হঠাৎ দেখা - সই

প্রতিদিন নীরা,অন্তত আধ ঘণ্টার জন্য হলেও এখানে এসে দাঁড়ায়। এটা তার বড় প্রিয় জায়গা। এই উপর থেকে ওই গহীন খাদের দিকে চেয়ে থাকতে তার বেশ লাগে… কত রহস্য, কত অন্ধকার লুকিয়ে আছে এর মধ্যে — ঠিক তার মনের খাদের মতন।

প্রায় ৪৫ মিনিট আগে এসেছে। এখানে তেমন লোকজন বা টুরিষ্ট আসে না। হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বাড়ি ফেরার রাস্তায় পা বাড়াতে গিয়েই দেখতে পেল… আকাশকে। 

হঠাৎই যেন চলন্ত জীবনটা কেউ রিমোটের পজ বাটানে ক্লিক করে রিওয়াইন্ড মোডে নিয়ে যাচ্ছে… আর একটার পর একটা স্মৃতি ফ্ল্যাশব্যাকে দেখতে পাচ্ছে। নতুন গড়ার স্বাদ, বেড়ে ওঠা, ভাঙনের শুরু, শব্দবিহীন শেষ হয়ে যাওয়া একটি অধ্যায় যেখানে রাগ, জেদ আর ভুল বোঝাবুঝি হারিয়ে দিয়েছিল ৬টা বসন্ত পেরিয়ে আসা ভালবাসাকে।

হঠাৎই নীরবতা ভেঙে আকাশই বলে উঠল — কেমন আছো?

নীরা যেন এটাই চাইছিল, চাইছিল নিজের নামটা শুনতেও, বলল
 হুম।ভালো। তুমি? — ভালই। তা এখানে? — এখানেই আছি। ৩ বছর হল। তুমি এখানে? — হ্যাঁ, এমনি ঘুরতে। — আচ্ছা।

কিছুক্ষণ থেকেই নীরার একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। চোখ জোড়া যেন কিছুতেই স্থির থাকছে না… চারদিকে ঘুরছে। হঠাৎ করেই মনে হল… হ্যাঁ, এটাতো বসন্ত, রডোডেনড্রন ঝড়ে পড়ে আছে রাস্তায়।


৭টা ফিকে হয়ে যাওয়া বসন্ত পেরিয়েও আজও কত রঙীন হয়ে আছে স্মৃতির বসন্তগুলো। এই বসন্তেই তো তাদের প্রথম কাছে আসা, হাত ধরা, প্রথম ঠোঁটের ছোঁয়া। কত ছোটো ছোটো স্বপ্নের বাসা তৈরি হয়েছিল এই বসন্তেই। শেষ বছরটা ছিল সবচেয়ে রঙীন, যেন রঙমিলান্তি 
 শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব… আচমকাই একমুঠো লাল আবীরে আকাশ রাঙিয়েছিল নীরাকে…ফাগুনের হাওয়ায় সেদিন রক্ত ঝড়েছিল দুই শরীরে। কিভাবে যে এই শক্ত ভিতের বাঁধনে উড়ে আসা এক টুকরো রেণু এসে অঙ্কুরিত হচ্ছিল ধীরে ধীরে তারা জানতেও পারে না,তখন থেকেই ফাটল শুরু... অবশেষে ভেঙে চুরমার সব। নিজের মনেই হেসে উঠল নীরা।

অনেকক্ষণের নিঃশব্দতা ভাঙার জন্যই আকাশ কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তা শেষ হল না তারমাঝেই একটা আদো আদো গলা একটু অভিমানের সুরেই বলল 
— বাবা, এট্টু আত্তে — আমি তো ছোটো নাকি!!

হঠাৎই নীরা যেন কেঁপে উঠল অজান্তেই।কিছুক্ষন পরে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল 
— তোমার মেয়ে বুঝি?

আকাশ নিশ্চুপ চাহনিতে দাঁড়িয়ে রইল। নীরা চোখ নামিয়ে বলল 
 তুমি তো কথা বলো খুব মিষ্টি… কি নাম তোমার?

মায়ের হাত ধরে থাকা গুটি গুটি পায়ের ফুলটি, বসন্তের রাঙা হাওয়ার মতো খিলখিলিয়ে বলে ওঠে 
 নীরা।

নীরা বুঝতে পারে তার চোখটা জ্বালা করছে, মনের ভিতর যেন সুনামি চলছে। ততক্ষণে ঘন সাদা চাদরের অংশ ঢেকেছে রাস্তা। ধীর পায়ে নীরা চলে আকাশকে পেরিয়ে মেঘের রাস্তায়, তার একান্ত নিজস্ব গন্তব্যের দিকে….



ভালবাসা পরিণতি পায়নি, আজও
তবু বেঁচে আছে সে —
নিষ্পাপ হৃদয়ের অক্ষরের মাঝে,
হঠাৎ দেখায়।।


চিত্রালংকরণ - কর্ণিকা বিশ্বাস