চড়াই পাখি, ফিরে এসো - রনিন

গল্প

বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারপাশে গজিয়ে ওঠা পিঁপড়ের ঢিবিটাকে দেখছিলো ‘কিরা’। ওটা আসলে শহর। সন্ধ্যা নেমে আসার আগে যতক্ষণ রাস্তার উজ্জ্বল আলোগুলো চোখ বুজে থাকে, ওই চেনা জনপদটাকেই যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য কেমন অন্ধকার আর নোংরা বলে মনে হয়। আলো জ্বললেই সব মালিন্য উধাও ভোজবাজির মত। রাস্তাগুলোতে কমলা আলোর সাজ, দূরের ব্রিজটাতে লাল নীল আলোর মালা, কাছে-দূরের সব হাই-রাইজ এপার্টমেন্টগুলোর গায়ে নিয়ন আলোর রোশনাই ঝকমক করে ওঠে, সন্ধ্যা নামলেই। যেন দীন দুঃখিনী মেয়েটা বিকেল শেষে রাতপরী হয়ে ওঠে এক লহমায়। কিরা এই রূপান্তর চোখ ভরে উপভোগ করে প্রতিদিন। অবশ্য শুধু কল্লোলিনী তিলোত্তমার সাজ নয়, কিরা উপভোগ করে ঠিক এই সময়ের ঠান্ডা হাওয়াটাও। যে ভিজে ভিজে হাওয়া গঙ্গার বুক থেকে ভেসে আসে প্রতিদিন রাত নামার আগে। গালে আদুরে ঠান্ডা ছোঁয়া অনুভব করে কিরা, গঙ্গার ভালোবাসা চামড়ায় মেখে নিতে চায়। সে চোখ বন্ধ করে। ওই আর্দ্র কবোষ্ণ বাতাসটুকুই এ শহরে প্রকৃতির সঙ্গে তার একমাত্র যোগসূত্র।

‘চিকেন রোল গরম হবে তিন মিনিটে, সস দেব?’ ভদ্রতায় মোড়া কৃত্রিম শব্দে চোখ খুললো চোদ্দ বছরের কিশোর। খিদে পাচ্ছে, হাতের কব্জি থেকে ঝোলা প্লাস্টিক ব্যান্ড থেকে ভেসে আসা ‘আইকন’-এর গলা না শুনলে বোধহয় সেটা অনুভব করতে পারতো না সে। ‘আসছি, আমি আবার কবে থেকে রোলে সস পছন্দ করলাম!’ আইকনকে ধমক দিয়ে কলকাতার দিকে চোখ মেলে তাকায় ছেলেটা। হ্যাঁ, সাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। মেট্রোপলিস ঝিমিয়ে পড়া ধূসর খোলস ছেড়ে সেজে উঠেছে প্রতিদিনের মত। ১৪২ তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিরা মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে চারধার। কাচের দরজাটা টেনে বন্ধ করে বসার ঘরের দিকে পা বাড়াবার আগে প্রিয় নারীকে উদ্দেশ্য করে সে হাত নাড়ল, ‘বিদায়, সুন্দরী...’

আটটা বাজে। গাড়ির স্বচ্ছ ফাইবারের জানলায় চোখ রেখে কিরা বাইরের অপসৃয়মান দৃশ্যমালা গিলছিল। নতুন গাড়ি, ড্রাইভারের সিট ফাঁকা। নব্যেন্দু, কিরার বাবা, বেশ কিছু টাকা খরচ করে গাড়িতে ‘আইকন’ ইনস্টল করেছেন কয়েকদিন হলো। দিনরাত তাঁকে ফোন আর ল্যাপটপ নিয়ে কাটাতে হয়, সুতরাং বাড়ির কাউকে কোথাও ড্রাইভ করে নিয়ে যাওয়ার হ্যাপা সামলানো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। আইকন আসায় সে ঝামেলা থেকে মুক্তি। স্ক্রিনে শহরের ম্যাপ দেখে গন্তব্যে আঙুলের চাপ দিলেই গাড়ি হিসেবে কষে সব থেকে কম সময়ে এবং কম দূরত্ব পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। মুশকিল আসান।

কমলা রঙের এল.ই. ডি আলোগুলো একসঙ্গে জ্বলছে নিভছে, সেই বিচ্ছিন্ন কিন্তু সরলরৈখিক আলোকনির্দেশ ধরে গাড়ি ছুটছে প্রায় নিঃশব্দে। কিরা নৈবর্ক্তিক চোখে সামনের স্ক্রিনে চোখ রাখল, তার পছন্দের রেস্তোরাঁগুলোর হদিশ ফুটে উঠছে সেখানে। মাল্টিপ্লেক্স কিংবা গেম পাবগুলোও আছে পর্দার ওপরে। কোথায় যাবে সে? মৌচাকে আজ বসবে ক্রিকেটের আসর, খেলাঘরে আজ হচ্ছে ভার্চুয়াল রেস আর বোয়েতাং সাজবে আজ দাবার ছক নিয়ে। আইকন সেকথাই জানাচ্ছে বটে। কোনটা কিরাকে টানছে আজ? কিরা জানে আইকন ইতিমধ্যেই তার অভ্যাসগুলোকে সাজিয়ে একটা প্যাটার্ন খুঁজে নিয়েছে, সে যখন মনে মনে নিজের পছন্দগুলো হাতড়াচ্ছে আইকন ততক্ষণে জটিল হিসেবে নিকেশ করে তার সম্ভাব্য পছন্দের তালিকা তৈরী করে ফেলেছে। কিরা স্ক্রিনে আঙ্গুল ছোঁয়ায়, খেলাঘর নামটার ওপর চাপ দেয় আলতো করে। আইকনের বেতারকণ্ঠ বেজে ওঠে, ‘সাত মিনিট পঁয়ত্রিশ সেকেন্ডে...’

কিরা একটু বিরক্ত হয়ে স্ক্রিনের দিকে ভেঙচে ওঠে, ‘আট মিনিট লাগলেও আমার কিচ্ছু এসে যায় না।’ তারপর আবার জানালার দিকে দৃষ্টি ফেরাল সে। ‘দুঃখিত।’ আইকনের মোলায়েম গলা বলে ওঠে। কিরা বিরক্ত হয়। চেনা ছকগুলো আরও বেশি করে চেনা হয়ে যাচ্ছে। গতানুগতিক। আর সেই অতিপরিচিত ছকগুলো তাকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরছে এবার। এর থেকে কি মুক্তি নেই?

নব্যেন্দু আড়চোখে ছেলের দিকে তাকালেন, আজ কিরার মুখে কথার ফুলঝুরি ছুটছে সেটা বিশ্বাস করতে খানিক কষ্টই হচ্ছে তাঁর। খাবার টেবিলে নব্যেন্দু এবং নীলিমা নিঃশব্দে রাতের খাবার খেতে খেতে ছেলের মুখের দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

“দুটো গাড়ির মধ্যে দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেলাম, বুঝলে?... প্রথম থেকেই স্লগ করছিলাম, দেখছিলাম ওদের দৌড় কতদূর অব্দি...ওর্তেগাকে দেখলাম সব থেকে বেশি লিড নিয়েছে... হিসেবে করে দেখলাম আমি যদি এক্ষুনি পিক আপ নিতে পারি তাহলে ওর্তেগাকে সহজেই পেরোতে পারবো... সেই যে পিক আপ নিলাম আর থামলাম না... লাস্ট ল্যাপের একটু আগেই প্রায় ধরে ফেলেছিলাম ওর্তেগাকে কিন্তু হঠাৎ... ‘ জলের গ্লাসে দ্রুত চুমুক দিয়ে খাবারের দলাটাকে গলা দিয়ে এক ধাক্কায় নামিয়ে কিরা আবার নিজের বিজয়গাথা সব্বাইকে শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল,’কারেন বলে একটা মেয়ে দেখলাম আমাকে সাইডে চাপতে শুরু করলো... মাথা গরম না করে আমি শুধু ওর্তেগাকে ফলো করতে থাকলাম... এদিকে ফিনিশিং লাইন এগিয়ে আসছে... আমি নিজেকে বললাম, ‘ফার্স্ট পজিশন আর তা না হলে কিছুই নয়’... তারপর একটা আলতো ব্রেক চাপতেই কারেন ছিটকে গেলো... তারপর শুধু পিক আপ... আর পিক আপ... কখন যে ওর্তেগার লাল গাড়িটাকে পেরিয়ে গেছি খেয়াল করিনি... চারদিকে দর্শকদের গর্জন শুনেই টের পেলাম আমি জিতে গেছি...”

“ভাগ্যিস খেলাটা ভার্চুয়াল,” নীলিমা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন, যদিও মুখে চাপা গর্বের হাসিটা লুকোতে পারেন না।

“কিরা ইজ এ স্পেশাল কিড-” নব্যেন্দু এটুকু বলেই থামলে ভালো করতেন, কিন্তু পরের কথাটা জিভ গলে ঠিক বেরিয়ে গেলো, “দেখতে হবে তো ও কার ছেলে!”

“কলকাতার ফাঁকা রাস্তায় যে ষাটের ওপর গাড়ি চালাতে পারে না সেই নব্যেন্দু রাহার ছেলে!” নীলিমা স্বামীকে চিমটি কাটার সুযোগ ছাড়েন না। কিরা হাসতে গিয়ে বিষম খেল।

অপমানের বদলে হাসি ফেরালেন নব্যেন্দু। তিনি ঠিক যেমনটি ভেবেছিলেন বার্তালাপ ঠিক সেই দিকেই ছুটছে। গৃহিণীও একদম তালে তাল মিলিয়ে ধরতাই দিয়ে যাচ্ছেন। এবার অবশ্য একটু গম্ভীর হবার পালা।

“ডেজার্ট?” আইকনের প্রশ্ন শুনে নীলিমা মাথা নাড়লেন।

“এইবার লেখাপড়ার কথায় আসা যাক একটু?” নব্যেন্দু ছেলের দিকে তাকাতে তাকাতে মাংসের হাড়টাকে শেষবারের মত চুষে নিলেন। নীলিমা সবাইকে ব্যানানা আইসক্রিম ভর্তি কাঁচের বাটি এগিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নিঃশব্দে। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগে যেন পরিবেশটাকে একটু বেশি মাত্রায় ঠান্ডা করার চেষ্টা করেন ভদ্রমহিলা।

‘বলো, শুনছি।’

কোনটা বেশি ঠান্ডা? কিরার গলা না আইসক্রিমের গ্লাস?

বাপের চোখদুটো গিন্নির দিকে একবার অনিশ্চিতভাবে ঘুরে গেল। নীলিমা যদিও আইসক্রিমে ডুবে।

“আইকন তোমার ‘এভালুয়েশন চার্ট’ তৈরী করে দিয়েছে। নিঁখুত পর্যবেক্ষণ, দারুণ বিশ্লেষণ। আমি অন্তত ওর মত খারিজ করতে পারছি না।” নব্যেন্দু অনেক চেষ্টাতেও গলার ব্যগ্রতা লুকোতে পারলেন না। কিরা চোখ তুললো না। শুধু মাথা নেড়ে বললো, “তা কি বলছে আইকন আমার ব্যাপারে?”

“তোমার সমস্ত পরীক্ষার ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে ও নিদান দিয়েছে যে তোমার বিশ্লেষণী ক্ষমতা বেশ ভালো। আর সেটা যদি সংখ্যাভিত্তিক হয় তাহলে তুমি সমবয়সের ছেলেমেয়েদের চাইতে অনেক এগিয়ে। ইউ বিলং ইন দ্য টপ ফিফটিন পার্সেন্ট! শুধু পাটিগণিতের দক্ষতা ধরলেই তোমার জায়গা সেরা দশ পার্সেন্টে! ভাবা যায়!” নব্যেন্দু টেবিলে চাপড় মারলেন। নীলিমা সস্তা সিনেমার এক্সট্রার মত হেসে উঠলেন। স্বামীর খোঁচা মারা দৃষ্টিতে বুঝলেন তাঁর অতিনাটকীয় অভিনয়ে তাল কাটার সমূহ সম্ভাবনা। তিনি চুপ করলেন।

“ক্যারি অন।”

“তিরিশখানা চার্ট বানিয়ে দিয়েছে আইকন। সব তোমার সম্ভাব্য জীবিকাকে কেন্দ্র করে।”

“উহ, একটু সহজে বল না কেন? হি মিনস, ইট প্রিপেয়ার্ড এ প্রবাবল কেরিয়ার চার্ট ফর ইউ!” নীলিমা কাঁধ ঝাঁকালেন। নব্যেন্দু চোখ নাচিয়ে প্রশংসা করলেন। কিরার ভ্রূ কুঁচকে গেল।

“আমার ভবিষ্যৎ তাহলে ওই যন্ত্রটাই ঠিক করে দেবে?”

বিপদ। মস্তিষ্কে ঘণ্টা বাজলো বোধহয়। নব্যেন্দু গলা খাঁকারি দিলেন। নীলিমা আইসক্রিম গিলে নিয়েছিলেন খানিকটা। এখন কাশতে শুরু করলেন।

“শোন, আইকনের ভবিষ্যদ্বাণী হল, তুই অর্থনীতি নিয়ে পড়বি। সরকারি মন্ত্রণালয়ে উঁচু পদ পাবার চান্স সেখানে ষাট শতাংশ। ফাইন্যান্স নিয়ে যদি পড়িস তাহলে আমার মত বা আমার চাইতে ভালো এডভাইজর হবার চান্স কুড়ি শতাংশ।” নব্যেন্দু বেশ রসিয়ে রসিয়ে বললেন। নীলিমা ধৈর্যচ্যূত হলেন। এইটুকু একটা ছেলেকে বোঝাতে নব্যেন্দুর এত সময় লাগছে কেন?

“এক সপ্তাহের ছুটি শেষ হলেই তোমার ‘আইরিড’ সিস্টেমে অর্থনীতির কোর্সগুলো আনলক করে দেওয়া হবে। তারপর তুমি যেমন ফল করবে তেমনি অটো আপডেট হবে বাকি কোর্সগুলো। অবশ্য তার জন্য তোমার ‘অনুমতি’ চাই। আর সেটা তোমায় করতে হবে একখানা সিগনেচার করে।” নীলিমা নাটকের যবনিকা টানতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

কিরার আইসক্রিম গলে যাচ্ছে। তার চোখ আটকে আছে কাচের গ্লাসের তরল শরীরে। পলক পড়ছে না একটাও।

“বাবা, আমি পিয়ানো শিখতে চাই।” কিরা বললো।

“ভালো, শেখো না! কে বারণ করছে! ওর কোর্সগুলোও পরে ডাউনলোড করে নেওয়া যাবে। তবে ওটা তোমার সেকেন্ডারি প্রায়োরিটি।” নব্যেন্দু বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রুখে দাঁড়ালেন। এই সময়টার জন্যই তিনি এতক্ষণ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

“কিন্তু মনে রেখ, ওতে তোমার কোনও ভবিষ্যৎ নেই!” নীলিমা কাঁধ ঝাঁকালেন। পরমুহূর্তেই বুঝলেন কাজটা ভালো করেননি। কিন্তু নব্যেন্দু ছাড়বেন না। সুতোর শেষ প্রান্ত তার হাতের মুঠোয় এসে গেছে।

“আইকন বলেছে তুমি পুরোনো সুর যদিও বা তুলতে পারো ভালো, নতুন সুর করার বোধটাই তোমার নেই। এর আগেও তুমি অনেক গুলো ইনস্ট্রুমেন্ট ঘেঁটে দেখেছ, একটাতেও তেমন...”

“আমি ওতেই খুশি।” কিরার গলাটা কি দৃঢ় শোনালো? নব্যেন্দু এবার আক্রমণাত্মক হলেন।

“উঁহু, ওতে তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”

“দুঃখিত বাবা, আমি ইকোনোমিক্স পড়ব না। মিউজিক শিখবো।” কিরার গলাটা আরও পরিষ্কার এবারে। নীলিমা অসহায়ভাবে স্বামীর দিকে চাইলেন। আসলে ওটা নীরব তিরস্কার, “ছেলেটাকে সামলাতে পারছো না?” ভাবখানা এমনই।

“ড্যাম ইট কিরা! একজন সফল মিউজিসিয়ান হবার চান্স তোমার ক্ষেত্রে মাত্র দেড় শতাংশ!” নব্যেন্দু মাত্রা ছাড়ালেন।

“তবুও ওটাই আমার ইচ্ছে, বাবা।”

“তুমি কেন বুঝছো না? মিউজিক এখন শুধু হাসপাতালে চলে অথবা ওয়েটিং রুমগুলোতে আর তা না হলে লিফটে? কজন এখন ছবি আঁকে বল দেখি? দেওয়ালে ফুল লতাপাতা কিংবা রাস্তাঘাটের ভাঙাচোরা দেওয়াল গুলোকে ঢাকতেই তো ওগুলোর ব্যবহার। সেটাও তো সরকারি যন্ত্রগুলো করে ফেলে ফটাফট।”

“সে হোক, আমি নিজের পথ নিজেই বাছতে চাই।” কিরা গ্লাস ছেড়ে বাবার চোখে চোখ রাখলো। গলার স্বর এবার একটু কঠিন।

“আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু ওই বিদ্যেতে তোর পেট চলবে তো?” নব্যেন্দু দিশেহারা। হাতে ধরা সুতোর প্রান্ত তিনি আপ্রাণ খুঁজেও অনুভব করতে পারছেন না। অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে।

“আইকনরা আসার আগে যেভাবে আমাদের পূর্বপুরুষরা নিজেদের পেট চালাতো ঠিক তেমনি করে নিজের পেট চালাবো, বাবা। বেসমেন্টে থাকবো। প্র্যাক্টিস করবো। বারে রেস্তোরাঁয় বাজাবো। তারপর সুযোগ পেলেই...”

“আর যদি না পাস?”

“তাহলে বিয়ের অনুষ্ঠানে ভাড়া খাটবো। জন্মদিনে গেস্টদের এন্টারটেইন করবো।” কিরার মুখ উজ্জ্বল হল। নীলিমা লজ্জায় মুখ লাল করে ঠকাস করে কাঁচের গ্লাস টেবিলে রাখলেন। নব্যেন্দুর উপর তার সমস্ত আশা ভরসা লোপ পেয়েছে। লোকটা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কমাতে পারে খালি, কিন্তু একটুও ব্যক্তিত্ব নেই--- নব্যেন্দুকে ঘুমের আগে এমনটাই বলবেন তিনি। সেই আক্রমণটাকেই শান দিচ্ছিলেন তখন।

“আবেগ! বিপ্লব! উচ্চিংড়েবাজি! এসবে আমার ঘোর আল্যার্জি! আমাদের সমাজেরও। সেই জন্যই আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের সব ভুল কাটিয়ে উঠতে চাইছি। কার হাতে এত সময় আছে, জীবনভর স্ট্রাগল করার? একটা নিশ্চিত পথ শিশু কিশোরদের হাতে তুলে দেবে বলেই তো আইকনের জন্ম! আজ তাই দারিদ্র্য নেই, রোগ নেই, অপরাধ নেই! তুই চাস না এরকম একটা ‘সুষ্ঠ’ সমাজের অংশীদার হতে? বল চাস কিনা?” নব্যেন্দু এতগুলো কথা বলে হাঁফাচ্ছেন। কয়েক ঢোক জল গিলে নিজেকে শান্ত করলেন।

“রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন।” আইকনের গলা। নব্যেন্দু মুখ বেঁকালেন। সবকিছুতেই যন্ত্রটা ওস্তাদি করে। অবশ্য লোকে ওটাকে ‘অভিভাবকত্ব’ বলে। বিরক্তি চেপে রেখে নব্যেন্দু আবার ছেলের দিকে ফিরলেন।

“আইকন ছাড়াও আমরা ‘মানুষ’, তাই না?” কিরা জানতে চাইল।

“ইয়েস, অফ কোর্স! তবে ‘ইন্টেলিজেন্ট’ নিশ্চয়।” আবার টেবিল চাপড়ালেন নব্যেন্দু।

“ওই ইন্টেলিজেন্সের অনেকটাই আর্টিফিসিয়াল, ঠিক বললাম?”

“কিন্তু সেটা আমাদের ভালোর জন্যই! আজ মানুষের আয়ু বাড়ছে, খুন খারাবি নেই, আত্মহত্যা নেই, মহামারী নেই। সবই তো আইকনের কল্যাণে। আমাদের সম্মিলিত বোধবুদ্ধি ঠিক করে দিচ্ছে সমাজে কে বাঁচবে, মরলে কতদিনে মরবে। কার জীবিকা কী হবে। কেমন হবে আমাদের খাদ্যাভ্যাস এমনকী নেশাগুলোও আইকন নিজে হাতে ঠিক করে দিচ্ছে। কী অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ, ভাবা যায়?” নব্যেন্দু এবার স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন ছেলের দিকে। নীলিমাও। স্বামী যুক্তির জালে সন্তানকে মাত দিয়েছেন। কটূক্তিগুলো আবার মনের দেরাজে ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখলেন।

“নিয়ন্ত্রণ কথাটায় আমার আবার ঘোর আল্যার্জি, বাবা।”

“কিরা...” নব্যেন্দু নিয়ন্ত্রণ হারালেন। তাঁর চোখ লাল।

“যারা আইকনের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়নি, তারা কিন্তু বাতিলের খাতায় চলে গেছে আজ।” নীলিমা মৃদু গলায় জানালেন।

“বাতিল হয়নি। আইকন তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে।”

“দেখ, আইকন আমাদের তো শুধু ভালোটাই দেখেছে না, ও আমাদের জেনেটিক কারেকশনও করছে তো! আর এত কিছুর জন্য প্রয়োজন একটা সুষ্ঠ দায়বদ্ধ সমাজ। যেখানে মানুষ ওর দেখানো পথে চলবে। তবেই না আমরা এগোবো! কিন্তু ওই বদমেজাজি প্রতিবাদীর দল তো সবকিছুতেই বেঁকে বসছিল, তাই না? রোজ রোজ মিছিল, পদযাত্রা, আইন অমান্য! জঘন্য! আর ওদের জন্যই তো আমাদের ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া! তাই সরকার থেকে ওদের দায়িত্ব নিয়ে দেশ থেকে বার করে দিতে হল। ভালো হয়েছে! আপদ গেছে, যত্তসব!”

“প্রাইমারিতে শিখেছি ওঁরা আছেন এখনও।” কিরা মাথা গোঁজ করে আছে।

“নিশ্চয় আছে ওঁরা! কিন্তু ওই গল্পের বইয়েই। শহরের বাইরে যে মরুভূমির আস্তাকুঁড় আছে তাতে কোনও মানুষ বাঁচতে পারে না। দুশো বছর ধরে ওঁরা শুধু ক্ষয় হয়েছে। এটুকু আমার বিশ্বাস।”

“বিশ্বাস করতে পারছি না।”

“তোমার ইচ্ছে।”

“আহ, নব্যেন্দু, আমরা কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম? কথা হচ্ছিল ছেলেটার ভবিষ্যৎ নিয়ে।” নীলিমা আবার হাই তুলতে গিয়েও জিয়াকে চাপা দেবার চেষ্টা করলেন। রাত বাড়ছে।

“প্রয়োজন আছে নীলিমা, তোমার ছেলে ভাবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানুষের মন থেকে শিল্পবোধকে মুছে দিচ্ছে। নতুন সমাজ ব্যবস্থা মানুষকে সৃজনশীলতা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। তাই না কিরা?” নব্যেন্দুর চোয়াল দৃঢ় হয়, কিরার বিস্ফারিত চাহনি বাপের চোখের দিকে ন্যস্ত।

নীলিমা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইলেন যুযুধান দুই পক্ষের দিকে।

“ও ভাবে, আদি মানুষদের বংশধর হবার সুবাদে তাদের সূক্ষ্ম মনন আর তাদের শিল্পবোধ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার অধিকার আছে ওর। কিরা তাদের খুঁজতে চায়, তাদের সঙ্গে মিশতে চায়, তাদের মত হতে চায়। ওই বিদ্রোহীদের কাছ থেকে শিখতে চায় ‘মানুষ’ হবার শিক্ষা! কী ঠিক বলছি তো?” ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কড়া সুরে জানতে চান নব্যেন্দু।

“তুমি এসব কী করে জানলে?” নীলিমা আঁতকে উঠে স্বামীকে প্রশ্ন করলেন।

“বাবা, তুমি...আমার ট্যাব...” কিরা যেন বাপের কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারেনি এখনও।

“হ্যাঁ, পড়েছি। তোর ট্যাবে লেখা আছে এসব কিছু, লেখা আছে আরও অনেক কিছু। পড়তে হয়েছে শুধু তোকে বুঝতে, তোকে বাঁচাতে।” নব্যেন্দুর গলায় মরিয়া স্বীকারোক্তি, “ভুল কিছু করিনি, ডিজিট্যাল প্রিভি এক্ট অনুসারে নাবালক সন্তানের যন্ত্রপাতি ঘাঁটার পূর্ণ অধিকার আছে আমার।”

কিরা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘরের দিকে পা বাড়াল নিঃশব্দে।

“ঘুমোতে যাওয়ার আগে একবার আইকনকে দিয়ে ভাইটালসগুলো চেক করে নিতে ভুলো না কিরা।’ নীলিমা ছেলেকে মনে করিয়ে দিলেন।

‘সিস্টেম চেক-আপ।’ শরীরের মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজনা যে শরীরের পক্ষে ভালো নয় সেটাই জানিয়ে দিল আইকনের যান্ত্রিক গলাটা।

নব্যেন্দু ও নীলিমা শূন্য চোখে তাকালেন দেওয়ালে লাগানো আইকন নামাঙ্কিত ক্যামেরার দিকে।

“কোথায় যাচ্ছিস রে?” বান্ধবীকে হোল্ডে রেখে নীলিমা জানতে চাইলেন ছেলের কাছে। ছেলে প্রিয় স্পোর্টস শ্যু পায়ে গলিয়ে নিল, পায়ের উষ্ণতা বুঝে নিয়ে বুদ্ধিমান জুতো নিজে থেকেই গোড়ালি চেপে ধরলো।

“গেম পাবে-” কিরা মৃদু স্বরে উত্তর দিল। ছেলের মুখটা দেখে মায়ের মুখ ফ্যাঁকাসে হল। ছেলেটার এ কী চেহারা হয়েছে? “এত্ত সকালে?” নীলিমা নাছোড়বান্দা। “পাব সারা রাত্তির খোলা থাকে,” কিরা মুখ না তুলেই উত্তর দিল, “এখনও এক মাসের ছুটি আছে তো?”

নীলিমা ছেলের বেয়াড়া প্রশ্নটা কোনোরকমে গিলে নিয়ে পরবর্তী নির্দেশ জারি করলেন, “তোর বাবার ক্লায়েন্ট কল শেষ হলেই কিন্তু তোর ফর্ম নিয়ে বসবো আমরা। তাড়াতাড়ি আসিস।”

“চাবি?” কিরা মায়ের সামনে হাত পাতল। হাতের তালু দিয়ে নির্দেশ দিতেই আইকনের ইশারায় টেবিলের ড্রয়ার খুলে গেল, গাড়ির চাবি হাতে ঝুলিয়ে কিরা দরজার সামনে দাঁড়ায়। স্লাইডিং দরজা খুলে যায়। ঘর ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকায় কিরা।

“আসছি।” ছোট্ট শব্দটা শেষ হতেই তার শরীরটা মিলিয়ে গেল দরজার ওধারে।

“কী রে, কী হলো? কোনো শব্দ নেই কেন?” ফোনের ওপাশ থেকে বান্ধবীর গলা শোনা গেলেও নীলিমা প্রশ্নের উত্তর দিতে ভুলে গেলেন।

“আসছি” কথাটা এমন ভাবে বললো কেন ছেলেটা? কেমন যেন মন খারাপের আলগা ছোঁয়া ছিল কিরার গলায়। কিন্তু কেন?

রুপোলি তিনকোনা গাড়িটা নিঃশব্দে ছুটছে ফ্লাইওভার ধরে। একটা ক্রসিংয়ে এসে গাড়ির গতি কমে গেল, অটোমেটিক সেন্সর সিস্টেম চারদিকের পরিস্থিতি বুঝে রাস্তার ধারে গাড়িটাকে থামিয়ে দিল। দরজা খুলল। কিরা গাড়ি থেকে নেমে ছুট লাগায় ‘ক্যাশবক্স’ লেখা ছোট্ট চারকুঠুরিটার দিকে। জন্মের সময় সন্তানের প্রতিপালনের জন্য বাপ-মাকে টাকা জমা দিতে হয় সরকারের কাছে, সেই একাউন্ট থেকে কার্ডের মাধ্যমে টাকা তুলতে পারে তাদের সন্তান। কিরা নিজের কার্ড ব্যবহার করে টাকা তুলে নেয় নিজের পকেটে, স্ক্রিনে দেখায় বাকি টাকার সংখ্যাটা। দশমিকের আগে এবং পরে শুধুই শূন্য সেখানে। টেলার মেশিন যান্ত্রিক গলায় জানতে চাইছে কিরার কাছে, তার ট্রাঞ্জাকশন শেষ কিনা। কিন্তু উত্তর দেবার কেউ নেই চারপাশে, কারণ সে ততক্ষণে গাড়িতে চেপে বেরিয়ে পড়েছে তার পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

“এরপর?” আইকন জানতে চাইছে।

একটা খাবারের দোকানের নাম লিখে দেয় কিরা স্ক্রিনে। গাড়ি সেদিকেই ছুট লাগায়।

খাবারের দাম চুকিয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে ছেলেটা মাথায় হাত দিয়ে ভাবে কিছুক্ষণ। এবার কোথায় যাবে সে?

“সাউদার্ন মেট্রোপলিসের ফ্লাই ওভারটা মারাত্মক নীলিমা, ওখানে গত এক সপ্তায় দুটো দুর্ঘটনা হয়েছে।”--- নব্যেন্দুর কথাটা মনে পড়ে গেল কিরার।

“বাবা, ম্যাগনেটিক ফিল্ডে একটা গ্লিচ দেখা দিয়েছে। হলদে নিয়নের সাইনবোর্ডের ঠিক কাছটাতে গেলেই যদি নিউট্রালে থাকো তাহলে গাড়ি হঠাৎ করে শূন্য ছেড়ে মাটির দিকে ঝাঁপাচ্ছে। অবশ্যই ওটাকে ঠিক করার জন্য চেষ্টা চলছে, তবে এত ব্যস্ত রাস্তা বলে কিছুটা সময় লাগার কথা।” কিরা বাপকে আশ্বস্ত করেছিল। ওয়েবম্যাগে খবরটা বেরিয়েছিল ঘটা করে। “ঐটুকু গ্লিচের সুযোগ নিয়ে যদি সত্যিই কেউ আত্মঘাতী হতে চায় তাহলে তাকে পাকা ড্রাইভার হতে হবে বস!”- এইভাবেই প্রতিবেদন শেষ করেছিলেন সংবাদিক।

টিনটিনের বাড়ি যাবার ওইটাই একমাত্র পথ। অন্য আরেকটা ঘুরপথে আছে যদিও, সেটাতে গেলে সময় লাগবে ঠিক তিনগুণ। কিরার মুখে হাসি ফুটলো।

‘টিনটিনের বাড়ি।’ কিরা জোর গলায় ঘোষণা করতে স্ক্রিনে বাড়ির ঠিকানাটা লেখা হয়ে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। গাড়ি ছুটতে থাকে সাউদার্ন মেট্রোপলিস ধরার জন্য।

কিরা নিজের সিটে উঠে বসে উত্তেজিত হয়ে।

প্রতিটা মুহূর্ত দামি এই সময়, প্রতিটা পদক্ষেপ নিক্তিতে মেপে ফেলতে হবে। ছেলেটা টি-শার্টের হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছল, যদিও শীততাপ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে গাড়ির মধ্যে।

“আইকন, বাম দিকে চার ফুট।” ছেলেটা গাড়িতে লাগানো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আপ্লিকেশনকে নির্দেশ দিল। “নিউট্রাল”--- এর পরের নির্দেশ। হলদে সাইনবোর্ডটা দেখা যাচ্ছে। “বিপজ্জনক!” আইকন আতঁকে উঠলো। “ম্যান্যুয়াল ওভাররাইড।” কিরার জবরদস্তি। মাটিতে গোত্তা খাওয়ার শব্দ। আর তখনই পরবর্তী নির্দেশ, “দরজা খোল।”

আবার নিষেধ, আবার নিষেধকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো। খোলা দরজা দিয়ে বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় কিরার নির্দেশ, “থামবে না।”

“ধড়াম!” গাড়িটা আছড়ে পড়েছে কংক্রিটের দেওয়ালে। সামনের দিকটা চুরে দুমড়ে গেছে তিনকোনা দামি গাড়িটার, ভিতর থেকে ধূসর কালো ধোঁয়া আর আগুনের ফুলকি ছিটকে পড়ছে বাইরে। “ম্যালফাঙ্কশন...” আইকন কথাটা বারবার বলে চলেছে, তবে প্রতিবার তার গলার জোর কমে আসছে।

কিরা রাস্তায় ঝাঁপ মেরেই বুঝলো তার শরীর মাটি ছুঁলেই হবে তীব্র অভিঘাত। হলও তাই। ঝাঁকুনি খেয়ে বেশ কয়েক ফুট রাস্তায় ঘষ্টানি খেয়ে তার শরীর যখন থামলো তখন তার স্থির শরীরকে কাটিয়ে ছুটে গেছে আরও অনেক গাড়ি। দুহাত দিয়ে মাথা ঢেকে আঘাত কমাতে চেষ্টা করেছিল ছেলেটা। স্থির হয়ে অপেক্ষা করছিল নিজেকে সামলাতে।

এবার চোখ তুলে তাকালো কিরা। সামনে পিছনে অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তাদের যাত্রীরা রাস্তায় নেমে বিস্ফারিত চোখে দেখেছে তাকেই। তাদের হাঁ-মুখের সামনে দুপায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো কিরা, এখনো ব্যাগখানা বুকের সঙ্গে জাপ্টে রেখেছে সে। সেটাকে পিঠে চাপিয়ে সে একবার অবাক মুখগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে।

এরপর সে ছুটতে শুরু করল। মানুষ আর গাড়ির ভিড় কাটিয়ে, ফ্লাইওভারের ঢালু বেয়ে, তার দৌড় জারি রইল।

রোমাঞ্চে পা দুটো কাঁপছে এখনো, রক্তচাপ উর্দ্ধগামী। অনেকদিন পর আবার নিজেকে জীবন্ত মনে হল তার।

সে থামতে ভুলে গেল।

বিকেলের আলো মরে আসছে, সন্ধ্যা নামছে তিলোত্তমাকে ঘিরে।

ফুটপাথে বসে আছে কিরা, একটা রংচটা দেয়ালে হেলান দিয়ে। গায়ে চোটের চিহ্ন, ঠোঁটের কোণে রক্তের শুকনো দাগ। জামাকাপড় ছিন্ন ভিন্ন। হাঁটুর কাছে জিনস ছিঁড়ে ঝুলে পড়েছে। চুলে লেগে আছে ধুলো আর বালি।

ব্যাগ থেকে একটা স্যান্ডউইচ বার করে নিস্পৃহভাবে চিবোচ্ছিল সে। চোখের এককোণে জলের শুকনো দাগ। বাপ-মায়ের সাজানো ঘর ছাড়ার বারো ঘন্টার মধ্যে সে বুঝে গেছে তার প্রিয় শহরকে দূর থেকে যতটা সুন্দরী মনে হোক না কেন, কাছ থেকে দেখলে অনেক জটিল কুটিল জরাগ্রস্ত রেখার আঁকিবুকি দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমে পুলিশের তাড়া, তারপর শহর জুড়ে সিকিউরিটি অ্যালার্ম। সেই রহস্যটাই সমাধানের চেষ্টা করছিল কিরা। ভাঙা গাড়ির মধ্যেই তো সে ফেলে এসেছিল হাতে ঝোলানো প্লাস্টিকের ‘জেনেটিক কোড আইডি’, তার পরেও কীভাবে তাকে ক্রমাগত তাড়া করছে ওরা? আঙুলের ছাপ নাকি রেটিনার গঠন? ভাবতে গিয়ে সে টের পায় স্যান্ডউইচ শেষ কিন্তু খিদে মেটেনি। ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা চকলেট বার টেনে বার করতে গিয়ে সে প্রথম শব্দটা শুনলো।

‘ক্লিক!’ এরপর আবার এলো শব্দটা, ‘ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক...’

কিরা ব্যাগটাকে আঁকড়ে ধরে উঠে দাঁড়াল। সাবধানে এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিল। কই, কেউ নেই তো? সকাল থেকে তাড়া খেয়ে খেয়ে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, এখন এই অদৃশ্য শব্দের উৎসটা তাকে রীতিমত বিরক্ত করে তুলছে।

‘ক্লিক-ক্লিক-ক্লিক-’ এবার শব্দগুলো বেশ কাছে এগিয়ে এসেছে। এদিকে আধো অন্ধকার গলিপথে কাউকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ কিরার চোখদুটো বড় হয়ে যায়। অন্ধকারের বেড়াজাল ভেদ করে তিনটে প্রমাণ সাইজের মাকড়শা তার দিকে এগিয়ে আসছে। ‘স্পাইডার সেন্ট্রি’, সংক্ষেপে ‘এসএস’। এরা আটপায়ে ঘুরে বেড়ায় শহর জুড়ে, এদের চোখ দিয়ে গোটা শহরের ওপর নজর রাখে পুলিশ। এদের দিয়ে অপরাধী অনুসন্ধানের কাজও হয় বেশ মসৃণভাবে। কখন কোন অসাবধানতায় এদের চোখে পড়ে গেছিল কিরা কে জানে! পিছু নিতে নিতে ঠিক এখানে এসে পৌঁছেছে ধাতব পুতুলগুলো। কিরার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, সে অনুভব করে তার পিছনে শুধু পলেস্তারা খসা দেওয়াল ছাড়া আর কিছুই নেই।

‘হাত তোলো।’

‘সোজা হয়ে দাঁড়াও।’

‘সাবধান, নড়ার চেষ্টা করো না।’

তিনজনেই এগিয়ে আসছে। কিরা স্থির চোখে ওদের অগ্রগতি মেপে চলেছে।

এমন সময় হঠাৎ একসঙ্গে তিনজোড়া লম্বা হাত বেরিয়ে এলো ওদের শরীর থেকে। একজন কিরার পা দুটো চেপে ধরেছে একজন ওর হাতের কব্জি দুটো আর তৃতীয় জন চেপে ধরেছে তার দুটো কাঁধ। দেওয়ালে শিকারের মত আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিরা, আর বনবিড়ালের মত ফুঁসছে সে।

ওদের একজনের সর্পিল হাত থেকে একটা ছুঁচের মত জিনিস বেরিয়ে এল। কিরার চোখের মনির সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। ভয়ে চোখ বন্ধ করল কিরা। ছুঁচের ডগাটা এবার চার ভাগে ভাগ হয়ে গেল, চিমটের মত চোখের পাতাকে টেনে ধরে ফাঁক করল। কিরা অনুভব করল একটা তীক্ষ্ণ লাল আলোর বিন্দু তার চোখের মনির ওপর আছড়ে পড়লো।

“রেটিনা, ভেরিফাইড।” সেন্ট্রি ঘোষণা করে। আরেকজন উর্দ্ধতনের কাছে পরবর্তী পদক্ষেপের নির্দেশ চায়।

“বন্দিকে নিতে গাড়ি আসছে, বারো মিনিটের পথ।” সেন্ট্রি বাকিদের শোনায়।

কিরা এবার মরিয়া হয়ে উঠল। তাকে দেওয়ালে চেপে রাখাটা সেন্ট্রির পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে ক্রমাগত।

‘ঝুপ!’

কোনো কারণে পাশের ডাস্টবিনটা কেঁপে উঠল হঠাৎ। একজন সেন্ট্রি কিরার হাত ছেড়ে দ্রুত সেদিকে ছুটে গেল। ওদের দুচোখের মাঝখান থেকে সরু টর্চের আলো বেরিয়ে ঘোরাঘুরি করল এদিক ওদিক।

এই সুযোগ! কিরা দুহাতে টেনে ধরল ঘাড়ে চেপে বসা ধাতব হাতদুটোকে।

“এস এস- ১৮৯, বন্দিকে বেহুঁশ করো।” একজন ঘোষণা করে। এস এস- ১৮৯ আবার ছুটে এল, তার শরীর থেকে আরেকটা ছুঁচ বেরিয়ে এল কিরার হাতের ধমনী লক্ষ্য করে। শেষ চেষ্টায় কিরা ডান হাত বাড়িয়ে ধরে। ভাঙা টিনের ডান্ডাটা আরেকটু চেষ্টা করলেই হাতের মধ্যে এসে পড়বে।

“নড়াচড়া বিপজ্জনক, ওর হাত দুটো চেপে ধর।”

“দমাস!”

প্রথম ধাক্কায় সেন্ট্রি হতভম্ব হয়ে পড়ল। এরপর ক্রমাগত আঘাতে সে প্রথমে কিরাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল এবং তারপর পিছিয়ে যেতে শুরু করল। আঘাতের পর আঘাত, তার পরে আবার আঘাত। কিরার এলোপাথাড়ি মারে এস এস -১৮৯ হঠাৎ ঝিমিয়ে পড়ল। তার হাত দুটোর চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেল হঠাৎ।

“সেন্ট্রি ডাউন!” কথাটা যেন বিপদ ঘন্টার মত শোনালো।

কিরা নিজেও হকচকিয়ে গেছিলো কিছুটা।

কয়েক মুহূর্তের জন্য সময় থমকে যায়। কিরা এবং বাকি সেন্ট্রি দুটোও যেন অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে সময় নেয় কিছুটা।

সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা জাতীয় অপরাধ। আর সেই সম্পত্তি যদি হয় পুলিশ-পাহারাদার তাহলে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। শাস্তির গুরুত্ব বয়েস নিরপেক্ষ। কিরার মগজে বাক্যটা বারবার ধাক্কা খায়, “তুমি খুন করেছো, কিরা।”

“এস এস ১৮৯, মৃত।” কথাটা ঠিক যেন বিচারকের কঠিন ঘোষণার মত শোনায়।

“অপরাধীকে এক্ষুনি বন্দি করা হোক।” তৃতীয় পাহারাদারের ঘোষণা।

ফেরার আর পথ নেই। আইনের চোখে এখন সে খুনি। কিরার হাতের মুঠো শক্ত হয়।

ওদের ছুটে আসার অনেক আগেই সে ঠিক করে নিয়েছিল তার পরবর্তী পদক্ষেপ।

দুম... দাম...ধড়াম ...

মাকড়সাগুলো নিস্তেজ। তিনটেই।

শুধু একখানা বিকৃত যান্ত্রিক শব্দ হচ্ছে সেন্ট্রির গোল মাথার ধোঁয়া ওঠা মাথা থেকে, “পলাতককে ধরতে সাহায্য চাই, লোক পাঠানো হোক।”

কিরা রাগে হতাশায় হাতের ডান্ডাটা চালায় আবার। শব্দ থেমে যায়। ছেলেটা ফুটপাথে এলিয়ে পড়ে ক্লান্তিতে। ডাণ্ডাটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ভেঙে পড়ে কান্নায়।

ক্লিক.. ক্লিক...ক্লিক...ক্লিক...

কিরা চোখের জল মুছে ভয়ার্তভাবে এদিক ওদিক তাকায় আবার। ওরা আসছে। দল বেঁধে। এবার কী করবে সে? এদিকে যান্ত্রিক পদশব্দ এদিকেই এগিয়ে আসছে ক্রমাগত।

এমন সময় হঠাৎ, একটা হাত বেরিয়ে এল পাঁচিলের খোঁদল ভেদ করে। কিরার জামা খামচে ধরে হ্যাচকা টানে কেউ অন্ধকারে টেনে নিল তাকে।

“চুপি চুপি আমার পিছু পিছু এসো।” মেয়েলি গলা। তার হাত যার মুঠোয় বন্দি, সে ছুটছে। কিরাও। অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছে।

অন্ধকার নেই। মিটমিটে লালচে বাল্ব জ্বলছে একটা। সেই আলোতেই ঘরটাকে কেমন জাদুঘরের কোনও গোপন কক্ষ বলে মনে হচ্ছে কিরার। তার পায়ের কাছে প্রহরীর মত বসে আছে একটা বেড়াল। সে থাবা চাটছে। এক নিমেষে দেয়ালে এলিয়ে পড়া হতক্লান্ত কিশোরকে দেখছে। যেন পালতে গেলেই টুঁটি চেপে ধরবে। ওর গায়ে সাদা আর খয়েরি লোম। চোখদুটো কটা।

আর মেয়েটা? সে এখন অদৃশ্য। যদিও পাশের ঘরে সামান্য খুটখাট শব্দ আসছে। “ক্ষিধে পেয়েছে?”--- ঐটুকু প্রশ্ন করেই সে পালিয়েছিল মিনিট পনেরো আগে। পাহারায় রেখে গিয়েছিল নচ্ছার বেড়াল ছানাটাকে।

মেয়েটা যতক্ষণ আসছে না ততক্ষণে নিজের চিন্তাভাবনাগুলোকে একটু গুছিয়ে নিতে চাইল কিরা। কোথায় এল সে? মেয়েটাই বা কে? কতটা নিরাপদ কিরা এখন? আচ্ছা, কতগুলো গলি পেরিয়েছিল ওরা? এই ঘরটাতে পৌঁছতে এতগুলো সিঁড়ি কেন ভাঙতে হয়েছিল তাকে? মাটির ঠিক কতটা নিচে তারা পৌঁছেছিল? প্রশ্নগুলো অন্ধকার ঘরে জোনাকির মত জ্বলছিল আর নিভছিল। অথবা কিরা স্বপ্ন দেখছিল?

“আলুসেদ্ধ আর ভাত, সঙ্গে সবুজ লঙ্কা।” মেয়েটা এলুমিনিয়ামের থালাটা তার সামনে রেখে মিষ্টি হাসলো। কথাটায় আজব মায়া আছে। আইকনের সঙ্গে তুলনা টানতে গিয়ে কিরা লজ্জা পেল।

“আমার ব্যাগে খাবার আছে।”

“যাক, একদম পরিকল্পনা করেই পালিয়েছ?” মেয়েটা থালা সরিয়ে নিল। কিরা দুঃখী চোখে দেখলো, মেয়েটা হাতের তালুতে ভাত আর আলুমাখা ছোট ছোট ডেলা বানাচ্ছে। বেড়ালটা আদুরে ভঙ্গিতে মেয়েটার কোলে গিয়ে বসলো। একটা ডেলা বেড়ালটার মুখে চালান করে দিয়ে অন্যটা নিজের মুখে পুরল মেয়েটা। কিরার কাছে এমন দৃশ্য অপরিচিত। সে শুধু চোখ মেলে রইল।

“তোমার নাম কী? কে তুমি? আমাকে এখানেই বা নিয়ে এলে কেন?” কিরা অনেক ভেবে এইটুকুই বলতে পারলো।

“ধন্যবাদ দিতে আবার নাম জানার দরকার আছে নাকি?” হাসিটা কিরাকে আরও অস্বস্তিতে ফেললো।

“ধন্যবাদ।” কিরার গলাটা ভেঙে যায় এর মধ্যেই।

মেয়েটার মুখ গম্ভীর। বেড়ালটা ‘ইয়াও’ শব্দে হাই তুলল যেন।

“বাড়ি থেকে পালিয়েছি...তখন ভাবিনি ব্যাপারটা এতটা জটিল হবে...সঙ্গে কিছু টাকা আর খাবার আছে...কিন্তু কীভাবে এদের নজর এড়িয়ে পালাবো সেটাই বুঝতে পারছি না যে...আর তাছাড়া ঘরে ফেরার পথটাও বিলকুল বন্ধ।” ছেলেটার গলা যেন কান্না এড়াতেই বেশি রকমের নিস্তেজ শোনায়।

“এখন আপাতত বাড়িতে ফিরতে চাইলেও পারবে না। আশা করি এতক্ষণে শহরের সবকটা পুলিশ হেডকোয়ার্টারের তোমার জেনেটিক ম্যাপ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপাতত তিনখানা এস এসের খুনি হিসাবে ওরা তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এখন ধরা পড়া মানে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে সোজা মরণের ওপারে পাঠিয়ে দেবে প্রশাসন। আশা করি জান, কোনো প্রভাবশালী মানুষই তোমার সাহায্য করতে পারবে না, একমাত্র...” মেয়েটা যেন তার সমস্ত ভবিতব্য এক নিশ্বাসে বলতে গিয়েও সামান্য হেঁয়ালি করে।

“একমাত্র?” কিরা আশাবাদী হতে চেষ্টা করে।

“একমাত্র আমি ছাড়া!” মেয়েটা হাতের থালাটা নিয়ে পাশের ঘরে আবার অদৃশ্য হয়।

“কীভাবে?” কিরা অদৃশ্য মেয়েটার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছোঁড়ে।

হাতে একটা দুধভর্তি বাটি এনে সেটাকে বেড়ালটার সামনে রাখল মেয়েটা। তারপর হাঁটুমুড়ে বসে পড়ল পলাতক কিশোরের সামনে। তাকে খুঁটিয়ে দেখে প্রথমে তারপর অতি আপনজনের গলায় বলে ওঠে, “তোমার হাতে পায়ে কয়েকটা জায়গায় কেটে ছড়ে গেছে, এক্ষুনি ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি।”

প্রতিবাদ করার আগেই মেয়েটা পাশের ড্রয়ার থেকে তুলো আর একটা শিশি করে, খুব যত্নে কিরার কনুই আর হাঁটুতে তরল লাল ওষুধটা লাগিয়ে দিল। মুখে বলল, “মারব্রোমাইন, মানে লাল ওষুধ। ভয় পেয়ো না, ক্ষত সারাবে চটপট।”

বেড়ালটা দুধ খাওয়া শেষ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে এক চোখ বন্ধ করে ফ্যাঁচ করে হেঁচে উঠলো। ঘরটা যেন কেঁপে উঠলো।

“কী জঘন্য!” কিরা মুখ বেঁকিয়ে বলল। বেড়ালটার সবজান্তা হাবভাব তার মোটেও ভালো লাগছিলো না।

“ও বেচারা ঠিক সময়ে ডাস্টবিন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বলেই এখন তুমি এখানে। তা না হলে এতক্ষণে এস এস গুলোর সঙ্গে পুলিশের গাড়িতে থাকতে, তাই না?” মেয়েটা গায়ের জোরে লাল তুলোটা কিরার ক্ষতে চেপে ধরলো। চিড়বিড়ে জ্বালাটা গিলে নিয়ে কিরা নিজের বীরত্ব দেখালো।

“রাত হয়েছে, আজ বিশ্রাম সেরে কাল সকালে আলোচনায় বসা যাবে।” মেয়েটা ওষুধপত্রের বাক্স গুছিয়ে রাখতে রাখতে জানিয়ে দিল। একটা দেরাজ থেকে টেনে বার করল একখানা বালিশ আর চাদর। মেঝের ওপর সেগুলোকে পরিপাটি করে অতিথির জন্য বিছানা প্রস্তুত করল। “আমি এখন পাশের ঘরেই বেশ কিছুক্ষণ বই পড়বো, কিছু দরকার পড়লে জানিও।” মেয়েটা আবার অদৃশ্য হল। তার পিছু নিল বিজ্ঞ বেড়ালটাও।

“বই” শব্দটা কিরার কানে অনেকবার ধাক্কা মারলো। তারপর প্রতিধ্বনিটা ধীরে ধীরে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

মেয়েটার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়েই ব্যাগ থেকে খাবারের প্যাকেটটা টেনে বার করলো কিরা। ঠান্ডা বাসি মাংসের বিস্বাদ টুকরোটাকে জিভ দিয়ে নাড়তে নাড়তে নাকে লাগলো আলু সেদ্ধ ভাতের গন্ধ। কী তেষ্টা পাচ্ছে!

“জল?”

কিরা চমকে গেল। তার ঠিক পাশটাতে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে জলের বোতল হাতে। তার হাত থেকে বোতলটা প্রায় ছিনিয়ে এক ঢোকে প্রায় পুরো জল গলায় ঢালল ছেলেটা। জামার হাতায় মুখ মুছে বলল, “ধন্যবাদ।”

মেয়েটা মুচকি হেসে পাশের ঘরে হারিয়ে গেল আবার।

কিরা মাটির শয্যায় শরীর এলিয়ে দেয়, বালিশে মাথা রেখে দুহাতে ব্যাগটাকে জড়িয়ে ধরে।

শরীর জুড়ে ব্যথা। সেটাকে ঘিরে রয়েছে অসহ্য মানসিক ক্লান্তি। তবু সেসবের উর্দ্ধে কিরার মাথায় খেলা করছে সেই একটাই প্রশ্ন, “কে এই মেয়েটা?”

পাশের ঘর থেকে লালচে আলোর আভা দরজা পেরিয়ে অন্ধকার মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ছে। একটা গান মৃদু স্বরে বাজছে, “ঘুম যায় ওই চাঁদ মেঘপরীদের সাথে...গল্প শোনার পালা এখন নিঝুম নিশি রাতে...”

সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোখের পলকগুলো বন্ধ হয়ে আসে তার। কলকাতা শহরের ভূগর্ভে কোনো এক অজানা গোলকধাঁধার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে পলাতক কিশোর।

“কেমন দেখলে বাইরেটা?”

কিরা চোখ বন্ধ করে ভাবছিল তার পরবর্তী পদক্ষেপগুলোর কথা। প্রশ্নটা তার চিন্তাভাবনাগুলোকে এক মুহূর্তে মাটিতে আছড়ে ফেললো। ধড়ফড় করে উঠে বলো সে।

মেয়েটা এখনো দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মিটিমিটি হাসছে তার দিকে তাকিয়ে।

“কী করে জানলে আমি বাইরে যাবার চেষ্টা করেছি?” কিরা সন্দেহের দৃষ্টিতে তার রক্ষাকর্ত্রীকে মেপে নেওয়ার চেষ্টা করল।

“আমাদের বয়সটা একরকম হলেও, তোমার থেকে অনেক বেশি মানুষ চিনি আমি।” শুধু বেড়ালটাই নয়, তার মালকিনও সমান জ্ঞানী।

“আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। তুমি কি আমার পিছু নিয়েছিলে?” ছেলেটা অবিশ্বাসীর মত প্রশ্ন করে।

“মাটির তলায় একলা থাকি, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো তোমাদের মত শহরবাসীদের থেকে অনেক ধারালো। তোমার নড়াচড়ার শব্দেই টের পেয়েছিলাম তুমি পালাচ্ছ। তবে পিছু নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি একদমই।” মেয়েটা হাসল আবার। ছেলেটা তার কাছে একটা পথভোলা খরগোশের মতই খেলার জিনিস।

বাল্বের আলোয় এই প্রথম কিশোরী মেয়েটাকে ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করল কিরা। ঘাড় অব্দি ছড়ানো চুলগুলো লালচে এবং রুক্ষ। কিন্তু যত্ন আছে তাতে। পরনে একটা মেটে রঙের সুতির ফ্রক। পায়ে একজোড়া রঙিন হাওয়াই চটি। এক পাটির রং লাল আরেক পাটির রং সাদা। মেয়েটা কে?

“আমার নাম কিংশুক রাহা,” কিরা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, মেয়েটার সামনে এসে মাথা নিচু করে নিজের পরিচয় দিল, ‘বন্ধুরা কিরা বলে ডাকে। আপাতত বাড়ি থেকে পালিয়েছি...”

মেয়েটা হাত তুলে তাকে থামায়, শান্তভাবে বলে, “বাকিটা জানি, কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন পালিয়েছে?”

কিরা ভাবল। ঠিক ভুলগুলোকে নিক্তিতে মেপে উত্তর দিল ধীরে সুস্থে নিচুস্বরে, “আমি ‘ফ্ল্যারিন’ খুঁজতে চাই।”

“ভ্রাম্যমান যাযাবর মানুষদের বস্তি? ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসে মরার থেকে অবশ্য ফ্ল্যারিন খোঁজার চেষ্টাটা অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত।” হাত নাড়িয়ে ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলল মেয়েটা।

“আপাতত সেরকমই হচ্ছে,” কিরা মাথার চুলে হতাশভাবে হাত চালিয়ে স্বীকার করল। যদিও মেয়েটার জ্ঞান গম্যি দেখে তার ততক্ষণে তাক লেগে গেছে বেমালুম।

“আচ্ছা, আমরা এখন কোথায় আছি? কেনই বা পুলিশ চারদিকে পাহারা দিলেও এখানে এসে পৌঁছতে পারছে না? তুমি কে? এত জায়গা থাকতে তুমি এখানেই কেন থাকো? তোমার পরিবার পরিজন এরাই বা কোথায়?” কিরা এতগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে করার পরিশ্রমে হাঁফায়।

“চড়াই!” মেয়েটা বলল গম্ভীর মুখে, “হ্যাঁ, ওটাই আমার নাম। আর এটার নাম হল মিয়া, খুব সঙ্গত কারণেই। আমাদের এই মাথা গোঁজার জায়গাটার নাম ‘রাজভবন’। কারণ এর ঠিক ওপরেই যে বিশাল সাদা মার্বেলের বাড়িখানা আছে সেটায় একসময় এ রাজ্যের রাজ্যপাল থাকতেন। বিশ্বযুদ্ধের আগুন থেকে রাজকর্মচারীদের বাঁচাতে তাই এই প্রাসাদের নিচে মাটি কেটে বানানো হয় তিনতলা বাঙ্কার। যুদ্ধ শেষে তার প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়। তারপর শহর পাল্টে যায় অজস্রবার। এই বাঙ্কার চিরকালের জন্য পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ওপরের যন্ত্রদুনিয়া এখানকার ঠিকানা জানে না, এমনকি ওদের সিগন্যাল স্ক্যানারও এর ত্রিসীমানায় কাজ করে না। তাই এই ছেড়ে যাওয়া রাজপ্রাসাদে আস্তানা নিয়েছে দুটো ফেলে দেওয়া প্রাণী, আমি আর মিয়া। বুঝলে?” মেয়েটা বিষণ্ণভাবে হাসলো।

“আমাকে সাহায্য করবে?” কিরা জানতে চাইল অসহায় গলায়।

“করছি তো!” চড়াই নামের মেয়েটা আবার হাসল, “তবে আমার দৌড় এই শহরের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ, ওর বাইরে যে বিশাল দুনিয়া আছে সেখানে আমার ওড়া বারণ। “

“তোমাকে কিচ্ছুটি করতে হবে না, শুধু শহর থেকে বেরোনোর রাস্তাটা যদি বাতলাতে পারো তাহলেই হবে।” কিরা উজ্জ্বল চোখে তাকায় মেয়েটার দিকে, বোধহয় মরিয়া হয়ে আশ্বাস খোঁজে, “আমি ওদের হাতে জীবন দিতে চাই না।” গলাটা কেমন যেন কেঁপে উঠল তার।

“রাস্তার হদিস দিতে পারি, এমনকি তোমাকে শহরের প্রান্তে পৌঁছেও দিতে পারি আমি,” চড়াই কিরার খুব সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এখন, “কিন্তু তার বদলে চাই...”

কিরা দ্রুত ব্যাগ হাতড়ে একমুঠো টাকা বার করে মেয়েটার চোখের সামনে নাড়াল।

“ওসব চাই না,” চড়াই নিস্পৃহ গলায় বলে, “আমার চাই একটা প্রতিজ্ঞা।”

“প্রতিজ্ঞা? নিশ্চয়, যদি ধরা পড়ি তাহলে এই গোপন ডেরার খবর জানতে পারবে না কেউ।” কিরা আশ্বস্ত করতে চায় মেয়েটাকে।

“প্রতিজ্ঞা কর, ফ্ল্যারিনের খোঁজে বাকি জীবনটা উৎসর্গ করবে?” কিরার কব্জিটাকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল মেয়েটা।

“আমার আর কোনো উপায় নেই যে।” মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিরা, “প্রতিজ্ঞা করছি, যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন মানুষের খোঁজে পথে পথে ঘুরবো।”

“এবার টাকাগুলো দাও।” মেয়েটার মুখে হাসি ফিরেছে এবার। কিরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল, “এই যে বললে ওসব চাই না!”

চড়াই গম্ভীর মুখে ঘোষণা করল, “আমার জন্য নয়, তোমার জন্যই দরকার। এবার দাও।”

টাকাগুলো তার হাতে চালান করে কিরা দ্বিধাজড়ানো গলায় বলল, “ওগুলো দিয়ে কী করবে?”

“ট্রিপল জিরো কিনবো।”

“সেটা কী?”

“এনালগ সিগনালকে মাস্ক করতে যে নতুন যন্ত্র বার হয়েছে সেটাকেই বলে ট্রিপল জিরো।” ফিসফিস করে বলল চড়াই, “তুমি নিশ্চয় এর নাম শোনোনি? শুনবেই বা কী করে, এ হল আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ডের ভাষা। এখন এখানে চুপচাপ লুকিয়ে বসে থাকো। মিয়া থাকবে তোমার পাহারায়। খবরদার আমার ফিরে আসার আগে যেন পালাবার মতলব এঁটো না। সবকিছু ঠিক থাকলে আজ রাতেই বেরিয়ে পড়া যাবে পালানোর রাস্তা খুঁজতে।” মেয়েটা মুখটাকে রুমাল দিয়ে বেঁধে পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিল।

“আর যদি তুমি ধরা পড়?” কিরা প্রশ্নটা করেই ফেলে।

“যাকে ওরা দেখতে পায় না তাকে ওরা ধরবে কীভাবে?” মেয়েটা সিঁড়ি বেয়ে উপরের অন্ধকারে হারিয়ে যাবার আগে ঘোষণা করে যায়। কিরা আরেকটা ধাঁধা মাথায় নিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল।

“তৈরী?’ চড়াই হাসিমুখে প্রশ্ন করে। কিরার মনেও প্রশ্নটা ঘুরপাক খায়, সত্যি কি সে তৈরী? মনের সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে সে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল।

মাটির ওপরে সভ্যতা। মাটির নিচে এক পরিত্যক্ত যাত্রাপথ। মাটির ওপরে ওরা অপরাধী। মাটির নিচে ওরা অভিযাত্রী।

এ পথে আছে সুগভীর সুড়ঙ্গ, আছে অযত্নে পড়ে থাকা লুকোনো গুদামঘর, আছে শতাধিক বছরের পুরোনো মেট্রো রেলের জালপথ। খেলার সাধ মিটে গেলে যেমন শিশু তার পুরোনো খেলনা অযত্নে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তেমনি নাগরিক উন্নতির উত্তেজনায় মানুষ পুরোনো সৃষ্টিকে পায়ে ঠেলেছে চরম অবহেলায়। সেখানে আজ ধুলো জমেছে, ময়লা আর আবর্জনার স্তূপে চাপা পড়েছে তাদের এক সময়ের সৌন্দর্য। সেসব পেরিয়ে চলতে গিয়ে কিরা আবিষ্কার করে আলোর রূপটানে সেজে ওঠা কল্লোলিনীর সযত্নে লুকিয়ে রাখা আরেকটা রূপ।

ছপাস!

“আরে বাবা, একটু দেখে চলো।” চড়াই হাত ধরে টেনে তুলল কিরাকে। জুতো মোজা ভিজে গেছে বিলকুল। একটা দুর্গন্ধ বিনবিন করে শরীরের চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে।

“ইশ, দেখতে পাইনি একদম।” কিরা নাক সিঁটকে বলে উঠল, “আচ্ছা, ওখানে কী আছে?”

“বোকা, নর্দমার জল দেওয়ালের ফুঁটো দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে এখানে। নালা নর্দমা চলছে আমাদের মাথার উপরে, সত্তর ফুট হবে খাড়াইয়ে। কিন্তু ওদের গায়ে অজস্র ফুটিফাটা আছে। সেখান থেকেই চুঁইয়ে পড়ছে নোংরা জল। সামলে চলো এবার থেকে।” চড়াই বিরক্ত হল।

অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে গলিপথ পেরিয়ে কয়েকঘন্টা চলার পরে একসময় থামে চড়াই। এবার? কিরা অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না।

‘মিয়াও!’ চড়াইয়ের খোলা ব্যাগ থেকে মাথা বার করে বেড়ালটা। তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে টিফিন কৌটো খুলে ভাজা মাছের টুকরো বার করে মেয়েটা। মিয়ার ডাক বন্ধ হয় এবার।

“আমারও ক্ষিদে পাচ্ছে যে।” কিরা বলে উঠল।

“আমরা আর ‘রাজপ্রাসাদে’ নেই মহারাজ! খাবার বন্দোবস্ত হবে আরও ঘন্টা খানেক চললে।” চড়াই-এর গলায় নেত্রীর ঝাঁজ।

“আচ্ছা, ওখানে কী আছে?” কিরা কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল। একটা গুনগুন ধ্বনি আর একটা রাক্ষুসে হাঁ-এর মত গর্ত দেখা যাচ্ছে অনেক দূর থেকেই।

“কানাগলি,” চড়াই সংক্ষেপে জানায়। তারপর আবার নিঃশব্দ পথচলা।

“ওটা কীসের শব্দ, চড়াই?” কিরা ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিকে চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন করে।

তার পথপ্রদর্শিকা কিন্তু নিঃশব্দে চলেছে। তাদের চলার পথের ঠিক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একখানা গভীর নর্দমা, কালো কালির মত পিচ্ছিল বর্জ্যপদার্থের নিঃশব্দ তরঙ্গ। ঘেন্নায় গা ঘিন ঘিন করে উঠলেও নেহাৎ বীরত্ব দেখাতেই সে বমি চেপে রেখেছে। একরত্তি মেয়েটার সামনে এমনিতেই সে প্রতিমুহূর্তে নাস্তানাবুদ হচ্ছে, তার ওপর যদি এরকম সময়ে নিজেকে সামলাতে না পারে তাহলে নিশ্চয় কিরার সম্পর্কে একদম বাজে ধারণা হবে মেয়েটার। কিন্তু শব্দের প্রাবল্য যেন বেড়েই চলেছে ক্রমাগত। অনেকগুলো মানুষের গলার শব্দ শোনা যাচ্ছে সমবেতভাবে, আলাদা করে তাদের বোঝা যায় না। কিরার ধমনীতে রক্তপ্রবাহের গতি বেড়ে যায়।

“মুখটা ঢেকে নাও কাপড়ে, আমি না বললে কথা বলবে না একটাও।” চড়াই সতর্ক করে দিল।

নিঃশব্দে আদেশ মেনে নিয়ে ব্যাগ থেকে লম্বা তোয়ালে বার করে মুখ ঢাকল কিরা। টানেলের বামদিকে একটা গলিপথ দেখা যাচ্ছে, শব্দ আসছে সেপথ ধরেই। কিরা আর চড়াই গলিপথ ধরে ঢুকলো এবং কয়েকখানা সিঁড়ি ভেঙে এসে পৌঁছল একটা আধো অন্ধকার প্ল্যাটফর্মে। ছেলেটার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।

মানুষ!

নতুন আগন্তুকদের দেখে উঠে দাঁড়াল অনেকে, বাকিরা শঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। এখানে ওখানে ইতস্তত জ্বলছে আগুন, তার আঁচে হাড়ি চড়িয়েছে কেউ কেউ। মহিলাদের ঘাড়ে বাঁধা কাপড়ের পুটুলি থেকে জুলু জুলু চোখে তাকিয়ে আছে সদ্যজাতরা। কেউ কেউ কাপড়ের আবরণে লুকিয়ে অস্ত্রের বাঁটে হাত রেখেছে সাবধানে। নোংরা পরিধান, হিংস্র দৃষ্টি আর চরম দারিদ্র্যের সামনে দাঁড়িয়ে কিরা নিজেকে কেমন অসহায় অনুভব করল।

“এরা কারা?” কিরা জানতে চাইল। ফিসফিস করে।

“এরা সবাই ‘মানুষ’।” চড়াই সংক্ষেপে উত্তর দিল।

“দাঁড়াও।” দুজন মুশকো চেহারার লোক পথ আগলে দাঁড়াল তাদের। মেয়েটা বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে মুখ থেকে আবরণ সরায়, বেশ জোরের সঙ্গে জানায়, “রহমতকে খুঁজছি, সে কোথায়?”

“তফাৎ যাও।” এবার গুণ্ডাদুটোর পিছন থেকে এল এক প্রৌঢ়ের ঘষঘষে কণ্ঠস্বর। মুশকো কালো চেহারা নিয়ে দাড়িগোঁফে ঢাকা একজন বয়স্ক মানুষ এসে দাঁড়ালেন তাদের সামনে। চড়াইয়ের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে মাথা নাড়িয়ে লোকদুটোকে চলে যাবার ইঙ্গিত দিলেন তিনি।

“খুকি, এখানে আসাটা তোর জন্যেও বেশ বিপজ্জনক,” বুড়ো হাসিমুখেই সতর্কবার্তা শোনালেন মেয়েটাকে, “আর যাই হোক, জায়গাটাতো আর ভালো নয়!”

“তোমার মত খারাপ লোককে খুঁজতে খারাপ জায়গাতেই তো আসতে হবে, তাই না?” চড়াই ঠাট্টা করল, কিরা ঢোক গিলল ভয়ে।

রাগ করেন না রহমত বরং গলা ছেড়ে হাসেন, “খুকি, বল হঠাৎ আজ বুড়োকে মনে পড়লো যে?”

“চিড়িয়া এনেছি।” মেয়েটা কিরা-কে দেখিয়ে বলল। চোখ বড়বড় করে মেয়েটাকে আড়চোখে দেখে নিল কিরা। ‘চিড়িয়া?’ কথাটা শুনে ভয় পাওয়া উচিত না কি রাগ করা সেটা বুঝতে বেশ অসুবিধা হল তার।

লোকটা এতক্ষণ ঝোলা আলখাল্লার পকেটে ডান হাতখানা ঢুকিয়ে রেখেছিলেন, এবার সেটা বার করে এক ঝটকায় কিরার মুখের আবরণ সরিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখলেন প্রথমে তারপর আবার হাসলেন প্রাণখুলে। এদিকে কিরার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল।

লোকটার ডানহাতের কব্জির পরের অংশটা শুধুই ধাতুর। দুখানা সাঁড়াশির মত আংটা লোকটার হাতের তালুর কাজ করছে। শিউরে উঠল পলাতক কিশোর। এরা কারা? আঁতকে ওঠারও শক্তি হারিয়েছে সে।

“এই প্রথম নিজের বয়সী একজন চিড়িয়া এনেছিস, খুকি। ছেলেটা কে বা কীভাবে পরিচয় হল সেসব জিজ্ঞাসা করবো না।” লোকটাকে থামিয়ে দিল চড়াই, “ও তোমাদের মতই অপরাধী। এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ওকে পৌঁছে দিতে তোমার সাহায্য দরকার রহমত।”

“কোথায় যাবে?” বুড়ো কিরা-কে প্রশ্ন করলেন। চড়াইয়ের মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে কিরা ঢোক গিলল, খুব নিচু গলায় বলল, “ফ্ল্যারিন।”

লোকটার হাসি আর থামতে চায় না যেন। চড়াই আবার থামাল তাঁকে, কিরার দেওয়া টাকাগুলো থেকে এক খাবলা তুলে ধরায় রহমতের লোহার হাতটায়। হাসি থামে তার।

“নাও এবার কাজে নেমে পড়।” চড়াইয়ের রিনরিনে গলা শুনে রহমত এক চোখ বন্ধ করে স্যালুট ঠুকলেন, “জি, হুজুর-” তারপর ঘষঘষে গলায় ডাক ছাড়লেন, “এ পিটটা, এ ধনিয়া, নয়া কাস্টমার আয়া হ্যায়।”

আবার মুশকো লোকদুটো উদয় হল। এক পা এক পা করে তারা এগিয়ে এল কিরার দিকে। ছেলেটা ভয়ার্ত চোখে তাকাল চড়াইয়ের দিকে,কিন্তু মেয়েটার চোখদুটো মাটির দিকে নিবদ্ধ কেন? লজ্জা, ভয় অথবা অপরাধবোধ? সে পিছন ফিরে ছুটতে চাইল। আরেকটা ষণ্ডা তাকে পিছমোড়া করে ধরল। রহমতের হাতটা একটা রুমাল দিয়ে চেপে ধরল তার মুখ। জ্ঞান হারানোর আগে চড়াইয়ের সঙ্গে চোখাচুখি হল তার, মেয়েটার মুখে কি দুঃখের ছায়া পড়েছে? কিরার শরীর এলিয়ে পড়ল রহমতের কোলে। তাকে চ্যংদোলা করে লোকগুলো নিয়ে চলল তাদের ডেরায়।

জলের মধ্যে ডুবে সূর্যের দিকে তাকালে যেরকম মনে হয় ঠিক সেরকমই মনে হচ্ছিল কিরার। সমস্ত দৃশ্যপট কেমন যেন ঝাপসা আর তরল তার চোখে। মাথার পিছনে কেমন যেন রিনরিনে যন্ত্রণা। কিরা তবুও উঠে বসতে চাইল।

“বেটা, অনেক ঘুমিয়েছিস, এবার উঠে পড় দেখি।” রহমতের গলা। কিরার দৃষ্টি এবার পরিষ্কার। ছোট্ট টিমটিমে অন্ধকার ঘরে সে পড়েছিল এতক্ষণ, সামনে কয়েকটা কাঠের আঁচে আগুনের শিখা। এককোণে চড়াইয়ের শরীরটাকে দেখতে পেল সে। একটুকরো গামছার ওপরে পাদুটো ভাঁজ করে বসে আছে মেয়েটা। স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে কিরা বোধহয় উত্তর খুঁজতে চাইল।

“তোমার শরীর থেকে বারকোড তুলতে ছোট্ট একটা অপেরেশন হলো।” চড়াই হাসিমুখে উত্তর দিল। রহমতও হাসলেন, “এখন থেকে তুই আজাদ চিড়িয়া, বেটা।”

‘‘আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করো না,” কিরার গলা এবার সপ্তমে, “অনেক আগেই আমি জি সি ডি ক্লক ফেলে দিয়েছি। আমাকে ওদের সিস্টেম আর কখনোই ধরতে পারতো না।”

চড়াই আর রহমত মজার ভঙ্গিতে দৃষ্টি বিনিময় করল । তারপর হেসে উঠল দুজনেই।

রহমত মাথা ঘুরিয়ে তাঁর নোংরা চুলের রাশি সরিয়ে ঘাড়ের দিকটা আলোর সামনে ধরলেন। কিরার বিস্ফারিত চোখের সামনে ফুটে উঠল একটা ছোট্ট ক্ষতচিহ্ন।

“জি সি ডি ছাড়াও জন্মের সময় থেকে একটা বারকোড লাগানো দানা পুরে দেওয়া হয় ঘাড়ের কাছে মাংসের মধ্যে। সেটাতেই ধরা পড়ে অশিকাংশ অপরাধী। ‘আইকন গ্রিড’- ওটাকে না সরালে ওদের জালে আজ না হয় কাল ধরা পড়তেই হবে।” রহমত উত্তর দিল, ছোট্ট একটা চিমটের ডগায় রক্তমাখানো চারকোনা চিপটা তুলে ধরল তার চোখের সামনে। এই বস্তুটা এতদিন শরীরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল সে নিজের অজান্তে? আলতোভাবে সে আঙ্গুল ছোঁয়াল নিজের ঘাড়ের দিকটায়। সাদা কাপড়ের এবড়োখেবড়ো বাঁধুনির আড়ালে সামান্য যন্ত্রণার আভাস পেয়ে হাত সরিয়ে নিল সে। ধীরে ধীরে মাটির ওপরের দুনিয়া থেকে সে আলগা হয়ে পড়ছে। কিরা ভারমুক্ত মনে করে নিজেকে। চেনাশোনা সভ্য জগতের খাঁচা এখন তার জন্য নয়। আচ্ছা, ওরা কি কিরাকে একেবারে ভুলে যাবে?

“চল এবার।” কিরা জলদি উঠে দাঁড়ালো। ব্যাগটা তার হাতের মুঠোয় ধরা। চড়াই উঠল না।

“আরও এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে।” মেয়েটার গলা বেশ ঠান্ডা। কিরার উৎসাহ মিইয়ে গেল। সে বসে পড়ল আবার।

“কিন্তু কেন?” প্রশ্নটা মুখ ফস্কে বেরিয়েই পড়ল।

“আগে খেয়ে নাও।” রহমতের নির্দেশে একজোড়া মাখন লাগানো পাউরুটি এসে হাজির হয়েছে ততক্ষণে। বুড়ো হাসলেন, “এটাও তোমার অপারেশনের প্যাকেজের মধ্যে পড়ছে, খোকা!”

খাবার গন্ধে প্রশ্নগুলো ডানা মেলে পালালো। এর পরে এক কাপ চা। ঢেঁকুর তুললো কিরা। পরিতৃপ্তির।

সবকিছুর শেষে চড়াই ঘড়িতে চোখ রাখলো। “দশ মিনিট, রহমত।”, মেয়েটা ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

“পিট্টা, ওদের পৌঁছে দিয়ে আয়।” রহমতের গর্জনে টাকমাথা দস্যুটা এগিয়ে এল আবার।

“এদের আবার কী দরকার?” কিরা চড়াই-কে ফিসফিস করে প্রশ্ন করল। উত্তর পেতে অবশ্য দেরি হল না। দৈত্যটা একটা লিভার ধরে টান মারতেই আলো জ্বলে উঠলো অন্ধকার পথের এক ধারে। প্ল্যাটফর্ম! রেল লাইনের ওপরে একটা এককামরার বগি দেখে চমকে ওঠে কিরা। লোকটা বগিতে উঠে কিছু যন্ত্রপাতি টানাটানি করতেই সেই চৌকো ঘরটাও আলোয় হেসে উঠলো।

“চলে এস।” ট্রেনের ইঞ্জিনটা চলতে শুরু করেছে একটু একটু করে, ড্রাইভারের কেবিন থেকে চড়াই মাথা বার করে কিরাকে নির্দেশ দেয়। কাঁধের ব্যাগটাকে টেনে সে ছুটতে শুরু করে, এক লাফে উঠে পড়ে চলমান কামরায়। পরিত্যক্ত লোহার জলপথ ধরে এককামরার ট্রেন ছুটলো চারদিক কাঁপিয়ে।

“গোটা শহরে বারোটা ব্লাইন্ড স্পট আছে, পুলিশের স্ক্যানারে তারা ধরা পড়ে না। এরকম তিনটে ব্লাইন্ড স্পট পড়ে তোমার যাত্রাপথে। শেষের টাই এ শহর থেকে তোমার মুক্তির দরজা। আমরা এখন চলেছি দ্বিতীয় স্পটের কাছে। বুঝলে?” চড়াই ব্যাখ্যা করল। মাথা নাড়ে কিরা। সবটুকু না বুঝলেও আপাতত এটুকুই যথেষ্ট বলে তার মনে হয়।

ক্লিক... ক্লিক...ক্লিক...ক্লিক...ক্লিক...

পিট্টা নামের মানুষটা চমকে ওঠে। চমকে ওঠে ওরা দুজনও।

“মিয়াও!” বেড়ালটাও জানান দেয় শত্রুর উপস্থিতি।

“এরা এখানে? আমাদের কারোর শরীরে তো বারকোড নেই! আর তাছাড়া আমাদের দুজনের কাছেই তো ট্রিপল জিরো মাস্ক আছে, তাহলে সেন্ট্রি আমাদের কীভাবে তাড়া করছে ?” কিরা চিৎকার করে জানতে চায়। ধরা পড়ার আতঙ্কে সে নীল।

“চৌম্বক ক্ষেত্র, ওটাতেই সর্বনাশ হয়েছে। গাড়ির গতিবেগ ওদের সেন্সরি সিস্টেমে ধরা পড়েছে বোধহয়।” চড়াই উৎসুক চোখে ওদের সংখ্যা আন্দাজ করার চেষ্টা করে, “আমি অবশ্য অনেক আগেই ওদের উপস্থিতি আশা করেছিলাম!”

...ধড়াম...ক্রাম ...

ওদের যান্ত্রিক হাতদুটো কেবিনের ছাদ ধরে টানাটানি করছে তুমুল। একটা ধার তুবড়ে গেছে, আরেকটা ধার এখনও জোড়ের গায়ে লেগে আছে। কিরা দ্রুত পিট্টার হাতের লোহার ডান্ডা নিয়ে অপেক্ষা করে। ছাদের ফাঁকা অংশটা দিয়ে সেন্ট্রির হাত গলে ভিতরে আসতেই সেটাকে গায়ের জোরে আঘাত করে সে।

“স্ক্রিচ!” ভারসাম্য হারিয়ে গড়িয়ে পড়ল সেন্ট্রি, চলমান কেবিনের ধারে কংক্রিটের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছত্রখান হয়ে ভেঙে পড়ে।

“খুনের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো চারে।” চড়াই এই বিপদের মধ্যেও ঠাট্টা করতে ছাড়ে না।

“সংখ্যাটা পাঁচে না পৌঁছলে শান্তি পাচ্ছি না।” কিরা ছাদের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়। এদিকে দ্বিতীয় সেন্ট্রি লোহার ছাদটাকে প্রায় উপড়ে ফেলেছে। ফাঁকা খোঁদল বেয়ে সে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে যাত্রীদের ওপরে। ডান্ডার ধারালো দিকটা গায়ের জোরে সেন্ট্রির শরীরে ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করল কিরা। কিন্তু একটা ফাঁপা ‘ঠনাস’ করে শব্দ ছাড়া আর কিছুই পরিবর্তন হল না সেন্ট্রির শরীরে।

এবার বিশালদেহী পিট্টা ইঞ্জিনের কন্ট্রোল প্যানেল ছেড়ে কিরার সঙ্গে হাত লাগাল, তার হাতের মোচড়ে সেন্ট্রির বর্ম ভেঙে ধোঁয়া ওঠল। এক পদাঘাতে তাকে কেবিন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল তারা।

“হতভাগা টিনের সৈন্য কোথাকার!” পিট্টা গাল পাড়ল এবং তারপর প্রাণ খুলে হাসল।

“সেন্ট্রি ডাউন।” সবাই চমকে দেখল, এখনও একটা লোহার আংটা ধরে ঝুলছে ভেঙে ছত্রখান হয়ে যাওয়া সেন্ট্রির দেহাবশেষ।

তর্জনীর আলতো ধাক্কায় সেটাকে ঝেড়ে ফেলে দিল চড়াই। দেওয়ালের ধাক্কায় চুরমার হয়ে গেল আহত সেন্ট্রির শরীর।

“শেষ পর্যন্ত আমাকেও খুন করতে হলো,” চড়াই দুঃখী মুখে বলে ওঠে, তারপর মুচকি হাসল, “খেলনাগুলোকে কে বানিয়েছে এমন?”

সব্বাই হেসে ওঠল। কিরাও।

১০

পিট্টা অপেক্ষা করছে। থেমে গেছে তার ইঞ্জিনঘরটা।

প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে একটা কটু গন্ধের ঝাঁজ এসে নাকে ধাক্কা মারলো কিরার।

“নাক আর মুখ ঢেকে নাও।” চড়াই নির্দেশ জারি করল। কিরা পথপ্রদর্শিকার পিছু নেয় নিঃশব্দে।

সামনে দিনের আলো। যদিও ম্রিয়মান। খানিকটা অন্ধকার মেশানো। মেঘ করেছে নাকি? টানেলের শেষদিকটা হাঁ করে আছে। বাইরে পরিত্যক্ত জিনিসপত্রের ছোট ছোট স্তূপ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে আঙ্গুল তুলে চড়াই বলে ওঠে, “আমাদের পথ শেষ হয়ে এসেছে।”

কিরার মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বের ঝড়টা আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। হঠাৎ চড়াইয়ের হাতের ধাক্কায় সে থমকে দাঁড়ায়।

“একটা জিনিস দেখবে?” চড়াই মেঝে থেকে ছোট্ট একটুকরো পাথর তুলে ছুঁড়ে মারল সামনের খোলা হাঁ মুখটাতে। ছেলেটার বিস্ফারিত চোখের সামনে সেটা জুড়ে অকস্মাৎ লাল আলোর একটা পর্দা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।

“স্ক্যানার।” চড়াই হাসল, “ভয় নেই, ওটা আমাদের স্ক্যান করবে, কিন্তু রিপোর্ট করবে না।” তার আশ্বাস পেয়েই কিরা দৌড়ে পেরোল পর্দাটা, তার পিছু পিছু মেয়েটাও।

ওরা এসে দাঁড়াল একটা উঁচু আবর্জনার স্তূপের ওপর, সেটা থেকে নামলেই চড়াই উৎরাই ভরা একটা মালভূমি। সেখান থেকে বেশ কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ শেষ করলেই একটা সবুজ জঙ্গলের ঘন পর্দা। তারপর? আর দেখা যায় না।

“এখান থেকে নেমে সোজা দৌড় মারবে ঢালু দিয়ে, ততক্ষণ থামবে না যতক্ষণ জঙ্গলের গভীরে ঢুকছ না, বুঝলে?” চড়াই কিরাকে পথের নির্দেশ দিল। বোধহয় শেষবারের মত।

“আচ্ছা, তখন এক ঘন্টার জন্য অপেক্ষা করতে বললে কেন?” কিরার মনে প্রশ্নটা আবার ধাক্কা মারলো।

“আজ কত তারিখ বলতো?” চড়াই দিগন্তের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল।

“দাঁড়াও, কয়েকটা দিনের হিসেবে...”

“১৩ই জুলাই, ২০৭৫। “

“তাতে কী এসে যায়, চড়াই?” কিরা অবাক হয়।

“আজ পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ।”

“আকাশ কালো সেই কারণে, বুঝলাম। কিন্তু...”

“আর আধ ঘন্টার মধ্যে চাঁদ চলে আসবে পৃথিবী আর সূর্যের মাঝখানে। আর তখনই বেশ কিছুক্ষণের জন্য আইকনের সিগন্যাল রিসেপশন আংশিকভাবে অকেজো হয়ে পড়বে। সেই সুযোগে পিট্টা আমাকে নিয়ে হারিয়ে যাবে শহরের তলপেটে। বুঝলে?”

“বাপরে, তুমি কত কিছু জানো।”

“তোমাদের মত আমার মাথায় বিদ্যে ঢেলে দেয় না কেউ। আমি ‘বই’ পড়ি, নিজের ইচ্ছেয়, নিজের পছন্দমত।”

“চড়াই, আমার সঙ্গে যাবে? মানুষদের খোঁজে? ফ্ল্যারিনের পথে?”

এবার হাসলো মেয়েটা।

“শহরে চড়াইদের সংখ্যা কমে আসছে, তাই আমাকে এখানেই থাকতে হবে।”

একটা দমকা হাওয়ায় চড়াইয়ের লালচে খয়েরি চুলগুলো উড়ে গেল হঠাৎ। তার ঘাড়ের কাছটায় কিরার চোখ চলে যায় নিজের অজান্তেই। বিস্ফারিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে কিরা। কোনও ক্ষত নেই। তা সত্ত্বেও মেয়েটাকে শহরের স্ক্যানার গুলো খুঁজে পায় না!

“সময় হয়েছে।” মেয়েটার গলায় রহস্যের ছোঁয়া। মাথা নাড়িয়ে কিরা ছুটতে শুরু করল, ঢালু বেয়ে। উঁচু নিচু স্তূপগুলোকে পেরিয়ে। তারপর সমতল বেয়ে। জঙ্গলে প্রবেশের আগে সে মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিল তার ‘বন্ধুকে’, শেষবারের মত। যে মানুষের খোঁজে সে বাড়ি ছেড়েছিলো এই কয়েকদিন সেই মানুষটাই তাকে আগলে রেখেছিল। এত দূর থেকে তার ছোট্ট শরীরটাকে আকাশের পটভূমিকায় দেখতে পেল কিরা।

মেয়েটার পিঠের দুপাশে কি দুটো ডানা ফুঁটে উঠছে ক্রমশ? কে জানে!

“এ শহরে চড়াইদের ফিরিয়ে আনতে হবে, এ শহর ওদের।” কিরা মনে মনে উচ্চারণ করল। তার ছোট্ট চেহারাটা হারিয়ে গেল জঙ্গলের সবুজে।