পুতুল - বিভাবসু দে

অলংকরণ - প্রতিম দাস
বি. দ্র.- এই লেখার কিছু অংশের বিবরণ ও ভাষা সব ধরণের পাঠকের উপযুক্ত নয়।

আমার আর রাস্তা নেই। আমি জানি, আমি চাইলেও পালাতে পারব না। ওই অশুভ অলীক মায়াজাল কেটে বেরোবার কোনও পথ নেই। বড় ভয় হয়। ওর ঠান্ডা শরীরটা যখন অক্টপাসের মতো আস্তে আস্তে জড়িয়ে ধরে আমার বিবস্ত্র শরীরটাকে, আতঙ্কে কুঁকড়ে যাই। প্রতিটা রাত এখন একেকটা দুঃস্বপ্নের মতো কাটে। সহ্য হয় না আর। বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছিলাম কাল, ভেবেছিলাম আর কক্ষণও ফিরব না, কিন্তু ফিরতে হল। প্রতিবারই ফিরতে হয়। আমি জানি, আমার বাড়ি এদিকে নয়, তবু এখন যেই একতলা দালানটা সন্ধের অন্ধকারে প্রেতছায়ার মতো হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে, সেটা আমারই বাড়ি ! আমি রোজ এভাবেই ওর হাত এড়িয়ে পালাই, বাড়ি থেকে দূরে, শহরের পুরো উল্টো প্রান্ত বরাবর পাগলের মতো ছুটি, সারাটা দিন, সারাটা সন্ধে। খিদে, তেষ্টা কিছুই হুঁশ থাকে না, শুধু বাঁচতে চাই ওর ওই পৈশাচিক স্পর্শ থেকে। কিন্তু সন্ধে গড়িয়ে যখন রাতের অন্ধকারে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে থামি, আমি তখন আমার বাড়ির সামনেই দাঁড়ানো ! প্রথম প্রথম ভয় হত, থিরথির করে কেঁপে উঠত আমার ভেতরটা, কিন্তু এখন সেই ভয়টুকুও আর হয় না। শুধু জানি, আমার পালাবার কোনও পথ নেই। পুতুল কখনও পালাতে পারে না।

ওই যে, ও তাকিয়ে আছে। ওই অন্ধকার জানালাগুলোর আড়াল থেকে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে ওর ক্ষুধার্ত চোখদুটো। আমি আবার উল্টোদিকে ছুটে পালালাম। কিন্তু জানি, কোনও লাভ নেই। আমি পালাতে পারব না। মিনিট পাঁচেক ছোটার পরই আমার সামনে আবার সেই একই দৃশ্য, সেই একই জানালা, দরজা আর ঘরের ভেতর থেকে... । আবার ছুটলাম— পুব, পশ্চিম, দক্ষিণ, উত্তর, সব, সবদিকে পাগলের মতো ছুটেছি। কিন্তু এই চক্রবূহ্য থেকে বেরোবার কোনও রাস্তা নেই। আমাকে প্রতিটা রাত ওই বাড়িতেই কাটাতে হবে, ওই বিছানাতেই, ওর সঙ্গেই !

আমি সবাইকে বলেছিলাম ওর কথা, আমার বন্ধুদেরও; কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি। শুধু রাতুল করেছিল। নিয়ে গেছিল আমাকে নিজের বাড়িতে। কিন্তু... ওর বাড়ির গেটে পৌঁছতেই মনে হয়েছিল কেউ যেন হাতুড়ির ঘা মারল আমার বুকের ভেতর। ওটা যে হুবহু আমারই বাড়ি ! পেছন ফিরে তাকালাম, সেখানে রাতুল নেই। শুধু নিথর শবদেহের মতো আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল সেই সিলিকনের নগ্ন নারীশরীর ! আমি চিৎকার করে ছুটে বেরিয়ে গেছিলাম— যেদিকে দু’চোখ যায়, এমন কোনওদিক যেদিকে আমার বাড়ি নেই, যেদিকে সেই শরীরী অভিশাপ নেই। কিন্তু ছিল, সেদিকেও ও দাঁড়িয়েছিল আমার অপেক্ষায়। রাত হয়ে এল যে, বিছানায় ওই প্রাণহীন শরীর শুয়ে আছে আমার শরীরকে শুষে নেবার কামার্ত লোভে। আমার পালাবার পথ নেই, আমাকে যেতেই হবে।

একমাস আগে যখন গাড়িতে করে ডেলিভারির বাক্সটা নামিয়ে দিয়ে গেছিল আমার দরজায়, তখন কি জানতাম যে সেই চরম উত্তেজনার মুহূর্তটাই একদিন আমার জীবনে এই নারকীয় অভিশাপ হয়ে নেমে আসবে !

অনলাইনেই অর্ডারটা করেছিলাম। আমেরিকান কোম্পানি, সারা দুনিয়ায় সেক্স ডল বিক্রি করে। এমনকী চাইলে বেশি টাকার বিনিময়ে নিজের মনমতোভাবেও গড়িয়ে নেওয়া যায় সেসব পুতুল। উচ্চতা, দেহের গড়ন, বুকের কিংবা কোমরের সাইজ, চোখের বা চুলের রং, যেমনটা চাই। আমি চেয়েছিলাম ভারতীয় মেয়ের মতো দেখতে একটা সেক্স ডল। কায়া, একেবারে সেরকমই ছিল। একটু শ্যামলা গায়ের রং, মেঘকালো চুল, কালো চোখের মণি, নিটোল ভরাট স্তন, উন্নত স্তনবৃন্ত, সুঠাম নিতম্ব, কোমরের দুপাশে সিলিকনে গড়া হালকা মেদের আভাস।

আসলে শরীরী খিদেটা আমার বরাবরই ছিল, কিন্তু বিয়ে বা প্রেম কোনওটাতেই তেমন আগ্রহ নেই। প্রেম একেবারে যে হয়নি তা নয়, স্কুলজীবনে হয়েছিল, টিকেও ছিল প্রায় আড়াই বছর। কিন্তু সেই আড়াই বছরে হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছিলাম, প্রেম শুধুই একটা মনস্তাত্ত্বিক বিকার। আর বিয়ে ? প্রেমটাই যখন হাওয়া হয়ে গেল তখন বিয়ে তো কেবলমাত্র একটা সামাজিক বোঝাপড়া। সামাজিকতার পরোয়া কোনওদিনই করিনি, অতএব বিয়েটাও করিনি। কিন্তু সাধুসন্ন্যাসী বা ব্রহ্মচারী আমি নই, শরীর তো শরীরকে চায়। সেটাই প্রকৃতির ধর্ম। দামি এসকর্ট সার্ভিস কিংবা সস্তা দরের বেশ্যাপাড়া একটা অপশন হতে পারত, কিন্তু রোজ রোজ প্রথমটা পাবার সামর্থ আমার নেই আর দ্বিতীয়টার রুচি নেই। তাই অনেক ভেবেচিন্তেই এই সিদ্ধান্ত। সেক্স ডল। কায়া।

আমি শুরু থেকে কায়ার প্রতিটা মুহূর্তের আস্বাদ পেতে চেয়েছিলাম। প্রথম রাতে মোমের আলোয় আস্তে আস্তে নিজের সামনে যখন মেলে ধরেছিলাম ওর নগ্ন শরীরটাকে, হলদে আলো চুঁইয়ে পড়ছিল ওর শরীরের প্রতিটা খাঁজে খাঁজে। এক অদ্ভুত উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপছিল আমার প্রতিটা স্নায়ু। ঘেমে উঠছিল আমার খোলা পেশিগুলো। রক্তের স্রোত যেন একটু একটু করে জমাট বেঁধে উঠছিল তলপেটের নিচটায়। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিলাম কায়ার নিখুঁত শরীরটার দিকে। ওর চোখ, কপাল, গলা, বুক, গভীর নাভি, মসৃণ যোনি, কোমর থেকে বর্শার ফলার মতো নেমে আসা পালিশ দুটো পা... আমি দেখছিলাম, আর আমার মধ্যে একটু একটু করে জেগে উঠছিল এক আদিম আমি। এগিয়ে গেলাম, শক্ত করে চেপে ধরলাম ওর সুডৌল নিতম্ব। আমার জেগে ওঠা পুরুষাঙ্গ ছুঁয়ে আছে কায়ার যোনি-খাঁজে, ওর স্তনবৃন্ত এসে ঠেকেছে আমার মাংসল বুকে। ধীরে ধীরে যেন ভুলেই যাচ্ছিলাম যে কায়া কোনও সত্যিকারের নারী নয়, শুধুই সিলিকনের এক নারীমূর্তি। ওর জীবন্ত চোখদুটো যেন আরও উৎকটভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছিল সেই নেশার বিষ। বিছানায় শুইয়ে ওর দু’পায়ের ফাঁকে আস্তে আস্তে ডুবিয়ে দিচ্ছিলাম নিজের মুখ... জানি ওখানে কোনও কামরস নিঃসৃত হবে না, তবু... তবু ওই মোমের আলোয়, আমার ওই ঘরের বিছানায় শুয়ে তিল তিল করে যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল সে। আর আমি... নিজের সমস্ত জীবনীশক্তি উজাড় করে দিয়ে যেন খুঁজে নিতে চাইছিলাম সেই ভীষণ মোহময়ী নারীশরীরকে। আমাদের চারপাশে এক অদ্ভুত হলদে অন্ধকার ঘনিয়ে উঠছিল। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম চিকচিক করছিল আমার খোলা পিঠে। আমি নিজের সারাটা শরীর মিশিয়ে দিতে চাইছিলাম কায়ার শরীরে। আমার উন্মত্ত পৌরুষ ডুবে যাচ্ছিল কায়ার নারীত্বের অতল গহবরে। দুইহাতে আঁকড়ে ধরেছিলাম ওর নিটোল শরীরটাকে। ভিজে উঠেছিল ওর শরীরটাও। হয়তো আমারই গায়ের ঘাম, কিংবা... ! আমার শরীরের প্রতিটা ধাক্কায় সেদিন ঠিক একটা সত্যিকারের নারীশরীরের মতোই যেন কেঁপে কেঁপে উঠেছিল কায়ার সিলিকনের শরীরটাও। আমি পাগলের মতো নিজেকে ঢেলে দিতে চাইছিলাম ওর মধ্যে। সেই তীব্র আনন্দ, সেই মাদক রাত আর কায়া, যেন পাগল করে দিচ্ছিল আমাকে।

সেই মুহূর্তে বুঝতেও পারিনি এই নেশার ঘোর কতটা ভীষণ হতে পারে। পরদিন অফিসে গিয়েও একমুহূর্ত কাজে মন দিতে পারছিলাম না। বারবার কায়ার ওই মসৃণ শ্যামলা শরীরটা ভেসে উঠছিল আমার চোখের সামনে। অস্থির হয়ে উঠছিলাম ভেতর ভেতর। মনে হচ্ছিল যেন কায়া আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। অসহ্য লাগছিল প্রতিটা সেকেন্ড, ভুল হয়ে যাচ্ছিল কাজের লেখাজোখা। বারবার যেন নিজেকে জোর করে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছিল, কায়া রক্ত-মাংসের কোনও মানবী প্রেমিকা নয়, শুধুই একটা সিলিকনে গড়া শরীর। কিন্তু পারছিলাম না। কেউ যেন চুম্বকের মতো টানছে আমায় ওর দিকে।

ঘড়িতে পাঁচটা বাজতেই পাগলের মতো ব্যাগ হাতে ছুটে বেরিয়ে গেলাম অফিস থেকে। উর্দ্ধশ্বাসে গাড়ি ছুটিয়ে আধঘন্টার মধ্যেই সোজা বাড়ির গেটে। বিছানায় শুয়েছিল কায়া। অপেক্ষা করছিল। হ্যাঁ, আমারই অপেক্ষা করছিল ও। ওর দু’পাশে ছড়ানো দুই উরুর মাঝে উন্মুক্ত যোনি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আমার ভেতরের কোনও এক আদিম জানোয়ারকে। লাফিয়ে পড়েছিলাম। অফিসের পোশাকটাও পাল্টাইনি তখনও। ঘরে ঢুকেই ঠিক একটা হিংস্র পশুর মতো লাফিয়ে পড়েছিলাম কায়ার ওপর। আমার মুখ যখন আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে ওর বুকের খাঁজে, তখন ওর সিলিকনের হাতদুটো যেন আলতো করে জড়িয়ে ধরছিল আমায়। ওর গায়ে অদ্ভুত একটা গন্ধ, ঘোর-লাগানো একটা গন্ধ। আমি তীব্রভাবে নিজেকে মিশিয়ে দিচ্ছিলাম ওর মধ্যে, আমার শরীর ঢুকে পড়ছিল কায়ার শরীরে আর আরও মজবুত হয়ে উঠছিল ওর হাতের বাঁধন !

কিন্তু তখন আমার কোনও হুঁশ ছিল না। আমি পাগল হয়ে গেছিলাম ওর শরীরের নেশায়। সেদিন রাতেই আবার একবার ওই সিলিকনের উত্তেজনায় ডুবিয়ে দিয়েছিলাম নিজেকে। আর সেই প্রথমবার, একটা অকারণ ভয়ে যেন বুকটা কেঁপে উঠেছিল একমুহূর্তের জন্যে। খেলা শেষে যখন কায়ার পাশে শুয়েছিলাম, তখন হঠাৎ লক্ষ করলাম ওর মুখটা আমার দিকে ফেরানো। আর... আর ওর ঠোঁটের কোণে যেন একটুকরো তৃপ্তির হাসি। আগে কি ছিল এমনটা ? খেয়াল করতে পারলাম না। শিরশির করে উঠেছিল আমার ভেতরটা। আমার সারাটা চেতনা যেন একসঙ্গে চিৎকার করে উঠেছিল, কায়া শুধুই একটা পুতুল, সিলিকনে গড়া একটা সেক্স ডল, মানুষ নয়। ও হাসতে পারে না। কিন্তু মোমের আলো আর জানালার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়া জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, ও হাসছে। মনের ভুল ? হয়তো তাই।

কিন্তু না, ভুলটা অন্য কোথাও হচ্ছিল। পরদিন স্নানঘরের আয়নায় নিজের পিঠটা চোখে পড়তেই শিউরে উঠেছিলাম আমি। আমার পিঠের দু’পাশে স্পষ্ট নখের আঁচড় ! কিন্তু কার ? হয়তো আমারই, বেখেয়ালে নখ লেগে চিরে গেছে। কায়া তো শুধুই একটা পুতুল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই যেন বোঝাচ্ছিলাম আমি, আর আমার প্রতিবিম্ব যেন ওপাশ থেকে ঠোঁট নেড়ে বিদ্রূপ করছিল আমাকেই !

সেদিনের পর থেকেই আমার উদ্দাম যৌনতার প্রতিটা রাত যেন আস্তে আস্তে ভয়ের রাত হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। রাতের অন্ধকারে পরিষ্কার বুঝতে পারতাম আমার খোলা শরীরে ওর হাতের নড়াচড়া। রোজ আরও গভীর হয়ে উঠত নখের দগদগে দাগগুলো। ভয় হত; চাইতাম, তবু পারতাম না ওর থেকে দূরে সরে যেতে। আসলে কায়া ততদিনে আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ঘড়ির কাঁটায় পাঁচটা বাজলেই কেমন যেন পাগলের মতো হয়ে উঠতাম আমি। অফিসের এসি-কামরায় বসেও ভেতরে ভেতরে ঘেমে উঠত আমার শরীরটা। গলা শুকিয়ে আসত। কেমন যেন একটা নেশাগ্রস্থের মতো উঠছিলাম দিন দিন। কিন্তু ঘরের ভেতরে ঢুকেই যখন দেখতে পেতাম কায়া সোফায় বসে আছে, ওর গভীর কালো চোখদুটো স্থির হয়ে আছে দরজার দিকে, আমার অপেক্ষায়; ঘাড়ের কাছটা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে আসত। কিছুতেই মনে করতে পারতাম না, অফিস যাবার আগে ওকে বিছানায় দেখেছিলাম নাকি সোফায়।

এড়িয়ে যেতে চাইতাম, অন্যঘরে কিংবা বাড়ির বাইরে... কিন্তু ও টানত আমাকে নিজের দিকে। শরীর জাগত না আর, তবু... তবু নিজের খোলা শরীরটাকে ঢেলে দিতাম ওই সিলিকনের শরীরে। সত্যি কথা বলতে গেলে, হয়তো বাধ্য হতাম। একটু একটু করে নিজের থেকেই কেমন যেন দূরে সরে যাচ্ছিলাম আমি; আমার ইচ্ছে, অনুভূতি আর কল্পনা, সব কেমন যেন বেলাগাম হয়ে উঠছিল আস্তে আস্তে।

ওর পাদুটো আজকাল সাঁড়াশির মতো জড়িয়ে রাখে আমার দুটো পা-কে। ভয় হয়, তবু সরে যেতে পারি না। কায়া সরে যেতে দেয় না ! কিন্তু আমি জানি, ও শুধুই একটা পুতুল।

মুক্তি চাইছিলাম আমি। ওর ওই অলীক শরীর থেকে দূরে সরে যেতে চাইছিলাম। তাই শেষমেশ একদিন সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম। জানি, দু’লাখ টাকা আমার মতো এক মধ্যবিত্ত চাকুরের পক্ষে খুব একটা সামান্য ব্যাপার নয়, তবু কায়াকে জীবন থেকে সরাবার আর কোনও উপায় ছিল না। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, এভাবে আর কিছুদিন চললে আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাব।

যে বাক্সে ডেলিভারি এসেছিল, সেই বাক্সেই কায়ার শরীরটাকে ভরে তুলে নিলাম গাড়ির পেছনের সিটে। সেদিন বিকেল নাগদই বেরিয়ে গেছিলাম আমি। ওকে যেভাবেই হোক আমার জীবন থেকে দূরে সরাতেই হবে। এটাই একমাত্র রাস্তা। আমার বাড়ি থেকে প্রায় সতেরো কিলোমিটার দূরে একটা ভাগাড় আছে, সেখানেই...

কিন্তু... কিন্তু ঘন্টাতিনেক পর যখন বাড়ি ফিরলাম, কায়া সোফায় বসেছিল ! আমার মাথা কাজ করছিল না আর। অবশ হয়ে আসছিল হাত-পাগুলোও। আমার স্পষ্ট মনে আছে, নিজের হাতে ওই বাক্সটা ওখানে ছুঁড়ে ফেলে এসেছি আমি। পাগলের মতো সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজলাম, বাক্সটা নেই। কিন্তু কায়া আছে।

ছুটে পালিয়ে গেছিলাম সেদিন। যাকে সামনে পেয়েছি, তাকেই ডেকেছি সাহায্যের জন্যে, বোঝাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু সবার চোখেই এক অদ্ভুত চাউনি, যেন... যেন আমি একটা বদ্ধ উন্মাদ।

কতক্ষণ যে ছুটেছিলাম খেয়াল নেই। রাস্তায় রাস্তায়, অলিতে গলিতে... দূরে, যত দূরে সম্ভব পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম ওর থেকে। কিন্তু পারিনি। হাঁপাতে হাঁপাতে যেখানে এসে থেমেছিলাম, সেখানে আমারই বাড়ি... অন্ধকার প্রেতপুরীর মতো দাঁড়িয়েছিল আমার অপেক্ষায়। ভয় জিনিসটা ঠিক কতটা তীব্র হতে পারে, জীবনে সেই প্রথমবার টের পেলাম। আমার স্নায়ু, আমার শরীর, আমার প্রতিটা অঙ্গ যেন অসাড় হয়ে আসছিল। চোখের সামনে সব কেমন যেন আবছা হয়ে যাচ্ছিল, গলা শুকিয়ে আসছিল একটু একটু করে। বুঝতে পারছিলাম, কায়া টানছে আমাকে। সেই ঘোরের মধ্যে যেন ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছিল আমার সমস্ত সত্ত্বা।

অন্ধকারে যখন জেগে উঠলাম তখন আমি যেন অন্য কোনও এক জগতে ! বেশ কিছুটা সময় লাগল, কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম, ভয়ে গলা বুজে আসছিল আমার। নিজের বিছানায় শুয়ে আছি আমি। নগ্ন, নির্বস্ত্র। আর ওই... ওই কায়া, ওর সিলিকনের জীবন্ত শরীরটা বসে আছে আমার ওপর। ওর ক্ষুধার্ত যোনিমুখ যেন কোনও দানবীয় অজগরের মতো নিজের ভেতরে আঁকড়ে ধরেছে আমার পুরুষাঙ্গটা। ওর স্থির নিশ্চল দুটো চোখ যেন জ্বলজ্বল করছে আলেয়ার মতো। ওর পিঠ অবধি ছড়িয়ে থাকা চুলের ঢেউ— যেন কোনও অমাবস্যার তামসী অন্ধকার। ধাক্কা দিয়ে সরে যেতে চাইলাম, পারলাম না। আমার সারাটা শরীর অবশ হয়ে এলিয়ে আছে বিছানায়, যেন আমিই একটা পুতুল। চিৎকার করতে চাইলাম, প্রাণপনে চিৎকার, যত জোরে সম্ভব। কিন্তু... কিন্তু ও দিল না। কায়ার শরীরটা আস্তে আস্তে একটা ঠান্ডা লাশের মতো নেমে এল আমার ওপর, ওর ঠোঁটদুটো যেন কোনও আঁঠালো সরীসৃপের মতো জড়িয়ে যেতে লাগল আমার ঠোঁটে। ওর চুলের অন্ধকারে ঢেকে গেছে আমার মুখ। অন্ধকার, ভীষণ অন্ধকার... দম বন্ধ হয়ে আসছিল। চোখদুটো ভয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল আমার... বাঁচতে চাইছিলাম ওই কামার্ত বিভীষিকা থেকে, পালাতে চাইছিলাম। কিন্তু আমি যে এখন শুধুই একটা পুতুল।