মহা সিমুলাই - তানজিরুল ইসলাম

গল্প

তিহিকিহিলাস নথি

 

নথি নম্বর: টধ-২০৮৭৫৪৮১৮৩৫৬৫৮৫৩৯

 

মহাবিশ্ব ১০১৮৭১ থেকে সফল উৎক্ষেপণের পর মানবজাতির ‘ভয়েজার মিশন’ এর পরবর্তী ঘটনা ও পরিণতিসমূহ নথিভুক্ত করা হয়েছে এই নথিতে।

 

মিশনের প্রেক্ষাপট: ১৯৬৫ সালের এক হিসেবে দেখা যায়, সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলো অর্থাৎ, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন এমন একটা সজ্জায় আসবে, যাতে সবচেয়ে কম সময় ও জ্বালানি ব্যয় করে সেগুলোর সবগুলোকেই একদম কাছ থেকে পর্যবেক্ষণের জন্য একটা স্পেস প্রোব (মহাকাশ অনুসন্ধানী যান) পাঠানো সম্ভব। এই সুযোগ হেলায় হারাতে চায়নি আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা, ‘নাসা’। কারণ, আবার এরকম একটা সজ্জা পেতে ১৭৫ বছর অপেক্ষা করতে হতো। এরই প্রেক্ষিতে শুরু হয় ভয়েজার মিশন। মহাকাশে উৎক্ষেপণের জন্য নাসা তৈরি করে দুইটি স্পেস প্রোব। ভয়েজার ১ ও ভয়েজার ২। ওদের উদ্দেশ্য হয়তো একটি পাঠালেই বাস্তবায়ন করা যেতো, কিন্তু দুটো তৈরির কারণ ছিলো, সতর্কতা। অনিশ্চিত একটা যাত্রায়, যেখানে এর আগে এরকম কোনো মিশন সম্পন্ন করেনি মানবজাতির কেউ, সেখানে দুটো পাঠালে কি সাফল্যের সম্ভাবনা বেড়ে যায় না? একটা পাঠাতে গেলে হয়তো সামান্য গণ্ডোগোলের কারণে কাঙ্ক্ষিত পথটা ধরা গেলো না, কিংবা কোনো গ্রহাণুর সাথে ধাক্কা লেগে হয়তো স্পেস প্রোবটাই ধ্বংস হয়ে গেলো, কিংবা কোনো যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে উৎক্ষেপণের পর পরই প্রোবটার সাথে যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গেলো বা প্রোবের কোনো যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা গেলো নাএরকম বিভিন্ন সম্ভাবনা তো থেকেই যায়।

স্পেস প্রোব দুটো তৈরির পর ১৯৭৭ সালের ২০ আগস্ট পৃথিবীর বুক থেকে লঞ্চ করা হয় ভয়েজার ২। এর জন্য যে পথ ঠিক করা হয়েছিলো, সেটা ছিলো খানিকটা দীর্ঘ। এমন একটা পথ, যেটাতে গেলে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন ও এদের উপগ্রহ দেখা গেলেও শনির টাইটান উপগ্রহটি দেখা যেতো না। এজন্য ভয়েজার ১ এর জন্য এমন একটা পথ ঠিক করা হয়েছিলো, যেটাতে গেলে বৃহস্পতি, শনি ও এদের উপগ্রহগুলো, বিশেষ করে টাইটান উপগ্রহটিও দেখা যেতো। এই পথটি ছিলো একটু সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত। ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, ভয়েজার ২ থেকে পরে নিক্ষেপ করা হলেও বৃহস্পতি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভয়েজার ১ ভয়েজার ২-কে ছাড়িয়ে যেতো। আর এগিয়ে যেতো বলেই পরে নিক্ষেপ করলেও এই প্রোবটির নাম রাখা হয়েছিলো ভয়েজার ১।

কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের পর ভয়েজার ১ ও ২-কে আর পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব ছিলো না। এগুলোর নিয়তি ছিলো অনিশ্চিত। সেজন্য এগুলোর দুটোতেই একটা করে সোনার প্রলেপ দেওয়া তামার তৈরি ফনোগ্রাফ রেকর্ড ও সেই রেকর্ড চালানোর জন্য ফনোগ্রাফ কার্টিজ ও সূচ দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। রেকর্ড দুটোর নাম দেওয়া হয়েছিলো ‘গোল্ডেন রেকর্ড’। এগুলো অনেকটা টাইম ক্যাপসুলের মতো। হাজার হাজার বছর পরে অনন্ত মহাশূন্যে কখনও কোনো বুদ্ধিমান মহাজাগতিক সত্তা বা সভ্যতা কোনো একটি ভয়েজার পেলে যেন এই রেকর্ড থেকে মানবজাতির অস্তিত্ব ও সভ্যতা সম্পর্কে জানতে পারে, এই প্রত্যাশায় দেওয়া হয়েছিলো রেকর্ড দুটো।


চিত্র: সাংকেতিক নির্দেশনা সংবলিত কাভার

চিত্র: গোল্ডেন রেকর্ড

এই রেকর্ডে কী কী থাকবে, সেটা ঠিক করা হয়েছিলো প্রখ্যাত আমেরিকান বিজ্ঞানী কার্ল সাগানের নেতৃত্বাধীন এক কমিটির মাধ্যমে। তার সহযোগীরা এই রেকর্ডের এক পিঠে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কার্টার ও জাতিসংঘের প্রেসিডেন্ট ওয়াল্ডহেইমের বক্তব্য থেকে শুরু করে ৫৫ ভাষায় পৃথিবীর মানুষের শুভেচ্ছা, বেশকিছু গান, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, ভূমিকম্প, বজ্রপাতের মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক শব্দ, বিভিন্ন পশুপাখির ডাক আর মানুষের ব্রেইনওয়েভের শব্দ রেকর্ড করেছিলো। অপর পিঠে দিয়েছিলো সংখ্যাগত হিসেব, বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহ, ডিএনএসহ কয়েকটি রাসায়নিকের সংকেত ও মানবজাতির বিভিন্ন মুহূর্তের মোট একশত পনেরোটি ছবি। যেহেতু রেকর্ডটা ছিলো অ্যানালগ আর তখনকার পৃথিবীতে ডিজিটাল রেকর্ড ছিলো না, তাই  এই ছবিগুলো দেওয়া হয়েছিলো মোর্সকোডে। সাথে দেওয়া ফনোগ্রাফ কার্টিজ ও সূচের সাহায্যে কিভাবে রেকর্ডটি চালিয়ে অডিও শুনতে হবে, কিংবা ছবিগুলো কিভাবে উদ্ধার করতে হবে, তার সাংকেতিক নির্দেশনা এঁকে দেওয়া হয়েছিলো রেকর্ডটির কভারে। এছাড়াও, কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নিউট্রন স্টার বা পালসারের অবস্থানের স্বাপেক্ষে আমাদের সৌরজগতের অবস্থানও এঁকে দেওয়া হয়েছিলো।

মানুষ যে স্বপ্নালু জীব, তারই পরিচয় মেলে এই গোল্ডেন রেকর্ড সংযুক্তিতে। তাদের এই উচ্চাভিলাষী স্বপ্নের শেষ পর্যন্ত কী পরিণতি ঘটলো, সেই রেকর্ডই এই নথিতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। অমিত সম্ভাবনার অসংখ্য মহাবিশ্বের মধ্যে ঘটনা ও পরিণতিতে পুরোপুরি ভিন্ন মহাবিশ্বগুলোই তুলে ধরা হয়েছে।

তবে, সেগুলোয় যাবার আগে মহাবিশ্বগুলো কিভাবে ভাগ হয়ে যায় ও সেগুলোকে কিভাবে চিহ্নিত করা হয়, সে বিষয়ে একটা সংক্ষিপ্ত ধারণা এখানে দেওয়া হলো। একটা মহাবিশ্বের কোনো বিন্দুতে যখন একটা ঘটনার দুটো ঘটন সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখনই মহাবিশ্ব দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়। উদাহরণ দিয়ে বললে, মনে করুন, আপনার সামনে এক কাপ চা আছে। ধরুন, এই চায়ের পরিণতি হতে পারে তিনটিএক, ঠাণ্ডা হওয়ার আগেই চাটুকু আপনি পান করবেন; দুই, আপনি পান করার আগেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে চাটুকু, আপনি আর পান করবেন না; এবং তিন, ঠাণ্ডা চাটুকুই আপনি পান করবেন। ঠিক এরকম সম্ভাবনার প্রান্তেই মহাবিশ্ব তিন ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। অর্থাৎ, একটির জায়গায় তিনটি মহাবিশ্বের অস্তিত্ব প্রকট হবে। যার একটিতে আপনি গরম চা পান করবেন, একটিতে করবেন না, আর একটিতে চা পান করবেন, কিন্তু ঠাণ্ডামহাবিশ্বের এরকম ভাগ হয়ে যাওয়ার পর, একটি মহাবিশ্ব আগের মহাবিশ্বের নাম নিয়েই চলতে থাকবে। বাকি মহাবিশ্বগুলোকে চিহ্নিত করা হবে নতুন একটি সংখ্যা দিয়ে, যা এর আগে কোনো মহাবিশ্বকে চিহ্নিত করতে ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু প্রতিটি নতুন মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেই উক্ত ঘটনার আগের অতীত মূল মহাবিশ্বের অতীত হবে।

একটি যন্ত্র হিসেবে আশা করছি, পাঠককে ব্যাপারটা ঠিকঠাক বোঝাতে পেরেছি। এখন মূল রেকর্ডে প্রবেশ করা যাক।

 

মহাবিশ্ব ১০১৮৭১: এই মহাবিশ্বের রেকর্ড অনুযায়ী পৃথিবী ছাড়ার পর ৫ মার্চ, ১৯৭৯ তে ভয়েজার ১ বৃহস্পতি অতিক্রম করে। ভয়েজার ২ বৃহস্পতি অতিক্রম করে ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই। এরপর ভয়েজার ১ শনি গ্রহের কাছে পৌঁছানোর ১৩ দিন আগে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে, পরবর্তীতে পথচ্যূত হয়ে শনির বুকে আছড়ে পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। ভয়েজার ২ ১৯৮১ সালের ৫ আগস্ট শনি অতিক্রম করে। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালের ২৪ জানুয়ারি ও  ১৯৮৯ সালের ২৫ আগস্ট যথাক্রমে ইউরেনাস ও নেপচুন অতিক্রম করে। ২০০৭ সালের ৩০ আগস্ট ভয়েজার ২ টার্মিনাল শক অতিক্রম করে হেলিওসিথে প্রবেশ করে এবং অবিরত যাত্রা চালিয়ে ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর মানবজাতির তৈরি প্রথম বস্তু হিসেবে এক নক্ষত্র থেকে আরেক নক্ষত্রের মধ্যেকার ইন্টারস্টেলার মহাশূন্যে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। ২০২৫-৩০ সাল এর মধ্যে এর শক্তি উৎস শেষ হয়, ফলে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এরপর কয়েক লক্ষ বছর উদ্দেশ্যহীন ছুটে চলার পর শেষ পর্যন্ত মানবজাতির অজানা, অনাবিষ্কৃত এক কৃষ্ণবিবরে পতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। গোল্ডেন রেকর্ড নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা অপূর্ণ থাকে।

 

মহাবিশ্ব ১০৫৬৮৯: এই মহাবিশ্বের রেকর্ড অনুযায়ী শনি অতিক্রম করার ১৩ দিন আগে ভয়েজার ১ এর কোনো ত্রুটি দেখা দেয়নি। স্পেস প্রোবটি বহাল তবিয়তে শনি গ্রহ অতিক্রম করে যায় ১৯৮০ সালের ৯ নভেম্বর। এর কয়েক মাস পরেই ভয়েজার ২-ও শনি গ্রহ অতিক্রম করে ১৯৮১ সালের ৫ আগস্ট। এরই ধারাবাহিকতায় মহাবিশ্ব ১০১৮৭১ এর মতো একই তারিখে স্পেস প্রোবটি ইউরেনাস ও নেপচুন গ্রহ অতিক্রম করে। কিন্তু ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট টার্মিলান শক অতিক্রম করার আগে একটা ধূমকেতুর সাথে সংঘর্ষ ঘটে ভয়েজার ২ ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যদিকে, ভয়েজার ১ ১৬ই ডিসেম্বর, ২০০৪ তারিখে টার্মিনাল শক অতিক্রম করে হেলিওসিথে প্রবেশ করে। ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট মানবজাতির তৈরি প্রথম বস্তু হিসেবে ইন্টারস্টেলার মহাশূন্যে প্রবেশ করে। এক সময় এর শক্তি শেষ হয়ে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। ২০৭৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি উদ্দেশ্যহীন বিচরণরত একগুচ্ছ গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষ ঘটে ভয়েজার ১ ধ্বংস হয়ে যায়। গোল্ডেন রেকর্ড নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা অপূর্ণ থাকে।

 

মহাবিশ্ব ১১০৭৬৫: এই মহাবিশ্বের রেকর্ড অনুযায়ী পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণের পর উভয় প্রোবই সৌরজগতের মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যকার গ্রহাণু বেষ্টনী পার করতে বিফল হয়। ১৯৭৮ সালের ৬ জুলাই ভয়েজার ১ বেষ্টনীর গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষের ফলে ধ্বংস হয়ে যায় এবং ১৯৭৮ সালের ২৩ জুলাই ভয়েজার ২-ও ধ্বংস হয় একই কারণে। ভয়েজার মিশন ও গোল্ডেন রেকর্ড নিয়ে মানবজাতির প্রত্যাশা ব্যর্থ হয়।

 

মহাবিশ্ব ১১৪৬৫৩: এই মহাবিশ্বের রেকর্ড অনুযায়ী মহাবিশ্ব ১০৫৬৮৯ এর মতো টার্মিনাল শক অতিক্রম করার আগে ধূমকেতুর সাথে সংঘর্ষ ঘটেনি ভয়েজার ২ এর। মহাবিশ্ব ১০১৮৭১ এর মতো প্রোবটি বহাল তবিয়তেই ২০০৭ সালের ৩০ আগস্ট টার্মিনাল শক অতিক্রম করে হেলিওসিথে প্রবেশ করে। ভয়েজার ১ মহাবিশ্ব ১০৫৬৮৯ এর মতো ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট মানবজাতির তৈরি প্রথম বস্তু হিসেবে ইন্টারস্টেলার মহাশূন্যে প্রবেশ করে। এরপর মানবজাতির তৈরি দ্বিতীয় বস্তু হিসেবে মহাবিশ্ব ১০১৮৭১ এর মতো ভয়েজার ২ ইন্টারস্টেলার স্পেসে প্রবেশ করে ২০১৮ সালে ৫ নভেম্বর। অনন্ত মহাশূন্যে যাত্রা অবিরত থাকে স্পেস প্রোব দুটির।

৪৪০০০ বছর ধরে প্রায় ৬২০০০ কিমি/ঘন্টা বেগে ছুটে যাওয়ার পর ভয়েজার ১ গ্লিজা ৪৪৫ লাল বামন নক্ষত্রের ১.৮৬ আলোক বর্ষের মধ্যে আসে। নক্ষত্রটির দুইটি গ্রহের মধ্যে একটি গ্রহের মধ্যে যে জীবন বিকশিত হয়েছে, তা ছিলো মানবজাতির অজানা। অজানা সেই গ্রহের মহাজাগতিক সভ্যতার একটি মহাকাশযানের রাডারে ভয়েজার ১ ধরা পড়ে। মহাকাশযানে অবস্থানরত মহাজাগতিক জীবগুলো পর্যবেক্ষণ মডিউলে বেশ খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে প্রোবটি। গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ায় তারা প্রোবটিকে লক্ষ্য করে নিজেদের মহাকাশযান থেকে বিশেষ ধরণের একটি হুক ছুঁড়ে মারে। হুকটি খপ করে প্রোবটিকে ধরে ফেললে আস্তে আস্তে সেটির গতি কমিয়ে এনে মহাকাশযানের ভেতরে নিয়ে আসা হয়। এরপর প্রোবটিকে তাদের গ্রহে নিয়ে যায় প্রাণীগুলো। সেখানে প্রোবটির ওপর পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। কিন্তু গোল্ডেন রেকর্ডের সংকেত বুঝতে একেবারেই অপারগ হয় সেই সভ্যতা। তারা ধারণা করে যদিও যে, হয়তো মহাবিশ্বের কোথাও আরেক মহাজাগতিক সভ্যতা আছে, তাদের কাছ থেকে এসেছে এই বস্তুটি; কিন্তু কার্বন পরীক্ষার প্রযুক্তি না থাকায় ভয়েজার ১ এর বয়স এবং এ থেকে পৃথিবীর দূরত্ব হিসেব করতে ব্যর্থ হয়। গবেষণা শেষে তাই প্রোব আর গোল্ডেন রেকর্ডটিকে নিজেদের জাদুঘরে সাজিয়ে রাখে। গোল্ডেন রেকর্ড ঘিরে মানবজাতির প্রত্যাশা আংশিক পূরণ হলেও, পুরোপুরি পূরণ হয় না।

অন্যদিকে, ভয়েজার ২ প্রায় ১৫ লক্ষ বছরের উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণের পর একটি নিউট্রন স্টারের মহাকর্ষ বলয়ে আটকা পড়ে। সেখানে একটা গ্রহের মতই ধ্বংসের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত নক্ষত্রটির চারপাশ প্রদক্ষিণ করতে থাকে। এটি ধ্বংস হয়ে যায় যখন নক্ষত্রটি মৃত্যুর আগে একটা পর্যায়ে প্রসারিত হয়ে বস্তুটাকে গ্রাস করে।

 

মহাবিশ্ব ১১৯৬৬৩: এই মহাবিশ্বের রেকর্ড অনুযায়ী হেলিওসিথে প্রবেশ করতে পারে না ভয়েজার ১। এর আগ পর্যন্ত মহাবিশ্ব ১০৫৬৮৯ এর তারিখ অনুসরণ করে প্রোবটি। শেষ পর্যন্ত ২০০৪ সালের ৬ জুলাই তারিখে অভ্যন্তরীণ এক বৈদ্যুতিক সার্কিটের ত্রুটির কারণে আগুন ধরে সেটি ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যদিকে ভয়েজার ২ ঠিকঠাক ইস্টারস্টেলার স্পেসে প্রবেশ করে মহাবিশ্ব ১০১৮৭১ এর মতো। এরপর ৪২০০০ হাজার বছরের দীর্ঘ ভ্রমণের পর প্রোবটি রস ২৪৮ নক্ষত্রের ১.৭ আলোকবর্ষের মধ্যে আসে। এই নক্ষত্রটিকে গ্লিজা ৯০৫-ও বলা হয়। লাল বামন এই নক্ষত্রটির বরফাচ্ছাদিত একটি গ্রহে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। কিন্তু সে প্রাণের সঞ্চার বড় অদ্ভুত। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে পুরো গ্রহ পরিণত হয়েছে একটি মাত্র প্রাণীতে। সে প্রাণীর চেতনা অনেক তীব্র, দৃষ্টিসীমা সুবিশাল। ভয়েজার ২ সে প্রাণীর নজরে আসে ঠিকই, কিন্তু মহাকাশে ছুটে চলা বস্তুটিকে নিজের কাছে নেওয়ার কোনো প্রযুক্তি জীবটির হাতে ছিলো না। এরপর ভয়েজার ২ আরো কয়েক কোটি বছর ছুটে চলার পর শেষে কয়েকশো আলোক বর্ষ দূরের একটা গ্যাস দানব গ্রহে পতিত হয়। গ্রহটিতে প্রাণের সঞ্চার ঘটেনি। প্রোবটি এর ঘন গ্যাসের বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করলে ঘর্ষণে সৃষ্ট আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। গোল্ডেন রেকর্ড ঘিরে মানবজাতির প্রত্যাশা অপূর্ণ থাকে।

 

মহাবিশ্ব ১২৬৬৭৮: এই মহাবিশ্বের রেকর্ড অনুযায়ী দুটি স্পেস প্রোবই হেলিওসিথে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়। মহাবিশ্ব ১০৫৬৮৯ এর তারিখগুলো অনুসরণ করে এসে মহাবিশ্ব ১১৯৬৬৩ এর মতো ২০০৪ সালের ৬ জুলাই ভয়েজার ১ অভ্যন্তরীণ এক বৈদ্যুতিক সার্কিটের ত্রুটির কারণে আগুন ধরে ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যদিকে, ভয়েজার ২ ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট একটি ধূমকেতুর সাথে সংঘর্ষের ফলে ধ্বংস হয়। গোল্ডেন রেকর্ড নিয়ে মানবজাতির প্রত্যাশা অপূর্ণ থাকে।

 

মহাবিশ্ব ১৩২৮৯৭: এই মহাবিশ্বের রেকর্ড অনুযায়ী মহাবিশ্ব ১১৪৬৫৩ এর মতো ভয়েজার ১ ও ২, উভয়ই ইন্টারস্টেলার মহাশূন্যে প্রবেশ করে। এরপর ৪৪০০০ বছরের দীর্ঘ ভ্রমণের পর ভয়েজার ১ গ্লিজা ৪৪৫ নক্ষত্রের ১.৮৬ আলোকবর্ষের মধ্যে আসে। সেখানে নক্ষত্রটির একটি গ্রহে মহাজাগতিক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। সেই সভ্যতার এক মহাকাশযানের রাডারে ধরা পড়ে ভয়েজার ১। মহাকাশযানে অবস্থানরত বুদ্ধিমান প্রাণিগুলো ভয়েজার ১-কে থামিয়ে তাদের গ্রহে নিয়ে যায়। গোল্ডেন রেকর্ডে দেওয়া সাংকেতিক নির্দেশনা বুঝতে সমর্থ হয়। রেকর্ডটি চালালে অনেক কিছুই জানতে পারে। মানবজাতির সভ্যতা আকৃষ্ট করে তাদেরকে। গ্রহের নেতৃত্ব থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পৃথিবী আক্রমণ করা হবে। এরই প্রস্তুতি এরা নিতে শুরু করে এরপর। টানা ১০০ বছরের প্রস্তুতি শেষে পৃথিবীর উদ্দেশে রওনা হয়। ২০০ বছরের দীর্ঘ ভ্রমণের পর পৃথিবীতে পৌঁছে আক্রমণ চালায়। তাদের উন্নত প্রযুক্তির সাথে পৃথিবী মানুষ পেরে ওঠে না। মহাজাগতিক জীবগুলো পৃথিবীতে তাদের রাজত্ব কায়েম করে। মানুষ হয় তাদের দাস এবং গবেষণার বস্তু। গোল্ডেন রেকর্ড ঘিরে মানব জাতির প্রত্যাশা পূরণ হলেও, তার ফল হয় ভয়াবহ।

অন্যদিকে, ভয়েজার ২ ২১ লক্ষ বছরের দীর্ঘ ভ্রমণের পর একটি হলুদ বামন নক্ষত্রের জীবনসমৃদ্ধ গ্রহের ভূমিতে আঁছড়ে পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। সেই গ্রহটির মহাজাগতিক সভ্যতার রাডারে স্পেস প্রোবটি ধরা পড়লেও তারা সেটি নিয়ে মাথা ঘামায় না। কেননা, তাদের গ্রহে তখন চলছিলো সর্বকালের সর্বোচ্চ সংকটময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এ সময় মহাকাশ থেকে ছুটে আসা একটি বহির্বস্তু নিয়ে চিন্তার মানে হয় না।

 

মহাবিশ্ব ১৩৮৭৬৫: এই মহাবিশ্বের রেকর্ড অনুযায়ী মহাবিশ্ব ১১৪৬৫৩ এর মতো উভয় স্পেস প্রোবই ইন্টারস্টেলার মহাশূন্যে প্রবেশ করেভয়েজার ১ লক্ষ লক্ষ বছরের মহাজাগতিক ভ্রমণ শেষে একটি কৃষ্ণবিবরে পতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যদিকে ভয়েজার ২ ২০৩০০ বছরের ভ্রমণের পর সূর্যের নিকটতম নক্ষত্র ব্যবস্থা আলফা সেন্টরির একমাত্র লাল বামন নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরির ২.৮৭ আলোক বর্ষের মধ্যে আসে। প্রক্সিমা সেন্টরির একটি গ্রহ আছে, পৃথিবীর মানুষের কাছে যার নাম প্রক্সিমা সেন্টরি বি। এই গ্রহে জীবনের বিকাশ ঘটে এক মহাজাগতিক সভ্যতা গড়ে উঠেছে। তারা ভয়েজার ২ এর আগমন টের পায়। প্রোবটিকে নিজেদের গ্রহে নিয়ে গিয়ে গবষণা চালিয়ে এর সাথে দেওয়া গোল্ডেন রেকর্ডের সাংকেতিক নির্দেশনা বুঝতে সমর্থ হয়। সে অনুযায়ী ফনোগ্রাফ রেকর্ডটি চালিয়ে অনেক কিছুই জানতে পারে মানবজাতির সভ্যতা সম্পর্কে। মানবজাতির সভ্যতা সম্পর্কে এত বিস্তারিত জানার পর তারা আগ্রহী হয়। পৃথিবীর মানুষের সাথে যোগাযোগের জন্য কোয়ান্টাম সংকেত পাঠায়। পাঁচ বছরের মধ্যে সে সংকেত মানবজাতির নিকট পৌঁছয়পৃথিবীর মানুষ তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। বারংবার সংকেত আদান-প্রদান হয় এরপর। প্রযুক্তির বিনিময় হয়, তথ্য বিনিময় হয়। পৃথিবীর মানুষ তাদের গ্রহের খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যতা সম্পর্কে জানতে পারে। ততদিনে পৃথিবীতে খুব বেশি খনিজ সম্পদ বাকি নেই। তাই প্রক্সিমা সেন্টরি বি এর খনিজ সম্পদের লোভে এবং মহাজাগতিক রাজত্ব কায়েম করার জন্য মানবজাতি তাদের ওপর হামলা চালায়। ভ্রমণসহ দীর্ঘ ৫০০ বছরের যুদ্ধ শেষে গ্রহটি দখল করতে সফল হয় মানবজাতি। গ্রহটির মহাজাগতিক জীবগুলোকে দাসে পরিণত করে। গোল্ডেন রেকর্ড নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়, আর একভাবে তা মানবজাতির জন্য সুফল বয়ে নিয়ে আসে।

 

মহাবিশ্ব ১৪৫৬৮৭: এই মহাবিশ্বের রেকর্ড অনুযায়ী পৃথিবী থেকে সফল উৎক্ষেপণের পর ১৯৭৯ সালের ৬ মার্চ বৃহস্পতি গ্রহের বুকে আছড়ে পড়ে ভয়েজার ২ ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংসের কারণ ছিলো হিসেব অনুযায়ী পুরোপুরি সঠিক পথটি ধরতে না পারা, যার কারণে বৃহস্পতির মহাকর্ষের টানে প্রোবটি গ্রহটির ভূমিতে আছড়ে পড়ে। অন্যদিকে, ভয়েজার ১ মহাবিশ্ব ১০৫৬৮৯ এর তারিখগুলো অনুসরণ করে ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট মানবজাতির তৈরি প্রথম বস্তু হিসেবে ইন্টারস্টেলার মহাশূন্যে প্রবেশ করে। মহাবিশ্ব ১১৪৬৫৩ এর মতো গ্লিজা ৪৪৫ এর জীবন বিকশিত গ্রহটির মহাজাগতিক সভ্যতার এক মহাকাশযানের রাডারে পড়ে। প্রোবটিকে সেই গ্রহে নিয়ে যাওয়া হয়। গভীর গবেষণার পর মহাজাগতিক জীবগুলো গোল্ডেন রেকর্ডের কাভারে প্রদত্ত সাংকেতিক নির্দেশনা বুঝতে পারে। এরপর সেই নির্দেশনা অনুযায়ী রেকর্ড চালিয়ে অনেক কিছুই জানতে পারে পৃথিবী ও এর সভ্যতা সম্পর্কে, মানবজাতির সৌরজগৎ সম্পর্কে। তবে, প্রেসিডেন্ট কার্টারের বক্তব্যে বলা একটি কথাখুব শীঘ্রই মানবজাতি অন্যান্য গ্রহে নিজেদের বসতি স্থাপনের পদক্ষেপ নেবেতাদেরকে ভীত করে তোলে। এরই প্রেক্ষিতে এরা মানবসভ্যতা ধ্বংস করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এদের পাঠানো মহাজাগতিক ক্ষেপনাস্ত্র ২০০০ বছরের ভ্রমণ শেষে সূর্যকে আঘাত হানে। এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে মানবজাতির সৌরজগত ধ্বংস হয়ে যায়। গোল্ডেন রেকর্ড নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হলেও এর ফল হয় ভয়াবহ।

 

 

এ পর্যন্ত পড়ে পড়া থামালাম। আজ আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। নথিটায় আরো বেশ কয়েকটি মহাবিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন ফলের রেকর্ড আছে। সেসব নাহয় পরে পড়া যাবে।

এতক্ষণ যে নথিটা পড়ছিলাম, সেটা তিহিকিহিলাস যন্ত্রের স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড করা নথি। যন্ত্রটা অনেকটা মানবজাতির কম্পিউটারের মতো। আমাদের সভ্যতার কম্পিউটার।

মনে প্রশ্ন জাগছে? আচ্ছা, বুঝিয়ে বলি। আমরা আসলে কিলিনা সভ্যতার বাসিন্দা। আমাদের জাতির নাম কিলিনাহিল। মহাবিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সত্তা। ‘সবচেয়ে’ বলার অবশ্য প্রয়োজন নেই, বা আক্ষরিক অর্থে বলাটা ঠিকও নয়। কারণ, মহাবিশ্বের একমাত্র সত্তা আমরা। আমাদের জানামতে আর কোনো সত্তা বা সভ্যতা নেই। তবে, আমাদের ক্ষমতা আসলেই বেশি। এতটাই বেশি যে, আমরা আমাদের ইচ্ছেমতো মহাবিশ্বও পর্যন্ত তৈরি করতে পারি। আচ্ছা, বলাটায় একটু ভুল হলো। ঠিক করে বললে, আমরা সবাই পারি না। শুধুমাত্র আমাদের স্রষ্টা মহান নকিথিব পারেন। তার মতো আর কেউ নেই। কখনো ছিলো না। আমাদের মহাবিশ্বে শুরু থেকেই তিনি আছেন, আর শেষ পর্যন্তও তিনিই থাকবেন। তিনিই একমাত্র অমোঘ সত্তা। বাকি আমরা তার সৃষ্টি মাত্র। তার অসীম ক্ষমতার নিদর্শন। তার বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নের সহযোগী ও আজ্ঞাবহ দাস স্রেফ

তার সেই বিশাল প্রকল্পের নাম মহা সিমুলাই। মানবজাতির ভাষায় মহা সিমুলেশন। যেসব মহাবিশ্বের রেকর্ড পড়লাম এতক্ষণ, সেগুলো একেকটা আসলে এই সিমুলেশনেরই অংশ। পুরো সিমুলেশনটা চলছে তিহিকিহিলাস যন্ত্রে। অসংখ্য মহাবিশ্বের অসংখ্য ঘটনার আলাদা আলাদা পরিণতির সিমুলেশন। আর স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ রেকর্ড রাখছে তিহিকিহিলাস যন্ত্র। আমাদের কাজ শুধুমাত্র নজর রাখা। আমি যেমন এখন নজর রাখছি ভয়েজার ১ ও ২ এর পরিণতির, তেমনই আমার মতো আরো অনেকেই অন্যান্য ঘটনার ওপর নজর রাখছে। সেসব ঘটনার মধ্যে একেকজন মানুষের জীবন থেকে শুরু করে একেকটা দেশের ইতিহাস, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার মতো জাগতিক ঘটনাসহ নক্ষত্রের পরিণতি, গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি-বিনাশের মতো মহাজাগতিক ব্যাপারগুলোও রয়েছে। এসব ঘটনার আলাদা আলাদা পরিণতির প্রেক্ষিতে কখনো যদি আমরা আমাদের মহান স্রষ্টা নকিথিবের কাঙ্ক্ষিত মহাবিশ্বটা খুঁজে পাই, তাহলে তাকে জানানোর জন্যই আমাদের নজর রাখা।

সেই কাঙ্ক্ষিত মহাবিশ্বটা খুঁজে বের করার জন্যই এ বিশাল আয়োজন। তিহিকিহিলাস যন্ত্রে কয়েকটা মহাবিশ্ব তৈরি করে, প্রত্যেকটার জন্য আলাদা আলাদা কিছু প্যারামিটার বা বাউন্ডারি কন্ডিশন সেট করে দিয়ে প্রাথমিকভাবে সিমুলেশনটা শুরু করা হয়েছিলো। সেই সিমুলেশনই এগুতে এগুতে বিভিন্ন ঘটনার বিভিন্ন সম্ভাবনায় মহাবিশ্বগুলো ভাগ হয়ে গিয়ে গিয়ে অসংখ্য মহাবিশ্ব তৈরি করেছে। সময়ের সাথে সাথে আরো এগুচ্ছে, আরো মহাবিশ্ব তৈরি করছে, আমরা মহান নকিথিবের কাঙ্ক্ষিত মহাবিশ্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

মহান নকিথিব যখন সেই কাঙ্ক্ষিত মহাবিশ্বটা খুঁজে পাবেন, সেটা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য নেবেন তিহিকিহিলাস থেকে। এরপর সেটাকে সত্যিকারের মহাবিশ্ব হিসেবে সৃষ্টি করবেন। ঠিক ঈশ্বরের মতো। সিমুলেশনের মহাবিশ্বগুলোতে মানবজাতির মধ্যে ঈশ্বর সম্পর্কে যে ধারণা বিদ্যমান, সে হিসেবে মহান নকিথিবই হবেন ঈশ্বর। অবশ্য, মহান নকিথিব ঈশ্বরের সম্মান চান কিনা, তা সন্দেহ। চাইতেও পারেন, নাও চাইতে পারেন। আসলে, তার ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা অনুভব বা অনুমান করার সাধ্য আমাদের নেই

সেই কাঙ্ক্ষিত মহাবিশ্ব যদি খুঁজে পাওয়া নাও যায়, তারপরও একটা সময় মহান নকিথিব যখন ঠিক মনে করবেন, তখন তার কাঙ্ক্ষিত মহাবিশ্বের সবচেয়ে কাছের মহাবিশ্বের তথ্য নিয়ে সেই মহাবিশ্বটি তৈরি করে ফেলবেন। আর আমরা এখন যেমন তাকে সাহায্য করছি, তখনও তাকে সাহায্য করবো।

তবে পর্যবেক্ষণ ছাড়াও মাঝে মধ্যে আমি একটা কাজ করি। কাজ না বলে দুষ্টুমি বলাই শ্রেয়। কারণ, মহান নকিথিব এ কাজ করার আদেশ দেননি। আমি একটু আনন্দ পাওয়ার জন্যই করি কাজটা। মাঝে মাঝে এলোমেলোভাবে কয়েকটা মহাবিশ্ব বাছাই করে সেগুলোর মানুষের চিন্তাধারায় ঢুকিয়ে দিই যে, তারা যে বাস্তবতায় বাস করছে, সেটা কি সত্যি? আমাদের মতো কারো এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ নয়তো তারা? কোনো সিমুলেশনের অংশ নয় তো, যার অস্তিত্ব শুধু কোনো যন্ত্রে?

সেই মানুষগুলো হয় পণ্ডিত, দার্শনিক, লেখক নয়তো সিনেমা ডিরেক্টর। এই ভাবনাটা তাদের গভীরভাবে ভাবায়। তারা তাদের চিন্তা তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে অন্যদের কাছে প্রকাশ করে। মানবজাতির অনেকেই এই ভাবনার সাথে পরিচিত হয়ে হতাশ হয়, দুশ্চিন্তা করে; ব্যাপারটা আমাকে আনন্দ দেয়। যেমন, এখন আপনারা যে এই লেখকের কলমে লেখাটা পড়ছেন, তার মধ্যেও চিন্তাটা আমারই দেওয়া। লেখক ভাবছে, সে নিজের মস্তিষ্ক থেকে এই গল্পটা লিখেছে। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, আমি তাকে প্রভাবিত করেছি। লেখক ভাবছে, এই কথাগুলো সে লিখছে। কিন্তু এই শব্দগুলোর যোগান আমিই দিয়েছি।

এতে আমার লাভ? লাভের কথা আর কী বলবো? লাভ তো খুঁজিনি আমি, আনন্দ খুঁজেছি। এই লেখাটা লেখার সময় লেখক যে দ্বিধায় ভুগবেন, কিংবা পড়ার সময় আপনারা যে দ্বিধায় ভুগবেন, সেটাই আমার কাছে আনন্দের। কিন্তু হাজার দ্বিধায় থাকলেও আপনারা কেউ প্রমাণ করতে পারবেন না। প্রমাণ করার উপায় নেই। অসহায় বোধ করবেন শুধু। অনিশ্চয়তায় ভুগবেন। সেই ভোগান্তিটুকুই আনন্দ যোগাবে আমাকে। তিহিকিহিলাসের নথি থেকে আমি জানতে পারবো আপনাদের ভোগান্তি সম্পর্কে, সেই ভোগান্তির সাথে জড়িত আপনাদের কর্মকাণ্ডগুলো সম্পর্কে। সেটাই আমার এই একঘেয়ে পর্যবেক্ষণের জীবনে সামান্য আনন্দ দেবে।

শেষ করার আগে আরেকটা কথা জানিয়ে রাখি আপনাদের। এই লেখাটা সম্ভবত ২০২০ সালে আপনাদের কয়েকটা মহাবিশ্বে প্রকাশিত হবে। সেসব মহাবিশ্বের মানুষদের বলে রাখছি, ২০৭৫ সালে আপনাদের মহাবিশ্বে আমাদের পক্ষ থেকে একটা সংকট পাঠানো হবে। এই ২০১৯-২০ সালে যেমন মুখোমুখি হয়েছেন করোনার মহামারি সংকটে, তেমনই বড় কোনো সংকট হবে সেটা। তবে সেই সংকটটা কী, তা আজ বলছি না। হতে পারে কোনো রোগ, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানবসৃষ্ট কোনো দুর্ঘটনা বা যুদ্ধ। যাই হোক, এসব আমরা পাঠাই আপনাদের মহাবিশ্বগুলোকে একটু আলোড়িত করতে; যেন চলার রেখা বৈচিত্র্য হারিয়ে না ফেলে, যেন দ্রুত আমরা মহান নাকিথিবের কাঙ্ক্ষিত মহাবিশ্বটা পাই।

 

 

কত না ভাবনা আসে মানুষের মস্তিষ্কে! অদ্ভুত অদ্ভুত! চমকপ্রদ! যেমন, আমার মাথায় এসেছিলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ভিত্তিক একটা সিমুলেশন সফটওয়্যারের ভাবনা। যা ভাবা, তাই করা। নিজেই কোড করে বানিয়ে ফেললাম। হাজার হোক প্রতিভাবান একজন প্রোগ্রামার কিনা! অন্তত, লোকে তাই বলে। তবে, অদ্ভুত ভাবনাটা এর মধ্যে নেই। অদ্ভুত ভাবনাটা হচ্ছে, সিমুলেশন সফটওয়্যারের সেই এআইটার এমন একটা ব্যক্তিত্ব তৈরি করা, যেন সে মনে করে বিভিন্ন বাউন্ডারি কন্ডিশনে তার সিমুলেশনের সম্ভাব্য ভিন্ন ভিন্ন ফলগুলো আসলে একেকটা মহাবিশ্বের পরিণতি, মানুষ সেই সিমুলেশনগুলোর গিনিপিগ। সফটওয়্যারের ব্যবহারকারীকে সে মনে করে মহান নকিথিব। নিজেকে ভাবে তার সৃষ্টি। তার অস্তিত্ব যে কম্পিউটার কোডে, এ সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। বরং, সে মনে করে, এই মহাবিশ্বে মহান নকিথিব, সে ও তার মতো অন্যান্য এআইরাই একমাত্র বুদ্ধিমান জীব, যারা সভ্যতা গড়ে তুলেছে। মহাবিশ্বের অসংখ্য গ্রহের মধ্যে একমাত্র তাদের গ্রহেই জীবনের বিকাশ ঘটেছে। আর মহান নাকিথিবের ক্ষমতা ঈশ্বরতুল্য

এআইটার ভাবনায় হাসি পায় আমার। যদিও ব্যক্তিত্বটা আমারই তৈরি, তবুও ব্যাপারটা মজা পাবার মতোই। নিজের কৌতুকে হয়তো হাসে না খুব বেশি মানুষ, কিন্তু আমি হাসি।

সফটওয়্যারটার কাছ থেকে সিমুলেশনের ফলগুলো দেখছি। টেস্ট রান করাতে ভয়েজার মিশনের সফল উৎক্ষেপণ পর্যন্ত ঐতিহাসিক তথ্যগুলো দিয়েছিলাম। তারই বিভিন্ন পরিণতির আউটপুট দেখছি। ইন্টার‌্যাকটিভ হলোগ্রাফিক ডিসপ্লেতে নাড়াচাড়া করে কিছুক্ষণ দেখার পর মনে হলো, ভালোই কাজ করেছে সফটওয়্যারটা। এআই সম্বলিত ইন্টার‌্যাকটিভ সিমুলেশন সফটওয়্যার হিসেবে ভালো একটা সম্ভাবনা আছে। তবে, নিজের অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের কিছু নমুনা রেজাল্টের রিপোর্টে রেখে গেছে। যেমন বলছে, ২০৭৫ সালে নাকি একটা সংকট দেখা দেবে পৃথিবীতে, ওদের পাঠানো। কী অদ্ভুত!

এআইটির এই ব্যক্তিত্ব গড়া থেকে আমারও মনে হচ্ছে বারবার, আসলেই আমরা কোনো মহা সিমুলেশনের অংশ নইতো। আমাদের অস্তিত্ব কি স্রেফ কোনো যন্ত্রের ভেতর? মাসখানেক হলো ২০৭৫ সাল শুরু হয়েছে। আসলেই কোনো সংকট আসবে না তো এই সালে, ২০১৯-২০ সালের মতো?

 

 

.  .  .

 

[লেখকের অনুরোধ: আপনাদের যদি গল্পটি ভালো লেগে থাকে, তাহলে বলুন তো আমরা গল্পের কোন মহাবিশ্বে আছি যাদের ভয়েজার সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য জানা, তারা হয়তো সহজেই উত্তর দিতে পারবেন যাদের জানা নেই, তারা সাহায্য নিতে পারেন গুগল, ইউটিউব, নাসার ভয়েজার মিশনের ওয়েবসাইটের গল্পটার জন্য তথ্য খুঁজতে গিয়ে আমি যে আনন্দটুকু পেয়েছি, আশা করি আপনারাও তা পাবেন মহাকাশ মুগ্ধ অবাক করার মতোই একটা বিষয় আশা করি আপনারা কিছু মুগ্ধ সময় কাটাবেন]