মানসী

বিভাবসু দে


সকাল থেকেই মনটা আজ বড় উদাসী হয়ে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে, কিছুতেই যেন বসতে চাইছে না ঠিক। ভাবলুম একখানা কবিতা লিখে ফেবুতে ছাড়ি; কিন্তু তাও হল না, ভাবগুলো শব্দের সাথে আঁড়ি করে বসে আছে। না, যাই বরং স্নান করি গে, যদি তাতে মনটা একটু থিতু হয়। এলাম স্নান করে, কিন্তু বেশ টের পাচ্ছি মন বাবাজীবন এখনও আগের মতোই কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন। সত্যিই বড় উতলা হয়ে আছে মনটা; সাপেদের খোলস ছাড়ার সময় বোধহয় এমনি উশখুশ করতে থাকে ভেতরটা! আজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বড় সাজতে ইচ্ছে করছে! ও হরি, এ আবার কী রোগে ধরলো, কখনও তো এমন আজব ইচ্ছে হয়নি আগে। যেই আমি কস্মিনকালে চুলে চিরুনি ঠেকাই না, এলোমেলো চুলেই ঘুরে বেড়াই সারাদিন, আজ পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে চলেছি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে; নিজেকে কেমন যেন বেশ সুন্দর লাগছে আজ! নিজেকে দেখে মুগ্ধ হওয়া, একে কি একটা যেন বলে মনোবিদ্যায়; সেই রোগে ধরলো নাকি! হঠাৎ আঁতকে পেছনে সরে এলাম, আরশির স্থির চিত্রপটটা কেমন যেন টলমল করে উঠল জলের মত! অবাক হয়ে দেখলুম, সেই আয়নার জলছবিতে টলমল করতে থাকা আমার মুখখানা কেমন যেন মেয়েদের মতো হয়ে এল; ছোট করে ছাঁটা চুলগুলো লম্বা হয়ে গিয়ে পড়েছে পিঠ ছেয়ে, খোঁচাখোঁচা দাঁড়িতে ভরা গালদুটো বেশ পালিশ গোলাপি হয়ে উঠেছে! বেশ ঘাবড়ে গেলাম, তাড়াতাড়ি মাথায়, গালে হাত বুলিয়ে দেখলাম... না, চুল দাঁড়ি সবই তো ঠিকই আছে আগের মতোই, তাহলে আজ ছায়াটা কায়ার অনুকরণ ছেড়ে এমন বিদ্রোহী হয়ে উঠল কেন? তাও আবার যে সে বিদ্রোহ নয়, একেবারে বিনা অপারেশনে লিঙ্গ পরিবর্তন! এবার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল... টলটলে জলের আরশি থেকে একটু একটু করে উঠে এল আমার ছায়াখানা। তবে এখন যে সে আর ছায়া নয়, রীতিমত সুতন্বী কায়াধারিণী তরুণী! গভীর কালো ডাগর দুটো চোখ, পিঠ অবধি নেমেছে চুলের ঢেউ, নীল শাড়িতে ওর গায়ের হলুদ রং যেন ঠিকরে পড়ছে; ঠিক যেন নীলাম্বরী রাধিকা! অবাক চোখে দুজনে দেখলাম একে অপরকে; কেন জানি না অপরিচিত এই তরুণীকে বড় বেশি পরিচিত মনে হতে লাগল আমার। আমি তখন চিরুনি হাতে বিছানায় বসে হাঁ করে তাকিয়ে আছি ওর দিকে, সে এসে বসলো পাশের সোফায়। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরতেই গা টা ছমছম করে উঠল কেমন; কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি ভূত?”

তরুণীর গোলাপি গালদুটো আরেকটু লালচে হয়ে উঠল লজ্জায়, হাসিমাখা মুখে সে বললে, “আমায় দেখে তাই মনে হয় বুঝি?”

এবার একটু সাহস পেয়ে বললাম, “কিন্তু তুমি ঠিক মানুষও তো নও, অমন আয়না ফুঁড়ে মানুষ তো বেরোতে পারে না! তুমি ঠিক কে বলো তো।”

—“আমি ছায়া গো।”

—“কার?”

—“কেন? তোমার...”

নিজের শরীরের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললাম, “সে কেমন কথা? আমি পুরুষ, তুমি মেয়ে, তুমি কি করে আমার ছায়া হবে শুনি?”

ছোট্ট একচিলতে হাসির রেখা দেখা দিল সেই মায়াবিনীর ঠোঁটের কোণে, “ছায়া বুঝি শুধু শরীরের হয়? মনের ছায়া হয় না বুঝি?”

—“মনের ছায়া!! সে আবার কি বস্তু? যদি হয়ও বা তবে সে খামোখা নারী হতে যাবে কেন?”

—“নারী হতে বুঝি ভারী আপত্তি তোমার?”

—“না, ইয়ে মানে, পুরুষ মানুষ হঠাৎ নারী হতে যাব কেন? আমার তেমন স্বভাব নয় মোটেই।”

পাতলা দুটো গোলাপি ঠোঁটের ফাঁকে মুক্তোর ঝিলিক খেলিয়ে সে বললে, “তোমার শরীরটা নাহয় পুরুষ, কিন্তু মনের লিঙ্গ নির্ণয় করলে কোন যন্তরে শুনি?”

মেয়েটির কথা কিছুই বুঝতে পারলুম না, “এ আবার কি হেয়ালি কথা?”

—“আমি হলেম তোমার মনের নারী।”

—“মানে?”

—“মনের নারী পুরুষ হয় না গো। সবার মনেই থাকে এই দুটো সত্ত্বা। যার মনে যেই সত্ত্বার জোর বেশি তার শরীরটা তেমনধারা রূপ পায়। তুমি পুরুষ হয়েছো কারণ তোমার মনে আমার যেই পুরুষ দোসর আছে সে আমাকে এতকাল দাবিয়ে রেখেছে; যদি উল্টোটা হত তবে আমার রূপেই রূপ পেতে তুমি।”

অবাক হয়ে শুনছিলাম ওর কথা, জিজ্ঞেস করলাম, “তা আজ হঠাৎ বেরিয়ে পড়লে কি করে?”

—“হাঁপিয়ে উঠেছিলাম গো, আমার ওই পুরুষের দাপাদাপিতে, তাই বেরিয়ে পড়লাম আজ প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে। ইচ্ছে হল বাইরের পুরুষের চোখ দিয়ে একবার ভেতরের নারীকে আর ভেতরের নারীর চোখ দিয়ে বাইরের পুরুষটাকে দেখি। বড় ইচ্ছে হয় গো মাঝে মাঝে, নিজের মতো করে তোমায় গড়ি।”

—“আচ্ছা, আমি যদি মেয়ে হতাম, তাহলে কি ঠিক তোমার মতোই হতাম দেখতে?”

—“হ্যাঁ গো, প্রকৃতির তাই তো নিয়ম।”

নিজের নারীত্বের রূপচ্ছটা দেখে বেশ অহংকার হল। মেয়ে হলে বেশ রূপসী সুন্দরীই হতাম তাহলে! নিজের মনের তরুণীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, তোমার আর মনের ভেতরের পুরুষটার কি সব সময় ঝগড়া চলে?”

—“না না, সেকি কথা গো? ঝগড়া হতে যাবে কেন? আমরা যে একই সত্ত্বা। হ্যাঁ তবে দড়ি টানাটানি খেলা বলতে পারো, আর সেটা সারাজীবন চলে। তাই তো শরীরে পুরুষ হয়েও মনের নারীত্বটা প্রবল হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে অনেকের মনে; দ্বৈত জীবনের বোঝা নিয়ে বাঁচে তারা, দেহে পুরুষ মনে নারী! উল্টোটাও হয়।”

—“হুম, তাই বুঝি আজকাল অনেকে লিঙ্গ পরিবর্তন করায়।”

—“হ্যাঁ গো। সে যে বড় ভীষণ লড়াই, শুধু কি মনের, সমাজের সাথেও যে লড়তে হয় তাদের। আজকাল তো তবু চিন্তাধারা উদার হয়েছে অনেক, আগেকার দিনে তো শুধু অপমান আর বিদ্রূপই জুটত এমন লোকেদের কপালে।”

—“এই বলছি, তুমি যে হঠাৎ এমন নিয়ম ভেঙে বেরিয়ে এলে, আমিও কি তবে এখন মেয়ে হয়ে যাব নাকি?”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠল সে, “না গো, আমি এমনি এসেছি, তোমায় দেখতে। চিন্তা নেই, তোমার মনে আমার যে পুরুষ দোসরটি আছে সে আমার চেয়ে ঢের জোরালো, ওর হাত থেকে রাশ কেড়ে নেবার সাধ্যি এজন্মে আমার হবে না।”

—“যাক বাবা, বাঁচালে! আচ্ছা, তোমার নাম কি?”

—“মনের আবার নাম হয় নাকি?”

—“ওহ, হ্যাঁ তাও ঠিক। তবু কিছু একটা বলে যদি ডাকি, এই ধরো মৃণালিনী নামটা কেমন?”

—“বড্ডো বুড়োমার্কা হয়ে গেল না?”

—“তাই বুঝি? তবে তুমিই বল না কি বলে ডাকা যায় তোমাকে।”

—“তুমি নাহয় মানসী বলে ডেকো আমায়।”

—“মানসী। বাহ্, সুন্দর নাম!”

—“আচ্ছা মানসী, মনের জগৎ ছেড়ে যখন বাইরে এসেছ, তখন একটা সম্পর্ক পাতালে কেমন হয়?”

—“কেমন শুনি?”

—“সেখানেই তো মুশকিল! মা নও, বোনও নও তুমি। আবার আমি আর তুমি পুরোপুরি আলাদাও নই যে তোমার সাথে প্রেম করা যাবে।”

—“আমি নাহয় সখী হব তোমার, মনের কথা বলবে আমাকে মন খুলে।”

—“সখীটা বেশ। কিন্তু তোমায় মনের কথা কি বলব বল, তুমি নিজেই তো আমার মনের অংশ, কিছু কি অজানা আছে তোমার?”

—“নেই আবার? কত কিছুই তো লুকিয়ে রাখো আমার কাছে। তোমার পুরুষ মনখানা কত দুঃখ ব্যথা লুকিয়ে রেখে আমার সামনে একগাল হাসি এঁটে খুশির ভান করে বেড়ায়। কত বলি মন খুলে কাঁদো, হাল্কা হয়ে যাক মনের বোঝা, সে এড়িয়ে যায় আমাকে।”

—“এমনটা তো ভাবিনি কখনও। সত্যিই তো কতবার এভাবেই নিজের মনে নিজেকেই ছলনা করেছি।”

—“হুম, আজ থেকে সখী মানলে তো? তাহলে এমন আর কোনোদিন আড়ালে রেখো না নিজের সখীকে।”

—“বেশ,তাই হবে। আচ্ছা, তুমি তো প্রথমবার এলে আমার কাছে, তোমায় কি দেই বলো তো?”

“দেবে আমায় কিছু?”, কাজলকালো চোখে হাসির ফোয়ারা যেন ছলকে পড়ল, কি সরল সেই চাউনি।

—“হ্যাঁ, কিন্তু কী যে দেব সখী তাই তো বুঝতে পারছি না!”

—“মনে আছে, তখন তুমি ক্লাস ইলেভেনে পড়তে, একটি মেয়েকে খুব ভালো লাগতো তোমার। একটি চিঠি লিখেছিলে তাকে দেবে বলে, কিন্তু দাওনি। আমি অনেক বুঝিয়েছিলাম, কিন্তু শোনেনি তোমার পুরুষ মন।”

পুরোনো দিনের কথায় হঠাৎ বুকের ভেতরে একটু যেন ঢেউ খেলে গেল, বললাম, “সবই তো জানো!”

—“তোমারই মনের অংশীদার গো আমি, জানবো না কেন? এখনও তো লুকিয়ে রেখেছো সেই চিঠিটা ‘গল্পগুচ্ছ’-এর ভেতর। যদি চাও, তবে সেটি দাও আমায়।”

—“চিঠিখানা? আচ্ছা বেশ, একটু বস, এক্ষুনি নিয়ে আসছি।”

ছুটে গেলাম পড়ার ঘরে, টেবিলের পাশেই রাখা ছিল ‘গল্পগুচ্ছ’, তারই পাতার ভাঁজে খুঁজে পেলাম সাত বছর পুরোনো সেই না-দেওয়া চিঠিখানা। কি আজব কাণ্ড, হবু প্রেমিকাকে দেব বলে লিখেছিলাম রাত জেগে, কিন্তু পারিনি দিতে আর আজ সেই চিঠি দিতে যাচ্ছি আমার মনের মানসীকে।

চিঠি হাতে ফিরে এলাম বসার ঘরে। কিন্তু একি, কোথায় মানসী, কোথায় গেল আমার সখী!! তন্নতন্ন করে খুঁজলাম সারা ঘর, কেউ তো নেই কোথাও। আয়নাটাও তো নিরেট হয়ে দাঁড়িয়ে, কই আর টলমল করছে না তো আগের মতো। কেউ তো নেই, খালি সোফায় শুধু চিরুনিখানা পড়ে আছে।

অলংকরণ - প্রমিত নন্দী
মূল ছবি - লিওন জার্নীতস্কি