পাহাড় ঘেরা সবুজ জগত - শুভদীপ বিশ্বাস

চারদিকে উঁচু পাহাড় ঘেরা একটা ছোট্টো সবুজ উপত্যকা, প্রবল জলধারার ক্ষীণ গর্জনের রেশ ছাড়া একদম শান্ত । পাশের উঁচু পাহাড়ের চুড়োগুলো কখনো সাদা মেঘের আড়ালে, কখনো মেঘ কেটে উঁকি মেরে যেন খিলখিলিয়ে হাসছে । সারি সারি দেবদারু আর পাইন গাছের ফাঁকে মেঘের খেলা চলছে অবিরত। মেঘ কেটে গেলে, বিশাল পাহাড়ে ধাপে ধাপে হরেকরকম সবুজ রঙের খেলায় চোখ ফেরানো অসম্ভব হয়ে পড়ে । সেই পাহাড়গুলোর হঠাৎ কিছু কিছু জায়গা থেকে জলধারা, বহু উঁচু থেকে উপত্যকার সর্বনিম্ন ঢালে, প্রবল বেগে পড়ছে। এরকম অনেক জলধারা মিলে বিশাল জলপ্রবাহ তৈরি করেছে। আমি যে জায়গার কথা বলছি সেখানে এই জলধারা পার্বতী নদী নামে পরিচিত। শুধু ঠান্ডা জল নয়, পাহাড়ের কিছু কিছু জায়গায় গরম জলের কুন্ড থেকে গরম জলও এসে মিশছে। 

যে উপত্যকার কথা এতক্ষণ বললাম সেটি পার্বতী উপত্যকা অঞ্চলে অবস্থিত, যার পোশাকি নাম ক্ষীরগঙ্গা। অসাধারণ সৌন্দর্য আর উষ্ণপ্রস্রবণের (পার্বতী কুন্ড)জন্য এটা সর্বাধিক বিখ্যাত। শুধু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নয়, বিদেশ থেকেও বহু মানুষের ঢল নামে বছরের বিভিন্ন সময়। শীতকালে বরফে মোড়া থাকে পাহাড়গুলো, আর থেকে থেকে তুষারবৃষ্টি পর্বত আরোহীদের মনকে নাড়িয়ে দেয়। তবে অসাধারণ সুন্দর এই জায়গায় পৌঁছনোটা আদৌ সহজ নয়। অতি দুর্গম যাত্রাপথের মধ্যেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের নিরবিচ্ছিন্ন খেলা, অভিযাত্রীদের অভিজ্ঞতাকে যে 'ভয়ঙ্কর সুন্দর' করে তোলে এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। 
যাত্রাপথের বর্ণনা দেবার জন্য প্রথম থেকেই শুরু করা যাক। চণ্ডীগড় শহরের সেক্টর ৪৩ থেকে ১৯ নম্বর বাস টার্মিনাল থেকে কুল্লু মানালি যাবার বাসে চড়ে বসলাম সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার বাসে। প্রসঙ্গত বলে রাখি জনা প্রতি খরচ আনুমানিক দুহাজার টাকা(দুদিন এক রাত)। সঙ্গে জল ও কিছু শুকনো খাবার থাকলে খরচ অনেক কম হয়।বৃষ্টি সারাক্ষণ সাথী। মে থেকে অক্টোবরের মধ্যে গেলে রেইনকোট বা ছাতা সঙ্গে অল্প গরম কাপড় রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যাবার কথায় ফেরা যাক।চণ্ডীগড় থেকে কুল্লু মানালি বাস এ করে কুল্লু শহরের বুনটার জায়গায় পৌঁছলাম তখন ভোর চারটে (আট ঘন্টার বাস যাত্রায় দুবার বাস থামে) তারপর অন্য একটি বাসে সকাল ছটায় আবার বুনটার শহর থেকে কাসুলি হয়ে বারশানিতে বাস এসে থামে নটার দিকে। সমাপ্ত গাড়িতে যাত্রা। অনেকে বুনটার থেকে ছোট গাড়ি করে কাসুলিতে পৌঁছে হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে আবার বাসে করে সাড়ে সাতটায় কাসুলি থেকে বারশানিতে পৌঁছতে পারে, তবে খরচ বেশী হয়ে যাবে। বারশানিতে কিছু ব্রেকফাস্ট সেরে, ওখান থেকে ট্রেকিং পথ শুরু। ক্ষীরগঙ্গা পর্যন্ত তেরো কিলোমিটারের পথ। সময় লাগে আনুমানিক পাঁচ থেকে ছঘন্টা। ভয়ঙ্কর সুন্দর পথ অতিক্রম করার প্রথমেই চোখে পড়বে সেই ভয়ানক স্রোতস্বিনী নদী। আর কানে লেগে থাকবে তার গর্জন। পাহাড়ি উপত্যকা বরাবর নদীর পাশ ধরে চলতে থাকার মাঝে চোখ পড়বে অসাধারণ পাহাড়ি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য । 
ক্ষীরগঙ্গা পর্বত-অভিযাত্রীদের জন্য যেমন আকর্ষণীয়, ঠিক তেমনি ধর্মপ্রাণ মানুষের আগমনের অন্যতম ধর্মপীঠ। এক প্রবীণ অধিবাসীর কথায়, আগে তেমন লোকজনের দেখা মিলত না। কেবল সাধু-সন্ন্যাসীদের আগমন ছিল। ইদানিংকালে অভিযাত্রীদের সংখ্যা প্রবল ভাবে বেড়েছে, বিদেশি বা বিদেশিনীদের মধ্যে ইজরায়েলী যাত্রীরা সংখ্যায় বেশি। তাদের সাথে আড্ডায় অনেক সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায়। সবই উৎসুক ইজরায়েলের বর্তমান পরিস্থিতি এবং এত সমস্যার কারণ জানতে। ইজরায়েলীরা বলতে চান, তারা শুধু চান ‘শান্তি’। তাঁদের এখানে আসার একটাই উদ্দেশ্য ট্রেকিং এর সাথে অসাধারণ সৌন্দর্য উপভোগ করা। জায়গাটির এ হেন নামকরণের কারণ সম্ভবত, গরম জলের উৎস থেকে যে জল আসে তার সাথে সাদা এক ধরণের ক্ষীরের ন্যায় দেখতে ছোট ছোট পদার্থ মিশে থাকে, সেই কারণেই ক্ষীরগঙ্গা। জলের কুন্ডটি এখন সুন্দর করে বাঁধানো, প্রায় ছশো পঁচিশ বর্গফুট। অনবরত সেখানে ‘বেশ গরম’ জলের এক ধারা এসে পড়ছে।ছেলে এবং মেয়েদের জন্য স্নানের জন্য পৃথক জায়গা রাখা রয়েছে । ক্ষীরগঙ্গাতেই ,কুণ্ড থেকে কিছু নিচে, ওই অঞ্চলের লোকেরা অস্থায়ী ধাবা এবং থাকার জায়গা করে রাখেন,সঙ্গে তাঁবুও থাকে। যাত্রীদের যার যেরকম পছন্দ সে সেরকম ঘর ভাড়া নিতে পারেন । প্রতি রাত একশ টাকা,কম্বল বালিশ সমেত।

সবথেকে আকর্ষণীয় হল আকাশ। রাত হোক কিংবা দিন, নিজের খেয়াল খুশিতে সর্বদা সে লাস্যময়ী রূপে বিদ্যমান। কখনও মান-অভিমানে রত, কখনও সে খুশি, কখনও আবার দুঃখী। এক একদিনের আকাশ এক একরকমের। দিনের বিভিন্ন সময়েও তার কত রূপ। সাধারণত সকালের দিকে মেঘলা ও কুয়াশা আছন্ন থাকলেও, বেলা বাড়ার সাথে সাথে কিছুটা দৃশ্যমান হয় আশপাশটা। অপূর্ব সেই পাহাড়ি রাজ্যে মেঘেদের পাড়ি। কখনও ঘন মেঘে ঢেকে যায়, কিছুক্ষণ পরেই আবার দেখা যায় আলপাইন গাছের সারি। কিছু জায়গা পাইন বন, আবার সেই ঘন বন থেকে দৃষ্টি সরালেই, যেখানে পাইন গাছের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে, সেখানে গজিয়ে উঠেছে, নাম না জানা হরেক রকমের পাহাড়ি গুল্ম-লতার ঝোপ। দূর থেকে সে যেন আর ঝোপ নয়। রঙের বাহার। চোখ যেন তাতে আটকে পড়ে থাকে। কত ধরনের নাম না জানা রংবেরঙ্গের যে ফুলের এই মেলা, মনকে উতফুল্লিত করে তোলে। সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে একরাশ মেঘের দল এসে তাদের কে ঢেকে দিয়ে চলে গেল তার বোঝার অবকাশটুকু দেয় না। বহু দূরে ৩-৪ টি পাহাড় দেখা গেলেও, ক্ষীরগঙ্গা থেকে পাহাড়ের গায়ে ছোট গ্রামের চিহ্ন টুকুও দেখা যায়না। অবশ্য ক্ষীরগঙ্গা যাবার পথে একটি পাহাড়ি (৩০-৪০ টা ঘর সমন্বিত) গ্রামের মধ্যে দিয়ে আতিক্রম করতে হয়। গ্রামের লোকদের পেশা বলতে আপেল চাষ আর গোদুগ্ধ সংগ্রহ। বর্তমান সময়ে ক্ষীরগঙ্গা অভিযাত্রীদের সংখ্যা বাড়ার ফলে তারা ছোট ছোট ধাবা খুলে রেখেছে ঘরের পাশে। যাত্রীদের ক্ষণিক বিশ্রাম আর কিছু আহার তাঁদের আরও ৯ কিমি হাঁটার জন্য চাঙ্গা করে তোলে। 


অতি উৎসাহী পর্যটকরা অবশ্য ক্ষীরগঙ্গা পৌঁছে ক্ষান্ত হন না। ক্ষীরগঙ্গা থেকে আরও ১০০০ মিটার উপরে মান্তালাই হ্রদ(৪১১৬ মিটার) ট্রেকিং শুরু করেন কেউ কেউ। তবে এই রাস্তা আরও ভয়ঙ্কর এবং প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ। ক্ষীরগঙ্গা পর্যন্ত রাস্তায় মানুষের সাক্ষাৎ মেলে, খাবার মেলে, কিন্তু মান্তালাই হ্রদ যেতে, আর কিছুই মিলবে না। রাস্তাও খুব স্পষ্ট ভাবে নেই, নিজেকেই খুঁজে বার করে নিতে হবে। কেউ কেউ অবশ্য পিন- পার্বতী পাস (৫৩১৯ মিটার) পর্যন্ত ট্রেকিং করেন, সেটা যে আরও দুর্বিষহ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ক্ষীরগঙ্গা থেকে মান্তালাই আর পিন পার্বতী ট্রেকিং যথাক্রমে  দিন ৩-৪ ও ৭-৮ দিন লাগতে পারে।
এবার ফেরার পালা। ক্ষীরগঙ্গা থেকে যে পথ ধরে এসেছিলাম সেই পথ ছাড়াও বারশানি পৌছনোর আর একটা পথ আছে। তবে বেশিরভাগ মানুষ এই পথ ব্যবহার করেন না। ক্ষীরগঙ্গা থেকে বুনি – বুনি পাস হয়ে কালগা ব্রিজ পার হয়ে বারশানিতে পৌছনো যায়। আমারা যখন ফেরার জন্য রওনা দিলাম তখন সকাল ১০টা। আকাশ কুয়াশা আর মেঘে আচ্ছন্ন। পাহাড়ে ওঠার থেকে নামার গতি কিছুটা বেশই থাকে। তবুও পাহাড়ি সৌন্দর্য্যের হাতছানি উপেক্ষা করার মত নয়। ছবি তোলার সময় খেয়াল থাকেনা কখন সময় চলে যায়। নিচে নামার সাথে সাথেই মেঘ কাটল না। তবে রোদ্দুর বাড়ার সাথে সাথে কিছুটা আকাশ পরিষ্কার হয়ে উঠল। পাহাড়ি ঝর্নার অবিরাম প্রবাহ এখনও একই গতিতে বহমান। পোকার ডাক পার্বতীর গর্জনকেও ছাপিয়ে যাছে মাঝে মাঝে। ক্ষণিক বিশ্রাম। আবার হাঁটা। গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় ছোট ছোট শিশুদের ছবি তোলার সময় আবার তাঁদের সেই লাজুক হাসি ফিরে ফিরে আসছে। হঠাৎ পথ ভুলে অন্য পথে চলে যাওয়া। অবশ্য পথ ভুল করে মন্দ হয়নি। বিস্তর আপেল বাগান ভর্তি কাঁচা-পাকা আপেলগুলি লালসার সঞ্চার করছিল। দু-একটা আপেল ছিঁড়ে নেবার ইচ্ছা যে হাতছানি দিচ্ছিল তা বলতে বাধা নেই। মাঝেমধ্যে নতুন অভিযাত্রীদের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ায় এটাই মনে জাগছিল, এরাও এক আজব দেশে যাছে, যেখানে নেই ধর্মীয় গণ্ডির বাধ্যবাধকতা, নেই হানাহানি, নেই মারামারির সঙ্কীর্ণতা, নেই কোন মলিনতা । আছে শুধু শান্তি। এক পরম শান্তি।

ছবি - লেখক