নশ্বর - সোহম গুহ

গল্প

আমার মেয়ের জন্ম হয়েছে আজকে; তার প্রথম কান্না ডুবে গিয়েছে কলকাতার দাঙ্গায় সদ্যমৃত মানুষের আর্তনাদে। না, ১৯৪৬-এর মত হিন্দু মুসলিমের মধ্যে হয়নি এই লড়াই; হয়েছে ভীত, আতঙ্কিত একদল মানুষের মধ্যে। তাদের আমি দোষ দিই না। বেলভিউ হাসপাতালের কাচের জানলা ভেদ করে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন কলকাতার রাস্তায় জ্বলা গাড়ির আগুনের আলো কতটুকুই বা চোখে পড়েছে আমাদের?

স্ত্রীর দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আমি। না, আমার মত আতঙ্ক গ্রাস করেনি তাকে, বরং সে অনেক বেশি ব্যস্ত সদ্যোজাতকে মাতৃদুগ্ধ পান করাতে। যদিও সে জানে সবই। টিভি বন্ধ হয়ে গেলেও ব্যাটারি লাগিয়ে পুরোনো রেডিওগুলো আবার জীবন্ত। “ঊর্মি,” আমি জিজ্ঞেস করলাম স্ত্রীকে, আমার মেয়ের নিষ্পাপ চোখের দিকে তাকিয়ে, “এটাই কি প্রাপ্য ছিল ওর?”

“সপ্তক, ঈশ্বরের কাছে আমরা সুতোয় বাঁধা পড়া পুতুলের উপরে কিচ্ছু কি? না তো।”

আমাদের কেবিনের বাইরে তখন ছোটাছুটির শব্দ। অনেক আহত মানুষ জমা হচ্ছে বিভিন্ন ঘরে। হাসপাতালের রিসেপসপন তখন বিল কাটার কথা, ফর্ম ভরার কথা ভুলে গেছে। অগ্নিদগ্ধ শবের উপরে একটু একটু করে জ্বলে উঠছে মনুষ্যত্বের প্রদীপ। আমার মোবাইলের রেডিওটা তখনো একই কথা বারবার বলে চলেছে। তার বক্তব্য জুড়ে আছে উত্তর আকাশের ধ্রুব তারার পাশের ক্রমবর্ধমান লাল জ্যোতিষ্কটি। বৃহস্পতি একটু আগেই মুছে গেছে সৌরজগতের চার্ট থেকে। পৃথিবী গিলে ফেলতে এনএস৩৩-র লাগবে আর মাত্র দশটি ঘন্টা। এমতাবস্থায় মেয়েকে কী করবো আমি বুঝতে পারছি না, মূঢ় হয়ে বসে আছি একটা চেয়ারে। আমার মত প্রায় সব মানুষই কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

মানুষ যখন কী করবে বুঝে উঠতে পারে না, তখন যে জন্তুটিকে সে আফ্রিকার রিফট ভ্যালিতে ছেড়ে এসেছিল, সে চামড়া চিরে ভেতর থেকে বেড়িয়ে পড়ে। মানুষ বুঝতে পারছে না সে পালাবে কোথায়। ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান, আমেরিকা চীনের যুদ্ধের বাইরে, অনেক অনেক বড় কিছুর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা মাপার ক্ষমতা দেয়নি সবাইকে ঈশ্বর। যাদের দিয়েছিলেন, তারাও শক্তিশালী কেপলার-২ ব্যবহার করেও এনএস৩৩-র কথা জানতে পারেনি। জানবেই বা কী করে? ঊর্ট মেঘে ঢাকা পড়ে গেছিল তো এনএস৩৩ এর ম্লান জ্যোতি। আর জেনেই বা কোনো লাভ হত? স্টেলার ইঞ্জিন কেবল মাত্র কল্পবিজ্ঞানের গল্পের বাস্তব। মানুষ এখনও গ্রেড-১ সভ্যতার উপরে উঠতে পারেনি।

আমার চিন্তায় বাধা পড়লো। কেবিনের দরজা ঠেলে মোমবাতি হাতে এক নার্স উঁকি মারলেন। পরনের সাদা পোশাক তাঁর শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গেছে পরিশ্রমের ঘামে। চোখ দুটো তাঁর একদিনের মধ্যে ভীষণ ক্লান্ত। খুব ধীর লয়ে তিনি বললেন, “আপনাদের এই কেবিন খালি করতে হবে। দুঃখিত, কিন্তু পেশেন্টের লোড বেড়ে গেছে গত কয়েক ঘন্টায়।” আমি মৌন হয়ে মাথা নাড়লাম। বাইরের কলকাতা তো কাচের জানলা ভেদ করে আমার কাছে ধরা দিয়েইছে।

তাও, আমি বুঝতে পারছি না কীসের মোহে, কোন ভবিষ্যৎ দর্শন করে এই হাসপাতাল, এবং হয়ত এর মত বাকি হাসপাতালগুলোও, এই দুর্যোগের মধ্যেও অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। একজন মুমূর্ষুকে বাঁচিয়ে কী লাভ যদি তাকে ঘণ্টা কয়েক পরে পৃথিবীর অন্তিম অবস্থা দর্শন করতে হয়? সাধারণ মানুষ বলেই ডাক্তারদের হিপক্রিট ওথের তাৎপর্য সম্পর্কে অজ্ঞ আমি। তাঁরা ভালো করেই বুঝেছেন আগামিকাল কী ঘটতে চলছে। মানুষের যাবতীয় চিহ্ন মুছে মহাকালের হালখাতা থেকে, কিন্তু তাঁদের উপস্থিতিতে মৃত্যু যেন কাড়তে না পারে একজনকেও। তাই অন্তিম প্রহরে পরিবার পরিজন ছেড়ে হাসপাতালে পড়ে তাঁরা।

কার্ল সেগানের ফ্যান ছিলাম বলেই হয়তো এনএস৩৩ কী জিনিস আমি জানি। একটা নিউট্রন স্টার। আইএইউের (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন) রেজিস্টারে যার অস্তিত্বই ছিল না। নাকি ছিল?

পার্কিং থেকে গাড়ি বের করে মিন্টো পার্ক পেরনোর পর বিষয়টা আমার মাথায় চাড়া দিল। এতো বড় একটা ঘটনা, কেউ কিচ্ছু জানত না? ঊর্মি পাশ থেকে বলল, “সপ্তক, সাবধানে স্টিয়ারিং ধর। হাত কাঁপছে তোমার।” আমাদের চারপাশে কলকাতা এখন ধ্বংসস্তূপ। সাবওয়ের আউটলেটে গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বিদ্যুৎবিহীন রাস্তার ওপাশে দেখা যাচ্ছে লালচে আভা। নন্দন জ্বলছে। সরকার মুছে গেছে এক নিমেষে। শেয়ার বাজার নিশ্চিহ্ন। কেবল ১০০.৩ এফএমের রেডিও জকি আবৃত্তি করছে ‘মনে কর শেষের সেদিন কি ভয়ঙ্কর’ আমাদের গাড়ির রেডিওতে। গলা তারও কেঁপে যাচ্ছে মাঝে মাঝেই। মৃত্যু চিন্তা গ্রাস করেছে আমাদের সবাইকে। পাশ ফিরে তাকালাম। না। সবাইকে না। আমার মেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে তার মায়ের কোলে। রেডিও এখনো কেন আমাদের মেটামরফিং টাচস্ক্রিন ফোনের একটা অঙ্গ বুঝতে পেরেছি।

এল্গিন ফোরাজন মলের সামনে দলা পাকিয়ে পরে অনেক মানুষ আর গাড়ির ধ্বংসস্তূপ। একটা খণ্ড যুদ্ধ ঘটে গেছে এখানে। এখন সেখানেই শ্মশানের শূন্যতা। পাশ থেকে ঊর্মি বলল হঠাৎ, “শুনতে পাচ্ছ?”

গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করলাম আমি। শব্দটা আমিও পেয়েছি। একটা প্লেনের শব্দ। কিন্তু সেই শব্দ অনেক উপরে, সেই প্লেন আমাদের সাধারণ যাত্রীবাহী বিমান নয়। তার গতিবেগ অনেক অনেক বেশি। জানলা দিয়ে দেখতে যাব, একটা বিস্ফোরণের শব্দ আমাদের নির্বাক করে দিল। কাচ নামিয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি দিলাম আমি। বিড়লা সাইন্স মিউজিয়ামের মোড়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সামনে কংক্রিটের জঙ্গলের মাঝে দেখা যাচ্ছে অনেকখানি আকাশ। ভোরের হালকা বেগুনি আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। প্লেনটাকে দেখতে পেলাম আমি। বিস্ফোরণের শব্দটা সোনিক ব্যারিয়ার ভেদ করার। প্লেনটা দেখতে কনকর্ডের মত, কিন্তু অনেক আধুনিক মডেল। এই প্লেন যে আমাদের দেশে আছে আমি সেটাই জানতাম না। উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে উড়ে গেল ওটা। কিন্তু যাত্রী কে বা কারা? তারা কি জানত এটা ঘটতে চলেছে? আর যদি জেনেও থাকে আগামি ঘণ্টা সাতেকের মধ্যে তারা পালিয়ে যাবে কোথায়? পৃথিবী তো গোল!

পকেট থেকে ফোন বের করলাম আমি। সংগ্রামকে জিজ্ঞেস করা দরকার। একটা সিগন্যাল তখনো টিমটিম করছে আমার বিএসএনএল পিকোসিমের। কেউ এখনো বসে ওদের দপ্তরে। আশা ভঙ্গ করে যখন ফোনটা বেজে-বেজে চুপ হয়ে গেল, আমি গড়িয়াহাটের ফ্লাইওভার ধরলাম। গোলপার্কের কাছে এসে আমার ফোনের রিংটোন আমার মেয়ের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল। নাম্বারটা একটা স্যাটেলাইট ফোনের। সংগ্রাম রিংব্যাক করেছে।

ওদের বাড়ির অমতে ঊর্মিমালা যখন আমায় বিয়ে করে তখন যে ওর সবথেকে বেশি বিরোধিতা করেছিল, সে হল ওর ভাই সংগ্রাম। ২০৭০ সালে গোটা পৃথিবীর ক্লাইমেট রিফিউজি ক্রাইসিস আর রিলায়েন্সের এসেট লিকুইডেরশনের সুযোগকে ব্যবহার করে যে কোম্পানি বলতে গেলে গোটা ভারতে নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল, অর্থাৎ এসজিসি/সংগ্রামস গ্রুপ অফ কম্পানিস, তার ৮৪% শেয়ার ছিল বলতে গেলে একটাই লোকের হাতে। সংগ্রাম সরকারের। এক অনামি শিল্পপতি থেকে রাতারাতি কিং সলোমন হয়ে যাওয়ায় ঊর্মি আর তার মধ্যের দূরত্ব কেবল আরও বেড়ে গেছিল। আমি নিজেও ব্যবসায়ি। আদি মোহিনী মোহন কাঞ্জিলালকে দেখছি গত বছর দুই ধরে। কিন্তু সংগ্রামের কাছে আমার সম্পত্তি ধূলিকণা ছাড়া কিছু না। ঊর্মি একবার একটা হিসেব দিয়েছিল, ১২০ ট্রিলিয়ান ডলারের। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ, আমাদের দেশের জিডিপি-র প্রায় ৮%, একটা লোকের পকেটে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম ফোন তুলে, “বলুন, সংগ্রামদা।” ঊর্মি আর সংগ্রাম দুজনেই আমার থেকে চার-পাঁচ বছরের বড়।

“সপ্তক, শেষমেষ ফোনটা তোমায় করতেই হল। কী যেন বলেছিলে? আপনাকে প্রয়োজন নেই আমাদের, নিজের পায়ে এগিয়ে চলার ক্ষমতা রাখি। আরও ইত্যাদি…” গলাটা শুনেই আমার ভেতরটা তেতো হয়ে গেল। “আমার বোনের জীবন নষ্ট করে কেমন লাগছে?”

“আমাদের সবারই জীবন নষ্ট হয়ে গেছে তো এই মুহূর্তে দাদা, সেখানে এই প্রশ্ন কি অযৌক্তিক নয়?”

সংগ্রামের গা জ্বালানো হাসি আমার কান জ্বালিয়ে দিল। “ভুল জানো তুমি। আমি বেঁচে যাব। আমরা বেঁচে যাব।”

কথাটা দুর্বোধ্য লাগলো আমার। লাউডস্পিকারে পাশে বসে সবই শুনতে পাচ্ছিল ঊর্মি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী বলতে চাইছেন?”

“আঃ, এই জন্যই তোমার কিছু হল না। তোমার বাড়ি ক্রস করলাম একটু আগে, এখন আমার নিচে বঙ্গপোসাগর।” কথাটা অনর্থক, কিন্তু ধরতে পারলাম আমি। জিজ্ঞেস করলাম, “জেটটা আপনার?”

“এই তো বুঝতে পেরেছ। আচ্ছা। রাখি। জাহাজ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য মরিশাসে।”

“ভালো। জাহাজে করে কতদূর যাবেন? আর জানেন তো, আপনার এই কথা অবান্তর একজনের কাছে। আপনার ভাগ্নির কাছে।”

হঠাৎ সংগ্রামের কণ্ঠস্বর বিচলিত, “ভাগ্নি?”

“হ্যাঁ, নাম ঠিক করেছি যাজ্ঞসেনী।”

“আচ্ছা… আমি… রাখলাম…” খাপছাড়া উত্তর দিয়ে সংগ্রাম ফোন কেটে দিল। নির্বুদপতির মনুষ্যত্ব কি কিছুটা জেগে উঠেছে এই শেষ দিনে?

কলকাতার যে প্রাচীর সমুদ্রকে ঠেকিয়ে রেখেছে বাইরে, তার আকার একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে দক্ষিণে। আমি ৮বি বাসস্ট্যান্ডের কাছের পাম্পে আমার গাড়ির হাইড্রোজেন সেলটাকে চার্জ দিয়ে নিলাম। দরকার নেই। কিন্তু ওই, অভ্যাস। ভাগ্যিস দিয়েছিলাম।

ঊর্মি বলল, “ওরা জানত এনএস৩৩-র কথা।”

“হঠাৎ তোমার এই কথা মনে হল কেন?”

“সেনীর নাম শোনার আগে অবধি ওর কণ্ঠস্বর ছিল দৃঢ়। তোমার আমার মত আতঙ্কে বিভ্রান্ত না। যদি দমদম থেকেও ওর প্লেন টেক অফ করেও থাকে, তাহলেও বলব এই প্লেন ও আমেরিকা থেকে আনিয়েছে। ও মরিশাসের কথা বলল খেয়াল আছে? একটা ডুবে যাওয়া দ্বীপে না আছে জাহাজঘাটা, না আছে শহর। কিন্তু দুটো জিনিস আছে। একটা ভাসমান ল্যান্ডিং স্ট্রিপ, আর…”

“আর কী?”

“পৃথিবীর প্রথম, সদ্যসমাপ্ত স্পেস এলিভেটর।”

ঊর্মির কথার সূত্র ধরতে পারলাম আমি। স্পেস এলিভেটরের পৃথিবীর যোগসূত্র ওই ল্যান্ডিং স্ট্রিপ। তাহলে, লোয়ার আর্থ অরবিটে কী তৈরি করেছে কিছু উচ্চবিত্ত মানুষ?

বাড়ি ফিরে আমি কিছু খবরের কাগজের কাটিং নিয়ে বসলাম। চিনের তিব্বতকে খনন করে বিআরআইের (Belt and Road Initiative) মাধ্যমে সেই আকরিক আশিয়ান দেশগুলোতে পাঠানো, ভারতেরও বিআইএমএসটিইসি-র (Bay of Bengal Initiative for Multi-Sectoral Technical and Economic Cooperation) মাধ্যমে সেই একই কাজ করা। রাশিয়া, আমেরিকার প্রত্যক্ষ সাহায্য, এমন কী প্যারিস চুক্তির যাবতীয় নির্দেশকে অবমাননা, অত্যধিক গ্লোবাল ওয়ারমিং, আমাজনকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সম্পদ নিষ্কাশনের জন্য, এমনকী রাইট উইঙ সরকারগুলোর অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ, সবই একসূত্রে গাঁথা। গত অর্ধশতাব্দী ধরে তারা জানত কী ঘটতে চলেছে, তাই তারা পরিবেশের উপরে যথেচ্ছাচার করেছে, আর গুছিয়েছে নিজেদের আখের। আমরাই নির্বোধ, হয় সায় দিয়েছি তাদের এই স্বার্থান্বেষণে, অথবা বসেছি ধর্নায়।

সূর্য উঠলেও জানলা দিয়ে আসা তার আলো ম্লান। এনএস৩৩-র টানে পৃথিবীর কক্ষপথ একটু একটু করে বিচ্যুত হচ্ছে, সরে যাচ্ছে সে সৌরজগতের গভীরতর প্রান্তের দিকে। অনুভব করলাম, শীত বাড়ছে ক্ষণেক্ষণে, মে মাসের চাঁদিফাটা গরম নেই আর, মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা হাওয়া শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে। শিরদাঁড়ায় কাঁপুনি ধরছে আরও একটা কারণে। মিনিট পাঁচেক আগে যে শব্দকম্পন আমাদের দোতলার কাচ ফাটিয়ে দিয়েছে তার উৎস একটু আগে রেডিও আমাদের বলেছে। প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটেছে উত্তর আমেরিকায়। ইয়েলোস্টোন সৃষ্টি করেছে তার নতুন কলডেরা, প্রায় চারশো মাইল ব্যাসের, তার গোটা ম্যাগমা চেম্বারটাই এখন খোলা আকাশের নিচে। বিস্ফোরণ ঘটেছে ক্রাকতোয়াতে, ব্যারনে। গোটা প্যাসিফিক রিম জেগে উঠেছে এক নতুন অভিকর্ষ বলের সন্ধান পেয়ে। সুনামির ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বহু অঞ্চলের সঙ্গে। দাঙ্গা, হিংসা, সব থেমে গেছে কলকাতার রাস্তায়। সবাই এখন বাড়ির ভেতর ঢুকে নিজেদের অন্তিম প্রহর গুনছে। কলকাতার কলতান শেষ হয়ে এখন এটা মৃতের শহর।

হঠাৎই বেজে উঠল ফোন। আমি তুলে বললাম, “কিছু বলবে সংগ্রাম?”

***

খাঁ খাঁ শূন্যতা বিরাজ করা দমদম এয়ারপোর্টে। কখনো সিকিউরিটি চেকিং ছাড়া সরাসরি গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়বো এখানে ভাবিনি। কিছু পুলিস তখনো বসে ছিল চুপচাপ ডোমেস্টিক ফ্লাইটের রিসেপশনের সামনে। আমাকে বেমক্কা গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়তে দেখল বটে, কিন্তু গা করলো না। আমি সার্ভিস এন্ট্রেস দিয়ে সোজা ঢুকে গেলাম ল্যান্ডিং স্ট্রিপে। মাথার উপরে শোনা যাচ্ছে সংগ্রামের সুপারসনিক জেটের গর্জন।

সংগ্রাম অনেককিছু করেছে, পেয়েছে। সে আজকে প্রায় অর্ধেক পৃথিবীর মালিক। যে দেশের অর্ধেক লোক খেতে পায় না দুবেলা, সেই দেশ থেকে উঠে এসে সে আজ বিশ্বের দ্বিতীয় ধনীতম মানুষ। পৃথিবীর সবকিছু তার কাছে পৌঁছে যায় এক লহমায়, কিন্তু রক্তের সম্পর্কের কেউ তাকে বাবা বলে ডাকে না। এই আক্ষেপ সংগ্রামের পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরেও থাকবে।

প্লেন থেকে তাকে মহার্ঘ টিশার্ট পড়ে নামতে দেখে ঊর্মি বলল, “এখনো পুরোপুরি অমানুষ হয়ে যাসনি।”

“দিদি, কথা বলার সময় নেই। যাজ্ঞসেনী কোথায়?”

প্যারাম্বুলেটরটা গাড়ি থেকে বের করে এগিয়ে দিলাম তার দিকে। আমার ঘুমন্ত মেয়ে জানতেও পারলো না তার চারপাশে কত বড় একটা নাটক মঞ্চস্থ হয়ে গেল। আমার ঊর্মির চোখে জল। স্বাভাবিক। কিন্তু সংগ্রামের চোখও ভিজে কেন? ওর দেহরক্ষী প্যারাম্বুলেটরটা ঠেলে প্লেনে ওঠাল। তার সঙ্গে প্লেনে উঠল সংগ্রামও। শেষ পাদানিতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে সে যেন কী ভাবল, তারপর নেমে এসে আমাদের অবাক করে প্রণাম করলো ঊর্মিকে।

“ক্ষমা করো দিদি। কিন্তু ক্রোধে অন্ধ হয়ে নিজের কে সেটাই ভুলে গেছিলাম। সময় থাকতে নিজের অন্তরকে বুঝতে পারলে তোমাদেরকেও নিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু সব সিস্টেম চালু হয়ে গেছে। এখন আর সম্ভব নয়। যাজ্ঞসেনীকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব আমার কেবিনে। খুব বেশি খাবার আর অক্সিজেনও লাগবে না ওর। আর…”

“কোথায় যাচ্ছ তোমরা?”

আকাশের দিকে হাত তুলে দেখাল সংগ্রাম, “ঐখানে, অনেক দূরে একটা গ্রহ আছে, কেপলার ২২বি। সেটা আকারে পৃথিবীর দ্বিগুণ, ঘন ট্রপিক্যাল এলিয়ান জঙ্গলে ঢাকা, সম্পদে পরিপূর্ণ। সেইখানে নামবে আমাদের জাহাজ।”

“স্পেসশিপ?”

“হ্যাঁ। ২০৬০ সালে গোটা পৃথিবীরব্যাপি একটা হিউম্যান জিনোম প্রোজেক্ট হয়েছিল মনে আছে? সেই প্রজেক্ট থেকে ১৬৭ জন মানুষকে বাছা হয়, তাঁদের সেরা মানের জেনেটিক সিকয়েন্সের জন্য। কিন্তু এতো বড় প্রোজেক্ট লোকচক্ষুর আড়ালে করা সম্ভব ছিল না, তাই ইউএন আমাদের কাছে হাত পাতে, বিশ্বের প্রত্যেক ধনকুবেরের কাছে। পরিবর্তে আমরা পাই এই দুনিয়া থেকে পালাবার একটা সুযোগ। নিউক্লিয়ার প্রপালশনের মাধ্যমে আমাদের জাহাজ আলোর আশি শতাংশ বেগ নিয়ে ছুটে যাবে ওই গ্রহান্তরের দুনিয়ায়। সময় লাগবে অর্ধশতাব্দী।”

সংগ্রাম কেন যাজ্ঞসেনীকে নিয়ে যেতে এতো উদগ্রীব আমি বুঝতে পারলাম। প্রত্যেক মানুষই চায় তার একটা অংশকে কালজয়ী করতে। কেউ তা লাভ করে তার লেখার মাধ্যমে, কেউ বা পায় অমরত্ব তার শিল্পকলায়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তার অংশ রেখে যায় তার বংশধরদের মধ্যে, তাদের জেনেটিক কোডে, রক্তের সম্পর্কে। সংগ্রামের নিজের কেউ নেই, কিন্তু তার পূর্বপুরুষের রক্ত বইছে এক সদ্যজাতের ধমনীতে।

প্রত্যেক বাবা-মাই চায় তার সন্তানের জন্য এক সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার। আমরা সেই ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন সংগ্রামের কাঁধে। এক সম্পূর্ণ নতুন দুনিয়ায় আমার প্রৌঢ়া মেয়ে সংগ্রামের অস্থিভস্ম নিয়ে নেমে ঠিক কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে আমরা জানি না। তার গোটা শৈশব কেটে যাবে জানলার বাইরের অগুন্তি ধাবমান নক্ষত্র গুনে, সংগ্রামের কাছে তার ফেলে আসা জগতের গল্প শুনে। সে হয়তো রবীন্দ্রনাথ কে জানবে না, জানবে না তার পূর্বপুরুষরা স্পর্ধা দেখিয়েছিল মাহাজাগতিক ব্রহ্মকণা কণা বোসনের অস্তিত্ব জানার।

হয়তো জানবে। সংগ্রামের কথা ঠিক ধরলে ওই যানের হৃদয়ে রাখা এক সুবিশাল ড্রাইভ, মানুষের যাবতীয় লব্ধ জ্ঞানের ডিজিটাল সঞ্চয়। কে জানে, হয়তো স্টিফেন হকিংয়ের ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইমের’ পাশে স্থান পেয়েছে সত্যজিৎ রায়ের ‘বৃহচঞ্চু’?

একটা ভেপার কোণ তৈরি করে প্লেনটা আকাশে মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেলেও আমরা রানওয়ে ছাড়লাম না। এখানে ঠাণ্ডা এস্ফ্যাল্টের উপরে বসে উপরে তাকালে অনেকখানি আগুনে রাঙা আকাশ দেখা যায়। একটা মাক্‌ ২৫ বিমানের লো আর্থ অরবিটে গিয়ে আবার মারিসাসে রি এন্ট্রি নিতে কত সময় লাগবে? আশা করি ওদের হাতে সময় আছে। আশা করি পৃথিবীর আয়ু আছে ততটুকু। বিমান বন্দরের উন্মুক্ত ক্যাফেটেরিয়া থেকে ট্রলি করে প্রায় বিয়েবাড়ির ভোজ নিয়ে এলো ঊর্মি। “এতো ফাঁসির খাবার,” বলেই বুঝলাম জোকসটা যথাযথ হল না। “সরি, ঊর্মি।”

“সপ্তক, শোননি? যেতে হয় পেট ভরে খেয়ে, হাসতে হাসতে।”

শেষ হ্যাম স্যান্ডউইচটা উদরস্থ করে অনুভব করলাম ভারশূন্যতা প্রকট হচ্ছে। এক আদিম অপদেবতা দ্রুত এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। সূর্যের উলটো দিকে থাকা সত্ত্বেও বাঁচেনি মঙ্গল। এনএস৩৩-র প্রকোপে তার কক্ষপথ টলে গেছে। সে এখন প্রহর গুনছে সূর্যের বুকে আছড়ে পড়ার। বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তাঁদের শব পাক খাচ্ছে এনএস৩৩-র চারপাশে, যতক্ষণ না এই নিউট্রন স্টার টেনে নেবে সেই টুকরোগুলোকে তার অতি ভারী হৃদয়ে। এই মহাকাশের ৯.২ বিলিয়ানতম জন্মদিনে যে নক্ষত্রজগতের সৃষ্টি, সেই সৌরজগত মিলিয়ে যাবে কালের গর্ভে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। গোটা মহাবিশ্ব জানতেও পারবে না এইখানে মানুষ বলে একটা প্রজাতির উত্থান ঘটেছিল। তারা যুদ্ধ করেছে, বইয়েছে রক্তের বন্যা, কিন্তু তারা ভালোও বেসেছে, করেছে অমর সৃষ্টি। আমার মনে পড়লো বছর তিনেক আগের মোনালিসার রহস্যময় ভাবে চুরি হয়ে যাওয়ার কথা, অথবা জনগণের দাবি অগ্রাহ্য করে ভারত সরকারের পাকিস্থান আক্রমণ করে সিন্ধু সভ্যতার যাবতীয় নিদর্শন লাহোর মিউজিয়াম থেকে এই দেশে তুলে আনার। তারা নয়টি স্তূপ খনন করে বুদ্ধের দেহাবশেষ তুলে এনেছিল হয়তো এই কারণেই।

গুহাবাসী মানুষ যখন প্রকৃতির রোষের সামনে পড়েছিল, জন্ম হয়েছিল প্রথম দেবতার। আজ সহস্র বছর পরেও, মহাবিশ্বের গোপনতম রহস্যের সমাধান করেও সে অগ্রাহ্য করতে পারেনি অবিনশ্বরের আহ্বান। যে মানুষগুলো অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষগুলোকে দেখিয়েছিল সামনে এগোনোর মঝঝিমপন্থ, তাঁদের কী করে ফেলে আসা যায় পুরনো পৃথিবীতে? মানুষের উদ্বর্তনের সাক্ষী যে পুরাত্বাত্তিক নিদর্শন, তাদেরই বা রেখে আসা যায় কীভাবে? মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ তার সৃষ্টি করার আকাঙ্ক্ষা। ল্যুভর এবং লুম্বিনি তাই স্থান পেয়েছে এক ইনটারস্টেলার যানের গর্ভে।

আমার ফোনের রেডিও এখন বলছে, “বন্ধুরা, একটু আগে আমাদের স্যাটেলাইট খবর দিয়েছে যে পৃথিবীর সঙ্গে এনএস৩৩-র সাক্ষাৎ হয়ছে। আমি ইউনিস, আবার দেখা হবে আমাদের, হয়তো অন্য কোন গ্রহে, অন্য কোন জন্মে। যে নক্ষত্রধূলিকণাগুলি সঙ্গবদ্ধ হয়ে আমাদের সৃষ্টি করেছিল তাদের নিজের স্রষ্টার কাছে শক্তি রূপে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ‘লেলিহ্যসে গ্রসমানঃ সমন্তাল্লোকান্‌ সমগ্রান্বদনৈর্জ্বলদ্ভিঃ। তেজোভিরাপূর্য জগৎসমগ্রং ভাসস্তবোগ্রাঃ পতপন্তি বিষ্ণো।।’ বিদায়...”

রেডিও চুপ করে যাওয়ার আগে শেষবারের মত মনে করিয়ে দিয়ে গেল কেন আমরা ভারতীয়, কেন আমাদের ধার্মিক পরিচয় গৌণ আমাদের জাতীয় পরিচয়ের কাছে।

মাটি ফাটছে আমাদের চারপাশে, ভলকে ভলকে পৃথিবীর গলিত ম্যান্টেল ঠেলে উঠছে আমাদের চারপাশে। ঐরাবতের শুঁড়ের মত সেই আগুন উঠছে বিলীন হওয়া আকাশের দিকে। মেঘ মুছে গেছে অনেকক্ষণ, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে আমাদের। পায়ের তলার জমি বিদায় নিল আমাদের থেকে। আমরা উঠছি ওই শুঁড়গুলোর একটার দিকে। উপরে, আরও উপরে। আগুনের হল্কা ফোস্কা ফেলে দিয়েছে আমাদের সর্বত্র, ঊর্মি আঁকড়ে ধরে আমাকে, আর আমার চোখ দিগন্তের দিকে। শেষ বারের মত বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম আমি। পলকের জন্য এক অতিকায় দণ্ড চোখে পড়লো আমার, দক্ষিণের দিকে। বায়ুশূন্য আকাশের জন্য এই উচ্চতা থেকে অনেকদূর দেখা যায়। পায়ের নিচের কলকাতা এখন নরক। উন্মুক্ত ধমনির মত লাভা ঠেলে উঠছে তার প্রত্যেক কোষে। মানুষের শব্দ শুনতে পাচ্ছি না আমি, ৪২ও গুঁড়িয়ে যাওয়ার সময় মূক। নিস্তব্ধতার পর্দার মুড়ে আমার পৃথিবী বিলীন হচ্ছে। তার অন্তিম সঙ্গীত অন্তর্হিত হয়েছে মহাবিশ্বের শূন্যতায়। মহাকাশযানটাকে এবার দেখতে পেলাম আমি। তার অতিকায় সিলিন্ড্রিকাল অবয়ব মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে, এই ধ্বংসলীলাকে পেছনে ফেলে এক নতুন বাসস্থলের সন্ধানে – মানুষের অন্তিম অডিসি, যার শুরু হয়েছিল আফ্রিকার রিফট ভ্যালি থেকে বেরনোর সময়। যোগ্যতমের উদ্বর্তনের মাপকাঠি এখন অর্থনীতি ঠিক করে দিয়েছে। আমার বুকের কাছে ঊর্মি বায়ুর অভাবে ছটফট করছে। চোখ বন্ধ করে ওকে শেষবারের মত চুমু খেলাম। শ্বাস বায়ুর আদানপ্রদানের জন্য শেষবার স্বাদ পেলাম ওর শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটের।

বিদায়, যাজ্ঞসেনী। এক ফুরিয়ে যাওয়া জগতের শেষ অক্সিজেন আজ তোমার হিমোগ্লোবিনে বন্দি। আপাতত।