অগ্ন্যুত্পাতের আগের ফেলে আসা সব কথাগুলো

পারিজাত ব্যানার্জী


এখন আমার সামনে শুধু পড়ে রয়েছে সেই সাদাপাতারা। নিশ্ছিদ্র, সুঠাম, মেদহীন। সেই কোন এক অবেলায় হঠাৎই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তালেগোলে। উঠেই দেখি সামনে নিশ্চিন্তে শীতের আলপনায় রোদ পোয়াচ্ছে এক দিস্তা পাতা। কিরকম ঝকঝকে, যেন একখণ্ড রোদকেই তারা ধরে রেখেছে তাদের কোটরে নির্নিমেষভাবে, হেলায়। পতপত করে উড়ছে তারা কখনও হাওয়ায়, যেন সমুদ্রের গা জোয়ারিতে ভেসে থেকেই তাদের উপচে পড়ছে সব সীমাহীন আনন্দধারা! বিছানায় বসেবসেই দেখলাম খানিক তাদের এলোমেলো চুলের গুচ্ছ — আনমনে যা উড়ে চলেছে দূর দরিয়ায়। সামনে গরাদ দেওয়া পুরোনো বাড়ির সবুজ জানালা— পড়ন্ত বিকেলের রোদকে যে ছায়ায় ধরে তরঙ্গের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিচ্ছে সাদা ওইসব পাতার অভ্যন্তরে। একেই কি বলে প্রতিসরণ? তেরছা হয়েই তো আলোটা পড়ল, তাই না? — আমি অবশ্য অপার্থিব চেতনের প্রতিসরণেরই খবরাখবর রাখি। পদার্থবিদ্যায় বরাবরই টলমল করে ওঠে আমার এই দুটো আপাদমস্তক ভেজা পা!

সেই কবের থেকে শুরু। আর ঠিক তখনই হয়তো শেষ! কারণ তারপর মনে আছে, ওই সাদা পাতাগুলোকে একরাশ নির্মম আক্রোশে আর সাদাই থাকতে দিইনি আমি। ওরা কেন অমন দুধবর্ণা হয়ে খেলে বেড়াবে, আরাম করবে অমন বিকেলবেলায়?

তবু আমার অবসর জুটবে না — কাদা লাগবে অবচেতনে — দুধসাদা ফেনিল দোটানায়? একদা যেই শূন্যই ছিল আমার নিজস্ব দণ্ডি কাটা প্রদেশ — সেই মাদুরের আস্তরণের মাঝের ছক ভাঙা ঘর থেকে আজ পড়তে পড়তে ধূলিকণা হয়ে মিশে যেতে হবে আমায় ছোট ছোট দূর্লভ কাঁকড়াবিছের দলে বালুকাবৃত হয়ে!

তাও ভালো অন্তত আঁচড় কাটার সুযোগটুকু ওরা কেড়ে নেয়নি এখনও! সুযোগের সদ্ব্যবহার করে কাটাকুটি তাই এঁকেই চলেছি অনবরত — কখনও সাদা পাতায়, কখনও ঝরাপাতায়, কখনও বালিয়াড়ির বুকে, কখনও আবার ছেঁড়া রোদেপোড়া কার্ণিসের দাওয়ায়।

স্বপ্ন নিয়েই ভাবছিলাম। ভাবতে ভাবতেই অতল কুয়াশা-সংকেতের নিস্তব্ধ চিৎকার — যা শেষ হওয়ার আগেই নেমে আসে ঘুম। মিনিট পাঁচেকের অতল গভীর ঘুম। ঘুমের জানালাগুলো খুলে যায় যেমনতেমন ভাবে। আমি বড় থেকে ছোট হতে হতে মিশে যাই স্কুলের উঁচু উঁচু গরাদওয়ালা গেটের ওপাড়ে। অচেনা স্কুল, অচেনা সব ছোটদের দল। তাইতো — আমার চেনা জগতটা যে আসলে না বলেকয়েই বড্ড বড় হয়ে গেছে আজ! এই মুখগুলির ভীড়ে তারা তাই আজ বেমালুম হয়ে যাওয়া ‘নেই’ এর দল!

দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যাওয়ার আগে ভেসে আসে কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদ। এমনিই, হাওয়ায় বা তার খামতিতেই বোধহয়। কানের গভীরে তার আলতো রেশ রেখেই তা আবার হারিয়েও যায় চিরতরে! তবুও ওই অদেখা মুহূর্তের হাহাকারই জানিয়ে দেয়, আমার ওই ছোট্ট আমিটার কোনো বন্ধু নেই আজ আর কোথাও। সবাই বলাবলি করে, এ ওর দিকে চায়, ফিসফিস করে জানিয়ে দেয় চরাচরকে সেই অমোঘ সত্য। আমি তাই টের পাই বিশাল হলঘরের শেষপ্রান্তে এক কাঠের বেঞ্চিতে বসে — একলাই। একাই একসময় বইখাতাও খুলে ফেলে দেখি আমার অন্য আমিটা। বড় তাড়াতাড়ি বেশ মানিয়ে গুছিয়েই নিল কেমন করে ওই দুদিকে বিনুনি বাঁধা মোটা পাওয়ারের চশমা পরা মেয়েটা? কই, আমি তো আজও শিখে উঠতে পারলামনা কিছু!

বড়বড় থামের আড়ালেই দাঁড়িয়ে থাকি চুপচাপ। আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখি, তখনও চলছে নাটকের শেষ দৃশ্যের মহড়া। সবাই দিব্যি হাসছে, সং সাজছে, চোখমুখ নাড়ছে কতরকম ভাবে — অথচ সবই ধোঁয়াটে — যেন রঙ আছে তবু তার ছিটে এসে লাগেনা আর আমার গালে, ঠোঁটে। আমার ছোট্ট আমিটা শুধুই অপেক্ষায় থাকে যবনিকা পতনের। আমার পিছনের বড় ভারী পর্দা যে আমাকেই নামাতে হবে একা — কারো সাহায্য ছাড়াই। তবু তার আগেই শুনে ফেলি সামনের বেঞ্চে বসা বড় বড়চোখ আঁকা মেয়েগুলোর আফসোস ধ্বনি, “ইশ! যদি থাকত ওর সেই বন্ধুটা আজ, তবে কি আর সব কাজ এমন করে একা সামলানোর দায় থাকত ওর?” আমিও অনেক ভাবি, কিন্তু সেই অদেখা প্রিয় মানুষের মুখটা আর কিছুতেই মনে করতে পারিনা। ততক্ষণে শুধু পরে থাকে যে শুধু অস্থিটুকু। তাতে সত্যকে আর পাওয়া যায় না। অবশ্য, পেলেও কি আর অবসাদ কমে? সব পুড়ে যাওয়ার পর ওসবে আর কোনো তাপ উত্তাপ হয়না।

ছোট্ট আমিটা করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌছে যায় মধ্যযৌবনে, গ্রামের এক পুরোনো কলেজ লাগোয়া থাকার জায়গায়। ওখানেই নতুন পাওয়া বান্ধবে মজে সে দুই হাত তুলে উড়ে যায়। উড়তেই থাকে, যতক্ষণ না এক দূরদেশের নৈশালোকিত জমায়েতে ছিটকে পড়ে তারা দুজন। প্রেমাষ্পদের পরণে সেই ঢোলা নীল পাঞ্জাবী, যেন ঠিক এমনটাই হওয়ার কথা ছিল বহুকাল। অনেক মাইল পার করে ভেসে আসা উপস্থাপকের গলায় তখন সভাসমাপ্তির অমোঘ আশ্বাস। তারপরেও চলে যদিও রঙখেলা। প্রেমিক চকিতে এই বড় আমিকে ইশারা করে বেড়িয়ে আসার। আমি কিছু বোঝার আগেই দেখি তুঁতে নীল রঙে উপচে যাচ্ছে ওর শরীর, মন, সব — যেন কোন অস্তিত্ব নেই তার কোথাও — কোনদিন ছিলওনা এমনভাবে। তাকে বাঁচাতে যেতেই উল্লাসের প্রহেলিকা ভেদ করে শুনতে পাই ওর ডাক —“পালাও। পালাও।” আমি ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে যেতেই রঙের আকুলতা উজাড় করে সেই দেখি ছলনা করে আবার কাছে টেনে নেয় আমায়! আমি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি হঠাৎ। স্লো মোশনে এগিয়ে আসতে থাকি নিজের কাছে নিজেরই হাত ধরে। পিছনে পরে থাকে রঙ, চিৎকার, তুঁতে রঙের বিভীষিকারা আর বাকি যা থাকার কথা নয়, তাও! নতুন শুরুটা আবার হওয়ার আগেই বিকল করতে হবে হৃৎযন্ত্র — আমি নিশ্চিন্তে অপেক্ষায় থাকি সেইসময়ের।

অলংকরণ - প্রমিত নন্দী