সম্পাদকের কথা


দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, একটু খোঁজাখুঁজি করলেই, নয় নয় করে অন্তত তিনশটি রামায়ণের বর্ণনা আছে। প্রায় সব কটা বর্ণনার মূল স্বরটায় একটা সামঞ্জস্য আছে। রামের টুকটুকে বৌকে রাবণ অপহরণ করে নেওয়ার পর, রাম-রাবণের যুদ্ধ হয় এবং তার আগে-পরের নানা ঘটনা — মোটমাট এই হলো রামায়ণ। আর এই রামায়ণের কল্যাণেই আমাদের দুর্গা পূজা। মানে রাম তো যাবেন লড়তে (বৌ কিনা হনুমানের সাথে পালিয়ে আসতে নারাজ), কিন্তু কোমরের জোর বেশ নড়বড়ে। একজন বুদ্ধি দিলেন, দুর্গাকে ভজিয়ে যদি আশীর্বাদ জোগাড় করা যায় তাহলে এক্কেবারে গ্যারেন্টেড লঙ্কা-বিজয়। কিন্তু তখন নাকি আবার দুর্গার ঘুমের সময়। দেবীকে জাগানো তো আর চাট্টিখানি কথা নয়, কোনো বামুনের সাহসে কুলোয় না। এদিকে বৌ বিনা রামের বড় কষ্ট! তখন রাম গেলেন তখনকার শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের কাছে, অকাল বোধনের জন্য।

পুজোয় বসে পন্ডিত শুধোন — সংকল্প?
রাম বলেন — রাবণ বধ
রাবণ তথাস্তু বলে অর্ঘ্য নিবেদন করেন।

দিন পাল্টায়, সময়ও। মিহির সেনগুপ্তর দিনে বৃষ্টি পড়লে মসজিদের টিন এনে প্রতিমার মাথা বাঁচানো হতো। এখনো কুমোরটুলির বেশির ভাগ প্রতিমার চুল বানায় পার্বতীপুরের আলী সাহেব, আয়েশা বিবিরা। কিন্তু এবারে এক গৌরী বাড়ি ফেরার আগেই আরেক গৌরী মারা যান। হঠাৎ আগমনীর সুরের আগেই শোনা যায় জাত-ধর্মের হল্লা, লক্ষ্মী পুজো অব্দি প্রতিমাকে মণ্ডপে রাখার আব্দারের মধ্যেই শুরু হয়, ‘কেন আগে নয়’ এর ছুতো খোঁজা। কিন্তু এরপরেও তো কাশফুল, শিউলি ফোঁটা শুরু করে, প্যান্ডেলের বাঁশ পড়ে, রাত্তিরে হালকা হিম, দোকানে ‘পুজো স্পেশাল’, টিকেটের আকাশছোঁয়া দাম এবং পুজোর বাজারের ভীড়। দুর্গা ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি আসবেন যে!

বাঙালির জীবনে রামের প্রভাব কম থাকলেও রাবণের আবাহন করা অকাল-বোধন তাই রয়ে গেছে, আমাদের মিলনোৎসব-স্থান-কাল ছাপিয়ে, গঙ্গা-পদ্মা-সুরমার একুল অকুল ছাপিয়ে। আমাদের ভালোবাসায় আছে রাজ-কন্যা গৌরী যে ভালোবেসে ঘর করে ভোলা-খ্যাপার। উত্তর ভারত যখন দশোহরা উদযাপন করে, রাবণদহন করে, তখন আমাদের মায়েরা কন্যা-বিদায়ের শোকে মুখে আঁচল-চাপা দিয়ে নাড়ু করেন, মেয়ে সুখে শান্তিতে ঘর করুক 
— আগামী বছর আবার হবে। তাই আমাদের কাছে পুজো এখনো বাড়ি ফেরার গল্প। বাবার কাছে মেয়েরা তো সব সময়ই ‘মা’।

আমাদের, পরবাসিয়াদের, সাধ্য কম, সাধ অনেক। তাই আপনাদের কাছ থেকে চেয়ে চিনতে সাজানো হয়েছে আমাদের পুজোর পসরা। যা ভালো হবে তার কৃতিত্ব আপনাদের — পাঠক-পাঠিকা, লেখক-লেখিকা আর শিল্পীদের। ভুলত্রুটির দায়ভার সম্পূর্ণ আমাদের। আস্কারা আগেও পেয়েছি, এবারও দিন। কথা দিলাম আমরাও নিজেদের যথাযোগ্যভাবে শুধরে নেবো।

শারদীয়া শুভেচ্ছা,


পরবাসিয়া পাঁচালী