সম্পাদকের কথা

প্রিয় পাঠকবন্ধুরা,

প্রথমেই আপনাদের সবাইকে জানাই নতুন বাংলা বছরের প্রীতি ও শুভেচ্ছা। বেশ কিছুদিন পরে আপনাদের কাছে নিয়ে এলাম পরবাসিয়া পাঁচালীর এই নতুন সংখ্যা। পত্রিকা প্রকাশে বেশ খানিকটা বিলম্ব হলেও আশা করি আপনারা চারপাশের চরম নিরানন্দময় পরিস্থিতিতে আমাদের অপারগতার কথা কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পেরেছেন।

ডিসেম্বরে যখন প্রথম এই সংখ্যার জন্য কল্পনায় ২০৭৫-এর পৃথিবীর ছবি আঁকছিলাম, তখন সবার অগোচরে বাড়ছিল এক অদৃশ্য বিভীষিকা। কে জানত ২০২০-এর পৃথিবীতেই নেমে আসবে এক অকল্পনীয়, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কালিমা! দু’মাস ধরে চলা লকডাউনের পরেও টানেলের শেষে আলোর ক্ষীণতম বিন্দুরও দেখা মিলছে না। এর আগে বিজ্ঞানীরা ও আরও অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন আগামী দিনে প্রাদুর্ভাব ঘটবে নতুন রোগের। কিন্তু আমরা সেসব সাবধানবাণীতে কান না দিয়ে চালিয়ে গিয়েছি লাগামহীন জীবনযাপন, করে গিয়েছি প্রকৃতির ওপর নির্মম অত্যাচার। তার ফলস্বরূপ, আজ আমাদের পিঠ ঠেকে গিয়েছে দেওয়ালে, সমগ্র মানবসভ্যতাই অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। ডাক্তার, গবেষক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, পুলিশ, সাফাইকর্মী এবং আরও আপৎকালীন পরিষেবা কর্মীরা অবিরত লড়াই করে চলেছেন আমাদের জন্য, যাতে আমরা সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু এই কঠিন সময় কাটিয়ে উঠতে গেলে আমাদের সবাইকেই দায়িত্ব নিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনা এই পৃথিবী রাজ করতেই এসেছে, তাই হয়তো সহজে তার হাত থেকে মুক্তি মিলবে না। সুতরাং, সরকারি গাইডলাইন মেনে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই এই যুদ্ধে আমাদের একমাত্র হাতিয়ার।

এবার আসি আমাদের বর্তমান সংখ্যার বিষয়ে। এই সংখ্যায় আমরা ২০৭৫-এর পৃথিবীর সম্পর্কে একটা আভাস পাঠককে দিতে চেয়েছি। আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে সুদূর ২০৭৫-এর কথা হয়তো অনেকেই ভাবেন না। বিশ্ববিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক ও সাইবারপাঙ্ক জনরার স্রষ্টা উইলিয়াম গিবসন সে কারণে মনে করেন, ভবিষ্যত আর আগের মতো নেই। সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মানুষ আসলে ভবিষ্যত নিয়ে উৎসাহ হারাচ্ছে। “বিংশ শতাব্দীতে বসে আমরা বারবার একবিংশ শতাব্দীর কথা ভেবেছি,” তিনি বলেন, “কিন্তু আজকের দিনে কটা লোক আর দ্বাবিংশ শতাব্দীর নামোচ্চারণ করে, বলতে পারেন? এমনকি সেই সময়কে আমাদের কাছে অচেনা, অজ্ঞাত বলারও মানে, আমাদের কোনও ভবিষ্যত নেই।”

গিবসন মনে করেন, তাঁর সময়ে ভবিষ্যত চর্চা একটা কাল্ট, হয়তো বলা ভালো এক প্রকার ধর্মে পরিণত হয়েছিল। তাঁর জেনারেশনের মানুষ ‘পোস্টালজিয়া’য় আক্রান্ত থাকত। তারা ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখতে ভালবাসত। তারা ভবিষ্যতকে পারফেক্ট বলে কল্পনা করত, নস্টালজিয়ায় ভোগা মানুষ যেমন অতীতকে শ্রেষ্ঠ সময় বলে মনে করে। উদাহরণ হিসবে বলা যায় যেমন অনেকেই মনে করতেন, চাকরিতে কোনও বিশেষ কাঙ্খিত প্রমোশনটি পেলে জীবন পারফেক্ট হয়ে উঠবে।

“পাহাড়ের গায়ে স্ফটিকের মতো শহর বা নিউক্লিয়ার যুদ্ধ-পরবর্তী তেজস্ক্রিয় পতিত জমির ভবিষ্যত হারিয়ে গিয়েছে,” গিবসন ২০১২ সালে বলেন, “আমাদের সামনে পড়ে আছে শুধুই… আরও জিনিস… আরও ঘটনাবলি।” এর ফলে জন্ম নিয়েছে এক অদ্ভুত পোস্টমডার্ন অস্থিরতা। গিবসন একে বলেন ‘ভবিষ্যত ক্লান্তি’। এর প্রভাবে ভবিষ্যতের রঙিন, পারফেক্ট স্বপ্ন নিয়ে আমরা বিশেষ ভাবিত নই। বরং আমাদের লক্ষ্য এখন বর্তমানে। ইন্টারন্যাশানাল অ্যাটিচুড সার্ভের সমীক্ষা বলছে, আমরা ভবিষ্যত নিয়ে কদাচিৎ ভাবি, আর আমদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন বহুদূরবর্তী ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। যখন আমাদের ভাবতে বাধ্য করা হয়, কল্পনায় যা দেখি, তা আমাদের মোটেই খুশি করে না। পিউ রিসার্চ সেন্টারের করা একটা সমীক্ষার মতে, ৪৪ শতাংশ আমেরিকানরা আগত সময়ের ব্যাপারে নৈরাশ্যজনক ধারণা রাখেন।

ভবিষ্যতের ব্যাপারে নিরাশা শুধু আমেরিকানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ২৬টি দেশের ৪ লাখের ওপর মানুষের একটি ইন্টারন্যাশানাল সমীক্ষা জানাচ্ছে, উন্নত দেশের মানুষেরা মনে করেন, তাঁদের সন্তানদের জন্য তাঁদের চেয়েও খারাপ জীবন অপেক্ষা করে আছে। ২০১৫ সালের আর একটি সমীক্ষা বলছে, উন্নত দেশের মানুষেরা ভবিষ্যত সম্পর্কে বিশেষভাবে নৈরাশ্যজনক ধারণা রাখেন। যেমন— মাত্র ৪ শতাংশ ব্রিটিশ মনে করেন জীবনযাত্রার মান ভালোর দিকে এগোচ্ছে। তুলনায় ৪১ শতাংশ চিনের মানুষ ভবিষ্যত সম্পর্কে আশাবাদী।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, অদূরবর্তী ভবিষ্যত একদিকে যেমন অনেক বেশি পুঙ্খানুপুঙ্খ ও জমাটবাঁধা, অন্যদিকে দূরবর্তী ভবিষ্যতের ধারণা তেমনই অনেক বেশি অ্যাবস্ট্রাক্ট, কল্পনার রঙিন মোড়কে সাজানো। অদূরবর্তী ভবিষ্যতের ভিত্তি যেখানে অনেকটাই বাস্তব অভিজ্ঞতা, আর সেখানে দূরবর্তী ভবিষ্যত গড়ে ওঠে বিভিন্ন মতবাদ ও চিন্তাধারার দ্বারা। হয়তো জনবিস্ফোরণ, গ্লোবাল ওয়ারমিং, অতিমারীর প্রকোপ ইত্যাদি মানুষকে আরও বেশি করে ভবিষ্যত সম্পর্কে নিরাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

তবুও গিবসন মনে করেন ভবিষ্যত নিয়ে সামান্য হলেও আশাবাদী হওয়ার প্রয়োজন আছে, “কারণ প্রতিটি ভবিষ্যত অন্য কারো অতীত, প্রতিটি বর্তমান অন্য কারো ভবিষ্যত।” সে কারণেই এই সংখ্যার অবতারণা। বলাই বাহুল্য, যে পরিকল্পনা নিয়ে সংখ্যাটি শুরু করেছিলাম, বিগত পাঁচ মাসে সেই বিষয়ভাবনা বেশ খানিকটা বদলে গিয়েছে। অনেক লেখাতেই প্রভাব পড়েছে বর্তমান পরিস্থিতির। এছাড়াও লেখায় এসেছে পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্সো, ডিস্টোপিয়া কিংবা ইউটোপিয়ার মতো বিষয়। থাকছে ওপার বাংলার লেখক মোহাম্মদ সাইফূল ইসলামের হার্ড সাইফি উপন্যাস, আর এপার বাংলার লেখিকা সায়ন্তনী পলমল ঘোষের ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস। এছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু মৌলিক কল্পবিজ্ঞান গল্প অন্য সব সংখ্যার মতোই। পাঠকদের মতামত এক্ষেত্রে যে খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটা বলাই বাহুল্য। কাজেই ভালো লেগেছে, খারাপ লেগেছে বা মনে দাগ কাটেনি, যে কোনো ধরণের মতামত আমাদের জানাতে ভুলবেন না। আসুন তবে, ডুব দেওয়া যাক ভবিষ্যতের অনন্ত সাগরে। আপনার যাত্রা শুভ হোক। অলমিতি।

ধন্যবাদান্তে,