অন্তিম উপহার - শিমুল মন্ডল

গল্প

২৫শে মার্চ, সোমবার, ২০৭৫ খ্রিষ্টাব্দ। নিজের বসার ঘরের প্রিয় কাউচটায় আধশোয়া হয়ে ভ্রু কুঁচকে সামনের হলোগ্রাফিক পর্দায় চেয়ে আছেন প্রফেসর লি ওয়েনল্যাং । পর্দা জুড়ে রয়েছে পৃথিবীর একটা মানচিত্র। মানচিত্রটা দেখে নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায় প্রফেসর লি’র। পৃথিবীটা আর আগের মত নেই, ভেবে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি। তার ছোটবেলায় পৃথিবীর মানচিত্রে সাতটা মহাদেশ ছিল, আর এখন আছে মাত্র পাঁচটা। এন্টার্কটিকের বরফ গলে পুরো মহাদেশটা নেই হয়ে গেছে আরো ত্রিশ বছর আগে। সেই বরফ গলা পানির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে ডুবে গেছে পুরো ওশেনিয়া। সাথে সাথে আফ্রিকা আর এশিয়ারও অনেক দেশ এখন সমুদ্রের তলায়। তবে আপাতত প্রফেসর লি’য়ের ভাবনার বিষয় সেটা নয়, বরং তাকে ভাবিয়ে তুলেছে মানচিত্র জুড়ে লাল লাল ছোপ গুলো। পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা কয়েক ডজন হেলথ স্যাটেলাইটের পাঠানো তথ্য থেকে এই মানচিত্রটা প্রতি মিনিটে হালনাগাদ করা হচ্ছে, আর প্রতিবারেই লালের সংখ্যা যেন বেড়েই চলেছে জ্যামিতিক হারে।

এই হেলথ স্যাটেলাইট গুলো মূলত নিওজেনেসিস কর্পোরেশনের অধীনে কাজ করে। প্রফেসর লি নিজেও একসময় নিওজেনেসিস কর্পোরেশনের অংশ ছিলেন। বলা চলে আজ থেকে তিন দশক আগে নিজের হাতেই তিনি এই কর্পোরেশনের ভিত্তি দাঁড় করিয়েছিলেন। প্রধান গবেষক হিসাবে শুরু করে সিইও হওয়া পর্যন্ত প্রায় পয়ত্রিশ বছর নিওজেনেসিসের অপরিহার্য সদস্য ছিলেন তিনি। কিন্তু বিগত পাঁচ বছরে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে, বয়সের ভারে সিইও এর পদ থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি, তারপর নানা হাত ঘুরে মালিকানার পরিবর্তন হয়ে নিওজেনেসিস এখন পরিণত হয়েছে একটি বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থায়। প্রফেসর লি’য়ের এখন মনে হয় নিওজেনেসিস যেন দিনে দিনে মানব সেবার চেয়ে ব্যবসার দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েছে।

সাম্প্রতিক কয়েক মাসের ঘটনায় সেটা যেন আরো বেশি করে বোধগম্য হচ্ছে, শুধু তার কাছেই না, বাকি পৃথিবীর কাছেও। নিও জেনেসিস কর্পোরেশনের প্রধান প্রডাক্ট বা সেবা হল নিওবায়োটিকস। প্রায় চল্লিশ বছর আগে যখন গ্লোবাল ওয়ার্মিং আর প্রকৃতির উপর নির্বিচারে ধ্বংসলীলা চালানোর ফলে একের পর এক নতুন নতুন সুপার ব্যাকটেরিয়া আর সুপার ভাইরাসের আক্রমণ বেড়ে গেল পৃথিবীজুড়ে, তখন মানুষের হাতে থাকা অ্যান্টিবায়োটিক ও কাজ করা বন্ধ করে দিল। ঠিক এমন একটা সময়েই প্রফেসর লি ও তার দল নিওবায়োটিকসের ধারণা নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। তাদের লক্ষ্য ছিল কম্পিউটার প্রোগ্রামের জন্য যেমন এন্টিভাইরাস থাকে, তেমনি মানব শরীরের জন্যেও একধরনের কৃত্রিম রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরী করা। প্রফেসর লি জানতেন এর সমাধান আছে ন্যানো টেকনোলজির মধ্যে। তিনি ও তার দল প্রথমেই তাই এমন একধরনের ন্যানো রোবট তৈরী করেন যাদের আকার মানুষের রক্তকনিকার চেয়েও ছোট। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এমন কয়েক বিলিয়ন রোবটের একটা দলকে কোন মানুষের দেহে প্রবেশ করিয়ে দিলে সেই মানুষটার কোন সমস্যা হয় না, আর রোবটগুলো ওর রক্তের শর্করা থেকে শক্তি সংগ্রহ করে দিনের পর দিন চালু থাকতে পারে। আর সবথেকে বড় দিক হল এই রোবটগুলো মানব শরীরের উপাদান ব্যবহার করে নিজের রেপ্লিকাও তৈরী করতে পারে।

এরপরের কাজ ছিল এই ন্যানো রোবটের দলকে প্রোগ্রামিং করে শরীরের ভিতরের ক্ষতিকারক কোষ চেনানোর ব্যবস্থা করা আর চিহ্নিত হলে ক্ষতিকারক কোষগুলোকে ধ্বংস করার নির্দেশ প্রদান করা। বছর কয়েকের মধ্যে সে কাজেও সফল হন প্রফেসর লি। তাছাড়া এমন একটা ব্যবস্থাও তারা করেছিলেন যেখানে নতুন কোন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস শনাক্ত হবার সাথে সাথে সেটার জেনেটিক কোড আপলোড করে দেয়া হয় নিওবায়োটিকের সেন্ট্রাল সার্ভারে, এটাকে বলে নিওআপডেট। মানুষ চাইলেই একটা নির্দিষ্ট টাকা দিয়ে নিজেদের শরীরে থাকা নিওবায়োটিক রোবটদের প্রোগ্রাম আপডেট করে নিতে পারে। সেসময়ে এই আবিষ্কারের পিছে জলের মত টাকা খরচ করেছিল নিওজেনেসিস কর্পোরেশন। এর পরের কয়েক বছরে অবশ্য সেই খরচের কয়েকশত গুণ টাকা আয় করেছে তারা। এখন তো সরকারিভাবেই শিশু জন্মের পর পর নিওবায়োটিকসের টিকা দেওয়া হয়, এছাড়া ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমেও একজনের শরীর থেকে আরেক জনের শরীরে যেতে পারে নিওবায়োটিক রোবটের দল। এখন, এই চল্লিশ বছর পর এসে পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যার শরীরে নিওবায়োটিক রোবটের দল নেই।

এতদিন পর্যন্ত সব কিছু মোটামুটি ঠিকই ছিল। ঝামেলার শুরু হয়েছে এবছরের ফেব্রুয়ারি থেকে। এবারের শীতে যখন আফ্রিকা থেকে নতুন ধরনের এই সুপার বাগ বা জীবাণু, বিজ্ঞানীরা যেটার নাম দিয়েছেন “ক্লারা—৭৫”, সেটা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল তখন কোন এক অজানা কারণে হুট করেই ক্লারার জন্য তৈরী করা নিওবায়োটিক আপডেট এর দাম এক ধাক্কায় বাড়িয়ে একশোগুণ করে দেওয়া হল। প্রফেসর লি শুনেছেন নিওজেনেসিস এর নতুন সিইও অ্যাডাম ওয়েশাপ্ট এর বিজনেজ প্ল্যান এটা। লোকটা জাতে জার্মান আর ভীষণ রকমের নাক উঁচু আর ভয়াবহ উচ্চাকাঙ্ক্ষী ধরনের বলে শুনেছেন তিনি। দাম বেড়ে যাওয়ায় এবারে এক বছরেই হয়তো বিগত দশ বছরের সম্মিলিত লাভের চেয়েও বেশি লাভ করবে নিওজেনেসিস। কিন্তু এই লাভের মূল্য দিতে হবে পৃথিবীর সাধারণ মানুষকে। উচ্চ মূল্যে আপডেট কিনতে না পারায় পৃথিবী জুড়ে হু হু করে বেড়ে চলেছে ক্লারার প্রকোপ। এই মুহূর্তে হলোগ্রাফিক মানচিত্রে তাকিয়ে ক্লারার পরিস্থিতিই দেখছিলেন প্রফেসর লি। মানচিত্রে এক একটা লাল ফোঁটার মানে হল এক একজন নতুন ক্লারা আক্রান্ত মানুষ। সময়ের সাথে যেভাবে লালের পরিমাণ বাড়ছে তাতে করে খুব দ্রুতই যে লাখে লাখে মানুষ মারা যাবে সে ব্যাপারে কোন ভুল নেই।

এমন পরিস্থিতিতে প্রফেসর লি খুব অসহায় বোধ করছেন। একজন মানুষের লোভের বলি হয়ে চোখের সামনে এভাবে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু দেখতে হবে ভাবতেই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে তার। কিন্তু কী বা করার আছে তার? নিও বায়োটিকসের আবিষ্কারক হলেও এখন আর নিওজেনেসিস বা ওয়েশাপ্ট এর কাছে তার কোন দাম আছে বলে মনে হয় না। তবু একবার শেষ চেষ্টা হিসাবে ওয়েশাপ্ট এর সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।

দুপুর দুটো বেজে দশ মিনিট, নিও জেনেসিস এর হেডকোয়ার্টারে নিজের বিশাল রুমে বসে আছেন অ্যাডাম ওয়েশাপ্ট । তার সামনেও একটা হলোগ্রাফিক পর্দায় পৃথিবীব্যাপী ক্লারা সংক্রমণের বর্তমান চিত্র দেখা যাচ্ছে। যত মানুষ সংক্রমিত হয়েছে তার যদি অর্ধেক মানুষও তার ঠিক করা দামে নিওবায়োটিকস এর আপডেট নেয়, তবে পৃথিবীর ইতিহাসে নিওজেনেসিস হবে সর্বকালের সবথেকে সফল কর্পোরেশন আর তিনি হবেন পৃথিবীর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সিইও। তবে এটা তার লক্ষ্য নয়, তার মনের গভীর ইচ্ছের কথা কেউ জানে না, যেমন জানে না তার আসল পরিচয়টাও। সেটা তিনি নিজেই ঘটা করে জানাবেন, যখন তার ইচ্ছে পূরণ হবে। এমন একটা সময়ে এসে বারবার নিজের পূর্ব পুরুষদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তার। নতুন এক একক পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন তো তারাই দেখেছিলেন প্রথম। আর আজকে তাদের সেই স্বপ্ন পূরণের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আর মাত্র কয়েকটা সপ্তাহ, খুব দ্রুতই পৃথিবীর জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে। আর তারপরই শুরু হবে তার আসল খেল।

কমিউনিকেশন মডিউলে ব্যক্তিগত সহকারীর কণ্ঠ শুনে নিজের কল্পনা ছেড়ে বাস্তবে ফিরে এলেন ওয়েশাপ্ট। সহকারী জানালো নিওজেনেসিসের সাবেক সিইও প্রফেসর লি ওয়েনল্যাং তার সাথে কথা বলতে চান। মনে মনে একটু অবাক হলেন তিনি, প্রফেসর লি’কে তিনি খুব ভালো করেই চেনেন। এক কালে লোকটার অনেক ক্ষমতা ছিল, নিওবায়োটিক এর জন্ম এই লোকটার হাত ধরেই। কিন্তু এখন নিজের সব সম্পদ দান করে দিয়ে একা একা এক মফস্বল শহরে গিয়ে আস্তানা গেড়েছেন। দেখা যাক কী চায় লোকটা তার কাছে, তিনি সহকারীকে লাইন দিতে বললেন, কমিউনিকেশন মডিউলে প্রফেসর লি’র কণ্ঠ ভেসে এল

—হ্যালো আমি প্রফেসর লি ওয়েনল্যাং বলছি।

—কী বলবেন বলুন, আমি শুনছি।

—আমি একটা অনুরোধ করার জন্য আপনাকে ফোন করেছি। আপনি দয়া করে নিও বায়োটিকস এর আপডেট এর মূল্য সবার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নামিয়ে আনুন।

—সেটা সম্ভব নয়।

—কেন জানতে পারি?

—সেটা আলাদা করে বলার কী আছে, লাভ করতে কে না চায়?

—কিন্তু এটাকে লাভ না বলে লোভ বলেই মনে হচ্ছে।

—সে আপনি যা মনে করতে চান, করতে পারেন।

—রাগ করবেন না। লক্ষ কোটি মানুষের জীবন আজ আপনার হাতে, দয়া করে তাদের কথাটা একবার ভাবুন।

—ভেবেছি অনেক আগেই। দেখুন আমি বিশ্বাস করি যার যোগ্যতা নেই তার এই পৃথিবীতে না থাকাই উচিৎ।

—সেই যোগ্যতার মাপকাঠি কি টাকা?

—অবশ্যই, আমি তাই মনে করি। টাকা কামাতে যোগ্যতা থাকতে হয় এটা চিরন্তন সত্য।

প্রফেসর লি বেশ বুঝতে পারলেন এভাবে কথা বলে কাজ হবে না। তার এখন লোকটাকে বদ্ধ উন্মাদ বলে মনে হচ্ছে। এধরনের লোক সবকিছুকেই আর্থিক লাভ ক্ষতি দিয়ে বিবেচনা করে। অনেক ভেবে প্রফেসর লি আবার বললেন

—দেখুন আপনি যদি দাম না কমান তবে মানুষ কিন্তু একসময় নিওজেনেসিসকে ছেড়ে অন্য কারো দিকে ঝুঁকে পড়বে।

এই কথায় মনে হল কিছুটা কাজ হয়েছে। খানিকটা সময় চুপ করে থেকে ওয়েশাপ্ট বললেন

—আপনি কি আমায় হুমকি দিচ্ছেন প্রফেসর?

—না হুমকি না, বরং আমি আপনাকে সুবুদ্ধি দিচ্ছি আর অনুরোধ করছি আপনার সিদ্ধান্ত আরেকবার ভেবে দেখার জন্য।

—আচ্ছা, আমি বিষয়টা আরেকবার ভেবে দেখব, কোন ভাল খবর থাকলে কালকের মধ্যেই পাবেন।

—ধন্যবাদ।

কমিউনিকেশন মডিউলের লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। নিজের চেয়ারে বসে কিছুটা সময় গভীর চিন্তা করলেন ওয়েশাপ্ট। এত বছর ধরে নিওজেনেসিস আর নিওবায়োটিকস যে বাজারে একছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছে তার কারণ হল বাজারে নিওবায়োটিকসের কাছাকাছি আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী সিস্টেম নেই। ওয়েশাপ্ট খুব ভালো করে জানেন নিওবায়োটিকস এর মত আরেকটা সিস্টেম দাঁড় করাতে হলে সেটা একমাত্র প্রফেসর লি’য়ের সাহায্যেই সম্ভব। লোকটা যে এই বয়সেও এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে সেটা ওয়েশাপ্ট আশা করেননি। প্রফেসর লি’র উপর নজর রাখার জন্য অবশ্য নিওজেনেসিস এর একটা টিম কাজ করে, নিজেদের বিজনেস সিক্রেট রক্ষার জন্যই এটা করতে হয় । তবে আজকে প্রফেসর লি’র ফোন পেয়ে ওয়েশাপ্ট এর মনে হচ্ছে শুধু লক্ষ্য রাখাটাই যথেষ্ট নয়। যে কাজে তিনি নেমেছেন, তার জন্য বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নেয়াও চলবে না। ভাবনা থামিয়ে নিজের ব্যক্তিগত এনক্রিপ্টেড কমিউনিকেশন চ্যানেল চালু করলেন ওয়েশাপ্ট। তারপর প্রফেসর লি’র নাম আর ছবি দিয়ে একটা বার্তা পাঠালেন বিশেষ একজনের কাছে, শেষে লিখলেন “যত দ্রুত সম্ভব” । যাকে পাঠালেন তার প্রতি পূর্ণ আস্থা আছে ওয়েশাপ্ট এর। লোকটা কখনো তাকে নিরাশ করেনি। আশা করা যায় আজকে রাতের মধ্যেই প্রফেসর লি এর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এমন প্রচ্ছন্ন হুমকির পর প্রফেসর লি’কে আর বাঁচিয়ে রাখা চলে না।

রাত এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট, প্রফেসর লি ওয়েনল্যাং এর বাংলো। রোজকার মত আজকেও রাত দশটা বাজতেই নিজের ডুপ্লেক্স কন্ডোর দোতলায় নিজের বেডরুমে ঘুমাতে গিয়েছিলেন প্রফেসর লি। রাতে এই বাড়িতে তিনি ছাড়া আর কেউ থাকে না। সারাজীবন গোপনীয়তা আর নির্জন পরিবেশে চিন্তার সুবিধার জন্য একা একা থাকাই অভ্যেস করেছেন, তাই এখন আর কোন সমস্যা হয় না। কিছু সময় বিছানায় এপাশ ওপাশ করার পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছেন টের পাননি। হঠাৎ একটা কাঁচ ভাঙ্গার শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল প্রফেসরের। শব্দটা এসেছে নিচে তার বসার ঘর থেকে। বিছানার পাশে রাখা জলের গ্লাসটা তুলে নিয়ে এক চুমুকে সেটা শেষ করলেন, তারপর গায়ের নাইট গাউনটা ঠিক করে নিয়ে বিছানা থেকে পা নামিয়ে বসলেন। নিচে যাবার দরকার নেই, তিনি জানেন যে এসেছে সে তাকে খুঁজতেই এসেছে আর কিছু সময়ের মধ্যে এই ঘরেই আসবে সে। তার উপরে যে দীর্ঘদিন থেকে গোপনে গোপনে নজর রাখা হয় সেটা তিনি জানেন।

বেড রুমের সামনে পায়ের চাপা শব্দ শোনা গেল, প্রফেসর শক্ত গলায় বললেন —ভিতরে আসুন, লুকোছাপার দরকার নেই, দরজা খোলাই আছে । প্রফেসরের কথা শেষ হতে দরজা ঠেলে একজন দীর্ঘদেহী লোক ঘরে ঢুকল। লোকটার মুখ কালো মুখোশে ঢাকা, চোখে নাইট ভিশন গগলস। তবে তার ডান হাতে স্বাভাবিকভাবে ধরা সাইলেন্সার লাগানো অটোমেটিক পিস্তলটা দেখেই বোঝা যায় সাধারণ চোর—জোচ্চর এ নয়, এ হল মৃত্যুর দূত। প্রফেসর লি’র চেহারা দেখে মনে হল না যে তিনি ভয় পেয়েছেন। বরং শান্ত কণ্ঠে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলেন

—ওয়েশাপ্ট পাঠিয়েছে নিশ্চয়ই?

জবাবে লোকটা কোন কথা বলল না। প্রফেসর লি বুঝলেন এ লোক পেশাদার, কে পাঠিয়েছে তার নাম কোনভাবেই বলবে না। দুকাঁধ একটু উপরে তুলে শ্রাগ করলেন প্রফেসর। তারপর বিছানার পাশের টেবিলের উপর রাখা একটা নীল খামের দিকে ইশারা করে আততায়ীকে বললেন

—তোমার কাজ শেষ হলে যাবার সময় ওই চিঠিটা নিয়ে যেও, যে তোমাকে পাঠিয়েছে তাকে দিও ওটা। ধরে নাও এটাই আমার শেষ ইচ্ছে।

আততায়ী লোকটা এবারে নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। তারপর হাতে ধরা অটোমেটিক এর ট্রিগারে ছোট্ট দুটো টান দিল। বিছানার উপর বসা অবস্থায় দুবার কেঁপে উঠলেন প্রফেসর লি। তারপর ঢলে পড়লেন বিছানার উপর। দ্রুত হাতে টেবিলের উপর থেকে চিঠির খামটা তুলে নিল আততায়ী, তারপর গ্লাভসে ঢাকা দুই আঙ্গুল দিয়ে প্রফেসরের খোলা চোখ দুটো বন্ধ করে দিল। সে পেশাদার মানুষ, দুর্বলতা তার চরিত্রের ধরণ নয়। তবু এই লোকটাকে খুন করে একটু যেন মন খারাপ হল তার, শত হলেও এই লোকটার আবিষ্কার করা নিওবায়োটিকস না থাকলে হয়তো সে নিজেও এতদিন বেঁচে থাকত না। দ্রুতই মনের দুর্বল ভাবটা দূর করে যে পথে বাড়িতে ঢুকেছিল, সেই একই পথে বেরিয়ে গেল লোকটা। আর তার মিনিট পাঁচেক পরেই কিচেনের গ্যাস সিলিন্ডারটা বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে গেল পুরো বাড়িতে।

২৬ শে মার্চ, দুপুর বারোটা, যথারীতি নিওজেনেসিস এর হেডকোয়ার্টারে নিজের রুমে বসে আছেন ওয়েশাপ্ট। তার মনটা আজ ভীষণ ফুরফুরে। কাজটা হয়ে গেছে কাল রাতেই, সকাল থেকে টেলি নেটওয়ার্কেও দেখাচ্ছে খবরটা। পুলিশ সন্দেহ করছে গ্যাস লিকেজ থেকে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। পুরো বাড়িটা এমন ভাবে পুড়ে গেছে যে এর থেকে বেশি কিছু জানা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হেঁটে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন ওয়েশাপ্ট। তারপর বুক পকেট থেকে নীল খামটা বের করলেন। খামটা তাকে আজ সকালে পৌঁছে দিয়ে গেছে কেউ একজন, ওয়েশাপ্ট জানেন কে সে, তবে নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের দুজনের কেউই কারো সাথে সরাসরি দেখা করেননি কোনদিন। চিঠির খামটা ছিঁড়ে চিঠিটা পড়া শুরু করলেন তিনি, সম্বোধন অংশে নিজের নামটা দেখে বেশ অবাক হলেও পড়া থামালেন না

মিঃ ওয়েশাপ্ট,

এই চিঠি আপনার হাতে পৌঁছনোর মানে হল সম্ভবত আমি আর বেঁচে নেই। আজ দুপুরে আপনার সাথে যখন কথা হল, আর আপনি ভেবে দেখার জন্য সময় চাইলেন, তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। আপনি নিপুণ কর্মদক্ষ লোক, তাই খুব বেশি সময় যে হাতে নেই সেটাও জানতাম। আসলে কাজটা করে আপনি আমার আর বিশ্ববাসীর উপকারই করেছেন।

চোখের সামনে এমন লক্ষ কোটি মানুষের মৃত্যু আমি মেনে নিতে পারতাম না, কিছু একটা আমাকে করতেই হত। মিঃ ওয়েশাপ্ট আপনি তো জানেন, নিওবায়োটিকস এর সৃষ্টিকর্তা আমি। এর ডিসাইন থেকে শুরু করে প্রোগ্রামিং সবই আমার হাত দিয়েই হয়েছে। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের এক রাতে আমি যখন ল্যাবে একা একা বসেছিলাম ঠিক তখনই আমার মাথায় এই চিন্তাটা প্রথম আসে। আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছিলাম একদিন না একদিন আপনার মত কোন এক লোভী নিষ্ঠুর পাগলের কুক্ষিগত হবে নিওবায়োটিকস। বিজ্ঞান আর পৃথিবীর ইতিহাস তাই বলে। এখন পর্যন্ত যত আবিষ্কার মানুষের কল্যাণে করা হয়েছে, এক সময় না এক সময় তা ব্যবহৃত হয়েছে মানুষেরই বিরুদ্ধে, মানুষের সীমাহীন লোভ পুরণের জন্য। তাই আমি সেই সময়ে নিওবায়োটিকসের প্রোগ্রামে কিছু পরিবর্তন করি। আর পরিবর্তনটা এমনভাবে এনক্রিপ্ট করে প্রোগাম এর মাঝে সেট করি যেন তা ধরা পড়ার কোন সম্ভাবনা না থাকে।

নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে কী সেই পরিবর্তন? এখন আর সেটা জানাতে কোন সমস্যা নেই, কারণ সেটা পরিবর্তন করার ক্ষমতা এখন আর কারো নেই, আমার তো নেইই। যাহোক ছোট্ট করে বলি, আপনি তো জানেন মানব শরীরের এন্টিবডির মত আচরণ করতে পারে নিওবায়োটিকস। আজকে জেনে রাখুন প্রাকৃতিক এন্টিবডিকে দেখে দেখে তার কাছ থেকে শিখতেও পারে সে। মানেটা বুঝতে পারছেন আশা করি। মানেটা হল নতুন কোন ভাইরাসের মোকাবিলা করার জন্য নিওবায়োটিকস শুধুমাত্র সেন্ট্রাল সার্ভারের উপরেই নির্ভরশীল নয়, প্রয়োজন হলে সে সেন্ট্রাল সার্ভারের সাহায্য ছাড়াও কাজ করতে পারে। কোন নতুন ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কোন না কোন মানুষের দেহে এন্টিবডি তৈরি হবেই। শরীরে নিওবায়োটিকস আছে এমন কারো শরীরে যদি প্রাকৃতিকভাবে এন্টিবডি তৈরী হয় তবে নিওবায়োটিকস সেটা খুব সহজেই শিখে নেবে। সেন্ট্রাল সার্ভার এর সাহায্য ছাড়াও নিওবায়োটিক রোবটেরা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে, এমনকি একটি মানুষের দেহে থাকা নিওবায়টিক রোবটেরা যোগাযোগ করতে পারে আশে পাশে থাকা অন্য মানুষের দেহের নিওবায়োটিক রোবটদের সাথে।

নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এর মানেটা কী। কোন একজন মানুষের দেহে এন্টিবডি তৈরি হলে ভাইরাসের মতই ছোঁয়াচেভাবে সেই ফর্মুলাটা ছড়িয়ে পড়তে পারে মানুষ থেকে মানুষে। এখন হয়তো আপনার মনে প্রশ্ন জাগছে এমন কিছু যদি থেকেই থাকে তবে এত দিন সেটা কেন বোঝা যায়নি বা জানা যায়নি? কারণটা সহজ, এতদিনে নিওবায়োটিক রোবটের দল একবারের জন্যেও তাদের এই ক্ষমতা ব্যাবহার করেনি। কিন্তু এখন করবে, কারণ এখন আমি মৃত। ওদের প্রোগ্রামটা এভাবেই করেছিলাম আমি। আমি যখন মারা গেছি তখন আমার শরীরের নিওবায়োটিকেরা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আর ওরা কাজ বন্ধ করার পর বারো ঘন্টার মাঝে যদি আবারো চালু হয়ে সেন্ট্রাল সার্ভারে যোগাযোগ না করে তবে পৃথিবীর সকল নিওবায়টিক রোবট আমার তৈরী করা সেই অটোমেটিক মোডে চলে যাবে...

বাকি চিঠিটা আর পড়া হল না ওয়েশাপ্ট এর, চিঠিটা ছুড়ে ফেলে কব্জির ঘড়িটার দিকে তাকালেন। বারো ঘন্টা পেরিয়ে গেছে এরই মধ্যে। দ্রুত ছুটে গিয়ে হলোগ্রাফিক পর্দার সামনে দাঁড়ালেন ওয়েশাপ্ট। তার চোখের সামনে একে একে মানচিত্রের লাল দাগগুলো সবুজ হতে শুরু করেছে এরই মধ্যে।

তীব্র হতাশায় ওয়েশাপ্ট দুহাতে নিজের মাথার চুল নিজেই খামচে ধরলেন। হেরে গেছেন তিনি, হেরে গেছেন একটা মাত্র বুড়ো মানুষের কাছে। নিজের জীবনের বিনিময়ে মানব জাতিকে শুধু এবারের মতই রক্ষা করেননি প্রফেসর লি ওয়েনল্যাং, বরং মানব জাতিকে উপহার দিয়ে গেছেন এমন এক অস্ত্র যা ভবিষ্যতেও তাদের আগলে রাখবে ভয়ানক জীবাণু আর ওয়েশাপ্ট এর মত লোভী নিষ্ঠুর মানুষদের থেকে। মানব জাতির জন্য এটাই তার অন্তিম উপহার।