খাদ - ডরোথি কুইক

খাড়া পাহাড়টার একেবারে ধারে বসে ছিল মেয়েটা। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল নিচের দিকে, যেখানে এলোমেলো খাঁজকাটা পাথরগুলোর ওপর দিয়ে তীব্র গতিতে বয়ে চলেছিল জলের ধারা। সে দেখছিল, অস্তগামী সূর্যের আলো কেমন করে তার গোলাপী আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে সেই ঘুরে ঘুরে পাক খেয়ে ওঠা জলের ওপর। সব মিলিয়ে একটা অপার্থিব ভাললাগা, তবু সেদিকে তাকালেই মেয়েটা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছিল। কারণ তার চোখ কোন সৌন্দর্য দেখছিল না, সে শুধু দেখছিল অনেক নিচের সেই ভয়ংকর পাথর আর জলটুকু।

‘না, আমার সাহস নেই,’ বিড়বিড় করে মেয়েটা বলল, পরক্ষণেই তার কণ্ঠস্বর ডুবে গেল জলের আওয়াজে। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে আবার স্থির বসে রইল, দুচোখে ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে। আর ঠিক এই সময় দূর থেকে ভেসে এল সাইরেনের শব্দ।

পলকে মাথা তুলল মেয়েটা, চুপ করে শব্দটা শুনল, তারপর ধীরে ধীরে তার মুখে ফুটে উঠল একটা নিষ্প্রাণ হাসি। তার এতক্ষণের চিন্তাগুলো যেন এতক্ষণে ডানা মেলল।

‘কারখানার বাঁশি। তার মানে জিম এবার ফিরবে। আর ফিরে আমায় না দেখতে পেলে কী ক্ষেপেই না যাবে! এখন আমি যদি ফিরে যাই, পিটিয়ে মেরেই ফেলবে আমায়। কিন্তু না, আমি ফিরব না। কিছুতেই ফিরব না। হা ঈশ্বর! দয়া করো আমায়, সাহস দাও।’

বলতে বলতে হঠাৎ তার দুটো হাত দুহাতে শক্ত করে ধরে সামনে পেছনে দুলতে শুরু করল মেয়েটা। সে এমন আনচান করছিল যে আচমকা তার জুতোটা খুলে গিয়ে পড়ল নিচের সেই উন্মত্ত জলরাশির মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে সেটা দেখার জন্যে সে ঝুঁকে পড়ে চোখ মেলল, কিন্তু ততক্ষণে সূর্য পাহাড়ের আড়ালে ডুবে গেছে। অন্ধকারে কিছুই তার চোখে পড়ল না। সুতরাং শব্দটা অন্তত যাতে শুনতে পায়, তাই সে উৎকর্ণ হয়ে কান পাতল।

কিন্তু কোন নতুন শব্দও সে শুনতে পেল না, শুধু নিচের পাথরে সেই জল বয়ে যাওয়ার শোঁ শোঁ ক্রুদ্ধ আওয়াজ। তার জুতোটা গেছে, এবার তার পেছন পেছন সে-ও যাবে। সাংঘাতিক চোট লাগবে, অবচেতনেই সে ভাবছিল। আর তখনই হঠাৎ যেন নিজেকে সে দেখতে পেল, পাথরের ওপর পড়ে থাকা তার থ্যাঁৎলানো দেহটা, হয়তো মরেনি, কিন্তু মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে।

আচমকা একটা ভয়ে সে টলমল করে পাথরের ওপর উঠে দাঁড়াল। পালিয়ে যেতে চাইল এই খাদের ধার থেকে, আবার সেই জিমের কাছেই— যদিও সেটা তার পক্ষে মারাত্মক, কিন্তু এই ভয়ংকর মৃত্যুর থেকে তো ভাল!

‘না, আমি পারব না,’ বিড়বিড় করল মেয়েটা, ‘সেই সাহসটুকু থাকলে কিছুতেই আমি ফিরে যেতাম না, কিছুতেই না।’ সহসা দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেলল সে।

আর তখনই তার মনে হল, কে যেন তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, খুব কাছে। নিমেষে মুখ তুলে সে তাকাল। একটা অচেনা লোক দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে।

খুব নরম গলায় লোকটা জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’ লোকটার গলায় কী ছিল কে জানে, অন্ধকারে তার মুখও ভাল করে দেখা যাচ্ছে না, তবু তার গলা শুনে মেয়েটার সব ভয় কেটে গেল।

বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে মেয়েটা বলল, ‘আমি মরতে চাই।’ খাদের নিচে আঙুল দেখাল সে, ‘কিন্তু আমার ভয় করছে। আমার সাহস নেই।’

‘ও এই ব্যাপার?’ সামান্য হেসে লোকটা বলল, ‘তাহলে আমি তোমায় সাহায্য করতে পারি,’ লোকটার গলায় গাঢ় সহানুভূতির ছোঁয়া, ‘তবে তার আগে সবটা আমায় বলতে হবে।’

আশ্চর্য ব্যাপার, লোকটা তার কাজে বাধা দিচ্ছে না কিংবা তাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে না দেখেও মেয়েটা একটুও অবাক হল না, বরং তার দরদ মাখানো গলায় সে যেন এক অচেনা বন্ধুত্ব খুঁজে পেল, আর হড়বড় করে বলতে শুরু করল তার কথা।

‘আমি ববকে ভালবাসতাম— কিন্তু আমার বাড়ির লোকেরা আমার বিয়ে দিল জিমের সঙ্গে। জিমের প্রচুর টাকা ছিল— আর একটা বাড়ি। আমি ছিলাম সুন্দরী আর আকর্ষণীয়া, রান্না করতেও পারতাম। কিন্তু জিম আমায় ভালবাসত না, ব্যবহার করত— আমি— আমি— ঘৃণা করতাম ওকে।’ বলতে বলতে তার হাতগুলো পরস্পরকে আঁকড়ে ধরছিল, আঙুলগুলো চেপে বসছিল নরম মাংসের ভেতর, আর ধীরে ধীরে নখের আগায় জমা হচ্ছিল রক্তের ফোঁটা।

‘আচ্ছা?’ জিজ্ঞেস করল লোকটা। ‘তাই—’ বাকিটা অনুচ্চারিত রেখেই চুপ করে গেল সে।

মেয়েটা আবার বলতে শুরু করল, ‘আমি জিমকে ভালবাসার অনেক চেষ্টা করেছি— কিন্তু পারিনি। ও ছিল একটা মত্ত পশু। আর সেইসব দিনে বব ছিল আমার কাছে মুক্তির হাওয়া। জিম যখন বাড়ি থাকত না, সে তখন আমার কাছে আসত, আমার জন্য নিয়ে আসত ছোটখাটো উপহার। একদিন সে এসে দেখল আমি কাঁদছি, দেখল আমার হাতে আর পিঠে কালসিটের দাগ। তখন সে আমায় তার বলিষ্ঠ দুহাতে তুলে নিয়ে—’ বলতে বলতে আবেশে মেয়েটার দুচোখ বুজে আসে। সে যেন স্পষ্ট অনুভব করতে পারে সেই সোনালি মুহূর্তগুলো।

‘সেদিনই আমরা ঠিক করলাম, বব একটু ভালমতো টাকাকড়ি পেলেই দুজনে একসঙ্গে পালিয়ে যাব,’ মেয়েটা তার স্মৃতির পাতায় আবার ডুবে যাচ্ছিল, ‘আর সেদিনই জিম বেশ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরল। আমি চটপট লুকিয়ে ফেললাম ববকে, কিন্তু জিম বেশ ভালমতো পান করেই বাড়ি ঢুকেছিল। কিছু একটা সন্দেহ করে সে পেটাতে শুরু করল আমাকে। আমি প্রথমে তড়পানোর চেষ্টা করলাম, তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ঈশ্বর বোধহয় সেই রাত্রে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম, শুনে বব বেরিয়ে এল আমায় সাহায্য করতে— আর— আর সেই মুহূর্তেই জিম তাকে খুন করল!’

লোকটা চুপ।

মেয়েটা বলে যাচ্ছিল, ‘জিম ছাড়া পেয়ে গেল, কারণ সে নাকি প্রতারিত হয়েছে। জুরীরাও তার দিকেই ছিল। আর তারপর আমার আরও খারাপ দিন শুরু হল, যখন জিম আবার ফিরে এল। আমার কাছে সেই দিনগুলো ক্রমশ নরকের মতো হয়ে উঠল,আমি— আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না, আমি ববের কাছে, শুধুমাত্র ববের কাছে যেতে চাইছিলাম— কিন্তু আমার সে সাহস নেই।’

লোকটা মেয়েটির কাছ ঘেঁষে এল।

‘কোন চিন্তা নেই, মাত্র এক মিনিটের ব্যাপার,’ ফিসফিস করে লোকটা বলল, ‘এক সেকেন্ড, তারপরেই শেষ।’

রোগা চেহারাটা যেন সামান্য কেঁপে উঠল। অস্ফুটস্বরে মেয়েটা বলল, ‘আমি— আমি পারব না।’

লোকটা আর এক পা এগিয়ে এল।

আস্তে, খুব আস্তে সে উচ্চারণ করল, ‘ভয় কীসের? তুমি তো একা নও, আমিও তো যাব তোমার সঙ্গে।’

‘কিন্তু কেন?’ মেয়েটা অবাক হয়ে যাওয়া গলায় বলল বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে তার হাতটা যেন আপনা থেকেই এগিয়ে গেল লোকটার আঙুলগুলো ধরার জন্যে।

লোকটা সেটা আমল না দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল, ঠিক পাথরের প্রান্তে, খাদের ধারটায়। তারপর হাত বাড়িয়ে ডাকল, ‘কই এসো!’

মেয়েটা এবার মন্ত্রমুগ্ধের মতো সামনে পা বাড়াল। আর সেই মুহূর্তে চকিতে নিচের সেই ক্ষুরধার পাথরগুলোর ওপর জল আছড়ে পড়ার ভয়ংকর শব্দটা কানে আসতেই শিউরে উঠে পিছিয়ে গেল সে, ‘না, আমার ভয় করছে।’

‘তাহলে জিমের কাছেই ফিরে যাও আবার!’ তীব্র বিদ্রূপের স্বরে বলল লোকটা।

‘না, না।’ চিৎকার করে ওঠে মেয়েটা।

এবার লোকটা খানিকটা কড়া গলায় বলে উঠল, ‘তাহলে তোমাকে এই মুহূর্তে জিম আর ববের মধ্যে যে কোন একজনকে বেছে নিতে হবে।’ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বাকিটা যোগ করল সে, ‘তোমার সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আর বেশি সময় নেই।’

‘কিন্তু— কিন্তু বব যদি আমায় খুঁজে না পায়?’ ফুঁপিয়ে উঠল মেয়েটা।

লোকটার গলায় কোন উত্তাপ নেই, ‘মাত্র এক সেকেন্ড। আর তারপরেই— অনন্ত মুক্তি।’

আবার শিউরে ওঠে মেয়েটা, ‘ওখানে কী গভীর অন্ধকার!’

‘নিচে পৌঁছলেই দেখবে সেখানে আলোর বন্যা।’

‘কিন্তু— ভীষণ ঠান্ডা হবে জায়গাটা!’

লোকটা হাসল, ‘এসো, আমার হাতটা ধরো। একদম ঠান্ডা লাগবে না।’ মৃদু আর শান্ত গলায় কথাটা বলল সে, আর এতক্ষণে হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটার দিকে।

মেয়েটা আকুল হয়ে হাতটা জড়িয়ে ধরতে এগিয়ে গেল, কিন্তু পারল না। ততক্ষণে লোকটা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে নিচে, অনেক নিচে— অন্ধকারের মধ্যে। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার! লোকটার চারপাশ ঘিরে ও কীসের আলো! একটা আশ্চর্য উজ্জ্বল আলো যেন ঘিরে রেখেছে তাকে! অন্ধকার যেন কেটে গেছে সেই আলোর মায়ায়। এক নিমেষে মেয়েটার সমস্ত ভয় যেন কেটে গেল।

সে চিৎকার করে বলল, ‘দাঁড়াও। আমি আসছি।’

সেই মুহূর্তে অবাক হয়ে মেয়েটা লক্ষ্য করল, নিচে থেকে সেই লোকটা হাসছে, একদম ববের মতোই তার হাসিটা, আর তার দুটি বাহু দুদিকে প্রসারিত, যেন কাউকে আঁকড়ে ধরার প্রত্যাশায়। সে আর এখন অচেনা কেউ নয়, সে আসলে— সে আসলে— বব নিজেই! এক মুহূর্তও দ্বিধা না করে মেয়েটা নিচের দিকে ঝাঁপ দিল ববের দুই প্রসারিত বাহু লক্ষ্য করে।

ওরা দুজন একসঙ্গে চলে যাচ্ছিল নিচে, আরও নিচে, খাদের একেবারে শেষপ্রান্তে। ববের উষ্ণ ঠোঁটদুটি দৃঢ়বদ্ধ হয়ে বসে ছিল মেয়েটির ঠোঁটে, গরম করে দিচ্ছিল তাকে। এমনকি মেয়েটা জানতেও পারল না কোন মুহূর্তে সেই জলের স্রোত তাকে বরণ করে নিল চিরকালের মতো।