ছোট্ট একটা নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে আছে ফারহান। চারদিকে অথৈ সাগর। কালো রাতের আকাশটাকে খুবই বিষণ্ণ লাগছে।
ফারহান জানে না সে এখানে কী করে এলো! আর এসব চিন্তা করার মতো শক্তিও ওর নেই।
শুধুই চেয়ে আছে সে। সামনের দিকে, নিঃসীম আকাশের দিকে...
ঠিক তখনই ওর সামনে এল ওটা। অন্ধকার চিরে বেরিয়ে যেন বেরিয়ে এল প্রাচীন কোন এক অভিশাপ!
ফারহানের মনে হচ্ছিল সে পাগল হয়ে যাবে। ওর জায়গাতে অন্য কেউ থাকলে তারও ঠিক তেমনটাই মনে হত!
পার্থিব পৃথিবীর কেউই ওটাকে দেখে সুস্থির থাকতে পারে না...
হুট করে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল ফারহানের। ধরফরিয়ে উঠে বসল সে। পুরো শরীর ঘেমে গেছে তার।
একটু ধাতস্থ হয়ে চারপাশে তাকাল সে। নাহ! সব ঠিকই আছে! তাদের সেই পুরনো ঘর, সেই বিছানা, টেবিল ল্যাম্পের সেই বিষণ্ণ আলো আর ওর পাশে শুয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে ইশরাত।
ইশরাতকে ডাকতে গিয়েও ডাকল না ফারহান। গত কয়েক মাসে ওদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব এতোটাই বেড়ে গেছে যে এখন নিজের বউকে ডাকতেও ওর আত্মসম্মানে লাগছে।
চুপচাপ ডাইনিং টেবিলে গিয়ে এক গ্লাস পানি খেল সে। তারপর ঘরে এসে আবার শুয়ে পড়ল।
যদিও ফারহান জানে যে ওর আর ঘুম আসবে না! এই নিয়ে গোটা সপ্তাহে তৃতীয়বারের মতো সে দেখল স্বপ্নটা!
বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিলো ফারহান। চব্বিশে মে। জুন মাসের এক তারিখে ওদের বিবাহবার্ষিকী!
হেডফোনটা কানে লাগিয়ে ‘সিগারেটস আফটার সেক্স’ ব্যান্ডের ‘অ্যাপোক্যালিপ্স’ গানটা ছেড়ে দিলো সে।
‘মাই লিপস অ্যান্ড ইয়োর লিপস, অ্যাপোক্যালিপ্স!” কোরাসটা শুনতে শুনতে কখন যে ঘুম এসে গেল সেটা টের পেল না সে।
ভোরবেলাতে ইশরাতের ডাকে ঘুম ভাঙ্গল ফারহানের। আজকাল খুবই কম কথা বলে ওরা। প্রতিদিন সকালবেলা নাস্তা বানিয়ে ফারহানকে ডেকে অফিসে চলে যায় ইশরাত। রাতের বেলা ফারহানের আগেই চলে আসে সে তারপর খেয়েদেয়ে ফারহানের জন্য টেবিলে খাবার রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবেই চলছে।
কোন রকম আবেগই আর অবশিষ্ট নেই ওদের মধ্যে। তারপরেও কেন যে ওরা দুজন এখনও এক ছাদের নিচে থাকছে তা ওদেরও জানা নেই।
শুক্রবারের দিন একদম ভোর ছটা থেকে ইশরাতের ডিউটি। এজন্য সকাল সকালই নাস্তা বানিয়ে চলে যায় সে।
বেশ স্বচ্ছলই বলা যায় ওদের। তাই ফারহান বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে একজন কাজের মেয়ে রাখার। যাতে করে ইশরাতকে আর কষ্ট করে রান্না না করতে হয়।
কিন্তু প্রচণ্ড খুঁতখুঁতে ইশরাত ব্যাপারটাতে মত দেয়নি। পরের হাতের রান্না সে খেতে চায় না।
এইসবই ভাবছিল ফারহান ঠিক তখন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল ইশরাত।
খুব বেশী লম্বা নয় ইশরাত, বাঙালি মেয়েদের মতোই মাঝারি উচ্চতার। গায়ের রঙ শ্যামলা আর মাথায় দীঘল কালো চুল। চেহারা আহামরি কিছু না হলেও কেমন যেন একটা অপার্থিব আকর্ষণ আছে ইশরাতের চোখ দুটোতে। ভার্সিটিতে পড়ার সময়ে ইশরাতের ওই চোখদুটো দেখেই প্রেমে পড়ে গেছিলো ফারহান। আজকে লাল একটা সালোয়ার কামিজ পরেছে সে, খুবই সুন্দর লাগছে দেখতে ওকে।
“টেবিলে খাবার রাখা আছে, দশ মিনিটের মধ্যে খেয়ে নিও, আমি যাচ্ছি।” ঠান্ডা গলায় বললো ইশরাত।
“আজ আমার ডিউটি নেই, পরে খাব।” মোবাইল টিপতে টিপতে উত্তর দিল ফারহান।
“খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে, ওভেনে গরম করে নিও।” এই বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল ইশরাত।
“ইশ...শোন...” নিজের অজান্তেই যেন বলে উঠল ফারহান।
অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়াল। আজ বহুকাল পর পিছন থেকে ফারহান তাকে ডেকেছে! সবচেয়ে বড় কথা ফারহান তাকে ‘ইশ’ বলে ডেকেছে। ভার্সিটির প্রেমের সেই উদ্দাম দিনগুলোতে এই নামেই তাকে ডাকত ফারহান।
“হুম বল।” চশমাটা ঠিক করতে করতে বলল ইশরাত।
“তুমি খেয়েছ?”
“তোমার শরীর ভালো তো?”
“কেন?”
“নাহ! এতদিন পর আমি খেয়েছি না খাইনি সেই খবর নিচ্ছ!” ইশরাতের মুখে ব্যঙ্গের হাসি।
“যাও যাও, আমি খেয়ে নেব।” বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠল ফারহান।
“তুমি চিরকালই এমন উদ্ধত একটা মানুষ।” এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ইশরাত।
সকাল সাড়ে সাতটার মতো বাজে।
চার্চরোডে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধীরে সুস্থে একটা গোল্ডলিফে টান দিচ্ছে ফারহান। চার্চরোডকে বলা হয় রাজশাহীর সবচেয়ে শান্ত রাস্তা। এমনিতেই রাজশাহী শান্ত শহর তার ওপর এই রাস্তাটা একটু বেশীই শান্ত।
রাস্তাটার ডানপাশে খ্রীষ্টানদের গির্জা। মূলত এইজন্যই রাস্তাটার নাম হয়েছে চার্চরোড। সেখান থেকে একটু এগিয়ে গেলে রাজশাহী চিড়িয়াখানা। গির্জার ঠিক সামনে রাস্তার বামপাশে একটা পরিত্যক্ত শপিং কমপ্লেক্স। রাতের বেলাতে তো রাস্তাটা একদম সুনসানই হয়ে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে টি-বাধের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল ফারহান। পদ্মার এই বাঁধটার আকৃতি অনেকটা ইংরেজী ‘টি’ অক্ষরের মতো। সেজন্যই এটার নাম টি-বাঁধ। সকাল সকাল জায়গাটা বলতে গেলে প্রায় নির্জনই থাকে।
একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বেশ আয়েশ করে সিগারেট টেনে চলেছে ফারহান। চোখের সামনে যেন ভেসে উঠছে ছাত্রজীবনের সেই দিনগুলো।
ভার্সিটিতে পড়ার সময়ে এই টি-বাঁধে কতোবার ইশরাতকে নিয়ে ঘুরতে আসত সে। মাঝে মাঝে নৌকাতে করে ঘুরতেও যেত ওরা। ঢেউয়ের কবলে পড়ে নৌকা কেঁপে উঠলে ভয় পেয়ে ওকে আঁকড়ে ধরত ইশরাত।
সেই দিনগুলো আজ শুধুই স্মৃতি! ওরা দুজনেই আজ অবসাদগ্রস্থ দুজন স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর কিছু না।
ফারহানের থেকে বেশ দূরে কলেজের ইউনিফর্ম পরা দুজন ছেলে-মেয়েকে দেখা যাচ্ছিল। সকাল সকাল টি-বাঁধ এলাকাতে লোকজন বলতে গেলে থাকেই না! সেই সুযোগেই হয়ত প্রেমালাপ সেরে নিতে এসেছে ওরা।
একটু পরে নিচে দিকে নেমে গেল সেই যুগল।
মৃদু হাসল ফারহান। বাঁধ থেকে নিচে বিরাট আকৃতির সেই পাথরগুলোতে বসে পদ্মার ঢেউ দেখতে দেখতে প্রেম করার মজাই আলাদা। ইশরাতকে নিয়ে সে নিজেই কতবার এমনটা করেছে।
ঘড়ির দিকে তাকাল ফারহান। কেবল সোয়া নয়টা বাজে! সময় কি খোঁড়া হয়ে গেছে নাকি? সারাটা দিন কী করে পার করবে সে? বন্ধু-বান্ধবরাও তেমন কেউই রাজশাহীতে নেই! এই পিছিয়ে পড়া শহরটাতে কেউ থাকতে চায় না। ভাগ্যক্রমে ওর আর ইশরাত দুজনেরই পোস্টিং এখানে হয়েছে বলেই ওরা থাকছে। ওর সাথে যদি ইশরাতের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, তবে সেও আর এখানে থাকবে না। বাড়িতে ফিরে গিয়ে মোবাইল-ইন্টারনেটে সময় কাটানোর কথাটাও একবার ভেবে দেখল ফারহান। নাহ! ওসব তো রোজই করা হয়!
হঠাৎই নারীকণ্ঠের একটা আর্তচিৎকারে ঘোর কাটল ওর। ধড়ফড় করে দৌড়ে গেল সে। চিৎকার আসছে বাঁধের নিচ থেকে।
আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ফারহান দেখতে পেল যে চিৎকার করছে সেই মেয়েটা যাকে একটু আগেই সে দেখেছে, পাশে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর সাথে থাকা ছেলেটা।
তাড়াতাড়ি করে নিচের দিকে নামতে লাগল ফারহান।
পিছনে কিছু মানুষের গলা শুনতে পেল সে। একবার ঘুরে তাকিয়ে বুঝতে পারল যে মেয়েটার চিৎকারে আশে-পাশের কিছু বাড়ি থেকেও মানুষ বেরিয়ে এসেছে।
প্রায় দুই-তিন মিনিট পর ফারহান পৌঁছে গেল সেই ছেলে-মেয়েদুটোর কাছে।
“কী হয়েছে? এভাবে চিৎকার করছেন কেন?” অবাক কণ্ঠে বলে উঠলো সে।
মেয়েটার চিৎকার ততক্ষণে থেমে গেছে। হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা হাত বাড়িয়ে ডান দিকে নির্দেশ করল।
সেদিকে তাকিয়েই গায়ের রক্ত হিম হয়ে এল ফারহানের! একজন মধ্যবয়স্ক লোকের দেহ পড়ে আছে! চোখদুটো ভীষণ বাজেভাবে থেঁতলে দেওয়া লোকটার আর লোকটার বুকের ওপর পড়ে আছে পাঁচ-ছয় বছর বয়স্ক একটা বাচ্চা মেয়ে।
কোনমতে এগিয়ে গিয়ে লোকটার নাড়ি পরীক্ষা করল ফারহান। নাহ! নাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। লোকটা মারা গেছে! বাচ্চা মেয়েটার নাকের কাছে হাত দিয়েই সে বুঝতে পারল যে মেয়েটা তখনও জীবিত!
“এই যে ভাই! লাশ-টাশ নাকি ওগুলো? আপনি কেন হাত দিচ্ছেন? পুলিশ এসে হাত দিবে!” পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল।
ফারহান ফিরে তাকিয়ে দেখল তার পিছনে জনা-পাঁচেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে কে কথাটা বলেছে সে বুঝতে পারল না।
“এই যে ভাই, কথা শুনেন না? সরেন ওইখান থেকে! থানাতে ফোন দিয়েছি আমি!” মোটা লম্বামতো একজন লোক বলে উঠল। ফারহান বুঝতে পারল যে এই লোকটাই আগে কথাগুলো বলেছিল।
“আপনার পরিচয়?” ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করল ফারহান।
“আমি আবুল হোসেন! এই এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর! এইখানে পাশেই বাড়ি। চিৎকার-চেচামেচি শুনে বাইরে এলাম। আপনে কে ভাই? আদব কায়দা কি কিছুই জানেন না?” রাগী কণ্ঠে বলে উঠল লোকটা।
“ইন্সপেক্টর কাজি ফারহান জারিফ, ডিবি।” নিজের আইডি কার্ডটা লোকগুলোর সামনে মেলে ধরে বললো ফারহান।
“স্যার! সরি আমি বুঝতে পারিনি।” এই বলে পিছিয়ে গেল আবুল হোসেন। ভদ্রলোক যে বেশ ভয় পেয়েছে বোঝাই যায়।
“কোন সমস্যা নেই কাউন্সিলর সাহেব। থানায় ফোন দেওয়া হয়েছে না? আসুক ওরা। ওদের সাথে প্রথমে আমিই কথা বলব। আর শুনুন বাচ্চা মেয়েটা বেঁচে আছে। ওকে এখনই হাসপাতালে নিতে হবে। তাড়াতাড়ি কিছু একটা ব্যবস্থা করুন।” বলে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল ফারহান।
“স্যার বলছিলাম কী, হাসপাতাল তো দূর হয়ে যায়। তার চেয়ে ওকে পর্যটন মোটেলের ওদিককার ক্লিনিকটায় নিলে ভালো হয় না? ওখানকার ডাক্তার আপা খুবই ভালো!” মাথা নিচু করে বলল আবুল হোসেন।
বিরক্ত লাগছে ফারহানের! জানত এই কথাটাই শুনতে হবে তাকে। তবে মেয়েটার শরীর কাঁপছে! এখনই ওকে ডাক্তারের কাছে না নিতে পারলে খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে হাসপাতাল একটু দূরই হয়ে যায়।
“আপনি আমার সাথে আসুন কাউন্সিলর সাহেব, আর আপনার লোকদের বলে দিন যে পুলিশ আসার পর ওরা যেন অপেক্ষা করে। আমি না আসা পর্যন্ত যেন মৃতদেহে হাত না দেয়।” বাচ্চা মেয়েটাকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে বলল ফারহান।
ওরা এগিয়ে চলল সেই ক্লিনিকটার দিকে।
“আরে ভাই ঢুকতে দেন, আফা আমারে চিনে! আর রুগীর অবস্থাও ভালা না! সাথে ডিবি অফিসার আছে ওই দেখ!” গার্ডকে বললেন আবুল হোসেন।
“আফা অনেক বড় ডাক্তার। আপনার মতো কাউন্সিলররে পরোয়া করার সময় উনার নাই! আর ডিবি? উনি যে ডিবির লোক তার কী প্রমাণ? বসেন। আফা রোগী দেখতেছে। শেষ হলে এমনেই আপনাদের ঢুকতে দেওয়া হবে।” গার্ডের কণ্ঠ দিয়ে যেন ব্যঙ্গ ঝরে পড়ছিল।
ওদিকে ডাক্তারের ঘরের ওপর লাগান নেমপ্লেটটা দেখে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেছে ফারহান। ওখানে লেখা রয়েছে
ডা. ইশরাত খানম
এমবিবিএস, এমপিএইচ,
সিসিডি, এমপিএইচসি
আজ কতদিন পর এই ক্লিনিকে এসেছে ফারহান! শুরুর দিকে মাঝে মাঝে ইশরাতের চেম্বারে আসত সে। কিন্তু গত কয়েক বছরে সবকিছুই বদলে গেছে!
“স্যার! ও স্যার! এই ছোড়া তো বিশ্বাসই করে না আপনি ডিবির লোক।” ফারহানের কানের কাছে এসে বলল আবুল হোসেন।
বাস্তবে ফিরে এল ফারহান। আর সাথে সাথে যেন রক্ত চড়ে গেল তার মাথা। এক হাতে বাচ্চাটাকে শক্ত করে ধরে অপর হাত দিয়ে খপ করে গার্ডের কলারটা চেপে ধরল সে। ছয়ফুট লম্বা ফারহানের সামনে ইঁদুরের মতো অবস্থা হল গার্ডের। ভয়ে চিৎকার শুরু করল সে।
রাগের মাথায় আর কোন হুশই ছিল না ফারহানের।
“ফারহান! এসব কী!” ইশরাতের কণ্ঠে শুনতে পেল ফারহান। সম্ভবত গার্ডের চিৎকার শুনতে পেয়ে বের হয়ে এসেছে সে।
“এখানে কী করছ ফারহান? তোমার কোলে ওই বাচ্চাটা কে?” প্রায় চিৎকার করে উঠল ইশরাত।
বলার মতো কিছুই পেল না ফারহান। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সে।
“কাউন্সিলর সাহেব? কী হয়েছে এখানে?” আবুল হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলল ইশরাত।
“আফা! আপনি স্যারকে চেনেন? উনি ডিবি অফিসার!” কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল আবুল হোসেন।
“হুম! ডিবি ইন্সপেক্টর কাজি ফারহান জারিফ! আমার স্বামী! আমার চেয়ে ভালো আর ওকে কে চেনে?” ঠান্ডা গলাতে বলল ইশরাত।
ওর উত্তর শুনে বোবা হয়ে গেল আবুল হোসেন।
ইশরাতের চেম্বারে চুপচাপ বসে আছে ফারহান আর আবুল হোসেন।
পাশে একটা বেডে বাচ্চা মেয়েটাকে শুইয়ে তাকে দেখছে ইশরাত। সবকিছু বোঝানোর পর ইশরাতের রাগ আর নেই।
“স্যার! এই আফা যে আপনের বউ সেইটা কন নাই কেন?” ফিসফিস করে বলল আবুল হোসেন।
“জানি না।” এইটুকু বলেই থেমে গেল ফারহান। আবুল হোসেন বুঝতে পারল যে এসব নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছে না ফারহান।
মেয়েটাকে একটা ইনজেকশন দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওদের সামনের চেয়ারটায় এসে বসল ইশরাত। তারপর একগ্লাস পানি খেয়ে ফারহানের দিকে তাকাল।
“ভয়ের কিছু আছে কী?” যান্ত্রিক কণ্ঠে বলল ফারহান।
“নাহ! মেয়েটা কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে! সম্ভবত ওর বাবাকে খুন করার দৃশ্য দেখে ফেলেছে ও। অজ্ঞান হয়ে আছে এখনও। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে। সমস্যা নেই।” বলল ইশরাত।
“তোমাকে যদি ডিসটার্ব করে থাকি সেজন্য আমি সরি।” বলল ফারহান।
“আরে না না। বাচ্চা মেয়েটার জীবনের প্রশ্ন! তোমাদের জায়গাতে আমি থাকলেও এমনটাই করতাম। তো, চা খাবে তুমি?”
“নাহ।” জানালার দিকে তাকিয়ে বলল ফারহান।
“আপনি চা খাবেন কাউন্সিলর সাহেব?” আবুল হোসেনকে বলল ইশরাত।
“খাওয়া যায় ম্যাডাম। হেহে... আপনাদের সোনায়-সোহাগা জুটি একেবারে! পুলিশ আর ডাক্তার।” দাঁত বের করে হেসে ফেলল আবুল হোসেন।
“সে আর বলতে ! আচ্ছা আমি চা আনাচ্ছি।” এই বলে গার্ডকে ডাকল ইশরাত।
ঘরে ঢুকেই গার্ড এদিকে ওদিক তাকিয়ে ফারহানের পা-টা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
“আরে! কাঁদছেন কেন?” অবাক হয়ে বলল ফারহান।
“স্যার! আপনি ম্যাডামের হাফপ্যান্ট! জানতাম না! তার উপরে আবার ডিবি অফিসার!” মাফ কইরা দেন কাঁদতে কাঁদতেই বলল গার্ড।
“হাফপ্যান্ট!” অবাক হয়ে বলল ফারহান।
“ও আসলে বলতে চেয়েছে হাজব্যান্ড!” এই বলে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে হাসি চাপল ইশরাত।
কতদিন পর ওর সামনে এইভাবে হাসল ইশরাত! গার্ডের ওপর খুশি হয়ে উঠল ফারহানের মন।
“পা ছাড়েন। কোন সমস্যা নেই।” এই বলে উঠে দাঁড়াল ফারহান।
তখনই বেজে উঠল আবুল হোসেনের ফোন। ফোন ধরে কিছুক্ষণ হা-হু করে ফোনটা নামিয়ে রাখল সে।
“আফা! আর চা খাওয়া হইতেসে না, স্যার পুলিশ আইসা পড়সে চলেন।” বলে উঠল লোকটা।
“তুমি এই কেসে কাজ করছ নাকি? আজ না তোমার ছুটির দিন?” অবাক হয়ে ফারহানের দিকে তাকিয়ে বলল ইশরাত।
“হুম, কিছু ব্যাপার আছে। সেজন্যই আমি আগ্রহী। ছুটির দিন আর ভালো লাগছে না, দেখি কী হয়।” এই বলে উঠে পড়ল ফারহান তারপর বলল, “ইশরাত! বাচ্চাটাকে দেখে রেখ, ও সম্ভবত হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী। আমি একটু পরই আসছি।”
মাথা নাড়ল ইশরাত।
“তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন যে আশপাশে আর কেউ ছিল না?” অবাক কণ্ঠে রাজপাড়া থানার সাবইন্সপেক্টর অজিতের দিকে তাকিয়ে বলল ফারহান।
“সেটাই মনে হচ্ছে স্যার, আপনি মানা করেছেন শুনে আমরা লাশে হাত দিইনি, তবে আশেপাশের পরিবেশ দেখেশুনে তাই মনে হয়েছে আর স্থানীয় একজন লোকও বলেছে যে খুব সকালে তিনি এই লোককে মেয়েটাকে নিয়ে টি-বাঁধে আসতে দেখেছে।” বলল অজিত।
“হুম, ভদ্রলোকের পরিচয় জানা গেছে?”
“জানা গেছে স্যার, উনার নাম মোঃ ফরহাদ হোসেন। একটা কলেজে বাংলার অধ্যাপক। বামপাটা কয়েক বছর আগে একটা অ্যাকসিডেন্টে নাকি নষ্ট হয়ে গেছে।”
“বাহ! এতোকিছু এতো তাড়াতাড়ি জেনে ফেললেন?”
“উনার পকেটে একটা আইডিকার্ড পেয়েছিলাম স্যার। সেখান থেকেই উনার কলেজের নম্বর নিয়ে ফোন করে সবকিছু জেনেছি।”
“আচ্ছা, উনার মেয়ের নাম কী?”
“ওহ আচ্ছা! হুম, শুনলাম আপনি নাকি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিলেন বাচ্চাটাকে। কেমন আছে ও? বাচ্চাটার নাম ক্রান্তি। বিয়ের পর দীর্ঘকাল সন্তানহীন ছিলেন জনাব ফরহাদ আর তার স্ত্রী। কয়েক বছর আগেই ক্রান্তির জন্ম হয়েছে।”
“উনার স্ত্রী কোথায়?”
“ভদ্রমহিলাকে সব জানান হয়েছে। খবর শুনে নাকি উনি অজ্ঞান হয়ে গেছেন। আমরা লাশ নিয়ে যাই? কী বলেন স্যার? পোস্ট মর্টেমের পর মর্গে এসে ইনাকে দেখে নেবেন ইনার স্ত্রী আর আপনি বাচ্চাটাকে আনুন।”
“পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আমার দ্রুত চাই মি. অজিত।”
“স্যার এই কেসটা কি ডিবি তদন্ত করছে?” সাহস করে প্রশ্নটা করেই ফেলল অজিত।
“এই প্রশ্ন কেন?”
“না মানে আপনাদের হেডকোয়ার্টার থেকে তো থানাতে কিছুই জানান হয়নি।”
“হেডকোয়ার্টারে আমি কথা বলে নেব, আপনি পোস্টমর্টেমের ব্যবস্থা করুন।”
“আচ্ছা স্যার।”
“জাহাজের শোপিসটা দেখে ভয় পেয়েছে? কী বলছ!” অবিশ্বাস্য গলাতে বলে উঠল ফারহান।
“সেটাই! একটু আগেই জ্ঞান ফিরেছে, তারপর আমার টেবিলের ওপর ওই জাহাজের শোপিসটা দেখে খুবই জোরে চিৎকার করেছে বাচ্চাটা। আমিও অবাক!” বলল ইশরাত।
কিছুক্ষণ আগেই ইশরাতের চেম্বারে ফিরে এসেছে ফারহান। ক্রান্তিকে নিয়ে যেতে হবে।
“তো, ক্রান্তি কোথায়?” ইশরাতের চোখে চোখ রেখে বলল ফারহান।
“ক্রান্তি?”
“ওই বাচ্চা মেয়েটার নাম ক্রান্তি।”
“ওহ! বাথরুমে গেছে আয়ার সাথে, আসছে। তুমি ওকে নিয়ে যাচ্ছ, নাকি?”
“হুম তা তো যেতেই হবে। ওর মা আসবেন, ভদ্রমহিলার হাতে ওকে বুঝিয়ে দিতে হবে। আর তদন্তের ব্যাপার তো আছে!”
“বাচ্চাটা অনেক মিষ্টি! আমাদের যদি...” বলতে বলতে থেমে গেল ইশরাত, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল “আচ্ছা ফারহান, এই কেসের তদন্ত তুমি করছ?”
“অফিশিয়ালি না, তবে আমার ইচ্ছা আছে। হেড অফিসে জানিয়েছি, দেখা যাক কী হয়।”
ততক্ষণে আয়ার হাত ধরে চলে এসেছে ক্রান্তি।
“মা, ইনি তোমার আংকেল, ইনি তোমাকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাবেন।” ক্রান্তির থুতনি ধরে আদর করে বলল ইশরাত।
“তুমি নিয়ে চল ডাক্তার আন্টি! আমার ভয় করছে! ওটা যদি আবার আসে...” ক্রান্তির গলা তখনও কাঁপছে।
“ওটা! ওটা কী মা?” ফারহান জিজ্ঞাসা করল।
হাত দিয়ে ইশরাতের টেবিলের ওপর রাখা সেই জাহাজের শোপিসটা দেখাল ক্রান্তি।
“জাহাজ? কেমন জাহাজ? টি-বাঁধে জাহাজ? কেমন ছিল জাহাজটা?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করল ফারহান।
“আমি জানি না! কিচ্ছু জানি না!” এই বলে ডুকরে কেঁদে উঠল ক্রান্তি।
“শোন ফারহান! এ কেবল একটা মানসিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে। তুমি সবসময় জোর দিয়ে মানুষের পেট থেকে কথা বের করতে চাও। কিন্তু এ তেমন অবস্থায় নেই!” বেশ রাগী কণ্ঠে বলল ইশরাত।
“এখানে এসব না বললে হয় না? আয়া দাঁড়িয়ে আছে!” ইশরাতের দিকে তাকিয়ে বলল ফারহান।
লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে চলে গেল আয়াটি।
কিছুক্ষণের নীরবতা।
তারপর ক্রান্তিকে কোলে নিল ফারহান। তারপর দরজার দিকে হাঁটা দিল সে।
“আমি যাচ্ছি, ধন্যবাদ সাহায্য করার জন্য।” ইশরাতের দিকে ঘুরে বলল ও।
“কোন সাহায্য লাগলে ফোন দিও।”
“আর কিছুই দরকার হবে না। পোস্টমর্টেম করার জন্য আলাদা ডাক্তার আছে। তারাই সব দেখবে।” বলে গটগট করে হেঁটে চলে গেল ফারহান।
জাহাজের সেই শোপিসটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল ইশরাত! আজ কেন যেন তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে! বিয়ের এতগুলো বছরেও তাদের কোন সন্তান হয়নি! একটা সন্তান হলে হয়ত ফারহানের সাথে ওর দূরত্ব কমে যেত।
মনে মনে কয়েকবার ফারহানকে ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তাও করেছে সে। কিন্তু কেন যেন পারেনি।
শুধু এক ছাদের নিচেই থাকছে ওরা। কিন্তু গত ছয়-সাত মাস একবারের জন্যও ঘনিষ্ট হওয়া হয়নি তাদের!
মিসেস ফরহাদ হোসেনের চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতে চোখদুটো ফুলে লাল হয়ে গেছে তার।
রাজপাড়া থানার ওসির সামনে ক্রান্তিকে কোলে নিয়ে বসে আছেন তিনি। পাশের চেয়ারটায় বসে আছে ফারহান।
“ফারহান সাহেব, আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন, আর আপনার ডিপার্টমেন্ট থেকে কিছু জানান হয়েছে কি আপনাকে?” বললেন ওসি আলি মুনতাসির।
“ডিবি এই কেসে সরাসরি জড়াতে চাচ্ছে না, তবে আমাকে বলা হয়েছে আমি চাইলে আপনাদের সাথে কাজ করতে পারি, তবে সেক্ষেত্রে আপনাদের সাহায্যের ওপরেই নির্ভর করতে হবে আমাকে। আমার বড়কর্তারা এই কেসকে ডিবির জন্য শুধুই সময় নষ্ট হিসাবে দেখছেন।” হতাশ কণ্ঠে বললো ফারহান।
“অবশ্যই সাহায্য করবো! কিন্তু কেন যেন এই কেসটা আমার কাছে আত্মহত্যার কেসই মনে হচ্ছে! দেখলেন না ক্রান্তি কী বললো? ওর বাবা নিজেই নিজের দুই চোখে লাঠি দিয়ে খোঁচা মেরেছেন।”
“ও কিন্তু একটা বড় জাহাজ আর তার ওপরের কিছু কামানের কথাও বলেছে, আর ওর মতে ওসব দেখেই ওর বাবা এমন করেছেন!”
“এসব ওর কল্পনা। পদ্মায় অমন জাহাজ আসবে কী করে?”
“মিসেস হোসেন, আপনার হাজবেন্ডের কি কারও সাথে কোন শত্রুতা ছিলো?” পাশে বসা ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললো ফারহান।
“না না! ওর মতো সহজ-সরল মানুষের সাথে কার সমস্যা থাকবে? প্রতিদিন সকালে ক্রান্তিকে নিয়ে মর্নিং ওয়াক করতে যেতো! আর আজ... আমি বুঝতে পারছি না কী থেকে কী হয়ে গেলো!” কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন মহিলা।
“আচ্ছা আপনি বাড়ি যান, ওসি সাহেব গাড়িতে করে আপনাদের বাড়ি পৌঁছে দেবেন। কাল হয়তো একবার আমি আপনার বাড়িতে এসে ক্রান্তিকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বের হবো। ঘুরবো ফিরবো! ভয় পাবেন না! ও আমাকে পছন্দ করে! কেমন জাহাজ ও দেখেছে তার একটা ছবি না দেখলে আমার চলছে না! স্কেচ আর্টিস্টকে দিয়ে একটা ছবি আঁকাতে হবে।”
“আমার মেয়েকে না টানলেই কী নয়?”
“আপনি কি চান না আপনার স্বামীর মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন হোক?”
“তা চাই!”
“আচ্ছা, আপনি যান। ওসি সাহেব উনাদের বাড়ি যাবার ব্যবস্থা করুন।
“পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কখন আসবে ওসি সাহেব?” বিরক্ত স্বরে বললো ফারহান।
“কালকের মধ্যেই।” ওসি মুনতাসিরের কণ্ঠটা কেমন যেন ঠান্ডা। তাঁর থানাতে তাঁর ওপর কেউ খবরদারি করছে ব্যাপারটা মেনে নেওয়া সহজ হচ্ছে না তাঁর পক্ষে। কিন্তু একজন ডিবি অফিসারকে কিছুই বলতে পারছেন না তিনি!
“হুম, কাল সকালে আমার একটা গাড়ি চাই, ক্রান্তিকে নিয়ে বের হবো।” চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো ফারহান।
“অবশ্যই।”
“আর অজিত সাহেবকেও বলে দিন উনি যেন আমার সাথে যান।”
“আচ্ছা, তাই হবে।”
“আর জাহাজের ব্যাপারে অনেক ইনফর্মেশন রাখেন এমন কাউকে চাই আমার।”
“এমন কেউ...উমম...আছেন একজন! তবে উনি কি...”
“কে উনি, নামটা বলুন শুধু।”
“ভদ্রমহিলার নাম অনিন্দিতা কাদের, রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের প্রভাষক। কিছুদিন আগেই জয়েন করেছেন শিক্ষক হিসাবে। ন্যাভাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ওপর বিশেষ ডিগ্রী আছে নাকি উনার। জাহাজ নিয়ে নাকি অনেক গবেষণাও করেন উনি।”
“আপনি উনাকে কী করে চেনেন?”
“আমার মেয়ে রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ে। মাঝে মাঝে খোঁজখবর নেই। সেখান থেকেই মহিলার সাথে পরিচয়। অমায়িক একজন মহিলা তবে একটু জেদি আর একরোখা।”
“ডিবির সামনে ওসব জেদ টেদ খাটবে না। উনার নাম্বার দিন।”
“উনার কার্ডই আছে। এই নিন, আর আমি উনাকে ফোন করে আপনার কথা বলে দেব।” এই বলে ফারহানের হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিলেন ওসি সাহেব।
আড়চোখে কার্ডটা দেখলো ফারহান।
‘ড. অনিন্দিতা কাদের
বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ারিং(যন্ত্রকৌশল), এম.এস.সি ইঞ্জিনিয়ারিং(নৌ প্রকৌশল)
পি.এই.ডি(জাপান)
প্রভাষক(যন্ত্রকৌশল বিভাগ)
রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।’
মনে মনে হাসলো ফারহান। এ ধরনের কার্ডগুলো দেখে আজকাল হাসি পায় তার। ওর নিজের স্ত্রীরও এমন কার্ড রয়েছে।
আসলে আজকাল নামের পাশে একগাদা ডিগ্রী না থাকলে কেউ পাত্তা দেয় না! তাই এই মানুষগুলোকেও খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না।
বাড়িতে ঢুকে অবাক হয়ে গেলো ফারহান। ওর জন্য টেবিলে খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করছে ইশরাত!
অনেক চেষ্টা করেও ফারহান মনে করতে পারলো না যে শেষ কবে ও ইশরাতকে এইভাবে অপেক্ষা করতে দেখেছিলো।
“হাতমুখ ধুয়ে এসো, খেয়ে নেবে।” বললো ইশরাত।
“তুমি খেয়েছ?”
“নাহ, এসো একসাথে খাবো।”
আর কিছু না বলে হাত-মুখ ধুয়ে জামা-কাপড় পাল্টে এলো ফারহান।
“ওই বাবুটার কী খবর?” ফারহানের প্লেটে ভাত তুলে দিয়ে বললো ইশরাত।
“ওকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে এলাম। কাল আবার ওকে নিয়ে বের হবো। ওর দেখা ওই জাহাজটার একটা স্কেচ বানাতে হবে।” খেতে খেতে বললো ফারহান। মাছভাজা করেছে ইশরাত। ফারহানের খুবই প্রিয় খাবার!
“জাহাজ! আচ্ছা শোনো! আজকে নেটে চিকিৎসা সংক্রান্ত ওয়েবসাইটগুলো ঘাঁটছিলাম আর একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম জানো!”
“কী?”
“গত কয়েক মাস ধরে না পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তেই অনেক মানুষ মনোচিকিৎসকদের কাছে অভিযোগ করেছে যে তারা স্বপ্নে নাকি একটা বিকট জাহাজ দেখে। আরও আজব ব্যাপার কী জানো?”
“কী?”
“তাদের মধ্যে অনেকেই আত্মহত্যা করেছে!”
“ইশরাত...”
“কী?”
“থাক পরে বলছি।” এই বলে চুপচাপ খেতে লাগলো ফারহান।
খাওয়া শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো ফারহান। আজকাল ফেসবুকের বাইরে ইন্টারনেট খুব একটা ঘাটে না সে। কিন্তু একজন ডাক্তার হিসাবে ইশরাতকে নতুন নতুন অসুখ সম্পর্কে বেশ ভালোই খবর রাখতে হয়।
বেশ অনেকক্ষণ পর বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো ফারহান।
অদ্ভুত ব্যাপার! ইশরাত জেগে রয়েছে!
“ঘুমাবে না? সকালে ডিউটি নেই?” অবাক হয়ে বললো ফারহান।
“ফারহান! শোনো! আজকে ওই মেয়েটাকে দেখার পর আমার কেমন যেন লাগছে!”
“কেমন?”
“একটা বাচ্চা! কত্তো সুন্দর একটা বাচ্চা! আমাদের যদি...”
“ঘুমাও ইশরাত।”
“আচ্ছা ঠিকাছে, এসো বিছানায়।”
ফারহান বিছানায় ওঠার সাথে সাথে ওর ওপর ঝাপিয়ে পড়ল ইশরাত। নিজের ঠোঁটদুটোকে চেপে ধরলো ফারহানের ঠোঁটে!
প্রথমে কিছুটা ইতঃস্তত করলেও পরে ইশরাতকে জাপটে ধরলো ফারহান! ওর কানে ভেসে বেড়াতে লাগলো ‘অ্যাপোক্যালিপ্স’ গানটার সেই লাইনটা, “মাই লিপস, অ্যান্ড ইয়োর লিপস! অ্যাপোক্যালিপ্স!”
রাত তিনটা বাজে। চুপচাপ বারান্দাতে দাঁড়িয়ে ধূমপান করে চলেছে ফারহান। ইশরাত ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত দুটো পর্যন্ত উদ্দাম ভালোবাসার ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মেয়েটা। ফারহান নিজেও ক্লান্ত।
পাঁচ বছর হলো বিয়ে হয়েছে ওদের। শুরুর দিকের রাতগুলোতে ঠিক এভাবেই একে অপরকে ভালোবাসত ওরা!
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে প্রেম ওদের। ফারহান পড়ত রাজশাহী ভার্সিটিতে আর ইশরাত রাজশাহী মেডিকেলে। ওদের দুজনের পরিবারের সম্মতিতেই বিয়েটা হয়েছিল।
কিন্তু বিয়ের কয়েকমাস পর হুট করেই যেন সবকিছু বদলে যেতে লাগলো। নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ওরা।
এমনও দিন গেছে যে অনেক রাতে অফিস থেকে ফিরে ফারহান দেখেছে যে ইশরাত ঘুমিয়ে আছে আবার সকালে ডিউটিতে যাওয়ার সময়ে ইশরাত দেখেছে যে ফারহান ঘুমিয়ে আছে। এমনও সময় গেছে যে পুরো সপ্তাহ জুড়েই ওদের একটা কথাও হয়নি।
ধীরে ধীরে বেড়ে গেছে দূরত্ব। রাতের বেলা ঘনিষ্ট হতেও কেমন যেন অস্বস্তি হতো ওদের। এতো বছরেও বাচ্চা-কাচ্চার কথা তাই কেউই তোলেনি।
মাঝে মাঝে কাছের আত্মীয়রা ব্যাপারটা তুললে দুজনেই কৌশলে এড়িয়ে যেত।
কারণ সম্ভবত দুজনের মনের মধ্যেই একটা সন্দেহ দানা বেঁধেছিল, যে অপরজন হয়ত আর বেশীদিন তার সাথে থাকবে না!
এই সন্দেহটাই একটা সম্পর্ককে শেষ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
“তো পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে যে ভদ্রলোক নিজেই নিজের চোখে লাঠিয়ে দিয়ে গুঁতো মেরেছিলেন?” অবাক হয়ে বলল ফারহান।
“সেটাই।” গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ওসি মুনতাসির।
রাজপাড়া থানার ওসির কক্ষে বসে আছে ফারহান। ওর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে সাব ইন্সপেক্টর অজিত।
“স্যার! উনার বাচ্চা মেয়েটাও কিন্তু এটাই বলেছিল।” বলে উঠলো অজিত।
“মেয়েটা তো একটা বড় জাহাজের কথা বলেছিলো? সেটার কী হবে?” কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলো ফারহান।
“জাহাজের অস্তিত্ব তো আর পোস্টমর্টেমে প্রমাণ করা যাবে না, তাই না?" বলে উঠলেন ওসি।
“যে ডাক্তার পোস্টমর্টেম করেছে তার সাথে দেখা করতে চাই আমি।”
“জানতাম আপনি এটাই বলবেন। অজিত উনাকে ওই ডাক্তারের সাথে দেখা করাও, আর আজ সারাদিন তুমি উনার সাথেই থাকবে।” নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন ওসি।
“আরে ফারহান যে!” এই বলে উৎফুল্লভাবে এসে ফারহানকে জড়িয়ে ধরল শুভ।
“শুভ একটুও বদলায়নি! এখনও সেই আগের মতোই উৎফুল্ল থাকে সবসময়।” মনে মনে ভাবল ফারহান।
“তুই রাজশাহীতে?” একটু ধাতস্থ হয়ে বলল ফারহান।
“এই গতমাসে জয়েন করলাম। কেমন আছিস তুই? কেমন আছে...ইশরাত?”
“ভালোই আছি আমরা। তুই কেমন আছিস? বিয়ে থা করেছিস?”
“আর বিয়ে দোস্ত! নাহ ওসব আর আমাকে দিয়ে হবে না। এই জীবন নিয়েই ভালো আছি। তো আমার কাছে কী মনে করে? সাথে দেখি অজিত সাহেবকেও এনেছিস। ওহ! আচ্ছা, তবে তুইই সে ডিবি অফিসার? তোর কথা বলেছিলেন আমাকে ওসি সাহেব।”
“সেটাই। তুই নাকি রিপোর্ট দিয়েছিস যে ভিক্টিম ভদ্রলোক আত্মহত্যা করেছেন?”
“সেটাই! লাঠিতে শুধুই উনার আঙ্গুলের ছাপ।”
“এমনও তো হতে পারে যে খুনি গ্লাভস পরে ছিল?”
“উনার মেয়ে নাকি কাউকে দেখেনি! আর ভদ্রলোক শেষমুহূর্তে বেশ উত্তেজিত ছিলেন।”
“অ্যালকোহল পাওয়া গেছে উনার রক্তে?”
“আরে না না! তেমন কিছু না। কিছু দেখে সম্ভবত উনি ভয় পেয়েছিলেন। সে কারণেই...”
“সে কারণে আত্মহত্যা? তাও নদীর ধারে এসে? তাও এইভাবে নিজের চোখে লাঠি দিয়ে খোঁচা মেরে? নিজের মেয়ের সামনে?”
“দোস্ত! আমি যা রিপোর্ট দিয়েছি তা ঠিকই দিয়েছি। লোকটা আত্মহত্যাই করেছেন।”
“টাকা খেয়েছিস নাকি কারও কাছে?”
“তোর আমাকে অমন মনে হয়?” ঠান্ডা গলায় বলল শুভ।
ফারহান বুঝতে পারল যে প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি। স্কুল থেকেই শুভকে চেনে ও। প্রচণ্ড আদর্শবান ছেলে সে। কারও এক পয়সাও কখনও এদিক সেদিক করার ইতিহাস নেই তার।
“তা কোথায় থাকিস এখন?” কথার মোড় ঘোরাতে বলল ফারহান।
“সরকারী কোয়ার্টারে। ওই যে ঘুষ খাই না, তাই বাড়ি করাটা এখনও হয়ে ওঠেনি।” মুচকি হেসে বলল শুভ।
চুপ করে রইলো ফারহান।
“তোরা কোথায় আছিস আজকাল? ইশরাতের কথা তো কিছুই বললি না?” বলল শুভ।
“ইশরাত অনেক ডিগ্রী নিয়ে নিয়েছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পড়াচ্ছে আজকাল, আর প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখে, এইতো।”
“বাচ্চা-কাচ্চা কটা হল তোদের?”
“একটাও না।”
“থাকিস কোথায়?”
“এই নে আমার কার্ড। বাড়ির ঠিকানা দেওয়া আছে, রাত আটটার পর যাবি, তখন গেলেই ইশরাতকে পেয়ে যাবি।” এই বলে একটা কার্ড শুভ’র হাতে ধরিয়ে পিছন ঘুরে হাঁটতে লাগল ফারহান।
হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল শুভ।
এতদিন পর এইভাবে শুভ’র সাথে দেখা হবে ভাবতে পারেনি ফারহান। ফারহানের স্কুল আর কলেজ জীবনের বন্ধু ছিল সে।
কিন্তু সমস্যাটা শুরু হয় ইশরাতকে নিয়ে।
ইশরাতের সাথেই মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় শুভ। ইশরাতের প্রতি খুবই দুর্বল ছিল ব্যাটা। ইশরাতকে খুশি রাখার জন্য কী না করত! এমনকি নোটগুলোও ইশরাতকে ফটোকপি করতে হত না। সবকিছু শুভই করে দিত।
স্বভাবতই ব্যাপারটা ভালোভাবে নিতে পারেনি ফারহান। ইশরাতের সাথে এই নিয়ে মনোমালিন্য হয়ে যায় তার।
এরপর থেকে ইশরাত এড়িয়ে চলত শুভকে।
শুভ’র সাথে ফারহানও আর কথা বলত না। মাঝে মাঝে দুয়েকবার রাস্তাঘাটে দেখা হলে কথা বলতে এগিয়ে এসেছিল শুভ, কিন্তু ফারহান দেখেও না দেখার ভান করত ওকে।
এম.বি.বি.এস পাশ করার পর দেশের বাইরে চলে যায় শুভ।
এরপর আজই ওকে প্রথম দেখল ফারহান।
***
ক্রান্তির বর্ণনা শুনে একমনে জাহাজের ছবিটা এঁকে চলেছে রতন। ব্যাপারটা তার জন্য নতুনই বটে। এর আগেও বিবরণ শুনে বহু মানুষের ছবি এঁকেছে সে। কিন্তু কোন জাহাজের ছবি, এই প্রথম আঁকছে সে।
প্রায় আধাঘন্টা পর রতন স্কেচটা দিল ফারহানের হাতে।
ছবিতে বেশ বিরাট আকৃতির একটা জাহাজ দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধ জাহাজ বলেই মনে হচ্ছে সেটাকে।
“ভালো কাজ করেছ রতন, এখন যাচ্ছি দরকার পড়লে আবার আসব।” এই বলে একহাতে ক্রান্তির হাত ধরে আরেকহাতে স্কেচটা নিয়ে বেরিয়ে এলো ফারহান।
“স্যার এবার কোথায় যাব?” গাড়িতে ওঠার পর জিজ্ঞাসা করল অজিত।
“ড. অনিন্দিতার সাথে দেখা করতে হবে। রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে চল, উনার চেম্বারে বসেই কথা হবে।”
বেলা সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্রান্তিকে ওর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে ফারহানকে। ভদ্রমহিলা একদমই ভেঙ্গে পড়েছেন।
“এই আঁকা ছবি দেখে কী করে বলব জাহাজের ব্যাপারে? তবে জাহাজটা বেশ পুরনো মনে হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এমন জাহাজ ছিল।” স্কেচটা হাতে নিয়ে বললেন ড. অনিন্দিতা।
ড. অনিন্দিতা চেহারায় কেমন যেন একটা স্নিগ্ধতা রয়েছে। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখে যে কঠোরতার ভাব থাকে এই মহিলার মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও নেই। উনার চেম্বারেই বসে আছে ফারহান আর তার পাশে বসে একটা পেপারওয়েট নিয়ে খেলছে ক্রান্তি।
“আপনি হয়ত গতকাল টি-বাঁধে ঘটে যাওয়া সেই রহস্যময় আত্মহত্যা কেসের ব্যাপারে শুনেছেন?” ড. অনিন্দিতার দিকে তাকিয়ে বলল ফারহান।
“হ্যাঁ! এক ভদ্রলোক নাকি নিজের চোখদুটো লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন! এটি তো তারই মেয়ে, তাই না? ওসি সাহেব আমাকে বলেছেন সব।”
“হুম, এই মেয়ে বলছে যে পদ্মার বুকে নাকি এমন আকৃতির একটা জাহাজ দেখা গেছিল আর সেটা দেখেই তার বাবা এমন করেছে!”
“আপনি এটা বিশ্বাস করেন?”
“আমি শুধু জানতে চাই এমন কোন জাহাজ কি সত্যিই আছে?”
“আচ্ছা, মা এদিকে এসো তো।” এই বলে ক্রান্তিকে নিজের কাছে ডেকে নিলেন ড. অনিন্দিতা। তারপর কম্পিউটারের মনিটরে তাকে একের পর এক জাহাজের ছবি দেখিয়ে যেতে লাগলেন।
পাঁচ মিনিট অতিক্রান্ত হওয়ার পরই হুট করে একটা বিরাট জাহাজ দেখে ভয় পেয়ে গেল ক্রান্তি। এতোটাই ভয় পেল যে সে চোখ ঢেকে ফেলল।
“কী হলো মা?” বললেন ড. অনিন্দিতা।
“এটাই ওই জাহাজ!” চোখ ঢেকেই বলল ক্রান্তি!
“বিসমার্ক!” অবাক হয়ে বললেন ড. অনিন্দিতা।
“কোন সমস্যা?” বলল ফারহান।
“আমি ভাবলাম মেয়েটাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু উল্লেখযোগ্য জাহাজ দেখাই। যাতে করে মেয়েটা বলতে পারে যে জাহাজটা কেমন ধরনের ছিল। কিন্তু এ তো বলছে...”
“এ কী বলছে?”
“এ বলছে যে এ ‘বিসমার্ক’কে দেখেছে!”
“বিসমার্ক?”
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান নৌবাহিনীর জলদানব বিসমার্ক! অটো ফন বিসমার্কের নামে রাখা হয়েছিল জাহাজটার নাম! মিত্রবাহিনীর আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল জাহাজটা।”
“সেই জাহাজটা কি এখনও আছে?”
“নাহ! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েই ডুবে গেছে ওটা!”
“কীহ!”
“হ্যাঁ। লম্বাতে আটশো পঁচিশ ফুট ছিল সেই জাহাজ। প্রচণ্ড গতিতে সাগর কাঁপিয়ে চলত সে! ব্রিটিশ জাহাজ এইচএমএস হুডকে পাঠানো হয় এই জাহাজকে ডোবানোর জন্য... কিন্তু...”
“কিন্তু কী?”
“১৯৪১ সালের ২৪শে মে সকালে হুড আক্রমণ করে বিসমার্ককে। আর এক ভয়াবহ জলযুদ্ধের পরে হুড নিজেই বিসমার্কের শিকারে পরিণত হয়!”
“তারপর?”
“ব্রিটিশ আর সুইডিশ নৌবাহিনী ছয়টি ব্যাটলশিপ, দুইটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এবং আরো কিছু জাহাজ নিয়ে যৌথভাবে আক্রমণ করে বিসমার্ককে। বিসমার্কের নাবিকেরাও বীরের মতোই যুদ্ধ করে। কিন্তু একটা সময়ে এতকিছুর সাথে আর পেরে ওঠে না বিসমার্ক! বিসমার্ককে ডুবিয়ে দেয় ব্রিটিশ নৌবাহিনী!”
“ইন্টারেস্টিং!”
“হুম আপনি নেট ঘাটলেই অনেক কিছুই পেয়ে যাবেন!”
“আচ্ছা।”
“আবার সাবাটন ব্যান্ডের বিসমার্ক গানটাও শুনতে পারেন। কিছুদিন আগেই বেরিয়েছে গানটা। বিসমার্ককে নিয়েই গানটা করেছে ওরা। এখন পর্যন্ত এটাই বছরের সবচেয়ে সফল হেভিমেটাল গান।”
“সাবাটন পাওয়ার মেটাল।”
“তা হেভিমেটালের মধ্যেই তো। যে মেটালই বলুন না কেন। সবই তো হেভিমেটালের অংশ।”
“আমার পাওয়ার মেটাল ভালো লাগে না। ব্ল্যাক মেটাল শুনি!”
“আমারও ব্ল্যাক মেটাল ভালো লাগে না। যাইহোক, গানটা শুনতে পারেন। সংক্ষেপে বিসমার্ক সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যাবেন। এখন একটু উঠতে হবে, আমার ক্লাস আছে।”
“আচ্ছা আচ্ছা।”
ফারহান বুঝতে পারল যে পাওয়ার মেটালকে খারাপ বলাতে ভদ্রমহিলা বেশ রাগই করেছেন। আজকাল ব্ল্যাক মেটালও শোনে না ফারহান। ইন্ডি আর শোগেজই বেশী শোনা হয় তার।
বাড়িতে ফিরে বেশ মনোযোগ দিয়ে সাবাটনের বিসমার্ক মিউজিক ভিডিওটা দেখল ফারহান।
বেশ ভালোই। অন্য পাওয়ার মেটাল গানগুলোর মতো নয় এটা। সাধারণত পাওয়ার মেটালে এত্তো বেশী হারমোনিক গিটার পার্ট থাকে যেগুলো একটা সময়ে বোরিং লাগতে থাকে এক্সট্রিম মেটাল ফ্যানদের কাছে। তবে এই গানটাতে সবকিছু বেশ ভালোভাবেই করা হয়েছে।
বিসমার্ক সম্পর্কে আসলেই বেশ ভালো ধারণা পেয়ে গেল সে। যে লাইনদুটো ফারহানের সবচেয়ে ভালো লাগল সে দুটো হলো-
“The flagship of the navy, the terror of the seas
His guns have gone silent at last”
যদিও কেসের সাথে এসবের কোন সম্পর্কই খুঁজে পেল না সে।
অবশেষে ড. অনিন্দিতাকে ফোন দিল সে।
“হ্যালো।” কিছুক্ষণ বাজার পরেই ফোনটা ধরলেন ড. অনিন্দিতা।
“আমি ইন্সপেক্টর ফারহান বলছিলাম।”
“বলুন ইন্সপেক্টর সাহেব।”
“গানটা শুনলাম!”
“হুম।”
“বেশ ভালো লাগল।”
“পচা পাওয়ার মেটাল আপনার ভালো লাগে? ওয়াও!”
“আহ! আমি সরি।”
“ব্যাপার না। এই শোনেন, ডা. ইশরাত আপনার স্ত্রী এটা আমি জানতাম না! আজ এক কলিগের কাছ থেকে জানলাম। এত বিখ্যাত একজন ডাক্তারের হাজবেন্ড আপনি! বাবারে বাবা!”
“ওকে চেনেন আপনি?”
“গোটা শহরেই সবাই চেনে উনাকে।”
“হুম, আপনার হাজবেন্ড কী করেন?”
“সরি, আমি অবিবাহিত।”
“মাই গড! আচ্ছা শোনেন, কাল দেখা করতে চাচ্ছিলাম আপনার সাথে।”
“কাল তো সন্ধ্যার আগে সময় হবে না। সন্ধ্যার দিকে ‘অলটাইম কফি শপ’এ চলে আসেন, ওখানকার কফি আমার প্রিয়।”
“আচ্ছা!”
“শুনছো, শুভ ফোন দিয়েছিল, তোমার সাথে নাকি ওর দেখা হয়েছিল?” বাড়িতে ঢুকেই বলল ইশরাত।
“হ্যাঁ, ও তো ওই কেসের পোস্টমর্টেম করছে।”
“আমাদের বাড়িতেও নাকি আসবে।”
“তোমাকে দেখতে আসবে।”
“উফফ! ফারহান! এই শোন চল তাড়াতাড়ি খেয়ে নেই!” এই বলে চোখ টিপল ইশরাত।
মনে মনে হাসল ফারহান। আজকেও রাতে ভালোমত ঘুম হবে না।
ছাব্বিশ তারিখের শুরুটা প্রচণ্ড হতাশার সাথে শুরু হলো ফারহানের জন্য।
ওকে ডিপার্টমেন্ট থেকে ফোন দেওয়া হয়েছে। একটা আত্মহত্যার কেস নিয়ে ও কেন এত মাথা ঘামাচ্ছে সেই ব্যাপারে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে। সম্ভবত এটা ওসি মুনতাসিরেরই কেরামতি।
শুধু তাই নয়, ক্রান্তির মা আর ক্রান্তিকে ওর সাথে দিতে চাচ্ছেন না। মেয়েকে নাকি হারাতে চান না তিনি।
বাংলাদেশের মানুষের সমস্যাই এটা! সবসময় ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায় তারা।
কিন্তু এটাকে আসলে বেঁচে থাকা বলে না।
“এই ইশরাত!” বলে ডেকে উঠল শুভ।
“আরে শুভ যে!” শুভকে চিনতে পেরে অবাক হয়ে বলল ইশরাত।
পড়ন্ত বিকালে বাজার করে বাড়ি ফিরছিল ইশরাত আর সেখানেই শুভ তাকে দেখে ফেলে।
“কেমন আছিস রে ইশরাত?” বলে উঠল শুভ।
“এইত, তুই?”
“যেমন দেখছিস। তোর হাজবেন্ড শালা তো এখনও আমাকে সহ্য করতে পারে না!”
“বাদ দে! চল, বাসায় চল।”
“আরে ধুর! আমাকে জেলে ভরবে তোর বর! তার চেয়ে চল কোথাও কফি খাই।”
“আচ্ছা, অলটাইম কফি শপ তো কাছেই, ওখানেই চল।”
“তাহলে ব্যাপারটাকে আপনি অলৌকিক হিসাবে নিচ্ছেন?” কফির কাফে চুমুক দিয়ে বললেন ড. অনিন্দিতা।
“তাছাড়া আর কী? এত মানুষ স্বপ্নে কী দেখল? আমি কী দেখলাম?”
“হুমম.. আচ্ছা আপনি কি নাস্টিসিজমের ব্যাপারে শুনেছেন?”
“নাহ।”
“একটা অদ্ভুত ধর্ম এটা। এরা বলে যে পৃথিবীর মানুষ বা ধর্মগুলো যাকে ঈশ্বর বলে মানে সে আসলে ঈশ্বর নয়! সে ডেমাইয়ার্জ নামের একটা ডিমন!”
“মানে?”
“আচ্ছা! নাস্টিসিজম অনুসারে এই জগৎ সংসারে অনেক মহাবিশ্ব রয়েছে। এর মধ্যে কিছু সত্যিকারের মহাবিশ্ব আর বাকিগুলো নকল! প্রতিবিম্ব মহাবিশ্ব! সবকিছু সৃষ্টি করেছেন একজন মহান ঈশ্বর আর প্রতিটি আসল মহাবিশ্বের দায়িত্বে রয়েছে তার মনোনীত একজন করে প্রতিনিধি আর নকলগুলো শাসন করে ডিমনেরা!”
“আচ্ছা!”
“নাস্টিসিজম আরও বলে যে সবকিছুর মধ্যেই আত্মা আছে! সে জীব হোক আর জড় হোক! মৃত্যুর পর এই আত্মা সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু আত্মাকে ডেমাইয়ার্জ আটকে ফেলে! ওরাই প্রেত হয়ে এই জগতে থাকে! মানে মৃত্যুর পরেও ফিরে আসে!”
“আজব!”
“শুধু তাই নয়! ডেমাইয়ার্জ শক্তি পায় এই মহাবিশ্বের প্রাণীদের চিন্তা থেকে। অনেক মানুষ যদি একটা কিছু নিয়ে চিন্তা করে তবে সেটাকে ডেমাইয়ার্জ সত্যি করে ফেলে।”
“কী বলতে চান?”
“সম্ভবত বিসমার্ক মিউজিক ভিডিওটি অনেক মানুষ দেখার ফলে তাদের মনে জাহাজটি নিয়ে চিন্তা এসেছে! তারা ভেবেছে! আর সেই চিন্তা থেকেই...”
“ডেমাইয়ার্জ বিসমার্ককে ফেরত এনেছে?”
“বিসমার্কের আত্মাকে!”
“ধুর! এগুলো বুজরুকি! ডেমাইয়ার্জ বলে কেউ নেই!”
“হতে পারে! তবে এর চাইতে ভালো ব্যাখ্যা আর পাচ্ছি না!”
“আরে ইশরাত দেখ! তোর স্বামী এক সুন্দরীর সাথে বসে রয়েছে!” কফি শপে ঢুকেই বলে উঠলো শুভ।
ইশরাত বহু আগেই ফারহানকে দেখেছে। ফারহানদের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল ইশরাত।
“ডিসটার্ব করছি নাকি আপনাকে মি. ফারহান?” ফারহানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল ইশরাত।
“ইশরাত! তুমি এখানে!” অবাক হয়ে বলল ফারহান।
“কেন? তোমাদের রোমান্টিক আলাপে বাঁধা দিলাম নাকি?”
“তা তুমিও কি এখানে রোমান্টিক আলাপ করতেই এসেছ নাকি?” ততক্ষণে ইশরাতের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা শুভকে নজরে পড়ে গেছে ফারহানের।
থতমত খেয়ে চুপ হয়ে গেল ইশরাত।
“হাই! ডা. ইশরাত, আমি অনিন্দিতা, রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে পড়াই, আপনার স্বামীর সাথে একটু আড্ডা দিচ্ছিলাম আরকি, কিছু মনে করবেন না।” এই বলে ইশরাতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন ড. অনিন্দিতা।
“নাইস টু মিট ইউ মিসেস...” হাত মিলাল ইশরাত।
“মিসেস না! মিস! আমি অবিবাহিত!”
“বিয়ে করার কথা ভাবছেন কী?” পেছন থেকে বলে উঠল শুভ।
“না! এখনও ভাবছি না!” মৃদু হেসে বললেন ড. অনিন্দিতা।
“ফারহান চল কাল সকাল সকাল টি-বাঁধে যাই, সেই আগের দিনগুলোর মতো!” খাবার টেবিলে ফারহানের পাতে মাছ দিতে দিতে বলল ইশরাত।
“বলছ? আচ্ছা! তুমি নটার মধ্যে পৌঁছে যেও। আমি একটু রাজপাড়া থানা হয়ে তারপর আসব।”
“তোমার কেসের কাজ?”
“আত্মহত্যাই সম্ভবত, ওপর থেকেও আমাকে পুলিশের কাজে মাথা গলাতে মানা করা হচ্ছে!”
“বাদ দাও! কাল কিন্তু সময়মত এসো!”
“অবশ্যই!”
“ডা. অনিন্দিতাকে আমার বেশ ভালো লেগেছে! চমৎকার মহিলা!”
“শুভ’র সম্ভবত আরও বেশী ভালো লেগেছে!”
“এটা কেমন কথা?”
“শুভ’র সব মেয়েকেই ভালো লাগে!”
“ধুস বাদ দাও তো!”
“আচ্ছা।”
“আর একটা কথা...”
“কী?”
“চল আমরা আবার সব নতুন করে শুরু করি!”
“আমিও সেটাই চাই ইশরাত।” ইশরাতের হাত ধরে বলল ফারহান।
“আই লাভ ইউ ফারহান।”
“আই লাভ ইউ টু ইশ!”
রাজপাড়া থানা থেকে বের হয়ে ফারহান দেখতে পেল তার মোবাইলে দুটো মিসকল দিয়েছে ডা. অনিন্দিতা। ঘড়িতে সময় দেখল ফারহান। সাড়ে আটটা বাজে।
ফোন করল সে ড. অনিন্দিতাকে।
“হ্যালো! ফারহান সাহেব! ফোন ধরলেন না কেন?” ড. অনিন্দিতা কণ্ঠে উদ্বেগ।
“ফোন সাইলেন্ট ছিল। কোন সমস্যা?”
“শুনুন! একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমি কালকে ধরতে পেরেছি। ওই ভদ্রলোক আত্মহত্যা করেছিলেন ২৪ তারিখে, তাই না?”
“হ্যাঁ!”
“২৪শে মে-তেই বিসমার্ককে আক্রমণ করেছিল ব্রিটিশ নৌবহর! আপনাকে বলেছিলাম, মনে আছে?”
“হ্যাঁ!”
“আর বিসমার্কের ডুবে যাওয়ার দিনটা মনে আছে?”
“হ্যাঁ! ২৭শে মে!” বলতে বলতেই চমকে উঠল ফারহান!”
“হ্যাঁ! মানে আজ! ২৪ শে মে সকাল নটার দিকে ডুবেছিল বিসমার্ক! মানে নটায় আজ সম্ভবত আবার...”
আর কিছু শুনতে পায়নি ফারহান! ফোনটা তার হাত থেকে পড়ে গেল।
টি-বাঁধে ঢুকেই ইশরাতকে জড়িয়ে ধরল ফারহান। ঘড়ির কাটা নটা ছুঁইছুঁই! আশেপাশে মানুষও আছে বেশ কজন। বেশ উদ্ভট দৃষ্টিতেই ওদেরকে দেখছিল তারা। এভাবে জনসমক্ষে তথাকথিত ‘ঢলাঢলি’ বলে কথা!
“এই কী কর! মানুষ দেখছে!” বিব্রত হয়ে বলল ইশরাত।
“দেখুক! আমার বউকে আমি জড়িয়ে ধরব!”
লাল শাড়ি পরে এসেছে ইশরাত! অপূর্ব লাগছে ওকে।
নদীর দিকে পিছন ফিরে ফারহানকে দেখছে সে। আর ফারহান তাকিয়ে আছে নদীর দিকে।
ডানপাশে কয়েকজন লোক গরু নিয়ে যাচ্ছে, একটা কিশোর ছেলে দা দিয়ে মাটি কোপাচ্ছে আর দুজন শ্রমিক কোদাল দিয়ে কী যেন করছে।
ব্যাপারটা শুরু হল হঠাৎ করেই!
হুট করেই যে দৃশ্যপটে আর্বিভূত হলো ওটা!
বিসমার্ক! পদ্মাতে আবার ফিরে এসেছে সেটা! ফারহানের চোখজোড়া যেন কোটর ছেড়ে বের হয়ে আসতে লাগল! সেই রণসজ্জায় সজ্জিত সাগরদানব! প্রচণ্ড চাপ পড়তে লাগল ওর স্নায়ুতে!
আশেপাশের সবাইই দেখছে জাহাজটাকে! নাহ ইশরাতকে ওটা দেখতে দেওয়া যাবে না! ওকে জড়িয়ে ধরল ফারহান!
“আরে! কী কর!” আবার লজ্জায় বলল ইশরাত!
আশেপাশে ততক্ষণে নীরব প্রলয় শুরু হয়ে গেছে। যে লোকগুলো গরু নিয়ে যাচ্ছিল তারা নিজেদের চোখগুলো গেঁথে ফেলতে লাগল গরুগুলোর শিংয়ের সাথে! প্রতিটা গরুই শিং ঢুকিয়ে দিতে লাগল একে অপরের পেটে!
যে ছেলেটা দা দিয়ে মাটি কোপাচ্ছিল সে হঠাৎ করে দা চালিয়ে দিল নিজের গলাতেই!
আর কোদালওয়ালা দুজন কোদালগুলো দিয়ে নিজেদের পেটে আঘাত করে চলল ক্রমাগত!
রক্তের বন্যা বইতে শুরু করল পুরো এলাকাতে।
ইশরাতকে তখনও জড়িয়ে ধরে আছে ফারহান। কিন্তু ওর নজর বিসমার্কের দিকে!
কিচ্ছু শুনতে পারছে না সে কারণ তার কানদুটো অচল হয়ে গেছে! দুটো চোখের একটাও হুট করেই অন্ধকার হয়ে গেল! ফারহান বুঝতে পারল যে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর আরেকটাও চোখও অন্ধ হয়ে যাবে।
নিজের শরীরের সব শক্তি একত্রিত করে ঠোঁটদুটোকে ইশরাতের ঠোঁটের ওপর চেপে ধরল ফারহান। ইশরাত তখনও কিছু বুঝতে পারেনি! কারণ সে তো বিসমার্ককে দেখেইনি!
“মাই লিপস অ্যান্ড ইউর লিপস, অ্যাপোক্যালিপ্স!” নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়ে এলো ফারহানের...