অদম্য - সহস্রাংশু গুহ

গল্প

‘ভয়’, ছোট্ট নিগূঢ় এই শব্দটি কত গভীরভাবে জড়িয়ে যায় একেক সময় মানুষের জীবনে। তাপমান যন্ত্রের পারদ যখন শূন্যের নীচে গিয়ে স্থবির হয়ে যায়, হিমেল শীতল বাতাস যখন হু হু শব্দ করে বৃদ্ধ মানুষটির অনাবৃত মুখের ফ্যাকাসে কুঞ্চিত চামড়ায় শলাকার মতো বিঁধতে থাকে, শরীরের শেষ উষ্ণতাটুকুও যখন আড়াল খুঁজতে উদ্যত হয় সেই সময়ও ভয়ের অনুভূতি বেরিয়ে আসে কানের পাশ দিয়ে গরম লবণাক্ত জলের রূপ ধরে। এ জীবনে অনেক দেখা চোখ দুটি যখন ধূসর আকাশের ওই দিগন্তের ওপারে হারিয়ে যায় তখনও অবচেতন মনে একই দৃশ্য পট ফিরে ফিরে আসে বার বার। ছোট্ট মেয়েটার বুক ফাটা কান্না হাহাকার জাগিয়ে তোলে বৃদ্ধের অন্তরাত্মায়। ফায়ারিং স্কোয়াডের সেই অমোঘ নির্দেশ ‘ফায়ার’ যেন ধ্বনিত হয়ে ফেরে দিগন্তের ওপার থেকে। চোখের সামনে মেয়েটির মৃত্যু ভয় এবার যেন ঝাঁপিয়ে পরে কন্যা-হারা পিতার বুকে। কর্ণপটহ বিদীর্ণ করে শেষ চিৎকারটা ভেসে আসে দিকচক্রবালের ওপর থেকে, ‘বাবা, আমাকে বাঁচতে দাও, মেরো না, বাবাআআ’।

‘প্রফেসর?’ তরুণী মনোবিদের ডাকে দুঃস্বপ্নের জাল উধাও হয় প্রফেসর গুহর মস্তিষ্ক থেকে। সদ্য ছিন্ন জাল ছাপ রেখে যায় প্রফেসরের বিহ্বল দৃষ্টিতে।

‘প্রফেসর, আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন?’ নাওমি এসে প্রফেসরের কপালে হাত রাখেন। বৃদ্ধ এই প্রফেসরকে পিতৃসম স্নেহ করেন ডক্টর নাওমি। শেষ প্রায় পাঁচ বছর ধরে এই জ্ঞান তপস্বীর পাদস্পর্শে রয়েছেন তিনি। প্রথম প্রথম সম্পর্কটা রোগী ডাক্তারের মতো থাকলেও কর্তব্যে অবিচল, নিষ্ঠাবান, জ্ঞান বৃদ্ধ এই বিজ্ঞান তপস্বীর মধ্যে নিজের ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া বাবাকে খুঁজে নিতে পেরেছিলেন ডক্টর। তাঁর কাজ যদিও প্রফেসরকে মানসিক ভাবে সুস্থ রাখা তবে নাওমি ঠিক বুঝেছিলেন যে প্রফেসরকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে হলে তাঁর হারিয়ে যাওয়া কন্যা সন্তান ঝিলমিলের জায়গা কিছুটা হলেও পূর্ণ করার চেষ্টা তাঁকেই করতে হবে। সে কাজে কতদূর সার্থক হয়েছেন তিনি তা তাঁর নিজের কাছেই প্রশ্ন চিহ্ন বহন করে। কারণ, এই মুহূর্তে প্রফেসরকে দেখেই তিনি বুঝতে পারছেন যে সেই দুঃস্বপ্ন আবার দেখছিলেন প্রফেসর।

‘আবার সেই স্বপ্ন দেখছিলে বুঝি?’ রেলিং ধরে দাঁড়ানো বৃদ্ধের বুকে আদুরে কন্যার মতো নিজেকে সঁপে দেন নাওমি। তাঁর শরীরের স্পর্শেই বোধহয় দ্রুত বাস্তবে ফিরে আসেন প্রফেসর। হাত তুলে কন্যা-সম নাওমির মাথায় রাখেন। মুখের মৃদু হাসি বলে দেয় বিগত অনেকগুলি বছর যে দুঃস্বপ্ন তাঁকে নিয়ত তাড়া করে ফিরছে অন্তত কিছু মুহূর্তের জন্য তার থেকে মুক্তি পেয়েছেন তিনি।

‘কতবার বলেছি, এই ভোরবেলা একা একা বেরিও না, বেরিও না, একটা যদি কথা শোনো তুমি?’

‘ব্রাহ্ম মুহূর্তে এই সূর্যোদয় দেখাটা যে আমার অনেক দিনের অভ্যাসরে মা।’ সত্যি উত্তর পূর্ব ভারতের হিমালয়ের কোলে এই স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা বোধহয় কাব্যের দ্বারাও অসম্ভব। বিশেষণের লম্বা তালিকা নিঃসন্দেহে শুরু করা চলে ‘স্বর্গোদ্যান’ দিয়ে। প্রফেসরের বাহুমূল থেকে সন্তর্পণে নিজেকে ছাড়িয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ান এবার ডক্টর নাওমি। সামনের উপত্যকায় তখন ভোরের সূর্যের প্রথম আলো মৃদু পরশ বুলিয়ে চলেছে। উপত্যকার শেষ প্রান্তের থেকেও সুদূরে বরফ ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় সোনালী আভা। কিছুক্ষণ আগেও বাতাসে যে তীক্ষ্ণ ঠাণ্ডার কামড় ছিল তা ধীরে ধীরে সহনীয় হয়ে আসছে উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। কী ভালোই না হতো যদি নৈসর্গিক এই দৃশ্যের সাথে মিশে থাকতো কিছু পাহাড়ি পাখির মিষ্টি কলতান, রিসার্চ ফেসিলিটির সামনের মাঠটায় নতুন দিনের প্রারম্ভে এক ঝাঁক প্রজাপতির মতো খেলা করে করে বেড়াত কিছু ছোট্ট বালক বালিকা। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ডক্টরের বুক থেকে। শুধু এই ফেসিলিটি নয়, একে কেন্দ্র করে যদি আজ কয়েক শত মাইল জায়গাও খুঁজে দেখা যায় তবু দেখা মিলবে না আটজনের বেশি একটিও মনুষ্য সন্তানের। এই শতাব্দীর প্রথম লগ্নেই অভিশাপের মতো যে মহামারী নেমে এসেছিল এশিয়ার এই অংশে তা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে একদা জনবিস্ফোরণে কাবু এই ভূখণ্ডকে।

 

‘সাবজেক্ট কোথায়?’ প্রফেসরের গলায় চিন্তাভগ্ন হয় নাওমির। অপার্থিব এই সূর্যোদয়ের সামনে অতি বেরসিকও যে স্বপ্নালু হতে বাধ্য।

‘নিজের সন্তানের মতো যাকে তৈরী করলে তাকে এখনো মানুষ বলে ভাবতে পার না, না তুমি?’ মুখে হাসি এনে পাল্টা প্রশ্ন করেন।

‘আঃ হ্যাঁ, দুঃখিত। আসলে সবকিছুই যেন কীরকম কর্মফল হিসেবে মনে হয় আজকাল, কাজ করতে করতে সাধারণ ব্যাপারও মাথায় থাকে না। তা কোথায় তোমার অদম্য? যা দুষ্টু হয়েছে ছেলেটা।’

‘নিচে, বাগানে খেলা করছে বোধহয়, তোমারই সৃষ্টি বলে কথা, ব্রাহ্ম মুহূর্তে সে কি আর বিছানায় শুয়ে থাকতে চায়?’

মুখে হাসি এনে ব্যালকনির দরজা ঠেলে এগিয়ে যান প্রফেসর। রুটিন মাফিক সব কিছু চেক করে নিতে হবে। এই দিনটার স্বপ্ন দেখছেন তিনি বিগত কয়েক দশক ধরে কিছুতেই একে ব্যর্থ পর্যবেশিত হতে দেবেন না, এই এখন তাঁর একমাত্র পণ।

‘তুমি আসবে না নাওমি?’ দরজা আধখোলা করে পিছন ফিরে তাকান একবার প্রফেসর।

‘আপনি এগোন, আমি যাচ্ছি, আরেকটু দেখে নেই ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘা।’ প্রফেসরের মধ্যে কর্মতৎপরতার আভাস দেখেই নাওমির মধ্যেও পেশাদারি ভাবটা ফুটে বেরোয়। পিতা কন্যার সম্পর্কটা পেশাদারিত্ব দখল করে নেবার সাথে সাথেই ‘তুমি’র স্থানাভীষিক্ত হয় ‘আপনি’। স্প্রিং দেওয়া কাচের দরজা বন্ধ হবার পরও করিডোরের দিক থেকে চোখ সরে না ডক্টরের। এই যে মানুষটি এখন দৃপ্ত ভঙ্গিতে লম্বা করিডোরের প্রান্তবর্তি দরজার দিকে দ্রুত পদক্ষেপে হেঁটে চলেছেন তাঁর জীবনে যে কী দুর্বিষহ যাতনা নেমে এসেছিল আজ থেকে কয়েক দশক পূর্বে তা ভাবলে শিহরিত হতে হয়। কতটা অদম্য ইচ্ছে শক্তি থাকলে মানুষ এত বড় একটা শোক পেয়েও নিজের কর্তব্যে অটুট থেকে পৃথিবীকে নতুন আশার স্ফুলিঙ্গ দেখাতে সক্ষম হয় তা সত্যি সাধারণ মানুষের সমস্ত ধ্যান ধারণার বাইরে।

সন ২০৩০। নাওমির জন্ম হয়নি তখনও। ভারতবর্ষের মুম্বাই শহরের জেনেটিক রিসার্চল্যাব তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জিন কারিগরদের একোমদ্বিতীয়ম ঠিকানা। সবার লক্ষ্যে কেবল একটি মাত্র দিন তখন। জুলাই ২৫। গোটা বিশ্ব জুড়ে সব ধরণের গণ মাধ্যমে জ্বলন্ত একই বিষয়ে হেডিং। ক্যানসার প্রতিরোধে জীবনপণ করে থাকা সহস্রাধিক বিজ্ঞানীর প্রায় দুই দশক ব্যাপী গবেষণার ফসল তখন একটি ক্ষুদ্র অ্যামপুলের মধ্যে রাখা সোনালী কয়েকবিন্দু তরল। ২৫ জুলাই প্রথম সেই তরল প্রয়োগ করা হবে ক্যানসার আক্রান্ত একটি ছোট্ট শিশুর শরীরে। পশু শরীরে গবেষণালব্ধ ফল থেকে অনুমেয় যে মনুষ্য দেহে প্রয়োগের পর অপেক্ষা মাত্র একপক্ষ কালের, তার মধ্যেই শরীরের সব ক্যানসার আক্রান্ত কোষের মৃত্যু তো ঘটবেই তার সাথে সেই শরীরেই তৈরি হবে ক্যানসার প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি। শুধু তাই নয়, শিশুর জিনেও ঘটবে সূক্ষ্ণ পরিবর্তন যা শিশুটির পরবর্তী প্রজন্মেও প্রতিরোধ করে যাবে ক্যানসারের জীবাণুর অনুপ্রবেশকে। ক্যানসারমুক্ত ধরিত্রীর স্বপ্ন বুকে বেঁধে তখন জেনেটিক রিসার্চের বিজ্ঞানীরা প্রহর গুনছেন ২৫ শে জুলাইয়ের। সকল প্রস্তুতি পর্ব শেষ হয়েছে ঠিক দুই দিন আগেই। এই দুই দিন হাতে রাখা হয়েছিল অতিরিক্ত সময় হিসেবে। সকল বড়ো গবেষণারই শেষ লগ্নে একটু আবেগের উপস্থাপনা হতে বাধ্য তাই দুদিন অতিরিক্ত সময় হাতে রেখে শিশুটির এক বছর জন্মদিনের দিনই ঠিক করা হয়েছিল ঐতিহাসিক এই প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হবে। হায়রে, প্রকৃতি বোধহয় তির্যক্ দৃষ্টি হেনেছিলেন মনুষ্য সন্তানের উপর। নাহলে হিতসাধনই যে গবেষণার একমাত্র উদ্দেশ্য তা কখনো এরকম...।

ভাবতে ভাবতে ব্যালকনিতে থাকা চেয়ারে গা এলিয়ে দেন ডক্টর নাওমি। উদীয়মান সূর্যের নরম রোদ গায়ে মেখে স্মৃতিচারণে ডুবে জান। নাহ, প্রয়োগের কুফল সেদিন কিছু বোঝা যায়নি। প্রতিষেধক প্রয়োগের প্রায় মাস ভর শিশুটিকে রাখা হয়েছিল সব রকম পর্যবেক্ষণের মধ্যে। শরীরে বাসা বাঁধা ক্যান্সার কোষ বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার পর শিশুটির স্বাস্থ্য যখন দিনে দিনে প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠছে তখন সম্মিলিত সিদ্ধান্তে শিশুটিকে পৌঁছে দেওয়া হয় তার মায়ের কোলে। দুনিয়া জুড়ে গণমাধ্যমে ততদিনে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে এক বছরের সেই ছোট্ট শিশুকন্যা। হবে নাই বা কেন, মা বাবার আদরের ধন একরত্তি ওই মেয়েই যে তখন মূর্তিমান যম ক্যান্সারের মতো অভিশাপের। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পরেও শান্তি ছিলো না মেয়ের, দিনের পর দিন দেশি বিদেশী সাংবাদিক, বাবা মায়ের সাক্ষাৎকার প্রয়াসী মানুষের ভিড় লেগেই থাকতো নিত্য। জন্ম রুগ্ন মেয়ের প্রাণোচ্ছল হাসি খেলা আর বাড়ন্ত স্বাস্থ্য দেখে খুশির অন্ত ছিলো না বাবা মায়ের। বাড়ি ফেরার পর সপ্তাহ তিনেক কেটে গেলেও যখন উদ্বেগজনক কোনও কিছুই ঘটল না তখন অবধারিত ভাবেই ঢিলে দেওয়া হল পর্যবেক্ষণের। সমস্যা বাঁধল অচিরেই। মেয়ের খাবার চাহিদা যে সমবয়সী শিশুর থেকে দিনকে দিন লক্ষণীয়ভাবে বেশি হয়ে যাচ্ছে তা বাবা মায়ের নজর এড়িয়ে গেল। মাস ঘুরতে না ঘুরতে একদিন এলো বিপর্যয়। রাতের বেলা মা যখন আদুরে মেয়েকে স্নেহালিঙ্গন করে স্তন্যপান করাচ্ছেন সেই সময় ছোট কষের দাঁতে মেয়ে বসিয়ে দিল প্রচণ্ড এক কামড়। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলেও মা কিন্তু মেয়েকে আলিঙ্গন চ্যুত করেননি তখনো যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে আরও কিছু কামড় বসলো মায়ের শরীরে। অচিরেই রক্তাত্ব বুকে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে মা ভর্তি হলেন হাসপাতালে। মেয়ে থাকলো বাড়িতে আয়ার জিম্মায়। পরেরদিন সবরকম পরীক্ষার যখন ফলাফল সামনে এলো তখন মুম্বাই শহরের ডাক্তারগণ অপারগ হলেন রোগের গোত্র নির্ধারণে। ওদিকে মহিলার শারীরিক অবস্থার অবনতি ততক্ষণে দ্রুত হয়েছে। প্রচণ্ড কাশির দমক আর ভলকে ভলকে রক্তবমি করা মহিলাকে ততক্ষণে নিয়ে যাওয়া হয়েছে স্পেশাল কেয়ার ইউনিটে। দিন শেষ হবার আগেই মহিলা ঢলে পড়েছিলেন মৃত্যুর কোলে, পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত দান, মুখোশ পরিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ, কিছুই কাজ দেয়নি কারণ তৎকালীন চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাধ্যে কুলায়নি ক্ষণে ক্ষণের তফাতে হয়েই চলা ওই রক্তবমি বন্ধ করা। সৎকারের জন্য মহিলার দেহ যখন হাসপাতালের বাইরে আনা হল তখন তাঁকে মনুষ্য মরদেহ বলে সনাক্ত করতে বাঁধে। হাড়ের উপর ফ্যাকাসে রক্তহীন চামড়া নিয়ে সে যেন কোনও প্রেতলোকের প্রাণী। একবারের জন্য ও তখন কারোর মনে হলনা যে বাকরুদ্ধ হওয়ার আগে মহিলার একমাত্র কাকুতি ছিল খাবার চেয়ে। জান্তব ক্ষুধাই যে এই রোগের প্রথম উপসর্গ তা তখনো অলক্ষিত সবার কাছে। মহিলার দেহ যখন নিষ্ক্রমণের পথে তখনই প্রচণ্ড কাশি নিয়ে হাসপাতালে এলো সেই মা হারা শিশুর আয়া এবং পরিবারের আরেক সদস্য। সূর্য প্রদক্ষিণ সমাপন করবার আগেই একই উপসর্গ দেখা দিল স্পেশাল কেয়ার ইউনিটের দুই ডাক্তার আর এক নার্সের মধ্যে।

বাকি গল্প? সে গল্প এক সময় অন্তর্জালের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দুনিয়ায়। কিন্তু এই পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে ধীরে ধীরে তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে সকল গণমাধ্যম থেকে। কারণ অবশ্যই বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক বন্ধ করা। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যসংস্থার এক বিশেষ টিম যাচাই করেছে উপলব্ধ সব চলচ্চিত্র, যদি তার থেকে বেরয় কোনও সমাধান সূত্র। নাওমির এই সব কিছু জানা হয়েছে প্রফেসর গুহর মনোবিদ হবার সূত্রে। যে রোগ মুম্বাই শহরের এক নামী দামী বেসরকারি নার্সিংহোমে প্রথম নথিভুক্ত করা হয়েছিল সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতে তা মহামারীর আকার নেয়। মুম্বাই শহরের ছোট বড় সবকটি হাসপাতালে জনবিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। রোগীর সংস্পর্শে থেকে দ্রুত গতিতে রোগ ছড়াতে থাকে ডাক্তার ও নার্সদের মধ্যে। বিপদ বুঝে শহরে মেডিক্যাল টিম পাঠাতেও অস্বস্তিতে পরে তৎকালীন দেশীয় সরকার। মাস ঘুরতে না ঘুরতে এক বছরের সেই ফুলের কুঁড়ি সম মেয়েটার দাঁত থেকে যা রোগ ছড়াতে আরম্ভ করেছিল তাতে আক্রান্তের সংখ্যা সহস্রাধিক হয়। ততদিনে অন্তত এটুকু বোঝা গেছে যে এই রোগের প্রথম উপসর্গ হল অত্যন্ত খিদে অনুভব করা, এর পরেই আসে মারণ কাশি ও রক্তবমি। প্রথম ঘণ্টা খানেক আক্রান্তের খিদে ভাব ও কাশিতে চোখে পড়ার মতো কোনও অস্বভাবাকিতা দেখা যায় না ফলস্বরূপ আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেও বোঝে না কী ভীষণ বিভীষিকা বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। ওই সময়েই তার যেটুকু কাশি হয় বা যেটুকু সে থুতু ফেলে তার মধ্যে দিয়েই রোগের বীজ ছড়িয়ে পড়ে এবং বাতাস বাহিত হয়ে আক্রমণ করে পরবর্তী শিকারকে। আরও কিছুদিন যেতে উঠে আসে আরেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রথম যে ঘণ্টাখানেক আক্রান্ত ব্যক্তি অন্তত চলৎশক্তি যুক্ত থাকে তার মধ্যে কোনও জনসমাগম জায়গায় সে এসে পড়লে অনেক মানুষের উপস্থিতিতে হয়তো মানুষের শরীরের গন্ধেই তার মধ্যে এক হিংস্রতা প্রকট হয়ে ওঠে। বিচার বুদ্ধি শূন্য হয়ে সে উদ্যত হয় নিকটবর্তী নারী পুরুষ নির্বিশেষে আক্রমণ করতে। ক্যান্সারের ওই কালান্তক প্রতিষেধক তৈরিই হয়েছিল জেনেটিক মডিফিকেশন করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ক্যান্সার মুক্ত করার জন্য। শিশুর শরীরে তা মিশে মাত্র দুই মাসের মধ্যে এমন প্রাণঘাতী ভাইরাসে রূপান্তরিত হয় যা মুহূর্তের মধ্যে জিনের স্পাইরাল সোপানেও ভাঙ্গা গড়ার মারণ খেলা শুরু করে দেয়। অতএব আক্রান্ত ব্যক্তির দেহ-নিঃসৃত যেকোনো রকম তরল, গ্যাস তো বটেই তাদের আঁচড়, কামড়ের মধ্যে দিয়েও ছড়াতে থাকে রক্তবমির মরণ রোগ। মাত্র ২০ ন্যানোমিটার ব্যাস সম্বিলিত হওয়াতে বাতাসবাহিত এই ভাইরাস মুখোশ পরে দমন করা দুঃসাধ্য পর্যবেশিত হয়। পাবলিক প্লেস, বিশেষ করে জনবহুল যানবাহন, রেলস্টেশন, জনবহুল রাস্তাঘাট বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে দেখতে দেখতে। এটুকু মাত্র দয়া মহাকাল দেখিয়েছিলেন এই যে মানুষ ব্যতীত অন্য কোনও প্রাণীর দেহে এই রোগের কোনোরকম প্রকোপ দেখা যায়নি। বছর পাঁচেক ঘুরতে না ঘুরতে দক্ষিণ ভারতের সমস্ত বড় শহরের আকাশ বিষাক্ত রক্তের গন্ধে পুতিগন্ধময় হয়ে ওঠে। উত্তর এবং পূর্ব ভারতবর্ষের অধিকাংশ বড় শহরে তখন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চলছে সুস্থ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ। স্থানে স্থানে উঁচু দেওয়াল তুলে বায়ুনিরোধক ক্যাম্পের প্রচেষ্টাও ততদিনে ব্যর্থ পর্যবেশিত হয়েছে। এর আগেই অবশ্য সকল মানবাধিকার কমিশনের আদর্শ শত হস্ত দূরে সরিয়ে মুম্বাইতে আক্রান্ত অধ্যুষিত স্থানে সংক্রমণ রুখতে আদিম পন্থার ব্যবহার হয়ে গেছে। দাবানল যদি দমনে অক্ষম হও তবে পার্শস্থ সমস্ত বনাঞ্চল ধ্বংস করে দাও। দগ্ধ হওয়ার কিছু না থাকলে আগুন নিভতে বাধ্য। অতএব ওঠাও বন্দুক, চালাও অগ্নিবর্ষণ আক্রান্ত অধ্যুষিত স্থানে জনসমাগম দেখলেই। স্বয়ং বিধাতাও বোধহয় এমন দাবী করতে পারেন না যে অনলবর্ষী বন্দুকের সামনে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ শরীরগুলোর সবাই পূর্বে থেকেই রোগাক্রান্ত ছিল। কিন্তু প্রবল গুলিবর্ষণকে উপেক্ষা করে দিনকে দিন বাতাসবাহিত বীজাণু ছড়িয়ে পড়তে থাকে উল্কার বেগে। সুজলাং সুফলাং ভারত ভূমি ভরে ওঠে রক্তশূন্য মানুষের বেওয়ারিশ লাশে, বিষাক্ত রক্ত কালো করে তোলে শ্যামল ভূমি। প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ কীর্তি তাসের ঘরের মতোই ভেঙ্গে পড়ে মহাকালের কড়াল অঙ্গুলি হেলনে। মাংসাশী মেঠোইঁদুর, শিয়াল, কুকুর, শকুন বংশ বৃদ্ধি করে জাঁকিয়ে রাজত্ব শুরু করে দেয়। মাত্র সাত বছরের মধ্যে ভারতবর্ষ একরকম জনশূন্য হয়ে পড়ে।। অধিকাংশই মৃত। বিত্তবান এবং ভাগ্যবান কিছু মানুষ বিদেশে পলায়ন করে বংশ রক্ষা করেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অবশ্য সারা পৃথিবীর তাবড় তাবড় শক্তিধরদের নিয়ে ততদিনে চালকবিহীন ব্যোমযানে করে বাতাস পরিশোধনের কাজে লেগে পড়েছে। ভারতবর্ষের পার্শ্ববর্তী দেশগুলি তথা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা মায়ানমার প্রভৃতি সকল দেশকে একরকম জনশূন্য করে অবশেষে ২০৪৫সনের দিকে মহাকাল শান্ত হয়। এককালে যে দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে বসবাস করতো পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ, কালের বক্রদৃষ্টিতে মাত্র পনের বছরে তা জনমানবশূন্য, দূষিত, বসবাসঅযোগ্য, শ্মশানে পরিণত হয়। হে মহাকাল কী নিষ্ঠুর তোমার পরিহাস। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নত করতেই নাওমির মানস পটে ভেসে ওঠে দুঃস্বপ্নের মতো আরেকটি ভয়ঙ্কর ছবি।

 

চালকবিহীন বিমান দিয়ে প্রায় মাটির একদম কাছ থেকে চলচ্চিত্রটি গ্রহণ করা হয়েছিল ২০৪০ সনের এক শীতের সকালে। নাওমি তা দেখেছেন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যসংস্থার আর্কাইভ থেকে। স্থান একদা ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লী। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য্যের অন্যতম শ্বেতশুভ্র তাজমহলের উপর লুটিয়ে পড়েছে শীতের সকালের রোদের পরশ। একদা স্রোতস্বীনি যমুনার দুই পাশে বিরাজ করছে শ্মশানসম নীরবতা। জনশুন্য রাজধানীর সমস্ত দুঃখের নীরব সাক্ষি হয়ে নিঃশব্দে ধীর লয়ে বয়ে চলেছে ক্ষীণ জলের ধারা। মর্মর সৌধ ঘিরে থাকা মনোহারি ফুলের বাগান ততদিনে ঢেকে গিয়েছে বন্য গুল্ম লতায়। সর্বগ্রাসী আগুনের লেলীহান শিখার মতো কিছু ঘন সবুজ বন্য গুল্ম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে শ্বেত শুভ্র তাজমহলের চারিপাশ। সন্নিকটস্থ সুবিশাল শ্বেত পাথরের বেদির এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে পরে রয়েছে রুগ্ন, রক্তশুন্য, কোটরাগত চোখ নিয়ে অর্ধভুক্ত বেশকিছু নরপিশাচের নিশ্চল দেহ। আর তাদের ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে ততোধিক বিশাল চেহারার শকুন। একদা বিলুপ্ত প্রায় এই প্রাণীদের তখন আর কোনও অস্তিত্ব সংকট নেই। তাজমহলের শীর্ষে বসে এক বিশাল শকুন তার সুবিশাল পক্ষদ্বয় দুপাশে বিস্তার করে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছিল নিচে হয়ে চলা মহাভোজের এই দৃশ্য। চালকবিহীন বিমানের চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে নজরদারির মধ্যেও সে ছিল স্থির অবিচল। সহসা শকুনটি লম্বা গ্রীবা নিচু করে ডানা মেলে নেমে এল প্রায় আশি মিটার নিচে শ্বেত পাথরের বেদির উপর একটি অলক্ষিত মৃতদেহ লক্ষ করে। নিখুঁত নিশানায় মর দেহটির বুকের উপর বসে পড়ল সেটি। দেহটি ছিল অল্প বয়েসী কোনো যুবকের। মৃত্যু আসন্ন বুঝে কেন যে এই অমর প্রেমের সৌধের সামনে এসেছিল কে জানে। কিছুক্ষণ লম্বা গ্রীবা বাড়িয়ে চতুর্দিক পর্যবেক্ষণ করে সেই শকুন তীক্ষ্ণ নখরে আঁকড়ে ধরল দেহটি। তারপর বিশাল ডানা ঝাপটে আকাশে উঠল। গন্ত্যব অবশ্যম্ভাবী ভাবে তার বাসা, যেখানে হয়ত সদ্যজাত শিশু শকুনের দল চিল-চিৎকার জুড়েছে খাবার তাড়নায়। অদ্ভুত ভাবে অরক্ষিত মরদেহটির ভাগ নিয়ে লড়াই করতে এলনা কোনও দ্বিতীয় ভাগিদার। খাবার এখন সহজলভ্য তাই বিবাদ নিষ্প্রয়োজন। যুবক জীবদ্দশায় নিশ্চই স্বাস্থ্যবান ছিল, শকুন বেশ কষ্টে ডানা ঝাঁপটিয়ে যখন তাজমহলের সুবিশাল গম্বুজ অতিক্রম করছে ঠিক সেই সময় নখর থেকে ছিঁড়ে পড়ল সেই মরদেহ। সবেগে আঁছড়ে পড়ল গোম্বুজের চূড়ায়। বিষাক্ত কালো রক্তে তাজমহলের শ্বেত গম্বুজে কালিমা লেপে নিচের এক ঝাঁক ভোজন মত্ত শকুনের মাঝে গিয়ে পড়ল লাশটা। মুহূর্তের জন্য সচকিত হয়ে সরে গেল শকুনের দল, তার পরেই আবার ফিরে এল দ্বিগুন উৎসাহে। রক্তাক্ত কালো ঠোঁট দিয়ে সোৎসাহে ঠোকরাতে লাগল নতুন লাশটিকে।

 

‘আপনার প্রাতরাশ ডক্টর’। ইভার স্বরে দৃষ্টি ফেরান ডক্টর নাওমি। দুঃস্বপ্নের মতো বিভীষিকাময় সেই দৃশ্য মনে করে উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ততক্ষণে। মহাকালের পরিহাস ভাবতে ভাবতে কখন যে আধঘন্টাটাক পার হয়ে গেছে নিজেও বোঝেননি। সামনের উপত্যকায় তখন সোনালী রোদ্দুর ঝলমল করছে। নীল আকাশের পটভূমিতে ঝকঝক করছে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া। ‘প্রেফসর গুহ কিন্তু এখুনি আপনার তলব করবেন। খাবারটা এখানেই রাখি?’

মুখে হাসি এনে ব্যালকনির টেবিলটা পরিষ্কার করতে উদ্যত হন ডক্টর।

‘দেখেছ ইভা, এরকম সোনালী রোদ্দুর মাখা দৃশ্য দেখলে কি করে সময়-জ্ঞান থাকবে বলো?’ হাসি মুখে একমুহূর্ত পূর্বের মানসিক উদ্বেগ দূরে সরিয়ে দেওয়া বুঝি মনস্তত্ত্বিকের পক্ষেই সম্ভব কেবল।

ডক্টরের কথার জবাবে শুধু যান্ত্রিক হাতের থেকে খাবার সাজানো প্লেটটা নেমে আসে টেবিলের উপর। ‘আমি যে কাব্যরসে বঞ্চিত ডক্টর’। দপদপ করে ওঠে ইভার চোখের কোটরাগত লেড লাইট।

‘প্রফেসরকে বলো আমি প্রাতরাশ শেষ করেই ওনার সাথে ল্যাবে দেখা করবো’

ঘাড় ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে যান্ত্রিক পদক্ষেপে ইভা প্রস্থান করে।

ইভা মানুষ নয়। যে মহাযজ্ঞ করতে তাদের এখানে আগমন, পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে মাত্র আটজন মানুষকে এখানে আসার যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়েছে। ওদের সাথে আছে যন্ত্র মানবী ইভা এবং অতিমানব অদম্য। নাওমির এখানে আর কোনও মহিলা বন্ধু নেই, এক এই যন্ত্রমানবী ইভা ছাড়া। অবশ্য এতে কোনও সমস্যা হয় না নাওমির। তাঁর জন্ম ২০৫০ এ, জন্মের পরেই তাঁর ধাত্রী মা হিসেবে পেয়েছিলেন এক অ্যান্ড্রহিউমোনয়েড রোবটকে। শিক্ষা- দীক্ষা, খেলা-ধুলা, দৈনন্দিন জীবনে প্রতি পদক্ষেপে তিনি রোবটের সখ্য লাভ করেছেন। কুড়ির দশকের মহামারীর প্রকোপে এশিয়ার জনসংখ্যার যে বিপুল হ্রাস ঘটেছিল তার পূরণেই হু হু করে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে রোবটের। আর এই বিগত প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর ধরে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলিতে যে পরিবেশ পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে তা তো যন্ত্র মানব ব্যতিরেকে সম্ভবই নয়। তিল তিল করে প্রত্যেক শত বর্গমিটার জমি ধরে আকাশ-ভূতল শোধনের কাজ চালিয়ে অধুনা ধারণা করা হচ্ছে যে অন্তত ভারতভূমি আজ প্রাণঘাতী বীজাণুমুক্ত। প্রথম দফার কাজ শেষ হতেই শুরু হয় আরেক মহাযজ্ঞ। পৃথিবীর অবশিষ্ট মহাদেশগুলি থেকে তাবড় তাবড় জেনেটিক ইঞ্জিয়ার নিয়ে তৈরি হয় পাঁচ সদস্যের এক বিশেষ দল। নেতৃত্ব দিতে আহ্বান জানানো হয় বর্ষীয়ান প্রফেসর গুহকে। টিমের সবাই বিশেষ করে ডাক্তার গুহ যেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কাজের সমস্ত রকম মানসিক ধকল বহন করতে পারেন সেই জন্য দলে অন্তর্ভুক্তি ঘটে খ্যাতিমান তরুণী মনোবিদ নাওমির। একজন মাত্র সহকারী সহযোগে আট জনের এই টিম ও ইভাকে নিয়ে আসা হয় উত্তর পূর্ব ভারতের হিমালয়ের কোলে শ্যামল রঙ্গিন মংপো উপত্যকায়। এই অঞ্চলে ততদিনে যন্ত্র মানব সহযোগে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল এক ফেসিলিটি। জায়গা হিসেবে এই স্থানের মাহাত্ম এই যে অভিশপ্ত ওই পনের বছরে এই স্থানের শুধু নয় আসে পাশের কুড়ি কিলোমিটার এলাকাতেও কোনও আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়নি। তার একটি হেতু এই যে উপত্যকা হলেও এই স্থানের গমনপথ অত্যন্ত দুর্গম। আকাশপথে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা ব্যতিত অন্যভাবে এই স্থানে গমন নিতান্তই সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত। সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় ১২ হাজার ফিট উচ্চতায় এই স্থান তাই চিরকাল মানুষের স্থায়ী আবাস হিসেবে অযোগ্য বিবেচিত হয়ে এসেছে। তবু ফেসিলিটি তৈরির আগে এখানের বাতাস শুদ্ধিকরণ করা হয় প্রায় বছর কাল যাবত। যন্ত্র মানবদল সে কাজ সুসম্পন্ন করার পরেই সবরকম ভাবে নিশ্চিন্ত হয়ে ফেসিলিটি তৈরিতে হাত দেওয়া হয়। এখানে এখন রয়েছে সম্পূর্ণ স্ব-নিয়ন্ত্রিত ১২০টি ইনকিউবেটর। বিশেষ টিমের নবম সদস্য অদম্য মানুষ হলেও তার জন্ম আসলে কৃত্রিমভাবে। প্রফেসর গুহর তত্ত্বাবধানে তাঁরই শরীর থেকে সংগৃহীত জীন এবং কোষের সমন্বয়ে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ইঞ্জিনিয়ারের বিশেষ গোষ্ঠী তৈরি করে এক সুপার জিন। যার প্রথম ফলশ্রুতি একটি কোঁকড়া চুলের মিষ্টি বালক, ওই অদম্য। নামটি অবশ্য প্রফেসরেরই দেওয়া। প্রফেসরের মাতৃ ভাষায় ওই নামের মানে ‘ইনভিন্সিবল’ জাতীয় কিছু বলে শুনেছিলেন নাওমি। অদম্যর শরীর একটি সুস্থ সবল পাঁচ বছরের বালকের মতো,বুদ্ধিমত্তাও অনুরূপ। তার শরীরের কেবল একটি অংশই তাকে অতিমানবের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অদম্যর জেনেটিকাল অর্গান বিশেষ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দরুন বিশেষ রকম ক্ষমতা সম্পন্ন। এই বয়সেও পরিমিত সময়ের ব্যবধানে ওর শরীর উৎকৃষ্ট মানের শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু যা নিষিক্ত অবস্থায় কৃত্রিম মাতৃজঠরে দ্রুত বিকাশের জন্য উপযুক্ত, তা উৎপন্ন করতে সক্ষম। মস্তিষ্কের বিকাশ নিয়ন্ত্রিত থাকায় তার মধ্যে এই অতিশক্তি বর্তমান থাকলেও তা তার মানসিক কোনও উদ্বেগের কারণ ঘটায় না। শুধু নিয়ম মাফিক তার থেকে সংগ্রহ করা হয় উন্নত মানের শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু। প্রথমে যদিও একটি পুরুষ এবং একটি নারী শরীর ক্লোন করার পরিকল্পনা হয়েছিল কারণ সাধারণ পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীর থেকে যে শুক্রাণু বা ডিম্বাণু পাওয়া যায় তা ইনকিউবেটারের কৃত্রিম জঠরে পরিণত হওয়ার যোগ্য নয়। কিন্তু এই দুটি মানব দেহ ক্লোনের ব্যাপারে বাঁধ সেধেছিলেন স্বয়ং প্রফেসর। উদ্বেগের কারণ ছিল এই যে এই ২০৭৫ সনে এসেও মানুষ ক্লোনিংয়ের ক্ষত্রে ক্লোন্ড সাবজেক্টের সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপনের উদাহরণ বিরল। তাই দুজন বালক বালিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলার থেকে মন্দের ভালো একজনের মধ্যেই শুক্রাশয় এবং জরায়ু প্রতিস্থাপন। পরিণত বয়েস হওয়ার পর যখন এই কর্মযজ্ঞ জন্মানো নারী শিশুরা ডিম্বাণু উৎপাদনে সক্ষম হবে তখন অদম্যর শরীর থেকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জরায়ু অপসারণ করে তাকে স্বাভাবিক পুরুষালি জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া যাবে। সব কিছু অনুকূল থাকলে অপেক্ষা তো করতে হবে এক দশকের মতো সময়। প্রতি সপ্তাহে অদম্যর শরীর থেকে সংগ্রহ করা হয় প্রমাণ অনুপাতে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু, সকল রকম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তার মধ্যে থেকে একটি করে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয় ইনকিউবেটরে। যেখানে কৃত্রিম মাতৃ জঠরে মাত্র তিন মাসেই এক পূর্ণাঙ্গ সুস্থ সবল শিশুর জন্ম হয়। ভারতভূমিতে মনুষ্য সংখ্যা বাড়াতে এই কৃত্রিম প্রজনন কর্মযজ্ঞের দিকেই তাকিয়ে গোটা বিশ্ব। প্রথম দফার ১২০ সন্তানের জন্ম হলে অবশ্য প্রথম কয়েক মাস তারা থাকবে এই ফেসিলিটির মধ্যেই ততদিনে তাদের জন্য আবাস্থল বানিয়ে নেওয়া হবে বড়ো শহরের কোনও একটিতে। অন্যান্য দেশ থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষরা এসে ধীরে ধীরে বসতি গড়বেন ভারতভূমিতে। দেশের ভবিষ্যৎ এই কৃত্রিম উপায়ে জন্মানো শিশুদের মানুষ করার দায়িত্ব নিয়ে ধীরে ধীরে অনেক মনুষ্য সমাগম ঘটবে এই দেশে, আবার প্রাণের সাড়ায় জগৎ মাঝে অন্যতম হয়ে উঠবে ভারতভূমি সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এই সবকটি দেশ। মোটামুটি এক লক্ষ শিশুর কৃত্রিম প্রজনন ঘটানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। অবশ্যই তা এই একটি মাত্র ফেসিলিটিতে হবে না। তবে এখানকার সাফল্যের উপরেই নির্ভর করছে এই কর্মযজ্ঞের ভবিষ্যৎ। সুদূর পরিকল্পিত প্রায় অর্ধ-শতাব্দীর এই কর্মযজ্ঞের সফলতার সবটুকু নির্ভর করছে আজ ২৫শে জুলাই ২০৭৫ সনে অদম্যর বীজ দিয়ে কৃত্রিমভাবে প্রথম শিশুটির ভূমিষ্ঠ লাভ সুষ্ঠভাবে হওয়া নিয়ে।

‘ডক্টর! আসুন এবার, সময় যে হয়ে এলো’ ব্যালকনির দরজা ঠেলে ইভার পুনরাগমন হয়। ক্ষিপ্র হস্তে একবার কবজি উল্টে ঘড়ি দেখে নেন নাওমি। সকাল সাতটা বেজে পনের। ঠিক ৮৯ দিন আগের এক বসন্তের সকালে পর্যবেক্ষণ ল্যাবের অন্তঃস্থিত ইনকিউবেটরে প্রবেশ করান হয়েছিল অদম্যর শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত ডিম্বাণু। এতদিন ধরে প্রতি মুহূর্তে তার উপর নজরদারি চালিয়ে গেছে স্বয়ংচালিত হাজারো যন্ত্রপাতি এবং অবশ্যই ইভা সমেত টিমের আটজন সদস্য। সপ্তাহ না পেরোতেই ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ সম্ভব হয়েছিল। প্রফেসর উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন এই জানতে পেরে যে ইতিহাসের পাতায় নাম উঠতে চলা শিশুটি এক কন্যা সন্তান। অদম্যকে অবশ্য শুধুই জানান হয়েছে তার জন্য একটি ছোট্ট বোন তৈরি হচ্ছে ল্যাবেরটরিতে। উৎসুকভাবে কয়েকবার সে দেখেও গেছে। ইনকিউবেটরের ভিতরে রক্তাভ অর্ধ-তরল পদার্থে ভাসমান ওই সিন্থেটিক মাতৃ-জঠরে কীভাবে তার বোন বেড়ে উঠছে তা অবশ্য তার বোধগম্য হয়নি। তবে ইভার থেকে প্রাথমিক শিক্ষা পেয়ে এটুকু এখন সে জানে যে এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ঘটছে যার ফল হিসেবে আজ হয়ত সে পাবে খেলার সাথী ছোট্ট একটি ফুটফুটে বোন।

দ্রুত ছন্দে ব্যালকনির দরজা পেরোতে গিয়ে পদস্খলন ঘটে একবার নাওমির। পিছন ফিরতেই চোখ আটকে যায় ব্যালকনিতে বসে থাকা রক্তাভ চোখের দাঁড় কাকটির দিকে। প্রত্যরাশের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণেই বোধহয় এসে জুটেছে। মনের মধ্যেটা কেমন জানি করে ওঠে নাওমির। ৩০র দশকে মুম্বাইয়ের রাস্তার চলচ্চিত্রতে নরমাংস ঠুকরে খাওয়া দৃশ্য দেখে এই প্রাণীটির উপর কেমন ভয় মিশ্রিত ঘেন্না জন্মে গেছে ওঁর মধ্যে। ততক্ষণে অবশ্য ইভার যান্ত্রিক হাতের আস্ফালনে ‘কা কা’ করতে করতে প্রস্থান ঘটেছে আপদের। মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে ল্যাবের দিকে পা বাড়ান ডক্টর।

ইতিমধ্যেই ল্যাবেরটরির মধ্যখানে ইনকিউবেটর ঘিরে জড়ো হয়েছেন অদম্য বাদে দলের সবাই। নিঃশব্দে দরজা ঠেলে নাওমি ও ইভা প্রবেশ করেন ঘরে।

‘নাওমি এবং ইভা ব্যতীত বাকিরা সবাই এবার পর্যবেক্ষণ কক্ষের ভিতরে চলে যাও। এই ল্যাবের দরজা সিল করে দাও বাইরে থেকে’ এই পঁচাত্তরে এসেও প্রফেসরের উদ্যত আদেশ সবার উপরে কর্তৃত্ব করতে সক্ষম। একটু অনিচ্ছুক মুখ করে বাকিরা বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয় তখনই। প্রটোকল সবার জানা। শিশুর ভূমিষ্ঠ মুহূর্ত থেকে ঘণ্টা দুই অবধি প্রফেসর নাওমি এবং ইভা ওই শিশুকে পর্যবেক্ষণ করবে এই বদ্ধ ঘরের মধ্যেই। কিছুমাত্র অপ্রীতিকর ঘটলে প্রফেসর এবং নাওমির প্রথম কাজ হবে যত শীঘ্র সম্ভব ওই শিশুর শরীর নষ্ট করে ফেলা। পরিস্থিতি যদি মানুষের আওতার বাইরে চলে যায় তখন ইভা দায়িত্ব নেবে এই ঘরকে সম্পূর্ণভাবে বাইরের প্রকৃতির থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার। ভবিষ্যতের পথ দর্শক এই ল্যাবেরোটোরি তখন পরিণত হবে প্রফেসর, নাওমি এবং ঐ শিশুর সমাধিস্থানে।

বাকিরা বেরিয়ে যেতেই ক্ষিপ্রহস্তে এপ্রন আর গ্লাভস পরে নিলেন নাওমি। মুখে মাস্ক লাগিয়ে নিলেন। প্রফেসর আগেই রেডি হয়ে গিয়েছিলেন। এবার শুরু করলেন শেষ মুহূর্তের কাজ।

প্রথমেই ইনকিউবেটরের রক্তাভ অর্ধ-তরল নিষ্কাশনের পক্রিয়া চালু হল। ভাসমান সিন্থেটিক মাতৃ জঠরের মধ্যে তখন প্রাণের উপস্থিতি লক্ষণীয়। ভূমিষ্ঠ মাত্র এই শিশুকে কিন্তু সদ্যজাত বললে ভুল বলা হবে, ইনকিউবেটরের কৃত্রিম পরিবেশ মাত্র তিন মাসেই শিশুকে এক-বৎসরের ন্যায় পরিণত করতে সক্ষম। সময় বড়ো মূল্যবান এই কর্মযজ্ঞে। যার জন্য শুক্রাণু তৈরিতে বিশেষভাবে জন্মদান করা অতিমানবের ব্যবহার হলেও, মাতৃ জঠরের জন্য কৃত্রিম যন্ত্রের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। নাহলে এতো সংখ্যক মহিলা নিয়োগ করা সাধ্যে কুলালেও প্রফেসরের তীব্র যুক্তির জন্য এতো মেয়ের জীবন নিয়ে খেলার সম্মতি দেওয়ার সাহস দেখায়নি বিশ্বের তাবড় মাথারাও।

ইনকিউবেটরের অর্ধ-তরল নিষ্ক্রান্ত হতে সময় লাগলো প্রায় মিনিট পনের। কাচের বড়ো ডিম্বাকৃতি ইনকিউবেটরে রাবারের গল্ফস লাগান গর্তে হাত ঢুকিয়ে প্রফেসর হাল্কা করে ফাটিয়ে দিলেন সিনথেটিক জঠরের পর্দা। বাকিটা ঘটবে ঠিক যেভাবে ডিমের খোলস ফাটিয়ে সরীসৃপ বেরিয়ে আসে সেইভাবে। ইতস্তত হাত পা ছোড়ার মধ্যে দিয়ে, জঠরের পর্দা ছিঁড়ে যতই শিশুকন্যার দেহটি পরিষ্কার হতে লাগলো প্রফেসরের চোখমুখ ভোরে উঠলো অনাবিল আনন্দে। হাত পা ছোড়ার ভঙ্গিমা আর মুখের ভাব বলে দিচ্ছে হলেই বা এক বছরের পরিণত, সদ্যোজাতের তখন কান্নার সময়। নাওমি চালু করে দিলেন পরিশ্রুতকের পাম্পটা। কন্যার শরীরে লেগে থাকা ক্লেদাক্ত রক্ত ধুয়ে বেরিয়ে যেতেই লিভার টেনে ইনকিউবেটরের একদিক খুলে দিলেন নাওমি। বিজয়িনীর এক মুখ হাসি নিয়ে ডক্টর দুহাতে উঁচু করে ধরলেন নতুন ভারতভূমির প্রথম কন্যা সন্তানকে। হাততালিতে মুখর হয়ে উঠল পর্যবেক্ষণ কক্ষে থেকে যারা এতক্ষণ নিঃস্পলকে তাকিয়ে ছিল মনিটরের দিকে।

কিন্তু একী, এই তো মুহূর্ত আগেও কাচের মধ্যে হাত পা ছুড়ে কাঁদছিল শিশুটা তবে এখন কেন একদম স্থির। তবে কি, তবে কি...। নাওমির উদ্বেগ দেখে এগিয়ে এলেন প্রফেসর। নাহ, কোনোরকম নড়াচড়া করছে না ছোট্ট ফুট দেড়েকের শরীরটা। প্রফেসরের চোখে জল বাঁধ ভাঙবে এখুনি যেন। শরীর কম্পমান। শিশুটির বুক নিজের কানে প্রাণপণে চেপে ধরে স্পন্দন খুঁজছেন এবার নাওমি।

 

‘প্রফেসর?’ নাওমির গলার স্বরে কান্নার আভাস। ঘরের মধ্যে একমাত্র স্থির শান্ত অবিচলিত ইভা, একবারের জন্যেও তার দৃষ্টি সরেনি শিশুটির দিক থেকে।

 

কী হবে ভাবতে ভাবতেই নাওমির হাতের একটি আঙ্গুল চলে গেছিল শিশু কন্যার মুখে। ছোট্ট দাঁতের কামড় পড়তেই ভীষণ চমকে উঠলেন নাওমি। ঠিক এই ভাবেই, এই ভাবেই সেই কুড়ি সালের কালো দিনটিতে একটি শিশুকন্যা কামড়ে ধরেছিল এক মাতৃস্তন। শিশুটির চোখ খোলে এবার, রক্তাভ চোখ। এতো লাল হয় সদ্যোজাতের চোখ? প্রচণ্ড ভয়ে চিৎকার করে ওঠেন নাওমি। অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় তাকে তৎক্ষণাৎ জড়িয়ে ধরে ইভা। মুহূর্তে নাওমির কোল থেকে তুলে নিয়ে নিজের বাহুমূলে সবলে আঁকড়ে ধরে শিশুটিকে।

 

‘ও অঁ অঁ অঁ আ আ আ’

না, আশঙ্কা অমূলক। স্নিগ্ধতার পরশ মাখা কোল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান্ত্রিক হাতের স্পর্শ পেয়েই গলা থেকে কান্না ঠেলে বেরোল শিশুর। জন্ম যতই কৃত্রিম জঠর থেকে হোক, ভূমিষ্ঠ হবার পর নারীর স্পর্শ না পেলে কি শিশুর মন টেকে। এ সদ্যোজাতের যদিও দাঁত গজিয়ে গেছে সিনথেটিক জঠরের কল্যাণে তবু গ্লাভস পরা নাওমির আঙ্গুলকে যে সে মাতৃস্তনবৃন্ত ভেবে ভুল করবে তাতে আর আশ্চর্য কী।

ঘণ্টা দুই পর বিজয়গর্বে নাওমি আর ইভাকে নিয়ে ল্যাবেরোটোরির বাইরে বেরিয়ে এলেন প্রফেসর। নিজের হাতে এই কর্মযজ্ঞ সামলে অবশেষে তিনি ফিরে পেয়েছেন ৩০র দশকে হারিয়ে যাওয়া তাঁর সেই এক বছরের ছোট্ট মেয়েকে। মুম্বাইতে যখন প্রতিষেধক প্রয়োগ সম্পূর্ণ তখনই নিজের আত্মীয় পরিজন ও ক্যানসার জয়ী ছোট্ট সন্তানকে ফেলে প্রফেসর গুহকে বিদেশ পারি দিতে হয় জেনেটিক ওষুধের মহিমা বিস্তার ও আরো উন্নতি সাধনের কাজে। ব্যস, তারপর আর দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি তাঁকে। শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জিননকারিগর হওয়ার অভিশাপে নিজের পরিবারের শেষ সময়েও পাশে থাকতে পারেননি। শিউরে উঠেছিলেন মুম্বাইতে মাস কিলিংয়ের খবর শুনে। সেই থেকে এতগুলো বছর তাঁকে তারা করে বেরিয়েছে এক দুঃস্বপ্ন। রক্তশূন্য একদল নরপিশাচের হুঙ্কারের মাঝে ছোট্ট এক অসহায়ার আকুতি--- কিন্তু নাহ, আজ সব দুঃস্বপ্নের থেকে মুক্তি। আহা আজ যদি ওর মা বেঁচে থাকতেন।

উৎসুক বাকি সদস্যদের ঠেলে সরিয়ে হঠাৎ ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে এলো অদম্য। পলকে এক বার চর্কি পাক ঘুরে নেচে উঠলো। খুব পছন্দ হয়েছে তার নতুন খেলার সাথীকে। ‘কী নাম গো আমার বোনের?’

‘ঝিলমিল।’ হাঁটু মুড়ে বসে অদম্যর একমাথা কোঁকড়া চুল হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিলেন প্রফেসর।

 

সহস্রাধিক বছর বিজ্ঞান সাধনা করেও প্রকৃতির কাছে মানুষ কতো তুচ্ছ এখনো যে সামান্য অণুবীক্ষণিক জীবাণুর কাছেও তাকে হার মেনে যেতে হয়েছিল আজ থেকে মাত্র কয়েক দশক আগেই। তবে প্রফেসর জানেন আজকের মতো মানুষ আবার জিতবে, ঘন কালো তমিস্রার বুক চিরে মানব জাতি আবার তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করবে, কারণ সে অদম্য, মহাকালের কড়াল ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আজকের মতো বার বার সে হেরে গেলেও উঠে দাঁড়াবে সব প্রতিকূলতাকে দূরে ঠেলে। প্রফেসরের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল আনন্দের অশ্রু। ওদিকে সন্তান স্নেহে ঝিলমিলকে আঁকড়ে নাওমি তখন শিশুর মতোই উৎফুল্ল হয়ে উঠেছেন।