সবকিছুর দিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল কিশোরী মেয়েটি, একদম শেষবারের মতো। চারদিকে শুধুই ধ্বংস আর বিনাশের চিহ্ন! আকাশটা ভরে গেছে কালো ধোঁয়াতে।
মেয়েটি আর তার মা দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি খোলা প্রান্তরের ঠিক মাঝখানে, একটি বিশাল আকৃতির মহাকাশযানের সামনে।
“মা, আর কতক্ষণ?” উদাস কণ্ঠে বলল মেয়েটি।
“এইত, আর দশমিনিট, তারপর আমরা রওনা দেব। আকাশটা আরেকটু পরিষ্কার হোক", স্মিত হেসে বললেন মেয়েটির মা।
“চলেই যেতে হবে?” কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল মেয়েটি।
“আহা! এ ছাড়া আমাদের আর কি কোন উপায় আছে বাছা? আমরা দুজন ছাড়া সবাই মারা গেছে। আর কেউ বেঁচে নেই আমাদের গ্রহে! এখনই আমাদের গ্রহ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, কয়েকদিন পর আমরা আর একটুও অক্সিজেন পাব না এখানকার বায়ুমণ্ডলে ! তখন আমরা বাঁচব কীভাবে? খাব কী? তাই যেতেই হবে। তোমার বাবাও এমনটাই বলেছিলেন।”
“আর কখনোই এখানে ফিরে আসা হবে না?”
“আমি মিথ্যা আশ্বাস দিতে পছন্দ করি না বাছা। সম্ভবত আর কখনোই আমরা এখানে ফিরতে পারব না। এটা আমি মেনেই নিয়েছি, তুমিও মেনে নাও।”
“কত স্মৃতি আছে! আর এখান থেকে চলে যাব? তাও আমাদের নিজের গ্রহ থেকে!”
“শোন, আমি একজন বিজ্ঞানী আর বিজ্ঞানের কাছে স্মৃতির কোন দাম নেই। স্মৃতি কী? মায়া! মায়া ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আমাদের তো বাঁচতে হবে! আর বাঁচতে হলে যেতে হবে অন্য কোথাও। আমাদের ছায়াপথের বাইরে এমন এক গ্রহ আছে যেখানকার প্রাণীরাও আমাদের মতই অক্সিজেন নিয়ে বাঁচে, ওখানেই যাচ্ছি আমরা। আমি ভেতরে যাচ্ছি, সবকিছু ঠিক আছে কি না দেখতে হবে। একটু পর তোমাকে ডাকব, তখন ভেতরে চলে এস”, এই বলে ভিতরে চলে গেলেন মেয়েটির মা।
একা দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইল মেয়েটি।
আজকের আকাশটাকেও যেন খুব বিষন্ন লাগছে। কালো ধোঁয়া অনেকটাই কেটে গেছে! আর একটু পরেই হয়ত মহাকাশযানটিকে চালু করবেন মা।
চোখ বন্ধ করল মেয়েটি। একে একে তার সামনে ভেসে উঠতে লাগল সেইসব মুখ যারা তার জীবনে রেখে গেছে নিজেদের ছাপ।
ওর ছোটবেলার খেলার সাথীদের কথা মনে পড়ল। কত ভালোই না ছিল দিনগুলো! মজা করে খেলত ওরা। কোন দুঃশ্চিন্তা ছিল না! ওরা কেউ এখন আর বেঁচে নেই! কেউ যুদ্ধে মরেছে আর কেউ...
মনে পড়ল মা-বাবার সাথে কাটান সেই হাসি-খুশিতে ভরপুর দিনগুলোর কথা। কত সুন্দর একটা জীবন ছিল ওদের!
আর এরপরেই মনে পড়ল যুদ্ধের কথা!
সেই সর্বনাশা যুদ্ধ! প্রতিটি দেশ কোন এক অজানা কারণে ঝাপিয়ে পড়ল একে অপরের ওপর। প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ একযোগে হামলা করে বসল ওদের দেশের ওপর। ওর মা-বাবা দুজনেই ছিলেন সরকারের উচ্চপর্যায়ের বিজ্ঞানী। যুদ্ধের কারণে ক্রমাগত তাদের দিয়ে নতুন নতুন মারণাস্ত্র বানিয়ে নিচ্ছিল সরকার! ওর মা-বাবা এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে দিনের অধিকাংশ সময়ই মেয়েটাকে একাই থাকতে হত বাড়িতে।
প্রতিদিন গভীর রাতে মা-বাবা ফিরতেন, একসাথে টেবিলে রাতের খাবার খেত ওরা। কিন্তু মা-বাবার মুখ থাকত বিষন্ন!
মনে পড়ল বাড়ির পাশের সেই ছেলেটির কথা যাকে ওর ভালো লাগত। আর এই স্মৃতি মনে আসতেই নিজের অজান্তেই লালচে হয়ে উঠল মেয়েটির গাল।
মেয়েটার একঘেয়ে জীবনে ওই ছেলেটা ছিল একফালি রোদ্দুরের মতো!
খুবই হাসি-খুশি ছিল ছেলেটি। নিঃসঙ্গ দিনগুলোতে জানালাতে ঘন্টার পর ঘন্টার শুধুমাত্র ছেলেটাকে দেখার জন্যই দাঁড়িয়ে রইত মেয়েটা। কী যে একটা ছিল ছেলেটার চেহারাতে! ওর হাসিতে! যেটা এক মুহূর্তের মধ্যে নিজের সব দুঃখ ভুলিয়ে দিত মেয়েটাকে!
মাঝে মাঝে ছেলেটাও ওকে দেখত। ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসত, তারপর ঘরে ঢুকে যেত।
আচ্ছা, ছেলেটাও কি ওকে পছন্দ করত? সেই প্রশ্নের উত্তর আর কখনোই পাওয়া সম্ভব নয়।
তীব্র শীতের সেই রাতের কথা মনে করতেই বুক কেঁপে উঠল মেয়েটির! সারাটা রাত যুদ্ধে ওদের এলাকার ওপর হাওয়াই হামলা চালিয়েছিল শত্রুপক্ষ। একের পর এক বিস্ফোরণের আওয়াজ যেন সেদিনের রাতটাকে ক্রমাগত রক্তাক্ত করে চলেছিল।
পরে বাবার কাছ থেকে মেয়েটি শুনেছিল যে শত্রুপক্ষ অনেক দিন ধরেই ওদের বাড়ির সন্ধানে ছিল। ওদের দেশের সরকারের সবচাইতে গুরত্বপূর্ণ দুজন বিজ্ঞানীকে শেষ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল তারা।
“সম্ভবত ওদের কোন চর ওদের জানিয়ে দিয়েছে যে আমরা এই এলাকাতে থাকি”, ফিসফিসিয়ে ওর মাকে বলছিলেন ওর বাবা।
“সেটাই! কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো কোন আক্রমণ হলো না!” অবাক হয়ে বলেছিলেন ওর মা।
“ওটাই ভাবছি!” বাবার চোখেও সেদিন দেখা দিয়েছিল চিন্তার রেখা।
পরের দিন সকালে তীব্র আক্রমণে ছিন্নভিন্ন পাশের বাড়িটা থেকে ঐ ছেলেটার রক্তাক্ত মৃতদেহ আবিষ্কার করেছিল এলাকার লোকজন!
অনেক চেষ্টা করেও সেদিন একটুও কাঁদতে পারেনি মেয়েটি। ওর বুঝতে বাকী ছিল না যে ওদের বাড়ি মনে করে শত্রুপক্ষ পাশের বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল।
সেদিন থেকে যেন একদম বোবা হয়ে গিয়েছিলেন মেয়েটির বাবা। প্রয়োজন ছাড়া ওর মাও একদমই কথা বলতেন না।
যুদ্ধ তখন চরম পর্যায়ে পৌছেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল সবগুলো দেশ। প্রতিদিন ধরে পড়ছিল হাজার-হাজার প্রাণ।
কিন্তু মৃত্যুর ক্ষুধা যেন মিটছিলই না।
চোখ খুলল মেয়েটি। এবার শুধু একটা স্মৃতি মনে করা বাকী আছে। আর এটা চোখ খুলেও মনে করতে পারবে সে।
স্মৃতিটা গতকাল দুপুরের।
হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে এসে ঢুকলেন ওর মা-বাবা। তারপর নিজেদের মধ্যে এক অদ্ভুত আলাপচারিতায় জড়িয়ে পড়লেন তারা।
“এটা ঠিক হবে না! এর দায় তো সবার নয়! এটা কোন সমাধান হতে পারে না!” কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন ওর মা।
“এটাই সমাধান। কোন অসুখকে বেশী বাড়তে দিলে সেটা গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সেই শরীর থেকে অসুখটা যেন অন্য শরীরে না ছড়ায় সেটার একটাই উপায়! ওই শরীরটাকেই শেষ করে দেওয়া! আমাদের জগৎ ঐ শরীরটার মতো, এখানকার সবাইকে শেষ না করে দিলে চলবে না”, দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলেন ওর বাবা।
“মানে... মানে...”
“কিছুই না! আমি একটু পরেই চলে যাচ্ছি। যে ক্যাপসুল দুটো দিয়ে গেলাম সেটা তুমি খেয়ে নিও, আমাদের মেয়েটাকেও খাইয়ে দিও। ওটা খেলে তোমাদের ওপর ওই বিস্ফোরণের কোন প্রভাব পড়বে না।”
“সবকিছু কি শেষ হয়ে যাবে ওতে?”
“নাহ! প্রথমে পনের মিনিটের মধ্যে গ্রহের সকল প্রাণের মৃত্যু ঘটবে, চব্বিশ ঘন্টা পর আমাদের গ্রহও ধ্বংস হতে শুরু করবে আর আটচল্লিশ ঘন্টা পর পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে! আমার বায়োহ্যাজার্ড ওয়েপনটা এমনই। সরকারের জন্য বানিয়েছিলাম কিন্তু এখন এটাকে তার চাইতেও ভালো কাজে লাগাব।”
“তুমি কি আমাদের সাথে যেতে পার না?”
“নাহ! এত প্রাণের বিনাশ হতে চলেছে আমার কারণে, যদিও এটা ওদেরই ভালোর জন্য, তারপরেও এর দায় নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে পারব না। আমিও ওদের সাথেই থাকব।”
“কিন্তু...”
“কোন কিন্তু নয়! আমাদের মেয়েকে নিয়ে ওই গ্রহে চলে যাবে। যেটার কথা তোমাকে বলেছিলাম। আর শোন কাল সকালেই মহাকাশযানে করে এই গ্রহ ছেড়ে চলে যাবে, একদমই দেরী করবে না। আমি যাচ্ছি!”
“আমি তোমাকে যেতে দেব না!”
“তুমি আমাকে চেন। আমি যা বলি আমি তা করিই।”
মুখের ভাষা যেন হারিয়ে ফেললেন মেয়েটির মা। নিজের স্বামীকে চেনেন তিনি। তাকে আটকানো যাবে না। আর ভিতরে ভিতরে এখন তারও মনে হচ্ছে, যে তার স্বামী যেটা করতে যাচ্ছেন সেটাই ঠিক। এই গ্রহের কারোরই বেঁচে থাকার অধিকার নেই!
“আমাদের মেয়েকে কিছু বলবে না?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন মেয়েটির মা।
“ও ছোট! ও কিছু বুঝবে না। ওকে দেখে রেখ!” এই বলে বেরিয়ে গেলেন মেয়েটির বাবা। যাওয়ার আগে মেয়েটির মুখের দিকে একবারও তাকাননি তিনি।
সত্য বলতে কী বাবার কথাবার্তা ঠিকমতো বুঝতেও পারছিল না মেয়েটি। ও শুধু বুঝতে পারছিল যে বাবা এমন কিছু করতে যাচ্ছেন যার ফলে ওদের ভালো হবে!
তারপর? তারপর আর কী! ঠিক সন্ধ্যার সময়ে ঘটে গেল সেই মহা বিস্ফোরণ।
ওটা শুরু হয়েছিল একটা মৃদু গুঞ্জনের মতো করে। শতশত পতঙ্গ আর্তনাদ করলে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমন একটা শব্দ! ওতেই সব শেষে হয়ে গেছে! মারা গেছে সবাই। কীভাবে সবাই মরল সেই দৃশ্য দেখার দুর্ভাগ্য মেয়েটির হয়নি। সারাটা সময় ওকে নিয়ে ঘরের মধ্যেই বসেছিলেন ওর মা। পনের মিনিট! তারপর সব শেষ!
প্রাণীদের মৃত্যুর পর মরতে শুরু করল উদ্ভিদেরা আর ধীরে ধীরে ক্ষয় শুরু হলো জড় পদার্থগুলোতেও। আর কিছুক্ষণ পর হয়ত সবকিছুই শেষ হয়ে যাবে!
“কই গেলে বাছা, ভেতরে এস,” মায়ের কণ্ঠ শুনে যেন বাস্তবে ফিরে এল মেয়েটি। শেষবারের মতো চারদিকে চোখ বুলিয়ে সবকিছু দেখে নিল সে। তারপর আস্তে আস্তে প্রবেশ করল মহাকাশযানে।
একটা হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে লাগল মহাকাশযান। আলোর চাইতেও কয়েকশোগুণ বেশী গতিতে চলে সেটা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অনেক দূরে পৌঁছে গেল তারা।
মন খারাপ করে চুপচাপ বসে আছে মেয়েটি। ওর মাও কেমন যেন গম্ভীর হয়ে বসে আছেন।
“আচ্ছা মা আমরা যে গ্রহে যাচ্ছি ওটা কেমন?” নীরবতা ভাঙ্গল মেয়েটি।
“বেশ সবুজ একটা গ্রহ। প্রচুর অক্সিজেন আছে, আমাদের অসুবিধা হবে না,” মৃদু হেসে বললেন ওর মা।
“আচ্ছা, ওই গ্রহের জীবেরা কি আমাদের থাকতে দেবে?”
“ওই গ্রহ কয়েক রকমের প্রাণী রয়েছে তবে যে প্রাণীরা ওই গ্রহে রাজত্ব করে তারা আমাদের তুলনায় খুবই দুর্বল। আকারেও অনেক ছোট। এমনকি ওই গ্রহের সবচাইতে বড় প্রাণীটাও আমাদের পায়ের একটা আঙ্গুলের সমান না।”
“আর ওদের প্রযুক্তি?”
“জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে অনেক পিছিয়ে ওরা। ওদের অস্ত্রগুলোও আমাদের ওপর কাজ করবে না। আসলে আমাদের শরীরের গঠনের সামনে ওসব অস্ত্র অচল, আমাদের শরীর যেসব পদার্থ দিয়ে তৈরী সেগুলোর ব্যাপারে জানেই না ওরা। ওরা যদি আমাদের থাকতে দিতে না চায়, তবে...”
“তবে কী মা?”
“ওদেরকে শেষ করতে হবে। তারপর নিজেদের জায়গা বানাতে হবে। এই গ্রহটা আমরা কিছুতেই ছাড়তে পারি না। অক্সিজেনের এমন বিশাল সংগ্রহ আর কোন গ্রহে নেই।”
“ইশশ মা! ওখানেও লড়াই করতে হবে?”
“লড়াই? বললাম না! ওরা আমাদের সামনে কীট-পতঙ্গের মতো। লড়াই ছাড়াই ওদের হটিয়ে দেব।”
“ইশশশ!! বেচারা প্রাণীগুলো!”
“আচ্ছা, ওদের জন্যও তোমার মায়া হচ্ছে?”
“হচ্ছেই তো!”
“কিছুই করার নেই আমার! আমি খুব দুঃখিত।”
আবার কিছুক্ষণ সব চুপচাপ।
“আচ্ছা মা, ওই গ্রহটার নাম কী?” উদাস চোখে জিজ্ঞাসা করল মেয়েটি।
“পৃথিবী!” মৃদু হেসে বললেন ওর মা।