রণ - ঋজু গাঙ্গুলী

অলংকরণ - ষ্টারলগ ম্যাগাজিনে গল্পটি প্রকাশের সময় Boris Vallejo-এর আঁকা ছবি

কারসন চোখ খুলল।

মাথার ওপরে হালকা নীলাভ আকাশ। ও মাটি... না, বালির ওপর শুয়ে আছে। একটা ধারালো পাথর ওর পিঠের নীচে থাকায় ওর ব্যথা লাগছে। একদিকে কাত হল ও। তারপর হাত-পায়ে ভর দিয়ে উঠে বসল।

“আমার মাথাটা গেছে!” বিড়বিড় করল কারসন, “নয়তো আমি মারা গেছি।”

কথাটা ভাবার কারণ ছিল। যে বালিতে কারসন বসে ছিল তার রঙ উজ্জ্বল নীল! ওই রঙের বালি পৃথিবীতে হয় না। অন্য কোনো গ্রহেও হয় বলে কারসনের জানা নেই।

নীল রঙের একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি ডোমের নীচে নীল বালিতে বসে আছে ও!

হ্যাঁ, কারসন স্পষ্ট বুঝতে পারল, ওর মাথার ওপরে যা আছে সেটা আকাশ নয়। দূরে কোথাও একটা জায়গায় সেই ওলটানো বাটির মতো জিনিসটা শেষ হয়েছে। নীল রঙটার দিকে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকা যায় না, অস্বস্তি হয়।

কিছুটা বালি হাতের মুঠোয় নিয়ে ও আবার ছেড়ে দিল। বিভ্রম নয়, এটা বালিই। ওর ঘর্মাক্ত হাতে তার কয়েকটা দানা লেগে রইল।

ঘাম? তাই তো। বেশ গরম লাগছে। ঘাম গড়িয়ে পড়ছে ওর উন্মুক্ত পা দিয়ে। উন্মুক্ত??!

তাই তো! ও একেবারে উলঙ্গ! সেই অবস্থায় শরীরের যেখানে-যেখানে ওই নীল বালি লেগেছে, সেই জায়গাগুলোর রঙ নীল। কিন্তু বাকি শরীর স্বাভাবিক রঙই দেখাচ্ছে। কিছুটা আপনমনেই কারসন ভাবল, “যদি আলোটা নীল হত, তাহলে আমার গায়ের রঙটাও তাই দেখাত। সেটা যখন নয়, তার মানে বালিটা সত্যিই নীল। নীল বালি! আমি কোথায় আছি?”

জায়গাটা গরম। ভীষণ গরম... নরকও তো গরম বলেই ও পড়েছে। কিন্তু নরকের রঙ বোধহয় লাল। তাহলে এটা নরক নয়। তবে কি বুধ? বুধ ভয়ঙ্কর গরম ঠিকই। কিন্তু বুধ তো ওর অবস্থান থেকে প্রায় চারশো কোটি মাইল দূরে।

ওর অবস্থান!

এক ঝটকায় কারসনের সব মনে পড়ে গেল। প্লুটোর কক্ষপথের বাইরে নিজের ছোট্ট স্কাউটশিপে ছিল ও। ওর থেকে লাখ দশেক মাইল দূরেই অবস্থান করছিল পৃথিবীর আর্মাডা। তখনই ওদের স্ক্যানারের রেঞ্জে এসে পড়েছিল বহিরাগতদের একটা স্কাউটশিপ। অ্যালার্মটা আর্তনাদ করেছিল কান-ফাটানো আওয়াজ তুলে। তারপর...

 

এই বহিরাগতদের সম্বন্ধে পৃথিবীতে কেউ কিচ্ছু জানে না। কেমন দেখতে এরা, কী খায়, এমনকি কোত্থেকে এরা এসেছে, সবটাই অজানা। কৃত্তিকা নক্ষত্রমণ্ডলীর দিক থেকে ওরা এসেছে, শুধু এটুকুই নিশ্চিত।

প্রথমে পৃথিবীর সুদূরতম আউটপোস্টগুলোয় হামলা হয়। নজরদারি করা স্পেসশিপের সঙ্গে বহিরাগতদের ছোটো-ছোটো দলের সংঘর্ষ হয়। কোনোটায় পৃথিবীর বাহিনী জেতে, কোনোটায় তারা। কিন্তু একটা জাহাজও ধরা যায়নি। পৃথিবীর যেসব স্টেশন বা কলোনির ওপর হামলা হয়েছিল, সেখানেও কেউ বেঁচে ছিল না যারা হানাদারদের চেহারার বর্ণনা দিতে পারে।

প্রথমদিকে এই হামলাগুলো সংখ্যা বা নৃশংসতায় উল্লেখযোগ্য ছিল না। কিন্তু অবস্থাটা ক্রমেই বদলায়। এটাও স্পষ্ট হয় যে অস্ত্রের দিক দিয়ে পৃথিবীর ফাইটার স্পেসশিপগুলো এগিয়ে থাকলেও গতি আর নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বহিরাগতরা এগিয়ে আছে।

পৃথিবী প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী আর্মাডা তৈরি হয়। শুরু হয় অপেক্ষা। তারপর, সৌরজগৎ থেকে প্রায় দু’হাজার কোটি মাইল দূর থেকে বেশ কিছু স্কাউটশিপ খবর পাঠায়, এগিয়ে আসছে বহিরাগতদের বিশাল বাহিনী। সেই জাহাজগুলো ফিরে আসতে পারেনি। কিন্তু তাদের বার্তা থেকে স্পষ্ট, হানাদারদের এই বাহিনী হয় এসপার নয় ওসপার করার লক্ষ্যেই এগোচ্ছে।

স্কাউটশিপে বসে কারসন নিজের জীবনের প্রথম লড়াইয়ের জন্য তৈরি হচ্ছিল। ও জানে, মহাকাশে একটা যুদ্ধ তিন সেকেন্ডের বেশি টেকে না। তাই স্ক্যানারে বহিরাগত স্কাউটশিপটা দেখামাত্র নিজের নার্ভাসনেস, শুকিয়ে আসা ঠোঁট, গলা দিয়ে পিত্ত উঠে আসার তিতকুটে স্বাদ, এ-সব ভুলে কন্ট্রোল প্যানেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেটাকে নিশানায় নিয়ে তিন...দুই...এক-এর পর যেই ও ফায়ার করতে যাবে, তখনই স্ক্রিন থেকে গায়েব হয়ে গেছিল বহিরাগত স্কাউটশিপটা!

পাগলের মতো এদিক-ওদিকে খুঁজে কারসন একটু পরেই সেটাকে স্ক্রিনে ফিরে পায়। ও দেখে, স্কাউটশিপটা সোজা নামছে মাটির দিকে। ও-ও সেদিকে ঝাঁপ দেয়।

মাটি?!

ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে এতক্ষণে কারসনের খেয়াল হয়। প্লুটোর কক্ষপথের বাইরে যে বিন্দুতে ও ছিল তার সবচেয়ে কাছাকাছি গ্রহ বলতে নেপচুন, সেও প্রায় তিনশো কোটি মাইল দূরে! প্লুটো তো সূর্যেরও ওপাশে। তাছাড়া ওর ডিটেক্টরেও তো কোনো গ্রহ বা ওইজাতীয় বড়ো কিছু ধরা পড়েনি তার আগে।

কিন্তু সেই মুহূর্তে ওর ওসব ভাবার অবস্থা ছিল না। যাতে মাটিতে আছাড় না খায় সেজন্য কনট্রোলের সঙ্গে যুদ্ধ করতেই কারসন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মরিয়া হয়ে ব্রেক চেপা আর ডানদিকে ঘোরার চেষ্টা করতে গিয়েই ও একলহমার জন্য চোখে অন্ধকার দেখেছিল। আর তারপর এখানে!

 

চারদিকে তাকিয়ে দেখে কারসন। না, ওর স্কাউটশিপ, এমনকি মহাকাশ অবধি দেখা যাচ্ছে না।

উঠে দাঁড়ায় ও। মাধ্যাকর্ষণ কি পৃথিবীর চেয়ে একটু বেশি? হতে পারে।

যতদূর চোখ যায় নীল বালি ছড়িয়ে আছে একেবারে সমতল হয়ে। মাঝেমধ্যে কিছু কাঁটাঝোঁপ, তবে সেগুলোও নীল রঙের নানা শেডের।

সবচেয়ে কাছের নীল ঝোপের তলা থেকে বেরিয়ে এল একটা গিরগিটি। গিরগিটি? চারটের বেশি পা আছে বলে মনে হচ্ছে! গায়ের রঙটাও গাঢ় নীল। কারসন-কে দেখে সেটা আবার ঝোপে ঢুকে গেল।

আকাশ... না, নীল রঙের ওলটানো বাটির মতো ছাদটার নীচে যে জায়গাটা রয়েছে, তার মাঝামাঝি রয়েছে ও। কাছের দেওয়াল বোধহয় একশো গজ দূরে হবে। দূরের দেওয়ালের নীচে লালচে রঙের কিছু একটা জিনিস পড়ে আছে, যার চেহারাটা ঠিকমতো বোঝা না গেলেও কারসনের সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল।

তারপরেই ওর মাথার মধ্যে ভেসে এল কথাগুলো।

“আকাশ অনন্ত। মাত্রার সংখ্যাও অসীম। তবু দুটি প্রজাতি মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। এদের সংঘর্ষের পর একটি নিশ্চিহ্ন হবে। যেটি টিকে থাকবে সেটিও এতই দুর্বল হয়ে পড়বে যে এগিয়ে চলার বদলে তারা পিছিয়ে যাবে বোধবুদ্ধিহীন স্থবিরতায়। কিন্তু আমি এটা হতে দেব না।”

“আপনি...” কারসন মুখ খুলল না, তবু প্রশ্নটা ওর মনে জমাট বাঁধল, “আপনি কে?”

“আমি কে সেটা তুমি পুরোপুরি বুঝবে না। আমাকে...” কারসনের মনে হল, যেন তার মাথা ঘেঁটে কোনো যথাযথ শব্দ খুঁজে আনতে চাইল কেউ, “বিবর্তনের শেষ ধাপের একজন বলতে পার। তোমরা, বা যাদের তোমরা বহিরাগত বলছ তারা প্রগতির শেষ ধাপে পৌঁছলে আমার মতো হবে, যেখানে একটা গোটা প্রজাতির চেতনা মিশে গিয়ে একটাই সত্তা তৈরি হয়। অমর, অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন, চেতনার অতীত। কিন্তু এই জায়গায় আসতে গেলে তোমাদের শুধু টিকে থাকলেই চলবে না, নিরন্তর এগিয়ে যেতে হবে। যদি তোমাদের যুদ্ধ হয়, তাহলে সেটা অসম্ভব।

তাই আমি হস্তক্ষেপ করব। তারপর যেকোনো একটিই জাতি টিকে থাকবে, অন্যটি নয়।”

“কে...?” কারসন বুঝতে পারল, ওর গলা এতটাই শুকিয়ে আসছে যে ইচ্ছে থাকলেও ও প্রশ্নটা করতে পারত না।

“যে বেশি শক্তিশালী, সেই টিকে থাকবে। অন্যজন নয়।” আওয়াজটা কারসনের মাথায় গমগমিয়ে ওঠে। “সেজন্যই আমি যুদ্ধক্ষেত্রের একেবারে বাইরের দিকের দু’জনকে বেছেছি। তোমাকে, আর অন্যদের একজনকে। দু’জনকেই আমি নিয়ে এসেছি এমন পরিবেশে যা দু’জনের কাছেই অচেনা, এবং একইরকম অস্বস্তিকর। তুমি এবং তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী, দু’জনেই এখানে নিরস্ত্র, বিবসন। তোমাদের মধ্যে কারও যদি গায়ের জোর ঘটনাচক্রে বেশি হয়েও থাকে, সেটার ব্যবহারে আমি বাধা দেব। এই লড়াইয়ে বুদ্ধি আর সাহস অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সাহস, যেটা না থাকলে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না।”

“কিন্তু ইতিমধ্যে তো দুটো বাহিনী...”

“না। স্থান-কালের যে বিন্দুতে তোমরা আছ সেটা আলাদা। যতক্ষণ না তোমাদের এই লড়াইয়ের একটা ফয়সলা হয়, ততক্ষণ এই রণক্ষেত্রের বাইরে সর্বত্র সময় থেমে থাকবে।

আমি বুঝতে পারছি, তুমি ভাবছ এই জায়গাটা সত্যি কি না। এটা সত্যি, আবার সত্যি নয়ও। তোমার সীমিত বোধবুদ্ধি দিয়ে ব্যাপারটা বোঝা শক্ত। তাই এটুকু বলি যে এখানে তোমাদের যা কিছু সহ্য করতে হবে সেটা আসল। তুমি এখানে মারা গেলে সেটা হবে আসল মৃত্যু। আর তোমার মৃত্যুর অর্থ হবে তোমার প্রজাতির মৃত্যু। তোমার এটুকুই জানা দরকার। ব্যস।”

কারসন বুঝতে পারল, ওর মাথার মধ্যে আর কণ্ঠস্বরটা নেই।

 

হঠাৎ কারসন দেখল, দূরে পড়ে থাকা লাল রঙের গোল জিনিসটা, যেটা দেখতে রোলারের মতো হলেও আসলে ওর বহিরাগত প্রতিদ্বন্দ্বী, ওর দিকে গড়িয়ে আসছে। রোলারটা কাছে এগিয়ে আসামাত্র কারসন বুঝতে পারল ঘৃণার একটা ঢেউ যেন ওখান থেকে বেরিয়ে ওকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। সেই ঘৃণা এতই নিঃসীম, তার পেছনে লুকিয়ে আছে এতটাই হিংস্রতা, যে কারসনের শরীর গুলিয়ে উঠল।

আশেপাশে তাকিয়ে কারসন বুঝল, রোলার, বা গোলকটা এত দ্রুত এগোচ্ছে যে ওর পক্ষে দৌড়ে সেটাকে পেছনে ফেলা অসম্ভব। লুকোনোর মতো কোনো জায়গাও ও দেখতে পেল না। মরিয়া হয়ে একটা ধারালো পাথরের টুকরো হাতে নিয়ে তৈরি হল কারসন। প্রতিপক্ষের সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই ওর। তবু, লড়াই না করে ও হার মানবে না।

গোলকটা দ্রুত ওর দিকে ধেয়ে এল। দশ গজ... পাঁচ গজ...! তারপর ওটা থেমে গেল।

না। ওটাকে থামিয়ে দেওয়া হল। থামবার আগে ওটার একটা দিক চ্যাপ্টা হয়ে গেছিল। ওরকম হয় যখন কোনো বল দেওয়ালে এসে লাগে। ঠিক বলের মতোই কিছুতে ধাক্কা খেয়ে ওটা পিছিয়ে গেল। তারপর ওটা আবার এগিয়ে এল। ধীরে, সতর্কভাবে। আবার ওটা একই জায়গায় থেমে গেল। কিছুটা পাশে সরে গিয়ে ওটা আবার চেষ্টা করল, কিন্তু এবারও ওটা আটকে গেল।

আহ্‌! ব্যাপারটা কারসন বুঝতে পারল। দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে সমতা রক্ষার জন্য একটা অদৃশ্য দেওয়াল, বা বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। পার্থিব বিজ্ঞানের পক্ষে বোঝা অসম্ভব এমন একটা ফোর্স ফিল্ড। আর সেটা এই জায়গার দেওয়ালের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত অবধি ছড়িয়ে রয়েছে। এই ব্যাপ্তিটা বোঝার জন্য কারসনকে কষ্ট করতে হল না। গোলকটাই কয়েক ইঞ্চি পরপর অদৃশ্য দেওয়ালটার কাছে এসে বোঝার চেষ্টা করছিল, কোথাও কোনো ফাঁক আছে কি না যেটা দিয়ে ওটা এদিকে আসতে পারে।

না। কোনো ফাঁক পায়নি ওটা। কারসন নিজেও কয়েক পা এগিয়ে হাত বাড়িয়েই বুঝতে পারল, ওর সামনে একটা মসৃণ, অনেকটা রবারের মতো নমনীয় কিছু রয়েছে। নমনীয়, তবে অভেদ্য। উষ্ণ, তবে পায়ের নীচের বালির চেয়ে বেশি গরম নয়। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে কারসন বুঝতে চাইল, দেওয়ালটা উপরদিকে কতটা রয়েছে। যতদূর অবধি ও পৌঁছতে পারল দেওয়ালটা যে তা ছাড়িয়েও ওপরে উঠে গেছে এটা বোঝা গেল। এমনকি বালি সরিয়ে ও তার নীচেও খুঁজল। হ্যাঁ, ফুট দুয়েক নীচেও দেওয়ালটা রয়েছে।

তাহলে?

এই অদৃশ্য বাধাটা পেরিয়ে যাওয়ার একটা রাস্তা নিশ্চয় আছে, কারসন ভাবল, নইলে এই দ্বৈরথের তো কখনোই সমাপ্তি ঘটবে না।

ইতিমধ্যে গোলকটা সন্তর্পণে বাধার সর্বত্র খুঁজতে-খুঁজতে ওর কাছে এসে পৌঁছেছিল। কারসনের থেকে বড়োজোর ছ’ফুট দূরত্বে ওটা থেমে গেল। কারসনের মনে হল, ওকে খুঁটিয়ে দেখছে ওর প্রতিদ্বন্দ্বী। অথচ গোলকটাতে কয়েকটা খাঁজ ছাড়া ও চোখ বা কান জাতীয় কিছু দেখতে পেল না। ওই খাঁজগুলোর মধ্যে দুটো থেকে ইঞ্চিখানেক ব্যাসের, দেড় ফুট মতো লম্বা দুটো শুঁড় বেরিয়ে এসে বালিটা ছুঁয়ে, চেপে দেখল। গোলকটা যখন সচল থাকে তখন ওই শুঁড়গুলো যে ভেতরে ঢুকে যায়, এটা কারসন বুঝল। ও এ-ও বুঝল যে গোলকটার নড়াচড়ার জন্য দায়ী তার ভেতরে কিছু একটার এগিয়ে-পিছিয়ে যাওয়া, অনেকটা... ট্যাংকের মতো!

গোলকটার দিকে তাকালেই কারসনের সারা শরীর একটা অদ্ভুত ভয়ে কেঁপে উঠছিল। ও বুঝতে পারছিল, ছ’ফুট দূরত্বে থাকা প্রাণীটি শুধু চেহারায় নয়, মনের দিক দিয়েও সম্পূর্ণ আলাদা, ‘প্রাণী’ বলতে যা কিছু ও জানে বা বোঝে তার সংজ্ঞার বাইরে।

প্রাণীটি টেলিপ্যাথি জানে কি না, সে ব্যাপারে কারসন নিশ্চিত ছিল না। তবে যেভাবে তার ঘৃণা একটা অদৃশ্য ঢেউয়ের মতো কারসনকে প্লাবিত করেছিল কিছুক্ষণ আগে, তাতে ও বুঝেছিল যে কোনোভাবে নিজের অনুভূতি বা ভাবনাকে ছুড়ে দেওয়ার ক্ষমতা প্রাণীটির আছে। হয়তো সে ওর ভাবনা বুঝবে এই আশায় কারসন দুটো কাজ করল।

প্রথমে ও হাতিয়ার হিসেবে কিছুক্ষণ আগে বেছে নেওয়া পাথরের টুকরোটাকে নীচে ফেলে দিল। যেমনটা লোকে করে অস্ত্র সমর্পণ বোঝাতে।

দ্বিতীয়ত, ও জোর গলায় বলে উঠল, “আমাদের মধ্যে কি শান্তি একেবারেই অসম্ভব?” সেই আদিগন্ত শূন্যতায় কারসনের নিজের কানেই কথাগুলো বড়ো অদ্ভুত শোনাল। তবু ও বলে চলল, “আমাদের যে এখানে এনেছে, সেই বলেছে, যদি আমরা লড়াই করি তাহলে কী হবে। শুধু একজন নয়, একটা গোটা প্রজাতি মরে যাবে তার ফলে। তার বদলে আমরা যদি নিজেদের মতো থাকি, নিজের-নিজের ছায়াপথে, তাহলে কী ক্ষতি? আমরা কি যুদ্ধ না করে এই ব্যাপারটাতে একমত হতে পারি?”

উত্তর এল। ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের মতো ঘৃণা, আক্রোশ, আর রক্ততৃষ্ণার লাল রঙে ছোপানো ভাবনাগুলো ওকে আঘাত করল। টাল সামলানোর জন্য কয়েক পা পিছিয়ে গেল কারসন। বড়ো-বড়ো শ্বাস ফেলে ও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল।

দুর্বল লাগছিল কারসনের। কিন্তু ওর ভাববার ক্ষমতা আর মনের জোর অটুট ছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নীচু অথচ স্পষ্ট গলায় কারসন বলল, “তোমার উত্তরটা পেয়েছি। একদম স্পষ্ট ভাষায়। তাই হোক তবে। যুদ্ধ... আমৃত্যু।”

যে প্রাণী এমনভাবে মনোভাব ছুড়ে দিতে পারে, তাকে কি মনের দিক দিয়ে কাবু করা সম্ভব? কারসন নিজের ভেতরের সবটুকু ঘৃণা আর বিতৃষ্ণা সংহত করে শত্রুর মৃত্যুকামনা করল, তবে তাতে লাভ হল না। বরং দারুণ গরমে ওর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। বালিতে বসে ও গোলকটাকে দেখায় মনোযোগী হল, যাতে তার কোনো দুর্বলতা থাকলে সেটা ওর চোখে ধরা পড়ে।

 

শুঁড়গুলোর মাথা দ্বিধাবিভক্ত, অনেকটা দুটো আঙুলের মতো। গোলকটা শুঁড় বাড়িয়ে অদৃশ্য দেওয়ালের ওপাশের ঝোপ থেকে ডাল ভাঙছিল। কারসন প্রাণীটির উদ্দেশ্য বুঝতে পারছিল না। তবে তার দেখাদেখি ও নিজেও ওইরকম মোটা ডাল ভাঙতে লাগল। এতে আর কিছু হোক না-হোক, ওই শুঁড়গুলো আর ওর হাতের জোরের তুলনা করা যাবে। ডালগুলো ভাঙতে ওর কষ্ট হল না, যার অর্থ গোলকটা বাইরের শক্ত খোলের আড়ালে আদতে হয় দুর্বল, নইলে ওকে ঠকানোর চেষ্টা করছিল। পায়ের কাছ থেকে ও আবার পাথরের টুকরোটা কুড়িয়ে তৈরি হল।

গোলকটা ঝোপের চারপাশ খুঁজতে গিয়ে হঠাৎই একটা নীল গিরগিটি পেয়ে গেল। গিরগিটিটা শুঁড়ের মধ্যে ধরা পড়ে ছটফট করছিল। গোলকটা গিরগিটির শরীর থেকে একটা-একটা করে পা ছিঁড়ে নিতে লাগল। কারসনের সারা শরীর এই অকারণ নৃশংসতায় গুলিয়ে উঠল। তবু, ও চোখ সরাল না শত্রুর থেকে। প্রাণপণে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা গিরগিটিটা কিছুক্ষণ পর স্থির হয়ে গেল। হয়তো জীবিত অবস্থায় সেটাকে আরও কষ্ট দেওয়া যাবে না বলেই গোলকটা কারসনের উদ্দেশে মৃত গিরগিটিটাকে ছুড়ে দিল।

গিরগিটির শরীরটা কারসনের পায়ের কাছে এসে পড়ল।

বিদ্যুদ্বেগে দুয়ে-দুয়ে চার করল কারসন। যেকোনো কারণেই হোক না কেন, মাঝের দেওয়ালটা এখন আর নেই। সেজন্যই গিরগিটিটার মৃতদেহ ওর কাছে পৌঁছেছে। শত্রুর অকারণ নৃশংসতা আর অবস্থার গুরুত্ব ওকে যে কতটা রাগিয়ে তুলেছিল সেটা ও নিজেও বোঝেনি। কিন্তু এবার ও কিছু না ভেবেই পাথরটা নিয়ে পাগলের মতো ছুটে গেল গোলকটার দিকে।

কিন্তু দেওয়ালটা সরেনি। দারুণ ধাক্কা খেয়ে চোখে সর্ষেফুল দেখল কারসন। মাটিতে পড়ে যাওয়া অবস্থা থেকে ও আবার উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছিল। হঠাৎ ওর খেয়াল হল, কিছু একটা উড়ে আসছে ওর দিকে। একদিকে ঝাঁপ দিয়ে মাথা বাঁচাতে পারলেও বাঁ পায়ের নীচের মাংসল দিকটায় একটা তীব্র ব্যথা টের পেল ও। ব্যথা উপেক্ষা করে পেছনদিকে গড়িয়ে গেল কারসন। সেই অবস্থাতেই মাথা তুলে ও দেখল, গোলকটা দুই শুঁড়ের মধ্যে একটা বড়ো পাথর তুলে ওর দিকে তাক করছে।

পাথরটা ওর দিকে উড়ে এল। কারসন সহজেই পাথরটাকে পাশ কাটাতে পারল। ও বুঝতে পারল, সোজা ছুড়তে পারলেও কোনো পাথরকে খুব একটা দূরে, বা খুব বেশি জোরে ছুড়তে পারছে না গোলকটা। নিজেকে গালাগাল দিল কারসন। আগের পাথরটা ওর গায়ে লেগেছিল কারণ ও ভ্যাবলার মতো বসে ছিল বালিতে। কিন্তু এখন...

চার গজ দূর থেকে একটা ফুট তিনেক চওড়া গোলক ফসকানোর মতো লোক কারসন নয়। ওর হাত থেকে ধেয়ে যাওয়া পাথরটা সপাটে গোলকটার গায়ে আছড়ে পড়ল। ধারালো দিকটা লাগলে পরিণাম আরও সন্তোষজনক হত নিঃসন্দেহে। তবে চ্যাপ্টা দিকের মার খেয়েও গোলকটা যে কিছু শিখেছে সেটা বোঝা গেল। আরেকটা পাথর তোলার চেষ্টা ছেড়ে দ্রুত পিছিয়ে গেল সেটা। যতক্ষণে কারসন আরেকটা পাথর তাক করেছে ততক্ষণে গোলকটা ওর থেকে প্রায় চল্লিশ গজ দূরে চলে গেছে।

কারসনের মুখে হাসি ফুটল। এই রাউন্ডটা ওই জিতেছে। নেহাত পা দিয়ে দরদর করে রক্ত ঝরছে! তবে এটা নিজে থেকেই থেমে যাওয়া উচিত, কারণ শিরা বা অন্য কিছু কেটেছে বলে মনে হচ্ছে না। কারসন বরং অদৃশ্য দেওয়ালটার স্বভাব বুঝতে উদ্যোগী হল।

দেওয়ালটা ঠেলে কারসন বুঝল, ওটা ওকে যেতে দেবে না। অথচ হাতে বালি নিয়ে সেটা পাচার করার চেষ্টা করে ও দেখল, বালিগুলো ওপাশে পড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ পাথর, বালি, গিরগিটির শরীরটা...

তার মানে কি এই যে নিষ্প্রাণ জিনিসই দেওয়ালটা পেরিয়ে যেতে পারে?

তত্ত্বের সত্যতা যাচাই করার সুযোগ এল ঝটপট। ঝোপঝাড় নেড়ে আর একটা নীল গিরগিটি পেয়ে সেটাকে ধরল কারসন। ওটা ছুটে পালানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু সেই সুযোগ না দিয়ে কারসন গিরগিটিটাকে দেওয়ালের দিকে ছুড়ে দিল।

গিরগিটিটা ছিটকে ফিরে এল!

কারসন বুঝল, ওর ধারণাটাই সত্যি। জীবন্ত কিছুই এই দেওয়ালটা পেরিয়ে যেতে পারবে না।

নিজের পায়ের ক্ষতস্থানটা ভালো করে দেখে কারসন এও বুঝল যে রক্তপাত থেমে আসছে। তবে জায়গাটা জল দিয়ে একটু ধুতে পারলে ভালো হত।

জল!

কথাটা ভাবামাত্র তেষ্টায় কারসনের নির্জীব লাগল। ও বুঝতে পারল, জল খুঁজে না পেলে এই লড়াইয়ে ও এমনিতেই হেরে যাবে। বাঁ পা-তে যাতে চাপ না পড়ে সেজন্য সামান্য খুঁড়িয়ে ও দেওয়ালের এ-পাশে, মানে এই রণক্ষেত্রে ‘ওর’ দিকটা ভালোভাবে খুঁজে দেখতে চেষ্টা করল।

 

কিন্তু না। পুরো জায়গাটা, মানে একপাশের ধূসর নীলচে দেওয়াল থেকে অন্যদিক অবধি পুরো জায়গাটা বারবার ঘুরেও কারসন জল পেল না। ও নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে এখানে আসার পর থেকে খুব বেশি হলে ঘণ্টাচারেক কেটেছে। তাতে ওর এতটা জলের জন্য ব্যাকুল হওয়া উচিত নয়। তবু কারসনের শরীর, মন, মাথা সবকিছু তেষ্টায় ছটফট করতে লাগল। অসহ্য তাপ, নীল বালি, নিথর ভারী বাতাস, ঘর্মাক্ত অবস্থা, আর তৃষ্ণা... সব মিলিয়ে কারসন বুঝতে পারল, ওর শরীর লড়াই থেকে পালিয়ে যেতে চাইছে। বালিতে বসে পড়ল ও। তখনই ওর নজর পড়ল বেশ কিছুটা দূরে নিস্পন্দ হয়ে বালিতে বসে থাকা গোলকটার দিকে।

কী যেন বলেছিল সেই কণ্ঠস্বর? হ্যাঁ... একইরকম অস্বস্তিকর! অর্থাৎ শুধু ও নয়, ওর প্রতিদ্বন্দ্বীও এইমুহূর্তে ছটফট করছে জল, বা ওইরকম কিছুর অভাবে।

উঠে দাঁড়াল কারসন। ওর পা এখন ব্যথায় টন্‌টন্‌ করছে। শরীর দুর্বল। জল পাওয়া যাবে না। তবু একটা চেষ্টা ওকে করতেই হবে। এই লড়াইয়ের ফয়সলা যদি করতে হয় তাহলে তার জন্য ওর হাতে খুব বেশি সময় নেই। একটা সময়ের পর ওর শরীর জবাব দিয়ে দেবেই। কিছু একটা ওকে করতে হবে। এখনই। কিন্তু কী করতে পারে ও?

ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করল কারসন। ও বুঝতে পারল, পা-র একটা ব্যবস্থা করতে না পারলে ও অসহায় হয়ে পড়বে। জল নেই, তাই নিরুপায় হয়ে ঝোপের দিকেই এগোল ও। পাতা বা ওইজাতীয় কিছু একটা ছিঁড়ে ও তাই দিয়ে সযত্নে ক্ষতস্থানটা যথাসাধ্য পরিষ্কার করল। বালি আর জমে থাকা রক্ত ঝরে যাওয়ার পর জায়গাটাকে বাঁধতে গিয়ে কারসন বুঝল, ঝোপের মধ্যে লতানে গাছের আকর্ষগুলো ভয়ানক শক্ত। ছিঁড়তে না পেরে সেগুলোকে ধারালো পাথর দিয়ে কেটে আলাদা করল। তারপর পাতা আর ওই লতা দিয়ে জায়গাটা বাঁধল, যাতে চট করে আবার রক্ত না বেরোয়।

এরপর কারসন লতাগুলোকে একসঙ্গে পেঁচিয়ে একটা বেশ মজবুত দড়ি-গোছের জিনিস তৈরি করল। পাথরগুলোর একটাকে অন্য জিনিসে কুঁদে কিছুক্ষণের অক্লান্ত চেষ্টায় ও একটা ধারালো, ভারী ছুরিও বানিয়ে ফেলল। দড়ি দিয়ে একটা বেল্ট বানিয়ে, তাতে ছুরিটা গুঁজে কারসন কিছুটা আশ্বস্ত হল। ঝোপগুলো ভালো করে খুঁজে কারসন বুঝল, ওখানে আর যে ধরনের গাছ বা গুল্ম আছে তাদের একটা শুকনো আর ভঙ্গুর, একটা নরম, আর একটা প্রায় কাঠের মতোই ভারী আর মজবুত।

কিন্তু কারসন আর কিছু ভাবতে পারছিল না। অসহ্য গরমে ওর মাথা অসাড় হয়ে পড়ছিল।

গোলকটা কী করছে? ওটা মাঝে অদৃশ্য দেওয়ালের কাছে এসে ওকে দেখে গেলেও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছে। তবে কিছু একটা করছে ওটা। পাথর জমাচ্ছে? কারসন কিছু ভাবতে পারছিল না। তবু যন্ত্রের মতো ও যতগুলো সম্ভব পাথরের টুকরো নিজের কাছে জমা করল, যদি ছোড়ার সুযোগ আসে এই আশায়।

গরম! অসহ্য গরম! আর তেমনই তেষ্টা। কারসন আর কিচ্ছু ভাবতে পারছিল না। ওর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ও বুঝতে পারল, জল পাওয়া যাক বা না-যাক, তার খোঁজে ওকে একটা মরিয়া চেষ্টা করতেই হবে। বাধা হয়ে থাকা দেওয়ালটার কাছে গিয়ে কারসন বালি খুঁড়তে শুরু করল। দেওয়াল বরাবর প্রায় চার ফুট নীচে ও নিরেট পাথর পেল, কিন্তু জল পেল না।

হাঁচড়পাঁচড় করে উঠে এল কারসন। দাঁড়াতে পারল না। তেষ্টা আর পায়ের ব্যথা ওকে নির্জীব করে দিয়েছিল। বালিতে উপুড় হয়ে শুয়েই ও দেখল, গোলকটা কিছু একটা করছে। কী করছে?

গর্ত খুঁড়তে গিয়ে বালির যে স্তূপটা তৈরি হয়েছিল, তাতে উঠল কারসন। এবার ও ভালোভাবে দেখতে পেল কী বানিয়েছে ওর প্রতিদ্বন্দ্বী। ঝোপ থেকে পাওয়া কাঠ আর লতানে গাছের লতা দিয়ে গোলক একটা গুলতির মতো জিনিস তৈরি করেছে! সেটা দিয়ে কী...? তারপরেই কারসন বুঝতে পারল কী জন্য জিনিসটা বানানো হয়েছে।

একটা বড়োসড়ো পাথর ওর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল।

জিনিসটা এতটাই দূর দিয়ে গেল যে কারসনকে নীচুও হতে হয়নি। কিন্তু পাথরটার সাইজ, এবং সেটা যতটা দূরে গেল তা দেখে কারসনের চুল খাড়া হয়ে উঠল। ওর ‘অর্ধ’-র শেষ প্রান্তে পৌঁছেও ও পুরোপুরি নিরাপদ হবে না। মরিয়া হয়ে কারসন অদৃশ্য দেওয়ালের এদিক-ওদিক নড়ে আর সেখান থেকে পাথর ছুড়ে জিনিসটাকে অকেজো করার চেষ্টা করল বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু হয় ব্যাপারটা বড়ো বেশিরকম মজবুত, নয় ওর হাতে যথেষ্ট জোর ছিল না। বেশ কয়েকটা পাথর ছুড়েও গুলতির মতো জিনিসটার গায়ে আঁচড়ের বেশি কিছু কাটতে পারল না কারসন।

সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ওর পায়ের ব্যথা। কারসন বুঝতে পারছিল, টাটাতে থাকা একটা পা নিয়ে ও পাথরগুলো ঠিকমতো ছুড়তেও পারছে না। তবু ও স্থির হয়ে একজায়গায় বসতে পারছিল না। ও জানত, একবার বসলে ওর অবসন্ন শরীরে ঘুম নামবে, আর একবার ঘুমিয়ে পড়লে সেই ঘুম আর ভাঙবে না।

গোলকের উপহার হিসেবে উড়ে আসা একটা পাথর কারসনের জমানো পাথরে ঠোক্কর খেয়ে আগুনের ফুলকি তুলল। সেদিকে তাকিয়ে কারসনের মাথায় একটা আইডিয়া গজাল।

পাথর ঘষে কি আগুন বানানো সম্ভব?

আদিম মানুষ তো পাথর ঘষেই আগুন বানাত। ও কি তেমন কিছু করতে পারবে? মরিয়া কারসন পায়ের ব্যথা, তেষ্টা, সব ভুলে সামনের ঝোপটার দিকে এগোল ঘষটে-ঘষটে। ওর কপাল ভালো ছিল। ওই ঝোপটা ভেঙেই বেশ কিছু টুকরোটাকরা ও জমা করতে পারল। তারপর ধৈর্য ধরে, মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া, বা কিছুটা দূরে আছড়ে পড়া পাথর উপেক্ষা করে কারসন পাথরে পাথর ঘষে ফুলকি তুলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সহজদাহ্য একটা শুকনো ডাল, তারপর গোটা স্তূপটা জ্বলে উঠল দাউদাউ করে।

কারসন দেখল, লতানে গাছের আকর্ষগুলো অত সহজে জ্বলে না। পাতাগুলোও ধিকধিকি জ্বলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। দাহ্য কাঠের টুকরোগুলোকে পাতার মধ্যে রেখে, সেটাকে লতা দিয়ে বেঁধে আধ ডজন বল বানিয়ে কারসনের মুখে হাসি ফুটল।

ছোড়ার মতো জিনিস এবার ওর কাছেও রয়েছে। আগুনে বোমা!

একটা বোমায় আগুন ধরিয়ে সেটা ছুড়ল কারসন। জিনিসটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। ব্যাপারটা বুঝতে গোলকের সময় লাগেনি। ঝটপট ওই গুলতির মতো যন্ত্রটা সরিয়ে দূরে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হল সে। কিন্তু কারসন একেবারে তৈরিই ছিল। একটা মরিয়া মনোভাব, সঙ্গে ভেতর থেকে উঠে আসা একটা আদিম হিংস্রতা ওর নিশানাকে নিখুঁত করে তুলছিল। ওর হাত থেকে ছুটে যাওয়া একের-পর-এক গোলা আছড়ে পড়ল যন্ত্রটায়। চার নম্বরটা আটকে গেল যন্ত্রটার ভেতরে কাঠের ফাঁকে। ওটাতেই কাজ হল।

হু-হু করে জ্বলে উঠল গুলতি-টা।

গোলকটা তার দুই শুঁড় দিয়ে বালি তুলে, জ্বলন্ত অংশের ওপর সেটা ফেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছিল। কারসন দেখল, শুঁড় দিয়ে যতটুকু বালি প্রাণীটি তুলতে পারছে সেটা মোটেই যথেষ্ট নয়। আগুনটা নিভল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই যন্ত্রটা প্রায় ভস্মীভূত হয়ে গেল।

গোলকটা কারসনের দিকে ঘুরে স্থির হয়ে রইল। আবার ওর দিকে ভেসে এল রাগ আর ঘৃণার ঢেউ, তবে ধীরে। যেন, তাদের ঠেলে দেওয়ার মতো জোর জোটাতে পারছে না গোলকটা। কারসন একটা পাথর তুলে ছুড়ে দেওয়ামাত্র গোলকটা সরে গেল নিরাপদ দূরত্বে।

বসে পড়ল কারসন। বিজয়োল্লাস নয়, বরং ক্লান্তি, টাটিয়ে ওঠা পায়ের ব্যথা, আর তেষ্টা ছাড়া ওর মাথায় আর কিচ্ছু আসছিল না। নরক কি এমনই হয়? তলিয়ে ভাবার অবস্থাও ওর ছিল না। গোলকটার অবস্থাও যে বিশেষ সুবিধের নয় সেটা বুঝতে পারছিল ও। অথচ মাঝের বাধাটা যতক্ষণ আছে, আর গোলকটা আছে ওর নাগালের বাইরে, ততক্ষণ লড়াইয়ের একটা এসপার-ওসপার করা ওর পক্ষে অসম্ভব।

কী করা যায়?

জবাব দিতে বসা শরীরকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করল কারসন। ইতিহাস হাতড়ে ও বোঝার চেষ্টা করল প্লাস্টিক আর ধাতুর উদয়ের আগে মানুষ কী ধরনের অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করত।

পাথর? হয়ে গেছে। নাগালের বাইরে।

গুলতির সাহায্যে ছুড়ে দেওয়া পাথর, আর সেই পদ্ধতিতেই পরে বারুদকে কাজে লাগিয়ে কামানের গোলা? বারুদ নেই। গুলতি হয়ে গেছে। তাছাড়া ওর ‘দিক’- এমন কাঠকুটো নেই যা দিয়ে ওইরকম ভারী যন্ত্র বানানো যায়।

তির-ধনুক? নাহ্‌! কারসন জানে, কলেজে একেবারে উঁচু দরের জিনিস হাতে নিয়েও ওর নিশানা একেবারেই ভালো হত না। এখন ও যদি নিজের হাতুড়ে জ্ঞান কাজে লাগিয়ে কিছু বানায়ও, তাতে লক্ষ্যভেদ করা যাবে না।

বল্লম? হুঁ, এটা ভালো আইডিয়া! হাতের কাছে থাকা পাথরের স্তূপ আর কাঠের টুকরো ঘেঁটে কারসন পাথর হাতড়ে বল্লম বানাতে ব্যস্ত হল। ও জানত, খুব একটা দূর থেকে বল্লম ছুড়ে ও ওই গোলকের তেমন একটা ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু নাগালের মধ্যে পেলে যদি ওটা ছুড়ে মারা যায়...! ইতিমধ্যে কারসন বুঝে গেছে, গোলকটার গায়ে কোনো অতিরিক্ত আস্তরণ বা আবরণ নেই। তাই শুধু আহত করা নয়, যদি একবার হাতিয়ারটাকে গোলকের গায়ে হারপুনের মতো গেঁথে দেওয়া যায়, তাহলে ও গোলকটাকে মাঝের দেওয়ালটার কাছে টেনে আনতে পারবে। তারপর ধারালো পাথর ছুড়ে...!

কিন্তু সে-সব পরে হবে। আপাতত কারসন একটা কাঠের টুকরোর মাঝখানটা দু’ভাগ করে, সেখানে একটা লম্বা, ভারী, আর ধারালো পাথর গুঁজে, সবটাকে লতা দিয়ে টাইট করে বেঁধে বল্লম বানানোয় ব্যস্ত হল। সময়ের দিকে খেয়াল ছিল না কারসন-এর। তবে বেশ কিছুক্ষণ পর একটা মোটা দাগের, কিন্তু কার্যকরী বল্লম তৈরি হল। তারপর সেটার একপ্রান্তে ও লতা জুড়ে বানানো একটা মজবুত দড়ি বাঁধল। অন্য প্রান্তটা বাঁধল নিজের হাতে, যাতে বল্লম তথা হারপুনটা গোলকের গায়ে গেঁথে দেওয়ার পর ও-ও সেটার কাছে যেতে পারে।

শেষ গিঁটটা বাঁধার পর কারসন আবিষ্কার করল, ও মাথা তুলতে পারছে না। বালিতে চাপ দিয়ে উঠতে গিয়ে ও বুঝল, শরীর আর মগজের আদেশে সাড়া দিচ্ছে না। বারতিনেকের চেষ্টায়, হাঁটুতে ভর দিয়ে কিছুটা উঠেও ধুপ্‌ করে বালির ওপর পড়ে গেল কারসন।

ঘুম। ঘুম চাইছে শরীর। ঘুমোতেই হবে ওকে। কিন্তু এখানে নয়। ও দেওয়ালের বড্ড কাছে রয়েছে। দূরে যেতে হবে। দশ গজ... বিশ গজ...

অন্ধকার।

 

মাথার কাছে একটা ভারী কিছু পড়ার শব্দে ঘুম ভাঙল কারসনের। ও একটা স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্নটা ওর মনে পড়ল না, তবে সেটা যে ভয়ানক কিছু ছিল এ ব্যাপারে ও নিঃসন্দেহ ছিল।

নীল আকাশ। নীল বালি।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছে ও? এক দিন? এক মিনিট?

ওর মুখে বালি ছিটিয়ে দিয়ে খুব কাছে এসে পড়ল একটা পাথর। দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে কারসন দেখল, অদৃশ্য দেওয়ালটার গা ঘেঁসে, বিশ গজ মতো দূরত্বে এসে স্থির হয়ে রয়েছে গোলকটা। ওকে উঠতে দেখেই গোলকটা পিছিয়ে গেল, যতটা দূরে যাওয়া সম্ভব।

কারসনের মুখে একটা তিক্ত হাসি ফুটল। নিরাপদ দূরত্বে যাওয়ার আগেই ও জ্ঞান হারিয়েছিল। যদি গোলকটা বুঝত ও এই মুহূর্তে কতটা দুর্বল, তাহলেও কি এভাবে পালাত ওটা?

মাথা ঘামাল না ও। বরং হাত-পায়ে ভর দিয়ে ও নিজেকে নিয়ে গেল দূরে। আরও দূরে। একেবারে পেছনের দেওয়াল অবধি। তাতে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজল কারসন। এখন ও নাগালের বাইরে রয়েছে। এবার...

আবার যখন চোখ মেলল কারসন তখন এমনিতে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে ওর চরম ক্লান্তির অবস্থাটা কেটে গেছে। ঘুম, বা অজ্ঞান হয়ে থাকাটা শরীরকে সেটুকু বিশ্রাম দিয়েছে। মুখের ভেতরটা শুকনো, জিভটা ভারী আর ফোলা। আর... ব্যথা! কীসের ব্যথা?

নড়ার চেষ্টা করামাত্র কারসনের বাঁ পা এমন প্রতিবাদ জানাল যে যন্ত্রণায় কারসন চোখে অন্ধকার দেখল। নীচে তাকিয়ে ও বুঝতে পারল, অবস্থা খুবই খারাপ। এই ‘রণ’-ক্ষেত্রে কী ধরনের জীবাণু আছে তা ও জানে না। তবে তাদের ছোঁয়ায় ওর ক্ষতস্থান, এমনকি পুরো বাঁ পা-ই ফুলে উঠেছে বীভৎসভাবে। যে লতাগুলো দিয়ে ও জায়গাটাতে পাতা বেঁধেছিল, সেগুলোই ওর মাংসে কেটে বসেছে একেবারে।

পাতাগুলো সরিয়ে কারসন বুঝল, সংক্রমণের ফলে রক্তে বিষ মিশেছে। শুধু হাঁটুর নীচের অংশ নয়, থাইয়ের অর্ধেকটাও ফুলে উঠেছে। জল, ওষুধ, কাপড়ের অভাবে ওর মেয়াদ আর বেশিক্ষণ নয়।

কারসন হাল ছেড়ে দিত। কিন্তু একটা তথ্য, একটা ভয়ংকর জ্ঞান ওকে বসে থাকতে দিল না।

ওর মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গেই শেষ হয়ে যাবে মানবজাতি।

বল্লমটা ধরে, যন্ত্রের মতো আবার এগোতে শুরু করল কারসন। হামাগুড়ি দিয়ে, নিজেকে ছেঁচড়ে ও নিয়ে গেল দেওয়ালের কাছে। কতক্ষণে ও সেখানে পৌঁছল, ওর খেয়াল নেই। এক ঘণ্টাও হতে পারে, এক যুগও হতে পারে। কিন্তু ওর এই চরৈবেতি মন্ত্র জপ করার একটাই লক্ষ্য ছিল। কোনোভাবে যদি ও একবার গোলকটাকে নাগালে পায়...!

না। গোলকটা নাগালের বাইরে ছিল। শুধু তাই নয়, চোখটা যথাসাধ্য ধারালো করে কারসন বুঝতে পারল, গোলকটা পাথর ছোড়ার জন্য আরেকটা গুলতি-গোছের যন্ত্র বানাতে শুরু করেছে। ওটা আগের তুলনায় অনেক ধীরে নড়াচড়া করছে। অর্থাৎ গোলকটার অবস্থাও সুবিধের নয়। তবে গুলতিটা তৈরি হয়ে গেলে কারসনের আর কোনো পালানোর জায়গাও থাকবে না।

তবে যন্ত্রটা তৈরি হওয়া সম্পূর্ণ হওয়া অবধিও কি টিকবে কারসন? আপন মনে মাথা নেড়ে ও শুয়ে পড়ল আবার।

“শুনতে পাচ্ছ?”

একটা ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে এল কারসনের কানে। না, কানে নয়, মাথায়।

চমকে উঠল কারসন। এটা তো সেই গলাটা নয়! এটা কি... স্তম্ভিত বিস্ময়ে কারসন বুঝতে পারল, একটা গিরগিটির কাছ থেকে আসছে আওয়াজটা।

“চলে যাও।” কারসন চোখ বন্ধ করে বলার চেষ্টা করল, কিন্তু ওর জিভ নড়ল না। “তুমি আসলে নেই। গিরগিটি কথা বলতে পারে না। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি!”

“আহত।” গলাটা বলল, “মেরে ফেলো। আহত – মেরে ফেলো। এসো।”

চোখ খুলল কারসন। না, গিরগিটিটা ভ্যানিশ করে যায়নি। ওটা আছে। ওটা অদৃশ্য দেওয়াল বরাবর একটু এগিয়ে-পিছিয়ে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে।

“আহত।” কারসন আবার শুনল। “মেরে ফেলো। এসো।”

বেশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল কারসন। কিন্তু এই অদ্ভুত আদেশ বা অনুনয় ওর মাথায় ধাক্কা মেরেই চলল। চোখ খুলে, গিরগিটিটার চলাফেরার দিকে তাকিয়ে ও বুঝতে পারল, গিরগিটিটা ওকে কোনো একটা দিকে যেতে বলছে। কোন্‌ দিকে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কারসন বুঝল, উত্তরটা না বোঝা অবধি এই অদ্ভুত আদেশ বা কাতর আর্তির হাত থেকে ও রেহাই পাবে না। কোনোরকমে গিরগিটিটাকে অনুসরণ করল ও। মাঝের বাধা বরাবর বেশ কিছুটা এগিয়ে এসে ও দেখতে পেল, একটা গিরগিটি ছটফট করছে।

এটা কি... হ্যাঁ! এটাই তো সেই গিরগিটিটা যার শরীর থেকে জ্যান্ত অবস্থাতেই একটা-একটা করে পা ছিঁড়ে নিচ্ছিল গোলকটা। কিন্তু ওটা কি তাহলে মরেনি?

যে গিরগিটিটাকে অনুসরণ করে এসেছিল কারসন, তার দিক থেকে বারবার ভেসে এল আর্তি, “আহত। মেরে ফেলো! আহত। মেরে ফেলো!” ছটফট করতে থাকা গিরগিটির কাছে গিয়ে নিশ্চিত হল কারসন। হ্যাঁ, এটাই সেটা। যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে বেচারি। ছুরিটা বের করে গিরগিটিটাকে যন্ত্রণার হাত থেকে নিষ্কৃতি দিল কারসন। অন্য গিরগিটিটা পালিয়ে গেল।

দেওয়ালে ভর দিয়ে তাকাল কারসন। গোলকটা কাজ চালু রেখেছে। ধীরে, অথচ নিশ্চিতভাবে মাথা তুলছে আরেকটা প্রকাণ্ড গুলতি। ওটার কাছে পৌঁছনোর মতো কোনো উপায় ওর নেই। ওর আর কিচ্ছু করার নেই।

নিদারুণ হতাশার একটা অন্ধকার সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছিল কারসন। রক্তের বিষক্রিয়ার শিকার হয়ে তিলে-তিলে মরা, বা ধেয়ে আসা পাথরের ঘায় থেঁতলে যাওয়া। এদের তুলনায় দ্রুত, যন্ত্রণাহীন কোনো মৃত্যুর ব্যবস্থা কি ওর পক্ষে নিজের জন্য করা সম্ভব? ছুরিটা...

নাহ্‌, ক্লান্তভাবে মাথা নাড়ল কারসন। ওটা ও পারবে না।

দেওয়ালে হেলান দেওয়া নিজের হাত দুটোর দিকে নজর পড়ল কারসনের। ওর হাতগুলো কি এত সরু ছিল? এত রুক্ষ? ঠিক কতদিন ধরে এই নরকে রয়েছে ও? এই অবস্থায় আর কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে ও এই অসহ্য গরম, এই অনন্ত তৃষ্ণা? এইরকম আধমরা হয়ে...

মাথার এলোপাথাড়ি ভাবনার তুফানের মধ্যে হঠাৎ একটা শান্ত, স্থির বিন্দু খুঁজে পেল কারসন। সেটা এল একটা প্রশ্নের আকারে?

গিরগিটিটা জ্যান্ত অবস্থায় দেওয়াল ভেদ করে এদিকে কীভাবে এসেছিল?

 

বালিতে বসে পড়ল কারসন। এখনও পর্যন্ত দেওয়ালটা নিয়ে দেখা, বোঝা ঘটনাগুলো মনে-মনে সাজিয়ে উত্তরটা খুঁজতে চাইল ও। ঘটনাক্রম পরপর সাজালে এটা স্পষ্ট যে গিরগিটিটা আধমরা, বা আরও সঠিকভাবে বললে অজ্ঞান ছিল বলেই সেটা দেওয়াল ভেদ করতে পেরেছিল।

তাহলে কি এটা আসলে কোনো দেওয়াল নয়? এটা কি তাহলে ভাবনা, বা চেতনা থেকে তৈরি হচ্ছে? সেজন্যই কি অচেতন জিনিস, বা জীব এটাকে ভেদ করতে পারছে?

কারসন বুঝতে পারল, ওর হাতে আর একটাই দান বাকি আছে। এটা ছাড়া ওর কাছে আর কিচ্ছু নেই। সেটাকে কাজে লাগানোর জন্য ধীরে-ধীরে নিজেকে বালির স্তূপটার দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল ও। খুঁড়তে-খুঁড়তে এই স্তূপটা তো ওই বানিয়েছিল? কবে...? জানে না ও। কয়েক ঘণ্টা আগে, কয়েক দিন আগে, যা খুশি হতে পারে। তবে মোদ্দা কথা হল, বালির স্তূপটার ওপরে উঠে ও যদি কোনোভাবে নিজেকে অজ্ঞান করে দিতে পারে তাহলে ওর শরীরটা পড়বে দেওয়ালের ওপর।

না। দেওয়ালটা তখন থাকবে না। ও পড়বে ওপাশে!

গুঁড়ি মেরে বালির স্তূপে উঠল কারসন। ও দেখে নিল, ছুরিটা আছে ওর কোমরে, বল্লম-তথা-হারপুনটা রয়েছে বগলে, তার একটা প্রান্ত বাঁধা রয়েছে ওর এক হাতে। অন্য হাতে একটা ভোঁতা পাথর নিয়ে নিয়েছিল কারসন। স্তূপের মাথায় পৌঁছে সেই ভোঁতা পাথরটা দিয়ে নিজের মাথায় সপাটে একটা ঘা...

যন্ত্রণাই কারসনের জ্ঞান ফিরিয়ে আনল। কোমরের কাছে একটা তীব্র, হঠাৎ হওয়া ব্যথা, যেটা ওর মাথায় দপদপ করতে থাকা ব্যথার থেকে আলাদা।

কিন্তু কারসন এটার অপেক্ষা করছিল। তাই ও নড়ল না। বরং চোখের পাতাগুলো আণুবীক্ষণিক মাপে খুলে ও বুঝতে চাইল, কী ঘটছে। হ্যাঁ, ওর অনুমান সঠিক। গোলকটাই দুই শুঁড়ের মাঝে ধরা একটা পাথর ওর দিকে ছুড়ে বুঝতে চেয়েছে ও জীবিত না মৃত। গোলকটা আপাতত বিশ ফুট দূরে, তবে ওটা আরও কাছে আসছে।

কারসন নিথর হয়ে রইল। গোলকটা কাছে এল। আরও কাছে। পনেরো ফুট এসে ওটা আবার থেমে গেল।

কারসন শ্বাস-প্রশ্বাস নিতেও সাহস পাচ্ছিল না। তার চেয়েও বেশি করে ও মাথাটা ফাঁকা রাখার চেষ্টা করছিল, যাতে ওর টেলিপ্যাথিক শত্রু ওর সচেতন অবস্থাটা টের না পেয়ে যায়। তার ফলে গোলকটার ভাবনাগুলো ও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিল।

এতটা অন্যরকম, এতটা অমানবিক ভাবনার পরিচয় এর আগে কখনও পায়নি কারসন। এমন বহু ভাব আর আবেগ ওকে ছুঁয়ে গেল, যেগুলো মানুষের ভাষায় প্রকাশই করা যায় না। তবে ও এটা বুঝল যে ওদের এই ‘রণ’-ক্ষেত্রে নিয়ে আসা সত্তাটি ঠিকই বলেছিল। মানুষ আর এই প্রাণীদের সহাবস্থান একেবারেই অসম্ভব।

আরও কাছে এল গোলকটা। কারসনের শরীরটা থেকে মাত্র ফুটখানেক দূরে থেমে গোলকটা তার শুঁড়গুলো বের করল...

উঠে বসল কারসন। যন্ত্রণার অনুভূতি আর কাজ করছিল না ওর মধ্যে। বরং হারপুনটা বের করে, শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে সেটা ও ছুড়ে দিল গোলকটার দিকে। হারপুনটা গোলকের গায়ে গেঁথে গেল!

গোলকটা পিছিয়ে গেল। কারসন পিছু নিল। উঠে দাঁড়াতে পারছিল না ও। যন্ত্রণার অনুভূতিটা না থাকলেও পা কাজ করছিল না। তবু, গোলকটা নড়ার সঙ্গেই কারসনের হাতে বাঁধা লতায় টান পড়ছিল। তাতে সাড়া দিয়ে ও ঘষটে-ঘষটে এগিয়ে গেল গোলকটার দিকে।

একটা জায়গায় পৌঁছে থেমে গেল গোলকটা। শুঁড়দুটো দিয়ে, অনেক চেষ্টা করেও হারপুনের ধারালো প্রান্তটা নিজের শরীর থেকে বের করতে পারল না সেটা। কারসন এগিয়ে এল ওটার কাছে, আরও কাছে। গোলকটা বোধহয় ততক্ষণে বুঝতে পেরেছিল, ওটার পক্ষে আর নড়াচড়া সম্ভব নয়। ওটাও শুঁড় বের করে ওর কাছে এগিয়ে এল।

কারসনের কোনো ধারণা ছিল না যে ওর মধ্যে তখনও ওই শক্তিটুকু আছে। কিন্তু নিজেকেও অবাক করে দিল ও। ছুরিটা নিয়ে গোলকের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল কারসন। ওর শরীর থেকে মাংস ছিঁড়ে নিচ্ছিল শুঁড়গুলো। কিন্তু ও টের পাচ্ছিল না। ওর শরীর জুড়ে ছিল রাগ, আর একটা অদম্য হিংস্রতা। ও আঘাত করল, করেই চলল, করেই চলল, করেই চলল...!

 

কোথাও একটা বেল বাজছে। একটা... অ্যালার্ম?

নিজের অবস্থা আর অবস্থান বুঝতে বেশ কিছুটা সময় নিল কারসন। ও দেখল, ও নিজের স্কাউটশিপেই বসে আছে। সামনের স্ক্রিনে কোনো বহিরাগত স্পেসশিপ নেই। আশেপাশে কোনো অসম্ভব গ্রহ নেই।

অ্যালার্মটা বাজছে সামনে, রিসিভার থেকে। কেউ ওকে ডাকছে। যন্ত্রের মতো সুইচ টেপে কারসন। ওর মতো স্কাউটশিপদের প্রধান বেস তথা মাদারশিপ ম্যাগেলান-এর ক্যাপ্টেন ব্র্যান্ডারের মুখটা ভেসে ওঠে সামনের ছোট্ট স্ক্রিনে।

“কারসন? শুনতে পাচ্ছ?” অধৈর্য গলাটা ভেসে আসে। “সাড়া দাও। আর ডিউটি করতে হবে না। যুদ্ধ শেষ। আমরা জিতেছি।”

স্ক্রিনটা আবার অন্ধকার হয়ে যায়।

পুতুলের মতো কারসন বসে থাকে বেশ কিছুক্ষণ।

এটা কীভাবে হল? ঠিক কী হয়েছিল?

নিজের শারীরিক অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করে কারসন। ও সুস্থ। কোথাও কোনো চোট্‌-আঘাত নেই। ওর পা...

ট্রাউজারের নীচের দিকটা তুলে স্তম্ভিত হয়ে যায় কারসন। একটা লম্বা সাদা দাগ রয়েছে সেখানে! যেমনটা হয় কোনো ক্ষতস্থান পুরোপুরি সেরে গেলে। কারসন নিশ্চিত, এই দাগটা আগে ছিল না। ঝটপট শার্ট খুলে আয়নার সামনে দাঁড়ায় ও। হ্যাঁ! ওর সারা শরীর জুড়ে রয়েছে অজস্র ছোটো-বড়ো আঘাতের চিহ্ন। তবে সেগুলো সবই সেরে যাওয়ার পরের, প্রায় দেখাই যায় না এমন।

ঘটেছিল! ওর আর ওই বহিরাগতের লড়াইটা সত্যি ঘটেছিল তাহলে!

ম্যাগেলান-এ পৌঁছেই ব্রান্ডারের খোঁজ করল কারসন। ব্র্যান্ডার নিজের চেম্বারেই ছিলেন। কারসন স্যালুট করে দাঁড়াল।

“আহ্‌ কারসন!” ব্র্যান্ডারের গলা শুনে কারসন বোঝে, ভদ্রলোক এখনও পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেননি, “তুমি কী জিনিস মিস্‌ করলে, তা তুমি নিজেও জান না!”

“কী হয়েছিল স্যার?”

“আরে আমি নিজেই ঠিকমতো জানি না!” উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন ব্র্যান্ডার, “শুধু আমি নয়, পুরো আর্মাডায় কেউ ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। আমরা একবার ফায়ার করেছিলাম। মাত্র একবার! তাতেই ওদের পুরো বাহিনী উড়ে গেল! কী বলব তোমাকে? মনে হল... যেন একটা স্পেসশিপ থেকে আগুন আরেকটা স্পেসশিপে ছড়িয়ে গেল, এমনকি যেসব স্পেসশিপ আমাদের অস্ত্র তো দূরের কথা, দৃষ্টির নাগালের বাইরে ছিল, সেগুলোও উড়ে গেল! আমাদের একটা জাহাজের গায়ের রঙ অবধি চটেনি!

সত্যি বলছি, এতে আমাদের কোনো কৃতিত্ব নেই। আমার মনে হয়, ওদের স্পেসশিপগুলোতে এমন কিছু একটা উপাদান ছিল, যাতে একঢিলে লাখখানেক শিকার... তবে মোদ্দা কথা হল, স্কাউটশিপে ছিলে বলে এমন একটা দুর্ধর্ষ আতশবাজি তুমি মিস্‌ করে গেলে। এটাই বড়ো দুঃখের ব্যাপার।”

কারসন একবার ভাবল, ও কিছু বলবে কি না। তারপর ওর মনে হল, বিশ্বসংসারের সবচেয়ে বড়ো মিথ্যেবাদী হওয়ার অপবাদটা মাথায় নিয়ে কী লাভ? বরং ‘আসলে’ যা হয়েছে, সেটা ওই শুধু জানুক।

“ঠিকই বলেছেন স্যার।” মুখে দুঃখের ভাব ফুটিয়ে বলে কারসন, “আমি সব মিস্‌ করে গেলাম!”

 

[মূল কাহিনি: ফ্রেডরিক ব্রাউন-এর ‘এরিনা’, প্রথম প্রকাশ~ ‘অ্যাস্টাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশন’ পত্রিকার জুন, ১৯৪৪ সংখ্যা। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম কল্পবিজ্ঞান কাহিনিগুলোর মধ্যে অন্যতম এই গল্পটি ‘সায়েন্স ফিকশন হল অফ ফেম’-এ স্থান পেয়েছে।]