AU REVOIR - সায়ন্তনী পলমল ঘোষ

উপন্যাস
পূর্বকথা

স্বচ্ছ দেওয়ালের ওপারে তাকিয়ে ছিলেন দীর্ঘকায় পুরুষটি। হাজার হাজার জোনাকির মত আলোকরাজিতে সেজে উঠেছে রাতের শহর। আকাশে হাজার হাজার নক্ষত্ররাজি নিশ্চিন্তে বিশ্রামরত। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটো বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মাথার মধ্যে অনেক হিসেব নিকেশের কাটাকুটি আর কান দুটো সজাগ হয়ে শুনছে ঘরের মধ্যে উপস্থিত দ্বিতীয় ব্যক্তির কথা। কথা না বলে পরিকল্পনা বলাই ভালো। কথা শেষ করে দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রথম ব্যক্তির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হয়ত তাঁর মনের খবর বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। কয়েক মুহূর্ত পর প্রথম ব্যক্তি দ্বিতীয় ব্যক্তির দিকে ফিরে তাকালেন। মুখে ব্যঙ্গাত্মক হাসির আভাস।

“হাসছ কেন?” দ্বিতীয় ব্যক্তি কিঞ্চিৎ বিরক্ত।

“তোমার পরিকল্পনা শুনে।”

“এতে হাসির কী হল?” দ্বিতীয় ব্যক্তি এবার কিছুটা রাগত স্বরে বলল।

“পর্বতের মূষিক প্রসব কথাটা শুনেছ?”

“হুম।”

“তোমার প্ল্যানটা অনেকটা সেইরকম।” প্রথমজনের ঠোঁটে বাঁকা হাসি।

“মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?” কিছুটা চেঁচিয়ে উঠল দ্বিতীয় ব্যক্তি।

“তোমার যা প্ল্যান তার জন্য লটারী করে কয়েকটা সাধারণ মানুষ আই মিন কমন পিপল চুজ করে নিলেই হয়। এই প্ল্যানের জন্য তুমি মানুষ খুন পর্যন্ত করলে! ভাবলেই তোমার প্রতি করুণা হচ্ছে আমার।”

এবার দ্বিতীয় ব্যক্তি কিছুটা হতভম্ব, “তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ পরিষ্কার করে বল। আমি বুঝতে পারছি না।” প্রথম ব্যক্তির চোখে বুদ্ধি আর ধূর্ততার মিশেল। প্রখর দৃষ্টিতে দ্বিতীয় ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে বললেন, “ইউ নো ড্যান, আমি কখনও ঠুকে ঠুকে এক, দুই মারি না। আমার ব্যাট চললে বল গ্যালারিতে পড়ে। যেখানে আমার কোনও ইনভলভমেন্ট থাকবে সেখানে সবকিছু অন্যরকম হবে, আই মিন সবার চেয়ে আলাদা, একদম অন্য ধরনের কিছু।”

“আমি তো সেটাই...।”

“নো, তোমার প্ল্যানটা অনেকের নতুন বোতলে পুরোনো মদ ভরার মত। বাইরেটা দেখে ইন্টারেস্ট হবে কিন্তু ভেতরের জিনিসের স্বাদ সেই পুরোনো। আমি চাই মদ আর বোতল দুটোই নতুন হবে।” চোখ দুটো চকচক করে উঠলো প্রথম জনের।

“তাহলে তুমি কী করতে চাইছ?”

“খেলার রাশ আমার হাতে দিয়ে দাও। তারপর দেখো কী হয়।”

“আমার প্ল্যান না হয় রদ্দি, তোমার প্ল্যানটা কী, জানতে পারি?”

“অবশ্যই। তাহলে শোনো।”

দীর্ঘ কথোপকথনের পরে ড্যান প্রায় লাফিয়ে উঠল, “ওয়াও, হোয়াট অ্যান আইডিয়া। আমি তোমার সব শর্তে রাজি। সামনে থেকে খেলবে তুমি। আমি শুধু তোমাকে ব্যাক আপ সাপোর্ট দিয়ে যাবো।”

“তুমি টাকার তলায় চাপা পড়ে যাবে ড্যান তাই কিছু টাকা আমার গদি বানাতে দিও।” ভ্রু নাচিয়ে বললেন প্রথম জন।

“সেটা তো অনেক আগেই বলেছি।” ড্যানের চেহারায় তৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট।

“সো দ্য গেম স্টার্টস নাও। AU REVOIR।” প্রথম ব্যক্তি বাইরের রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলেন।

সাল ১৯৩৩

প্রমথ কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তলটায় একবার হাত বোলাল। উঠোনে একফালি চাঁদের মরা আলো। পরপর তিনজন কুখ্যাত ইংরেজ শাসক পেডি, ডগলাস আর বার্জ নিহত হওয়ার পর থেকে ইংরেজ শাসকরা মেদিনীপুরে বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে মেদিনীপুরের ছেলেরাও কম যায় না। তারা দেশের স্বাধীনতার জন্য কোনও কিছুর পরোয়া করে না। নিজের প্রাণও তাদের কাছে তুচ্ছ। প্রমথ এমনই একজন। আপাতত তাদের বিপ্লবী দলের নেতা বরুণদার নির্দেশে এই প্রায় পোড়ো বাড়িটায় আত্মগোপন করে আছে। বরুণদার নির্দেশ পেলেই আবার অ্যাকশন শুরু হবে। প্রমথর কেমন একটা সন্দেহ হচ্ছে। উঠোনের ঐদিকের ভাঙ্গা পাঁচিলের দিকে কেউ একজন আছে। পিস্তলটা কোমর থেকে বের করে এগিয়ে গেল প্রমথ। ইংরেজ পুলিশের চর হলে আজ তার রক্ষা নেই।

সাল ১৯৬৩

প্যাকিং শেষ করে কফির মগটায় চুমুক দিলেন মেজর ইশতিয়াক খান। শেষ হয়েছে ভারত-চীন যুদ্ধ। কাল কতদিন পর আবার লাখনৌয়ের ট্রেনে উঠবেন। সেখানে অপেক্ষায় আছে তাঁর পরিবার। বাবা, মা, ভাই, বোন আর তাঁর ভালোবাসার মানুষ রেহানা। ইশতিয়াক অবশ্য সবচেয়ে অপেক্ষায় আছেন তাঁর ছোট্ট গুলকে দেখার জন্য। যাকে জন্মের পর থেকে তিনি দেখেননি। তিনি যখন দেশের জন্য শত্রুপক্ষের সঙ্গে লড়াই করছিলেন তখন পৃথিবীর আলো দেখেছে তাঁর কন্যাটি। এবারে বাড়ি ফিরে প্রথমবার দেখবেন নিজের আত্মজাকে। নিজের খেয়ালে ডুবে ছিলেন ইশতিয়াক হঠাৎ মনে হল বাইরে অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে। মুহূর্তের মধ্যে সৈনিকের স্নায়ু সজাগ হয়ে উঠলো। বাইরে বেরিয়ে এলেন ইশতিয়াক।

সাল ১৯৮৩

রবির সারা গায়ে ঘাম পিছলে যাচ্ছে। আজকে একদম টানটান ম্যাচ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিন-দুই গোলে ওদের দল যে জিতেছে তাতে রবির কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি। শুধু যে নিজে গোল করেছে তাই নয় বলতে গেলে একলাই ওদের স্কুলের দলকে টেনেছে। বন্ধুরা ওকে বলে ফুটবলার হতে। রবিরও স্বপ্ন তাই। ফুটবল, শরীরচর্চা এগুলো ওর নেশা। দল বেঁধেই বাড়ি ফিরছিল সবাই। একটা সময় যে যার বাড়ির পথ ধরতেই রবি একলা হয়ে গেল। সন্ধ্যে নেমে গেছে অনেকক্ষণ। রবিও বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। মোহন চাচাদের বাড়ির পেছনে অন্ধকারের মধ্যে ওটা কী?

সাল ১৯৯৩

পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসছিল জোস। ওপরের চার্চে গিয়ে ফাদারের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে এল সে। মাঝে মাঝেই যায়। ফাদার যেমন ভালো মানুষ তেমনি ওনার পড়াশোনাও প্রচুর। ওনার সঙ্গে গল্প করা মানে নিজে সমৃদ্ধ হওয়া। জোস অনেক স্বপ্ন নিয়ে মুম্বাই ছেড়ে হিমালয়ের কোলে এই ছোট্ট পাহাড়ী শহরের কলেজে পড়ানোর চাকরিটা নিয়ে চলে এসেছে। ওর ইচ্ছে এখানে একটা এন জি ও খুলবে। তারপর আশেপাশের যে ছোট ছোট গ্রামগুলোতে এখনও ভালো করে শিক্ষার আলো পৌঁছয়নি, ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই তাদের সাহায্য করবে। তাদের উন্নতি করবে। ফাদার যেমন মানুষের ধর্ম পরিচয়ের উর্দ্ধে গিয়ে সবার পাশে দাঁড়ান। সেও তেমনি করবে। বাবা-মা এবং প্রভু যীশুর আশীর্বাদ তার চলার পথের পাথেয়। নিজের ছোট্ট কোয়ার্টারের গেট খুলে ভেতরে ঢুকলো জোস। পাহাড়ী এলাকায় ঝুপ করে অন্ধকার নেমে যায়। বাগানের ওদিকে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে।

সাল ২০০৩

“আচ্ছা, তুই আমার সাথে এত ঝগড়া করিস কেন রে?”

“কী বললি আমি তোর সাথে ঝগড়া করি! মিথ্যেবাদী, পাজির পা ঝাড়া কোথাকার।” আইভি চোখ পাকিয়ে তেড়ে গেল অরিত্রর দিকে।

“এই গালি দিবি না একদম। ভালো হবে না বলে দিচ্ছি কিন্তু।”

“কী করবি রে তুই?”

দুই বাল্যবন্ধুর এরকম খুনসুটি চলতেই থাকে। সেই ছোটবেলা থেকেই যত ভাব তত আড়ি দুজনের। এইরকম করে কেটে গেছে অনেকগুলো বসন্ত। শৈশব, কৈশোর পার করে যৌবনে এসেও বদলায়নি তারা। দুজনের ভালো লাগার বিষয়টাও এক। ইতিহাস আর ভারতীয় পুরাণ নিয়ে দুজনে যখন আলোচনা করতে বসে তখন গুরুগম্ভীর বিষয় দিয়ে শুরু হয়ে তর্কে গিয়ে শেষ হয়। সম্প্রতি দুজনেই চাকরী পেয়ে যাওয়ায় চাপমুক্ত হয়ে ঝগড়াঝাঁটিটা আরও মন দিয়ে করতে পারছে দুজনে। আইভির বাবার দুজন সহকর্মী আসায় বাবা-মা তাদের আপ্যায়ন করছেন । ভাই পড়াশোনায় ব্যস্ত। আইভির রুমে তাই দুই বন্ধু প্রাণ খুলে ঝগড়া করছিল। হঠাৎ চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার নেমে এল। লোডশেডিং হয়েছে। এখনও ঘরে ঘরে ইনভার্টার আসেনি। মুখে কিছু না বললেও আইভির মনে হল ঘরের আবহাওয়াটা যেন অন্য রকম লাগছে। সে আন্দাজে সামনের চেয়ারে বসা অরিত্রর হাতটা চেপে ধরল।

সাল ২০১৩

ডাক্তার বড়ুয়া ক্লান্ত শরীরে ইজিচেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলেন। আজ অমানুষিক পরিশ্রম হয়ে গেছে। বাড়িতেও আবার কেউ নেই সবাই বিয়েবাড়ি গেছে। শরীরটা আর টানছে না কিন্তু কিছু করারও ছিল না। সিজন চেঞ্জের এইসময়টায় সবার রোগ অসুখ হচ্ছে। ডাক্তাররা যদি মুখ ঘুরিয়ে নেন তাহলে সাধারণ মানুষগুলো কী করবে। টেবিল ল্যাম্পটা অফ করে চোখ বন্ধ করলেন ডাক্তার বড়ুয়া। খানিক পরে কেমন একটা অস্বস্তি অনুভূত হল তাঁর। নাহ, টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালতে হবে।

সাল ২০১৯

“নিয়ে যাও এদের।” কনস্টেবলরা অপরাধী দুজনকে হাতকড়া পরিয়ে জীপের দিকে টেনে নিয়ে চলল। পৃথা পকেট থেকে ফোনটা বের করে ওপরমহলে জানিয়ে দিল যে অপারেশন সাকসেসফুল। ভালো করে চারিদিকে তাকালো সে। একটা পরিত্যক্ত গোডাউন এটা। ইনফর্মার মারফত খবর এসেছিল যে এখানেই আজ রাতে লুকিয়ে থাকবে দুজন কুখ্যাত অপরাধী। পুলিশের ওয়ান্টেড লিস্টে যাদের নাম ওপরের দিকেই আছে। খবর পেয়েই পরিকল্পনা ছকে ফেলেছিল পৃথা এবং অপরাধী দুজনকে জাল বন্দী করতে সে সক্ষম হয়েছে। পৃথার ডানদিকে একটা দরজা। দরজার ওপারে কী আছে দেখার জন্য এগিয়ে গেল সে।

সম্পূর্ণ ভাবে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত একটি বড় হলঘর যার চারিদিকে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি নিঃশব্দে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। ঘরের দক্ষিণ দিকে সার দিয়ে আটটি খাটের মত জিনিস রাখা আছে। যার একপ্রান্ত দেওয়ালের সঙ্গে যুক্ত। খাটগুলি ফাইবার জাতীয় কোনও বস্তু নির্মিত এবং খাটের সঙ্গে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সঙ্গত করছে। আটটি খাটে এই মুহূর্তে আমাদের পূর্ব পরিচিত আটজন মানুষ শায়িত আছে । তাদের সকলেরই চোখ বন্ধ। সবার প্রথম রবির শরীরটা একটু নড়ে উঠলো, সে চোখ খুলল। তারপর একে একে বাকিরা। চোখ খুললেও সবাই একটা ঘোর লাগা অবস্থায় আছে। কারুরই নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই। ঘরের একদিকে একটা স্বচ্ছ দরজা। দরজাটা আচমকা খুলে গেল। দরজা দিয়ে পাঁচজন যন্ত্রমানব আর যন্ত্রমানবী প্রবেশ করল। সবার হাতে একটা করে ইনজেকশনের সিরিঞ্জের মত জিনিস। তার মধ্যে ঈষৎ লালচে রঙ্গের তরল। তারা প্রত্যেকের কাছে এসে শরীরে সেই তরলটা পুশ করে দিল। অবশ্য কারুর কোনও ব্যথা অনুভূত হল না। একই সাথে প্রত্যেকের কানের মধ্যে একটা করে মার্বেল গুলির মত যন্ত্র ঢুকিয়ে দিল।

***

চারিদিকটা ভালো করে দেখছিল পৃথা। তারা এখন যেখানে বসে আছে একটা ডোম আকৃতির ঘর যার দেওয়াল এবং ছাদ স্বচ্ছ। মাথার ওপর রাতের আকাশের গোল চাঁদটা দেখলেই এরকম একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যেও মন ভালো হয়ে যাচ্ছে তার। রবি অবাক হয়ে হাঁ করে বাইরে তাকিয়ে ছিল। অদ্ভুত দেখতে গাড়িগুলো সব কেমন আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে যেন। কী হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার।

“প্রভু কী ঘটছে আমার বোঝার সাধ্যের বাইরে। শুধু এই পরিস্থিতিতে তোমার আশীর্বাদ যেন সাথে থাকে।” জোস গলার ক্রুশটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বিড়বিড় করে । বাকি সকলের অবস্থাও প্রায় একই রকম। উদ্ভূত পরিস্থিতি সকলের কাছে শুধু অনভিপ্রেতই নয় অপরিচিত। তাদের মুখোমুখি উল্টো দিকে বিশাল একটা চেয়ার রাখা আছে। ঘরের দরজা খুলে গেল। দুজন লোক প্রবেশ করলেন। একজনের মুখে একটা মুখোশ লাগানো। পৃথার হঠাৎ করে কৃষ ফিল্মটার কথা মনে পড়ে যেতে এই পরিস্থিতিতেও হাসি পেয়ে গেল। মুখোশধারী এসে বড় চেয়ারটায় বসল। অন্যজন দাঁড়িয়ে রইল। মুখোশধারী ঈর্ষণীয় লম্বা।

“স্বাগতম, সুস্বাগতম সময় যাত্রীরা। ২০৭৫ সালে আপনাদের সকল স্বাগত জানাচ্ছি। আমি গ্যাম্বলার।”

“২০৭৫!”

“২০৭৫!”

“সময় যাত্রী!” সকলের মধ্যে বিস্ময় মিশ্রিত গুঞ্জন উঠলো। গ্যাম্বলার হাত তুলে সকলকে থামালো।

“জানি আপনারা কিছুই বুঝতে পারছেন না। আমি আর আমার সঙ্গী ড্যান আপনাদের সব বুঝিয়ে বলছি। তার আগে আপনাদের পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় হওয়াটা দরকার। আপনারা সকলে একে অপরের কাছে অপরিচিত।”

“লাইটস অফ।” ঘরের মধ্যে নিকষ অন্ধকার। কয়েক সেকেন্ড পরে প্রমথকে ঘিরে একটা আলোক বৃত্ত সৃষ্টি হল। অন্ধকার থেকে গ্যাম্বলারের গলা ভেসে এল, “প্রমথচন্দ্র জানা। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট কিন্তু কলেজের পড়াশোনা ছেড়ে নাম লিখিয়েছে বিপ্লবী দলে। দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। প্রমথ এসেছে ১৯৩৩ সাল থেকে।” সকলে অবাক হয়ে প্রমথর দিকে তাকালো। কয়েক মুহূর্ত সবাইকে হয়ত কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার সময় দিয়ে গ্যাম্বলার আবার শুরু করল। এবার আলোক বৃত্ত সরে এসেছে মেজরের ওপর, “মেজর ইশতিয়াক খান। আ ব্রেভ সোলজার। ইন্দো-চীন ওয়ারে অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। উনি এসেছেন ১৯৬৩ সাল থেকে।”

“এবার আসি আপনাদের মধ্যে যে সর্ব কনিষ্ঠ তার কথায়। রাবিন্দর সিং। স্কুল স্টুডেন্ট। ফুটবল ওর প্যাশন। রাবিন্দর এসেছে ১৯৮৩ সাল থেকে।”

“এরপর ১৯৯৩ সাল থেকে এসেছে জোস ডিসুজা। কলেজ শিক্ষক এবং সোশ্যাল ওয়ার্কার।"

“এরপর আছে দুই বাল্যবন্ধু আইভি সেনগুপ্ত আর অরিত্র দত্ত। একজন শিক্ষিকা আর অন্যজন আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের চাকুরে। ওরা এসেছে ২০০৩ সাল থেকে।”

“২০১৩ সাল থেকে এসেছেন ডক্টর জিতেন বড়ুয়া। উনি একজন বিখ্যাত ডাক্তার। রুগীরা ওনাকে ভগবান মনে করে।”

“সর্বশেষ জন হল পুলিশ ইন্সপেক্টর পৃথা বিশ্বাস। যার কর্মদক্ষতার কাছে অনেক বড় বড় পুরুষ অফিসার মাথা নত করে। পৃথা এসেছে ২০১৯ সাল থেকে।”

একটানা বলে গ্যাম্বলার একটু থামলেন।

২০৭৫ সালে আগত আটজন আগন্তুক পরস্পরের দিকে অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখোশধারী আবার কিছু বলতে গেলেন কিন্তু তার আগেই পৃথা বলে উঠলো, “এতক্ষণ আপনি অনেক কথাই বলে গেলেন কিন্তু আপনি কে বা আপনার সব কথা আমরা বিশ্বাসই বা করব কেন? আপনি বলছেন এটা ২০৭৫! এটা কি খুব অবিশ্বাস্য ব্যাপার নয়?” পৃথা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় গ্যাম্বলার আর ড্যানের দিকে। গ্যাম্বলারের মুখে মুখোশ আর ড্যানের চোখমুখ প্রতিক্রিয়াহীন।

“ওকে, আই ডোন্ট মাইন্ড। তোমার কাছ থেকে এটাই প্রত্যাশিত ছিল। ক্যারি অন। তুমি কী বলতে চাও বা করতে চাও কর।” গ্যাম্বলারের কণ্ঠস্বরটা অদ্ভুত। গলার স্বরে বোঝাই যায় না লোকটা রেগে আছে না খুশি আছে না ব্যঙ্গ করছে। পৃথা বাকি সাতজনের দিকে তাকালো। প্রমথ বলল, “আপনি যে প্রশ্নগুলো করেছেন সেই প্রশ্ন আমারও। যা কিছু ঘটছে আমার বোঝার অতীত।” বাকি সকলেও সহমত হয়ে মাথা নাড়ল। গ্যাম্বলার আর ড্যান চুপচাপ এদের লক্ষ্য করে যাচ্ছে। পৃথা অনেকটা নেত্রীর ভঙ্গিতে বলল, “প্রথমে সকলে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন। ইনি আপনাদের পরিচয় সম্বন্ধে যা বললেন তা কি সঠিক? বিশেষ করে, কী বলব আপনারা প্রত্যেকে যে সাল থেকে এসেছেন বলে এনারা বলছেন?” সকলে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। পৃথার ভ্রূটা কুঁচকে গেল।

“আচ্ছা, এবার বলুন তো এর আগে যে রুমটায় আমরা সকলে ছিলাম তার আগে আপনারা কোথায় ছিলেন বা আপনাদের কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল?” পৃথার প্রশ্নের উত্তরে সকলে যা জানালো তাতে করে সবার অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম। প্রত্যেকে কোনও একজন মানুষকে অনুসরণ করেছিল বা অস্বাভাবিক কিছু অনুভূত হয়েছিল বিশেষ করে একরাশ অন্ধকার যেন ঘিরে ধরেছিল তারপর আর কিছু মনে নেই। পৃথা কিছুক্ষণ কিছু ভাবল তারপর বলল, “মিস্টার, গ্যাম্বলার আমাদের সাথে যা কিছু ঘটেছে তা ভালো কি মন্দ আমরা কেউ জানি না কিন্তু বোধহয় প্রত্যেকেই বুঝতে পারছি যে এসব ঘটিয়েছেন আপনি বা আপনারা। এটাও বুঝতে পারছি যে আমরা আপনাদের হাতে বন্দী। কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে এইসব কাণ্ড ঘটিয়েছেন আপনারা এবার যদি খোলাখুলি সব কিছু পরিষ্কার করে বলেন আমাদের পক্ষে ভালো হয়। আমরা এখানে এলাম কীভাবে?”

ডাক্তার বড়ুয়া শান্ত মানুষ। এতক্ষণে তিনিও মুখ খুললেন, “আমার মনে হয় পৃথা যা বলছে একদম ঠিক বলছে। বর্তমানে আমাদের এমন দশা যে বাস্তবে আছি না স্বপ্ন দেখছি সেটাই যেন বুঝতে পারছি না।”

“ওকে, আই আন্ডারস্ট্যান্ড। আমি বলছি। আগে আপনারা শুনুন। এটা সত্যিই ২০৭৫ সাল। আপনাদের সময়ের থেকে এখন পৃথিবী অনেকটাই আলাদা। এখন প্রযুক্তি অনেক এগিয়ে গেছে। আপনারা বাইরে তাকালেই দেখতে পাবেন স্কাই পাথ দিয়ে গাড়ি চলছে। পৃথিবীর খনিজ জ্বালানীর ভান্ডার প্রায় নিঃশেষ হতে চলেছে তাই এখন সৌর শক্তি আর পারমাণবিক শক্তিই মূল ভরসা। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বেশ কিছু উপকূলবর্তী শহর যেমন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তেমনি আবার মানুষ সমুদ্রের মধ্যে ভাসমান শহর তৈরির প্রযুক্তি খুব সহজেই করায়ত্ত করে ফেলেছে। যাইহোক আর বেশি কিছু বলে আপনাদের বোর করব না। জাস্ট ২০৭৫ সালের পৃথিবী সম্পর্কে একটা ধারণা দিলাম। ট্রেনিংয়ের সময় আপনারা অনেক কিছু শিখবেন, জানবেন।”

“ট্রেনিং? কীসের ট্রেনিং?” সহসা রবি বলে ওঠে।

“বলছি সবই বলছি। সব কিছু বুঝতে পারবে। এখন চুপ করে সকলে আমার কথা শুনুন। আসল কাজের কথায় আসি। আমার সব কথা সবার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তার জন্য ড্যান আছে। যারা বুঝতে পারবে না ও আরও পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেবে। এখন শুধু আমি বলব। পৃথা এবং ডাক্তার বড়ুয়া নিশ্চই রিয়ালিটি শো কথাটার সাথে পরিচিত?” পৃথা এবং ডাক্তার বড়ুয়া দুজনেই ঘাড় নাড়লেন।

“তোমাদের সময়ের মত এখনও রিয়ালিটি শো প্রবল জনপ্রিয়। টিভি, অন লাইন স্ট্রিমিং সব জায়গায় এই শো-গুলোর তুমুল জনপ্রিয়তা। এখনকার নতুন প্রজন্মের কেউ আর ওই ফ্যামিলি ড্রামা মার্কা সিরিয়াল-টিরিয়াল দেখে না। আসলে ফ্যামিলি ভ্যালুস, সেন্টিমেন্ট এইসব এখন বস্তাপচা ওল্ড কনসেপ্ট। তাই এই শো-গুলো মানুষ হাঁ করে গেলে বলতে পারো। তবে শো-গুলোর চরিত্র বদলেছে, যেমন বদলেছে মানুষের। এখন আর তোমাদের সময়ের মত শুধু নাচ,গান কিংবা গটআপ গেমের শো হয় না। এখন কতরকম শো হয় তোমাদের ধারণার বাইরে। এই শো-গুলো থেকে যারা প্রোডিউস করে তাদের যেমন প্রচুর টাকা হয় তেমনি পার্টিসিপেন্টরাও প্রচুর টাকা পায়, আবার দর্শকদের জন্যও টাকা রোজগারের বিভিন্ন ব্যবস্থা থাকে। তাহলে বুঝতেই পারছ এক একেকটা শো মানে কী পরিমাণ হাইপ তৈরী হয়।” গ্যাম্বলার বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছিল কিন্তু এবার পৃথা বাধা দিল, “আপনি আমাদের এসব বোঝাচ্ছেন কেন?”

“একজন বুদ্ধিমান পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে এমন বোকার মতো প্রশ্ন আমি আশা করিনি।” গ্যাম্বলার এমন ভঙ্গীতে কথাটা বলল যে শুনেই গা জ্বলে গেল পৃথার।

“কী বলতে চাইছেন আপনি?” ফুঁসে উঠল পৃথা।

“মাই ডিয়ার ইয়াং লেডি, এত কষ্ট করে আমার আবিষ্কৃত মেশিন দিয়ে সৃষ্ট টাইম হোল দিয়ে তোমাদের কেন এই সময়ে নিয়ে এলাম এখনও বুঝতে পারোনি! তাহলে শোনো আমি শুরু করতে চলেছি এক নতুন গেম রিয়ালিটি শো ‘AU REVOIR’ যার পার্টিসিপেন্ট হলে তোমরা। বিভিন্ন সময়কাল থেকে আসা আটজন সাধারণ মানুষ।”

“কী বলছেন কী আপনি? আপনি বললেন আর আমরা রাজি হয়ে গেলাম? তাছাড়া আপনি তো বলতে গেলে কিডন্যাপ করে এনেছেন আমাদের। এখন কি পুলিশি ব্যবস্থা উঠে গেছে?” পৃথা রাগে উঠে দাঁড়িয়েছে।

একটা তাচ্ছিল্যের হাসি উড়ে এল গ্যাম্বলারের কাছ থেকে, “মাই ডিয়ার সুপার কপ মিস পৃথা বিশ্বাস, প্রথমত এখনের পুলিশের তোমাদের মত ওল্ড স্পিসিসের ওপর নষ্ট করার মত সময় নেই। তারা সেই সব মানুষদের নিয়ে মাথা ঘামায় যাদের ডি এন এ স্যাম্পল সংরক্ষিত আছে ডি এন এ স্টোরেজ ব্যাংকে মানে বর্তমানের মানুষ। আর আমার চেহারাটা কি এতই বোকা বোকা যে আমি পুলিশ টুলিশের কথা না ভেবেই তোমাদের পিকনিক করতে নিয়ে চলে এলাম এখানে! দ্বিতীয় কথা তোমরা সবাই স্বাধীন। এক্সিট ডোর খোলাই আছে বেরিয়ে যেতে পারো এই রুম থেকে। যেখানে ইচ্ছে যেতে পারো; শুধু আমার হেল্প ছাড়া মিস পৃথা বিশ্বাস তোমার ভাইয়ের ডাক্তারী কমপ্লিট হওয়ার ফাইন্যাল সার্টিফিকেটটা কোনও দিন দেখা হবে না, তোমার মা-বাবা তোমার পথ চেয়েই একদিন চিরতরে চোখ বন্ধ করে ফেলবেন। ডাক্তার বড়ুয়াকে আর কোনও দিন মেয়ে এসে ‘বাবা’ বলে জড়িয়ে ধরবে না। প্রমথকে ওর বিপ্লবী দলের লোকজন ভীতু কাপুরুষ ভাববে। মেজরের নিজের সন্তানের মুখ কোনও দিন দেখা হবে না। আরও বলব?” গ্যাম্বলার মুখোশের আড়ালে খিক খিক করে হাসছে। পৃথা ধপ করে চেয়ারটায় বসে পড়ল। বাকিরাও নিশ্চুপ হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। সত্যিই তাদের অবস্থা কলে পড়া ইঁদুরের মতো। এই লোকটার সাহায্য ছাড়া নিজেদের সময়ে ফিরে যাওয়া ওদের পক্ষে অসম্ভব। খানিকক্ষণ নীরবতার পর মেজর বললেন, “আমাদের কী করতে হবে?”

“দ্যাটস লাইক আ গুড বয়।” সুর করে বলল গ্যাম্বলার।

***

“রিয়েলি ইউ আর আমেজিং। তুমি বলেছিলে ওদের সাথে তোমার ফার্স্ট ইন্ট্রোডাকশনের লাইভ করতে। তার আগে দর্শকদের সাথে একটা ওপেন কনভারসেশন করবে। আমি রাজি ছিলাম না কিন্তু তুমি ভাবতে পারবে না কী রেসপন্স। প্রমথকে ওই ধুতি আর হাফ শার্ট পরে দেখে সবাই তো অবাক। সবার মুখে এখন চ্যানেল ওয়েভ আর AU REVOIR। রেটিং পয়েন্ট টেন। ভাবতে পারছ?” ড্যান উচ্ছসিত কিন্তু গ্যাম্বলারের মধ্যে সেরকম কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

“নেক্সট পার্ট ওদের ট্রেনিং ক্যাম্পের জীবন যাপনের এডিটেড ভার্সন তবে এমনভাবে হিডেন ক্যামগুলো থাকবে যাতে ওরা আট জন বিন্দুমাত্র বুঝতে না পারে যে ওদের কথাবার্তা, কাজকর্ম সব রেকর্ড হচ্ছে আর ওদের লাখ লাখ দর্শক দেখছে।”

“হুম, তুমি তো অলরেডি দর্শকদের এর একটা আভাস দিয়ে রেখেছ। দর্শকরা খুব এক্সাইটেড কী করে এই পুরোনো সময়ের মানুষগুলো এখনের সব কিছুর সাথে পরিচিত হবে দেখতে।”

“হুম জানি। তারপরই তো আসল খেলা।”

স্কাই পাথ দিয়ে নয়, প্রমথকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে স্থল পথ দিয়ে। রাস্তা যে এত মসৃণ হতে পারে প্রমথর ধারণার বাইরে ছিল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো প্রমথ। একটা H2O ট্যাব প্লান্ট। প্রমথর সময়ে লোকে কথায় বলত জলের দর মানে খুব সস্তা আর এখন নাকি জল হল দুর্মূল্য জিনিস। পৃথিবীর মানুষ নাকি একসময় যথেচ্ছ গাছপালা ধ্বংস করে ফেলেছিল আর নানারকম সব প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজকর্ম করে ফেলেছিল ফলে পৃথিবীর পান যোগ্য মিষ্টি জলের ভান্ডার এখন সীমিত। বিজ্ঞানীরা এক ধরনের ট্যাবলেট আবিষ্কার করেছেন যাতে সাময়িকভাবে তেষ্টা মেটে তবে সেই ট্যাবলেট ইচ্ছে মতো কিনে খাবার সাধ্য সবার নেই। সরকার থেকে পরিবার পিছু সপ্তাহে কিছু ট্যাবলেট বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। গত কিছু দিনে প্রমথ অনেক নতুন কিছু শিখেছে, জেনেছে। বস্তুত যে কয়জন মানুষ আর কলমানুষ তাদের ট্রেনার হিসেবে ছিল তাদেরকে বোধহয় প্রমথর পেছনেই বেশি খাটতে হয়েছে কারণ বয়সের হিসেবে নাহলেও সময়কালের হিসেবে সেই সবচেয়ে পুরোনো। টেলিভিশন, রিয়ালিটি শো এই ব্যাপারগুলোই তো তার কাছে অজানা ছিল। বাকিরা টেলিভিশনের সাথে পরিচিত হলেও রিয়ালিটি শো জিনিসটা তাদের অনেকের কাছেই অজানা। পৃথা আর ডাক্তার বড়ুয়া বাকিদের ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। জোস অদ্ভুত সুন্দর একজন মানুষ। শিক্ষকতার কাজে যুক্ত আর বোধহয় পৃথিবীর সব বিষয়েই ওনার জ্ঞান আছে। ওনার সমসাময়িক সমস্ত কিছুর খবর উনি রাখেন। গত কিছু দিনে প্রমথদের এই ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে। প্রমথ এই প্রথম ধুতি ছেড়ে প্যান্ট পরেছে। এই শোয়ের প্রথম প্রতিযোগী হল প্রমথ। তাকে এরা গাড়ীতে করে কোথাও একটা নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে পৌঁছে সবকিছু জানানো হবে তাকে। তার সঙ্গী বলতে দুজন– একজন মানুষ আর একজন কলমানুষ। কলমানুষই গাড়িটা চালাচ্ছে। রবির কথা খুব মনে পড়ছে প্রমথর। বাচ্চা ছেলে তো। মাঝে মাঝেই বাড়ির জন্য মন খারাপ করে বসে থাকত আবার পর মুহূর্তেই প্রমথর কাছে ওদের আন্দোলনের কথা শুনত। প্রমথকে ছুঁয়ে বলত ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না যে একজন সত্যিকারের স্বাধীনতা সংগ্রামীকে ও ছুঁচ্ছে। প্রমথদের অবস্থা অনেকটা ফাঁদে আটকা পড়া ইঁদুরের মতো হয়েছে। যা হচ্ছে ওদের কারুর জন্যই যে ভালো নয়, সেটা ওরা খুব বুঝতে পারছে তবে এর মধ্যে কিন্তু একটা কথা জেনে প্রমথ ভীষণ আনন্দ পেয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়ে যাবে। প্রমথ ছাড়া বাকি সময় যাত্রীরা প্রত্যেকে স্বাধীন ভারতের নাগরিক, এই কথাটা মনে পড়লেই প্রমথর মনের সব খারাপ লাগা উধাও হয়ে যাচ্ছে।

“এসে গেছি। এবার নামতে হবে।” প্রমথর সঙ্গী বলল। প্রমথ বাইরে তাকিয়ে দেখল একটা ফাঁকা মাঠ, তারপরে কিছু বাড়ীঘর দেখা যাচ্ছে।

***

প্রমথ একলা একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীরে অনেকগুলো যন্ত্রপাতি লাগিয়ে দিয়েছে ওরা। কানে আর মুখের মধ্যে তো আগে থেকেই ট্রান্সলেটার লাগানো ছিল যাতে সে সবার ভাষা বুঝতে পারে আবার সবাই তার ভাষা বুঝতে পারে। তাছাড়া কর্তৃপক্ষ এবং তার মধ্যে যোগাযোগের জন্য তার কানে আরেকটা যন্ত্র লাগানো আছে। প্রমথর হাতে একটা ঘড়ির মত যন্ত্র যার সাহায্যে সে বুঝতে পারবে ক্লাইভ কোথায় আছে। ক্লাইভ হল একটা ঘাতক রোবট যার হাত থেকে বাঁচতে হবে প্রমথকে। ক্লাইভকে এমন ভাবে প্রোগাম করা আছে যে প্রমথ আর তার মধ্যে ১০ ফুট দূরত্ব হলেই সে প্রমথকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবে তাই প্রমথকে সব সময় ক্লাইভের ১০ মিটার নাগালের বাইরে থাকতে হবে। ক্লাইভ প্রমথর ১০০ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে চলে এলে তবেই প্রমথর হাতে লাগানো এলার্ট ওয়াচ তাকে সিগন্যাল দেবে। এখন মুশকিল হল প্রমথ শুধু সিগন্যাল পাবে যে ক্লাইভ ওর কাছাকাছি চলে এসেছে কিন্তু কোন দিকে আছে মানে ক্লাইভের সঠিক ডিরেকশন যন্ত্র বলবে না। প্রমথ কিছুটা আনমনা হয়ে গেল। গত কয়েকদিনের মধ্যে জীবন কীরকম বদলে গেল। মেদিনীপুরের এক প্রান্তে একটা পোড়ো বাড়িতে লুকিয়ে ছিল সে আর আজ সে ভবিষ্যতের মানুষের হাতের ক্রীড়নক মাত্র। তার প্রতিটি পদক্ষেপ নাকি টিভিতে দেখা যাবে। কী করে এরকম হবে প্রমথর মাথায় ঢোকেনি। পৃথা বলছিল যে ওদের সময়ে অনেক উন্নত ক্যামেরা তৈরি হয়েছিল। এখন এদের প্রযুক্তি আরও উন্নত। ওরা অত্যাধুনিক সেই প্রযুক্তির সাহায্যে কাজ করবে নিশ্চই।

‘বিপ বিপ বিপ।’ ঘড়িটা জানান দিয়ে দিল যে ক্লাইভ রেডি মানে কলমানুষটাকে ওরা চালু করে দিয়েছে। এবার সে শুধু প্রমথকে খুঁজবে মারার জন্য। সত্যিই কি অদ্ভুত মাথা মানুষের! এমন যন্ত্র আবিষ্কার করেছে যা প্রায় মানুষের মত। তবে সবকিছু মানুষের মত হলেও মানুষের মত মন তো নেই ওদের। ওরাও প্রমথর মত মানুষের হাতের পুতুল।

“মুভ প্রমথ। মুভ।” বাম কানের ওপরে লাগানো যন্ত্রে গ্যাম্বলারের নির্দেশ এল। এভাবেই ক্রমাগত গ্যাম্বলার যোগাযোগ রাখবে তার সাথে। এটা সেটা চিন্তা মাথায় ঘূর্ণিপাক কাটতে প্রমথ ভুলেই গিয়েছিল যে এক জায়গায় বেশিক্ষণ স্থির হয়ে থাকা যাবে না। সে যে এখানে বসে অপেক্ষা করবে কখন ক্লাইভ কাছাকাছি পৌঁছবে সেটি হবে না। প্রমথকে নাকি সারা পৃথিবীর লোক দেখছে। এক জায়গায় বসে থেকে তাদের বোর করা চলবে না। প্রমথ এখন তাদের বিনোদনের উপকরণ মাত্র। আবার নির্দেশ এল। নাহ, এবার গাছের ছায়া ত্যাগ করতেই হল প্রমথকে। সামনে একটু দূরে যে বাড়িঘরগুলো আছে সেগুলোর দিকে রওনা দিল প্রমথ। বেশ কিছুটা হাঁটার পর একটা চক মত জায়গায় এল সে। ইংরেজীতে লেখা একটা সাইন বোর্ড পড়ে বুঝতে পারলো জায়গাটার নাম দিলগাঁও এবং এটা একটা গ্রাম। প্রমথর হাসি পেয়ে গেল। এখন গ্রামের মধ্যেও কেমন বড় বড় দোকান, চকমিলানো বাড়ি। খুব খিদে পেয়ে গেছে প্রমথর। সামনে একটা বিশাল দোকান। প্রমথ শিখে গেছে ওগুলোকে বলে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। কিছু খাবার কিনতে হবে। একটা বড় স্ক্রীনে দিক নির্দেশ করা আছে। সেই নির্দেশ মত জায়গায় এসে প্রমথ অবাক হয়ে গেল। সারি সারি অনেক শুকনো খাবার সাজানো আছে তবে তার মধ্যে যে মুড়ির প্যাকেট পাওয়া যাবে সে ভাবতেই পারেনি। হঠাৎ করে তার চোখের কোণটা আর্দ্র হয়ে উঠলো। মনে পড়ে গেল তার গ্রাম, তার পরিবারের কথা। গ্রামের অবস্থাপন্ন পরিবার তারা কিন্তু আত্মগোপন করে থাকার সময় অনেকদিনই তাকে না খেয়ে থাকতে হয়েছে। দুটো প্যাকেট তুলে নিয়ে কাউন্টারে এল প্রমথ। এখন সবই যন্ত্র চালিত, কিন্তু তাও একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা বসে আছেন প্রয়োজনে সাহায্য করার জন্য। প্রমথ একটু ভাবল। তাকে একটা চৌকো কার্ড দেওয়া হয়েছে, সেটাকে নাকি টাকার বদলে ব্যবহার করা যায়। এখন নাকি বেশি চলে বিট কয়েন নামে একটা মুদ্রা, তার নাকি আবার বাস্তব অস্তিত্ব নেই। কী সব ভার্চুয়াল ব্যাপার। প্রমথ অতটাও বুঝে উঠতে পারেনি, তাই তাকে এমনি কিছু টাকাও ওরা দিয়েছে। সে যখন ওজন যন্ত্রের একপাশে প্যাকেট দুটো রাখল তারপর যন্ত্রে নির্দেশিত টাকার অঙ্কটা কাউন্টারের মহিলার দিকে বাড়িয়ে দিল। তিনি এমন ভাবে তাকালেন যেন প্রমথ কোনও ভিনগ্রহী। প্রমথ বুঝতে পারল কেউ এখন জিনিস কিনে হাতে হাতে এইভাবে টাকা দেয় না। সবকিছু যন্ত্রের সাহায্যেই হয়ে যায়। বাইরে এল প্রমথ।

‘বিপ বিপ বিপ।’ খিদের চোটে ক্লাইভের কথা মনেই ছিল না তার। ক্লাইভ তার ১০০ মিটারের মধ্যে এসে গেছে কিন্তু সে কোন দিকে আছে প্রমথ জানে না। শুধু তাই নয় ক্লাইভের চেহারা কেমন তাও জানানো হয়নি তাকে। অনেক কলমানুষের চেহারাই একদম মানুষের মত চেনা খুব শক্ত। ঘড়িতে লাল আলো জ্বলেই যাচ্ছে। রাস্তাঘাটে বিশেষ লোকজন নেই। অল্পকিছু লোক চলাচল করছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কাউকে আবার বলাও যাবে না তার আসল পরিচয় কিংবা সে যে এক রিয়ালিটি শোয়ের প্রতিযোগী। ডানদিকের রাস্তা ধরে প্রমথ এগিয়ে চলল। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর সে লক্ষ করল লাল আলো এখনও জ্বলছে তার মানে ক্লাইভ এখনও তার কাছেই আছে। প্রমথ দিক পরিবর্তন করল। দ্রুত গতিতে হাঁটতে হাঁটতে সে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। ক্লাইভ কাছাকাছিই আছে। সে কয়েক পা সামনে এগোতেই হঠাৎ দেখতে পেল একটু দূরে দাঁড়ানো কালো জামা পরা লোকটার হাতটা সামনে উঠে এল। ক্লাইভ! ওর যান্ত্রিক হাতটাতেই পিস্তল সেট করা আছে। বিপদ বুঝে প্রমথ উল্টোমুখে দৌড় লাগলো। সবার আগে দশ মিটারের বেশি দূরত্ব সৃষ্টি করতে হবে। প্রমথ বুঝতে পারল ক্লাইভও ছুটে আসছে তার পেছনে। দুজনের মধ্যেকার দূরত্ব কমে আসছে।

“গাড়িতে উঠে পড়ুন।”

***

এগুলোকে নাকি মোটর বাইক বলে। এরটা একটু পুরোনো আমলের। এটা চালাতেও প্রমথকে ট্রেনিং নিতে হয়েছে। বাকিরা অনেকেই অবশ্য এই পুরোনো মডেল এমনিই চালাতে জানে এমনকি পৃথা পর্যন্ত পারে। দীনেশ দ্রুত গতিতে চালিয়ে এই গলি, সেই গলি করে ক্লাইভের থেকে বেশ অনেকটা দূরে নিয়ে চলে এল প্রমথকে। দীনেশ কম বয়সী একটি ছেলে। এক জায়গায় এসে বাইকটা দাঁড় করাল সে।

“অনেক ধন্যবাদ কিন্তু তুমি হঠাৎ আমাকে বাঁচালে কেন?” প্রমথ জিগ্যেস করল দীনেশকে।

“না বাঁচালে এতক্ষণে ওই কিলার এইচ এম তোমাকে মেরে ফেলত তো।”

“কিলার এইচ এম মানে?”

“কিলার হিউম্যানয়েড। আগেকার দিনে নাকি বড়লোকেরা লোকজনকে তাদের প্রয়োজনে খুন করার জন্য সুপারি কিলার নিয়োগ করত আর এখন এই কিলার এইচ এমগুলো কিনে নেয়। কোনও ঝামেলা নেই। মানুষ বিট্রে করতে পারে, এরা নয়।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল দীনেশ। একটু থেমে প্রমথকে বলল, “আচ্ছা, তোমাকে কে মারতে চাইছে?”

“ধরে নাও আমি একটা ফাঁদে পড়ে গেছি। আচ্ছা, আমি এখন আসি। অনেক ধন্যবাদ বন্ধু।” প্রমথর কানে পরবর্তী নির্দেশ এসে গেছে, “মুভ।”

***

সন্ধ্যে নামছে দিলগাঁওর বুকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রমথর হঠাৎ মনে হল অনেক কিছু পাল্টে গেলেও আকাশটা আজও একই আছে। আজও আকাশে চাঁদ উঠেছে, আজও তারা ফুটেছে। সারাদিন ক্লাইভের হাত থেকে বাঁচতে বাঁচতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মোট বার চারেক ক্লাইভ তার কাছাকাছি চলে এসেছে। কপাল জোরে প্রমথ ঠিক সময়ে ক্লাইভের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পেরেছে। রাতটা কীভাবে কাটবে জানে না প্রমথ। সারাদিন তো শুধু দৌড়ে বেড়িয়েছে। হঠাৎ একটা গোলমাল শুনে এগিয়ে গেল প্রমথ। বেশ কিছু লোকজন জড়ো হয়েছে একটা বাড়ির সামনে। তাদের উত্তেজিত কথাবার্তা থেকে প্রমথ জানতে পারলো ছেলেটি জল নিয়েছে। অবাক প্রমথর মাথায় প্রথমে কিছু ঢুকছিল না। একজন লোককে দেখে তার মনে হল, এ সেই সমস্ত লোকদের মধ্যে পড়ে উত্তেজিত অবস্থায় যাদের একটু উস্কে দিলে তারা নিজের টাকা পয়সার খবরও মুখ ফস্কে বলে ফেলবে। প্রমথ তাকে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে এখানে?” এরপর লোকটি গড়গড় করে যা বলল তার মর্মার্থ হল যে এই পঁচাত্তরের পৃথিবীতে জল তো খুবই মহার্ঘ্য। এই দিলগাঁওতে বিশুদ্ধ পানীয় জলের যে গোটা দুয়েক উৎস আছে তা বাজরিয়া বলে এক ধনী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তির কুক্ষিগত। সাধারণ মানুষ সেই জলে হাত দেওয়ার সাহসও করে না যে কারণে সেইখানে খুব একটা চড়া পাহারা থাকে না । সাধারণ মানুষকে তৃষ্ণা নিবারণ করতে হয় সরকারের দেওয়া ট্যাবলেট খেয়ে। প্রয়োজনে ট্যাবলেট কিনে নিতে হয়। অন্যান্য কাজের জন্য যে জল সরবরাহ করা হয় তা পানের অযোগ্য। এই বাড়ির ছেলেটির মা মৃত্যুশয্যায় ছেলের হাতের একটু জল প্রার্থনা করেছিলেন। মায়ের সেই অন্তিম অনুরোধ ছেলেটি ফেলতে পারেনি। সে চুপিসাড়ে এক আঁচলা জল এনেছিল মায়ের জন্য। মায়ের অন্তিম ইচ্ছাপূরণ হলেও বাজরিয়ার লোকেরা ঠিক খবর পেয়ে যায়। এখন তারা ছেলেটিকে ধরতে এসেছে। প্রমথর চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওদের গ্রামের টলটলে জলভরা পুকুর, শীতল জল ভরা কুয়োর প্রতিচ্ছবি। প্রমথর হঠাৎ মনে হয় এই ভারতবর্ষের জন্য তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে! ইংরেজরা চলে গেলেও তাদের প্রতিভূ হিসেবে এই বাজরিয়ার মত লোকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশের বুকে। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেলেও হঠাৎ প্রমথর মনে হল এই দেশের বুকে যেমন বাজরিয়ার মত লোকেরা আছে তেমন তো দীনেশের মত ছেলেও আছে যে সম্পূর্ণ অচেনা একটা মানুষকে বাঁচানোর ঝুঁকি নেয় কোনও শর্ত ছাড়াই। প্রমথর খুব কৌতূহল হল। সে একপাক ঘুরে বাড়ির পেছনে চলে এল। একটা খোলা জানালা আর তার ভেতরের দৃশ্য দেখে চমকে উঠল প্রমথ। তিনজন লোক নির্দয় ভাবে একটা ছেলেকে মারছে আর ছেলেটা আর কেউ নয় দীনেশ। মুহূর্তের মধ্যে প্রমথর স্নায়ুগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠলো। সে মেদিনীপুরের ছেলে। যেখানে পেডি, ডগলাস আর বার্জের মত শয়তানরা বিপ্লবীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। প্রমথ একটু সরে এসে এল। শো কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে ও কী করতে চলেছে। ও কিছু বলার আগেই গ্যাম্বলারের গলা ভেসে এল ওর কানে, “কী ভাবছো প্রমথ?”

“আমি ছেলেটিকে বাঁচাতে চাই।”

“কেন?”

“ও অন্যায়ের শিকার। ওর মত একটা ভালো ছেলেকে আমি এই বিপদে ছেড়ে দিতে পারি না।”

“ওকে বাঁচাতে গিয়ে তুমি বিপদে পড়তে পারো।”

“বিপদের তোয়াক্কা করলে প্রমথ জানা দেশের জন্য জান কবুল করত না। যাই হোক আমি ওকে বাঁচাবই।” ছেলেটির বাড়ি রাস্তার ওপরের। একদম নিচু পাঁচিল আর পেছন দিকেও একটা গেট। প্রমথ চট করে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে পেছনের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। দীনেশের বাইকটা সামনেই আছে। কী করতে হবে বুঝে গেছে প্রমথ। সে নিঃশব্দে বাইকটা বাইরের রাস্তায় নিয়ে চলে এল। নিঃশব্দে কাজ সারার অভ্যেস তার ভালোই আছে। আবার ভেতরে ঢুকলো। পকেট থেকে বার করল ট্রানকুলাইজার পিস্তলটা। খুব সামান্য ক্ষমতা এটার। একটা গুলি মানুষকে মিনিট পাঁচেক একটু দুর্বল করে দেবে, একটু মাথা টলমল করবে তারপর ঠিক হয়ে যাবে। প্রমথকে যখন ওটা দেওয়া হয় সে ভেবেছিল এরা এই খেলনাটা তাকে দিচ্ছে কেন! কিন্তু এখন এটাই তার কাজে আসবে। বাড়ির পেছনের দরজা খোলাই ছিল। প্রমথ ঢুকে পড়ল। দীনেশর মায়ের মৃতদেহ পড়ে আছে একটা ঘরে আর পরের ঘরটাতেই চলছে দীনেশকে তার অপরাধের শাস্তি প্রদান কর্মসূচি। ঘরের দরজার সামনে এসে প্রমথ মুহূর্তের মধ্যে তিনজনের দিকে তিনটে গুলি ছুঁড়লো। তার লক্ষ্য অবর্থ্য। আসল পিস্তল সে খুব ভালো মতো চালাতে পারে। লোকগুলো মাথা ধরে টলতে আরম্ভ করেছে। এই আক্রমণ তাদের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। রক্তাক্ত দীনেশকে হ্যাঁচকা মেরে তুলে একপ্রকার টানতে টানতে বাইকের কাছে নিয়ে এল প্রমথ। দীনেশ চালাবার অবস্থায় নেই। প্রমথ বাইক স্টার্ট করে বলল, “তাড়াতাড়ি বসো।”

দীনেশ বসতেই বলল, “কোন দিকে যাবো বল।”

হাঁপাতে হাঁপাতে দীনেশ বলল, “সোজা চল স্টীমার ঘাটের দিকে। এখনই একটা স্টীমার ছাড়বে ফ্লোরা আইল্যান্ডের জন্য। আমার বন্ধু কাজ করে স্টীমারে। ঠিক জায়গা হয়ে যাবে। আমার দিদি-জামাইবাবু থাকে ওখানে। একবার স্টীমার ছেড়ে দিলে আর বাজরিয়ার লোক আমার কিছু করতে পারবে না। সরকারী জলযান ছাড়া অন্য কারুর পারমিশন নেই জলে নামার।” মানুষ এখন অনেক উন্নত প্রযুক্তি করায়ত্ত করেছে। সমুদ্রের মাঝে ভাসমান দ্বীপ তৈরি করে সেখানে বসবাস করে। ফ্লোরা আইল্যান্ড এমনি একটি কৃত্রিম দ্বীপ।

‘বিপ বিপ বিপ।’ প্রমথর হাতের এলার্ট ওয়াচ সিগন্যাল দিচ্ছে ক্লাইভ তার কাছাকাছি চলে এসেছে কিন্তু এখন ক্লাইভের দিকে মন দিলে দীনেশকে বাঁচানো যাবে না। প্রমথ কিছু না ভেবে সোজা স্টীমার ঘাটের দিকে বাইক চালালো। ইতিমধ্যে বাজরিয়ার লোকেদের ঘোর কেটে গেছে। তারা আধুনিক খুব দ্রুতগামী বাইক নিয়ে ওদের তাড়া করেছে।

“তোমার ঘড়িতে কীসের সিগন্যাল?” দীনেশ অবাক হয়।

“কিলার রোবট আমার কাছাকাছি চলে এসেছে।”

“তুমি তাহলে নিজে বাঁচার চেষ্টা কর।”

“তুমি কি বাইক চালাতে পারবে?”

“নাহ, আমাকে এখানে নামিয়ে দাও। আমি কোথাও লুকিয়ে পড়ি। তুমি বাইকটা নিয়ে চলে যাও। ওরা আমার হাতগুলো বোধহয় ভেঙ্গে দিয়েছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। বাইক চালানো সম্ভব নয়। পায়ের অবস্থাও ভালো নয়। তুমি বাইক নিয়ে যাও।”

“তা হয় না বন্ধু। তোমাকে বিপদে ফেলে কাপুরুষের মত নিজের প্রাণ বাঁচাতে পারব না।” প্রমথর হাতের ঘড়ি ক্রমাগত সিগন্যাল দিয়েই চলেছে।

“ওই তো স্টীমার ঘাট। স্টীমারটা দাঁড়িয়ে আছে।” প্রমথ স্টীমারটা যেমন দেখতে পেল তেমনি দেখতে পেল ক্লাইভকেও। স্টীমার ঘাটের প্রবেশ দ্বারের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। বাজরিয়ার লোকেরা খুব কাছে চলে এসেছে। বাইকের গতি দ্রুত করল প্রমথ।

***

প্রমথ নিশ্চিন্ত মনে দেখল স্টীমারটা ছেড়ে দিল। একদম শেষ মুহূর্তে দীনেশ ছুটে গিয়ে উঠতে পেরেছে। ওইটা বোধহয় ওর বন্ধু, তার দেখাও পেয়ে গেছে। বাজরিয়ার লোকেরা নিষ্ফল আক্রোশে হাত-পা ছুঁড়ছে। প্রমথ ভারী শান্তিতে চোখ দুটো বন্ধ করল। তার শরীরটা হুমড়ি খেয়ে আশ্রয় নিল মাটির ওপর। ক্লাইভ তার সিস্টেমের নির্দেশ পালন করেছে।

পর্দার দিকে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকা দর্শকদের কানে ভেসে এল গ্যাম্বলারের গমগমে কন্ঠস্বর, “AU REVOIR।”

স্ট্রীট ল্যাম্পের আলোগুলো কেমন মরা মরা। যেন জোর করে, বাধ্য হয়ে জ্বলছে ওরা। এই আলোগুলো সোলার এনার্জিতে চলে। আজ বোধহয় ভালো করে খাবার পায়নি এরা, মানে কড়া রোদ ওঠেনি। অবশ্য এই ধুন্দ টাউনের চরিত্র সম্বন্ধে যা শুনেছেন ইশতিয়াক তার সঙ্গে এই পরিবেশটাই মানানসই। লোকেরা নাকি একে বলে অন্ধকারের শহর। খুন-জখম, রাহাজানি এসব এখানের নিত্য দিনের ব্যাপার। রাত নামলেই গোপন অন্ধকার কন্দর থেকে বেরিয়ে আসে ঘৃণ্য অপরাধজীবীর দল। সারা শহর জুড়ে ত্রাস ছড়ায় তারা। ইশতিয়াককে এই শহরের বুকে এক রাত্রি যাপন করতে হবে। নাঃ, তাঁর জন্য কোনও চার দেওয়ালের সুরক্ষা থাকবে না। নিশাচরের মত তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হবে এই অন্ধকার শহরের ততোধিক অন্ধকার অলিগলি। এটাই নাকি তাঁর টাস্ক। বিশেষ কোনও কাজ নেই তাঁর কিন্তু যদি কোনও বিপদ ঘটে তাহলে আত্মরক্ষা নিজেকেই করতে হবে। ইশতিয়াককে একটা হাত খানেক লম্বা রডের মতো জিনিস দিয়েছে। সেটাতে একটা সুইচ আছে। সুইচ টিপলে নাকি ইলেকট্রিক শক লাগবে। শো থেকে আর কোনও রকম সাহায্য করবে না। তাতে যদি ইশতিয়াকের প্রাণ সংশয়ও হয় তাতেও কিছু যায় আসে না ওদের। ওরা শুধু ইশতিয়াক কীভাবে একলা কারুর সাহায্য ব্যতিত এই অচেনা শহরের বুকে রাত্রি যাপন করে তা দর্শকদের সামনে তুলে ধরবে তাতে নাকি ওদের কোটি কোটি টাকা মুনাফা হবে। খুব অবাক লাগছে ইশতিয়াকের মানুষের জীবন মরণও খেলার বিষয়, উপভোগ করার বিষয়, টাকা কামানোর উপায়। প্রযুক্তি এখন অনেক উন্নত এই অন্ধকারেও ওরা যে কীভাবে ইশতিয়াকের ওপর নজর রাখছে আল্লাই জানেন। বিজ্ঞান হয়ত অনেক এগিয়ে গেছে কিন্ত মানুষের মন...।

দুদিন আগে ওরা প্রমথকে ক্যাম্প থেকে নিয়ে গিয়েছিল। রিয়ালিটি শোয়ের প্রথম প্রতিযোগী ছিল প্রমথ। ইশতিয়াক সহ বাকি সময়যাত্রীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল তার ফিরে আসার কিন্তু প্রমথ ফিরে আসেনি। তার কী পরিণতি হয়েছে তার সঠিক উত্তর তারা পায়নি। রোবটগুলোকে কিছু জিজ্ঞেস করে তো লাভ নেই। ক্যাম্পের একজন মানুষ কর্মীকে অনেক জিজ্ঞাসা করার পর এটুকু শুধু বলেছিল যে প্রমথ সারভাইভ করতে পারেনি। এর অর্থ কী বাকীরা বুঝে গিয়েছিল। রাত্রে কেউ আর খাবার খেতে পারেনি। রবি তো ভীষণ কান্নাকাটি করছিল। এই কদিনে ও প্রমথর খুব ন্যাওটা হয়ে গিয়েছিল।

“মেজর, কেমন লাগছে এই নৈশ অভিযান?” গ্যাম্বলারের গলা ভেসে এল মেজরের কানে।

“কেমন লাগা উচিত বলে আপনার মনে হচ্ছে?” মেজর ঈষৎ বিরক্ত।

“ভয় লাগছে?”

“একজন সোলজার কখনও ভয় পায় না।” দৃঢ় কণ্ঠে বললেন মেজর।

“তাহলে কেমন লাগছে?”

“এরকম ভূতের মতৌ উদ্দেশ্যবিহীনভাবে রাত্রিবেলা ঘুরতে অবশ্যই খুব একটা ভালো লাগছে না, তবে একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো ফিলিংসও হচ্ছে সেটা অস্বীকার করব না।”

“ওকে ক্যারি অন অ্যান্ড টেক কেয়ার। আপনাকে জানিয়ে রাখি গত কিছু দিনে এখানে ঠিক তিন দিন পর পর একজন করে মানুষ একই পদ্ধতিতে খুন হয়েছে, মানে সিরিয়াল কিলিং এর ঘটনা। আততায়ী ধরা পড়েনি। আজ থেকে তিন দিন আগেও একজন মানুষ খুন হয়েছে। হিসেব মতো আজও...।”

***

ইশতিয়াক একটা সরু গলিতে ঢুকে পড়লেন। গ্যাম্বলারের নির্দেশ কোনও এক জায়গায় বেশিক্ষণ স্থির হয়ে থাকা চলবে না। বিশ্রামের জন্য শুধু মাঝে মাঝে থামা যাবে। হাল্কা নীল রঙের নিয়ন আলোর সাইন বোর্ড ‘২৪ আওয়ারস’। কাঁচের দরজার ওপাশে কী আছে বোঝা যাচ্ছে না। ইশতিয়াক দেখলেন, এত রাতেও একজন লোক দরজা ঠেলে ঢুকছে। ঢুকতে গিয়েও লোকটার হঠাৎ ইশতিয়াকের দিকে নজর পড়ল, “দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে চলে আসুন। খুব টেস্টি জিনিস আছে আজ।” ইশতিয়াক এতক্ষণে বুঝলেন, এটা একটা খাবারের দোকান। সারা দিন রাত খোলা থাকে। একটু ভেবে ইশতিয়াক ঢুকে পড়লেন। তাঁকে কিছু টাকা পয়সা দেওয়া হয়েছে। চাইলে তিনি খরচা করতে পারেন। অল্প সময় হলেও মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া যাবে, আর কিছুটা সময় কেটেও যাবে, এই ভেবে ভেতরে ঢুকলেন ইশতিয়াক।

রিসেপ্সনের মত একটা জায়গা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেই চোখ বন্ধ করে ফেললেন ইশতিয়াক। গা টা গুলিয়ে উঠলো তাঁর। বড় একটা ঘরের চারপাশে অনেকগুলো সোফা পড়ে আছে, আর সেই সোফার মধ্যে প্রায় নগ্ন কিছু মেয়ে উত্তেজক ভঙ্গিমায় শুয়ে আছে।

“আমাকে পচ্ছন্দ না ওকে?” দুটি মেয়ে উঠে এসে ইশতিয়াককে প্রায় জড়িয়ে ধরেছে।

“এই দুটোই টেস্টি সাহেব। পকেট পারমিট করলে দুটোই টেস্ট করুন।” সেই লোকটি একটি প্রায় উলঙ্গ মেয়েকে নিজের কোলে বসিয়ে রেখেছে।

“আমি!”

“এই না আমি!” মেয়ে দুটি ন্যাকা স্বরে বলল। হতভম্ব ইশতিয়াক একবার মেয়ে দুটির দিকে দেখলেন; তারপর এক ঝটকায় দুজনকে সরিয়ে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এলেন সেখান থেকে। পেছনে হোহো হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে।

***

এবার রীতিমত বিরক্ত লাগছে ইশতিয়াকের। রাত প্রায় আড়াইটা। গ্যাম্বলার বলে দিয়েছে ভোর পাঁচটার আগে ইশতিয়াকের ছুটি নেই। পাহারাদারদের মতো শুধু এ গলি থেকে সে গলি, এ রাস্তা থেকে সে রাস্তা ঘুরে যাচ্ছেন। একবার ভুল করে গণিকালয়ে ঢোকার পর থেকে আর ভুলেও কোথাও ঢোকার কথা ভাবেন নি। অবশ্য ঢুকতেনই বা কোথায়? সারা শহর ঘুমোচ্ছে। একটা ল্যাম্প পোষ্টের নীচে একটু দাঁড়ালেন। হঠাৎ পাশের গলি থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ পেলেন ইশতিয়াক। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন। একটা লোক হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। ইশতিয়াক তাড়াতাড়ি তার বাঁধন খুলে দিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন, গণিকালয়ের সেই লোকটা। ইশতিয়াক কিছু বলার আগেই সে বলে উঠলো, “এতক্ষণে বোধহয় মেয়েটাকে মেরে ফেলল।”

“কোন মেয়েটা? কে মেরে ফেলল?” বিস্মিত ইশতিয়াক প্রশ্ন করলেন। উত্তরে লোকটি জানালো যে গনিকালয়ের একটি মেয়েকে নিয়ে সে একটু বাইরে ফুর্তি করবে বলে বেরিয়েছিল। আচমকা একটি লোক তাদের আক্রমণ করে। মেয়েটির মাথায় মেরে নিমেষের মধ্যে তাকে অজ্ঞান করে ফেলে, এবং তাকে খুব সহজেই কব্জা করে হাত পা বেঁধে ফেলে রেখে যায়। মদের ঘোরে বেসামাল থাকার জন্য সে কোনও প্রতিরোধই করতে পারেনি। তার ধারণা মুখ বাঁধা ওই আগন্তুকই সিরিয়াল কিলার।

“মেয়েটাকে কোন দিকে নিয়ে গেছে দেখেছ?” উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ইশতিয়াকের।

“ওই দিকে।” আঙ্গুল তুলে দেখাল লোকটা।

***

“ইশতিয়াক কী করছেন? কোথায় যাচ্ছেন?” গ্যাম্বলারের গলা ভেসে এল।

“মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে।”

“একটা নোংরা মেয়ের জন্য ওই ভয়ানক সিরিয়াল কিলারটার মুখোমুখি হবেন আপনি?”

“কেউ মায়ের পেট থেকে নোংরা হয়ে জন্মায় না। পরিস্থিতি অনেক সময় বাধ্য করে। গণিকা বলে তার বাঁচার অধিকার নেই এটা তো হতে পারে না।”

“আপনি কিন্তু কোনও রকম হেল্প পাবেন না।”

“জানি।” একটা গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন ইশতিয়াক। ডান দিক থেকে একটা অস্ফুট আর্তনাদ কানে এল। ওখানে একটা ভাঙ্গা পাঁচিল। ছুটে গেলেন ইশতিয়াক । পাঁচিলের পাশেই স্বল্প আলোয় দৃশ্যটা চোখে পড়ল তাঁর। মেয়েটি কুঁকড়ে পড়ে আছে পাঁচিলের ধারে আর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই ভয়ঙ্কর খুনি। তার হাতে চকচক করছে ধারালো একটা ছুরি। আজ পর্যন্ত প্রত্যেকটা খুন সে করেছে গলার নলি কেটে। আস্তে আস্তে সে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটির দিকে। হঠাৎ মেয়েটির চোখ পড়লো ইশতিয়াকের ওপর। সে চেঁচিয়ে ঊঠলো, “প্লীজ, আমাকে বাঁচান।” কিছুক্ষণ আগে দেখা মেয়েটির সঙ্গে এখনের মেয়েটির অনেক তফাৎ। এখন সে শিশুর মত ডুকরে কেঁদে উঠলো। এবার সেই খুনি ইশতিয়াকের উপস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলো। ঘুরে দাঁড়ালো সে। তার চেহারা দেখে চমকে উঠলেন ইশতিয়াক। মুখের অর্ধেকটা পোড়া।

“পালান ইশতিয়াক। পালান।” গ্যাম্বলারের গলা ভেসে এল। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ইশতিয়াক এগিয়ে গেলেন মেয়েটিকে বাঁচাতে। ততক্ষণে সেই আততায়ীও প্রস্তুত। সে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইশতিয়াকের ওপর। ইশতিয়াকের হাতের ইলেকট্রিক রডটা ছিটকে পড়ল। খানিকক্ষণ প্রবল সংগ্রামের পর ইশতিয়াক হঠাৎ করেই রডটার নাগাল পেয়ে গেলেন।

“আহ হ হ হ।” ছিটকে পড়ল সেই আততায়ী। রডটা কাজ করেছে সেই সঙ্গে একটা সাইরেনের আওয়াজ পেলেন ইশতিয়াক।

***

আগের দিন ইশতিয়াক নিজের টাস্ক কমপ্লিট করতে পারেননি। পুলিশ এসে গিয়েছিল। ওনাকে ওখানকার থানায় যেতে হয়েছিল। সারা রাত রাস্তায় ঘুরে কাটানো সম্ভব হয়নি। ইশতিয়াককে ওরা আজ ধুয়াধার বলে একটা জায়গায় ছেড়ে দিয়ে গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই গ্যাম্বলার খুব একটা সন্তুষ্ট নয় ইশতিয়াকের ওপর তাই আজ আবার নতুন টাস্ক চাপিয়ে দিয়েছে তাঁর ওপর। অনেক কিছু বদলে গেছে দেশের। এখন নাকি রাজ্যগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। ছোট ছোট প্রদেশ গড়ে উঠেছে। সেখানে একেক জন শাসক। অনেকটা আগেকার মুখ্যমন্ত্রীর ধাঁচে কিন্তু এখন গণতন্ত্রের চেয়ে স্বৈরতন্ত্রই মুখ্য। ইশতিয়াক যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেটা একটা পরিত্যক্ত কয়লা খনি অঞ্চল। মাটির নীচের সব সম্পদ স্বার্থপর মানুষ শেষ করে দিয়েছে। কয়লা খনি সংলগ্ন শহরটাও আজ মৃত মানুষের মত শুধু কঙ্কাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবৈধভাবে যথেচ্ছ কয়লা তোলার ফলে নীচের মাটি পুরো ফোঁপরা হয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। বাড়িগুলো সব একবুক হাহাকার নিয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই মৃত্যু পুরীতে শব্দরাও নিঃশব্দ। নিজের নিঃশ্বাসের আওয়াজটাও শোনা যায়। ইশতিয়াককে মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যে এই জায়গা ছেড়ে বেরোতে হবে। ওরা ইশতিয়াকের চোখ বেঁধে হেলিকপ্টারে করে এখানে এনে ওপর থেকেই মইয়ের সাহায্যে মাঝামাঝি একটা জায়গায় নামিয়ে দিয়েছে। চোখ বাঁধা থাকায় ইশতিয়াক একটুও বুঝতে পারেননি বেরোনোর রাস্তা কোন দিকে হতে পারে। একটা নাকি বিশাল ভাঙ্গা গেট আছে। সেইদিকে বেরোতে হবে। একে তো সময় নির্ধারিত, তারপর এখানে জায়গায় জায়গায় মাটির তলা পুরো ফোঁপরা। যেকোনো মুহূর্তে ধস নামতে পারে। কিছুটা আন্দাজে ভর করে উল্টো দিকের একটা কয়লা খাদানের ধার বরাবর দ্রুত গতিতে অনেকটা এগিয়ে গেলেন ইশতিয়াক। হঠাৎ ওঁর মনে হল সামনের দিকে অনেক মানুষের পায়ের আওয়াজ। ইশতিয়াককে যেটুকু বলা হয়েছে তাতে করে এই এলাকায় বর্তমানে ইশতিয়াক ছাড়া অন্য কারুর অস্তিত্ব থাকার কথা ন্য। ক্রমশ গলার আওয়াজ পেলেন ইশতিয়াক। সত্যিই চারটে লোক আসছে। তাদের পরনে লাল রঙের ইউনিফর্ম জাতীয় পোশাক।

“একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখেছ?” ইশতিয়াকের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল একটা লোক। হতভম্ব ইশতিয়াক শুধু মাথা নেড়ে না বললেন। লোকগুলো তাঁকে ছাড়িয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল। ওদের কিছু জিগ্যেস করার অবকাশ পেলেন না ইশতিয়াক।

“কী ভাবছেন ইশতিয়াক?” গ্যাম্বলারের গলা ভেসে এল।

“ভাবছি তোমাদের সময়ের মানুষ বড় অদ্ভুত! হয়ত ভীষণ স্বার্থপরও। ওরা ওদের জিজ্ঞাস্য জানার চেষ্টা করল কিন্তু এই নির্জন পুরীতে আমি কী করছি একবারও জানতে চাইল না। বস্তুত আমাকে এখানে দেখে ওদের কোনও মাথা ব্যথা আছে বলেও মনে হল না। আমাদের সময় কিন্তু এমনটা হত না।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইশতিয়াক। গ্যাম্বলার আর কিছু বলল না। সামনেই একটা ভাঙ্গা বাড়ি বোধহয় অফিস জাতীয় কিছু ছিল। দ্রুত পেরিয়ে যেতে যাবেন ইশতিয়াক এমন সময় তাঁর সৈনিকের স্নায়ু সজাগ হয়ে উঠলো। ঘরটার মধ্যে কারুর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছেন তিনি। একটা ক্ষীণ ফোঁপানির আওয়াজ আসছে। ইশতিয়াক চট করে মিলিটারী দক্ষতায় অতি সাবধানে ঘরটায় ঢুকে পড়লেন। অন্ধকার ঘরের কোণে গুটিসুটি মেরে কাঁপছে সে। একেই যে লোকগুলো খুঁজে বেড়াচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই ইশতিয়াকের। সাদা ফ্রক পরা ছোট্ট একটা পরী।

***

ভারতবর্ষের জনসংখ্যা নাকি সুনামির মত বাড়ছিল। 215 কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার পর সরকার থেকে এক সন্তান নীতি প্রণীত হয়। কোনও দম্পতিই একটির বেশি সন্তানের জন্ম দিতে পারে না। বাকি দেশে কারুর যমজ সন্তান হলে তাদের ছাড় দেওয়া হয় কিন্তু এই প্রদেশের বর্তমান শাসক অত্যন্ত দুরাচারী একটি মানুষ। মানবিকতা শব্দটা তার অভিধানে নেই তাই এখানে কারুর যমজ সন্তান জন্ম নিলেই বাচ্চা দুটির মধ্যে যে মায়ের গর্ভ থেকে শেষে পৃথিবীর আলো দেখে অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে পৃথিবী থেকে সরে যেতে হয়। সব ডাক্তার এবং হাসপাতালগুলোকে এরকমই নির্দেশ দেওয়া আছে। এই যে ছোট্ট মেয়েটি লিলি ও আর ওর দিদি কলি প্রায় একসাথেই পৃথিবীর আলো দেখেছিল। শুধু লিলি কলির পাঁচ মিনিট পরে এসেছিল দুনিয়ায়। হিসেব মত তার বেঁচে থাকার কথা নয় কিন্তু ডাক্তার ওদের এক আত্মীয় হওয়ায় কোনও ভাবে ব্যাপারটা গোপন রাখেন এবং ওরা দুইবোন একই রকম দেখতে হওয়ায় এই সাত বছর বয়স পর্যন্ত ওদের বাবা-মা লিলির অস্তিত্ব কোনও ভাবে গোপন করেছিলেন। কীভাবে করেছিলেন ভীত সন্ত্রস্ত বাচ্চা মেয়েটি গুছিয়ে বলতে পারল না। তার পক্ষে বলা সম্ভবও ছিল না। সে শুধু এটুকু বলতে পারল যে হঠাৎ করেই কীভাবে যেন খবরটা এখানকার শাসকের কানে চলে গেছে। শাসকের লোকেরা তার পরই লিলির পরিবারকে আক্রমণ করে। লিলির পরিবার সীমান্ত পেরিয়ে গেছে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে লিলি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং নিজের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাচ্চা মেয়েটি গুছিয়ে কিছু বলতে পারছে না। ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে মেয়েটি যা বলল, তা থেকেই এটুকু উদ্ধার করলেন ইশতিয়াক। বাচ্চা মেয়েটির শুকনো মুখ দেখেই ইশতিয়াক বুঝতে পারলেন সে ক্ষুধার্ত। পকেটে একটা বিস্কুটের প্যাকেট ছিল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে নিজে হাতে করে তাকে খাবার খাওয়ালেন ইশতিয়াক।

“তুমি চিন্তা করো না। আমি তোমাকে সীমান্ত পার করে দেব।”

“তুমি আমাকে হেল্প করবে? ওই দুষ্টু লোকগুলোর হাত থেকে বাঁচাবে?”

“হুম। জানো আমারও একটা ছোট্ট মেয়ে আছে। তাকে আমি এখনও চোখেও দেখিনি। জানি না তাকে কোনও দিন আমি দেখতে পাবো কিনা। সে নিশ্চই বড় হয়ে তোমার মতোই মিষ্টি হবে।”

“তার নাম কী?”

“তার নাম গুল।”

***

“ইশতিয়াক, কী করছেন?” ভেসে এল গ্যাম্বলারের গলা। যথেষ্ট ক্রুদ্ধ সে।

“লিলিকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি।”

“এতে তো আপনি বিপদে পড়তে পা্রেন? আপনি আগের দিন ভালো করেই বুঝে গেছেন নিজেকেই সারভাইভ করতে হবে। আমরা কোনও রকম সাহায্য করব না। তাছাড়া আপনার সময় পেরিয়ে যাবে। আগের দিন টাস্ক কমপ্লিট করতে পারেন নি । আজও না পারলে কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।”

“জানি।”

“তারপরেও আপনি ওকে বাঁচানোর ঝুঁকি নেবে্ন?”

“আমি একজন সৈনিক। আমি নিজের জীবনের কথা ভাবতে শিখিনি। আমি দিনের পর দিন সীমান্তে দেশের জন্য লড়াই করেছি। নিজের কথা ভেবে একটা ফুলের মত শিশুকে বিপদের মুখে ফেলে পালাবো ভাবলেন কী করে আপনারা? ইন্ডিয়ান আর্মির একজন মেজর এত ডরপোক নয় এটা জেনে রাখুন।”

ইশতিয়াক লিলিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। লিলি তাকে এটুকু বলতে পেরেছে যে এই খনি অঞ্চলের শেষেই সীমান্ত। সীমান্ত পেরোতে পারলেই সে পাবে বেঁচে থাকার অধিকার।

“ইশতিয়াক এখনও ভেবে দেখুন।”

“ভাবার কোনও জায়গা নেই। শুধু একটা কথা ভেবে অবাক লাগছে। কী অবস্থা হয়েছে দেশটার! এই দেশটার জন্যই তো আমার কত সৈনিক বন্ধু নিজেদের প্রাণ দিয়েছে আমারই চোখের সামনে। আমাদের ভবিষ্যতের ভারতবর্ষের এই চিত্র ভাবতেই আমার কষ্ট হচ্ছে।” ইশতিয়াকের কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ল।

ইশতিয়াক একটু ভাবলেন। লিলি এমনিতেই বাচ্চা তারওপর ভয়ে, খিদেয় আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ওর পক্ষে খুব বেশি জোরে হাঁটা সম্ভব নয়।

“বিটিয়া, এসো।” লিলিকে কাঁধে তুলে নিলেন ইশতিয়াক তারপর ছুটতে আরম্ভ করলেন। লিলিকে খুঁজতে আসা লোকগুলোর হাত থেকে লিলিকে বাঁচাতে হবে আবার নিজেকেও সময়ের মধ্যে গেটটা খুঁজে পেতে হবে। নিজের জন্য নয় লিলিকে বাঁচানোর জন্যই এখন তাঁকে দ্রুত এখান থেকে বেরতে হবে।

***

দূর থেকে ইশতিয়াকের চোখে পড়ল বিশাল ভাঙ্গা গেটটা। হাঁপিয়ে পড়েছেন। লিলিকে কাঁধে নিয়ে অনেকটা পথ ঘুরতে হয়েছে। দুজনের কেউই সঠিক পথ জানতেন না। অবশেষে সীমান্ত এসে গেছে কিন্তু তার আগেই তাঁকে মুখোমুখি হতে হল লিলিকে ধরতে আসা লোকগুলোর।

“ইশতিয়াক নিজের কথা ভাবুন। বাচ্চাটাকে ছাড়ুন। আপনার হাতে মাত্র সাত মিনিট সময় আছে।” গ্যাম্বলারের কথা এসে কানে ধাক্কা দিল।

“আয়াম আ ইন্ডিয়ান সোলজার নট আ কাউয়ার্ড। হিন্দুস্থানী সিপাহী কাভি জং কি ময়দান সে পিছে নাহী হাটতা। মারতা হ্যায় ইয়া মরতা হ্যায়।”

ঝট করে লিলিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন ইশতিয়াক, “ভাগ বিটিয়া ভাগ।” লিলি ছুটে যাচ্ছে সীমানার দিকে আর লোকগুলোর সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন ইশতিয়াক। ইশতিয়াককে কোনও অস্ত্র দেয়নি ওরা, কিন্তু ইশতিয়াক ওসবের পরোয়া করেন না। খালি হাতেই চারজনকে আটকানোর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেন। কিছুতেই ওদের লিলির কাছে পৌঁছতে দেওয়া যাবে না। এদের আটকাতে হবে। লিলি প্রায় গেটের কাছে পৌঁছে গেছে।

ইশতিয়াক হঠাৎ খেয়াল করলেন একটা লোকের কোমরের বেল্টে একটা ইলেকট্রিক রড আটকানো আছে। ইশতিয়াক ঝাঁপিয়ে পড়ে রডটা খুলে নিলেন। লোকগুলো বলশালী হলেও ইশতিয়াকের ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পেরে উঠলো না। দুজনকে শক দিলেন ইশতিয়াক, আর বাকি দুজন রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাল। ইশতিয়াক গেটের দিকে ছুটতে আরম্ভ করলেন। গেট পেরিয়ে দেখলেন লিলি তার পরিবারের সাথে মিলিত হয়েছে। একটা গাড়ি নিয়ে ওঁরা দাঁড়িয়ে আছেন, আর তার পাশেই ইশতিয়াকের জন্য শো কর্তৃপক্ষের গাড়ি অপেক্ষা করছে। দশানন নামের হিউম্যানয়েডটা এগিয়ে এল, “আজও তুমি ফেল করেছ। সময়ের মধ্যে তোমার টাস্ক কমপ্লিট হয়নি। গেট পেরোতে তোমার এক্সট্রা দশ মিনিট সময় লেগেছে।” দশাননের কথাগুলো ইশতিয়াকের মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল না। লিলির হাসি মুখটা দেখে তিনি পরম তৃপ্ত।

আবার ভেসে এল গ্যাম্বলারের কঠিন কণ্ঠ, “ইশতিয়াক আপনি বারবার একই ভুল করছেন। এরপর আপনার জন্য কি অপেক্ষা করছে তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।”

কি আছে ইশতিয়াকের ভাগ্যে? দর্শকদের মধ্যে প্রবল আলোচনা শুরু হল।

কারখানাটা দেখে অবাক হয়ে গেল রবি। বিশাল বিশাল যন্ত্র থেকে প্রসেসেড ফুড টিন জাত হয়ে বিশাল বিশাল বাক্সে ভরা হয়ে যাচ্ছে। সবটাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে হচ্ছে। কোনও মানুষ নেই পুরো কারখানাটায়। শুধু কিছু হিউম্যানয়েড আছে নজরদারির জন্য। কোথাও যন্ত্রপাতিতে কিছু গন্ডগোল হলে ওরাই ঠিক করে কিংবা হেড অফিসে খবর দেয়।

“রবি কী দেখছো?” রবির কানে গ্যাম্বলারের গলা ভেসে এল।

“কী বিশাল কারখানা!”

“দেখেছ মানুষ কেমন উন্নতি করেছে?”

“হুম। তা ঠিক।”

“এমন নিষ্প্রাণভাবে বলছ কেন?”

“আসলে এত বড় কারখানা, কিন্তু একটাও মানুষ নেই! কেমন যেন ভালো লাগছে না। আমাদের গ্রামের বড় রাস্তার পাশে একটা কারখানা আছে। সেখানে রোজ আটটার সময় বাঁশি বাজে। কারখানার কর্মীরা ছুটে ছুটে কাজে যায়; আবার পাঁচটার সময় বাঁশী বাজলে সবাই ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরে আসে; কিন্তু এইসব কিছুর মধ্যেই একটা প্রাণ চাঞ্চল্য থাকে। বৈশাখীর সময় কারখানার সবাই একসাথে কত আনন্দ করে। আপনাদের এই কারখানা অনেক উন্নত। এমন সব মেশিন আছে যার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। এসব তো মানুষেরই আবিষ্কার, তাই না?”

“সে তো অবশ্যই।”

“আসলে কী জানেন মানুষ ছাড়া মানুষের আবিষ্কার বেজান লাগছে আমার।”

“তুমি 1973 এর মানুষ তাই তোমার এমন মনে হচ্ছে। 2075 এর মানুষ এসব ফালতু সেন্টিমেন্ট নিয়ে মাথা ঘামায় না। তোমার মত 17-18 বছরের ছেলেরা এখন শুধু এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে, আর কোনও কিছু ভাবার সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই তাদের নেই।”

“খুব অবাক লাগছে তোমাদের পৃথিবী দেখে। ভালো নয় গো তোমাদের এই উন্নত ভবিষ্যতের পৃথিবী।”

“তাই নাকি?”

“হুম।”

“আচ্ছা তোমার টাস্কটা ভালো করে বুঝেছো তো?”

“হ্যাঁ, ওই কালো মাথা রোবটটা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে।”

“ওর নাম দানব। যদি কিছু জানার থাকে ওকে জিগ্যেস করো।”

***

রবি কাজে লেগে পড়ল। সে বয়সে ছোট বলেই হয়ত তার কাজটা পরিশ্রম সাপেক্ষ হলেও করা বেশ সোজা। এই কারখানায় দুটো ইউনিট আছে। একটায় কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার টিনবন্দী হয় আর একটায় ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট তৈরী হয়। এই খাবারগুলো আবার বড় বড় প্যাকিং বাক্সে ভরা হয়। একেকটা বাক্সে কুড়িটা করে টিন থাকে। রবির কাজ হল এই রকম পাঁচশ কার্বোহাইড্রেটের প্যাকিং বাক্স আর পাঁচশ ভিটামিনের প্যাকিং বাক্স একটা ট্রাকে তোলা; তারপর ট্রাকটাকে নির্দেশ মত একটা জায়গায় পৌঁছে দেওয়া। তবে কাজটা তাকে টানা করে যেতে হবে, এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পুরোটা সম্পূর্ণ করতে হবে। পাঁচশ বাক্স তোলা হয়ে গেলে আধঘণ্টা বিশ্রাম পাবে সে। সেই সময়টা সে বিশ্রামও নিতে পারে আবার কাজও করতে পারে।

***

হাঁফিয়ে পড়েছে রবি। আসলে কার্বোহাইড্রেটের বাক্সগুলো একটা উঁচু প্লাটফর্মে এসে জমা হচ্ছে। বেশ কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে সেগুলোকে নামাতে হচ্ছে। তারপর ট্রাকে তুলতে হচ্ছে। এমনিতে এই কাজগুলো করে রোবটরা। তাদের তো আর কষ্ট বলে কিছু নেই, কিন্তু রবির বেশ কষ্ট হচ্ছে। সে একজন ফুটবলার এবং শারীরিক ভাবে খুবই শক্ত সামর্থ্য বলে এতক্ষণ একটানা কাজটা করতে পারলো, কিন্তু পাঁচশো তোলা হয়ে গেলে তাকে একটু বিশ্রাম নিতেই হবে।

“ইউ ক্যান টেক সাম রেস্ট।” দানব তার যান্ত্রিক স্বরে বলল। রবি একটা চেয়ারে বসে ঢকঢক করে বেশ খানিকটা এনার্জি ড্রিংক খেলো। এদের দেওয়া এই ড্রিঙ্কটা বেশ কাজের। রবির ক্লান্তি অনেক খানি দূর হয়ে গেল।

“কী মনে হচ্ছে কাজটা সময়ের মধ্যে তুমি শেষ করতে পারবে?” গ্যাম্বলারের গলা ভেসে এল।

“হুম।”

“ওকে, এই আধ ঘন্টা তুমি নিজের মতো করে কাটাতে পারো।”

“আমি একটু বাইরে বেরোতে পারি? ঠিক সময়ে ফিরে চলে আসব। এই রোবটদের মাঝে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে।”

“ঠিক আছে যাও। সময় শেষ হলেই দানব তোমাকে সিগন্যাল পাঠিয়ে দেবে।”

***

“উফফ! বাইরে এসে বাঁচলাম একটু। আকাশে কি দারুণ মেঘ ভাসছে।” পায়ে পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল রবি। তার সামনে গগনচুম্বী এক পাঁচিল যার ওপাশে কী আছে দেখা যাচ্ছে না। শুধু কেমন একটা আওয়াজ আসছে মনে হচ্ছে। যেন মানুষের ক্ষীণ আওয়াজ।

“কী দেখছো রবি?” গ্যাম্বলারের প্রশ্ন।

“এই পাঁচিলটা কীসের? এর ওপাশে কী আছে?”

“ওপাশে একটা বসতি আছে।”

“ওটা এত উঁচু পাঁচিল দিয়ে এভাবে ঘেরা কেন?”

“ওখানে বসবাসকারী মানুষগুলো এই আধুনিক পৃথিবীর অনুপযুক্ত। এই উন্নত সুন্দর পৃথিবীর সাথে ওই মানুষগুলো বেমানান।”

“মানে? মানুষ আবার বেমানান হয় কেমন করে?”

“অত ভেবে তোমার কাজ নেই। তোমার হাতে বেশি সময় নেই। সময়ে নিজের কাজে ফিরে যাও।” গ্যাম্বলার চুপ করে গেল। রবি একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল হঠাৎ সামনে একজনকে দেখে চমকে উঠলো। একটা মানুষ অবশ্য তাকে মানুষ না বলে কঙ্কাল বলাই শ্রেয়।

“তুমি কে গো?” গলা শুনে মনে হল বয়স রবির মতই, কিন্তু তার চেহারা দেখে তা বোঝার উপায় নেই।

“আমি রবি। তুমি কে? তোমার এমন অবস্থা কেন?” বিস্মিত প্রশ্ন রবির।

“তুমি বোধহয় এখানে নতুন তাই কিছু জানো না।” রবি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।

“আমি টনি। ওই পাঁচিলের ওপারে থাকি।”

“এই পাঁচিলের ব্যাপারটা কী আমাকে পরিষ্কার করে বল তো?”

“আগে এই আশেপাশের কারখানাগুলোতে অনেক মানুষ কাজ করত। তাদের বসতি ছিল ওই পাঁচিলের ওপাশের জায়গাটায়। তখন এই পাঁচিল ছিল না। তাদের একটা সুস্থ জীবন ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সব বদলে গেল মানুষের জায়গা নিল মেশিন আর কলের মানুষ মানে রোবটরা। কারখানার কর্মীরা কাজ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল। অল্প কিছু মানুষ যারা বেশি লেখাপড়া জানত, তারা অন্য জায়গায় গিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণী এখানেই রয়ে গেল। কাজ ফিরে পাবার আশায় অনেক আন্দোলন করল, কিন্তু কোনও ফল হল না। শেষে একদিন এই পাঁচিল তুলে প্রায় বন্দী করে দেওয়া হল আমাদের। অধিকাংশ সময় পাঁচিলের গেটে তালা দিয়ে দেয় ওরা। আমাদের কাছে কাজ নেই, খাবার নেই, ওষুধ নেই। এই পৃথিবী শুধু ধনিক শ্রেণীর জন্য। আজ যদি আমরা কিছু খাবার না পাই, তাহলে একদিনেই আমাদের বসতির অনেক বয়স্ক ও শিশু একদিনেই মারা যাবে। আমি একটু ফাঁক পেয়ে বেরিয়েছি যদি কিছু খাবার পাই, কিন্তু বোধহয় পাবো না।” ছেলেটার দু চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগলো।

“পাবে, খাবার পাবে। তুমি শুধু আমাকে বুঝিয়ে দাও তোমাদের পাঁচিলের গেট কোন দিকে।” দৃঢ় কণ্ঠে বলল রবি। ইতিমধ্যে তার হাতের ঘড়িতে সিগন্যাল চলে এসেছে। সময় শেষ হয়ে গেছে।

“খাবার দেবে তুমি? খাবার দেবে?”

“হুম। তুমি তাড়াতাড়ি বল।” টনি রবিকে পথ নির্দেশ বুঝিয়ে দিল। রবিও তাকে কিছু কথা বলল।

“আমি এখন আসছি।” রবি কারখানার পথ ধরল।

***

ট্রাক লোড করে ফেলেছে রবি। ঘর্মাক্ত শরীরে তাড়াতাড়ি ট্রাকটায় চড়ে বসল সে। তার কাকার চারটে ট্রাক আছে। শখ করে ট্রাক চালানোটা শিখেছে সে। অবশ্য এই আধুনিক ট্রাক চালানো আর তাদের ট্রাক চালানোয় বেশ কিছুটা পার্থক্য আছে। এই ট্রাক চালানো তাকে ট্রেনিং ক্যাম্পে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারখানার ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেল রবি। ট্রাকের জি পি এস সিস্টেমে তার গন্তব্য দেখতে পাচ্ছে, রবি কিন্তু রবির মন জানে তাকে পৌঁছতে হবে অন্য কোথাও। একটা টার্নিং-এ এসে রবি জি পি এসের নির্দেশ অমান্য করল। বামদিকের পরিবর্তে ডানদিকে ট্রাকের মুখ ঘোরালো সে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে রেড লাইট সিগন্যাল শুরু হয়ে গেল।

“রবি কী করছ তুমি? কোথায় যাচ্ছ?”

“আমি এই খাবার ভর্তি ট্রাক আপনাদের চোখে ওই বাতিল লোকগুলোর কাছে পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।”

“এর ফল কী হতে পারে তুমি জানো?” গ্যাম্বলারের কঠিন গলা।

“হ্যাঁ, কেন জানবো না। প্রমথ ভাইয়ার মত আমিও আর ক্যাম্পে ফিরবো না তাই তো?”

“সব জেনেও একাজ তুমি করবে?” গ্যাম্বলার সন্দিগ্ধ।

“আমি রবিন্দর সিং। আমাদের গুরুদ্বারের লঙ্গরখানায় নিজের হাতে লোককে পরিবেশন করে খাওয়াই। আমার পিতাজি প্রতি মাসে লঙ্গরখানার জন্য সাহায্য করেন আর আমি সব জেনে শুনে শুধু নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য এই ট্রাক নিয়ে চলে যেতে পারবো না।”

“তুমি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করছ রবি।” ধমকে ওঠে গ্যাম্বলার।

“আমি যে সময় থেকে এসেছি সেই সময় মানুষ এমন ভুলই করত। গুড বাই মিস্টার গ্যাম্বলার।” রবি এসে পৌঁছেছে বসতির গেটে। খোলা গেটের সামনে টনি দাঁড়িয়ে আছে। দুপাশে কঙ্কালসার বুভুক্ষু মানুষের সারি। রবি দ্রুত গতিতে ট্রাক নিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। রবি একবার পেছনে তাকালো তারপর সুইচ টিপে ট্রাকের ডালাটা উল্টে দিল। বাক্সগুলো মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল বাক্সগুলোর ওপর। তৃপ্ত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে ছিল রবি। তার সম্বিৎ ফিরল টনির ডাকে, “জলদি এখান থেকে বেরিয়ে চল নাহলে ওই ফ্যাক্টরি মালিকের লোকেরা তোমাকে ছাড়বে না।” টনি উঠে বসেছে চালকের পাশের আসনে।

***

নিঃশব্দে অন্ধকার কারখানা চত্বরটায় পা রাখলেন ইশতিয়াক। প্রথম দিনের মত আজও তাঁর সঙ্গী সীমাহীন অন্ধকার। আগের দুদিনের ব্যর্থতার শাস্তি স্বরূপ তাঁকে আজকের টাস্কটা দেওয়া হয়েছে। আগের দুদিন যেহেতু তিনি গ্যাম্বলারের নির্দেশ অমান্য করে স্বেচ্ছায় অপরাধীদের সাথে সম্মুখ সমরে নেমেছিলেন তাই আজ তাঁকে ওদের ইচ্ছায় একজন অপরাধীকে চিরতরে শেষ করতে হবে। শুধু তাই নয় আজ ব্যর্থ হলে আর কোনও সুযোগ পাবেন না ইশতিয়াক। আজ হয় মারতে হবে নাহলে মরতে হবে। পুলিশ সুত্রে খবর এই পরিত্যক্ত কারখানাটায় নাকি লুকিয়ে আছে সেই অপরাধী। ইশতিয়াকের খুব অবাক লাগছে পুলিশের কাজ তাকে করতে পাঠিয়ে দিল গ্যাম্বলার। সত্যিই লোকটা প্রবল ক্ষমতাশালী। বাইরের ফাঁকা জায়গাটা অতি দ্রুত পার হয়ে কারখানার ভেতরে ঢুকে এলেন ইশতিয়াক। তাঁকে খুঁজে বার করতে হবে কোথায় লুকিয়ে আছে সেই অপরাধী।

***

বসে বসে একটু তন্দ্রামত এসে গিয়েছিল রবির। তখন কিছুটা আসার পর তারা ট্রাকটা ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর দৌড়তে দৌড়তে টনি তাকে এখানে এনেছিল। এটা একটা পরিতক্ত্য কারখানা । টনি বলেছিল চট করে কেউ তাকে এখানে খুঁজতে আসবে না। এই কারখানার কিছুটা দূরেই নদী পথ। ওদিক দিয়ে পালানোর সুযোগ আছে, কিন্তু এই মুহূর্তে পালাতে গেলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে তাই এখন দিন দুয়েক রবিকে এখানেই লুকিয়ে থাকতে হবে। তখন তাকে এখানে রেখে দিয়েই টনি পালিয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যের অন্ধকার নামার একটু আগেই গোপনে আবার এসে কিছু খাবার আর কোথা থেকে একটা ইলেকট্রিক রড জোগাড় করে আত্মরক্ষার জন্য রবিকে দিয়ে গেছে। ফ্যাক্টরি মালিকের লোকেরা নাকি পাগলা কুকুরের মতো রবিকে খুঁজছে। গ্যাম্বলারের সাথে এখানে আসার পর রবির কথা হয়েছে কয়েকবার। রবিকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, রবি নিয়ম বিরুদ্ধ কাজ করেছে; শুধু তাই নয় রবির জন্য ফ্যাক্টরি মালিকের সাথে শো কর্তৃপক্ষের গণ্ডগোল হয়েছে, তাই রবি কোনও সাহায্য পাবে না। তবে সে যদি কোনও রকমে নদী পার হয়ে অন্যদিকে যেতে পারে, তাহলে আবার রবির দায়িত্ব ওদের।

***

ইশতিয়াকের মিলিটারি দক্ষতা তাঁকে বলল সামনের ঘরটায় সম্ভবত কেউ আছে। অন্ধকারেরও নিজস্ব একটা আলো থাকে। সেই চোখ সয়ে যাওয়া আলোতেই এগিয়ে গেলেন ইশতিয়াক। তাঁর সন্দেহ নির্ভুল ছিল। ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মানুষটাও ইশতিয়াকের উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে। দুড়দাড় করে ছুটে পালানোর চেষ্টা করল সে। ইশতিয়াকও ছুটলেন তার পদধ্বনি অনুসরণ করে। বাতিল যন্ত্রপাতিতে ভর্তি কারখানার মধ্যে যেন একটা লুকোচুরি খেলা চলছে। ছুটতে ছুটতে একটা বড় হলের মত জায়গায় ঢুকে পড়লেন ইশতিয়াক। ইশতিয়াক যতদূর বুঝতে পারলেন এই ঘরটা থেকে বেরোনোর রাস্তা একটাই আর সেই দরজাটা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি তাই ঘরের মধ্যে উপস্থিত দ্বিতীয় ব্যক্তির পালাবার পথ নেই। ইশতিয়াক খুব সন্তর্পণে একটু একটু করে এগোচ্ছেন। তিনি মোটামুটি আন্দাজ করতে পারছেন সে কোথায়। আচমকা ঘরের মধ্যে একটা আলো জ্বলে উঠলো। ইশতিয়াক সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাতের রডটা তুলে ধরলেন। অপরপক্ষও কাঁপা কাঁপা হাতে রড তুলে ধরেছে। এতক্ষণ চোর পুলিশ খেলা দুই প্রতিপক্ষ পরস্পরের দিকে হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে রইল কিচ্ছুক্ষণ।

“রবি!”

“ইশতিয়াক ভাইয়া তুমি আমাকে বাঁচাতে এসেছ? আমি শুধু শুধু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।” রবির চোখ মুখ উজ্বল হয়ে উঠল। রড নামিয়ে সে ইশতিয়াককে জড়িয়ে ধরল। রবির খুশিতে ইশতিয়াক সামিল হতে পারলেন না। বয়স এবং অভিজ্ঞতায় বড় ইশতিয়াকের বুঝতে বাকি রইল না গত দুদিন অবাধ্য হওয়ার শাস্তিটা কতটা ভয়ঙ্কর হতে চলেছে। গ্যাম্বলার কেন একদিন বলেছিল যে, এটা জীবন মৃত্যুর খেলা, সেটাও আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছেন ইশতিয়াক।

“তুই এখানে এলি কেমন করে তাড়াতাড়ি বল?”

রবি গড়গড় করে সব বলে গেল।

“চল তাড়াতাড়ি তোকে নদী পার করে দিই।” ইশতিয়াক রবিকে বলেন। ইশতিয়াক নিজের অন্তিম পরিণতি ভালই আন্দাজ করতে পারছেন। এর চেয়ে যুদ্ধের সময় দেশের হয়ে শহিদ হয়ে গেলে অনেক শান্তি পেতেন তিনি। এখন রবিকে রক্ষা করাই তাঁর আসল লক্ষ্য। আজ সকালেও যে ওকে ‘বেস্ট অফ লাক’ বলেছিলেন। রবিকে তাঁর এখানে আগমনের আসল কারণ জানতে দিতে চান না ইশতিয়াক। ও জানুক ওর ইশতিয়াক ভাইয়া ওকে বাঁচাতে এসেছে।

“ইশতিয়াক কিল হিম।” গ্যাম্বলারের নির্দেশ ভেসে এল যেটা রবির কানেও গেল। রবি অবাক হয়ে ইশতিয়াকের দিকে তাকাল। ইশতিয়াক শুধু বললেন,” এখান থেকে চল।” রবিকে নদী পার করে দিলে তাঁকে হয়ত মরতে হবে কিন্তু রবির দায়িত্ব ওরা আবার নিয়ে নেবে।

“ইশতিয়াক কিল হিম। দিস ইজ ইয়োর টাস্ক।”

“ইশতিয়াক ভাইয়া গ্যাম্বলার কি বলছে?” রবির গলাটা কেঁপে গেল।

“আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি রবি। এই মুহূর্তে তুমি আর ইশতিয়াক একটা জীবন মৃত্যুর দাঁড়িপাল্লার দুদিকে ঝুলছ। অন্যদিকটা ফাঁকা করতে পারলে তবেই জীবনের দিকে ঝুঁকবে নাহলে সোজা ওপরে।” গ্যাম্বলার বলে। রবি কিছু বুঝতে না পেরে অসহায় ভাবে ইশতিয়াকের দিকে তাকায়। উপায়ান্তর না দেখে ইশতিয়াক সব সত্যি বলেন। ইশতিয়াকের কথা শেষ হতে না হতেই গ্যাম্বলারের গলা ভেসে আসে, “তোমাদের দুজনের সামনেই এখন একটাই অপশন। একে অন্যকে শেষ করার চেষ্টা করা কারণ একমাত্র তাহলেই যে কোনও একজন সারভাইভ করবে। আমাদের দর্শকবৃন্দ একটা ফাটাফাটি ডুয়েল দেখার অপেক্ষায়।”

“আপনি কী বলছেন এসব?” রবি চেঁচিয়ে ওঠে।

“মাই ডিয়ার ইয়াং চ্যাপ। ইশতিয়াক যদি তোমাকে না মারতে পারে তাহলে আমার কিলার রোবট দশানন ওকে শেষ করে দেবে, আর তোমার অবস্থা তো বুঝতেই পারছ। খুবই খারাপ। নিজে বাঁচতে চাইলে ইশতিয়াককে মারতে হবে। তোমারে বধিবে যে, সামনে দাঁড়ায়ে সে। খিক খিক খিক।” নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতে থাকে গ্যাম্বলার।

“আমি পারব না ইশতিয়াক ভাইয়াকে মারতে।”

“ওকে ফাইন, ইশতিয়াক নাও ইয়োর টাস্ক ইজ ভেরি ইজি। আপনার প্রতিপক্ষ তো খেলার আগেই গেম ছেড়ে দিল।”

“রবি চল এখান থেকে।”

“ইশতিয়াক, আপনি ভীষণ অবাধ্য, আর আপনার মত অবাধ্য ছেলেকে শায়েস্তা করার জন্য দশানন আর দানব বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। আর ওরা কোনও মানুষ নয় যে আপনি ওদের লড়াই করে হারাবেন। রবিকে নিয়ে বেরোলেই ওরা আপনাকে শেষ করে দেবে আর রবি আমি তোমাকে একটা দারুণ অফার দিচ্ছি। তুমি বাচ্চা ছেলে তাই তোমার ওপর দয়া হচ্ছে আমার। ইশতিয়াককে অবাধ্যতার শাস্তিটা তুমিই দিয়ে দাও তাহলে, আর তোমাকে ওই নদী পেরোনোর ঝামেলা করতে হবে না। আমার রোবট দুটো এক্ষুনি গাড়িতে করে রাজ খাতিরে তোমাকে ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনবে। তোমার হাতের ওই রডটার সুইচ টিপে শুধু ওর গায়ে ছুঁইয়ে দাও। ব্যস তোমার মুক্তি। তোমরা তো কয়েকদিন আগে পর্যন্ত কেউ কাউকে চিনতেও না তাহলে এত দ্বিধা দ্বন্দ্ব কিসের আমি তো বুঝে পাচ্ছি না।”

রবি আর ইশতিয়াক কিছুক্ষন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর ইশতিয়াক বললেন, “তোর হাতের রডটা আমার গায়ে ছুঁইয়ে দে রবি।”

“পারব না। তোমার রডটা আমার গায়ে ছুঁইয়ে দাও ভাইয়া। তোমার কিছু হয়ে গেলে তোমার মেয়ে কোনও দিন তার বাবাকে দেখতেই পাবে না।”

“আর তোর কিছু হয়ে গেলে তোর আম্মি তো তোর পথ চেয়েই মরে যাবে। তুইই তো বলেছিলি। তুই আমার ছোট ভাইয়ের মত। আমাকে ভাইয়া ডাকিস, আমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য তোকে মারতে পারব না। আমি একজন সৈনিক আমি দেশের শত্রু নিধন করি। নিজের ভাইয়ের জান নিতে আমি পারব না।”

“ইমোশনাল ফুলস। বি প্র্যাকটিক্যাল। হারি আপ। আমাদের দর্শক তোমাদের এই ইমোশনাল ড্রামা নয়, অ্যাকশন দেখতে চায়।” গ্যাম্বলার অধৈর্য।

“ওকে।” রবি নিজের রডটা অন করে নিজের শরীরেই ছুঁইয়ে দিল। তার স্থির বিশ্বাস ছিল ইশতিয়াক ভাইয়া তাকে মারতে পারবে না।

“রবি!” রডটা ছুঁড়ে দিয়ে চিৎকার করে ছুটে গিয়ে রবির এলিয়ে পড়া শরীরটা নিজের কোলে তুলে নিলেন ইশতিয়াক। এক ফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়ল রবির কপালে। বোকা ছেলেটা তাঁকে বাঁচাতে নিজেকে শেষ করে দিল! রবির হাত থেকে পড়ে যাওয়া রডটা তুলে নিজের শরীরে ছুঁইয়ে দিলেন ইশতিয়াক। রবির জীবনের বিনিময়ে বেঁচে থাকার কোনও ইচ্ছেই তাঁর নেই। বেঁচে থাকার আর কোনও চেষ্টা করতে চান না তিনি। ওই অমানুষ গ্যাম্বলারের নামানুষগুলোর হাতে মরার চেয়ে একজন সৈনিকের এই সম্মানজনক মৃত্যু।

“AU REVOIR, AU REVOIR! ইমশনাল ফুলস।” গ্যাম্বলার চিৎকার করে উঠলো।

জোস গাড়ীর গতি বাড়ালো। তাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দূরের একটা জায়গায় পৌঁছতে হবে। তারপর সেখানে তাকে টাস্ক দেওয়া হবে। তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর জন্য জোস স্কাই পাথ ধরে চলেছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দামী গাড়ী ছাড়া স্কাই পাথে চলতে পারে না তাই এখানে ভিড়টা কম হয়। গাড়ী অবশ্য চালানোর বিশেষ কিছু নেই। সব কিছুই স্বয়ংক্রিয় শুধু প্রয়োজন মত সবকিছু সেট করে বসে থাকা। জোসের গাড়িটা স্বচ্ছ ফাইবার জাতীয় জিনিস দিয়ে তৈরি। জোস চারিদিকটা ভালো করে দেখছিল। সত্যিই এরকম একটা গাড়িতে চেপে যাচ্ছে এটা তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।

“কেমন লাগছে জোস?” গ্যাম্বলারের কণ্ঠ।

“আপাতত ভালোই লাগছে। এরপর আপনাদের দয়া।” শ্লেষ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল জোস।

“হুম তা ঠিক। যাইহোক তোমার গাড়ির স্ক্রীনের দিকে তাকাও, ওখানে জুডাসের ছবি দেখতে পাবে। জুডাস ইজ আ ফ্রেন্ডলি ম্যান । তোমার যে কোনও প্রয়োজনে ও তোমাকে হেল্প করবে। তোমার কিছুদুরেই ও গাড়ি নিয়ে থাকবে।”

“ওকে।” স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে জোস একবার জুডাসের চেহারাটা দেখে নিল। লম্বা শক্তপোক্ত চেহারার একটা লোক। জোস আবার বাইরে মন দিল। ঝকঝকে নীল আকাশ। হঠাৎই সাঁ করে একটা গাড়ী জোসের গাড়িটাকে ওভারটেক করল। জোসের একটু অবাকই লাগলো কারণ ও যেটুকু জেনেছে তাতে স্কাই পাথে এরকম ওভারটেকের ঘটনা ঘটে না। সামনে আর কোনও গাড়ী নেই। ওই গাড়িটাকেই দেখা যাচ্ছে। গাড়িটার গতি অস্বাভাবিক মনে হল জোসের। গাড়িটা হঠাৎ সাঁত করে নীচের দিকে নামতে লাগলো। আশ্চর্য হল জোস। গাড়ীটা নীচের হাইওয়েতে না নেমে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। অবাক কান্ড আরেকটা গাড়ী একইরকম ভাবে হুশ করে জোসকে পেরিয়ে গেলো। আবার কয়েক সেকেন্ড পরে উল্টো লেনে ঘুরে চলে এল। কিছু একটা গণ্ডগোল মনে হচ্ছে। কিন্তু কী? জোস এগিয়ে চলল।

***

বিপ বিপ বিপ। জোসের গাড়িতে একটা সিগন্যাল আসছে। কেউ ওর সাহায্য চাইছে। এই অত্যাধুনিক গাড়িগুলোতে এখন নাকি একরকম প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় যাতে অন্য কোনও গাড়ির আরোহী কোনও বিপদে পড়লে তার কাছাকাছি থাকা অন্য গাড়ির কাছে সাহায্য চাইতে পারে। স্ক্রীনে দেখাচ্ছে জোসের গাড়ির দুশ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে রয়েছে গাড়িটা। আর একটু এগোতেই স্ক্রীনে ফুটে ওঠা তীর চিহ্ন অনুসরণ করে জোস দেখতে পেল গাড়িটা। এটা সেই হুশ করে পেরিয়ে যাওয়া প্রথম গাড়িটা। হাইওয়ের পাশে একটা হাল্কা জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা মনে হয় অ্যাকসিডেন্ট করেছে।

“কী ভাবছ জোস? গাড়িটাকে সাহায্য করবে?”

“আপনারা কি সব কথা জানতে পেরে যান?”

“জোস এটা রিয়ালিটি গেম শো। তোমাদের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর আমাদের নজর আছে।”

“কী করে এভাবে নজর রাখেন?”

“এটা ২০৭৫ জোস। নাথিং ইজ ইম্পসিবল নাও। তোমার প্রতিটি মুভমেন্ট আমাদের ক্যামেরা বন্দী।”

“আমি তো ক্যামেরা দেখতে পাচ্ছি না।”

“আরে জোস। এখন ওই এত্ত বড় ক্যামেরার দিন আর নেই। এখন প্রযুক্তি অনেক অনেক এগিয়ে গেছে। যাইহোক কী করবে ভাবছ?”

“অবশ্যই গাড়ীর আরোহীকে সাহায্য করব।”

“তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ। তোমাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টার্গেট পয়েন্টে পৌঁছতে হবে। ওখানে তোমাকে টাস্ক দেওয়া হবে।”

“পৌঁছতে একটু দেরি হলে কী ক্ষতি হবে? সবই তো আপনাদের হাতে।”

"তুমি একটা গেমের পার্টিসিপেন্ট আর প্রত্যেক গেমের একটা রুলস থাকে জোস। কোনও দিকে না তাকিয়ে এগিয়ে যাও।” নির্দেশ আসে গ্যাম্বলারের কাছ থেকে।

***

“সরি, জোস ডিসুজা সেটা পারবে না। আমি তো অনেক পুরোনো দিনের মানুষ, তারওপর শিক্ষক। আমার মোরাল ভ্যালুস তোমাদের থেকে অনেকটাই আলাদা।” কথা বলতে বলতেই জোস তার গাড়িটা ল্যান্ড করাল সেই গাড়িটার পাশে।

“তাহলে তুমি আমার কথা শুনবে না?” এবার রাগত স্বর গ্যাম্বলারের।

“বললাম তো পারব না।” জোস নিজের গাড়ী থেকে নেমে পড়ল। গাড়িটার দরজা খোলা। জোস গাড়ীর দরজাটা খুলে দেখলো ভেতরের আরোহীর কপাল কেটে রক্ত পড়ছে, তবে জ্ঞান হারায়নি। বছর তেইশ বয়স হবে ছেলেটির।

“প্লীজ, হেল্প মী।”

“কী হয়েছে তোমার?”

“আগে তাড়াতাড়ি এখান থেকে নিয়ে চলো আমায়। পরে সব বলছি। আমার খুব বিপদ। আমার গাড়ির সোলার প্যানেলটা নষ্ট হয়ে গেছে।”

“ঠিক আছে চলো।” জোস ছেলেটাকে গাড়ি থেকে বের হতে সাহায্য করল।

“একটু দাঁড়াও।” ছেলেটা ওর গাড়ির পেছন থেকে একটা বাক্স বের করল।

“চলো।”

“আগে তোমাকে একটা জিনিস দেখাই তারপর বলব।” হাত বাড়িয়ে পেছনের বাক্সের ডালাটা তুলে ধরল ছেলেটি। জোস অবাক হয়ে দেখলো বাক্সের মধ্যে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে একটি ব্যাঘ্র শাবক। বিস্ময়ে জোসের মুখে প্রায় কথা নেই। ছেলেটি বলল, “জানি তুমি ভীষণ অবাক হয়েছ। তোমাকে বিশ্বাস করে আমি সব কথা বলছি। না বলে আমার উপায়ও নেই।” ছেলেটি বলে চলল, "আমার নাম বিদ্যুৎ রায়। আমার বাবা আকাশ রায় একজন পরিবেশবিদ এবং বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ। নাম শুনে থাকতে পারো আমার বাবার।” জোস নিঃশব্দে মাথা নাড়লো।

বিদ্যুৎ আবার বলে চলল, “জানো নিশ্চই মানুষের অপরিসীম লোভের কারণে বিশ্বের বহু প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং বহু প্রাণী বিপন্ন। মানুষ কিছুতেই বুঝছে না যে এরাও ইকো সিস্টেমের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এইসব প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেলে একদিন মানুষও বিপদে পড়বে। যাইহোক আমার বাবা সরকার এবং কিছু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের সহায়তায় একটা প্রাকৃতিক গবেষণাগার বানিয়েছেন সেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশে এইসব বিপন্ন প্রাণীদের সংরক্ষণ করার, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছেন। এরজন্য বহু অসাধু মানুষের সঙ্গে তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। এই যে শাবকটি দেখছ এটি পৃথিবীর সর্বশেষ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। এর মাকে চোরা শিকারীরা মেরে ফেলেছে। আমি একে বহুকষ্টে বাঁচিয়ে বাবার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। এটা বাঘিনী। আমাদের গবেষণাগারে বাঘের শুক্রাণু সঞ্চিত আছে। একে নিয়ে গেলে হয়ত পৃথিবীতে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব টিকে যাবে কিন্তু ওরা আমায় তাড়া করছে। বাধ্য হয়ে বাচ্চাটাকে আমি ট্র্যানকুলাইজার দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি।”

“ওরা এইটুকু বাচ্চাকে নিয়ে কী করবে?”

“এটা পৃথিবীর সর্বশেষ রয়াল বেঙ্গল টাইগার। মানে বুঝতে পারছ? একে নিয়ে গিয়ে প্রচুর টাকায় কোনও ধনীর ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেবে। তার ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানায় বেঁচে থাকবে তারপর ব্যস।” হতাশা ঝরে পড়ে বিদ্যুতের গলায়। জোস চুপচাপ বিদ্যুতের নির্দেশিত পথে গাড়ী ছুটিয়ে দেয়। তার মন উথাল পাথাল। তার গাড়ির পেছনে যে বাঘের ছানাটা ঘুমোচ্ছে সে নাকি এই পৃথিবীর শেষ রয়্যাল বেঙ্গল! জোস আর কিছু ভাবতে পারছে না।

“ওরা তাড়া করে আসছে আমাদের পেছনে। ওরা বুঝতে পেরে গেছে।” বিদ্যুৎ আতঙ্কিত হয়ে বলে। জোস দেখে সেই দ্বিতীয় গাড়িটা প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে আসছে।

“ওরা গুলি ছুঁড়ছে।” একটা গুলি এসে জোসের গাড়ির সোলার প্যানেলে লাগলো।

“এবার কী করবে? এই গাড়ি নিয়ে তো বেশিদূর যাওয়া যাবে না।” বিদ্যুৎ ভয় পেয়ে গেছে।

জোসের হঠাৎ মনে পড়ে যায় জুডাসের কথা। তার তো কাছাকাছি থাকার কথা।

“চিন্তা করো না আমি ব্যবস্থা করছি।”

***

জোস একটু চিন্তিত ছিল জুডাস ওকে সাহায্য করবে কিনা কারণ আদপে তো এই বিপদে জোস নিজে পা দিয়েছে। গ্যাম্বলার ওকে বারণ করেছিল। জোস ভাবছিল গ্যাম্বলার ওকে বারণ করে দেবে কিন্তু যাইহোক সেরকম কিছু ঘটল না। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জুডাস ওদের উদ্ধার করল শুধু তাই নয় জুডাসের গাড়ীটা সেলফ প্রোটেক্টিভ মানে গাড়ীতে হালকা অস্ত্রশস্ত্র সংযুক্ত আছে। জুডাসের গাড়ী থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গুলির ঝাঁক ছুটে যেতেই বিদ্যুতের শত্রুপক্ষ রণে ভঙ্গ দিল। ইতিমধ্যে গ্যাম্বলার একবার জোসকে সাবধান করেছে সময় নিয়ে কিন্তু জোস পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, সে আগে বিদ্যুৎকে তার গন্তব্যে পৌঁছবে। তারপর নিজের গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেবে।

***

“এখানে গাড়ী থামালেন কেন? আরও বেশ কিছুটা যেতে হবে।” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে বিদ্যুৎ।

“হুম জানি, কিন্তু এখানে একটু নামতে হবে। গাড়ীতে প্রবলেম হয়েছে।”

“ওকে।” বিদ্যুৎ আর জোস নেমে পড়ল।

“বাক্সটা নামালে কেন?” গর্জে উঠল জুডাস। বিদ্যুৎ পেছনের সিটে বাক্সটা নিয়ে বসেছিল। নামার সময় বাক্সটাও নামিয়ে নিয়েছে।

“ও বাক্সটা নামিয়েছে তাতে সমস্যা কী?” বিস্মিত জোস প্রশ্ন করে। জুডাসের ঠোঁটের কোণে শয়তানের হাসি খেলে যায় আর হাতে পিস্তল নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসে।

“বাঘের বাচ্চাটা আমাকে দিয়ে দাও।”

“মানে? কী বলছ তুমি জুডাস?”

“মানে ভেবে দেখলাম এই প্রোডাকশন হাউসে কাজ করে সারাজীবনে যত মাইনে পাবো এই একটা বাঘের বাচ্চায় তার থেকে অনেক বেশি রোজগার হবে।” পিস্তল নাচিয়ে বলে জুডাস।

“তুমি বুঝতে পারছ না। এই বাচ্চাটা...।”

“আরে ছাড়ো ওসব ফালতু কথা।” জুডাস পিস্তল হাতে এগিয়ে আসছে।

জোস বিদ্যুতের কাছে সরে আসে, “আমি জুডাসকে আটকাচ্ছি, তুমি বাচ্চাটাকে নিয়ে পালাও।”

ঠিক সেই মুহূর্তেই গ্যাম্বলারের গলা ভেসে এল, “জুডাসের সাথে তুমি পারবে না জোস। ওর কথা শোনো নাহলে তোমার প্রাণ সংশয় হবে। ও যা বলছে তাই কর।” জোসের গলা দিয়ে শুধু একটা শব্দই বার হল, “ইম্পসিবল।” জুডাস ওদের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। জোস কিছু না ভেবে জুডাসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জোসও যথেষ্ট শক্ত সামর্থ। সে আর জুডাস জড়াজড়ি করে মাটিতে পড়ে গেল।

“বিদ্যুৎ পালাও।” বিদ্যুৎ তৈরিই ছিল। ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠে মুহূর্তের মধ্যে ওপরের স্কাই পাথ ধরল সে।

“গাড়ীর সেলফ ফোনের সাথে কানেক্ট করেছি। ওকে ফিরে আসতে বল, নাহলে তুমি শেষ।” নিজের ফোনটা বাড়িয়ে দাঁতে দাঁত চিপে কথাগুলো বলল জুডাস। জোস মাটিতে পড়ে আছে। স্বাভাবিক ভাবেই জুডাসের সঙ্গে দীর্ঘসময় লড়াই করা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। কিন্তু যেটুকু সময় পেরেছে, তাতেই বিদ্যুৎ পালিয়ে গেছে।

“ওর কথা শোনো জোস, নাহলে আমরা এখান থেকে তোমাকে বাঁচাতে পারব না। ও তোমাকে শেষ করে দেবে।” গ্যাম্বলারের গলা ভেসে এল জোসের কানে।

“নিজের জীবনের মায়া করলে তো প্রথমেই পালিয়ে যেতাম। তোমরা ভবিষ্যতের মানুষ প্রকৃতিকে এভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছ। আমি অতীতের মানুষ, নাহয় একটু প্রায়শ্চিত্ত করলাম।”

“নাও ইউ আর ফিনিশ।” জুডাসের পিস্তলটার লক্ষ্য এখন শুধুমাত্র জোস।

পর্দায় গ্যাম্বলারের শান্ত কণ্ঠস্বর, “AU REVOIR.”

“হ্যাঁরে, অরিত্র এই ধু ধু প্রান্তরে আমাদের তিনদিন কাটাতে হবে!”

“হুম, সেটাই তো আমাদের টাস্ক বলে জানাল ওরা।”

অরিত্র আর আইভিকে ওরা একটা প্রায় মরু অঞ্চলে ছেড়ে দিয়ে গেছে। সঙ্গে সামান্য শুকনো খাবার আর জল। এইচ টু ও ট্যাবলেটও মাত্র দুটো দিয়েছে। ওদের কাজ হল সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে এখানে তিন দিন কাটাতে হবে। কোনও রকম সাহায্য ওরা পাবে না। এমনকি ওদের প্রাণ সংশয় হলেও না। শুধুমাত্র একটা পুরোনো আমলের গাড়ী রাখা আছে যেটা প্রয়োজনে ওরা ব্যবহার করতে পারে।

“আমরা থাকব কোথায় রে?” চিন্তিত আইভি প্রশ্ন করে।

“গাড়িটাই সেফ জায়গা বলে আমার মনে হচ্ছে।”

“তাই ভালো। কী অদ্ভুত ভাবে আমরা এই পরিস্থিতিতে এসে পড়লাম বলত। দুজনে আড্ডা দিচ্ছিলাম নিশ্চিন্তে সেখান থেকে...।” আইভির কথা শেষ হল না গ্যাম্বলারের গলা ভেসে এল।

“হ্যালো ফ্রেন্ডস, কেমন লাগছে তোমাদের?”

“এই ধু ধু মরু প্রান্তরে অবশ্যই খুব ভালো লাগছে।” ব্যঙ্গ করে বলল অরিত্র।

“রেগে আছ মনে হচ্ছে, কিন্তু কিছু করার নেই এটাই তোমাদের টাস্ক। আর একটা কথা তোমাদের টাস্কটা তো খুব সহজ বলেই আমার মনে হচ্ছে। কিচ্ছু করতে হবে না শুধু তিনটে দিন এখানে কাটাতে হবে তাই আমি ঠিক করেছি তোমরা আমাদের দর্শকদের সাথে গল্প করবে। তাদের প্রশ্নের উত্তর দেবে। তোমাদের গাড়িতে একটা ভিডিও কলার লাগানো আছে। তোমরাও প্রশ্নকারী দর্শককে দেখতে পাবে।”

“মানে?”

“মানে আমাদের দর্শকরা তোমাদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাইতে পারেন। তোমাদের সময়ের কথা বা অন্য যে কোনও বিষয় তোমাদের শুধু তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। ওকে?”

“ওকে।” হতাশ গলায় বলে আইভি।

***

“আর পারছি না রে।”

“আমিও আর পারছি না। সেই সকাল থেকে লোকের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছি।” অরিত্র বলে।

“সত্যিই এখনকার মানুষের মনে আমাদের সময় সম্বন্ধে কতরকম প্রশ্ন।”

“শুধু কি তাই এরা তো দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি অনেক বিষয়েই কিচ্ছু জানে না।”

“গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে রে। একটু জল দেনা।” আইভিকে দেখে মায়া হল অরিত্রর। জলের বোতলটা হাতে তুলে বুঝতে পারল তলায় একটুখানি জল আছে। মরু প্রান্তরের গরমে সারাদিন বকবক করতে করতে বারবার গলা শুকিয়ে এসেছে আর খেয়াল না করে কখন যে এতটা জল খেয়ে ফেলেছে বুঝতেও পারেনি ওরা। অরিত্রর নিজেরও ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে, কিন্তু আইভির জন্য ও সব কষ্ট সহ্য করতে পারে। বোতলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নে জল খেয়ে একটু ধাতস্থ হ।” বোতলটা হাতে নিয়ে আইভি চমকে উঠল, “জল যে শেষ রে।”

“শেষ নয়, একটু আছে তুই খেয়ে নে।”

“আর তুই?”

“আমার তেষ্টা পায়নি। তুই খা।” আইভি আর কিছু না বলে খুব সাবধানে অল্প একটু জল খেয়ে বোতলটা অরিত্রকে দিয়ে বলল, “জলটা খেয়ে নে।”

“ওইটুকু জলের আবার আমার জন্য কী রেখেছিস? তুই খেয়ে নে তোর কষ্ট হবে।”

“একদম বেশি বকবক করবি না। তোর নাকি তেষ্টা পায়নি। নিজের মুখটা দেখেছিস? শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে। খা বলছি।” আইভির প্রশ্রয় মিশ্রিত ধমক খেয়ে জলটুকু খেয়ে নেয় অরিত্র। ট্যাবলেট দুটো পরের দিনের জন্য রেখে দেয় তারা।

***

“এই আমাকে বেশি বিস্কুট দিচ্ছিস কেন?”

“খিদে পেলে তোর কী হাল হয় আমি কি জানি না ভেবেছিস? তোকে তোর চেয়ে বেশি চিনি আমি।” চোখ পাকিয়ে বলে আইভি। তাদের অবশিষ্ট বিস্কুট প্যাকেটটা শেষ করতে করতে খুনসুটি চলতে থাকে দুজনের।

“ফ্রেন্ডস তোমরা আজকের প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য প্রস্তুত তো?”

“হুম। প্রস্তুত না হয়ে উপায় আছে?”

“এটা ঠিক বলেছ আইভি। লেটস স্টার্ট।”

***

“এই অরিত্র মনে হচ্ছে শোয়ের লোকজন আমাদের জন্য খাবার, জল আনছে। দ্যাখ একটা বড় গাড়ী আসছে।”

“হ্যাঁরে, বাঁচা গেল। ট্যাবলেট দুটোও তো খেয়ে ফেলেছি।”

আইভি অতি উৎসাহে গাড়ী থেকে নেমে সামনে এগিয়ে গেল, কিন্তু এরপর যা ঘটল তার জন্য ওরা কেউই প্রস্তুত ছিল না। গাড়ীর আরোহীরা দরজা খুলে নিমেষের মধ্যে আইভিকে ভেতরে টেনে নিয়ে গাড়ী চালিয়ে দিল। হতভম্ব অরিত্র কয়েক সেকেন্ড পরে সম্বিৎ ফিরে পেতেই ছুটে এসে গাড়ী স্টার্ট করে গাড়ীটাকে ফলো করতে আরম্ভ করল। কী ঘটলো বুঝতে না পেরে সে গ্যাম্বলারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল।

“হ্যালো, আপনাদের গাড়ি আইভিকে ওইভাবে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কেন?”

“ওটা আমাদের গাড়ী নয়।”

“তাহলে?”

“শিওর নই, তবে মনে হচ্ছে হিউম্যান ট্রাফিকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত কোনও দল এটা ঘটিয়েছে। ওরা এভাবেই আচমকা মানুষ তুলে নেয়।”

“মানুষ তুলে নেয় মানে?”

“ওরা মানুষের ব্যবসা করে। অনেকের গোপন ল্যাবে মানুষকে গিনিপিগ বানিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে। সেখানে মানুষ সাপ্লাই দেয়। তাছাড়া পর্ন ইন্ডাস্ট্রি বা ব্রোথেল তো আছেই।” গ্যাম্বলার এমন ভাবে কথাগুলো বলল যেন সামান্য ব্যাপার।

“কী বলছেন কী আপনি?” আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল অরিত্র।

“যা সত্যি তাই বললাম।” স্বাভাবিক ভাবেই বলল গ্যাম্বলার।

“প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন।” কাতর অনুরোধ করে অরিত্রর।

“প্রথম কথা শর্ত অনুযায়ী তিনদিন তোমাদের নিজেদের ক্ষমতায় সারভাইভ করতে হবে। আমরা কোনও হেল্প করব না আর দ্বিতীয় কথা তোমার কোনও সাহায্যের তো প্রয়োজন নেই।”

“সাহায্যের প্রয়োজন নেই মানে কী?”

“মানে বিপদে পড়েছে আইভি। তুমি নও। তুমি স্বচ্ছন্দে আজকের আর কালকের দিনটা কাটিয়ে নিজের টাস্ক কমপ্লিট করতে পারো। তারপর নিজের সময়ে ফিরে যেতে পারো। আইভি যদি পারে ওদের কাছ থেকে মুক্ত হতে, তাহলে ওকে আমরা অবশ্যই সেকেন্ড চান্স দেব।”

“নিজের সময়ে ফিরে যাবো আইভিকে ছাড়া!”

“হুম। সমস্যা কী? তুমি আইভিকে এখানে আনোনি। আমি এনেছি। আর তোমরা একই সময় থেকে এসেছ বলে একসাথে টাস্ক দেওয়া হয়েছিল। এমন কোনও কন্ডিশন আমরা রাখিনি যে দুজনকে একসাথে টাস্ক কমপ্লিট করতে হবে। তুমি সম্পূর্ণ স্বাধীন। আইভির কোনও দায় তোমার নেই। ওদের ফলো না করে ফিরে গিয়ে টাস্ক কমপ্লিট কর।”

বালির ওপর দিয়ে গাড়ী চালাতে রীতিমতো কসরত করতে হচ্ছে তবুও তার মধ্যেই অরিত্র জবাব দিল, “আপনার হিসেবে আইভির কোনও দায়িত্ব আমার না হতে পারে, কিন্তু আমার হিসেবে আইভির সমস্ত দায়িত্ব আমার। ওকে এই বিপদ থেকে বাঁচানো আমার কর্তব্য।”

“তুমি ভুল করছ অরিত্র। আবার বলছি আইভির কোনও দায় তোমার নয়। তুমি নিজে নিরাপদে থাকো। মানছি আইভি তোমার বন্ধু, কিন্তু তার জন্য নিজে কেন প্রাণের ঝুঁকি নিচ্ছ। যারা ওকে তুলে নিয়ে গেছে তারা ভয়ঙ্কর লোক।”

“আইভি আমার সেই বন্ধু যে ছোট থেকে সমস্ত বিপদে আপদে, সুখে-দুঃখে আমার পাশে থেকেছে। আমি আইভিকে ভালোবাসি। ওকে বিয়ে করে সারা জীবনের জন্য ওর পাশে থাকব ঠিক করেছিলাম, আর আজ ওকে এইভাবে একটা অচেনা সময়ে, অচেনা জায়গায় ফেলে পালিয়ে যাব।”

“বিয়ে? ওহ, অরিত্র হাসালে তুমি। জানো তো এখন আর কেউ ওই প্রেম, বিয়ে এসব নিয়ে ভাবে না। বিশ্বাস করে না এসবে। জীবনে উটকো ঝামেলা, দায়িত্ব কেউ চায় না। ইচ্ছে হলে দু চারদিন লিভ ইন করে নেয়।”

“আমি তো এখনের মানুষ নই। আমাদের সময়ের মানুষ ভালোবাসা, বিয়ে সব কিছুতে বিশ্বাস করত। যাকে আপনারা উটকো ঝামেলা, ফালতু দায়িত্ব ভাবেন তার মধ্যেই জীবনের সুখ খুঁজে পেত। যাইহোক আপনারা আমাকে হেল্প করবেন কিনা বলুন।”

“তুমি কি ফিরবে না?”

“নাহ।”

“ইউ নো, ইউ আর আ বিগ ফুল অরিত্র।”

“হতে পারে আপনাদের হিসেবে আমি বোকা, কিন্তু আমি একটা কথা খুব ভালোভাবে জানি আইভিকে ছাড়া আমার জীবনটা অসম্পূর্ণ। হয়ত কথাগুলো ফিল্মি শোনাচ্ছে, কিন্তু এটাই সত্যি। ও আমার জীবনের কতখানি আপনাদের বোঝার সাধ্য নেই। আমি চললাম আইভির খোঁজে। যদি মনে হয় সাহায্য করবেন জানাবেন আমাকে।” অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে গাড়ীটা। অরিত্র গাড়ীর গতি বাড়ালো।

***

এই দলটার নাম “দ্য অসুরস”। এদের ব্যবসাই হল সুযোগ পেলে কিডন্যাপিং করা তারপর সুযোগ বুঝে তাদের বিক্রি করা। গ্যাম্বলার দয়া করে এইটুকু তথ্য জানিয়েছে অরিত্রকে। একটা উঁচু বালিয়াড়ির পাশে বিশাল লম্বা একটা গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটার পেছনে ওরা আইভিকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তারপর গাড়ীটা নিয়ে চলে গেছে। বোধহয় আবার কোনও মানুষ তুলতে গেছে। অরিত্র একটু দূরে আড়াল থেকে দেখছিল সব। চারিদিক শুনশান, মাথার ওপর গনগনে সূর্য।

“অরিত্র এখনও ভেবে দেখো?” গ্যাম্বলারের গলা ভেসে এল অরিত্রর কানে।

“ভেবে দেখার কিছু নেই। আমি শুধু একটা কথাই ভাবছি যে আপনি এখনও আমার ওপর নজর রাখছেন, কিন্তু আমাকে একটু সাহায্য করছেন না!”

“এটা তো রুলসের বিরুদ্ধে।”

“রাখুন আপনার রুলস।” কথা বলতে বলতেই অরিত্র কানের পাশে ঠান্ডা ধাতব স্পর্শ অনুভব করল। ধরা পড়ে গেছে সে।

***

“অরিত্র!” আইভি ছুটে এসে মুখ লুকোল অরিত্রর বুকে কিন্তু পরমুহূর্তেই আতঙ্কিত হয়ে বলে উঠল, “তুই এখানে এলি কী করে?” অরিত্র আইভিকে সব খুলে বলার আগে লক্ষ করল আরও দুটি যুবতী মেয়ে আর একটি বছর কুড়ির ছেলে সেখানে বন্দী। তারাও কিডন্যাপড হয়েছে। অরিত্র দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল কী করে এদের হাত থেকে সবাই মুক্ত হবে। গাড়ীর পেছনের এই ওয়াগনটা বাইরে থেকে লক করা তাও আবার নাম্বার লক। ওপরের দিকে শুধু একটা স্বচ্ছ ফাইবারের জানালা আছে।

“কত বড় বোকামি করেছ এবার বুঝতে পারছ? সুন্দর নিজের টাস্কটা কমপ্লিট করে নিতে পারতে।”

“জাস্ট শাট আপ। এখানে এতগুলো মানুষ বন্দী আর আপনি এখনও একই কথা বলে চলেছেন। আপনি আমাকে ট্র্যাক করতে পারছেন এখনও তার মানে খুব সহজেই পুলিশে খবর দিয়ে আমাদের উদ্ধার করতে পারতেন, কিন্তু আপনি তা করছেন না।”

“আমরা কেন শুধু শুধু ওই ক্রিমিনালদের সাথে ঝামেলায় জড়াতে যাব?”

“আমাদের এই বিপদ তো আপনাদের জন্য হয়েছে।”

“এই কথাটা আইভি হয়ত বলতে পারে কিন্তু তুমি না। তুমি নিজের বিপদ নিজে ডেকেছ। তাও বারবার রিকোয়েস্ট করছ যখন, তখন দেখি কোনও ভাবে তোমাদের দুজনকে ছড়ানো যায় কিনা।”

“আমাদের দুজন মানে? বাকিদের কী হবে?” আইভি বলে।

“আরে ওদের সাথে আমাদের কী সম্পর্ক। ওদের যা খুশি হোক আমাদের কোনও মাথা ব্যথা নেই।”

“তোমরা যখন সুযোগ পাচ্ছ তোমরা চলে যাও।” রন নামের ছেলেটি বলে।

“সেটা হয় না। সবাই একসাথে বন্দী আছি। মুক্ত হলে সবাই একসাথে হব।” দৃঢ় গলায় বলে অরিত্র।

“আবার বোকামি।”

***

“আইভি, এখানে একটা রড আছে। ওরা আসছে দেখলাম। গাড়ী থেকে একটা মেয়েকে নামাচ্ছে মানে ওয়াগনের দরজা ওরা খুলবেই। আমি ওদের আটকাব আর তুই বাকিদের নিয়ে সেই সময় পালিয়ে যাবি। আমাদের গাড়ীটা বালিয়াড়ির ওপাশে আছে। রন রাস্তা জানে ও নিয়ে যাবে। তারপর তুই গ্যাম্বলারের সঙ্গে যোগাযোগ করিস। গাড়িতে তো সব ব্যবস্থা আছে।”

“থাম,থাম। তুই অনেক কথা বলছিস। এবার বল তো আমি চলে যাব আর তুই কী করবি?”

“দ্যাখ, আইভি। আমাদের দুজনের একসঙ্গে পালানো সম্ভব নয়। আমি ওদের না আটকালে তুই পালাবি কী করে?”

“আমি তোকে ছেড়ে পালাব ভাবলি কী করে তুই? আজ পর্যন্ত কোনও দিন কোনও বিপদে তোকে ছেড়ে পালাইনি আজও পালাব না। মরতে হলে দুজনে একসঙ্গে মরব। আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি অরিত্র।” কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আইভি। অরিত্র আবেগতাড়িত হয়ে আইভিকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমিও তোকে ভীষণ ভালোবাসি রে। এইরকম পরিস্থিতিতে তোকে নিজের মনের কথা জানাতে হবে ভাবিনি কোনও দিন। চেয়েছিলাম সারা জীবন তোর হাত ধরে থাকব। মা-বাবাকে জানিয়েও ছিলাম। ওরাও খুব খুশি হয়েছিল, কিন্তু আমাদের ভাগ্যে একসাথে থাকা নেই রে। তোকে আমার দিব্যি, ওরা যখন ঢুকবে তুই ওদের নিয়ে পালাবি।"

আইভি কিছু বলতে পারে না, তার দু চোখ দিয়ে অবিশ্রান্ত ধারায় জল পড়তে থাকে ।

“এই তোমরা একটা রিলেশনশিপ নিয়ে এত সিরিয়াস! এত ইমোশনাল! অদ্ভুত ব্যাপার!” মেয়ে দুটির মধ্যে একজন বলে উঠল। আইভিরা কোনও উত্তর দিল না।

***

“রেডি?” অরিত্রর জিজ্ঞাসার উত্তরে বাকিরা মাথা নাড়ল। লোকগুলো নতুন মেয়েটাকে ঢোকাবার জন্য দরজাটার লকটা খুলে ওপেন করা মাত্র অরিত্র রডটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকদুটোর ওপর। আইভিরা দ্রুত বাইরে এসে নতুন মেয়েটাকে টেনে নিয়ে গাড়ীর দিকে দৌড় দিল।

“তোমরা তাড়াতাড়ি গাড়ীটা নিয়ে পালাও।” আইভি বাকিদের বলল।

“তুমি ওঠ।”

“না গো। অরিত্র দিব্যি দিয়েছিল বলে এসেছিলাম কিন্তু আমি ওকে ফেলে পালাতে পারব না। তোমরা পালাও।”

“তুমি ওকে বাঁচাতে পারবে না। ওখানে ফিরে গেলে ওরা তোমাকেও মেরে ফেলবে। তুমি আমাদের সঙ্গে চল।” একটি মেয়ে বলে।

“একসাথে বাঁচতে না পারলে একসাথে মরব দুজনে।”

আইভি পেছন ফিরে দৌড় দিল। ওরা অরিত্রকে ধরে ফেলেছে।

“শুট হিম।”

“না আ আ।” আইভি আর্তনাদ করে উঠল।

“আইভি পালা।” অরিত্র চিৎকার করে উঠল কিন্তু আইভি অরিত্রর দিকে ছুটে গেল।

“শুট বোথ অফ দেম।” বিপরীত দিশায় দুখানা গুলি ছুটে গেল।

“AU REVOIR foolish love birds!” গ্যাম্বলারের কণ্ঠ ভেসে এল।

চারিদিকে অনন্ত নীল জলরাশি। আরব সাগরের বুকে ভেসে চলেছেন ডাক্তার জিতেন বড়ুয়া। জিতেনকে যেতে হবে মিড আইল্যান্ডে। বর্তমান সময়ে সমুদ্রের বুকে গড়ে উঠেছে অনেক কৃত্রিম দ্বীপ। সেখানে বহু মানুষ বসবাস করে। আসলে একটা সময় নাকি দূষণের কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রের জলস্তর এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে উপকূলীয় অনেক অঞ্চল জলমগ্ন হয়ে যায় তখন মানুষ সমুদ্রের বুকেই বসতি গড়ে ফেলে। এই স্টীমারটায় খুব অল্প সংখ্যক লোক আছে। স্টীমারের ডেকে দাঁড়িয়ে জিতেনের চোখের কোণে জল জমা হতে লাগলো। মেয়েটা বায়না করেছিল ক্লাস টুয়েলভের পরীক্ষা শেষ হলে সমুদ্রে বেড়াতে যাবে। জিতেনের মাও নাতনির সাথে যোগ দিয়ে বলেছিলেন পুরী যেতে চান। তাহলে সমুদ্র দর্শন, জগন্নাথ দর্শন সব হয়ে যাবে। জিতেনও ঠিক করেছিলেন ব্যস্ত শিডিউল থেকে একটু সময় চুরি করবেন পরিবারের জন্য। কিন্তু জীবন এক অদ্ভুত জায়গায় এসে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাঁকে। ওরা কেমন আছে, কী করছে কে জানে।

“কী ভাবছেন ডাক্তার বড়ুয়া?” গ্যাম্বলারের গলা ভেসে এল।

“নিজের পরিবারের কথা।”

“কে কে আছে আপনার পরিবারে?”

“বাবা-মা, আমার স্ত্রী আর মেয়ে।”

“ওদের কথা মনে পড়ছে?”

“সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? আমাকে এভাবে সম্পূর্ণ একটা অন্য সময়ে নিয়ে চলে এলেন আপনারা। ওরা তো কিছু বুঝতেও পারবে না আমার কী হয়েছে। আমার বাবা-মা বৃদ্ধ, মেয়ে এখনও স্কুলে পড়ে। আমার স্ত্রীকে নিজের চাকরি সামলে ওদেরকে সামলাতে হবে। আমার খোঁজে নিশ্চই থানা-পুলিশও করছে।” জিতেনের কণ্ঠে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা সব ঝরে পড়ে।

“ডোন্ট ওরি ডক আপনি ঠিকঠাক টাস্ক কমপ্লিট করলেই আপনাকে আপনার সময়ে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। আমাদের প্রয়োজন মিটলেই আপনি নিশ্চিন্তে আপনার পরিবারের কাছে ফিরে যাবেন। কোনও চিন্তা নেই তাই এখন শুধু শোয়ের দিকে মনোনিবেশ করুন আপনি আমাদের সাত নম্বর প্রতিযোগী।”

“হুম কিন্তু আমার আগের প্রতিযোগীদের পরিণতি কী হয়েছে আমি জানি না।”

“সেটা আপনার জানার কথাও নয়। আমাদের দর্শক সেটা জানে। আপনি শুধু আপনার কাজে মন দিন। ওকে?”

“হুম ওকে।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জিতেন।

***

কংস এসে জিতেনকে জানালো যে তাঁকে মিড আইল্যান্ডের লস্ট হাউস বলে একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানেই টাস্ক দেওয়া হবে তাঁকে। কংসের দিকে তাকিয়ে হাসি পেয়ে গেল জিতেনের। হিউম্যানয়েডের নাম দেওয়ার জন্য এরা আর নাম খুঁজে পায়নি কংস! এ ব্যাটা জানেও না কংস কত খারাপ লোক ছিল। সত্যিই যুগ এখন কত এগিয়ে গেছে! এই যন্ত্র মানুষটার ওপর পুরো দায়িত্ব জিতেনকে আইল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া, টাস্ক দেওয়া সবকিছুর। শুধু তাই নয় গ্যাম্বলার এবং বাকি লোকজন স্টুডিওতে বসে জিতেনের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজর রাখছে। জিতেন কী করছেন সারা দুনিয়া টিভি স্ক্রীনে দেখতে পাচ্ছে। এরা কোথায় ক্যামেরা লাগিয়ে রাখে ভগবান জানে।

“আপনি লস্ট হাউসে যাবেন?” জিতেন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, একটি বছর ষোলোর ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।

“হুম। তুমি?”

“আমি আরিন। এই স্টীমারটা আমার বাবার। আমার সমুদ্র ভালো লাগে বলে এমনিই মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ি। জলের বুকে ভেসে থাকতে খুব মজা লাগে আমার।”

“ও আচ্ছা।”

“আপনাকে ওই এইচ এমটা বলছিল না লস্ট হাউসে যাওয়ার কথা?”

“ও হ্যাঁ হ্যাঁ।”

“আপনি আমার একটা কাজ করে দেবেন?” ছেলেটার গলায় কাতর অনুরোধ।

“কী কাজ?”

“একটু দাঁড়ান আমি আসছি।” ছেলেটা চলে গেল কেবিনের দিকে। ফিরে এল একটা বড় চকলেটের প্যাকেট নিয়ে।

“লস্ট হাউসে আমার ঠাকুমা থাকেন। ওনার নাম মনীষা জুনেজা। প্লীজ আপনি ওনাকে এই প্যাকেটটা দিয়ে দেবেন। উনি এই চকলেটটা খেতে খুব ভালোবাসেন।” আরিনের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে থাকে। অবাক হন হিতেন, “তুমি কাঁদছ কেন আর তুমি নিজে গিয়ে ওনাকে দিচ্ছ না কেন?”

“আমি কী করে যাবো? ওনাকে তো বাবা লস্ট হাউসে রেখে এসেছে।”

“মানে?”

“আপনি কি লস্ট হাউস সম্বন্ধে জানেন না?”

“না মানে আসলে আমি অনেক কিছুই জানি না। যাইহোক তুমি আমাকে লস্ট হাউস সম্বন্ধে বল।” জিতেনের প্রশ্নের উত্তরে আরিন যা বলল তাতে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন জিতেন। তাঁদের সময়ে অনেকে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দায়িত্ব এড়ানোর জন্য বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসত। এই লস্ট হাউস অনেকটা বৃদ্ধাশ্রমের নতুন রূপ। এখন নাকি বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে চায় না। যেসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নিজেদের জোরে থাকেন তারা থাকেন। কিন্তু যারা আর্থিক এবং শারীরিক ভাবে দুর্বল হন তাদের বেশিরভাগের ঠিকানা হয় এই লস্ট হাউস। ছেলে-মেয়েরা কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে বাবা-মাকে এখানে রেখে যায়। তবে একবার লস্ট হাউসে রেখে এলে আর নাকি সেই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করা যায় না। আরিনের দাদুর মৃত্যুর পর ওর ঠাকুমার ঠিকানাও হয়েছে ওই লস্ট হাউস। ও ঠাকুমাকে বাড়িতে রাখার জন্য ওর বাবা-মাকে অনেক অনুরোধ করেছিল, কিন্তু তাঁরা ওর কোনও কথাই শোনেননি।

***

“কী ভাবছেন ডঃ বড়ুয়া?”

“ভাবছি একজন সন্তান এত নির্দয় কি করে হতে পারে? আমি তো ভাবতেই পারি না যে আমার বাবা-মাকে বাড়ির বাইরে অন্য কোথাও রেখে আসবো।”

“কিন্তু ডাক্তার বড়ুয়া একজন বৃদ্ধ মানুষ যার পরিবার বা সমাজকে নতুন করে কিছু দেওয়ার নেই উল্টে তাদের পেছনে খাবার, ওষুধ এসবে খরচ করতে হয় তাদের বাঁচিয়ে রাখা মানে তো সম্পদ নষ্ট করা। একজন বয়স্ক মানুষ আর বাড়ির ওয়েস্ট মেটেরিয়ালের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। দুটোই কোনও কাজে লাগে না।” গ্যাম্বলারের কথা শুনে বিস্ময়ে ফেটে পড়েন জিতেন।

“অদ্ভুত কথাবার্তা বলছেন আপনি, যে বাবা-মা আমাদের বড় করে, জীবনে পথে চলার উপযুক্ত করে তুলল তারা ওয়েস্ট মেটেরিয়াল! এরপরে আর নতুন করে কিছু বলার নেই আপনাকে। এখন তাড়াতাড়ি বলুন আমার টাস্ক কী? আর একটা কথা আমি এখানে মনীষা জুনেজা নামের এক বৃদ্ধার সাথে দেখা করতে চাই, কিন্তু আপনার রোবট কংস বা এখানের বাকি মানুষজন আমার কথায় পাত্তাই দিচ্ছে না।”

“জানি, ওই বৃদ্ধার নাতি একটা গিফট পাঠিয়েছে। কিন্তু ডঃ বড়ুয়া, মনীষা জুনেজা এখন লস্ট কেস। তাই ওরা আপনার কথায় কর্ণপাত করছে না।”

“মানে?”

“মানে ওনার ছেলে শুধু ওনাকে এখানে এডমিট করার ফিজ দিয়েছিল, কিন্তু বাঁচিয়ে রাখার জন্য অতিরিক্ত টাকা-পয়সা দেয়নি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ওনাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।”

“কী বলতে চাইছেন আপনি?” চেঁচিয়ে উঠলেন জিতেন।

“আমি যা বলেছি আপনি বুঝতে পেরেছেন।”

জিতেনের চোখের সামনে সবকিছু দুলে উঠলো যেন।

***

“কে? রাজিত? আমাকে নিতে এসেছিস?”

প্রায়ান্ধকার একটা ঘরের মধ্যে একটা হসপিটালের বেডের মত খাটে একজন বৃদ্ধ শুয়ে আছেন। কংস জিতেনের হাতে একটা সিরিঞ্জ ধরিয়ে দিয়েছে। জিতেন সিরিঞ্জটা নিয়ে স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে আছেন।

“ইউ মাস্ট ফিনিশ ইয়োর টাস্ক আদার ওয়াইজ আই উইল শুট ইউ।” কংসের যান্ত্রিক কণ্ঠ জানিয়ে দিল জিতেনকে।

“ডাক্তার বড়ুয়া মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য অনেক ইনজেকশন পুশ করেছেন। এবার নিজের জীবন বাঁচাতে ইনজেকশনটা পুশ করুন।” গ্যাম্বলারের গলা ভেসে এল।

“নিজের জীবন বাঁচাতে অন্যের জীবন নিতে আমি পারবো না। আমি একজন ডাক্তার। আমি লোকের জীবন বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করি। আমি কী করে একজন মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেব? এটা তো খুন।” অসহায় হয়ে পড়েন জিতেন।

“নো ডক, আপনি না মারলেও এই ইউস লেস বৃদ্ধকে মরতেই হবে আর আপনার টাস্ক এটাই। আপনাকে এটা করতেই হবে। আপনাদের সময় বাচ্চারা ট্রুথ অর ডেয়ার খেলত না? আপনার ডেয়ার এটাই। যে হাতে মানুষের জীবন রক্ষা করেন সেই হাতেই একটা মানুষকে মারতে হবে আপনাকে। করতে তো আপনাকে হবেই নাহলে কংস কিন্তু ওর কর্তব্যে কোনও গাফিলতি করে না। শ্রীকৃষ্ণের মামা কংস কতটা নির্দয় ছিল আপনি তো সেটা নিশ্চয় জানেন। আমার কংসও সেইরকম নির্দয়।” খুব ঠান্ডা হিমশীতল কণ্ঠে এতগুলো কথা বলে গেল গ্যাম্বলার। জিতেনের সমস্ত শরীরে মনে হচ্ছে কেউ যেন হাজার হাজার সুঁচ ফুটিয়ে দিচ্ছে। ভয়ঙ্কর এক অনুভূতি হচ্ছে শরীরে, মনে।

বৃদ্ধ আবার ডাকলেন, “রাজিত এসেছিস বাবা।” হিতেন একবার কংসের দিকে তাকালেন তারপর হাতে সিরিঞ্জ নিয়ে ধীরে পায়ে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে গেলেন। কাছে গিয়ে বৃদ্ধের কপালে হাত বুলিয়ে দিতেই বৃদ্ধের চোখে-মুখে আলো জ্বলে উঠলো। অন্ধকার ঘরে বন্দী অসুস্থ বৃদ্ধ জিতেনকে নিজের সন্তান ভেবে ভুল করলেন। তাকে জড়িয়ে ধরলেন। জিতেনের কাছে আরিনের দেওয়া চকলেটটা ছিল। সেটা বৃদ্ধের হাতে তুলে দিলেন। মাত্র কয়েক সেকেন্ড তারপরেই কংসের যান্ত্রিক চোখ দুটোতেও বোধহয় বিস্ময়ের ছাপ। জিতেনের শরীরটা বৃদ্ধের বেডের ওপর লুটিয়ে পড়ে আছে। সিরিঞ্জটা জিতেন নিজের শরীরেই পুশ করেছেন।

“AU REVOIR, Doc!” গ্যাম্বলারের কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল।

প্যারাসুটটা পিঠ থেকে খুলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো পৃথা। জায়গাটার ভূমিরূপ অদ্ভুত। রুক্ষ পাথর, টিলা, হালকা জঙ্গল। ওকে হেলিকপ্টারে করে এখানে এনেছিল ওরা। তারপর পৃথাকে প্যারাসুট নিয়ে জাম্প দিতে হয়েছে। ওর টাস্ক হল এই পাথুরে জঙ্গল থেকে বাইরে বেরোনোর রাস্তা খুঁজতে হবে ওকে। ওর কাছে কোনও খাবার নেই। মাত্র একটা এইচ টু ও ট্যাবলেট দিয়েছে ওরা। এখান থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে উঠতে পারলেই শো কর্তৃপক্ষের গাড়ী এসে ওকে তুলে নেবে। পৃথাকে রাত নামার আগেই এখান থেকে বেরতে হবে।

“কেমন লাগছে পৃথা?” গ্যাম্বলারের গলা ভেসে এল।

“এই প্রশ্নটার কি কোনও অর্থ আছে?” বাঁকা সুরে বলল পৃথা।

“কেন?”

“হঠাৎ করে একদিন জানতে পারলাম আমি ২০১৯ সাল থেকে ২০৭৫ সালে এসে পড়েছি শুধু তাই নয়, আমি আপনাদের হাতের পুতুল। নিজের প্রাণ বাঁচাতেই বলুন আর নিজের সময়ে ফিরে যাবার জন্যই বলুন, আপনাদের কথায় চলতে হবে আমাকে। আপনাদের পকেট ভরানোর জন্য আপনাদের রিয়ালিটি গেম শোতে পার্টিসিপেট করতে হবে। বাধ্য হয়ে মেনে নিলাম। মন দিয়ে আপনাদের দেওয়া ট্রেনিং নিলাম। আমার সঙ্গী আমার মতোই আরো সাতটা মানুষ। যাদের সঙ্গে একটা মানসিক বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছিলাম তারা একে একে শোতে অংশ নেওয়ার জন্য ট্রেনিং ক্যাম্প ছাড়ল, কিন্তু কেউ আর ফিরে এল না। এমনকি তাদের পরিণতি কী হয়েছে? তারা নিজেদের সময়ে ফিরে গেছে? নাকি তারা চিরতরে শেষ হয়ে গেছে, এটুকু পর্যন্ত জানি না আমি। আর আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, কেমন লাগছে আমার? প্লীজ ফারদার আমাকে এই ধরনের অনর্থক প্রশ্ন করবেন না।” রাগত স্বরে কথা শেষ করল পৃথা।

“বাহ বোঝা যাচ্ছে একজন জাঁদরেল পুলিশ অফিসার কথা বলছে। কিন্তু পৃথা ওই যে তুমি বললে বাধ্য হয়েছ তুমি এই শোতে পার্টিসিপেট করতে, তেমনি আমার সাথে কথা বলতেও তুমি বাধ্য, আর এটা তুমি ভালো করেই জানো। আমাদের দর্শকরা জানতে চান, এখন তোমার মনের অবস্থা কেমন? আনসার মি।” আদেশের সুরে বলল গ্যাম্বলার।

একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে পৃথা বলল, “ওকে, এই মুহূর্তে আমি শুধু এটাই চিন্তা করছি যে, কত তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেরোনোর রাস্তা খুঁজে পাবো।”

“ওকে, গো।”

পৃথা একটু ভেবে সামনের টিলাটা লক্ষ করে এগোলো। মাথার ওপর চড়া রোদ। পৃথা নিজের মনের মধ্যেই ভাবলো, আজও সূর্যের আলোয় আলোকিত হয় পৃথিবী। হয়ত অনেক কিছুই বদলে গেছে কিন্তু সত্যিই কি সব বদলে যায়?

***

টিলার ওপর উঠে চারপাশে তাকিয়ে পৃথা বোঝার চেষ্টা করল, বাইরে বেরোনোর রাস্তা কোনদিকে থাকতে পারে। কিন্তু তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে তেমন কিছু নজর এল না। এইসময় একটা দূরবীনের খুব দরকার ছিল। হতাশ পৃথার মনে হল পূর্ব দিকে জঙ্গল কিছুটা পাতলা। ওইদিকে যাওয়াই মনস্থ করল সে।

“কী ভাবছ পৃথা? আবার আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তোমাকে।”

“হুম বুঝেছি। আমি পূর্ব দিকে যাবার কথা ভাবছি। আমার মনে হচ্ছে, ওইদিকে গেলে বাইরে যাবার রাস্তা পাবো। ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে। যাও।”

***

“কী হয়েছে আপনার? কী হয়েছে? আপনি কে? এখানে এলেন কী করে?” পৃথার কোলে মাথা দিয়ে যে মানুষটি শুয়ে আছেন তাঁর বয়স ওই বছর পঞ্চান্ন হবে। একটা গাছের তলায় প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় পৃথা আবিষ্কার করে এনাকে।

“একটু জল।”

পৃথা তার একমাত্র সম্বল এইচ টু ও ট্যাবলেটটা ওই ভদ্রলোকের মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ওটা মুখের লালায় ভিজে গলে গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভদ্রলোক উঠে বসলেন। পৃথা আবার প্রশ্ন করল, “আপনি কে?”

“বলছি, তার আগে বল তুমি কে? একলা একটা মেয়ে এখানে কী করছ?”

“আমি পৃথা। একটা কাজের জন্য এখানে এসেছি। আপনি নির্ভয়ে আমাকে বলুন আপনার কী হয়েছে?”

“সে অনেক কথা।”

“হোক অনেক কথা। আপনি বলুন।”

“তাহলে শোনো। আমি ডক্টর জিতেন্দ্র আগারওয়াল। একসময় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেছি। আমার বিষয় রোবটিক্স। একসময় অধ্যাপনা ছেড়ে পুরোপুরি গবেষণায় মন দিলাম। তৈরি করলাম অত্যন্ত উন্নত অটোবট। গ্যালিয়াম আর ইন্ডিয়াম ধাতুর সাথে আরও অনেক উপাদান মিশিয়ে তৈরি করলাম ওই রোবটগুলো। যারা প্রয়োজন মতো যেমন খুশি নিজেদের আকার পরিবর্তন করতে পারে। এরপরই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা আমি করলাম। আমি আমার তৈরি সবচেয়ে উন্নত অটোবট দুটোর ওপর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে অনেক হাই লেভেলে গবেষণা শুরু করলাম। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে বহু দিন ধরে অনেক কাজ হলেও আমার কাজ সবার চেয়ে অনেক আলাদা ছিল। আমি সারা পৃথিবীর কাছে আমার কাজটা সারপ্রাইজ হিসেবে রাখব বলে চলে এলাম এই জায়গায়। এখানে একটা প্রপার্টি কিনে আমার ল্যাব বানালাম। আমার রিসার্চও সাফল্যের মুখ দেখল।” এতটা বলে হাঁফাতে লাগলেন জিতেন্দ্র।

“তাহলে সমস্যাটা কী?”

“যে দুটো রোবট নিয়ে কাজ করছিলাম আমি, ওদের নাম দিয়েছিলাম দুর্যোধন আর দুঃশাসন।”

“দুর্যোধন! দুঃশাসন!”

“হ্যাঁ, তোমরা এখনকার ছেলেমেয়েরা মহাভারতের কথা হয়ত জানো না। প্রাচীন ভারতের একটা মহাকাব্য মহাভারত থেকে কিছুটা মজার ছলেই নাম দুটো নিয়েছিলাম। কারণ দুর্যোধন আর দুঃশাসন মোটেই ভালো মানুষ ছিলেন না, কিন্তু সত্যিই এমনটা হবে আমি ভাবিনি। ওদের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, ওরা আমাকেই শেষ করে দেবার কথা ভাবছে।”

“মানে?” পৃথা প্রচণ্ড অবাক হয়।

“মানে ওরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ বলতে পারো। ওরা নিজেরাই মানুষের মতো চিন্তা ভাবনা করতে পারছে। আমি এটাই চেয়েছিলাম, কিন্তু আমি এটা ভাবিনি যে মানুষের মনের মধ্যে যেমন সাদার সাথে কালো, ভালোর সাথে মন্দ দুটো দিক থাকে, তেমনি ওদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মধ্যেও সেগুলো সৃষ্টি হয়ে যাবে। আমারই ভুল। আমি বোধহয় ওদের ঈশ্বর হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আজ ওরা ওদের ঈশ্বরকেই শেষ করে দিতে চাইছে।”

“সে তো বুঝলাম, কিন্তু কেন?”

“ওরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও আজও ওদের কিছুটা কন্ট্রোল আমার হাতে আছে। এই দ্যাখো এই কন্ট্রোলিং ডিভাইসটা যদি ওরা হাতে পেয়ে যায়, তাহলে আর ওদের কাছে আমার কোনও প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। এটা আমার ল্যাবের একটা গোপন জায়গায় লুকোনো ছিল। ওরা আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল এটার জন্য। আমি দিইনি। এভাবে কয়েকদিন চলছিল। ভেবেছিলাম সামলে নেব কোনওভাবে। নিজের সৃষ্টিকে তো চট করে ধ্বংস করা যায় না। আজকে বুঝতে পারলাম ওরা আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করছে। ওরা ভাবছে আমাকে মেরে ফেলার পর ওরা এটাকে ঠিক খুঁজে বের করে ফেলবে। এটা বোঝার পর আমি আর একটুও দেরী করিনি আমি কোনও মতে ওদের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে এসেছি। ওরা ইতিমধ্যে আমার দুই সহকারীকে মেরে ফেলেছে।”

“এটা দিয়ে আপনি ওদের কন্ট্রোল করতে পারছেন না?”

“এটার করেস্পন্ডিং আরেকটা ডিভাইস আছে। দুটো একসাথে কাজ করলে ওদের কিছুটা কন্ট্রোল করা যাবে কিন্তু ওই ডিভাইসটা ওরা কব্জা করে ফেলেছে। এখন ওরা আমাকে খুঁজছে। এই দ্যাখো সিগন্যাল ওরা খুব কাছাকাছিই আছে।”

“এখন উপায়?”

“একটা উপায় আছে কিন্তু বিপজ্জনক। আমার যা অবস্থা আমি কী করব বুঝতে পারছি না। আমি চেয়েছিলাম মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন দুটো হিউম্যানয়েড তৈরি করতে, কিন্তু আদপে তৈরি হয়েছে দুটো স্বার্থপর দৈত্য। ওরা এখন আর আমার মানে মানুষের কন্ট্রোলে থাকতে চাইছে না। ওদের আটকাতে না পারলে মানবজাতির সমূহ বিপদ। ওরা নিজেদের মতো আরও এরকম রোবট তৈরি করে ফেলতে পারবে। মানুষ ওদের দাস হয়ে যাবে।” একটু থেমে ডক্টর আবার বললেন, “আমি আসলে একটা ভীতু মানুষ, নাহলে এভাবে পালিয়ে আসতাম না। ওদের ধ্বংস করার শেষ উপায়টাই অবলম্বন করতাম।”

পৃথার সামনে রোবট সিনেমার দৃশ্যগুলো ভেসে উঠলো। সে আর ভাই একসাথে সিনেমাটা দেখেছিল। কে জানে কেমন আছে ওরা। চোখের জল চোখেই আটকে সে বলল, “ওদের ধ্বংস করার উপায় বলুন।”

***

“বাহ, পৃথা তুমি তো হাইওয়েতে পৌঁছে গেছ। এবার আমাদের গাড়ী তোমাকে তুলে নেবে। তুমি জিতে গেছ।” গ্যাম্বলারের গলা। ডক্টর আগারওয়ালের দেখানো পথ ধরে খুব তাড়াতাড়িই পৃথা রাস্তা পেয়ে গেছে।

“জেতার অনুভূতি কেমন পৃথা?”

“আমি তো এখনও জিতিনি।”

“মানে?'

“মানে কিছু না। জাস্ট জোক করছিলাম। গাড়িটা একটু তাড়াতাড়ি পাঠান।”

“গাড়ী তোমার সামনে।”

এখনকার গাড়িতে কোনও আওয়াজ হয় না। শব্দদূষণের কোনও বালাই নেই। কখন গাড়িটা এত কাছে চলে এসেছে পৃথা বুঝতেও পারেনি। ওর সামনে গাড়িটা দাঁড়াতেই পৃথা ডক্টর আগারওয়ালকে গাড়িতে তুলে দিয়ে গাড়ির ড্রাইভারকে বলল, “এনাকে কোনও হসপিটালে নিয়ে যাও। ইনি অসুস্থ।”

“আর আপনি?”

“আমি এখন যাবো না। আমার কাজ আছে।”

“পৃথা কী করতে চাইছ তুমি?” আবার গ্যাম্বলার।

“আপনি তো সবই জানতে পেরে যান। তাহলে এটাও নিশ্চই বুঝতে পারছেন যে, আমি দুর্যোধন আর দুঃশাসনকে বধ করার কথা ভাবছি।” পৃথা ব্যঙ্গ করে বলল।

“এতে তোমার প্রাণ সংশয় ঘটতে পারে। সেটা ভেবে দেখেছ।”

“জানি।”

“আমরা তোমাকে কোনও রকম হেল্প করব না এই কাজে।”

“সে আশাও করি না। সে আশা করলে একটা গাড়ী চাইতাম ডক্টরের ল্যাবে যাওয়ার জন্য।”

“হুম, বুদ্ধিমতী তুমি। কিন্তু এখন চরম বোকার মত কাজ করছ। আরেকবার ভেবে দেখ।”

“ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আপনার মতো বুদ্ধি দিয়ে কাজ করতেও চাই না। জীবনে কিছু কাজ বোকার মতোই করতে হয়। তাতে হয়ত নিজের ক্ষতি হয় কিন্তু অন্যের উপকার হয়। যাইহোক এসব কথা আপনি বুঝবেন না। ড্রাইভারকে বলুন, ডক্টরকে নিয়ে যেতে। ওরা যে কোনও মুহূর্তে এসে পড়বে।”

“এই তোমার শেষ সিদ্ধান্ত?”

“হুম।”

পৃথা তার হাতে ধরা কন্ট্রোল ডিভাইসটার দিকে একবার তাকালো তারপর ডক্টর বড়ুয়ার ল্যাবের দিকে রওনা দিল।

***

একদম জনশূন্য একটা জায়গায় ডক্টরের ল্যাব। পৃথার হাতে ডক্টর একটা ব্যান্ড পরিয়ে দিয়েছেন যার সাহায্যে সে ল্যাবে ঢুকতে পারবে। এই ল্যাবের সুরক্ষা ব্যবস্থা সবই স্বয়ংক্রিয় ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। এই ব্যান্ডটা ছাড়া পৃথা এখানে ঢুকতেই পারবে না। গেটের সামনে এসে ব্যান্ডের নির্দিষ্ট সুইচ টিপতেই গেট খুলে গেল। পৃথা প্রায় দৌড়ে দৌড়ে এখানে এসেছে। রীতিমতো হাঁফাচ্ছে সে, কিন্তু বিশ্রামের সময় নেই। ডক্টর বলে দিয়েছেন, এই ব্যান্ডটা ব্যবহার করে সে ল্যাবে ঢোকার সাথে সাথে দুর্যোধন আর দুঃশাসনের কাছে সিগন্যাল চলে যাবে। ওরা অবশ্য ভাববে, ডক্টর ল্যাবে ঢুকেছেন। ল্যাবের ভেতরে ঢুকে পড়েছে পৃথা। ল্যাবটা দোতলা। ডক্টর যা বলে দিয়েছেন, সেই মতো পৃথাকে দোতলায় যেতে হবে। লিফটের কাছে এসে চমকে উঠলো পৃথা। একজন রক্তাক্ত মানুষ পড়ে আছে লিফটের মধ্যে। বোধহয় ডক্টরের সহকারী। লিফট ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো পৃথা। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে চমকে উঠলো সে। সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে নীচে তাকিয়ে দেখল পৌঁছে গেছে তারা। ডক্টর তাদের মানুষের মত আকার আকৃতি, বুদ্ধিমত্তা দিলেও চোখের ভাষা দিতে পারেননি। ওই নিষ্প্রাণ চোখ দেখলেই বোঝা যায় ওরা মানুষ নয়, যন্ত্র মানুষ। পৃথা তাড়াতাড়ি উপরে উঠতে লাগল। ওরা দুজন ল্যাবে ঢুকে পড়েছে বুঝতে পারলো পৃথা।

***

পৃথার দিকে এগিয়ে আসছে দুই যন্ত্র মানব সরি যন্ত্র দানব। তাদের ধাতব কণ্ঠস্বরে ক্রমাগত বলে যাচ্ছে, “গিভ মি দ্য ডিভাইস আদার ওয়াইজ আই উইল কিল ইউ।”

“পৃথা তুমি এখনও বাঁচতে পারো। ওদের দিয়ে দাও ওটা।” গ্যাম্বলারের কথার কোনও উত্তর দিল না পৃথা।

সে একবার চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিল। তারপর সামনে রাখা কালো বক্সের মত যন্ত্রটায় ডক্টরের দেওয়া কন্ট্রোলিং ডিভাইসটা ঢুকিয়ে লাল সুইচটা টিপে দিল। যন্ত্র মানব দুজন একসাথে চিৎকার করে উঠল “নো।” ল্যাবটা দুলছে। পৃথা ডক্টরের দেওয়া ট্যাবলেটটা মুখে ভরে দিল। কয়েক মুহূর্ত পরেই বিশাল একটা বিস্ফোরণ হয়ে গোটা ল্যাবটা ধ্বংস হয়ে যাবে। ল্যাবের সিকিউরিটি সিস্টেম অনুযায়ী ওই সুইচটা টেপার সাথে সাথে আর এই ল্যাব থেকে বেরোনোর কোনও উপায় নেই। ল্যাবের সাথে সাথে দুর্যোধন, দুঃশাসন আর ওদের সাথে পৃথাও শেষ হয়ে যাবে। ডক্টর ওকে একটা ট্যাবলেট দিয়ে বারবার অনুরোধ করেছিলেন, সুইচ টেপার সাথে সাথে সেটা খেয়ে নিতে তাতে শেষ মুহূর্তের অসহ্য যন্ত্রণা থেকে ও মুক্তি পাবে। পৃথার চোখের সামনে আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে এল।

“AU REVOIR, AU REVOIR!” গ্যাম্বলারের চোখে মুখে বিজয়ীর উল্লাস। সফলভাবে শেষ হয়েছে তাঁর গেম রিয়ালিটি শো। তাঁর এবং ড্যানের উভয়ের উদেশ্য সিদ্ধ হয়েছে।

১০
ডিসেম্বর মাস, সাল ২০২০

করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে মুক্ত হয়েছে পৃথিবী। ডাক্তার হওয়ার জন্য ওই সময় প্রচুর চাপ গেছে পরীক্ষিতের। তাই বাবা, মা আর দিদিকে নিয়ে ক্রিস্টমাসে একটু ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে তার। পুলিশ অফিসার হওয়ায় তার দিদিরও প্রচুর ধকল গেছে। ঘুরতে যাওয়ার আলোচনার জন্য দিদির রুমে ঢুকে টেবিলের ওপর একটা খোলা ডাইরি দেখল সে। প্রতি পাতায় পেপার কাটিং আটকানো। ডাইরিটা তুলে দেখতে আরম্ভ করল পরীক্ষিত।

প্রথম খবরটা অরিত্র আর আইভি সেনগুপ্ত নামে এক দম্পতির খবর। অরিত্র একজন ইতিহাসবিদ আর আইভি একজন শিক্ষিকা, সেইসাথে লেখিকা। এঁরা সম্পূর্ণ নিজেদের খরচের বস্তিবাসী, ফুটপাতবাসী বাচ্চাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। এঁদের সাহায্যে বহু বাচ্চা নিজের পায়ে সফলভাবে দাঁড়িয়েছে।

পরের পাতায় জোস ডিসুজা নামে একজন কলেজ শিক্ষকের। যিনি তাঁর এনজিও নিয়ে করোনার সময় লকডাউন চলাকালীন গরিব মানুষদের জন্য উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। জোস সারাজীবনই এইধরণের কাজ করে আসছেন।

এরপরে আছে প্রমথ চন্দ্র জানা নামে এক অতি বৃদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামীর কথা। যিনি স্বাধীনতার পরে স্কুল শিক্ষক হয়েছিলেন। তিনি তাঁর পুরো এক বছরের পেনশনের টাকা করোনার ত্রাণ তহবিলে দান করেছেন। তাঁর কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনিরাও অনেক টাকা দান করেছে।

পরের খবরের মানুষটির নাম পরীক্ষিত জানে। ডাক্তার জিতেন বড়ুয়া। এঁর কর্মকান্ডের সাথে পরীক্ষিত পরিচিত।

এরপর আছে বিখ্যাত প্রাক্তন ফুটবলার রবিন্দর সিংয়ের কথা। লকডাউনের সময় রবিন্দর প্রতিদিন পঞ্চাশ জন দুঃস্থ মানুষের খাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাছাড়া অনেক টাকা পয়সাও দিয়েছেন।

শেষ খবর ইন্ডিয়ান আর্মির রিটায়ার্ড মেজর ইশতিয়াক খানের। ইশতিয়াক এবং তাঁর দুই ছেলেমেয়ে মিলে লকডাউনের সময় অনেক মানুষকে সাহায্য করেছেন।

পৃথা বাথরুম থেকে বেরোতেই স্বভাবতই বিস্মিত পরীক্ষিত প্রশ্ন করে, “এই পেপার কাটিংগুলো জমিয়ে রেখেছিস কেন?”

স্মিত হেসে পৃথা জবাব দেয়, “সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজিস না।”

শেষকথা
সাল ২০৭৫

বাইরের মুক্ত আকাশের দিকে আনমনে তাকিয়ে আছেন আমাদের পূর্ব পরিচিত গ্যাম্বলার ওরফে বিজ্ঞানী কল্কিশ্বর চৌধুরী। ড্যান ওরফে দক্ষিণ বাজাজ হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল, “তুমি নাকি তোমার ভাগের প্রাপ্য টাকা নিতে চাওনি?”

“হুম।” সংক্ষিপ্ত জবাব দেন কল্কিশ্বর।

“কেন? তুমি কি আরও বেশি চাইছ?” বিস্মিত প্রশ্ন ড্যানের।

“দুর্গা কোথায়?” ড্যানের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেন কল্কিশ্বর। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর ড্যানের ঠোঁটে একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে, “সত্যিই ইউ আর আ গ্রেট গ্যাম্বলার। তোমার মত শান্তশিষ্ট মানুষ এত রিস্ক নিয়ে এতবড় একটা জুয়া খেলে ফেলবে আমি ভাবতেও পারিনি। এভাবে আমাকে বোকা বানিয়ে আমার সাহায্যে আমার টাকায় নিজের উদেশ্য সিদ্ধ করবে আমি জাস্ট কল্পনাও করতে পারিনি।”

“মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?” শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন কল্কিশ্বর।

একটু হেসে ড্যান বলল, “আমি তোমাকে একটা গল্প শোনাই। একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁর বুদ্ধি যতটা তীক্ষ্ণ, মনটা ততটাই ভালো। তিনি সব সময় তাঁর সব কাজ মানব হিতের জন্য করতেন। আমাদের ইতিহাস, প্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর যেমন আগ্রহ ছিল, তেমনই জ্ঞান ছিল অগাধ। এই বিজ্ঞানী তাঁর সময়ের অন্যান্য মানুষজনের থেকে একদম আলাদা ছিলেন। সবসময় দুঃখ করতেন মানুষের মধ্যে থেকে মানবতা, ভালোবাসা, সহমর্মিতা, মূল্যবোধ একেবারেই হারিয়ে যাচ্ছে বলে। প্রকৃতির প্রতিও নির্দয় হয়ে উঠছে মানুষ। সবকিছুই ভাবছে কৃত্রিমভাবে বানিয়ে ফেলবে। বলতেন কোনও উপায় থাকলে আবার বর্তমান প্রজন্মকে বোঝাতেন যে শুধু স্বার্থপরের মত নিজের কথা ভাবলে, শুধু জীবনে সফল হয়ে ভোগ বিলাসের দিকে ঝুঁকলে সুখ পাওয়া যায় না। আসলের চেয়ে নকল কখনও দামী হতে পারে না। তাঁর প্রাণ ছিল তাঁর ছোট্ট পরিবারটি। স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বাস করছিলেন তিনি। তারপর একদিন এই বিজ্ঞানী সময় যাত্রা নিয়ে গবেষণা করছেন জানতে পেরে এক স্বার্থপর ব্যবসায়ী বন্ধুবেশে তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ হয়। বিজ্ঞানী এবং তাঁর স্ত্রী বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেননি। যেইমাত্র বিজ্ঞানীর গবেষণা সফল হল ওমনি সেই বন্ধু বেশী শত্রুর আসল রূপ বেরিয়ে পড়ল। তার শোয়ের জন্য কিছু সময় যাত্রী চাই। যা অন্য কেউ করতে পারেনি এরকম শো করতে পারলে শুধু প্রচুর অর্থাগমই হবে না সেইসাথে সে হয়ে যাবে এন্টারটেন্টমেন্ট দুনিয়ার বেতাজ বাদশা। প্রথমে সে বিজ্ঞানীকে লোভ দেখালো। কাজ না হওয়ায় অনেক চাপ সৃষ্টি করল কিন্তু বিজ্ঞানী অনড়। অকারণে কিছু পুরোনো দিনের মানুষকে সে বিপদে ফেলতে চায় না। সে শুধু বিজ্ঞানের স্বার্থে এই গবেষণা করেছিল। তখন সেই ব্যবসায়ী অন্য পথ ধরল। খুন করালো বিজ্ঞানীর গর্ভবতী স্ত্রীকে। তার মেয়েকে লুকিয়ে ফেলল অজানা কোনও জায়গায়। এবার বিজ্ঞানী সম্পূর্ণ অসহায়। সে রাজি হল ব্যবসায়ীর প্রস্তাবে, কিন্তু সেই সাথে সে প্রস্তাব দিল সে নিজেও সম্পূর্ণভাবে এই শোয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। মুখোশের আড়ালে শো সঞ্চালনা করবে। তার পরিকল্পনা মতো শো করলে শো হবে একদম অন্যরকম। তার প্রস্তাব মনে ধরল ব্যবসায়ীর আর এটাই ছিল বিজ্ঞানীর একটা জুয়া। সে পুরোনো দিনের অনেক খবর রাখত। সে অনেক চিন্তা ভাবনা করে বেছে বেছে বিশেষ কিছু মানুষকে নিয়ে এল। যারা হয়ত খুব বিখ্যাত নয় কিন্তু তাঁরা সারাজীবন অন্যের জন্য কাজ করে এসেছেন, নিজের পরিবারকে ভালোবেসেছেন। যাঁদের মানবিক মূল্যবোধ অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। আটজন মানুষের জন্য সিনেমার মত সাতটা গল্প সাজাল সে। যেখানে বর্তমান সময়ের কিছু সমস্যাকে নিজের মতো করে আকার দিল সে। তার সাতজন প্রতিযোগী জানলোও না যে তাদেরকে একেকটা সাজানো গল্পের মধ্যে প্রবেশ করানো হচ্ছে। বিজ্ঞানী আড়ালে থেকে গল্পটা নিয়ন্ত্রণ করছে। দর্শকরা অবাক হয়ে দেখলো প্রত্যেকে অন্যের জন্য নিজের জীবনের মায়া করছে না। প্রতিযোগীরা কেউ জানত না যে শেষ পর্যন্ত তাদের আসল গুলির বদলে ট্র্যানকুলাইজার দিয়ে কিংবা ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হবে। তারপর তাদের ঠিক সেই মুহূর্তে পৌঁছে দেওয়া হবে যে মুহূর্ত থেকে তাদের আনা হয়েছিল। আসলে সেই বিজ্ঞানী মুখোশের আড়াল থেকে এমন নিষ্ঠুরের মত অভিনয় করত তাদের সাথে যে তারা ভাবত, জিততে না পারলে মৃত্যুই তাদের শেষ ঠিকানা। এখনের দর্শকদের তুমুলভাবে নাড়া দিয়ে দিল বিজ্ঞানী আর তার বেছে আনা প্রতিযোগীরা। সেইসাথে বিজ্ঞানী দর্শকদের কথার জালে জড়িয়ে কিংবা পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে পরিচিত করাল বিগত দিনের অনেক ভুলে যাওয়া জিনিসের সাথে। ক্লাইভ, রাবণ এদের সম্বন্ধে জানতে অর্থাৎ ইতিহাস, মহাকাব্য, পুরাণ এসব সম্বন্ধে জানতে। দর্শকরা নিজেদের উৎসাহে প্রতিযোগিদের সম্পর্কে জানতে তাদের জীবন কাহিনী খুঁজতে আরম্ভ করলো। বিজ্ঞানীর উদেশ্য আস্তে আস্তে সফল হতে লাগলো। বর্তমান সময়ের অনেক মানুষের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা মানবতা যেন জেগে উঠল। বহুদিন পর অনেক সন্তান বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেল, অনেকে আবার প্রেমে পড়তে আরম্ভ করল, যারা রোবটের উন্নতি সাধন নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিল, তারা মানুষের কথা ভাবতে শুরু করেছে আবার। বিজ্ঞানী তার জুয়া খেলায় জিতে গেছে। কী, গল্পটার কোথাও ভুল আছে?” গ্যাম্বলারের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল ড্যান।

“না, ভুল নেই। তবে বিজ্ঞানী তার জুয়ায় বোধহয় পুরোপুরি জেতেনি। তার অতি প্রিয় একজনের বিনিময়ে সে জুয়া খেলেছে।” আর্দ্র চোখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কল্কিশ্বর।

“আমার দুটো প্রশ্নের উত্তর দেবে কল্কি?”

“কী?”

“আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি, কিন্তু ডাক্তারের শোটার পর থেকেই আমার সন্দেহ হচ্ছিল আর ফিডব্যাক যা পাচ্ছিলাম তাতেও দেখছিলাম মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলছে এই শো। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না যে তুমি কী করে এত শিওর ছিলে যে ওই সময় যাত্রীরা তোমার গল্প অনুযায়ী চলবে মানে ওরা নিজেদের কথা না ভেবে অন্যের কথা ভাববে? নিজেদের জীবন পর্যন্ত দিতে চাইবে।”

“প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই ভালো মন্দ দুটো দিকই থাকে। কারুর ভালো দিকটা প্রকট হয় আর কারুর মন্দ দিকটা। আমি চেয়েছিলাম বর্তমান সময়ের মানুষের মধ্যে ভালো দিকটা জাগিয়ে তুলতে যেটা মনের গহনে চাপা পড়ে যাচ্ছিল বর্তমান প্রজন্মের। সেইজন্য আমি এমন মানুষদের বেছে ছিলাম যারা নিজেদের সময়ে মানবতাকে সম্বল করে জীবনের পথে এগিয়ে গেছে। এদের প্রত্যেকের সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে তবে আমি এদের বেছে ছিলাম। এরা ভীষণ বিখ্যাত না হলেও এদের কর্মকাণ্ডের জন্যই এদের সম্পর্কে অনেক তথ্য পুরোনো আর্কাইভে আছে। কয়েকজনের সম্বন্ধে বিভিন্ন বইতেও লেখা আছে। সেসব খবর তোমরা জানো না। তোমার ভাষায় আমি মানবতার ওপর বিশ্বাস রেখে জুয়া খেলেছি বলতে পারো। আমার মন দৃঢ়ভাবে আমাকে ওদের ওপর বিশ্বাস করতে বলেছিল। আমার মতো সর্বহারা একটা মানুষ যার আত্মসমর্পণ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না, সেই বোধহয় এমন জুয়া খেলতে পারে।”

“নিজের সন্তানের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এমন জুয়া শুধু তুমিই খেলতে পারো, অন্য কেউ নয়। আরেকটা প্রশ্ন, শোটার নাম নিয়ে। আমি আগেই তোমাকে প্রশ্নটা করেছিলাম, তুমি এড়িয়ে গেছ। AU REVOIR কথাটা তো ফরাসী। এর অর্থ তো গুড বাই। তাহলে...।”

“ফরাসীরা বিদায় সম্ভাষণে এই কথাটা বলে কেন জানো? তারা এর দ্বারা বলতে চায় আবার দেখা হবে। আমি আবার মানবতার, ভালোবাসার দেখা পেতে চেয়েছিলাম।” কথা শেষ করে কল্কিশ্বর আবার নীল আকাশের দিকে তাকালেন। সেদিকেই তাকিয়ে বললেন, “প্লীজ, দুর্গাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। প্লীজ।”

“বাবা।” অতি আপন কচি গলাটার ডাকে ঘুরে দাঁড়ালেন কল্কিশ্বর। কতদিন পর এই ডাক শুনলেন কল্কিশ্বর। তাঁর ছোট্ট দুর্গা এসে কোলে উঠে বলল, “বাবা, ওদিকে দেখো।” অবাক কল্কিশ্বর দেখলেন তাঁর শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অপালা।

“তোমার মানবতাই জিতে গেছে, কল্কিশ্বর। কিডন্যাপ করালেও অপালাকে আর তোমার ভূমিষ্ঠ না হওয়া সন্তানকে মেরে ফেলতে পারিনি। কোথায় যেন আটকে গেছিলাম। তোমায় মিথ্যে বলেছিলাম যে অপালাকে খুন করেছি।” বহুদিন পর কল্কিশ্বরকে তাঁর পরিবারের সাথে একলা ছেড়ে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ড্যান।

কিছুদিন পর

“স্যার, ডক্টর কল্কিশ্বর ফ্যামিলি নিয়ে কোনও গোপন জায়গায় চলে গেছেন। কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ওনার বাড়ি, ল্যাব সব ফাঁকা।”

“ঠিক আছে। খোঁজ করার কোনও দরকার নেই। তুমি এখন যাও।” সেক্রেটারিকে বিদায় করে দিয়ে ড্যান ভাবে, “এই ভালো হয়েছে। নাহলে হয়তো ড্যানের মত আবার কারুর লোভের শিকার হতে হত কল্কিশ্বরকে। আবার যখন মানবতা বিপন্ন হবে, কল্কিশ্বর নিশ্চয় ফিরে আসবে।”