বড় হওয়ার আগে (প্রথম পর্ব) - কর্ণিকা বিশ্বাস

বড় হওয়াটা একদিনে না ঘটলেও, প্রায়শই উপলব্ধিটা হঠাতই একদিন ঘটে। হয়ত কোন দরকারী কাজ সারছেন, এমন সময় মাথার মধ্যে টিকটিক করে কাজের চাপ, দায়দায়িত্ব, নির্ধারিত কর্মপরিকল্পনারা এক সাথে হেঁকে উঠে বড় হওয়াটা জানান দিয়ে দিল। আপনাদের কথা জানিনা, তবে আমার জীবনে এই ঘটনা হামেশাই ঘটে থাকে। সত্যি বলতে কি,আক্ষেপ করাটা একটা অভ্যাস। বিস্তারিত কার্য-কারণ বর্ণনা করে পাঠকের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেব না; আজ বরং একটু পূর্বকথা বলি। 

আমি জন্মাবধি প্রধানত কলকাতানিবাসী। আমার দাদু-ঠাকুর্দা ছিলেন পূর্ববঙ্গের লোক। বাংলা সাহিত্যে ভিটে মাটি ছেড়ে আসা মানুষের গল্প তো কম নেই। সুনিল বাবুর 'পূর্ব-পশ্চিম' পড়েনি এমন বাঙালি বিরল। এছাড়াও, দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়া তপন রায়চৌধুরীর 'বাঙ্গালনামা'ও অনেকে পড়েছেন। আমার বাবা-কাকারা ছোটবেলায় যে অনটনের মধ্যে মানুষ হয়েছেন আমাদের বেলায় সেটা পুষিয়ে দেওয়ার একটা বিশেষ চেষ্টা ছিল। তবে, কখনই সেটা মাত্রাতিরিক্ত হয়নি। 


নব্বইএর দশকের বেশীরভাগ মধ্যবিত্ত সংসারে প্রায় একই ছবি দেখা যায়। অধিকাংশেরই একটি বা দুটি বা বড়জোর তিনটি সন্তান। ছোট সংসার, সচ্ছল জীবনযাপন, এই ছিল মোটামুটি সামাজিক চিত্রটা। পড়াশুনো করে চাকরী-বাকরি পেতে হবে, এই তথাকথিত মধ্যবিত্ত মানসিকতাটা তখনও ফ্যাশন বহির্ভুত ছিল না। মনে রাখবেন, তখনো কিন্তু রাজ্য সরকার পঞ্চম বেতন পূনর্মূল্যায়ণ করেননি। খাওয়া পরার অভাব না থাক, আধিক্যও যে ছিল তা বলতে পারিনা। সাধারণত, বাড়ীতে মাংস হত শুধু রবিবার। নতুন জামা কেনা হত নববর্ষে আর পুজোয়। জাবং-মিন্ট্রায় অভ্যস্ত আজকের বালক-বালিকারা এটা ভাবতেই পারবে না। আর পছন্দের খেলনা, শারদীয়া আনন্দমেলাটা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করতে কত দিন যে মিছি মিছি গৃহকর্মে মাকে সাহায্য করতে হয়েছে সেটা বলতে গেলে আর একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। তবে মা-বাবা যে শুধুই শাসন করতেন এমনটা নয়। বিশেষত, বর্তমানকালের অভিভাবকদের মতো সেযুগের বাবামায়েদের সন্তানের সাথে "ক্যোয়ালিটি টাইম" কাটানোর বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হত না। আমাদের লেখাপড়া, শিল্পচর্চা,আদর, আবদার সবই আবর্তিত হত মা-বাবা কিংবা পরিবারের আর পাঁচটা কাছের লোকের হাত ধরেই। কিছুদিন আগে ফেসবুকে পড়লাম,বিদেশের কিছু গবেষক বিস্তর গবেষণা করে বের করেছেন, বাচ্চাদের গৃহকর্মে উৎসাহ দিলে নাকি তাদের মানসিক গঠন ভাল হয়। বছর তিরিশ আগে হলে বোধয় এই তথ্য কুম্ভীলকতার দায়ে পড়ত। 
চিত্রালংকরণ: কর্ণিকা বিশ্বাস
বাবার বদলির চাকরি, ফলে, আমার শিশুকালের খানিকটা কেটেছে নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে। প্রথমে দার্জিলিংএর এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে,তারপর কোলাঘাট, মুর্শিদাবাদের বহরমপুর এবং শেষে আবার কলকাতায় প্রত্যাবর্তন। যে সময়টার কথা বলছি, সেই সময় কিন্তু দ্বিতল বাস দেখা যেত কলকাতার রাস্তায়। যতদূর মনে পড়ে, কলকাতায় এসে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সময় সদ্য কনভেন্ট-ফেরত কেজি ক্লাসের আমি বিজ্ঞের মতো ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা লাভের দাবি জানিয়েছিলাম। এই ভুয়ো দূরদর্শিতার অসারতা যখন বুঝি, ততদিনে কৈশোর পার হয়ে গেছে। কিন্তু সেই সময়, আমার বাবা এই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছিলেন। আজ যারা ফেমিনিজম নিয়ে বিস্তর চেঁচামিচি করেন তাঁদের বোঝা উচিৎ এই ঘটনা কিন্তু আমার মা-মাসীদের ক্ষেত্রে খাটত না। বড় হয়ে কি হতে চাও -- এই প্রশ্নের উত্তরে বেশ সগর্বে হুঙ্কার ছাড়তাম, 'ডাক্তার'। অবশ্য ছোটবেলার বান্ধবীদের সাক্ষ্য নিলে সেটাই বদলে হয়ে যাবে আইস্ক্রীম-ওয়ালার বউ। এটা শিশুমনের সরলতা না সামাজিক প্রভাব সেটা আপনারাই বিচার করুন ! না, ডাক্তার আমি হইনি। তবে বড় হয়ে বুঝেছি, "গাট ফিলিং" কেই সম্মান জানানো উচিৎ। আর কিছু না হলে একটা আইসক্রিম পার্লার অন্তত... 

আমাদের বাড়িতে প্রথম রঙিন টেলিভিশন আসে বি-পি-এল কোম্পানির, সে এক ঢাউস মাপের সি.আর.টি. মনিটর। সেটা সম্ভবত ১৯৮৮-৮৯ সাল। আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, সেই টিভি কেনা হয়েছিল প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায়। তখন তো আর কেবল বা ডিশ ছিলনা, শুধু দূরদর্শন। তবে বিনোদনের জন্য সেই সময় সেটাই যথেষ্ট। বুধবার চিত্রহার, রবিবার রঙ্গোলী, চন্দ্রকান্তা। নাটক, গান, যন্ত্রসঙ্গীত এসবের লাইভ শোও থাকত। এখনও থাকে বৈকি, তবে কজন আর দেখে! তখন 'ফৌজি' করে খান সাহেব সবে সবে নাম করেছেন। এছাড়াও মাল্গুড়ি ডেজ, শহীদ কাপুরের বাবা পঙ্কজ কাপুরের করমচাঁদ, রজিত কাপুর অভনীত, বাসু চট্টোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বেশ ভাল লাগত। মনে আছে, বহরমপুরে থাকতে এক রবিবার সকালে, আমরা সবাই বি.আর. চোপড়ার মহাভারত দেখতে ব্যস্ত, আর ওদিকে হনুমানের দল এসে আমাদের জলখাবার সাবাড় করে দিয়েছে। এখন এই কংক্রিটের জঙ্গলে এরা কোথায় থাকে কে জানে! যে ভাড়াবাড়িতে আমরা থাকতাম, তাঁর পিছনের উঠোনে মা টম্যাটো ফলিয়েছিলেন। সেবছর এত ফলন হয়েছিল যে পাড়া-প্রতিবেশীদের বিলিয়েও শেষমেশ তা বাজারে বিক্রী করতে হয়েছিল। বাড়ীতে মাকে সাহায্য করতেন অনেকগুলি নাবালক-নাবালিকার জননী, এক মুসলিম বিধবা, তাঁকে ডাকতাম বাদলী পিসি। জাত-ধর্ম নিয়ে কোন ছুৎমার্গ কোনদিন দেখিনি বাবা-মায়ের মধ্যে। বহরমপুর থেকে চলে আসার অনেক দিন পরও শত দুখিনী সেই দরিদ্র মুসলিম রমণীর হাতের রান্না ভুলতে পারিনি। 

কলকাতাবাস বাবার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। উনি আবার বদলি হয়ে গেলে আমি আর মা থেকে যাই কলকাতায়। ঠাকুর্দা বাড়ী করেছিলেন বেহালা ফ্লাইং ক্লাবের কাছে। সেখানেই, একান্নবর্তী পরিবারে, একটা ঘরে মা সংসার পাতলেন। কাকার বিয়ে হল, হাঁড়ি আলাদা হল, বাস্তু ভাগ হল। বাবার ভাগ্যে জুটল কেবলমাত্র ফাঁকা ছাদ। আমার সৎ পরিশ্রমী চাকুরীজীবি বাবা সংসারের জোয়াল টেনে পাই পয়সা জুড়ে জুড়ে ছাদে ঘর তুললেন। কিন্তু আমার পড়াশুনা, নাচ, আঁকা, টিউশন কোন কিছুর ওপরেই কোন আঁচ পড়তে দেননি তিনি। দিনের শেষে মিস্ত্রীরা কাজ করে চলে গেলে মা সংসারের সব কর্তব্য সেরে ধুলো কাদা সাফ করতেন । আজ এই ছবিটা মনে পড়লে গলার কাছে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে আসে। পরবর্তীকালে অবস্থা দুর্বিপাকে বাবা যখন দোতলাটা বিক্রি করতে বাধ্য হন তখনও বাবার চোখে বিষাদের ছায়া লক্ষ্য করার মতো বড় হয়ে উঠতে পারিনি। 

কম্যুনিজম এ কোনদিনই আমার তেমন আস্থা নেই। রাজনৈতিক বিশ্বাসের কথা বলছি না, সকলের সমান অধিকার প্রসঙ্গে বলছি। প্রকৃতি যেখানে সকলকে সমান কর্মফলের অধিকারী করেনি সেখানে মানুষের কাছে তা আশা করা নিতান্ত মূর্খামি নয় কি? আমার ঠাকুমা ছিলেন ঘোরতর বামপন্থী। কিন্তু নাতি-নাতনির মধ্যে তিনি তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের ছায়া পড়তে দেননি। এই অবহেলা অনেকটা ঘুচেছিল দিদিমার ভালবাসায়। দিদিমা জীবিত থাকতে পুজোর সময় মা-মামা-মাসী সকলের সপরিবারে দাদুর বাড়ীতে হাজির থাকার হুকুম ছিল। তুতো ভাইবোনেদের তাই ছোটবেলা থেকে নিজের ভাইবোন বলেই জেনে এসেছি। সেই দিনগুলো সত্যি বড় আনন্দে কেটেছে। একসাথে খুনসুটি, মারপিট, শুকতারা, চাচা চৌধুরীর কমিক্স ভাগ করে পড়া, দুষ্টুমি করে বড়দের কাছে বকুনি খাওয়া থেকে আড়াল করার মধ্যে যে স্নেহের বন্ধন ছিল তাঁর জোরেই আজও সম্পর্কে ভরসা রাখি। দিদিমা একটা সাদা খরগোশ পুষেছিলেন। তাঁর নরম লোমওয়ালা তুলোর বলের মতো শরীর, খাড়া খাড়া কান, আর ডালিমের বীজের মতো টুকটুকে লাল চোখ ক্ষুদেদের খুব প্রিয় ছিল। আমার দাদু ছিলেন পি ডাব্ল্যু ডির রিটায়ার্ড এঞ্জিনিয়র। আপাদমস্তক সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী পরা, ফর্সা মোটাসোটা এক অমায়িক ভদ্রলোক। নাতনীদের তিনি বিশেষ স্নেহ করতেন। সকৌতুকে ময়মনসিং এর টানে বলতেন, "কিরে, তরা কি আমেরিকা, হনুলুলু যা(z)বি নাকি?" দাদুর কথা কিয়দংশে ফলেছে। আমার মামাতো দিদি বর্তমানে সত্যই আমেরিকানিবাসি এবং যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তবে হনুলুলু যাওয়াটা আমার হল না। দাদু-দিদিমা-ঠাকুর্দা আজ বহু বছর হল পরলোক যাত্রা করেছেন। বছর আড়াই আগে ঠাকুমাও চলে গেলেন, আমার বিয়ের কয়েকদিন পরেই। তাঁর সাথে সাথে দেশভাগের লাঞ্ছনার শিকার একটা প্রজন্মের যবনিকা পতন ঘটল।