পালনকর্তা - লুৎফুল কায়সার

গল্প
শুরুর আগে
কেস্টভিল,
আমেরিকা,
১৭ই নভেম্বর, ২০৩০

অদ্ভুত বইটা খুলে এক নাগাড়ে পড়ে যাচ্ছেন ড. রায়হান খান। সত্তরের মতো বয়স হবে তাঁর, এই বয়সেও যথেষ্ট শক্ত-সমর্থ তিনি। বইটার প্রায় শেষের দিকে এসে গেছেন, পৃথিবীকে এই মহামারি থেকে বাঁচানোর এই একটাই উপায়।

“তোমার কাজ কতদূর, হাসান?” পাশে বসে থাকা নিজের ছেলে ড. হাসানকে প্রশ্ন করলেন তিনি। হাসানই তার ল্যাব সহকারী।

“বাবা, প্রায় শেষ, আপনি নিশ্চিত এইসব করে আমরা পৃথিবীকে বাঁচাতে পারব? এইসব অদ্ভুত আচার-অনুষ্ঠান! এগুলো সাধারণ মানুষের জন্য নয়! এগুলো নিষিদ্ধ!” ড. হাসানের গলাতে বিদ্রোহের সুর।

মনে মনে হাসলেন ড. রায়হান। রসায়নবিদ হিসাবে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এই পিতা-পুত্র আমেরিকাতে বেশ বিখ্যাত ছিলেন, মানে ২০২০ সাল পর্যন্ত। দুজনেই বেশ কয়েকটা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন, লিখেছেন একাধিক গবেষণাপত্র। কিছু সরকারী প্রজেক্টেও কাজ করার কথা ছিলো ওনাদের, কিন্তু তারপরেই পৃথিবীতে আঘাত হানলো সেই মহামারি।

সম্পূর্ণ নতুন ওই মহামারিতে হাজারে-হাজারে মানুষ মারা যেতে লাগল।

নাগরিকদের গৃহবন্দী করে রাখল দেশগুলো, গবেষণা চলতে লাগল প্রতিষেধক আর ওষুধ আবিষ্কারের, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না!

দশ-দশটি বছর ধরে টিকে আছে ওই মহামারি। পৃথিবীর প্রায় চারভাগের একভাগ মানুষ মারা গেছে। যারা বেঁচে আছে, তাদের মধ্যেও প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন মানুষ।

মানুষহীন শ্মশান হয়ে গেছে পৃথিবীর এককালের আলো ঝলমলে শহরগুলো।

গত দশ বছরে যত শিশু জন্ম নিয়েছে তাদেরকে কোনো বাঘ-ভালুকের গল্প শুনিয়ে বড় করার অবকাশ হয়নি তাদের মা-বাবার। তাদের শুধুই ওই মহামারি থেকে বাঁচার পদ্ধতি শেখানো হয়।

“তৈরী তুমি?” বইটা হাতে নিয়ে বললেন ড. রায়হান।

“হ্যাঁ বাবা,” ঢোক গিললেন ড. হাসান।

পড়তে শুরু করলেন ড. রায়হান—

“যখন সব আশা নিভে যায় আর পৃথিবীর বুকে ভর করে কালো আঁধার... তখন শুধুই এক অসীম শক্তি তোমাদের বাঁচাতে পারে... স্মরণ করো পালনকর্তাকে...”

১ নভেম্বর, ২০৭৫
নিউইয়র্ক

রাস্তা দিয়ে চুপচাপ হেঁটে চলেছে পুষ্পিতা।

রাত আটটার মতো বাজে। রাস্তাতে তেমন লোক নেই। স্ট্রিট লাইটের আলোতে ওর মতোই কয়েকজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে।

২০৭৫-এর এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই বদলে গেছে।

যানবাহনগুলো সব এখন আকাশ দিয়ে চলে। রাস্তা দিয়ে আর তেমন কিছুই চলে না। মানবসভ্যতা অনেক এগিয়ে গেছে।

মূলত ২০৩০ সালে ওই ভয়াবহ মহামারি পুরোপুরি বিদায় নেওয়ার পর থেকেই পরিবর্তনটা এসেছে। বদলে গেছে সবকিছু।

পৃথিবীতে এখন আর কোনো দেশ বা সীমানার প্রাচীর নেই, গোটা পৃথিবীই এখন একটা পরিবারের মতো। পৃথিবী শাসন করে একটি মাত্র সংস্থা যার নাম ‘আর্থ কাউন্সিল’। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি থেকে বেছে নেওয়া হয় আর্থ কাউন্সিলের সদস্যদের।

এখন সবাই একে অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কেউ কারো ওপর আর জোর করে নিজেদের মতকে চাপিয়ে দিতে চায় না। ধর্মগুলোর মধ্যে কয়েকটা টিকে আছে, তবে আগের সেই উগ্রতা আর নেই, সবার মধ্যেই সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা জন্মেছে।

একমনে হেঁটে চলেছে পুষ্পিতা।

অবশেষে বহুতল সেই ভবনটা দেখতে পেল সে। ওখানে ডা. মুনের চেম্বার।

চেম্বারের বাইরে বেশ বড় করে লেখা রয়েছে, ‘ডা. মাসুদা পারভীন মুন’ নামটা। শহরের অন্যতম সেরা মনোচিকিৎসক এই মহিলা। মাত্র কয়েক বছরেই বেশ পরিচিতি পেয়েছেন। রোগীর তাই বেশ ভিড় থাকে ওনার চেম্বারে।

পুষ্পিতা যখন ঢুকলো তখন প্রায় রাত সাড়ে নটা বাজে।

ডা. মুনের বয়স বেশী নয়, ত্রিশের ঘরে। মহিলা দেখতে খুব বেশী সুন্দর নন, তবে কোঁকড়া চুল আর বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়া চেহারাতে একটা আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে।

“আপনার আইডি কার্ডটা দেখি,” পুষ্পিতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি।

আইডি কার্ডটা তাঁর হাতে তুলে দিলো পুষ্পিতা। সেটা নিয়ে একটা মেশিনে প্রবেশ করালেন ডা. মুন।

সাথে সাথে ওই মেশিন থেকে পুষ্পিতার একটা ত্রিমাত্রিক মূর্তি উঠে দাঁড়াল আর নিজের পরিচয় দিতে লাগল।

“হাই, আমি পুষ্পিতা খান, জন্মসাল ২০৫২...”

নতুন এই পৃথিবীর আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই আইডি কার্ড। সবারই একটি করে আইডি কার্ড আছে আর নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি কাজেই সবাইকে এটা নিয়ে যেতে হয়।

“আপনি ড. হাসানের মেয়ে! বাপরে!” পুষ্পিতার দিকে ঘুরলেন মেয়ে।

মনে মনে হাসল পুষ্পিতা। প্রায় সব জায়গাতে গিয়েই তাকে এই কথাটা শুনতে হয়। ওর বাবা আর পিতামহ অনেক বিখ্যাত এই নতুন পৃথিবীতে।

“হ্যাঁ ডক্টর,” হাসল সে।

“পরিচয় পর্বে আপনার মায়ের নাম কেন নেই?”

“আসলে ওনার নামটা আমার ঠিক মনে নেই!” মাথা নিচু করে বলল পুষ্পিতা। এই প্রশ্নটাও ওকে অসংখ্যবার শুনতে হয়েছে।

“কোনো সমস্যা?”

“নাহ এমনিই।”

“তো বলুন? আপনার সমস্যা কী?” চশমাটা পরে নিলেন ডা. মুন। প্রয়োজন ছাড়া মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না তিনি। আপাতত পুষ্পিতার মায়ের ব্যাপারটার সাথে তাঁর কাজের কোনো সম্পর্ক নেই।

“আমি খুব উদ্ভট কিছু স্বপ্ন দেখি,” ঢোক গিলে বলল পুষ্পিতা।

“আপনি কী করেন?”

“বর্তমানে? তেমন কিছু না, ইন্টারনেটে ছোটখাটো কিছু কাজ আর বেশীরভাগ সময়ে বাড়িতেই থাকি।”

“থাকেন কোথায়?”

“বাবার একটা ফ্ল্যাট আছে, ওখানেই। এখান থেকে দেড় ঘন্টা লাগে যেতে।”

“একা থাকেন?”

“হ্যাঁ।”

“আত্মীয়-স্বজন?”

“মা তো আমার জন্মের পরের বছরই মারা গেছেন আর বাবা পাঁচ বছর হলো গত হয়েছেন, তারপর আর কেউ নেই। বাংলাদেশের ওদিকে কেউ থাকলে থাকতে পারে।”

“এখন তো আর ওই বর্ডারের সমস্যা নেই, চাইলে তো যেতেই পারেন ওদিকে।”

“যেতে আর ইচ্ছা করে না।”

“কোনো বয়ফ্রেন্ড?”

“না নেই।”

“হুম... নেশাজাতীয় কিছু সেবন করেন?”

“না না!”

“এই সমস্যা কবে থেকে শুরু হয়েছে?”

“বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই... আর...”

“কী?”

“বেঁচে থাকতে বাবাও এই স্বপ্নগুলো দেখতেন!”

“হুম?”

“উনি মারা যাওয়ার ঠিক একমাস পর থেকে আমি এই স্বপ্নগুলো দেখতে থাকি।”

“উনি কীভাবে মারা গেছিলেন?”

“আত্মহত্যা করেছিলেন! নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে...”

“উনি কি কোনো প্রকার মানসিক চাপে...”

“না না ডক্টর, ওই স্বপ্নগুলো ছাড়া বাবার আর কোনো সমস্যা ছিল না।”

“আচ্ছা, কী ধরণের স্বপ্ন দেখেন?”

“একটাই স্বপ্ন, একাধিকবার দেখি...”

“থাক আর বলার দরকার নেই, আপনি দশমিনিট স্বপ্নটার কথা মনে করুন, এরপর আমি দেখছি ব্যাপারটা।”

একটা বিছানায় শুয়ে আছে পুষ্পিতা। ওর মাথাতে একটা হেলমেট লাগানো। সেই হেলমেটা থেকে অসংখ্য তার গিয়ে লেগেছে একটা বিরাট মেশিনে। সেই মেশিনের পর্দাটাতে ভেসে উঠছে ওর স্বপ্ন।

বেশ বড় একটা সাইনবোর্ড, ওতে লেখা ‘ওয়েলকাম টু কেস্টভিল’।

পরিত্যক্ত একটা শহর। দোকানপাট, বাড়িঘর সবকিছু দেখেই বোঝা যাচ্ছে গত ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে ওখানে কেউ থাকে না। সেই পুরনো ধাঁচের সবকিছু।

কোনো প্রাণী নেই শহরে, এমনকি মশা-মাছির ডাকও শোনা যাচ্ছে না। অদ্ভুত এক নিঃস্তব্ধতা।

এরপরের পাঁচ মিনিট প্রায় একই দৃশ্য, শহরের আনাচ-কানাচ দেখানো হচ্ছে।

মেশিনটা অফ করে দিতে যাবেন ডা. মুন আর ঠিক তখনই পরিবর্তনটা হলো।

কেমন যেন একটা অদ্ভুত যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে লাগলো। ওটাকে ঠিক কণ্ঠ বলা যাবে না! দুটো বিরাট পাহাড় একে অপরের সাথে যেন ঘষা খাচ্ছে।

মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো ডা. মুনের। মেশিন অফ করে দিতে গেলেন তিনি আর ঠিক তখনই থেমে গেল সেই শব্দ।

“কী মনে হয় ডক্টর?” বলল পুষ্পিতা, কোনোমতে উঠে বসেছে সে।

“হুম স্বপ্নটা বেশ জটিল। আমি কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, আপনি এগুলো খান আপাতত... দশ দিন পর দেখা করুন।”

ওষুধের লিস্টটা নিয়ে বেরিয়ে এলো পুষ্পিতা।

***

খুব অদ্ভুত একটা পরিবেশ। অন্ধকার একটা ঘর, তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুষ্পিতা।

ড. রায়হান আর ড. হাসান ওর সামনে দাঁড়িয়ে। দাদুভাইয়ের একটা ছবি সবসময়ই ওর ঘরে লাগানো থাকে, তাই ওনাকে চিনতে কোনো কষ্ট হলো না পুষ্পিতার।

কিন্তু বাবা আর দাদুভাইকে দুজনকেই খুব তরুণ দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে দুজনের বয়সই যেন সমান।

“বাবা!” আর্তনাদ করে উঠল পুষ্পিতা।

“হ্যাঁ মা,” হাসলেন ড. হাসান।

“এই স্বপ্নগুলো... আমি আর পারছি না বাবা...”

“এই স্বপ্নগুলো আমিও দেখতাম মা... আসলে আমরা... আমরা...”

“দাঁড়াও হাসান, ওকে সবকিছু আমিই বলছি” এগিয়ে এলেন ড. রায়হান।

“দাদু! আপনি জীবিত! বাবা জীবিত! আমি কি স্বপ্ন দেখছি?” পুষ্পিতার নিজের কাছেই কেমন যেন ফ্যাসফেসে লাগল ওর কণ্ঠ।

“হ্যাঁ দাদুভাই, তুমি স্বপ্নই দেখছ, তবে আমরা দুজনে কিন্তু মারা যাইনি, এই পৃথিবীতে কেউই মারা যায় না! আমরা অন্য এক জগতের বাসিন্দা হয়েছি... পালনকর্তার জগৎ!”

“পালনকর্তা? মানে ঈশ্বর!”

“ঈশ্বর... অনেক ঈশ্বর আছেন... তবে ধর্মগুলো যেমন বলে ওনারা কিন্তু তেমন নন...”

“মানে?”

“সৃষ্টিকর্তার স্বপ্নের মধ্যে আমাদের এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে...”

“আমি কিছু বুঝছি না দাদু!”

“আগে পুরোটা শোন... সৃষ্টিকর্তা অতি প্রাচীন এক সত্তা... আমরা তাঁকে যেমন ভাবি তিনি তেমন নন... ওনার স্বপ্নের মধ্যে উনি সৃষ্টি করেছেন বাকী ঈশ্বরদের.. আর এই ঈশ্বরদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হলেন পালনকর্তা… ইয়োগ-সোথথ তাঁর নাম! আমাদের মন, মস্তিষ্ক আর আত্মার মালিক তিনি, পুরো সৃষ্টিজগতকেই উনি নিজের ইচ্ছার মাধ্যমে চালনা করেন। সৃষ্টিকর্তা আমাদের পরোয়া করেন না। পালনকর্তাও আমাদের মতো ছোটখাটো সৃষ্টিদের নিয়ে খুব একটা ভাবেন না। কিন্তু...

“আমরা যদি সঠিক আচার-অনুষ্ঠান মেনে ওনাকে আহবান করি, তবে উনি আসেন আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আর আমাদের কোনো ইচ্ছা পূরণ করেন... কিন্তু উনি শুধু শুধু এসব করেন না... ওই মহামারির হাত থেকে পৃথিবীকে উনিই রক্ষা করেছিলেন... যে প্রতিষেধক আমি বানিয়েছি সেই জ্ঞানও উনিই আমাকে দিয়েছেন... কিন্তু উনি শুধু শুধু কিছু দেন না... আমার আত্মা ওনাকে দিতে হয়েছিল, সাথে দিতে হয়েছিল কেস্টভিলের বাকী সব লোকদের আত্মাও। পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য এটা আমাকে করতে হয়েছে... কেস্টভিল শহরটা জীবন্ত... এখনও...”

“তোমার মায়ের মৃত্যুও পালনকর্তার ইচ্ছাতেই হয়েছে পুষ্পিতা... আমার মৃত্যুও...” বলে উঠলেন ড. হাসান।

“বাবা! মানে মা...” ডুকরে কেঁদে উঠল পুষ্পিতা।

“তোমার জন্মের পর তোমার মা আমার চোখের সামনেই অদৃশ্য হয়ে গেছিলেন! স্রেফ অদৃশ্য! যে হাসপাতালে তুমি হয়েছিলে সেখানকার ডাক্তার আর নার্সরা পর্যন্ত ওর ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি! তোমাকে কোথায় পেলাম সেটাও জিজ্ঞাসা করেনি তারা। ওদের সামনে দিয়ে যখন তোমাকে কোলে নিয়ে বের হয়েছিলাম ওরা এমন একটা ভাব করেছিল যে তোমাকে আর আমাকে দেখতেই পাচ্ছে না ওরা! পরে আমি ওই হাসপাতালের রেকর্ড চেক করেছিলাম... তোমার মায়ের কোনো রেকর্ডই নেই ওখানে। তখন সব বুঝিনি... পরে বুঝেছি... এমনটাই হবার ছিল! এটাই ছিল পালনকর্তার ইচ্ছা! তুমি মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতে না, তোমার মায়ের কোনো ছবি নেই কেন?”

“হ্যাঁ বাবা!”

“কারণ যে ছবিগুলো ছিল সেগুলো থেকেও তোমার মায়ের চেহারা মুছে গেছিল।”

“কেন এমনটা হয়েছিল বাবা?”

“এই বিষয়টা তোমাকে আমি কোনোদিনই বোঝাতে পারব না... এমনকি তোমার মায়ের নামটাও আমি তোমাকে বলতে পারিনি, কারণ আমার মনে ছিল... থাক সে কথা...”

“তোমাকে কেস্টভিল ডাকছে মা... এটাই তোমার নিয়তি... আমাদের নিয়তি... অনেক বড় আর মহান এক সত্তার অংশ হতে যাচ্ছ তুমি...”

“বাবা, আমি ওই শহরে যাব না...” মেঝেতে বসে পড়ল পুষ্পিতা।

“তোমাকে যেতে হবে পুষ্পিতা... এটা নিয়তি... তুমি সেটাকে বদলাতে পারো না...”

***

ধরফরিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসল পুষ্পিতা। ওর পুরো শরীর ঘেমে গেছে। অদ্ভুত স্বপ্ন!

মোবাইলটা টেনে নিলো সে। রাত দুটো বাজে। তারিখ ১০ই নভেম্বর, সকালে ডা. মুনের সাথে দেখা করতে হবে।

“হুম তবে বলছিলেন বেশ উন্নতি হয়েছিল? তবে কাল আবার ওই স্বপ্নটা দেখেছেন?” স্পষ্ট চিন্তার ছাপ ডা. মুনের চেহারাতে।

“হ্যাঁ! এতো ভয়াবহ কোনো স্বপ্ন হতে পারে তা আমার জানা ছিল না!” পুষ্পিতার চেহারার পুরোটাই আলুথালু অবস্থা।

“দেখুন, যতদূর আমি শুনেছি, ওই মহামারিতে কেস্টভিলের সবাই মারা গেছিল, পরে কোনো একটা কারণে ওখানে আর কেউ থাকেনি। কিন্তু আপনার স্বপ্নটা... যাইহোক দিনের শেষ স্বপ্ন তো...”

“ডক্টর, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে স্বপ্নে যা দেখেছি তা সত্য...”

“আচ্ছা দেখি আপনার স্বপ্নের ব্যাপারটা... যান ওই বেডে গিয়ে শুয়ে পড়ুন...”

***

গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছেন ডা. মুন। পুষ্পিতার এখনও হুশ ফেরেনি। একটা স্বপ্ন যে এত ভয়াবহ হতে পারে তা ওনার ধারণাতে ছিল না!

টলতে টলতে বাথরুমে গেলেন তিনি। কোনোমতে মুখ ধুয়ে আয়নাতে নিজের মুখটা দেখলেন।

আর পারলেন না ডা. মুন। হড়হড় বমি করে ফেললেন তিনি...

***

“আচ্ছা আপনার মায়ের ব্যাপারটা, আসলেই কি ওনার কোনো ছবি ছিল না বাড়িতে?” লিখতে লিখতে প্রশ্ন করলেন ডা. মুন।

“হ্যাঁ ডক্টর, আসলেই ছিল না। বাবাকে প্রশ্ন করলে উনি বলতেন, ‘তোমার মা ছবি তোলা পছন্দ করতেন না।’ এমনকি মায়ের নামটাও কোনোদিন আমাকে বলেননি তিনি। জিজ্ঞাসা করলেই এড়িয়ে যেতেন!”

“এজন্যই আপনার আইডি কার্ডে মায়ের নাম নেই?”

“হ্যাঁ!”

“কিছু নতুন ওষুধ লিখে দিলাম। এগুলো নিয়মিত খাবেন আর ১৭ তারিখে আমার সাথে দেখা করবেন,” কাগজটা পুষ্পিতার দিকে এগিয়ে দিলেন ডা. মুন।

“ওইসব সত্যি না তো ডক্টর? পালনকর্তা... অপদেবতা...”

“কামঅন মিস. পুষ্পিতা... এটা ২০৭৫ সাল... এখন এসবে কে বিশ্বাস করে?”

১৪ই নভেম্বর
রাত ১০ টা।

ইন্টারনেটের কিছু অদ্ভুত সাইট ক্রমাগত ঘেঁটে যাচ্ছেন ডা. মুন। ২০৭৫ সালের এই পৃথিবীতে ডার্ক আর ডিপ ওয়েবের ব্যাপারটা আর নেই। সবই এখন সারফেস ওয়েব। নতুন পৃথিবীতে অপরাধ তেমন নেই, অল্প সংখ্যক অপরাধীরা নিজেদের কাজের জন্য বিশেষ কিছু সাইট ব্যবহার করে যেগুলোতে পাসওয়ার্ড দিয়ে তবেই ঢোকা যায়। বর্তমান পৃথিবীতে চাইল্ড পর্ণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, এই ধরণের পর্ণ তৈরী, দেখা এবং ছড়িয়ে দেওয়া শাস্তি মৃত্যুদন্ড। কর্তৃপক্ষ শক্ত হাতে এই ব্যাপারটাকে বন্ধ করতে পেরেছে। এসব কারণে ডার্ক ওয়েব বলতে আর তেমন কিছু নেই।

পুষ্পিতার স্বপ্নটা যেন মাথা থেকে যাচ্ছেই না ডা. মুনের। সেই নামটা... ইয়োগ-সোথথ।

অনেক খোঁজার পরে একটা অদ্ভুত ওয়েবসাইটে এই সংক্রান্ত কিছু তথ্য পেলেন তিনি।

আশ্চর্য! আসলেই ইয়োগ-সোথথকে পালনকর্তা বলে আরাধনা করত প্রাচীন কিছু জাতি, তাও হাজার-হাজার বছর আগে।

কেস্টভিল শহরের ইতিহাসও বড়ই অদ্ভুত।

সেই মহামারির সময়ে হুট করেই একদিন নিউইয়র্ক শহরে ফিরে আসেন ড. হাসান আর সবাইকে জানান তার বাবা ওই মহামারির প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছেন। উনি সাথে করে ডা. রায়হানের লেখা একটা পাণ্ডুলিপি এনেছিলেন।

ওনাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোথায় ড. রায়হান, উনি শুধু বলেছিলেন, “বাবা মারা গেছেন!”

“কী করে? কীভাবে?” এইসব প্রশ্নের উত্তর আর কখনোই দেননি তিনি।

তখন এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। এক সপ্তাহের মধ্যে সেই পাণ্ডুলিপির ফর্মুলা থেকে প্রতিষেধক তৈরী হয়, এক সপ্তাহের মধ্যে নানানভাবে পরীক্ষা শেষে মানুষকে প্রতিষেধক দেওয়া শুরু হয়।

কেস্টভিলের ব্যাপারে এরপর অদ্ভুত এক খবর ছাপা হয়। পাশের শহরের দুজন রেঞ্জার ড. হাসান নিউইয়র্কে আসার দুদিন পর কেস্টভিলে গেছিলেন। তারা গিয়ে দেখতে পান পুরো শহর ফাঁকা! কেউ নেই!

সেই দুজন রেঞ্জারের মধ্যে একজন রেঞ্জার. হাবার্টের ভাষায়—

“পুরো শহরটা ফাঁকা। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো প্রতিটা দোকান খোলা, প্রতিটা বাড়িতে জিনিসপত্র এদিক সেদিক ছড়িয়ে রয়েছে। শুধুই মানুষগুলো নেই! যেন কোনো এক অদ্ভুত কারণে তারা হুট করেই হারিয়ে গেছে!”

ডা. হাসানকে এরপর নানাভাবে প্রশ্ন করা হলেও উনি কেস্টভিল নিয়ে কোনো উত্তর দেননি। মানুষ নতুন প্রতিষেধক নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে ওই ছোট শহর নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি।

একমাস পর কেস্টভিলকে পরিত্যক্ত শহর ঘোষণা করা হয়। ওখানে আর কেউ কখনো থাকেনি।

২০৬০ সাল পর্যন্ত মাঝে মাঝেই ভ্রমণপিয়াসী আর হাইস্কুল ছাত্ররা ক্যাম্পিং করতে ওই শহরটিতে যেত। কিন্তু ওই বছরের অক্টোবরে ‘হ্যারি’ নামের একজন স্কুলছাত্র রহস্যময়ভাবে নিখোঁজ হওয়ার পর ওখানে মানুষের যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হয়।

কেস্টভিল সংক্রান্ত পেজটা একপাশে সরিয়ে ইয়োগ-সোথথ সংক্রান্ত পেজটা আবার দেখতে থাকলেন ডা. মুন। একটা পিডিএফ ফাইল রয়েছে ওই পেজে। কিছু না ভেবেই ওটা নামাতে দিলেন তিনি, বেশ বড় আকারের একটা ফাইল।

কেস্টভিল সংক্রান্ত পেজটা আবার দেখতে লাগলেন তিনি।

মাঝে মাঝেই কেস্টভিল থেকে মানুষ নিখোঁজ হয়। এখন পর্যন্ত প্রায় সাতান্ন জন মানুষ ওখানে নিখোঁজ হয়েছে। ষাট সালের পর যারা নিখোঁজ হয়েছে তারা কেন ওখানে গেছিল তা রহস্যময়। কারণ ওদিক দিয়ে কোন গাড়িও যায় না!

ভ্রু কুঁচকে যায় ডা. মুনের।

সেই পিডিএফ ফাইলটা নেমে গেছে।

ওপেন করলেন তিনি, বেশ কঠিন ইংরেজীতে লেখা, সাথে রয়েছে নানান আঁকিবুঁকি।

পড়তে লাগলেন ডা. মুন।

***

বাথরুমের বেসিনটায় ক্রমাগত বমি করে চলেছেন ডা. মুন।

প্রায় পনেরো মিনিট আগে ওই পিডিএফ ফাইলটা পড়া শেষ করেছেন তিনি।

ওনার কেন যেন মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি উনি উন্মাদ হয়ে যাবেন! ওটা পড়া ঠিক হয়নি তাঁর।

১৭ই নভেম্বর

“তো, কী অবস্থা আপনার?” কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললেন ডা. মুন।

“স্বপ্নগুলো আর দেখিনি, তবে গভীররাতে কারণ ছাড়াই ঘুমটা ভেঙ্গে যায়! আমার মনে হয় একবার কেস্টভিলে যাওয়া দরকার ডক্টর,” ম্লান হাসি দিলো পুষ্পিতা।

“মানে? ওখানে তো কেউ থাকে না!”

“সমস্যাটা মানসিক, ওই জায়গাটা... ওখানকার রহস্য... একবার জায়গাটা ঘুরে এলে হয়ত মনের মধ্যে থাকা সংশয়গুলো কেটে যাবে। আর ভয় পাব না... আমি যেতে চাচ্ছি...”

“হুম... তবে...”

“আমি এখনই যেতে চাই...”

“কী বলেন, বেশ রাত হয়েছে!”

“ফ্লাইং কারে করে যেতে বড়জোর বিশ মিনিট লাগবে। আর আমি চাই...”

“কী?”

“আপনিও চলুন আমার সাথে... সমস্যা নেই, ওখানে তো কেউ থাকেই না। আর আমার কাছে পিস্তল আছে,” এই বলে পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে দেখাল সে।

“আমি! কেন?”

“দরকার আছে, গেলেই বুঝতে পারবেন!” পুষ্পিতার মুখে রহস্যময় হাসি।

***

ধীরে ধীরে গাড়িটা মাটিতে নামল।

পুষ্পিতা আর ডা. মুন এদিক সেদিক দেখতে লাগল। সেই পুরনো সাইনবোর্ড, ওতে লেখা— “ওয়েলকাম টু কেস্টভিল”।

“চলুন, একটু ঘুরে ফিরে দেখি,” হাসল পুষ্পিতা। হাঁটতে লাগল সে, ওর পিছনে পিছনে যেতে লাগলেন ডা. মুন।

একটু অবাক হলেন ডা. মুন। পুষ্পিতার আচার-আচরণে কেমন যেন পরিবর্তন এসে গেছে। উৎফুল্ল মনে হচ্ছে মেয়েটাকে।

আকাশে বেশ বড় একটা চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমা নাকি আজ? চাঁদের আলোতে শহরের রাস্তাঘাটগুলো বেশ ভালোমতোই দেখা যাচ্ছে।

পুরনো ধরণের সেই রাস্তা, রাস্তার দুপাশের দোকান, ছোট্ট একটা পার্ক।

“এই পার্কে হয়ত আমার বাবাও খেলেছে ছোটবেলাতে, তাই না ডক্টর?” বাচ্চা মেয়ের মতো খিলখিলিয়ে হেসে উঠল পুষ্পিতা।

কোনো কথা বলছেন না ডা. মুন। পুষ্পিতার আচরণ খুবই অদ্ভুত লাগছে তাঁর কাছে।

রাস্তা ধরে এগোতে লাগল তারা। বেশ পুরনো একটা সিনেমা হলের সামনে এসে থামলো পুষ্পিতা, “এই হলটা! বাবার মুখে শুনেছি, এখানে উনি ছোটবেলাতে মিকি মাউসের সিনেমাগুলো দেখতেন! সে সময়ে খুব চলতো এগুলো! এই শহরটা! এত্তগুলো স্মৃতি!”

“আমাদের এখন যাওয়া উচিত মিস. পুষ্পিতা,” বললেন ডা. মুন। জায়গাটা একদম ভালো লাগছে না তাঁর।

“এই আরেকটু, আরেকটু এগোলেই আমাদের সেই পুরনো বাড়ি... ওটা দেখার পরেই আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে!”

“সমাধান? কেমন সমাধান?”

“আরে চলুন তো।”

“আপনি তো কখনো আগে এই শহরে আসেননি, বাড়িটা চিনবেন কী করে?”

“বরিস স্ট্রিটের পাঁচ নম্বর বাড়ি, বাবার কাছে শুনেছি আর বরিস স্ট্রিট তো সিনেমা হলটার পিছনে!”

***

বরিস স্ট্রিটের বাকি বাড়িগুলোর তুলনায় পাঁচ নম্বর বাড়িটার তুলনামূলকভাবে ভালো। সামনে একটা বেশ লন, তারপরেই একতলা বাড়িটা। দরজাটা খোলা।

“দেখছেন ডক্টর? বাড়িটা ঠিক স্বপ্নে যেমন দেখেছিলাম, তেমনই!” কেমন যেন ফিসফিসিয়ে বলে উঠল পুষ্পিতা।

মাথা নাড়লেন ডা. মুন। ওই মেশিনের মাধ্যমে পুষ্পিতার স্বপ্ন তিনিও পর্যবেক্ষণ করেছেন। আসলেই, বাড়িটা একদম স্বপ্নে দেখা সেই বাড়িটার মতো!

“চলুন ভেতরে ঢুকি,” হাঁটতে লাগল পুষ্পিতা।

কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন ডা. মুন। চুপচাপ পুষ্পিতাকে অনুসরণ করে গেলেন তিনি।

বাড়িটার ভেতরে কেমন যেন একটা গুমোট ভাব। বহুকাল কেউ এখানে ঢোকেনি। পকেট থেকে টর্চ বের করে এখানে সেখানে আলো ফেলতে লাগলেন ডা. মুন।

পুরো বাড়ির দেয়াল আর মেঝেতে অদ্ভুত ভাষাতে কীসব যেন আঁকিবুঁকি করা আছে!

“আসুন ডক্টর, আমার পিছে আসুন!” এমনভাবে হাঁটছে পুষ্পিতা যেন এই বাড়িটা কতকাল ধরে ওর চেনা। টর্চের আলোর ধারই ধারছে না সে!

“আপনি এই বাড়িটা এত ভালো করে চিনলেন কী করে?” ডা. মুনের কণ্ঠে সন্দেহ।

“স্বপ্নে এতবার বাড়িটা আর শহরটা দেখেছি যে সব মুখস্থ হয়ে গেছে! ডক্টর, একটু আগে আপনাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছি আমি, বাবা আমাকে কোনো ঠিকানা দেননি আমি স্বপ্নেই এই বাড়ির রাস্তা চিনেছি!” কেমন যেন ফ্যাসফেসে লাগছে পুষ্পিতার কণ্ঠ।

“হুম, তাই তো দেখছি, স্বপ্নে একদম ঠিকঠাক দেখেছেন সবকিছু আপনি!”

“অবাক লাগছে আপনার? আসুন এই ঘরটাতে আসুন...” ডানদিকের একটা দরজা খুলে ফেলল পুষ্পিতা।

ঘরটাতে একটা জানালা রয়েছে তাই চাঁদের আলো বেশ ভালোভাবেই প্রবেশ করছে ওখানে।

আশেপাশে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে চমকে উঠলেন ডা. মুন! এই সেই ঘরটা যেখানে স্বপ্নে ড. রায়হান আর ড. হাসানকে দেখেছিল পুষ্পিতা।

“সেই ঘর! এত নিখুঁত,” আশেপাশে টর্চ মারতে লাগলেন ডা. মুন।

ঘরের পিছনে একটা দরজা। সেটা খুলে বাইরে চলে গেছে পুষ্পিতা ততক্ষণে।

পিছনের উঠান।

বাইরে এলেন ড. মুন। উঠানে একটা বড় পাথর। অদ্ভুত ভাষাতে কীসব যেন খোদাই করা রয়েছ তাতে।

“ডা. মুন...” ঘোরলাগা কণ্ঠে বলে উঠল পুষ্পিতা, “আপনাকে অনেক মিথ্যা বলেছি আমি... অনেক... আপনাকে এখানে আমি শহরটা দেখাতে বা নিজের মানসিক জোর বাড়ানোর কাছে সাহায্য করতে নিয়ে আসিনি... আপনাকে এখানে একটা উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছি আমি...”

“কী উদ্দেশ্য?” তখনও পাথরটার দিকে তাকিয়ে আছেন ডা. মুন।

“ভয় পাবেন না তো?”

“ভয় পাওয়ার কী আছে?”

“অবশ্য পেলেও কিছু করার নেই! আমার দাদু নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন পানলকর্তার উদ্দেশ্যে... আমার বাবার জীবনও গেছে ওনার ইচ্ছাতে। আমাদের পরিবারের সবাইকে এভাবেই নিজের কাছে টেনে নেবেন পালনকর্তা... আমার ভাগ্যেও তাই রয়েছে... কিন্তু এটাকে না... ঠেকাতে পারি আমরা! আমি আপনাকে এখানে এনেছি কারণ আমি বাঁচতে চাই!”

“বুঝলাম না? কী বলতে চান আপনি?”

“পালনকর্তার কৃপাপ্রাপ্ত কোন মানুষ যদি নিজের কাহিনী কাউকে শুনিয়ে তাকে পালনকর্তার উদ্দেশ্যে বলি দেয়, তবেই সে মুক্তি পায়... রক্ষা পায় তার বংশ। আমি আপনাকে আমার কাহিনী শুনিয়েছি এখানে আনার জন্য! এখন আমি আপনাকে...”

“বলি দেবেন?”

“হ্যাঁ! ওই পাথরে পিষে মারব আপনাকে...”

“অতবড় পাথর আপনি তুলবেন কী হবে?”

“পালনকর্তা আমাকে সে শক্তি দিয়েছেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই... আপনাকে পিষে ফেলব...”

“আপনি কিচ্ছু জানেন না মিস পুষ্পিতা...” চিৎকার করে উঠলেন ডা. মুন।

“আহাহাহাহা, আরে ধুর...” হেসে ফেলল পুষ্পিতা, “আপনার ওষুধ খেয়ে গত কিছুদিন ভালোই আছি। আমি বুঝতে পেরেছি যে এইসব শুধুই আমার অবচেতন মনের কল্পনা। বাবার আঁকা কিছু ছবি আর এই শহরের পুরনো নক্সা দেখেই আমি শহরটা চিনেছি। এখন যেহেতু ভালোই আছি, তাই ভাবলাম আপনাকে নিয়ে এখানে এসে একটু শহরটা দেখে যাই। মানসিক জোর পাব একটু। তারপর আপনার সাথে ঠাট্টা করার লোভটা সামলাতে পারলাম না... কিছু মনে করবেন না... চলুন যাই... ওসব পালনকর্তা টর্তা কিছুই না!”

“অবচেতন মনের কারণে আপনি একটা শহর হুবহু স্বপ্নে দেখলেন?” ডা. মুনের মুখে বাঁকা হাসি।

“হ্যাঁ! হয় তো অমন!”

“না... অমন হয়নি...”

“চলুন ফিরে যাই... আপনার চেম্বারে বসে বাকি কথা শুনব।”

“আমরা আর এখান থেকে যেতে পারব না মিস. পুষ্পিতা।”

“আপনি কি এখন ঠাট্টা করছেন?”

“নাহ... আমি এমন কিছু একটা পড়েছি যা আমাকে বুঝিয়েছে পালনকর্তার মহানুভবতা আর মানবতার ক্ষুদ্রতা... আমি জানতাম আপনি আমাকে এখানে নিয়ে আসবেন, পালনকর্তার ইচ্ছাতেই এটা হয়েছে। আসলেই আপনার দাদুকে ওই প্রতিষেধক দিয়েছিলেন পালনকর্তা... তার বিনিময়ে উনি আপনার দাদুর সাথে সাথে এই শহরের সব মানুষের আত্মাকে গ্রাস করেছিলেন। ওই অভিশপ্ত আত্মাগুলোকেই উনি স্থাপন করেছেন এই শহরে... আপনার স্বপ্নগুলোতেও এই শহরই আপনাকে কাছে ডাকত। সেই বইটা আমি ইন্টারনেটে পেয়েছিলাম, যা দেখে আপনার দাদু পালনকর্তাকে ডাকার উপায় পেয়েছিলেন!”

“কী বলছেন এসব, আমি যাচ্ছি এখান থেকে, আপনি থাকলে থাকুন,” এই বলে ঘুরে হাঁটা শুরু করল পুষ্পিতা।

“তোমার মা... উনার সব চিহ্ন মুছে গেছে পালনকর্তার ইচ্ছাতে, কারণ উনি এমনটাই চেয়েছিলেন। এই পৃথিবীর আর কারও মনেই তোমার মা সম্পর্কে একটু স্মৃতিও অবশিষ্ট নেই। তোমার বাবা কিছু বলতে পারতেন না, কারণ উনি নিজেও ভুলে গেছিলেন সব! পালনকর্তা এমনটা করেছেন কারণ উনি চাইতেন তুমি এখানে এস! তোমার মা ছিলেন বিশেষ একজন মানুষ! যিনি জন্ম দিয়েছেন তোমাকে, যে পূর্ণতা দেবে এই শহরের আত্মাকে। ওনার নাম প্রকাশিত হোক এমনটা চান না পালনকর্তা। কেন চান না? এই প্রশ্নের উত্তর বোঝার মতো জ্ঞান আমাদের নেই।

“আমরা কেউই আর এখান থেকে যেতে পারব না, ওনার ইচ্ছা নেই! বুঝলে পুষ্পিতা, তোমার দাদু বলেছিলেন না? এই শহরটা জীবন্ত? আসলেই তাই... আক্ষরিক অর্থেই! গত দশ-বারো বছরে যারা এই শহর থেকে রহস্যময়ভাবে নিখোঁজ হয়েছে তাদের আত্মাও মিশে আছে এই শহরের মাঝে...” পাগলের মতো হাসতে লাগলেন ডা. মুন।

ততক্ষণে দরজার কাছে চলে গেছে পুষ্পিতা আর তখনই শুরু হলো ব্যাপারটা।

অদ্ভুতভাবে মাটি কাঁপতে শুরু করল। প্রথম পুষ্পিতার মনে হলো যে ভূমিকম্প হচ্ছে।

কিন্তু ওগুলো কী? চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখা যেতে লাগলো যে মাটি আর শহরের প্রতিটি বাড়ির বুক চিরে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য কালো কালো শুঁড়।

কিলবিলে সেই শুঁড়গুলো জড়িয়ে ধরল পুষ্পিতাকে। অনেক চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারল না সে। তার আগেই মাটির নিচে চলে গেল ওর দেহটা!

শুঁড়গুলো ডা. মুনকেও ঘিরে ধরেছে, কিন্তু তারপরেও পাগলের মতো হেসে চলেছেন তিনি। এই হাসি মানবতার ক্ষুদ্রতাকে বরণ করে নেওয়ার হাসি।

***

পাঁচ মিনিট পর,

সবকিছু নিঃস্তব্ধ। পুরো কেস্টভিল শহর যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। এই শহরে নিখোঁজ হওয়া মানুষের তালিকাতে আরও দুটো নাম যোগ হয়ে গেল।

কেউ কি কখনো জানবে কী হয়েছিল পুষ্পিতার সাথে? কিংবা বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মুনের সাথে?

জানলেও কি বিশ্বাস করবে?

মনে হয় না। ২০৭৫ সালের এই পৃথিবীতে কে এসব বিশ্বাস করে?