জানুয়ারি ২০১৯


প্রচ্ছদশিল্পী - পিয়াল চক্রবর্তী


(প্রতিটি লেখা Hyperlink করা আছে। লেখার ওপর ক্লিক করে পড়ুন।)



দুষ্প্রাপ্য রচনা


উপন্যাস


গল্প

শিবশঙ্কর মিষ্টান্ন ভান্ডার সাগরিকা রায়
মানবী অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
নৈবেদ্য পৃথ্বীশ গজী
রণ ফ্রেডরিক ব্রাউন ঋজু গাঙ্গুলী
রুবি রায় সায়ন্তনী পলমল ঘোষ
বোকাবাক্স সুস্মিতা কুণ্ডু
প্রজেক্ট এন্টিহার্প প্রদীপ কুমার বিশ্বাস
নেফিলিম প্রলয় কুমার নাথ
চন্দ্রাহত মোঃ ফুয়াদ আল ফিদাহ
কারাগার ৪৬০০ তানজিরুল ইসলাম
মায়া লুৎফুল কায়সার
একটি মেটাফিজিক্যাল মৃত্যু নীলাভ বিশ্বাস
রক্তবীজ বিভাবসু দে

অনুবাদ কমিকস




সম্পাদকের কথা

প্রিয় পাঠকবন্ধুরা,

প্রথমেই আপনাদের সবাইকে জানাই নতুন বছরের প্রীতি ও শুভেচ্ছা। আপনাদের সঙ্গে পরবাসিয়া পাঁচালীও পেরিয়ে এল আরো একটা বছর। গত বছর এই সময়েই প্রকাশিত হয় আমাদের প্রথম বিশেষ সংখ্যা - কল্পবিজ্ঞান ও রহস্য সংখ্যা। গত বছরের শুরুতে আমাদের পত্রিকা নিয়ে যে সমস্ত দোলাচল ছিল, পাঠকদের ভালোবাসায় তার অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেছে। এই বছরে আমাদের প্রথম নিবেদন - বিশেষ কল্পবিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসি সংখ্যা।

বাংলা ভাষায় এবং ভারতের প্রথম কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা ‘আশ্চর্য!’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৩-র জানুয়ারি মাসে। আকাশ সেন ছদ্মনামে অদ্রীশ বর্ধন সম্পাদিত এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছিল কল্পবিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টা। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে সে পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে রণেন ঘোষের সম্পাদনায় ‘বিস্ময়’ কিংবা অদ্রীশবাবুর উদ্যোগে ‘ফ্যানট্যাসটিক’-এর মতো পত্রিকার উত্থান হয়েছিল। কিন্তু কালের গ্রাসে তারাও একে একে বিদায় নিয়েছে। তবে আনন্দের কথা, বর্তমান সময়ে ‘কল্পবিশ্ব’-এর উদ্যোগে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে নতুনভাবে পাঠকমহলে উৎসাহ গড়ে উঠছে।

আশি-নব্বইয়ের দশকে বাংলায় কল্পবিজ্ঞান নিয়ে ‘ফ্যানট্যাসটিক’ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যিক সিদ্ধার্থ ঘোষের বক্তব্য ছিল অনেকটা এরকম―

“বিদেশে সায়েন্স ফিকশন আজ সিরিয়াস অধ্যয়নের বিষয়। ...বাংলায় সায়েন্স ফিকশন নিয়ে সিরিয়াস কোনো গবেষণা হয়নি। বাংলা সাহিত্য পত্রিকায় সায়েন্স ফিকশান আজও অচ্ছুৎ। ...এই অবস্থার জন্য বিস্মিত হবার কোনো কারণ নেই। শিশু কিশোরদের জন্যই শুধু সায়েন্স ফিকশান লেখা হবে, এটাই এখনো অবধি রেওয়াজ। আর সেই সঙ্গে সায়েন্স ফিকশানের দুটি বাংলা পরিভাষা ‘বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প’-এর সঙ্গে ‘কল্পবিজ্ঞানের গল্প’-এর ঠাণ্ডা লড়াই জারি করেছেন কিছু স্পর্শকাতর পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তি। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কিছু সমালোচক মনে করেন কল্পবিজ্ঞানের গল্প কিঞ্চিৎ নিকৃষ্ট জাতের, যেখানে ফ্যান্টাসির দাপট বেশি এবং বিজ্ঞানের অপলাপের সুযোগ আছে। এর থেকে আরো একটি ভ্রান্ত অনুমানের হদিশ পাই আমরা, যা সায়েন্স ফিক্‌শনের প্রকৃত তাৎপর্য ও সুপ্ত ক্ষমতা উপলব্ধি করতে না পেরে তাকে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলার কাজে নিযুক্ত করার পথনির্দেশ মনে করে।”
―সিদ্ধার্থ ঘোষ (সায়েন্স ফিকশান একটি পরিভাষার জন্ম, শারদীয়া এক্ষণ, ১৯৮৮)

তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেলেও অবস্থা খুব একটা পাল্টায়নি। কারণ ‘ফ্যানট্যাসটিক’-পরবর্তী যুগের খ্যাতনামা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যিক অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর কথাতেও ত্রিশ বছর আগেকার কথার অনুরণন লক্ষ করা যায়।

“বাংলায় কল্পবিজ্ঞানে চার ধরণের লেখার সম্ভাবনা দেখি। প্রথমত অবশ্যই ছোটদের জন্য হাল্কা কল্পবিজ্ঞানের লেখা যেখানে বিজ্ঞানের শর্ত, লজিক কোনটাই থাকে না। লজিক ও বিজ্ঞান একটা বড় অংশ বাঙালী পাঠককে দূরে সরিয়ে দেয়। ...এবার, দ্বিতীয় শ্রেণীর লেখায় আসি। এ ধরণের কিছু লেখা খুব কম সংখ্যায় হলেও আমরা শিশু কিশোর পত্রিকা গুলোতে পেয়েছি, যেখানে গল্পের মধ্যে বিজ্ঞান বা কল্পিত বিজ্ঞানে বড় কোন ভুল থাকে না। ...এবার, তৃতীয় শ্রেণীর গল্পের ক্ষেত্রে আসি। শুধুই বড়দের জন্য লেখা কল্পবিজ্ঞানের গল্প। বাংলা সাহিত্যে এর একটা বড় অভাব আছে। ...এবার শেষ বা চতুর্থ শ্রেণীর লেখার কথায় আসি। এক্ষেত্রে গল্পের কেন্দ্রে থাকে বিজ্ঞান।”
―অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী (অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর সাথে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা, শারদীয়া কল্পবিশ্ব, ২০১৮)

পরবাসিয়া পাঁচালী তার জন্মলগ্ন থেকেই ব্যতিক্রমী সাহিত্যচর্চার চেষ্টা করে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। তাই কল্পবিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসির মতো সাহিত্য, যা বাংলায় কিছুটা হলেও অবহেলিত ও ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী, তা নিয়ে চর্চার আগ্রহে পরবাসিয়া পাঁচালীর এই সংখ্যার আয়োজন। বিশেষভাবে আমরা কৃতজ্ঞ, কল্পবিশ্বের অন্যতম দুই সম্পাদক দীপ ঘোষ ও সন্তু বাগের কাছে। এই সংখ্যা করার পথে নানান বিষয়ে সাহায্য করেছেন তাঁরা। আমাদের ইচ্ছে ছিল, ‘আশ্চর্য!’, ‘বিস্ময়’ ও ‘ফ্যানট্যাসটিক’ থেকে তিনটি হারিয়ে যাওয়া লেখা এই সংখ্যায় পুনর্মুদ্রণ করব। সে লেখাগুলি স্ক্যান করে দিয়ে সাহায্য করেছেন সন্তুবাবু। দীপবাবু দিয়েছেন ‘আশ্চর্য!’ ও ‘ফ্যানট্যাসটিক’-এর লেখাগুলির বর্তমান প্রকাশক কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান-এর কাছ থেকে প্রকাশের অনুমতি। এছাড়া আমরা ধন্যবাদ জানাই সমস্ত লেখক ও শিল্পীকে, যাঁদের একের পর এক অসাধারণ কাজে এই সংখ্যা সেজে উঠেছে।

পাঠকদের মতামত এক্ষেত্রে যে খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটা বলাই বাহুল্য। কাজেই ভালো লেগেছে, খারাপ লেগেছে বা মনে দাগ কাটেনি, যে কোনো ধরণের মতামত আমাদের জানাতে ভুলবেন না। তাহলে আর দেরি কীসের, কল্পনার অপরিসীম দুনিয়ায় প্রবেশ করুন। যাত্রা শুভ হোক!

ধন্যবাদান্তে,

শম্ - অদ্রীশ বর্ধন

অলংকরণ - মূল প্রচ্ছদ

প্লুটোর কক্ষপথ ছাড়িয়ে সবে ‘ইলকো’ ক্রুজারটা শুরু করেছে তার আন্তঃনক্ষত্র যাত্রা, ঠিক এমনি সময়ে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে একজন অফিসার খবরটা আনলে কম্যাণ্ডারের কাছে।

“স্যার, আমাদের এক কারিগরের গাফিলতির ফলে তিন নম্বর গ্রহের ওপর ক-৩ টাইপের একটা শম্-কে ফেলে এসেছি। শম্-এর সংগৃহীত সবকিছুই রেখে আসতে হয়েছে ঐ সাথে।”

কম্যাণ্ডারের তিনকোণা চোখগুলো ক্ষণেকের জন্য পল্লবাচ্ছাদিত হলো বটে কিন্তু তারপরই যখন কথা শুরু করলে সে, তখন উত্তেজনার চিহ্নমাত্র পাওয়া গেল না তার কণ্ঠে।

“কি অবস্থায় খাড়া করা হয়েছিল শম্-কে?”

“সবচেয়ে বেশী ব্যাসার্ধ তিরিশ মাইল। ওজন একশো ষাট পাউণ্ড প্লাস মাইনাস পনেরো।”

কয়েক সেকেণ্ড সব চুপচাপ। তারপর কমাণ্ডার বললেন—“ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। হপ্তা কয়েক পরেই তো ফিরে আসব। তখন শম্-কে তুলে নিলেই চলবে। নিজের এনার্জি নিজেই বানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা যারা রাখে সেই মূল্যবান শম্-য়েদের একটিকেও এভাবে আমি হারাতে রাজী নই। আর, যে অপদার্থ লোকটার গাফিলতিতে এই কাণ্ড, তার কঠোর শাস্তি যাতে হয়, সে ব্যবস্থা তুমি করো।” নিরুত্তাপ কিন্তু স্থিরকণ্ঠে আদেশ দিয়ে দিলে কম্যাণ্ডার!

কিন্তু যাত্রা সমাপনান্তে রাইগা গ্রহের কাছাকাছি একটা চ্যাপ্টা আংটির মত মহাকাশ জাহাজের সঙ্গে লড়াই বেঁধে গেল ইলকা’র। আগুন-যুদ্ধ যখন শেষ হলো, তখন দুটো মহাকাশ পোতই রূপান্তরিত হয়েছে তাল তাল গলিত ধাতুতে। রেডিও অ্যাকটিভ ধাতুর তালের মধ্যে ছিল মৃত যোদ্ধাদের লাশগুলো। লাশসমেত ধাতুর পিণ্ডগুলো ঘুরতে শুরু করে দিল আপন আপন কক্ষপথে নক্ষত্রের চারপাশে। এমনই বিরাট সে কক্ষপথ যে শুধু একবার সে পথ পরিক্রমণ করে আসতে লেগে যাবে কয়েক কোটি বছর।

পৃথিবীর ওপর তখন সরীসৃপদের যুগ।

 

মালপত্র আর রসদের শেষ বাক্সটি নামিয়ে নেওয়ার পর কয়েক মিনিট জিরিয়ে নিল দু’জন। তারপর সুকোমল উঠে পড়ল ওর ছোট্ট সী প্লেনে। প্রদীপ হাত নেড়ে বিদায় জানাল ওকে।

চীৎকার করে বললে—“আমার বউয়ের কাছে চিঠিখানা পৌছে দিতে ভুলো না যেন।”

ইঞ্জিনে ষ্টার্ট দিতে দিতে সুকোমল জবাব দিলে সমান স্বরগ্রামে—“যে মুহূর্তে জমি স্পর্শ করবে, সেই মুহূর্তেই ব্যবস্থা করবো হে, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। অন্তত কিছুটা ইউরেনিয়াম খুঁজে বার করার চেষ্টা করো তুমি। খানিকটা পেলেই মনে রেখো, তোমার, তোমার বউ আর ছেলের কপাল ফিরে যাবে এ জন্মের মত। আর, ভালুক-টালুকের সাথে লড়াই করার চেষ্টা না করে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজো। নেহাৎ বেগতিক দেখলে গুলি চালাবে।”

গতিবেগ বৃদ্ধি পায় সী প্লেনের। পুঞ্জ পুঞ্জ ফেনায় তোলপাড় হয়ে ওঠে জলরাশি। তারপরেই জলচর যানটি উঠে পড়ে আকাশে। সামান্য একটু ভয় ভয় লাগে প্রদীপের। পুরো তিনটি হপ্তা ওকে এইখানে, এই পর্বতময় উপত্যকায় থাকতে হবে। কথা বলার সঙ্গী তো দূরের কথা, এমন একটা পোষা প্রাণীও নেই যার সান্নিধ্যে ওকে এই ভয়াবহ নিঃসঙ্গতাবোধ থেকে কিছুটা মুক্তি দিতে পারে। যদি কোন কারণে সী প্লেনটা তুহিন ঢাকা নীল সরোবরে ফিরে যেতে না পারে, তা হলেই ওর মৃত্যু অবধারিত। সঙ্গে প্রচুর খাবার দাবার থাকলেও কোন মানুষের পক্ষে এই দুস্তর ব্যবধান পেরিয়ে, বরফ ঢাকা পর্বত চূড়া লঙ্ঘন করে, কয়েক শো মাইলের মত ধূ ধূ প্রান্তর হেঁটে পাড়ি দিয়ে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এত সাতপাঁচ চিন্তা করারই বা দরকারটা কি? সুকোমল যথাসময়েই পৌঁছে যাবে নীল সরোবরে। এখন প্রদীপের ওপরেই নির্ভর করছে এই অভিযানের সমস্ত ঝুঁকিটা। এ অঞ্চলে সত্যিই যদি কোথাও ইউরেনিয়াম থাকে তো পুরো একুশটা দিন সে পাচ্ছে তা খুঁজে বার করার। কাজেই আবোল তাবোল ভবিষ্যৎ না ভেবে কাজ শুরু করা যাক।

বনে জঙ্গলে পাহাড় পর্বতে দিন কাটানোর অভ্যাস তার অনেকদিনের। কাজেই সবার আগে তার কাজ হলো পাহাড়ের কিনারা থেকে বেরিয়ে আসা একটা ঝুলন্ত চ্যাটালো পাথরের তাকের ওপর নিজের ডেরা বানিয়ে নেওয়া। মাত্র তিন হপ্তার আস্তানা। কাজেই এর চাইতে স্থায়ী আর কিছু করার দরকার নেই। চলনসই মাথা গোঁজবার ঠাঁই একটা হলেই হলো। সকালের সূর্য ততক্ষণে আগুন ঢালা শুরু করেছে। দরদর করে ঘামতে থাকে প্রদীপ। টেনে টেনে রসদ আর মালপত্র এনে জড়ো করে ওর ডেরায়। বেশ ভাল করে ঢাকা দিয়ে রাখে ত্রিপলের আচ্ছাদনে। বড়সড় জানোয়ারের অনুসন্ধিৎসা থেকে আড়াল করে রাখার কোন আয়োজনেই ত্রুটি রাখল না ও। ডিনামাইটগুলোকে রাখলে অন্যদিকে। শ’দুয়েক গজ দূরে সযত্নে ত্রিপল দিয়ে মুড়ে রাখলে যাতে আর্দ্রতা স্পর্শ না করতে পারে। শোওয়ার জায়গায় তো আর ডিনামাইট নিয়ে ঘুমানো যায় না! নেহাৎ বোকা না হলে এ ধরনের সাহস কেউ দেখায় না।

প্রথম দুটো হপ্তা কেটে যায় হু হু করে। উৎসাহিত হওয়ার মত কিছুই পাওয়া গেল না। সম্ভাবনা শুধু একটাই রইল। সময়ও রইল প্রচুর এই একটা সম্ভাবনা নিয়ে অভিযান চালানোর। কাজে কাজেই তৃতীয় হপ্তার শেষাশেষি একদিন সকাল বেলা প্রদীপ রওনা হলো উপত্যকার উত্তর-পূর্ব দিকে খাদের মধ্যে শেষ অনুসন্ধান চালানোর সংকল্প নিয়ে। এ অঞ্চলটা এর আগে সে কোনদিন দেখেনি।

গাইগার কাউন্টার সঙ্গে নেয় ও। রেডিও অ্যাকটিভ মৌলিক পদার্থের হদিশ পেতে গাইগার কাউন্টার অপরিহার্য। ইয়ারফোন লাগিয়ে নেয় কানে। তারপর রাইফেলটা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে পড়ে হন হন করে। এই বিশেষ অভিযানের শুরু অথবা শেষ—যে কোন একটা পরিণতি নির্ধারিত হয়ে যাবে আজকে।

‘৩০-০৬ রাইফেলটা রীতিমত ভারী এবং বন্ধুর পথে বহন করে নিয়ে যাওয়া রীতিমত কষ্টকর। কিন্তু এ জিনিস বর্জন করে পথ চলাও নিরাপদ নয়। এ অঞ্চলের বিশালদেহ ভালুকগুলো আর যাই হোক, খুব উদার নয় এবং বেধড়ক খুন জখম করার জন্যে বিলক্ষণ দুর্নাম আছে তাদের। এই কটা দিনের মধ্যেই গোটা দুয়েক জানোয়ারের ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে তার এই হাতিয়াবের বুলেট বর্ষণে। কয়েকবার তো শুধু রাইফেল তুলতেই বুদ্ধিমান জীবগুলো বুঝে নিয়েছে। অবস্থা খারাপ এবং বিনা বাক্যব্যয়ে সটকান দিয়েছে দৃষ্টিপথ থেকে। ‘২২ পিস্তলটা ভেড়ার চামড়ার হোলষ্টারে রেখে ফেলে যায় আস্তানায়।

যাত্রা শুরুর সময়ে শিষ দিতে থাকে প্রদীপ। আকাশ বেজায় পরিষ্কার।
কুয়াশার চিহ্ন মাত্র নেই আশেপাশে। নীলচে সাদা বরফভূমির ওপর ঝকঝক করছিল জ্বালাময় তপনদেব। গ্রীষ্মের এহেন রূপ তাই উল্লসিত করে তুলেছিল ওর অবসাদক্লিষ্ট অন্তরকে। তন্ন তন্ন করে তল্লাশ করে ইউরেনিয়ামের কণাটুকুও আবিষ্কার করতে পারেনি ও। তবুও আনন্দে মন ভরে ওঠে ওর সুন্দর সকালের স্বচ্ছরূপ দেখে। ওর প্ল্যান ছিল এই : একটা দিন স্রেফ হেঁটে নতুন অঞ্চলে পৌঁছানো। পুরো ছত্রিশ ঘণ্টা সেখানে কাটান এবং প্রত্যেকটা পাথর উল্টে উল্টে অনুসন্ধান চালানো। তারপর ফিরে এসে দুপুরের প্লেনটা ধরা। জরুরী অবস্থায় প্রয়োজনীয় প্যাকেটটা ছাড়া খাবার বা জল সঙ্গে রাখলো না ও। ক্ষিদের দাপট খুব বৃদ্ধি পেলে পথেঘাটে দুএকটা খরগোস মারা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। তাছাড়া নদী নালায় সুস্বাদু মাছও এত বেশী এখানে যে, খাবার বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন মানেই হয় না।

সারাটা সকাল হাঁটল প্রদীপ। মাঝে মাঝে কিট্ কিট্, করে উঠতে থাকে গাইগার কাউন্টার এবং প্রত্যেকবার কিট্ কিট্, শব্দ শুনেই লাফিয়ে ওঠে ও! আশায় আনন্দে দুলে উঠে বুক। কিন্তু প্রতিবারেই ঝিমিয়ে পড়ল কাউন্টারের কিট্-কিটানি। সত্যিকারের তেজস্ক্রিয় কোন জিনিসই নেই এ উপত্যকায়।

এদিকে-সেদিকে একটু আধটু কণা রয়েছে পড়ে—বেশী কিছুই নেই। বাস্তবিকই জায়গা নির্বাচনই হয়েছে ভুল। প্রদীপের হাল্কা মেজাজ বিগড়ে যায়। ফিকে হয়ে আসে ফুর্তির রেশ। কিন্তু এখনও একটা সুযোগ আছে। এই শেষ ছত্রিশ ঘন্টার প্রতিটি মুহূর্ত সে কাজে লাগাবে। দরকার হলে সারা রাত্রি তন্ন তন্ন করে প্রতি ইঞ্চি জমি পরীক্ষা করে দেখবে। তাহলেই এত পরিশ্রম হয়ত সার্থক হতে পারে।

ম্লান হাসিতে বঙ্কিম হয়ে ওঠে ওর ঠোট। দুপুরের সূর্য নিষ্করুণ চোখে তাকিয়ে ছিল প্রদীপের শ্রান্ত অবসন্ন মূর্তির পানে। খাওয়ার সময় হয়েছে। শুধু সময় দেখে নয়, উদরের সংকেত থেকেও প্রদীপ বোঝে, এবার খাওয়ার সময় হয়েছে। এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে এগিয়ে চলে ও মাছ ধরার আশায়। ঠিক এমনি সময়ে ঘাস-নরম একটুকরো জমির ওপর এসে দাঁড়ায় ও এবং যে দৃশ্য চোখে পড়ে ওর, তা এমনই বিস্ময়কর যে তা দেখা মাত্র পদযুগল চকিতে অসাড় তো হয়ই, তারও পরে চোয়ালও ঝুলে পড়ে, হাঁ হয়ে যায় মুখ।

দেখে মনে হোল যেন একটা দারুণ উৎসাহী দানবের কশাইখানার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ও। বিরাট সংগ্রহশালা। শুধু জানোয়ারের দেহ। তিনটে পরিষ্কার সারিতে সাজানো এই দেহ। যতদূর চোখ যায়, ততদূর গেছে এই সারি। আর সে কি জানোয়ার! খুব কাছের দেহগুলো যে হরিণ, ভালুক, পাহাড়ী ভেড়া আর শিয়ালের—তা বোঝা যায়। এক এক ধরনের জানোয়ারের নমুনা আছে একটি—তার বেশী নয়। কিন্তু তারও ওদিকে সারির মধ্যে যে কত বিচিত্র অদ্ভুত প্রাণীর চেহারা চোখে পড়ল, তা সুস্থ মস্তিস্কে কল্পনা করতে পারত না প্রদীপ। কদাকার চেহারা প্রাণীগুলোর, লোমশ এবং তারও পরে রয়েছে নিশার আতংকের মত সারি সারি সরীসৃপ! এই অসাধারণ প্রদর্শনীর সব শেষের জানোয়ারটি দেখামাত্র চিনতে পারল প্রদীপ। শহরের মিউজিয়ামে ঠিক এই জানোয়ারেরই একটা বৃহত্তর নমুনা দেখেছিল প্রদীপ। অবশ্য কংকালের ওপর খড় চামড়া মুড়ে অনেক কায়দা করে একটা কাল্পনিক আকার খাড়া করা হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক দানব জানোয়ারটার।

না, কোন সন্দেহই আর নেই। সারির সবশেষের জানোয়ারটি সেই ষ্টেগোসরই বটে—তবে আকারে অনেক অনেক ছোট। ছোট্ট একটি গাধার চাইতে বড় নয়—এত ছোট!

হতভম্ব হয়ে সারির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকে প্রদীপ। মাঝে মাঝে পেছন ফিরে তাকায় এই বিপুল সংগ্রহশালার পানে। আঁশওলা, নোংরা-হলদেটে একটা টিকটিকির খুব কাছে গিয়ে উঁকি মারতেই চমকে ওঠে প্রদীপ। চোখের পাতাটা কাঁপছে না? তারপরেই আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারে ও। জানোয়ারগুলো মৃত নয় মোটেই! প্রত্যেকেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত। নড়াচড়ার ক্ষমতা এইভাবে কেড়ে নেওয়ার পর সযত্নে তাদের সাজিয়ে রাখা হয়েছে এই সংগ্রহশালায়। কি আশ্চর্য অলৌকিক উপায়ে এহেন কাণ্ড সম্ভব, তা ভাবতেও মাথা ঘুরে যায় প্রদীপের। বিন্দু বিন্দু ঘাম দাঁড়িয়ে যায় ওর কপালে। কত কোটি বছর আগে ষ্টেগোসররা এই উপত্যকায় দাপাদাপি করে বেড়িয়েছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ে ওর। বিচিত্র এই মিউজিয়ামের প্রতিটি জানোয়ারই মোটামুটি একই সাইজের। উদাহরণ স্বরূপ, অনেক চোখ চালিয়েও কোথাও সত্যিকারের বড় আকারের একটা সরীসৃপও চোখে পড়ল না ওর। টিরানোসরাস-এর চিহ্ন নেই কোথাও। ম্যামথও নেই। প্রত্যেকটা নমুনার আকার একটা বড় আকারের ভেড়ার মত। এই গোলমেলে ব্যাপারটা নিয়ে মনে মনে তোলাপাড়া করছে ও, এমন সময়ে পেছন দিকে খস্ খস্ শব্দ শুনে হুশিয়ার হয়ে ওঠে প্রদীপ।

এক সময়ে পারা নিয়ে কাজ করতে হয়েছিল প্রদীপকে। তাই মুহূর্তের জন্যে ওর মনে হয়েছিল তরল-ধাতু পারা দিয়ে আধা-ভর্তি একটা চামড়ার থলে যেন আপনা আপনি গড়িয়ে এসেছে খোলা জায়গাটার মধ্যে। জিনিসটা দেখতে অনেকটা বর্তুলের মতো—অথচ তা পুরোপুরি বর্তুলাকার নয়। গুরুতর তরল পদার্থের যে মন্থর গতি, ঠিক সেই গতিতেই আস্তে আস্তে সরে আসছিল জিনিসটা। কিন্তু তা চামড়া নয় এবং প্রথমে যে দাগগুলো দেখে উৎকট আঁচিল বলে মনে হয়েছিল, কাছাকাছি আসতে দেখা গেল সেগুলো আসলে কতকগুলো অপার্থিব কলকব্জার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। জিনিসটা যে মূলে কি, তা অনুমান করার বিশেষ সময় পায়নি প্রদীপ। কেন না, নিরীহ-দর্শন কদাকার বস্তুটাকে কয়েক সেকেণ্ডের বেশী দেখার সুযোগ পায়নি ও। তারপরেই, বিদকুটে বর্তুলাকার বস্তুটার ভেতর থেকে বিদ্যুৎবেগে বেরিয়ে এসেই ঢুকে গেল কয়েকটা ধাতুর রড—রডের প্রান্তে গোলাকার ফুলে ফুলে লেন্সের মত কয়েকটা জিনিসও ঝিকমিকিয়ে উঠল এবং পরক্ষণেই ঘণ্টায় পাঁচ মাইল বেগে ওর দিকে গড়িয়ে এল জিনিসটা। বস্তুটার অগ্রগতি যে উদ্দেশ্যমূলক এবং সে উদ্দেশ্য যে ওরই পক্ষাঘাতগ্রস্ত দেহ দিয়ে সারিবদ্ধ জানোয়ারদের দল ভারী করা—তা বুঝতে পুরো একটা সেকেণ্ডও লাগল না প্রদীপের। জীবন্ত-মৃত নমুনা সংগ্রহের অভিযানের সর্বশেষ লক্ষ্য সে—এই কথা এর মাথায় আসা মাত্র নিদারুণ আতংকে লাফিয়ে উঠল ওর হৃদযন্ত্র।

অস্ফুট, অবোধ্য চীৎকার করে লাফিয়ে পিছিয়ে এল প্রদীপ এবং এক ঝটকায় অভ্যস্ত ক্ষিপ্রহাতে স্লিং থেকে নামিয়ে নিলে রাইফেল। যে শম্-কে ওরা ফেলে গিয়েছিল পৃথিবীতে—সেই শম্ তখনও প্রায় তিরিশ গজ দূরে। সেই একই মন্থর কিন্তু একঘেয়ে অপরিবর্তনীয় গতিবেগে এগিয়ে আসছিল সে। নিষ্ঠুর পশু যে ভাবে সোজাসুজি তেড়ে এসে আক্রমণ করে তার চাইতেই এ আক্রমণের ধরন অনেকাংশে ভয়াবহ। নিশ্চিন্ত অগ্রগতির মধ্যে এতটুকু তাড়াহুড়ো করার প্রয়াস নেই এবং সেই জন্যেই তা আরও ভয়ংকর।

চকিতে একটা কার্টিজ টেনে নিয়ে চেম্বারে ভরে ফেললে প্রদীপ। তারপর কাঁধের ওপর কুঁদো রেখে দৃষ্টি প্রসারিত করে দিলে মাছি বরাবর। দৃষ্টিপথের অপর প্রান্তে রইল চামড়ার মত জিনিসটা। ঝলমলে সূর্যের নীচে বড় সুন্দর লক্ষ্যবস্তু। ঘোড়া টানার সময়ে নিষ্ঠুর মৃদু হাসি ভেসে ওঠে ওর ঠোঁটের কোণে। ১৮০ গ্রেনের, ধাতুর জ্যাকেট পরা, নৌকো-পুচ্ছ বুলেটগুলোর গতি যে সেকেণ্ডে ২৭০০ ফুট, তাতে আর তার অজানা নয়। এত কাছ থেকে খুব সম্ভব শুধু একটা গর্ত সৃষ্টি করে দফারফা করে ছাড়বে ঐ কদাকার জঘন্য জিনিসটার।

দড়াম! কাঁধের ওপর সেই পরিচিত ধাক্কা। ই-ই-ই-ই! আর্ত সুরে বাতাসের বুক চিরে ছুটে যাওয়ার শব্দ! তার পরেই, যেন নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে ওর। না, সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। মাত্র বিশ গজ দূরে ওর কালান্তকস্বরূপ রাইফেলের বুলেট শম্-এর গায়ে লেগেই ছিটকে বেরিয়ে গেছে।

ক্ষিপ্তের মত আবার কার্তুজ ভরে প্রদীপ। পর পর দুবার অগ্নিবর্ষণ করে। তারপর বোঝে এ কায়দা একেবারেই নিরর্থক। এভাবে ধ্বংস করা যাবে না সামনের ঐ ভয়ংকর জিনিসটাকে। যখন মাত্র ছ ফুট দূরে পৌঁছোলো শম্, তখনও স্পষ্ট দেখতে পেলে আঁচিলের মত স্ফীতিগুলো থেকে লিকলিক করে উঠল চকচকে আঙুলের মত কতকগুলো হুক। আর, সবুজ তরল পদার্থে সপসপে হুলের মত ফাঁপা একটা শলাকা সাপের জিহ্বার মত কিলবিল করে উঠল হুক গুলোর মাঝে।

পেছন ফিরেই উধ্বশ্বাসে দৌড়াতে শুরু করল প্রদীপ।

প্রদীপের তখনকার ওজন ছিল ১৪৯ পাউণ্ড।

সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই বরং সোজা। শম্-এর চলাফেরা দেখে মনে হলো ওর চাইতে বেশী গতিবেগ অর্জন করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। কিন্তু সেদিক দিয়েও যে খুব টেক্কা দিতে পারবে বলে উল্লাস বোধ করতে পারে না প্রদীপ। একনাগাড়ে বিরামবিহীনভাবে এবং কোন রকম মন্থরতা বা দ্রুতির অবকাশ না রেখে পৃথিবীর কোন প্রাণীর পক্ষে ঘণ্টায় পাঁচ মাইল বেগে যাওয়া কয়েক ঘণ্টার বেশী সম্ভব নয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রদীপ বুঝতে পারলে এ বস্তুটি যে শিকারের পেছনে ধাওয়া করে, সে প্রাণীটি হয় ঘুরে এসে লাফিয়ে পড়ে নাছোড়বান্দা বস্তুটির ওপর। অথবা, প্রাণীটি যদি অপেক্ষাকৃত ভীতু শ্রেণীর হয়, তাহলে আতংকে বিহ্বল হয়ে বারবার চক্কর দিতে থাকে একই বৃত্তপথে যতক্ষণ না ক্লান্তিতে অবশ হয়ে লুটিয়ে পড়ছে সে মাটির ওপর। এ জিনিসের খপ্পর থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে একমাত্র ডানাওয়ালা প্রাণীরাই। কিন্তু জমির ওপর যাদের যাতায়াত তাদের পরিণতি শুধু একটিই এবং তা হলো শিহরণ জাগানো ঐ প্রদর্শনী সারির আর একটি নমুনা বাড়ানো। কিন্তু কার জন্যে এই বিপুল সংগ্রহ? কেন? কেন? কেন?

ছুটতে ছুটতে ধীর মস্তিষ্কে একটার পর একটা বোঝা হাল্কা করতে থাকে প্রদীপ। লাল সূর্যের দিকে একবার তাকিয়েই শিউরে ওঠে আসন্ন অমানিশার অন্ধকারের কথা ভেবে। রাইফেলটা নিয়ে মহাদ্বিধায় পড়লো ও। শম্-এর ওপর এ হেন জবর হাতিয়ারেরও কোন জারিজুরি খাটে নি। কিন্তু তবুও তখুনি তখুনি অস্ত্রটা হাতছাড়া করা যে উচিত নয়—এই শিক্ষাই সে পেয়েছে সামরিক স্কুল থেকে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকবে এ রাইফেল তার কাঁধে। যদি নিতান্তই গুরুভার হয়ে ওঠে, তখন উপায়ান্তর না থাকলে বর্জন করা ছাড়া আর কোন উপায়ই নেই। কিন্তু এই ভয়ংকর দৌড় প্রতিযোগিতার ফলাফল যে শেষ পর্যন্ত তারই বিপক্ষে যাবে, তা বুঝতে বিশেষ দেরী লাগে না প্রদীপের। সামরিক শিক্ষা যাই থাকুক, তার্কিক মনটা বারে বারে ওকে হুশিয়ার করে দিতে থাকে—রাইফেলটা একটা বোঝা ছাড়া কিছুই নয়। এ শত্রুকে এ দিয়ে যখন নিধন করা যাবে না, তখন সামরিক শিক্ষাকে আপাতত ভুলে গিয়ে অস্ত্রটাকে নিক্ষেপ করে যে দিকে খুশী। মন স্থির করে ফেলে প্রদীপ। ওজন অসহ্য হয়ে উঠলেই ৩-০৬ কে বিদায় দিতে হবে। কিন্তু এখন রাইফেলটাকে ও ঝুলিয়ে নেয় কাঁধে। গাইগার কাউন্টারকে সযত্নে বসিয়ে রাখে একটা চ্যাটালো পাথরের তাকের ওপর। কিন্তু লম্বা লম্বা পা ফেলায় এতটুকু শৈথিল্য দেখায় না ও।

একটা জিনিস নিশ্চিন্ত। এ দৌড় প্রতিযোগিতার সঙ্গে কচ্ছপ আর খরগোসের দৌড়ের কোন মিল নেই। অন্ধের মত ভয়ের তাড়নায় এ দৌড়োনোর শেষ পরিণতি হলো শ্রান্তিতে অবসন্ন হয়ে, শেষ বিন্দু শক্তিটুকু নিঃশেষিত করে আত্মসমর্পণ করা ঐ মন্থর গতি চলমান চামড়ার থলির খপ্পরে।

বুকভরে নিঃশ্বাস নেয় প্রদীপ। আশপাশে তাকায় যদি কিছু পাওয়া যায়, এই আশায়। এ প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করার কোন সংকেত যদি কোথাও পড়ে থাকে , তারই সন্ধানে ধূর্ত দৃষ্টি বুলোয় চারদিকে। সৌভাগ্যক্রমে উপত্যকার গাছপালাগুলো ছিল খুবই দূরে দূরে। না হলে জঙ্গলের মধ্যে সোজাসুজি দৌড়োনোর কোন সুযোগই পেত না ও।

হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যায় প্রদীপ। যে পথ দিয়ে ও ছুটে চলছে, সেই পথেরই ওপর কাৎ হয়ে ঝুলছে মস্ত একটা পাথরের চাঁই।

ঝুলন্ত পাথরের চাঁই। মতলব কিলবিল করে ওঠে ওর মস্তিষ্কের কোষে কোষে।

টিলাটার ওপর লাফিয়ে উঠে পেছনে তাকায় প্রদীপ। দূরে দেখা যাচ্ছিল ঘাস-সবুজ জমিটা। বিকেলের সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। লম্বা লম্বা ছায়া পড়েছে প্রান্তর-পাহাড়ের ওপর। কিন্তু পাছু-নেওয়া শম্-কে খুঁজে বার করতে বেগ পেতে হয় না ওকে। তখনও সেই একই গতিতে প্রদীপের পদচিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে আসছিল শম্। যাতনাময় অধীর আগ্রহে জিনিসটার অগ্রগতি লক্ষ্য করতে থাকে ও। ঐটুকু সময়ের মধ্যেই সম্পূর্ণ হয় ওর পর্যবেক্ষণ। যা ভেবেছে তাই! সত্যিই তাই। যদিও অনেক ক্ষেত্রে প্রদীপের পায়ের চিহ্ন সিধে পথ ছেড়ে বেঁকা পথ ধরেছে, ভাল পথ ত্যাগ করে খারাপ পথে বাঁক নিয়েছে—তবুও একগুঁয়ে ভাবে এই আঁকাবাঁকা পদচিহ্নকেই অনুসরণ করে এগিয়ে আসছে শম্। এ দৃশ্য দেখতে যতটুকু সময় গেল, তার চাইতেও অল্পসময়ের মধ্যে স্থির হয়ে গেল ওর পরবর্তী কর্মপন্থা। সময় খুবই অল্প। মাত্র বারো মিনিট। এরই মধ্যে প্রদীপের নবলব্ধ জ্ঞানকে প্রয়োগ করতে হবে জিনিসটার কবল থেকে নিজেকে বাঁচানোর পরিকল্পনায়।

ইচ্ছে করে পা ঘষে ঘষে ঝুলন্ত পাথরটার তলা দিয়ে এগিয়ে যায় প্রদীপ। গজ দশেক যাওয়ার পর ফিরে আসে ঐ পথেই। তারপর তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে টিলার ওপরে একটা খাঁজে। তড়বড় করে উঠে যায় টলমলে পাথরের চাঙরটার ঠিক পেছনে।

সড়াৎ করে বেল্টের খাপ থেকে ছুরীটা টেনে বার করে ও। তারপরেই শুরু হয় মাটি খোঁড়া। বিজ্ঞানসম্মতভাবে কিন্তু অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সাথে চাঙরটার মূল দেশের মাটি আলগা করে দিতে থাকে ও। কয়েক সেকেণ্ড অন্তর অন্তর ভয়ে, উদ্বেগে ঘামতে ঘামতে এক কাঁধ দিয়ে পাথরটায় ঠেলা দিয়ে পরখ করতে থাকে ও। তারপর এক সময়ে, যেন কত যুগ পরে, সামান্য দুলে ওঠে অত বড় চাঙরটা। ছুরীটা সবেমাত্র খাপের মধ্যে ঢুকিয়ে গুঁড়ি মেরে বসে হাপরের মত ও হাঁপাচ্ছে, ঠিক এমনি সময়ে অদূরে একটা পাথরের আড়ালে তার পদচিহ্নের ওপর গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে এল শম্।

একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে প্রদীপ ধূসর বর্তুলাকার থলিটার দিকে। অনিমেষ চোখে দেখতে থাকে এগিয়ে আসছে জিনিসটা। এগিয়ে আসছে যতিহীন একই গতিতে। প্রাণপণে শ্বাস প্রশ্বাস প্রশমিত করার চেষ্টা করে ও। শম্-এর আর কি কি অনুভূতি আছে, সে প্রমাণ এখনও অবশ্য পাওয়া যায় নি। শুধু পায়ের ছাপ অনুসরণ করা ছাড়া নতুন কোন অনুভূতির চিহ্নও দেখা যায় নি তার হাবভাবে। কিন্তু তাহলেও সাবধানের মার নেই। কে জানে হয়তো পুরো একসেট যন্ত্রপাতিতে বোঝাই ওর ভেতরটা। সুযোগ মত যে কোন একটিকে ব্যবহার করা মোটেই আশ্চর্য নয় ও রকম বিদকুটে জিনিসের পক্ষে। চাঙরটার আড়ালে গুটি সুটি মেরে বসে থাকে প্রদীপ। প্রত্যেকটা স্নায়ুতে ছুটতে থাকে চনমনে তড়িৎপ্রবাহ।

কিন্তু শম্-এর কলকৌশলে কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। পদচিহ্ন অনুসরণেই সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে গড়াতে গড়াতে বস্তুটা এসে পড়ে ঠিক চাঙরটার তলায়। যেই আসা, সঙ্গে সঙ্গে বিকট চীৎকার করে শরীরের সর্বশক্তি দু’হাতের মাংসপেশীর মধ্যে এনে এক প্রচণ্ড ঠেলা মারলে প্রদীপ টলমলে পাথরের চাঙরটার ওপরে। হুড়মুড় করে চাঁইটা গড়িয়ে পড়ল ঠিক শম্-এর ওপর। বারো ফুট উঁচু থেকে খসে পড়ল পাঁচ টন ওজনের একটা বিশাল পাথর।

হাঁচর-পাঁচর করে টিলার গা দিয়ে নেমে আসে প্রদীপ। বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে বিশাল পাথরটার দিকে। তারপরে সোল্লাসে এক পদাঘাত করে পাথরটার ওপর—“কি হে, বুঝছো কেমন? সুকোমল ফিরে এলে তোমার ঐ মাংসের বাজার থেকে দু চারটে নমুনা আমরাও নিয়ে যাব ’খন। এবারের অভিযান তাহলে একেবারে বৃথা যাবে না, দেখছি। শয়তান কোথাকার! যে নরক থেকে তোমার আবির্ভাব—সেই নরকের আনন্দই উপভোগ করো এবার।”

তারপরেই, লাফিয়ে পিছিয়ে আসে ও। বিস্ফারিত হয়ে ওঠে দু চোখ, আতংকে অক্ষিকোটর থেকে যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায় প্রত্যঙ্গ দুটি! পাথরের বিশাল চাঁইটা নড়ছে। ধীরে ধীরে পাঁচ টন ওজনের পাথরটা সরে যেতে থাকে তার পদচিহ্নের ওপর থেকে। চোখের সামনেই প্রদীপ দেখতে পায় মাটির একটা স্তর উঠে আসে পাথরটার সঙ্গে। রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে ও। পাথরটা গড়িয়ে পড়ে পাশের দিকে। আর, ধূসর একটা বস্তুর খানিকটা নড়তে দেখা যায় ছোট্ট গর্তটার মধ্যে। আর্ত চীৎকার করে প্রাণ হাতে নিয়ে আবার দৌড়োতে শুরু করে প্রদীপ।

পায়ের ছাপ ধরে যে দিক থেকে এসেছিল, সেই দিকেই পুরো একটা মাইল দৌড়ে গেল ও। তারপর থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে তাকালে পেছন দিকে। বহুদূরে খসে পড়া পাথরটার কাছ থেকে সরে আসা একটা চলমান কালো বিন্দু চোখে পড়ে ওর। ঠিক আগের মত নিয়মিত গতিতে, মন্থর গতিতে, বিরাম বিহীন গতিতে ওরই দিকে এগিয়ে আসছিল বিন্দুটা। ধপাস করে বসে পড়ে প্রদীপ। ছড়ে যাওয়া, মাটি মাখা হাতের চেটোতে চেপে ধরে দুই কপাল।

কিন্তু হতাশার এই ভাব কিন্তু বেশীক্ষণ রইল না। কুড়ি মিনিট বিশ্রাম তো সে পাচ্ছে। চীৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ে ও। যতখানি পারে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে দেহের অবশ সন্ধি আর মাংসপেশীগুলোকে খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ দেয়। তারপর ট্রাউজারের পকেট থেকে বার করে খাবারের জরুরী প্যাকেটটা। দ্রুত হাতে বিস্কুট আর চকোলেট চালান করতে থাকে উদর গহ্বরে। এরপর বরফ-ঠাণ্ডা একটু জল খেলেই নবজীবন লাভ করবে ও। কিন্তু তার আগে তিনটে বেনজেড্রিন বড়ি গিলে ফেলে প্রদীপ। এ ধরনের দৈহিক সংকট কালে কাজে লাগবে বলেই বড়িগুলো সঙ্গে রেখেছিল প্রদীপ। তখনও মোটামুটি দশ মিনিটের পথ পেরোতে বাকী শম্-এর। আবার যাত্রা শুরু করে প্রদীপ। যে অবসাদ হাড়ের ভেতর পর্যন্ত পোঁচেছিল, তার বেশীর ভাগই উড়ে গিয়েছিল এ ক’মিনিটের বিশ্রামে।

পনেরো মিনিট দৌড়োনোর পর প্রায় তিরিশ ফুট উচু একটা খাড়াই পাহাড়ের সামনে এসে পৌঁছোয় প্রদীপ। দু পাশের পথ এমনই খারাপ যে কহতব্য নয়। চোখা চোখা কাঁটা ঝোপ, ছুরীর মত ধারালো পাথরের কিনারা, আর এবড়োখেবড়ো গহ্বর। কোন উপায়ে যদি পাহাড়টার চূড়োয় পৌঁছোনো যায়, তাহলেই কেল্লাফতে। শমকে বাধ্য হয়ে ঘুরে আসতে হবে অন্য দিক দিয়ে। সে ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে পড়বে হতভাগা এবং অনেকগুলো মিনিটও হাতে পেয়ে যাবে প্রদীপ।

সূর্যের দিকে তাকায় ও। লাল টকটকে বিশাল অরুণ দেহ দিগরেখা সবে স্পর্শ করেছে। আর দেরী নয়। চটপট হাত-পা চালাতে হবে এবার। পাহাড়ে চড়ার কোনো অভিজ্ঞতা নেই প্রদীপের। কিন্তু মূল পদ্ধতিগুলো জানা ছিল ওর। প্রত্যেকটা খাঁজ, এবড়ো-খেবড়ো জায়গা আর ছোট কিনারা ধরে টেনেটুনে নিজেকে তুলে আনতে থাকে ও চূড়োর দিকে। পাহাড়ে চড়ার কায়দা কিছুমাত্র না জেনেও অনেকটা তাদের মতই প্রাণের দায়ে উঠে আসতে থাকে প্রদীপ। ছোট্ট ছোট্ট খাঁজগুলোর ওপর হাতের পায়ের চাড়া দিয়ে ধাপে ধাপে দেহটাকে তুলে আনতে থাকে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে।

চূড়োয় পৌছোনোর সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের নীচে গড়িয়ে এসে পৌঁছেলে শম্।

প্রদীপ বুঝলো, আর দেরী করা সঙ্গত নয়। এই মুহূর্তেই এ জায়গা ছেড়ে শটকান দিতে হবে ওকে। আলোর রেশটুকু থাকতে থাকতেই তাকে কাজে লাগাতে হবে এই ক’টি অমূল্য মিনিটকে। এ সময়ে প্রতিটি মুহূর্তের মূল্য যে কতখানি, তা কোন ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা চলে না। তা সত্ত্বেও কৌতুহল আর আশাই ওকে ধরে রাখলে ওখানে। যে মুহূর্তে ঘুরপথে রওনা হবে শম, সেই মুহূর্তে নেমে এসে চম্পট দেবে ও। তাছাড়া, ছিনেজোঁকের মত জিনিসটা হতাশ হয়ে যদি হাল ছেড়ে দেয় তো এইখানেই টেনে ঘুম দিতে পারবে সে।
ঘুম! শরীরের প্রতিটা কোষে কোষে যেন ঘুমের রিমিঝিমি সঙ্গীত বেজে ওঠে! ঘুম! সারা শরীর দিয়ে সে কামনা করতে থাকে এই ঘুমকে।

কিন্তু ঘুরপথে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না শম্-এর। পাহাড়ের নীচে মাত্র কয়েক সেকেণ্ড ইতস্তত করলো সে। তারপরেই অনেকগুলো স্ফীতি খুলে গিয়ে বেরিয়ে পড়লো কতকগুলো ধাতুর প্রত্যঙ্গ। একটার ডগায় লাগানো ছিল লেনস। শূন্যে দুলে উঠল এই প্রত্যঙ্গটি। বিদ্যুৎবেগে নিজেকে টেনে নিলে প্রদীপ কিন্তু বড় দেরীতে। শম্-এর অলৌকিক চোখ নিমেষের মধ্যে দেখে নিয়েছে তাকে, পেয়ে গেছে তার হদিশ।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে চীৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে নিজের ওপরেই গাল পাড়তে থাকে প্রদীপ। মূর্খ! আহাম্মক!

চকিতে সব কটা প্রত্যঙ্গ সেঁধিয়ে গেল ভেতরে। অন্য একটা স্ফীতি থেকে বেরিয়ে এল একটা সরু রড। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় রক্তের মত লাল হয়ে ওঠে রডটা।

তার পরেই, তা সিধে উঠে আসতে থাকে প্রদীপের দিকে। আড়ষ্ট হয়ে রডটার উর্ধ্বগতি লক্ষ্য করতে থাকে ও। সড় সড় করে উঠে এসে রডটার আঁকশির মত ডগাটা আঁকড়ে ধরে পাহাড়ের একটা খাঁজ। ঠিক ওর নাকের নীচেই।

লাফিয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে প্রদীপ। রডটা এর মধ্যেই ছোট হতে শুরু হয়ে গিয়েছিল। শম্-ই টেন নিচ্ছিল চকচকে রডটাকে নিজের ভেতরে। আর, চামড়ার থলির মত বর্তুলাকার জিনিসটা উঠে আসছিল জমি ছেড়ে ওপর দিকে। অজান্তেই ঘড় ঘড় শব্দ বেরুতে থাকে প্রদীপের আতংক-বিহ্বল কণ্ঠ দিয়ে। নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকে ধাতুর আঁকশিটার দিকে। তারপর একটা পা পিছিয়ে নেয় মোক্ষম পদাঘাতের জন্যে।

এবারেও কিন্তু ওর ঐ অভিজ্ঞতাই সংযমী করে তোলে ওকে। লাথি মারা মুলতবী রাখে প্রদীপ। লাথি মারতে গিয়ে কত জনে যে কি শোচনীয়ভাবে হার স্বীকার করেছে, তা তো তার অজানা নয়। অবিবেচকের মত লাথি চালিয়ে পরাজয় স্বীকার করতে রাজী নয় প্রদীপ। শম্-এর এমন খাসা যন্ত্রপাতির সংস্পর্শে ওর দেহের কোন অংশ আনা হবে নেহাতই বোকামো। তার বদলে গাছের শুকনো একটা ডাল তুলে নেয় প্রদীপ। তারপর একটা প্রান্ত ধাতুর আঁকশির ভেতরে গলিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে চাড় দিতে শুরু করে।

মড়-মড়-মড়াৎ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল একটা চোখ ধাঁধানো ঝিলিক—ধবধবে সাদা আর ফিতের মত। শুকনো কাঠের মধ্যে দিয়েও প্রদীপ অনুভব করে সেই প্রচণ্ড শক্তির ধাক্কা—যে শক্তি নিমেষের মধ্যে কাঠের ডগাটা টুকরো টুকরো করে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলে। ধোঁয়া-ওঠা ডাণ্ডাটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় ও—যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে যায় মুখ। অসাড় আঙুলগুলো দুমড়ে মুচড়ে অবরুদ্ধ ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে পিছিয়ে আসে কয়েক পা। মুহূর্তের জন্যে থমকে দাড়ায় ও। পাশের দিকে ফিরে আবার পদযুগল আশ্রয় করে চম্পট দেওয়ার জন্যে। কিন্তু তারপরেই প্রবল জিঘাংসার অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে অধরোষ্ঠে। নিষ্ঠুর সংকল্পে ঝিকমিক করে ওঠে দাঁতের মাড়ি—ঝটিতি স্লিং থেকে নামিয়ে আনে রাইফেলটা। ভালই হয়েছে। এতদূরে শম্-কে এনে উচিত কাজই করেছে প্রদীপ। এবার পাওয়া গেছে তাকে মুঠোর মধ্যে। আশায় উল্লাসে দুলে ওঠে ওর বুক।

জানু পেতে বসে পড়ে প্রদীপ। পড়ন্ত আলোয় মাছি বরাবর তাকিয়ে নিশানা ঠিক করে নেয়—নলচে স্থির হয়ে থাকে আঁকশিটার ওপর। তারপর ফায়ার করে ও। ধপ করে একটা শব্দ হয়। পড়ে গেছে শম্। বাজখাঁই চীৎকার করে ওঠে প্রদীপ। জবর বুলেট এবার পেরেছে তার মর্যাদা রাখতে। বুলেটের কামড়ে শুধু আঁকশিটাই চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে আলগা হয়ে যায় নি, পাহাড়ের গায়ে একটা মস্ত গহ্বরের সৃষ্টি করেছে। হতভাগা শম্-এর সাহস হবে না ধাতুর থাবা দিয়ে পাহাড়ের ঐ অংশটা আবার আঁকড়ে ধরার।

নিচের দিকে তাকায় প্রদীপ। বাস্তবিকই জমির ওপরেই আছড়ে পড়েছে চামড়ার থলির মত জিনিসটা। দাঁত বার করে হেসে ওঠে প্রদীপ। এরপর যতবার ঐ কদাকার জিনিসটা ধাতুর আঁকশি লাগাবে পাথরের খাঁজে ততবার বুলেট বর্ষণে মাটি টের পাইয়ে দেবে সে। দেখা যাক, কতবার আছাড় খাওয়ার ধৈর্য থাকে শম্-এর। বুলেটের তো আর অভাব নেই তার। চাঁদ না ওঠা পর্যন্ত দরকার হলে কয়েক ইঞ্চি দূর থেকেও গুলি চালাতে কসুর করবে না ও। তারপর চাঁদ উঠলে খেলা আরও জমে উঠবে। তাছাড়া ঐ জিনিসটা জড় পদার্থের মত দেখতে হলেও নিশ্চয় বুদ্ধি রাখে যথেষ্ট। শেষ পর্যন্ত নিরর্থক প্রচেষ্টায় বিরতি দিয়ে হয়ত হতভাগা ঘুরপথে রওনা হতে পারে। সেই সুযোগে পায়ের দাগ ঢেকে আত্মগোপন করার পক্ষে একটা রাতই যথেষ্ট।

আর, তারপরেই—দম বন্ধ হয়ে আসে ওর। ক্ষণেকের জন্যে অশ্রুও ছলছল করে ওঠে ক্লান্ত দুই চোখে। অনেক নিচে আবছা অন্ধকারের মধ্যে থেকে কুৎসিত বর্তুলাকার বস্তুটা এবার তিন-তিনটে আঁকশিওয়ালা রড একই সাথে পাঠিয়ে দিচ্ছে ওপর দিকে। হু হু করে উঠে আসছে রডগুলো তার দিকে। তারপর খাঁজটা আঁকড়ে ধরলো তিনটে আঁকশি—প্রত্যেকটি আঁকশির মধ্যে ব্যবধান রইল প্রায় চার ফুট।

রাইফেলটা চট করে কাঁধে তুলল প্রদীপ। ঠিক আছে, উপর্যুপরি গুলি চালিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল সে ক্যাম্পে। আর আজ এসেছে তার এই ক্ষমতার চরম পরীক্ষার দিন। প্রভেদ শুধু এই যে রাতের অন্ধকারে কোনদিন তাকে ক্যাম্পে এ পরীক্ষা দিতে হয়নি।

প্রথম ফায়ারিংটা হলো বেজায় নিখুঁত—গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে উড়তে লাগল পাথর। খসে পড়ল আঁকশিটা। দ্বিতীয় বুলেটটাও মোক্ষম আঘাত হানলে দু’নম্বর আঁকশিটার ওপর। আরও খানিকটা পাথর উড়লো শূন্যে। খসে পড়ল মাঝের আঁকশি। কিন্তু তিন নম্বর আঁকশির দিকে নলচে ফেরাতে না ফেরাতেই প্রদীপ বুঝল বৃথা, সব বৃথা, সে যতবড় বন্দুকবাজই হোক না কেন, এ জিনিসকে জাহান্নমে পাঠানোর ক্ষমতা তার নেই। | প্রথম আঁকশিটা আবার যথাস্থানে চেপে বসেছিল। যত দ্রুতই গুলিবর্ষণ করুক না কেন প্রদীপ, একটা না একটা আঁকশি সব সময়েই আঁকড়ে থাকবে। পাহাড়ের খাঁজ এবং ধীরে ধীরে তুলে নিয়ে আসবে শম্-কে।

রাইফেলটাকে একটা গাছের শাখায় ঝুলিয়ে ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে দৌড়তে শুরু করল প্রদীপ। বহু বছরের কষ্ট সহিষ্ণুতার অভ্যাস থাকার ফলেই এত কষ্টও সে সহ্য করে যেতে পারছে আজ। কিন্তু কোথায় চলেছে সে? এখন সে করবেই বা কি? পেছনের ঐ জঘন্য জিনিসটার গতিরোধ করার মত কোন হাতিয়ারই কি নেই এ দুনিয়ায়?

তখনই মনে পড়ল ডিনামাইটের কথা।

ধীরে ধীরে গতি পরিবর্তন করে শ্রান্ত অবসন্ন প্রদীপ লেকের ধারে তার ক্যাম্পে ফিরে চলল। মাথার ওপর মিটমিটে তারাগুলো ফিকে আলো ফেলে পথ দেখাতে লাগল ওকে। সময়ের সবকিছু হিসেব আর অনুভূতি হারিয়ে ফেলে প্রদীপ। দৌড়োতে দৌড়োতেই নিশ্চয় খাওয়াটা শেষ করেছিল ওকে—কেননা ক্ষিদে তো কই পাচ্ছে না। ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে একটু খেয়ে নিলেই চলবে’খন… না, না, সময় হবে না… একটা বেনজেড্রিন বড়ি খেলেই চলে যাবে। না, না, বড়ি তো ফুরিয়ে গেছে, চাঁদও উঠে এসেছে ওপরে… পেছনেই এসে পড়েছে শম্। শুনতে পাচ্ছে প্রদীপ। একদম পেছনে। খুব কাছে।

মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে আলোজ্বলা চোখগুলো উঁকি মেরে গেল ওর ওপর। ভোরের দিকে একটা ভালুকও পরম অসন্তোষের সঙ্গে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে পেরিয়ে গেল সামনের পথ।

সূর্য ওঠার একটু পরেই লেকের ধারে পৌছোলো প্রদীপ। এত কাছে এসে গিয়েছিল শম্ যে ঘাসপাতার মধ্যে দিয়ে যেন তার আসার সড়সড়ানিও শুনতে পাচ্ছিল ও। টলমল করে উঠল প্রদীপ। মুদে এল দুই চোখ। আচ্ছন্ন ভাবটা ঝেড়ে ফেলার জন্যে নাকের ওপর ছোট ঘুসি মারে ও। চোখ খুলে যায়। চোখের সামনেই দেখতে পায় ডিনামাইটগুলোর আচ্ছাদন। ডিনামাইটের চটচটে ষ্টিকগুলোর দৃশ্য মনে পড়তেই সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে ওঠে ও।

এরপর করণীয় কি? পলতে? না। পায়ের ছাপের ওপর পলতে ডিনামাইট বসিয়ে ঠিক কতখানি সময় পরে তা ফাটানো দরকার—সে হিসেব অতখানি নিখুঁতভাবে করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। দরদর করে ঘাম গড়িয়ে পড়তে থাকে। সারা গা বেয়ে। জামা-কাপড়ও ঘামে মাটিতে চিটচিটে হয়ে উঠেছিল। ঠিক যে মুহূর্তে শম্ এসে পৌছোবে ডিনামাইটের ওপর, সেই মুহূর্তেই দূর থেকে ঘটাতে হবে বিস্ফোরণটা। কিন্তু লম্বা লম্বা পলতে লাগানো সঙ্গত মনে করে না প্রদীপ। কতখানি বেগে পলতে জ্বলবে, তার তো কোন ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। এমনও হতে পারে শম্ ডিনামাইট পেরিয়ে যাওয়ার পর হয়ত ঘটলো বিস্ফোরণ। থুৎনি নেমে আসে দ্রুতস্পন্দিত বুকের ওপর। কি করবে ও? এ সমস্যার সমাধান কি ভাবে করবে ও? তারপরেই ঝাঁকানি দিয়ে মাথা তুললে ও, পিছিয়ে এল কয়েক পা। তখনই চোখে পড়ল .২২ পিস্তলটা। যেখানে রেখে গিয়েছিল, ঠিক সেইখানেই পড়েছিল খুদে হাতিয়ারটা।

কোটরে বসা দুই চোখে এবার বিদ্যুৎ জ্বলে ওঠে।

উন্মাদের মত বাক্সটার মধ্যে স্তুপের মত সাজায় যতগুলো ডিনামাইট ছিল ওর ভাণ্ডারে—সব। আলগা বারুদও ছড়িয়ে দেয় এন্তার। তারপর বাক্সটা নিয়ে গিয়ে বসায় শম্ যে পথে আসছে, সেই পথের ওপর। বিশ গজ দূরেই ছিল ছোট্ট একটা টিলা। টিলার আড়ালে গিয়ে বসে পড়ে ও। সরু একটা খাঁজের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরে পিস্তলের নলচেটা। মারাত্মক ঝুঁকি নিচ্ছে সে। মাত্র বিশ গজ দূরে ঐ ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটলে তাকেও আস্ত পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। কিন্তু জীবন্ত অবস্থায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শম্-এর কশাইখানায় স্থান পাওয়ার চাইতে ডিনামাইটে মৃত্যুও অনেক ভালো।

আড়ষ্ট হয়ে ওঠে ও। এসে গেছে শম্। দূরে পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে গড়ানো বস্তুটা। চামড়ার থলির মত দেখতে হলেও যা চামড়ার থলি নয়। পৃথিবীর কোন বস্তুই নয়। এগিয়ে আসতে থাকে সে নিশ্চিন্ত গতিবেগে ডিনামাইটের স্তুপের দিকে।

শক্ত হয়ে ওঠে প্রদীপের চোয়ালের হাড়। উত্তেজনায়, উদ্বেগে, শ্রান্তিতে, মাথার শিরা উপশিরাগুলো যেন ছিঁড়ে পড়তে চায়। পিঠের ওপর পড়ছিল সকালের সূর্যের উষ্ণ স্পর্শ। একটা পাখী ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। ছপাৎ করে লাফিয়ে ওঠে একটা মাছ লেকের জলে।

আচমকা প্রদীপের অতন্দ্র চোখ খরখরে হয়ে ওঠে। কি মুস্কিল! এত সময় থাকতে এই সময়েই কিনা হতচ্ছাড়া ভালুকটার বেড়ানোর খেয়াল হলো এদিকে। মন্থর গতিতে হেলতে দুলতে পাশের ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসে জানোয়ারটা। এসে দাঁড়ায় ডিনামাইটের কাছে। তারপর সন্দিগ্ধভাবে বার দুয়েক আঘ্রাণ নেয়। মানুষের গন্ধ পেয়েই বুঝি গলার মধ্যে ঘড়ঘড় করতে থাকে কিছুক্ষণ।

আর, উত্তেজনায় কাঠ হয়ে বসে নিঃশব্দে অভিসম্পাত দিতে থাকে প্রদীপ। ভালুকটার কাঁধের ওপর দিয়েই অদূরে দেখা যাচ্ছে গড়ানে জিনিসটা। অব্যাহত গতিতে এগিয়ে আসছে প্রদীপের পদচিহ্ন অনুসরণ করে। এবার ভালুকটারও চোখ পড়ে সেদিকে। তখনও প্রায় বিশ গজ দূরে রয়েছে শম্-এর দেহপিণ্ড। গজরাতে গজরাতে এগিয়ে যায় ভালুকটা। কিন্তু ফুট ছয়েক দূরে আসতেই থমকে দাড়িয়ে যায় শম্। ভালুকটাও দাঁড়ায়। তারপর পেছনের দু’পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে ওঠে সে—সে কি মূর্তি! জিঘাংসা যেন মূর্ত হয়ে ওঠে—দাঁড়িয়ে ওঠে শম্-এর সামনে। রক্তবর্ণ ঠোটের পাশে ঝিলিক দিয়ে ওঠে ভয়াবহ চকচকে দাঁতের সারি। কিন্তু কাজ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না শম্। তাই আমোল না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার তালে গড়িয়ে যায় একদিকে। খেপে যায় ভালুকটা, সরে এসে পথ আটকায়। গজরানিও বাড়তে থাকে। আর তার পরেই থাবা চালালে সে। সারি সারি বল্লমের মত বেঁকানো নখ বসানো মারাত্মক সেই থাবার প্রচণ্ড ঘায়ে গণ্ডারের চামড়াও ফালা ফালা হয়ে যেত। কিন্তু বিস্ফারিত চোখে প্রদীপ দেখলে শুধু খানিকটা ধুলো উড়ে যেতে শম্-এর ধূসর দেহ থেকে।

আচমকা ধাক্কার বেগ সামলাতে না পেরে মাত্র কয়েক ইঞ্চি ছিটকে পড়ে একদিকে—তার বেশী নয়। গতি স্তব্ধ করে সেকেণ্ড কয়েকের মধ্যে সামলে নেয় নিজেকে। তারপর যেন কিছুই হয়নি, এমনি নির্বিকারভাবে আবার গড়াতে শুরু করে আরো বড় চক্কর দিয়ে। অনেকখানি ঘুরে আততায়ীকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতলবে।

কিন্তু জঙ্গলের রাজা কোন লড়াই অসমাপ্ত রেখে যাওয়া পছন্দ করে না। চকিতে, অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় জমির ওপর দিয়ে যেন পিছলে যায় তার অতবড় দেহখানা। তারপর গর্জন করে উঠে লাফিয়ে পড়ে শম্-এর ওপরে, সামনের দুই থাবা দিয়ে সবলে আঁকড়ে ধরে অপার্থিব থলিটাকে। আর ঝকঝকে দাঁতের সারি দিয়ে প্রচণ্ড কামড় বসায় ধূসর বস্তুটার ওপর।

উত্তেজনায় এবার সব ভুলে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে প্রদীপ। মূর্খ! মূর্খ! নিরেট মূর্খ না হলে এভাবে শম্-এর সাথে শক্তির পরীক্ষা করতে কেউ এগোতো না।

ধূসর পটভূমিকায় বিদ্যুৎবেগে ঝলসে উঠল রূপালি ধাতু। একটি মাত্র ধাতু। একটি মাত্র ঝিলিক দেখা গেল। অত্যন্ত দ্রুত এবং মারাত্মক সে ঝিলিক। জঙ্গলাধিপতির গর্জন মুহূর্তের মধ্যে নেমে আসে কাতর গোঁ গোঁ শব্দে। তারপর সেকেণ্ড কয়েক ঘড়ঘড়ানির পর প্রায় এক টন ওজনের বিভীষিকা অবশ হয়ে এলিয়ে পড়ে জমির ওপর। প্রাণহীন সে দেহ। গলাটা কেটে ঠিক দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল। প্রদীপ স্পষ্ট দেখতে পেলে রক্ত মাখা ফলাটা ধোঁয়াটে শম্-এর ভেতরে সেঁধিয়ে গেল নিমেষে। ধুলোর ওপর সামান্য একটু উজ্জ্বল লাল রঙ ছাড়া আর কোন চিহ্নই রইল না তার নিরীহ আকৃতিতে!

ভালুকটার নিষ্প্রাণ দেহ পেরিয়ে এগিয়ে এল শম। এগিয়ে এল প্রদীপের পদচিহ্নের ওপর। আবার শুরু হলো অগ্রগতি। পাথরের আড়ালে মাথা নামিয়ে নেয় প্রদীপ। ঠিক আছে। তবে তাই হোক। জঙ্গলের বিভীষিকাও আজ পরাজিত। কিন্তু ডিনামাইটের ঐ স্তুপ পেরিয়ে…

খুব শান্তভাবে, সাবধানে পিস্তলের ঘোড়া টেনে ধরল প্রদীপ। সংক্ষেপে প্রথমে শোনা গেল বিস্ফোরণের শব্দ। তার পরেই অনেকগুলো অতিকায় অদৃশ্য হাত যেন ঝাঁকানি দিয়ে শূন্যে টেনে তুলেই ছেড়ে দিল তাকে। মুখ থুবড়ে পড়ল প্রদীপ একটা আলকুশীর ঝোপের ওপর। কিন্তু আঘাতের বেদনা বোধ তখন ওর লোপ পেয়েছিল। ওর মনে পড়ে, আকাশের পাখীগুলোও যেন আচম্বিতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এর পরেই কয়েক গজ দূরে ঘাসের ওপর ধপ করে একটা ভারী জিনিস পড়ার শব্দ। তারপর সব চুপ।

মাথা তুললে প্রদীপ… এ রকম অবস্থায় সব পুরুষই যা করে। সারা গায়ে তখনও টনটনে বেদনা। অতিকষ্টে কাঁধ তুলতেই ও দেখতে পেলে… অদূরে মাটিতে সৃষ্টি হয়েছে একটা বিশাল গহ্বর। তখনও ধোঁয়া উঠছিল গহ্বরের ভেতর থেকে। আরও একটা একটা জিনিস দেখলে ও। ফুট দশেক দূরেই ধূসর সাদাটে বস্তুটা চিনতে কোন অসুবিধে হলো না ওর। রেণু-রেণু পাথরে ঢাকা পড়ায় কিম্ভুতকিমাকার দেখতে লাগছিল শম্-কে। প্রদীপের মনে হলো এর কানের রিমঝিম শব্দ এবার বুঝি মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে পড়ছে।

গড়াতে শুরু করে শম্। এগিয়ে আসে সোজা তার দিকে।

পিস্তলের আশায় আশপাশ হাতড়াতে থাকে প্রদীপ। কিন্তু কোথায় পিস্তল বিস্ফোরণের ধাক্কায় কোথায় যে ঠিকরে পড়েছে, খোঁজবারও অবসরও নেই…

মাত্র এক ফুট দূরে এসে গেছে শম্। দুই চোখ মুদে ফেলে প্রদীপ। সমস্ত শরীর হিতশীতল হয়ে যায় ধাতুর তৈরী আঙুলের স্পর্শে। আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরে ওকে, শূন্যে তোলে। বাধা দেওয়ার কোন ক্ষমতা ছিল না প্রদীপের অবশ দেহে। ইঞ্চি কয়েক উঁচুতে তুলে তাই ওর শিথিল শরীরটাকে কয়েকবার অদ্ভুতভাবে ঝাঁকানি দেয় শম্। থর থর করে কেঁপে ওঠে প্রদীপের সর্বাঙ্গ। অপেক্ষা করতে থাকে সেই ভয়ংকর সিরিঞ্জের, যে সিরিঞ্জের ভেতরে আছে নীল রঙের তরল পদার্থ। আর, মনের চোখে দেখতে পায় হলদেটে রঙের একটা টিকটিকির কুঁচকোনো মুখ—চোখের পাতা যার ঈষৎ কম্পমান।

তারপর, নির্বিকারভাবে, কোন রকম রূঢ়তার লক্ষণ না দেখিয়ে ওকে জমির ওপর নামিয়ে দেয় শম্। কয়েক সেকেণ্ড পরে চোখ খুলে ও দেখলে বর্তুলটা গড়াতে গড়াতে সরে যাচ্ছে ওর কাছ থেকে। নির্নিমেষ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে প্রদীপ।

মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তার পরেই সী প্লেনের ইঞ্জিনের শব্দ ভেসে এল ওর ওর কানে। চোখ খোলার পর ও দেখেছিল উদ্বিগ্নমুখে ওর ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুকোমল।

একরাতেই দশ পাউণ্ড ওজন কমে গিয়েছিল প্রদীপের।

[বিদেশী ছায়ায়]
‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার ‘সেপ্টেম্বর-জানুয়ারী ১৯৬৩’ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এই গল্পটি। ‘আশ্চর্য!’-এর সমস্ত লেখার বর্তমান প্রকাশক ‘কল্পবিশ্ব পাবলিকেশানস’-এর সৌজন্যে লেখাটি এবারের সংখ্যায় পাঠকের সামনে আবার নিয়ে এল ‘পরবাসিয়া পাঁচালী’।

মহাবিশ্বের ওপার হতে - বিশু দাস

অলংকরণ - মূল প্রচ্ছদ

দু হাত দূরে নজর চলে না এমন ঘন কুয়াশা। এমনি দিনে দেখা দিলো সেই ভয়াবহ অবস্থা।

সারাটা বিকেল ঘন কুয়াশা সাপের মত পাকিয়ে পাকিয়ে এসে জমা হতে লাগলো গোলা বাড়ীটার চারপাশে। ঘরের মধ্যে কেমন একটা ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। দরজার ফাঁক দিয়ে কুয়াশার রেখা ঘরের ভেতরে এসে নামছে নিঃশব্দ সরীসৃপের মত, তার বিশাক্ত জিভের ছোঁয়া এসে লাগছে মাথার চুলে। ভিজে ভিজে যাচ্ছে চুলগুলো।

ঠাকুমা’র সংখ্যা ন’শ’ - শ্রীধর সেনাপতি

অলংকরণ - মূল প্রচ্ছদ

আলোক দত্ত বয়সে যুবক। ভবিষ্যতে দারুণ উন্নতি করার সম্ভাবনা নিয়ে সে গ্রহাভিযানের কাজে নিযুক্ত হয়েছে। বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে যারা গ্রহ অভিযানে অংশ নেয়, আলোক দত্ত তাদেরই একজন। স্পেশাল অ্যাসপেক্টস ম্যান। তবে স্বভাবে একটু গোঁয়ার, মেজাজ কিছু পরিমাণে খিটখিটেও! সেই ছেলেবেলা থেকে এখন পর্যন্ত তার মুখে প্রধান একটাই প্রশ্ন : শুরু হয়েছিল কীভাবে? হ্যাঁ, প্রশ্নটা সে আজীবন করে আসছে। একগুঁয়ে মানুষ তো।

অভিযানে যারা বেরিয়েছে, তাদের সকলেরই নাম কী উচ্চারণে, কী অর্থে বেশ গুরত্বপূর্ণ। বেশ মানানসইও বটে! যে যার নাম পছন্দসই বেছে নিয়েছে। যেমন, ম্যানব্রেকার ক্র্যাগ! জজ ব্লাড! ট্রাবল ট্রেন্ট! কিন্তু আলোক দত্ত বাপ মায়ের দেওয়া নামের প্রতি তবুও বিশ্বস্ত। অবশ্যি পৃথিবীর একই অঞ্চলের মানুষ তারা নয়।

গোড়াতে ম্যানব্রেকার বলেছিল, ‘আলোক দত্ত-র মতো একটা মামুলী নাম নিয়ে কেউ কখনও হিরো বনতে পারে না।’ তারপর তার গলা থেকে যেন বাজের আওয়াজ শোনা গিয়েছিল, ‘আমাদের এই গ্রহাভিযানে তুমি একজন স্পেশাল অ্যাসপেক্টস ম্যান। আমরা তোমার জন্যে একটা নাম ঠিক করে রেখেছি। এখন থেকে ওই নামই ব্যবহার হবে।’

আলোক দত্ত ম্যানব্রেকারের ধমক থোড়াই কেয়ার করে। তবু কৌতূহল জেগেছিল। নামটা কী? শুধিয়েছিল চোখ নাচিয়ে হেসে।

ম্যানব্রেকার জবাব দিয়েছিল, ‘ব্লেইজ বোল্ট! অর্থাৎ দ্রুত ধাবমান আলোকচ্ছটা!’

‘না। আমার আসল নামই চালু থাকবে।’

‘তুমি বরাবর ভুল করে আসছো। নতুন নাম মাঝে মধ্যে একটা নতুন ব্যক্তিত্ব বয়ে আনবে। আমি তো আগে বেশ একটু ভীতুই ছিলাম। ম্যানব্রেকার নামটা নেবার পরই কোথা থেকে যেন একটা বেপরোয়া ভাব অনুভব করছি ভেতরে ভেতরে। মারদাঙ্গা খুনোখনিতে যে পটু, সে নামটা কেমন বেছে নিয়েছে দেখো। জর্জ ব্লাড়! হে হে। আর, ওই ট্রাবল্ ট্রেন্ট—’

‘থাক।’ আলোক দত্ত তাকে থামিয়ে দিয়ে জজসাহেবের রায় ঘোষণা করার মতো বলেছিল,

‘আমার নাম আলোক দত্তই থাকবে।’

 

উপগ্রহটি খুবই ছোট। নাম এ্যাসটারয়েড্-জিরো। কিন্ত, সবদিক দিয়ে উন্নতি করেছে চরম। বেশ কিছু দিন হয়ে গেল, অভিযাত্রীরা এখানে এসে পৌঁছেছে। থাকবে আরও কয়েকটা দিন। গ্রহবাসীদের সঙ্গে তাদের মস্ত একটা কনট্র্যাক্ট হয়ে গেছে। শুধু মুখের কথায় না। রীতিমতো দেশীয় ভেলভেটের মতো গাছের বাকলের ওপরে তারা লিখে দিয়েছে তাদের চুক্তিপত্র। গ্রহবাসীদের চুক্তির সর্তগুলো অভিযাত্রীরা ধরে রেখেছে নিজেদের প্যারাফেল টেপের বুকে। তারা গ্রহবাসীদের মনকে ইতিমধ্যে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে। বশ করেছে মিষ্টি মিষ্টি কথার ফাঁদে আর ব্যবহারে।

এখানে দুটো বাজার। খুবই জমজমাট। সারা জগতের অদ্ভুত যতসব জিনিসপত্র শুধু যেন এখানে এসেই জমে রয়েছে। পৃথিবীতে কত লাক্সারী ট্রেড করবে করো। তার জন্যে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারে অফুরন্ত মাল!

এদিক ওদিক ঘুরে দেখবার পর ম্যানব্রেকার বললো, ‘এসব তো গেল সাধারণ দিক। মিঃ ব্লেইজ্ বোল্ট! সরকারী সনদ অনুযায়ী তোমার কাজ ভিন্ন রকমের। আমাদের দলে তুমি স্পেশাল অ্যাসপেক্টস ম্যান। এই গ্রহ থেকে তোমাকে এমন কিছু বিশেষ খবর বা বস্তু জোগাড় করে নিয়ে যেতে হবে, যার সঙ্গে এই গ্রহবাসীদের সামাজিক সভ্যতা রীতিনীতি ইত্যাদির বিষয়গুলো জড়িয়ে রয়েছে। এখানে জ্যান্ত পুতুলগুলো দেখেছো? তাদের সম্পর্কে কি জানতে পেরেছো কিছু? পুতুলগুলোর যেমন একটা কালচারাল দিক রয়েছে তেমনি তাছে তাদের মাকেট ভ্যালুও!’

‘ওপর ওপর দেখে এক একটিকে জ্যান্ত পুতুল মনে হলেও, আমার সন্দেহ, এর গভীরে হয়তো কোন রহস্য রয়েছে।’ আলোক দত্ত বললো, ‘রহস্যের সমাধানও বের করতে হবে। এই গ্রহবাসীরা বলে, তাদের মৃত্যু নেই। তারা অজর অমর! কথাটা তোমরা শুনেছো নিশ্চয়। আমি মনে করি এদের ওই কথার মধ্যেই হয়তো রহস্যটির চাবিকাঠি কোনো রয়েছে।'

‘মিঃ ব্লেইজ্ বোল্ট! আমার কিন্তু ধারণা, এরা খুবই কম বয়েসে মারা যায়। পথেঘাটে দোকানে বাজারে তো শুধু যুবক যুবতীদেরই দেখা যাচ্ছে। বয়স্ক একজন মানুষও নজরে এলো না। তবে কি যুবক বয়স পার হলেই তারা ঘর থেকে আর বেরোয় না?’

আলোকদত্তর হঠাৎ খেয়াল হলো। আরে, তাইতো! তিনদিন ধরে দিকবিদিকে এত ঘোরাঘুরি করা হলো। কোথাও এমন একটা বিশেষ জায়গা তো নজরে এলো না, যেটাকে শ্মশান বা কবরখানা বলে চিহ্নিত করা যায়!

ম্যানৱেকার ফের বললো, এখানে বুড়োরা মারা গেলে বোধহয় তাদের কবর দেওয়া হয়।

‘কোথায় সেই কবরখানা? তুমি কি দেখেছো, মিঃ ম্যানব্রেকার?’ আলোক দত্তর কথায় ব্যঙ্গের সুর।

না! ম্যানব্রেকারও সেটা দেখেনি। মাথা নেড়ে সে জবাব দিল, ‘মৃতদেহটাকে হয়তো পুড়িয়ে ছাই করে বা বাষ্প করে বাতাসে উড়িয়ে দেয়। হয়তো নিজেদের পিতৃপুরষদের প্রতি এদের কোন শ্রদ্ধা নেই।’

‘না, মিঃ ম্যানব্রেকার! তোমার শেষের কথাটিতে আমার আদৌ সায় নেই। অন্যান্য প্রমাণ থেকে একথা আমার কাছে স্পষ্ট যে টয়্যাস্টারয়েডের অধিবাসীদের এনটায়ার কালচার এদের পিতৃপুরষের প্রতি সীমাহীন শ্রদ্ধার ওপরে প্রতিষ্ঠিত।’

‘বেশ। সব রহস্য খুঁজে বের করে তাহলে। তুমি স্পেশাল অ্যাসপেক্টস ম্যান, মিঃ ব্লেইজ বোল্ট। এ কাজটা তোমারই।’

নোকোমা এই টয়্যাস্টারয়েডের মানুষ। পণ্ডিত লোক। পৃথিবীর প্রায় সব মূলভাষা শিখে বসে আছে। আলোক দত্ত ইতিমধ্যে নোকোমার সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নিয়েছে। নোকোমার মনটা বেশ পরিষ্কার। আর খুব মিশুকেও। তাদের মুখের ভাষা মোটামুটি সহজ করে সে শিখিয়ে দিয়েছে আলোক দত্তকে।

‘আচ্ছা নোকোমা, এই গ্রহবাসীদের কারো কারো মুখে শোনা, তোমাদের নাকি মত্যু নেই। কথাটা কতদূর সত্যি?’ সযোগ বুঝে আসল প্রশ্নটা একদিন করে বসলো আলোক দত্ত। নোকোমা জবাব দিল হাসিমুখেই, ‘কতদূর সত্যি মানে কী? আমাদের—মানে এই গ্রহবাসীদের যদি মৃত্যুই হবে, তোমাদের কাছে এ কথাটা বলার জন্যে কেউ এখানে থাকতো না।’ বলেই হো হো করে খানিক হাসি। তারপর হাসি থামিয়ে ফের বললো, ‘না। আমরা মারা যাই না। আমাদের এলিয়েন কাস্টম হচ্ছে, নকল করা নয়। এটা অবশ্যি অপরের কাছে হাসির ব্যাপার মনে হতে পারে। টয়্যাস্টারয়েডে শুধু নীচুজাতের প্রাণীদের মত্যু ঘটে।’

‘তোমাদের কেউই মারা যায় না?’

‘না। না। একজন কেন এই নিয়মের বাইরে যাবে?’

‘কিন্তু তোমাদেরও তো বয়স বাড়ে। তোমরা খুব বড়ো হয়ে যাও। তখন কি করো?’

‘তখন আমাদের কাজকর্ম আস্তে আস্তে কমে আসে। শেষে একদম বন্ধ হয়ে যায়। দেহে আর শক্তি থাকে না। তোমাদের পৃথিবীর মানুষদের বেলাতেও তো এই নিয়ম, তাই না?’

‘নিশ্চয়। কিন্তু যখন তোমরা খুব বুড়ো হয়ে পড়ো, তখন কোথায় যাও?’

‘কোথাও না। তখন আমরা ঘরে বসে থাকি। কাজকর্ম করবে, ঘুরবে বেড়াবে বয়সে যারা যুবক, তারাই।’

আলোক দত্ত এখানে যেন কিছুটা থমকে গেল। ব্যাপারটা তার নিজের কাছেই ক্রমশঃ হেঁয়ালির মতো হয়ে উঠছে। পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে সে কী রিপোর্ট দেবে, এ গ্রহবাসীদের জন্ম আছে, মৃত্যু নেই! নোকোমাও তো এই অসম্ভব কথাটা আলোক দত্তকে বোঝাতে চায়। এখানে জন্ম আছে, মৃত্যু নেই। কিন্তু শুরু হয়েছিল কিভাবে?

‘নোকোমা, এবার একটু অন্য দিক দিয়ে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করা যাক।’ বিব্রত, প্রায় বিমূঢ়ও, আলোক দত্ত বললো, ‘তোমার বাবা মা কোথায়?’

‘বাইরে কোথাও বেরিয়েছে। তারা এখনও সত্যিকারের বুড়োবুড়ি নয়।’ নোকোমার মুখে মিষ্টিহাসিটি লেগেই রয়েছে আঠার মতো।

‘তোমার ঠাকুর্দারা? ঠাকুমারা?’

‘তাদের কেউ কেউ এখনও বাইরে। বেশী বুড়োরা রয়েছে বাড়িতে। একটা ফ্যামিলীর আমরা ইয়ঙ্গার ব্যাচ। আমার মনে হয় বাড়িতে আমার ঠাকুমা রয়েছে ন’শ’জন।’

‘ এ্যাঁ,’ শুনে রীতিমতো চমকে ওঠে আলোকদত্ত! ঠাকুমার সংখ্যা ন'শ! নোকোমা নিশ্চয় রসিকতা করছে। তার কথার আরও একটু ব্যাখ্যার দরকার। তবেই না বিষয়টা পরিষ্কার হবে!

আলোক দত্ত মজার গলায় শুধলো, ‘কী বললে? তোমার ঠাকুমার সংখ্যা ন’শ’!’

নোকোমার মুখে যেন একটা আলো পড়েছে। চোখ দুটো কী উজ্জ্বল। হাসি হাসি মুখে সে বললো, ‘আমাদের বংশের কারো কারো বংশধরের সংখ্যা আবার অগুনতি। তাদের বাড়িতেই তারা রয়েছে।’

‘এই বংশধরেরা সবাই বেঁচে?’ আলোক দত্ত কপাৎ করে খাবি খেল। অবিশ্বাস্য ঘটনা!

‘থাকবেই তো। সব কিছু কে না বাঁচিয়ে রাখতে চায়?’

দারুণ! দারুণ খবর! একটা চাপা উত্তেজনা আলোক দত্তকে ছটফটিয়ে দিল। ঘোড়ার মতো দু’বার তুড়ুক তুড়ক করে লাফ দিয়ে বলে উঠলো, ‘আমি কি তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারি?’

নোকোমা এবার সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। মনে মনে কী একটা ভেবে নিয়ে তাকে যেন সতর্ক করে দিয়ে বললো, ‘বয়সে সবার চেয়ে যে বড় তার সঙ্গে তোমার দেখা করাটা ঠিক বিজ্ঞের কাজ হবে না। টয়্যাস্টারয়েডে তোমরা ভিনগ্রহী। অচেনা আগন্তুক। তাই নানান আপত্তির কথা উঠবে। তবে অন্য দু’দশজনকে তুমি অবশ্যই দেখে যেতে পারো।’

ঠিক আছে। আলোক দত্ত তাতেই খুশী হবে। সে উৎসাহিতভাবে বললো, ‘নোকোমা, যদি তোমাদের কেউ কখনও না মারা যায়, তাহলে তোমাদের সম্পূর্ণ জাতিটাই এখনও পর্যন্ত বেঁচে আছে, তাই না?’

‘নিশ্চয়। একটা গাছে যেন ফল ধরে আছে। ফলগুলো গুণে দেখাও হয়েছে। একটাও গাছ থেকে খসে পড়েনি বা কেউ পেড়ে নেয়নি। সবগুলোই যথাযথ গাছে ঝুলে। এই রকম আর কী!’

‘কিন্তু যদি তোমাদের সর্বপ্রথম মানুষটা এখনও পর্যন্ত বেঁচে থাকে, তাহলে তো তোমাদের শুরু—সেই উৎপত্তির কথাটা তোমার জেনে নিতে পারো। শুরু হয়েছিল কী ভাবে? তুমি কি জানো, নোকোমা?’

‘না। আমি জানি না। আমাদের এখানে একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়, ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেবার পক্ষে আমার বয়সটা খুবই কম।’

‘তাহলে কে সেটা জানে? আসলে, জানে কি কেউ?’

‘হ্যাঁ, সব বুড়োবুড়িরা জানে।’

কৌতূহলে ছটফট করতে করতে আলোক দত্ত শুধলো, ‘বুড়োবুড়ি মানে? তোমার চেয়ে কত পুরষ পেছনের মানুষরা জানে এ সষ্টির রহস্য?’

‘দশ পুরুষ। তার বেশী না। যখন আমার ছেলেমেয়েরা দশ পুরুষে পৌঁছবে, তখনই ওই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার অধিকার জন্মাবে আমার! আমি তখন আমাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাবো!’

‘তোমাদের ওই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কথা যদি আমাকে আরও একটু খুলে বলো—’

‘বছরে একবার, সবচেয়ে বুড়ো মানুষদের কাছে আর সব বুড়োবুড়িরা যায়। তাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে জিজ্ঞাসা করে, কীভাবে শুরু হয়েছিল এসব! সবচেয়ে বুড়ো মানুষরা আমাদের উৎপত্তির কথা আর সব বুড়োবুড়িদের বলে। এটাই আমাদের প্রধান উৎসবের দিন। আনন্দ হৈ-হুল্লোড় হাসিগান। শুধু এইসবই চলে দিনভর। তারপর ফের ঘুমিয়ে পড়ে সবচেয়ে বুড়ো মানুষেরা। একবছরের জন্যে। অনেক পুরুষ ধরে এ রীতি চলে আসছে। এটাই আমাদের ধমীয় অনুষ্ঠান।’

 

টয়্যাস্টারয়েডের অধিবাসীরা আমাদের পৃথিবীর মানুষের মতো নয়। বাঁদরের মতো তাদের মুখের আদল। তারা সোজা হয়েই হাঁটে। পরে পা-ঢাকা ঢিলেঢালা লম্বা পোশাক, কোমরের কাছে বাঁধা। পোশাকের নীচের দিক লক্ষ্য করলে মনে হয় তারা দু’-পেয়ে প্রাণীই। যদিও ম্যানব্রেকারের এ সম্পর্কে এখনও কিছুটা সন্দেহ রয়েছে। সে বলে, ‘টয়্যাস্টারয়েডের এই মানুষগুলো ঠিক পায়ে হেঁটে বেড়ায় না। যেন গড়িয়ে যায়। হয়তো চাকার সাহায্যে চলে।’

তাদের হাতদুটো লক্ষ্য করার মতো। সারা হাত জুড়ে ছোট ছোট অনেক ভাঁজ। ওই হাত দিয়ে ইচ্ছেমত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে তো পারেই, উপরন্তু দরকার হলে খোদ হাতই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে একটা জটিল যন্ত্র হয়ে কাজে লেগে যায়।

জর্জ ব্লাডের মত : এই গ্রহবাসীরা সব সময়ে বাঁদরের মুখোস পরে থাকে। গ্রহাভিযাত্রী মানুষেরা তাই কখনও তাদের আসল মুখ দেখতে পায় না।

আলোক দত্ত নিজের আবিষ্কারের কথা অভিযাত্রী বন্ধুদের কাছে বলতেই তো তারা হো হো করে হেসে উঠলো।

ম্যানব্রেকার ব্যঙ্গ করে বললো, “মিঃ ব্লেইজ বোল্ট তার অভ্যাস মতো এখনও চিন্তা করে যাচ্ছে : শুরু হয়েছিল কীভাবে? আচ্ছা মিঃ ব্লেইজ বোল্ট, তুমি কি এখনও একথাটা ভুলতে পারোনি, কোনটা আগে এসেছিল—মুরগী, না ডিম?’

এসব কথা গায়ে মাখতে আলোক দত্ত’র বয়েই গেছে। সে জোরের সঙ্গে ফের তার বিশ্বাসের কথা বললো, ‘উত্তরটা আমি শীগগির পেয়ে যাবো। একটা চমৎকার সুযোগ এসেছে।’

ম্যানৱেকার বললো, ‘তুমি স্পেশাল অ্যাসপেক্টস ম্যান। কিন্তু সময় নষ্ট করছো রঙ অ্যাসপেক্টসয়ের পেছনে। শুরু কী ভাবে হয়েছিল, সেটা জানা বড় কথা নয়। এই গ্রহবাসীরা সবাই অমর থাকে, এ খবরটাই ইম্পর্ট্যান্ট।’

‘আমি কিন্তু এদের উৎপত্তিটাই আবিষ্কার করতে চাই।’ আলোক দত্ত বললো জোর গলায়।

ম্যানব্রেকার অতঃপর তর্ক জুড়ে দিল, ‘বোকার মতো কথা বলছো। তুমি কি বুঝতে পারছো না? উন্নততর বিজ্ঞান, তাদের প্রকৃতি বা স্রেফ বরাত জোর কীসের দৌলতে তাদের এই অবস্থা? এ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতে পারছি না।’

‘মনে হয় তাদের কেমিস্ট্রি।’

‘নিশ্চয়। এখানে অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রি এসেছে বহুকাল আগে। সবজাতের রসায়নই আছে এদের ভাঁড়ারে। নিজেদের শরীরকে এরা ইচ্ছে মত ছোটবড় করতে পারে। এই প্রাণীগুলোকে আমি স্টুপিড মনে করি। কিন্তু এদের এই অত্যাশ্চর্য শক্তিকেও তো স্বীকার না করে পারা যায় না। এই শক্তির পেছনে আসলে কোন রসায়ন কাজ করে, সেটাই আবিষ্কার করা দরকার। সেই দ্রব্য হাতে পেলে পেটেন্ট ওষুধ বানিয়ে আমরা জগৎজোড়া বাজারের অধীশ্বর হয়ে যেতে পারি, মিঃ ব্লেইজ বোল্ট। এ ব্যাপারে তখন আমাদের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী জুটবে না। কারণ এই টয়্যাস্টারয়েডয়ের অধিবাসীরা তাদের ঘর ছেড়ে কখনও কোথাও যায় না। যা হোক, আমার আরও ধারণা, এরা এদের শরীরের কোষগুলোকে সঙ্কুচিত প্রসারিত করতে পারে। আরও বিচিত্রতম কিছু করতে সক্ষম কিনা, কে বলবে?’

‘না। এদের শরীরের কোষগুলোকে এরা সঙ্কুচিত করতে পারে না। তোমার একথার কোন মানে হয় না, ম্যানব্রেকার।’

‘নেভার মাইণ্ড।’ ম্যানব্রেকার বললো, ‘চলিত প্রয়োগগত রসায়নের বোধহয় বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে এরা। তারও এখানে কোন মানে নেই। এখানকার ফারমাকোপিয়া যে-মানুষ তুলে নিয়ে যাবে, তার কখনও মৃত্যুর দরকার হবে না। সেই নাছোড়বান্দা ঘোড়ার পিঠেই তুমি এখন সওয়ার হয়েছো, তাই না? তবে বসেছো পেছন ফিরে। অর্থাৎ ঘোড়ার পিঠে তুমি ঘোড়ার ল্যাজের দিকে মুখ করে বসে আছো, মিঃ ব্লেইজ বোল্ট।’

‘হ্যাঁ। এ সম্পর্কে তারা স্থিরনিশ্চিত। যদি মারা যেতো, তাহলে তারা প্রথম জানতো। নোকোমা তাই বলে।’

‘বলো কী? এদের ভেতরে কৌতুকরসবোধও আছে তাহলে?’

আলোক দত্ত হাসিমুখে বললো, ‘কিছু কিছু। একমাত্র আমি এখন সেটা বুঝতে পারছি। এদের বিশ্বাস, এরা অমর! কথাটা মেনে নিলে, এটাও নিশ্চয় বিশ্বাস করতে হয় এদের আদি প্রাচীনতম মানুষটিও তাহলে এখনও বেঁচে। এদের কাছ থেকে আমি তাহলে জানতে পারবো এই প্রজাতির উৎপত্তির রহস্যটা।’

শুনতে শুনতে ম্যানব্রেকার যেন হঠাৎ ক্ষেপে উঠলো। নিজের চুল আর কান ধরে সেকী টানাটানি। সেইসঙ্গে দুমদাম করে দুরমুশের মতো পা ঠুকতে লাগলো মাটিতে। চেঁচাতে লাগলো ক্ষ্যাপাষাঁড়ের মতো—‘রহস্য! রহস্য! রহস্য! আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। শুধু রহস্যটা জেনে কী লাভ হবে? একটা প্রজাতির উৎপত্তি! চুলোয় যাক। ইউ ফু-উ-ল।’ অদূরে পাহাড় থেকে প্রতিধ্বনি ভেসে এলো, ‘ইউফুল!’

 

নোকোমার কাছ থেকে আগাম কোন আমন্ত্রণ ছিল না। আলোক দত্ত নিজেই গেল বাড়িতে। নোকোমা তখন বাড়িতে নেই। খবরটা জেনেই সে এ কাজটি করেছে। ছিঁচকে চোরের মতো চুপিসাড়ে ঢুকে পড়েছিল বাড়িতে।

টয়্যাস্টারয়েডে ন’শ’ ঠাকুমা সম্পর্কে নিজেই একটু খোঁজখবর নিয়ে জানতে চায় আলোক দত্ত এখানে জ্যান্ত পুতুল সম্পর্কে গুজবই বা কতদূর সত্য? নোকোমার সাহায্য ছাড়া নিজের চেষ্টাতে বিষয়টা জেনে নিতে পারলে ক্ষতি কী? এখানে মানুষ বুড়ো হলেও মারা যায় না। মৃত্যু কী, তারা জানে না। কিন্তু ব্যাপারটা যদি সত্যি হয় তাহলে এখানে বুড়োবুড়িরা কী কাজ করে? গ্রহটির এই প্রজাতির উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল, সে রহস্য এরা কেউ জানে কিনা, আলোক দত্তর এমন সব চিন্তাই প্রচণ্ড মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।

নোকোমাদের বাড়ি একটা বিশাল পাহাড়ের মাথায়। সমতল জায়গায়। পাথর মাটির সংমিশ্রণে তৈরী। অনেক বাড়ি কাছাকাছি ঝাঁক বেঁধে রয়েছে। তবে প্রতিটি বাড়ি দেখতে বেশ হিমছাম। বাড়িগুলোকে দেখে পাহাড়েরই একটা অংশ বলে ভুল হতে পারে।

প্যাঁচালো পাথরে রাস্তা দিয়ে আলোক দত্ত ওপরে উঠেছিল। নোকোমা তাদের বাড়িটা আগের দিন চিনিয়ে দিয়েছিল, তাই কোন অসুবিধা হয়নি। অবশ্যই চোরের মতো বাড়িতে ঢুকেছে সে। ঢুকেই এক ঠাকুমার সঙ্গে মুখোমুখি। ইনি ন’শ’ ঠাকুমার একজন! বসেছিলেন। আলোক দত্তকে দেখে মুখে তাঁর মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো। আলোক দত্তর সঙ্গে দু’চারটে কথাবার্তা হলো তাঁর। কাউকেই খুব একটা অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়নি। ঠাকুমার ভাষা বুঝতে তেমন আর কষ্ট নেই। নোকোমার কাছে আলোক দত্ত এই ভাষা শেখার পাঠ আগেই তো নিয়ে রেখেছিল।

ঠাকুমার ডাকে একজন ঠাকুর্দা এলেন। মিষ্টি হাসি তাঁরও মুখে। এই দুই প্রাচীন প্রাচীনার চেহারা যুবক আর কাজের মানুষদের তুলনায় কিঞ্চিৎ ছোট। পৃথিবীর শান্ত দয়ালু মানুষের মতো দেখতে। তবে একটা ঘুম-ঘুম বিষাদময় আবহাওয়া যেন ঘিরে রেখেছে মানুষ দুটিকে।

‘এখানে আপনাদের চেয়ে বুড়ো মানুষ আর কেউ আছে?’ আলোক দত্ত সম্ভ্রম দেখিয়ে শুধলো।

‘অনেক অনেক। সংখ্যায় ঠিক কত হবে, কে জানে?’ ঠাকুমা জবাব দিলেন। তাঁর ডাকে সেখানে এসে হাজির হলেন আরও অন্যান্য ঠাকুর্দারা। তাঁদের বয়স আরও বেশী। চেহারায় তাঁরা আরও খাটো। কিন্তু সকলের মুখেই সেই মিষ্টি হাসির ছোঁয়া। চোখে ঘুমঘুম ভাব। না, এদের কারো মুখে কোন মুখোস আঁটা নেই। এখন সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল আলোক দত্তর কাছে। ত্রিভুবনে এমন ওস্তাদ কারিগর কেউ নেই, যে এইসব ঠাকুমা ঠাকুর্দার মুখের নিখুঁত নকল করে মুখোস বসাতে পারে।

আলোক দত্ত প্রথম ঠাকুমাকে শুধলো, ‘যিনি বয়সে সবচেয়ে বড়ো, তাঁর বয়স এখন কত হবে?’

তাঁর জবাব, ‘আমরা বলি যে আমরা সবাই সমান বয়সের। কারণ আমরা সবাই চিরস্থায়ী। সকলেরই বয়স এক, এটা সত্যি নয়। তবে বয়সের হিসেব চাওয়াটা এখানে অভদ্রতা।’

না-জেনে না-বুঝে সেকি ঠাকুমা ঠাকুর্দাদের রাগিয়ে দিল? অলোক দত্ত সবিনয়ে বললো, ‘আমাদের পৃথিবীতে একটা জীব আছে। গলদা চিংড়ি। আপনারা তা জানেন না। সেই জীবটিকে যদি জলে রেখে জলটুকু খুব ধীরে ধীরে গরম করা হয়, তাহলে গলদা চিংড়িও খুশী খুশী ভাব নিয়েই গরমজলে এক সময়ে সেদ্ধ হয়ে যায়। একদম ভয় পায় না। কারণ সে জানে না ঠিক কত ডিগ্রী উত্তাপ তার পক্ষে বিপজ্জনক। এখানে আমিও পড়েছি প্রায় সেই রকমই ঝামেলায়। আপনাদের সঙ্গে আমিও এক ডিগ্রী থেকে আর-এক ডিগ্রীতে অবাধে চলে এসেছি। আমার সহজ বিশ্বাস নাড়া খায়নি। আপনাদের সম্পর্কে যে কোন বিশ্বাসের মধ্যে যদি সামান্যতমও বিপদ থাকে, তাহলে আমি তো সেই বিপদের মধ্যেই পড়ে গিয়েছি। যাই হোক, আপনারা যাঁরা এখন এখানে উপস্থিত, তাঁদের সকলের চেয়ে বয়সে বড় এমন আর-কেউ কোথাও আছেন নাকি?’

প্রথম ঠাকুমা আলোক দত্তকে ইসারা করলেন তাকে অনুসরণ করতে। আলোক দত্ত চললো। ঘরের মেঝের ভেতর দিয়েই একটা ঢালু পথ। নামতে হলো নীচের দিকে। বাড়ির অতি পুরনো অংশ সেটা।

 

আন্ডারগ্রাউণ্ডে জীবন্ত পুতুলের দল। সারি সারি তাকের ওপরে সাজানা। কুলঙ্গীর ভেতরে নিজের নিজের চেয়ারে বসে রয়েছে তারা। সংখ্যায় কয়েকশ’।

ঠাকুমার সঙ্গে আলোক দত্ত গিয়ে হাজির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুতুলদের অনেকেই যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলো। বাকীরা জেগে উঠলো তাদের কথার আওয়াজ শুনে বা হাতের ছোঁয়া পেয়ে। প্রতিটি পুতুলই অবিশ্বাস্যভাবে প্রাচীন। কিন্তু সদাসতর্ক—চোখমুখের ভাব দেখে বোঝা যায়। চোখে একটু ঘুম-ঘুম ভাব থাকলেও, ছোট্ট ছোট্ট ঠোঁটে মিষ্টি হাসি খেলা করে গেল আলোক দত্তকে দেখে। আলোক দত্ত কথা বললো তাদের সঙ্গে। কী আশ্চর্য! তারা পরস্পরকে ভালভাবে বোঝে।

এসব ব্যাপার লক্ষ্য করে আলোক দত্তর মনে একটু ভয় জাগলো। গলদা চিংড়ি! গলদা চিংড়ি! জলের উত্তাপ বিপদ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। পরিবর্তনটা চিংড়ি বুঝতে পারছে না। আলোক দত্ত মনে মনে আরও বললো, এই ঘটনায় যদি তুমি তোমার বোধশক্তিকে বিশ্বাস করো, তাহলে তুমি তোমার সহজ বিশ্বাসের মধ্যেই জ্যান্ত সেদ্ধ হয়ে যাবে!

এখন তার জানা হয়ে গেল, জ্যান্ত পুতুলগুলো কল্পনা নয়, বাস্তব। টয়্যাস্টাররেডয়ের বর্তমান অধিবাসীদের পূর্বপুরুষ এরাই।

ফের ঘুমিয়ে পড়লো অনেকেই। জেগে থাকায় সময়টা এদের খুবই কম। তবে ঘুমের চরিত্র একই রকম। আলোক দত্ত চলে আসবার আগে জীবন্ত ম্যমিদের অনেকেরই ফের একবার ঘুম ভেঙেছিল। ঘুম ভাঙলেই, স্বল্পক্ষণের জন্যে হলেও বেশ চনমনে হয়ে উঠেছিল। ছটফট করেছিল কথা বলার জন্যে।

চোখে দেখেও সহজে যেন বিশ্বাস হয় না। বিস্ময়ে অভিভূত আলোক দত্ত এক সময়ে বলে উঠলো, ‘অবিশ্বাস্য ঘটনা।’

শুনে তারা সক্কলে, ছোট, আরও ছোট, আরো আরো ছোটরা হাসিমুখে পৃথিবীর মানুষটির কথার অনুমোদন জানালো।

মানুষটি কৌতূহলে ছটফট করতে করতে বললো, ‘বয়সে সবচেয়ে বড় যারা, তারা কোথায়? একেবারে আদিতে যারা এসেছিল? আপনাদের প্রথমতম বৃদ্ধরা—

সেই প্রথম ঠাকুমা জবাব দিলেন, আমাদের বুড়ো মানুষ অনেক আছে। বুড়ো। আরো বুড়ো। আরো আরো বুড়ো। তারও চেয়ে বুড়ো। তবে আরও খোঁজাখুঁজি করাটা তোমার পক্ষে বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তুমি তো এখন পর্যন্ত যথেষ্ট দেখলে। বুড়ো মানুষদের অবস্থাটা স্রেফ ঘুমঘুম। চলো, এবার ওপরদিকে ওঠা যাক।

ওপরে উঠে যেতে হবে? এসব অবিশ্বাস্য ক্ষুদে ক্ষুদে জ্যান্ত পুতুলদের মাটির নীচের আস্তানায় ছেড়ে রেখে? এত তাড়াতাড়ি পারবে না আলোক দত্ত। এদিক ওদিকে অনেকগুলো পথ রয়েছে। সব পথই নীচের দিকে আরও গভীরে চলে গেছে। সেখানেও ওইরকম ঘরের পর ঘর। সংখ্যাহীন! ভেতরে আরও মৌচাকের মতো পথের প্রসার।
আলোক দত্ত এগিয়ে চললো। তার গতি থামাবে কে? ওই ক্ষীণদেহ পুঁচকে জ্যান্ত পুতুলগুলো? আলোক দত্ত যেন পৃথিবীর হিসেবে শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে যাচ্ছিল ওই শুঁড়িপথ দিয়ে। ওপরের স্তরে যেখানে আবহাওয়ার ভেতরে ছিল একটা পরিষ্কার গন্ধ, এখন পরিবেশে কেমন যেন ঘুম-ঘুম, হাসি-হাসি, বিষন্নতার সংমিশ্রণ! রীতিমতো উগ্র প্রকৃতির। সময় বা মহাকাল, এভাবেই গন্ধ ছড়ায়।

ঠাকুমার কাঠির মতো হাত শক্ত করে চেপে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে এসেছে সে। এবার ঠাকুমাকে শুধলো, ‘এখানে যারা আছে, তারা কি বয়সে আপনার চেয়ে বড়?’

ঠাকুমা জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ। বয়সে এতই বড় আর আকারে এমনই ছোট যে আমিও তাদের আমার হাতের চেটোয় ধরতে পারবো না।’

প্রতিটি ঘরে ক্ষুদে ক্ষুদে আর অতি বুড়ো প্রাণীদের নজরে আসতে লাগলো। হ্যাঁ, আলোক দত্ত এখন সেদ্ধ-হয়ে-যাওয়া গলদা চিংড়ি। নিশ্চয়ই! এ সব কিছু তাকে বিশ্বাস করতে হবে। নিজের চোখে দেখা অভিজ্ঞতা। নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি সহযোগে উপলব্ধি করা।

আলোক দত্ত একটি ক্ষুদে ঠাকুমাকে দু-আঙুল দিয়ে টুক করে তুলে নিল, ‘ঠাকুমা, এখানে কি আপনার চেয়েও বুড়ো মানুষ কেউ আছে নাকি গো?’

বলেই কান পেতে শুনতে পেল, ‘আছে বৈকি। তারা আকারে আমার চেয়েও ছোট। তুমি প্রায় শেষের কাছে চলে এসেছো, নাতি।’

তারপরই আলোক দত্তর দু-আঙুলের মধ্যে এই ক্ষুদে ঠাকুমাটির ঘুমন্ত শরীর ঝুলে পড়লো। ফের তাই বসিয়ে দিতে হলো তাকে তার নিজের জায়গাতে। এখানে যার বয়স যত বেশী, ঘুমও তার তত বেশী। | আরও নীচের দিকে নামতে নামতে আলোক দত্ত পাহাড়ের একেবারে মূলের কাছে পৌছে গেল। এখানের পথ নিরেট পাথরকাটা। সংখ্যাতেও অবশ্যি কম। কিন্তু সে যা হোক, টয়্যাস্টারয়েডের এই স্তরের প্রাণীগুলোকে খালি চোখে আর দেখা যাবে তো? ওপরের স্তর থেকে ছোট হতে হতে সব শেষ স্তরে কী চেহারা নিয়ে তারা পৌঁছেছে? তাদের সঙ্গে কি কথাবার্তা চালানো যাবে? আলোক দত্তর ভয়, হয়তো ওসব আর সম্ভব হবে না। তাহলে তো তাদের উৎপত্তি-রহস্য অন্ধকারেই রয়ে গেল।

কিন্তু নোকোমা কি বলেনি যে সব বুড়োবুড়িই সে রহস্য জানে? বলেছিল তো! তবে, আলোক দত্ত সেটা এদের বয়সে সবচেয়ে বুড়ো মানুষটির মুখ থেকেই শুনে যাবে আশা করেছিল।

‘সেই আদি প্ৰথমতম মানুষটি এখানে কে? থাকেন কোথায়? উঠুন। উঠুন। সাড়া দিন।’ সবচেয়ে নীচের তলার সবচেয়ে প্রাচীনতম ঘর বলে মনে হয়েছে জায়গাটিকে। তাই আলোক দত্ত অস্থির হয়ে কথাগুলো বললে।

‘এটা কি আমাদের বার্ষিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান?’ একজন ঘুম ভেঙে জেগে উঠে ক্ষীণতম গলায় প্রশ্ন রাখলো। চেহারা তার পৃথিবীর নেংটি ইঁদুরের চেয়েও ছোট। তবে মৌমাছির চেয়ে বড় নয়। আলোক দত্ত বললো, ‘এটা একটা বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। গোড়াতে কীভাবে শুরু হয়েছিল দয়া করে একটু বর্ণনা দিন।’

সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীণ একটা শব্দ শোনা গেল। তার কথা শুনে একযোগে হেসে উঠলো কি লক্ষ কোটি জীবাণু? আলোক দত্ত মনে মনে খুবই বিরক্ত। তবে কৌতূহলকে বশে রাখতে পারল না। সাগ্রহে ফের শুধলো, ‘বয়সে আপনাদের সকলের চেয়ে বড় কে? কে আপনাদের মধ্যে প্রথম?’

‘আমি!’ এবার চাপা গলায় বলে উঠলেন একজন, ‘আমিই হলাম এদের প্রথমা। প্রথম ঠাকুমা। আর সবাই আমার ছেলে মেয়ে। তুমিও কি আমার ছেলেমেয়েদের ভেতরে একজন?’

‘নিশ্চয়।’

‘তাহলে তুমিও হবে চূড়ান্ত সন্তান। কারণ আর সকলের মতো তুমি নও।’

‘গোড়াতে ছিল কেমন? আপনিই তো প্রথমা। তাহলে আপনি কি জানেন আপনার উদ্ভব কী ভাবে হয়েছিল?’ দারুণ উত্তেজনায় সর্বাঙ্গ কাঁপছিল আলোক দত্তর।

জবাব এলো, ‘জিনিসগুলোর আরম্ভের প্রণালী এতই মজার! একটা কৌতুক! স্রেফ একটা কৌতুক!’ বলে সবচেয়ে বড় ঠাকুমা হেসে তো কুটিকুটি।

‘তাহলে কৌতুকটাই আমাকে বলুন। যদি স্রেফ একটা কৌতুকই আপনাদের জাতির জন্ম দিয়ে থাকে, তাহলে সেই সৃষ্টি সংক্রান্ত কৌতুকটা কী, দয়া করে আমাকে একবার শোনান।’

‘সেটা তুমি নিজেই নিজেকে বলো।’ ঠাকুমা যেন টুংটাং করে বেজে উঠলেন, ‘যদি তুমি আমার সন্তানদের একজন হও, তাহলে তুমিও সেই কৌতুকের একটা অংশ। ওহ! এটা বিশ্বাস করাও খুব মজার। এই ঘুম থেকে জেগে ওঠা, হাসি তামাসা করা, তারপর ফের ঘুমিয়ে পড়া দারুণ লাগে।’

হতাশায় মনটা যেন পড়ে যায় অলোক দত্তর। প্রায় তীর ছুঁয়ে কি তরী ডুববে?

‘ফের ঘুমিয়ে পড়বেন না।’ আলোক দত্ত চেঁচিয়ে বললো, ‘শুরু হয়েছিল কী ভাবে? এখনি বলুন আমাকে।’ বলেই হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর ফাঁকে সে বন্দী করে ফেললো সর্বজ্যেষ্ঠা ঠাকুমাকে।

ঠাকুমার আপত্তি, ‘এটা বাষিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। ওই অনুষ্ঠানে তুমি তিন দিন ধরে রহস্যটা অনুমান করবে। আমরা হাসাহাসি করবো। বলবো,
না—না—না—! যা ভেবেছো তার চেয়ে ন’গুণ বেশী জটিল। বিষয়টা ভাবো, আরো আন্দাজ করো।’

‘না। তিনদিন ধরে আমি তা ভেবে দেখবো না। এখনি শুনতে চাই সেটা। না বললে আপনাকে আমি আমার হাতের মুঠোয় পিষে খতম করে দেব।’

রাগত কণ্ঠে ভয় দেখায় আলোক দত্ত। তবে গলায় জোর নেই। স্বরও কাঁপা কাঁপা।

‘তাকাও আমার মুখের দিকে। তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। তারপর যদি তুমি সেই অপকর্মটি করতে পারো, তাহলে একটা অবাক কাণ্ডই হবে।’ শান্ত মিষ্টি সুরে সর্বজ্যেষ্ঠা ঠাকুমা বললেন।

অভীযাত্রীদের যে কোন বেপরোয়া সদস্য ওই অপরাধটি খেলার ছলেই করে যেতে পারতো। তাদের হাতে একটার পর একটা জীবন্ত পুতুল খতম হয়ে যেত ওই রহস্যটি আবিষ্কার করার উদ্দেশ্য। বিবেক বোধের ধার ধারতো না। নাম আলোক দত্ত না হয়ে ব্লেইজ বোল্ট হলেই ওজনদার নামের গুণেই সেও হয়তো তেমন কাজ করতে পিছপা হতো না। যেমন ম্যানব্রেকার বলে থাকে, মানুষের নামের মধ্যেও নাকি বিশেষ ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটতে পারে।

‘বলুন। বলুন আমাকে।’ মনের মধ্যে নিদারুণ যন্ত্রণা নিয়ে আলোক দত্ত সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালো, ‘সারা জীবন ধরে জানতে চেষ্টা করেছি। শুরু হয়েছিল কীভাবে? যে কোন জিনিসের আরম্ভটা কীভাবে হয়? আপনি জানেন—’

‘আমরা জানি। যেভাবে এসব শুরু হয়েছিল, তা ভারী মজার ব্যাপার। নিদারুণ একটা কৌতুক। বোকার মতো, ক্লাউনের মতো, এমনি অদ্ভুত জিনিস। কেউ সেটা আন্দাজ করতে পারে না। বিশ্বাস করতে পারে না।’

‘আমাকে বলন। আমাকে বলুন।’ আলোক দত্তর মুখ ছাইরঙা। সে এখন প্রায় উন্মাদ।

‘না, না। তুমি আমার সন্তানের অংশ নও।’ সর্বজ্যেষ্ঠা ঠাকুমার অতি ক্ষীণ স্বরও যেন আনন্দে খল খল করে বাজলো, ‘বাইরের অচেনা কারো কাছে কৌতুকের কথা বলাটাও মস্তবড় এক কৌতুক! তাকে এমন মজার অবিশ্বাস্য কথা শোনানোর মানে তাকে অপমান করা। বহিরাগতদের মৃত্যু আছে। আমার কৌতুকের কথা শুনে বহিরাগত কেউ হাসতে হাসতে দম ফেটে মারা যাক, এটা আমার ইচ্ছে নয়। আমার বিবেকেরও সায় নেই।’

‘আমাকে বলুন। অপমান করুন। হাসতে হাসতে আমায় মরতে দিন।’
প্রায় মৌমাছি আকারের লক্ষ লক্ষ জীব হেসে উঠলো একযোগে। ওপর দিক থেকেও হাসির ঢেউ ছুটে এলো। বিচিত্র হাসির আওয়াজ। হাসির আওয়াজ! তারা হাসছে। এবং হাসছে। এবং হাসছেই! ওই হাসি ক্ৰমে সংক্রামিত হলো আলোক দত্তর মধ্যে। একটা অব্যক্ত অতৃপ্তির যন্ত্রণা বুকে নিয়ে সীমাহীন হতাশায় ভেঙে পড়া পৃথিবীর ওই মানুষটিও একসময়ে হাসি জুড়ে দিল হো হো করে।

মহাকাশযানের কাছে সে যখন ফিরে গেল, মুখে কোন কথা না বলে তখনও সে ওই রকমই হাসছিল।

[ আর. এ. ল্যাফাটির ‘নাইন, হানড্রেড গ্র্যান্ডমাদার্স' অবলম্বনে রচিত ]
‘ফ্যানটাসটিক’ পত্রিকার ‘বার্ষিকী ১৯৮৩’ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এই গল্পটি। ‘ফ্যানটাসটিক’-এর সমস্ত লেখার বর্তমান প্রকাশক ‘কল্পবিশ্ব পাবলিকেশানস’-এর সৌজন্যে লেখাটি এবারের সংখ্যায় পাঠকের সামনে আবার নিয়ে এল ‘পরবাসিয়া পাঁচালী’।

যামল - সুমিত বর্ধন

অলংকরণ : সুমিত রায় ও মিশন মন্ডল
ভূমিকা - পৃথিবী - একত্রিংশ শতাব্দী

পাণ্ডুর চাঁদ আলো দেয় সামান্যই, মাঠে বসানো রোশনি স্তম্ভের মধ্যেও অর্ধেক অকেজো হয়ে পড়েছে। সেই আলো আঁধারির মধ্যে একটা দানবিক ডাইনসোরের মতন দাঁড়িয়ে থাকে ল্যাণ্ডারটা। তার সামনের অংশ থেকে নিঃশ্বাসের মতন বেরিয়ে আসে বাষ্পের কুণ্ডলী।

ল্যাণ্ডারের একপাশ থেকে বেরিয়ে আসা র‍্যাম্পের দিকে মাঠের মধ্যে দিয়ে দৌড়য় আতঙ্কিত মানুষের দল। মাঠের চারপাশে লাগানো কাঁটা তারের বেড়া পার হয়ে তাদের দিকে মাঝে মধ্যেই ছিটকে আসে এনার্জী অস্ত্রের আলোক রেখা।

নিঝুম দ্বীপের রাজকুমার - রনিন

অলংকরণ - পার্থ মুখার্জী

(প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক ‘স্যর’ ম্যালকম রসের সহকারী কেন কোবার্নের লাইব্রেরি থেকে উদ্ধারকৃত একটি ডায়েরির কয়েকটি ছেঁড়া পাতা থেকে আহৃত আখ্যান—ম্যালকমকে পাঠানো ইংরেজি অনুবাদের আসল প্রতিরূপ।)

2nd April, 2088

(সময়ের হিসেব মেঘনাদ সেন এবং বৃতি সেনের তৈরী ‘সমান্তরাল সূর্যঘড়ি’ অনুসারে (হ্যাঁ, বাবা এবং মা, সত্যি ওটা নির্ভুল সময়ের হিসেবে দেয় এখনও!)

মন খারাপ।

হ্যাঁ, আজ আমার মন খারাপ।

এক যে ছিল রাজা - দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়

অলংকরণ : সুমিত রায় ও মিশন মন্ডল
(১)

সন্ধ্যে নামছে জঙ্গলের কোণায় কোণায়। পশ্চিমে আকাশ জুড়ে রঙের খেলাও প্রায় শেষের পথে, ঘন কালো রঙের পাতলা চাদর নেমে আসছে পৃথিবীর বুকে। অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল গাছগুলোর বেষ্টনী এড়িয়ে দ্রুত এগোচ্ছিল লোকটা। দক্ষিণে নদীর দিক থেকে একটা ভেজা দামাল হাওয়া ছুটে এসে ছোট্ট শিশুর মতো কচি হাতের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে চোখে মুখে।

শিবশঙ্কর মিষ্টান্ন ভান্ডার - সাগরিকা রায়

অলংকরণ - মৈনাক দাশ

পাঁচ বছর আগে আমাদের তারকমণি দত্ত লেনে একটি মিষ্টির দোকান খুলেছিলেন বিপ্রবাবু। খুব নাম ছিল দোকানের। কিন্তু দোকানটা ইদানিং আর মোটেই পয়া নয়। কেউ রটিয়ে দিল, ওই দোকানের মিষ্টি দিয়ে পুজো দিলে মা-কালী খুশি তো হনই না, ক্রুদ্ধই হন। শুনে গোপাল স্যার ছুটে এলেন দাদুর কাছে। দাদু মনমোহিনী বিদ্যাপীঠের সংস্কৃতের টিচার ছিলেন ছাব্বিশ বছর আগে। তখন মাধ্যমিকে কেউ কেউ সংস্কৃত নিত। দাদু সংস্কৃত জানেন, শাস্ত্রপাঠ করেন। এবং জ্যোতিষ জানেন। গোপাল স্যারের ছেলে মাধ্যমিক দিয়েছে। পরীক্ষার ঠিক আগের দিন ‘মায়ের ইচ্ছে’ কালীবাড়িতে গিয়ে পুজো দিয়েছেন গোপাল স্যার। সেই পুজোর প্রসাদ খেয়েই ছেলে গিয়েছে পরীক্ষা দিতে। এখন মা-কালী যদি শিবশঙ্কর মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি অপছন্দ করেন, তাহলে স্যারের ছেলের রেজাল্ট বোঝাই যাচ্ছে! স্যারের মা কেঁপে ঝুপে একাকার। গোপাল স্যার চিন্তায় যখন অর্ধমগ্ন, তখন স্যারের মা গলায় গমক তুলেছে—হ গুপাল, হুপায় কী হুপায় কী?

হুপায় মানে উপায় খুঁজতেই আমার দাদুর কাছে আসা গোপাল স্যারের। দাদু ভেবেচিন্তে বললেন—দাঁড়াও। অত হুড়োহুড়ি করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় না। আমি দেখছি। এই বলে গোপাল স্যারকে বিদায় দিয়ে দাদু নিজেই বিপ্রবাবুর মিষ্টান্ন ভান্ডারে গেলেন—হ্যাঁ বিপ্রবাবু, বলছি, সুগার ফ্রি মিষ্টি আছে কিছু?

বিপ্রবাবু মাথা নেড়ে নেড়ে খানিক ভাবলেন—সুগার ফ্রি? তা বললে হবে? আটা-ময়দায় কিছু পরিমাণ শর্করা রয়েছে। সম্পূর্ণ সুগার ফ্রি যাকে বলে, তা পেতে হলে আপনাকে একঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। আমার ল্যাবে আমি সম্পূর্ণ সুগার ফ্রি মিষ্টি বানিয়ে আনছি।

একথা শুনেই দাদু থ! মিষ্টির কারিগর রতন ঘুপচি ঘরে বসে মিষ্টি বানায়। সেই ঘর কিনা ল্যাব? গামছায় বেনারসির আঁচল? হে হে! দাদুর হাসি পাবেই। কারণ এই রতন কদিন আগেই জেলে গিয়েছিল। অপরাধ মোটেই ছিল না ওর। ময়দা, ছানা কিনে আনছে মিষ্টির জন্য। এমন সময় দেখে রাস্তায় খুব ভিড়। কারা সব চেঁচাচ্ছে –দিতে হবে! দিতে হবে! রতন ভিড়ের পাশ কাটিয়ে আসছে, কেউ একজন বলল—রতনা, সামনে দেখ, একখানা বাঁশ রাস্তায় পেতে রাখা আছে। ওটা ডিঙোলেই কিন্তু আড়ষ্ট হতে হবে। কেউ যাচ্ছেনা দেখছিস তো?

শুনে রতনের বুকে সাহসের খোল করতাল বেজে উঠল। কেউ যাচ্ছে না ভয়ে, রতনের তো ভয় নেই, দেখাতে এক লাফে বাঁশের গন্ডি পেরিয়ে যেতেই অবাক। আড়ষ্ট তো হল না! মাঝে থেকে পুলিশ এসে ধরে জেলে নিয়ে গেল কালো ভ্যানে চাপিয়ে। হ্যাঁ, ওই ময়দা আর ছানার কথা ভাবছ তো? ওগুলো সব রাস্তায় পড়ে ধুলিসাৎ! বিপ্রবাবু খবর পেয়ে রতনকে ছাড়িয়ে আনলেন এই কথা বলে যে, রতন আর কখনও আইন অমান্য করবে না। রতন তারপর থেকে বাঁশ দেখলে সাত হাত দূরে। এখন বাঁশটা আট হাত দূরে থাকলে কী হবে? সে আমি জানিনে বাপু। গল্পটা বলতে দাও।

তো, বিপ্রবাবু নিজেই দোকানের ভেতরে ঢুকে গেলেন। দাদু বাইরে অপেক্ষমান। খানিক পরে দোকানের চারপাশ মিষ্টি গন্ধে ভরে গেল। আর তারপরেই বিপ্রবাবু চৌকো চৌকো সাদা মিষ্টি এনে হাতে দিলেন। অবশ্যই সুদৃশ্য প্যাকেটে করে। আর একটি মিষ্টি শালপাতার বাটি করে দাদুর হাতে দিলেন—খেয়ে দেখুন, এটাই হল সুগার ফ্রি মিষ্টি। সুগারের সবটুকু এই পদার্থের ভেতর থেকে নিষ্কাসন করা হয়েছে। মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ পেয়েছেন কি? খানিক আগে? দাদু পরীক্ষার খাতা দেখার মত করে মিষ্টি চাখলেন। ও হরি! মিষ্টি কোথায়? স্রেফ অ্যান্ড স্রেফ স্বাদহীন, গন্ধহীন স্বপ্নে দেখা রাজকন্যে যে! যাকে দেখতে ভাল, কিন্তু অস্তিত্বই নেই! মানে সেই দেখার মত স্বাদ নেই । স্বপ্নে খাওয়া মিষ্টির মত একটি বস্তু মাত্র! একে কখনই মিষ্টি বলা যাবেনা। দাদু ভেবে নাম দিলেন—সৃষ্টি। বিপ্রর সৃষ্টি ডায়াবেটিকের জন্য। আসুন, বসুন সৃষ্টি খান। এইভাবে একটা ফ্লেক্স বানিয়ে দোকানের সামনে রাখার পরামর্শও দিলেন দাদু। কথাটা মনে ধরল বিপ্রবাবুর। অনেকক্ষণ দাদুর দিকে তাকিয়ে ভাবলেন আর ভাবলেন। দাদু কিন্তু বিপ্রর চোখের দৃষ্টি দেখে ভয় পেলেন। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে চণ্ডীপুজো করলেন। হে বিপদনাশিনী! রক্ষে কর! বিপ্রবাবু অমন করে তাকাচ্ছিলেন কেন? বড্ড ভয় ধরিয়ে দিয়েছে বিপ্রর দৃষ্টি! কিন্তু একটি কথা জানা হল না বলে দাদু বিকেলের দিকে হাতে পাঁচু গোপালের মন্দিরের তামার তাবিজ বেঁধে ফের গেলেন বিপ্রর মিষ্টান্ন ভান্ডারে। কারণ বিপ্রর চাউনিতে ভারি ভয় পেয়েছিলেন দাদু। দোকানে সবুজ আলো জ্বেলে বিপ্রবাবু একখানি ল্যাপটপ নিয়ে কী সব টাইপ করছেন। দাদু উঁকি দিয়ে দেখে মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝতে পারলেন না! এটা কী ধরণের অক্ষর রে বাবা? স্প্যানিশ নাকি? দাদু একসময় স্প্যানিশ শিখেছিলেন এক স্প্যানিশ সাহেবের কাছ থেকে। তিনি পরীক্ষা করার জন্য বললেন স্প্যানিশে—কে স এসতো? ইস ইস্প্যানিও? মানে হোয়াট ইজ দিজ? ইজ ইট স্প্যানিশ?

বিপ্রবাবু ল্যাপি থেকে মাথা না সরিয়ে স্প্যানিশে জবাব দিলেন—ইসতো এন হেবরিও।

শুনে তো দাদুর মাথায় হাত। শিবশঙ্কর মিষ্টান্ন ভান্ডারের দোকানদার কিনা স্প্যানিশ জানেই, হিব্রুও জানে! ওরে, এটা কী দেয় মিষ্টিতে যে মা-কালী অপছন্দ করছে? মুখে দিলে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে সে মিষ্টি! স্বয়ং পুরোহিত সন্তোষ চক্রবর্তী মশাই নিজের চোখে এই দৃশ্য দেখেছেন বলেই না সকলে জানতে পেরেছে! মনে মনে একথা ভাবছেন দাদু, দেখা গেল বিপ্রবাবু টেলিপ্যাথিও জানেন। মুচকি হেসে বললেন—ছানাটা আমাদের বিশেষ ধরণের গরুর দুধের কিনা। মায়ের অচেনা। কটাদিন খেলেই মুখে রুচে যাবে। এখন অ্যাবজর্ভ হচ্ছে না!

দাদুর হঠাৎ করে রাগ হয়ে গেল। বিপ্রর মধ্যে বেশ একটা পাকামি রয়েছে। কলেজের ছেলেরা এই পাকামিকে আঁতলামি বলে। আঁতেল শব্দটা ফ্রেঞ্চ শব্দ। মানে বুদ্ধিজীবী । ইংরেজিতে যাকে বলে ইন্টেলেকচুয়াল। তো বিপ্রকে একহাত নিতে ইচ্ছে হল দাদুর। বেশ গম্ভীর হয়ে জানতে চাইলেন—আচ্ছা, বিশেষ ধরণের গরু মানে? চারটে ঠ্যাং আছে?

বিপ্র অবাক—চারটে? ছটা বলুন। ছয়টা ঠ্যাং।

—হুর, এমন আবার হয় নাকি? দেখান তো!

—সেটি হচ্ছে না। খেতে ইচ্ছে হলে দুটো খেয়ে দেখুন। বিপ্রবাবু মাথা নেড়ে নেড়ে হু হু করে গান করেন।

এসবের পরে আমার দাদু ভারি মুষড়ে পড়েন। বাড়িতে ফিরে এসে হাত পা ধুয়ে আরাম কেদারায় বসে ভেবে চললেন। আজ বিপ্রর মধ্যে একটা কী রকম যেন ব্যাপার দেখলেন! বেশ অদ্ভুত লাগল বিপ্রবাবুকে। ছয় ঠ্যাঙের গরুর দুধের কথা বলল ঠিকই, কিন্তু তেমন গরু সাত জন্মেও দেখেননি দাদু। শোনেননিও। বিপ্রবাবুর এত সাহস যে তাঁর মত সম্মানীয় মানুষের সঙ্গে ইয়ার্কি করে? দুঃখ হল। আমি সামনের টেবিলে বসে পড়ছি, দাদু আমাকেই খুলে বললেন। আগাগোড়া সব। আমি দাদুকে সাহস দিলাম—ওসব লোকের কথায় কিছু মনে কর না দাদু। তোমাকে সবাই এখানে রেস্পেক্ট করে। উনিও। আজ হঠাৎ কেন মজা করার সাহস পাবেন? এমন হতে পারে উনি মজা করেননি? হয়তো ওঁর গরুটার সত্যিই ছয়টি পা? মাদারিহাটে একবার দেখেছিলাম পাঁচ পা-ওলা গরু। সেই গরু দেখিয়ে গরুর মালিক টাকা তুলছিল! আর কত পুঁতির মালা দিয়ে সাজিয়েছিল গরুটাকে! ধর, তেমন যদি হয়?

দাদু মাথা নাড়েন—ওটা লোক ঠকানো ব্যবসা। একটা পা অপারেশন করে পিঠে জুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু তাতে তো আর গরুর দুধ পালটে যাবে না!

হুম। সেটাও কথা। আচ্ছা, আমি চুপচাপ দেখছি। এখনই দাদুকে কিছু বলার দরকার নেই।

পরের দিন থেকেই আমি অবজার্ভ করতে শুরু করলুম। সাধারণত বিপ্রবাবুর দোকানে খুব ভিড় হয়। সারাদিনই ভিড়। ইদানিং ভিড় কমতির দিকে। মিষ্টি বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়ার মত ভিড়টা আর নেই। বরং পাশের পার্বণ মিষ্টান্ন ভান্ডারে সেই ভিড়টা ঢুকে গিয়েছে। ভাবলুম, শিবশঙ্করের জিলিপির দারুণ স্বাদ। জিলিপি কিনে দেখি, স্বাদ আগের মতই আছে কি-না।

বিপ্রবাবুকে দেখলুম ক্যাশে বসে টাকা গুনছেন। দুটো লোক দাঁড়িয়ে ঠোঙা গুছিয়ে রাখছিল। প্ল্যাস্টিকের ঠোঙা আর চলে না। এখন সব দোকানে কাগজের ঠোঙা। দিদু তাই কয়েকটা ভাল দেখে প্ল্যাস্টিকের ঠোঙা যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছে—কি জানি, কখন আবার দরকার হয়, বলে। আমি গিয়ে দাঁড়াতেই তিনজনই চোখ তুলে তাকাল। ভাবটা—কী চাই? গোছের।

দেড়শো গ্রাম জিলিপি নিয়ে দোকানের একটি টেবিলে বসেছি। বেশ লালচে রঙের গরম জিলিপি দেখে জিভে জল এল। একটা জিলিপি তুলে কামড় বসালাম। চিনির রস গড়িয়ে পড়ল হাত বেয়ে। কিন্তু… ছ্যা ছ্যা! এ কেমন জিলিপি? একফোঁটা মিষ্টি নেই! ফ্যাসফেসে স্বাদ! না মিষ্টি, না ঝাল, না টক…কিছুই নেই এই জিলিপিতে! এমন জিলিপি আমি কখনও খাইনি! ছিঃ! কী বিশ্রি স্বাদ! আমার অবস্থা হল, কমলের কাজিন বিধুদার মত। বিধুদা বিয়ে করেননি। বিয়ের বয়স পেরিয়ে যেতে তাঁর আফশোস হল। কিন্তু তখন আর পাত্রী কোথায়? এদিকে কমলের বিয়ে হল। বিয়ের পরে মিন্টুদা বিধুদাকে জিজ্ঞাসা করেছে—কমলের বউ কেমন হল বিধু? বিধুদা সড়াৎ করে জিভে ঝোল টেনেছেন—‘আর বল না! এক্কেবারে রাজভোগ! কিন্তু…!’ আমার এখন জিলিপি মুখে দিয়ে সেই ‘কিন্তুটা’ মনে পড়ল। এসব কথা শুনেছি মিন্টুদার ভাইপো টুলুর থেকে। টুলু আমার ক্লাসমেট। জিলিপি দেখতে দারুণ, কিন্তু এই জিনিস তো আমার সেই জিলিপি নয়! এতো স্বপ্নের সেই জিনিস। দেখতে পারছি, কিন্তু স্বাদ নিতে পারছি না! কিছু বলব ভেবে তাকিয়ে দেখি বিপ্রবাবু কখন দোকান থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। গেলেন কোথায়? খাবারের দাম নিয়েছেন অথচ এই বাজে মিষ্টি সার্ভ করছেন? অভিযোগ করতেই হবে। উনি পালিয়ে যাবেন কোথায়? দোকানের স্টাফ দুজনের একজন ঘুমোচ্ছে চেয়ারে হেলান দিয়ে। আরেকজন বাইরে দাঁড়িয়ে ঝাড়পোঁছ করছে। আমি দেখলাম দোকানের ভেতরে যাওয়ার একটি দরজা রয়েছে। চারপাশে তাকিয়ে টুক করে সেই দরজার ভেতরে ঢুকে গেলাম। ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম। ভেতরে একটা বিশাল বড় অ্যাকোয়ারিয়াম। কত রকমের মাছ সেই জলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের বাড়িতেও আছে অ্যাকোরিয়াম। আমি মাছ চিনি। গোল্ড ফিস, টাইগার শার্ক, কমেড, আঞ্জেল, সোর্ড, ডিসকাস মাছ…! এত্তবড় অ্যাকোরিয়াম আমি এই প্রথম দেখলুম। এখানে, এই অন্ধকারে এত্তবড় অ্যাকোরিয়াম রেখেছেন কেন বিপ্রবাবু? কিন্তু উনি এখানে নেই মানে অন্য কোথাও গিয়েছেন? এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে এলাম। এসে টেবিলে বসে জিলিপি নাড়াচাড়া করতে করতে দেখলুম, বাইরে থেকে বিপ্রবাবু এসে দোকানে ঢুকছেন। আচ্ছা, উনি বাইরে গিয়েছিলেন?

আমি জিলিপিগুলো খেতে পারিনি, সেকথা বিপ্রবাবুকে বলে দিলাম। এটাও বললাম, আগে এই দোকানের জিলিপি কত ভাল ছিল। এখন কেন এমন বিশ্রি স্বাদ?

বিপ্রবাবু অবাক অবাক চোখে তাকালেন—তাই নাকি? আমিও শুনতে পাচ্ছি, ইদানিং নাকি আমার দোকানের মিষ্টির স্বাদ নষ্ট হয়ে গিয়েছে! জানি না বাপু, কেন এমন হচ্ছে! আচ্ছা, আমি দেখছি। কাস্টমারের দিকটা আমার দেখাই তো উচিত। বলে বিপ্রবাবু চিন্তিত মুখে দোকানে ঢুকে গেলেন। আমি আর কিছু বললাম না। বাইরে বেরিয়ে এলাম। বিপ্রবাবু নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন এটাই যথেষ্ট। আর একটি ব্যাপার দেখে ভাল লাগল। দাদুর সঙ্গে বিপ্রবাবু যেমন ব্যবহার করেছেন, এখন কিন্তু ব্যবহার পালটে গিয়েছে। সবাই অভিযোগ করছে বলে উনি মাথা ঠান্ডা করেছেন, এমন হতে পারে!

আমি দোকান থেকে বেরিয়ে ভজাদার দোকান পেরিয়ে যেতে যেতে দাঁড়ালাম। ভজাদার একটা বিরাট অ্যাকোয়ারিয়াম আছে। একটু দেখি গিয়ে।

সত্যি বড় আকোরিয়াম। কিন্তু বিপ্রবাবুর অ্যাকোয়ারিয়াম অনেক বড়। ভজাদা দুশো টাকায় টাইগার শার্ক কিনেছে। হালকা কালো রঙের রূপচাঁদ মাছ আছে। এছাড়াও ব্ল্যাকমূর, অস্কার ফিস দেখলাম। বিপ্রবাবুর অ্যাকোয়ারিয়ামে আরও কিছু অচেনা মাছ দেখেছি। আজকাল কত নতুন ধরণের মাছ আসছে ! ভজাদা প্ল্যাস্টিকের ঘাস, গাছ, ম্যাট, সিলিকন কোরাল দিয়ে সুন্দর সাজিয়েছে অ্যাকোয়ারিয়াম। আমার এত রকমের মাছ নেই। তবে আর সব আছে। একটা এল ই ডি লাইট লাগানো আছে। বিপ্রবাবুর অ্যাকোয়ারিয়ামে সবুজ আলো দেখেছিলাম! দোকানেও সবুজ আলো ছিল! বিপ্রবাবু সবুজ আলো ভালবাসেন তাহলে!

ভজাদা হেসে বলল—দেখা হয়ে গেল? জল পালটাস তো বাড়ির অ্যাকোয়ারিয়ামে?

—হ্যাঁ ভজাদা। বলে দোকান থেকে নেমে এলাম। বাড়িতে যাব। দাদুর সঙ্গে কয়েকটা কথা নিয়ে আলোচনা আছে। মনের কোণে খিচ ধরে আছে! কিছু একটা অদ্ভুত লাগছে। যেটা আমার চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু মন ঠিক বুঝেছে। সেটা কী জানতে হবে।

বাজার পেরিয়ে গলিতে ঢুকে পড়েই চমকে উঠলাম। আমার খানিকটা আগে আগে বিপ্রবাবু গলি থেকে বেরিয়ে গেলেন। এইমাত্র দোকানে ছিলেন! এখন আবার এদিকে কোথায় যাচ্ছেন উনি? আমি প্রায় দৌড়ে গিয়েও ওঁকে ধরতে পারলুম না। কোথায় গেলেন, বুঝতেই পারলুম না। আশ্চর্য তো!

আমাকে এখনই দোকানে যেতে হবে। দেখব দোকানে উনি কখন ফেরেন। আমি ফের বিপ্রবাবুর দোকানে গেলাম। দেখি, দোকানে সবুজ আলো ছড়িয়ে আছে। বিপ্রবাবু ল্যাপি খুলে কাজ করছেন! তাহলে গলি দিয়ে বেরিয়ে উনি দোকানে এসেছেন? এত তাড়াতাড়ি? আমি কি দোকানে ঢুকব? কী বলব ঢুকে? আমার কাছে পয়সাও নেই যে মিষ্টি কিনতে এসেছি বলব! কী করি? হুমম! একটু চিন্তা করে দেখি…! আচ্ছা, বিপ্রবাবু কেন একটি রহস্যময় মানুষ হয়ে উঠলেন আস্তে আস্তে! আগেও ওঁকে দেখেছি। জন্ম থেকেই দেখছি। অথচ সেই পুরনো বিপ্রবাবু খুব দ্রুত পালটে গিয়েছেন। দেখি, আরেকবার । উনি কি এখনও ল্যাপি নিয়ে বসে আছেন? দোকানে উঁকি দিয়ে দেখতেই সাঙ্ঘাতিক চমকে উঠেছি। উফ! লোকটা ফের গেল কোথায়? নিশ্চয় ভেতরে গিয়েছেন! কারণ এখন উনি বাইরে মোটেই আসেননি। আমি নিজেই বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। বাইরে যদি আসতেন, আমি দেখতে পেতামই। উনি অবশ্যই দোকানের ভেতরের দরজাটা দিয়ে গিয়েছেন। আমি যাব। দেখব, ওই দরজা দিয়ে বিপ্রবাবু কোথায় যান!

দোকানে ঢুকেই তাড়াহুড়ো করে ভেতরের দরজার কাছে চলে এলাম। এখন দোকানে গোটা ছয়েক কাস্টমার আছে। এসময় সিঙ্গারা ভাজা হয়। কাস্টমার নিয়ে ব্যস্ত বলে আমাকে কেউ লক্ষ করেনি। আমি ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ঘরটা ভারি অন্ধকার! অ্যাকোয়ারিয়ামের ভেতরে জল চকচক করে নড়ছে। মাছেরা হুটোপুটি করছে। গোল্ড ফিসগুলো একেবারে কর্নারে এসে চুপ করে আছে! নট নড়নচড়ন!

ঘরের মধ্যে কোথাও কিন্তু বিপ্রবাবুর ট্রেস নেই! অদ্ভুত কান্ড! আচ্ছা, অন্য কোন দরজা কি আছে এখানে যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না?

ঘরটা ছোট। অর্ধেকটা জুড়েই আবার অ্যাকোয়ারিয়াম। তাহলে বিপ্রবাবু কোথায়?

এইসময় আমি দেখলাম, গোল্ডফিস দুটো যেন ভয় পেয়েছে এমন ভাবে ছুটোছুটি করছে! আকোরিয়ামের পেছনের দিকের কাচের গায়ে একটা নীল দাগের কাছে ওরা যাচ্ছে বারবার। অবাক কান্ড। এরকম দাগ কেন? কীসের দাগ ওটা? তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখতে পাচ্ছি দাগটা আস্তে আস্তে বড় হয়ে যাচ্ছে! ক্রমশ ফাঁক হয়ে গেল। যেন কাচের গায়ে একটা দরজা খুলে গেল! সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন বিপ্রবাবু! মাছেদের মত সাঁতরে উনি বেরিয়ে এলেন অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে। আমি লুকিয়ে পড়তে পেরেছিলাম বলে উনি দেখতে পেলেন না! বাইরে এসে গা মুছে জামাকাপড় চেঞ্জ করে দোকানে ঢুকে গেলেন। আশ্চর্য! দেখি, অ্যাকোয়ারিয়ামের ভেতরের নীল দাগটা ফের জোড়া লেগে গিয়েছে।

এবারে আমি আস্তে আস্তে নেমে গেলাম অ্যাকোয়ারিয়ামে। পায়ের পাতায় জলের স্পর্শ পেলাম। জল খুব ঠান্ডা নয়। আস্তে আস্তে জলের ভেতর নেমে দেখছি, জল বেশ গভীর। সাঁতরে নীল দাগটার কাছে এলাম। নীল দাগটা খুলে যায় কী করে? আঙুল দিয়ে টাচ করলাম। কিন্তু কিচ্ছু হল না। কী করব ভাবছি, হঠাৎ গোল্ডফিস দুটো সাঁতরে নীল দাগের কাছে এসে ঝাপটা মারতেই কাচ ফাঁক হয়ে গেল! প্রথমে অল্প, পরে একজন মানুষ ঢোকার মত । কিন্তু সেই ফাঁক দিয়ে জল বেরিয়ে গেল না! জল ওখানে, ওই নীল দাগের কাছে এসে স্থির। যেন জেলি। আমি সেই জল মেখে ঢুকে গেলাম নীল দাগের ভেতর দিয়ে। যেখানে ঢুকেছি, সেখানে জল নেই। শুকনো একটা সরু সবুজ আভাযুক্ত গলিপথ ধরে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে আমার যেন শরীর বলে কিছু নেই! হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছি। যেতে যেতে একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। কেউ একজন উল্টোদিক দিয়ে আসছে! কে? এই গলিপথে লুকিয়ে পড়ার মত জায়গা নেই। কী করব? নাহ, কিচ্ছু করার নেই। যা আসুক, মুখোমুখি হতে হবে।

আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। পায়ের নীচে মাটি নেই। কিছুই নেই, যেন বাতাসে ভর করে দাঁড়িয়ে আছি। যে আসছিল, বা যা আসছিল, সে-ও দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি কথা বলে উঠলাম। কেন যে কথা বললাম জানি না। আসলে ভয় আঁকড়ে ধরেছিল আমাকে তীব্রভাবে। ভয়েই চেঁচিয়ে উঠেছি—কে ওখানে? বিপ্রবাবু?

বিপ্রবাবুর নামটাই মাথায় ঘুরছিল বলে ওই নামটাই আগে মাথায় এল। আশ্চর্যের বাকি ছিল আরও। উল্টোদিক থেকে খুব চেনা গলায় কে বলে উঠল—বিপ্রবাবু?

—কে? বিপ্রবাবুকে চেন?

—চেন? যেন প্রতিধ্বনি হচ্ছে।

—চিনি। এই পথে বিপ্রবাবু যাতায়াত করেন। মিষ্টির দোকান থেকে। বলতে বলতে আমি এগিয়ে গেলাম। সে-ও এগিয়ে আসছে। আমরা এবারে মুখোমুখি। আমি সেই সবজে আলোর ভেতরে যেটুকু দেখতে পাচ্ছি, তাতে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি। আমার অপোজিটে যে দাঁড়িয়ে, সে হুবহু আমিই! যেন আয়নায় নিজেকে দেখছি। দেখতে দেখতে অভূতপূর্ব অনুভূতি দিয়ে বুঝতে পারছি, আমি হয়তো অন্য দুনিয়ার আমিকে দেখছি! সমান্তরাল পৃথিবীর আরেকটা আমি! আমাদের ক্লাসে স্যার এই বিষয়ে বলেছিলেন—ব্ল্যাক হোলের ওপরে আমাদের এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মত আরেক অবিকল মহাবিশ্ব আছে। ওখানে যা আছে, সব এই পৃথিবীর ট্রু কপি। প্রত্যেকটি প্রাণীর কার্বন কপি আছে ওখানে! এই তাহলে আমার কার্বন কপি? বিপ্রবাবু তাহলে সমান্তরাল পৃথিবীর মানুষ। এই বিশ্বে ঢুকে পড়েছেন। অন্য দুনিয়ার খাবার নিয়ে এসেছেন, যা এই দুনিয়ার মুখে রুচছে না! তাহলে এই দুনিয়ার বিপ্রবাবু কোথায়? এখানে প্রবেশ করে এখানকার বিপ্রবাবুকে সরিয়ে দেওয়ার ছক কষা চলছে? আসল বিপ্রবাবু বুঝতেই পারছেন না, তাঁর দোকানে অনুপস্থিতির সময় অন্য একজন বিপ্রবাবু জাঁকিয়ে বসেছেন! এবং ব্যবসার সর্বনাশ করছেন! আমাকে ফিরে যেতে হবে। বিপ্রবাবুকে ফিরিয়ে দিতে হবে তাঁর জায়গায়। নিজের নিজের পৃথিবীতে ফিরে যাবে বিপ্রবাবুদের।

—আমরা ফিরে যাচ্ছি নিজের নিজের জায়গায়। সমস্বরে বলে উঠলাম আমি ও আমার কার্বন কপি। আমি যা ভাবছি, সে সেটাই ভাবছে। আমরা ব্যাক করলাম। জানিনা, সমান্তরাল দুনিয়ার সেকেন্ড বিপ্রবাবুর এই দুনিয়ায় আসার জন্য কি অ্যাকোয়ারিয়াম আছে? সেই অ্যাকোরিয়ামের ভেতর দিয়েই কি আমার কপি এখানে চলে এসেছিল? বিপ্রবাবু প্রথমে কীভাবে আমাদের দুনিয়ায় ঢুকলেন? এই অ্যাকোরিয়ামের ভেতর দিয়েই পথটা আছে, উনি জানতেন!

হয়তো জানতেন না । আবিষ্কার করেছিলেন কোন এক অজানা সময়ের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এই পৃথিবীতে এসে ফিরে যেতে মন চায়নি তাঁর। চেয়েছিলেন এখানে রয়ে যেতে। অথচ আমাদের বিপ্রবাবুর মাথায় কেন এই ব্যাপার এল না? উনি কেন সমান্তরাল পৃথিবীর পথ খুঁজে পেলেন না? যদি সবটাই কার্বনকপি হয়? এটাও হওয়া উচিত ছিল। কার্বন কপির একজন যেটা ভাবছে, অন্যজনেরও সেটাই ভাবা উচিত!

আমি সাঁতরে বেরিয়ে এলাম বাইরে। আজ আবার সেকেন্ড বিপ্রবাবু অন্য পৃথিবীতে যাবেন। আমি লুকিয়ে বসে রইলাম। সুযোগ চাই। যদি আমার কার্বন কপি আমার মত করে কাজটা করতে পারে, তাহলে আর ভয় নেই এই বিশ্বের বিপ্রবাবুর।

অনেক রাতে সেকেন্ড বিপ্রবাবু অ্যাকোয়ারিয়ামে নামলেন। নীল দাগের কাছাকাছি গিয়ে কাচ ফাঁক হতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এবারে উনি নিশ্চয় সেই সরু সবুজ আভাযুক্ত গলিপথে…! অ্যাকোয়ারিয়ামের সব জল বের করে দিলাম। মাছগুলো ছটফট করতে করতে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে একসময় মরে গেল। তারপর অ্যাকোয়ারিয়ামটার পেছনের কাঁচে আস্তে আস্তে আঘাত করে চিড় ধরিয়ে ফেলে একবার চিড়ের মধ্যে জোরে আঘাত করতে কাচ ফেটে চুরমার! মাছগুলোকে মরতে হল! কিচ্ছু করার ছিল না আমার!

বিপ্রবাবুর কপি আর ফিরতে পারবেন না এই দুনিয়ায়।

পরদিন সকালে মিষ্টি কিনতে গিয়েছি। দেখি, হরু যাদব এসেছে ছানা দিতে। দোকানে ভারি মিষ্টি গন্ধ বের হচ্ছে! রসগোল্লা জ্বাল হচ্ছে। একটু ওয়েট করলে গরম রসগোল্লা পাব। ততক্ষণ বসে না থেকে জিলিপি খাই। দেখি স্বাদের বদল হল কি-না।

গরম জিলিপিতে কামড় বসাতেই মিষ্টি গরম রসে মুখ ভরে গেল। শিবশঙ্কর মিষ্টান্ন ভান্ডারে ফের ভিড় জমে উঠছে! বিপ্রবাবু হাসলেন—আজ মিষ্টি ভাল হবে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করিয়েছি। মা-কালীরও পছন্দ হবে। গ্যারান্টি।

মিষ্টি নিয়ে ফিরে আসছি। এই বিপ্র নিজের জায়গা ফিরে পেল। ওই বিপ্র? সে কি নিজের দোকানটা খুলেছে আজ? খুলেছে নিশ্চয়। হিসেবমত আমার কার্বন কপিরও এখন মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা।

মানবী - অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

অলংকরণ - প্রতিম দাস

“নাও, চা-টা ধর। ক’টা বেগুনি ভেজে আনি?” কথাগুলো বলতে বলতে অনিন্দ্যর দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিল সঞ্চারী।

মুম্বাইয়ের পাওয়াই লেকের পাশে অনিন্দ্যর এই ছোট্ট ফ্ল্যাটের ব্যাল্কনি থেকে লেকটার বেশ অনেকটাই দেখা যায়। এখন নভেম্বর মাসের শেষ। লেকের দিক থেকে মিষ্টি হাওয়া আসছে। আজ খুব একটা ভাল মুডে ছিল না অনিন্দ্য। কিন্তু এই বাসন্তী হাওয়া আর সঞ্চারীর মিঠে উপস্থিতি, ঠিক এই মুহূর্তটা যেন স্নায়ুতন্ত্রকে টানটান করে, মন ভাল করে দিল।

“না না... ভাজাভুজি খেতে আজ ভাল লাগছে না। তুমিও বরং চেয়ারটা টেনে এনে বস। মা’কে দেখছি না...”

“মা এই সময় সিরিয়াল নিয়ে মেতে থাকেন তুমি জানো তো! রিমোটে বাংলা চ্যানেল কী করে সেট করতে হয়, আমিই শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছি। ন’টার আগে উঠবেন বলে তো মনে হয় না।”

“তাহলে প্রেমালাপটা একটু বেশিক্ষণ করা যাবে, অভয় দিচ্ছ?”

সঞ্চারী খুব সুন্দর করে হাসল। হাসলে ওর গালে টোল পড়ে, আগে যেন লক্ষ করেনি অনিন্দ্য। পড়ন্ত বিকেলের আলো ওর গালে পড়ে কনট্রাস্ট তৈরি করায় গালের টোলটা নজরে এল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সঞ্চারীর হাতটা বাম হাত দিয়ে চেপে ধরে অনুনয় করল অনিন্দ্য, “এ্যাই, একটা গান কর না।”

“বাংলা, না হিন্দি?

“যা খুশি। বিকেলটা আজ বড় সুন্দর লাগছে।”

কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে একটু ভেবে নিয়ে সঞ্চারী শুরু করে, “দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে, আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাইনে তোমাকে...”

সঞ্চারীর গান যেন কেমন মন উদাস করে, আউল বাউল করে দেয়। গান শেষ হতেই চরম নিস্তব্ধতা। সঞ্চারী কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়। দুজনেই চুপ করে খানিকক্ষণ বসে থাকে। লেকের জলের উপর কালো আকাশ ঝুঁকে আসছে। অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে অনিন্দ্যর ব্যাল্কনিতেও। সঞ্চারী লাইট জ্বালাতে উঠে দাঁড়ায়। অনিন্দ্য ওর কনুইতে টান দিয়ে বসিয়ে দিতে গেলে টাল সামলাতে না পেরে ওর কোলে আছড়ে পড়ে সঞ্চারী। আচমকা এমন পতনের কারণে মানবী হলে হয়তো ব্রীড়ানত হয়ে বলে উঠত, “কী যে কর না! অসভ্য!”

কিন্তু সঞ্চারীকে সেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়নি। ওর প্রোগ্রামে এই ছোট্ট ভুলটা শুধরে নিলে জীবনটা আরও মধুর হয়ে উঠবে, এমনটাই মনে হয় অনিন্দ্যর।

“আচ্ছা সঞ্চারী, এই যে গানের মধ্যে দিয়ে বলে উঠলে - ‘পাইনে তোমাকে...’ তুমি কী সত্যিই আমাকে পাওনি? আমার তো মনে হয় অফিসের সময় ছাড়া যে সময়টুকু জুটিয়ে নিতে পারি, তার সিংহভাগ কেবল তোমায় দিয়ে থাকি। আজ তোমার গানের মধ্যে কেমন যেন করুণ সুর বেজে উঠল। যদিও এটা প্রশংসা করতেই হবে, আগের চাইতে গানগুলো তুমি অনেক ভালো গাও এখন। উচ্চারণের জড়তাও অনেকটাই কেটে গেছে।

“তোমার আগের বউয়ের চাইতেও ভালো?” সঞ্চারীর গলায় ব্যঙ্গের সুর শুনে চমকে উঠল অনিন্দ্য। এই খবরটা ওকে কে দিল? নিশ্চয়ই মা। কোনও মানে হয়! এন্ড্রয়েড বউকে এই সব গোপন কথা না বললেই কি চলছিল না? ধুত্তেরি, মা তো সঞ্চারীর আসল পরিচয় জানেই না! আর কী করেই বা জানবে? অনিন্দ্য তো আর সেকথা ফাঁস করেনি মায়ের কাছে!

ঘটা করে, একেবারে মন্ত্র পড়ে, সাত পাক দিয়ে, উলুধ্বনির হুল্লোড়ে, প্রথম বউ সাগরিকার সাথে অনিন্দ্যর বিয়ে হয়েছিল। তখন সে মুম্বাইতে ছিল না, চাকরি করত কোলকাতায়। বিয়ের ব্যবস্থা তাদের গ্রাম চন্দ্রবোড়ায় হয়নি। একবার বলবার চেষ্টা করেছিল অনিন্দ্য – গ্রামে বিয়ে না করলে ব্যাপারটা ভালো দেখায় না। সাগরিকার বাড়ির লোক একেবারে হা হা করে উঠেছিল। আসলে পৃথিবীটা সূর্যের চারিদিকে যতবার পাক খায়, চন্দ্রবোড়ায় জীবন ততবার পাক খায় না। প্রশাসনিক ঢিলেমিই হোক, বা রাজনৈতিক কারণে - দ্বাবিংশ শতাব্দীর ভারতের শহরগুলোকে টেকনোলজির ম্যারাথন দৌড়ে জিতিয়ে দিলেও, কিছু কিছু গ্রাম যেন এখনো শতাব্দী প্রাচীন ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সভ্যতার আলো এখানে চুপিসারে ঢোকে, জীবন চলতে থাকে গড়িয়ে। চন্দ্রবোড়া ঠিক এমনই একটা গ্রাম।

সাগরিকার সাথে বিয়েটা টেঁকেনি অনিন্দ্যর। আসলে মা ছাড়া আর কেউ ছিল না তার। বাবা তার অল্প বয়সেই চলে যান। একমাত্র ছেলে অনিন্দ্যকে তার মা মানুষ করেন। গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করলেও মনের দিক থেকে তিনি অনেক আধুনিক। সাগরিকার সাথে কোলকাতায় বিয়ে তিনি নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু স্কুলের চাকরি থেকে রিটায়ার করার পরও নিজে চন্দ্রবোড়া ছাড়তে চাইলেন না। মাঝে মধ্যে অনিন্দ্যর কোলকাতার বাসায় এসে থাকতেন ঠিকই, কিন্তু সাগরিকা তাদের জেট স্পিড জীবন সংসারে শাশুড়িকে একেবারেই মেনে নিতে পারেনি।

 

প্রথম স্ত্রীকে ভোলা অত সহজ ছিল না। ওরা দুজনে একই অফিসে কাজ করত। দুজনের প্রেম ছিল যাকে বলে একেবারে দাপুটে প্রেম। ছ’বছর একটানা প্রেম পর্ব চালিয়ে বিয়ের জোড়ে বাঁধা পড়েও সব কেমন যেন দ্রুত শুকিয়ে গেল। একটা ব্যর্থ সম্পর্ক বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই জেনে, দুজনেই সরে গিয়েছিল নিঃশব্দে। সাগরিকা এখন সাগর পাড়ের কন্যা – ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর কুয়ালালামপুরের চাকরির হাতছানিতে সাড়া দিতে সে সময় নেয়নি। পলিমার টেকনোলজির বিশেষজ্ঞ ছিল অনিন্দ্য। তাই সেও মুম্বাইতে পাড়ি দিয়েছিল নতুন এক কোম্পানির ডাকে।

সাগরিকার নামের আদ্যক্ষরের সাথে মিল রেখে অনিন্দ্য তার এন্ড্রয়েড ঘরণী আকিরার নাম রেখেছিল - সঞ্চারী। জাপানে উন্নত পলিমার তৈরির মেশিনের ট্রেনিং নিতে অনিন্দ্যকে তার কোম্পানি জাপান পাঠায়। নাকাগাওয়ার সাথে আলাপ হয় সেখানেই। লোকটা একটু ছিটিয়াল টাইপের ছিল। সে নিজেও ছিল একজন পলিমার টেকনোলজিস্ট। তবে নিজের মাথাখানাকে একদণ্ড শান্তিতে জিরোতে দিত না। রোবটিক্স নিয়ে সঙ্গোপনে গবেষণা করত।

নতজিমা জাপানের একটা ছোট্ট দ্বীপ। নানাও সিটি থেকে সামান্য দূরে। আফটারনুন রিসেসে কফিশপে কফি খেতে খেতে, নাকাগুয়া তার রোবট বানানোর নিজস্ব ল্যাবের গল্প শুনিয়েছিল অনিন্দ্যকে। নিছক কৌতূহলী হয়ে নাকাগাওয়ার ল্যাব দেখতে যেতে চায় অনিন্দ্য আর নাকাগাওয়াও খুব খুশি হয় ওর প্রস্তাবে।

নানাও সিটি থেকে বোটে করে নতজিমা যেতে যেতে এক ছুটির দিনে সে অনিন্দ্যকে শুনিয়েছিল, অন্য রোবট কারিগরির সাথে তার বানানো রোবটের তফাতের কথা। নাকাগাওয়া জানায়, তার তৈরি হিউম্যানয়েডদের সাথে মানুষের শরীরের ফারাক বার করা মুশকিল। কারণ সে উন্নত পলিমার টেকনোলজির সাথে রোবটিক্স মিশিয়ে দৈনন্দিন কাজের সাথী হিসাবে তাদের বানিয়ে থাকে। অনিন্দ্য জানে, একবিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই হিউম্যানয়েড তৈরি করতে শুরু করেছিল জাপান ও অনেক উন্নত ইউরোপিয়ান দেশ। প্রথমে তাদের সাথে যন্ত্রের তফাত খুব বেশি ছিল না। গত তিরিশ বছরে হিউম্যানয়েডদের বিবর্তন হয়েছে রকেট স্পিডে। এখন এই দ্বাবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভারতের যে কোনও শহরে ডোমেস্টিক হেল্প হিসাবে হিউম্যানয়েডরা বেশ জনপ্রিয়। এখন তারা আর খরচা সাপেক্ষ নয়। ভারতেও মুম্বাই দিল্লিতে অনেক রোবট তৈরির কারখানা গজিয়ে উঠেছে। কিন্তু সেসব হিউম্যানয়েডদের আলাদা করে চিনতে পারা যায়। যদি নাকাগাওয়ার কথা সত্যি হয়, তবে কে জানে এরা একদিন মানুষের চেয়ে উন্নত হয়ে উঠবে!

তখন ডিসেম্বরের শেষ দিক। জাপানেও ঠাণ্ডা বেশ জমিয়ে পড়েছে। বোট থেকে নামতেই প্রায় ঠকঠক করে কাঁপছিল অনিন্দ্য। উঁচু নিচু প্রায় নির্জন রাস্তায় গাড়ি হাঁকাতে হাঁকাতে নাকাগাওয়া এলোমেলো কথা বলে চলেছিল। এই দ্বীপটাতে জনসংখ্যা খুব কম দেখা যাচ্ছে। হয়তো সেইজন্যই নাকাগাওয়া এমন দ্বীপ বেছে নিয়েছে তার গবেষণার জন্য। ঠোঁটের কোণে ব্যাঁকা হাসি ঝুলিয়ে সে প্রশ্ন করেছিল, “তুমি বিবাহিত, না এখনো সেসবের সময় পাওনি? সারাক্ষণ কাজ নিয়েই বুঝি ব্যস্ত থাক?”

অনিন্দ্য জানিয়েছিল - সে বিবাহিত, কিন্তু ডিভোর্সি। নাকাগাওয়া খুব উৎসাহিত পড়েছিল, তবে তার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেনি। শুধু বলেছিল, “তাহলে তোমার উপযুক্ত কনের সন্ধান একমাত্র আমিই দিতে পারব বুঝলে হে ভারতবাসী!”

আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসার বিন্দুমাত্র উৎসাহ তখন অনিন্দ্যর ছিল না। সাগরিকাকে ভোলা যায় না। তাই নাকাগাওয়ার অবান্তর কথার কোনও গুরুত্ব দেয়নি সে।

নাকাগাওয়ার কাঠের বাড়িতে বসবার ঘরে খুব উজ্জ্বল আলো জ্বালা ছিল সেদিন। অপূর্ব সুন্দরী এক রমণী এসে আরিগাতো জানিয়ে জাপানের বিখ্যাত সবুজ চায়ের দুটো কাপ নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল। তার গমন পথের লাস্যময়ী ভঙ্গিমা অনিন্দ্যর শরীরে জমিয়ে বসা ঠাণ্ডা যেন অনেকটাই দূরে সরিয়ে দিয়েছিল মুহূর্তে। অনিন্দ্যর চোখের নজর লক্ষ করতে করতে নাকাগাওয়া জোরে জোরে হেসে উঠে বলেছিল, “বলেছিলাম না, একেবারে তোমার মন পসন্দ হবে!”

অনিন্দ্য লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে চায়ের কাপ টেনে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনার মেয়ে বুঝি?”

নাকাগাওয়া সেই কথায় বেজায় ঠা ঠা শব্দে হেসে উঠে কুতকুতে চোখ নাচাতে নাচাতে বলেছিল, “নিজের ক্রিয়েশন... তাই মেয়ে তো বটেই! তবে কী জান, ওকে এমন অপ্সরা বানাবো বলে ট্রায়াল নিতে গিয়ে যা যা করতে হয়েছে, তাতে বাবা মেয়ের সম্পর্ক কতদূর সঠিক, বলা মুশকিল। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, জলদি শেষ করে নাও দেখি, আমি বরং দেখি রাতের খাবারের কী ব্যবস্থা হয়েছে।”

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অনিন্দ্য ভাবছিল, লোকটা তার সাথে মজা করছে না তো? এতটাই পারফেকশন যে মেয়েটি রক্তমাংসের কোনও নারী নয়, তা বোঝার উপায় নেই। ভারতে যেসমস্ত রোবট কর্মীদের দেখা যায়, তারা অনেকটাই যান্ত্রিক। হাঁটা চলায় কাঠিন্য আছে। সেটাই স্বাভাবিক, যতই হোক রোবট যন্ত্র ছাড়া তো আর কিছুই নয়।

যন্ত্র মানবীর সাথে বিয়ের প্রস্তাবে বেজায় হাসি পেল অনিন্দ্যর। যদিও শুনেছে এই জাপানেই নাকি অনেক কাল আগে এক রোবট বানানোর কারিগর, তার নিজের বানানো রোবট রমণীকে বেশ ঢাক ঢোল পিটিয়ে বিয়ে করেছিল। এই দ্বাবিংশ শতাব্দীতেও এই গল্প শুনে লোকে হাসাহাসি করে, যদিও টেকনোলজি আপেক্ষিকভাবে অনেক এগিয়ে। তাই আকিরাকে বিয়ে করে হাস্যস্পদ হয়ে উঠতে পারে অনিন্দ্য। কিন্তু ভিতরে ভিতরে এক তীব্র আকর্ষণও বোধ করছে অনিন্দ্য। জীবনটাকে একটু উল্টে পাল্টে দেখলে মন্দ কী?

মেয়েটি এবার ড্রয়িং রুমে ঢুকে অনিন্দ্যকে বাও করে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, তার কিছু প্রয়োজন আছে কিনা। ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে, তাকে অপলক দেখতে দেখতে অনিন্দ্য ভাবে, নাঃ, কোথাও নিশ্চয়ই কিছু ভুল হচ্ছে। মেয়েটি এবার জাপানিস ভাষায় কিছু বলল। একফোঁটাও বোধগম্য না হওয়ায় অনিন্দ্য বলে, “প্লিস স্পিক ইন ইংলিশ, আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড জাপানিস।”

অনিন্দ্যর কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, নাকাগাওয়া ঘরে ঢুকে পড়ে বলে, “আসলে আমি ওকে ইংরেজিটা এখনো শিখিয়ে উঠতে পারিনি। তুমি চাইলে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খুব কম দিনেই ওকে বাঙলাও শিখিয়ে দিতে পারবে। ওর প্রোগ্রাম মালটিলিঙ্গুয়াল করা আছে, তাই কোনও ভাষাতেই অসুবিধা নেই। তুমি ট্রায়াল নিতে পার।”

এরপর নাগাগাওয়া তার যন্ত্র কন্যাটির সাথে জাপানী ভাষায় মৃদুস্বরে কিছু কথা বলে নিয়ে অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল, “চল, আমরা ডাইনিং হলে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে নিই, রাত অনেক হল।”

নিখুঁত ভাবে মেয়েটির খাবার পরিবেশনের কায়দা এবং প্রয়োজনে হাতের কাছে সব সুন্দর ভাবে বাড়িয়ে দেওয়া দেখে অনিন্দ্য তাকে ভারতে নিয়ে আসবার প্রস্তাব মেনে নেওয়ার কথা বলেই ফেলল। নাকাগাওয়া খুব খুশি হয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে দুপাক নেচে নিল। যন্ত্র মানবীকে অনিন্দ্যর প্রস্তাব জানিয়ে দিতে সে হেসে উঠল, কিন্তু লজ্জা পেল না সম্ভবত।

 

জাপান থেকে ফেরার সময় রীতিমত সাক্ষী সাবুদ সহ কোর্টে দরখাস্ত করে যন্ত্র সুন্দরীকে নিজের বউ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে দেশে নিয়ে এল অনিন্দ্য। এটা তাকে বাধ্য হয়েই করতে হয়েছিল। নাকাগাওয়া সেক্সটয় হিসাবে তার নিজের হাতে গড়ে তোলা হিউম্যানয়েডকে বেচতে রাজি হয়নি। অনিন্দ্যও আর আপত্তি করেনি। রেজিস্ট্রেশনের সময় আকিরার জাপানী নাম বদলে নাম দিয়েছিল – সঞ্চারী।

সঞ্চারীকে মুম্বাইয়ের ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে বাংলা শিখিয়ে নিতে প্রায় বছর খানেক লেগে গিয়েছিল অনিন্দ্যর। তার জিভ জাপানী ভাষা থেকে বাংলায় অভ্যস্ত হতে সময় লাগা স্বাভাবিক ছিল। অবশ্য দেশে ফেরার মাস খানেক পর, ঘটা করে বন্ধুবান্ধব ডেকে পার্টি দিয়ে নিজের দ্বিতীয় বিয়ের সামাজিক স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছিল অনিন্দ্য। ততদিনে সঞ্চারী ভাঙা ভাঙা বাংলা আর ইংরেজি শিখে নিতে পেরেছিল। কিন্তু সঞ্চারীর আচরণে, সে যে মানবী নয়, এই কথাটা কারো গোচর হয়নি।

সঞ্চারীর যৌন আবেদন যে সাধারণ মানবীর চাইতে অনেক বেশি, সেটা বুঝে নিয়ে নাকাগাওয়ার সৃষ্টিকে সে তারিফ না করে পারেনি। সত্যিই সে যে শুধুমাত্র সেক্সটয় হিসেবে গড়ে ওঠেনি, বোঝা যেত তার নিজস্ব ভালোলাগা, বা না লাগাকে বেশ ভালোরকম গুরুত্ব দেওয়া দেখে। অনিন্দ্যর পছন্দ অপছন্দ বুঝে নিতেও সময় লাগেনি তার। সঞ্চারীর বুদ্ধিমত্তা সমাজের আর পাঁচটা সাধারণ যন্ত্র মানবীর চাইতে অনেক আলাদা হয়ে উঠেছিল খুব কম সময়ের মধ্যে। তাই সঞ্চারীর সাথে বছর খানেক ঘর করার পর নিজের মাকে নিয়ে এসেছিল অনিন্দ্য তাদের চন্দ্রবোড়া গ্রাম থেকে। কিন্তু সঞ্চারী যে যন্ত্র মানবী, সেটা মাকে জানাতে দ্বিধা করেছিল অনিন্দ্য। সঞ্চারীকে জানিয়েছিল - ঘুণাক্ষরেও যেন মা জানতে না পারেন সঞ্চারী মানবী নয়, জাপান থেকে বিয়ে করে আনা এক মেয়ে।

দ্বিতীয়বার বিয়ে করবার ব্যাপারটা জানতে পেরে মা বলেছিলেন, “এটা তুই কী করলি অনি? জাপানী মেয়েটার সাথে ঘর করতে পারবি? আমাদের সাথে ওদের তফাত কত জানিস? সাগরিকার সাথেই তোর বনাবনি হল না, এখন...”

“মা, তুমি ভুল করছ। সঞ্চারী খুব ভালো মেয়ে। একেবারে বাঙালি হয়ে গেছে মনে প্রাণে। ওকে বাংলার আদব কায়দা, রান্নাবান্না শিখিয়ে তবে তো তোমাকে ডেকে আনছি! আর আপত্তি তুলো না, আমি টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিচ্ছি, তুমি প্লেনে উঠে পড় দেখি!” উৎসাহ নিয়ে বলেছিল অনিন্দ্য।

মুম্বাইতে অনিন্দ্যর ফ্ল্যাটে ঢুকেই সঞ্চারীর সৌন্দর্য দেখে মা বলেছিল, “এযে একেবারে স্বর্গের দেবী রে! নাঃ, তোর পছন্দের প্রশংসা করতেই হয় অনি।”

মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সঞ্চারীকে প্রণাম করতে দেখে অনিন্দ্য যেমন অবাক হয়েছিল, তেমনিই ওর মা। ইন্টারনেট সার্ফ করে সঞ্চারী বাংলার গ্রাম অঞ্চলের ট্র্যাডিশন কখন রপ্ত করে ফেলেছে - অনিন্দ্যর ব্যস্ত জীবন তা জানতেও পারেনি। তাই মনে মনে খুশি না হয়ে পারেনি।

মুম্বাইতে মায়ের থাকার এক সপ্তাহ কেটে গেল। একদিন অনিন্দ্য ঘরে ঢুকে দেখে ড্রয়িং রুমে মা পা ছড়িয়ে বসে টিভি দেখছে আর সঞ্চারী মায়ের চুলে তেল লাগিয়ে চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দিচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে দেখে অনিন্দ্যর মা যেন একটু লজ্জা পেলেন। বললেন, “বড় লক্ষ্মীমন্ত বউ রে তোর অনি! এত যত্নআত্তি কি আর আমার পেটে সইবে? কে ওকে এসব শেখাল বল দেখি? জিজ্ঞেস করলে কিচ্ছু বলবে না, শুধু মিটমিট করে হাসবে।”

অনিন্দ্য জানে ওর মা অনেক কষ্ট করে ওকে মানুষ করেছেন। একাকী জীবনে এত সুখ চোখে দেখা হয়নি, তাই সুখের প্রতিটি বিন্দু যেন শুষে নিচ্ছেন প্রাণ ভরে।

মাস খানেক কোথা দিয়ে কেটে গেল টের পাননি অনিন্দ্যর মা। ছেলের বউয়ের আদর যত্নে তার চেহারায় চাকচিক্য ফিরে এসেছে, এটাই একদিন ফলাও করে রাতে ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে ছেলেকে জানাচ্ছিলেন। সঞ্চারীর রাঁধা বিউলির ডাল আর আলুপোস্তর প্রশংসা করতে করতে মা বলে উঠল, “এবার অনেকদিন তো হল অনি, আমার টিকিটটা এবার কেটে দে। বাড়ি তো ফিরতে হবে! তোর বউ যা যত্নে রেখেছে তোকে, এবার আর ফিরে গিয়ে চিন্তা হবে না তোর জন্য। তবে তোদের একটা ছেলেপুলে না হলে, সব কেমন বেসুরো লাগছে। সঞ্চারীকে সকালে এই কথা বলায়, ও দেখি কথা না বলে উঠে চলে গেল।”

ব্রহ্মতালুতে তক্ষকের কামড়েও বোধহয় এত যন্ত্রণা হত না, যতটা মায়ের কথায় অজান্তে ঘটে গেল। এই কথাটা কোনোদিন ভেবে দেখার সময় হয়নি অনিন্দ্যর। আশ্চর্য! এই পরম সত্য, বড় আঘাতের - মাকে বোঝানো অসাধ্য। যন্ত্র মানবী মায়ের সেবাযত্ন, অনিন্দ্যর নরম সহচরী হতে পারলেও, মা হওয়ার ক্ষমতা তার নেই। খাওয়া শেষ করে ওয়াশ বেসিনের দিকে যেতে যেতে অনিন্দ্য শুনল - মা বলছেন, “অনি তুইও সঞ্চারীর মতো আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস?”

সেদিন সঞ্চারী যেন একটু বেশিই শরীরী হয়ে উঠেছিল। একটু পরে ঘরের স্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে বলেছিল, “আমি মা হতে চাই।”

সঞ্চারীর চুলে বিলি কাটতে কাটে অনিন্দ্য বলে, “তুমি বুদ্ধিমতী, ভালো করেই জানো তোমার শরীর সন্তান জন্ম দেওয়ার উপযুক্ত নয়। অবুঝ হয়ো না। আর সন্তান ছাড়া আমরা কি কিছু খারাপ আছি?”

“আছি তো! সারাদিন তুমি থাক না। তোমার মাও চলে যাবেন। আমার সময় কাটবে কী করে। তুমি একটা দত্তক নাও বরং।”

“ইউ মীন এডপশন? আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী বাবা ও মা দুজনকেই সন্তান পালনে সমর্থ হতে হবে, তবেই দত্তক নেওয়ার অনুমতি পাওয়া যাবে। যখন তারা আমার বউ একজন হিউম্যানয়েড জানতে পারবে, তখন পারমিশন দেবে না। একটু বোঝার চেষ্টা কর।”

“আর মাকে কী বোঝাবে?”

“সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও।”

অনেক রাত পর্যন্ত সেদিন ঘুম এল না অনিন্দ্যর। সব ঠিকঠাক চলছিল। এবার যেন কোথায় হঠাৎ করে সুর কেটে গেছে। যেন সব বাজনা থেমে যাওয়ার পর গায়ক অবাক হয়ে ভাবছে, পরের লাইনটা যেন কী ছিল?

দু-একবার ভাবল অনিন্দ্য – নাকাগাওয়াকে ফোন করলে কেমন হয়? ওই তো সঞ্চারীর জন্মদাতা। তারপর ওর মন বলল, পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে একজন হিউম্যানয়েড হওয়া সত্ত্বেও সে কেমন মানব গুণের অধিকারী হয়ে উঠেছে, এই ব্যাপারটা নাকাগাওয়াকে বোঝানো অসম্ভব। যন্ত্র মানবী এখন অনিন্দ্যর ঘরণী হয়ে ওঠায় হয়তো ভুলেও গেছে তার জন্মস্থানের কথা। আর তার যন্ত্র বিশারদ পিতা নতুন সৃষ্টি নিয়ে হয়ে গেছে মশগুল।      

 

মায়ের যাবার দিন যত এগিয়ে আসে, ততই সঞ্চারী যেন ঝিমিয়ে পড়ে। কখনো কখনো বাড়াবাড়ি রকম কেয়ারিং হয়ে ওঠে সঞ্চারী। ব্যাপারটা মায়ের নজরেও পড়ে। তিনি সঞ্চারীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, “চলে যাব বলে মন খারাপ করছিস? তোদের একটা ছেলেপুলে হলে তাদের কাঁথা বদলানোর জন্য ঠিক চলে আসব দেখবি। আসলে কী জানিস, নিজের জায়গাটা একেবারে নিজস্ব। তাই, ফিরে তো যেতেই হবে। তবে তোর জন্য আমারও খুব মন খারাপ করবে এবার।”

ফিরে যাওয়ার ঠিক দুদিন আগে অনিন্দ্যর মায়ের পা পিছলে গেল। বাথরুমের সামনের প্যাসেজে জল পড়েছিল, কেউ লক্ষ করেনি। পা স্লিপ করতে না করতে সঞ্চারীর রিফ্লেক্স একশন কাজ করল। দুটো বলিষ্ঠ হাত মায়ের পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিল। অনিন্দ্যর মা একেবারে বেবাক। কী হয়ে গেল বুঝে উঠতে পারলেন না। সেই সময়ে অনিন্দ্য অফিসে ছিল। মাকে পিছলে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে গিয়ে হাতদুটো যথেষ্ট যান্ত্রিক হয়ে উঠেছিল। সঞ্চারীর গায়ের জোর আর ক্ষিপ্রতা তাকে এতটাই অবাক করেছিল, মা নিজেও যেন বিমূঢ় হয়ে গেলেন।

বিকেলে অনিন্দ্য বাড়ি ফিরতে ঘটনাটা খুলে বলতেই অনিন্দ্য জোরে জোরে হেসে উঠে বলেছিল, “এতে অবাক হওয়ার কি আছে? ও জাপানের মেয়ে... মার্শাল আর্ট ওর রক্তে! ভাগ্যিস তুমি পড়ে যাওনি! নইলে এখানেই তিন মাস বিছানায় পড়ে থাকতে হত।”

বিপদ ঘনিয়ে এলো যখন বেডরুমে সঞ্চারী বজ্রপাতের মতো ঘোষণা করল, “আমি মায়ের সাথে যাচ্ছি, চন্দ্রবোড়ায়। মাকে একা পাঠানো ঠিক হবে না। আমি দেখেছি ওনার ব্লাড প্রেশার নিচের দিকে, আর সুগার লেভেল অনেকটা উপরে, যদিও অন্য বায়কেমিকাল...”

অনিন্দ্যর কানে কিছু ঢোকে না। একে তো সঞ্চারীকে একা সে কোথাও ছাড়েনি, তার উপর তার ডাক্তারি তাকে আরও বিস্মিত করে তুলেছে। সে সঞ্চারীর কথা শেষ হতে না হতে বলে, “দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি এত সব জানলে কী করে? ডাক্তার দেখিয়েছিলে?”

“আমি নিজেকে ডাক্তারি প্রশিক্ষন দিয়েছি। আমি এখন কারো নার্ভে সামান্য চাপ দিয়েই বুঝে নিতে পারি তার শারীরিক সমস্যা। হয়তো খানিকটা ফেস রিড করতেও শিখে গেছি। এই যেমন ধর, আমাকে ছেড়ে যে তুমি একটা রাতও থাকতে পারবে না, তোমার মুখ বলে দিচ্ছে। আমাকে যে তুমি কোনোদিন একা ছাড়নি, সেটাও তোমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। কিন্তু আমারও একটা স্বাধীনতা আছে। মায়ের সাথে যাই। একা ফিরে আসব কিছুদিন পর। এটাতে একটা নতুন ট্রায়ালও হয়ে যাবে।”

সর্বনাশ, এতটা উন্নতি যে কোনও যন্ত্র মানবীর হতে পারে - ভাবতেই পারেনি অনিন্দ্য। এই কেস যে নাকাগাওয়ার হাতের বাইরে চলে গেছে, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। আজ সঞ্চারী অনেক জেদি আর আত্মবিশ্বাসী। তাই সহজেই সে অনিন্দ্যকে নিজের দাবী জানিয়ে দিতে দ্বিধা করছে না।

ল্যাপটপ খুলে মায়ের আর সঞ্চারীর ফ্লাইটের টিকিট কেটে ফেলে অনিন্দ্য। যা থাকে কপালে। নিজে যেতে পারলে ভাল হত, কিন্তু সামনেই ওদের অফিসের তত্ত্বাবধানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল সামিট আছে। চন্দ্রবোড়ায় এই সময়ে তার যাওয়া অসম্ভব।

 

মায়ের সাথে সঞ্চারী চলে যাবার পর অনিন্দ্য খানিকটা একা হয়ে গেলেও কাজের মধ্যে ডুবে গিয়ে, সময় যে কখন দুটো পূর্ণিমা দেখে ফেলেছে, জানতেও পারেনি। এদিকে সঞ্চারী গ্রামবাংলার পরিবেশে মুগ্ধ। এখন সে পূর্ণ মানবিক গুণের অধিকারী। শুধু মায়ের অভিযোগ শুনতে হয়, “মেয়েটা মুখে কিচ্ছুটি দেয় না। সারদিন শুধু টোই টোই করে পাড়া বেরিয়ে বেড়ায়। ধানের খেত, আমের বাগান আর পুকুর ধারে ঘুরে বেড়ায়। সঙ্গী জুটিয়ে নিয়েছে গোটা কতক। শহরের মেয়ে বলে তার খাতির খুব। রান্নার এত ভালো হাত বলে পাড়া প্রতিবেশীর মন জয় করে নিয়েছে সহজেই। তাই বলে আমার যত্নে ভাঁটা পড়েনি একটুও।”

মায়ের আনন্দে আনন্দিত হতে পারেনি অনিন্দ্য। বরং কোথায় একটা ভয় এসে হৃদয়ে জুড়ে বসেছিল। অতিরিক্ত মানবীর জীবন যাপন ওর পক্ষে মারাত্মক হতে পারে, সেটা নাকাগাওয়া না বলেও দিলেও অনিন্দ্যর জানা ছিল।

তার শঙ্কা মিথ্যে হল না। এক সপ্তাহ পর অনিন্দ্যর মা ফোন করে জানালেন, সঞ্চারী বিছানা ছেড়ে উঠছে না। কথাবার্তা প্রায় বন্ধ। ডাক্তার দেখানোর কথা বললে উত্তেজিত হয়ে হাতের ইশারায় বারণ করছে। অনিন্দ্যর চন্দ্রবোড়া চলে আসা অত্যন্ত জরুরি।

কাল বিলম্ব না করে রওনা দেয় অনিন্দ্য। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সঞ্চারীর গায়ের চামড়ায় চাকা চাকা দাগ দেখে চমকে ওঠে অনিন্দ্য। একে অজানা অসুখ, তার সাথে পরিচিতজন আর ডাক্তার দেখানোর জন্য মায়ের পিড়াপিড়ি - দুইয়ের দ্বন্দ্বে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে থাকে অনিন্দ্য। তাই আসল ডাক্তার নাকাগাওয়াকে ফোন করে।

সৃষ্টিশীল নাকাগাওয়া ততদিনে তার নতুন সৃষ্টির আনন্দে আকিরাকে প্রায় ভুলে গেছে। নাকাগাওয়ার একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে অনিন্দ্য। সঞ্চারীর সাম্প্রতিক জীবন যাত্রার বিশদ বিবরণে আর অসুখের ধারা শুনে স্কিন পয়েসনিং হয়েছে বলে রায় দেয় সে।

অনিন্দ্য বোঝে কোনও কারণে চন্দ্রবোড়ায় এসে সঞ্চারীর পলিমার নির্মিত চামড়ায় ভয়ঙ্কর কোনও ক্ষতি হয়ে গেছে। হয়তো পুকুরের জলে ডুব দেওয়া একটা কারণ হতে পারে। পুকুরের জলে আর্সেনিক থাকা বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু সঞ্চারীর কম্পিউটার মাথাও পুকুরের জলের ক্ষতিকারক রাসায়নিকের হদিস দিতে পারেনি কেন?

এবার মাকে সব খুলে বলতে হয় অনিন্দ্যকে। একদিনে মা সঞ্চারীকে কতটা ভালবেসে ফেলেছিলেন, তাকে ডুকরে কেঁদে উঠতে দেখে বুঝতে পারে অনিন্দ্য।

“পুকুরের জল আমার মেয়েটাকে কেড়ে নিল। কতবার বারণ করেছি, শোনেনি... আমি জানতাম শহরের মেয়ে, হয়তো সহ্য হবে না। তখন যদি জানতাম, ও রক্ত মাংসের নয়...”

“ভেঙে পড়ো না মা। ভরসা রাখ। বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই, ওকে সারিয়ে তোলা ডাক্তার কেন, ওর জন্মদাতার পক্ষেও সম্ভব নয়। আর্সেনিক পলিমার ভেদ করে ওর সিস্টেমকে ছুঁয়েছে। এখন আর কিচ্ছু করার নেই।”

অনিন্দ্যর হাত ধরে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সঞ্চারী। তার যান্ত্রিক হৃদয় যে মানবিক যন্ত্রণায় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, তার চোখের দৃষ্টি সেই কথা জানিয়ে দিচ্ছে। অনিন্দ্যর চোখের জলে ভেসে যায় সঞ্চারীর পলিমার শরীর। প্রাণের সমস্ত স্পন্দন থেমে যায় ধীরে ধীরে। অনিন্দ্য উঠে গিয়ে বাইরে দাঁড়ায়। সন্ধ্যে নেমে আসছে পৃথিবীর বুকে। পাখিরা ঘরে ফিরে যাচ্ছে। আচ্ছা, সঞ্চারীর জীবনও কি পাখির দলের সাথে উড়ে গেছে? না না, যন্ত্র মানবীর আত্মা থাকে না। কিন্তু হৃদয়?