রহস্য ও কল্পবিজ্ঞান সংখ্যা (জানুয়ারী ২০১৮)



প্রচ্ছদশিল্পী - রুমেলা দাস

সম্পাদকের কথা

শীতের দিনে খাওয়াদাওয়াটা সেরে বারান্দায়, দুপুরের রোদে বেশ আমেজ নিয়ে বসেছিলাম। হঠাৎ মনে পড়ল, আধার লিংক করাতে হবে। তাই ব্যাজার মুখে দরজা দিয়ে বেরোতেই নাকে কে যেন একটা রুমাল চেপে ধরলো। তারপর সব অন্ধকার।

চোখ খুলতে দেখি এক অচেনা ঘরে শুয়ে আছি। মাথা ঝিম ঝিম করছে। এতদিনে গল্প উপন্যাস তো কম পড়লাম না। সিনেমা-টিভি সিরিজও কম দেখলাম না। কেউ কিডন্যাপ করেছে বুঝতে তাই সমস্যা হল না। কিন্তু হাত পা বাঁধা নেই কেন? কোথায় সেই গুদামঘর, একগাদা প্যাকিং বাক্স, হাতলভাঙা চেয়ার? বদলে বেশ ছিমছাম, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘর, পরিপাটী বিছানা। ঘরে যেদিকে একটা দরজা থাকার কথা সেদিকে তাকালাম কিন্তু হাতলহীন একটা অস্বচ্ছ দেয়াল চোখে পড়ল। সামনে গিয়ে দাঁড়াতে নিজে থেকেই খুলে গেল। বাইরে আসতেই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল।

দেখলাম এক আজব দুনিয়াতে এসে পড়েছি। একদম সাইফাই সিনেমার মত আকাশে উড়ন্ত যান চলাচল করছে। বাইরে রাস্তায় অনেক লোক হাঁটছে। সবাইকে দেখতে একই রকম আমাদের মতন। কিন্তু পরনে অদ্ভুত সব পোশাক, হাতে ফোনের মতো দেখতে আশ্চর্য কিছু একটা। সবকটায় ত্রিমাত্রিক ছবি, লেখা সব একেবারে ভেসে ভেসে উঠছে। দরজার বাইরে একটা বাচ্চা মত ছেলে দাঁড়িয়েছিল। আমি বেরোতেই ঝরঝরে বাংলায় আমায় বলল, “আপনার ঘুম ভাঙলো?”

এরকম আজব দেশে বাংলা বুলি শুনে চমকে গেছিলাম। ওর কাছ থেকেই জানতে পারলাম, এই গ্রহের নাম সাইবং। একটা যন্ত্রের সাহায্যে এরা যেকোনো ভাষায় যেকোনো লোকের সঙ্গে ভাবের আদান প্রদান করতে পারে। এদের সময়ের হিসেব আমাদের সঙ্গে না মিললেও এটুকু বুঝতে পারলাম এরা অন্তত বিজ্ঞানচর্চায় আমাদের থেকে অনেকটাই উন্নত।

আমি চটেমটে জিজ্ঞেস করলাম, “অ্যাই শোন, আমায় ধরে এনেছ কেন?” ছেলেটা হাসল তারপর বলল, “আরে মশাই। জানবেন সব, আগে দেখুন কোথায় এসে পড়েছেন।” তারপর একটা উড়ন্ত যান বোতাম টিপে নামিয়ে সেটায় ওঠার নির্দেশ দিল।

সেই উড়ন্ত যানে যেতে যেতে যা দেখলাম তাতে পিলে চমকে যাবার জোগাড়। দেখলাম একটা শহরে রোবট খুনের তদন্ত করছেন ব্যোমকেশ বক্সী। পাশেই আর এক জায়গায় কৃত্রিম মৌল চুরির কিনারা করতে তলব পড়েছে স্বয়ং ফেলু মিত্তিরের। ওদিকে প্রফেসর শঙ্কু আর প্রফেসর নাটবল্টু চক্র একসঙ্গে কোলাবোরেশন করেছেন। জিজ্ঞেস করে জানা গেল তাঁরা তৈরী করছেন এক সুপারকম্পিউটার যা দিয়ে এই ব্রহ্মাণ্ডের সব গ্রহের সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। এই কাজে তাঁদের সাহায্য করছেন বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত। এক অজানা দ্বীপে, অজানা রহস্য সন্ধানে নৌকো ভাসিয়েছেন জয়ন্ত মানিক আর সঙ্গে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

এই সব দেখতে দেখতে আমায় সেই ছেলেটা নিয়ে গেল একটা বিশাল সবুজ হাতের কাছে। জানতে পারলেন তিনিই এই গ্রহের অধিপতি। যদিও গলাটা কোথা থেকে আসছে বুঝতে পারলাম না কিন্তু সেই বৃহৎ হাত এক জলদগম্ভীর কণ্ঠে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, তোমায় কেন ধরে আনা হয়েছে জানো? উত্তরে ঘাড় নাড়তে জানালেন, পরবাসিয়া পাঁচালীর বিশেষ সংখ্যা করতে হবে রহস্য ও কল্পবিজ্ঞান নিয়ে। না হলে মুক্তি নেই। এখানে বাংলার যে প্রথিতযশা গোয়েন্দা আর বৈজ্ঞানিককে দেখলাম তাদেরও নানা এরকম কাজের ভার দেওয়া হয়েছে যা করলে তবেই তাঁরা ছাড়া পাবেন। এইসব শুনে আমি এমন চমকে উঠলাম যে চট করে ঘুমটা ভেঙে গেল। যাহ আজকেও আর আধার লিংক করতে যাওয়া হল না!

যাই হোক, নতুন বছরে শুরুতেই আমাদের নিবেদন রহস্য ও কল্পবিজ্ঞান সংখ্যা। কারণ বলা তো যায় না কোনদিন কিডন্যাপ হয়ে যেতেও পারি। সাবধানের মার থুড়ি সাইবং তো নেই! ভালো থাকবেন। ভালো রাখবেন। এবারের মতো এইটুকুই।


প্রতিবর্ত

অনিন্দ্য রাউত


১০ই জানুয়ারি, সকাল ৯টা
এডগারের প্রথম কেস

হাডসন ড্রাইভের মতোই এই সুন্দর রাস্তার দুই পাশে ছিমছাম কিছু বাড়ি। বাড়ির সামনে কিছুটা উঠোন, গাড়ি রাখার মতো জায়গাও। এই রাস্তার ধারেই মিস্টার ব্রাইটনের বাড়ি। আর সেখানেই আমার গন্তব্য।

আমি ইউনিফর্ম পরে যখন পৌঁছাই তখন অফিসার রোজমুন্ড দাঁড়িয়ে বাইরে। ব্রিফ শুনতে শুনতে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম। বাইরে একটি ভক্সহল করসা গাড়ি দাঁড়িয়ে। অবস্থাপন্ন মিস্টার ব্রাইটন। বাড়ির ভিতর দেখেও তাই ইঙ্গিত মেলে। উডেন স্ট্রাকচারের বাড়ির ভেতরটা ভীষণই আধুনিক। মিস্টার ব্রাইটন ইংল্যান্ডের বাকি অধিবাসীর মতোই ফুটবল প্রেমী। হলের ডেকোরেশন ভর্তি সরঞ্জাম। একটা ছোট এশট্রে। তবে সিগার রাখা ওপরে। এরকম এশট্রে সিগারের জন্য সাধারণত হয় না। দেওয়ালের চারিদিকে চোখ বোলালাম। হোম থিয়েটারের পেছনে চেলসির বড় কাটআউট আর ঘরের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট অনেক নীল রঙের জার্সি, মার্চেন্ডাইজ। সব এক লহমায় দেখে ভেতরের ঘরে যখন পৌঁছলাম তখন মিসেস ব্রাইটন মাথায় হাত দিয়ে বিছানার ওপর বসে। আমি চেয়ারটা টেনে বসলাম। রোজমুন্ড পেছনে দাঁড়িয়ে।

শতরূপ সান্যালের DIARY ১


প্রথম পর্ব
হত-দন্ত

ডিসেম্বর ১, ২০১৪; রাত ১২টা

আমি সিনিয়র জার্নালিস্ট শতরুপ সান্যাল। ডায়েরি লেখার অভ্যাসটা ছোট থেকেই। রুমালচোরের রুমাল হারানোর ঘটনা থেকে পরীক্ষায় চোতা সমেত ধরা পড়ে স্যারের উদোম কেলানি সবই অবলীলায় লিখে ফেলি। অগত্যা! নাক গলাই জার্নালিজম-এ। পিছু ছাড়ে না লেখা। ঘটনার ঘনঘটা আমাকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রেখেছে। এক সেকেন্ডও সময় নেই ভাববার।

দু-দিন হলো এসেছি উত্তরাখণ্ডের দেরাদুনে। এখানকার আনপ্রটেক্টেড জঙ্গল এরিয়ায় কি ক্রিয়াকর্ম শুরু হয়েছে, তারই হাল-হদিশের জন্য সুবীরদা তড়িঘড়ি পাঠান এখানে। সুবীরদা মানে আমার উঁচুতলার দাদাবিশেষ। বসও বটে। এখানে আসা অবধি চারিদিকে এতো সবুজ দেখছি। যা দেখে কেস সালটাবো কি! বেশ রোমান্টিসীজম আসছে। কলকাতার ট্রাফিক আর ধোঁয়ার গুঁতো খেতে খেতে সবুজ কি জিনিস ভুলতে বসেছিলাম।

গোলায়াথ

নিল গেইম্যান
রূপান্তর: মোঃ ফুয়াদ আল ফিদাহ

দুনিয়াটাকে সবসময় সস্তা আর ধোঁকাবাজির জায়গা ভেবে এসেছি— এ দাবী আমি করতেই পারি। আমার মনে হতো, গ্রহটাকে বানানোই হয়েছে আরও অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক কিছু একটা লুকাবার জন্য। সে দিক থেকে চিন্তা করতে গেলে, সত্যটা আমি প্রথম থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সত্যটা যে আসলেই সত্য, তা আমি এখন নিশ্চিতভাবে জানি। আর এই চিঠিটা পড়লে, তুমিও জানতে পারবে। এখনো দুনিয়াটাকে আমার সস্তা আর ধোঁকাবাজির জায়গা বলে মনে হয়। আলাদা দুনিয়া, অন্যরকম সস্তা। কিন্তু সস্তা আর ধোঁকাই বটে।

যখন কেউ আমায় বলে, এটাই সত্যি। আর আমি বলি, আসলেই কি তাই? উত্তরে শুনতে পাই, পুরো না হলেও কাছাকাছি... মানে, আমাদের জানামতে এটাই সত্য।

দ্য প্যাটার্ন

বিল প্রোন্‌যিনি
রূপান্তর: মারুফ হোসেন


ছাব্বিশ এপ্রিল, শনিবার রাত ১১:২৬। চোখে রিম্লেস চশমা আর গায়ে ধূসর রঙের বিযনেস সুট পরা ছোটখাটো এক লোক এসে হাজির হল স্যান ফ্রান্সিসকোর ‘হল অফ জাস্টিস’-এ। ডিটেকটিভ স্কোয়াড রুমে এসেই বে এরিয়া-র তিন গৃহবধূকে খুনের স্বীকারোক্তি দিল লোকটা। মহিলা তিনজনের লাশ সেদিন বিকেল আর সন্ধ্যাতেই পাওয়া গেছে।

ইন্সপেক্টর গ্লেন রক্সটন সবার আগে কথা বলল লোকটার সাথে। প্রথমে ভেবেছিল, লোকটা বোধহয় পাগলাটে। সব বড় শহরেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এমন খুনের গল্প ফেঁদে স্বীকারোক্তি দেয় অনেক লোক। অনেকে আবার মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে খুন করে এসে স্বীকারোক্তি দেয়। লোকটাকে সহকর্মী ড্যান টোবিয়াসের সঙ্গে রেখে সিনিয়র অফিসার ল্যাফটেন্যাণ্ট জ্যাক শেফিল্ডের সাথে কথা বলতে গেল রক্সটন।

“জ্যাক, এক লোক এসেছে কিছুক্ষণ আগে। বলছে, আজ লাশ পাওয়া গেছে যে মহিলা তিনজনের, তাদের নাকি সে-ই খুন করেছে।” জ্যাক শেফিল্ডের উদ্দেশ্যে বলল রক্সটন। “লোকটা বোধহয় পাগল।”

স্যাম্পল

২৭ ডিসেম্বর ২০১৬
গত ১৩ই ডিসেম্বর ২০০০ থেকে জিম্বো নামের একটি অ্যালসেশিয়ান কুকুর হারিয়ে গেছে। শক্ত সমর্থ গড়ন। রঙ সাধারণ অ্যালসেশিয়ানের মতোই। পেতলের চেন সহ খয়েরী রঙের ক্রশবেল্ট পড়ানো আছে। কোনও সহৃদয় ব্যক্তি সন্ধান পেলে নিম্নোক্ত ঠিকানায় জানাতে অনুরোধ করা হচ্ছে বা ফোন করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
শুভ্রাংশু পাল
প্রযত্নে – সুধাংশু কুমার পাল
১৮/৭ ভট্টাচার্য পাড়া লেন
বহরমপুর মুর্শিদাবাদ
ফোন – ০৩৪ ৮২৯ ৫৭০০

ব্ল্যাকহোল ইনিশিয়েটর রহস্য

বিভাবসু দে



সারা ঘর জুড়ে অতিকায় সব মেশিনের ছড়াছড়ি, লাল নীল আলো জ্বলে জ্বলে উঠছে তাতে। সিলিকোনিয়ামের তৈরী এক্সপেরিমেন্টাল স্যুট পরে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মধ্যে, সবার চোখেই একটা দারুণ উৎকণ্ঠার ছাপ। মাঝে মাঝে বাতাসে ভেসে উঠছে কিছু ডিজিটাল ছবি, আবার কিছু বাইনারি ডাটাও। হঠাৎ ম্যাটার ট্রান্সপোর্টেশন চেম্বারের হলুদ আলোটা জ্বলে উঠল, একটু পরেই তাতে দেখা গেল প্রফেসর হিউনেসকে, সাথে আরেকজন কে যেন। দুজনেই চেম্বার থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন ঘরের মধ্যিখানে, সাদা টেবিলের ওপর আধভাঙা সুপারগ্লাসের একটি বাক্সের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

প্রফেসরের সাথে থাকা দ্বিতীয় ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, “এখান থেকেই চুরি হয়েছে জিনিসটি?”

সৌর্যালোক

পারিজাত ব্যানার্জী


একসাথেই তো যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল দুটিতে। পাশাপাশি বসত, একে অপরের জন্য জায়গা রাখত অলিখিত কোনও নিয়মের ফেরেই। অন্য বন্ধুদের সাথে একজন বেশী সময় কাটালে অপরপক্ষ অভিমানে ঠোঁট ফোলাতো। ক্লাসের সব নোটস একসাথেই তৈরি করত তারা। একে অপরকে পড়া না বোঝালে সেদিনের পড়াটাই যেন শেষ হতো না ওদের। একজন একদিন না বলেকয়ে ডুব দিল কি দিল না, সব ক্লাস ফেলে অন্যজন সোজা পৌছে যেত তার বাড়ি। বাড়িরও সবাই জানত এক প্রাণ এক আত্মা এই সূর্য, তৃষা। এদের আলাদা করা ভগবানেরও অসাধ্য।

কিন্তু ভগবান নিজে বোধহয় অন্যরকম কিছু চেয়েছিলেন। আর সেখানেই শুরু হয় আমাদের গ ল আর প— ‘সৌর্যালোক’।

দ্য মেথড শেরিফ

এড ল্যাসি
রূপান্তরঃ আদনান আহমেদ রিজন


ব্যাংক ভবনটা ছোট হলেও আধুনিক। তবে এটা আসলে অনেক দূরে অবস্থিত সিটি ব্যাংকের একটা শাখা। গ্রামের সীমান্তবর্তী আড়াআড়ি মাঠে ভবনটা সম্প্রতি নির্মাণ করা হয়েছে। রাস্তার মোড়ের দিকে মুখ করা প্রবেশপথ। মোড়টা আবার হাইওয়ের সাথে সংযোগস্থাপন করেছে একটা নতুন ব্রিজের মাধ্যমে। শেরিফ বেইনসও অনেকটা সেই গ্রামের মতোই দেখতে... বৃদ্ধ, বেঁটে আর জীর্ণ। তিনি ব্যাংকে প্রবেশ করার সাথে সাথে দৌড়ে এল হ্যাংলা-পাতলা হিসাবরক্ষক এমা। সাথে গলা ফাটিয়ে চিৎকার, “আঙ্কল হ্যাঙ্ক, আমাদের সবকিছু নিয়ে গেছে! সবকিছু!” হিস্টিরিয়া-গ্রস্তের মত বিবর্ণ দেখাচ্ছে মেয়েটার চেহারা, ভয়ে চোখদুটো বিস্ফারিত।

“ডা...ডাকাতি?” আকস্মিক শকে যেন শেরিফের কাঁধ দুটো নুয়ে পড়ল, চোখে বিহ্বল ভাব। কয়েক সেকেন্ড পর সামলে উঠে মৃদু ঝাঁকি খেলেন তিনি। হিসাবরক্ষকের কাঁপতে থাকা কাঁধ এক হাতে ধরে, অন্য হাতে হোলস্টার থেকে পিস্তল আলগা করলেন। “এমা, শান্ত হও। আমাকে বলো কি হয়েছে!”