাদের শুষ্ক কিনারায়।
তখন আমি ডাকাত সাজি, হাওয়ার সাথে মিশে
যাত্রা করি তোমার অতলান্তে, নিশ্চুপে, বেহায়া আমি নির্লজ্জতায়;
মিশে যাই ল্যাম্পপোস্টের আলোয়, প্রেম হয়ে চুঁইয়ে পড়ি শরীর দিয়ে।
অন্ধকারে প্রহর গুণি, প্রমাদ হয়ে জরিপ করি তোমার ’পরে;
তোমার বিপ্রতীপে থাকি, আঁখিতে মিশে যাই,
পড়ে রই নিস্তেজ ভারহীন সূক্ষ্মতায় তোমার কুহেলিসম বুকে, ভীষণ গভীরে!

এক মুঠো বালিয়াড়ি

অনুপ বৈরাগী



যদি তুমি ফিরে আসো অবেলায়
দুমুঠো চাল রাখা আছে চুলোর ধারে

দুপুরস্নানের ফিসফাস কানে আসে
“খুন করে ফেরার হয়েছে মরদ”
এ’কদিনে গেছি জেনে
মানুষ কোতোল করে খুনি হতে হয়
সুখের মুখে ঝাঁটা মারে যারা
থাবার আঁচড় কাটে ভাতের থালায়
খিদের নোলায় ঢালে নুন জল
গলা টিপে মেরে ফেলে রাতঘুম
তারা নাকি কালজয়ী! সাধুপুরুষ!

জোনাকির পথ ধরে যদি ফিরে আসো
বাড়া ভাতের পাশে নুন রাখা আছে
হাতপাখা মুঠো করে বসে আছে ফাটা সিঁথি
ভাগাড়ে জমছে লাশ
লাঠি ঠুকে থানাদার বলে গেছে
খাল্লাস! খাল্লাস!

চোখের আগুনে ফুঁ দিয়ে চলে যেও
তুঁসের চাদরে পুষে রাখি
গলনের লীনতাপ
গোটা রাত

কুটুম কাটাম

দেবায়ন কর


পিকচার আভি বাকি হ্যায়

কেয়া রায়


প্রথম পর্ব

একেতেই আজ রবিবার। দুপুরের ভোজনপর্ব সেরে প্রায় সব বাঙালিই নাকে সরষের তেল ঢেলে ঘুম দিতে ব্যস্ত। ফলে শত দরকারের সময় কাউকে ফোনে পাওয়া বিশাল চাপের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অগত্যা নিজের ঘরের সামনের ব্যালকনিতে ইতস্তত ভাবে পায়চারি করছে কিংশুক। কোনও প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে মনে হল এখানে ওখানে। চুলগুলো উস্ক-খুস্ক, গালভর্তি দাড়ি, জিনসের ওপর পাঞ্জাবি পরা, বাঁ হাতে সিগারেটটা পুড়ছে আর ডান হাত পাঞ্জাবির পকেটে। বাইরের পরিবেশটাও গুমোট হয়ে আছে অনেকক্ষণ যাবত। কে জানে বৃষ্টি হবে হয়তো শেষ রাতের দিকে। কিংশুক পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে ডায়াল করল কাকে একটা যেন। ও প্রান্ত থেকে সেই ব্যক্তি কল রিসিভ করতেই কিংশুক বেশ ঝাঁঝিয়ে উঠল, “দেখুন সুজিত বাবু, আপনাকে ঠিক যতটুকু করতে বলেছি, ঠিক ততটুকুই করবেন। এর চেয়ে একচুল বেশি বা কম যেন না হয়। কাজ হলে বাকি ৭০% টাকাও পেয়ে যাবেন সময়মতই। ওকে বাই!”

ফোন রাখার পর কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিংশুক, “নাহ আর বেশি ভাবলে চলবে না, আব তো যো হোগা দেখা জায়েগা।” এইসব মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, ঠিক তখনই কিংশুকের স্ত্রী সায়নী চা নিয়ে ঘরে ঢুকল।

নেই তবু আছে

প্রতিম দাস




গত চার বছরে কতবার যে বাড়ি ভাড়া নিলো আর ছাড়লো ওরা তার ঠিক ঠিকানা নেই। তিনজনের সংসার । সোহিনী, সঞ্জয় আর ওদের আট বছরের মেয়ে সৃজা। বছর সাতেক আগে থেকে অবনতির শুরু। একের পর এক প্রতিকূল পরিস্থিতির চাপে পড়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে নিতে ব্যবসাটার বারোটা বাজিয়েছে সঞ্জয়। অবশ্য, কয়েকজন কর্মচারীর বেইমানিও দায়ী। আগে কাজের ক্লান্তি চাপ কমাতে দু পেগ করে মদ খেত সঞ্জয়। সেটা এখন নেশায় পরিণত হয়েছে। তার সাথে ছিল এবং আছে ক্রিকেট খেলা দেখার নেশা। একাধিক কেবল চ্যানেল এবং আই.সি.সি-র দৌলতে এখন তো বছরে ৩৬৫ দিন ক্রিকেট। এই দুই নেশার বাঁধনে পড়ে সঞ্জয়ের আর্থিক অবস্থা দিন দিন নিম্নগামী।

মদের নেশা ইদানীং হয়েছে। ক্রিকেটের নেশা আরও সাঙ্ঘাতিক। আট বছর আগের ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের দিনটার কথাই ধরা যাক। যেদিন সৃজার জন্ম হয়। খেলা দেখার উন্মাদনায় সোহিনীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়টা পর্যন্ত দিতে পারেনি সঞ্জয়। আর তার জন্য ঘটে যাওয়া ঘটনার সূত্রে সোহিনী কোনও দিনই সঞ্জয়কে ক্ষমা করতে পারবে না।

ফুল

নীলাঞ্জনা মন্ডল


–এই ফুলি, ফুলি কি সুন্দর গন্ধ রে মা এটায়! ওটা দে, ওটা দে.. আহ! কি খুশবু। এটা রাজা বল? আচ্ছা, তুই যে এগুলো পেড়ে আনিস, কেউ দেখলে কী হবে জানিস?

–কী হবে গো? ওরা তো কেউ নেয় না, তাই আমি নিই। জানো তো, ওই বাড়িতে একটা ছেলে আছে, একভাবে তাকিয়ে থাকে আমি ফুল পারলে। মাঝে মাঝে হাসলে লালা গড়ায়। কেমন জানো!

–ওরকম বলে না সোনা, ওর বোধহয় বড় অসুখ।

–ছাড়ো না মাসি, শোনো ও বাড়িতে খুব সুন্দর গন্ধরাজ লেবুও আছে জানো, কিন্তু হাত পাই না। খুব উঁচু.. কিন্তু চিন্তা নেই। আর বড়জোর ৭–৮ দিন, ততদিনে ঠিক নাগাল পেয়ে যাব। তোমার জন্য না ইয়াব্বড় লেবু নিয়ে আসব। ভাত দিয়ে মেখে খেলে দেখবে রাজা রাজা মনে হবে।

একটি প্রাগৈতিহাসিক গল্প

বিভাবসু দে


গল্পটা যে ঠিক কবেকার তা আমারও জানা নেই; কি করে জানব বলুন, সাল-তারিখের হিসেব যে তখনও শুরুই হয়নি। যীশু খ্রিষ্টের আসতে আরও আটষট্টি হাজার বছর বাকি, মানে গড়পড়তা প্রায় সত্তর হাজার বছর আগের কথা বলছি। না না, ভুল লিখিনি, সত্তরের পর তিনখানা শূন্য বসালে যা হয়, তাই বলছি। ইতিহাসের বইয়ে পাবেন না, ইতিহাসকার নামক মহাপুরুষেরা তখনও যে অবতীর্ণই হননি পৃথিবীর বুকে; এমনকি মহাকাব্যের গণ্ডিও অতদূর বিস্তৃত নয়। মোদ্দা কথা এটি একটি প্রাগৈতিহাসিক গল্প, যা শুধু ধরা দেয় কল্পনার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা কোনো কোনো উন্মাদোতর লেখকের প্রলাপে!

সে সময় পৃথিবী এক আজব রূপান্তরের মধ্য দিয়ে রোজ ঢেলে সাজাচ্ছে নিজেকে; হিমযুগ সবে শেষ হয়েছে, কিন্তু সেদিনের পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা আজকের থেকে অনেকটাই কম। সেদিনকার পৃথিবী গোটা একটা পৃথিবী ছিল, কাঁটাতারের বেড়া তখনও তাকে দেশে দেশে টুকরো করেনি। বিবর্তনের বহু ধাপ পেরিয়ে আধুনিক দেহকাঠামোযুক্ত মানুষেরা দেখা দিয়েছে পৃথিবীর বুকে, কিন্তু একুশ শতকের বিশ্বনিয়ন্তা মানুষ হতে এদের এখনও অনেক পথ-চলা বাকি। সভ্যতা বা পরিবার বলতে যা বোঝায় তা এখনও ঠিক শুরু হয়নি, তবে পারিবারিকতার বীজবপন হয়ে গেছে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের মধ্য দিয়ে। এই গোষ্ঠীজীবনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মিলে চলার, একতার মন্ত্র, যা আরও বহু হাজার বছরের দীর্ঘ যাত্রাপথের শেষে নিজেকে মেলে ধরবে এক মহান সভ্যতা রূপে, যার বুকের গভীরে সযত্নে সঞ্চিত থাকবে আত্মীয়তা, ভালোবাসা, সহানুভূতির নির্যাস।

মাতৃস্নেহ

অঙ্কন মুখোপাধ্যায়


১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি চার দফা দাবি পেশ করেন, এর কিছুদিন পর ২৫শে মার্চ উনি বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করেন। সেইদিনই, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে সেনা অভ্যুত্থানের নির্দেশ দেন, শুরু হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে নির্বিচারে গণহত্যা পর্ব।

পশ্চিম পাকিস্তানের, সেনাদলের রেজিমেন্টে একজন সাধারণ সৈনিক হিসাবে, আফজলের আগমন ঘটে। আফজল বয়সে পাকিস্তান রাষ্ট্রের থেকে মাত্র তিন বছরের বড়। অন্যান্য হাজারও সৈনিকের মতই, সে এদেশে হত্যালীলায় ঘাতকের ভূমিকায় অংশগ্রহণ করতে এসেছে। বয়স এতটা কম হলেও, মানুষ মারতে আফজলের হাত কাঁপে না । আসলে ওদের ওইভাবেই তৈরি করা হয়েছে, নির্মম, ক্ষমাহীন, হিংস্র।

আফজল পাকিস্তানের লাহোরে বড় হয়েছে, যদিও আশ্চর্যের বিষয়, ওর জন্ম যশোরে। বুনিয়াদী শিক্ষা, মৌলবাদী চিন্তাধারা, ধর্মের গোঁড়ামি ও ঠুনকো ঔদ্ধত্য এগুলো ছোটবেলা থেকেই পেতে শুরু করেছিল লাহোরে। এর উপর ওর মায়ের অনুপস্থিতি, বাবার ওর প্রতি ক্রুর ব্যবহার... সব মিলিয়ে ছেলেটার মধ্যে মানুষের প্রতি ভালবাসা, মানবতার উপর বিশ্বাস, মায়ামমতার ছিটেফোঁটা নেই।

নভেম্বর ২০১৭ পরবাসিয়া পাঁচালী

প্রচ্ছদ
প্রচ্ছদশিল্পী - রুমেলা দাস

সম্পাদকের কথা

পুজোর রেশ কাটতে না কাটতে গুটি গুটি পায়ে হাজির হয়েছে শীত। গাছের পাতাঝরা দেখতে দেখতে বেরিয়ে পড়ছে লেপ-কম্বল-মাফলার-সোয়েটার। সঙ্গে দোসর অসময়ের নিম্নচাপ। উত্তুরে হাওয়া খবর দিল রসগোল্লার একচেটিয়া অধিকার বাংলারই, যদিও ‘কানাঘুসো’ শোনা যাচ্ছে কপিরাইট আসলে মিলেছে ‘বাংলার রসগোল্লা’র। বেশ কিছু দিন ধরেই এ নিয়ে জল্পনা চলছিল, যদিও তাতে রসগোল্লার বিক্রি কম বা বেশি কিছু হয়নি। রসগোল্লা নিজে কখনও ‘আমার জন্ম কোথায়’ বলে মেগাসিরিয়ালের নায়কের মতো কৌতূহলী হয়ে উঠবে— সে সুযোগ পায়নি।

শহরে আগুন

চিন্ময় বসু



আকাশে জেগে কিছু গির্জা
আর মন্দিরের চুড়ো,
আর কিছু নেই— সব গ্যাছে পুড়ে,
জননেতার গরম বুলিতে ছারখার
গলি রাস্তা বাড়ী ঘর সব কিছু সব কিছু।
আর আমি পুড়ে যাওয়া শহরের
মৃত্যুর ইতিহাস লিখেছি গলিত চর্বিতে।
এক অসহায় মোমবাতির ধোঁয়াটে অশ্রুতলে মোমের থেকেও ঘন ভাষায়
আমি ছিঁড়ে যাওয়া তারের মত
বিশ্বাসের কথা বলেছি।

গল্পের এবড়ো খেবড়ো নুড়িপাথরের
উপর সারাদিন ঘুরে ঘুরে
মিথ্যুক দেওয়ালের সামনে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধুই
চমকিত আর মর্মাহত হওয়া।
টিয়ার মাথাখোঁড়া চড়া ডাক
আকাশে পাথর ভাঙ্গে।
এত আগুনের মধ্যেও
দিব্বি সাদা তুলোর গাঁটরির মত
মেঘগুলো ফেটে ছড়িয়ে যায় আকাশে।
যীশুর পায়ে হাঁটা ধোঁয়া ওঠা
সমুদ্রের বুক নিয়ে আমি ডুকরে বলি
কাঠের জগত যদি ব্যর্থ হয়ে যায়
তো মানুষ কেন মোমের মত
গাঢ় অশ্রু ঝরিয়ে কাঁদবে।

এ শহরে কাগজই গাছের পাতা,
কিন্তু পাহাড়, সে তো অটুট বিশ্বাসের
মত আজো খাড়া থাকে, আছে।
ক্লান্ত চরণ বালকের কাছে
সবুজ পাতার মত হল সবুজ নিশ্বাস
যাতে মৃত ভালবাসা প্রাণ পায়।
যত মৃত্যু আর দীক্ষার আশীর্বাদে জেগে
খুঁড়িয়ে চলে, বয়ে চলে এ পোড়া শহর।

অলংকরণ - প্রমিত নন্দী



তারা খসার পালা

সঞ্চয়িতা দাস

হয়তো

সূচনা ঘোষাল


হয়তো...
ভীষণ সহজে দাম-দর করে কিনে ফেলেছিস,
রাস্তায় ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো নারীদেহকে
বেশ কায়দা করে নিয়েও এসেছিস নিজের
বিলাসবহুল বহুতলের ফ্ল্যাটে...
জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ানো মেয়েটার বয়স,
খুব বেশী হলে ওই তেরো কী চোদ্দো...
তোর বয়স আমার হিসাবে পঁয়তাল্লিস এখন!
বেশ পটু হাতে কাছে টেনে নিলি ওই নরম মাংসপিন্ডটাকে
তোর স্পর্শের আঘাতে বিদ্ধ হতে থাকল অপ্রাপ্ত নারীমন
জানিয়ে দিলি, পৌরষত্ব কী, পুরুষের আকর্ষণ কেবল শরীর
যৌনসুখে মাতাল হয়েছিলিস তুই সেই রাতে
তোর অত্যাচারে চাপা পড়ে ছিল কচি মেয়েটার আর্তনাদ
তোর... প্রেমিকা তখন ফোনের ওপারে ভালোবাসা জানাতে প্রস্তুত
তুই তখন আদর নামক বিষে আক্রান্ত!
তোর নামী প্রেমিকা জানলোই না তোর চাহিদা কিসে মেটে
আবারও তুই খেলে চললি আর একটা
প্রাপ্ত বয়স্কা নারীমনের সাথে, দিনের পর দিন
সেও যে তোকে শরীর দেয়নি তা নয়,
দিয়েছে... হয়তো সুখী হসনি তুই তাতে...
সকাল হতে ক্ষতবিক্ষত যোনী দেখে ভয়ে,
কেঁদে ওঠে ওই বছর তেরোর মেয়েটা!
তুই তখন আরাম ঘুমে ব্যাঘাত শুনে ধমকে উঠলি
“ন্যাকামি মারাস না,এটা তোদের পেশা”
কথাটা শুনে কেমন যেন চুপ হল মেয়েটা
সত্যিই তো! এটা তো ওর পেশা...
বাড়িতে না খেতে পেয়ে মরতে বসা পেটের সংখ্যা চার!
বাবার জুয়ার টাকা জোগাড়ে আর ওদের
পেট বাঁচাতে বাবা তাকে বেচে দিলো এই নরকে!
তাও তো সেই ঘটনা একবছর হয়ে গেল!
প্রথম প্রথম বাড়ির জন্য আর শরীরের যন্ত্রনায় ছটফটাতো মন
এখন সবটা সয়ে গেছে...
এও জানে একটুপর এই বাবুও কটা টাকা
মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে তাড়িয়ে দেবে!
মেয়েটার গন্তব্য হবে আবার সেই স্যাঁতস্যাতে গলি আর রাস্তার ধার
আর... তুই... ঘুম থেকে উঠে শুরু করবি অভিনয়
সৎ থাকার অভিনয়, না ঠকানোর অভিনয়
বাড়িতে... প্রেমিকার কাছে সব জায়গায়
প্রয়োজন হবে তোর দক্ষতাযুক্ত অভিনয়ের!
তারপর রাত হলে আবার যাবি রাস্তায় ধরে আনবি
আর একটা কচি মনের নারীদেহকে...
আবারও তৃপ্তি পাবি, উল্লাসে মেতে যাবি সব ভুলে...
তবে, একদিন শেষ হবে, তুইও পাপের সীমা অতিক্রম করবি
পাপ ছুঁয়ে যাবে তোর বাঁচানো পরিবারেও
তখন রেহাই পাবিনা তুই... কেঁদেও ছাড়া পাবি না
ডুবে যাবি পাপের সাগরে, আরো অতলে
তুলে আনবে না কেউ, ওটাই তোর শাস্তি হবে!
পাপের বিনাশ যে যুগ পাল্টালেও নিয়ম বদলায় না!

অলংকরণ - আইন এম

বিজয়া

তন্ময় দাস (উন্মাদ)


শরীরী লজ্জাহারা

সায়ন রায়

গম্ভীরতম সূর্য দেখিনু মেঘবাদলের কোলে
শঙ্কিত তব মেঘমালা দেখো সেজেছে রঙের দোলে
চমকিত সেই উত্তাপ দেয় অভাগিনীটির কোলে
শত শত সুখ ফেলে এসে দুখ শুকায় অশ্রুজলে।

বাঁচবে না কোন অস্ত্রহীনা বস্ত্রহীনের পরে
বঙ্গের বধু অঙ্গের মধু বেচে অমধুর দরে
অমলিন চাঁদ পেতে রাখা ফাঁদ পা দেয় তাতে কারা
দংশন জ্বালা মেটাবে আজি শরীরী লজ্জাহারা।

কামনা, বাসনা, স্বপন ছাওয়ায়
নীলাচলে স্মৃতি দাপিয়ে বেড়ায়
অম্বরে তার রেশ থেকে যায়
অযথা বেদন মাথানত হয়

ঝমঝম করে অন্তর ভরে ঘটিকা গণক গোনে ডান কড়ে
নৃত্য কুশলি কৌশল করে মত্ত চিত্তে বীর্য ভরে
মাথানত করে মান দান করে কুণ্ঠ নমস্কারে
বাঁচবে না কোনো বস্ত্রহীনা অস্ত্রহীনের পরে।

অলংকরণ- নীলাভ বিশ্বাস



একটি সময়ের মৃত্যু ও ফিদেল কাস্ত্রো

শবনম সুরিতা


ফিদেল কাস্ত্রো মারা গেছেন। নব্বই বছর বয়েসে এসে দৈহিক সামর্থ্যের কাছে হেরে গেছেন তিনি। কিন্তু তবুও সারা বিশ্বের ছোট-বড় সমস্ত সংবাদ মাধ্যম তাঁর মৃত্যুর পর এক অদ্ভুত তাড়াহুড়োয় ফেটে পড়ছে কাস্ত্রো সম্বন্ধে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে। যেন এই বুঝি কেউ এসে খবরদারি শুরু করল বলে! কেউ সোজাসুজি আক্রমণ করছেন তাঁর আদর্শ, জীবনযাত্রাকে তো কেউ নির্লিপ্ত, কেঠো স্মৃতিচারণেই গল্পে দাঁড়ি টানছেন। যেন কাস্ত্রোর মৃত্যু আসলে কোন ঘটনাই নয়। তাঁর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ জনগণের সামনে তাদের নিজেদের কাস্ত্রো-ভিত্তিক অবস্থান।

আমি অবশ্য এই তাড়াহুড়োর দলে পড়ি না মোটেও। বেড়ে ওঠার নানা সময়ে কাস্ত্রো বা তাঁর সমগোত্রীয় অনেক মানুষ সম্বন্ধে আমার অবস্থানগুলির মধ্যে মোটামুটি একটা স্থিরতা ছিল। যেমন ছোটবেলায় টেলিফোন রাখার টেবিলের ওপর পরপর আমার ঠাকুর্দা, বাবার পিসিমা, মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও, কাস্ত্রো, রবীন্দ্রনাথ সারিবদ্ধ ছবিতে বন্দী হয়ে থাকতেন। গৃহস্থবাড়ির নিয়ম মেনে সব ছবির গায়ে লাগা ধুলো এক কাপড়েই মোছা হত। আমার তখনও বোঝার বয়েস হয়নি এদের মধ্যে ঠিক কাদের লাশে লাল পতাকা জড়ানো হতে পারে। আর এই না-জানার অবস্থান থেকে বেড়ে ওঠার, বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছি অনেক পরে, কলেজে ভর্তি হবার পর। বাম ছাত্র রাজনীতি করতে গিয়েই গলা ফাটিয়ে বলতে শিখেছি ‘El pueblo unido jamas cera vencido’ (ঐক্যবদ্ধ মানুষের জয় নিশ্চিত)।

স্কুলজীবনে

এবং সেখান থেকেই একটু একটু করে শিখেছি অবস্থানের প্রয়োজনীয়তার। আবার এই প্রয়োজনীয়তা মেটাতে গিয়েই আস্তে আস্তে সারিবদ্ধ ছবির মুখগুলির সাথে নাম যুক্ত করতে শিখেছি। শিখেছি কীভাবে দেশে দেশে মানুষ একই লক্ষ্যের লড়াইয়ে জানকবুল করে দিতে দু’বার ভাবে না। তবে শেখা, জানা-বোঝা ওই পর্যন্তই। ছবির সাথে নাম আর নামের সাথে বামের সাঁকো গড়তে ঠিক যতটুকু জ্ঞানের প্রয়োজন হয়, ততটুকুতেই থেমে গিয়েছিলাম আমি আমার সমসাময়িক আরো অনেকের মত। কিন্তু পারিনি। নিজের কাছে নিজের অবস্থান জানার প্রয়োজনীয়তা থেকেই থেমে যেতে পারিনি, হাঁটতে থেকেছি। কেন হেঁটেছি সেটা হাঁটা শুরু করার সময় অত বুঝিনি, এখনও বুঝি না। তবে কেন হেঁটে যেতে হবেই, থামা চলবে না, হাঁটার দায়িত্ব কতখানি, এটা এখন জানি। এটুকু অন্তত ফিদেল মারা গিয়ে শিখিয়ে দিয়েছেন আমায়। কীভাবে তা করেছেন, সেটাই লিখতে চাই এখানে।

একুশ শতাব্দীর সন্তান আমি। আমার জন্ম খোলামেলা ভারতবর্ষের এক প্রান্তিক শহরে হলেও প্রাপ্তবয়স্কতা লাভ করেছি দেশের অন্যতম মেট্রোপলিটান নগরীতে। লেখাপড়ার সুবাদে পাড়ি দিয়েছি উন্নত বিশ্বের নাকউঁচু ভূখণ্ডে। বয়েসের হিসেবে ফিদেল কাঁটায় কাঁটায় আমার ঠাকুমার সমান, সুতরাং বলাই বাহুল্য আমাদের মাঝের ফারাকটুকু নেহাত কম নয়। কেবল বয়েসের সীমারেখাই যে আমাদের দুজনকে আলাদা করে রেখেছে তা নয়। অভিজ্ঞতা থেকে ভূগোল— দূরত্ব আমাদের প্রবল। তবুও অনেক বাঘা বাঘা লোকেরা যা করে উঠতে পারেননি, ফিদেল সেটা পেরেছিলেন। এক বাক্যে বলতে গেলে, ফিদেলের প্রধান কাজ ছিল মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব ঘোচাবার। সে দূরত্ব হোক টাকার, ক্ষমতার, আদর্শের বা সম্পর্কের— এই লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অনড়। মানুষের সাথে মানুষের সকল প্রকার দূরত্বের প্রথম ধাপ চিরকালই অজ্ঞতায় টইটম্বুর হয়ে থাকে। পাশের মানুষটিকে চেনার কোন চেষ্টা না করে, না জেনে ঘোষণাসূচক বাক্য উচ্চারণ নির্দ্বিধায় অসভ্যতার সাক্ষ্যপ্রমাণ হয়ে ওঠে। কিন্ত ফিদেল সম্পর্কে একথা বলতে পারব না একদম এই প্রসঙ্গে মাথায় রাখতে হবে, যে যুগের সন্তান তিনি ছিলেন, সেই যুগের অপরনাম জেটযুগ নয়। মাউসের ক্লিক বা অনলাইন লাইব্রেরীর সাহায্যে এক লহমায় পৌঁছানো যেত না বিশ্বের প্রতিটি কোনায়। এতকিছুর পরেও ফিদেল পেরেছিলেন কিউবা থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভারতবর্ষকে জানতে। ১৯৫৩ সালে কতজন ভারতীয় কিউবা সম্বন্ধে জানতেন সে তথ্য আমার অজানা, তবে ফিদেল ভারত সম্বন্ধে বেশ ভালো মতই খোঁজ রাখতেন (অন্তত তার আভ্যন্তরীণ রীতি-নীতির চলন তাঁর পরিচিত ছিল) এটুকু জানি। শুধু তাই নয়, নিজের বক্তব্যে ভগবত গীতা ও শ্রীকৃষ্ণের উল্লেখ করে ন্যায়-অন্যায়কে সংজ্ঞায়িত করার স্পর্ধা রাখতেন ফিদেল কাস্ত্রো। আমার অজ্ঞতা লজ্জায় ফেলে দেয় আমাকেই। আমি অসভ্য। সত্যিই ফিদেল আমার সময়ের মানুষ ছিলেন না। একুশ শতকের সব জানার, বুঝে ফেলার সময়ের সামনে ফিদেল এক অন্য সময়ের সুদৃঢ় প্রতিনিধি। তাঁর মৃত্যুতে অনেককেই দেখলাম বলতে কেন তাঁর মৃত্যু জানিয়ে দিয়ে যায় যে বিংশ শতাব্দীর মৃত্যু অবশেষে ঘটেই গেছে।

কিউবার বিপ্লবের সূচনা, 1953

একটা প্রশ্ন জাগে নিজের ভেতর। ফিদেলের মৃত্যু কি শুধুই এক যুগের অবসানের সূচকমাত্র? নাকি তাঁর মৃত্যু স-জ্ঞান রাজনীতির মরে যাবার বার্তাও নিয়ে আসে বগলদাবা করে? ইন্টারনেটে ফিদেল সম্পর্কে নানা রকমের ছবি-কার্টুন দেখতে পাচ্ছিলাম তাঁর মৃত্যুর খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর। এক জায়গায় দেখলাম বেশ সুচিন্তিতভাবে আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদে জয়লাভকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ফিদেলেরই উচ্চারিত বাক্যে, “I will not die until America is destroyed”— সূক্ষ্ম হিউমার ছুঁচের মত ফুটল সারা গায়ে, দুনিয়া জানতে পারল আসলেই কেন ফিদেল দেহরক্ষা করেছেন এতদিনে।

আমেরিকার বিনাশ বলতে ফিদেল কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তা আমরা কেউই আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারব না, আন্দাজ করতে পারব কেবল। কিন্ত সেই আন্দাজেও রয়ে যাবে ফাঁকফোকর নির্ঘাৎ। কারণ ফিদেল মারা গেছেন। আর মৃত্যু-পরবর্তী কোন ব্যক্তিত্বকে উদ্ধৃতিতে বন্দী করা যায় ঠিকই, উদ্ধৃতির উদ্দেশ্যের রহস্য সম্পূর্ণরূপে উন্মোচন করা যায় না।

ঐতিহাসিক জয়ের পর

সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে ভালো করেই জানি নেতা, জনতা আর জননেতার মধ্যে পার্থক্য কী। শুধু তাই নয়, আমি এও জানি, যে কোন নেতা বা বিশেষ করে জননেতা যখন মারা যান বা বুদ্ধিশক্তি হারিয়ে ফেলেন, ব্যক্তিত্বহীন নেতা বা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জনতার দল সদর্পে জননেতার ভাষ্যের পাঠোদ্ধারে উপনীত হন। এছাড়াও একদল গবেষক বা একাডেমিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা ক্রমাগত চেষ্টা করে যান জননেতার ‘আসল রূপ’ চেনাতে। এই প্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ ফিচেল আঙ্গিকে নিজেই নিজেকে তাহলে কিছুটা তাত্ত্বিক, কিছু অযৌক্তিক এবং  স্বল্প মাত্রায় আত্মঘাতী একটি প্রশ্ন করাই যায়— ফিদেল, তুমি কার? কে বলবে তোমার কথা? আর সেটা যে তোমারই কথা থাকবে, সে বিচার করবে কে?

সজ্ঞানতায় পরিপূর্ণ কোনো উত্তর খুঁজতে আমি যাচ্ছি না কারণ এমন উত্তর আমার অজ্ঞ মাথা থেকে কখনোই বেরোবে না। অতএব হার স্বীকার করে নিয়েছি সানন্দে। একজন অত্যন্ত অমনোযোগী, চঞ্চলমতি ছাত্রী হিসেবে ধারণা করার ধৃষ্টতাটুকু করতে পারি আমি বরং।

ফিদেলকে উত্তরের মধ্যে খুঁজতে যাওয়াটাই কেন জানি না আমার জন্য দারুণ ব্যর্থতার গন্ধ নিয়ে আসে। আঁচ করতে পারি, ফিদেল কোন উত্তর নন। তিনি একাধারে প্রশ্ন, প্রশ্নকর্তা, প্রশ্ন করবার সাহস। মার্কসবাদী ফিদেল আসলে দ্বন্দ্বের, দ্বন্দ্বের পক্ষে যুক্তির প্রতিনিধিত্ব করে গিয়েছেন আমৃত্যু, এবং তার পরেও। সুতরাং ফিদেলকে খুঁজে যেতে হবে লড়াইয়ের ঠিক মধ্যিখানে কোথাও। ভবিষ্যতের সাথে অতীতের দ্বন্দ্বরূপী যে লড়াই, ফিদেল যেন সেই লড়াইয়ের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। হয়ত এর নামই শখ করে তিনি রেখেছিলেন বিপ্লব। সাজিয়ে গুছিয়ে আমার এতকিছু বলা যে আসলেই ফিদেল প্রসঙ্গে এক অদ্ভুত অজ্ঞ, ছড়িয়ে থাকা রোমান্টিকতার প্রমাণ, তা স্বীকার করি। আর ফিদেল যেন আমার এই Exotic অজ্ঞতার মুখোমুখি মারাত্মক রকম পরিশীলিত জ্ঞানের আজব অ্যান্টি-থিসিস হয়ে উঠতে থাকেন। আমি আরো আরো লজ্জায় পড়ে যাই। আমার সময় লজ্জায় পড়ে যায় তার সাথে।

‘মার্চ টু হাভানা’, 1959

আমি নিজে ডায়রি লিখি। অন্য কারো প্রয়োজনে নয়, নিজের সময় কাটাতে, নিজেকে আরেকটু ভালো করে চিনতে চেষ্টা করি— তাই লিখি, যা মাঝে মাঝে আমার ব্লগে জায়গা করে নেয়। মাঝে মাঝে ফিরে যাই পুরনো লেখায়। কাটাকুটি করে ফেলে আসা ‘আমি’-কে বদলাবার চেষ্টায় লাগি। পারি কি না জানিনা, তবে গত দেড় বছরের খান ষাটেক ব্লগপোস্টে একটা আমিত্বের ধারাবাহিকতা টের পাই। সাদায়-কালোয় লিখে রাখলে খানিকটা হলেও একটা মানুষ স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে বলে আমি মনে করি। নাহলে তো পৃথিবীর দু’পেয়েরা রয়েই যেত নিজেদের সব রহস্য-রোমাঞ্চ থেকে অধরা চিরকাল। শব্দ আমায় মানুষ চেনায়। আর মানুষ চিনতে শেখা, নিজেকে চিনতে শেখাই এখন আমার নিত্যদিনের অভ্যেস।

যাই হোক, ফিদেল প্রসঙ্গে লিখতে বসে মানুষ ফিদেল ও তাঁর জীবনের স্পষ্ট-অস্পষ্টের কথা মনে পড়িয়ে দিল আমার এই প্রাত্যহিক অভ্যাসটি। কোথায় যেন পড়েছিলাম ফিদেল কাস্ত্রোর একটা মহাভারত-সমান জীবনী আছে। বাড়িতেই ছিল বাবার কাছে, খোঁজ নিয়ে জানলাম। হুশ করে মাথায় খেলে যায় চিন্তা। ফিদেলও কি কখনো ফিরে যেতেন নিজের ফেলে আসা জীবনের কাছে? চাইতেন ফিরে যেতে? মোনালিসা বা যে কোন পাকা দাবাড়ুর মত চালাক হাসি হাসতেন কি আশেপাশের অজ্ঞতা দেখে? দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন তাঁর বক্তব্যের অসমাপ্ত পাঠের প্রেক্ষিতে? নাকি একদম পেছনে তাকাতেন না ফিদেল? শ্যেনদৃষ্টি সর্বদা সামনে, খোলা আসমানের দিকে থাকত তাক করা? এই কৌতূহল মেটাতে বইয়ের একটি অনলাইন সংস্করণ বাগে আনলাম, আর মাথার ভেতর একটা নতুন জগত খুলে গেল।

নিউ ইয়র্ক, 1959

ইগন্যাসিও র‍্যামোনেতের শতঘন্টাব্যাপী দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে ফিদেল কাস্ত্রোর যে একটি জীবনী রচিত হয়েছিল, সে কথা অনেকেই জানেন। কিন্ত আমার মত জানা সত্ত্বেও সেই বিশাল, পেটমোটা বইটি শেষ পর্যন্ত পড়ে উঠতে পারেননি, এমন মানুষের সংখ্যাও নেহাত ফেলনা নয়। মানুষ হিসেবে, এবং বিশেষ করে একুশ শতাব্দীর সন্তান, আমি অন্তত ধৈর্যের সাথে কিছুই শেষ করে উঠতে পারিনা ভালো মত। সেই কারনেই পড়া হয়ে ওঠেনি পুরো বইটা আজ অবধি। তুলনায় ফেসবুকের ওয়াল থেকে ওয়ালে আমার আঙুল দ্রুত নেচে বেড়াতেই যেন অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ্য। তবুও সাহস করে সেই বইটির কিছু অধ্যায় পড়বার চেষ্টা করেছি। এবং পড়তে পড়তেই মাথার ভেতর আচমকা ইগন্যাসিও’র প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা জেগে উঠেছে। একজন মানুষের ঠিক কতখানি অধ্যবসায় থাকলে ১০০ ঘন্টার সাক্ষাতকার নিতে পারে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে অবাক হয়েছি। এক প্রশ্ন থেকে আরেক প্রশ্নে যাওয়া শুধু নয়, এক ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের, কর্মজীবনের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর তথ্য থেকে কীভাবে নিংড়ে তুলে আনতে পারে একটা সময়ের ইতিহাস, ভেবেছি সেটা। অবশেষে ইগন্যাসিও’র প্রতি একটা প্রণাম না ঠুকে পারলাম না। কিন্ত মনের প্রশ্ন এখানেই থামল না। মাথার ভেতর ডায়ালেক্টিক্স খাটিয়ে বুঝতে পারলাম যে এহেন সিন্থেসিস একা ইগন্যাসিও’র ক্ষমতায় হয়নি। আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে বিপরীতে থাকা উত্তরদাতার নাম ফিদেল কাস্ত্রো। যার জীবনবর্ণনা যতটা উত্তেজক, তার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী তাঁর বাচনশক্তি। ভূতের রাজার বর পেয়েছিলেন কি না জানি না, তবে ফিদেলের বক্তৃতা আর গুপী-বাঘার যুগলবন্দী যে একই রকম জনতাকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে দিতে পারত, এ কথা আর নতুন করে প্রমাণ করবার দাবী রাখে না। শোনা যায়, ঘন্টার পর ঘন্টা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারতেন তিনি হাজার হাজার জনতাকে স্রেফ তাঁর অনবদ্য শব্দ-কথার গাঁথুনিতে।

তাঁর দীর্ঘ জীবনে এমন কতই না বক্তৃতা ফিদেল করেছিলেন। তবে তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচ্য নিঃসন্দেহে ১৯৫৩ সালে গ্রেফতার হবার পর বিচারাধীন সময় আদালতে উচ্চারিত ‘ইতিহাস আমাকে মুক্ত করবে’ বক্তৃতাটি। আত্মরক্ষার্থে করা এই বিখ্যাত, তাৎক্ষণিক অথচ টানা চার ঘন্টাব্যাপী বক্তৃতাটি পরবর্তীকালে ফিদেল প্রকাশ করেছিলেন। মূল বক্তব্যে যে বাক্যটি তিনি একদম পরিশেষে উচ্চারণ করেন, তা ছিল “History will absolve me”, যা পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে সংগঠিত বাম আন্দোলনের অন্যতম সর্বাধিক ব্যবহৃত উদ্ধৃতিতে পরিণত হয়। এখানে, এই বাক্যে ব্যবহৃত “absolve” শব্দটির প্রতি আমি খানিকটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

অভিধান অনুসারে absolve শব্দের অর্থ মুক্তিপ্রাপ্তি, ক্ষমা অথবা শোধ করা। এখন প্রশ্ন উঠছে ফিদেল কি শুধুই মুক্তিপ্রাপ্তির অর্থে এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, নাকি এর পেছনে এবং পরবর্তী রূপগুলিতে ধরা পড়লেও পড়তে পারে অন্য কোন ভাষ্য? দ্বিতীয়ত, যদিও বা তিনি মুক্তি অর্থেই এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে সেই মুক্তির আদল আসলেই কেমন, তা ফিদেলকে বুঝে উঠতে পারার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রয়োজনীয় বলে আমি অন্তত মনে করি।

বনাম সিআইএ, 1961

সংস্কৃতি, রাজনীতি ও বৃহত্তর সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে আমি সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করি যে কোন একমুখী ভাষ্যকে। যুক্তি ও চিন্তার দিশা যে সর্বত্রই একপথগামী হবে, তাঁর বিন্যাসের পূর্ণরূপ যে বহুরূপী ও স্তরীভূত নয়, তাও আমি মানতে নারাজ। সে কারণেই বোধহয় আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় অনেকান্তিক সত্যে। কিছুদিন যাবত কলকাতার বিশিষ্ট নাট্যকার ও গবেষক সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের সাথে একটি কাজে সাহায্য করবার সুযোগ পেয়ে পড়াশোনা করার অভ্যেসে ফিরে গেছি। ফলত, বেশ কিছু আশ্চর্য চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট বোধ করছি আচমকা। এমনই এক সুযোগে পড়ে ফেলি বাখতিন। সোভিয়েত চিন্তক মিখাইল বাখতিন যে কোন ভাষ্যের ‘হেটেরোগ্লোসিয়া’ (বাংলায় যার সবচেয়ে কাছাকাছি অনুবাদ ‘অনেকান্ত’ ছাড়া কী দাঁড়ায়, আমার একদমই জানা নেই) প্রসঙ্গে এমনই এক চিন্তাধারার কথা বলেন। তাঁর মতে, যখন কোন ভাষ্য বা বক্তব্যের জন্ম হয়, সেই ভাষ্যের অর্থ বা উদ্দেশ্য প্রায়শই থাকে একের বেশি। অর্থাৎ, দ্বৈত বা নানা স্বরে ধ্বনিত হতে থাকে একটি ভাষ্য, যাকে তিনি polyphony হিসেবেও বোঝাতে চেয়েছেন বারবার। বাখতিন এটাও বলেন যে এমন বহুমুখী উচ্চারণ ধরা পড়ে বিশেষত নানাবিধ পারফর্মেন্সের ক্ষেত্রে, যেমন সঙ্গীত বা নাট্যের পরিসরে। এবং যেহেতু জনসমক্ষে ও একান্তে সংগঠিত ফিদেলের বক্তৃতাগুলি আসলে একপ্রকার রাজনৈতিক সম্ভাবনাময় পারফর্মেন্স, অতএব তাঁর বক্তৃতাকেও এই ছাঁচে ফেলার চেষ্টা করা যেতেই পারে। কিন্ত সহজ করে বোঝাতে গেলে উদাহরণ দরকার। এক্ষেত্রে যদি লালনের বা রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গেও আমরা আসতে পারি, তাহলেও কিছু সমগোত্রীয় ব্যবহার আমাদের চোখে পড়বে। লালনের গানসমূহ মূলত শ্রুতি-পরম্পরায় বাহিত। সে অর্থে কোন লিখিত রূপ না থাকার ফলে অর্থ বা ‘মিনিং’-এর অন্বেষণে তাঁকে নানা রকমের দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যেমন তাঁর একটি গানের পংক্তি, “সিরাজ সাঁই ডেকে বলে লালনকে/ কুতর্কের দোকান তুই করিস না আর/ ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার”- এই শেষ পংক্তিটির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে যে লিখিত ভাষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন যতিচিহ্নের প্রয়োগে এর অর্থ এদিক-ওদিক হতে পারে সহজেই। “ভবে মানুষ, গুরু-নিষ্ঠা যার” বা “ভবে মানুষ-গুরু, নিষ্ঠা যার” অথবা “ভবে মানু্‌ষ, গুরু, নিষ্ঠা যার”- এই তিনটির মধ্যে যে কোন একটি হয়ে যেতে পারে বক্তব্যের উদ্দেশ্য। তাহলে প্রশ্ন ওঠে কোনটা মান্য করা হবে। কিন্ত যদি আমরা বাখতিনের পথে হাঁটতে যাই, লালনের একই সাথে তিনটি অর্থের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকট হয়ে আসে। আসলে লালনের গান লালন নিজে খাতায়-কলমে লিখে যাননি, উচ্চারণ করেছিলেন শুধু। যারা মুদ্রণে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তারাই লালনের হয়ে গানের অর্থ খানিকটা হলেও নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। এবং সেই প্রক্রিয়ায় কিছুটা হলেও লালনের ভাষ্য খণ্ডিত হয়ে পড়েছে বলা যেতে পারে।

একই ভাবে ফিদেলের হাতে গোনা কয়েকটি বক্তৃতা ছাড়া, নিজ হাতে সেই বক্তব্যের অনুলিখন ফিদেল করেননি। করেছেন বিভিন্ন সরকারী, বেসরকারী আধিকারিকেরা বা অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ। সুতরাং ফিদেল আসলেই যখন উচ্চারণ করেন যে “History will absolve me”, তিনি কোন অর্থে absolve বলেছিলেন, তা ফিদেল নিজে ছাড়া আর কেউই সম্পূর্ণ সঠিকভাবে বলতে পারেন না। আমরা কেবলই নিজেদের মত করে ধরে নিতে থাকি বিভিন্ন একমুখী সত্যকে ও মেতে থাকি সেই সত্যের উদযাপনে। আমাদের এযুগের তাড়াহুড়োয় কোথাও গিয়ে তাই ফিদেল রয়ে যান মিথের মতন অধরা, আংশিকভাবে স্পষ্ট।

এই একই উক্তির প্রেক্ষিতে আমরা ভাবতে বসি, তাহলে শেষ পর্যন্ত ফিদেলের মোক্ষ কোথায়? ওনার মুক্তি কি তাহলে শুধুই সমাজতন্ত্র কায়েমের স্বপ্নেই সীমাবদ্ধ? নাকি দূরদ্রষ্টা ফিদেল অল্প হলেও আঁচ করতে পেরেছিলেন ইতিহাসের ফেরে কোন অন্য মুক্তির কথা? এই মুক্তি কেমন? কী থেকে মুক্তি? বন্ধন, শৃঙ্খল থেকে মুক্তি? নাকি এই মুক্তি আসলে রূপকার্থে ব্যবহৃত, যার অর্থ সময়ের সাথে ক্রমাগত বদলে যেতে বাধ্য?

কমিকজগতের সুপারহিরো স্পাইডারম্যানের ভাষায় “With great power, comes great responsibility” এপ্রসঙ্গে মাথায় ঘোরে। ফিদেলের সুযোগ্য, বলিষ্ঠ নেতৃত্বে যে বিপ্লব বাস্তবায়িত হয়েছিল, তার পরবর্তীতে তিনি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রবল ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। এবং ক্ষমতার কান টানলে দায়িত্বের মাথা সমেত সুবিশাল বপু এসে ধরা দিয়েছিল তাঁর কাছে। ফলত, যে শৃঙ্খল থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে বিপ্লবের পথে কাস্ত্রো হাঁটতে শুরু করেছিলেন, পরের দৃশ্যে সেই বিপ্লবই তাঁকে বেঁধে রেখেছিল ক্ষমতার আসনে। যার ফলস্বরূপ একনায়কতন্ত্রের আভাস তাঁর কার্যকলাপে প্রচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল সাময়িকভাবে। ক্ষণের মুক্তি এভাবেই ফিদেলের জীবনে পরিণত হয় ক্ষমতার প্রতি পরাধীনতায়।

খরুশ্চেভের সঙ্গে, মস্কো, 1963

কিন্তু ইতিহাস থেমে থাকে না, থাকতে পারে না। এবং যেহেতু সময় পালটায়, ফিদেলের সেই উক্তিটিকেও উল্টেপাল্টে দেখার সময় এসে গেছে। ইতিহাসের হাতে, ইতিহাসের থেকে মুক্তি চাওয়া ফিদেল কাস্ত্রোকে এখনের সময়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে গেলে absolve শব্দের কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোন গতি নেই। মানুষ ফিদেলকে উদ্ধার করতে তিনি নিজেই পারতেন, এখনও তাই। এক্ষেত্রেও ধরে নিতে হবে অনেকান্তের সত্যতা আর প্রশ্ন করতে হবে প্রতিদিন, এই উক্তির উদ্দেশ্য আসলেই কী? নিজের বিচ্যুতির জন্য ইতিহাসের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা? নাকি এসবের বাইরে গিয়ে নিজের বক্তার আসন থেকে, ক্ষমতার থেকে মুক্তির কামনা? ফিদেল কি তাহলে চাইতেন বক্তার আসনের চূড়ান্ত গণতান্ত্রিকীকরণ? যেখানে তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ হয়ে উঠবে আসলে অনেকগুলি ক্ষীণকন্ঠের সমাহারে সমৃদ্ধ?

আমরা জানব না, কারণ ফিদেল নিজেই আজ ইতিহাস হয়ে গেছেন। তিনি মুক্ত। কিন্তু তাঁর দায়ভার রয়েই গেছে, একই সাথে উত্তরাধিকারও। আর এখনও, এতগুলি ফেলে আসা বছরের মতই, absolve হওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রেখে যাচ্ছেন। আর এই সময়ে দাঁড়িয়ে ফিদেলের মৃত্যু আমাদের চিরপরিচিত সব সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করার জোগান দিয়ে যায়— ফিদেল কই? ইতিহাস কী ও কেন? মুক্তি কোন পথে? আর বিপ্লবের সময় ঠিক কখন?

ফিদেলের মৃত্যু বড় অসময়ে এলো। এমন একটা সময়ে তিনি মারা গেলেন যখন তাঁর মারা যাওয়া আলাদা করে কিছু ঘটিয়ে দিয়ে যায় না চারপাশে। এখন এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি যখন কোন মানুষের মৃত্যু নতুন করে আমাদের অন্তরাত্মাকে আন্দোলিত করতে ব্যর্থ হয়। আমরা কাঁদি না, হাসি না। নীরব দর্শকের মত শুধু সাক্ষী থেকে যেতে পারি। ফিদেলের মৃত্যুও ঠিক তেমনি আমাদের আর তেমনভাবে আন্দোলিত করে না। এই সময়ের গুণগত মাপকাঠিতে তিনি বহুযুগ আগেই মরে গেছেন। এমন বর্ণাঢ্য, ঐতিহাসিক জীবনের অধিকারী ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর আরো অনেক শোরগোল প্রাপ্য ছিল। কিন্তু এমনটা মোটেও হয়নি। বড়জোর তিন-চারদিনের খবরের কাগজের প্রথম পাতা, তারপর টিভি চ্যানেলের সপ্তাহান্তের গোটা দুয়েক বিশেষ অনুষ্ঠান বরাতে জুটবে এই মৃত্যুর। তাহলে হঠাৎ এখন কেন লিখছি এই মানুষটিকে নিয়ে?

লিখছি, কারণ ফিদেলের মৃত্যু আরো একবার জানান দিয়ে যায় তিলে তিলে মরে যেতে থাকা একটা সময়ের কথা। অসম্ভব স্বপ্নালু একটা সময়ের মরে যেতে থাকার কথা। আবার অন্যদিকে চরম হতাশার, স্বপ্নভঙ্গের সময়কেও ধরিয়ে দিয়ে যায় আমাদের ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যু।

ভিয়েতনাম, 1973

এখন অন্তত ফিদেলের মৃত্যু কাউকে অপরাধী করে দেয় না। বরং তাঁর থেমে যাওয়া আরো অনেককে বাঁচিয়ে রেখে যায়। আমার জানা মতে, তিনি মরণোত্তর দেহদান করে যাননি, সুতরাং তাঁর দেহের অংশবিশেষ অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না চাইলেও। দৈহিক খণ্ডনের বিপরীতে থেকেও থিসিয়ুসের জাহাজের আখ্যান মনে পড়ায় আমাদের এই বিপ্লবীর মৃত্যু। বেশ কিছু মানুষ দেখলাম বিভিন্ন মাধ্যমে বিদায় জানাচ্ছিলেন ফিদেলকে। আমি জানাইনি। কারণ আমি শিখেছি বাস্তববাদী কমিউনিস্টদের দৈহিক মৃত্যুতে অশ্রু ঝরাতে নেই। অন্তত সেই ব্যক্তি যদি হন ফিদেল কাস্ত্রো। কাস্ত্রোর মুক্তি মৃত্যুতে ঘটতে পারে শুধু একটি মাত্র দিক থেকে। ইতিহাসের ফেরে দেশে দেশে যেভাবে ফ্যাসিবাদী শক্তি নব নব রূপে ফিরে আসছে পৃথিবীর সর্বত্র, কোথাও গায়ে গেরুয়া তো কোথাও মুখের চামড়ার রঙে হালকা কমলা-গেরুয়ার আভাস, ঐকিক নিয়মে তাঁর বিপরীতে দাঁড়াবার জন্য গুটিকয়েক ফিদেল ফিরে আসবেই। কে জানে, ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদের নিত্য নতুন ভাষ্যের বিরুদ্ধে আবার কোন ফিদেল জন্মান কি না নতুন কোন মুক্তির লক্ষ্যে।

মানুষের মৃত্যুতে কাঁদা যেমন যুক্তিহীন, স্মৃতির মৃত্যুতে অনড় থাকা তেমনই অমানবিক। সুতরাং মানুষ ফিদেলের মৃত্যুতে ব্যথিত হবার যত কারণ আছে, তা মেনে নেওয়া কোন যৌক্তিক মস্তিষ্কের পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। ২০১৬ সালে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ ফিদেলের শারীরিক অবস্থার প্রেক্ষিতে এই মৃত্যু অবধারিত ছিল। কিন্ত এসব মস্তিষ্কের কথা কেবল। তাঁর সাথে হৃদয়ের, স্মৃতির, স্মৃতির রোমান্টিকতার কোন যোগ নেই। কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র, গ্রান মা’তে ফিদেল বিষয়ক কিছু লেখা পড়ছিলাম। আলফন্সো গার্সিয়া নামের একজনের লেখা চোখে পড়ল। লেখাটির শিরোনাম বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “কাছ থেকে ফিদেলকে দেখেনি আমার পরিবার”। লেখকের বাবা-মা ১৯৫০-এর দশক থেকেই কিউবা নিবাসী। ভগবানে প্রবল বিশ্বাসী গার্সিয়া দম্পতি সমাজতন্ত্র কী জানেন না। কমিউনিজম দিয়ে কী হয় জানার কোন প্রয়োজন পড়েনি তাঁদের জীবনে। দৈনন্দিন টানাপোড়েনে দিনের শেষে লেডি অফ এল কোব্রে দেবীর মূর্তির নীচে নত হলেও, কোথাও একটা তাঁরা যেন জানতেন ফিদেল নামক ছেলেটা আদতে মুশকিল আসান, মসীহা গোছের কেউ একটা। যখন এই লেখাটা পড়ছিলাম, আমার সামনে টিভি চলছিল। পর্দায় এক হিরোকে দেখতেই মাথায় খেলে গেল অদ্ভুত সামঞ্জস্য। রজনীকান্ত। যার দয়ায় দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র বাস্তব-অবাস্তবের ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিতে বসেছে প্রায়।


অদ্ভুত তুলনা বলতেই পারেন মানুষজন, কিন্ত এই দুজনেরই একটা মারাত্মক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে, সে কথা মানতেই হবে। কাস্ত্রো ও রজনীকান্ত নিজেদের মত করে, পৃথিবীর দুটি সম্পূর্ণ অন্য গোলার্ধে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে স্বপ্ন দেখিয়ে এসেছেন। বাস্তবে-অবাস্তবের নায়ক এরা দুজনই। এদের হাত ধরেই মানূষ কখনো চিনতে শেখে বাস্তব-অবাস্তবের ফারাকটুকু, আবার আরেকজন নিজের স্বার্থেই ক্ষণিকের জন্য হলেও পেরোতে শেখে স্বপ্ন আর সত্যের মাঝের চৌকাঠ। মানুষ যখন জীবনের চরম অপ্রাপ্তি, হতাশা, না-পাওয়া থেকে দূরে যেতে আশ্রয় খুঁজতে থাকেন, কেউ পেয়ে যান রূপোলী পর্দা, আবার কারোর হাতে উঠে আসে কোন লাল নিশান। দু’পক্ষই স্বপ্ন দেখে চরম রোমান্টিকতার বাস্তবায়নের। পর্দার হিরোর মত কখনো এই মানুষ চায় প্রেয়সীকে অতি সহজেই নিজের করে নিতে। চায় সব গুণ্ডাকে একা হাতে দাবড়াতে, কিন্ত বাস্তবের মাটিতে তা পারেনা। অন্যদিকে আরেক দল মানুষ উদ্দীপিত হন কোন নেতার জাদুকরী বক্তব্যে। ঘন্টার পর ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে রক্ত গরম করা বাণী শুনে তাদেরও বুকে বিপ্লবের স্পন্দন জাগতে থাকে। আর সেই বুক ঠুকে তাঁরাও হতে চান এক একজন লেনিন, কাস্ত্রো। আবার এই দুই ক্ষেত্রেই ক্যামেরা সরলে উঠে যায় মেকাপ। চড়া রঙ (লাল কি না জানি না) মুছে গেলে ধরা পড়ে বার্ধক্যের বলিরেখা। যা স্বপ্নের হিরোর সাথে রক্তমাংসের মানুষের সব দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। স্বপ্নভঙ্গ হয় কি না জানিনা, তবে হিরোর মানবায়ন যে ঘটেই এটুকু নিশ্চিত। আর দেবতার মানবায়নের মতই এক্ষেত্রেও ধরা পড়ে মানুষের ঐকান্তিক টানাপোড়েন, ব্যর্থতা ও প্রবল দীর্ঘশ্বাস। শেষ দৃশ্য, তেনারা বৃদ্ধ হন আর উচু বনস্পতি গাছের মত ছায়ার সৃষ্টি করে যেতে থাকেন অবিরাম।

লুই আর্মস্ট্রঙ্গের কথাও যে কেন মনে পড়াচ্ছেন ফিদেল আমায় এতকিছুর পর, বুঝে উঠতে পারছি না। আমার অন্যতম প্রিয় সঙ্গীতস্রষ্টা, গায়ক ও স্যাক্সোফোনবাদক এই ব্যক্তিটির একটি অবিস্মরণীয় উদ্ধৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। যাদবপুরে স্নাতকস্তরে পড়াকালীন আফ্রো-আমেরিকান সঙ্গীত পড়েছিলাম কিছুদিন। পরীক্ষার আগের রাতে ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ কিছুতেই মাথায় ঢোকাতে পারছিল না গভীর তত্ত্বকথার আগাগোড়া কোনকিছুই। এই ব্যক্তিটির কথা পড়তে গিয়ে সেই উদ্ধৃতিটি চোখে পড়ল, আমি তড়াক করে জেগে উঠলাম। শেষ বয়েসের লুই-কে প্রশ্ন করা হয় তাঁর মৃত্যুর পর জ্যাজ-ব্লুজ সঙ্গীতের ভবিষ্যত প্রসঙ্গে। প্রশ্নকর্তা জানতে চান কীভাবে একই গান এত বছর ধরে গেয়ে-বাজিয়ে যাচ্ছেন অক্লান্ত লুই। ওই একটাই পথ, একটাই যন্ত্র, আর একটাই জীবন। জ্যাজের সুর বেসুর ঠেকে না কখনোই? তাঁর কি ক্লান্তি নেই? শিল্পীর কি আসলেই কোনো ক্লান্তি থাকে না? উত্তরে লুই বলেন, “How can I get tired? I don’t do anything. I just stand here. But my blues keep walkin”

ফিদেল প্রসঙ্গে এতগুলি মানুষের কথা মনে পড়ল, তাঁদের কথা লিখলামও। কিন্তু তাঁদের সাথে ফিদেলের যে কতটুকু যোগাযোগ বাস্তবের মাটিতে থাকা সম্ভব জানিনা। আসলে থাকার কথাও নয়। বাস্তবে এসব কিছুই হবার কথা নয়। আমি যতগুলি কথা লিখলাম, তাঁর কোনটাই কি আসলে বাস্তবে লিখছি? লিখতে পারছি? বাস্তব কি এতই সহজবোধ্য যে আমি শব্দে-কথায় বুঝিয়ে উঠতে পারি সত্যি অর্থে ঠিক কী বোঝাতে চাইছি? হয়ত পারছি না। পারছি না, কারণ একজন একুশ শতকের চব্বিশ বছরের মানুষের কাছে বাস্তব যথেষ্ট পরিমাণে উত্তেজনা নিয়ে আসতে পারে না।

বাস্তবের উত্তেজনা, বাস্তবের স্বপ্ন যে সময়টায় বেঁচে ছিল, সেই সময়ে ফিদেল বেঁচে ছিলেন। বিংশ শতকে বাস্তবের স্বপ্ন থাকত। তখন স্বপ্নের মত হাওয়ায় দুর্গগড়া বাস্তব ছিল না, যেখানে একদিকে রক্তমাংসের মানুষের বাস্তবের চেয়ে বেশি দামী হয়ে ওঠে কাল্পনিক দেশপ্রেম। এযুগের প্রতিনিধি আমার কাছে তাই বিংশ শতক মানে স্বপ্ন, স্বপ্নের হেরে যাওয়া, আর তারপরও নতুন স্বপ্ন দেখতে পারার সাহস। তবে তাঁর চেয়েও বেশি বিংশ শতাব্দী মানে বুঝব স্রেফ মানুষের শতাব্দী, বাজারের নয়। আর ফিদেল মানুষ ছিলেন। আনন্দ, উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা, স্বপ্ন, বিদ্রোহ, রাগ, ঘৃণা, অনুতাপ, মোহ, লজ্জা— সব মিলিয়েই ফিদেল কাস্ত্রো একটা নয়, অনেকগুলি মানুষ একসাথে হতে পেরেছিলেন।

আর এমন মানুষকে নিয়ে লিখতে বসলে ধরে নিতেই হবে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। মুক্তির পথে, মুক্তির ইতিহাস লিখতে লিখতে বুড়ো হাত থেমে গিয়েছিল। কারণ সেই হাত একা ছিল না। সেই পা পথে পথে একা হাঁটেনি। সেই শরীর একটা জীবনের গ্লানির বোঝা নিয়ে চলেনি কখনোই। সুতরাং তিনি ক্লান্ত হয়েছেন। এবং শরীরের ক্লান্তি মেনে ধরেই নিচ্ছি তিনি এখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। বা থেমে দম নিচ্ছেন কোথাও কোনো রাস্তার মোড়ে। উনি জানেন কিনা জানি না, অনেকগুলি ফিদেল ঠিক হাঁটছে। পৃথিবীর কোণে কোণে তাঁরা নিশ্বাস ফেলছে প্রতিদিন। আর এতকিছুর পরেও, ৬৪০ বার থামিয়ে দেবার চক্রান্তের পরেও ক্লান্ত ফিদেল আর্মস্ট্রং-এর জ্যাজের মত সঙ্গীত হয়ে ঝরে পড়ছেন সর্বত্র।

অবশেষে, তিনি আজ মুক্ত।

[মূল লেখাটি ‘মুক্ত ফিদেল’ শিরোনামে ১১ই ডিসেম্বর, ২০১৬, দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ-এ প্রকাশিত]

কুটুম কাটাম

রুমেলা দাস


ভাবনার ঘুলঘুলি

আমি ও আমিত্ব

অথৈ

অন্তর্দহন

অনিমেষ গুপ্ত

শোকের ছায়া লেগে থাকলেও অনেকের হৈ-হট্টগোল আর কথাবার্তায় ক’টাদিন সরগরম ছিল বাড়ীটা। শ্রাবণীই বরং একটু স্পেস চাইছিল একলা হওয়ার জন্য, চাইছিল প্রবালের স্মৃতিতে ডুবে থাকতে।

শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটে যাওয়ার পরে হঠাৎই খালি হয়ে গেল বাড়ী। শুধুমাত্র ঝুনুপিসি আর লতিকামাসী আরো আধবেলা থেকে শ্রাবণীর জিনিসপত্র একটু গোছগাছ করে ফিরে গেলে ওপর-নীচে দুটোতলার মাঝে বড় ধাপের ঘোরালো সিঁড়ি, ছোট বড় পাঁচটা ঘর আর প্রবালের ছেড়ে যাওয়া মাঝ দুপুরের শূন্যতার মধ্যে শ্রাবণী তখন একেবারে একা।

অমলের আর্তনাদ

কৃশানু চন্দ


জেল থেকে বেরোবার আগে অমল একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

২০৩৯ সাল। রাষ্ট্র সরকারের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভালো রাজ্যে আজ আলোর ঝলকানি।চারিদিকে বাজি পুড়ছে। কালো রাজ্য এবং ভালো রাজ্যের মাঝের ৫০ মিটার লম্বা কংক্রিটের পাঁচিলটা যেন দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থেকে ভালো রাজ্যেকে কালো শহরের কলুষতা থেকে রক্ষা করছে।

অযাচিত

চিন্ময় মহান্তী


প্রথম পরিচ্ছেদ

দ্বিপ্রহর হইতে সারাক্ষণ বৃষ্টি ঝরাইয়া মেঘগুলি কাজল বর্ণ হারাইয়া শুভ্র শ্বেত বর্ণ ধারণ করিয়াছে, তাহাদের উজ্বলতা হইতে কিরণ আসিয়া বর্ষণ ধৌত ধরিত্রী বক্ষের ঔজ্জ্বল্য স্বল্পমাত্রায় বাড়িয়া উঠিয়াছে; ইহা সকল লোকের নিকট ‘কনে দেখা আলো’ নামে বহু পূর্বকাল হইতেই পরিচিতি পাইয়াছে। কিঞ্চিত অদূরে সন্ধ্যাকাল অপেক্ষারত রহিয়াছে, সময় আসিলেই আপন স্থান লইয়া লইবে।

এমত সময়ে সুখেন কোথা হইতে আসিয়া উঠানের এক অঙ্গুলি কাদা সুকৌশলে অতিক্রম করিয়া ঘরে ঢুকিল, দেখিল তাহার বধূ দীপা মেঝের মধ্যিখানটিতে বহুল ব্যবহারে জীর্ণ মাদুরিটি পাতিয়া লইয়া শুইয়া রহিয়াছে। এই অকাল শয়ন দেখিয়া সে খানিক বিস্মৃত হইয়া বধূর শিয়রে মাদুরির একটি কোনা দখল করিয়া বসিল, জানিতে চাহিল, “দীপা তোমার কি হয়েছে ?” প্রত্যুত্তরে দীপা লজ্জিতা মুখটি বিপরীত পানে ফিরাইয়া লইল। সুখেন ইতস্তত ছড়াইয়া ছিটাইয়া থাকা বধূর কেশরাশির উপর আঁকিবুকি কাটিতে কাটিতে পুনরায় জানিতে চাহিল, “তোমার কি হয়েছে ?” দীপা এইবার উত্তর করিল, লজ্জিতা ওষ্ঠটি মৃদু কাঁপাইয়া বলিল, “তোমার মায়ের কাছে জানবে যাও।” সুখেন বুঝিতে পারিয়াছে তথাপি আপন বধূর মুখ হইতে শুনিতে ইচ্ছা করিতেছিল। তাহার সেই ইচ্ছা পূর্ণ হইল না। নারীজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অলংকার লজ্জা, তাহা দীপার বদন হইতে বিচ্যুত হইল না।

বৃষ্টি ভেজা বালিয়াড়ি

অর্পিতা সরকার


সেদিনও ঠিক এমনি এলোমেলো বাতাস বইছিল। আকাশ ছেয়েছিল মেঘের ঘনঘটায়। সঞ্চিতা একা দাঁড়িয়ে ছিল হোটেলের ব্যালকনিতে। ব্যালকনি থেকেই দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের অবিরত ঢেউয়ের আসা যাওয়া। পুরীর সি-বিচে সব সময় লোকের মেলা, তাই নির্জনতা খুঁজতে পুরীতে আসেনি সঞ্চিতা। ও এসেছে দূর থেকে মানুষের ভিড় দেখতে। মানুষের উপচে পড়া আনন্দকে দূর থেকে উপভোগ করে চলেছে ও।সাথে সমুদ্রের গর্জন ওকে কিছুতেই একলা হতে দেয় না। এই কারণেই বছরে একবার পুজোর ছুটিতে সঞ্চিতা চলে আসে পুরীতে।

ভিতরে ভিতরে যে মানুষ সম্পূর্ণ একা, তাকে নীরবতা আর টানে না। সঞ্চিতা প্রথম পুরী এসেছিল বাবা-মায়ের সাথে তখন ওর বয়েস তিন। তারপর কলেজ এক্সকারসনে। বাবা কিছুতেই ছাড়তে চায়নি ওকে। তবুও বন্ধুদের গোটা গ্রুপের করুণ আর্তির সামনে শেষ পর্যন্ত বাবার মত পেয়েই গিয়েছিল।

ঝলকানি

অনিমেষ ভট্টাচার্য্য



পারমিতা পড়ল মহা ফাঁপরে। গত কয়েক মাস থেকেই সুবিমল উইকেন্ডের এক-আধ দিন করে বাড়িতে থাকত না। কখনও কখনও উইকডেজেও দেরি করে ফিরত। চাকরির চাপ আছে, তারপর খামখেয়ালি মানুষ। এদিক ওদিক ঘুরতে ভালবাসে। তাই পারমিতা অত গা করে নি।

আজ বাইশ বছর ধরে সংসার করছে। বাড়িতে ছেলে মেয়ে আছে। মেয়েটার সেকেন্ড ইয়ার হবে। আর রঙিনের ক্লাস ফাইভ। এরকম বয়েসে এসে অন্য কোন মেয়েমানুষের সঙ্গে লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম-পিরিতি – ব্যাপারটা ধর্তব্যের মধ্যেই আনে নি সে। ঐ বাংলা সিরিয়ালটা দেখতে দেখতেই মনে হল...

সূচিপত্র - অক্টোবর ২০১৭

প্রচ্ছদ শিল্পী - কৃষ্ণেন্দু মন্ডল

সম্পাদকের কথা - অক্টোবর ২০১৭

পুজো-টুজো শেষ, তবে উৎসবের তো আর কমতি নেই। প্রতিদিনই হরেক কিসিমের হুজুগ লেগেই আছে। দুগ্গা দুগ্গা বলে নাকের জলে চোখের জলে ভেসে বিসর্জন দিতে না দিতেই লক্ষ্মীদেবী হাজির। তিনি পাততাড়ি গোটানোর পরপরই আবার কালীপুজো, দীপাবলী। তিমিরবিনাশের, তিমিরবিলাসের উৎসব। সেসবও ফুরোয়। ছেঁড়াখোড়া ফানুস ল্যাম্পপোস্টে আটকে বৃষ্টিতে ভিজে চুব্বুস হয়। কত কত বছরের পর দেখা হয় ভাইবোনের। সর্ষেক্ষেতের দুপ্রান্ত থেকে ওরা ছুটে আসে দুহাত ছড়িয়ে। প্রবাসী ফোঁটা নিয়ে মুঠোফোনের স্ক্রিন রাঙা হয়।

মধ্যবিত্তিয় উষ্ণতায় - অমিত ঠাকুর

“শূন্য পথঘাটে রোদের তীব্র আঁচে পথিকরা ঘর্মাক্ত,
পিষছে দেহ গ্লুকোজ ঝড়িয়ে উষ্ণ হচ্ছে শ্রমিকের রক্ত।
মধ্যবিত্তের পরিধি সে এক বৃত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ..
কত স্বপ্ন কত ইচ্ছের তাগিদগুলো যেন আজ স্তব্ধ।
চায়ের আসর অলিতে গলিতে তর্ক করেই শেষ,
সময় গড়িয়ে কত কি হারিয়েছে এখনও কাটেনি রেশ...

মুখচোরা - ঈশানী বসাক

তুমি আসবে আমি জানি
বদলাবে নৈঃশব্দ্যের মানে
একান্ত রাস্তার এককোণে চায়ের শব্দ
সে শব্দের আঘাতে মানুষ এক আহত ফর্দ।

সোনালি শুভ্রতা জীবনের ভ্রম
আমরা সবাই হারিয়ে যাচ্ছি
অসমাপ্ত তৃষ্ণা, যেদিন মিটবে
সেদিন ফুরাবে বসন্তের ঘ্রাণ ।

জানো মায়া ঘিরে আছে বইয়ের পাতায়
নাম ডুবুক আবশ্যক ঋণের বোঝায়
কতটুকু ইচ্ছে কবর দিলে
বুঝবে আত্মহত্যা করতে রক্ত ঝরাতে হয়না।

সব থেকেও একলা বনে পথ চাওয়া
ঝড়ের গতিতে বৃষ্টি জিজ্ঞাসা চিহ্ন
কতদিন এভাবে হাসিমুখে চলি
কবেই হারিয়েছে খাতার মুখচোরা নরম পলি।


অলংকরণ - কর্ণিকা বিশ্বাস

বিসর্জন - সই

ইচ্ছে ছিল, এবার শারদীয়ায় শিউলি মাখা ভোরে
শিশিরে পা ভিজিয়ে আগমনীর গান শোনাব তোমায়,
তুলো পেঁজা মেঘের ভিতর দিয়ে উঁকি দেবে সোনালী রোদ্দুর;
গান শেষে, জড়িয়ে টেনে নেবে তোমার বুকের কাছে
আর আমি জন্মের কান্না কাঁদব তোমায় আঁকড়ে...

ইচ্ছে ছিল, ঝিমিয়ে পড়া এক বিকেলে হাঁটব তোমার সাথে,
তোমার হাতের ’পরে আমার হাত, পা মেলাবে পায়ের সাথে;
কথা বলব অনেক, যারা জমে আছে রাতের পর রাত,
এক কোণে ঘাপটি মেরে, খুব চুপচাপ, হারিয়ে যায়
তবে ফুরোয় না কিছুতেই, থাকে আড়ালে আবডালে...

ইচ্ছে ছিল, ঈশান কোণের এক শ্রাবণ মেঘ জমাবো চোখে,
ভীষণ অভিমানে মুখ ফিরিয়ে চলে আসব যখন, তখন তুমি
মানিয়ে নেবে আমায়, বাঁধ ভাঙবে শ্রাবণের, দুচোখের
জল তুমি আটকে দেবে আঙুল দিয়ে চিবুক স্পর্শ করার আগেই
তারপর উষ্ণতার বৃষ্টি নামবে ঠোঁটজুড়ে, ভীষণ ভালোবেসে...

জমানো কথারা হারিয়েছে স্বরে, বিস্মৃতির শরণাপন্নে আশ্রিত স্মৃতি;
অবিরত অন্তঃক্ষরণের জ্বালায় কান্নারা শুকিয়েছে গলার কাছে।
নির্জীব ঠোঁট, আজ ফ্যাকাশে শুকনো শীতলতায় মোড়া।
চোখে জমেছে ধূসর মেঘ, আবছা করেছে অবচেতনের দৃষ্টি;
আগমনীর সুর বদলেছে বিসর্জনের মহোল্লাসে।

হয়তো আর কোনো দিন দেখা হবে না, স্মৃতিতেও না, স্বপ্নেও না;
পথ হয়ে গেল আলাদা, এত দিন আমি দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম
মোড়ে মোড়ে বড্ড ভিড় জমেছে তাই, তুমি ভীষণ দূরে আজ আমার থেকে
তোমাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি তাই স্পর্ধিত আমার পা মাটিতে নেই
মহাযাত্রার পথে পা বাড়িয়েছি, চারিদিকে হরধ্বনির চরম স্নিগ্ধতা!

আর আমার মন গাইছে “আমি তোমারই তোমারই তোমারই নাম গাই, আমার নাম গাও তুমি”....


অলংকরণ - নাদিয়া (শাটারস্টক)

ছোঁয়া - ছন্দা মান্না পন্ডিত

শ্বাসের ওপর শ্বাস যখন সমদ্বিখন্ডিত,
তারায় ফুটে ওঠা আরশিমুখ,
আধান নির্বিশেষে বাঁ’দিকের বাসিন্দা,
চেটোর উষ্ণতায় অস্থিমজ্জা।

ফিরে এসো প্রাণ!
শেষ ছাই দিয়ে গড়ব আবার
মিলিয়ে দেবো কর্ণিয়া,
বেরিয়ে যাওয়া রক্তের
সঞ্চালন হবে শিরায়,
বেজে উঠবে হৃদপিন্ড,
অস্থির হবে পূর্ণাঙ্গ।

নির্বিকার মায়া!
পাঁজর ফোকরে ছটফটায়,
আলাদীনের প্রদীপ খোঁজে,
জন্মান্তরে হাতড়ায়।

সকাল ফের সাংসারিক ব্যাখ্যায়।
হাজার ব্যস্ততার মাঝে অদৃশ্য দহন পেরিয়ে;
নশ্বর এই দেহে লেগে থাকে

শেষ ছোঁয়ার অনুভূতিটা...


অলংকরণ - পিম চাউই (শাটারস্টক)

নতুন পরিচয় - তপন বাড়ৈ

নরপিশাচের কবলে যখন ক্রুদ্ধ বাঘিনী
সর্বশেষ থাবাতেও রেহাই মেলেনি সম্মান বাঁচাবার,
ঘামে ভেজা শিথিল শরীরের তখন
কাঁচা মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছিল পিশাচের দল।

কুটুম কাটাম - কৃষ্ণেন্দু মন্ডল

হৃদয়ের বার্তাবাহক

গর্ভবতী - সাজিদ রহমান

রানু সাধাসিধা আটপৌরে একটি মেয়ে। বিয়ের কিছুদিন পর স্বামীর সাথে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকা শহরটি যেন বুক চিতিয়ে আছে সবাইকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য। নদীর স্রোত কখনও একই, সমান ঢেউয়ের সৃষ্টি করে না, জীবনও তাই।

রানুর আজ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হলো। উঠতেই শরীরে ব্যথাটা ছেঁকে ধরল, আর তখনই মনে পড়লো গতরাতে মারের কথা। স্বামী সোহাগিনী সে যে না, তা আগে থেকেই জানে। তবে এই শারীরিক অত্যাচার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। কী করবে, কিছুই ভেবে পায় না। মাঝে মাঝে তার মনে হয়, সব কিছু ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যাবে যেদিকে দু চোখ যায়। কিন্তু, চাইলেই কি আর পারা যায়? মানুষটিকে যে সে ভালোবাসে নিজের থেকেও বেশী। চলে গেলে লোকটা কী করবে, কোথায় থাকবে, কী খাবে এসব ভেবে আর যাওয়া হয়ে উঠে না। মানুষটি কি বোঝে তার এই আবেগ ভালবাসার কথা? মনে হয় না। বুঝলে কি তাকে এভাবে মারতে পারতো? সন্তান না হওয়া কি শুধু তার একার দোষ, আর কোনও কারণ থাকতে পারে না? আর হয় না তো হয় না, কী করবে সে? স্বামীরও তো সমস্যা থাকতে পারে, এটা তাকে কে বোঝাবে?

কচি কলাপাতা

পারিজাত ব্যানার্জী

“কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরেছিল ও।” বলেই বুঝলাম, নিতান্তই বোকামি করে ফেলেছি। যে ছেলের জন্মকর্ম সব লণ্ডনে, সে আর কি করে বুঝবে কচি কলাপাতা রঙের মাহাত্ম্য? আপনারাই বলুন!

গহনের দৃষ্টিতে অপার মুগ্ধতাটুকু তবুও লেগেই রইল। “You mean to say green? মানে, স-বু-জ?” যাক, কিছুটা ঠিকই আন্দাজ করেছে দেখছি! কি করে ঢিলটা ছুঁড়ল ঠিকঠাক? সাহেবরা অবশ্য সব পারে। দুশো বছর কেমন রাজত্বটাই না করেছিল, ভাবা যায়? তাছাড়া নীরেনকাকা একেবারে এই গাঁয়েরই ছেলে। এমনকি, মধুকাকিমা যতই ইংরেজদের ঠাটবাট নিয়ে চলুক, তাঁরও শুনেছি আদিবাড়ি এই গঙ্গার পাড়েই— নৈহাটীতে।

যদিও গহনকে দেখছি বাংলাটা একদম শেখায়নি কেউই। কেমন টেনে টেনে বলে। আরে, বাংলা হল গিয়ে সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা। এ ভাষাতেই রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের হাতেখড়ি। আর এ ভাষাই কিনা বিদেশে ব্রাত্য?

আমি খানিকটা গলা পরিষ্কার করে বললাম, “অনেকটাই— But তুমি say করতে পারো, ওটা green-এর এক type যাকে বলা চলে, কলাপাতা colour green!”

ছোটখাট ব্যাপার - প্রমিত নন্দী

বাইরে পারদের কাঁটা চল্লিশের গন্ডি টপকে গিয়েছে। ঘরের মধ্যেকার শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্রটি তার কাজ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছিল।

“আমার ঘরটা এর চেয়ে ঠাণ্ডা।” গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে বললেন ৪-সির বাসিন্দা পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই মিসেস নীলিমা সেন। তিনি এসেছেন একুশ তলায়, মিসেস রায়চৌধুরীর ফ্ল্যাটে। মিসেস গার্গী রায়চৌধুরীও নয় নয় করে পঞ্চাশের কোঠা পেরিয়েছেন বেশ কিছুদিন।

মিসেস রায়চৌধুরী বললেন, “ছোটখাট ব্যাপারগুলোই হজম হয় না, বুঝলে! গরমটা তাও মেনে নিতে পারি। কিন্তু জল পড়ার এই টপটপ শব্দটা! এ তো আর সহ্য হচ্ছে না হে। ওই যে, শুনতে পাচ্ছ না?”

বোবা উত্তর - রুমেলা দাস

সবে মার্চ। কলকাতার রোদে পা রাখলে, শুধু শরীর কেন? মনও জ্বলে দাউদাউ করে। তা ভালোমতোই টের পাচ্ছেন, সায়ন মল্লিক। জ্বালা ধরা চোখে সামনের মানুষজন, ফুটপাথে বসা হকার, জেব্রা ক্রসিংয়ের খানিক দূরে দাঁড়ানো খৈনি টেপা পুলিশ সবই বড্ড অচেনা লাগছে। অথচ এ রাস্তায় যাতায়াত, সেই সাদা-কালোর সময় থেকে।

জীবনদীপ বাসস্ট্যান্ড থেকে চ্যাটার্জী তলার কাছাকাছি পৌঁছতে সময় লাগে মিনিট পনেরো কুড়ি। তবু মনে হচ্ছে এ পথ অনন্ত। বারেবারে গুলিয়ে যাচ্ছে কোন পথে যাবে সায়ন? মিলেমিশে তাল পাকিয়ে যাচ্ছে টুকরো টুকরো সন্দেহ, বিষ, অপবাদ যা কয়েকমাস যাবদ সহস্র ফণার বিষ ঢেলেছে সায়ন আর প্রমিতার জীবনে। তিল তিল করে বেড়ে ওঠা একুশ বছরের একটা স্বাধীনচেতা জীবনের স্বাধীনতা শক্ত সুতোর গেরো পরিয়েছে সায়নের ফুসফুস দুটোকে।

শারদ সংখ্যা ১৪২৪

প্রচ্ছদ শিল্পী - কৃষ্ণেন্দু মন্ডল



কুটুম কাটাম


জীবনস্মৃতি


অন্যরকম




সম্পাদকের কথা


দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, একটু খোঁজাখুঁজি করলেই, নয় নয় করে অন্তত তিনশটি রামায়ণের বর্ণনা আছে। প্রায় সব কটা বর্ণনার মূল স্বরটায় একটা সামঞ্জস্য আছে। রামের টুকটুকে বৌকে রাবণ অপহরণ করে নেওয়ার পর, রাম-রাবণের যুদ্ধ হয় এবং তার আগে-পরের নানা ঘটনা — মোটমাট এই হলো রামায়ণ। আর এই রামায়ণের কল্যাণেই আমাদের দুর্গা পূজা। মানে রাম তো যাবেন লড়তে (বৌ কিনা হনুমানের সাথে পালিয়ে আসতে নারাজ), কিন্তু কোমরের জোর বেশ নড়বড়ে। একজন বুদ্ধি দিলেন, দুর্গাকে ভজিয়ে যদি আশীর্বাদ জোগাড় করা যায় তাহলে এক্কেবারে গ্যারেন্টেড লঙ্কা-বিজয়। কিন্তু তখন নাকি আবার দুর্গার ঘুমের সময়। দেবীকে জাগানো তো আর চাট্টিখানি কথা নয়, কোনো বামুনের সাহসে কুলোয় না। এদিকে বৌ বিনা রামের বড় কষ্ট! তখন রাম গেলেন তখনকার শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের কাছে, অকাল বোধনের জন্য।

হাঙর - মিলন গাঙ্গুলী

“দ্বীপে হাঙর পাওয়া যায় না?” জানতে চাইলাম।

ঢক ঢক করে বিয়ার গিলছিল টাকো । খালি বিয়ারের টিনটা দূরে ফেলে নতুন আরেকটা টিন তুলে নিতে নিতে বিরক্ত হয়ে বলল, “
দ্বীপে হাঙর আসবে কি করে? ওরা সাগরে থাকে। অগভীর জলেও চলে আসে কখনও কখনও। জোয়ারের জল চলে গেলেই লেগুনের ভেতরে আটকা পড়ে যায়। তখন যে সাঁতার কাটতে নামে তার কপালে খারাবি হয়। তবে বেশির ভাগ সময় হাঙরটা মারা যায়।

“তুমি হাঙর নিয়ে অনেক কিছু জানো তাই না?” হাসলাম।
পালাউ দ্বীপ
“উহু, ভাল জানে পালাউ (palau) দ্বীপের লোকজন।”

“পালাউ দ্বীপ এখান থেকে কত দূর?”

“খুব বেশি দূর না। দ্যাখ না কত হালি হালি পালাওয়ান এই দ্বীপে আসে কাজ করার জন্য। অদের ওখানে বেতন কম। ঘণ্টায় মাত্র দেড় ডলার। তাই।”

“বেশ বড় দ্বীপ?”

“বড়। তবে মাত্র একটা দ্বীপ নিয়ে পালাউ না। ২৫০টা দ্বীপ মিলে মিশে পালাউ। দেখতে বেশ সুন্দর। ছায়া ছায়া স্বপ্নের মত। গেলে আর আসতে ইচ্ছা করবে না।”

যাত্রা, সুন্দরবন আর আজকের একজন মানুষ - সুমন বিশ্বাস

[এটি কোন পুস্তক বিষয়ক আলোচনা নয়, স্মৃতিকথা নয়, ভ্রমণ কাহিনী নয়। ঠিক যে কি তা আমি নিজেই পরিষ্কার করে বলতে পারব না। ওই একটু আধটু অভিজ্ঞতার বর্ণনা আর নিজের চিন্তাভাবনাকে কলমের ডগায় আনার চেষ্টা। বেশ বড় হয়ে গেল লেখাটা, জানি না ক’জন ধৈর্য বজায় রেখে শেষ অব্ধি পড়তে পারবেন। কয়েকটি ছবিও দিয়েছি লেখাটিতে উল্লেখ করা বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে।]

সম্প্রতি একটি বই হাতে পেলাম। ‘চিৎপুর চরিত্র’, ষাটের দশকে যাত্রাবন্ধু হিসাবে জনপ্রিয় প্রবোধবন্ধু অধিকারীর লেখা।
পড়তে যে খুব ভাল লেগেছে তা বলব না, প্রচুর নিজের পিঠ চাপড়ানি আর একঘেয়ে কূটকচালিতে ভর্তি। এই লেখকের হাত দিয়ে অসামান্য উপন্যাস ‘ধলেশ্বরী’ কি করে বেরিয়েছিল ভাবতেই অবাক লাগছে। তাছাড়া ঘটনাগুলো প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছরের পুরনো, আজকের দিনে সেই সব ঘটনা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে মূল্যহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু পড়তে গিয়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছি, অন্ধকারের আড়ালে থাকা একটা অচেনা জগতের উপর তারার আলো পড়ে কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা আবছা একটা ছবি চোখের সামনে ফুটে উঠেছে। পরিষ্কার করে দেখার চেষ্টা করছি চশমার কাঁচ মুছে, কিন্তু অন্ধকার কাটছে না।

একটি কল্পিত গল্পকথা - কৃশানু চন্দ

স্থান — হনুগড়
সময় — ১৯৭২

হনুগড়ের মধ্যে অরাজকতা। ছোট ছোট শিশুশাবকদের সিধুহাত হাতির তান্ডবে মরতে হচ্ছে। জঙ্গলের মধ্যে সবাই ভীত, শঙ্কিত মন নিয়ে কাঁপছে। কিছুই বলা যাচ্ছে না কবে কিভাবে এই ভয়ঙ্কর সমস্যার সমাধান হবে।


ওপরতলার মাংসাশী প্রাণীরা দিন দিন মোটা হচ্ছে।


সব সাধারণ পিঁপড়েরা খাটছে, খিদের চোটে কষ্ট পাচ্ছে, রুগ্ন হয়ে মরছে, আবার জন্মাচ্ছে।


স্থান — হনুগড়

সময় — ১৯৭৭

হনুগড়ে আলোলাল সিংহের আগমন।জঙ্গলের পশুপাখীদের সঙ্গে নিয়ে দাপটের সাথে সিধুহাত হাতিকে পরাজিত করে অবশেষে হনুগড়ে শান্তি আনেন আলোলাল সিংহ।


ওপরতলার মাংসাশী প্রাণীরা দিন দিন আরও মোটা হচ্ছে।


সব সাধারণ পিঁপড়েরা আরও খাটছে, খিদের চোটে আরও কষ্ট পাচ্ছে, রুগ্ন হয়ে মরছে, আবার জন্মাচ্ছে।


তোমার আমার দুর্গা - কেয়া রায়

জানিস, আমার দুর্গা রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যে পথেঘাটে ফেরি করে কিংবা লোকের বাড়ি কাজ করে বেড়ায় দু'পয়সা রোজগারের আশায়। আর তোদের দুর্গা?

জানিস, আমার দুর্গা ছেঁড়া কাঁথা গায়ে দিয়েই দিনান্তে দু'বেলা দু'মুঠো খেয়ে ভালো থাকার স্বপ্ন দেখে। আর তোদের দুর্গা?

জানিস, আমার দুর্গার নরম শৈশব হারাচ্ছে তোদের বিকৃত মানসিকতার ভারে, কখনও ধর্ষণ তো কখনও যৌন নির্যাতন। আর তোদের দুর্গা?

বসন্ত; মানসী এবং ইন্দ্রজিৎ - সুস্মিতা দাস

বসন্ত,
কেন ডাক দাও বারে বারে...
হাতছানি দিয়ে যাও মুখচোরা কোকিলের পানে;
তবে যে আজ, যেন তোমায় অন্যরকম লাগে,
যে উপমায় চিনতাম তোমায়, তার থেকে ভিন্ন সাজে —
অচেনার গাম্ভীর্যে।

মোহিত হয়েছি আগেও, ভালোবেসেছি,
নেশায় ডুবিনি আগে;
রঙগুলো সব রয়েছে একই, শুধু বেড়েছে রকমারি;
লাল, গোলাপি,হলুদ-সবুজের কাড়াকাড়ি।

বাঁশ বন কেন হয়েছে চঞ্চল
পাখিদের কোলাকুলি;
খসখস করে ওঠে পাতারা সব
ফাঁকে ফিঙে আর বুলবুলি।

পাগল হাওয়ারা উন্মুক্ত,
ভাসিয়েছে মাদকতায়...
পাহাড়ের ডাকে নদী ছুটে যায়
ব্যাকুল কোন প্রাণের তৃষায় —

ওই সিঁদুরে-রাঙা ঝাঁকড়া মাথা গাছ,
এককোণে একাকী —
শান্ত হয়, জীবন খুঁজে পায়,
মানসী এবং ইন্দ্রজিৎ-এর ভালোবাসায়।


চিত্রালংকরণ - ঋভু চৌধুরী

পদ্ম ও কিশোর - শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রত্যেক বছর পুজো এলেই আমাকে নিজের একটা
পুরোনো ছবি পাঠায় ঋভু —
মামাবাড়ির দুর্গাদালানে বসে আছে ও, এদিকে ফেরানো মুখ
হাতে ধরা একখানা ফুটি ফুটি পদ্মকলি।
ওর মুখে হাসি নেই, দুঃখ নেই
কেবল শরতের সুখবর-আনা মেঘ ভেসে যাচ্ছে
এদিক থেকে ওদিক, ওদিক থেকে সেদিক...

এই এলোমেলো মেঘে পুজো আসে, পুজো চলে যায়।
ঢাক-কাঁসর-ঘন্টা বাজিয়ে জলের ধারে গিয়ে দাঁড়ায় মানুষ —
তখনই, আটচালা কিংবা মন্দিরের বাইরে, মুক্তনদীতটে
প্রকৃত বোঝা যায় মাতৃপ্রতিমা কত দূর —
মূর্ধায় স্পর্শ করে ঊর্ধ্বাকাশ, অন্তরাকাশ, দশদিক
নক্ষত্রলোক থেকে ব্যথার পৃথিবী
ধুলোয় ধুলোয় ছুঁয়ে থাকে শরৎকালের বিম্বমূর্তি এক...

একদিন ঢাকিরা ফিরে যায়। মলিন হয়ে পড়ে রোদ।
ঋভুর ছবিটা বের করে দেখি —
শূন্য দেউলচত্বরে ধান খুঁটছে ছাইবর্ণ ঘরপায়রার দল,
সিঁড়ির একটা ধাপিতে ও বসে আছে —
মুখ দেখা যাচ্ছে না, মুখ ওদিকে ফেরানো
হাতে ধরা পদ্মকলির বুকে একটি রাতুল ছাপ
বাকি পদচিহ্নেরা নিঃশব্দে জলের দিকে নেমে গেছে...


চিত্রালংকরণ - কর্ণিকা বিশ্বাস

স্বীকারোক্তি — ‘এক’ - দেবজিৎ ভট্টাচার্য্য



সময়ের চাকা গড়াচ্ছে —
বিন্দু বিন্দু করে জমছে প্রচুর রক্ত —
আঁশ খোসা জমা হয়ে — তৈরী হচ্ছে একতাল অবয়ব,
এরা নাকি যন্ত্র?
এদের বুকে নাকি স্পন্দন আসবে,
এদের নিঃশ্বাস পড়বে বাতাসে,
এরা নাকি শব্দের দোহাই দিয়ে —
স্লোগান দেবে, রাজনৈতিক মিছিলে।
আবার কিছুটা সময় পরে, স্বর্গের নিয়ম ভাঙবে এরাই,
পৃথিবীটাকে নরক বানাবে এরাই।
মাতৃক্রোড়ে জন্ম নেবে — অগণিত জরাসন্ধ,
প্যান্ডেমোনিয়ামে জমা হবে — বীভৎস কিছু লাশ।
তুমি আবার চীৎকার করে প্রশ্ন করবে —
হে ঈশ্বর এটাই কি তুমি চেয়েছিলে?
আমরা আবার পালন করব একটা করে দিন,
প্রতিরাতে মুখোশ পড়ে — বিছানা বদলাবে এ যুগের লিলিথ।
আমরা ভুলে গেছি এরা যন্ত্র,
এদের মস্তিস্ক বিকল,
এটা নিয়ে আর যাই হোক — বন্ধুত্ব হয় না,
এটাই আমার স্বীকারোক্তি,
এটাই স্তাবকতার শেষ পরিচয়।


চিত্রালংকরণ - কর্ণিকা বিশ্বাস