রুবি রায় - সায়ন্তনী পলমল ঘোষ

অলংকরণ - সৌমিক পাল

বজ্রসেন সুরাপাত্রে এক চুমুক দিয়ে দরজার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলেন। স্পষ্টতই প্রতীয়মান তিনি কারুর অপেক্ষায় উন্মুখ। দুপাত্র সুরা পানের পর তাঁর চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। নূপুরের ছমছম আর চুড়ির রিনরিনে শব্দ বজ্রসেনের প্রশস্ত ললাটে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল।

“এত দেরী?” নেশাতুর কণ্ঠে বলে উঠলেন বজ্রসেন।

“আপনার পুরস্কারের প্রতীক্ষায় ছিলাম।”

“মানে? আমার পুরস্কার তো তুমি।”

দুর্বোধ্য এক হাসি উপহার দিয়ে সে বলল, “নিজের জিনিস পুরস্কার হিসেবে চাইছেন! আমি তো আপনার জন্য নতুন পুরস্কারের আয়োজন করেছি।” দুহাতে তালি দিল সে। দরজার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন বজ্রসেন। বছর আঠারোর সদ্য যৌবনবতী অসাধারণ রূপসী একটি মেয়ে সারা শরীরে মাদকতা মেখে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটি পেটিকা।

“এই রইল আপনার উপহার। ওর নাম কুমারী আর এই পেটিকায় সামান্য কিছু কাঞ্চন মূল্য আছে আপনার পরিশ্রমের। আমি এখন আসি। পরে আবার আসবো। আমি তো রইলামই।” দরজা টেনে দিয়ে চলে গেল সে। কুমারী এসে বজ্রসেনের পাশে বসলো। তার দুই চোখে নিষিদ্ধ ইশারা, শরীরী ভঙ্গিমায় উদাত্ত আহ্বান। সাধক হলেও ষড়রিপুর প্রভাবমুক্ত নন বজ্রসেন। উপরন্তু পার্থিব বস্তুর ওপর তাঁর আকর্ষণ কিছুটা অত্যাধিকই বলা যায়। কুমারী সেই পেটিকাটি বজ্রসেনের হাতে তুলে দিল, “এর মধ্যে আপনার জন্য একটি বিশেষ মূল্যবান রত্ন আছে।” বজ্রসেনের লোভাতুর চোখদুটো দপ করে জ্বলে উঠলো। পেটিকা খুলে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলেন বজ্রসেন। স্বর্ণমুদ্রা আর রত্নখচিত স্বর্ণ আভরণে পরিপূর্ণ।

“সেই বিশেষ রত্নটি কোথায়?” অধৈর্য হয়ে ওঠেন বজ্রসেন।

“পেটিকার মধ্যেই আছে। খুঁজে নিন।” অপাঙ্গে চেয়ে বলে কুমারী। পেটিকার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেন বজ্রসেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই, “উহঃ।” নিমেষের মধ্যে নীল হয়ে যেতে থাকে বজ্রসেনের শরীর। তিনি যে ষড়যন্ত্রের শিকার বুঝতে বিলম্ব হয় না বজ্রসেনের। একদিন মুহূর্তের দুর্বলতায় বলে ফেলেছিলেন যে গণনা করে দেখেছেন যে তাঁর মৃত্যু হবে সর্পদংশনে তাই এই প্রাণীটি থেকে তিনি দূরেই থাকেন। মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পেরে বহু কষ্টে অন্তিম বাক্যগুলি উচ্চারণ করলেন তিনি, “তাকে বলে দিও প্রকৃতির নিয়মকে উলঙ্ঘন করার সাধ্য কারুর নেই। সেও পারবে না। একদিন তাকে পরাজিত হতে হবেই।”

১০ই মে, ২০১৮

প্রখর গ্রীষ্মের দাবদাহে প্রকৃতি জ্বলছে। এই কাঠফাটা রোদ্দুরের মধ্যেই অর্ক বাড়ির বাইরে যাবার জন্য তৈরি হলো।

“কী রে এই ঘোর দুপুরে কোথায় যাবি?” অবাক হলেন অর্কর মা।

“সাইবার ক্যাফেতে যাব। এই সময় গেলে ফাঁকা থাকে নিশ্চিন্তে কাজ করা যায়।”

“আচ্ছা যা তাহলে। টাকা নিবি নাকি?

“নাহ।”

পিচ গলা রাস্তায় পা রাখলো অর্ক। সারা শরীর ঝলসে যাচ্ছে ।

“চললি তাহলে?” রবির গলা। ওদের বাড়িটা রাস্তার ধারে আর রবির রুমের একটা জানালা একদম রাস্তার ওপরে। জানালা লাগাতে এসে রবির চোখ পড়েছে অর্কর ওপর।

“হুম, যাবি তো আয়।”

“না ভাই, আমি তো তোমার মত লাট্টু হইনি যে গরমে সেদ্ধ হতে হতে চুম্বকের টানে যাব।”

অর্ক হেসে রবিদের বাড়ি পার হয়ে গেল। সত্যিই রুবি বৌদি ওকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করছে। অর্ক সাধারণত ওর প্রয়জনীয় কাজকর্ম ওর দাদার ল্যাপটপেই সেরে নেয় কিন্তু অনিক অফিসের একটা ট্রেনিংয়ে একমাসের জন্য ভুবনেশ্বর গেছে তাই সেদিন অর্ক আর রবি ওদের পাড়ার সাইবার ক্যাফেটায় গিয়েছিল। এই বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে ওরা। দুজনেই পড়াশোনায় ভালো তাই বিভিন্ন ভালো কলেজের সন্ধান, এডমিশন টেস্টের ফর্ম ফিলাপ এসব একসাথেই করছিল। কিছুদিন আগে ওরা ঢোকার সাথে সাথেই বছর পঁচিশের একটি বিবাহিতা মেয়ে ঢুকল। কালো শিফন শাড়ি আর স্লিভলেস ব্লাউজে যেন এক বিদ্যুৎ শলাকা। সর্পিনীর মত হিলহিলে শরীর, মাখনের মত পেলব বাহু আর ঠোঁটের ওপরে একটা ছোট্ট তিল। মিষ্টি হেসে অর্ককে জিগ্যেস করল, “এখানে প্রিন্ট আউট করা যাবে? আসলে আমি এ পাড়ায় নতুন তো তাই জিগ্যেস করছি?” ব্যস তার অতল জলের মতো চোখ দুটোতে তলিয়ে গেল অর্ক। চোখ দুটোয় তীব্র এক সম্মোহনী ক্ষমতা আছে। প্রিন্ট আউট নেবার পর কয়েকটা মেল করার জন্য সে আবার অর্কর সাহায্য চাইল। কম্পিউটারে খুব একটা তুখোড় নয় সে। পাশে বসে তাকে সাহায্য করার সময় তার শরীর থেকে মহুয়ার মত মাতাল করা এক ঘ্রাণ ভেসে এসে অর্ককে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সেই শুরু তারপর থেকে প্রায়ই পাড়ার দোকানে, সাইবার ক্যাফেতে দুজনের দেখা হতে লাগলো। আলাপ-পরিচয়ের পর্ব সাঙ্গ হয়ে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে দুজনের মধ্যে কিন্তু অর্কর মন যে তার চেয়েও বেশি কিছু চাইছে। সে প্রেমিকা হিসেবে পেতে চায় রুবিকে। অর্কর আঠেরোতে পা দিতে আরও কয়েকদিন বাকি। দুজনের মধ্যে বয়সের প্রাচীরটা অনেকটাই চওড়া তারওপর সে বিবাহিতা। অর্ক জানে সে যা চাইছে তা শুধু অনুচিতই নয় এমন এক অসম্ভব কল্পনা যার বাস্তব রূপায়ণ কোনদিনই সম্ভব নয় কিন্তু তার মন যেন বাঁধনহারা ঘোড়া যাকে কিছুতেই লাগাম পরাতে পারছে না। তার এই মানসিক অবস্থার কথা জানে শুধু রবি। রবি তাকে বুঝিয়েছে, “রুবি বৌদির স্বামী বাইরে, একলা থাকে তাই সময় কাটানোর জন্য সে একটু আধটু গল্পগাছা করে তোর সঙ্গে কিন্তু তার মানে এই নয় সে তোর প্রেমে পড়েছে। নিজেকে সামলা তুই। তুই যেটা চাইছিস সমাজের চোখেও সেটা নোংরামি ছাড়া কিছু নয়।” সব বুঝেও অর্ক নিজের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। আজও রুবির সাথে দেখা করতেই সাইবার ক্যাফেতে যাচ্ছে। ওর ওখানে আসার কথা। পকেটে ফোনটা বেজে উঠলো।

“হ্যালো।”

“হ্যালো, আমি রুবি বলছি। অর্ক, লক্ষী সোনাটি আমার একটা রিকোয়েস্ট রাখবে?”

“তুমি একবার শুধু বল না কী করতে হবে।”

“আমি ক্যাফেতে আসতে পারছি না। তুমি একটি বার আমার বাড়ি আসতে পারবে?”

“এক্ষুনি আসছি।” হেসে ফেলল অর্ক। মনে মনে খুশিও হলো। রুবি কোনও দরকারে তাকে ডাকছে এটা তার কাছে বিশাল প্রাপ্তি।

“শোনো তুমি পেছনের রাস্তাটা দিয়ে এসো। কেউ দেখলে আবার কিছু বলবে।” রুবির সাবধানী গলা।

দরজার ওপারে দাঁড়ানো রুবি অর্ককে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো, “তুমি সত্যি এসেছ অর্ক!”

ভেতরে ঢুকে অর্ক বলল, “বল কী দরকারে এত জরুরী তলব?”

“যদি বলি তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই ডেকেছি।” মুখ নিচু করে মৃদু স্বরে বলল রুবি।

অর্ক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। অবাক হয়ে রুবির দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ তার নজর আটকে গেল রুবির হাতের দিকে। সাদা ধপধপে হাতে কালো দাগ কীসের? কাছে গিয়ে বুঝলো ওগুলো পোড়া দাগ। তার না বলা প্রশ্নটা রুবি নিজেই বুঝে নিল, “ওগুলো সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ। কাল রতন বাড়ি এসেছিল। জানো অর্ক ও কোনওদিন আমায় ভালোবাসেনি। বিয়ের পর থেকেই মারধোর, ছ্যাঁকা দেওয়া এসব চলে। আমি আর পারছি না অর্ক।” ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল রুবি। অর্ক আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না ছুটে গিয়ে রুবিকে জড়িয়ে ধরল। অর্কর বুকে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে রুবি বলল, “আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি অর্ক। আমাকে তুমি ফিরিয়ে দিও না। আমাকে রতনের হাত থেকে মুক্ত হতে সাহায্য কর।”

আবেগ মথিত কণ্ঠে অর্ক বলল, “আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালবাসি। বল কী করতে হবে?”

চোখ মুছে রুবি যা বলল তার সারমর্ম এই যে রতন এক তান্ত্রিকের কাছে যাতায়াত করে। রুবি যদি রতনকে ডিভোর্স দিতে চায় তাহলে তান্ত্রিক তার ক্ষমতা বলে রুবির ক্ষতি করবে। এদিকে রুবি এক সিদ্ধ পুরুষের সন্ধান পেয়েছে যিনি তাকে এক সাধন মার্গ দর্শন করিয়েছেন। সেই পথে সাধনা করলে রতনের সঙ্গী তান্ত্রিক দুর্বল হয়ে পড়বে কিন্তু একলা সেই সাধনা সম্ভব নয়। একজন সঙ্গী প্রয়োজন।

অর্ক রুবির হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বলল, “আমি প্রতি মুহূর্তে তোমার পাশে আছি।”

১৩ই মে, ২০১৮

খুব সন্তপর্ণে বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে এল অর্ক। তার মা-বাবা, বৌদি সবাই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। তাদের অজ্ঞাতেই গত দুদিন ধরে রাত সাড়ে এগারোটা বাজলেই নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে রুবির বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। তাদের বাড়ির পেছন দিয়ে একটা সরুগলি পথ রুবির বাড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছে। রুবির বাড়িটা পাড়ার একপ্রান্তে বহুদিন তালা বন্ধই পড়ে ছিল। মালিকরা বাইরে থাকে। তারপর রুবি ভাড়া নিয়েছে। চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। সেই কৃষ্ণ সায়রের মধ্যে অর্কর টর্চের আলোটা বিন্দুসম। গন্তব্যে পৌঁছে অর্ক বুক ভরে একবার শ্বাস নিল। আজ রাত বারোটা বাজলেই তার সাবলকত্ব প্রাপ্তি হবে আবার আজই তাদের সাধনার অন্তিম দিন। এরপর রতনের লৌহজাল থেকে রুবির মুক্তি কেউ আটকাতে পারবে না। রাত বারোটা থেকে তিনটে পর্যন্ত চলে বিভিন্ন পূজাচার। তারপর অর্ক ফিরে যায় বাড়ি। তাকে বিশেষ কিছুই করতে হয় না। যা কিছু সব রুবিই করে সে শুধু খালি গায়ে একটা লাল কাপড় লুঙ্গির মত করে পরে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। অবশ্য তাকে মড়ার খুলিতে করে একটা পুতি গন্ধময় জঘন্য তরল খেতে হয়। সেটা খাবার পর ঘন্টা দুয়েক মাথাটা ঝিমঝিম করে, সব কিছু ঝাপসা লাগে তারপর সব ঠিক হয়ে যায়। সে যাই হোক রুবির জন্য সে নিজের জীবন পর্যন্ত দিতে পারে। সমস্ত উপকরণ রুবিকে সেই সিদ্ধ পুরুষই জোগাড় করে দিয়েছেন। রুবির বাড়ির পেছন দিকে একটা ঘর আছে। সেই ঘরটাই সাধনার জন্য রুবি ব্যবহার করছে। মেঝেতে ওর সেই গুরুর নির্দেশ মত সিঁদুর দিয়ে কিছু নকশা আঁকা। ঘরের এক প্রান্তে পাঁচটা মড়ার খুলি সাজানো আর আরও বিভিন্ন উপচার রাখা আছে। অর্ক ঢুকতেই রুবি ওকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল। অর্ক হেসে বলল, “এখনও তো পনের মিনিট বাকি।” রুবি ওর নাকটা টিপে দিয়ে বলল, “তখন তো সুযোগ হবে না পুজোয় বসে যাব।”

১৫ই জুন, ২১১৮

কাঁচের জানালার ওপাশে ঝকঝকে আকাশ। এখন পৃথিবীর মানুষ অনেক সচেতন তাই দূষণের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। একসময় তো পৃথিবী ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছিল। শেষে আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা জাতি-ধর্ম, শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে একত্র হয়ে কিছু সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যার ফলস্বরূপ আজকের এই দূষণ মুক্ত পৃথিবী।

কায়া টবে লাগানো কৃত্রিম মানিপ্ল্যান্টটার গায়ে পরম মমতায় হাত বুলাচ্ছিল। এখন প্রায় সব বাড়িতেই এই ধরনের কৃত্রিম গাছ রাখা থাকে। সাধারণ গাছের তুলনায় এদের সালোকসংশ্লেষের হার প্রায় তিন গুণ ফলে বাড়ির পরিবেশ নির্মল থাকে। কায়ার চোখের কোল বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে মানিপ্ল্যান্টটার পাতার ওপর পড়ে জানালা দিয়ে আগত সূর্যরশ্মিতে হীরকদ্যুতির সৃষ্টি করল। এই গাছটা তাকে রিকি উপহার দিয়েছিল একুশ বছরের জন্মদিনে। নিজের পকেটমানির টাকা বাঁচিয়ে দিদির জন্য কিনে এনেছিল সে। বিয়ের পরে এই আপ্যার্টমেন্টে আসার সময় কায়া এটা সাথে নিয়ে এসেছিল। ছোট ভাইটা যে তার ভীষণ প্রিয়, ভীষণ আদরের কিন্তু আজ সে কোথায় আছে, তার কী পরিণতি হয়েছে কায়া কিচ্ছু জানে না। রিকি আদৌ বেঁচে আছে তো? কথাটা মনে আসতেই দুহাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলো কায়া। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে খেয়াল নেই তার। কাঁধের ওপর একটা স্পর্শ অনুভব করে মুখ তুলল সে। রাজ ফিরে এসেছে বাইরে থেকে। তাদের আপ্যার্টমেন্টে অপরিচিত লোক ছাড়া দরজা খোলার দরকার হয় না। যাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট সিস্টেমে লোড করা আছে তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যান করে আপনিই দরজা খুলে যায়।

“চল।”

“কোথায়?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে কায়া।

“গেলেই বুঝতে পারবে।” শান্ত গলায় বলে রাজ।

“প্লিজ রাজ, তুমি যদি আমার মন ভালো করার জন্য….।” কায়াকে কথা শেষ করতে দেয় না রাজ, “আমি তোমার এন্টারটেইনমেন্ট করার জন্য কোথাও যাব না। অন্য একটা জায়গায় যাব। আমার ওপর ভরসা নেই তোমার?”

রাজের হাতটা ধরে নিয়ে কায়া বলে, “রাগ করো না প্লিজ। জানো তো আমার মনের অবস্থা। তুমি দাঁড়াও আমি রেডি হয়ে আসছি।”

গাড়ির ম্যাপিং ডিসপ্লে বোর্ডে গন্তব্য স্থল হিসেবে রাজ সেট করল, “গ্রাভিটি "। কায়া অবাক হয়ে বলল, “গ্রাভিটি মানে তো তোমার সেই হাফ ম্যাড প্রফেসর সেনের বাড়ি।”

“হুম” সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় রাজ।

“প্রফেসর সেনের বাড়ি যাবে এখন?”

“হুম, গাড়ি সিগন্যাল দিচ্ছে রাস্তায় জ্যাম আছে। স্কাই পাথই বেটার।” গাড়ির সিস্টেম চালু করে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসল রাজ। মুহূর্তের মধ্যে তার গাড়ির চাকাগুলো ভেতরে ঢুকে গিয়ে তার বদলে চারখানা ফ্লিপার বেরিয়ে এল। মাটির থেকে তিরিশ ফুট ওপরে স্কাই পাথ বেয়ে বাতাস কেটে এগিয়ে চলল তাদের গাড়ি। দামি গাড়ির মালিকরা এখন স্কাই পাথটাই পছন্দ করে কারণ কমদামি গাড়িতে এই সুবিধা না থাকায় স্কাই পাথে ভিড় কম হয়।

“এই সময় হঠাৎ প্রফেসর সেনের বাড়ি যাচ্ছ?”

কায়ার প্রশ্নে একটু চুপ করে থেকে তারপর মুখ খোলে রাজ, “তোমাকে একটা কথা বলিনি। যখন বুঝতে পারলাম রিকির অন্তর্ধান রহস্য ভেদ করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না আর আমরাও কোনও কূলকিনারা পাচ্ছি না তখন আমি প্রফেসরের কাছে যাই। তুমি তো ওনার অগাধ পাণ্ডিত্য, অসাধারণ বুদ্ধি সম্পর্কে সবই জানো। মানুষটা একটু খ্যাপাটে হলেও সারা পৃথিবীর মানুষ ওনার প্রতিভার সামনে নতজানু হয়। যদি কিছু বুঝতে পারেন এই ভেবে গিয়েছিলাম। উনি সময় চেয়েছিলেন। আজ উনি তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে বলেছেন।”

“তুমি আমাকে আগে কিছু বলনি কেন?”

“বললে তোমার মনে আশা জাগত। হয়ত বাবা-মাকেও বলতে কিন্তু আদৌ কোনও পথ বেরবে কিনা আমি নিজেই জানি না তাই বৃথা তোমাদের কষ্ট আর বাড়াতে চাইনি।”

কথা বলতে বলতে ওরা প্রফেসর সেনের বাড়ি পৌঁছে গেল। শহর ছাড়িয়ে কয়েক একর জায়গার ওপর প্রফেসরের “গ্রাভিটি” অর্থাৎ বাড়ি আর ল্যাবরেটরি। বাড়ির নামটা প্রফেসর নিজেই রেখেছেন। রাজ আগেই সিগন্যাল পাঠিয়েছিল তাই নির্বিঘ্নে ল্যান্ডিং প্যাডে নামতে পারল ওরা।

“আরে এসো এসো ভেতরে এস। তোমাদের মত ইয়ং কাপলরা মুখ গোমড়া করে রাখলে একটুও দেখতে ভালো লাগে না তাই স্মাইল প্লীজ।” প্রফেসরের উষ্ণ অভ্যর্থনায় কায়ার মনে একটু আশার আলো উঁকি দিল। পারলে এই মানুষটাই পারবেন।

“একী চেহারা করেছ?” কায়াকে দেখে আঁতকে উঠলেন প্রফেসর। তিনি নিজে খুব স্বাস্থ্য সচেতন। লম্বা, ফর্সা মানুষটিকে দেখলে মনেই হবে না পঞ্চান্ন বছর বয়স হয়ে গেছে তাঁর।

“সবই তো জানেন। আপনার তো এত বুদ্ধি পারেন না আমার ভাইটাকে খুঁজে দিতে?” কায়া কেঁদে ফেলল।

“কেঁদো না কায়া। আমি এই বিষয়েই কথা বলতে তোমাদের ডেকেছি।”

কায়া আর রাজ একবুক আশা নিয়ে প্রফেসরের দিকে তাকায়।

“আমি তোমাদের আগে একটা গল্প শোনাতে চাই।”

অবাক হলেও কায়া আর রাজ চুপ করে থাকে কারণ তারা জানে এই গল্প শোনানোর পেছনে নিশ্চয়ই কিছু গূঢ় অর্থ আছে।

প্রফেসর জ্যোতির্ময় সেন শুরু করেন, “আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছর আগে এই বঙ্গদেশের বুকে রজনী নামে এক রূপজীবিনি ছিল। কোন জায়গায় থাকত বলছি না কারণ সেসব নাম এখন বদলে গেছে তোমরা বুঝতে পারবে না। তার রূপের মোহে কত আমির হয়েছে ফকির, কত প্রেমিক হয়েছে উন্মাদ তার ঠিক নেই। তার রূপের জালে যে একবার ধরা দিত রজনী তাকে নিঙড়ে নিত। কিন্তু এই রজনীর মনেও একটা আশঙ্কা ছিল। নিজের ওই ভরা জোয়ারের মত যৌবন হারাবার ভয় তাকে প্রতি মুহূর্তে তাড়া করে বেড়াতো। সে ভালো করেই জানতো তার এই রূপ-যৌবন চিরস্থায়ী নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাতে ভাটার টান আসবেই। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। নিজের রূপ-যৌবন ধরে রাখার উপায় খুঁজছিল সে। এমন সময় তার সাথে এক তান্ত্রিকের পরিচয় হয়। সাধনার দ্বারা অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল সেই তান্ত্রিক। সেই তান্ত্রিকের সাধন সঙ্গিনী হয়ে রজনী এক অদ্ভুত ক্ষমতা লাভ করে। উপযুক্ত তন্ত্র সাধন ক্রিয়ার মাধ্যমে তার যৌবনের পিয়াসী সুলক্ষণ যুক্ত বিপরীত লিঙ্গের মানুষের অর্থাৎ বলা যায় একজন পুরুষের জীবনী শক্তি হস্তগত করতে সমর্থ হয় সে। এই তান্ত্রিক ক্রিয়ার ফলে রজনীর বয়স পঁচিশেই আটকে থাকে আর একজন পুরুষের জীবনী শক্তি হরণ করার পর সে একশ বছর ওই ভাবে কাটাতে পারে। একশ বছর পর আবার তার সর্ব সুলক্ষণ যুক্ত পুরুষের দরকার হয়। এক কথায় বললে রজনী অমরত্ব এবং চিরযৌবন দুটোই করায়ত্ত করেছে। এক আঠারো বছর বয়সী সৈনিক ছিল তার প্রথম শিকার। এই তন্ত্র সাধনার নিয়ম অনুযায়ী প্রতি একশ বছর পর তাই তার আঠারো বছর বয়সী পুরুষেরই প্রয়োজন হবে নিজের রূপ-যৌবন রক্ষা করার জন্য। একটা কথা বলা হয়নি, ক্ষমতা লাভ করার পরই সে তার গুরু সেই তান্ত্রিককে ছলনা করে মেরে ফেলে।” এতদূর বলে প্রফেসর একটু থামলেন। কায়া আর রাজ মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে। জল খেয়ে প্রোফেসর আবার শুরু করলেন, “তোমরা অবাক হচ্ছ জানি কারণ আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে এগুলো গল্প-কথা ছাড়া কিছুই মনে হবে না কিন্তু আমি কেন এই একথাগুলো বলছি তোমরা অচিরেই বুঝতে পারবে। আমি কিছুদিন আগে আমার বৃদ্ধা মাকে নিয়ে আমাদের আদি বাড়িতে গিয়েছিলাম। জায়গাটা একসময় একটা মফস্বল শহর ছিল। এখন অনেক উন্নতি হয়েছে সে যাই হোক সেখানে পুরোনো একটা আলমারী থেকে আমার ঠাকুরদার অল্প বয়সের একটা ডায়েরী হাতে পাই। সেই ডায়েরী থেকে জানতে পারি আজ থেকে একশ বছর আগে রুবি রায় নাম্নী এক অসাধারণ সুন্দরী যুবতীর আবির্ভাব ঘটে ওই পাড়ায়। অর্ক দাশগুপ্ত নামে একটি বছর সতেরোর ছেলে পাগলের মত তার প্রেমে পড়ে যায়। রুবি রায়ও তাকে প্রশয় দেয় এবং নিজের স্বামীর অত্যাচারের কথা বলে তাকে এক তান্ত্রিক ক্রিয়ায় সামিল করে। অর্ক যেদিন আঠারো বছরে পা দেয় সেদিন রাত থেকে অর্ক এবং রুবি দুজনেই নিখোঁজ হয়ে যায়। রুবির বাড়িতে তান্ত্রিক ক্রিয়ার কিছু উপচার আর ছাইয়ের স্তুপ ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি।”

প্রফেসরকে বাধা দিয়ে কায়া বলে ওঠে, “এতো একদম ভাইয়ের মতো ব্যাপার!”

“হুম, রাজ যখন আমাকে জানায় রিকির বন্ধুরা জানিয়েছে যে রিকি রেবেকা নামে একটি পঁচিশ বছরের মেয়ের প্রেমে পড়েছিল এবং নিজের আঠারো বছরের জন্মদিনে উধাও হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় রেবেকার বাড়িতে মড়ার খুলি, ছাই এসব পাওয়া গেছে তখনই আমি চমকে উঠি। তোমরা জানই তো বিভিন্ন বিষয়ে আমার আগ্রহ। আমি পুরনো দিনের বইপত্র খুব পড়ি আর সংগ্রহও করি। দাদুর ডায়েরি পাওয়ার পর এ বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে আমি অনেক পুঁথি, পুরনো তুলট কাগজ আরও বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে যেসব কাটা কাটা সূত্র পাই সেগুলোকে জুড়ে আমি এই গল্পটা খাড়া করতে পেরেছি। মাঝের কথা জানা নেই তবে আমার ধারনা রজনী, রুবি আর রেবেকা একই ব্যক্তি।”

“তার মানে ভাই আর...।” কেঁদে ওঠে কায়া।

“তুমি ঠিকই ধরেছ কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।” প্রফেসর বলেন।

“কী কথা প্রফেসর?” রাজের উদ্বিগ্ন প্রশ্ন।

“এই রজনী বা রুবি যাই বল না কেন একে না আটকালে প্রতি একশ বছর পর একটা করে জীবন অকালে শেষ হয়ে যাবে।”

“কীভাবে ওকে আটকান যাবে? ওকে আমরা খুঁজব কীভাবে?” কায়া কাঁদতে কাঁদতে বলে।

“ওকে বর্তমান সময়ে খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল আশা করি সেটা তোমরা বুঝতে পারছ।”

“তাহলে?” রাজ প্রশ্ন করে।

“আমার ল্যাবে চল।”

প্রফেসরকে অনুসরণ করে ওনার ল্যাবে এল ওরা। উনি সঙ্গে থাকায় নিরাপত্তার বেড়াজাল সহজেই পার হয়ে গেল। বিশাল ল্যাব ওনার। কয়েকজন সহকারী কাজ করছে। তারা প্রত্যেকেই বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্রছাত্রী।

“তারা, রুম নম্বর থ্রিতে যাব আমরা।”

“ওখানে!” সহকারী মেয়েটি অবাক হয়।

“হুম।” গম্ভীর স্বরে বললেন প্রফেসর।

স্বয়ংক্রিয় দরজার ওপারে গিয়ে দাঁড়ায় ওরা। প্রফেসর ওদের দিকে ঘুরে বলেন, “আমি যা বলছি আগে মন দিয়ে শোন। এটা কী বলত?” সামনে রাখা গাড়ির মত একটা জিনিস দেখিয়ে জিগ্যেস করেন।

“নতুন ধরনের কোনও গাড়ি।” রাজ উত্তর দেয়।

“নো, ইয়ং ম্যান। ইটস আ টাইম মেশিন। মাই নিউ ইনভেনশন।” বিস্ময়ে রাজ আর কায়ার চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। প্রফেসর আবার শুরু করেন, “এটার কাজ এখনও শেষ হয়নি, সবে শুরু হয়েছে, মানে এটাতে আরও পারফেকশন আনতে হবে। ইটস আ ভেরি টাফ জব। এখন পর্যন্ত এটার সীমা ১৯৬৮ সাল থেকে ২১১৭ সাল পর্যন্ত ।”

“মানে?” কায়া প্রশ্ন করে।

“মানে অতীত কালে ১৯৬৮ সালের চেয়ে আরো পিছিয়ে যেতে পারবে না আবার ২১১৭ সালের জানুয়ারির পরেও ঢুকতে পারছে না অর্থাৎ গত সতেরো মাসের মধ্যেও ঢুকতে পারছে না। ভবিষ্যতের দিকে এখনও কাজ শুরুই করিনি। আসলে এটার প্রসেস অতন্ত্য জটিল। যাই হোক এবার আসল কথায় আসি। তোমরা বুঝতেই পারছ আমার পক্ষে এই মুহূর্তে একমাস পিছিয়ে রিকিকে রক্ষা করা সম্ভব নয় তাই আমি ঠিক করেছি একশ বছর আগে পিছিয়ে অর্ক দাশগুপ্তকে বাঁচাবো আর সেই সঙ্গে রুবিকে ধ্বংস করব। আমার গাট ফিলিং বলছে রজনী, রুবি,রেবেকা… দে আর সেম পার্সন। বলতে পার একটা চান্স নিতে চাই। যদি একটা ছেলেও বাঁচে।”

“আপনি একলা যাবেন?” কায়া প্রশ্ন করে।

“হুম, টাইম ট্রাভেল ইজ আ কমপ্লিকেটেড ম্যাটার। কিছু যদি গণ্ডগোল হয়, বর্তমানে নাও ফিরতে পারি। আরও বড় বিপদও হতে পারে।”

“আমি আপনার সঙ্গে যাব।” দৃঢ় কণ্ঠে বলে কায়া।

“কায়া ঠিক বলেছে। আমিও যাব।”

প্রফেসর প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না কিন্তু ওদের অনুরোধ-উপরোধের সামনে শেষে পরাজিত হলেন। ঠিক হল কিছু প্রস্তুতি নিয়ে অভিযান শুরু হবে।

১৩ই মে, ২০১৮

একটা তীব্র ঝাঁকুনি তারপর সব অন্ধকার। কয়েক মুহূর্ত পরে প্রফেসরের গলা, “লেটস গো গাইজ। ওয়েল কাম টু মাই নেটিভ প্লেস।” চোখ খুলে টাইম মেশিনের বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। টাইম মেশিনটা দেখলে যে কেউ ভাববে একটা দামি চার চাকা গাড়ির অতিরিক্ত কিছু নয় এটা। চারপাশে তাকিয়ে ওরা বুঝতে পারল জায়গাটা একটা বাড়ির ব্যাকইয়ার্ড। বাড়ির পেছনে অনেকটা পাঁচিল ঘেরা জায়গা তার মধ্যেই এখন টাইম মেশিন শুদ্ধ ওরা তিনজন। ওদের প্রাথমিক বিস্ময় কাটতে প্রফেসর বললেন, “এটা আমারই বাড়ি তবে একশ বছর আগে। আমার দাদু শ্রী রবিন সেনের ডায়েরি অনুযায়ী আজ বাড়িতে শুধু আমার দাদু আছেন। বাকিরা একটা শ্রাদ্ধ বাড়িতে গেছেন। পরশু ফিরবেন। একটা কথা বলা হয়নি আমার দাদু ছিলেন অর্ক দাশগুপ্তের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। রুবি যেসব কথা বলতে বারণ করেছিল দাদুর চাপাচাপিতে অর্ক সেসব প্রিয় বন্ধুকে বলে ফেলেছিল। দাদুর কাছ থেকেই সব জেনে রুবির বাড়িতে সবাই খোঁজ করতে গিয়েছিল। অর্ককে বাঁচাতে দাদুর সাহায্যের খুব প্রয়োজন হবে আমাদের। চল ভেতরে যাই। পেছনে কুয়ো তলার খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো ওরা। গান ভেসে আসছে, “দেখা জো তুঝে ইয়ার দিল মে বাজি গিটার...।” একটি ছেলে স্যান্ড গেঞ্জি আর গন্ডা খানেক পকেটওয়ালা বারমুডা পরে উদ্বাহু হয়ে গানের তালে নাচছে। প্রফেসর দেখে মনে মনে ভাবলেন, “এইরকম নাচের স্টাইলকেই কি ভাসান ডান্স বলত আগে?”

“দেখছ এই ব্যক্তিটিই ভবিষ্যতে আমার ওপর খবরদারি করবেন। আমাকে ভদ্রলোক করার চেষ্টা করবেন আবার বাবাকে বলে আমার প্রথম প্রেম অঙ্কুর তো দুরস্থান বীজেই নষ্ট করবেন।” প্রফেসরের বলার ভঙ্গিতে ওরা হেসে উঠলো। নাচতে নাচতে এতক্ষণে রবির চোখ গেল ওদের দিকে। হঠাৎ করে এমন অনাহুত অতিথি দেখে রবি হতভম্ব হয়ে গেল। কিছু বলতে গেল সে কিন্তু তার আগেই প্রফেসর তাঁর পকেট থেকে পিস্তলের মত একটা জিনিস বের করে রবির দিকে তাক করে বললেন, “বেশি ট্যা ফো করবে না। ভবিষ্যতে অনেক জ্বালাবার সুযোগ পাবে আমাকে। যা বলছি মন দিয়ে শোনো এখন। আমরা ভবিষ্যতের মানুষ। আমি তোমার আপন নাতি। আজ থেকে দশ বছর পর আমার ঠাকুমার কপাল পুড়বে। তোমার একমাত্র ছেলের একমাত্র ছেলে আমি। রুবি রায়ের হাত থেকে অর্ককে বাঁচাতে এসেছি আমরা।” রবি কাঁপতে কাঁপতে প্রশ্ন করে, “আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

“জানি তো তোমার বুদ্ধির বহর। ঠাকুমা কি আর সাধে বলত এই লোকটা আমার জীবনটা শেষ করে দিল। যাই হোক শোনো এখন।” প্রফেসর ভালো করে সমস্ত ব্যাপারটা এবং তাঁদের আসার উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বললেন রবিকে।” শুনতে শুনতে রবির মুখটা ক্রমশ হাঁ হয়ে যাচ্ছিল। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তার কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রফেসর তার বিশ্বাস অর্জন করেই ছাড়লেন। হাজার হোক দাদু-নাতির সম্পর্ক। কায়ার দুচোখ ভরা জল দেখে ভারী মায়া হলো রবির। তার দিদির মতোই তো তাছাড়া এঁদের কথা অনুযায়ী অর্কর সামনে বড় বিপদ। রুবি বৌদিকে শুরু থেকেই কেমন একটা লাগতো তার। অর্ককে যেন বশ করে ফেলেছে। সমস্ত চিন্তাভাবনা যেন লোপ পেয়েছে ছেলেটার। রবি ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “অর্ককে সব বলে দিলে হয় না?”

“না হয় না, কারণ প্রথম কথা অর্ক আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। প্রেমে পড়লে মানুষ অন্ধ, বোবা, কালা সব হয়ে যায়। এই কথাটা আমার দাদু মানে তুমিই আমাকে বলেছিলে যখন কলেজে পড়তাম। আর দ্বিতীয়ত আমার লক্ষ্য শুধু অর্ককে বাঁচান নয়, রুবির ধ্বংস নাহলে ও তো আবার নতুন শিকার খুঁজে নেবে।

“আমরা তাহলে কী করব?”

“আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে শোনো মন দিয়ে।” খাটের উপর সবাই বসলেন। প্রফেসর তাঁর পরিকল্পনা ভালো করে বুঝিয়ে বললেন ওদের। সবশেষে বললেন, “আমার প্ল্যান যে সাকসেসফুল হবেই তার কোনও গ্যারান্টি নেই কিন্তু চেষ্টার তো কোনও বিকল্প নেই।”

১৩ই এপ্রিল, ২০১৮

“কাকিমা, অর্ককে একটু নিয়ে যাব আমার সাথে? আমার এক দাদু এসেছেন ওনাকে মহামায়া মন্দিরে নিয়ে যাব।”

“কীসে যাবি তোরা?”

“দাদুর ফোর হুইলার আছে।”

“আচ্ছা নিয়ে যা তাহলে।” নিশ্চিন্ত হন অর্কর মা।

“ফিরতে দেরি হলে চিন্তা করো না।”

“ঠিক আছে।”

বাড়ি থেকে বেরিয়ে অর্ক বলে, “তোর কোন দাদু এসেছেন রে?” মুচকি হেসে রবি বলে, “নাতি দাদু।”

“মানে?”

“মানে ওনার নাম ওটা।”

“ভারী অদ্ভুত নাম তো। আচ্ছা আজ তো তোদের কোথায় যেন অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণ ছিল ?”

“ছিল তো সবাই গেছে। দাদুর জন্য আমি রয়ে গেছি।” মনে মনে রবি ভাবে, “আজকের রবি তো সপরিবারে বর্ধমানে মাসির বাড়িতে কব্জি ডুবিয়ে খাচ্ছে। তুই তো জানিস না আমি হলাম একমাস পরের রবি।”

অর্ককে নিয়ে রবি ওদের বাড়ির পেছনে এল।

“তোর দাদুর গাড়িটা দারুণ।” মুগ্ধ হয়ে বলে অর্ক।

“চল গাড়িতে উঠি। দাদু গাড়িতেই আছেন।” গাড়িতে ওঠার পর জ্যোতির্ময় বলেন, “ইয়াং ম্যান হ্যাভ আ ড্রিংক।” জ্যোতির্ময়ের বাড়ান ড্রিঙ্কের ক্যানটা থেকে দু চুমুক খাওয়ার পরই অর্কর মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। জ্যোতির্ময় তারিখ আর সময় সেট করলেন।

১৩ই মে, ২০১৮

চারিদিক নিস্তব্ধ শুধুমাত্র ঝোপের মধ্য থেকে ক্রমাগত ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। কায়া আর রাজ রুবির বাড়ির পেছন দিকে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের কয়েক হাত দুরেরই রুবির বাড়ির ভাঙা পাঁচিল আর তার বামদিকে সেই ঘরখানা। প্রফেসরের তৈরি নাইট ভিশন স্পেক্টাগ্লাসের সাহায্যে ওরা সবকিছু দিনের আলোর মত পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে। অর্ককে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আগেই রুবি ওই ঘরে ঢুকেছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল প্রফেসর আর রবি এখনও এলেন না। শেষ রক্ষা কি সম্ভব হবে? কায়া এবং রাজ দুজনের মনেই আশঙ্কার কালো মেঘ উঁকি দিচ্ছে। হঠাৎ মাটিতে মৃদু কম্পন শুরু হলো ।কয়েক সেকেন্ড পরে প্রফেসরের টাইম মেশিন দৃশ্যমান হলো। ভেতরে প্রফেসর, রবি আর অচৈতন্য অর্ক। প্রফেসর বেরিয়ে এসে বললেন, “আর দেরি নয়। কায়া তোমাকে কী করতে হবে মনে আছে তো?”

“ইয়েস প্রফেসর।”

“ওকে, তুমি তোমার জায়গায় চলে যাও। আমার সিগন্যাল পেলেই কাজ শুরু করবে আর রাজ তোমরা অর্কর জামা-কাপড় খুলে লাল কাপড়টা পরিয়ে নিয়ে এসো।”

জানালার একচিলতে ফাঁক দিয়ে প্রফেসর দেখলেন ঘরের মাঝখানে তান্ত্রিক ক্রিয়ার একটা নকশার ওপর বসে আছে অর্ক। সে যে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তার সামনে বসে রুবি মন্ত্রোচ্চারণ করছে। হাতের কব্জিতে পরা ঘড়ির মত যন্ত্রটায় বোতাম টিপে সিগন্যাল পাঠালেন প্রফেসর।

যত সময় পার হচ্ছে রুবির মনটা এক অপার্থিব আনন্দে ভরে উঠছে। আর অল্প কিছু তান্ত্রিক ক্রিয়ার পরই আবার একশ বছরের জন্য সে নিশ্চিন্ত। তার প্রথম শিকার ছিল এক রাজ সৈনিক, তারপর একে একে এক তরুণ ভাস্কর, জমিদার তনয়, নবীন ব্যবসায়ী হয়ে আজকের এই অর্ক। অপ্রতিরোধ্য সে। উত্তুঙ্গ তার আত্মবিশ্বাস। অকস্মাৎ চমকে উঠল রুবি। মূল বাড়ির দিক থেকে এক পৈশাচিক আওয়াজ ভেসে আসছে। হাড়হিম করা ভয়ানক সে আওয়াজ। বাড়িটাও কাঁপছে মনে হচ্ছে। অর্ক কোথাও পালাবার মত অবস্থায় নেই তাই তাকে অরক্ষিত রেখেই রুবি বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। সে বেরনোর সঙ্গে সঙ্গে প্রফেসর তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে অসম্ভব দ্রুততায় ঘরে ঢুকলেন। ঘরে উপস্থিত অর্কর জায়গায় তাঁদের সাথে নিয়ে আসা অর্ককে বসিয়ে দিয়ে বর্তমান অর্ককে নিয়ে ঘরের কোণায় চলে এলেন তাঁরা। তাঁর তৈরি ফোর ডি ক্রিয়েটার নামক গ্যাজেটটি চালু করার সঙ্গে সঙ্গে কায়াকে সিগন্যাল পাঠালেন। তাকে বলাই আছে সংকেত পেলেই সাউন্ড ভাইব্রেটরটি বন্ধ করে দিতে কারণ তিনি কোনও মতেই রুবির মনে সন্দেহ সৃষ্টি করতে চান না, তাছাড়া কায়া ধরা পড়ে গেলে ওকে মুহূর্তের মধ্যে শেষ করে দেওয়ার মত ক্ষমতা রুবির আছে।

রুবি বসার ঘর পর্যন্ত আসতেই চারিদিক পূর্ববৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। অবাক হয়ে ব্যাপারটা কী ঘটল অনুধাবন করার চেষ্টা করতে লাগলো সে। অন্যদিকে কায়ার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। আপাদমস্তক কালো পোশাক পরিহিতা কায়া বাগানের একটা ঝাঁকড়া গাছের পেছনে লুকিয়ে আছে হাতে সাউন্ড ভাইব্রেটরের রিমোট। যন্ত্রটা রাখা আছে বাইরের ঘরের জানালার নীচে। কয়েক মিনিট পর রুবির সম্বিৎ ফিরল। সাধনার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তাছাড়া অর্কও একলা আছে ওখানে। তাড়াতাড়ি সে ফিরতি পথ ধরল।

অর্ক একই রকম ঝিমুনি ভাব নিয়ে বসে আছে দেখে নিশ্চিন্ত মনে আবার কাজ শুরু করল সে। ততক্ষণে ফোর ডি ক্রিয়েটারের সাহায্যে ঘরের মধ্যেই একটা হাইপার কিউব তৈরি করে সঙ্গীদের নিয়ে তার মধ্যে আত্মগোপন করেছেন প্রফেসর। এছাড়া উপায় ছিল না প্রায় সংজ্ঞাহীন অর্ককে বের করে নিয়ে যেতে গেলে রুবির চোখে পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। রুবি একমনে মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছে সে বুঝতেও পারেনি এই ঘরের মধ্যেই চতুর্থ মাত্রায় তিনজন অনাহুত ব্যক্তি আর আরেকজন অর্কর অস্তিত্ব আছে। প্রফেসরের তৈরি ফোর ডি স্পেক্টাগ্লাসের সাহায্যে রুবির ক্রিয়াকলাপ তাঁরা দেখতে পেলেও রুবি তাঁদের দেখতে পাচ্ছে না। অন্তিম মুহূর্তে পৌঁছে গেছে রুবি ওরফে রজনীর সাধনা। সে একটু একটু করে অর্কর প্রাণশক্তি হরণ করার জন্য প্রস্তুত হলো। আর কয়েক মুহূর্ত পরেই সে অমরত্বের দিকে আরো এক কদম এগিয়ে যাবে আর অর্কর দেহটা হয়ে যাবে এক মুঠো ছাই। কিন্তু একীহচ্ছে অর্কর প্রাণশক্তি শোষণ করা শুরু করতেই তার শরীরের চামড়া কুঁচকে যাচ্ছে কেন! জরা ক্রমশ থাবা বসাচ্ছে তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গে আর অর্কর মধ্যে কোনও পরিবর্তনই ঘটছে না। কী করে সম্ভব এটা! অর্ক তো সর্ব সুলক্ষণযুক্ত পুরুষ আর রাত বারোটা বাজতেই সে আঠারো বছরে প্রবেশ করেছে তাহলে? রুবি জানতেও পারল না সে যে অর্কর প্রাণশক্তি হরণ করার চেষ্টা করেছে তার বয়স আঠারোর সীমা অতিক্রম করেনি। এই অমরত্ব সাধনায় সামান্য ত্রুটিও ক্ষমাযোগ্য নয়। রুবির জরাগ্রস্থ শরীরটা ক্রমশ দুর্বল হয়ে নেতিয়ে পড়ছে। শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। অবশেষে চারশ বছরের জরার ভার থেকে রুবির শরীর মুক্তি পেল। তার আত্মা বিলীন হয়ে গেল মহাকালের গর্ভে।

প্রফেসরের মুখে হাসির রেখার আঁকিবুকি। তাঁর পরিকল্পনা সফল হয়েছে। একটা ছয়শ বছরের পুরনো পুঁথি পড়ে তাঁর যা ধারণা হয়েছিল সেটাই প্রয়োগ করেছিলেন তিনি। একমাস আগের অর্ককে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে জেনেছে হঠাৎ সে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় মহামায়া মন্দিরে আর যাওয়া হয়নি। বর্তমানের অর্ক এখন রবির ঘরে বসে আছে। ইনজেকশন দিয়ে তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা হয়েছে। আড়াল থেকে ওদের কথাবার্তা শুনছেন প্রফেসর।

“রবি বল না কী হয়েছে? আমি তোর বাড়িতে এলাম কী করে?” উদ্বিগ্ন গলা অর্কর।

“রুবি বৌদির বাড়িতে আগুন লেগেছে অর্ক। আমি তো জানতাম তুই ওখানে আছিস তাই ছুটে গিয়ে লোকজনের তোর ওপর লক্ষ্য পড়ার আগেই তোকে যাহোক করে বের করে আনি।”

“রুবি? রুবি কোথায়?” চেঁচিয়ে ওঠে অর্ক। প্রফেসরের শেখান কথাগুলো আউড়ে যায় রবি, “তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি রে। এতবড় বাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিল। নেহাত ওই ঘরটা পেছনে বলে তোকে বের করতে পেরেছি। ওখানে তো ছিল না। মনে হয় রুবি বৌদি আর….।”

“নাহ, হতে পারে না।” ডুকরে কেঁদে উঠলো অর্ক।

অর্ককে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়িতে রেখে এল রবি। ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার আগে প্রফেসর আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। উনি চাননি এই সাধনার বিষয়ে কেউ বিন্দুমাত্র আভাসও পাক।

এবার বিদায়ের পালা। কায়া রবির হাত দুটো ধরে বলল, “যদিও সময়ের হিসেবে আমি তোমার চেয়ে অনেক ছোটো কিন্তু তাও তোমাকে আমার ভাইয়ের মত মনে হয়েছে। তোমাকে সারাজীবন মনে থাকবে।” কায়া আর রাজ বিদায় নেবার পর প্রফেসর বললেন, “আপাতত টা টা। তোমার আমার তো আবার দেখা হবে। তবে প্লীজ বেশি জ্বালিও না আমাকে।”

১৬ই জুন, ২১১৮

প্রফেসরের লিভিংরুমে বসে এনার্জি ড্রিঙ্কে চুমুক দিচ্ছিল কায়া। টাইম ট্রাভেল করার পর বর্তমানে ফিরে এসে ভীষণ দুর্বল লাগছে ওদের। টেবিলের ওপর কায়ার ফোনটা বেজে উঠলো। রাজ এক আকাশ হাসি মুখে নিয়ে ফোনটা কায়ার দিকে বাড়িয়ে দিল। ভিডিও কলারের মুখটা দেখেই কায়া চমকে উঠল।

“হেই দি হোয়াটস আপ? তুই আর জিজ কোথায়?”

রিকির কথাগুলো কানে ঢুকছে না কায়ার। প্রাণভরে ভাইকে দেখছে সে। দু চোখের কোল ছাপিয়ে আনন্দাশ্রু ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার গালে। প্রফেসর মিউজিক বক্সে তাঁর পুরোনো গানের সংগ্রহ থেকে 1969 সালের একটা

গান চালিয়ে দিলেন “মনে পড়ে রুবি রায় কবিতায় তোমাকে…”