বড় হওয়ার আগে (শেষ পর্ব) - কর্ণিকা বিশ্বাস

আমি বরাবরই বেড়াতে যেতে ভালোবাসি। স্কুল জীবনে সেই সুযোগ অবশ্য বেশী পাইনি। মানছি, সেটার জন্য দায়ী প্রধানত আমি নিজে। হুকুম-তামিল ছাত্রী হিসাবে ইস্কুলে আমার বেশ একটা খ্যাতি ছিল। শিশু শিক্ষার নাম করে তথাকথিত নামী বিদ্যালয়গুলি যে অন্যায্য প্রত্যাশার ফানুস তৈরী করতে শেখায়, তার দাম দেয় কে? মিথ্যা পিয়ার প্রেশারের ভাঁওতা দিয়ে শিক্ষিকারা আমাকে বুঝিয়েছিলেন, প্রথম হতে না পারলে কপালে নির্ঘাত কালাপানি নাচছে। পড়া নষ্ট হওয়ার ভয়ে যার রাতের ঘুম উড়ে যায়, তার পক্ষে কি বেড়াতে যাওয়া সহজ ব্যাপার? মাধ্যমিক পাশ করে সোনা-হেন মুখ করে ভর্তি হই দক্ষিণ কলকাতার এক নামী ইস্কুলে। যা হবার ছিল, তাই হল। কল্পনার বুদবুদ ফাটতে বেশী সময় লাগেনি। নম্বরের ঝুড়ির সাথে নম্বরধারীও বাস্তবের মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল। সত্যিকারের ভাল ছাত্র দেখে চোখ খুলে গেল। তার সাথে আর একটা জিনিস হল। স্বেচ্ছা বঞ্চনার গ্লানি এমনভাবে চেপে বসল, যে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোটা পরম কর্তব্য রূপে মান্য করলাম! নানাবিধ অফার এবং ক্যাশব্যাকের কল্যাণে আমার সাথে সাথে সেই নেশাও ক্রমশ বড় হয়েছে। তবে, ছোটবেলায় বাবা-মার সাথে দেখা বম্বে-গোয়ার সমুদ্রতট, উত্তরবঙ্গের অরণ্য, সিকিমের পাহাড়, নালন্দার ধ্বংসাবশেষ মনের একটা বিশেষ কোণ দখল করে রয়েছে। বড় হয়ে নিজের পছন্দে অনেক নামী-অনামী জায়গায় গেছি, কিন্তু বাবার হাত ধরে বেড়ানোর অনুভূতির তুলনা নেই। তালিকা মিলিয়ে গোছগাছ করা নেই, গাড়ী বুক করা নেই, ফ্লাইট স্কেডিউল মেলানো নেই। অনেক স্বাধীনতার মাঝে এই নেইগুলো বড্ড মিস করি। 

আমার দিগগজ হওয়ার বৃথা চেষ্টার বলি হয়েছিল আরও দুটো জিনিস, নাচ এবং আঁকা। ছোটবেলায়, মনে আছে, বৃহস্পতিবার ইস্কুল থেকে ফিরে জলখাবার খেয়ে নাচের ক্লাসে যেতাম। গুরুজীর মতো অসামান্য শিক্ষক এবং ভাল মানুষ কোনটাই আর দেখিনি। কিন্তু সেই সময় এই যাত্রাপথটি বেশীরভাগ দিনই অশ্রুসিক্ত এবং উচ্চস্বরে প্রতিবাদ মুখর থাকত। পরবর্তীকালে, নাটক চর্চার সময় খুব আক্ষেপ হত, নৃত্যশিক্ষার দিনগুলো হেলায় নষ্ট করার জন্য। আঁকার ক্ষেত্রেও আমি সময়-সুযোগের সঠিক সদ্ব্যবহার করিনি। মাস্টারবাবু কলেজস্ট্রীট থেকে বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবির প্রতিলিপির বই এনে দিতেন। কোন এক দিন জেদের বশে আমি সেগুলি কুটি-কুটি করে ছিঁড়েছি। এতে আমার কি দোষ বলুন? সব জিনিসেরই সংহার অনিবার্য। তার জন্য আমার পিঠেও দু-চার ঘা পড়েছিল নিশ্চয়। তবে, সত্যি বলতে কি, দুই দশক আগে পাঁচশ টাকা মাইনে দিয়ে যে বাবা-মা সন্তানের জন্য আঁকার মাস্টার রাখতেন তাঁদের দু-চার ঘা দেওয়ার অধিকার অবশ্যই আছে। 
চিত্রালংকরণ: কর্ণিকা বিশ্বাস
ছোটবেলায় আমার জিনিসপত্র জমানোর একটা বাতিক হয়েছিল। বাসের টিকিট, ট্রেনের টিকিট, স্টেশনের ওজন যন্ত্রের টিকিট, যাতে আবার ভাগ্যফল লেখা থাকত, পুরোনো মুদ্রা, ডাকটিকিট, ছবি, গ্রীটিংস কার্ড কত কিছুই না জমানোর চেষ্টা করেছি। মাঝখান থেকে, জন্মগত অধিকার ভেবে যে জিনিসটা কোনোদিনও জমানোর চেষ্টা করিনি, তারই অভাব রয়ে গেল জীবনে। মার সাথে সম্পর্কটা ছিল অনেক বেশী সহজ । বাবা ছিলেন দূরের মানুষ, যিনি অফিস যাবেন, বকাবকি করবেন না, প্রশ্রয় দেবেন, বেশী রাত হলে টিউশন থেকে নিয়ে আসবেন। বাবারা তো এগুলো করেই থাকেন। একবার আমার জন্য একটা মাঝারি মাপের বাইসাইকেল সেই শিয়ালদহ থেকে বাবা চালিয়ে নিয়ে আসেন। কিন্তু বাবার প্রচেষ্টায় জল ঢেলে অচিরেই আমি সাইকেল শিক্ষা থেকে স্বেচ্ছাবসর নি। চিরটাকাল উপেক্ষিত বাবার অবদান টের পেলাম হস্টেলে এসে, কারণ সাইকেল ছাড়া গতি নেই। কালীপুজোয় বাজি কিনে দেবে কে? বাবা। গরমকালে বাজার ঘেঁটে সবচেয়ে ভাল হিমসাগর আম আনবে কে? বাবা। আবদার করার আগেই পছন্দের মাছ আনবে কে? বাবা। পরীক্ষা দিতে যাব, সঙ্গে যাবে কে? বাবা। এখনও বিমানবন্দর থেকে বাড়ী যেতে বাবাকেই চাই। ভাগ্যিস অতটা বড় হয়ে যাইনি!

ইস্কুলে যাওয়ার প্রধান আকর্ষন ছিল আমার দুই বান্ধবী। আমাদের পছন্দের খেলা ছিল নেম, প্লেস, এনিমেল, থিং। অর্থাৎ, কেউ একটা অক্ষর পছন্দ করবে আর সকলে সেই অক্ষর দিয়ে এই চারটি শব্দ লিখবে, কমন হলে নম্বর কাটা যাবে। এছাড়াও, মেমরি গেম, ক্যারিকেচার, নানাবিধ বই পড়া এবং আদান-প্রদান চলত। তখন ইন্টারনেট, কম্পিউটার সহজলভ্য না থাকায় শিশুসুলভ সারল্য অটুট ছিল। মোবাইল ফোন তো দূর অস্ত, সকলের বাড়িতে ল্যান্ডলাইনও থাকত না। তখন বাড়ীতে গ্লোব, এটলাস থাকত। ইতিহাস পড়া হত কল্পনার চশমায়; হিস্টরিকাল ফিকশন কি বস্তু তা কেউ শোনে নি। জীবন সাধারন ছিল, সহজ ছিল। ওয়াটসঅ্যাপ ছিল না, তাই প্রতিদিন অপেক্ষা করে থাকতাম সকালের ইস্কুল বাসের জন্য। বই পড়ার সখটা নেহাতই ছেলেবেলা থেকে। পড়ি বা না পড়ি, মা বই কিনে দিতেন। ইংরেজী ক্লাসিক্সের সংক্ষিপ্তসার, এনিড ব্লাইটন, সুকুমার রায়, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এসবের স্বাদ গ্রহণ করি বেশ কম বয়েসে। সব যে বুঝেছি তা হয়ত নয়, কিন্তু কিছু বুঝেছি এবং বুঝে ভাল লেগেছে, এই বোধোদয়টাই গল্প পাঠের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। পরবর্তীকালে বিভূতিভূষণ, মুজতবা আলি, বনফুল, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আবুল বাশার, আশাপূর্ণা দেবী, হার্ডি, সুইফট, অস্টেন, ক্রিস্টি, ড্যান ব্রাউন, বার্ন্স, কামু, কোটজি ইত্যাদি অনেক কিছুই পড়েছি, কিন্তু বইয়ের প্রতি ভালবাসাটা শুরু হয়েছিল কোন এক দেশলাই বিক্রেতা বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে । বইয়ের দোকানে গেলে আজো একটা মনকেমন করা ছেলেবেলার গন্ধ পাই। নতুন বইয়ের গন্ধ, নাকি নস্টালজিয়ার আল ধরে হাঁটা, কে জানে! এ পথে পরতে পরতে চমক। ভিন্ন বয়সে, ভিন্ন পরিস্থিতিতে একই কাহিনীর ভিন্ন আবেগ, ভিন্ন আবেদন। মহেশের মৃত্যুতে একদা সজল চোখ আজ হয়ত গফুর মিয়াঁর অসহায়তায় অস্থির। এই তো বড় হওয়ার পথ। যে চকোলেটে একসময় একাধিপত্য ছিল, আজ তা অনায়াসে তুলে দিই অপরিচিত পথশিশুর হাতে। বড় হওয়াটা একটা ছোট গল্পের মতো। আসলে, আমরা বোধয় কেউ বড় হই না। বারবার নতুন করে সেই মনকেমন করা গন্ধটা বুক ভরে টেনে নি । ফেলে আসা সময়টাকে তো আর ফিরে পাব না, তাই নতুনকেই আলিঙ্গন করি সহানুভূতি, সহযোগ এবং ভালবাসা দিয়ে। একেই কি, বড় হওয়া বলে না?