প্রত্যেকটা বছর একটু একটু করে কমতে থাকে আমার প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রছাত্রী সংখ্যা, একজন-দুইজন করে মুছে যেতে থাকে স্মৃতি থেকে। আজ আমরা ডেস্কগুলোকে বৃত্তাকারে সাজিয়েছি; আমাদের শিক্ষিকা, মিস সাদিয়া, বলছেন যে সিন্থিয়া এই দুনিয়ার চাইতে অনেক উত্তরে একটা জায়গায় গিয়েছে।
গতকাল রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছিল মেয়েটা, একটা গাড়ি ছুটে এসে চাপা দিয়ে ওকে মেরে ফেলে। মেয়েটা হাসিখুশি ছিল, ছিল প্রাণবন্ত। তাই সন্দেহ নেই, সবাই মনে রাখবে ওকে...
...পরবর্তী শুদ্ধিকরণের আগ পর্যন্ত।
তারপর কেবল আমার স্মৃতিতেই থাকবে মেয়েটি।
কেন যেন শুদ্ধিকরণ আমার ওপর কাজ করে না। তবে তার আগে যে বয়স-বৃদ্ধি নিরোধক ওষুধ দেয়া হয়, তা করে। আজও আমার বয়েস নয়, অথচ হবার কথা ছিল পঁচিশ। কেউ না জানলেও আমি জানি, এখন চলছে ২০৭৫ সাল। জানি আমার বাবা-মা ছিল, ছিল আরো অনেক বন্ধু।
চোখের ওপরে এসে পড়া চুলের গোছাটাকে সরালাম আমি, দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন মিস সাদিয়া। ঘন, লম্বা চুল পেয়েছি মায়ের কাছ থেকে। বাবা আগে জোর করে আমার চুল ছোট ছোট করে রাখতেন, বলতেন—বড় হলে আমাকে মেয়েদের মতো লাগে!
ওদেরকে মিস করি খুব।
আমার পাশে বসে কাঁদছে মন্টি, সিন্থিয়ার সবচাইতে কাছের বান্ধবী। ওর আসল নাম মাহজাবিন, আমরা দুষ্টুমি করে মন্টি বলে ডাকি।
আলতো চাপড় বসালাম মেয়েটার কাঁধে। ‘আমিও সিন্থিয়াকে মিস করব।’ শুনে মাথা নাড়ল মেয়েটা, অদ্ভুত এক কষ্টে ভরে উঠল আমার মন। শুদ্ধিকরণের মাঝ দিয়ে গেলেই বান্ধবীর সব স্মৃতি ভুলে যাবে মন্টি। পরিণত হবে হাসিখুশি মেয়েতে...কিন্তু আমি তো ওই মেয়েটার কথা কোনোদিন ভুলতে পারব না।
‘শুদ্ধিকরণের বেশি দেরি নেই,’ আচমকা আমোদের সুরে বলে উঠলেন মিস সাদিয়া। ‘আমরা বয়-বৃদ্ধি রোধের ওষুধ পাব। না বন্ধুদেরকে হারাতে হবে, আর না বাবা-মাকে।’ আমার দিকে একবার তাকালেন উনি। জানেন যে আমার বাবা-মা ছিল কখনো না কখনো, এ-ও জানেন যে তারা মারা গেছেন; তবে তাদের নাম ওনার মনে নেই।
‘বয়েস বৃদ্ধির কারণে হয়তো মারা যাবে না কেউ, কিন্তু দুর্ঘটনা তো প্রায়শই ঘটে।’ বললাম আমি।
সঙ্গে সঙ্গে একগাদা অশ্রুসজল লাল চোখ আমার দিকে ফিরে তাকাল।
এক দশক আগের একটা স্মৃতি আমার আজও মনে পড়ে। সেদিন কর্ডরয়ের প্যান্ট পরেছিলাম, শীতের কারণে হাত ঢুকিয়ে রেখেছিলাম পকেটে। বাতাসে তখন বসন্তের গন্ধ, শীত বিদায় জানাই-জানাই করছে।
প্রতি বছর বসন্তে হয় শুদ্ধিকরণ। সময়টাকে নিখুঁতই বলা চলে। ঋতুরাজ বসন্ত, আসার সঙ্গে সঙ্গে ঝেটিয়ে বিদায় করে সব জরাকে।
‘ইমাম, ফুটবল খেলবি?’
বছর দশেক পেরিয়ে গেলে পর, ফুটবলে আর সেই নতুনের চাকচিক্য থাকে না!
বাতাসের দমকা একটা ঝাপটা আমার মাথার টুপি উড়িয়ে ফেলল। চট করে ধরে ফেললাম ওটা, পরে নিলাম আবার। চুল বড় হয়েছে, কাটা দরকার। এবার শুদ্ধিকরণের পর, সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিলাম।
গোলবারের দিকে চলে গেল আমার নজর। ফুটবলে আগ্রহ হারিয়েছি অনেক আগেই, তারপরও মনে কৌতূহল জন্মেছে—এক লাথিতে বলটা দুই বারের ভেতর ফেলতে পারব কি?
‘আসছি,’ বলে খেলতে চলে গেলাম।
কাঠের চেয়ারটাকে হেলান দিয়ে বসলাম আমি। প্রতিবছর আমাদের সবাইকে এই বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ লিখে তা আবার ক্লাসের সবাইকে পড়ে শোনাতে হয়। জানি মমিনুল কী বলবে! ওর একটা বিড়াল ছিল—টাইগার নাম। মারা গেছে ওটা। মমিনুল বলবে: শুদ্ধিকরণ পশুদের ওপর কাজ করলে ও খুব খুশি হতো।
তবে কথা হচ্ছে, টাইগার সম্পর্কিত কিছুই ওর মনে নেই...একেবারে কিচ্ছু না। তবে হ্যাঁ, ওর কামরার চারদেয়াল জুড়ে আছে বিড়ালটার ছবি। তাই জানে, ওই নামের একটা পশু ও পালত একসময়। কিন্তু শুদ্ধিকরণ যে শুধু মানুষের জন্য, পশুর জন্য নয়।
দুর্ঘটনায় যেসব মানুষ মারা যায়, তাদের মতো আস্তে আস্তে দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে যায় পশুরা।
দুটো ধূসর, বিশালাকার বাস এসে থামল স্কুলের সামনে। আমরা সবাই মিস সাদিয়ার নেতৃত্বে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। শীত করছে খুব, শরতে এতটা ঠান্ডা থাকার কথা না। কিন্তু পারমাণবিক যুদ্ধে সব তছনছ হয়ে যাবার পর, আবহাওয়ার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।
চিকিৎসা মন্ত্রণালয় থেকে লোক এসেছে, আমাদেরকে ইনজেকশন দেবে, যেন কোনোভাবে বয়েস না বাড়ে। উত্তেজিত সবাই, তবে লাইন ভাঙল না কেউ। সাহায্য করলেন মিস সাদিয়া, আমাদের হাত ধরে রাখলেন।
ইনজেকশনের পর, কাঁধে একটা করে কার্টুন আঁকা ব্যান্ড এইড লাগিয়ে দিলেন তিনি। এই বছর কোন কার্টুনটা পাবো, তাই ভাবলাম খানিকক্ষণ। জীবনে খুব অল্প বৈচিত্র্যই বাকি আছে, এই ব্যাপারটা তাদের একটা।
‘ইমাম, এবার তোমার পালা। ভয় পাচ্ছ নাকি?’
ত্রিশ বছরে এই প্রথম বারের মতো ভয় লাগতে শুরু করল আমার।
‘নাহ,’ বললাম দৃঢ় স্বরে, যেন ভয়কে তাড়াতে চাইছি। কে জানে, কর্তৃপক্ষ কিছু জানতে পেরেছে কিনা! হয়তো আগামীকাল আমিও উধাও হয়ে যাব, আমার স্মৃতিতে সবগুলো ডেস্ক বৃত্তাকারে সাজানো হবে।
ভয় ঝেরে ফেলে বসলাম চেয়ারে, চোখ রাখলাম ইনজেকশন দিতে আসা লোকটার চোখে। আজ থেকে একুশ বছর আগে এই লোকটাই আমাকে ইনজেকশন দিয়েছিল।
শুদ্ধিকরণের ফলে আমাদের স্মৃতি মুছে যায়, আর এই ওষুধের কারণে থমকে যায় বয়স। কিন্তু আরেকটা উপসর্গ দেখা দিয়েছে এর ফলে—পৃথিবী যেন স্থবির হয়ে গিয়েছে। নতুন কোনো আবিষ্কার নেই, নেই কোনো কিছু সৃষ্টির তাড়না। আমার বিশ্বাস, এই ওষুধের ফলে সৃষ্ট রোগের প্রতিষেধক একদিন না একদিন কেউ আবিষ্কার করবে। আমি চাই আমার বয়েস বাড়ুক, চাই বিয়ে করতে...সন্তানের বাবা হতে।
‘কাজ শেষ, বাছা।’
ডোরেমনের একটা স্টিকার আমার কাঁধে লাগিয়ে দিল লোকটা, ওর চোখের দিকে তাকিয়েও সেখানে পরিচিতির কোনো লক্ষণ পেলাম না।
আর সবার মতো শুদ্ধিকরণের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে এই লোকটাও।
আমাদের ডেস্কগুলো আবার বৃত্তাকারে সাজানো হয়েছে। অনেকগুলো আসনে পড়েছে ধুলো, দীর্ঘদিন কেউ বসে না ওগুলোয়।
গতকাল রাতে, বাড়িতে আগুন লাগায় মারা গেছে মমিনুল।
কেন যেন খুব কষ্ট লাগছে আমার। হয়তো ছেলেটাকে বন্ধু ভাবতাম বলে!
মমিনুলের স্মৃতি মনে পড়তেই হাসি খেলে গেল আমার চেহারায়, হাত দিয়ে ঢাকলাম সেই হাসি। দশ বছর আগের সেই বিকেলের কথা মনে আছে আমার। গোল করেছিলাম সেদিন, বলটা বাড়িয়ে দিয়েছিল মমিনুল।
আবার খেলতে হবে একদিন, নতুন এক সঙ্গী পাব সেদিন। হয়তো তৈরি হবে নতুন এক স্মৃতি। কে জানে, হয়তো একদিন মমিনুলকেও ভুলে যাব আমি।
টের পাচ্ছি, বিকৃত হয়ে উঠছে আমার চেহারা, চোখ ভরে উঠছে জলে! কাঁদতে শুরু করেছি আমি, কিন্তু নিজেকে থামালাম না।
এই অশ্রু সিন্থিয়ার জন্য, আমার বাবা-মায়ের জন্য, মমিনুলের জন্য, আমাকে ঘিরে থাকা সহপাঠীদের জন্য...
...এবং সর্বোপরি, এই অশ্রু আমার জন্যই।