শ্রোডিঙ্গারের ঐশ্বরিক বিড়াল - মোহাম্মদ সাইফূল ইসলাম

উপন্যাস
অধ্যায় এক
২০৮১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টিচার্স কোয়াটার

“আরে ভাই কেন শুধু শুধু বিরক্ত করছেন? আর কতবার বলবো আমার কাছে সেই রিসার্চের আর কোনও ভার্সন নেই। যে কপিটি ইউনিভার্সিটির তদন্ত কমিটিকে দেওয়া হয়েছিলো সেটিই ফাইনাল ভার্সন। কয়েকদিন পরপর ফোন দিয়ে সেই একই ঘ্যানঘ্যান করেন! বিরক্তিকর!”

ফোনের অপর পাশ থেকে অচেনা কণ্ঠটি বলে, “আমরা নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে খবর পেয়েছি আপনার কাছে আরেকটি ভার্সন আছে। দেখুন, আপনি যতো টাকা চান আমরা দিতে প্রস্তুত। আমাদের স্যার টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করেন না। আপনি…”

কণ্ঠটিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে প্রফেসর তানভির হাসান বলেন, “আর বলতে হবে না। কে আপনার স্যার তা আমার জানার কোনও দরকার নেই। এরপর আপনি কী বলবেন তাও আমি জানি। আপনি বলবেন, দরকার হলে এই রিসার্চের প্যাটেন্টে আমার নাম থাকবে। এই সংক্রান্ত যত আন্তর্জাতিক পুরস্কার সবকিছুতে আমার ভাগ থাকবে। কিন্তু ভাই, আপনাকে কী করে বোঝাই! যে জিনিস আমার কাছে নেই, সে জিনিস কীভাবে আপনার স্যারের হাত তুলে দিই?”

অপর পাশ থেকে তেলতেলে কণ্ঠটি হে হে করে হেসে উঠে। “স্যার, একটি বার বোঝার চেষ্টা করুন। নিজের জন্যে না হলেও বিজ্ঞানের কল্যাণের কথাও ভাবুন একবার।”

“আপনি আমাকে আর ফোন দিবেন না।” বলেই লাইনটা কেটে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান, নামকরা প্রফেসর— তানভির হাসান। ছুটে আসা অদৃশ্য তেলের ছিটেগুলো পাঞ্জাবি হতে মুছতে থাকেন দুহাত দিয়ে। যদিও জানেন আবার কয়েক মাস পর এই লোক ফোন করে একই অনুরোধ করবে। গত পাঁচটি বছর ধরে জীবন অতিষ্ঠ করে দিয়েছে। একটাই প্রশ্ন তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, কে ঐ লোককে প্রফেসর মোবাশ্বেরের থিওরির দ্বিতীয় ভার্সনের তথ্যটা দিলো?

নাহ, আর দেরি করা ঠিক হবে না। আজই মাইশার হাতে সব ডকুমেন্ট তুলে দিতে হবে। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যাংকে পৌঁছান। ভল্টের ভেতর থেকে বের করে আনেন পলিথিনে মোড়ানো একটি লাল রঙের প্যাকেট।

***

মুখোমুখি বসে আছেন প্রফেসর তানভির হাসান ও মাইশা। “তোমার বাবা ল্যাব অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাননি; বরং নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন।” তানভির হাসানের মুখে কথাটি শুনে ভীষণ চমকে উঠে মাইশা। তাহলে কি এতোদিন যা শুনে এসেছে সব মিথ্যে? হঠাৎ করে একরাশ অভিমান এসে ভর করে তার মনে।

“টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে তোমার বাবা প্রফেসর মোবাশ্বের চৌধুরী ছিলেন আমার পিএইচডির সুপারভাইজার; সেটা তো তুমি জানোই। আমি সদ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর উচ্চতর গবেষণার জন্যে আমেরিকায় যাই।” এপর্যন্ত বলে মাইশার মুখের দিকে তাকিয়ে তার অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করলেন প্রফেসর তানভির হাসান।

বসার ঘরে দুটো মুখোমুখি সোফায় বসে আছে দুজন। ছোট ছিমছাম একটি ঘর। মাইশার মুখে কোনও কথা নেই। তার মনে কেবল খেলা করছে, বাবা কী করে তাকে একা ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারলেন! বুক ফেটে কান্না আসছে তার, অনেক কষ্টে আটকে রেখেছে। কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বলে, “আজ এতদিন পর হঠাৎ একথা কেন বলছেন, চাচা?”

মাইশার চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন তানভির হাসান। মেয়েটা দেখতে একদম তার মায়ের মতো হয়েছে। বড়বড় চোখ, প্রশস্ত কপাল, নাকটা একটু চাপা; ধবধবে গায়ের রঙ, ডান গালের নিচে একটি ছোট্ট তিল সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকাংশে। মায়ের রূপ আর বাবার মেধা পেয়েছে সে।

মুখে কোনও কথা না বলে ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়ান তানভির হাসান। হেঁটে ঘরের এককোণে রাখার একটি লকার খুলে প্লাস্টিকে মোড়া বড়সড় প্যাকেট বের করে আনেন। পুনরায় সোফায় বসতে বসতে বলেন, “তোমার বাবা সময় ভ্রমণের বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে বাতিকগ্রস্থ ছিলেন। বিশেষ করে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সুপার-স্ট্রিং থিওরির জগতে তিনি ছিলেন বিশ্বের প্রথমসারির বিজ্ঞানীদের একজন। এই থিওরির এম. সি. ডাইমেনশন তাঁর নামে মানে মোবাশ্বের চৌধুরী ডাইমেনশন হিসাবে নামকরণ করা হয়। একেবারে মৌলিক পর্যায়ের কাজ।”

তানভির হাসানের কোনও কথাই যেন মাইশার কানে ঢুকছে না। তার কিশোরী মনে কেবল ঘুরে ফিরে আসছে “বাবা আমাকে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন? কী করে পারলেন?” কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে আচমকা সে বলে, “এতোদিন পরে হঠাৎ একথা তুলছেন কেন, চাচা? আজকেই কেন?”

কথার মাঝে হঠাৎ বাধা পেয়ে তানভির হাসানের উপলব্ধি হয় মাইশার মনের ভেতর অন্যকিছু ঘুরছে। নিজ আসন ছেড়ে উঠে তার পাশে এসে বসেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “মা’রে, তুমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছ। পদার্থবিজ্ঞানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বকনিষ্ঠ হিসাবে শেষ পরীক্ষা দিয়ে রেকর্ড করেছ। আজ তুমি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে উপস্থিত। তাই এই দিনটিকে তোমার জীবনের চরম সত্যটি জানানোর জন্যে বেছে নিয়েছি। এই তথ্য আজ তোমাকে নতুন পথ বেছে নিতে সাহায্য করবে। আরেকটা কারণ আছে, একটু পরে বলছি। মনোযোগ দিয়ে শোনো—”

শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মাইশা। বিড়বিড় করে বলে, “বাবা কোথায় নিরুদ্দেশ হয়েছেন?”

“তোমার বাবা এই মুহূর্তে ঠিক কোথায় আমি জানি না।” একহাতে এখনও প্লাস্টিকের প্যাকেটটি ধরে রেখেছেন তানভির হাসান। সেটির সিল খুলতে খুলতে বলেন, “সময় নিয়ে গবেষণা করতে করতে একসময় প্রচণ্ড অস্থির হয়ে উঠেন তিনি। এই দেখ, এখানে সব কিছু আছে।” প্যাকেটটি খুলে একটি ক্রিস্টাল ডিস্ক মাইশার দিকে বাড়িয়ে ধরেন তিনি।

মনের ভেতর তোলপাড় চলছে মাইশার। সারাজীবন জেনে এসেছে তার বাবা ল্যাব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন; আর এখন শুনছে তিনি তাকে রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। মাইশার এখন যে বয়স, যুক্তির চেয়ে আবেগ দ্বারা বেশি পরিচালিত হওয়াটাই যৌক্তিক। ঠিক তাই ঘটছে তার মনের ভেতর। আর্দ্র কন্ঠে বলে, “তাহলে আমাকে এখন কী করতে বলেন?”

“তুমি যথেষ্ট পরিণত, কী করবে সেটি তোমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি কেবল উপদেশ দিতে পারি। এই ডিস্কে তোমার বাবার সব রিসার্চ, যন্ত্রের ডিজাইন বিস্তারিত আছে। টেক্সাস ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান আমার অনেকদিনে পরিচিত। তিনিও তোমার বাবার মতো কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও সময় নিয়ে গবেষণা করছেন। আমি তাঁর কাছে তোমার সিভি পাঠিয়েছিলাম। তিনি তোমাকে তাঁর প্রজেক্টের রিসার্চ দলে নিতে রাজি হয়েছেন। আজই সেই অফার লেটার হাতে পেয়েছি; এই কারণেই আজ তোমাকে সবকিছু খুলে বলা। এখন তুমিই ভেবে দেখ কী করবে।”

চুপচাপ কিছু একটা ভাবছে মাইশা। নীরবতা ভেঙ্গে কিছুক্ষণ পর বলে, “কীসের যন্ত্র?”

“তোমার বাবা একটি টাইম মেশিন বানিয়েছিলেন।” ধীরে ধীরে স্পষ্ট স্বরে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করেন তানভির হাসান। “তিনি তাতে চড়ে সময়ের কোনও এক স্তরে চলে গেছেন। কিন্তু তার এই ভ্রমণ সফল হয়েছে কি না সেই ব্যাপারে আমাদের কিছু জানা নেই।”

ভীষণ চমকে উঠে মাইশা। “টাইম মেশিন!” অস্ফূট আওয়াজ বের হয়ে আসে তার মুখ থেকে। এ যে অবিশ্বাস্য ব্যাপার! “কিন্তু টাইম মেশিন তো সিউডো সায়েন্স মানে অপবিজ্ঞানের আওতায় পড়ে। বাস্তবে তো এমন কিছু বানানো সম্ভব নয়!” প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে সে।

“আমারও একই ধারণা ছিলো, কিন্তু মোবাশ্বের স্যারের রিসার্চ দেখার পর দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে বাধ্য হয়েছি।” হঠাৎ মাইশার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায় তানভির হাসান। কথার প্রসঙ্গ বদলিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি মনে হচ্ছে কিছু একটা বলতে চাচ্ছ?”

“নাহ, তেমন কিছু না। তবে পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন রহস্যময় মনে হচ্ছে। প্রথমত আমাকে বাবার এই রিসার্চে কেন জড়ানো হচ্ছে? আর আবার সেই আপাত ব্যর্থ এক্সপেরিমেন্ট বা টাইম মেশিন নিয়ে এতদিনেও নতুন কোনও গবেষণা কেন হয়নি? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে বাবা মারা গেছেন এমনটি টেক্সাস ইউনিভার্সিটিই বা কেন মেনে নিল বা এমন মিথ্যা প্রচার করলো? তাদের কি উচিত ছিলো না ভালোমত তদন্ত করা ও গবেষণা যেখানে শেষ হয়েছিলো সেখান থেকে পুনরায় শুরু করা?” একদমে অনেকগুলো প্রশ্ন করে বসে মাইশা।

বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে তানভির হাসান মুচকি হাসেন; যেন মাইশার কাছ থেকে ঠিকঠিক এমন প্রশ্ন আসবে বলে ধরে নিয়েছিলেন; আর সব প্রশ্নের উত্তরও তার জানা আছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “এই ডিস্কে তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর আছে।”

অধ্যায় দুই
২০৬১, টেক্সাস ইউনিভার্সিটি, হকিং ল্যাব

“তানভির?”

“জ্বি স্যার?”

“সময় সম্বন্ধে তোমার ধারণা কী?”

প্রফেসরের মুখে আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে যায় তানভির। উত্তর দেওয়ার আগে মাথার ভেতর বিদ্যুৎ বেগে চিন্তা চলতে থাকে, “আমার রিসার্চে কি সময় নিয়ে কোনও কারবার আছে? স্যার কোন দৃষ্টিকোণ থেকে সময়ের ব্যাপারে জানতে চাচ্ছেন? আসলেই তো! সময় কী? এর কতটুকু আমরা জানি?” মৃদু কেশে গলা পরিষ্কার করে আমতা আমতা স্বরে বলে, “স্যার, মনে হয় সময় একটি মাত্রা।”

ধমকে উঠেন প্রফেসর মোবাশ্বের, “মনে হয় মানে? গাধার মতো কথা বলো কেন? সময় তো একটি মাত্রাই। আর কী কী জানো সেটা বলো।”

ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে তানভির হাসানের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র ছিলো সে। সময়ের ব্যাপারে অনেক গভীর জ্ঞান তার আছে। কিন্তু এখন সবকিছু যেন গুবলেট পাকিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে চোখমুখ উল্টে পড়ে যাবে। বিড়বিড় করে বলে, “স্যার, সময় হচ্ছে, সময় হচ্ছে…”

“থাক, বুঝতে পেরেছি। ইউনিভার্সিটিতে ফাঁকিবাজি করে পাশ করে এসেছ। শোনো, সময় হচ্ছে বিমূর্ত একটি বিষয়। এটিকে মাত্রা হিসাবে ধরা হলেও এর প্রকৃত প্রকৃতি এখনও আমাদের অজানা। শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল নিয়ে পরীক্ষাটার নাম শুনেছ তো?”

লজ্জায় লাল হয়ে যায় তানভিরের মুখমণ্ডল। স্যারের সামনে আসলেই কেন যে সব তালগোল পাকিয়ে যায় তার! মনোযোগ দিয়ে শুনছে সে স্যারের কথা। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় সে কোনও রকমে।

“কাল্পনিক একটি বিড়ালকে তিনি বক্সে পুরে সেখানে একটি টাইমার সেট করে দেন। টাইমারটি ক্লিক করলে রেডিয়েশন বিষক্রিয়ায় বিড়ালটি মারা যাবে। এখন সেই টাইমারটি ক্লিক করার সম্ভাবনা ৫০-৫০। তারমানে হচ্ছে বক্সের ভেতর বিড়ালটি হয় জীবিত কিংবা মৃত। যতক্ষণ পর্যন্ত বাক্সটি খোলা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই দুটি ঘটনাই ঘটে চলছে। যেই মাত্র বাক্সটি খোলা হবে তখন নিশ্চিত হওয়া যাবে বিড়ালটি বেঁচে আছে না মরে গেছে।” আচমকা ব্রেক কষে প্রফেসর রাগত স্বরে বলেন, “কী ব্যাপার, তুমি হাই তুলছ কেন?”

থতমত খেয়ে তানভির বলে, “না স্যার, অনেক রাতে ঘুমিয়েছি তো; তাই কিছুটা অবসাদ ভর করেছে; চোখটা লেগে আসছে।” বলতে বলতে আরেকটা হাই সুড়সুড়ি দিয়ে উঠে; দাঁত মুখ খিঁচে সেটিকে আটকায়, নাকের ডগা কেঁপেকেঁপে উঠে।

চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে প্রফেসর মোবাশ্বের। নাকের ডগার উপর চশমাটা টেনে এনে মাথাটা কিঞ্চিত ঝুঁকিয়ে চমশার উপর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, “রাত জেগে কী করো? পড়াশোনা তো নয়, সেটা আন্দাজ করতে পারছি। নিশ্চয় গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলো? তোমাদের বয়সের ছোকরাদের নিয়ে এই এক সমস্যা! জীবনে কোনটার প্রায়োরিটি বেশি সেটা নিয়ে সবসময় দ্বিধাবোধে ভোগ। আরে আগে প্রায়োরিটি ঠিক কর। মানুষ হয়ে জন্মেছ, বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করছ; চেষ্টা কর এই জ্ঞান সমুদ্রে একবিন্দু জল হলেও ঢেলে দিতে।”

স্যার আচমকা শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল ছেড়ে সক্রেটিসের মতো দার্শনিকের ঘাড়ে কেন চেপে যাচ্ছেন, মাথায় আসছে না তানভিরের। মৃদু তালে ঘাড় ঝাকিয়ে সে বলে, “জ্বি স্যার, প্রায়োরিটি সেট করে নেব। কিছুটা জল ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করবো।”

“তো কী যেন বলছিলাম?”

“বাঘের খালা স্যার, বাঘের খালা।”

“মানে?”

“বাঘের মাসি; বিড়াল, শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল।”

কপাল কুঁচকে তানভিরের রসিকতায় যে তিনি বিরক্ত তা বুঝিয়ে দিতে মুহূর্তও দেরি করলেন না প্রফেসর মোবাশ্বের চৌধুরী। “ওহ, হ্যাঁ। যা বলছিলাম।” আঙুলের ধাক্কায় চশমাটা আবার নাকের গোড়ায় ঠেলে দিয়ে বলা শুরু করেন তিনি, “এখন দুইটা দশাই সত্য; বিড়ালটা একই সাথে জীবিত ও মৃত। কিন্তু যেই মুহূর্তে বাক্সটি খোলা হলো তখন যেকোনও একটি দশা নিশ্চিত হয়ে যাবে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, অপর দশাটির কী হলো?”

“সেক্ষেত্রে অপর দশাটি কাল্পনিক হয়ে যাবে।” উচ্ছসিত কণ্ঠে বলে তানভির।

“এই শিখে এসেছ? তুমি না তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে?” ধমকে উঠেন প্রফেসর। “মনোযোগ দিয়ে শোন; বাক্সের ভেতরে বিড়ালটা যদি মরে যায়, তবুও সেটি না খোলা পর্যন্ত মৃত ও জীবিত। আর যদি জীবিত থাকে তবুও এটি মৃত ও জীবিত।” এই পর্যায়ে এসে কিছুটা চুপ মেরে যান মোবাশ্বের চৌধুরী। মনে মনে কিছু একটা গুছিয়ে নিচ্ছেন। নীরবতা ভেঙে খানিক পর বলেন, “এবার বলো দুটি বিপরীতমুখী সম্ভাবনা একই সাথে কীভাবে ঘটতে পারে?”

আমতা আমতা করে তানভির বলে, “স্যার, এটার ব্যাখ্যা কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট দিয়ে দেওয়া যায়। বিড়ালটির জীবত ও মৃত এই দুটি দশা কোয়ান্টাম সুপারপজিশন আকারে থাকবে। মানে অর্ধেক জীবিত; অর্ধেক মৃত।” বলেই ফুসফুস ভরে লম্বা দম নেয়; এই বুঝি স্যার ধমকে উঠবেন।

তাকে অবাক করে দিয়ে মোবাশ্বের চৌধুরী বলেন, “ভেরি গুড।”

টেনে রাখা দমটা ধীরে ধীরে ছাড়ে। মনেমনে খুশি হয়ে উঠে তানভির হাসান। স্যারের মুখে সচরাচর প্রশংসা শোনা যায় না।

“তবে যেই মুহূর্তে বাক্সটি খুলে ফেললাম সাথেসাথে এই সুপারপজিশন দশা ভেঙ্গে গেলো। তখন নিশ্চিত করে বলা যাবে বিড়ালটি জীবিত না কি মৃত। যদি মৃত হয় তাহলে জীবিত বিড়ালটা কোথায়? আর যদি জীবিত হয় তবে মৃত বিড়ালটা কোথায়?”

মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তানভিরের। কিছু একটা শোনার জন্যে চোখ পিটপিট করে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছেন মোবাশ্বের স্যার। আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো তাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “এখানেই চলে আসে প্যারালাল বিশ্বের থিওরি। যেই মুহূর্তে বাক্সটি খুলে দেখা গেল বিড়ালটি জীবিত, ঠিক আরেকটি প্রতিবিশ্বের সূচনা হয়ে গেলো। সেই বিশ্বে বিড়ালটি মৃত।”

পকেটে রাখা মোবাইলটা বিপবিপ করে বেজে উঠে। নিশ্চয় বহ্নি কল করেছে। কল করার আর সময় পেলো না! কত করে বলেছি এই সময়ে আমি ল্যাবে যমদূতের সাথে থাকি; ফোন না দিতে! নাহ, তাকে এখনই ফোন দিতে হবে। না ধরলে আবার গাল ফুলিয়ে রাখবে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে কলটা কেটে দেয় তানভির।

কিছুই হয়নি এমন ভাব করে বলে, “তার মানে কোনও ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকলে সেটি এখানে না ঘটলেও অন্য কোনও সমান্তরাল বিশ্বে ঠিকই ঘটছে; এটাই বুঝাতে চাচ্ছেন স্যার?” ধমক খাবে মেনে নিয়েই প্রশ্নটি করে তানভির।

“ঠিক বলেছ।” চোখে মুখে প্রশ্রয়ের হাসি প্রফেসরের। মনে মনে তানভিরকে বেশ পছন্দ করেন তিনি, কিন্তু সেটি লুকিয়ে রাখতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। “মনে কর তুমি একটি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সামনে গিয়ে রাস্তাটির দুটি শাখা বের হয়েছে, একটি ডানে আরেকটি বামে। তুমি যে কোনও একটিকে ধরে এগিয়ে যেতে পার। মনে কর তুমি ডানের রাস্তাটি বেছে নিলে। ঠিক আরেক সমান্তরাল বিশ্বে তুমি বামের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেছ।”

টুং করে একটি মেসেজ আসে মোবাইলে। কল করে না পেয়ে নিশ্চয় বহ্নি মেসেজ পাঠিয়েছে। আজকে ল্যাব থেকে বের হয়ে কড়া করে ঝাড় দিতে হবে একটা। নিজের আসনে কিছুটা নড়েচড়ে বসে সে।

তানভিরের দিকে কোনও খেয়াল নেই মোবাশ্বের চৌধুরীর; তিনি আপন মনে বলে যাচ্ছেন, “এই কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট আর সুপারপজিশন থিওরি একসাথে সংযুক্ত করে সময় ভ্রমণ করা সম্ভব। এখন এটাই আমাদের সমীকরণ আকারে সমাধান করতে হবে।”

চমকে উঠে তানভির হাসান। সময় ভ্রমণ! ঠিক শুনছে তো সে? স্যার কি জানেন না যে বিজ্ঞানী মহলে সময় ভ্রমণকে মনে করা হয় অপবিজ্ঞান? বেচারার বউ মারা যাওয়ার পর মনে হয় তার মাথায় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে!

তানভিরের চিন্তায় বাধা দিয়ে মোবাশ্বের বলেন, “এখনও সব সমীকরণ গুছিয়ে উঠতে পারিনি। তবে যেভাবে এগোচ্ছি খুব দ্রুতই সময় ভ্রমণের সমীকরণের সমাধান পেয়ে যাব। কয়েকটা লুকানো রাশিমালার রহস্য এখনও ধরতে পারছি না। এটাই ধাঁধার শেষ জট; এই জট খুলে গেলেই আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়ে যাবে সময় ভ্রমণের প্রযুক্তি।” অজানা উত্তেজনায় চোখ চকচক করছে প্রফেসরের। চোখের মোটা কাচের হাইপাওয়ারের চশমাও সেটিকে আড়াল করতে পারেনি। মানুষের স্বপ্নকে আড়াল করে এমন ফিল্টার এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি।

“লুকানো রাশিমালা মানে, স্যার?”

“আরে, লুকানো রাশিমালা মানে হিডেন ভেরিয়েবল; আমার থিওরিতে কিছু হিডেন ভেরিয়েবল আছে, সেটার জটই খুলতে পারছি না। তবে খুব জলদিই খুলে যাবে। মাথায় আসি আসি করেও আসছে না। সমাধানের আশপাশ দিয়ে ঘুরছি। চট করে একদিন মাথায় চলে আসবে। আমি ইউনিভার্সিটির গ্র্যান্ট কমিশনের কাছে এক্সপেরিমেন্টের জন্যে ফান্ড চেয়ে আবেদন করেছি। অনেক টাকার দরকার বুঝলে?” আচমকা ললাটে ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠে তার।

স্যার এখনও তো সমাধান বের করতে পারেননি! তার আগেই ফান্ড চেয়ে বসেছেন? যদি উল্টা পাল্টা কিছু হয়ে যায়? শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ল্যাবের ভেতরে বসেও প্রায় ঘেমে উঠেছে তানভির। মোবাশ্বের স্যারের আন্ডারে তারা বেশ কয়েকজন পিএইচডি করছে। এখন তিনি যদি কোনও উদ্ভট কান্ড ঘটিয়ে বসেন তাহলে তারা সবারই অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার হুমকিতে পড়ে যাবে। যদিও তার গবেষণার বিষয় আলাদা। স্যার একাই এই সময় প্রজেক্টে কাজ করছেন।

“আরে এত দুশ্চিন্তা করো না। সমীকরণের সমাধানও হয়ে যাবে আর ফান্ডও পেয়ে যাব।” দৃঢ প্রত্যয় ফুটে উঠে অল্প সময়ের ভেতর খ্যাতির শীর্ষে উঠে আসা মোবাশ্বের চৌধুরীর চোখেমুখে।

“স্যার আমি তো ফান্ড নিয়ে চিন্তা করছি না, আমি তো ভাবছি তারপরে কী হবে! ও আল্লাহ! আমার রিসার্চ শেষ না হওয়ার আগে যেন ফান্ড না মেলে। জলদি শেষ করে ভাগতে হবে এই পাগল গবেষকের খপ্পর থেকে।” পেটের কথাটা পেটেই হজম করে ফেলে তানভির হাসান।

“ও, ভালো কথা। চার তারিখে তিনটার সময় ডিন স্যারের সাথে মিটিং আছে। এই বেটাকে বাগে আনতে পারলেই কেল্লাফতে।” বলেই কুচক্রির মতো করে চোখমুখ বাঁকিয়ে মুচকি হাসেন তিনি।

“কয় তারিখে স্যার?”

“চার। কেন?”

“আজকেই তো চার তারিখ, স্যার।”

“লাফিয়ে উঠেন প্রফেসর মোবাশ্বের। হ্যাঁ! বলো কী? আয় হায়! আমি তো ভেবেছি আজকে এক তারিখ! এখন বাজে দুইটা পঞ্চাশ।” সময়ের পিণ্ডি চটকাতে চটকাতে তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বের হয়ে যান সময় ভ্রমণ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের অলীক স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা এই জ্ঞানতাপস।

অধ্যায় তিন
২০৮১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টিচার্স কোয়াটার

দুপুরের পর থেকে নিজেকে ঝড়ে ভীত কোকিলের মতো একাকী ঘরে আটকিয়ে রেখেছে মাইশা। মাঝে একবার চাচি এসে খাওয়ার জন্যে ডেকে গেছে। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে শরীর খারাপ বলে পার পেয়েছে। কিছুই ভালো লাগছে না তার। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে ঢাকা ভার্সিটির সকল কোলাহল; যেন পরের দিনের দৌড় প্রতিযোগিতার জন্যে সঞ্চিত করছে অদৃশ্য এক শক্তি। ছোট পিরামিড আকারের ক্রিস্টাল ডিস্কটি পড়ার টেবিলে অযত্নে ফেলে রেখেছে মাইশা। অনেকক্ষণ ধরে ঘোলাটে দৃষ্টিতে সেটির দিকে তাকিয়ে আছে সে, কিন্তু মনোযোগ তার অন্য কোথাও।

তানভির চাচা বারংবার সাবধান করেছে তাকে এই ডিস্কটির ব্যাপারে। অনেক বছর ধরে কোনও একটি গোপন সংগঠন এটি হাত করার জন্যে পিছনে লেগে আছে। টিকটিক করে প্রতিটি মুহূর্ত না ফিরে আসা স্রোতের মতো হারিয়ে যাচ্ছে। কখন যে সম্মোহিতের মতো ডিস্কটি হাতে তুলে নেয় মাইশা বুঝতেই পারেনি। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে।

দশ সেন্টিমিটার দৈর্ঘের একটি ত্রিভুজাকৃতির পিরামিড। ডিস্কটার শীর্ষে ছোট একটি বাটন। সেটি টিপে দিতেই নিচের দিকের একটি স্লাইড ক্লিক শব্দ করে খুলে যায়, সেখানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার অপশন। বাবা তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে এই ডিস্ক লক করেছে! কত তার বয়স তখন? দুই? ভ্রূ কুঁচকে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি চেপে ধরে ইনপুট সেকশনে। আরেকটি অপশন চলে আসে, ফেস-রিকগনিশন!

ডিভাইসটি মুখের সামনে তুলে ধরে। টুং করে একটি শব্দ হয় একটি ভয়েজ রেকর্ডিং বেজে উঠে, “আন-আইডেন্টিফাইড! আর দুইবার ভুল ট্রায়াল হলে ডিভাইসটি অটো ডিস্ট্রাক্ট হয়ে যাবে।” দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় মাইশা। দুই বছর বয়সের তার চেহারার সাথে বর্তমানের চেহারা কিছুতেই মিলবে না! চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবে সে। কিছু একটা মনে পড়তেই মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে তার। কম্পিউটার থেকে মায়ের ছবি বের করে ডিভাইসটির সামনে ধরতেই একটি ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফ পিরামিডটির মাথার উপর জেগে উঠে। মাইশার হৃদপিণ্ড হাপরের মতো লাফিয়ে উঠে যেন আচমকা।

প্রফেসর মোবাশ্বের চৌধুরীর ছোট একটি অবয়ব। মৃদুমৃদু কাঁপছে ছায়ামূর্তিটি। আলতো করে ডিস্কটি টেবিলের উপর রেখে ঘরঘর শব্দে চেয়ার টেনে তাতে বসে পড়ে মাইশা।

“মা, মাইশা। তুমি এই হলোগ্রাফিক রেকর্ডিং দেখছ তার মানে হচ্ছে আমার অতীত ভ্রমণ পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে। তবে এমনটা ঘটার কথা না। সময় সমীকরণের সমাধানে কোনও ভুল নেই, সম্ভাব্য সকল ঘটনাকেই বিবেচনা করা হয়েছে। যেই লুকানো রাশিমালা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম, সেটিকেও খুঁজে পেয়েছিলাম। তবে কেন যে আমার পরীক্ষা ব্যর্থ হলো বুঝতে পারছি না।

তুমি হয়তো খুব কষ্ট পেয়েছ তোমাকে একা ফেলে আমি নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছি। সেজন্যে আমার দুঃখের শেষ নেই। আমাদের সম্পর্কগুলোকে কেবল সাদা-কালোয় বিচার না করে ধূসর হিসাবেই দেখলে ভালো করবে। তোমাকে হয়তো আমার অনুভূতি ঠিকমতো বুঝাতে পারবো না। তবুও চেষ্টা করছি। আমার অন্তর্ধানের কারণ বুঝতে হলে আমাকে ঠিকঠাক মতো বুঝতে হবে। আমি ছোটবেলা থেকেই ছিলাম প্রচণ্ড বিজ্ঞানমনস্ক। রমণীর চোখের চেয়ে গণিতের সমীকরণই আমাকে বেশি আকৃষ্ট করতো। তাই আমার জীবনে কখনও প্রেম আসেনি, অন্তত নিপুণাকে বিয়ের আগে। হ্যাঁ, আমি প্রেমে পড়েছিলাম বিয়ের পরে কিন্তু বুঝতে পারিনি তার গভীরতা।”

ঘাড় কাত করে কম্পিউটার স্ক্রিনে মায়ের ছবিটির দিকে তাকায় মাইশা। একটি তরুণীর ছবি, ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত মায়াকাড়া একটি হাসি। নীল রঙের একটি শাড়ী পরা, কপালে ঠিক মাঝখানে একটি গাঢ় লাল রঙের টিপ, নীল রঙের বর্ডার; যেন রঙধনুর মতো আলো ছড়াচ্ছে। এত জীবন্ত আগে কখনও লাগেনি মায়ের ছবিটি, যেন এখনই স্ক্রীন ছেড়ে বের হয়ে আসবে। চোখ ছলছল করে উঠে মাইশার।

“আমি যেমন ছিলাম দুনিয়ার রঙরস থেকে শতহাত দূরে, তোমার মা ছিলো ঠিক তার উল্টো। সেই নিজেই ছিলো একটি রঙরসে পূর্ণ একটি দুরন্ত প্রজাপতি।” অবয়বটি একটু কেঁপে উঠে। মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। হয়তো চোখের জল আড়াল করার চেষ্টা।

“আমি যখন ল্যাবরেটরিতে গভীর চিন্তায় মগ্ন, দেখা যেতো ঠিক তখন তোমার মা শাড়ি পরে সেজেগুজে সেখানে হাজির। আমাকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে এসে বলতো, দেখেছ আকাশে পাখির ঝাঁক খেলা করছে! সারা রাত জেগে কাজ করেছি, ভোরের দিকে হয়তো চোখ বুজে আসছে। তখনই নিপু জোর করে উঠিয়ে বাগানে ধরে নিয়ে যেতো। অবাক হয়ে সদ্য ফোটা ফুলের উপর আলতো করে হাত বুলিয়ে শিশির ঝাড়তো আমাকে পাশে দাঁড় করিয়ে। এসব ফুল পাখি গাছের সৌন্দর্য আমাকে কখনও টানেনি। বরং তখনও আমার মাথায় ঘুরতো অক্টোপাসের শুঁড়ের মতো বিচিত্র ধরণের সমীকরণ আর কিম্ভুৎকিমাকার সব প্রতীক।”

দরজায় ঠকঠক করে শব্দ হয়, পরপর দুটি। এতই মগ্ন ছিলো মাইশা, মৃদু এই শব্দই যেন বজ্রের মতো কানে এসে হামলে পড়ে। চাচি! আবার খেতে যাওয়ার জন্যে ডাকছে। “তুমি যাও, আমি আসছি!” চিৎকার করে বলেই পুনরায় বাবার ভিডিওর দিকে মনোনিবেশ করে মাইশা।

“শুরু থেকেই আমার ধারণা হয়েছিলো শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল তত্ত্বে কিছু একটা ইঙ্গিত আছে যেটা আমি ধরতে পারছি না। এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছি দিনদিন। এরই মাঝে কিভাবে যেন তিনটি বছর কেটে গেলো। তারপর তিন মাসের ব্যবধানে ঘটে গেলো আমার জীবনে সবচেয়ে আনন্দদায়ক ও বিয়োগান্তক ঘটনা। তোমার জন্ম! নতুন প্রাণের জন্ম! আমার ও নিপুণার প্রাণের উৎস হতে নতুন প্রাণের সৃষ্টি! অবাধ্য নদীকে যেভাবে বাঁধ দিয়ে বশ করা হয়, আমিও জীবনের গতিপথ পালটে হয়ে গেলাম বশীভূত। ল্যাবে মন বসতো না, ক্লাসে অস্থির অস্থির লাগতো, মিটিং-এ কেবল ঘড়ি দেখতাম কখন শেষ হবে। ইচ্ছা করতো সারাক্ষণ তোমার আর নিপুণার আশেপাশে থাকি। জীবনের এই রূপ আমার কাছে চিরকাল অচেনাই ছিলো, ছিলো অধরা।”

আঙ্গুলের চাপে হলোগ্রাফটি পজ করে বিছানায় ডান থেকে বাঁ কাত হয় মাইশা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, মস্তবড় চাঁদ আকাশে। ধীরে পায়ে জানালার দিকে এগিয়ে কাচের স্লাইড টেনে সরিয়ে দেয়, বাতাসের দমকা একটা ধাক্কা এসে লাগে নাকেমুখে। রাতের ঠান্ডা বাতাসে কেমন যেন অজানা এক গন্ধ থাকে। চোখ বন্ধ করে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে লম্বা করে একটা দম নেয় মাইশা। জানালার কার্নিশে ডিভাইসটি রেখে চালু করে থুতনিতে হাত রেখে পুনরায় দেখা শুরু করে বাবার পাঠানো বার্তা।

“জন্মের দুই মাস পর তোমাকে নিয়ে নিপুণা দেশে যায় দুই সপ্তাহের জন্যে; আমি যেতে পারিনি, ইউনিভার্সিটি থেকে ছুটি পাইনি। এই কটা দিন ছিলো আমার জীবনের দীর্ঘতম দুঃসহ কাল। সকল রাতই ভোর হয়, ধীরে ধীরে দুটি সপ্তাহও কেটে যায়। তোমাদের ফেরার সময় ঘনিয়ে আসে। প্রতিটি ঘণ্টা প্রতিটি মিনিট মনে হচ্ছিলো অনন্তকাল। লন্ডন হিথ্রো এয়ারপোর্টে ট্রানজিটে অপেক্ষা করছিলে তোমরা। আট ঘণ্টা পর ফ্লাইট। হঠাৎ করে আমার ফোনে ট্রাভেল এজেন্সি থেকে একটি কল আসে। তারা আমাকে জানায়, আগের ফ্লাইটে শেষ মুহূর্তে একজন যাত্রী টিকেট বাতিল করেছে। তাই আমি ইচ্ছা করলে দুই ঘন্টা পরের ফ্লাইটেই তোমাদের টিকেট এগিয়ে নিয়ে আসতে পারি। সেক্ষেত্রে কোনও এক্সট্রা চার্জ লাগবে না বরং আমার একাউন্টে কিছু বোনাস পয়েন্ট যোগ হবে। আমার মাথায় তখন তোমাদের কাছে পাওয়ার আকাঙ্খা! বোনাস টোনাসের বিন্দু মাত্র চিন্তা করিনি। বরং আরও ছয় ঘণ্টা আগে তোমাদের দেখতে পাব, এটাই তো জীবনের সেরা বোনাস! দেরি না করে কনফার্ম করে দিলাম। আর এটাই ছিলো জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।”

ঠোঁট জোড়া দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেন প্রফেসর মোবাশ্বের। নাকের অগ্রভাগ ফুলে ফুলে উঠছে মৃদুমৃদু। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন নিজেকে। “প্লেনটি ঠিক মতোই উড়ান দেয় হিথ্রো থেকে, কিন্তু ল্যান্ডিং-এর সময় রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে। মাত্র এগারোজন যাত্রী বেঁচে যায়, তার মধ্যে তুমি একজন। আমি ঐ সিদ্ধান্তের জন্যে নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারিনি। একটি মাত্র সিদ্ধান্ত! ছয় ঘণ্টা আগে না কি পরে? ইয়েস অর নো? কি ক্ষতি হতো যদি এই শেষ মুহূর্তে টিকেট চেঞ্জ না করতাম?”

চোখের জলে চশমার কাঁচ ঘোলা হয়ে যায় মোবাশ্বের চৌধুরীর। আলগোছে সেটি খুলে শার্টের কোণার উল্টো পাশ দিয়ে মুছে আবার চোখে পড়ে নিয়ে পুনরায় বক্তব্য শুরু করেন। “যদিও তোমার তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি, কিন্তু পনেরো দিন অবজার্বেশনে রেখে তারপর আমার কাছে তুলে দেয় ডাক্তার। শুরু হয় আমার নতুন জীবন; যে জীবনে কেবল একটাই লক্ষ্য, একটাই উদ্দেশ্য! আমার সেই ‘ইয়েস’ সিন্ধান্তকে ‘নো’ করা। কাজের মাত্রা বাড়িয়ে দিলাম। দিনরাত এক করে সময় সমীকরণের সমাধানের চেষ্টা করছি। বারবার একটা জায়গায় এসে আটকে যাচ্ছিলাম। শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল থিওরিতেই লুকিয়ে আছে সেই হিডেন ভেরিয়েবল। এই হিডেন ভেরিয়েবল বা লুকানো রাশির মান ধরে ফেলতে পারলেই পেয়ে যাবো সময় ভ্রমণের সমীকরণের সমাধান। কয়েকজন ছাত্র ছিলো আমার আন্ডারে পিএইচডি করছিলো। তাদেরকে বোনাসের বিনিময়ে এক্সট্রা কাজ করাচ্ছিলাম। ঐ হিডেন ভেরিয়েবলকে আপাতত উহ্য রেখেই কাজ আগাচ্ছিলো। একের পর এক পরীক্ষা ব্যর্থ হচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছিলো ততই আমি বিমর্ষ হয়ে পড়ছি। আচমকা একদিন ধরতে পারি কী সেই হিডেন ভেরিয়েবল!

“এই ডিস্কটিতে আমার রিসার্চের সকল কিছু সেভ করে রেখেছি। হিডেন ভেরিয়েবলের বিস্তারিতও আছে শেষে। আছে টাইম মেশিন বানানোর ডিজাইন থেকে শুরু করে খুঁটিনাটি সব কিছু। আমি চাই কেন আমার এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ হলো তুমি সেটি নিয়ে গবেষণা করবে। তুমি ছাড়া আর কেউ এই এক্সপেরিমেন্ট করতে পারবে না। তুমিই এখন আমাদের দুজনের ভরসা।”

তারপর স্লাইডের মতো করে চলতে থাকে একের পর এক ডিজাইন, সমীকরণ। অনেককিছুই বুঝতে পারছে না। দ্রুত সেগুলোকে পাস করে দেয়, পরে সময় করে দেখবে বলে। সবশেষে উপস্থিত হয় সেই রহস্যের চাবিকাঠি, ‘হিডেন ভেরিয়েবল’। “ওহ মাই গড! ওহ মাই গড!” চমকে উঠে মুখ দিয়ে বিস্ময়কর চিৎকার বের হয়ে আসে মাইশার! একি দেখছি! আদৌ কি এটা সম্ভব?

মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় মাইশা। সে যাবে টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে। আবার শুরু করবে সময় সমীকরণ নিয়ে গবেষণা, যেখান থেকে শেষ করেছেন বাবা, শুরু করবে তারপর থেকে।

অধ্যায় চার
২০৬২, টেক্সাস ইউনিভার্সিটি

ক্যাম্পাসের ভেতরেই মোটামুটি নির্জন একটি জায়গায় চলছে সময় ভ্রমণ যন্ত্রের প্রোটোটাইপ বানানোর প্রক্রিয়া। এইদিকটায় সাধারণত কেউ আসে না, তবুও বাউন্ডারি দিয়ে শুরুতেই জায়গাটিকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। ইউনিভার্সিটির একেবারে কিনার ঘেঁষে বয়ে চলা লেকটি পার হয়ে হেঁটে গেলে দেখা মেলে ঘন বনাঞ্চল। এখানেই কিছু গাছ সাফ করে ফুটবল মাঠের সমান একটি ফাঁকা জায়গায় নিয়ে দিনরাত এক করে পুরোদমে ল্যাব নির্মাণ কাজ চলছে। আপাতত এখানেই একটি অস্থায়ী ঘর বানিয়ে সেখানে উঠে পড়েছেন প্রফেসর মোবশ্বের চৌধুরী।

তানভির হাসানকেও এই প্রজেক্টে পার্টটাইমার হিসাবে যুক্ত করেন প্রফেসর। খুশি মনেই এতে রাজি হয় তানভির। মুখে প্রকাশ না করলেও সে ঠিক বুঝতে পারে তাকে অন্যদের তুলনায় বিশেষ নজরে দেখেন প্রফেসর। সারাদিন নিজের প্রজেক্টের কাজ শেষ করে বিকাল থেকে এখানে যোগ দেয় তানভির।

উনিশজন টেকনিশিয়ান কাজ করছে। হাইভোল্টেজ পাওয়ার লাইন বসানোর কাজ চলছে এখন। প্ল্যাটফর্মের কনস্ট্রাকশনের কাজ প্রায় শেষ। দেখতে অদ্ভুত একটি স্ট্রাকচার! একমিটার ব্যাসের একটি পুরু স্টিলের বৃত্তাকার বেসমেন্ট বসানো হয়েছে শক্ত ফাউন্ডেশনের উপর, তাকে ঘিরে সুপার কন্ডাকটারের কিছু একটা বসবে। এখনও কাজ চলছে। ডিজাইনের কাজ প্রফেসর মোবাশ্বের একাই করেছেন। তার অফিস রুমের পাশেই আরেকটি রুম আছে। সেখানটায় কারও প্রবেশাধিকার নেই। প্রজেক্টের যাবতীয় গোপন কাজ এখানে বসেই সারেন তিনি।

প্রজেক্টের ব্যাপারে দু’একজন ব্যতিত বাদবাকি কেউই তেমন কিছু জানে না। কোনও একটি এক্সপেরিমেন্ট চালানোর জন্যে একটি ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হচ্ছে এমনটাই সবাই জানে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটা দুর্লভ কোনও ঘটনা নয়। প্রায়ই পাগলাটে প্রফেসররা উদ্ভট উদ্ভট সব পরীক্ষা চালিয়ে থাকেন আর ফান্ডের শ্রাদ্ধ করেন। এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ হলে, মুখ ভার করে বলেন, “উপস্‌, এমনটা তো হওয়ার কথা না! নিশ্চয় কোথাও ছোটখাটো ভুল হয়ে গেছে।” প্রায় সত্তরভাগ ফান্ডের টাকা এমন ছোটখাটো ভুলে উড়ে যাবে, এমনটা জেনেই কর্তৃপক্ষ এসব প্রজেক্ট চালানোর অনুমতি দিয়ে থাকেন।

প্রফেসর মোবাশ্বের আজ বেশ খোশমেজাজে আছেন। নিজে হাতে চা বানিয়ে এনে তানভিরের পাশে বসে গল্প শুরু করে দিয়েছেন। এমন সুযোগ সচরাচর আসে না। তানভিরও হঠাৎ অনেকদিনের চেপে রাখা প্রশ্নটি করে বসে। “স্যার, এই প্রজেক্টের ফান্ড কীভাবে অ্যাপ্রুভ করালেন? যতদূর জানি আপনার সময় সমীকরণের সমাধান এখনও শেষ হয়নি। আর ফান্ডের জন্যে অবশ্যই একটি গ্রহণযোগ্য প্রোপোজাল গ্র্যান্ট কমিশনের কাছে জমা দিতে হয়।”

মৃদু হেসে বলেন, “আমি সমাধানের খুব কাছে চলে এসেছি। এমনটাই তাদের বুঝিয়েছি। কেবল হিডেন ভেরিয়েবলটা বের করতে পারলেই কেল্লা ফতে। সেটাও যেকোনও সময় হয়ে যাবে। তাই তাদের বুঝিয়েছি এখন ফান্ডিং করলে কাজটা অনেকদূর এগিয়ে নেওয়া যাবে। ল্যাব সেটাপ করতেই তো একবছর লেগে যাবে! আমি সমীকরণের প্রাথমিক রূপ, টাইম মেশিনের ডিজাইন, ওয়ার্কিং প্রিন্সিপ্যাল ইত্যাদি জমা দিয়েছি। তারপরই না ফান্ড পেলাম। তবে এক্ষেত্রে আমার সুনাম, ট্র্যাক রেকর্ড ভালো কাজে দিয়েছে। তারপর একটা হুমকিও দিয়েছিলাম, তাতেই কাজ হয়ে গেছে।” ষড়যন্ত্রকারীর মতো কুটিল একটি হাসি ফুটে উঠে তাঁর চোখেমুখে।

চমকে উঠে তানভির! আরেকটু হলে গলা চা আটকে বিষম খেতো সে। “কী বলছেন স্যার? ইউনিভার্সিটির গ্র্যান্ট কমিশনকে হুমকি দিয়েছেন মানে?”

মাথা নিচু করে গলাটা তানভিরের দিকে কিছুটা বাড়িয়ে দিয়ে মোবাশ্বের চৌধুরী বলেন, “আরে তাদের বলেছি এই প্রজেক্টে ফান্ডিং না করলে, সমস্যা নেই। একই ধরণের প্রজেক্টের জন্যে ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো ফান্ড নিয়ে বসে আছে, আমি আজকে হ্যাঁ বললে কালকেই তারা প্রাইভেট জেট পাঠিয়ে দিবে। সামনাসামনি দুই দেশ সহোদরের মতো আচরণ করলেও, বাস্তবে তারা বৈমাত্রের ভাই। কানাডার নাম নিতেই…” চোখ টিপে কিছু একটা বুঝাতে চাইলেন প্রফেসর।

চা শেষ হতেই একমনে কম্পিউটারে কিছু ডাটা এন্ট্রি করতে থাকে তানভির। আজ যেন প্রফেসরকে কথা বলার বাতিকে পেয়েছে, থামতেই চাচ্ছেন না। তানভিরের পাশে এসে একটি চেয়ার টেনে বসে পড়েন তিনি। “আচ্ছা তানভির তোমার কি মনে হয় শেষ পর্যন্ত সময় ভ্রমণ সম্ভব হবে?”

“সত্যি কথা বলবো?”

মাথা নেড়ে অভয় দেয় প্রফেসর।

“স্যার, আমার মনে হয় এই প্রজেক্টের পুরো টাকাটাই জলে যাচ্ছে। সময় ভ্রমণ মূলত অপবিজ্ঞান। অনেক অনেক প্যারাডক্স আছে একে নিয়ে। আমার ধারণা…”

হাত উচিয়ে মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দেন প্রফেসর। “বিজ্ঞানের অনেক বিষয় আমাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। x, y, z এর মতো সময়কে একটি মাত্রা হিসাবে কল্পনা করতে পার? গাণিতিকভাবে আমরা বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে পারি; কিন্তু অনুভব করতে পারি কি? বস্তুকে ভেঙ্গে এনার্জি পাওয়া যায়, এটা সহজেই বুঝতে পারছি, আইন্সটাইন মশাইকে ধন্যবাদ। অনুরূপভাবে এনার্জি থেকেও কিন্তু বস্তু তৈরি করা সম্ভব। এই বিপরীত প্রক্রিয়াটাই বোঝা আমাদের জন্যে দুরূহ। কী হবে? ইলেক্ট্রন? নিউক্লিয়াস? বোসন কণা? না কি স্ট্রীং? যাই হোক, সময় ভ্রমণকে এখনও অপবিজ্ঞান মনে করা হয়। তুমি কি জান ১৯৪৫ সালে পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার হয়। কিন্তু সর্বপ্রথম ল্যাবে যিনি পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে আঘাত করেন, সেই রাদারফোর্ড ১৯৩৩ সালেও একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, “পারমাণবিক শক্তির কথা যারা বলে তারা অপবিজ্ঞানের কথা বলে। আজ থেকে তিন চার বছর পর সময় ভ্রমণও আর অপবিজ্ঞান থাকবে না, দেখে নিও।” চোখ কেমন যেন জ্বলজ্বল করে উঠে তাঁর।

তানভির আলতো করে মনিটরটি বন্ধ করে চেয়ারসমেত প্রফেসরের দিকে ঘুরে তাকায়। তার মনে কিছু সন্দেহের বুদবুদের উদয় হয়েছে, অজানা আশংকায় বুক কেঁপে উঠে; ভয়ে ভয়ে বলে, “স্যার, আপনি সময় ভ্রমণ করে কী হাসিল করতে চান?”

যেন তানভিরের প্রশ্ন শুনতেই পাননি এমন ভাব নিয়ে দূরের বনের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। দ্রুত সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। অস্থির হয়ে পাখপাখালি ঘরে ফিরছে; এই সময়টিতে মন কেমন অস্থির অস্থির আচরণ করে। অনেক ধর্মেই সূর্যাস্তের লগ্নে প্রার্থনায় কাটাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটা কি অস্থির মনকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার জন্যে? হাতে ধরে থাকা চায়ের কাপটি আলতো করে টেবিলে রাখতে রাখতে বলেন, “আমরা যে হিডেন ভেরিয়েবলের সন্ধান করছি, সে ব্যাপারে কি তোমার কোনও ধারণা আছে?”

“না স্যার। আপনি আগে কখনও সময় ভ্রমণের তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করেননি।”

“ও! হ্যাঁ হ্যাঁ! তাই তো!” লাজুক একটা ভাব ফুটে উঠে তার চোখে মুখে। “সময় সমীকরণে সমাধানের জন্যে আমাদের তিনটা বিষয় খুব ভালো করে বুঝতে হবে। প্রথম কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট, দ্বিতীয় বিষয়টা হচ্ছে শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল এক্সপেরিমেন্ট ও সব শেষে হচ্ছে প্যারালাল ইউনিভার্স।”

প্রথম দুইটি বিষয় তানভির ভালোই বোঝে; অন্তত বোঝে বলে মনে করে। কিন্তু প্যারালাল ইউনিভার্স? এটার সাথে আবার সময় ভ্রমণের কী সম্পর্ক?

“কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট হচ্ছে, মনে করো দুটি ইলেকট্রন কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট অবস্থায় আছে। তাহলে একটির স্পিন যদি আপ হয় তবে অপরটির স্পিন হবে ডাউন। ব্যাখ্যার সুবিধার জন্যে ধরে নিই দুটি বিট, শূন্য আর এক। তাহলে একটি যদি ‘এক’ হয়, তবে অপরটি ‘শূন্য’ হবে; আর একটি যদি ‘শূন্য’ হয়, তাহলে অপরটি ‘এক’ হবে। হুম, ব্যাপারটা একটু জটিলই বলা চলে...” নিজেকেই প্রবোধ দিচ্ছেন যেন মোবাশ্বের চৌধুরী।

খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে তানভির। হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে একটি কলম পেন্ডুলামের মতো করে এদিক সেদিক নাড়াচাড়া করছে বিক্ষিপ্তভাবে।

“এখন মনে করো একটি বিট পরীক্ষা করে দেখলাম ‘শূন্য’, তখন আরেকটা বিট পরীক্ষা না করেই বলা যাবে সেটি হবে ‘এক’। যদি দুটি বিটের মধ্যে ব্যবধান এক আলোববর্ষও হয়, তবুও একটি ‘শূন্য’ হলে অপরটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ‘এক’ হয়ে যাবে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে একটি বিট যে ‘শূন্য’ হচ্ছে এই তথ্যটি এক আলোকবর্ষ দূরের অপর বিটটি কীভাবে জানলো? এই তথ্য আলোর বেগে যেতেও তো একবছর সময় লাগার কথা। কিন্তু এই কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্টের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?”

“জ্বি স্যার বুঝতে পারছি। তারপর?” এগুলো অনার্স লেভেলেই পড়া হয়ে গেছে তাদের। কিন্তু সেটি আর এই মুহূর্তে স্যারকে বলার মানে হয় না।

“তাহলে প্রশ্ন আসে দুটি বিটের ভেতর তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে কীভাবে চলে যাচ্ছে? এইখানেই চলে আসে হিডেন ভেরিয়েবল। মনে করা হয় এই দুটি কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট বিটের ভেতর একটি হিডেন ভেরিয়েবল কাজ করছে। তবে পদার্থবিজ্ঞান আজ পর্যন্ত এই হিডেন ভিরিয়েবলের স্বরূপ উম্মোচিত করতে পারেনি।”

“আশা করি আপনি পারবেন স্যার।”

চোখ কুঁচকে তানভিরের দিকে তাকান প্রফেসর। বোঝার চেষ্টা করছেন সে রসিকতা করছে কি না! তানভির মুখমণ্ডল ভাবলেশহীন গোবেচারা করে রেখেছে। চোয়ালের হাড় শক্ত করে তিনি বলেন, “হুম, আমাকে পারতেই হবে…

তারপর হচ্ছে দ্বিতীয় বিষয়। শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল। আগেও তো এই বিষয়টা নিয়ে তোমার সাথে আলাপ হয়েছে, তাই না?”

“জ্বি স্যার।”

“গুড। তাহলে এবার আমরা শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের কমপ্লেক্স অবস্থার সাথে কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট সংযুক্ত করি।”

পিলে চমকে উঠে তানভির হাসান। কি বকছে এই পাগল? শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল ও কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট এমনিতেই বেশ জটিল থিওরি। এখন আর শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের কমপ্লেক্স অবস্থার সাথে এন্ট্যাঙ্গলমেন্টের খিচুড়ি পাঁকাবে? একটা অসহায় ভাব ফুটে উঠে তার চোখেমুখে।

“মুচকি হাসেন প্রফেসর মোবাশ্বের। তানভিরের হাসানের এই ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন যেন আত্মভোলা এই বিজ্ঞানী! “এখন মনে করো, একটি নয়, দুটি বিড়ালকে এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট অবস্থায় দুইটি বাক্সে ভরে পৃথিবীর দুই প্রান্তে রাখলাম। এখন একটি বাক্স খুলে পরীক্ষা করে দেখি যে বিড়ালটি মৃত। তাহলে কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট অনুযায়ী বুঝতে পারবো অপর বিড়ালটি জীবিত। কোনও অবস্থাতেই দুটিই একসাথে জীবিত অথবা দুটিই মৃত হবে না। ঠিক এখানেই চলে আসে মাল্টি-ইউনিভার্সের থিওরি।”

অলরেডি চোয়াল ঝুলে পড়েছে তানভিরের। কিন্তু ভাব ধরে রেখেছে যেন খুব মনোযোগ সহকারে স্যারের বক্তব্য শুনছে।

“এখন একটি বিড়াল জীবিত, আরেকটি বিড়াল মৃত; অথবা ভাইস ভার্সা অবস্থা। দুইটা অবস্থাই বাস্তব। কীভাবে সম্ভব? সম্ভব একমাত্র প্যারালাল বিশ্ব। ধর যখন একটি বাক্স খুলে পরীক্ষা করলাম, তখন সময়ে t অবস্থায় বিড়ালগুলির স্ট্যাটাস (1, 0); তাহলে ঠিক এই মুহূর্তে প্যারালাল বিশ্বে এই স্ট্যাটাস হবে (0, 1). তারমানে প্রতিটা অপশন বেছে নেওয়ার জন্যে একটি করে সমান্তরাল বিশ্বের সৃষ্টি হবে।”

“এই বিষয়টা বুঝতে একটু কষ্ট হচ্ছে স্যার। একটু সহজ করে আবার ব্যাখ্যা করবেন?”

চেয়ার থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে যান প্রফাসর মোবাশ্বের। ঘরের ভেতর ইতস্তত পায়চারি করেন কিছুক্ষণ। আচমকা ঘরের কোনে একটি তেলাপোকার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “মনে কর আমি এই তেলাপোকাটিকে জুতো পিষে দিলাম। তাহলে সাথেসাথে আরেকটা প্যারালাল বিশ্বের আবির্ভাব হয়ে গেল যেখানে আমি এটিকে মারিনি। বুঝতে পারছ?”

“জ্বি স্যার। এটা বুঝতে পেরেছি। যেই মুহূর্তে তেলাপোকাটিকে মেরে ফেললেন সময়ের এই বিন্দুতে দুটি পাশাপাশি বিশ্বের সৃষ্টি হলো। এটা তো সহজ।”

“তারমানে সময়ের যে কোনও বিন্দুতে প্যারালাল বিশ্ব সৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। যেমন ধর, তুমি বহ্নিকে বিয়ে করলে। বহ্নিই তো তোমার প্রেমিকার নাম, তাই না?”

রক্তিম বর্ণ ধারণ করে তানভির মুহূর্তেই। স্যার বহ্নির কথা জানলো কী করে? অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে মৃদু মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।

মাথা মৃদুমৃদু ঝাকুনি দিতে দিতে বলেন প্রফেসর মোবাশ্বের, “এক বিশ্বে তাকে বিয়ে করলে, আরেক বিশ্বে তার সাথে তোমার পরিচয়ই হলো না।” হাতের কাপটি টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলেন, “এই কাপটি আমি এখানে রাখলাম। আরেক বিশ্বে এই টেবিলের উপর না রেখে ঐ টেবিলের উপর রাখলাম। তাহলে ঠিক কখন কখন কীভাবে কীভাবে একটি প্যারালাল বিশ্বের সৃষ্টি হচ্ছে? এখানেই লুকিয়ে আছে আমাদের হিডেন ভেরিয়েবল। এটাই এখন আমাদের লক্ষ্য।

“তবে আমি একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছি। আমার ধারণা আমাদের মহাবিশ্বের প্রতিটি ইলেকট্রনের স্পিনের উপর নির্ভর করে একেকটি প্যালালাল বিশ্বের আবির্ভাব হচ্ছে।”

“বলেন কী স্যার! এতো অবিশ্বাস্য রকমের বিশাল একটি সংখ্যা!”

“ঠিক বলেছ। আমাদের বিশ্বে প্রায় 1080 সংখ্যক ইলেকট্রন আছে। এই ইলেকট্রনগুলো মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায়, মানে স্পিন দেয়। তাহলে ধর, একটি ইলেকট্রন আপ স্পিন দিলো, সাথেসাথে আরেকটি বিশ্বে এই ইলেকট্রনটি ডাউন স্পিন দিবে।

“আমি তো আর কল্পনাই করতে পারছি না! তাহলে তো প্যারালাল বিশ্বের সংখ্যা অসীম হবে। কারণ এই ইলেকট্রনগুলো অন্যান্যা ইলেকট্রনের সাথে ইন্টারেকশনের সংখ্যা অসীম। আবার ধরুন বোঝার সুবিধার জন্যে ধরে নিই আমাদের বিশ্বে একটি ইলেকট্রন এখান থেকে ছুটে সামনের দেয়াল আঘাত করলো। আরেকটি বিশ্বে এটি পেছনের দেয়ালে আঘাত করলো। তারপর এই দুটি বিশ্বে এই ইলেকট্রনটির আরও ইন্টারেকশনের সাথে সাথে প্রতি মুহূর্তে আরও প্যারালাল বিশ্বের উদ্ভব হতে থাকবে।”

মনে মনে খুশি হয়ে উঠেন মোবাশ্বের চৌধুরী। তারমানে তানভির ব্যাপাটা ঠিকঠিক বুঝতে পারছে। “তার মানে দাঁড়াচ্ছে কেবল একটি ইলেকট্রনের উপর নির্ভর করেই অসীম সংখ্যক প্যারালাল বিশ্ব হতে পারে। ধর একটা গাছের পাতা। পরের লেভেলেই সেই একটি থেকে অসীম সংখ্যক পাতা বের হচ্ছে। তার পরের লেভেলের প্রতিটি পাতা থেকে আবার অসীম সংখ্যক বের হচ্ছে। এভাবেই চলতে থাকবে।”

“কিন্তু স্যার, এটার সাথে সময় ভ্রমণের কী সম্পর্ক?”

সময় ভ্রমণের সম্পর্ক হচ্ছে, মনে করো সময়ের একটি বিন্দুতে এমন অসীম সংখ্যক প্যারালাল বিশ্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এখন যদি সময়কে পেছনের দিকে প্রবাহিত করি কী ঘটবে?”

তানভিরের মুখ দিয়েও অজান্তেই বের হয়ে আসে, “কী হবে স্যার?”

“অসীম সংখ্যাক বিশ্বের অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যাবে।”

দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে তানভির বলে, “ব্যাপারটা ঠিকমতো বুঝলাম না স্যার!”

“মনে কর তুমি সময়কে একদিন অতীতে নিয়ে গেলে। এর ফল কী হবে জানো? এই এক দিনে যতগুলো প্যারালাল বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো পেছনের দিকে মিলিয়ে যাবে। একদিনের অসীম সংখ্যক বিশ্বের অসীম সংখ্যক কম্বিনেশন অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে। তারমানে এই একদিনে এই মহাবিশ্বে প্রতিটি ইলেকট্রনের স্পিনের ফলে যতগুলো বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে; সবই পেছনের দিকে ধাবিত হবে। কী পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন এক মুহূর্তও যদি অতীতে যেতে চাও, সেটা বুঝতে পারছ? এক সেকেন্ডও যদি পেছনে যেতে চাও, তাহলে এই এক সেকেন্ডে সমগ্র মহাবিশ্বজুড়ে যত পরিবর্তন হয়েছে সব রিভার্স করতে হবে।”

“কিন্তু স্যার, এই পরিমাণ শক্তি তো আমাদের পক্ষে প্রডিউস করা সম্ভব নয়!” অনিশ্চিত কণ্ঠে বলে তানভির।

“এই তো এবার সঠিক পথে চিন্তা করছ। এক সেকেন্ড অতীতের ভ্রমণের জন্যেও অসীম শক্তির প্রয়োজন, যেটা আমরা যোগাড় করতে পারবো না। তাই এভাবে সময় ভ্রমণ সম্ভব নয়।”

দ্বিধাগ্রস্থ বোধ করে; তানভির স্যারের কথায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু স্যার আপনি যদি আগে থেকেই জানেন যে সময় ভ্রমণ সম্ভব নয় তাহলে কেন এই বিশাল তোড়জোড়?”

“এইভাবে সম্ভব নয়, কিন্তু কোনওভাবেই সম্ভব নয় সেটা তো আমি বলিনি! প্রথমে ধরে নিই, সময় ভ্রমণ সম্ভব; তাহলে কোন কোন পথে গেলে সফল হওয়া যাবে না সেটা জানা থাকলে বাকি যে পথ থাকবে, ঐটাই সফলতার দিকে নিয়ে যাবে! আমরা এখন জানি কোন পথে যাওয়া যাবে না। এখন সঠিক পথটা খুঁজে পেলেই হয়ে যাবে।”

ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না তানভির হাসান। কেবল এইটুকু ব্যাপারের উপর নির্ভর করে এত কর্মযজ্ঞ চালানোর মানে হয় না। নিশ্চয় প্রফেসর তার কাছে কিছু একটা গোপন করছেন। কী সেটা?

“বুঝলে তানভির, এই তিনটি বিষয়কে এক সমীকরণের গিঁটে নিয়ে আসতে পারলেই সময় সমীকরণের সমাধান পেয়ে যাবো।”

কিছুটা অন্যমনষ্ক ছিলো তানভির। প্রফেসরের কথায় চমকে উঠে বাস্তবে ফিরে আসে। “কোন তিনটি বিষয় স্যার?”

“আরে এখনই ভুলে গেলে? কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট, শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল ও প্যারালাল ইউনিভার্স। এই তিনটিকে…” হঠাৎ কথা থামিয়ে ডানহাত মুঠিবদ্ধ করে অদৃশ্য কিছু একটা মুচড়িয়ে সমীকরণগুলোর পিণ্ডি চটকে নিলেন মোবাশ্বের চৌধুরী।

“কিন্তু স্যার, যদি সময়মতো হিডেন ভেরিয়েবলের সমাধান না করা যায়? তাহলে তো এই তিনটি বিষয়কে একীভূত করা সম্ভব হবে না?”

“ও নিয়ে এত ভেবো না। সময় মতো সব হয়ে যাবে। সবকিছুই পরিকল্পনা মাফিকই এগোচ্ছে।”

“সবই তো বুঝলাম, কিন্তু স্যার এই তিনটি বিষয়কে একীভূত করে সময় ভ্রমণ কীভাবে সম্ভব হবে সেটাই তো আলোচনা করেননি।”

খুব দ্রুততার সাথে ভ্রূ জোড়া নাচিয়ে তিনি বলেন, “আরে, একদিনেই সবকিছু বুঝে যাবে না কি? যাও, এখন এই সমীকরণটার সমাধান করে নিয়ে এসো, ধরে নাও এই তিনটি ভেরিয়েবল পাঁচবার ফিডব্যাক ইটারেশন হবে।”

তানভিরের মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায় যে কিছু একটা লুকাচ্ছেন, প্রফেসর মোবাশ্বের চৌধুরী।

অধ্যায় পাঁচ
২০৮২, টেক্সাস ইউনিভার্সিটি

আজ সময় নিয়ে বেশ যত্ন করে সেজেছে মাইশা। নীল রঙের জিন্সের সাথে লাল রঙের ভি-গলার ফতুয়ায় বেশ মানিয়েছে তাকে। হালকা মেকাপ, পিঙ্ক কালারের ছোট মুক্তার দুল, গলায় একটা সাদামাটা ডিজাইনের চিকন স্বর্ণের চেইন। চেইনটার মাথার ঝুলছে ছোট গ্লোব আকৃতির একটি লকেট। মাথার পেছনে ছোট্ট করে একটা ঝুঁটি বাধা। সবকিছুতেই একটি পরিমিত ভাব। চোখ ধাঁধানো সুন্দরী না হলেও, দ্বিতীয়বার ঘুরে দেখার মতো আকর্ষণীয় অবশ্যই।

গতকাল বিকালে ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছেছে। আপাতত ইউনিভার্সিটির গেস্ট হাউজে উঠেছে। সকাল নয়টায় প্রফেসর হোয়াইন রোলোস্কির সাথে মিটিং। নয়টা বাজার বেশ কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে যায় মাইশা। এই ক্যাম্পাসেই তার জন্ম। জীবনের প্রথম তিনটি বছর এখানেই কাটিয়েছে সে। শৈশবের স্মৃতি সবই বিস্মৃত হয়ে গেছে। এমনকি বাবার চেহারাটাও আর মনের পর্দায় ভাসে না। আড়াআড়িভাবে বাঁধানো লাল রঙের ইঁট বিছানো পথ ধরে ধীর গতিতে হেঁটে চলে মাইশা। আশেপাশে অনেক কিশোর কিশোরীর মৌমাছির মতো গুঞ্জন করে বেড়াচ্ছে।

শিক্ষকদের নাম পড়তে পড়তে করিডোর ধরে এগিয়ে যায় মাইশা। একেবারে শেষে একটি বন্ধ দরজা, ইলেক্ট্রনিক সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে, “ডঃ হোয়াইন রোলোস্কি। প্রফেসর, কোয়ান্টাম ফিজিক্স। ডিন ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট।”

বুকের ভেতর কেমন যেন চিনচিন করছে, পেটের পেশী টানটান হয়ে আছে, কিছুটা নার্ভাস অনুভব করছে। বুক ভরা দম টেনে শেষ মুহূর্তে শিনা টানটান করে রুমের ভেতর ঢুকে পড়ে মাইশা। একটি ডেস্কে অল্পবয়সী একটি মেয়ে বসে, সম্ভবত চাইনিজ বংশোদ্ভূত। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। নজর তুলে মাইশার দিকে তাকিয়েই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, “মিস মাইশা চৌধুরী? আসুন আসুন প্লিজ। স্যার আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছেন। আমি স্যারের টিএ মোহ চ্যাও।” নিজের পরিচয় বলতে বলতে ডান হাত বাড়িয়ে দেয় সামনের দিকে।

মুহূর্তেই সব আশংকা দূর হয়ে সেখানে একটা সমীহ ভাব জেগে উঠে। মোহ চ্যাও-এর বাড়িয়ে দেওয়া হাত মুঠিতে নিয়ে মৃদু ঝাকুনি দেয় মাইশা। বাঁ হাত উঁচিয়ে পাশের একটি দরজা দেখিয়ে বলে, “প্রফেসর আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।”

বড় একটি টেবিলের অপরপাশে বসে আছেন মধ্যবয়স্ক প্রফেসর এইচ. রোলোস্কি, মুখ জুড়ে অমায়িক একটি হাসি। “এসো এসো তোমাকে শেষ দেখেছি বিশ বছর আগে, আর এখন কত বড় হয়ে গেছো!”

অনেকক্ষণ গল্প করলেন প্রফেসর। বেশিভাগই মাইশার ছোটবেলার কাহিনী। বুঝতে পারে বাবার সাথে বেশ ভালোই সুসম্পর্ক ছিলো তাঁর। অবশেষে কাজের কথায় আসেন রোলোস্কি। “তোমার বাবা নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর সেই ল্যাবটি সীল করে দেওয়া হয়েছে। আসলে কী হয়েছিলো আমরা কেউই ঠিক মতো জানি না। তদন্ত কমিটি কয়েকটি সম্ভাবনার কথা রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলো। হতে পারে কোনও এক সকালে ঘুম থেকে উঠে ইচ্ছা হয়েছে নিজে থেকেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। যদিও এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। আধুনিক বিশ্বে কেউ চাইলেই নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারে না। কোথাও না কোথাও ট্রেস থেকে যায়। তার উপর আবার ইন্টারপোলের মাধ্যমে খোঁজ করা হয়েছে। আরেকটা সম্ভাবনা…” হঠাৎ থেমে প্রফেসর বলেন, “কফি খাবে?” সম্মতির অপেক্ষা না করে নিজেই উঠে ঘরের এক কোণে চলে যান কফি বানাতে।

“হ্যাঁ, যা বলছিলাম। দ্বিতীয় সম্ভাবনা হচ্ছে তাঁকে খুন করা হয়েছে। খুনি খুব সতর্কতার সাথে ডেডবডি লুকাতে পেরেছে। তবে সম্পূর্ণ এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পাওয়া যায়নি। আর ল্যাবের ভেতর কোনও সিসি ক্যামেরা না থাকায় তাঁর নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনও রেকর্ডও নেই। যদিও এই সম্ভাবনা কম, তবুও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

শিউরে উঠে মাইশা। এমন আশংকার কথা তার মাথায় একবারের জন্যেও আসেনি।

“শেষ সম্ভাবনাটি হচ্ছে তিনি সফলভাবে সময় ভ্রমণ করতে পেরেছেন। এটার পক্ষে শক্ত যুক্তি হচ্ছে নিরুদ্দেশ হওয়ার তিন চার সপ্তাহ আগে তিনি কোথা থেকে যেন একটি বিড়াল যোগাড় করেন। ল্যাবে তার সাথে কাজ করতো তানভির হাসান, তার স্বাক্ষ্যতে তাই উঠে এসেছে। তিনি নিরুদ্দেশ হওয়ার পর থেকে বিড়ালটিও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তদন্ত কমিটি উল্লেখ করেছে হয়তো তিনি বিড়ালটি সহ সময় ভ্রমণ করে অতীতে অথবা ভবিষ্যতে চলে গেছেন। সেক্ষেত্রে ল্যাবটি এভাবেই ফেলে রাখার জন্যে রিকমেন্ডেশন করা হয়। হয়তো মোবাশ্বের চৌধুরী ঠিক ঐ জায়গায় কোনও একদিন ফিরে আসবেন।” শুকনো একটি হাসি ঝুলে থাকে প্রফেসরের ঠোঁটে; যেন এই নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনায় তিনি যারপরনাই বিব্রত।

বেশ ভালো মানের কফি। সমগ্র ঘর কফির গন্ধে ম ম করে উঠে। মগে চুমুক দিতেই তৃপ্তিতে চোখ বুজে আসে মাইশার। মৃদু স্বরে বলে, “স্যার, আমার ল্যাব কি সেখানেই হবে?”

“অবশ্যই। তুমি যেহেতু মাস্টার্স করবে, তাই একা তোমাকে সেখানে ছেড়ে দেওয়া হবে না। সরাসরি আমার তত্ত্বাবধানে কাজ করবে। ফান্ডিং এর তেমন একটা প্রয়োজন হবে না, যেটা লাগবে সেটা অল্পই বলা চলে, যোগাড় করা ব্যাপার না। ঐ ল্যাবটায় সবকিছুই সেটাপ করা আছে। অনেকদিন পরিত্যক্ত পড়ে আছে, কিছু যন্ত্রপাতি হয়তো বদলাতে হতে পারে, কিছু টুকটাক মেরামত করে নিলেই চলবে। তুমি আজ থেকেই শুরু করে দাও। কি বলো?”

“ঠিক আছে, ঘাড় কাত করে বলে মাইশা। স্যার একটা প্রশ্ন ছিলো।”

চোখে প্রশ্নবোধক ভাব ফুটিয়ে নিষ্পলক মাইশার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেন প্রফেসর হোয়াইন রোলোস্কি।

“আমি ভাবছি, বাবার পর ঐ এক্সপেরিমেন্ট আর কেউ চালিয়ে নেয়নি কেন? যেখানে ধারণা করা হচ্ছে তিনি হয়তো সফলভাবে সময় ভ্রমণ করতে পেরেছেন!”

“আসলে প্রফেসর মোবাশ্বের তার গবেষণার শেষের দিকের অগ্রগতির কিছুই ইউনিভার্সিটিকে জানাননি। ধারণা করা হয় তার দ্বিতীয় একটা রিপোর্ট অন্য কোথাও আছে। আর সময় সমীকরণ পদার্থবিজ্ঞানের এমন একটি বিষয় রাতারাতি এখানে বিশেষজ্ঞ তৈরি হয় না। বলতে গেলে তোমার বাবা, মিস্টার চৌধুরী একা হাতেই এই ফিল্ডকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তবে গবেষণা কিন্তু থেমে নেই, অনেকেই চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু তেমন অগ্রসর হতে পারেনি।” হঠাৎ চুপ হয়ে যান রোলোস্কি। চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবছেন। আচমকা চোখ খুলে মাইশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “মোবাশ্বের চৌধুরীর রিসার্চের দ্বিতীয় ভার্সনটার ব্যাপারে কিছু জান কি?”

এ ধরণের প্রশ্ন যে আসতে পারে, এবং প্রশ্নগুলো তাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় করা হতে পারে এই ধরণের মানসিক প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিলো মাইশার। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে চোখে অকৃত্রিম বিস্ময় ফুটিয়ে তুলে সে বলে, “দ্বিতীয় ভার্সন? না তো স্যার এমন কিছুর ব্যাপারে তো কিছু জানি না! আসলে বাবার রিসার্চের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। কয়েক মাস আগে আমার চাচা প্রফেসর তানভির হাসান আমাকে এই ব্যাপারে কিছুটা ব্রিফ করেন। তখন এই বিষয়ে আমার আগ্রহ জন্মে। আমার মনে হয় বাবার নিরুদ্দেশ হওয়ার বিষয়টা নিয়ে আমাকে কাজ করা উচিত।”

আরও কিছুক্ষণ পর প্রফেসরের রুম থেকে বের হয় আসে মাইশা; সাথে সাথে তার দিকে এক গোছা চাবি, একটি স্মার্ট কার্ড বাড়িয়ে ধরে মোহ চ্যাও। সেগুলো নিতে নিতে ঘড়ির দিকে নজর যায় তার। তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেছে! প্রফেসর হোয়াইন রোলোস্কি বেশ আমুদে লোক, ভালো আড্ডা দিতে পারেন। তার সাথে গল্প করার সময়, সময় যে কীভাবে চলে যায় সেই খেয়াল থাকে না। তবে মনে মনে নিজেকে সাবধান করে মাইশা। যত সরল দেখাচ্ছে, বাস্তবে এতটা নাও হতে পারেন। মোবাশ্বের চৌধুরীর গবেষণার গুরুত্ব সে ঠিকই বুঝতে পারছে। তাকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

লাঞ্চের পর বাবার ল্যাবটির দিকে হাঁটা ধরে মাইশা। একটি ফুটবল মাঠের সমান জায়গা, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ঝোপঝাড় বেশি জমেনি, পায়ে হাঁটা পথটিও পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে না। তার মানে আগাছা কেটে, ময়লা আবর্জনা সরিয়ে কিছুদিন পরপর জায়গাটি সাফসুতরো করা হয়। হয়তো প্রফেসরের শেষ কথাটাই সত্যি, তারা এখনও অপেক্ষা করে আছে কোনও একদিন মোবাশ্বের চৌধুরী এখানেই ফিরে আসবেন। কোথায় আছে বাবা এখন? বেঁচে আছেন তো?

অধ্যায় ছয়
২০৬২, টেক্সাস ইউনিভার্সিটি

সাত মাস দশ দিন পর সম্পন্ন হয় সম্পূর্ণ ল্যাব স্থাপনের কাজ; নির্ধারিত সময়ের বিশ দিন আগেই। এটাকে কি ল্যাব বলা যায়? না কি সম্পূর্ণটা মিলে একটি টাইম মেশিন? চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে আনেন প্রফেসর; তৃপ্তির একটি হাসি তার মুখ জুড়ে খেলা করছে। কিছুক্ষণ আগে প্রাইভেট কন্ট্রাকটারের কাছ থেকে সবকিছু বুঝে নিয়েছেন। পুরো ল্যাবটি এমনভাবে বানানো হয়েছে যে মাত্র একজন লোক দিয়েই এটিকে চালু করে সচল রাখা সম্ভব। বেশিরভাগ যন্ত্রপাতিও কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত।

দুপুর— প্রতি মুহূর্তে ষাট কোটি টন হাইড্রোজেন পুড়িয়ে সূর্য তার ক্ষমতার জানান দিচ্ছে ঠিক মাথার উপরে। নিজের অস্থায়ী অফিস রুমে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন প্রফেসর মোবাশ্বের। আজ থেকে তিনি আর তানভির ব্যতিত আর কেউ এই ল্যাবের আশেপাশে ঢুকতে পারবে না। তানভিরকে নিয়ে তাঁর অন্য একটা পরিকল্পনা আছে।

দেয়ালের সেট করা একটি পাঁচ বাই চার মিটার স্ক্রীনের ওপর একটি ডিজাইন জ্বলজ্বল করছে। আঙুলের ইশারায় সেটিকে সরিয়ে আরেকটি লোড করেন। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে পরেরটায় চলে যাচ্ছেন। একের পর এক ডিজাইনে চোখ বুলাচ্ছেন প্রফেসর মোবাশ্বের। তিনটা বাজতেই দরজা ঠেলে প্রবেশ করে তানভির হাসান। পেছনে না তাকিয়েই প্রফেসর বলেন, “তানভির তুমি সিমুলেশনটি সুপার কম্পিউটারে রান কর; আমি ডিজাইনগুলো শেষবারের মতো পরীক্ষা করে আসছি।”

“জ্বি স্যার।” ব্যাটার মাথার পেছনে মনে হয় একটা চোখ সেট করা আছে, মনেমনে খিস্তি দিয়ে উঠে তানভির।

সময় ভ্রমণের সিমুলেশন চলছে। অনেকগুলো ভেরিয়েবলের মান অজানা, সেগুলোকে উহ্য রেখেই চালানো হয়ে এই প্রোগ্রাম। এই ফাঁকে বহ্নির সাথে কথা বলা যেতে পারে। কাল দুপুরের পর আর কথা হয়নি। কী যেন একটা ঝামেলায় পড়েছে, পরিষ্কার করে বলেওনি। কিন্তু তানভিরের মনের ভেতর খচখচ করছে।

মাত্র ওপাশ থেকে বহ্নি বলে, “কী! এতক্ষণ পর আমাকে কল করার কথা মনে হোলো? তোমাকে না গতকাল বলেছিলাম বিপদে পড়তে যাচ্ছি! এই আমার প্রতি তোমার কমিটমেন্ট?” ঠিক তখনই সিমুলেশন রুমে প্রবেশ করেন মোবাশ্বের চৌধুরী। “একটু পরে ফোন দিচ্ছি,” বলেই কলটি কেটে দেয় তানভির। এ কী জ্বালা! বুড়ো কি একটু শান্তিতে প্রেমও করতে দেবে না?

“একটা কোয়ান্টাম কম্পিউটার যোগাড় করতে পারলে কাজের অনেক অগ্রগতি হতো। কিন্তু যে দাম! তাই সেটা পাওয়া যাবে না। আপাতত এই সুপার কম্পিউটারই ভরসা। তোমার সিমুলেশন শেষ হতে তো আরও ঘণ্টা তিনেক সময় লাগবে। ফলাফল কী হবে আমি জানি, গতরাতে আমি নিজেও একবার চালিয়ে ছিলাম একই প্যারামিটার দিয়ে।” কিছুটা হতাশ কণ্ঠে বলেন মোবাশ্বের চৌধুরী।

“তবে কি স্যার আমাদের সময় ভ্রমণ সফল হবে না?”

“এই বিষয়ে একটা মজার একটা ব্যাখ্যা আছে। ইলেকট্রন আবিষ্কারের অনেক আগেই বিদ্যুৎ আবিষ্কার হয় সেটা তো তুমি জানোই। সেক্ষেত্রে কি বিদ্যুৎ নিয়ে আমরা কাজ করিনি? আইনস্টাইন যদি ভর শক্তি বিনিময়যোগ্য এই সমীকরণ না দিতেন তবে কি পারমাণবিক শক্তির বিকাশ ঘটতো না? হয়তো হতো, তবে ভিন্ন পথে। কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট কিন্তু কাজ করে, এটা পরীক্ষিত। কিন্তু এর পেছনের কারণ বা হিডেন ভেরিয়েবলের খোঁজ আমরা এখনও পাইনি। সেক্ষেত্রে বলা যায় সময় ভ্রমণও ঠিকঠিক কাজ করবে, কিন্তু এর পেছনের সকল ব্যাখ্যা ও গণিত আরও পরে আবিষ্কৃত হতে পারে। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?”

“জ্বি স্যার।” তবে তানভির ঠিক ভরসা পাচ্ছে না প্রফেসরের কথায়। “কিন্তু স্যার আপনি তো সময় ভ্রমণের ব্যাপার আমাকে সবকিছু বলেননি এখনও।”

“ও! হ্যাঁ! তাই তো!” লাজুক হেসে প্রতিক্রিয়া জানান প্রফেসর। টেবিলের উপর থেকে একটা কাগজ টেনে তার উপর কিছু আঁকিবুঁকি করেন। চুপ করে তাঁর কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করছে তানভির। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে মোবাশ্বের চৌধুরী বলেন, “দেখ, মনে করে এইটা হচ্ছে একটি ট্রেনের বগি। ট্রেনটি একটি নির্দিষ্ট গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন তুমি যদি আচমকা বগিটির ছাদ ভেদ করে উপরের দিকে বের হয়ে যাও, তাহলে কী ঘটবে?”

স্যারের এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় তানভির। “কী ঘটবে? কী ঘটবে স্যার?”

“গতিজড়তার কারণে তুমিও অল্প কিছুক্ষণ ট্রেনের সাথেসাথে এগিয়ে যাবে। কিন্তু আস্তে আস্তে তোমার গতি কমতে থাকবে। এবং এবার যদি তুমি আবার ছাদ ভেদ করে ট্রেনের ভেতরে চলে আস তাহলে কী হবে?” জবাবের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই উত্তর দেন, “তাহলে তুমি পেছনের বগিতে চলে যাবে! এবার এই বিষয়টা সময়ের তীরের সাথে তুলনা কর। সময় কেবল সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এখন যদি কোনওভাবে স্পেসটাইমের একটা হোল দিয়ে বাইরে চলে গিয়ে আবার ভেতরে চলে আসি, তাহলে ফিরে আসাটা হবে অতীতের কোনও একসময়ে।”

বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে তানভিরের! আমতা আমতা করে বলে, “কিন্তু স্যার, স্পেস-টাইমের এই ফিল্ডে হোল তৈরি করবেন কী করে?”

“আরে এটার জন্যেই তো আমাদের এত তোড়জোড়। তুমি কি ভাবছ ট্রেনের মতো সময়ের বাউন্ডারিও নিরেট কিছু দিয়ে তৈরী? আসলে এটা তো একটা বিমূর্ত বিস্তৃত ক্ষেত্র ছাড়া কিছু না। আমাদের বোঝার জন্যেই কেবল স্থান-কালের চাদর উদাহরণ হিসাবে আনা হয়। ব্যাপারটা সহজ, আমরা একটা এন্টি-ফিল্ড খুব ছোট একটা জায়গায় ঘনীভূত করবো। অনেকটা ড্রিল মেশিনের মতো। তখনই ফিল্ডে একটি হোল তৈরি হবে। আর ওটা দিয়েই ফুড়ুৎ!” ডান হাতে একটা চুটকি বাজিয়ে বিষয়টা কত সহজ সেটাই দেখান প্রফেসর মোবাশ্বের চৌধুরী।

“কিন্তু স্যার?”

তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “বুঝতে পারছি তোমার মনে কী প্রশ্নের উদয় হয়েছে। তুমি ভাবছ এর সাথে শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল, কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট ও প্যারালাল বিশ্বের কী সংযোগ, তাই না?”

বুড়ো ব্যাটা মাইন্ড রিডার না কি? মনে মনে ভাবে তানভির; মুখ ফুটে বলে, “জ্বি স্যার।”

“আরে এখানেই তো চলে আসে হিডেন ভেরিয়েবলের খেলা। যে ভেরিয়েবলের উপর নির্ভর করে অসীম দূরত্বে তথ্য চলে যাচ্ছে কোনও সময় ব্যয় না করেই, যেই ভেরিয়েবলের উপর নির্ভর করে প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টি হচ্ছে প্যারালাল বিশ্ব, সেই ভেরিয়েবলই তো এই সময় ভ্রমণের আসল চবিকাঠি। মনে কর, আমি স্থান-কালের ফিল্ড ভেদ করে অতীতে চলে গেলাম। তখন আসলে কোয়ান্টাম লেভেলে কী ঘটবে জানো? তখন এই সময় ভ্রমণের সফলতার উপর নির্ভর করে দুটি প্যারালাল বিশ্বের সৃষ্টি হবে। একটাতে আমি সফল, আরেকটাতে অসফল।”

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে তানভির।

“এখন এই হিডেন ভেরিয়েবলকে স্থির রাখতে হবে, যদি একই বিশ্বে সময় ভ্রমণ করতে চাই।”

ব্যাপারটা এবার বুঝতে পারে তানভির। কিন্তু পরক্ষণেই তার অন্ধকার নেমে আসে। “কিন্তু স্যার, আমরা তো এখনও সেই হিডেন ভেরিয়েবলটা বের করতে পারিনি।”

“হয়ে যাবে, হয়ে যাবে। এত দুশ্চিন্তা করো না।”

যথারীতি সিমুলেশন ফেইল মেসেজ ভেসে উঠে কম্পিটার স্ক্রীনে। সেদিকে না তাকিয়ে প্রফেসর বলেন, “কাল তো শনিবার। সাপ্তাহিক ছুটি। আমরা দুপুর বারোটায় সময় ভ্রমণের প্রথম ল্যাব টেষ্ট করবো। এই সব সিমুলেশন টিমুলেশন বাদ দাও।”

সমগ্র শরীরের রোম আচমকা খাড়া হয়ে যায় তানভিরের। উত্তেজনার মৃদু মৃদু কাঁপতে থাকে সে। অস্ফুট কণ্ঠে বিড়বিড় করে, “ইতিহাসের প্রথম সময় ভ্রমণ!”

***

টিকটিক করে এগিয়ে যাচ্ছে সময়। প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টি হচ্ছে অসীম সংখ্যক প্যারালাল বিশ্ব। ল্যাবে একমনে কাজ করে যাচ্ছে তানভির। শেষবারের মতো সবকিছু পরীক্ষা করে দেখছেন প্রফেসর। বারোটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে সময় ভ্রমণ যন্ত্রের ঠিক মাঝখানের স্টিলের গোল ফ্রেমটিতে একটি স্টপওয়াচ রাখেন প্রফেসর। টিকটিক করে সেকেন্ডের কাঁটাটি ঘুরে যাচ্ছে বামদিক থেকে ডানদিকে।

কাঁটায় কাঁটায় বারোটায় সুইচ টিপে চালু করে দিলেন সময় ভ্রমণ যন্ত্রের পাওয়ার সাপ্লাই। স্টিলের ফ্রেমটিকে কেন্দ্র করে পাঁচটি সুপার কন্ডাকটার ধীরে ধীরে ঘুরতে থাকে। ঘূর্ণন গতি প্রতিমুহূর্তে বাড়ছে। এবার কৃত্রিম মহাকর্ষবলের সুইচটা চালু করে দেন প্রফেসর। ঘড়িটি কিছুটা উপরে উঠে ভেসে থাকে। সেটিকে কেন্দ্র করে প্রচণ্ড গতিতে ঘুরছে সুপারকন্ডাকটারগুলো, মনে হচ্ছে আগুনের চাকতি যেন।

বাড়তে বাড়তে সর্বোচ্চ গতিপ্রাপ্ত হয় বিশ মিনিটের ভেতর। সব প্যারামিটার পুনরায় পরীক্ষা করে দুজনে মিলে। কিন্তু কোনও পরিবর্তন নেই সেই ঘড়ির। আরও দশ মিনিট পরীক্ষা চালিয়ে বন্ধ করে দেন। তানভিরকে ইঙ্গিতে ঘড়িটি নিয়ে আসতে বলেন।

অনেক সময় নিয়ে ঘড়িটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন দুজনে মিলে। কিন্তু কোনও পরিবর্তন তাদের চোখে পড়ে না। কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু কী হয়েছে সেটি ধরতে পারছেন না। তার হিসাব মতে ঘড়িটি সময়ের দেয়াল ফুড়ে অতীতে চলে যাওয়ার কথা, কিন্তু কিছুই হয়নি! ভীষণ মুষড়ে পড়েন প্রফেসর।

পরের ছয়দিন ল্যাবের প্রত্যেকটি যন্ত্র, পাওয়ার সাপ্লাই, কম্পিউটার সুপার কন্ডাকটার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করেন দুজনে মিলে। কোথাও কোনও ব্যত্যয় চোখে পড়েনি তাদের। তবে কি হিডেন ভেরিয়েবল জানতে হবেই? সেটি ছাড়া সময় ভ্রমণ সম্ভবই নয়?

ডিনার শেষ করা মাত্রই কম্পিউটার রুমে ঢুকবেন, তখনই মিঁয়াউ শব্দ কানে আসে। কী ব্যাপার? এখানে বিড়াল কোথা থেকে এল? টেবিলের নিচে একটি বিড়ালের বাচ্চা, সাদা তুলোর মতো তুলতুল করছে! তার দিকে এগিয়ে এসে পায়ে মাথা ঘষা শুরু করে বিড়ালটি। নিচু হয়ে এটিকে কোলে তুলে নেন প্রফেসর। “হ্যালো! কিটি!” বিড়ালটির মাথায় আলতো হাত বুলাতে থাকেন। মনে হয় তার ক্ষুধা লেগেছে। দ্রুত ফ্রিজ খুলে একটি কৌটার মাছ খেতে দেন বিড়ালটিকে। সে খাচ্ছে, আর গড়গড় করে শব্দ করছে। তখনই প্রফেসর ঠিক করলেন এটির নাম রাখবেন ‘শ্রোডিঙ্গার’।

পরের সপ্তাহে আবার পরীক্ষা! এবারও ব্যর্থ। তারপরের সপ্তাহে আবার! একই ফলাফল। কোথাও বড় ধরণের ঝামেলা হয়েছে। অস্থির হয়ে উঠছেন প্রফেসর দিনদিন। বিষন্ন মনে বসে আছেন ল্যাবে, এমন সময় তানভির হন্তদন্ত হয়ে প্রফেসরের সামনে আসে। তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেন মোবাশ্বের চৌধুরী! এ কী অবস্থা হয়েছে তার? মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমায়নি! চোখ কদম ফুলের মতো বাইরের দিকে ফুলে আছে, টকটকে লাল, নেশাতুর দৃষ্টি।

“স্যার আমাকে আজই দেশে যেতে হবে। বহ্নির পুলিশ বাবা তাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিতে চাচ্ছে। শেষে আমাদের সম্পর্কের কথা তার বাবাকে বলতে বাধ্য হয়েছে। সবই ঠিক ছিলো, কিন্তু আমার তো কোনও বংশপরিচয় নেই, বড় হয়েছি এতিমখানায়। এটাই তার বাবা মানতে চাচ্ছেন না। আমাকে দেশে যেতে হবে, আজই যেতে হবে, স্যার। আজই।” একদমে কথাগুলো বলে লম্বা করে দম ছাড়ে তানভির; উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করছে সে।

তাকে আশ্বস্ত করে প্রফেসর বলেন, “অবশ্যই যাবে, এক্ষুণি যাবে। তোমার যে কোনও সাহায্য লাগলে আমাকে নির্দ্বিধায় জানাবে।” কয়েক বছর আগে হলে বলতেন, “আরে জীবনে কত বহ্নি আসবে! এসব ভেবো না। বিজ্ঞানের সমুদ্রে জলযোগ কর, জলযোগ।” কিন্তু তিনি এখন ভালোবাসার মূল্য বোঝেন, অনেক বেশি মূল্য দিয়ে।

ঐদিন রাতেই ঢাকার উদ্দেশে টেক্সাস ছাড়ে তানভির। একদম একা হয়ে যায় সময় ভ্রমণ ল্যাবে প্রফেসর। না, ঠিক একা নন, শ্রোডিঙ্গার এখন তার একমাত্র সঙ্গী। শ্রোডিঙ্গার!

অধ্যায় সাত
২০৮২, টেক্সাস ইউনিভার্সিটি

যন্ত্রপাতি বেশ পুরনো হয়ে গেছে, জায়গায় জায়গায় রঙ চটে গেছে, কোথাও কোথাও আয়েশ করে জং বাবাজি খেয়ে যাচ্ছেন শম্বুকগতিতে। বেশিরভাগ বদলে ফেলতে হবে আর কিছু আপডেট করে নিলেই চলবে। কন্সট্রাকশনের কাজ আরও একশ বছর টিকবে। পাওয়ার লাইনগুলো একে একে পরীক্ষা করে মাইশা, সুপার কন্ডাকটার, নাহ! সব ঠিক আছে। কেবল মান্ধাতা আমলের সুপার কম্পিউটারের বদলে একটা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কথা বলতে হবে ডিপার্টমেন্টকে।

দু’তিন দিন লেগে যায় শুধু ধূলোবালি পরিষ্কার করতেই। তৃতীয়দিন কিছুটা দম ফেলার সুযোগ হয় মাইশার। থাকার ঘরটি অনেক সময় নিয়ে গুছিয়েছে সে। এই একটা ব্যাপারে তার কিছুটা বাতিক আছে। জানালায় লাগিয়েছে আধুনিক ডিজাইনের চমৎকার ভারী পর্দা, নরম বিছানা আর ঘরের কোণায় কিছু শৌখিন ফুলদানী।

একটু সুস্থির হয়ে ঘরের চারদিকে তাকায়। শৈশবের প্রথম তিনটি বছর বাবার সাথে এখানে কাটিয়েছে, সেসব স্মৃতির কিছুই আপাতত মনে পড়ছে না। এই ল্যাবরেটরি প্রাঙ্গনের প্রতিটি জায়গার লেগে আছে বাবার ছোঁয়া! কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে মাইশা হঠাৎ করে। উদাস বদনে দূরের লেকের দিকে তাকিয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে; হঠাৎ ভয়ানক চমকে উঠে। অন্যমনস্ক ছিলো বলে বেশিই চমকে উঠেছিলো। না হলে একটি বিড়াল ছানা এসে তার পায়ে মাথা ঘষছে এতে এত চমকাবার কী আছে! কোলে তুলে নেয় বাচ্চাটিকে। “হ্যালো, টিনটিন?” আপন মনেই হেসে উঠে, বাবার বিড়ালের নাম ছিলো শ্রোডিঙ্গার, আর সে নাম দিয়েছে টিনটিন।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে এলো, ক্যাম্পাসের এক কোণে নির্জন এই জায়গায় একা থাকতে হবে ভাবতেই গা ছমছম করে উঠে মাইশার। গত তিনদিন কাজের চাপে কিছুই ঠাহর করতে পারেনি। আজ একটু অবসর পেতেই অন্যরকমের এক অনুভূতি গ্রাস করে তাকে। একপাশে লেক, অপরপাশে বড় বড় গাছের জঙ্গল; ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে কান ঝালাপালা হওয়ার যোগাড়! টিনটিনকে পেয়ে ভালোই হলো, বিড়াল হলেও অন্তত একজন সঙ্গী পাওয়া গেল নির্জন এই জায়গায়।

সময় কাটানোর জন্যে কম্পিউটারে বাবার থিওরির ফাইলগুলো খুলে পড়া শুরু করে। অনেক জটিল জটিল সমীকরণ শতশত পৃষ্ঠার আলোচনা। অক্টোপাসের মতো কালো কালো এই সমীকরণের প্রতীক, সংকেত কিছুই মাথায় ঢুকছে না। তবে সে জানে ধীরে ধীরে সবকিছুই তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আর কোথাও সমস্যা হলে প্রফেসর হোয়াইন রোলোস্কি তো আছেনই।

আর গোপনীয় কিছু আলোচনা করার জন্যে তানভির চাচা আছেন। একমাত্র তাকে এখন চোখবন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও যোগ্য কেবল তিনিই আছেন। বারবার কানে বাজছে বিদায়ের সময় তার সাবধানবাণী, “মা, খুব সাবধানে থেকো। গোপনে কোনও একটি সংস্থা মোবশ্বের চৌধুরীর রিসার্চের অন্য ভার্শনটা হাত করার পায়তারা করছে। তুমি এখন এটার মালিক, কী করবে সেটা তোমার একার সিদ্ধান্ত ও দায়িত্ব।”

দেখতে দেখতে দুই মাস পার হয়ে গেছে, ল্যাব পুরোটা আধুনিক যন্ত্রপাতিতে ভরে গেছে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেটাপের কাজও শেষ। পুরনো যেসকল ইকুইপমেন্ট কাজে লাগানো হয়েছে সেগুলোর ক্যালিব্রেশনের কাজও সম্পন্ন হয়ে হয়েছে। কেবল থিওরির ক্ষেত্রে কোনও অগ্রগতি হয়নি।

সপ্তাহে দুই দিন; শুরু আর শেষদিন প্রফেসর রোলোস্কির সাথে থিওরি অগ্রগতি আর এই সপ্তাহের কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ আলোচনা করে মাইশা। আজ প্রফেসরকে কিছুটা বিচলিত মনে হচ্ছে।

“দেখ মাইশা, সময় ভ্রমণ নিয়ে প্রফেসর মোবাশ্বেরের পর আর কেউ তেমন কাজ করতে পারেনি। তার অন্তর্ধানের পর বলতে গেলে এই ফিল্ডে কেউ কাজ করতে আগ্রহীও হয়নি, অল্প কয়েকজন ছাড়া। তারাও অন্ধগলির শেষ প্রান্তে এসে আটকে গেছে। তাই অনেক বছর পর তুমি যখন এই বিষয়ে আগ্রহী হলে আমি রাজি হয়ে গেলাম তোমাকে সুপারভাইজ করতে। তার ওপর তুমি আবার প্রফেসর মোবাশ্বেরের মেয়ে। কিন্তু এভাবে মাসের পর মাস কোনও অগ্রগতি না হলে তো প্রজেক্ট চালিয়ে নেওয়া যাবে না।”

“সে আমি বুঝতে পারছি। আসলে গত পনেরো বছরে এ নিয়ে কোনও জার্নাল বের হয়নি। আমাকে একদম প্রথম থেকে শুরু করতে হচ্ছে। বাবা যে জায়গায় এসে থেমেছিলেন আমাকে সে পর্যন্ত আগে আয়ত্ব করতে হচ্ছে।”

“প্রফেসর মোবাশ্বেরের থিসিসের আরেকটা ভার্সন আছে, সেটা খুঁজে পেলেও কিছুটা কাজ হতো। তুমি কিছু জানতে পেরেছ এই ব্যাপারে?”

“না স্যার। আমার মনে হচ্ছে সেটা একটা মিথ ছাড়া কিছু না।” আরও কিছুক্ষণ আলোচনা চালিয়ে চিন্তিত মুখে স্যারের রুম থেকে বের হয়ে আসে মাইশা। বুঝতে পারে খুব দ্রুত গুছিয়ে নিয়ে আসতে হবে কাজ।

এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ। প্রফেসর রোলোস্কির কাছে মাঝেমাঝে কাজের অগ্রগতি নিয়ে কিছু আশাব্যঞ্জক রিপোর্ট দেয় আর তানভির চাচার সাথে চলে মূল আলোচনা। বাবার সময় সমীকরণের সমাধানে কোথাও একটা ছোট্ট ভুল আছে, না হলে এভাবে সময়ের চোরা স্রোতে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন না।

ঘরে পা দিয়েই মাইশা বুঝতে পারে তার অগোচরে কেউ একজন এসেছিলো এখানে। দৌড়ে ল্যাবের কোনায় রাখা সেফটির দিকে এগিয়ে যায়। খুব সাবধানে পরীক্ষা করে কোথাও আঘাতের চিহ্ন আছে কী না। তারপর অতি সন্তর্পণে কোড প্রবেশ করিয়ে খুলে দেখে ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে! নেই! চুরি হয়ে গেছে বাবার কাছ থেকে পাওয়া ক্রিষ্টাল ডিস্কটি!

অধ্যায় আট
২০৬২, টেক্সাস ইউনিভার্সিটি

শ্রোডিঙ্গারকে কোলে নিয়ে বসে আছেন মোবাশ্বের চৌধুরী, আলতো করে মাথার হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন অবচেতন মনে; গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন। উদ্ভট একটা ধারণা তার মাথায় আসছে, কিন্তু তিনি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। গত এক সপ্তাহে অনেকবার ঘড়ি, টেনিস বল, মার্বেল, আপেল, পাতা ইত্যাদি নানান ধরণের জৈব ও অজৈব বস্তু সময় ভ্রমণ যন্ত্রের ভেতর দিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছেন। কিন্তু কোনও পজিটিভ ফলাফল পাননি। থিওরি মতে এগুলো কয়েকদিন অতীতে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু অতীত তো পরের কথা, বিন্দুমাত্র সরণও হচ্ছে না।

আবার শুরু থেকে সব সমীকরণ একে একে দেখা শুরু করেন। এখনও হিডেন ভেরিয়েবল কী সেটা বের করতে পারেননি। আপাতত এটি ছাড়াই পরীক্ষা চালিয়েছেন, এই কারণেই সফল হচ্ছেন না। ধীরে ধীরে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে তার। গভীর রাত, সকল দ্বিধা ঝেড়ে ল্যাবের ঢুকে একে একে বাতি জ্বালিয়ে চারদিকে আলোকিত করে নেন দ্রুত হাত চালিয়ে। একে একে সব সুইচ টিপে চালু করেন সময় ভ্রমণের যন্ত্র। শ্রোডিঙ্গারকে স্টিলের পাটাতনে রেখে পর্যবেক্ষণ কক্ষে বসেন।

শ্রোডিঙ্গারকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে ঘুরছে সুপার কন্ডাকটার ফ্রেমগুলো। ক্রমাগত বাড়ছে ঘূর্ণনের গতি। সুইচ টিপে চালু করে দেন কৃত্রিম অভিকর্ষ বল। স্টিলের পাটাতন থেকে কিছুটা উপরে উঠে শূন্যে ভাসতে থাকে শ্রোডিঙ্গার। প্রচণ্ড গতিতে ঘুরছে, এখন আর খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না কন্ডাকটারগুলোকে। লিভার টেনে পাওয়ার আরও বাড়িয়ে দিলেন প্রফেসর। আচমকা একটা আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাধিয়ে যায় তার। ধীরে ধীরে গতি কমে থেমে যায় সুপারকন্ডাকটারের ঘূর্ণন। চোখ পিটপিট করে সামনে দিকে তাকান প্রফেসর! নেই! নেই সেখানে সেই শ্রোডিঙ্গার!

চিৎকার দিয়ে উঠেন মোবাশ্বের চৌধুরী! তার অনুমান সঠিক। পেয়ে গেছেন তিনি হিডেন ভেরিয়েবল! মহাবিজ্ঞানী এরোইন শ্রোডিঙ্গার নিজের অজান্তেই তার থিওরিতে দিয়ে গেছে এই হিডেন ভেরিয়েবলের ইঙ্গিত! ওহ! মাই গড! ওহ মাই গড! দ্রুত সমীকরণগুলো নিয়ে আবার বসে যান প্রফেসর। এখন তিনি হিডেন ভেরিয়েবলের রহস্য জানেন। অবিশ্বাস্য! ভাগ্যক্রমে খুঁজে পেয়েছেন দর্শন ও পদার্থবিজ্ঞানের একত্রিকরণ সূত্র! দ্রুত লিখে যাচ্ছেন কম্পিউটারে। দুনিয়ার কোনও কিছুর দিকে তার আর নজর নেই।

সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীনতম শাস্ত্র হচ্ছে দর্শনশাস্ত্র। কখনও কখনও পদার্থবিজ্ঞানের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলেছে আবার কখনও নেমে পড়েছে মুখোমুখি সংঘাতে। মৌলিক যে কয়টি বিষয় নিয়ে এদের বিরোধ; ‘আত্মা’, ‘প্রাণ’, ‘সোল’, ‘রুহ’ কিংবা ‘কনশাসনেস’ যাই বলি না কেন এটি তার একটি। এটি নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানে তেমন কোনও গবেষণা হয়নি। মূল কারণ হচ্ছে, বিজ্ঞান আত্মা নামক অতিপ্রাকৃত এই বিষটিকে অস্বীকার করে এসেছে চিরকাল। একে নিয়ে নাড়াচাড়া করার একমাত্র ভার দিয়ে রেখেছে দর্শনশাস্ত্র কিংবা ধর্মতত্ত্বের হাতে।

অথচ এটিই হচ্ছে প্যারালাল বিশ্ব সৃষ্টি হিডেন ভেরিয়েবল। মহাবিশ্বের ইলেকট্রনের স্পিনের উপর নির্ভর করে প্যারালাল বিশ্বের সৃষ্টি হয় না। এটি সৃষ্টি হয় একটি প্রাণ ‘জীবিত’ কিংবা ‘মৃত’ তার ওপর নির্ভর করে। এরোইন শ্রোডিঙ্গার তার কাল্পনিক বাক্সে বিড়াল কেন দিয়েছিলেন? কেন তিনি একটি বল অথবা একটি আপেলকে রাখেননি? তিনি অবচেতন মনেই একটি প্রাণীকে রেখেছেন, যাতে মৃত বা জীবিত দুটি অবস্থায় দুটি প্যারালাল বিশ্বেই এদের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে।

এই শতাব্দীর শুরুর দিকে গিউলিও টনোনি ও ক্রিস্টোফ কচ কনশাসনেসকে পরিমাপযোগ্য একটি রাশি হিসাবে একটি কনশাসনেস ইন্ট্রিগ্রেটেড ইনফর্মেশন থিওরির কথা আমাদের জানান। তারা ফাই (φ) দিয়ে একে প্রকাশ করেন। তাঁদের থিওরি মতে সকল প্রাণই কনশাস। একটি ব্যাকটেরিয়া, মাছি, তেলাপোকা, ইঁদুর, বিড়াল, মানুষ সকল প্রাণীরই আত্মা বা কনশাসনেস আছে, তবে তা ভিন্ন ভিন্ন লেভেলে।

লেখা থামিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করেন মোবাশ্বের চৌধুরী। এখন একে একে অনেকগুলো পরীক্ষা করতে হবে। এবার ল্যাবে রাখা একটি ইদুরকে সময় ভ্রমণ যন্ত্রে প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষা করেন। ফলাফল নেগেটিভ। তারপর একটি গিনিপিগকে নিয়ে করেন একই পরীক্ষা, ফলাফল পজেটিভ।

তারমানে কনশাসনেসের একক ফাই এর মানের উপর সময় ভ্রমণ নির্ভর করছে! নির্ভর করছে প্যারালাল বিশ্বের উৎপত্তি! কম্পিউটার নিয়ে হিসাব করতে বসে যান পুনরায় প্রফেসর। একে একে ফাই-এর ভিন্ন ভিন্ন মান দিয়ে সিমুলেশন চালান। অবশেষে ফাই-এর ক্রিটিক্যাল মান বের করেন, সর্বনিম্ন যে মানের জন্যে সময় ভ্রমণ সম্ভব। যে মানটিকে ধ্রুবক রেখে সম্ভব প্যারালাল বিশ্বের সৃষ্টি না করে একই বিশ্বের অন্য সময়ে চলে যাওয়া।

সবকিছু ঠিক আছে। এবার তাঁকে আর ঠেকায় কে? তিন বছর অতীতে গিয়ে প্লেনের টিকেট না বদলানোর সিদ্ধান্ত নিতে বলতে হবে নিজেকে! কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব হবে? মনে মনে একটা পরিকল্পনা গুছিয়ে নেন তিনি। বিশেষ কিছু করতে হবে না। কেবল ঐ ট্রাভেল এজেন্সির ফোন কলটা যাতে তাঁকে কানেক্ট করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করলেই তাঁর পরিকল্পনা সফল।

আচমকা মনে পড়ে— আচ্ছা, শ্রোডিঙ্গার তো সময় ভ্রমণ করে অতীতে চলে গিয়েছে। কোথায় আছে সে এখন? হঠাৎ তার মনে একটি সম্ভাবনা জেগে উঠে! ওহ গড! একমাস আগে শ্রোডিঙ্গার ঘরের দরজায় এসে মিউ মিউ করছিলো! তখন বুঝতে পারিনি সে কোথা থেকে এসেছিলো। এখন পুরো ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।

শ্রোডিঙ্গার এখান থেকে একমাস অতীতে চলে গিয়ে আমার সাথে মিলিত হয়েছে। তাই তো সে আমাকে ভয় না পেয়ে পায়ে মাথা ঘষছিলো, যেন কতদিনের চেনা!

অধ্যায় নয়
২০৮২, টেক্সাস ইউনিভার্সিটি

তানভির হাসানের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে আলাপ করছে মাইশা। কোলে টিনটিন। চোখের ওপর চলে আসা চুল বাঁ হাতে সরাতে সরাতে বলে, “চাচা, বাবার ক্রিস্টাল ডিস্কটা সেফ থেকে চুরি হয়ে গেছে।”

“তোমাকে তো আগেই সাবধান করে দিয়েছিলাম এ ব্যাপারে! আশ্চর্য! পুলিশকে জানিয়েছ?”

“নাঃ, তাহলে এটি নিয়ে বেশি হৈচৈ হতো। থিওরির আরেকটা ভার্শন নিয়ে যে কানাঘুষো আছে সেটিই সত্যি হয়ে যেতো। তবে তুমি চিন্তা করো না, আমি আগেই অন্য একটা ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। সে যাক, কাজের কথা আসি। আমার ধারণা, বাবার ক্যালকুলেশনে কোথাও একটা ভুল ছিলো, যার কারণে যখন বাবা টাইম মেশিনে চড়ে বসে তখন কোনও একটা ব্যত্যয় ঘটে। তুমি কি কিছু বের করতে পেরেছ?”

“নাঃ, এখনও কিছু ধরতে পারিনি। ফাই-এর ক্রিটিক্যাল মান নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। সর্বনিম্ন যে মানের জন্যে টাইম ট্রাভেল সম্ভব মনে হচ্ছে সেখানেই একটা গণ্ডগোল হয়েছে।”

“আমারও তাই ধারণা। আচ্ছা, এই যে আত্মা বা কনশাসনেসের একক ফাই-এর সাথে প্যারালাল বিশ্ব সৃষ্টি হওয়া এবং এর সাথে সময় ভ্রমণের সংযোগ— এই বিষয়টা কি তুমি ভালো মতো বুঝেছ? এটা না বুঝলে কিন্তু তুমি এই রহস্যের কূলকিনারা করতে পারবে না।”

“কিছুটা বুঝেছি, অনেক বিষয় এখনও ধোঁয়াশা। ঠিক আছে, আমি যা বুঝেছি সেটা তোমাকে ব্যাখ্যা করছি। কোথাও ভুল হলে শুধরিয়ে দিও।” উৎফুল্লভাবে বলে মাইশা।

“কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট পরীক্ষিত সত্য। দুটি বস্তুকে যদি কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্টের আওতায় এনে অসীম দূরত্বে রাখা হয়, তবুও এদের একটির সাথে আরেকটির অদৃশ্য যোগাযোগ থাকে। এই যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ধরে নেওয়া হয় হয়তো কোনও হিডেন ভেরিয়েবল কাজ করে যেটা আলোর চেয়ে বেশি গতিশীল। এখন এই হিডেন ভেরিয়েবলে বিষয়টা প্যারালাল বিশ্ব সৃষ্টির সাথেও সম্পর্কযুক্ত। একজন মানুষ যেই মুহূর্তে মারা যায়, তখন ঠিক আরেকটি প্যারালাল বিশ্বে সে বেঁচে থাকে। এখানে বাবার থিওরি মতে আত্মা হচ্ছে সেই হিডেন ভেরিয়েবল। এখন এই হিডেন ভেরিয়েবলকে ধ্রুবক রেখে স্থান-কালের ফিল্ডকে ছেদ করে গেলে তখন আর প্যারালাল বিশ্বের সৃষ্টি হবে না। কারণ সেই আত্মাটি জীবিতও না মৃতও না, সে তখন স্থান-কালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখন কাল বা সময় একটি প্রবাহমান এনটিটি। যে মুহূর্তে আত্মাটি স্থান-কালের বাইরে চলে গেল, তখন আমাদের এই বিশ্বের কাল তখনও গতিশীল। তাই বাউন্স করে যখন আবার এই স্থান-কালের ফিল্ডে ঢুকবে, তখন সে অতীতে চলে যাবে।”

“হুম, তোমার বোঝায় কোনও ভুল নেই। আরেকটা বিষয়, মনে করো মোবাশ্বের স্যার অতীতে চলে গেছেন, সেখান থেকে ফিরবেন কী করে? এমনটাও তো হতে পারে তিনি এখনও অতীতেই আছেন, আমাদের সময়ে ফিরতে পারছেন না?”

“এটা ভেবেছিলাম, অতীতের কোনও সময়ে গিয়ে থাকলে সেখানে এমন আরেকটি টাইম মেশিন বানিয়ে একইভাবে আবার এই সময়ে ফিরে আসতেই তো পারেন, তাই না?”

“কিন্তু সেক্ষেত্রে অতীতের সেই সময়ে যখনই আবার স্থান-কালের ফিল্ডকে ছেদ করে বাইরে যাবে তখন থেকে তো আরও অতীতে চলে যাবে, ভবিষ্যতে কী করে আসবে?”

“এক্ষেত্রে ব্যাপারটা বাবার বলা সেই ট্রেনের মতো করে ব্যাখ্যা করা যায়। মনে করুন একটি ট্রেন সামনে দিকে চলছে। কেউ ছাত ফুটো করে বাইরে চলে গিয়ে ভেসে থাকলো। গতি জড়তার কারণে কিছুক্ষণ সে উপরে ভেসে থাকা অবস্থায়ও ট্রেনের সাথে সমবেগ বজায় রেখে চলবে। কিন্তু ধীরে ধীরে তার গতি কমে আসতে থাকবে। আরও কিছুক্ষণ পর ট্রেনটির পেছনের বগিটি তার ঠিক নিচে চলে আসবে। এখন যদি সে পুরনরায় ছাদ ফুটো করে ভেতরে ঢুকে পড়ে তাহলে সে সামনের বগি থেকে পেছনের বগিতে চলে এসেছে। এটাই তো অতীত সময় ভ্রমণের মূল তত্ত্ব?”

“হুম, সঠিক পথেই আছ, বলে যাও।”

“এখন কেউ যদি ছাদ ফুটো করে ছাদের উপর ভেসে থেকে সেখানে একটি থ্রাস্ট দিয়ে আরও সামনে দিকে এগিয়ে গিয়ে সামনের বগিতে ঢুকে পড়ে? এভাবে তো ভবিষ্যত ভ্রমণও সম্ভব!”

“হুম”, চিন্তিত মুখ করে কিছু একটা ভাবছেন তানভির হাসান। আঙ্গুল দিয়ে টেবিলের উপর ঠকঠক করে টোকা দিচ্ছেন নিয়মিত ছন্দে। নীরবতা ভেঙ্গে বলেন, “এখানে একটা ঝামেলা আছে। ভবিষ্যত তো অনিশ্চিত ও অনির্ধারিত। সেক্ষেত্রে হয়তো দেখা যাবে ট্রেনের একেবারে প্রথম বগিতে আমরা আছি, সামনে আরও কোনও বগি নেই যে লাফিয়ে সেটাতে চলে যাব। এই সমস্যাটা কি বুঝতে পারছ?”

“জ্বি, এটা বুঝতে পারছি। এখানে একটা এনোমালি আছে, এটা নিয়ে আরও ভাবতে হবে।”

“ঠিক আছে, আর সাবধানে থেকো। সম্ভব হলে সব জায়গায় সিসি ক্যামেরা সেটাপ করে নিও।”

টিনটিনকে খাবার খাইয়ে বিছানায় শুয়ে মনে মনে সময় ভ্রমণের সমীকরণগুলো উল্টে পাল্টে দেখছে মাইশা। একজন মানুষ যখন একটি বিশ্বে মারা যায় যায়, তখন দুটি প্যারালাল বিশ্বের সৃষ্টি হয়; যার একটিতে মানুষটি বেঁচে আছে আরেকটিতে সে বেঁচে নেই। যে বিশ্বটিতে মানুষটি বেঁচে আছে সেখানে যখন সে আবার মারা যায় তখন তার উপর নির্ভর করে আরও দুটি বিশ্বের সৃষ্টি হয়, একটাতে সে বেঁচে আছে আর অপরটিতে মারা গেছে। এভাবেই এই প্রক্রিয়া অসীম পর্যন্ত চলতে থাকে। এটার উপর নির্ভর করে বাবা ধরে নিয়েছেন, প্যারালাল বিশ্ব অসীম। তার অবচেতন মন বলছে এখানে একটা ভুল আছে, কিন্তু সেটা সে ধরতে পারছে না।

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই মাইশার। ভোর রাতে ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে। রীতিমত ঘামছে সে। চিন্তার ঝড়ে মনে হচ্ছে ব্রেনের নিউরোনগুলো ছিঁড়ে যাবে, মনে হচ্ছে শরীরের সকল রক্ত মাথায় এসে চাপ দিচ্ছে। “ভুলটা ধরতে পেরেছি! মাই গড! আমি জানি বাবা এখন কোথায় আছে!” আর্তচিৎকার বের হয়ে আসে মাইশার গলা চিরে।

অধ্যায় দশ
২০৮২, টেক্সাস ইউনিভার্সিটি

আড়চোখে তাকিয়ে দেখে রাত একটা বেজে দশ। বিছানা থেকে নেমে এলোমেলো পা ফেলে ল্যাবের দিকে এগিয়ে যায় মাইশা। দ্রুত হাতে কতগুলো ইনপুট দেয় কোয়ান্টাম কম্পিউটারে। আধা ঘণ্টা পর সিমুলেশনের ফলাফল দেখে চোখ কপালে উঠে যায় তার। দেরী না করে কল করে তানভির হাসানকে।

“এত রাতে?”

“চাচা আমি জানি বাবার কী হয়েছে।” অন্য কোনও কথা না বলে চিৎকার করে উঠে মাইশা, রীতিমত হাঁপাচ্ছে সে উত্তেজনায়।

গম্ভীর কণ্ঠে তানভির হাসান বলেন, “তুমি শান্ত হয়ে সব খুলে বল আমাকে।”

“বাবা ভুল করেছিলেন প্যারালাল বিশ্বের মান অসীম ধরে। ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করুন, একজন মারা গেল সাথে সাথে প্যারালাল আরেকটি বিশ্বের সৃষ্টি হলো যেখানে সে জীবিত। কিছুদিন পর ঐ বিশ্বে সে মারা গেলো। তখন ঐ বিশ্বের সেই ইভেন্টের উপর নির্ভর করে আরেকটি বিশ্বের সৃষ্টি হলো যেখানে সে বেঁচে আছে। এভাবে প্রতিটি জীবিত বিশ্বে তার বয়স বাড়তে থাকবে। একসময় এর শেষ বিন্দুতে কী হবে বুঝতে পারছেন?”

চমশা খুলে খালি চোখে উপরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে হিসাবটা মিলাতে থাকেন তানভির হাসান।

তাকে ভাবনার সময় না দিয়ে মাইশা বলে চলে, “এভাবে চলতে চলতে একসময় আসবে যখন মৃত্যুর সাথে সাথে আরেক বিশ্বের সৃষ্টি হবে, সেখানেও সাথে সাথে সে মারা যাবে। আমি হিসাবে করে দেখেছি এই সময়ের ব্যবধান প্ল্যাঙ্ক সময়ের সমান হলে আর কোনও প্যারালাল বিশ্বের সৃষ্টি হবে না। তখন তার আত্মার কী হবে আমি জানি না। হয়তো পরম শক্তির সাথে মিলিয়ে যাবে।”

“পরম শক্তি বলতে কি তুমি ঈশ্বরকে বোঝাচ্ছ?”

কিছুটা দ্বিধান্নিত কণ্ঠে মাইশা জাবাব দেয়, “অনেকটা তাই। ব্যাপারটা এখনও পুরোটা বোধগম্য হচ্ছে না।”

“তুমি কি জান তোমার কথা অনেকটা সনাতন ধর্মের জন্মান্তরবাদ তত্ত্বের মতো শোনাচ্ছে?”

“এখনও পুরোপুরি ঠিকঠাক মতো বুঝে উঠতে পারিনি ব্যাপারটা। তবে কাছাকাছি হতে পারে। কিন্তু জন্মান্তরবাদ তো একজন মারা গেলে তার পূণর্জন্ম হয়। এভাবেই চলতে থাকে যতক্ষণ না সেই আত্মার সিদ্ধি প্রাপ্তি হয়? আর এখানে তো…!”

“নাঃ, আমি বলছি না যে এমনটাই হবে— তো তুমি যেন কী বলছিলে? প্রফেসর মোবাশ্বের স্যার কোথায় আছেন এই মুহূর্তে?”

“বাবা ধরে নিয়েছিলেন প্যারালাল বিশ্বের এই সৃষ্টি অসীম পর্যন্ত চলবে। অসীমকে ধরে আত্মার ফাই-এর মান নিয়ে যে স্পেস-টাইম ফিল্ডের ফুটো তৈরি হবে সেটা অতীতে না গিয়ে স্থানহীন-সময়হীন মাত্রায় গিয়ে খুলবে। বাবা এখন তেমন একটি পরম শূন্য অবস্থায় আছেন। যদি সসীম মান সেট করে টাইম মেশিন চালু করতেন তবে এক ধাক্কায় অতীতে গিয়ে পড়তেন। আমি সিমুলেশন করে দুইটা অবস্থার ফলাফলই পেয়েছি!

“স্যার এই ভুল কীভাবে করলেন!” কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে তানভির হাসানের।

“শেষ সময়ে বাবা বেশ অস্থির ছিলেন সময় ভ্রমণ পরীক্ষাকে সফল করার জন্যে। সেই কারণে হয়তো বিষয়টা তাঁর নজর এড়িয়ে গেছে।”

মাইশার কন্ঠে কিছু একটা ছিলো। স্ক্রীনের দিকে ঝুঁকে এসে তানভির হাসান বলেন, “তুমি কি কিছু করার কথা ভাবছ?”

মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে মাইশা। চোখ ছলছল করে উঠে, কণ্ঠ ধরে আসে তার। নিচু স্বরে বলে, “বাবা সেই পরম শূন্যস্থানে কি অসীম অন্তহীন চিরঞ্জীব হয়ে বেঁচে আছে! তাকে বাঁচাতে আমি যাব না?”

বাকরুদ্ধ হয়ে যায় তানভির হাসান; তার বুঝতে সমস্যা হয় না যে মাইশাকে আর আটকানো যাবে না। বরং সে যেন নিরাপদে প্রফেসরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারে সে ব্যাপারে সাহায্য করা উচিত। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলেন, “তুমি কী করতে চাচ্ছ?”

“আমি টাইম মেশিনে চড়ে যাব সেই সময়হীন-স্থানহীন সেই শূন্য মাত্রার জগতে। টাইম মেশিনের পাওয়ার অন থাকবে। আমি গিয়ে বাবাকে নিয়ে আসব।”

“একটা বিষয় কিন্তু এখনও আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। স্যারের বিড়াল, শ্রোডিঙ্গার কিন্তু সময় ভ্রমণ করে অতীতে গিয়েছিলো। তাহলে স্যারের ক্ষেত্রে এমন কেন হবে?”

“শ্রোডিঙ্গার হয়তো অতীতে যায়নি। সেও হয়তো এখন বাবার সাথেই আছে। এটাও বাবার ভুল করার আরেকটা কারণ। শ্রোডিঙ্গার প্রথমে ভবিষ্যত থেকে আসেনি। সেই হয়তো এমনিতেই ক্যাম্পাসের আশেপাশের কোথাও থেকে এসেছিলো। আর বাবা যখন তাকে টাইম মেশিনের চড়িয়ে দেয় আর সে শূন্যে মিলিয়ে যায়, তখন বাবা ভেবে নিয়েছিলেন সে হয়তো একমাস অতীতে গিয়ে তার সাথে মিলিত হয়েছে।”

সময় কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একে একে টেকনিক্যাল সব বিষয় নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা হয় তাদের ভেতর। তানভির কিছু উপদেশ দেয়, নিরাপত্তার বিষয়টা আরও ভালো করে ভেবে দেখে। ঠিক হয় সাতদিন পর মাইশা টাইম মেশিনে চড়ে বসবে, ভ্রমণ করবে পরম শূন্য কোনও স্থানে।

কেমন আছে বাবা সেখানে? কী অবস্থায় আছে? আমাকে এত বছর পর দেখে চিনতে পারবে? বাবার কি বয়স বেড়েছে? মনে হয় না, সেখানে সময় বলতে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। এন্ট্রপি নেই, কোনও পরিবর্তন নেই। চির স্থির; চির অপরিবর্তনীয়! বাবাকে উদ্ধার না করলে সেখানে আমাকে থাকতে হবে অনন্তকাল। উফ্‌! কী নির্মম সে বেঁচে থাকা; কী অসহ্য সে অস্তিত্ব!

অধ্যায় এগারো
২০৮২, টেক্সাস ইউনিভার্সিটি

আলোর একটা ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় মাইশার। কয়েক মুহূর্ত চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি পরিষ্কার করে সে। কতক্ষণ সময় পার হয়েছে? কয়েক সেকেন্ড? না কি সহস্র বছর? তার অস্তিত্ব কি বিদ্যমান? সে কি বেঁচে আছে?

অদৃশ্য একটি কণ্ঠ ডেকে উঠে, “আমি জানতাম তুমি আসবে।”

“কে? কে? বাবা?”

চতুর্দিক থেকে কণ্ঠটি ভেসে আসে, “আমি এই বিশ্বের ঈশ্বর!”

বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় মাইশার। হাত দুটো চোখের সামনে তুলে পরীক্ষা করে মাইশা, মুখে চোখে বুলোয় আলতো করে। ফিসফিস করে বলে, “ঈশ্বর? আমি কি তবে মরে গেছি? আমি কি সত্যিই তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি? না কি আমার মস্তিষ্কের কল্পনা?”

আচমকা চোখের সামনে ভেসে উঠে একটি হালকা অবয়ব, মানুষের আকৃতি ধারণ করে সেটি ধীরে ধীরে! “বাবা!” আর্তচিৎকার বের হয়ে আসে মাইশার গলা চিরে! সেই চিৎকার যেন নিজের কানেই বারবার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে ফিরে আসে।

মুহূর্তেই আবেগকে সংযত করে সে বলে, “বাবা, আমাদের জলদি ফিরতে হবে।” তাগাদা দেয় মাইশা। স্পেস-টাইমের ফুটো আদৌ এখনও আছে কি? মনে মনে ভাবে মাইশা। কত সময় পার হয়েছে?

“নাঃ! আমি এই বিশ্ব ছেড়ে যেতে পারি না। ঈশ্বর কি তার মহাবিশ্ব ছেড়ে যেতে পারে?”

“কী বলছ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”

“আমার সময় সমীকরণে ভুল ছিলো। আমি ভেবেছিলাম যখন স্থান-কালের ফুটো দিয়ে বাইরে চলে আসবো তখন অতীতে গিয়ে পড়বো। কিন্তু নাঃ! স্থান-কালের বাইরে বলে কিছু নেই। পরম শূন্যস্থান বলে কিছু নেই! যেই মুহূর্তে আমি স্থান-কালের বাইরে চলে আসি ঠিক সেই মুহূর্তে এখানে আরেকটি বিগব্যাং সংঘটিত হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে আরেকটি মহাবিশ্ব। কোনও প্যারালাল বিশ্ব এটা নয়, একেবারে মহাবিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট জলজ্যান্ত একটি মহাবিশ্ব। আমাদের স্থান-কালের ভেতর আরেকটা বাবল বিশ্ব! যেহেতু আমি সেই বিগব্যাং তৈরি করেছি, আমার সত্তাই হয়ে গেছে এই বিশ্বের ঈশ্বর! এই বিশ্ব ছেড়ে আমি যেতে পারবো না। প্রকৃতির নিয়ম ভাঙার এটা আমার প্রায়শ্চিত্ত! তবে আমি এখানে আমার মনের মতো করে একটি পৃথিবী বানিয়ে নিয়েছি। এই দেখ।” বলেই হাত উঁচিয়ে কিছু একটা ইঙ্গিত করেন প্রফেসর মোবাশ্বের চৌধুরী।

অদৃশ্যের ভেতর হঠাৎ করেই যেন দৃশ্যমান হয়ে উঠে একটি বাড়ি— সামনে বাগান, সেখানে খেলা করছে ছোট্ট মাইশা। নিজেকে দেখেই চিনতে পারে সে। পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছে মোবাশ্বের চৌধুরী ও নিপুণা। মাইশার মা!

কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠে মাইশার, সামনে দাঁড়িয়ে বাবা, ঐখানে মা! দুজনের কারও স্মৃতিই তার কাছে নেই। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকায় সে। অস্ফুট কণ্ঠে বলে, “তাহলে আমি কেন এমন একটা বিগব্যাং সৃষ্টি না করে এই জায়গায় চলে এসেছি?”

মৃদু হেসে প্রফেসর বলেন, “তোমার আত্মা আমার আত্মার অংশ! আর তোমার আগমনের জন্যে আমি এই বিশ্বের সংযোগ খুলে দিয়েছি। আমি এই বিশ্বের সর্বশক্তিমান। অন্য কেউ হলে তার পরিণতি আমার মতোই হোতো। যদি ব্যাখ্যাতীত কিছু ঘটে যায় সেই কারণেই আমি চেয়েছিলাম কেবল তুমিই যেন এই পরীক্ষা কর, অন্য কেউ নয়। তাই সবকিছুর ব্যাখ্যা দিয়ে একটি ডিস্কে রেকর্ড করে তানভিরের বাংলাদেশের ঠিকানায় মেইলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ও ভালো কথা, ডিস্কের ব্যাপারটা আর কেউ জানে না তো?”

“নাঃ। তবে আমার ল্যাব থেকে কয়েকদিন আগে সেটি চুরি হয়ে গেছে।” মুহূর্তক্ষণ থেমে মুচকি হেসে বলে, “তবে তার আগে ঐটাতে তোমার রিসার্চের আগের ভার্সন কপি করে সব ডাটা এটাতে রেখে দিয়েছিলাম”, বলেই গলায় ঝুলানো ছোট গ্লোব আকৃতির লকেটটা হাত দিয়ে ধরে দেখায় মাইশা।

দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর মাইশা বলে, “আমাদের বিশ্বেও কি এমনি কোনও ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে?”

“সেটা আমি জানি না মা। এই বিশ্বের বাইরে কোনও কিছুর ব্যাপারে আমার জ্ঞান নেই।”

এবার আর চোখের জল বাধ মানে না। হু হু করে কেঁদে উঠে মাইশা। “আমি কি তবে তোমাকে ফিরিয়ে নিতে পারবো না?”

“না। এই বিশ্ব ছেড়ে যাওয়ার কোনও ক্ষমতা আমার নেই। তোমার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। যে কোনও সময় টাইম মেশিন বন্ধ হয়ে যাবে আর ঐ ফুটো মিলিয়ে যাবে। বিদায়, মা। বিদায়।” হাত ঊর্ধ্বে উঁচু করে ধরেন প্রফেসর।

“এক মিনিট দাঁড়াও, শেষ প্রশ্ন। তোমার বিড়াল শ্রোডিঙ্গার কোথায় তাহলে?”

“সেও এমনি কোনও মহাবিশ্বের ঐশ্বরিক বিড়াল হয়ে বেঁচে আছে, থাকবে অনন্তকাল।”

ধীরে ধীরে চোখ খোলে মাইশা; সেই চোখ বেয়ে এখনো জল ঝরছে। দরজায় দাঁড়িয়ে টিনটিন; সেও ম্যাঁও ম্যাঁও করে কাঁদছে, অকারণেই।