পুতুল - আগাথা ক্রিস্টি

ভেলভেটে মোড়ানো চেয়ারের উপর শুয়ে আছে পুতুলটা। আলো খুব একটা নেই ঘরে। লণ্ডনের আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। হালকা আলোয় একে-অন্যের মাঝে যেন ডুব দিয়েছে পর্দা, কার্পেট আর অন্যান্য আচ্ছাদন। পুতুলটাও ব্যতিক্রম নয়। সবুজ ভেলভেটের কাপড়, ভেলভেটের টুপি এবং রঙিন মুখোশ পরে শুয়ে আছে সে। ওটা একটা পাপেট ডল— ধনী মহিলাদের খেলার সামগ্রী। টেলিফোনের পাশে, অথবা ডিভানের কুশনের মাঝে শুইয়ে রাখা হয় তাকে। চুপচাপ তাই থাকে পুতুলটা, অন্ততকালের জন্য অনড়... অথচ অদ্ভুতভাবে জীবন্তও।

সিবিল ফক্স, ছুটোছুটি করছে ঘরময়। পুতুলটার দিকে অবাক চোখে তাকাল একবার। ভাবল-কী ভাবল তা পরক্ষণেই ভুলে গেল! ‘নীল ভেলভেটটার ডিজাইন যেন কেমন ছিল?’ এই চিন্তাটাই দখল করে নিল ওকে। ‘কোথায় রাখলাম? এখানেই তো ছিল!’ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে, কাজের ঘরের দিকে চেয়ে ডাকল, ‘এলসপেথ, নীলটার ডিজাইন কি তোমার কাছে? মিসেস ফেলোস-ব্রাউন কিন্তু যে-কোন মুহূর্তে এসে পড়বেন!’

আগের ঘরে ফিরে এল আবার, লাইট জ্বালিয়ে দিল। একনজর তাকাল পুতুলটার দিকে। ‘গেল কোথায়— আহ, পেয়েছি।’ হাত থেকে পরে যাওয়া ডিজাইনটা তুলে নিল সে। বাইরে থেকে পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। এক কি দুই মিনিট পর ঘরে এসে প্রবেশ করলেন মিসেস ফেলোস-ব্রাউন, সাথে রয়েছে পেকিনিজ কুকুরটা।

‘বৃষ্টি পড়বে,’ বিরক্তি খেলে গেল মহিলার কণ্ঠে। ‘কোন সন্দেহ নেই!’

হাতের দস্তানা এবং পরনের ফারকোট খুলে ফেললেন তিনি। অ্যালিসিয়া কুম্ব প্রবেশ করল। আজকাল খুব একটা আসে না সে, তবে খাস খদ্দেরদের কথা ভিন্ন। মিসেস ফেলোস-ব্রাউন সেই খাস খদ্দেরদের একজন।

এলসপেথ, কাজের ঘরের ফোরওম্যান, একটা ফ্রক নিয়ে নিচে নেমেছে। মিসেস ফেলোস-ব্রাউনের গলা দিয়ে ওটা গলিয়ে দিল সিবিল।

‘বেশ মানিয়েছে,’ বলল সে।

মিসেস ফেলোস-ব্রাউন পাশ ফিরে আয়নার দিকে তাকালেন। ‘আসলেই,’ বললেন তিনি। ‘তোমার বানানো পোশাক আমার চেহারাই পাল্টে দেয়! বিশেষ করে পেছনটা।’

‘তিন মাস আগের চাইতে অনেক শুকনো দেখাচ্ছে আপনাকে।’ সিবিল আশ্বস্ত করলেন ভদ্রমহিলাকে।

‘আরে না,’ বললেন মিসেস ফেলোস-ব্রাউন, ‘তবে দেখতে ভাল লাগছে-তাতে কোন সন্দেহ নেই। সব তোমার হাতের জাদু, কীভাবে যে কী করো তা বুঝতেই পারা যায় না।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। ‘আজকাল পোশাকের অর্ডার দেয়াটাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে পেট ভেতরে টেনে সোজা করতে পারতাম সামনের দিকটা। এখন সামনে-পেছনে সমান মেদ জমায় আর পারি না! আচ্ছা, কাজটা কী সম্ভব?’

অ্যালিসিয়া বলল, ‘আমার অন্য কয়েকজন খদ্দেরকে দেখলে বুঝতে পারতেন!’

মিসেস ফেলোস-ব্রাউন এদিক-সেদিক একে-বেঁকে নিজেকে দেখলেন।

‘পেছনে মেদ জমার চাইতে সামনে জমাটা বেশি ভয়াবহ।’ বললেন তিনি। ‘অনেক বেশি বেঢপ দেখা যায়। যাই হোক, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সামনেরটা ভেতরে চেপে রাখব। পেছন নিয়ে অত মাথা-ব্যথা নেই!’ ঘাড় বাঁকিয়ে আয়নার দিকে তাকালেন তিনি। আচমকা বলে উঠলেন, ‘ওহ, তোমাদের ওই পুতুলটা আমাকে খুব ভয় পাইয়ে দেয়। কতদিন হলো আছে এখানে?’

সিবিল চোখে অনিশ্চয়তা নিয়ে তাকাল অ্যালিসিয়ার দিকে, মেয়েটাকে হতভম্ব বলে মনে হলো।

‘নিশ্চিত করে বলতে পারব না... তবে অনেকদিন হয়েছে-আজকাল আসলে কিছু মনে থাকে না। সিবিল, কতদিন হলো ওটা আছে আমাদের কাছে?’

ছোট্ট করে জবাব দিল সিবিল, ‘জানি না।’

‘হুম,’ বললেন মিসেস ফেলোস-ব্রাউন, ‘গা কাঁটা দিয়ে ওঠে ওটা দেখলে, জানো? কেমন বিদঘুটে, তাই না? মনে হয় যেন আমাদের ওপর নজর রাখছে। ওই ভেলভেটের হাতায় মুখ লুকিয়ে হাসছে ক্ষণে ক্ষণে। তোমার জায়গায় আমি হলে, ওটা ফেলে দিতাম!’ কেঁপে উঠলেন ভদ্রমহিলা। তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পোশাক বানাবার টুকিটাকি নিয়ে। সবকিছু পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন মিসেস ফেলোস-ব্রাউন; তবে পুতুলটার পাশ দিয়ে যাবার সময় থমকে দাঁড়ালেন একটু।

‘নাহ,’ বললেন তিনি, ‘আমার পুতুলটা একদম পছন্দ না। অথচ দেখে মনে হচ্ছে, রাজত্ব পেতে বসেছে! নাহ, একদম মানাচ্ছে না!’

‘কথাটা দিয়ে কী বোঝাতে চাইলেন তিনি?’ জানতে চাইল সিবিল, ততক্ষণে মিসেস ফেলোস-ব্রাউন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গিয়েছেন।

অ্যালিসিয়া উত্তর দেবার আগেই ফিরে এলেন মিসেস ফেলোস-ব্রাউন, দরজা দিয়ে গলা গলিয়ে বললেন, ‘হায়, ঈশ্বর! আমি তো ফু-লিং-এর কথা ভুলেই বসেছিলাম! কোথায় গেলি, সোনামণি? হায়, হায়, এ কী!’

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মহিলা, অন্য দুইজনও তাকাল। পেকিনিজ কুকুরটা সবুজ-ভেলভেটের চেয়ারের পাশে বসে আছে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পুতুলটার দিকে। আনন্দ বা বিরাগ, কোনটাই নেই কুকুরটার ছোট-ছোট চোখে। কেবলই দেখছে।

‘চলে আয়, বাছা,’ ডাকলেন মিসেস ফেলোস-ব্রাউন।

বাছা’র সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই!

‘প্রতিদিন একটু একটু করে অবাধ্যতা বাড়ছে কুকুরটার।’ বললেন মিসেস ফেলোস-ব্রাউন, কিন্তু এমনস্বরে যে মনে হলো গুণগান গাইছেন! ‘আয়, ফু-লিং! সোনামণি! জাদু-পাখি!’

খুব বেশি হলে, মাথাটা মনিবানির দিকে ইঞ্চিখানেক ঘোরাল ফু-লিং; তারপর আবার মনোযোগ দিল পুতুলটার দিকে।

‘পুতুলটা দেখি আমার বাছার ওপর ভালই প্রভাব ফেলেছে।’ বললেন মিসেস ফেলোস-ব্রাউন। ‘অথচ আগে কখনও ওটার দিকে ফিরেও তাকিয়েছে বলে মনে হয় না। আমিও দেখিনি। আচ্ছা, আগেরবার যখন এলাম, তখন কি ওখানেই ছিল পুতুলটা?’

অন্য দুই রমণী একে-অন্যের দিকে তাকাল। সিবিলের ভ্রু কুঁচকে গিয়েছে। অ্যালিসিয়া কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘একটু আগেই না আপনাকে বললাম-আজকাল কিছুই খেয়ালে থাকে না। তোমার মনে আছে, সিবিল?’

‘ওটাকে কিনেছ কোত্থেকে?’ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন মিসেস ফেলোস-ব্রাউন। ‘কিনেছ না নিজেরাই বানিয়েছ?’

‘নাহ।’ ভাবনাটা কেন যেন অ্যালিসিয়াকে নাড়িয়ে দিল। ‘সম্ভবত-কেউ উপহার দিয়েছিল।’ মাথা নাড়ল মেয়েটি। ‘কী রাগটাই না লাগছে! এভাবে ভুলে গেলে চলবে!’

‘ফু-লিং, অনেক হয়েছে,’ কড়া স্বরে বললেন মিসেস ফেলোস-ব্রাউন। ‘এবার আয়, নইলে ঘাড় ধরে আনব।’

তাই করতে হলো ভদ্রমহিলাকে। কোলে উঠেই প্রতিবাদের ভঙ্গিতে ঘেউ ঘেউ করে উঠল পেকিনিজ। বার বার পুতুলটার দিকে তাকাল সে...

‘ওই পুতুল,’ বলল মিসেস গ্রোভস। ‘আমিও ভয় পেয়ে যাই মাঝে মাঝে!’

মিসেস গ্রোভস ঘর ঝাড়টাড় দেয়। এইমাত্র মেঝের একটা জায়গা পরিষ্কার করে এসেছে সে, এখন বাকিটা করছে।

‘আশ্চর্যের কথা হলো,’ বলল মিসেস গ্রোভস। ‘গতকালের আগে ওটার ওপরে যেন নজরই পড়েনি!’

‘পছন্দ হচ্ছে না?’ জানতে চাইল সিবিল।

‘সত্যিটাই বলি, মিসেস ফক্স। ওটা আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়।’ বলল মহিলা। ‘অস্বাভাবিক ব্যাপার, আশা করি আমার কথার অর্থ বুঝতে পারছেন। লম্বা-লম্বা, ঝোলানো পা; চোখের অপার্থিব দৃষ্টি-সব মিলিয়ে, বিদঘুটে একটা জিনিস।’

‘আগে তো কিছু বলোনি।’ বলল সিবিল।

‘কেবলই না বললাম-গতকালের আগে ওটা নজরেই পড়েনি? জানতাম যে একটা পুতুল আছে ওখানে, তবে-’ চুপ হয়ে গেল মহিলা, বিভ্রান্তি খেলে গেল চেহারায়। কিছু না বলে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।

সিবিল আরাম করে বসে থাকা পুতুলটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকাল। হতভম্ব একটা ভাব দেখা যাচ্ছে চেহারায়। অ্যালিসিয়ার দিকে ফিরল সিবিল।

‘আচ্ছা, মিস কুম্ব, এই জিনিসটা কতদিন ধরে আছে তোমার কাছে?’

‘ওই পুতুল! আসলেই মনে করতে পারছি না। গতকাল-লজ্জার কথা আর কী বলব-গতকাল ওই লেকচার শুনতে বেরিয়েছিলাম, মনে নেই? রাস্তার অর্ধেক গিয়ে দেখি, কোথায় যাচ্ছি সেটাই খেয়াল নেই! অনেক ভেবে নিজেকে বোঝালাম, নিশ্চয়ই ফোর্টনামসে যাচ্ছি। ওখানে যে কাজ আছে একটা, এতটুকু মনে পড়ছিল। বিশ্বাস করবে না, বাড়িতে ফিরে চা খাচ্ছি, এমন সময় মনে পড়ল সব! সবসময় শুনতাম, বয়সকালে মানুষজন বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আমার তো দেখি বয়স হবার আগেই... এই যেমন এখন। হ্যাণ্ডব্যাগ কই, চশমা কই, কিছুই মনে পড়ছে না! অথচ এইমাত্র দ্য টাইমস পড়ছিলাম।’

‘চশমা এই যে এখানে, ম্যাণ্টেলপিসের ওপরে,’ বলল সিবিল, এগিয়ে দিল অ্যালিসিয়ার দিকে। ‘পুতুলটা কোথায় পেলে? কে দিল?’

‘তা-ও মনে নেই,’ জানাল অ্যালিসিয়া। ‘কেউ একজন দিয়েছিল... নাকি পাঠিয়েছিল? সে যাই হোক, ঘরের সঙ্গে বেশ যাচ্ছে না, তাই না?

‘একটু বেশিই মানাচ্ছে।’ বলল সিবিল। ‘মজার কথা হলো, আমি প্রথম কখন এটাকে দেখেছি, তা মনেই করতে পারছি না।’

‘এই এই... আমার মত ভুলোমনা হয়ো না কিন্তু,’ অ্যালিসিয়া বকল মেয়েটিকে। ‘তোমার বয়স আমার হাঁটুর সমান।’

‘সত্য বলছি, মিসেস কুম্ব। আমি মনেই করতে পারছি না। গতকাল ওটার ওপর নজর পড়া মাত্র মনে হলো-মিসেস গ্রোভস যা বলল-জিনিসটা বড়ই বিদঘুটে। তারপর ভাবলাম, এই চিন্তা তো আগেও আমার মাথায় এসেছে! প্রথম কবে ভেবেছিলাম, সেটা অনেক মনে করার চেষ্টা করেও পারলাম না! মনে হচ্ছিল যেন আগে কখনও পুতুলটা দেখেনি—কিন্তু কথাটা তো সত্যি না। বহুদিন ধরেই ওখানে বসে আছে ওটা, আমার নজরে এল গতকাল... এই যা... ’

‘ঝাড়েতে চড়ে জানালা দিয়ে ঢুকেছে হয়তো,’ মজা করে বলল অ্যালিসিয়া। ‘যাই হোক, এখানে কিন্তু বেশ মানাচ্ছে।’ চারপাশে তাকাল একবার। ‘এখন তো ওকে ছাড়া ঘরটার অস্তিত্বই কল্পনা করা মুশকিল, তাই না?’

‘না,’ কেঁপে উঠে বলল সিবিল। ‘তবে পারলে ভাল হত।’

‘কী পারলে ভাল হত?’

‘পুতুলটাকে ছাড়া এই ঘরের কথা কল্পনা করতে পারলে।’

‘এক পুতুল নিয়ে সারাদিন মাথা ঘামাব নাকি আমরা?’ কিছুটা বিরক্ত শোনাল অ্যালিসিয়ার কণ্ঠ। ‘বেচারাকে নিয়ে কী সমস্যা তোমার? আমার তো দেখে ঠিক আছে বলেই মনে হচ্ছে। অবশ্য চশমা নেই বলে-’ চশমা চোখে দিল সে, একদৃষ্টিতে তাকাল পুতুলটার দিকে। ‘হুম, তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারছি। একটু বিদঘুটেই—কেমন যেন বিষণ্ণ, তবে সেই সঙ্গে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞও।’

‘আচ্ছা,’ বলল সিবিল। ‘মিসেস ফেলোস-ব্রাউন পুতুলটার ওপর এমন রেগে গেলেন কেন?’

‘মনের কথা মুখে উচ্চারণ করতে তার কোনদিন বাধেনি।’ বলল অ্যালিসিয়া।

‘হ্যাঁ, তবে ব্যাপারটা অদ্ভুত।’ হাল ছাড়তে রাজি নয় সিবিল, ‘একটা পুতুল কেন তাকে এতটা নাড়া দিল?’

‘কে জানে? অনেকেই আছেন, এমন আচমকা কোন কিছু অপছন্দ অরে বসেন।’

‘হয়তো,’ মুচকি হেসে বলল সিবিল। ‘পুতুলটা আসলে আগে এখানে ছিলই না। তুমি যেমন বললে, উড়ে এসে জুড়ে বসেছে!’

‘না,’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘আমি নিশ্চিত যে ওটা বেশ কিছুদিন হলো ওই চেয়ারেই বসে আছে। তবে গতকালের আগে কারও চোখে পড়েনি আরকী।’

‘আমারও কেন যেন তেমনটাই মনে হচ্ছে,’ বলল সিবিল।

‘আচ্ছা বাবা,’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘এবার জিনিসটাকে নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করো তো। তোমার কথা শুনে ভয়ে শিরদাঁড়া কাঁপছে! আশা করি এবার অপার্থিব গপ্পো ফাঁদতে শুরু করবে না ওটাকে নিয়ে?’ পুতুলটা তুলে নিল সে, ঝাঁকি দিল কয়েকবার। এরপর বসিয়ে দিল আরেকটা চেয়ারে। সাথে সাথে কিছুটা নিচে নেমে গেল ওটা, তারপর ওভাবেই রইল।

‘দেখতে একদমই মানুষের মত না এই পুতুল,’ বলল অ্যালিসিয়া, একদৃষ্টিতে তাকাল জিনিসটার দিকে। ‘অথচ কেমন যেন জীবন্ত, তাই না?’

***

‘ওহ, একেবারে পিলে চমকে দিয়েছিল।’ বলল মিসেস গ্রোভস, শো-রুমের দিকে যাচ্ছিল সে। ‘এখন তো ওই কামরায়, মানে ফিটিং-রুমে যেতেই ইচ্ছা করে না।’

‘তোমার পিলে আবার কোন জিনিস চমকে দিল?’ কোনার একটা টেবিলে বসে থাকা মিস কুম্ব জানতে চাইল। ‘এই মহিলা ভাবছে,’ মিসেস গ্রোভসকে কম আর নিজেকেই বেশি শোনাল ও। ‘দুটো সান্ধ্য-পোশাক, তিনটা ককটেল ড্রেস আর এক স্যুট বানিয়ে নেবে প্রতি বছর, কিন্তু আমাকে একটা পেনিও দিতে হবে না! আসলেই... কিছু কিছু মানুষ এমন হয় না!’

‘পুতুলটার কথা বলছি,’ বলল মিসেস গ্রোভস।

‘আবার সেই পুতুল?’

‘হ্যাঁ, ডেস্কের ওপর বসে আছে। ঠিক যেভাবে মানুষ বসে থাকে! পিলে চমকে গিয়েছিল!’

‘কী বলছ তুমি এসব?’

অ্যালিসিয়া উঠে দাঁড়াল, হেঁটে গিয়ে প্রবেশ করল ফিটিং-রুমে। এক কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে একটা ডেস্ক, ওটার কাছেই আছে একটা চেয়ার। আর ডেস্কের ওপরে হাত রেখে, ওটায় চুপচাপ বসে আছে পুতুলটা।

‘কেউ সম্ভবত ঠাট্টা করছে,’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘এভাবে বসিয়ে রেখেছে পুতুলটাকে। আসলেই, একদম মানুষের মত মনে হচ্ছে ওটাকে।’

সিবিল ফক্স ঠিক সেই মুহূর্তেই সিঁড়ি বেয়ে নামছিল, হাতে ধরে আছে একটা কাপড়।

‘এদিকে এসো, সিবিল। দেখ, আমাদের পুতুল এখন চেয়ারে বসে চিঠি লিখছে!’

তাকাল দুই মহিলা।

‘আসলেই অদ্ভুত ব্যাপার!’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘আচ্ছা, পুতুলটাকে ওভাবে বসাল কে? তুমি না তো?’

‘নাহ, আমি বসাইনি।’ বলল সিবিল। ‘হয়তো অন্য মেয়েদের কেউ দুষ্টুমি করেছে।’

‘বাজে রসিকতা।’ বলল অ্যালিসিয়া, পুতুলটাকে তুলে নিয়ে আবার সোফায় বসিয়ে দিল।

সিবিল হাতে ধরা পোশাকটা বিছিয়ে দিল চেয়ারে, তারপর উঠে গেল উপরে।

‘মিস কুম্বের নিচতলার ঘরে,’ বলল সে। ‘মানে ফিটিং-রুমে একটা পুতুল আছে না?’

ফোরওম্যান এবং কর্মরত তিন মেয়ে চোখ তুলে তাকাল।

‘জি, মিস। আছে একটা।’

‘কে ঠাট্টা করে ওটাকে ডেস্কের সামনে বসিয়ে রেখেছে?’

মেয়ে তিনজন একে-অন্যের দিকে তাকাল, এরপর তাকাল এলসপেথের দিকে। ‘ডেস্কে বসিয়েছে? আমি জানি না, মিস।’ জবাব দিল একজন।

‘আমিও না,’ আরেকজন বলল। ‘কাজটা তোমার, মার্লিন?’

কিন্তু মার্লিনও না করল।

‘তাহলে কি তুমিই মজাটা করলে, এলসপেথ?’

‘একদম না।’ বলল এলসপেথ, চেহারা শক্ত হয়ে এসেছে। ‘পুতুল খেলার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আমার।’

‘দেখো,’ বলল সিবিল, অবাক হয়ে খেয়াল করল, কণ্ঠ কেঁপে গেল কিছুটা! ‘ঠাট্টা করার জন্য আমি কিছু মনে করিনি। শুধু জানতে চাই-কাজটা কে করল!’

একসঙ্গে বলে উঠল তিন মেয়ে, ‘মিসেস ফক্স, আমাদের কেউ করেনি কাজটা।’

‘মিসেস গ্রোভসের কাজ না তো?’ মন্তব্য করল মার্লিন।

মাথা নাড়ল সিবিল। ‘মনে হয় না, বেচারি চমকে উঠেছিল পুতুলটাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে।’

‘চলুন যাই, আমি নিজে দেখব।’ বলল এলসপেথ।

‘এখন আর ডেস্কে নেই।’ বলল সিবিল। ‘মিস কুম্ব সোফায় সাজিয়ে রেখে দিয়েছেন ওটাকে। আসলে-’ একটু বিরতি নিল। ‘-কেউ নিশ্চয়ই মজা করার জন্য ওভাবে রেখেছিল পুতুলটাকে। কিন্তু এখন অস্বীকার করছে কেন, সেটাই বুঝতে পারছি না!’

‘আমাদেরকে শুধু শুধু মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করছেন কেন, মিসেস ফক্স?’ বলল মার্গারেট।

‘আমি দুঃখিত,’ বলল সিবিল। ‘তোমাদের মনে কষ্ট দিতে চাইনি। কিন্তু তোমরা না করলে পুতুলটা ওখানে গেল কীভাবে?’

‘হয়তো নিজে নিজেই হেঁটে গিয়েছে।’ বলেই খিলখিল করে হাসতে শুরু করল মার্লিন।

কেন যেন কথাটা সিবিলের পছন্দ হলো না।

‘যাই হোক, বাজে কথা বাদ দেয়া যাক।’ বলেই নিচতলায় চলে গেল সে।

 

অ্যালিসিয়া গুনগুন করে গান গাইছিল, আচমকা ঘরের চারদিকে তাকাল।

‘আবারও চশমা হারিয়ে ফেলেছি।’ বলল সে, ‘তবে আপাতত জিনিসটার দরকার নেই। ঝামেলা একটাই। আমার মত চোখের অবস্থা যাদের, তারা চশমা হারিয়ে ফেলে বড় বিপদে পড়ে। নতুন একজোড়া গলিয়ে খোয়া যাওয়াটাকে খুঁজে বের করতে হয়। নইলে তো চোখের সামনে পড়ে থাকলেও টের পাওয়া যাবে না! কিন্তু নতুন একজোড়া যদি চোখে থাকেই, তাহলে আর খোঁজার দরকার কী?

‘আমি খুঁজে দিচ্ছি।’ বলল সিবিল। ‘এইমাত্রই তো পড়েছিলে।’

‘তুমি যখন উপরে গেলে, তখন অন্য ঘরটায় গিয়েছিলাম। সম্ভবত ওখানেই রেখে এসেছি। কী বিরক্তিকর ব্যাপার!’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘হিসেব-নিকেশ করা দরকার। কিন্তু চশমা ছাড়া করি কীভাবে?’

‘তাহলে শোবার ঘর থেকে আরেকজোড়া এনে দিই।’ বলল সিবিল।

‘আরেক জোড়া তো এখন নেই।’ বলল অ্যালিসিয়া।

‘কেন? ওটার আবার কী হলো?’

‘সম্ভবত গতকাল চার্চে ফেলে এসেছি। ওখানে গিয়েছিলাম, এরপর আবার দুটো দোকানেও গিয়েছি।’

‘হায়, ঈশ্বর,’ বলল সিবিল। ‘তোমার দেখি তিনজোড়া চশমা লাগবে!’

‘তিনজোড়া কিনলে, সবসময় কোন না কোনটার খোঁজে ব্যস্ত থাকতে হবে আমাকে।’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘তাই একজোড়া থাকাই আসলে সবচেয়ে ভাল। খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত, খুঁজতে থাকতেই হবে!’

‘হুম, এখানেই কোথাও আছে তোমার চশমা।’ বলল সিবিল। ‘এই দুই ঘরের বাইরে যাওনি তুমি। যেহেতু এই ঘরে নেই, তাহলে ফিটিং-রুমেই আছে।’

ওই ঘরে গিয়ে খুঁজতে লাগল সিবিল। অনেকক্ষণ পরেও যখন পেল না, তখন সোফা থেকে তুলে নিল পুতুলটা।

‘পেয়েছি,’ বলল সে।

‘কোথায় পেলে, সিবিল?’

‘আমাদের মহামূল্য পুতুলের তলে। সম্ভবত ভুলে চশমার ওপরেই বসিয়ে দিয়েছিলে এটাকে।’

‘নাহ, আমি নিশ্চিত!’

‘ওহ,’ ক্লান্ত-স্বরে বলল সিবিল। ‘তাহলে হয়তো পুতুলটা তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার জন্য চশমা চুরি করেছে।’

‘কী জানি!’ বলল অ্যালিসিয়া, চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে পুতুলটার দিকে। ‘একেবারে অসম্ভব কিছু না। দেখে তো বুদ্ধিমান বলেই মনে হয়! কী বলো, সিবিল?’

‘চেহারাটাই আমার পছন্দ হয়নি।’ উত্তর দিল সিবিল। ‘দেখে মনে হয় এমন অনেক কিছু জানে, যা আমরা জানি না।’

‘আচ্ছা, একইসঙ্গে বিষণ্ণ আর মিষ্টি বলে মনে হয় না?’ বলল বটে অ্যালিসিয়া, তবে কণ্ঠে জোর নেই।।

‘একদম না।’ বলল সিবিল।

‘হুম... হয়তো তুমিই ঠিক... যাক গে সে-সব। লেডি লী কিন্তু মিনিট দশেকের মাঝে চলে আসবেন। এই রশিদগুলো পুরো করে ডাকে পাঠিয়ে দাও।’

***

‘মিসেস ফক্স। মিসেস ফক্স?’

‘বলো, মার্গারেট?’ বলল সিবিল। ‘কী হয়েছে?’

একটা টেবিলের ওপর ঝুঁকে ছিল সিবিল, স্যাটিনের এক টুকরা কাপড় কাটায় ব্যস্ত।

‘ওহ, মিসেস ফক্স, আবার সেই পুতুল! আপনার কথামত বাদামি পোশাকটা নিয়ে গিয়েছিলাম, দেখি-পুতুলটা আগেরমতই ডেস্কে হাত রেখে বসে আছে। সত্যি বলছি, আমরা এ-ব্যাপারে কিছুই জানি না! মিসেস ফক্স, আমরা এসব কেন করব, বলুন?’

সিবিলের কাঁচি কেঁপে উঠল।

‘এই দেখো,’ রাগান্বিত কণ্ঠে বলল সে। ‘তোমার কথা শুনতে গিয়ে এ কী অনর্থ হলো! যাক, খুব একটা নষ্ট হয়নি কাটা। পুতুলের কথা যেন কী বলছিলে?’

‘ওটা আবার ডেস্কে হাত রেখে বসে আছে।’

সিবিল নিচে গিয়ে, ফিটিং-রুমে প্রবেশ করল। আসলেই তাই।

‘দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ জিনিস তুমি, তাই না?’ পুতুলটার উদ্দেশে বলল সিবিল। এরপর আলগোছে তুলে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিল। ‘ওটাই তোমার জায়গা, বাছা। তাই ওখানেই থেকো।’ এরপর পাশের ঘরে গিয়ে বলল, ‘মিস কুম্ব।’

‘হ্যাঁ, সিবিল?’

‘কেউ একজন আমাদের সঙ্গে ফাজলামি করছে। পুতুলটা আজও ডেস্কে হাত রেখে বসেছিল।’

‘কে করতে পারে?’

‘উপরতলার তিনজনের একজন হবে।’ বলল সিবিল। ‘ভাবছে, খুব মজা হচ্ছে। তবে কেউ স্বীকার করবে না।’

‘কে হতে পারে—মার্গারেট?’

‘মনে হয় না মার্গারেট এমন করবে। ওই সদাহাস্য মার্লিনকেও বাদ রাখা যায়।’

‘একেবারে ছেলেমানুষি।’

‘হ্যাঁ-সেই সঙ্গে বোকামিও,’ বলল সিবিল। ‘তবে,’ দৃঢ়-কণ্ঠে যোগ করল। ‘এসবে যতি টানতে যাচ্ছি আমি।’

‘কীভাবে?’

‘দেখো,’ বলল সিবিল।

 

সে-রাতে চলে যাবার আগে, বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে দিল ফিটিং-রুম।

‘দরজা বন্ধ করে,’ বলল সে। ‘চাবি নিয়ে যাচ্ছি।’

‘ওহ, বুঝতে পেরেছি,’ আমুদে স্বরে বলল অ্যালিসিয়া। ‘তোমার এখন আমার ওপর সন্দেহ হচ্ছে? এতটাই ভুলোমনা হয়ে গিয়েছি যে নিজে না লিখে পুতুলটাকে বসিয়ে দিচ্ছি আমার জায়গায়? আর তারপর, ভুলে খেয়ে দিচ্ছি সব?’

‘সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না,’ সিবিল মেনে নিল। ‘যাই হোক, এটা তো অন্তত নিশ্চিত হওয়া যাবে যে আজরাতে আর কেউ দুষ্টুমি করতে পারবে না।’

পরদিন সকালে, কাজে এসে প্রথমেই ফিটিং-রুমের দরজা খুলে ভেতরে পা রাখল সিবিল। মিসেস গ্রোভস, হাতে ঝাড়-পৌঁছ করার সরঞ্জাম নিয়ে তৈরিই ছিলেন।

‘এবার দেখা যাবে!’ বলল সিবিল। পরক্ষণেই আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেল।

পুতুলটা বসে আছে ডেস্কে হাত রেখে!

‘হায়, ঈশ্বর!’ ওর পেছন থেকে বলে উঠল মিসেস গ্রোভস। ‘কী অপার্থিব ব্যাপার! আরে, মিসেস ফক্স, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? মিস কুম্বের কাছে ওষুধ থাকার কথা, এনে দেব?’

‘ঠিক আছি আমি,’ বলল সিবিল। তারপর পুতুলটার কাছে গিয়ে ওটাকে তুলে নিল, এরপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

‘কেউ একজন ঠাট্টা করছে।’ বলল মিসেস গ্রোভস।

‘সেটা কীভাবে সম্ভব তা বুঝতে পারছি না।’ ধীর-কণ্ঠে বলল সিবিল। ‘গতরাতে ঘরটা তালা দিয়ে গিয়েছিলাম। তুমি তো নিজেই দেখলে—কারও পক্ষে ভেতরে পা রাখা সম্ভব ছিল না।’

‘হয়তো আরেকটা চাবি আছে কারও কাছে,’ আশা নিয়ে বলল মিসেস গ্রোভস।

‘আমার তা মনে হয় না,’ বলল সিবিল। ‘আগে কখনও এই ঘরের তালা লাগাবার দরকার পড়েনি। ওটা আগের আমলের, একটাই চাবি আছে।’

‘হয়তো অন্য কোন চাবি দিয়ে খোলে... মিস কুম্বের ঘরের চাবি হতে পারে।’

একে একে দোকানে সবগুলো কামরার চাবি দিয়ে চেষ্টা করে দেখা হলো, কিন্তু কোনটাই কাজ করল না।

‘অদ্ভুত ব্যাপার, মিস কুম্ব,’ পরে, একসাথে দুপুরের খাবার খেতে বসে বলল সিবিল।

অ্যালিসিয়াকে সন্তুষ্ট দেখাল।

‘দেখো, বাছা,’ বলল সে। ‘আমার কাছে কিন্তু ব্যাপারটা দারুণ মনে হচ্ছে। এককাজ করা যায়, ভূত-গবেষকদের চিঠি লিখি না কেন? ওরা হয়তো কাউকে পাঠিয়ে দেখবে ওই ঘরে কোন ভূত-প্রেতের আছর আছে কি না।’

‘তোমার দেখি কোন চিন্তাই নেই!’ বলল সিবিল।

‘আরে না, বরঞ্চ উপভোগ করছি বলতে পারো।’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘মানে আমার এই বয়সে, ঘটনার ঘনঘটা দেখতে ভালই লাগে! পুতুলটা তো আর কারও কোন ক্ষতি করছে না।’

সেদিন সন্ধ্যায়, সিবিল এবং অ্যালিসিয়া আরেকবার বাইরে থেকে ফিটিং-রুম তালাবন্ধ করে দিল।

‘আমি এখনও মনে করি,’ বলল সিবিল, ‘কেউ একজন ঠাট্টা করছে। যদিও লাভ কী, তা বুঝতে পারছি না... ’

‘তোমার ধারণা, কাল সকালেও ডেস্কের সামনে পুতুলটাকে বসে থাকতে দেখবে?’ জানতে চাইল অ্যালিসিয়া।

‘হ্যাঁ,’ বলল সিবিল, ‘আমার সেইটাই ধারণা।’

কিন্তু না, ভুল প্রমাণিত হলো ধারণা। পুতুলটা ডেস্কের সামনে ছিল না, ছিল জানালার সিলে... যেন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল শহরকে! মানুষের মত নিখুঁত ভঙ্গিমায় বসে ছিল ওটা।

‘কী হাস্যকর রকমের ভীতিপ্রদ ব্যাপার, তাই না?’ বিকালে চা খেতে খেতে জানতে চাইল অ্যালিসিয়া। সাধারণত সিবিল ফিটিং-রুমে বসে সান্ধ্য-ভোজন সারে। আজ তা করল না, বসল অ্যালিসিয়ার কামরায়।

‘হাস্যকর বলতে?’

‘মানে, এসবে তো কোন লাভ-ক্ষতি হচ্ছে না কারও। একটা পুতুল এখান থেকে ওখান হচ্ছে কেবল।’

দিন যতই গড়াল, কথাটার অর্থ আরও পরিষ্কার হয়ে ধরা দিল সিবিলের কাছে। পুতুলটা এখন শুধু রাতেই স্থান-পরিবর্তন করে না। কয়েক মিনিট আগে ছিল এক জায়গায়, আবার কয়েক মিনিট পরেই তাকে অন্য কোথাও দেখা যায়। হয়তো এক সোফা বা চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছিল ওটাকে, একটু পরেই তাকে দেখা যায় অন্য চেয়ারে। কখনও থাকে জানালার সামনে বসে, আবার কখনও বা ডেস্কের সামনে।

‘ইচ্ছামত নড়া-চড়া করতে শুরু করেছে দেখি।’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘আমার ধারণা, সিবিল, মজাও পাচ্ছে কাজটা করে।’

মহিলা দুইজন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনড় বস্তুটার দিকে।

‘পুরাতন ভেলভেট এবং রঙের একটু আঁচড়... ব্যস।’ বলল অ্যালিসিয়া, কণ্ঠে ক্লান্তির সুর। ‘এক কাজ করা যায়... মানে... বলতে চাইছি... ওটাকে নষ্ট করে ফেলতে পারি আমরা।’

‘নষ্ট করে ফেলব মানে?’ জানতে চাইল সিবিল, চমকে গিয়েছে কথা শুনে।

‘এই যেমন,’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘ওটাকে আগুনে ফেলে দিতে পারি, মানে ওই যে... ডাইনী পুড়িয়ে মারত না... অমন করে। অথবা... ’ একেবারে শান্ত গলায় বলল কথাগুলো। ‘আঁস্তাকুড়েও ফেলে আসা যায়।’

‘তাতে কাজ হবে বলে মনে হয় না,’ বলল সিবিল। ‘কেউ না কেউ খুঁজে পেয়ে ঠিক আমাদের কাছে নিয়ে আসবে।’

‘তাহলে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়া যায়,’ হাল ছাড়বে না যেন অ্যালিসিয়া। ‘সবসময়ই তো কেউ না কেউ এসব জিনিস চেয়ে চিঠি লিখছে! আমার মনে হয়, সেটা করাই ভাল হবে।’

‘জানি না ... ’ বলল সিবিল। ‘আমার ভয় লাগছে।’

‘ভয়? কীসের ভয়?’

‘মনে হচ্ছে-আমরা যা-ই করি না, ঠিক ফিরে আসবে ও।’ বলল সিবিল।

‘ফিরে আসবে মানে... ? এখানে ফিরে ফিরে আসবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘হোমিং কবুতরের মত?’

‘সেটাই বোঝাতে চাইছি।’

‘আচ্ছা, আমরা পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো?’ জানতে চাইল অ্যালিসিয়া। ‘হয়তো আমি আসলেই বিচার-বুদ্ধি খুইয়ে ফেলেছি। আর তুমি আমার সঙ্গে তাল মেলাচ্ছ।’

‘না,’ বলল সিবিল। ‘কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে পুতুলটা আমাদের চাইতে বেশি শক্তিশালী।’

‘কী? ওই কাপড়ের দলা?’

‘ওই, ওই জঘন্য... ভয়ঙ্কর কাপড়ের দলাটা। কেন না, ও যে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ।’

‘দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ?’

‘যা চায়, সেটা ঘটিয়ে ছাড়ে। দেখো না, এটা এখন ওর ঘরে পরিণত হয়েছে!’

‘হ্যাঁ,’ চারপাশে তাকিয়ে বলল অ্যালিসিয়া। ‘ঠিক ধরেছ। অবশ্য এক দিক দিয়ে চিন্তা করলে, সবসময় তাই ছিল—রঙ, পর্দা, কার্পেট... সব মিলিয়ে দেখ। বলতেই হয় এই ঘরটা যেন ওর জন্যই বানানো।’ কিছুটা রাগের ছোঁয়া পাওয়া গেল ওর কণ্ঠে। ‘একটা পুতুল এভাবে সবকিছু দখল করে নেবে ব্যাপারটা মানা যায় না। শুনেছ তো? মিসেস গ্রোভস আর আসবে না বলে দিয়েছে।’

‘পুতুলের ভয়ে?’

‘তা বলেনি। এটা-সেটা বলেছে আরকী।’ কিছুটা ভয়ের সাথেই যোগ করল অ্যালিসিয়া। ‘আমরা কী করব, সিবিল? এখন আর কাজ করতে পারছি না আমি। অনেকদিন হয়ে গেল, একটাও ডিজাইন শেষ করতে পারিনি।’

‘আমিও কাজ করতে পারছি না।’ সিবিল স্বীকার করল। ‘হাস্যকর রকমের ভুল করছি। হয়তো... ’ অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল সে। ‘ভূত-গবেষকদের কাছে চিঠি লেখার বুদ্ধিটা খারাপ না। ওরা কিছু করতে পারে।’

‘লোকে আমাদের পাগল বলবে।’ বলল অ্যালিসিয়া, মুচকি হেসে। ‘আমি সিরিয়াসলি বলিনি। একেবারে শেষ উপায় ছাড়া ও-পথে হাঁটতে চাই না-’

 

পরের দিন সিবিল যখন এসে পৌঁছল, তখন দেখে ফিটিং-রুমের দরজাটা তালা দেয়া!

‘মিস কুম্ব, চাবি তোমার কাছে? রাতে তালা লাগিয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ,’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘এখন থেকে তালাবন্ধই থাকবে।’

‘মানে?’

‘মানে ওই কামরা আমার দরকার নেই। পুতুলটাই নিয়ে নিক। আমাদের একটাতেই কাজ চলে যাবে।’

‘কিন্তু এটা যে তোমার ব্যক্তিগত বসার ঘর!’

‘আমার আলাদা একটা বসার ঘরের দরকার নেই। শোবার ঘরটাকেই বসার ঘর বানিয়ে নেব।’

‘সত্যি সত্যি আর ফিটিং-রুম ব্যবহার করবে না?’ জানতে চাইল সিবিল।

‘হ্যাঁ, একদম সত্যি।’

‘কিন্তু-পরিষ্কার করতে হবে না? ধুলো জমে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে যে!’

‘যাক না!’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘ওই পুতুল যদি ঘরটাকে চায় তো নিয়ে নিক। নিজেই পরিষ্কার করবে ওটাকে। আমাদেরকে ঘৃণা করে সে, জানো তো?’

‘ঘৃণা করে বলতে?’ প্রশ্ন করল সিবিল। ‘পুতুলটা আমাদেরকে ঘৃণা করে?’

‘হ্যাঁ,’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘তুমি বোঝনি? নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ। ওর দিকে একনজর তাকালেই বোঝা যায়।’

‘হুম,’ চিন্তিতকণ্ঠে বলল সিবিল। ‘তা বোধহয় পেরেছিলাম। শুরু থেকেই মনে হচ্ছিল আমাদেরকে ওই ঘর থেকে তাড়াতে চায় সে।’

‘হিংসুক একটা পুতুল!’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘যাই হোক, এখন তো ওর ইচ্ছাপূরণ হয়েছে।’

এরপর শান্তির সাথেই কাটতে লাগল দিন। অ্যালিসিয়া সবাইকে জানিয়ে দিল যে আপাতত আর ফিটিং-রুমটা ব্যবহার করা হবে না। কারণ হিসেবে জানাল, এতে পরিষ্কার করার মত ঘরের সংখ্যা কমে আসে।

কিন্তু তাই বলে তো আর লোকের মুখ বন্ধ করা যায় না। একদিন শুনতে পেল, এক মেয়ে বলছে, ‘মিস কুম্ব এখন পুরো পাগল হয়ে গিয়েছেন। আগে থেকেই অদ্ভুত লাগত তাকে, কিন্তু এখন আর লুকাছাপার সুযোগ নেই! এক পুতুলের ভয়ে কেউ ঘর বন্ধ করে দেয়!’

‘সত্যি বলছ?’ ভয় খেলে গেল অন্যজনের কণ্ঠে। ‘আবার ছুরি-টুরি নিয়ে আমাদের পিছু ছুটবে না তো?’

গল্প করতে করতে চলে গেল তারা, অপমানে এতটুকু হয়ে চেয়ারে বসে রইল অ্যালিসিয়া। পাগল হয়ে যাচ্ছে! পরক্ষণেই ভাবল, ‘সিবিল না থাকলে তো আমিও নিজেকে পাগল বলে ধরে নিতাম। কিন্তু সিবিল... এবং মিসেস গ্রোভসও সন্দেহ করেছে যে কোথাও কোন ঘাপলা আছে। কিন্তু কথা হলো, এর শেষ যে কোথায় তা-ই তো বুঝতে পারছি না!’

তিনসপ্তাহ পর, অ্যালিসিয়াকে বলল সিবিল। ‘কখনও না কখনও তো ভেতরে ঢুকতে হবে।’

‘কেন?’

‘নোংরা হয়ে আছে নিশ্চয়ই, পোকার আবাসে পরিণত হয়েছে কামরাটা। অন্তত পরিষ্কার করে নাহয় আবার তালা ঝুলিয়ে দেব।’

‘তারচেয়ে বন্ধই থাকুক, আর ঢুকতে চাই না ওতে।’ বলল অ্যালিসিয়া।

সিবিল শক্ত হলো একটু। ‘তুমি দেখি আমার চাইতেও বেশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন!’

‘তা বলতে পারো,’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘প্রথম প্রথম কিন্তু এসবে আমিই বিশ্বাস করেছিলাম, তুমি করোনি। এখন কেন যেন ভয় লাগছে, ওই ঘরে ঢোকার সাহস পাচ্ছি না।’

‘হুম, কিন্তু আমি ঢুকতে চাই।’ বলল সিবিল, ‘এবং ঢুকেই ছাড়ব।’

‘কেন, তা জানো?’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘কারণ তুমি কৌতূহলী হয়ে পড়েছ!’

‘ঠিক আছে, আমার কৌতূহল হচ্ছে। আমি দেখতে চাই, পুতুলটা কী করল এই কয়দিন।’

‘আমি বলব, ওকে ওর মতই থাকতে দাও,’ মত জানাল অ্যালিসিয়া। ‘আমরা ওই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছি, এতেই ওর সন্তুষ্ট থাকার কথা।’ পরক্ষণেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘কী সব বাজে কথা বলছি!’

‘হুম। আমি জানি যে এসবই বাজে কথা। যাই হোক, এবার চাবিটা দাও।’

‘দিচ্ছি, বাবা। দিচ্ছি।’

‘তুমি সম্ভবত ভয় পাচ্ছ যে আমি ওকে ঘর থেকে বেরোতে দিব। অথচ সে অপার্থিব হলে... ’ কথা শেষ না করেই তালা খুলে ফেলল সিবিল, ভেতরে ঢুকল। ‘অদ্ভুত!’

‘কী অদ্ভুত?’ মেয়েটির কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিল অ্যালিসিয়া।

‘ঘরে একদম ধুলো-বালি নেই! তাই না? এতদিন ধরে বন্ধ আছে, তাই... ’

‘আসলেই অদ্ভুত।’

‘ওই যে আমাদের পুতুল,’ বলল সিবিল।

সোফায় বসেছে ওটা; তবে সচরাচর যেমন নরম হয়ে থাকে, তেমনটি নেই। সোজা বসে আছে, পিঠের নিচে কুশন। মনে হচ্ছে যেন বাড়ির মালিক মানুষজনকে স্বাগত জানাচ্ছে!

‘দেখে তো,’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘ওর ঘর বলেই মনে হচ্ছে, তাই না?’

‘চলো, ফিরে যাই।’ বলে দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিল সিবিল।

দুই রমণী একে অন্যের দিকে তাকাল।

‘ইস, যদি জানতেম,’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘না জানার কারণেই তো ভয়টা বেশি... ’

‘কে না ভয় পাবে?’

‘এমনকী করছে পুতুলটা, বলো? কেবল একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে। আমার তো ধারণা, পুতুলটার কোন দোষ নেই। ওই ঘরে কোন পোলটারগাইস্ট আছে!’

‘এতদিনে একটা ভাল কথা বললে।’

‘তবে বিশ্বাস হয় না নিজের কাছেই। ওই পুতুলটাকেই সব কিছুর জন্য দায়ী মনে হয়।’

‘আচ্ছা, ও কীভাবে তোমার কাছে এল, সেটা আসলেই মনে পড়ছে না?’

‘একদম না,’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘কিনে আনিনি, সে-ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কেউ আমাকে উপহারও দেয়নি। ও... এমনি এমনিই... এসে উপস্থিত হয়েছে!’

‘কখনও... যাবে না?’

‘কেন যাবে?’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘যা যা ওর চাই, তা তো এখানে পেয়েই গিয়েছে।’

পরেরদিন সকালে দেখা গেল, পুতুলের সব চাহিদা এখনও পূরণ হয়নি। সিবিল শো-রুমে যাবার সময় আঁতকে উঠল ভয়ে। তারপর ডাকল, ‘মিস কুম্ব, মিস কুম্ব। জলদি এস।’

‘কী হলো?’

অ্যালিসিয়ার জাগতে দেরি হয়েছে। ডান হাঁটুতে বাতের সমস্যা, তারপরেও যত দ্রুত সম্ভব চলে এল সে। ‘কী হয়েছে, সিবিল?’

‘নিজেই দেখে নাও।’

শো-রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল উভয়ে।

কেন না ভেতরে... সোফার হাতলের ওপর... চুপচাপ বসে আছে সেই পুতুল।

‘বেরিয়ে এসেছে,’ বলল সিবিল। ‘ফিটিং-রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে! এখন এই কামরাও চায়!’

অ্যালিসিয়া শীতল-কণ্ঠে বলল, ‘আস্তে-আস্তে... পুরো দোকানটাকেই গ্রাস করবে ও।’

‘হতেই পারে।’ বলল সিবিল।

‘জঘন্য, হতচ্ছাড়া কোথাকার,’ পুতুলটাকে বলল অ্যালিসিয়া। ‘আমাদেরকে জ্বালাচ্ছিস কেন? আমরা তোকে চাই না।’

আচমকা অ্যালিসিয়ার মনে হলো, সিবিলও একমত, হালকা নড়ে উঠল পুতুল। মনে হচ্ছিল যেন হাত দিয়ে ঢেকে ফেলল চেহারা, কেবল একটা চোখ উঁকি দিচ্ছে। সেই চোখে নৃশংস দৃষ্টি...

‘কী জঘন্য জিনিস।’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘আমার একদম সহ্য হচ্ছে না ওটাকে! একদম না!’

সিবিলকে অবাক করে দিয়ে দৌড় লাগাল অ্যালিসিয়া, হ্যাঁচকা টানে পুতুলটাকে তুলে নিয়ে চলে গেল জানালার কাছে। ওটা খুলেই রাস্তায় ছুঁড়ে দিল ওটাকে। ভয়ে-বিস্ময়ে আঁতকে উঠল সিবিল।

‘ওহ, অ্যালিসিয়া, তোমার কাজটা করা ঠিক হয়নি! একদম ঠিক হয়নি!’

‘কিছু একটা তো করতেই হত,’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘আর সহ্য হচ্ছিল না।’

সিবিল ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ফুটপাতে দেখা যাচ্ছে পুতুলটাকে, উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।

‘খুন করে ফেললে নাকি!’ বলল সিবিল।

‘বাজে কথা বোলো না তো... ভেলভেট আর সিল্কের তৈরি জিনিসকে খুন করা যায়?’

‘তারপরও, দেখতে একদম... ’

সিবিলের কথা শেষ হবার আগেই ওর হাত আঁকড়ে ধরল অ্যালিসিয়া।

‘হায়... হায়... বাচ্চাটা-’

ছোট্ট এক ময়লা পোশাক পরিহিত একটা বাচ্চা পুতুলটার দিকে ঝুঁকে আছে। রাস্তার ডানে-বাঁয়ে দেখল একবার। সাধারণত ফাঁকাই থাকে জায়গাটা, আজও তার ব্যতিক্রম নয়। পুতুলটাকে তুলে নিয়েই দৌড়ে রাস্তা পার হলো মেয়েটি।

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও!’ চিৎকার করে অ্যালিসিয়া, ফিরল সিবিলের দিকে। ‘বাচ্চাটা যেন কোনক্রমেই ওই পুতুল না নিতে পারে! ওটা অভিশপ্ত... বিপজ্জনক। আমাদেরই কিছু একটা করতে হবে।’

কপাল সঙ্গে ছিল ওদের। কেন না সেই মুহূর্তে একদিক থেকে এল তিনটা ট্যাক্সি এবং অন্যদিক থেকে তিনটা ভ্যান। দুইয়ের মাঝে পড়ে গেল বাচ্চাটা, দাঁড়িয়ে রইল রাস্তার মাঝখানে। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামল সিবিল, তার পেছনেই অ্যালিসিয়া। একটা ভ্যান এবং প্রাইভেট কারের ফাঁক গলে, সিবিল অ্যালিসিয়াকে নিয়ে পৌঁছে গেল বাচ্চাটার কাছে।

‘ওই পুতুল নিয়ো না,’ বলল অ্যালিসিয়া। ‘আমাকে ফেরত দাও।’

বিদ্রোহীর দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকাল শুকনো-পাতলা মেয়েটি। বয়স টেনে-টুনে আট হবে।

‘কেন দেব, অ্যাঁ?’ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল ও। ‘জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছ, দেখিনি বুঝি? এর অর্থ তুমি ওকে চাও না। তাই এখন ও আমার!’

‘আরেকটা পুতুল কিনে দেব,’ পাগলের মত বলল অ্যালিসিয়া। ‘চলো, পুতুলের দোকানে গিয়ে সবচেয়ে সেরাটা কিনে দিচ্ছি। তবে এটা আমাকে দিয়ে দাও।’

‘দিব না,’ বলল মেয়েটি। দুই হাতে আঁকড়ে ধরল ভেলভেটের পুতুলটাকে।

‘ফেরৎ দাও,’ বলল সিবিল। ‘ওটা তো তোমার না।’ হাত বাড়িয়ে দিল ও, কিন্তু সেই মুহূর্তেই চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল মেয়েটি।

‘এটা আমার! আমি দেব না! দেব না! দেব না! আমি একে ভালবাসি! তোমরা বাসো না। ঘৃণা করো। অথচ বেচারি চায় শুধু ভালবাসা।’

বলেই ঈলের মত এঁকে-বেঁকে রাস্তা পার হয়ে উধাও হয়ে গেল মেয়েটি। দুই বয়স্কা মহিলা পিছুও নিতে পারল না।

‘বাচ্চাটা চলে গিয়েছে,’ বলল অ্যালিসিয়া।

‘বেচারি চায় শুধু ভালবাসা,’ আপনমনে বলল সিবিল।

‘হয়তো,’ বলল অ্যালিসিয়া, ‘শুরু থেকে কেবল সেটাই ছিল ওর চাহিদা... ভালবাসা... ’

লণ্ডনের ব্যস্ত ট্রাফিকের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে, দুই মহিলা ভয়ার্ত চোখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইল।