আশ্রয়ের আঁধার - তানজিরুল ইসলাম

অলংকরণ - পার্থ মুখার্জী

ভয়...

ভয় মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী অনুভূতি। ভয় একটা মানুষকে ভেতরে ভেতরে মেরে ফেলতে পারে। মানুষটার অস্তিত্বকে করে তুলতে পারে দুর্বিষহ।

দুর্ভাগ্য যে, নিউ কলকাতা চাইল্ড হোমের বাচ্চাগুলোর নিত্যসঙ্গী এই অনুভূতিটাই। প্রতিদিনই ওদের সাথে খারাপ কিছু না কিছু ঘটছে, দুর্বিষহ কোনো না কোনো কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করতে হচ্ছে ওদের।

দম বন্ধ করা ভয়ে গলা শুকিয়ে যায় বাচ্চাগুলোর। মনের ভেতর অদম্য আতঙ্কের তাণ্ডব চলে। স্মৃতির শুরু থেকে ওদের সঙ্গী এক দুঃসহ ভয়। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেটাই ওদের সঙ্গী হয়ে থাকবে।

যেমন বলা যায় পাঁচ বছর বয়সের কৃষ্ণদেহী রাকেশের কথা। অথবা বলা যায় চার বছর বয়সী ফুটফুটে বরুণের কথা। কিংবা বলা যায় টুকটুকে নিকিতার কথাও, যে এবার আটে পা দিলো। ওদের মতো আরো অনেকের কথাই বলা যায়। আরো সেসব বাচ্চা, যারা এই অনাথ আশ্রমটায় আছে এবং প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছে বিভিন্ন ভয়াবহতার।

শুরুটা বরং বরুণকে দিয়েই করি। নিজের ঘরে ডাবল বাঙ্ক বেডটার নিচের বেডে বসে আছে বাচ্চাটা। হাতে একটা ‍রুবিক্স কিউব। সেটায় সমস্ত মনোযোগ ঢেলে কিউবটা মেলাবার চেষ্টা করছে। চোখে-মুখে কেমন যেন একটা আপ্রাণ ভাব। যেন ওটার ওপরই নির্ভর করছে ওর জীবন-মরণ। অনেকটাই সেরকম। ও যদি এটা মেলাতে না পারে, তাহলে যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে ওকে, সেটার কথা ‍ও ভাবতেও চায় না।

ওর সামনে কয়েক হাত দূরে একটা চেয়ারে বসে আছে এক নারীমূর্তি। তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

কিউবটা মেলাতে মেলাতে বরুণ একবার মহিলার দিকে তাকালো। সাদা সালোয়ার, কালো কামিজ আর সাদা ওড়না পরনে মহিলার। হ্যাংলা-পাতলা, শুকনো। চোখ-চোয়াল বসে গিয়েছে কতদিন আগে কে জানে। কালিপড়া, অক্ষিকোটরের ভেতরে ঢুকে যাওয়া চোখদুটো দেখলে বুকটা ধ্বক করে ওঠে। নাকটাও সাধারণের থেকে খানিকটা বেশি লম্বা; যার কারণে বিভিন্ন কার্টুন ছবিতে দেখানো ডাইনিদের মতো লাগে মহিলাকে।

বরুণ তাকাতেই মহিলা চোখ পাকিয়ে উঠলো। ছেলেটা চমকে উঠে সাথে সাথে আবার দৃষ্টি নামিয়ে নিলো, মনোযোগ দিলো কিউব মেলানোয়। কপালে ঘাম জমে গেছে ওর, যদিও ফ্যানটা ঠিকঠাক চলছে ঘরে।

বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না বরুণ। কয়েকবার ইতস্তত কিউবটাকে এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে হা করে ওটার দিকে তাকিয়ে রইলো। দুশ্চিন্তার চাদর আরো খানিকটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো ওকে। কেমন যেন দম বন্ধ বন্ধ লাগতে শুরু করলো ওর। সেটা কাটাতেই হয়তো ছেলেটা ঢোক গিললো কয়েকবার।

“ব-রু-ণ!” কথা বলতে বলতে কণ্ঠ চড়তে শুরু করলো মহিলার। উঠতির একটা পর্যায়ে স্থির হলো খনিকের মধ্যে। “কী ব্যাপার? থেমে গেলি কেন? কিউব মেলাতে না পারলে ভালো করেই জানিস তোর জন্য কী অপেক্ষা করছে!”

“আমি-আমি”, যেন শব্দ আসছে না ছেলেটার মুখে। “মে-মে-মেলাচ্ছি। আমার একটু সময় লাগবে।”

“ইতোমধ্যেই অনেক সময় নিয়েছিস তুই। আমি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করবো না।”

“আর এ-একটু। প্লিজ।” অনুনয় ঝরলো ছেলেটার কণ্ঠে।

“ঠিক আছে, মেলা। আমি আরেকটু বসছি। কিন্তু এটাই শেষ। আমি আর বেশি সময় নষ্ট করতে পারবো না তোর জন্য।”

বরুণ কিছু না বলে কিউবটা মেলানোয় নিজের সমস্ত মনোযোগ ঢেলে দিলো। কিউবটাকে বারবার উল্টিয়ে পাল্টিয়ে ভাবতে লাগলো কীভাবে মেলানো যায় জিনিসটা। কিন্তু সমস্ত চেষ্টা ঢেলে দিলেও ওর ছোট্ট মস্তিষ্কে উপায় ধরা দিলো না কোনো। খানিক বাদেও ছেলেটা দিশেহারাভাবেই কিউবটা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে গেলো।

“বরুণ”, শান্তস্বরে ডাকলো সামনের মহিলা। তবে কণ্ঠ শান্ত হলেও ধারালো দৃষ্টি মহিলার চোখে। “তাকা আমার চোখে।”

বরুণ চোখ তুলে তাকালো। চেহারায় অপার্থিব এক আতঙ্ক। তাহলে কি শাস্তির ক্ষণ উপস্থিত?

“আমার চোখে কী দেখতে পাচ্ছিস তুই?” প্রশ্ন করলো মহিলা।

“জা-জা-জানি না।”

“ভালো করে তাকা।” কেমন যেন মাদকতা এসে ভর করে মহিলার কণ্ঠে।

বরুণ স্থির তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আস্তে আস্তে ওর সামনে অন্য এক জগৎ উঠে এলো। কেমন যেন মন খারাপ করা ধূসরতার এক জগত। কেমন যেন উদাস করা এক শীতলতা সে জগতে। ধূসরতাটুকু আর শীতলতাটুকু বাদে কিছুই নেই জগৎটায়। নেই দিগন্ত। নেই বৈচিত্র। অনন্ত বিশালত্ব, নিঃসীম একাকীত্বের এক জগৎ।

নিশ্ছিদ্র ধূসরতাটুকুর মধ্যেই আস্তে আস্তে সামান্য অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করলো বরুণের সামনে। ক্রমে ক্রমে পাক খেয়ে খেয়ে বড় হলো সে অন্ধকার। বড় হতে হতে একটা সময় নির্দিষ্ট আকারে এসে থেমে গেলো। এরপর একটা আকৃতি তৈরি হলো অন্ধকারটুকুতে। আস্তে আস্তে ভয়ংকর এক জীবে বদলে গেলো আকৃতিটা। যে জীব তৈরি হলো অন্ধকারের কুণ্ডলি থেকে, বরুণের দেখা নির্দিষ্ট কোনো প্রাণীর সাথেই মিল নেই তার। চোখ-কান-নাকবিহীন অসংখ্য মুখ একটা ভাসমান মাংসের স্তূপ থেকে বেরিয়ে আছে। পাটিতে দাঁত নেই বললেই চলে। মাত্র অল্প কয়েকটা সূচালো দাঁত দেখা যাচ্ছে। প্রায় দাঁতহীন পাটির ফাঁক দিয়ে লকলকে লম্বা জিহ্বা বের হয়ে এসেছে মুখগুলো থেকে।

বরুণ সাথে সাথে চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করলো। প্রাণিটার দিকে তাকাতে চায় না ও। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও চোখ বন্ধ করতে পারলো না। প্রাণিটার ভয়ংকর অবয়ব স্পষ্টই রয়ে গেলো ওর চোখের সামনে। এভাবে কতক্ষণ কাটলো ঠিক বলতে পারে না বরুণ, একসময় খেয়াল করলো কুৎসিত দর্শন প্রাণিটা ওর দিকে এগুতে শুরু করেছে। সাথে সাথে ভয়ানক চমকে উঠলো ও। শিরদাঁড়া বেয়ে যেন অপার্থিব আতঙ্কের শীতল স্রোত বয়ে গেলো। হাঁড়ের গভীরে শিরশির করে উঠলো ওর। প্রাণিটার কাছে আর এক মুহূর্তও থাকতে চায় না ও। সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়ালো। কিন্ত দৌড়াতে গিয়ে খেয়াল করলো, ও দৌড়াচ্ছে ঠিকই, তবু জায়গা থেকে এক বিন্দুও সামনে এগুচ্ছে না। অন্যদিকে প্রাণিটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে ওর দিকে।

বরুণ প্রাণপণে চেষ্টা করে গেলো, ছটফট করতে লাগলো লাগাতার। কিন্তু ও যেন কোনো খাঁচার ভেতরে আটকা। অবস্থান বদলাচ্ছে না ওর কিছুতেই। অদৃশ্য কোনো শক্তি যেন ওকে ধরে রেখেছে জায়গাটায়।

কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁধে মৃদু উষ্ণ এক স্পর্শ অনুভব করলো বরুণ। ওর ভাগ্য এতটাই খারাপ যে ঢোক গেলারও সময় পেলো না ও। সাথে সাথে প্রাণিটা পেছনের দিকে টেনে নিতে শুরু করলো ওকে। ছেলেটার ধূসর জগৎ নিমেষে নিকষ অন্ধকারে ভরে গেলো। একটু আগের শীতলতাটুকু বিদায় নিয়ে ওর শরীর জড়িয়ে ধরলো অদ্ভুত এক ভেজা উষ্ণতা। সমস্ত দেহেই সেই উষ্ণ ভেজা স্পর্শ; যেন কোনো মাংসের স্তূপে ঢুকে পড়েছে ও। ব্যাপারটা বুঝতে ওর খুব বেশি সময় লাগলো না। দম বন্ধ হয়ে আসতে আসতেই টের পেলো ভয়াল দর্শন প্রাণিটা ওকে নিজের ভেতরে শুঁষে নিয়েছে।

নিকিতাকে ডেকে পাঠিয়েছে সিস্টার সুস্মিতা হালদার। মেয়েটা এখন তার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে। ভাবছে ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না। দরজায় দাঁড়িয়ে দ্বিধায় ভুগলো খানিকক্ষণ। ওর উপস্থিতি টের পেয়ে ভেতর থেকে ভারী কণ্ঠে ভেসে এলো, “বাইরে কে? নিকিতা? আয়, ভেতরে আয়।”

নিকিতা আস্তে আস্তে কাঁপা পায়ে ভেতরে ঢুকলো। দরজার পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো মোটসোটা (একটু বেশিই মোটা, থলথলে বললে ভুল হয় না) সিস্টার ঘরের মাঝখানে একটা গোলটেবিলের পেছনে বসে আছে। নিকিতাকে ঢুকতে দেখে হোদল কুতকুতে মহিলা গোল টেবিলটার সামনে রাখা চেয়ারে বসার ইঙ্গিত দিলো মেয়েটাকে। নিকিতা ঘরের দরজাটা লাগানোর পর ইতস্তত পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসলো।

“কীরে রাতের খাবার খেয়েছিস?” আন্তরিক সুরে বললো মহিলা।

নিকিতা অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ, সিস্টার। খেয়েছি।”

“কোনো সমস্যা নেই তো? সমস্যা হলে বলবি।”

“না, সিস্টার। কোনো সমস্যা নেই।” নিকিতা মুখে সমস্যাহীনতার কথা বললেও মনের কথাটা ভিন্ন। ওদের সবার সমস্যার ওপর সমস্যা। প্রত্যেকটা বাচ্চাকে সীমাহীন আতঙ্কের মধ্যে বাস করতে হয়। কিন্তু সিস্টারকে ওসব বলে লাভ নেই। কীইবা করবে সিস্টার?

সিস্টার সুস্মিতা পেছনে হেলান দিলো। তার ওই বিশাল শরীরের ভারে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে উঠলো চেয়ারটা। নিজের নাস্তানাবুদ অবস্থার কথাই যেন ব্যক্ত করলো ক্যাঁচক্যাঁচিয়ে। “বাকীদের কী খবর?”

“ভালোই আছে, সিস্টার।” নিকিতা এবারও মিথ্যে বললো।

নিকিতার কথা শুনে সন্তুষ্টির হাসি ফুটলো সিস্টারের ঠোঁটে। সিস্টার যখন হাসে, চোখদুটো প্রায় বন্ধের মতো হয়ে যায়। থলথলে মুখে টানা ঠোঁট, সরু চোখ—হাসিটা বেশ অদ্ভুত লাগে দেখতে। চামড়ায় কেমন যেন শিরশিরে অনুভূতি হয়।

“বুঝলি নিকিতা, তুই সবার বড়।” হাসিটা ধরে রেখেই বললো সুস্মিতা হালদার। “ওদেরকে একটু দেখেশুনে রাখবি।”

“আচ্ছা, সিস্টার।” নিকিতা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

“ভালো কথা, তোকে যেজন্যে ডেকেছি,” প্রসঙ্গ পাল্টালো হোৎকাদেহী সিস্টার। “তোর পড়াশুনার কী খবর? তোর নাকি ইদানিং কম নম্বর আসছে? সিস্টার পারমিতা বললো সন্ধ্যের সময়।”

“ভালো।” ছোট্ট করে বললো নিকিতা। আর ওর কথা শেষ হতে না হতেই ঝপ করে অন্ধকার নেমে এলো ঘরটায়। লোডশেডিং। দেয়ালে লাগানো প্যাঁচানো হ্যালোজেন বাতিটা নিভে গেছে।

“তাহলে নম্বর কমছে কেন?”

আগের আন্তরিক সুরটা আর নেই মহিলার কণ্ঠে। তার বদলে কেমন যেন একটা ফ্যাসফেসে কণ্ঠ। হঠাৎ শুনে নিকিতা চমকে উঠলো। উত্তরে কী বলবে মাথায় আসছে না ওর। সেজন্য চুপচাপ বসে রইলো।

“নম্বর কমছে কেন?” আবার জিজ্ঞেস করলো সিস্টার সুস্মিতা। কণ্ঠ আরো ফ্যাসফেসে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন শব্দগুলো কোনোকিছুর সাথে ঘষা খেয়ে বেরুচ্ছে।

“জানি না।” অনিশ্চিত কাঁপা কাঁপা সুরে বললো নিকিতা। “আমি তো চেষ্টা...”

ঘরের এককোণে ফস করে একটা ম্যাচের কাঠিতে আগুন জ্বলে উঠলো এ সময়। সুস্মিতা হালদার কখন যে উঠে গেছে নিকিতা খেয়ালই করেনি। হঠাৎ আগুনটা জ্বলে ওঠায় ওর কথা থেমে গেলো।

স্থূলকায় সিস্টার কাঠিটা থেকে মোমের সূতায় আগুন লাগিয়ে নিলো। আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ালো নিকিতার দিকে। মোমের আগুন মহিলার চেহারায় অদ্ভুত একটা আবেশ নিয়ে এসেছে এমনিতেই, এর ওপর যুক্ত হয়েছে মুখভর্তি বিন্দু বিন্দু ঘাম। মহিলার মুখটা বীভৎস লাগছে দেখতে। গা শিরশির করে ওঠে।

ধীর পায়ে নিকিতার দিকে এগুলো মহিলা। সে যখন কথা বললো, কথাগুলো শোনালো আগের চেয়েও ফ্যাসফেসে। তবে এখন আর শুধু ফ্যাস ফ্যাস করছে না, আলাদা একটা ক্যারকেরে ভাবও যুক্ত হয়েছে। “বল, তোর নম্বর কমছে কেন? বল, ফাঁকিবাজি করছিস কেন?”

“আমি-আমি,” ভয়ে কথা বেরুতে চাইছে না নিকিতার মুখ থেকে। বিস্ফারিত চোখে সিস্টারের দিকে তাকিয়ে আছে ও। সিস্টারের যে শুধু গলার স্বর পাল্টে গেছে এমন নয়, মোমের আলোতে নিকিতা দেখতে পাচ্ছে সিস্টার সুস্মিতার চেহারা গলে পড়তে শুরু করেছে। ঠিক যেমন করে গলে পড়ে গরম মোম।

দেখতে দেখতে সুস্মিতা হালদারের পুরো শরীরটাই গলে পড়লো মেঝের ওপর। পরনের কাপড়-চোপরও গলে থকথকে জেলির মতো শরীরটার সাথে মিশে গেলো। কিন্তু মহিলার শরীর গলে পড়লেও হাতের মোমটা কীভাবে যেন দাঁড়িয়ে গেছে মেঝের ওপর, ঢলে পড়েনি। ওটার আলোতে দেখা যাচ্ছে, সিস্টার সুস্মিতার স্তূপাকার অর্ধস্বচ্ছ থকথকে জেলির মতো শরীরটা কাঁপছে। সেটার ওপর ভাসছে ঠোঁট আর চোখদুটো, নিকিতার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফ্যাসফেসে-ক্যারকেরে স্বরে ঠোঁট থেকে ভেসে এলো, “কেন ফাঁকিবাজি করছিস, নিকিতা? কেন?”

এ পরিস্থিতিতে নিকিতা আর স্থির হয়ে বসে থাকতে পারলো না চেয়ারে। উঠে পালাতে ‍উদ্যত হলো। কিন্তু ও যখন দরজার নবে হাত দিয়ে খোলার চেষ্টা করলো পাল্লাটা, লক্ষ করলো নবটা একটুও ঘুরছে না। শক্ত হয়ে জ্যাম লেগে আটকে গেছে।

হাঁচড়ে পাঁচড়ে, শক্তি খাটিয়ে নবটা ঘুরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলো নিকিতা। কিন্তু একবিন্দুও নড়ার নাম নেই নবটার। এর মধ্যে আবার শুনতে পেলো, সিস্টার সুস্মিতার ঘ্যাসঘেসে কণ্ঠটা এগিয়ে আসছে। ভয়ে ভয়ে চোখ বড় করে পেছনে তাকালো একবার নিকিতা। থকথকে জেলির মতো স্তূপটা এর মধ্যে অনেকখানিই এগিয়ে এসেছে। ক্রমে ক্রমে আরো এগিয়ে আসছে। জিনিসটাকে এগুতে দেখে মরিয়া হয়ে গেলো নিকিতা। আগের চেয়ে যেন দ্বিগুণ শক্তিতে নবটাকে ঘোরাবার জন্য হাঁচড়-পাঁচড় চালালো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। মেয়েটার বৃথা চেষ্টার বিপরীতে নবটা না নড়লেও থকথকে জেলিটা এসে গ্রাস করে ফেললো ওর পা। কেমন যেন গা শিউরানো উষ্ণ তরল একটা স্পর্শ। নিকিতার গা গুলিয়ে উঠলো। ও তাকাবে না, তাকাবে না করেও একবার তাকালো নিচের দিকে। থকথকে অর্ধস্বচ্ছ জেলিতে ভাসমান চোখদুটোর সাথে চোখাচুখি হয়ে গেলো। ওর দুপায়ের মাঝখানে ভাসছে চোখদুটো। বুক কাঁপিয়ে দেওয়া অসুস্থ দৃষ্টি হানছে।

হঠাৎ এ সময় নবটা ঘুরে গিয়ে দরজাটা খুলে গেলো। নিকিতা আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না সেখানে। দরজা গলে বের হয়ে প্রাণপণে ছুটতে লাগলো। ছুটেই গেলো, ছুটেই গেলো, ছুটেই গেলো—জানে না ও কতক্ষণ। ও শুধু এই ভয়াল জিনিসটা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়।

রাতের অন্ধকার। আলো নেই কোথাও। রাকেশ দৌড়াচ্ছে খোলা মাঠে। ঠাণ্ডা বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে ওকে। তারপরও ঘামছে ও। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছে। পেছনে একঝাঁক বাদুড় তাড়া করছে ওকে। বাদুড়গুলো কীভাবে জুটে গেছে, মনে করতে পারে না রাকেশ। এই মাঠেই বা কীভাবে এলো, তাও মনে করতে পারে না। শুরু থেকেই অন্ধকারে একটা খোলা মাঠে দৌড়াচ্ছে ও। আর বাদুড়গুলো ওকে তাড়া করছে।

ছুটতে ছুটতে একবার পেছনে তাকালো রাকেশ। বাদুড়গুলোকে ধেয়ে আসতে দেখলো। এতগুলো বাদুড় দেখে মাথা ঝিম ঝিম করে উঠলো ওর। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। দৌড় জারি রাখলো আগের মতোই।

হাঁপরের মতো ওঠা নামা করছে ওর বুক। প্রচণ্ড পানির পিপাসা পেয়েছে। পা আর চলতে চাইছে না। ব্যথায় টন টন করছে। ক্ষণে ক্ষণে দৌড়ানোর গতি কমছে ওর। কিন্তু থামার উপায় নেই। থামলেই বাদুড়গুলো ধরে ফেলবে ওকে। আর ধরে ফেললে কী হবে, সেটা ভাবতেও চায় না ও।

এমন সময় কীসে যেন হোঁচট খেলো রাকেশ। তাল হারিয়ে হুড়মুড় করে মাটিতে পড়লো। কিন্তু ও যেখানে পড়েছে, জায়গাটা স্রেফ মাটি নয়, একটা পোকার সাগর। অজস্র ছোট ছোট পোকার মাঝে পড়েছে ও।

রাকেশ পড়ে যেতেই পোকাগুলো জাপটে ধরলো ওকে। ছেলেটা হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে পোকাগুলো ছাড়াতে চাইলো শরীর থেকে, কিন্তু পারলো না। পোকার সাগরে যেন তলিয়ে যাচ্ছে ও। এদিকে বাদুড়গুলোও বসে নেই। নাগালে পেয়ে ঘিরে ধরলো ওকে। চারপাশ থেকে কামড়ে ছিঁড়ে-খুবলে খেতে শুরু করলো। একদিকে পোকার কামড়, অন্যদিকে বাদুরের। ছেলেটা ছটফট করতে লাগলো যন্ত্রণায়। কিন্তু এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই ওর। শরীরের শেষ বিন্দুটুকু সাবাড় হওয়া পর্যন্ত ওকে ওভাবেই ছটফট করতে হলো।

*

চোখ খুলে তাকালো রাকেশ। সারা শরীর ঘামে ভিজে একাকার। বিছানাটাও বেশ খানিকটা ভিজে গেছে ওর ঘামে। এদিক ওদিক তাকালো ও। ঘরে ভোরের আলো ঢুকেছে। সেই আলোতে নিজের পরিচিত ঘরটা দেখতে পেয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো ছেলেটা। এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিলো ও। যাক, ব্যাপারটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু না। কিন্তু বাস্তবেও তো ওর সাথে কম হয় না। কোনটা স্বপ্ন, কোনটা সত্যি বুঝতে পারে না ও। যেমন, এখন দেখছে ঘরের ছাদ থেকে ফাঁসির দড়িতে কয়েকটা বাচ্চার লাশ ঝুলছে। এটা নিশ্চয়ই স্বপ্ন নয়?

চোখ সরিয়ে নিলো ও। জানালার দিকে তাকালো। দেখতে পেলো জানালায় বসে নিকিতাদি বাইরে ভোর দেখছে। নিকিতাদিকে দেখে মনে একটু স্বস্তি পেলো ছেলেটা। এরপর বরুণের বাঙ্কটার দিকে তাকালো। ছেলেটাকে ঘুমোতে দেখা যাচ্ছে ওখানে।

রাকেশ এবার বিছানা থেকে নামলো। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে বসলো নিকিতার কাছে। জিজ্ঞেস করলো, “নিকিতাদি, ছাদে কি কিছু দেখতে পাচ্ছো?”

রাকেশের কথায় ঘোর ভেঙে নিকিতা ছাদের দিকে তাকালো। “নারে, কিছু তো দেখছি না। তুই ঠিক আছিস?”

“বাজে স্বপ্ন দেখেছি, নিকিতাদি। বাদুড় আর পোকায় খাচ্ছিলো আমাকে।”

রাকেশকে বুকে জড়িয়ে ধরলো নিকিতা। “আমারও কাল রাতটা ভালো যায়নি রে। সিস্টার সুস্মিতার ঘরে গেছিলাম। এরপর কী হলো মনে নেই। শুধু মনে আছে খুব বিদঘুটে আর ভয়ংকর একটা জিনিস দেখেছি। সারারাত ঘুম হলো না।”

“সিস্টার সুস্মিতা তোমাকে ভয় দেখিয়েছে?” খানিকটা অবাক হলো রাকেশ।

“জানি না রে।”

এমন সময় বরুণ বললো, “আমিও কালকে খুব ভয় পেয়েছি।”

বরুণ যে কখন বিছানা ছেড়ে নেমে এসেছে, দুজনের কেউই খেয়াল করেনি। নিকিতা জিজ্ঞেস করলো ওকে, “কী হয়েছিলো?”

“বেশি কিছু মনে নেই গো নিকিতাদি। রুবিক্স কিউব মেলাচ্ছিলাম। শেষে কিছুতেই মিলছিলো না। হঠাৎ দেখি অন্য জগতে চলে গেলাম। ভয়ংকর একটা জগৎ। ভয়ংকর একটা জীব খেয়ে ফেলেছিলো আমাকে।” কথাটা বলার সময় বরুণের মুখ কেমন কুঁচকে গেলো।

নিকিতা হাত প্রসারিত করে দিলো বরুণের দিকে। বরুণ সাড়া দিয়ে নিকিতার পাশ ঘেঁষে বসলো। নিকিতা জড়িয়ে নিলো ওকে।

পাশ থেকে রাকেশ বললো, “আচ্ছা নিকিতাদি, আমরা এখান থেকে পালাতে পারি না?”

“পালিয়ে কি বাঁচতে পারবো? এই চাইল্ডহোমের বাইরের জগৎ তো আরো ভয়ংকর। বইপত্রে পড়িস না?” চাইল্ডহোমটায় যে বইগুলো পড়ানো হয়, তারই জ্ঞানের আলোকে বললো নিকিতা। সেগুলোয় বাইরের জগৎ সম্পর্কে ভয়ংকর ভয়ংকর সব কথা লেখা।

“জানি না, নিকিতাদি।” সংশয় নিয়ে বললো রাকেশ। “আমার কেন জানি সব মিথ্যে মনে হয়।”

“মিথ্যে কেন হবে?” নিকিতার কণ্ঠে প্রশ্ন। “এই চাইল্ডহোমটাই তো বাঁচিয়ে রাখছে আমাদের বাইরের শক্তি থেকে। তারপরও মাঝে মধ্যে বাইরের খারাপ শক্তি ঢুকে পড়ে বলে আমাদের সাথে খারাপ ব্যাপারগুলো ঘটে। আমরা ভয় পাই।”

ছোট্ট বরুণ নিকিতার কোলের ওম থেকে বললো। “আমি একদিন এই চাইল্ডহোম ছেড়ে বাইরের জগতে পা রাখবো, নিকিতাদি। তুমি দেখে নিও।”

উত্তরে নিকিতা কিছু বললো না। ছোট্ট বরুণের মাথায় বিলি কেটে দিলো স্রেফ।

রাতের খাওয়া শেষ। ড. নিখিল নন্দী স্টাডিরুমে বসে নিবিষ্ট মনে নিউ কলকাতা চাইল্ডহোমের বাচ্চাদের ফাইলগুলো দেখছেন। হিপনোটিক সাজেশন বাচ্চাগুলোর ওপর কতটুকু কাজ করছে, তাদের মানসিক অবস্থা বর্তমানে কীরকম, তাদেরকে যেসব পরিস্থিতিতে ফেলা হচ্ছে, সেগুলোর প্রেক্ষিতে তাদের প্রতিক্রিয়া কী—সবকিছু তুলে দেওয়া আছে ওখানে। ড. নন্দী দেখছেন আর ভাবছেন। মাঝে মাঝে সিদ্ধান্ত নেবার সময় মাথাটা পেছনের দিকে হেলিয়ে দিচ্ছেন।

অনেকদিন ধরেই এই অনাথ আশ্রমটা গোপন এক সাইকোলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্টের অংশ। বিদেশি শক্তির সমর্থনে চলছে এই এক্সপেরিমেন্ট। শুধু এই আশ্রমটাই নয়, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন আরো অনেক অরফ্যানেজ বা অনাথ আশ্রম আছে, যেগুলোয় এই এক্সপেরিমেন্ট চালানো হচ্ছে। এক্সপেরিমেন্টটার উদ্দেশ্য এমন কিছু মানুষ গড়ে তোলা, যাদের মধ্যে আবেগ থাকবে না একটুও, ভয় পাবে না কোনোকিছুকেই আর হবে তুখোড় মস্তিষ্ক ও অসাধারণ কল্পনাশক্তির অধিকারী। এজন্য চাপ প্রয়োগ করে বাচ্চাগুলোকে মস্তিষ্ক খাটাতে বাধ্য করা হয়। ভয়ংকর সব পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়ে ভয় কমিয়ে আনা হচ্ছে ক্রমাগত। ড. নন্দী হিপনোটিক সাজেশনের মাধ্যমে বা বিভিন্ন ড্রাগ দিয়ে অনাথ আশ্রমের বাচ্চাগুলোকে অমন ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতার ভিজুয়াল, অডিটরি বা ট্যাকটাইল হ্যালুসিনেট করান, স্বপ্ন দেখান। হিপনোটিক সাজেশনের মাধ্যমে ওদের আবেগপ্রবণতাও কমিয়ে আনছেন আস্তে আস্তে।

এভাবে এর আগেও দুটো ব্যাচ পার করে দেওয়া হয়েছে। তাদের নিয়ে ফলাফল বেশ সন্তোষজনক। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে সফলতার সাথে কাজ করছে। রাষ্ট্রচালনা, প্রতিরক্ষা, গবেষণা বা ব্যবসা—যে ক্ষেত্রই হোক, তাদের জুড়ি মেলা ভার। আবেগপ্রবণতার বালাই ছাড়াই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও জোরালো দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে তারা। সবকিছু ঠিকঠাক চললে নিউ কলকাতা চাইল্ডহোমের মতো অনাথ আশ্রমগুলো থেকে এরকম আরো অনেক বাচ্চাই বেরিয়ে আসবে, যারা হবে পরবর্তী প্রজন্মের আলোকদ্রষ্টা; নেতৃত্ব দেবে আগামীর পৃথিবীকে।

ড. নন্দী হাতের ফাইলটা শেষ করে আরেকটা ফাইল তুলে নিলেন। এমন সময় তার পেছনে সামান্য আওয়াজ হলো, কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। ড. নন্দী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। দেখতে পেলেন তার পেছনে এক তিরিশ কিংবা বত্রিশ বয়সের যুবক দণ্ডায়মান। শ্যামলা বর্ণ, মাথার চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো, চোখদুটো মায়াবী; পুরুষ মানুষের এমন মায়াবী চোখ সাধারণত দেখা যায় না। আগন্তুকের পরনে কালো জিন্স, কালো জ্যাকেট আর কাঁধে একটা সস্তা গলফ ব্যাগ ঝোলানো।

নিখিল নন্দী আগন্তুককে চিনতে না পেরে প্রশ্ন করলেন, “কে? ভেতরে কী করে ঢুকলে?”

উত্তরে আগন্তুক মৃদু হাসলো। “রঞ্জন ব্যানার্জী।”

“ঠিক চিনলাম না।”

“চেনার কথাও না।” রঞ্জনের হাসিটা আরেকটু চওড়া হলো। “সেই কতদিন আগে আমার ফাইলও ওভাবে ঘেঁটেছেন আপনি, এখন মনে না থাকারই কথা।”

ড. নন্দী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। কিছু বললেন না।

“আমি আপনার এই এক্সপেরিমেন্টের প্রথম ব্যাচের এক সাবজেক্ট। এই চাইল্ডহোমেই বড় হয়েছি।”

নিখিল নন্দীর ভ্রু কুঞ্চিত হলো। “আমার কাছে কী প্রয়োজন হঠাৎ?”

রঞ্জন আরেকবার হাসলো। “না, প্রয়োজন আর নেই আপনার কাছে। আমি এসেছি আমার শৈশব আর কৈশোরটাকে, ইনফ্যাক্ট আমার গোটা জীবনটাকেই নরক বানানো রাক্ষসটাকে শাস্তি দিতে। অন্যভাবে বললে বদলা নিতে।”

ড. নন্দী অবাক হলো রঞ্জনের কথায়। “তুমি কীভাবে আমাকে রাক্ষস ভাবছো? আমি তোমার কত বড় উপকার করেছি, জানো? তোমাকে একধরণের অতিমানব বানিয়েছি। তোমার মতো মানুষেরা আগামীর পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেবে।”

ডক্টরের কথায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো রঞ্জন। “সত্যিই? আপনি তাই ভাবছেন?” উন্মাদগ্রস্থের মতো হাসতেই থাকলো। “আপনার ভাবনাটা হাস্যকর, ড. নন্দী। সত্যি বলতে আমার জীবনটাকে আপনি ছারখার করে দিয়েছেন। আমার আবেগ কেড়ে নিয়েছেন আপনি। একজন আবেগহীন মানুষ কী পরিমাণ হতাশাগ্রস্থ হতে পারে, ভাবতে পারেন? আমার ভয় কেড়ে নেবার উদ্দেশ্যে আমাকে বিভিন্ন আজেবাজে জিনিস হ্যালুসিনেট করাতেন, আপনি কি জানেন সেই হ্যালুসিনেশন আমার এখনও হয়? আমার চারপাশে সময়ে অসময়ে চলে আসে সেই আজেবাজে জিনিসগুলো? মাঝরাতে আমাকে হঠাৎ হঠাৎ ‍দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠতে হয়? আপনি কি জানেন আপনার এইসব ট্রিটমেন্টের জন্য আমার মস্তিষ্ক অন্যকারো সাথে বন্ধুত্ব করতে পারে না? নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে হয় আমাকে?” আগের মতোই হাসছে রঞ্জন, “আর দেখুন, আপনাকে এসব বলার মুহূর্তে আমার প্রচণ্ড দুঃখবোধ হওয়ার কথা, অথচ আমি কি নির্লিপ্তভাবে হাসছি।” হঠাৎ হাসি থামিয়ে একদম স্বাভাবিক গলায় বললো রঞ্জন, “আমার জীবনটাকে আপনি নষ্ট করে দিয়েছেন, ড. নন্দী। আপনাকে আমি আজ দেখাবো, ভয় কী।”

ড. নন্দী চিৎকার করে লোকজন ডাকার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার চিৎকারে কেউ সাড়া দিলো না। প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই শরীরটা নিয়ে তিনি পালাতে চেষ্টা করলেন, তখনই রঞ্জন তাকে ধরে ফেললো। মুখে ভারী ঘুসি বসিয়ে দিলো সাথে সাথে। ডক্টর ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেলেন।

রঞ্জন পকেট থেকে ইঞ্জেকশন আর লালচে তরলে ভর্তি ছোট একটা শিশি বের করে আনলো এরপর। শিশিটা থেকে তরলটুকু ইঞ্জেকশনে ভরে নিলো। মাত্রা ঠিক করার ঝামেলায় গেলো না আর। খালি শিশিটা আবার পকেটে চালান করে ধীরপায়ে ডক্টরের দিকে এগিয়ে গেলো।

ডক্টর হাত দিয়ে মুখ চেপে মেঝেতে পড়ে আছেন। চোখেমুখে আতঙ্ক। রঞ্জন কাছে গেলে ছটফট করে বাধা দেবার চেষ্টা করলো মানুষটা, কিন্তু লাভ হলো না। ইঞ্জেকশনটা তার হাতে পুশ করে দিলো রঞ্জন। অল্পক্ষণের মধ্যেই লোকটার শরীর নিস্তেজ হয়ে গেলো ইঞ্জেকশনের প্রভাবে। জ্ঞান থাকলেও শরীর অবশ হয়ে গেলো পুরোটাই। সামান্য আঙুল নাড়ানোর শক্তিও আর অবশিষ্ট রইলো না।

ডক্টরের নিস্তেজ দেহটাকে টানতে টানতে ঘরের একপাশে দেয়াল ঘেঁষে থাকা কাঠের আলমারিটার কাছে নিয়ে গেলো রঞ্জন। ডক্টরকে মেঝেতে ফেলে রেখে আলমারিটা খুলে একটা তাক ফাঁকা করলো আগে। এরপর লোকটার নিস্তেজ শরীর খালি তাকটায় চালান করে দিয়ে একটু আগে কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখা সস্তা গলফ ব্যাগটার দিকে এগিয়ে গেলো। সেটা বয়ে নিয়ে এসে চেইনটা একটানে খুলে ফেললো সে। ডক্টরের দিকে মুখটা খুলে ধরতেই ব্যাগটা থেকে হাজার হাজার মাকড়সা বেরিয়ে এলো। সবগুলো মাকড়সাকে ডক্টরের শরীরের ওপর ছেড়ে দিয়ে আলমারির দরজাটা বন্ধ করে দিলো রঞ্জন। এরপর ঢুলু ঢুলু পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

পেছনে আলমারির ভেতর বিস্ফারিত চোখে মাকড়সা সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে লাগলো ড. নন্দী। কিচ্ছু করার নেই মানুষটার। নিশ্চল শরীরে মাকড়সার ‍সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতেই একসময় হয়তো আতঙ্কের চোটে মারা যাবে সে, কিংবা ইঞ্জেকশনে থাকা স্লো পয়জনটাই হবে তার মৃত্যুর কারণ। আর তার লাশটা যখন উদ্ধার হবে, তখন মানুষ অবাক হয়ে দেখবে কী অপার্থিব এক আতঙ্ক তার চোখদুটোয়।