ট্রেনের সন্তান - সুবোধ মাহাতো

“বাবু! এক রুপাইয়া দো না!” — দুপুরের এক পশলা বৃষ্টির পর, ট্রেনের সীটে বসে যেই একটু আঁখি-পল্লব যুগলকে আলিঙ্গনের সুযোগ করে দিলাম, ঠিক তখনই চিরাচরিত এই আবেদন শুনে একটু বিরক্তই হয়ে গেছিলাম। “এখন খুচরো নেই” বলে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু বৃথা সেই চেষ্টা। চোখ একটু ভালো করে খুলতেই দেখলাম যে একজন নয়, দুজন দাড়িয়ে আছে। ট্রেন ছাড়তে এখনও মিনিট পঁয়তিরিশ বাকি। পাশের সীটগুলো তখনও যাত্রী-অপেক্ষারত। ভাবলাম, ভর্তি ট্রেনে কোনোদিন তো সুযোগ হয়নি, এই একটা বেশ সুযোগ ওদের মুখে ‘চিরাচরিত’ ওই আবেদনটা ছাড়াও অন্য কিছু শোনার।
নাকের ডগার চশমাটা আর একটু ভালো করে এঁটে জিজ্ঞেস করলাম, “তুম লোগো কা নাম ক্যা হেই?” ওদের অস্থির, শ্রান্ত চোখ গুলো একটু ধাতস্থ হল। আরেকবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেই তাদের লালা-জড়ানো ঠোঁট বলে উঠলো, “মেরা নাম ‘রূপসী’ হ্যাঁই আউর ইয়েহ মেরা ভাইয়া, ‘বঙ্গ’।” বিহারী বুলিতে এরকম বাঙালি নাম শুনে কিছুটা অদ্ভুত ঠেকল। তাদের এরকম নামের কারণ যেই জানতে চাইলাম অমনি দেখি, আরেকটি বছর সতেরো কি আঠারো এর মেয়ে, কিছুটা দূর থেকে যেন আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এদিকেই আসছে। তার কোল অন্ধকার করে (আলো মোটেও নয়) আরও একটি ধূলিময় শিশু গামছার সীট-বেল্ট বেঁধে নিশ্চিন্তে বসে আছে। হঠাৎ করে রূপসী ও বঙ্গ সেই বালিকা-মাতার কাছে সরে গিয়ে, তার শাড়ি ধরে দাড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। আচমকা সেই বালিকা-মাতা পপকর্ণের মত দাঁতগুলো বের করে নিষ্পাপ হাসির মাধ্যমে বলল, “হাম হি ইন লোগো কি মা হ্যাঁই বাবু; ইন দোনো কা নাম ‘রূপসী' আউর ‘বঙ্গ’ রাক্ষা হ্যাঁই, কিয়ু কি ইসি ‘রূপসী বাংলা’ ট্রেন মেই ইন দোনো কা জনম হুয়া থা”। বলেই একটু হেসে আবার জানাল, “এক রূপিয়া দো না বাবু!”
মুহূর্তের মধ্যে মনের গহনে এমন এক তরঙ্গ এসে লাগলো, যা ভাসিয়ে দিলো সবকিছু। বুকপকেটে থাকা ২০ টাকার নোটটা একই সাথে কত তুচ্ছ ও কত মূল্যবান মনে হল। এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে নোটটা জননী-বালিকার হাতে গুঁজে দিলাম। পরমুহূর্তেই মনে পরে গেল—বানজারা ছেলেমেয়েরা নাকি টাকা দিলে ‘ডেনড্রাইট খেয়ে নেশা করে’, ‘জুয়া খেলে’। কিন্তু আমি তো দেখেছিলাম ব্লাউজ-বিহীন জননীর নম্র-ক্ষুধাতুর চোখ; দেখেছিলাম তার দু’পায়ে দুটো ভিন্ন ডিজাইনের ছেঁড়া জুতো; আর দেখেছিলাম তার নিরাবরণ কাঁধের ওপর চরের মতো জেগে ওঠা এক টুকরো লালচে দাদের খণ্ড। রুপসী-বঙ্গ আর বেনামী সেই শিশুর মাথার উষ্ক-খুষ্ক লালচে-কালচে চুল মনে করিয়ে দিলো — ‘Chimney Sweeper’ কবিতার Tom, Ned, আর Jack এর কথা। কোনো এক রাতের অন্ধকারে, কোনো এক প্ল্যাটফর্ম এর সিঁড়ির তলায় অথবা কোনো ট্রেনের মেঝেতেই এরা পৃথিবীর আলো দেখেছিল এবং যাদের স্বাগত জানিয়েছিল ট্রেনের কু-ঝিক-ঝিক শব্দ। 

রূপসী ও বঙ্গ। হয়তো এরকম অনেক রূপসী-বঙ্গ জীবনের সফরে আমাদের সহযাত্রী, আমাদের আত্মীয়স্বজন। আমাদের পায়ের তলা ঝাড়ু দিয়েই তারা বড় হয়। এটাও তো হতে পারে, এই ট্রেনেই ঝালমুড়ি আর নারকেল-নাড়ু বিক্রি করে একটা ত্রিপলের কুটির বানাবে, জট মাথা মসৃণ হবে। এদের কাছেও অ্যাঞ্জেল আসবে, সুখের চাবিকাঠি নিয়ে। তখন আর জটিল সব শারীরিক কসরত করতে হবে না কমপার্টমেন্টের সরু রাস্তাতে। বেদনাদায়ক সেই আনন্দের অংশীদার হতে হবে না আমাদেরও। ভাবতে ভাবতেই, কয়েক মিনিটের সেই অদ্ভুত নিষ্কলুষ শান্তি ভেঙ্গে দিলো ১২৮৮৪ এর কর্কশ আওয়াজ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, বিকেল ৩ টে বেজে ৩০ মিনিট। পাশের সীটগুলো ভর্তি হয়ে উঠেছে বিভিন্ন শাড়ী, চুড়ি ও জিন্সের সাথে। ট্রেন ছাড়বে এবার। নেমে গেল সেই মা তার শিশুশাবকদের নিয়ে। জানলা দিয়ে দেখলাম হাসছে তারা সবাই। অনাবিল সেই হাসি। ঝক-ঝকে সেই হাসি। ট্রেন ছেড়ে দিলো…ধীরে ধীরে ট্রেনের সন্তানেরা ট্রেনের প্ল্যাটফর্মেই মিলিয়ে গেল।


চিত্রালংকরণ - কর্ণিকা বিশ্বাস