এক যে ছিল রাজা - দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়

অলংকরণ : সুমিত রায় ও মিশন মন্ডল
(১)

সন্ধ্যে নামছে জঙ্গলের কোণায় কোণায়। পশ্চিমে আকাশ জুড়ে রঙের খেলাও প্রায় শেষের পথে, ঘন কালো রঙের পাতলা চাদর নেমে আসছে পৃথিবীর বুকে। অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল গাছগুলোর বেষ্টনী এড়িয়ে দ্রুত এগোচ্ছিল লোকটা। দক্ষিণে নদীর দিক থেকে একটা ভেজা দামাল হাওয়া ছুটে এসে ছোট্ট শিশুর মতো কচি হাতের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে চোখে মুখে। কিন্তু এমন মনোহর পরিবেশের প্রতি কোনো মুগ্ধতা নেই তার চোখে মুখে, বরং জ্বলন্ত দৃষ্টি ও আরক্ত বদন প্রকাশ করছে তার অন্তরে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা ক্রোধকে! তীক্ষ্ণ চোখে দূরে জঙ্গলের সীমানা লক্ষ করতে করতে হাতের চাবুকটা খুব জোরে ঘোড়ার পিঠে মারল লোকটা। দ্রুত পৌঁছতে হবে, খুব দ্রুত। মহারাজকে দিতে হবে এই গুরুতর সংবাদ। আর এই বার্তার ফলাফল যে কী হতে পারে, তা খুব ভালো করেই জানে সে। পিঠে চাবুকের বাড়ি পড়তেই চিঁহিহি করে একটা আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে দ্বিগুণ গতি বাড়িয়েছে ঘোড়া, বাসায় ফিরতে থাকা পাখিদের কলকাকলি ছাপিয়ে জঙ্গলের বাঁকে বাঁকে মুখরিত হতে লাগলো তার খুরের আওয়াজ। ওই তো! ওই দেখা যাচ্ছে শিবির! নদীর পশ্চিম তীরের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ঘাঁটি গেড়েছে বিশাল সৈন্যদল, স্বয়ং মহারাজ সেখানে অপেক্ষা করছেন তার জন্য। ঘোড়ার খুরের ধুলোয় ঢেকে যাচ্ছে চারদিক, তারই মধ্যে গর্বিত দৃষ্টিতে শিবিরের সামনের সুউচ্চ পতাকা দণ্ডটার দিকে তাকাল সে। মৃদুমন্দ হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে ময়ূর-চিহ্ন আঁকা নিশান। ভারতবর্ষের বীরশ্রেষ্ঠ বংশের গর্ব।

 

একদৃষ্টে সোনালী ধারাটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন মহারাজ। হাতির দাঁতের তৈরী পাত্র থেকে কাঁচা সোনা বর্ণের সোমরস ঢেলে দিচ্ছে কোমল সুললিত দুটি হাত। ধীরে ধীরে অনাবৃত হাতদুটি বেয়ে তাঁর দৃষ্টি উঠতে শুরু করল উর্ধ্বমুখে। ক্ষীণকটি, উদ্ভিন্নযৌবনা এমন একটি নারীদেহ চোখের সামনে থাকলে তো এমনিতেই নেশা ধরে যায়! স্বল্প বস্ত্র পরিহিতা দাসীটি মণিমুক্তো খচিত সুরাপাত্র মহারাজের সামনে নিবেদন করে মিষ্টি হেসে চলে গেল। পাশেই সুবাস ছড়াচ্ছে সদ্য আগুনে ঝলসে আনা ধোঁয়া ওঠা হরিণের মাংস। আহ্! বুক ভরে সেই সুঘ্রাণ নিতে নিতে নরম তাকিয়ায় শরীর এলিয়ে দিলেন মহারাজ। খানিক দূরে নিজ আসনে উপবিষ্ট তাঁর প্রিয় বন্ধু ও প্রধান মন্ত্রণাদাতা রাধাগুপ্তও আপাতত কূটনৈতিক শলা-পরামর্শ সরিয়ে রেখে মনোনিবেশ করেছেন পাটলিপুত্র হতে আনানো উত্তম স্বাদের এই মদিরায়। ভারী মনোরম এই তোষালী অঞ্চলের পরিবেশ, তেমনি সুন্দর এখানকার ব্যবস্থাপনা। আর হবে নাই বা কেন, ভারতবর্ষের রাজাধিরাজ স্বয়ং তিনি যখন এখানে উপস্থিত, প্রমোদ-আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি রাখার সাহস নেই তাঁর বেতনভুক স্থানীয় সামন্তের। এই সুবিশাল দেশের প্রতিটা রাজ্য পদানত হয়েছে তাঁর দক্ষ সেনাবাহিনীর, শুধু...

—“মহারাজ!” একটা বিনম্র অথচ উত্তেজিত সম্ভাষণে চিন্তার সুতোটা ছিঁড়ে গেল। এইসময় তারই আসার কথা। এভাবে তাঁর বিশ্রামকক্ষে বিনা অনুমতিতে প্রবেশের অধিকার আর কজনেরই বা আছে? প্রবেশপথের দিকে না তাকিয়েই স্মিত হাসলেন, “এসো সুভদ্র! বলো, কী সংবাদ?”

কক্ষে প্রবেশ করে মহারাজকে অভিবাদন জানালো তাঁর অত্যন্ত স্নেহের বিশ্বস্ত অনুচর। খানিক সুস্থিত হয়ে শুষ্ক কণ্ঠে বলে উঠল, “আপনার অনুমান সত্যি হয়েছে মহারাজ। অনন্ত পদ্মনাভন নামক ওদের ওই ভুঁইফোড় নেতার এতদূর দুঃসাহস যে মহারাজের প্রেরিত আদেশপত্র অস্বীকার করে! এত স্পর্ধা সেই নরকের কীটের যে মহারাজের আদেশপত্র নিজের হাতে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে সে জানিয়েছে কোনোরকম বশ্যতা তারা স্বীকার করবে না, মহারাজ যেন তাদের এই মাতৃভূমি অধিকারের কথা দুঃস্বপ্নেও না চিন্তা করেন।”

ধীরে ধীরে উঠে বসলেন মহারাজ। অনেক দূর থেকে যেন হিমশীতল কঠিন গলা ভেসে এল, “বটে!”

—“শুধু তাই নয়,” অপমানের জ্বালা সুস্পষ্ট সুভদ্রের গলায়, “আপনার প্রেরিত এই দূতকে লাঞ্ছনা করতেও পেছপা হয়নি সে!”

অপার স্তব্ধতা কক্ষ জুড়ে। সদ্য ঘুম ভাঙা এক আগ্নেয়গিরি প্রবল আক্রোশে জেগে উঠছিল মহারাজের ভেতরে। যে তরবারির সামনে মাথা ঝুঁকিয়েছে উত্তরের কান্দাহার সহ বিস্তীর্ণ সিন্ধু উপত্যকা থেকে শুরু করে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ, একমাত্র দক্ষিণের ওই অসভ্য বর্বর চোল’রা ছাড়া এই দেশ নিজেকে সমর্পণ করেছে যাঁর পদতলে, সেই তাঁর প্রেরিত আদেশ প্রত্যাখ্যান করে তাঁকে অবমাননা করার দুঃসাহস দেখায় এই তুচ্ছ দুর্বল জাতি! দাঁতে দাঁত চাপলেন মহারাজ। প্রস্তুত তিনি হয়েই এসেছেন। তোষালীর প্রান্তরে অপেক্ষারত এই বিশাল বাহিনী তাঁর নির্দেশ পাওয়া মাত্র এই তৃণবৎ গোষ্ঠীকে পদতলে দলিত করতে এক মুহূর্ত সময় নেবে না। শেষবারের মতো সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু আর নয়। এই পাপের একটাই শাস্তি! এক ঝটকায় হাতের সুরাপাত্র ভূমিতে নিক্ষেপ করে প্রবল আক্রোশে ঘুরে উঠে দাঁড়ালেন মহারাজ। তাঁর চোখে তখন শিকারী নরখাদকের রক্তপিপাসা! তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত সেই দানবীয় গর্জন যেন সামনে দাঁড়ানো সুভদ্রকে আমূল কাঁপিয়ে দিল, “এক্ষুণি প্রধান সেনাপতিকে খবর দাও। আজ রাত্রের শেষপ্রহরেই আঘাত হানবে আমার বাহিনী। একটা মানুষও যেন কাল ভোরের সূর্য চাক্ষুষ করতে না পারে।”

—“কিন্তু মহারাজ...” উঠে দাঁড়ালেন রাধাগুপ্ত। ব্যস্ত পায়ে নিজের আসন ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন চাণক্যপুত্র ; মৃদু অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, “সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়ার আগে দ্বিতীয়বার বিবেচনা করা কি উচিত নয়? যতদূর জানতে পেরেছি, এরা বড়ই স্বাধীনতা প্রিয় জাতি। কোনোভাবে এদের স্বাধীনতা খর্ব করে নিজের বশ্যতায় আনতে চাইলে শুধুমাত্র প্রদেশের সেনাবাহিনীই যে প্রবল প্রতিরোধ তৈরী করবে তা নয়, কৃষক-বৈদ্য-বণিক নির্বিশেষে দলে দলে রাজ্যের সকল সাধারণ মানুষও স্বেচ্ছায় ঝাঁপিয়ে পড়বে এই মরণপণ যুদ্ধে। জাতীয়তাবাদ এদের বড়ই প্রবল! সেই বিপুল উন্মত্ত জনজোয়ারকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিহত করা কি আমাদের সীমিত সংখ্যক সৈন্যদলের পক্ষে সম্ভব হবে?”

কক্ষে উপস্থিত ব্যক্তিরা সবাই স্তব্ধ। বাইরের আকাশ আঁধার হয়ে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। সোনার থালার মত পূর্ণিমার চাঁদ তার সোনালী ছটায় ভাসিয়ে দিচ্ছে চরাচর। কী যেন এক চিন্তায় নিমগ্ন হলেন মহারাজ, শান্ত ধীর পায়ে গবাক্ষের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। সামনে দিয়ে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে মহানদী, তার স্বচ্ছ জলে পূর্ণচন্দ্রের সোনালী আভা সৃষ্টি করেছে এক অপূর্ব দৃশ্যের। একদৃষ্টে সেই জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে খর হয়ে উঠল মহারাজের দৃষ্টি। বাকি দুই সঙ্গীর চোখের আড়ালেই এক ভয়ঙ্কর ক্রূর হাসি ছড়িয়ে গেল মহারাজের মুখে।

প্রমাদ গনল প্রকৃতি।

(২)

রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর। অন্ধকারের মধ্যে সৈন্য শিবির গুলির পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছিল এক ছায়ামূর্তি। আশেপাশে জনমনুষ্যের কোনো সাড়া নেই, যে যার শয্যায় গভীর ঘুমে নিমগ্ন। শুধু হাতে নিভু নিভু মশালটা উঁচিয়ে ধরে দৃঢ় পায়ে হাঁটছিল লোকটা, তার দৃষ্টি দূরের এক নির্দিষ্ট শিবিরের দিকে।

ঘটাং ঘট ঘটাং ঘট। ধাতুর তৈরী বড় বড় পেষণযন্ত্রে পেষাই করা চলছে ধূসর বর্ণের কিছু পদার্থ। বুক অবধি লম্বা ধবধবে সাদা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে চিন্তিত মুখে পর্যবেক্ষণ করছিলেন কবিরাজ কৌম্য। কক্ষের এক প্রান্তে বড় বড় পাত্রে ঢালা হচ্ছে বিরাট হামানদিস্তা গুলি থেকে সংগৃহীত সেই গুঁড়ো পদার্থ, তারপর চলছে পাত্র গুলির মুখবন্ধের কাজ। মুখে কাপড় বেঁধে একমনে কাজ করে চলেছে শ্রমিকের দল। সময় তো প্রায় হয়ে এল, ঠিক মতো শেষ হবে তো কাজটা? তা নাহলে রাজার কোপ যে কীভাবে আছড়ে পড়বে তাঁর ওপর, তা ভালোমতোই জানেন আচার্য্য কৌম্য। গত সাতটা দিন-রাত এক করে রাজার আদেশে তিনি নিয়োজিত আছেন এই কর্মযজ্ঞে। পাটলিপুত্র থেকে আনানো সাদা ও বেগুনি রঙের এই ফুল বারবার সূর্যের তাপে শুকিয়ে ও বিভিন্ন আরক মিশিয়ে পেষণ করে তৈরী হচ্ছে এই চূর্ণীকৃত পদার্থ। অব্যর্থ বিষ!

বছর কয়েক আগে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ব্যবসা বাণিজ্য সেরে ফেরার সময় মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল একদল বণিক। মৃতপ্রায় মানুষগুলো মুখে গ্যাঁজলা তুলতে তুলতেই মারা গেল একসময়, নীল হয়ে ফুলে গিয়েছিল সর্বাঙ্গ। তাদের পোশাকআশাকের মধ্যে আটকে ছিল ছোট্ট ছোট্ট দানার মত কিছু বীজ, আর সাদা রঙের কিছু পাপড়ি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে ভুল হয়নি আচার্য্য কৌম্যের, এ নির্ঘাৎ কোনো অচেনা বিষফল! অতি সুচারু পদ্ধতিতে সেগুলিকে সংগ্রহ করে প্রাসাদের এক প্রান্তে তিনি গড়ে তুললেন সেই বিষফুলের গাছ! সাদা পাপড়ি ও বেগুনী বৃন্তের ফুলগুলি যতই সৌন্দর্য্যের প্রতীক হোক না কেন, কোনো জীবিত প্রাণীর রক্তে মেশা মাত্র মৃত্যু অনিবার্য!

—“আচার্য্যদেব!” দ্বারপ্রান্তে কার চাপা আওয়াজ শোনা গেল। পর্দা সরিয়ে ঢুকলো কালো পোশাক পরা লোকটা।

—“এসো এসো সুভদ্র। তোমার কথাই ভাবছিলাম।” এগিয়ে গেলেন রাজবৈদ্য কৌম্য, “একশত ঘড়া তো প্রস্তুত, কিন্তু তুমি একা... কীভাবে...?”

—“চিন্তা করবেন না আচার্য্যদেব,” স্মিত হাসল সুভদ্র। তারপর বাতাসে দুই হাতে তালি মারতেই যেন মাটি ফুঁড়ে হাজির হল একশো জন শক্তসমর্থ শ্রমিক! সুভদ্রের চোখের সামান্য ইশারায় মুখে কাপড় বেঁধে নিল প্রত্যেকে, তারপর একে একে এসে মাথার ওপর তুলে নিতে লাগল এক একটি বিশালাকার ঘড়া।

সপ্রশংস দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছিলেন আচার্য্য কৌম্য। বংশপরম্পরায় রাজবৈদ্য তিনি, মহারাজের পিতামহের সময়কাল থেকে এই গুরুদায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এই সুদীর্ঘ ঘটনাবহুল জীবনে প্রত্যক্ষ করেছেন নানা জয়-পরাজয়, ঘাত প্রতিঘাতের। নিজের চোখের সামনে জন্মাতে দেখেছেন মহারাজকে। অগ্রজদের তুলনায় এই বীরশ্রেষ্ঠ যে অনেক বেশী যোগ্য এবং অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী তা তাঁর জন্মের পরই অনুভব করেছিলেন, আর আজ হয়ত তা সত্যি প্রমাণ হতে চলেছে! তাঁর পিতা-পিতামহ যে কাজ করে যেতে পারেননি, অখণ্ড ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তারের সেই অধরা স্বপ্ন পূরণ হতে হয়ত আর বেশী বাকি নেই। এই বর্বর জাতির জনজোয়ারকে নিঃশেষ করে ফেলার জন্য মহানদীর জলে বিষপ্রয়োগ করার তাঁর এই সিদ্ধান্ত তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। নদীর বিষাক্ত জল পান করে একে একে মরবে রাজ্যের প্রতিটি অধিবাসী, আর তাদের মৃত্যুশয্যার ওপর মাথা উঁচু করে উড়বে ময়ূরচিহ্ন বিজয় নিশান! মশালের আলোয় চকচক করে উঠল বৃদ্ধের গর্বিত দুই চোখ।

বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি ঘোড়ার গাড়ি পিঠে বিষপূর্ণ কলস চাপিয়ে নিয়ে যাত্রা শুরু করল নদী অভিমুখে।

(৩)

পিঁইইইই... একটানা যান্ত্রিক শব্দ ভেসে আসছে। সোজা হয়ে উঠে বসল প্রিয়দর্শী। একটা চটচটে ঘুম চোখের পাতাগুলোকে আঁকড়ে ধরে আছে, কিন্তু ধীরে সুস্থে সেটাকে উপভোগ করার মত পরিস্থিতি এখন নেই। কারণ ঘরের অন্যপ্রান্তে রাখা নানারকম সুইচ, নব ও ডিজিটাল ডিসপ্লে দিয়ে বানানো কন্ট্রোল প্যানেলটা সচল হয়ে উঠেছে। ক্ল্যান ফোর-এ কলিং!

এক ঝটকায় এসে রিসিভারটা অন করল। স্ক্রীনে ভেসে উঠেছে খুদে খুদে দুই চোখের গোলগাল এক অফিসারের মুখ। ক্ল্যান ফোর-এ’র অপারেটিং হেড কম্যান্ডার নাকুশি হিতো। তাঁর মাথার ক্যাপে লাগানো ইউ এন পিস ফোর্সের লোগোর পাশে তিনটে স্টারের জ্বলজ্বলে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে তাঁর গৌরবময় দক্ষতার। মাইক্রোফোনটা মুখের কাছে এনে চিন্তিত গলায় বলে উঠল প্রিয়দর্শী, “এনি আপডেট নাকুশি?”

—“সিচুয়েশান ইজ আন্ডার কন্ট্রোল চিফ।” জাপানী পুতুলের মতো চোখদুটো নেচে উঠল, “ইট ওয়জ আ স্মল স্পিসিস, ভেরি প্রিমিটিভ। অ্যান্ড থ্রোন অ্যাওয়ে বাই আওয়ার বয়েজ। এভরি থিং ইজ সর্টেড নাও।”

—“গুড!” একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস প্রিয়দর্শীর বুক নিংড়ে বেরিয়ে এল, “ওয়েল ডান নাকুশি! কিপ ওয়াচিং দ্য এরিয়া। হ্যাভ আ গুড ডে!”

—“হ্যাভ আ গুড ডে চিফ!” দপ করে স্ক্রীন থেকে মিলিয়ে গেলেন কম্যান্ডার নাকুশি হিতো। শরীরটা পেছন দিকে হেলিয়ে দিল প্রিয়দর্শী। কাল প্রায় সারাটা রাত এই কন্ট্রোল সীটে বসেই কাটিয়েছে। ক্ল্যান ফোর-এ তে অ্যাটাকের খবরটা আসামাত্র ঘুম উড়ে গেছিল তার! প্রতিটা মুহূর্ত অসম্ভব সতর্কতার মধ্যে কাটাতে হয় তাদের, একটা ভুল পদক্ষেপও পৃথিবীর চরম বিপদ ডেকে আনতে পারে। অবশ্য কম্যান্ডার নাকুশি হিতোর দক্ষতার ওপর যথেষ্ট ভরসা ছিল তার। পরিস্থিতি যখন হাতের মুঠোয় এসে গেছে প্রায়, তখন নাকুশিকে ভোরে রিপোর্ট করার নির্দেশ দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য দু চোখের পাতা এক করেছিল। এখনও মাথাটা দুমনি বস্তার মতো ভারী হয়ে আছে, একটা স্টিমুলেটিং অ্যাম্পিউল ইনজেক্ট করতে হবে। অবশ্য এসবের অভ্যেস আছে তার। এই পঁচিশটা বছর কতগুলো রাতই বা ঠিকঠাক ঘুমিয়েছে! এই জন্যই তো স্পেশাল ট্রেনিং দিয়ে তাদের তৈরী করা।

বাইরের আকাশের একটা কোণ দুধ-চা এর মতো রং ধরছে ধীরে ধীরে। দুধ-চা! এই বস্তুটির প্রতি ছোটবেলা থেকে যে কী ভীষণ আকর্ষণ ছিল তার। এদিকে মায়ের কড়া নির্দেশ, এত ছোট ছেলে চা খাবে না। অবশেষে ক্লাস এইটে ওঠার পর দুধ-চা খাওয়ার পারমিশান পেয়েছিল মা’র আদরের ‘টুকাই’! চোখের জ্বালাটা যেন বেড়ে গেল। কাল থেকেই বারবার এটা হচ্ছে। কী ভুল করেই যে কাল পার্সোনাল ফোল্ডারটা খুলে ফেলেছিল ডুনার সামনে!

পাশের দিকে ঘাড় ঘোরাল। ডিভানের ওপর গোল হয়ে কুঁকড়ে ঘুমোচ্ছে একরত্তি মেয়েটা। স্প্রিং এর মতো ঝাঁকড়া চুলগুলো কপাল পেরিয়ে এসে ছুঁয়েছে চ্যাপ্টা নাকটাকে। এই দুমাসেই কেমন একটা অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে গেছে সে। এপ্রিলের শুরুর দিকেই খবরটা এসেছিল হেডকোয়াটার্সে, প্রিয়দর্শীদের কন্ট্রোল ইউনিটে। ক্ল্যান ওয়ান-সি তে বেআইনি ভাবে ঢুকে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করছে কিছু লোক। শুধু তাই নয়, আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলের টানটান সিকিওরিটিকে ফাঁকি দিয়ে জল চুরি করতে গিয়ে শেষমেশ ধরা পড়েছে। এই অবস্থায় সচরাচর ক্ল্যান কম্যান্ডারের টিমই মাঠে নামে... কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা অতটা সহজ ছিল না, কিছু সময় যেতেই বোঝা গেল যথেষ্ট তৈরী হয়ে এসেছে শত্রুপক্ষ! পরিস্থিতি সামাল দিতে হেডকোয়াটার্স থেকে স্পেশাল ফোর্স নিয়ে পৌঁছল প্রিয়দর্শী। শান্তি বাহিনী তারা, প্রথমেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে যেতে চায় না স্বাভাবিক ভাবেই। অত্যন্ত সতর্কতায় ওই খুনে জঙ্গীদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করানো, আর তারপর তাদের কাউন্সেলিং ক্যাম্পে পাঠানো... সবটাই যথাযথ ভাবে হয়েছিল প্রিয়দর্শীর নেতৃত্বে। বেশ কয়েকটি পরিবারকে বন্দী করে ঘাঁটি গেড়েছিল লোক গুলো, প্রাণভয়ে ঘরছাড়া হয়েছিল কিছু মানুষ... তাদেরকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে ফিরছিল, এমন সময় ওদের অ্যাম্ফিক্র্যাফ্টটার পেছনের চেম্বার থেকে চাপা গোঙানির আওয়াজ ভেসে এল। কে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে! চেম্বারে ঢুকে কান্নার আওয়াজ লক্ষ করে গিয়ে অবশেষে তারা আবিষ্কার করেছিল সেই বহিরাগত ব্যক্তিটিকে! একটা বছর চার-পাঁচের পুচকি অ্যাফ্রিকান মেয়ে। কালো চামড়া শুকিয়ে এখান ওখান থেকে ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে! জলের অভাব, দেখেই বুঝেছিল প্রিয়দর্শী। একটা নীচু টেবিলের নীচে ঢুকে কাঁদছিল মেয়েটা, খিদে-তেষ্টা-আতঙ্কে তখন ছোট্ট শরীরটা থরথর করে কাঁপছে! ওকে দেখে কী ভরসা পেয়েছিল কে জানে, কচি কচি হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল পরম আকুলতায়। তারপর দু-দুটো সপ্তাহ গেছে ডুনার ট্রমা কাটাতে। আগে যেখানে নাইরোবি শহরটা ছিল, তারই কাছাকাছি কোনো অঞ্চলে ছিল ওদের বাড়ি। গণ্ডগোলের মধ্যে পরিবারের সঙ্গে পালানোর সময় দলছুট হয়ে পড়ে ও, আর তারপর খাবার-জল ছাড়াই এই ভয়ঙ্কর তাপমাত্রায় রাস্তায় রাস্তায় দুটো দিন কাটিয়েছে... একে একে জানতে পারে সবই। সেই থেকে এই কন্ট্রোল রুমই ঘর-বাড়ি হয়ে উঠেছে ছোট্ট মেয়েটার। যদিও বাকি মেম্বাররা খুব একটা ভালো নজরে দেখেনি ব্যাপারটা, ডুনা একপ্রকার বোঝাই তাদের কাছে। তবে প্রিয়দর্শীর সিদ্ধান্তের ওপরে কথা বলার সাহস কারোর নেই। সমবয়সী কোনো খেলার সাথী নেই, তাই বকবক করে সারাক্ষণ প্রিয়দর্শীর মাথা খাওয়াটাই ওর কাজ। আর কী ভীষণ কৌতূহল সব বিষয়ে! এই তো, গতকালই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল কপি-পেস্ট করতে করতে দুম করে ওর পার্সোনাল ফোল্ডারটা খুলে ফেলেছিল প্রিয়দর্শী। ওমনি তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছে মেয়ে! “ওই সাদা সাদা লম্বা, ওগুলো কী?” চুল ঝাঁকিয়ে পাশে এসে বসে পড়েছিল।

—“কাশ ফুল,” গম্ভীর উত্তর দিয়েছিল প্রিয়দর্শী।

—“কী ফুল?”

—“কাশ।”

—“ওয়াও! সো বিউটিফুল! কোথায় পাওয়া যায় এগুলো?”

—“কোথাও না। আর কোথাও পাওয়া যায় না।”

অবাক হয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ডুনা। একটা অদ্ভুত জমাট বাঁধা কষ্ট যেন দলা পাকিয়ে উঠে আসছিল গলা দিয়ে, কী করে ওকে বোঝাবে প্রিয়দর্শী... এই ২৭৩৫ সালে ওর সেই ছোট্টোবেলার পুজোর গন্ধ বয়ে আনা কাশফুল আজ হারিয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে!

উহহ্! মাথার ভেতরটা যেন যন্ত্রণায় টাটিয়ে উঠল। হেডরেস্টে এলিয়ে চোখ বুজলো প্রিয়দর্শী। গতকাল থেকেই ফিরে ফিরে আসছে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো। হারিয়ে গেছে কত কিছু! সেই ভারত নামক দেশটা, মেদিনীপুরের এক অখ্যাত গ্রামে তার বেড়ে ওঠার ছেলেবেলাটা, মা-বাবা, ঘন সবুজ জঙ্গল, দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত... সব। বছর পঁচিশেক আগের সেই দিনটা আজও মনে পড়ে, যেদিন কুড়ি বছরের প্রিয়দর্শী মা-বাবাকে প্রণাম করে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়েছিল এক কনকনে শীতের ভোরে। সেই সদ্য কৈশোর পেরোনো যুবকের দুচোখে তখন এক আকাশ স্বপ্ন... দেশের সেবা করবে, বীর জওয়ানদের দলে নাম লেখাবে! কিন্তু কী থেকে যে কী হয়ে গেল! ভেতরে ভেতরে অনেক দিন থেকেই প্রস্তুতি চলছিল, তারপর শেষ পর্যন্ত এসেই গেল সেই চরম মুহূর্ত! পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীবই নিজেদের লোভ-লালসা-দ্বেষ এর উন্মত্বতায় নিজের হাতে ধ্বংস করল এই পৃথিবী, পরিণত করল এক মৃতপ্রায় গ্রহে।

(৪)

পুবের আকাশে সোনা রঙ ধরতে শুরু করেছে। একটা পাতলা সরের মতো কুয়াশা এখনো বিছিয়ে পৃথিবীর ওপর। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই কুয়াশার জাল ছিঁড়েখুড়ে আস্তে আস্তে নতুন সূর্যের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে, সূচনা করবে আরো একটা নতুন দিনের।

দূরে পাহাড়ের ঢালে বিস্তৃত ঘন সবুজ জঙ্গলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন মহারাজ। ধৌলি পর্বতমালার এই উত্তরের অংশটির প্রাকৃতিক পরিবেশ অতি মনোরম। একেই উষাকাল অত্যন্ত প্রিয় সময় তাঁর, তার ওপর এই গাঢ় সবুজ বনানী ও স্থানে স্থানে ফুটে থাকা রঙবেরঙ এর ফুলের বাহার যেন মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শীতলতার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে।

জোরে শ্বাস টানলেন মহারাজ। আহ্! ভোরের বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশ করছে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অবশেষে হয়ত পূরণ হতে চলেছে তাঁর আজন্মলালিত স্বপ্ন! তাঁদের বংশের প্রথম রাজা হিসেবে সমগ্র ভারতবর্ষকে এক পতাকার তলায় আনবেন তিনি। তিনিই হবেন এই সুবিশাল দেশের একচ্ছত্র অধিপতি। ওই মূর্খ পদ্মনাভন এবার বুঝবে তাঁকে অপমান করার ফল কী! প্রায় মাসছয়েক ধরে এই ধৌলি পর্বতের পাদদেশে ঘাঁটি গেড়ে রয়েছে তাঁর সেনাবাহিনী, প্রবল পরাক্রমে দমন করে চলেছে একের পর এক বিদ্রোহী শক্তিকে। মহানদীর জলে বিষ প্রয়োগের মত কার্যকরী কূটনৈতিক সিদ্ধান্তটা এই যুদ্ধক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে রেখেছে তাঁকে। একদিকে নদীর জল পান করে দলে দলে মরছে বর্বরগুলো, অন্যদিকে তাঁর সশস্ত্র সৈন্যদলের তরবারির আঘাতে ধ্বংস হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। এই অসম যুদ্ধে তাঁর জয় তো কেবল সময়ের অপেক্ষা! এই ভূমি তো বাধ্য হবেই তাঁর সামনে মাথা নোয়াতে...

—“এইটা তোমার?” একটা মিষ্টি রিনরিনে গলার আওয়াজে চমকে তাকালেন মহারাজ। অতি কষ্টে দুই হাতে তাঁর প্রিয় তরবারিটা তুলে ধরে অবাক চোখে দেখছে সেই রিনরিনে স্বরের অধিকারী! একটি বছর পাঁচ-ছয়েকের ফরসা গোলগাল ছেলে, মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুলগুলো নেমে এসেছে কপাল অবধি, তারই নীচ থেকে খুদে খুদে দুই চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জরিপ করে চলেছে তাঁর অস্ত্রটাকে। একমুহূর্ত তাঁর দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েই ফের তরবারিটায় মনোনিবেশ করল গম্ভীর মুখে। কে এই ছেলেটি? পোশাক-পরিচ্ছদ অতি সাধারণ, বরং কিছুটা হতদরিদ্র অবস্থাই বলা চলে। রাজপরিবারের কেউ নয় নিশ্চয়ই। তাঁর এই নিভৃত প্রমোদউদ্যানে ঢোকার সাহস পেল কোথা থেকে? প্রচণ্ড ক্রোধে জ্বলে উঠতে গিয়েও হঠাৎ যেন কী এক অদ্ভুত অনুভূতি ছেয়ে গেল মহারাজের বুকের ভেতরটায়। রত্ন খচিত সোনা বাঁধানো চকচকে তরবারিটা পরম যত্নে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরেছে বাচ্চাটা, সেই ভার সহ্য করতে গিয়ে যেন লালচে আভা ধরেছে ফরসা গালগুলোয়... সেদিকে চেয়ে চেয়ে পরম কোমলতায় ভরে গেল তাঁর মন। “হ্যাঁ, আমারি তো!” স্মিত হাসলেন মহারাজ।

—“বাব্বাহ্! কী ভারী!” আর ধরে রাখতে পারল না কচি হাত দুটো, পাথরের ওপর নামিয়ে রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে ছেলেটা বলে উঠল, “তুমি এইটা দিয়ে যুদ্ধ কর? কী করে?”

বাচ্চাটির আধো আধো কথা বেশ লাগছিল। মজার সুরে বলে উঠলেন, “ছোট্টবেলা থেকে অভ্যাস করেছি যে।”

—“হুম্,” গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল ছেলেটা। তারপর কী যেন চিন্তা করতে করতে বলে উঠল, “তোমরা যুদ্ধ করে কী কর? সব্বাইকে মেরে ফেল, না?”

সহসা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন মহারাজ। এরকম কথা তাঁর সামনে আজ অবধি কেউ তো বলেনি! মাথা নত হয়ে এল তাঁর। কী উত্তর হয় এর? এই সামান্য শিশুর সরল প্রশ্নটা এমন কাঁটার মত তাঁকে বিঁধছে কেন? ভোরের এই নিস্তব্ধ পরিবেশ যেন আরো থমথমে হয়ে উঠেছে। জোর করে হাসার চেষ্টা করলেন মহারাজ। আলতো করে ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তোমার নাম কী ? কোথায় বাড়ি তোমার?”

—“আমার নাম? আমার নাম তো পুরন্দর,” আবার কলকল করে উঠেছে সে, “আমার বাড়ি...” বলতে বলতেই হঠাৎ থমকে গেল ছেলেটা। তারপর দুই হাতে জড়িয়ে ধরল মহারাজের ডান হাতের পাতাটা, প্রবল বিস্ময়ে তাঁর অনামিকার রত্নখচিত আংটিটার দিকে তাকিয়ে আকুল গলায় বলে উঠল, “ও, তুমিই সেই রাজা? তোমার হাতে তো সেই আংটি!”

হতভম্ব মুখে নিজের ডান অনামিকায় পরা আংটিটার দিকে তাকালেন মহারাজও। সমুদ্র নীল রঙের এক পাথর খচিত এই আংটি, নরম নীলাভ দ্যুতি যেন ঠিকরে পড়ছে তার থেকে। কৈশোর পেরিয়ে তখন সদ্য যৌবনে পা রেখেছেন তিনি, একদিন তাঁর জননী ডান অনামিকায় পরিয়ে দিয়েছিলেন এই বিশেষ অঙ্গুরীয়টি... মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, “জয়ী হও।” মায়ের মুখে শুনেছিলেন তাঁর পিতামহী নাকি ছিলেন গ্রীস দেশের রমণী, বীর আলেকজান্ডারের প্রাক্তন সেনাপ্রধান সেলেউকসের কন্যা। বিশ্বজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণের ঠিক পূর্বেই জয় করেছিলেন মিশর দেশ, এবং সেই দেশ থেকে তাঁর সঙ্গেই আসে এই আংটিটি। অন্য দেশের হলেও অঙ্গুরীয়টি একেবারে যথাযথ ভাবে স্থান দখল করেছিল তাঁর ডান অনামিকায়... যেন তাঁর জন্যই বিশেষ ভাবে তৈরী করা! কিন্তু এই ছোট্ট শিশু এই আংটির কথা জানল কী করে? পুরন্দরের মুখের দিকে তাকালেন। মাথা ঝুঁকিয়ে সে তখনও নিরীক্ষণ করছে আংটিটা, সম্ভবত বুঝে ফেলেছে আংটির বিশেষত্ব। প্রথম প্রথম তিনিও খুব অবাক হতেন আংটিটা দেখে। খুব কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায়, সমুদ্র নীল রঙের পাথরটা আসলে স্থির নয়। সরু সরু সাদা চুলের মতো ঢেউ ওঠে ওতে। যেন সত্যিই কোনো জলের আধার!

—“তুমি এই আংটির কথা জানলে কী করে?” অস্ফুটে শব্দ কটা ছিটকে এল তাঁর মুখ দিয়ে। মাথা তুলে তাকালো পুরন্দর। তার মায়া ভরা চোখ দুটোয় যেন খুশি উপচে পড়ছে। ফিসফিস করে বলে উঠল, “রাজা! তুমি এসে গেছ, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। জানো, এখানে না সবাই নদীর জল খেয়ে মারা যাচ্ছে। আসার পথে দেখলাম, কতজন জল খেয়ে বমি করে করে রাস্তায় মরে পড়ে আছে। তুমি ওদের জন্য ভালো জল এনেছ, না? মা বলেছিল আমাকে গল্পটা।”

মহারাজের বুকের ভেতরে কে যেন প্রচণ্ড জোরে হাতুড়ির আঘাত করল। পুরন্দরের পালকের মত নরম হাতদুটো ধরে রেখেছে তাঁর হাত, সেই ছোঁয়াটুকু যেন সারা শরীর অবশ করে দিচ্ছে। তাঁর শুষ্ক কণ্ঠস্বর যেন দূরে ধৌলি পর্বতমালার গায়ে ধাক্কা খেয়ে ভেসে এল, “গল্প!”

—“মা বলেছিল...” আপনমনে বিড়বিড় করতে শুরু করেছে পুরন্দর, “এক দেশে এক রাজা ছিল। সে রাজার মতো রাজা আর হয় না। যেমন মহান, তেমন দয়ালু সেই রাজা তার প্রজাদের খুব ভালোবাসত... তাদের সুখ-দুঃখের কথাই ভাবত সবসময়। প্রজাদের আর কোনো কিছুর অভাব ছিল না... অভাব ছিল কেবল জলের। আসলে এই রাজার আগে একজন লোভী রাজা ছিল, সে যুদ্ধ করে দেশ দখল করতে গিয়ে সমস্ত জলাধার বিষাক্ত করে ফেলেছিল। তাই প্রজারা পানীয় জলের অভাবে একে একে মরতে শুরু করল। ভালো রাজার চোখে ঘুম নেই, কীভাবে সে বাঁচাবে তার প্রজাদের! একদিন রাজা ভাবল, নিশ্চয়ই অন্য কোনো দূর দেশে ভালো পানীয় জলের সন্ধান পাওয়া যাবে। সে নিজে সেই জল নিয়ে আসবে তার প্রজাদের জন্য। কিন্তু বড় বিপদসঙ্কুল সে পথ! রাক্ষস খোক্কস দত্যি-দানোর রাজ্য পড়বে সে পথে গেলে! তবুও রাজা যাবেই। তার মা তার হাতে পরিয়ে দিলেন একটা নীল পাথরের আংটি, তাতে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ ওঠে। সাত সমুদ্র বাঁধা আছে সেই আংটির ভিতর, যার হাতে থাকবে সে হবে সাত সমুদ্দুরের রাজা! তো রাজা বেরিয়ে পড়ল সেই সমুদ্র ঢেউয়ের আংটি পরে। তারপর...”

—“পুরন্দর!” এক ভীষণ চিৎকারে চমকে উঠে দাঁড়ালো পুরন্দর। অবাক হয়ে তাকিয়েছেন মহারাজও। পেছন দিক থেকে পাগলের মত দৌড়ে আসছে একটা লোক। ধূলিধূসরিত শরীর, পরনে মলিন একটা কাপড়, মাথায় বাঁধা কাপড়ের ফেট্টি বুঝিয়ে দিচ্ছে এ কোনো মজুর শ্রেণীর লোক। দৌড়ে এসে পুরন্দরকে এক ধাক্কায় নিজের পেছনে সরিয়ে দিয়ে মহারাজের পদতলে আছড়ে পড়ল লোকটা, “ওকে মাপ করে দিন হুজুর! না জেনে বুঝেই এখানে ঢুকে পড়েছে আমার ছেলেটা। দয়া করুন মহারাজ, ওকে শাস্তি দেবেন না। ওর শাস্তি আপনি আমাকে দিন, ওকে ছেড়ে দিন।” বলির পাঁঠার মত কাঁপতে কাঁপতে ব্যাকুল স্বরে বিলাপ করে উঠল।

—“কে তুমি? কী করছ এখানে?” দূর থেকে ছুটে আসা প্রহরীদের এক ঝলক দেখে নিয়ে দ্রুত তরবারিটা হাতে তুলে নিলেন মহারাজ, শত্রুপক্ষের কোনো গুপ্তঘাতক নয় তো এই লোকটা! “আমি আপনার দাস হুজুর,” হাতজোড় করে কঁকিয়ে উঠল লোকটা, “তোষালী থেকে খাদ্যশস্য রসদ নিয়ে এসেছিলাম। ছেলেটা সঙ্গে আসার জন্য বায়না জুড়ল, নিয়েই এলাম শেষমেষ... তারপর কোন ফাঁকে যে এখানে কীভাবে চলে এল...! মাপ করে দিন হুজুর...” ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কেঁদে ফেলল লোকটা। প্রহরীরা ঘিরে ফেলেছে চারদিক। প্রধান প্রহরীর দিকে মহারাজ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে এগিয়ে এসে অভিবাদন করে বলল, “হ্যাঁ মহারাজ। আপনার নির্দেশে তোষালী থেকে কৃষকরা আমাদের বাহিনীর রসদের জন্য খাদ্যশস্যের ভান্ডার নিয়ে এসেছে গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে। এই লোকটি আর তার বাচ্চা ওই দলেই ছিল। তারপর বাচ্চাটা কখন নজর এড়িয়ে এখানে ঢুকে পড়েছে...” মাথা নীচু করল প্রধান প্রহরী। তরবারি কোষাবদ্ধ করলেন মহারাজ। ওদের ছেড়ে দিতে নির্দেশ দিলেন। বাবার হাত ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যাচ্ছে পুরন্দর... যাওয়ার আগে পেছন ফিরে একবার মহারাজের দিকে তাকালো। এক অনাবিল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার মুখ! তারপর আবার মাথা নীচু করে রওনা দিল তার পথের উদ্দেশে।

একটা শিরশিরে অচেনা অনুভূতিতে কেঁপে উঠলেন মহারাজ। নিজের অজান্তেই ছুঁলেন আংটিটা। আচ্ছা, কী হল সেই রাজার? সে কি পারলো তার প্রজাদের বাঁচাতে?

(৫)

—“তুমি কিন্তু বললে না, পাপা!” রিনরিনে গলাটা কানের কাছে বেজে উঠতেই চমকে সোজা হয়ে বসল প্রিয়দর্শী। কখন উঠে পড়েছে মেয়েটা! ফোলা ফোলা মুখ আর সদ্য ঘুম ভাঙা চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডুনা। পরনে প্রিয়দর্শীর একটা গোল গলা টি-শার্ট, সেটাই ম্যাক্সি হয়ে তার গলা থেকে পা অব্দি ঢেকে ফেলেছে। মস্ত একটা হাই তুলে চেয়ারের হাতল বেয়ে তরতর করে উঠে চড়ে বসল টেবিলের এক পাশে, তারপর এলোমেলো চুলগুলো ঝাঁকিয়ে আধো আধো ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে বলে উঠল, “এবার বলো। ওয়ার্ল্ড ওয়ার কী?”

দাড়িটা চুলকোল প্রিয়দর্শী। এ মেয়ে সহজে ছাড়ার পাত্রী নয়! মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায় ও। ডুনার ব্রেনটা যেন সাধারণ পাঁচ বছরের বাচ্চার থেকে কয়েকগুণ বেশী অ্যাক্টিভ! অসম্ভব তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, আর খুব তাড়াতাড়ি নতুন জিনিস শিখে নেওয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে মেয়েটার। মেমারিটাও ভীষণ শার্প! ওকে আনার কয়েকদিন পর যখন প্রথম মুখ খুলেছিল, সোয়াহিলি ঘেঁষা একটা অদ্ভুত টানে ইংলিশ বলত। কিন্তু তার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই প্রিয়দর্শীর কথা শুনে শুনে দিব্যি ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টটা শিখে নিয়েছে! ওয়ান্ডার চাইল্ড! আর ছোটো বাচ্চাদের মতো সাধারণ ছোটখাটো বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ নেই তার, যত উৎসাহ বড়দের গুরুগম্ভীর বিষয়ে! এই তো দিনকয়েক আগে ও আর এরিনের আলোচনার মধ্যে ‘ওয়র্ল্ড ওয়ার’ কথাটা শোনামাত্রই পেছন পেছন ঘুরঘুর করছে ওটা নিয়ে বলার জন্য, কদিন ব্যস্ত থাকার কারণে ঠিক বাগে পায়নি ওকে। মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে নিল প্রিয়দর্শী। খুব সতর্কভাবে বোঝাতে হবে। ডুনার মতো বাচ্চারাই এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ, যদি ওদের বড় হওয়া পর্যন্ত এই গ্রহকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে প্রিয়দর্শীরা তবে একদিন ওরাই হবে মূল চালিকাশক্তি। গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে শুরু করল প্রিয়দর্শী, “ওয়র্ল্ড ওয়ার মানে এমন এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ, যেখানে পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটা কান্ট্রি একে অপরের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে শেষ হয়ে গেছে।”

—“কান্ট্রি? হোয়াট ইজ কান্ট্রি?” ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে একজোড়া নিষ্পাপ চোখ।

ভীষণ অবসন্ন লাগছে। উঠল প্রিয়দর্শী। বেডসাইড টেবিলের তিন নম্বর ড্রয়ারটা টানতেই বেরিয়ে এল রাশি রাশি অ্যাম্পিউল, সিরিঞ্জ, ছুরি, কাঁচি ইত্যাদি। একটা নির্দিষ্ট অ্যাম্পিউল ভেঙে সিরিঞ্জে পুরে বাম বাহুতে পুশ করল। আহ্! নীল তরল ঢুকে যাচ্ছে শরীরের শিরা উপশিরা বেয়ে, একটু পরেই সম্পূর্ণ সতেজ করে তুলবে প্রিয়দর্শীকে।

—“দেশ!” ডান হাতে ছুঁচ ফোটানো জায়গাটা ডলতে ডলতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসে বসল প্রিয়দর্শী, “এখনকার পৃথিবীতে আর কোনো দেশ অবশিষ্ট নেই, সব ধ্বংস হয়ে শুধু গুটিকতক বেঁচে থাকা মানুষ একজোট হয়ে ছোটো ছোটো ক্ল্যান তৈরী করে আছে। সেই আদিম যুগের মতো। কিন্তু আগে এমনটা ছিল না।”

চোখ বড় বড় করে তার দিকে চেয়ে আছে ডুনা, মুখটা অল্প ফাঁক। “আমাদের এই পৃথিবী আগে খুব সুন্দর ছিল, জানো তো ডুনা?” একটা হাহাকার যেন ছিটকে বেরিয়ে এল প্রিয়দর্শীর বুক থেকে, “তখন বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ, যারা একই ভাষায় কথা বলত, একই ধরনের খাবার-জামাকাপড়-শিক্ষা-সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকত, তারা একসঙ্গে মিলে একটা দেশে থাকত। প্রত্যেকটা মানুষের একটা দেশ ছিল। যেমন আমার দেশটার নাম ছিল ইন্ডিয়া।”

—“আর আমার?” ওকে থামিয়ে তড়বড়িয়ে বলে উঠল ডুনা, “আমার দেশের নাম কী?”

এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল প্রিয়দর্শী। তারপর নীচু গলায় বলতে শুরু করল, “তোমারও একটা দেশ হতে পারত। তুমি যেখানে থাকতে ওখানে আগে একটা দেশ ছিল, কঙ্গো। কিন্তু তুমি জন্মানোর বছর দশেক আগেই সে দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে, সেই থার্ড ওয়র্ল্ড ওয়ারের সময়।”

স্থির হয়ে বসে আছে ডুনা। শুধু চঞ্চল চোখ দুটো দেখে বোঝা যায় কী ভীষণ তোলপাড় চলছে ওর মধ্যে! “তো কী হল, বেশ তো ছিল দেশগুলো,” আবার শুরু করল প্রিয়দর্শী, “কিছু কিছু দেশের মধ্যে শত্রুতাও যেমন ছিল, তেমনি একে অপরের বন্ধুও ছিল অনেক দেশ। কিন্তু ধীরে ধীরে একটা সমস্যা পৃথিবীর বুকে এমনভাবে ডালপালা মেলে বড় হয়ে উঠতে লাগল যে সব দেশই ধীরে ধীরে একে অপরের চরম শত্রু হয়ে উঠতে শুরু করল। আর সেই সমস্যাটা হল জল। আরো ভালো করে বলতে গেলে পানীয় জলের অভাব। মানুষের ব্যবহার করার মতো পরিশ্রুত জলের যোগান ধীরে ধীরে কমে আসছিল গোটা পৃথিবী জুড়ে। তোমাকে সেদিন পলিউশান কাকে বলে বলেছিলাম, মনে আছে?”

—“ইয়া! পলিউশানের জন্য আমাদের আর্থের জল, বাতাস, মাটি সব নষ্ট হয়ে যায়, নেচার খুব কষ্ট পায়। উই হ্যাভ টু সেভ আওয়ার মাদার নেচার ফ্রম পলিউশান।” অনেক খানি মাথা ঝুলিয়ে সুর করে বলে উঠল ডুনা, “তাই তো আমি এরিনের সঙ্গে ব্যাকইয়ার্ডে গিয়ে ছোট্ট ছোট্ট গাছ লাগিয়েছি।”

—“গুড গার্ল!” ওর গালটা টিপে দিল প্রিয়দর্শী, “কিন্তু তখনকার পৃথিবীর মানুষ এই কথাটা বোঝেনি। গাছ কেটেছে, গাড়ি-ঘোড়া কল কারখানা এই সব থেকে ধোঁয়া ছেড়ে ছেড়ে বাতাসে কার্বন এমিশান বাড়িয়েছে... আর তার পরেও দিব্যি নিশ্চিন্ত হয়ে আরামে ঘুমিয়েছে! এইরকম চলতে চলতে শেষে এমন একটা অবস্থা এল যখন আর্থের টেম্পারেচার অনেকটা বেড়ে গেল। আর তার ফলে ভয়ঙ্কর ভাবে শুরু হল গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর এফেক্ট!” থামল প্রিয়দর্শী।

—“তারপর?” বিহ্বল চোখে বলে উঠল ডুনা।

—“তারপর? মাদার নেচারের ওপর আমরা এত অত্যাচার শুরু করেছিলাম যে সে এবার রিভেঞ্জ নিতে শুরু করল। গোটা পৃথিবী জুড়ে নানারকম ন্যাচারাল ক্যালামিটি শুরু হল। বড় বড় বরফমোড়া পাহাড়গুলো গলে গেল, আর সেই জলের বন্যার তলায় ডুবে গেল কত দেশ! কোথাও বা ভীষণ খরা হয়ে মরুভূমি তৈরী হল, কোথাও কনকনে শৈত্যপ্রবাহ হয়ে বরফের তলায় চাপা পড়ল অগুনতি মানুষ! পুরো গ্রহটার বাস্তুতন্ত্রটাই নড়ে গেল।”

—“তখন কী হল? ওরা অনেক গাছ লাগালো না কেন? তুমি বললে না ওদের? গাছেরা বড় হলে তো বৃষ্টি ডেকে আনত।” আফশোষে যেন ছটফট করে উঠল ছোট্ট শরীরটা।

একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠল প্রিয়দর্শীর মুখে। “মানুষ খুব বোকা, জানো!” বিষাদ মাখানো গলায় বলল, “যখন প্রকৃতি ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তখন তাকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা না করে লোভী মানুষের দল কী করল... যেটুকুনি পড়ে ছিল তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দিল! মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সবথেকে জরুরি হল জল। কিন্তু ততদিনে মাটির নীচে জলের স্তরগুলো শুকিয়ে এসেছে, বৃষ্টিও পড়ে না, নদী-নালা সব ধীরে ধীরে শুকনো খটখটে। তাই যেখানে যতটুকু পানীয় জল পাওয়া যায়, তাই নিয়ে শুরু হল লড়াই!”

—“ইসস!” নিজের কপালে চাঁটি মারল ডুনা।

—“ততদিনে তো সব দেশ নিউক্লিয়ার টেকনোলজিতে খুব উন্নত হয়ে গেছে, সবার হাতে ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র, কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না! শেষ পর্যন্ত ২৭২০ সালে শুরু হল থার্ড ওয়র্ল্ড ওয়ার, জলের জন্য।”

—“থার্ড কেন?” প্রশ্ন উড়ে এল।

—“পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগেও আরও দুবার এরকম ভয়ঙ্কর লড়াই হয়েছিল মানুষে মানুষে। সে অনেক বছর আগের কথা, প্রায় ৮০০ বছর আগে... ১৯১৪ আর ১৯৩৯ সালে। কিন্তু সেই দুবারের যুদ্ধ এতটাও ভয়ঙ্কর ছিল না, যা পুরো পৃথিবীকে ধ্বংস করতে পারে। হ্যাঁ, নিউক্লিয়ার অ্যাটাক হয়েছিল, জাপান বলে একটা দেশ এর ওপর নিউক্লিয়ার বম্বও ফেলা হয়, হিরোশিমা আর নাগাসাকি বলে দুটো শহরের ওপর। সেই ওয়র্ল্ড ওয়ার দুটোর কথা নাহয় আরেক দিন বলব, কেমন?” উল্টো দিক থেকে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়া দেখে আবার গুছিয়ে বলতে শুরু করল প্রিয়দর্শী, “কিন্তু এই থার্ড ওয়র্ল্ড ওয়ারের সময় প্রায় সব দেশের হাতেই তৈরী ছিল নিউক্লিয়ার ওয়েপনস। শুরু হল মাস এক্সপ্লোশান। পুরো মানবজাতি যেন তখন ক্ষমতার অহঙ্কারে উন্মাদ হয়ে উঠেছে! ছোট্ট দেশ গুলো ছাড়া প্রায় প্রত্যেকটা দেশ বম্ব চার্জ করেছিল একে অপরের ওপর। সেই ভয়ঙ্কর রেডিয়েশানে মারা পড়ল কোটি কোটি মানুষ, জীবজন্তু... পুড়ে ছাই হয়ে গেল গাছপালা-জঙ্গল। বাতাসে ছড়িয়ে গেল বিষ! আমার দেশের একজন সৈনিক হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখেছি সেসব। যুদ্ধ শেষে পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ মানুষ মরে গিয়ে বেঁচে থাকল আমাদের মতো ভাগ্যবান কিছু জন।” বলতে বলতে যেন শিউরে উঠল প্রিয়দর্শী। ডুনার মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে, একটা করাল আতঙ্কের ছায়া যেন তার চোখে-মুখে। এক মুহূর্তের জন্য মনটা মমতায় আর্দ্র হয়ে উঠলেও নিজেকে শক্ত করল প্রিয়দর্শী। থাক, ওকে বুঝতে হবে এসব। জানতে হবে মানুষের লোভ আর অহঙ্কার কোন মূর্খতার সীমানায় এনে দাঁড় করায়!

—“তখন সব দেশের সীমানা মুছে গেছে। মাইলের পর মাইল পুড়ে ঝলসে যাওয়া ক্ষেত, ফুটিফাটা জমি। নিউইয়র্ক, প্যারিস, জেনিভা, জোহানেসবার্গ এইসব বড় বড় শহরের শুধু ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। বাতাসে এতটাই বিষ, নিঃশ্বাস নেওয়া যায় না... চামড়া ঝলসে যায়। জলের অভাবে ধুঁকছে বেঁচে যাওয়া কিছু মানুষ জীব-জন্তু...”

—“ব্যাড! ভেরি ব্যাড!” ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রাগী গলায় চিৎকার করে উঠল ডুনা। তারপর প্রিয়দর্শীর দিকে আঙুল তুলে বলে উঠল, “তোমরা বড়রা খুব বাজে, খুব নিষ্ঠুর। তোমরা কেন এমন কষ্ট দিয়েছ নেচারকে? তাই তো আজ আর ওই কাশফুল ফোটে না! তোমার ওই ছবিটার মতো বড় বড় মাঠ ভরতি ঘাস নেই, উঁচু উঁচু গাছ নেই। আমার কত ইচ্ছে করে তোমার ছবির ওই নদীটার পাশে গিয়ে বসতে। কিন্তু সব... সব শেষ করে দিয়েছ তোমরা।”

মাথা নীচু করে বসেছিল প্রিয়দর্শী। হ্যাঁ, সবই তো সত্যি! ডুনার একটা কথাও তো ভুল নয়! এই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কী রেখে যেতে পারছে ওরা, একটা মৃতপ্রায় গ্রহ ছাড়া? কিন্তু...

—“কী ঝগড়াঝাঁটি চলছে বাপ-বেটিতে মিলে?” দরজার কাছ থেকে ঘুম জড়ানো গলার হাসি ভেসে এল। মুখ তুলল প্রিয়দর্শী।

(৬)

—“মধ্যাঞ্চল থেকে অতি উৎকৃষ্ট সুরা নিয়ে এসেছে আমাদের জোগানদাররা। সঙ্গে আছে আপনার অতি প্রিয় ঝলসানো শম্বরের মাংস। মহারাজ অনুমতি দেন তো পরিবেশনের নির্দেশ দিই?”

—“উঁ? সুরা? আজ নয় আচার্য্যদেব।”

—“কেন মহারাজ? বিজয় তো শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা! এই ধৌলি পর্বতমালা থেকে শুরু করে দয়া নদীর তীর বরাবর যতদূর চোখ যায়, সমগ্র অঞ্চলই তো আমাদের সৈন্যদের দখলে। কুয়াখাই নদীর উৎস মুখ থেকে সাগরের সঙ্গমস্থল... প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি গঞ্জ এখন আপনার পদানত মহারাজ। জনশূন্য হয়েছে এই সুবিশাল এলাকা, যারা বেঁচে আছে তাদের মুখে কেবল আপনারই জয়ধ্বনি... তবু কেন এমন চিন্তান্বিত দেখাচ্ছে আপনাকে?”

বালিঘড়িটার দিক একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন মহারাজ। আজ অমাবস্যার সন্ধ্যে একটু তাড়াতাড়িই নেমে গেছে। পশ্চিমের আকাশে ঘন কালো মেঘ ঢেকে ফেলেছে সূর্যাস্তের শেষ লালিমাটুকু, ওদিকে পুবে নবীন চন্দ্রালোকের আভাসও নেই। সৈন্য শিবিরে বিশ্রামরত সেনাদের মৃদু কোলাহল ও পাকশালা থেকে আসা মশলা পেষাইয়ের শব্দ ছাড়া বাকি চরাচর নিশ্চুপ। নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন মহারাজও, দূরের নিকষ কালোর দিকে চেয়ে। কিছু পরে গম্ভীর দৃষ্টিপাত করলেন রাধাগুপ্তের দিকে, “এখন উৎসব পালন করে মূর্খেরা!” বজ্রনির্ঘোষে যেন কেঁপে উঠল বিশ্রামকক্ষ। রাধাগুপ্তের দিকে তর্জনী নির্দেশ করলেন মহারাজ, তাঁর ভুরুতে চলছে কুটিল খেলা, “আপনি একথা বলছেন আচার্য্য! আপনি মহামহিম বুদ্ধিশ্রেষ্ঠ চাণক্যদেবের সুপুত্র, আপনার আশ্চর্য কূটনৈতিক পরামর্শেই ভ্রাতা সুসীমকে হত্যা করে, ভ্রাতা বীতশোককে গদিচ্যুত করে এই রাজসিংহাসনে আসীন হয়েছি আমি... আপনার মুখে কি এমন শিশুসুলভ বাক্য মানায়?”

মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলেন রাধাগুপ্ত।

মহারাজের তীব্র দৃষ্টি ফের জ্বলে উঠল। কঠিন গলায় বলতে থাকলেন, “আজ প্রায় দশ মাস অতিবাহিত। প্রায় সমগ্র রাজ্য আজ আমার পদানত। আমার সেনারা হত্যা করেছে সমস্ত বিরোধী শক্তিকে, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তছনছ করে দিয়েছে তাদের বাসভূমি... এজন্য তাদের বিশেষ প্রশংসা প্রাপ্য বইকি! কিন্তু এই তো সব নয়। আমার পিতা-পিতামহের মতো একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করার মতো মূর্খতা তো আমি করব না!” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মাথা তুলে তাকালেন রাধাগুপ্ত। তাঁর চোখে চোখ রেখে গর্জে উঠলেন মহারাজ, “এই বিরোধী শক্তির নেতা, ওই অনন্ত পদ্মনাভনকে আজ অবধি বন্দী করতে পারেনি আমার সৈন্যদল, হত্যা তো দূরে থাক! আর আপনি বলছেন আমি প্রমোদ-আমোদে নিজেকে নিয়োজিত রাখব! ভুলে যাবেন না আচার্য্য, বিষফলের একটি বীজও যদি মাটির তলায় লুকিয়ে থাকে... বহু বৎসর অতিক্রান্ত হয়েও সেই বীজ ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। যতই অঞ্চলের মানুষ আমার সামনে মাথা নত করুক... ওই বর্বর নেতা জীবিত থাকলে সে ফের বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে পারে দেশবাসীর মধ্যে। এই পাপ সমূলে বিনষ্ট করতে হবে।”

বহুক্ষণ পরে মুখ খুললেন আচার্য্য রাধাগুপ্ত। ধীর, নম্র গলায় বললেন, “আপনার এই বাসনার কথা আমার অজানা নয় মহারাজ। আপনার আদেশ শিরোধার্য...”

—“কিন্তু কী করে?” নিষ্ফল আক্রোশে ছটফট করে উঠলেন মহারাজ, “অতি ধূর্ত সে ব্যক্তি! চরেরা জানিয়েছে ছদ্মবেশ ধারণে তার মতো পটু খুব কম মানুষই আছে, মুহূর্তের মধ্যে বেশ বদল করে সাধারণের মধ্যে মিশে যায় সে! তার উপস্থিতি আজ অবধি শনাক্ত করে উঠতে পারেনি গুপ্তচরেরা। কীভাবে দমন করা যাবে সেই ব্যক্তিকে?”

—“ভরসা রাখুন মহারাজ,” শান্ত মৃদু কণ্ঠে বললেন রাধাগুপ্ত, “একজন আছে, যে পারবে এই অসাধ্য সাধন করতে।” তারপর একটু থেমে বললন, “আর কী কাকতালীয় ব্যাপার, এক্ষুণি তার হাজির হওয়ার কথা আপনার সামনে।”

মহারাজের কপালের ভাঁজ আরো গাঢ় হয়েছে। তিনি কিছু বলে ওঠার আগেই দ্বারপ্রান্তে চাপা গলার আওয়াজ এল, “মহারাজের জয় হোক!”

—“আসুন আসুন আচার্য্যদেব! আপনার কথাই ভাবছিলাম এতক্ষণ,” শশব্যস্ত হয়ে উঠে গেলেন রাধাগুপ্ত। কম্পিত পদে কক্ষের ভেতর এসে দাঁড়ালেন শুভ্র শ্মশ্রু-গুম্ফ শোভিত ক্ষীণকায় এক বৃদ্ধ।

—“আচার্য্য কৌম্য!” প্রচণ্ড বিস্ময়ে বলে উঠলেন মহারাজ। পরমুহূর্তেই প্রবল ক্রোধে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করলেন রাধাগুপ্তের দিকে, “আপনি কি আমার সঙ্গে মস্করা করছেন? বৃদ্ধ রাজবৈদ্য হত্যা করবেন ওই কূটবুদ্ধি বলশালী পদ্মনাভনকে ?”

—“অপরাধ নেবেন না মহারাজ,” এবার কম্পিত স্বরে বলে উঠলেন আচার্য্য কৌম্য, “আপনি আদেশ করলে সেই ব্যক্তিকে আপনার সামনে হাজির করতে পারি, যে পারে এই কাজ করতে।” নিজেকে সংবরন করলেন মহারাজ, বিস্মিত দৃষ্টিতে ইশারা করতেই আচার্য্য কৌম্য পর্দা সরিয়ে কোনো নির্দেশ দিলেন।

আর তারপর পর্দা সরিয়ে ধীর পায়ে কক্ষে প্রবেশ করল এক নারী।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন মহারাজ। এই সামান্য নারী হত্যা করবে সেই বিদ্রোহী নেতাকে! কী এমন শক্তি ধরে এ? খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন যুবতীটিকে। অপূর্ব সুন্দর মুখশ্রী, ঠিক যেন পাথর খোদাই করা দেবীমূর্তি! তবে সে সৌন্দর্য্যে স্নিগ্ধতার থেকে বেশী প্রকাশ পাচ্ছে তীব্র কামনার হাতছানি। আর সেই কামনার আবেশে যোগ্য সঙ্গত করেছে তার সাপের মত পিঙ্গলবর্ণ দুই চোখ ও স্ফূরিত অধর। যৌবন যেন উপচে পড়ছে সারা দেহে, আর সেই নিখুঁত সুগঠিত দেহসৌষ্ঠবকে আরও মদিরাময় করে তুলেছে তার অতিরিক্ত স্বল্প বসন। এক মুহূর্তের জন্য যেন সেই কামনার আঁচে উষ্ণ হলেন মহারাজ, নেশাতুর কণ্ঠে বলে উঠলেন, “কে এই নারী?”

—“ওর নাম ঔমিশা, মহারাজ। অর্থাৎ মৃত্যু।” সাদা দাড়ির ফাঁকে যেন সামান্য হাসলেন আচার্য্য কৌম্য। মৃত্যু! এমন রমণীর নাম মৃত্যু! কিন্তু নাম মৃত্যু মানেই যে সে কারো মৃত্যুর কারণ হতে পারে তা তো নয়। আবার জরিপ করতে লাগলেন মহারাজ... নাহ্, যোদ্ধা হওয়ার কোনো চিহ্নই নেই এই নারীর কমনীয় শরীরে, বরং এ যেন জন্মেছে পুরষের ভোগের জন্য... ভাবতে ভাবতে হঠাৎ এক জায়গায় নজর আটকে গেল তাঁর। চমকে উঠলেন মহারাজ। এতটা ভুল হল! এই কথাটা কীভাবে বিস্মৃত হলেন তিনি!

মেয়েটির মোমের মত পেলব উন্মুক্ত পৃষ্ঠে গ্রীবার সংযোগস্থলে তখন উঁকি দিচ্ছে খুব ছোট্ট একটি উল্কি। একটি ত্রিভুজকে বৃত্তাকারে সাপের মতো জড়িয়ে রেখেছে একটি লতা।

বিষকন্যা!

কী আশ্চর্য্য বুদ্ধি ধরেন চাণক্যপুত্র! মনে মনে রাধাগুপ্তের কূটনৈতিক কৌশলের তারিফ না করে পারলেন না মহারাজ। বিষকন্যাদের ব্যবহারের এর থেকে উপযুক্ত পরিস্থিতি আর হতেই পারে না। তাঁর পিতামহের আমলে সর্বপ্রথম এই পদ্ধতির প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা চাণক্যদেব। পিতামহের অনুমতিসাপেক্ষে চাণক্যদেবের তত্ত্বাবধানে কিছু অল্পবয়সী সুন্দরী কিশোরী নির্বাচন করা হয়। এরপর ওই মেয়েদের শরীরে প্রত্যেকদিন বিশেষ পদ্ধতিতে খুব অল্প পরিমাণে বিষ মেশানো শুরু হয়। সেই অল্প পরিমাণ বিষে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে নারীশরীর, কোনো রকম ক্ষতি ছাড়াই শরীরের রক্ত পরিণত হতে থাকে বিষে। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে উত্তীর্ণ হতে হতে তাদের শরীর সম্পূর্ণরূপে পরিণত হয় এক বিষের আধারে, অথচ বহিরঙ্গ থাকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এক কমনীয় সুন্দরী নারীর মতোই! ফলে কোনোভাবে সেই বিষকন্যাদের সঙ্গে কোনোরকম শারীরিক মিলনের ফলে সেই বিষ চলে যায় সাধারণ মানুষের দেহে। আর তৎক্ষণাৎ মৃত্যু! পিতামহের সময় থেকে শত্রুনিধনের বহুক্ষেত্রে এই বিষকন্যাদের সফলভাবে ব্যবহার করা হলেও তিনি অদ্যাবধি এদের বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগ করেননি। কিন্তু আজ হয়ত এই মেয়েটিই...

মহারাজের দৃষ্টির তারিফ এড়ায়নি রাধাগুপ্তের, ঝিলিক দিয়ে উঠল তাঁর চোখ, “কিছু পূর্বেই গুপ্তচরেরা সংবাদ এনেছে, কুয়াখাই নদীর পশ্চিমের জঙ্গলের মাঝ-বরাবর বণিকের বেশে ঘাঁটি গেড়ে আছে অনন্ত পদ্মনাভন। আর তার দলের একটি লোকের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, নারীদেহের প্রতি তীব্র আসক্তি আছে তার।” ধূর্ত শেয়ালের মতো সশব্দে হেসে উঠল কক্ষে উপস্থিত তিনজন পুরুষ।

পরের দিন কুয়াখাইয়ের জঙ্গলে অনন্ত পদ্মনাভনের বিশ্রামকক্ষের দ্বারে এসে দাঁড়ালো এক উদ্ভিন্নযৌবনা রমণী। ময়ূরধ্বজাধারী সৈন্যদের অত্যাচারে পরিবার পরিজন হারিয়েছে সে, রাজার দাসী হিসেবে আশ্রয় পেলে ধন্য হবে। তার কোমর ছাপানো খোলা চুলের আড়ালে গ্রীবার পাশে জ্বলজ্বল করতে লাগল ত্রিভুজাকার উল্কিটা।

(৭)

“গুডমর্নিং অলমাইটি!” এরিন দাঁড়িয়ে আছে। এরিন বার্লোস, ওর সহকর্মী। সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে বোধহয়, লালচে গাল গুলো ফোলা ফোলা, সোনালী রেশমের মতো নরম চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে কাঁধের ওপর। প্রিয়দর্শীর ‘মাইতি’ টাইটেলটাকে এরকম ভাবেই নিজের মতো ইম্প্রোভাইজ করে নিয়েছে এরিন। “গুডমর্নিং ডুনা বেবি,” বলে ডুনার গালে একটা চুমু দিয়ে প্রিয়দর্শীর গলা জড়িয়েও একটা চুমু খেল গালে। সিঁটিয়ে গেল প্রিয়দর্শী। এরিন ওকে পছন্দ করে মনে মনে, হয়ত সেও... কী যেন এক অদ্ভুত মায়া আছে ওর মধ্যে। ওর সঙ্গে কথা বললে যেন কেটে যায় মনের সব কালিমা, হিংসা, লোভ... এক পরম প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে হৃদয় জুড়ে। পেশায় মনোবিজ্ঞানী তো অনেকেই হয়, কিন্তু এরিন যেন সবার থেকে আলাদা... যেন স্বয়ং শান্তির দেবী ‘এরিন’! গ্রীক দেবীর নামে ওর এই নাম সত্যিই যথার্থ। ওর এই কোমল হৃদয়টার টানেই ওর কাছে ফিরে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে প্রিয়দর্শীর... কিন্তু এই পঁয়তাল্লিশ বছরে এসে সাধারণ মানুষের মত প্রেমমাধুর্যে ভরা জীবন কাটানোর সময় বা পরিস্থিতি কোনোটাই নেই তাদের। সামনে অনেক কাজ, অনেক বড় দায়িত্ব মানবজাতির প্রতিনিধি হিসেবে। তাও... এরিনের এইভাবে কাছে আসা... ওর ঠোঁটের ওপরের বাদামী আঁচিলটা...

—“কী হয়েছে ডুনা? এতো রেগে গেছ কেন?” ডুনার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসল এরিন। এই হেডকোয়ার্টার্সে প্রিয়দর্শী ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি যে ডুনাকে ভালোবাসে, আগলে রাখে সে হল এরিন। “তোমরা খুব পচা,” গম্ভীর গলায় বলে উঠল ডুনা, “তোমরা খালি যুদ্ধ করো, ওয়র্ল্ড ওয়ার করো, মারামারি করে সব নষ্ট করে দাও। আমরা কী করে বাঁচব, হ্যাঁ? দেখেছ কী অবস্থা করেছ নেচারের!”

—“ঠিক। একদম ঠিক। কিন্তু সবাই তো ডেমন হয় না, কিছু কিছু অ্যাঞ্জেলও থাকে যারা সবার ভালো করে। তুমি ফেয়ারি টেলসের গল্প শোনোনি?” প্রিয়দর্শীর দিকে একবার তাকিয়ে ওকে কাছে টেনে নিল এরিন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ও তোমাকে ওয়র্ল্ড ওয়ারের গল্প বলছিল বুঝি? আর ওই অ্যাঞ্জেলদের কথা বলেনি! তাহলে বাকিটা আমি বলছি শোনো। পৃথিবীর বেশীর ভাগ মানুষ, বড় বড় দেশের রাষ্ট্রনেতারা যখন যুদ্ধ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তখনও কিন্তু কিছু ভালো মানুষ ছিল, যারা পৃথিবীটাকে বাঁচাতে চাইছিল। কিন্তু তারা তো সংখ্যায় অনেক কম, ক্ষমতাও বেশী নেই... তাই ওদের কথা কেউ শুনলো না। শুরু হল ভয়ঙ্কর যুদ্ধ! তবে ওই ভালো মানুষেরাও চুপ থাকলো না, গোপনে এই পৃথিবীকে বাঁচাবার, মানবজাতিকে বাঁচাবার কাজটা করেই চলল। কারণ তারা জানত যখন যুদ্ধ শেষ হবে, এই পৃথিবী ততদিনে মানুষ-জীবজন্তু-গাছপালার বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। আর হলও তাই। একদিকে গ্লোবাল ওয়র্মিং এর মারণপ্রভাব, অন্যদিকে একের পর এক নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশান... সব সবুজ মুছে গিয়ে ধীরে ধীরে ধূসর গ্রহে পরিণত হল পৃথিবী। তখন হাল ধরল সেই ভালোমানুষেরা। জানো ওরা কী কী করল? পৃথিবীর যে প্রান্তে যতটুকু জীবিত প্রাণী ছিল, তাদের উদ্ধার করল। যতটুকু জল মেলে, তাকে পরিশ্রুত করার চেষ্টা করল। গাছ লাগালো, জমিকে আবার উর্বর করার জন্য হাতে হাত মেলাল। এই যে দেখছ না সামনে ওই বিশাল বড় ওয়াটার রিজার্ভারটা?” জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দেখাল এরিন, “ওটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিষ্টি জলের লেক, বৈকাল লেক। ওই যে ভালোমানুষের দলটা, ওরা এইরকম ভাবে পৃথিবীর নানা প্রান্তের কিছু কিছু জলের উৎসকে বাঁচিয়ে রেখেছে, আর যে কটা মানুষ বেঁচে আছে তারা যেন সমানভাবে জল পায়, জলের অপচয় না করে সেটা দেখছে...”

পায়ে পায়ে জানালার ধারে এসে দাঁড়ালো প্রিয়দর্শী। সত্যি, কতগুলো দিন কেটে গেল। বাড়ি ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল দেশ সেবার জন্য, কিন্তু এমন টালমাটাল অবস্থার মধ্যে যে দুনিয়াটা পড়বে ভাবতেও পারেনি। সাধারণ মানুষ আর কতটুকুই বা জানতে পারে ওপরতলার খবর! ওদের ট্রেনিং শেষ হওয়ার কয়েকবছর পরেই শুরু হল যুদ্ধ। ডাক পড়ল ওদের। যদিও হিউম্যান সোলজার অনেক কমই ছিল, মূলত আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স অর্থাৎ কাস্টমাইজড রোবটরাই লড়েছিল যুদ্ধে... ওরা ছিল নানারকম কন্ট্রোল ইউনিটে। দিন গড়াতে লাগল, অবস্থা কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকল। মন মানত না প্রিয়দর্শীর। ইচ্ছে হত কোনো এক অসীম শক্তিতে আটকে দেয় সবকিছু, গিয়ে মিনতি জানায় রাষ্ট্রনেতাদের এই যুদ্ধ বন্ধের জন্য... কিন্তু কে শুনবে তার কথা! তখনি হঠাৎ কাকতালীয় ভাবেই যোগাযোগ হয়েছিল জেনারেল জন হোয়্যাইটম্যানের সঙ্গে। ইউনাইটেড নেশানের অন্যতম একজন প্রধান এই মানুষটি যুদ্ধবিরোধী ও পরিবেশরক্ষার বার্তা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তখন। গোপনে দেশ ছাড়ল প্রিয়দর্শী, যোগ দিল ওনার তৈরী এই ‘ইউ এন পিস ফোর্স ফর আ নিউ ওয়র্ল্ড’-এ। সেই শুরু। সেই থেকে প্রতিটা মুহূর্তে পৃথিবীকে বাঁচানোর, মানবজাতিকে বাঁচানোর লক্ষ্যে ব্রতী হয়েছে সে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নিজেদের সামান্য পুঁজি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পরিবেশকে রক্ষা করতে, মানুষের মন থেকে লোভ-লালসা-যুদ্ধমনস্কতা এইসব অন্ধকার দূর করতে। তাদের এই ছোট্ট টীমে যেমন আছেন বৈজ্ঞানিক, সৈনিক, চাষী, ভূতত্ত্ববিদ... তেমনি আছে এরিনের মতো সায়কায়াট্রিস্টও, যার কাজই হল মানুষের মন থেকে সব নেগেটিভিটি সরিয়ে সহজ-সরল পরিবেশবান্ধব করে তোলা। তাও পারছে কই মানুষকে বোঝাতে! কিছু মানুষ এখনো নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য অন্য মানুষকে হত্যার চেষ্টা করছে, জল চুরি করছে! একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল প্রিয়দর্শীর বুক চিরে। দিন পনেরো হল মারা গেলেন চিফ জেনারেল জন। রেডিয়েশানের প্রভাব থেকে তাঁকে বাঁচাতে পারল না প্রিয়দর্শীরা। আর তাঁর অবর্তমানে এখন ওনার প্রিয় শিষ্য হিসেবে ওর কাঁধেই উঠে এসেছে এই পৃথিবীকে আগের মতো গড়ে তোলার পুরো দায়িত্ব। মাঝে মাঝে বড় অসহায় লাগে তার, পারবে সে এক নতুন পৃথিবীর জন্ম দিতে? নাকি সোলার সিস্টেমের বাকি গ্রহগুলোর মতই প্রাণহীন মৃত গ্রহে পরিণত হবে তাদের এই গ্রহ ? মায়ের মুখটা মনে পড়ে। ছোট্টবেলায় মা একটা গান শিখিয়েছিল... কী যেন...?

—“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে!” বেসুরো গলায় প্রিয়দর্শীর ভেতর থেকে কে যেন গুনগুনিয়ে উঠল। আহ্! কতদিন পর বাংলা বলল। মায়ের দেওয়া শিক্ষা, মায়ের দেওয়া সাহসও ছোট্ট থেকে বড় হয়ে যাওয়া টুকাইয়ের ভেতরে এখন ডালপালা মেলে মহীরুহের আকার ধারণ করেছে। মায়ের দেওয়া আরো একটা জিনিস আছে তার কাছে। নিজের ডান হাতের অনামিকাটার দিকে তাকালো প্রিয়দর্শী। এখনো জ্বলজ্বল করছে মায়ের পরিয়ে দেওয়া সেই আংটিটা! নীল সমুদ্রের মতো রঙের এক পাথর বসানো আছে মাঝে, তাতে যেন ছোট্ট ছোট্ট সাদা সুতোর মতো ঢেউ। এত সুন্দর ঘন নীল রং, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ভারি আরাম হয় চোখের... যেন সত্যিই কেউ ঠান্ডা জল দিয়ে মুছিয়ে দিল চোখ-মুখ! পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছে প্রিয়দর্শী, এই পাথর আসলে প্রাচীন ইজিপ্টের এক পাথর, নাম ল্যাপিস লাজুলি। এই নীল রঙের অনেক তাৎপর্য... তখনকার ইজিপ্টের বিখ্যাত নীল নদের প্রতীক এই রং। আবার একদিকে যেমন নীল রং বোঝায় আকাশ ও জলকে, তেমনি আবার পুনর্জন্মেরও প্রতীক এই নীল রং। পুনর্জন্ম অবশ্য বিশ্বাস করে না প্রিয়দর্শী, এই জীবনের কাজ এই জীবনেই শেষ করে যেতে হবে তাকে। কিন্তু আজ অবধি জানতে পারেনি কীভাবে ওই ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ ওঠে আংটির ভেতর! তেমনি জানতে পারেনি মায়ের কাছে কীভাবে এল এই আংটি। গ্রাম ছাড়ার সময় মা আঙুলে পরিয়ে দিয়েছিল আংটিটা। আর কী আশ্চর্য্য, ওটা একদম আঙুলের মাপেই ছিল! মা বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘তুই পারবি টুকাই! তুই পারবি সকলের ভালো করতে।’ সেই থেকে এই আংটিটা যেন সবসময় সাহস যোগায় ওকে, দুর্বল সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি দেয়। ঠোঁট কামড়ে ধরল ইউ এন পিস ফোর্সের চিফ জেনারেল প্রিয়দর্শী মাইতি। না, ভেঙে পড়লে চলবে না! তার শেষ রক্তবিন্দু অব্দি এই কর্মযজ্ঞ এগিয়ে নিয়ে যাবে। পৃথিবীর বুকে আবার শীতল জলের ধারা বইয়ে শস্য শ্যামলা করে তুলবে সে। তাতে পথে যত বাধা-বিপত্তিই আসুক না কেন!

এরিন আর ডুনার বকবকানি এখনো চলছে। হাত পা নেড়ে কী যেন বলছে ডুনা, এরিন গালে হাত দিয়ে শুনছে। কন্ট্রোল প্যানেলে এসে বসল প্রিয়দর্শী। মোট সাতটা ক্ল্যান আছে এখন পৃথিবীর বুকে। ওদেরটা বাদে বাকি ক্ল্যান কম্যান্ডারদের রিপোর্টগুলো চেক করতে হবে। কালকের ক্ল্যান ফোর-এ’র ঘটনাটা হালকা ভাবে নেওয়া ঠিক নয়, এই ধরনের অ্যাটাক এখন বেড়েই চলেছে। এখন তো শুধু মানুষই মানুষের শত্রু নয়, শত্রুদের সংখ্যা এবং রকমফের বেড়েই চলেছে দিনকে দিন। তাদের কাজ তো শুধু পৃথিবীতে পরিবেশ গড়ে তোলা, শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, যুদ্ধবাদী মানুষদের অহিংসার দিকে ফেরানোই নয়... এছাড়াও আরো একটা বড় বিপদের ব্যাপারে তাদের সতর্ক থাকতে হয় সবসময়! এবং সেটাই সবথেকে বেশীর চিন্তার...

পিঁইইক... পিঁইইক... পিঁইইক... প্রিয়দর্শীর সমস্ত মনঃসংযোগ জড়ো হল সামনের ডিজিটাল স্ক্রীনের ডানদিকে একটা বড় অংশ জুড়ে তৈরী হওয়া লাল ঘূর্ণিটার দিকে! বিপদ সঙ্কেত আসছে ক্ল্যান টু-ডি থেকে। মেসেজটা পড়ে বুকের ভেতর একটা হার্টবিট মিস হল প্রিয়দর্শীর! কি আশ্চর্য্য, এক্ষুণি ভাবছিল আর এক্ষুণি এমন একটা খবর এল! এক লাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো প্রিয়দর্শী, নিজের পাঁচটা স্টার লাগানো টুপিটা মাথায় লাগিয়ে দ্রুত পায়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, “রিলিজ দ্য আলফাবটস্, এরিন!”

স্ক্রীনের ওপর তখন ব্লিংক করছে কয়েকটা লাইন... “এক্সটারনাল অ্যাটাক! ইটস টাইপ-এ। নিড হেল্প আর্জেন্টলি।”

(৮)

এতক্ষণে সবুজের দেখা মিলল। হাতি, ঘোড়া, পাল্কী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে মহারাজের শোভাযাত্রা কিছু আগেই সীমান্ত পেরিয়েছে। হাতির পিঠের ওপর রঙিন রেশম দিয়ে বানানো রাজকীয় হাওদা থেকে এক ঝলক বাইরে তাকালেন মহারাজ। দুই পাশে বিস্তীর্ণ ঘন সবুজ ভূমি সোনালী রোদ মেখে ঝকঝক করছে... ওপরে চাঁদোয়ার মতো ঝুলে আছে গাঢ় নীল আকাশ। আহ্! মনটা প্রসন্ন হয়ে এল তাঁর। এতক্ষণ যাত্রাপথে শুধু কালো আর লাল রঙের একঘেয়ে দৃশ্যপট বদলে এ যেন এক নতুন পথের শুরু। অবশ্য এই একের পর এক ঝলসে কালো হয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি, গাছপালা, জীবজন্তু অথবা লাল রক্তের স্রোতের মধ্যে পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন মানুষ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টুকরো দেহাংশ... সবই তাঁর বিজয়ের সাক্ষ্য বহন করছে! জয়ী! জয়ী তিনি আজ! গর্বিত মুখখানি ঝলমল করে উঠল মহারাজের। এতদিনে পূরণ হল তাঁর সেই আজন্ম লালিত স্বপ্ন! ইতিহাসের পাতায় চিরকালের জন্য স্বর্ণাক্ষরে খোদাই থাকবে তাঁর নাম।

পথের একপাশে ফুটে আছে অপূর্ব সুন্দর নাম না জানা কিছু ফুল। কী তার রঙের বাহার! সেই নরম গোলাপী আভার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাঁর মনের আয়নায় ভেসে উঠল কারুবাকির মুখখানি। তাঁর প্রেয়সী! কতদিন তিনি দেখেননি তাঁর প্রিয়তমাকে! তাই বুঝি আকাশে আজ এত আলো! আজ যে তিনি আবার কাছ পাবেন তাঁর ভালোবাসাকে। এতদিনের অপেক্ষার অবসান হল। যুদ্ধ শেষে তাই কিছু দক্ষ সেনাবাহিনী ও প্রধান অমাত্যকে মোতায়ন করেই নিজস্ব অনুচরদের নিয়ে তিনি রওনা দিয়েছেন পাটলিপুত্রের প্রাসাদের উদ্দেশে। নিজের মুখে যুদ্ধ জয়ের খবর শোনাবেন তিনি! চোখ বন্ধ করে তাকিয়ায় হেলান দিলেন মহারাজ। পুরোনো দিনের স্মৃতি আচ্ছন্ন করছে মনকে। কারুবাকির সঙ্গে সেই প্রথম সাক্ষাৎ! আজও যতবার গিয়ে দাঁড়ান তাঁর প্রধান মহিষীর সামনে, সেই একই রকম রোমাঞ্চ আর মুগ্ধতা জড়িয়ে ধরে তাঁকে। তখনও তিনি রাজসিংহাসনে আরোহণ করেননি, উজ্জয়িনী ও তক্ষশীলার উপরাজা হিসেবে নিযুক্ত। এক ঘোর অন্ধকার রাত্রিতে উজ্জয়িনী থেকে সংগৃহীত রাজস্ব সমেত অনুগত চরদের নিয়ে পাটলিপুত্রের উদ্দেশে যাত্রা করছিলেন তিনি। বিদিশা অতিক্রম করার সময় পথে পড়ল প্রকাণ্ড এক ঘন জঙ্গল এবং প্রকৃতির এমনই লীলা যে সেই জনবসতিহীন প্রান্তরের মধ্যেই শুরু হল প্রবল ঝড়-বৃষ্টির তাণ্ডব! প্রবল বাতাসের বেগ, সঙ্গে আকাশ ভেঙে পড়া বৃষ্টি দিশেহারা করে দিল ঘোড়াগুলিকে। প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দে লাগাম ছেড়ে পাগলের মতো দৌড়ে পালাতে লাগল তারা। সে ভয়ঙ্কর ঝঞ্ঝায় প্রাণরক্ষার তাগিদে কোনোমতে গিয়ে পৌঁছলেন জঙ্গল সীমান্তে এক অট্টালিকার দ্বারে। সে অট্টালিকা ছিল এক ধনবান শ্রেষ্ঠীর। মহারাজ ও তাঁর সঙ্গী সাথীদের সেবা করার সুযোগ পেয়ে সে যেন ধন্য হল। আন্তরিক আতিথেয়তায় আহার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করল সে। সে রাত কেটে সকাল এল। আজও মনে আছে তাঁর, ঘুম ভেঙেছিল এক মধুর কণ্ঠের সঙ্গীতে। প্রভাতের নবীন সূর্যের কোমল ছটা যেভাবে কালো চাদর বিদীর্ণ করে নেমে আসে পৃথিবীর বুকে, ঠিক তেমন করেই তাঁর সামনে এসেছিলেন কারুবাকি। সদ্য ঘুমভাঙা চোখে বাতায়নের বাইরে তাকাতেই মহারাজ দেখেছিলেন তাঁর সেই রূপ। এক অপূর্ব সুন্দরী নারী আপনমনে গুনগুন করতে করতে বেড়াচ্ছিল সামনের উদ্যানে, চাঁপার কলির মত আঙুল দিয়ে আদর করছিল ফুলগুলিকে। তার স্নিগ্ধ দীঘল দুই চোখ যেন কী এক শীতল পরশ বুলিয়ে দিয়েছিল তাঁর অন্তরে। মনে হয়েছিল পৃথিবীর সমস্ত শান্তির খোঁজ রাখে এই নারী! শুধু রূপই নয়, সেই কন্যার ধর্মপ্রাণ দয়ালু হৃদয়খানি অনেক বেশী আকৃষ্ট করল তাঁকে... জড়িয়ে ফেলল এক অমোঘ আকর্ষণে। তিনি শ্রেষ্ঠীকে জানালেন তাঁর মনের কথা... অতঃপর শুভক্ষণে বিবাহ করলেন সেই শ্রেষ্ঠীকন্যাকে। তাঁর কারুবাকিকে।

কীসের যেন কোলাহল শোনা গেল! ভ্রুকূটি করে উঠে বসলেন মহারাজ। এতক্ষণ পথের দুপাশে শৃঙ্খলাবদ্ধ কৌতূহলী জনতার ভিড় ছিল বটে, কিন্তু এভাবে তাঁর যাত্রাপথে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সাহস পায় কে? খানিক দূরেই জটলা দেখা যাচ্ছে। কারা যেন কাঁদছে উচ্চঃস্বরে! মাহুতকে থামানোর নির্দেশ দিলেন মহারাজ। কারা এমন অভব্য, যে যুদ্ধে জয়ী রাজাকে স্বাগত করার বদলে কোলাহল আর হাহাকারের পরিবেশ তৈরী করছে? পাশের নীচু আসনের দিকে তাকালেন, “এ কীসের কোলাহল সুভদ্র?” সচকিত হয়ে উঠেছে সুভদ্র, অভিবাদন জানিয়ে বলে উঠল, “এখনি খবর আনছি মহারাজ।” তারপর হাতি থেকে নেমে কয়েকজন সৈন্য সমেত এগিয়ে গেল। ফিরে এল কিছু সময় পরেই। “মহারাজ, মহানদীর জলে বিষ মেশানোর ফলে আশেপাশের সব শাখানদী গুলিতেও সেই বিষ ছড়িয়ে গেছিল, আর এখানকার স্থানীয় কিছু মানুষ সেই জল পান করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, কিছু জনের অবস্থা সঙ্কটজনক। এ তাদেরই পরিজনদের বিলাপ!” জোড়হাতে জানাল সে। বিরক্তিতে কপালের ভাঁজ গভীর হল মহারাজের। গত এক বৎসর প্রাসাদের বিলাসব্যসন ছেড়ে রণক্ষেত্রে কাটালেন তিনি, কত পরিশ্রম করলেন... আর তাঁর জয়ের জন্য সামান্য প্রাণ দিতে পারছে না তাঁর প্রজারা! বারংবার নদীতে বিষ না মেশালে কিছুতেই দমন করা যেত না ওই বিদ্রোহী জনতাদের, তো তাদের সঙ্গে যদি সীমানার এ পারের কয়েকজন সাধারণ মানুষকে মরে তাতে এত কোলাহলের কী আছে? অধৈর্য্য হয়ে সামনে জনতার ভিড়ের দিকে তাকালেন মহারাজ। ওফ্! এতক্ষণের সুন্দর পরিবেশ, মনের প্রসন্নতা যেন মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এখানে সময় নষ্ট করলে যে পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে যাবে! জনতাদের অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন মাহুতকে। গলায় ঝোলানো ঘন্টা নেড়ে আবার পা ফেলেছে রাজহস্তী, সৈন্যরা সরিয়ে দিতে লাগল পথের মানুষকে। তাও এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা কিছু স্বজন হারার দল দুই হাত জড়ো করে সাহায্য ভিক্ষা করতে লাগল মহারাজের হাতির উদ্দেশে। চোখ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন মহারাজ। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে মনের ভেতর। রাজহস্তীর প্রতিটি গর্বিত পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গেই ক্রন্দনরত মানুষের ভিড়টার থেকে ক্রমশ দূরত্ব কমছে তাঁর, একটু একটু করে ঢুকে পড়ছে দৃষ্টি গোচরে... নিজের অজান্তেই তাঁর চোখ চলে গেল পথের পাশে পড়ে থাকা হতভাগ্য মানুষগুলোর দিকে। মাটিতে আছাড় খেয়ে বুক চাপড়াচ্ছে কিছু ধূলিমলিন মানুষ... এদিকে ওদিতে ছড়িয়ে দুই-তিনটি দেহ, কাতরাচ্ছে আরো ক’জন... শরীরের মধ্যে এক অজানা চোরাস্রোত বয়ে গেল মহারাজের! ওই যে দূরে ধূলার ওপর পড়ে আছে এক মৃত রমণী, তার পাশে বসে মায়ের আঁচলখানি মুঠিতে নিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে উলঙ্গ শিশুটি... সে দৃশ্য দেখে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে কেন তাঁর? তিনি মহান বীর, স্বয়ং ভারতসম্রাট... এই পরিবার খোয়ানো মানুষদের বুকফাটা হাহাকার কেন বারবার প্রবল আঘাত করছে তাঁর অন্তঃস্থলে! নাহ্, সামান্য কিছু প্রজার এই ক্রন্দনে দুর্বল হওয়া মানায় না তাঁর। কিন্তু বুকের ভেতর একটা বিষনদী যেন তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে, জ্বালিয়ে দিচ্ছে সবকিছু! চোখ সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে দৃষ্টি আটকে গেল তাঁর। কে এই লোকটা? কেমন যেন চেনা লাগছে! আগে কোথায় দেখেছেন? মাটিতে বসে হাহাকার করতে করতে মাথা চাপড়াচ্ছে সে... তার চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে বুক... কে শুয়ে আছে তার কোলে? মুখটির দিকে তাকাতেই শরীরের মধ্যে প্রচণ্ড জোরে যেন আছড়ে পড়ল একটা জলপ্রপাত! আমূল কেঁপে উঠলেন মহারাজ। কানের কাছে যেন বেজে উঠল একটা কচি রিনরিনে স্বর... “তোমরা যুদ্ধ করে কী কর? সব্বাইকে মেরে ফেল, না?”

পিতার কোলে শায়িত পুরন্দর তখন অচৈতন্য, মুখের এক পাশ দিয়ে শুভ্র ফেনায়িত তরল পিতার চোখের জলের সঙ্গে মিশে যেতে যেতে ভিজিয়ে দিচ্ছে মাটি।

(৯)

“ফিফটিনাইন ডিগ্রী নর্থ, নাইন ডিগ্রী ইস্ট,” স্বয়ংক্রিয় যানের সামনে সাজানো কন্ট্রোল সিস্টেমে গম্ভীর গলায় নির্দেশ দিল এরিন। নির্দেশ পাওয়া মাত্র দৈত্যাকার যান সচল, অ্যাম্ফিক্র্যাফ্টের দুপাশ থেকে পাতলা দুটো পাত বেরিয়ে এল। এই অ্যাম্ফিক্র্যাফ্ট অর্থাৎ উভচর যান কোনো জায়গার অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ জানামাত্রই নিজে থেকে স্থির করে নেয় তার যাত্রাপথ... জল, স্থল নাকি আকাশপথ কীভাবে গেলে যাত্রীরা সবথেকে দ্রুতবেগে সুরক্ষিত অবস্থায় গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। আপাতত একটা হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে তিরিশ জন আলফাবটস্, কয়েকজন টেকনিশিয়ান ও প্রিয়দর্শী সমেত উড়ান দিল বিশাল অ্যাম্ফিক্রাফ্ট।

কপাল থেকে গভীর ভাঁজটা কিছুতেই যাচ্ছিল না প্রিয়দর্শীর। এই আলফাবটস্ হল পিস ফোর্সের একটা অন্যতম সিক্রেট আর্মি, হেডকোয়াটার্সের খুব কম লোকই জানে এদের বিষয়ে। আদতে অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত ও মগজে শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার ভরা এই রোবোটের দল আক্ষরিক অর্থেই এক একটি দৈত্য! এরা পারে না এমন কোনো কাজ নেই। যেকোনো জীবিত প্রাণীকে মুহূর্তের মধ্যে ধুলোর বাষ্পে পরিণত করাই হোক বা পৃথিবীর ও পৃথিবীর বাইরের কোনো ভয়ঙ্কর শক্তির মোকাবিলা... সুনিপুণ ভাবে কম্যান্ডারের প্রতিটা আদেশ পালন করাই এদের কাজ। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি যে এই বিশেষ সৈন্য দলকে আসরে নামাতে হবে, ভাবেনি প্রিয়দর্শী। বিপদ বাড়ছে পৃথিবীর!

অ্যাম্ফিক্র্যাফ্ট মেঘের ওপর উঠতে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল প্রিয়দর্শী। গতকালের ক্ল্যান ফোর-এ আর আজকের ঘটনাটা ধরলে এই ছমাসে তিন বার ভিনগ্রহীদের অ্যাটাক হয়ে গেল পৃথিবীর ওপর! গতকালের দলটা ছোটোখাটো এবং মানুষের থেকে কম শক্তিধর হওয়ার জন্য নাকুশির নেতৃত্বে তাদের কবজা করে ফেলা গেলেও আজ ক্ল্যান টু-ডিতে আক্রমণকারীরা একদম টাইপ-এ! মানে এযাবৎ শনাক্তকৃত এলিয়েনদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী। ছমাস আগেও পৃথিবীর এক প্রান্তে হানা দিয়েছিল এই টাইপ-এ এলিয়েনরা, সে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা ভাবলে এখনও শিউরে ওঠে প্রিয়দর্শী। বহু সংঘর্ষের পর যদিও শেষমেশ আটকানো গেছিলো সে ভিনগ্রহীদের, কিন্তু মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পিস ফোর্সের যোদ্ধা রোবোটদের পুরো ইউনিট, প্রাণ গেছিল বেশ কিছু মানুষের। সেই ঘটনার পরই জেনারেল জন হোয়্যাইটম্যান তৈরী করেন বৈজ্ঞানিক আর ইঞ্জিনিয়ারদের বিশেষ দল, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জন্ম নিয়েছে সাধারণ রোবোটদের থেকে প্রায় একশোগুণ শক্তিশালী এই আলফাবটসরা! এই প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে নামানো হবে এই বিশেষ রোবটদের, কিন্তু পরীক্ষাগারে যতটা দক্ষতা এরা দেখিয়েছে কার্যক্ষেত্রে কী ততটা...”

—“হাউ স্ট্রেঞ্জ! চায়টা কী এরা?” চুল গুলো মাথার ওপর চুড়ো করে বাঁধতে বাঁধতে সামনে এসে বসল এরিন।

—“কোনো আপডেট পেলে?” বিচলিত হয়ে বলে উঠল প্রিয়দর্শী। দ্রুত পায়ে রিসিভারের দিকে যেতে যেতে আশঙ্কিত গলায় বলল, “কী সিচুয়েশান ওখানে?”

—“আরে বোসো বোসো!” ওর হাত ধরে টেনে বসালো এরিন। তারপর চিন্তামগ্ন সুরে বলল, “আমি এক্ষুণি ওদের মেসেজ রিসিভ করলাম। আর মেসেজে যেটা দেখলাম সেটাতেই তো অবাক লাগছে আমার।”

দমবন্ধ হয়ে এল প্রিয়দর্শীর। আর কি পৃথিবীর ধ্বংস হওয়া আটকানো গেল না তবে! বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত এই গ্রহকে যখন আবার নতুন করে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টায় নেমেছে হোয়াইটম্যানের দল, তখনি সমস্ত সমস্যার উর্ধ্বে যে অকল্পনীয় ভয়ঙ্কর বিপদের খাঁড়াটা নেমে আসছে পৃথিবীর ওপর সেটা প্রথম বুঝতে পারে তারা। এতদিন মানবজাতির রাজত্বে যে সুযোগটা পায়নি শত্রুরা, আজ মানুষের নিজের মূর্খামির জন্যই খুলে গেল সেই সুযোগের দরজা! ভিনগ্রহ থেকে আসা জীবরা দলে দলে আঘাত হানতে লাগল পৃথিবীর বুকে, দখল করতে চাইল এই গ্রহকে। শুধু তাই নয়, এতদিন পৃথিবীর বুকে যাদের অস্তিত্ব ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি মানুষেরা, সেই সমস্ত আত্মগোপন করে থাকা ভিনগ্রহীরা এবার বেরিয়ে আসতে লাগল মাটির তলা, সমুদ্রের নীচ থেকে! সভ্যতার ইতিহাসে বহুযুগ ধরেই বার বার এই পৃথিবীতে এসেছে ভিনগ্রহীরা, কিন্তু মানুষদের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে কেউ ফিরে গেছে, কেউ লুকিয়েছে পৃথিবীরই বিভিন্ন প্রান্তে... মানবজাতি দুর্বল হয়ে পড়ার চরম মুহূর্তে এবার তারা প্রকাশ্যে আসতে থাকল স্বমহিমায়! সেই থেকে এই এলিয়েনদের বিরুদ্ধে লড়েই চলেছে প্রিয়দর্শীরা। আর এই ভিনগ্রহীদের প্রধান লক্ষ্য হল জলের উৎসগুলো... কারণ যুদ্ধপরবর্তী পৃথিবীতে পানীয় জলের যে সামান্য সঞ্চয়টুকু আছে সেটাকে কবজা করতে পারলেই যে মানুষের দল মারা পড়বে তা বুঝে গেছে এরা। যেমন আজ যে এলিয়েন অ্যাটাকের খবরটা এল, সেটা বর্তমানে অন্যতম বড় একটা পরিস্রুত জলের ভান্ডার... নরওয়ের ফেরিস লেক এলাকা।

—“ক্ল্যান কম্যান্ডার এক্ষুণি রিপোর্ট করল। ফেরিসের পাশে একটা পুরোনো ভাঙা ওয়ারশেল্টারটা আছে না? এনার্জি সোর্সটাকে এখন ওখানেই ডিটেক্ট করা যাচ্ছে। কিন্তু... আশ্চর্য্যজনক ভাবে... ওরা এখনো পর্যন্ত্য কোনো স্ট্রাইক করেনি!” বিহ্বল গলায় বলে উঠল এরিন।

—“মানে? সো আনইউসুয়াল!” ভুরু কুঁচকে বলল প্রিয়দর্শী, “ছ’মাস আগের যুদ্ধটায় তো ওরা শুরু থেকেই অ্যাটাক করছিল। তবে এটা কি সেই টীমটা নয়? সামথিং ফ্রম অ্যানাদার প্ল্যানেট?”

—“থিঙ্ক সো!” গম্ভীর গলায় উত্তর এল। হিউম্যান সাইকোলজি পেশা হলেও এলিয়েনদের ওপর রিসার্চ করা টীমের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল এরিন, সেই প্রথম বার ভিনগ্রহী জীবদের মুখোমুখি হওয়ার পর থেকেই। এই বিষয়ে অগাধ জ্ঞান ও উৎসাহ তার। ভারিক্কি গলায় বলে চলল, “ইউ নো দ্যাট টাইপ-এ! সাচ আ পিকিউলিয়ার থিং! ঠিক আলোর মতোই এমন একটা এনার্জি-পার্টিকল ডুয়ালিটি আছে এদের, তাই নিজেদের এনার্জিটাকে কখন কোন বস্তুতে রূপান্তরিত করবে বলা মুশকিল। সেটা কোনো জীবন্ত প্রাণীও হতে পারে, অথবা ঘাস-নুড়ি-কাঠ এমন কোনো জড় পদার্থও! এখন হয়ত ওই ভাঙা বাড়িটার ভেতর ইট-সিমেন্টের ফর্মেই আছে ওরা! তোমার মনে আছে, আগের বার ওরা আমাদেরই সোলজারের ছদ্মবেশে আর্মির ভেতর ঢুকে পড়ে সেমসাইড করেছিল?”

—“হুম,” দাঁতে নখ কাটতে কাটতে বলল প্রিয়দর্শী। ছ'হাজার কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় উড়ে এসে অ্যাম্ফিক্র্যাফ্ট এখন আস্তে আস্তে নীচের দিকে নামছে, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ভূভাগের ছবি। ওই তো দেখা যাচ্ছে ফেরিস লেক! কোথাও কোনো অস্বাভাবিকত্ব নেই। “যে পরিমাণ হাই এনার্জি ডিটেক্ট করেছিল আই-আর স্ক্যানার, তাতে তো এই এলাকা জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাওয়ার কথা!” অন্যমনস্ক গলায় নীচের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠল, “আশ্চর্য্য! স্ট্র্যাটেজিটা ঠিক কী ওদের?”

(১০)

অন্দরমহলের শেষপ্রান্তের ঝরোকার দিকে দৌড়ে গেল কৃতিকা, আলতো হাতে পর্দা সরালো। ওই দেখা যাচ্ছে বিপুলদেহ হস্তীরাজ, এই প্রাসাদের হাতিশালার সবথেকে বড় হাতি... যা মহারাজের বাহন! সামনে পেছনে সুশৃঙ্খল ভাবে এগিয়ে চলেছে পদাতিক সৈন্য, পাল্কীর সারি... পাশে পাশে মহারাজের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে এগোচ্ছে সাধারণ জনতা, পুষ্পবৃষ্টি করছে দাস-দাসীরা। মহারাজ তবে এসে গেলেন? ঠোঁটে ঠোঁট চেপে এক পাশে সরে এল কৃতিকা, আনন্দে তার মুখ ঝলমল করছে! আজ মহারাণীকে চমকে দেবে সে! গত রাত্রেই দ্রুতগামী অশ্বে মহারাজের দূত খবর নিয়ে এসেছিল, যুদ্ধ শেষে পাটলিপুত্রের প্রাসাদের বদলে সাঁচীর এই উদ্যান বাটিকায় আসছেন মহারাজ বিশেষ দরকারে। অমনি মনটা নেচে উঠছিল কৃতিকার! ক’দিন ধরে মন মেজাজ একেবারেই ভালো নেই রাণীমার, কী এক অজানা কারণে অষ্টপ্রহর মনমরা হয়ে রয়েছেন... আহার-নিদ্রা সবই সারছেন কোনোমতে। দিনকয়েক আগে পাটলিপুত্রের প্রাসাদে নিজের পোষা কবুতরটিকে আদর করতে করতে যখন সাঁচীর এই উদ্যানবাটিকায় আসার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন রাণীমা, তখন বিশেষ অবাক হয়নি কৃতিকা। মন খারাপ থাকলেই এখানে আসেন মহারাণী, সুবিস্তৃত এই উদ্যান বড় প্রিয় তাঁর। এ স্থান তাঁর আর মহারাজের বিবাহস্থলও বটে! নিশ্চয়ই মহারাজের কথা মনে পড়ছে তাঁর, তাই অমন পদ্মের কুঁড়ির মত মুখখানি শুকিয়ে রয়েছে। আর দেবাদিদেবের কী অসীম লীলা, আজ এখানেই আসছেন মহারাজ! রাণীমার এখানে আসার খবর রাজামশাই পেয়েছেন কিনা জানে না সে, তবে মহারাজের আগমনের সংবাদ সে দেয়নি রাণীমাকে। আজ হঠাৎ করে যখন রাজামশাইকে দেখবেন রাণীমা, কী খুশিই না হবেন! সেই স্নিগ্ধ সুন্দর হাসিতে ভরে যাবে তাঁর মুখ! সেই উজ্জ্বল মুখখানি দেখে প্রাণ জুড়াবে তারও, রাণীমার মনখারাপ হলে তারও খুব কষ্ট হয় যে।

দ্রুত হাতে মহারাণীর স্নানের জল প্রস্তুত করতে লাগল কৃতিকা। চন্দন বাটা ও গোলাপের পাপড়ির পাত্র টেনে নিল কাছে। আজ রাণীমাকে সুন্দর করে সাজাবে সে। পাপড়িগুলি সুগন্ধী জলে ভাসাতে ভাসাতে ভাবতে থাকল... আচ্ছা, রাজামশাই কি জানেন যে রাণীমা সাঁচীর উদ্যান বিহারে এসেছেন? কিন্তু সেই সুদূর যুদ্ধক্ষেত্রে বসে কীভাবে মহারাজ জানতে পারবেন এ কথা? তবে কি জানেন না? তাহলে কি এমন দরকার পড়ল যে হঠাৎ পাটলিপুত্রে না ফিরে সাঁচীতে আসছেন মহারাজ?

—“অবস্থা খুবই সঙ্কটজনক মহারাজ, তবুও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি,” বলে উদ্যানরক্ষক ও প্রাসাদের কর্মচারীদের হাত নেড়ে নির্দেশ দিতে শুরু করলেন আচার্য্য কৌম্য। শুষ্ক মুখে বসে ছিলেন মহারাজ, বিষণ্ণ দৃষ্টি বাতায়নের বাইরে। একটা পুঞ্জীভূত যন্ত্রণা যেন শরীর বেয়ে পাক খেয়ে উঠে আসছে। কী হবে শেষ পর্যন্ত্য? সুস্থ হয়ে উঠবে তো ছেলেটা? নাহলে যে আমৃত্যু নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না তিনি! পায়ে পায়ে উন্মুক্ত দ্বারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সামনে সুশোভিত গোলাপ বাগান, লাল-হলুদ-গোলাপী রঙের বাহারে যেন ঝলমল করছে স্থানটি। সাঁচীর এই প্রাসাদটিকে ঘিরে রেখেছে অনেকগুলি উদ্যান, নানারকম ফুলের শোভা যেমন আছে... তেমনি এখানে পরিচর্যা করা হয় বহুবিধ ঔষধি, প্রাণদায়ী উদ্ভিদেরও। পথের পাশে পড়ে থাকা পুরন্দরকে পরীক্ষা করে যখন আচার্য্য কৌম্য শুষ্ক বদনে উঠে দাঁড়ালেন, পাগলের মতো দৌড়ে গেছিলেন তিনি! কোনো উপায় কি আছে ওকে ফিরিয়ে আনার? রাজবৈদ্য জানিয়েছিলেন, সাঁচীর উদ্যানবাটিকায় এমন এক জীবনদায়ী বিষহর উদ্ভিদ আছে যা দিয়ে হয়ত কাটানো যেতে পারে এই বিষের প্রকোপ, বাঁচানো যেতে পারে রোগীকে। তৎক্ষণাৎ শোভাযাত্রার অভিমুখ পরিবর্তন করার আদেশ দেন তিনি, বাহিনী রওনা দেয় সাঁচীর উদ্দেশে।

উহ্! কী যেন ফুটল হাতে। ডান তর্জনীটা চোখের সামনে আনলেন মহারাজ, একটা ছোট্ট রক্তবিন্দু লেগে আছে! চিন্তা করতে করতে কখন যেন গোলাপ বাগিচায় চলে এসেছেন। লাল গোলাপের কাঁটায় বেরিয়ে আসা রক্তবিন্দুটা আলতো করে পাপড়ির গায়ে ছুঁইয়ে দিলেন মহারাজ। এই সেই গোলাপ বাগান! মহারাজর চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল মধুর এক স্মৃতি... গোলাপের ডালিতে সাজানো এক বিবাহ বাসর, আর তার মধ্যে নববধূর সাজে বসে আছে ফুটন্ত গোলাপের মতোই এক রূপসী কন্যা! আজ তাঁদের এই বিবাহস্থলে এসে যেন আরো বেশী করে মনে পড়ছে তাকে। এই দুঃসময়ে, এই ভারাক্রান্ত মনের বোঝা একা কী করে বইবেন তিনি? তুমি কোথায় কারুবাকি? আজ তোমার আশ্রয়টুকু যে বড় দরকার আমার!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগোতে গিয়ে থমকে গেলেন এক নারীকণ্ঠের ডাকে, “মহারাজ?” ঘুরে দাঁড়িয়ে আশ্চর্য্য হয়ে গেলেন তিনি। তাঁর সামনে অভিবাদনের ভঙ্গিতে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৃতিকা। কী ব্যাপার? রাণীর খাস দাসী এখন এখানে...? “দয়া করে যদি আমার সঙ্গে আসেন...” তাঁর ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠেছে কৃতিকা, এগোতে শুরু করেছে সারিবদ্ধ গাছগুলির পাশ দিয়ে। বিস্মিত পদে তাকে অনুসরণ করলেন মহারাজ। কৃতিকার এরূপ আচরণের কারণ কী ? উচ্ছল পায়ে এগিয়ে চলেছে কৃতিকা, যেন প্রায় ছুটেই চলেছে... দ্রুত পায়ে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে লাগলেন মহারাজও। বাগিচার প্রায় দক্ষিণ প্রান্তে এসে পড়েছেন তাঁরা, ওই তো সামনে দেখা যায় শ্বেতপদ্মের জলাশয়টি। কিন্তু তাঁকে এখানে কেন উপস্থিত করল কৃতিকা ? এ তো তাঁর কারুবাকির প্রিয়স্থান! ভাবতে ভাবতেই সামনের দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে একটা ঢেউ খেলে গেল মহারাজের! কে বসে আছে সরোবরের ধারে? বাঁধ না-মানা ঘন কুন্তল কোমর ছাপিয়ে নেমে এসেছে শুভ্র বসনটির ওপরে... তাঁদের পায়ের শব্দে ঘুরে তাকালো সে। কারুবাকি! মহারাজের হৃদয়ে যেন একই সঙ্গে বিস্ময় ও আনন্দের বান ডাকল। কারুবাকি এখানে? যাঁকে এত করে চাইছিলেন সেই আজ তাঁর সামনে! মুখটি আঁচলে ঢেকে হাসিমুখে সরে গেছে কৃতিকা, অবাক দৃষ্টিতে উঠে দাঁড়িয়েছেন রাণী কারুবাকি। শুধু কি বিস্ময় সে দৃষ্টিতে? নাকি এক অসীম বেদনা লুকিয়ে আছে তাতে? এ নিশ্চয়ই তাঁকে এতদিন কাছ না পাওয়ার যন্ত্রণা! বাতাসে গোলাপের সুবাস, শুধু দুটি ধবধবে সাদা রাজহংস সরোবরে শ্বেতশুভ্র পদ্মগুলির মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে... আর কোত্থাও কেউ নেই। চঞ্চল পদে এগিয়ে গেলেন মহারাজ, পরম আকুতিতে দুই হাতের বাহুডোরে জড়িয়ে ধরলেন তাঁর প্রেয়সীকে, আশ্লেষে চুম্বন করলেন ঠোঁটের উপর বাদামি আঁচিলটি। প্রেমভরা দৃষ্টিতে কারুবাকির মুখখানি নিরীক্ষণ করতে গিয়ে খানিক দমে গেলেন মহারাজ, বেদনার কালো চাদরে এখনও কেন ঢাকা রাণীর মুখ? কেন শোকের সাগরে টলটল করছে মায়াময় চোখদুটি? দুই হাতে তিনি তুলে ধরলেন কারুবাকির মুখমণ্ডল, আবেগমথিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “দেখো! আমি এসেছি! আমি এসেছি তোমার কাছে! তবু ভার কেন তোমার মুখ?”

ধীরে ধীরে চোখ সরিয়ে নিলেন রাণী, অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দূরের দিকে। তোলপাড় চলছিল মহারাজের মনে। দুই হাতে কারুবাকির হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, “জয়ী হয়েছি আমি, জয়ী! পিতা ও পিতামহ যা করতে পারেননি, আমি তা করে দেখিয়েছি! স্বর্গ থেকে আজ তাঁরা আশীর্বাদ করছেন আমার ওপর, আমি নিশ্চিত...”

—“কিয়ং চু বিজয়ে তি?” এক অপার্থিব কণ্ঠে বলে উঠলেন কারুবাকি। কিন্তু এই বিজয় কীসের! থমকে দাঁড়ালেন মহারাজ। এ কী বলছেন রাণী? অভিমানের বাষ্প জমল মহারাজের গলায়, “এত কঠিন এক যুদ্ধে জয়ী হয়েছি আমি, এত দুরূহ এক শৃঙ্গ, তাও তুমি খুশি নও?” তাঁর দিকে তাকালেন রাণী, সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যেন ফালাফালা করে দিল মহারাজের মনের ভেতর সগর্বে দাঁড়ানো বিজয়ধ্বজাকে। “দুরূহ শৃঙ্গ! মানুষের কল্যাণসাধন অধিক দুষ্কর, মহারাজ। যিনি আদি হতে সকলের কল্যাণসাধন করছেন তিনিই দুঃসাধ্যসাধন করেন!” বলে উঠলেন কারুবাকি, “ইমানি আসিনবগামীনি নাম অথ চংডিয়ে নিঠুলিয়ে কোধে মানে ইস্যা!” হাত শিথিল হয়ে এল মহারাজের, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এ কী অনুভূতি হচ্ছে তাঁর! সেই পথের প্রান্তে পড়ে থাকা মৃতপ্রায় প্রজাদের দেখে যেমনটি হয়েছিল, শিশু পুরন্দরের মুমুর্ষু মুখখানি দেখে যে অনুশোচনার জ্বালা ধীরে ধীরে পোড়াচ্ছিল তাঁকে... সেই জ্বালা যেন হঠাৎ আবার আগুন ঝরাচ্ছে! রাণীর কথা গুলোই কি তবে চরম সত্য? চণ্ডতা, নিষ্ঠুরতা, ক্রোধ, মান ও ঈর্ষা অপুণ্যের কারণ? রাজ্য বিজয়ের আড়ালে আসলে পাপ করেছেন তিনি? “তাহলে আমার এই বীরত্ব, যশ, কর্ম... এসব মহৎ নয়?” কিছু অস্ফুট ধ্বনি যেন ছিটকে এল তাঁর গলা দিয়ে... শূন্যদৃষ্টিতে ভূমির দিকে চাইলেন মহারাজ।

ধীরে ধীরে মহারাজের কাঁধে হাত রাখলেন তাঁর বিদূষী প্রিয়তমা। বিষাদপূর্ণ গলায় যেন মন্ত্রোচ্চারণ হল, “মানবের প্রকৃত মহত্ব কীসে হয়, জানেন মহারাজ? সকলের হিতসাধনে, হিংসার পথে নয়। নাস্তি কি কংমতরং সর্বলোক হিতৎপা। সর্বলোকের হিতসাধন অপেক্ষা মহত্তর কর্ম নেই!” দূর থেকে আসা শব্দের মতো ভেসে আসতে লাগল কারুবাকির কান্নাভেজা বিলাপ, “লক্ষাধিক মানুষকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছে, মহারাজ। ঘরছাড়া হয়েছে, আপনার সৈন্যদের হাতে বন্দী হয়েছে আরো লক্ষাধিক মানুষ! নির্বিচারে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে অস্ত্রধারী সেনারা, শিশু-মহিলা-বৃদ্ধ কাউকেই ক্ষমা করেনি তারা! মৃত্যুপুরী এখন সে রাজ্য! এমনকি বিষজলের কারণে মৃত্যুবরণ করেছে আপনার অনুগত নিরপরাধ প্রজারাও! এই কি তবে প্রকৃত বিজয়? যুদ্ধক্ষত্র থেকে আসা সংবাদ প্রতিনিয়ত বিদ্ধ করেছে আমায়। রক্তে লাল হয়ে গেছে দয়া নদী, ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঢেকে ফেলেছে ধৌলি পর্বতমালাকে... এ সংবাদে ওই সাধারণ মানুষগুলোর জন্য প্রতিটা মুহূর্তে কেঁদে উঠেছে আমার প্রাণ। অনুভব করুন মহারাজ, ভাবুন সেই নিরীহ জনতার কথা... এই বর্বর হত্যাকাণ্ড কি আদৌ মহিমান্বিত করবে আপনাকে? এতগুলি মানুষের মৃত্যুর বিচার করবে কে? অহিংসা আর প্রেম দিয়েই মানুষকে কাছে টেনে নেওয়া যায়, শ্রেষ্ঠ শাসক হয়ে ওঠা যায়, মহারাজ। প্রজাদের কল্যাণেই কল্যাণ হয় দেশের, উদারতাই মানুষকে উচ্চাসনে স্থান দেয়... নৃশংসতা নয়। ইয়ং চু মোখ্যমুতে বিজয়ে এ ধংমবিজয়ে। ধর্মবিজয়ই হল মুখ্যবিজয়।”

যেন এক পাহাড় ভাঙছে মহারাজের ভিতর। বিজয়যাত্রার পথে পড়ে থাকা সেই রক্তাক্ত দেহ, ধ্বংস হয় যাওয়া বাড়ি-ঘর, মৃত জননীর পাশে মর্মান্তিক চিৎকার করতে থাকা শিশু... যা তাঁর এই বীরোচিত জয়ের গর্বিত প্রমাণ হিসেবে মনে হয়েছিল, সেই দৃশ্যগুলি যেন তাঁকে ঘিরে ধরে আবর্তিত হতে লাগল চারপাশে! যেন প্রশ্ন করতে লাগল, জবাব চাইতে লাগল মহারাজকে! কেঁপে উঠল তাঁর সারা শরীর। যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করার সময় একবারও কাঁপেনি তাঁর তরবারি, আজ তাদের জন্য এক সমুদ্র কান্না উঠে আসতে লাগল তাঁর বুক থেকে। আর দাঁড়াতে পারলেন না তিনি, কম্পিত দেহে পরাজিত ভগ্নপ্রায় মানুষের মতো ভূমির ওপর হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন ভারতসম্রাট। অনর্গল অশ্রু ধারা তাঁর বুক ভাসিয়ে দিয়ে সিক্ত করতে লাগল ধরনীকে। আত্মগ্লানির বিষদংশন করছে তাঁর সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে। কীভাবে প্রায়শ্চিত্ত হবে এই হিংসার, এই পাপের? হঠাৎ পেছন থেকে একটা নম্র অথচ উদগ্রীব গলা ভেসে এল, “বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা করবেন মহারাজ!”

চঞ্চল পদে এসে দাঁড়িয়েছে কৃতিকা। দ্রুত শ্বাস নিতে নিতে কম্পিত কণ্ঠে বলল, “আচার্য্য কৌম্য আপনাকে স্মরণ করেছেন।”

(১১)

ডানা গুটিয়ে এনেছে অ্যাম্ফিক্র্যাফ্ট, আস্তে আস্তে মাটি ছুঁলো। মাটিতে নেমে কোমরে হাত দিয়ে চারদিকে চোখ বোলাচ্ছিল এরিন। নির্দেশ মতো এনার্জি রেডিয়েশান পয়েন্ট থেকে ২০০ মিটার দূরেই ওদেরকে নামিয়েছে অ্যাম্ফিক্র্যাফ্ট। ওই তো দেখা যাচ্ছে ওয়ার শেল্টারটা! চারদিকে একটা থমথমে ভাব। টু-ডি’র রোবোট আর্মির সঙ্গে কিছু হিউম্যান সোলজারও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এলাকাটায়। মানুষ গুলোর মুখে কী মারাত্মক আতঙ্ক আর বিভ্রান্তি! প্রাণহীন রোবোটগুলো অবশ্য নির্বিকার মুখে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে নির্দেশের অপেক্ষায়। প্রিয়দর্শীকে দেখে শুকনো মুখে এগিয়ে এলেন ক্ল্যান কম্যান্ডার রিয়াজ আলজব্বার, হাত তুলে অভিবাদন জানাতে গিয়ে সামনের দৃশ্যটা দেখে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে থমকে গেলেন!

গং গং গং...!

প্রিয়দর্শীর পেছনে তখন ভারী ধাতব পা ফেলে অ্যাম্ফিক্রাফ্ট এর পেছনের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসছে দানবাকৃতি আলফাবটসরা।

—“নো ট্রেস!” নিজের হাতঘড়ির দিকে এতক্ষণ তাকিয়েছিল এরিন, এবার মুখ তুলে প্রিয়দর্শীর দিকে চিৎকার করে ইশারা করল। গতবারের ঘটনার পর থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন পুরো আর্মিকে দু'বার ইনফ্রা-রেড স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যান করা হয়, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি শক্তির উৎসের সন্ধান পেলেই সঙ্কেত আসতে থাকে। আপাতত স্ক্যানার থেকে এখন একটাই সিগনাল আসছে ওর হাতের মাইক্রো চিপ লাগানো ঘড়িটায়... একটা ছোট্ট লাল আলো, দপদপ করে ম্যাপে দেখাচ্ছে সেই ভাঙা বাড়িটার অবস্থান।

একদৃষ্টে বাড়িটার দিকে তাকিয়েছিল প্রিয়দর্শী। ধীরে ধীরে চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠছে ওর, একটা গম্ভীর ঘড়ঘড়ে আওয়াজ ছিটকে এল গলা থেকে, “লেটস্ ফেস দেম!” নির্দেশ পাওয়া মাত্র পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে এগিয়ে গেল আলফাবটসরা, তাদের অনুসরণ করল বাকি রোবোট সোলজাররা। বিশেষ বর্মের আড়ালে নিজেদের ঢেকে সাবধানে এগোচ্ছিল প্রিয়দর্শী আর এরিন, এমন সময় সামনের দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে থমকে দাঁড়ালো।

—“হোয়াট দ্য হেল ইজ গোইং অন?” হেলমেটটা খুলে ফেলে বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে উঠল প্রিয়দর্শী।

পুরো ওয়ারশেল্টারটাকে তখন ঘিরে ফেলেছে দানব-রোবোটেরা, কিন্তু... এ কী অদ্ভুত ব্যাপার! বাড়িটার পঞ্চাশ মিটারের মধ্যে ঢুকতে গেলেই কী এক অদৃশ্য দেওয়ালে যেন ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে তারা!

চোয়াল ঝুলে গেছে এরিনেরও। বিশাল বিশাল যন্ত্রমানবেরা নিজেদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে ওই অদৃশ্য বাধাটা, কিন্তু কিছুতেই পারছে না! এ কোন শক্তি? যেটা এত শক্তিশালী একটা বলয় তৈরী করেছে যা আটকে দিচ্ছে এই ভয়ঙ্কর আলফাবটসদেরও!

হাতঘড়ির দিকে তাকাল প্রিয়দর্শী। লাল আলো থেমে সেই এক জায়গাতেই। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে, পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে হবে। কিন্তু কী করবে সে? অপেক্ষা করে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে কখন উল্টোদিক থেকে প্রথম আঘাতটা আসে?

—“কী হচ্ছে মাইটি?” বিভ্রান্ত মুখে ওর দিকে এগিয়ে আসছে এরিন, “এটা কী ধরনের ফোর্স? ওই বাড়ির ভেতরে যে এনার্জি সোর্সটা আছে তার এফেক্টেই কি এমনটা হচ্ছে?”

—“আমি...” বিড়বিড় করে বলতে গিয়ে থেমে গেল প্রিয়দর্শী। কে যেন গুনগুন করে তার কানের কাছে কিছু বলছে! না, ঠিক কানের কাছে নয়... যেন মাথার ভেতরে! কে করছে এমন? কী বলার চেষ্টা করছে ? বিহ্বল হয়ে এদিক ওদিক তাকালো। কই, সে আর এরিন বাদে এখানে তো কেউ নেই! কথাগুলো যেন স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে... “টুকাই! টুকাই! এই টুকাই!” থরথর করে আমূল কেঁপে উঠল প্রিয়দর্শী! এ কার গলা শুনল সে! মা এভাবেই ডাকত না? মাথার চুলগুলো খামচে ধরল! চারদিকে যেন অখণ্ড নীরবতা... শুধু ভেসে আসছে মায়ের গলা... “টুকাই... টুকাই...”

“হেই মাইটি!” চিৎকার করে উঠল এরিন। পাগল হয়ে গেল নাকি লোকটা! এক হাতে মাথার রগটা টিপে ধরে তখন ওই বাড়িটার দিকে নেশাগ্রস্তের মতো হাঁটতে শুরু করেছে প্রিয়দর্শী। এগিয়ে চলেছে অসম্ভব গতিতে! দৌড়তে শুরু করল এরিন, যে করেই হোক আটকাতে হবে ওকে। এ তো আত্মহত্যারই সামিল! আলফাবটসদের কাছাকাছি এসে পড়েছে প্রিয়দর্শী, তার পরেই সেই অদৃশ্য দেওয়াল... আর তার পেছনে অপেক্ষা করছে কোন ভয়ঙ্কর জীব কে জানে? প্রচণ্ড বেগে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল এরিন... কিন্তু...

ঠিক যেন একটা মজবুত ইস্পাতের প্রাচীর। বাতাসের বুকে লুকিয়ে থাকা সেই প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ল এরিন। আহহ! অসহ্য যন্ত্রণা সারা শরীরে। কিন্তু ওর কী হল? কোনোমতে মাথা তুলে সামনের দিকে তাকিয়েই পাথর হয়ে গেল এরিন!

তার স্তম্ভিত চোখের সামনে দিয়ে অবলীলাক্রমে সেই অদৃশ্য দেওয়াল ভেদ করে হাঁটতে হাঁটতে বাড়িটার ভেতর ঢুকে গেল প্রিয়দর্শী!

ভেতরটা ধ্বংসস্তূপের মতো। নির্বিচারে বোমা-গুলির আঘাত সহ্য করার চিহ্ন বাড়িটার সারা শরীর জুড়ে। ভেঙে পড়েছে জানালা-দরজার ফ্রেম, একদিকের দেওয়াল পুরো ধসে গেছে। আপনমনে হাঁটছিল প্রিয়দর্শী। বেশ গরম লাগছে, ভারী জ্যাকেটটা খুলে ফেলা দরকার। মাথার ভেতরে শব্দটা এখনো এগিয়ে চলেছে, তাকেই অনুসরণ করছে ও। সামনে যে কোন ভয়াল আতঙ্ক অপেক্ষা করছে তার জন্য কে জানে! কীভাবে ওই অদৃশ্য দেওয়াল পার করে এখানে ঢুকতে পারল, জানে না সে। ওই আওয়াজ যে আসলে তার মায়ের নয়, মায়ের হতে পারে না তা এখন পরিষ্কার তার কাছে। কিন্তু কী যে হচ্ছে তার! কিছুতেই যেন নিজেকে ফেরাতে পারছে না! একটা চুম্বকের মতো অদৃশ্য শক্তি যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলেছে তাকে! আর কি কোনোদিন ফিরতে পারবে সে?

একটা সরু প্যাসেজের পর বাঁক ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রিয়দর্শী। মাথার মধ্যে গলাটা এখন চুপ। তার সামনে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক! ওর পায়ের আওয়াজে ঘুরল লোকটা...

“আঁক!” একটা খনখনে চিৎকার ছিটকে এল প্রিয়দর্শীর গলা দিয়ে! বড় দুর্বল লাগছে শরীরটা... হাঁটু মুড়ে মাটিতে নুয়ে পড়তে পড়তে দেখল তার দিকে তাকিয়ে হাসছে আরেকজন প্রিয়দর্শী মাইতি!

(১২)

—“কী সংবাদ আচার্য্যদেব?” উদ্ভ্রান্তের মতো চিকিৎসালয়ের দ্বারে এসে দাঁড়ালেন মহারাজ, পেছনে রাণী কারুবাকি। রোগীর শয্যার পাশে গম্ভীর মুখে বসে ছিলেন আচার্য্য কৌম্য, মুখ তুলে তাকালেন। এ কী চেহারা হয়েছে মহারাজের! ধূলিধূসরিত রাজপোশাক, শুষ্ক মুখমণ্ডল , অশ্রুবিন্দু জমে আছে চোখের কোলে... দৃষ্টিতে যেন সর্বহারার বেদনা! আশ্চর্য্য! কে এই বালক যার জন্য এতটা ব্যথিত মহারাজ! কিন্তু ছেলেটির অবস্থা তো... “কী হল আচার্য্যদেব?” মহারাজের তীব্র কণ্ঠে সচকিত হয়ে উঠলেন কৌম্য, কম্পিত হাতে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন শয্যায় শায়িত পুরন্দরের দিকে, “রোগীর নাড়ি খুবই ক্ষীণ মহারাজ, কিছু বলতে চায় আপনাকে...”

শয্যার পাশে ছুটে গেলেন মহারাজ। সাঁচী আসার পথে ঘোড়ার গাড়িতে কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান ফিরেছিল পুরন্দরের, শয্যার পাশে বসা মহারাজকে দেখে যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল তার চোখ দুটি... কিন্তু কিছু বলে ওঠার আগেই ফের চৈতন্য হারিয়ে ঢলে পড়ে সে। এখনও কপালের ওপর মহারাজের হাতের স্পর্শ পেয়ে সামান্য ফাঁক করল দুই চোখের পাতা, দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার ঘোলাটে চোখ বেয়ে। বিষের প্রভাবে নীল হয়ে উঠেছে সারা শরীর, অস্বাভাবিক রকম ফুলে উঠেছে মুখমণ্ডল... তার দিকে চেয়ে দরদর করে জল গড়াতে লাগল মহারাজর দুচোখ দিয়ে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাণীর চোখও তখন অশ্রুসিক্ত। উদগ্রীব হয়ে পুরন্দরের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লেন মহারাজ, হাতটা ধরে বলে উঠলেন, “কষ্ট হচ্ছে পুরন্দর? এভাবে চলে যেও না তুমি। একবার অন্তত জিততে দাও আমাকে!” বু বু করে এক দুর্বোধ্য স্বর বেরোলো পুরন্দরের মুখ দিয়ে। “তুমি... তুমি শেষ করলে না সেই গল্পটা? সেই রাজার গল্পটা...” শিশুর মতো ব্যাকুল স্বরে বলে উঠলেন মহারাজ, “সেই রাজা কি পারলো তার প্রজাদের কষ্ট দূর করতে? বলো পুরন্দর...”

—“রাআআ... জাআআ...” একটা ক্ষীণ স্বর যেন সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসছে বহুদূর থেকে... জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে পুরন্দরের, লালা গড়িয়ে পড়ছে মুখের কষ বেয়ে, অতি কষ্টে শ্বাস নিতে নিতে কম্পিত অঙ্গুলিনির্দেশ করল মহারাজের দিকে, “তুউউ... মিইই...”

বলতে বলতে স্তব্ধ হয়ে গেল কণ্ঠস্বর। শয্যার ওপর ঝুলে পড়ল শিথিল আঙ্গুল। শেষ বারের মতো এ জগৎকে দেখে নিয়ে স্থির হয়ে গেল পুরন্দরের দৃষ্টি।

কক্ষের ভেতর শ্মশানের নৈঃশব্দ্য। পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন মহারাজ, তাঁর দৃষ্টি বোধবুদ্ধিহীন মানুষের মতো। অঝোর অশ্রুধারায় ভিজে যেতে লাগল রাণী কারুবাকির গণ্ডদেশ, পুরন্দরের ললাটে আলতো হাত রেখে অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে উঠলেন, “এই তোমার বীরত্ব! এই তোমার বিজয়ের ফলাফল!”

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন ভারতসম্রাট। আজ তিনি নিঃস্ব, রিক্ত। লক্ষ লক্ষ মানুষের হত্যার কারিগর তিনি। খুইয়েছেন প্রজাদের ভালোবাসা, কারুবাকির শ্রদ্ধা। মন্থর পায়ে এগিয়ে চললেন নিজের কক্ষের দিকে। পুরন্দরের মতো নিষ্পাপ শিশুও আজ বিষের জ্বালায় ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল শুধুমাত্র তাঁরই লোভ-লালসার কারণে। এ পাপের উপযুক্ত শাস্তি কী ? কীভাবে হবে এর প্রায়শ্চিত্ত? কীভাবে আবার তিনি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন কারুবাকির সামনে? নিজ কক্ষে প্রবেশ করে দ্বার বন্ধ করলেন মহারাজ। খুলে রাখলেন রাজমুকুট। কী বলে গেল পুরন্দর? তাঁর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে কী বোঝাতে চাইল সে? তিনিই সেই রাজা? যে প্রজাদের মঙ্গলচিন্তা করে তাদের দুঃখ মেটানোর জন্য পাড়ি দিয়েছিল হাজার হাজার মাইল পথ? কিন্তু কীভাবে? তিনি কীভাবে হতে পারেন সেই রাজা! প্রজাদের মঙ্গলের কথা না ভেবে তিনি তো তাদের নৃশংস ভাবে হত্যা করেছেন কেবল! পুরন্দর কি জানে তার মৃত্যুর কারণ আসলে স্বয়ং তিনি! দু'হাতে মুখ ঢেকে বুক ফাটা আর্তনাদ করে উঠলেন মহারাজ। এই দুহাতে লেগে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত! বিবেকদংশনের এই জ্বালা যে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে তাঁকে! এর মুক্তি কোথায়?

শয্যায় লুটিয়ে পড়লেন ভারতসম্রাট। ধীরে ধীরে যেন তলিয়ে যেতে থাকলেন অচেতন নিদ্রার অন্ধকারে। তাঁর মাথার মধ্যে যেন আছড়ে পড়ছে এক বিপুল স্রোত... যেন খুলে দিচ্ছে কোনো নবজীবনের দ্বার! তাঁর অবচেতনের অন্তঃস্থলে বাজতে লাগল কারুবাকির উচ্চারিত শব্দ গুলি... “কল্যাণং অধিক দুকরং হো। য়ো আদিকরো কল্যাণস সো দুকরং করোতি...”

(১৩)

—“উঠুন প্রিয়দর্শী! ক্ষমা করবেন এভাবে আপনাকে আপনার মায়ের গলা শুনিয়ে এখানে আসতে বাধ্য করলাম বলে। এছাড়া কোনো উপায় ছিল না,” মাথার ভেতরে খুবই আন্তরিক গলায় কে যেন বলে উঠল! কে বলল? সামনের লোকটা তো তার দিকে তাকিয়ে হাসছে! লোকটার দিকে আবার তাকাতেই মাথা হেলিয়ে ইশারা করল সে। মাথাটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে প্রিয়দর্শীর। লোকটার মুখ নড়ছে না, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না... অথচ সে বুঝতে পারছে তার মনের ভাব! তবে কি ইথার তরঙ্গ দিয়ে... ? হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল উল্টোদিকের প্রিয়দর্শী। অবিকল যেন আয়নার ওপিঠ! তার মতোই ছ ফুটের ওপর লম্বা, পেটানো চেহারা, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, ছোট করে ছাঁটা চুল... এমনকি ডান ভুরুর নীচের কাটা দাগও! এরাই তবে টাইপ-এ? যারা যে কোনো জিনিসের রূপ ধারণ করতে পারে?

—“ঠিক তাই,” আবার একটা মৃদু শব্দ বেজে উঠল মাথায়। মুখ ঘুরিয়ে নিল প্রিয়দর্শী। এভাবে ওর মতো দেখতে আরেক জন প্রিয়দর্শী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে... অসহ্য লাগছে! কিন্তু এভাবে ওকে ডেকে আনল কেন? কোনো অ্যাটাক তো করছেই না, তার ওপর ওকে যেন কি বার্তা দিতে চাইছে! নিশ্চয়ই অনেক বড় প্ল্যান আছে এদের!

—“আপনার সমস্যাটা বুঝতে পারছি। এবার ঠিক আছে?” একটা তীব্র আলোর ঝলকানি... আর মুহূর্তের মধ্যে প্রিয়দর্শী থেকে এরিনের রূপ ধারণ করল জীবটা। যেন শান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে এরিন। “তবে আপনি যা ভাবছেন তা নয়, আমরা কোনো ক্ষতি করতে আসিনি।”

ক্ষতি করতে আসেনি? তাহলে কী মতলবে এসেছে? ছ’মাস আগেই এই ধরনের জীবেরা এসে কী ধরনের হত্যালীলা চালিয়েছে পৃথিবীর বুকে তা কি ভোলা যায়! এদের ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না কিছুতেই! মুহূর্তের মধ্যে সতর্ক হাতে নিজেকে পরীক্ষা করে নিল প্রিয়দর্শী। জ্যাকেটের ডান পকেটে একটা ছোট লেজার রে গান ছাড়া এই মুহূর্তে নিরস্ত্র সে। কিন্তু এই সামান্য বন্দুক দিয়ে...

—“আপনি ভুল ভাবছেন। আমরা ঠিক আপনাদের মতোই শান্তির দূত। কিন্তু মানুষের মধ্যেও তো যেমন শান্তিপ্রিয় গোষ্ঠী আছে, আবার লোভী স্বার্থপর হিংস্র গোষ্ঠীও আছে... যারা যুদ্ধ করে, পরিবেশকে হত্যা করে পৃথিবীকে এই জায়গায় দাঁড় করিয়েছে? আমাদের মধ্যেও ঠিক তাই। আসলে পুরো কালো বা পুরো সাদা বলে কিছু হয় না প্রিয়দর্শী,” আস্তে আস্তে চোখের বড় বড় পাতাগুলোকে নত করে যেন আশ্বাস দিল এরিন।

উঠে দাঁড়াল প্রিয়দর্শী। কথাগুলো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আসলে কী চায় এরা? কেন এসেছে এই পৃথিবীতে? এতটাই শক্তিশালী এই ভিনগ্রহী যে এই বাড়ির চারপাশে শক্তি বলয় তৈরী করেছে, এমনকি তরঙ্গের সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যে বুঝে নিচ্ছে তার মনের ভাব! এরা কারা! সামনে দাঁড়ানো এরিনের চোখে চোখ রাখল প্রিয়দর্শী।

—“আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি,” সেই অদ্ভুত সুন্দর নীলচে সবুজ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে এরিন, “আপনাদের এই গ্রহ থেকে কয়েকশো আলোকবর্ষ দূরে আমাদের বাস, তবে কোনো গ্রহে নয়... এক মহানক্ষত্রে। আমরা নিজেদের যেকোনো ভর থেকে শক্তিতে, বা শক্তি থেকে ভরে রূপান্তরিত করতে পারি... আর আমাদের এই শক্তির উৎস আমাদের মহানক্ষত্রই!”

নিবিষ্ট মনে শুনছিল প্রিয়দর্শী। মনের মধ্যে আশঙ্কাটা খানিক ফিকে হয়েছে। হয়তো সত্যিই এরা পৃথিবী দখল করতে আসেনি! কিন্তু তাহলে এতখানি পথ পাড়ি দিয়ে এরা কেন এসেছে তাদের এই মৃতপ্রায় গ্রহে? কী আছে এখানে?

—“আমাদের কাছে এটা সামান্যই পথ,” মিষ্টি হেসে একটা ভাঙা দেওয়ালে ঠেস দিল এরিন, “বিষয়টা আপনাদের পক্ষে কিছুটা জটিল, কারণ এ বিষয়ে আপনাদের বিজ্ঞান এখনও অবধি খুব সামান্যই ধারণা করতে পেরেছে... আসল রহস্যের সমাধান আপনাদের হাতের মুঠোয় এখনও আসেনি। তাই আপনার বোঝার মতো করেই বলি। ব্ল্যাক হোল আর হোয়াইট হোল সমন্ধে আপনাদের ধারণা আছে, তাই তো? আমরা সেই ব্ল্যাক হোল এবং হোয়াইট হোলকেই ব্যবহার করি আমাদের যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে। আমরা হাইপারড্রাইভ করি একটা ব্ল্যাক হোলে, এরপর স্পেস জাম্পের মাধ্যমে বেরিয়ে আসি অন্য একটা হোয়াইট হোল দিয়ে। এইভাবেই আলোর থেকেও বেশী গতিতে আমরা খুব কম সময়ে পৌঁছে যাই এই মহাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে।”

আলোর থেকেও বেশী গতিতে! মনের মধ্যে বিস্ময়ের তরঙ্গ খেলে গেল প্রিয়দর্শীর। “হ্যাঁ! আলোর থেকেও বেশী গতি,” যেন হালকা ব্যঙ্গের সুর অপরপ্রান্তে, “কিন্তু তার আবিষ্কার করার মতো জায়গায় পৌঁছনোর আগেই তো গ্রহহারা হতে চলেছেন আপনারা! আগে নিজেদের গ্রহকে বাঁচান! তাছাড়া এই গতির জন্যই তো আমরা মুহূর্তে উপস্থিত হই যে কোনো স্থানে, নাহলে এই বিশাল মহাজাগতিক সাম্রাজ্যের দেখভাল করব কীভাবে?”

—“মহাজাগতিক সাম্রাজ্য! মানে?” এবার চেঁচিয়ে উঠল প্রিয়দর্শী, “তোমরা তবে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে এসেছ পৃথিবীতে?” উত্তেজিত হয়ে খামচে ধরল জ্যাকেটের ভেতরের লেসার গানটা!

ধীরে ধীরে মুখটা কঠিন হয়ে উঠল সামনে দাঁড়ানো এরিনের অবয়বটার, মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। সোজা দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠল, “ইজি মিস্টার প্রিয়দর্শী মাইতি, ইজি! আপনাদের ওই খেলনা পিস্তল আমাদের ওপর কোনো কাজই করবে না। বরং আমি চাইলেই ওই পিস্তলসহ আপনাকে জ্বালিয়ে খাক করে দিতে পারি এক নিমেষে!” এরিনের সবুজ চোখের ভেতর যেন এক ঝলক আগুন দপ করে জ্বলে উঠল, “কিন্তু তা আমি চাই না! কারণ আমরা মহাবিশ্বের রক্ষক... এই মহাবিশ্বের রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। আর এই পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে আপনার মতোই একজনের দরকার। কারণ আপনি একজন ভালো মানুষ প্রিয়দর্শী। তাই আপনাকেই আমরা বেছে নিয়েছি।”

পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রিয়দর্শী। উল্টোদিকের জীবটা বলে চলেছে, “আমরাই হলাম সৃষ্টির আদি... এই মহাবিশ্বের সমস্ত শক্তির উৎস। সময়ের জন্মলগ্নে প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল আমাদের মহানক্ষত্র, যার নাম হয়ত আপনারা কোনোদিন শোনেনওনি, যার অস্তিত্বও আপনাদের অজানা। এরপর আমাদের মহানক্ষত্র থেকেই একে একে জন্ম নেয় এই মহাবিশ্বের বাকি সব নক্ষত্র, গ্রহ... এমনকি আপনাদের সূর্যও! সূর্যের থেকে অন্তত একশোগুণ বড় আমাদের মহানক্ষত্র, আর তার সৃষ্টির সময় থেকেই সৃষ্টি হয়েছে আমাদেরও। আমরা অমর! তাই এই সমস্ত মহাজাগতিক বস্তুর দেখভাল করা, সমতা রক্ষা করার কাজটা আমরাই করি।”

দমবন্ধ হয়ে আসছিল প্রিয়দর্শীর। ছোটোবেলা থেকে ভিনগ্রহী জীবেদের ব্যাপারে নানারকম কল্পনা করে এসেছে, এমনকি গত পনেরো বছর ধরে তাদের মোকাবিলাও করেছে নানাভাবে... টাইপ-এ এলিয়েনদের ক্ষমতা নির্ণয় করার মতো কষ্টসাধ্য কাজও তারা করতে পেরেছে। কিন্তু আজ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই জীবটা যা বলছে তা যে তার কল্পনারও অতীত ছিল.

—“এই মহাবিশ্বে এমন অনেক কিছু আছে যা আপনারা সত্যিই কল্পনা করতে পারবেন না। আপনারা তো একসময় এও ভাবতেন যে পৃথিবী ছাড়া অন্য কোনো গ্রহে প্রাণের কোনো অস্তিত্ব নেই!” হা হা করে হেসে উঠল এরিন, “আজকের এই উন্নত সভ্যতায় পৌঁছতে আপনাদের যত সময় লেগেছে, তার এক চতুর্থাংশেরও কম সময়ে এর থেকে বেশী উন্নত হয়ে উঠেছে বহু গ্রহের প্রাণীরা! আমরা জানি, কারণ আমরা মহাবিশ্বের সমস্ত গ্রহদের নজরদারী করি। সেদিক দিয়ে আপনাদের এই পৃথিবী বরং যথেষ্ট পিছিয়ে আছে, কারণ এই গ্রহের সবচেয়ে উন্নত জীবেরাও এতটাই বোকা যে তারা নিজেরাই নিজেদের গ্রহকে ধ্বংস করছে!” আবার একটা ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠল এরিনের মুখে। প্রিয়দর্শীকে কিছু ভাবার সময় না দিয়েই মাথার মধ্যে ধাক্কা মারতে শুরু করল আবার কিছু কথা, “তবে আমাদের মহানক্ষত্রেও কিছু হিংস্র জীবেরা আছে, যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, মৃতপ্রায় গ্রহের অধিবাসীদের হত্যা করে সেখানকার দখল নিতে চায়। তেমনি একটা গোষ্ঠী এসেছিল কিছুদিন আগে আপনাদের এই পৃথিবীতে। কিন্তু আপনাদের ভাগ্য খুব ভালো ছিল! সেইসময় আমাদের একটি প্রতিনিধি দল এই গ্রহে এসেছিল গ্রহের পরিবেশ-জীবজগৎ নিরীক্ষণ করতে। তারা এসে আমাদেরই জাতির ওই হিংস্র গোষ্ঠীকে আটকায়, নাহলে এই গ্রহের ধ্বংস হওয়া কেউ আটকাতে পারত না!”

মুহূর্তের মধ্যে মনের মধ্যে একটা ঘটনা ভুস করে ভেসে উঠল প্রিয়দর্শীর! ঠিকই তো! আগেরবারের ওই টাইপ-এ’রা যেরকম প্রবল আগ্রাসনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সামাল দিতে দিতে যেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছিল তাদের। মনে হয়েছিল আর তারা পেরে উঠবে না এই অসম যুদ্ধে। কিন্তু খুব অদ্ভুত ভাবেই যেন হঠাৎ থেমে গিয়েছিল সেই অজানা জীবের তাণ্ডবলীলা! তাদের আর কোনোভাবে ট্রেস করা যায়নি...

—“কিন্তু আমাদের সেই প্রতিনিধিরা একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করল,” প্রিয়দর্শীর মনের ভাবকে পাত্তা না দিয়ে বলে চলল এরিনরূপী সেই জীব, “শেষবার যখন তারা পৃথিবী পরিদর্শন করে গেছে প্রায় হাজার খানেক বছর আগে, তখনকার পরিবেশ পরিস্থিতির তুলনায় বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর! অস্তিত্বের প্রায় শেষ কিনারায় আছে এই গ্রহ! গ্রহের মোট জীবের সংখ্যা অতীতের প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ হয়ে গেছে, বাস্তুতন্ত্র বলে তো প্রায় কিছুই নেই! সব মিলিয়ে এখানকার প্রাণীদের বসবাসের পক্ষে একেবারেই অযোগ্য হয়ে উঠেছে এই গ্রহ। তখন তারা সময়ের সরণি বেয়ে ঘুরে দেখল ঠিক কীভাবে এই গ্রহের সবচেয়ে উন্নত জীব, যাদের ‘মানুষ’ বলে... তারা কীভাবে যুদ্ধ, দূষণ ইত্যাদির মাধ্যমে নষ্ট করেছে এই বাস্তুতন্ত্র! হ্যাঁ, আমাদের আরো একটা ক্ষমতা হল আমরা বর্তমান সময় থেকে অতীতে যেতে পারি,” জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে এরিন।

মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়দর্শী। সামনে দাঁড়ানো এই ভিনগ্রহীর একটা কথাও তো মিথ্যে নয়! কিন্তু সে, তাদের টীম তো চেষ্টা করছে ভুলগুলো শোধরানোর...

—“ঠিক বলেছেন প্রিয়দর্শী। মানুষই পারে তার ভুলগুলো শোধরাতে। মানুষই পারে তাদের গ্রহকে আগের মতো পুনরুজ্জীবিত করতে। আমরা শুধু তাকে সাহায্য করতে পারি, এর বেশী কিছু নয়। আর তাই তো এই গ্রহের স্বার্থেই আমরা খোঁজ করছিলাম একজন যোগ্য ব্যক্তিকে যে চেষ্টা করলে হয়ত পাল্টে দিতে পারে এই গ্রহের ভবিষ্যৎ। মানুষে মানুষে হানাহানি, দলাদলি এইসব সরিয়ে দিয়ে সবাইকে অহিংসার পাঠ পড়াতে পারে, পরিবেশকে ভালোবাসতে শেখাতে পারে। সে কারণে আমরা পাঠালাম আমাদেরই একজনকে যে খোঁজ করে জানাবে এখন পৃথিবীর বুকে এমন একজন মানুষও আছে কিনা, যে নিঃস্বার্থভাবে শুধু মানবজাতির কল্যাণই চাইবে! আর তাই আজ আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে!”

বুকের ভেতরটা ঢিপ করে উঠল প্রিয়দর্শীর। ওদের একজন মানে? এই ভিনগ্রহী জীবদের কেউ পৃথিবীর বুকে এতদিন লুকিয়ে আছে? কে সে?

—“আপনারা আমাদের অস্তিত্ব জানার জন্য কি এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন না? তো সেই যন্ত্র কখনো নিজের শোওয়ার ঘরের মধ্যে ব্যবহার করেছেন?” মজার সুরে যেন কথা গুলো ভেসে এল। শিরদাঁড়া দিয়ে একটা কনকনে স্রোত নেমে গেল প্রিয়দর্শীর। কী বলতে চাইছে ও ? ওর বেডরুমে... কার কথা বলছে...

এরিনের চোখের দিকে তাকাতে তাকাতে নিজের অজান্তেই শিউরে উঠল প্রিয়দর্শী! একটা আলোর ঝলকানির মধ্যে দিয়ে পাল্টে যাচ্ছে ওই চোখ! পাল্টে যাচ্ছে নরম সিল্কের মতো সোনালী চুল... তার জায়গায় দল বেঁধে জড়ো হয়েছে কালো কুচকুচে কোঁকড়ানো চুলের গোছা, ঝাঁপিয়ে পড়ছে একটা চ্যাপ্টা বাদামী নাকের ওপরে... ছোট হয়ে আসছে এরিন... এখন ওর জায়গায় কে দাঁড়িয়ে ওটা?

দু'চোখ উপছে বেয়ে আসা নোনতা জল ভাসিয়ে দিল প্রিয়দর্শীর গাল। কোনোমতে অবরুদ্ধ গলার বিড়বিড়ানি ছিটকে এল... “ডুনা!” তার আদরের ছোট্ট ডুনা... তার প্রাণের প্রিয় মেয়েটা আসলে মানুষ নয়!

শুকনো মুখে তখন তার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে একরত্তি মেয়েটা। মাথার ভেতর বাজতে থাকা আওয়াজটাও যেন বন্ধ হয়ে গেছে হঠাৎ। গলার কাছে একটা পাথর চাপা কষ্ট যেন দলা পাকিয়ে উঠছিল প্রিয়দর্শীর, বুকটা যেন ফেটে যাবে যন্ত্রণায়। কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর একটা ভীষণ অনুতপ্ত গলা ঝঙ্কার দিল তার মস্তিষ্কের কোষে, “এছাড়া আমাদের উপায় ছিল না প্রিয়দর্শী। আপনাকে খুব কাছ থেকে দেখার, জানার, আপনার মনটাকে পড়ার খুব দরকার ছিল আমাদের। নাহলে কাকে ভরসা করে আমরা তার হাতে তুলে দিতাম এই গ্রহের ভবিষ্যৎ?” ডুনার কচি স্বরই যেন ফের বলতে শুরু করেছে, “একটা অচেনা সহায়সম্বলহীন বাচ্চাকে আশ্রয় দিয়েছেন আপনি, নিজের হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন। গত দুমাস ধরে আমাদের প্রতিনিধি বারেবারে পড়ে দেখেছে আপনার মনের প্রতিটা কোণা, প্রতিটা ভাবনা... এই পৃথিবীকে বাঁচানোর, মানবজাতিকে বাঁচানোর জন্য আপনার লড়াই! এবং শেষ পর্যন্ত আপনার মধ্যেই খুঁজে পেয়েছে মানবতার সব থেকে বড় গুণ, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। এই পৃথিবী থেকে সব ভালো মানুষেরা হারিয়ে যায়নি প্রিয়দর্শী, আপনি তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। আর তাই তার ডাকে আমরা ফিরে এসেছি এখানে, শক্তিবলয় বানিয়ে ডেকে এনেছি আপনাকে... শুধুমাত্র আপনাকে সাহায্য করব বলে। আপনার হাতের ওই আংটিটা আপনাকে প্রতি মুহূর্তে ট্র্যাক করতে সাহায্য করেছে আমাদের। আপনাদের দলের ভিড়ে তাই সহজেই আপনাকে চিনে নিয়েছি, শুধুমাত্র আপনার জন্যই খোলা রেখেছি শক্তিবলয় পেরিয়ে এখানে আসার রাস্তা। জগতের রক্ষক হিসেবে আমরা চাই না কিছু প্রাণীর নির্বুদ্ধিতার বিনিময়ে শেষ হয়ে যাক এমন প্রাণবন্ত একটা গ্রহ। আরো একটা সুযোগ পেতে পারে মানবজাতি!”

—“চেষ্টা করছি তো আমি...!” একটা হাহাকার ছিটকে এল প্রিয়দর্শীর গলা দিয়ে। দু'হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল, “কিছু মানুষের এই স্বার্থপরতার জন্য নিজের আত্মীয়-স্বজন, নিজের বাড়ি, নিজের দেশ হারিয়েছে বহু মানুষ! আর এখন হারাতে চলেছে এই গ্রহকে! যারা মৃত তারা হয়ত মরে বেঁচে গেছে। তিল তিল করে রোজ মরছি তো আমরা, যারা বেঁচে থেকে পৃথিবীর শেষ দেখছি নিজেদের চোখে... কিন্তু কিছু করতে পারছি না! এই পাপের বোঝা যে অনেক বড়, আমাদের এই সামান্য চেষ্টা দিয়ে তাকে লাঘব করা কি সম্ভব? কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে কীই বা করতে পারি আমি?”

আস্তে আস্তে এগিয়ে এল ডুনা। নরম পালকের মতো হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল প্রিয়দর্শীর গলা। ঠিক তখনি ওর মাথার মধ্যে কে যেন ফিসফিস করে উঠল, “কে বলেছে আপনি সাধারণ? যার হৃদয় এত বড়, সে কখনো সাধারণ হতে পারে?”

দু'হাতে নিজের বুকে ডুনাকে আঁকড়ে ধরল প্রিয়দর্শী। পরম মমতায় সেই আওয়াজ বেজে চলেছে তখনও, “আপনি সাধারণ নন প্রিয়দর্শী। আজ থেকে ঠিক তিনহাজার বছর আগেও আপনি সাধারণ মানুষ ছিলেন না। অনেক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন আপনি! আপনার ইচ্ছেতে, আপনার কথায় প্রভাবিত হত বহু মানুষ! ফিরে যেতে চান সেই সময়ে? আবার নতুন করে শুরু করতে চান সব কিছু? যেখানে গিয়ে আপনি মানুষের মন থেকে যুদ্ধের মনোভাব মুছিয়ে ফেলে শেখাবেন পরম মানবতার কথা? যে জল আপনাদের জীবন ধারণের প্রধান উপকরণ, সেই জলকে সংরক্ষণ করতে শিখবে মানুষ, ভালোবাসতে শিখবে গাছপালাকে, বন্ধু করে নেবে পরিবেশকে? হয়ত আপনার হাত ধরে মানুষ ভুলে যাবে হিংসার পথ, শান্তির বার্তা ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবী জুড়ে? হয়ত এই সতেজ সজল গ্রহকে উষর গ্রহে পরিণত করার পথে পা বাড়াবে না মানুষ? হয়ত তৈরী হবে নতুন কোনো সম্ভাবনা, নতুন ভাবে লেখা হবে মানবতার ভবিষ্যৎ? যেতে চান আপনি? আমরা আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি সেই অতীতে...”

আরো শক্ত করে ডুনাকে বুকে চেপে ধরল প্রিয়দর্শী। উপচে যাওয়া দু'চোখ বন্ধ করে স্থির গলায় বলল, “চাই। আমি ফিরে যেতে চাই সেই অতীতে। বাঁচাতে চাই এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎকে। শান্তির আশ্রয় দিতে চাই সবাইকে, যেখানে ভবিষ্যতের কোনো মানুষ যেন প্রত্যক্ষ না করে বিশ্বযুদ্ধ! হাহাকার না করে একফোঁটা জলের জন্য! ফিরিয়ে দাও আমায়... ফিরিয়ে দাও সেই অতীতে... ফিরিয়ে দাও...”

আস্তে আস্তে ওর বুক থেকে মাথা তুলল ডুনা। এই প্রথম বারের জন্য যেন মুখ ফুটে আগের মতো বলে উঠল, “তাই হবে, পাপা।” সামনে পড়ে আছে একটা পরিত্যক্ত সিমেন্টের স্ল্যাব, কচি দু'হাতে প্রিয়দর্শীর হাত ধরে নিয়ে গেল সেখানে... তারপর আস্তে আস্তে শুইয়ে দিল ওকে। ধীরে ধীরে প্রিয়দর্শীর মুখের ওপর, বন্ধ চোখের ওপর নেমে আসতে লাগল ডুনার নরম হাতের ছোঁয়া। শরীরটা পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে যাচ্ছে..আস্তে আস্তে আবছা হয়ে আসছে সমস্ত ইন্দ্রিয়... তারপর যেন এক অতল ঘুমের মধ্যে একটু একটু করে তলিয়ে যেতে শুরু করল প্রিয়দর্শীর সমস্ত চেতনা...

(১৪)

ধীরে ধীরে উঠে বসল প্রিয়দর্শী। চারদিক কেমন যেন আবছা অন্ধকার। এ কোথায় আছে সে? এতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিল? নাকি অজ্ঞান হয়ে গেছিল? মাথাটা জোরে জোরে ঝাঁকালো প্রিয়দর্শী। আস্তে আস্তে সব মনে পড়ছে... জল শুকিয়ে যাওয়া পৃথিবী, এরিন, আলফাবটস্, এলিয়েন অ্যাটাক, ডুনা... হঠাৎই যেন সেই স্মৃতিগুলোকে ছাপিয়ে মাথার মধ্যে দল বেঁধে জড়ো হতে লাগল আরও কিছু শব্দ... লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু, পুরন্দর, রক্তে লাল দয়া নদী, গোলাপ বাগিচা, কারুবাকি... কয়েক মুহূর্ত চোখটা বন্ধ করল সে। হাতের আংটিটা অন্ধকারের মধ্যেও যেন জ্বলজ্বল করছে। এই আংটি আকাশের প্রতীক, জলের প্রতীক... পুনর্জন্মের প্রতীক! পাশেই কারুকার্য করা তাকিয়ার ওপর রাখা মণিমুক্তো খচিত রাজমুকুট। সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন মহারাজ। রূপকথার গল্প শুধু অতীতের হয় না, কখনো কখনো ভবিষ্যতেরও হয়! পুরন্দর হয়ত এটাই বলতে চেয়েছিল। স্মিত মুখে দুইহাতে স্বর্ণ মুকুটটা মাথায় তুলে নিলেন মহারাজ... সঙ্গে মাথায় তুলে নিলেন এই পৃথিবীকে বাঁচাবার, মানবজাতিকে বাঁচাবার, মানুষের মধ্যে হিংসা দলাদলি মুছে দিয়ে অহিংসা ও প্রেমের বার্তা ছড়িয়ে দেবার দায়িত্ব। যে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের পৃথিবী তিনি দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন... তা যেন সত্যি হয়ে কখনো নেমে না আসে সভ্যতার বুকে তা রূপায়ন করাই এখন তাঁর প্রধান কর্তব্য! আবার গড়ে তুলবেন সেই কলিঙ্গকে, যাকে নিজের হাতে ধ্বংস করেছেন তিনি... মঙ্গল করবেন কলিঙ্গদেশ তথা তাঁর সমস্ত প্রজাদের... লোভ লালসার পথ ত্যাগ করে মানবতার ধর্মে তাদের দীক্ষিত করবেন তিনি... প্রজাদের হৃদয়ে প্রকৃত প্রিয়দর্শী হয়ে উঠবেন! পায়ে পায়ে বন্ধ দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন মহারাজ। বাইরে থেকে তখন ভেসে আসছে প্রজাদের সম্মিলিত কণ্ঠের জয়ধ্বনি।

জয়ধ্বনি তাঁর।

জয়ধ্বনি মাগধ প্রিয়দর্শীর।

জয়ধ্বনি রাজা অশোকের।

 

স্বীকারোক্তি : রাজা অশোকের জীবনের কিছু তথ্য এবং ঘটনাবলী ছাড়া এই গল্পের সবটাই কাল্পনিক। তথ্য সংগ্রহে যে সূত্র গুলি সহায়তা করেছে সেগুলি হল,

১) অশোকচরিত - ডঃ অমূল্য চন্দ্র সেন

২) ধর্মবিজয়ী অশোক - প্রবোধ চন্দ্র সেন

৩) Ashoka - Wytre Keuning

৪) Indica - Megasthenes (translated)

৫) কারুবাকির ভাষা - অশোকের শিলালিপি থেকে অনুপ্রাণিত

৬) এছাড়া সমস্ত রকম সহায়তায় Google ও Wikipedia