তিনটে শব্দ - প্রমিত নন্দী

বিরক্তির সঙ্গে মাথাটা তুললাম। পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশের আর বেশি দেরি নেই। ঝাড়াই বাছাই করে তাড়াতাড়ি লেখাগুলো ছাপাতে দিতে হবে। হাতে যত কম সময় থাকে, প্রেসের বাছাধনদের নখরাবাজি যেন ততই বেড়ে যায়। এই রকম ব্যস্ততার সময়ে দেখি একটা উটকো লোক বেমালুম আমার ‘সম্পাদকের দপ্তরে’ ঢুকে পড়েছে! সঙ্গে সঙ্গে সিকিউরিটি গার্ডকে ডাকতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হাবে ভাবে বুঝতে পারলাম, লোকটা আর কেউ না, একজন লেখক।

পাণ্ডুলিপির সুবিশাল স্তুপটার দিকে তাকালাম। লোকটা হয়তো কোন লেখা সাধ করে আমাদের পত্রিকায় পাঠিয়েছিল। তারপর বহুদিন ধরে কোন খবর টবর পায়নি। বেজায় চটে গিয়ে শেষমেশ হাজির হয়েছে আমার কাছে।

কিন্তু না, লোকটার বগলে দেখি একতাড়া কাগজ এবং কোন রকম ভণিতা না করে সেগুলো সে আমার সামনের টেবিলে ঝপাৎ করে ফেলে দিল!

“ছাপুন!”, জোর গলায় বলল লোকটা।

আমি ঘটনার আকস্মিকতা সামলে তাড়াতাড়ি বললাম, “না – মানে – আপনি বোধহয় জানেন না-”

“ছাপুন!”, লোকটা আবার বলল, এবারে গলার স্বরে তেজ আগের চাইতেও বেশি। লোকটাকে ভালো করে দেখলাম এবার, মানে দেখতেই হল আর কি। নোংরা জামাকাপড়, উষ্কখুষ্ক চুল দাড়ি, মায় লেখকদের ট্রেডমার্ক ঝোলাটাও সশরীরে বিদ্যমান। এমন ধারা চিজ আমার নিত্য নৈমিত্তিক আহার, তাও চট জলদি একে রাস্তা দেখাতে না পারলে কপালে দুঃখ আছে।

“আমাদের পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করার একটা নির্দিষ্ট প্রসেস আছে।” কান এঁটো করা একটা হাসি দিয়ে বললাম, “আর তাছাড়া লেখা ছাপানোর তো অনেক উপায়ই আছে, তাই না? বাই দ্য ওয়ে, মশায়ের নামটা?”

“প্রমিত”, লোকটা আমার দিকে একটা আগুনে দৃষ্টি হেনে বলল, “প্রমিত নন্দী।“ টেবিলের ওপর দুহাত রেখে আমার ওপর ঝুঁকে বলল, “তা আমি জানি না ভেবেছেন? গত দু-এক বছরে সব কটা উপায়ই আমি হাতে নাতে পরখ করার সুযোগ পেয়েছি।”
“তাই নাকি?” আমি বলে উঠলাম, হাসি চাপার ব্যর্থ চেষ্টা করে। একেবারে ফুল ফ্রাস্ট্রেটেড পাবলিক!

“কোনো লাভ হয়নি।” কর্কশ গলায় লোকটা বলল, “যেমন ধরুন – কোনো এক পত্রিকায় আমার একটা লেখা পাঠালাম। সঙ্গে কয়েকটা চিঠি যেখানে আমার আগের কিছু সাহিত্যকীর্তির ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।”

আমি বলার চেষ্টা করলাম, “সাহিত্যকীর্তিগুলো যদি কাল্পনিক না হত – ”

“মাঝে কিছু উঠতি লেখকের সঙ্গে আলাপ জমিয়েছিলাম। হতচ্ছাড়াদের প্রতিভা বলতে গেলে কিস্যু নেই, তবু এদের কানেকশন কাজে লাগিয়ে যদি কিছু সম্পাদকের মন টন গলাতে পারি।”

“আন্দাজ করছি এতেও বিশেষ লাভ হয়নি।“ আমি মুচকি হেসে বললাম, “তা এটা অবিশ্যি খুব একটা আশ্চর্যেরও নয়, বিশেষত ব্যাপারটা যখন কোন প্রকাশকই খুব একটা পছন্দ তছন্দ করেন না।”

“অবশেষে”, লোকটার কথা ফুরোয়নি, “গত বছর মাথায় হঠাৎ একটা প্ল্যান এল। তারপর থেকে আমায় আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।”

খানিক কৌতূহল জাগল। থাকতে না পেরে জিগ্যেস করেই ফেললাম, “কী প্ল্যান?”

“প্ল্যানটা খুব সোজাসাপ্টা।” লোকটা নির্বিকার গলায় বলল, “আজকাল কোনো লেখা ছাপানোর ইচ্ছে হলে আমি প্রথমে একজন সম্পাদক খুঁজে বের করি। তারপর তার দপ্তরে কোনোভাবে ঢুকে পড়ে আমার পাণ্ডুলিপি পেশ করি। আর তারপর আমি মাত্র তিনটে শব্দ বলি।”

কিসব ভাঁট বকে চলেছে। বিরক্তির সঙ্গে জানতে চাইলাম, “ তা সেই তিনটে শব্দ কী শুনি?”

“ওই তিনটে শব্দ -”, একটু থেমে গলাটা নামিয়ে লোকটা বলল, “- ম্যাজিকের মত কাজ করে।”

“তা আপনার লেখা বের করাতে গেলে ম্যাজিকই চাই বটে।” ব্যঙ্গ করে বললাম, “ব্যাপারটা যদিও এখনো খুব একটা পরিষ্কার –”

“প্রথমে তারা অবিশ্যি ব্যাপারটাকে হেসে উড়িয়ে দেয়,” লোকটা স্বীকার করল, “যেমন আপনি করবেন। তা সম্পাদকরা আর কবে লেখকদের খুব একটা পাত্তা টাত্তা দিয়েছেন? এতো আপনাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য মশাই।”

“এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?” আস্তে আস্তে মাথাটা গরম হচ্ছিল।

“শুরুতে গাঁই গুই করলেও শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি তাদের প্রায় সকলেই রাজি হয়ে যান।”

“আর যারা রাজি হন না?” আর ধৈর্যে কুলোচ্ছিল না।

“তাদের আপনি নাম বললেই চিনতে পারবেন। আর-” লোকটা একটা বিচ্ছিরি রকমের বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, “- চাইলে আমি প্রমাণও দেখাতে পারি। গত কয়েক মাসে তাদের নাম সব নিউজ পেপারের প্রথম পাতায় বেরিয়েছে।”

পত্রিকার সম্পাদকের নাম কেন সংবাদ পত্রের প্রথম পাতায় বেরুবে সেটা আমার মাথায় ঢুকল না। কিন্তু আমার আর এই কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ ছিল না।

“সবই তো বুঝলাম, কিন্তু – কি যেন নাম আপনার?”

“প্রমিত”, লোকটা আবার জানাল, “প্রমিত নন্দী।”

“ও হ্যাঁ। প্রমিতবাবু আপনাকে দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে,” সিকিউরিটি গার্ডকে ডাকার জন্য টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালাম, “আপনি আমায় তিনটে কেন একশটা শব্দ বলতে পারেন কিন্তু আমি আপনার লেখা ছাপতে পারব না।” মনে মনে ভাবলাম, ওসব ভাঁওতাবাজি অন্য জায়গায় গিয়ে দেখাও চাঁদু!

লোকটা আমার কথা শুনে খানিকটা দমে গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষন। তারপর বেমক্কা পাণ্ডুলিপিটা আবার আমার সামনে টেবিলের ওপর সজোরে রাখল। এবারে চোখটা আপনা থেকেই লেখাটার প্রথম পাতার দিকে চলে গেল। শিরোনাম ও তার নিচে লেখকের নামটা পরিষ্কার দেখতে পেলাম, যেটা আগের বার খেয়াল করিনি।

‘তিনটে শব্দ’ – প্রমিত নন্দী।

“ছাপুন”, লোকটা ঠাণ্ডা গলায় বলল।

হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল সম্প্রতি কিছু পত্রিকার সম্পাদকের নাম কেন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বেরিয়েছে।

“নইলে?” কথাটা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল।

“ওইটাই আমার দ্বিতীয় শব্দ।” লোকটা হাসতে হাসতে জানাল।


(বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে)