সম্পাদকের কথা

প্রিয় পাঠকবন্ধুরা,

প্রথমেই আপনাদের সবাইকে জানাই নতুন বছরের প্রীতি ও শুভেচ্ছা। আপনাদের সঙ্গে পরবাসিয়া পাঁচালীও পেরিয়ে এল আরো একটা বছর। গত বছর এই সময়েই প্রকাশিত হয় আমাদের প্রথম বিশেষ সংখ্যা - কল্পবিজ্ঞান ও রহস্য সংখ্যা। গত বছরের শুরুতে আমাদের পত্রিকা নিয়ে যে সমস্ত দোলাচল ছিল, পাঠকদের ভালোবাসায় তার অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেছে। এই বছরে আমাদের প্রথম নিবেদন - বিশেষ কল্পবিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসি সংখ্যা।

বাংলা ভাষায় এবং ভারতের প্রথম কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা ‘আশ্চর্য!’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৩-র জানুয়ারি মাসে। আকাশ সেন ছদ্মনামে অদ্রীশ বর্ধন সম্পাদিত এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছিল কল্পবিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টা। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে সে পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে রণেন ঘোষের সম্পাদনায় ‘বিস্ময়’ কিংবা অদ্রীশবাবুর উদ্যোগে ‘ফ্যানট্যাসটিক’-এর মতো পত্রিকার উত্থান হয়েছিল। কিন্তু কালের গ্রাসে তারাও একে একে বিদায় নিয়েছে। তবে আনন্দের কথা, বর্তমান সময়ে ‘কল্পবিশ্ব’-এর উদ্যোগে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে নতুনভাবে পাঠকমহলে উৎসাহ গড়ে উঠছে।

আশি-নব্বইয়ের দশকে বাংলায় কল্পবিজ্ঞান নিয়ে ‘ফ্যানট্যাসটিক’ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যিক সিদ্ধার্থ ঘোষের বক্তব্য ছিল অনেকটা এরকম―

“বিদেশে সায়েন্স ফিকশন আজ সিরিয়াস অধ্যয়নের বিষয়। ...বাংলায় সায়েন্স ফিকশন নিয়ে সিরিয়াস কোনো গবেষণা হয়নি। বাংলা সাহিত্য পত্রিকায় সায়েন্স ফিকশান আজও অচ্ছুৎ। ...এই অবস্থার জন্য বিস্মিত হবার কোনো কারণ নেই। শিশু কিশোরদের জন্যই শুধু সায়েন্স ফিকশান লেখা হবে, এটাই এখনো অবধি রেওয়াজ। আর সেই সঙ্গে সায়েন্স ফিকশানের দুটি বাংলা পরিভাষা ‘বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প’-এর সঙ্গে ‘কল্পবিজ্ঞানের গল্প’-এর ঠাণ্ডা লড়াই জারি করেছেন কিছু স্পর্শকাতর পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তি। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কিছু সমালোচক মনে করেন কল্পবিজ্ঞানের গল্প কিঞ্চিৎ নিকৃষ্ট জাতের, যেখানে ফ্যান্টাসির দাপট বেশি এবং বিজ্ঞানের অপলাপের সুযোগ আছে। এর থেকে আরো একটি ভ্রান্ত অনুমানের হদিশ পাই আমরা, যা সায়েন্স ফিক্‌শনের প্রকৃত তাৎপর্য ও সুপ্ত ক্ষমতা উপলব্ধি করতে না পেরে তাকে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলার কাজে নিযুক্ত করার পথনির্দেশ মনে করে।”
―সিদ্ধার্থ ঘোষ (সায়েন্স ফিকশান একটি পরিভাষার জন্ম, শারদীয়া এক্ষণ, ১৯৮৮)

তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেলেও অবস্থা খুব একটা পাল্টায়নি। কারণ ‘ফ্যানট্যাসটিক’-পরবর্তী যুগের খ্যাতনামা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যিক অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর কথাতেও ত্রিশ বছর আগেকার কথার অনুরণন লক্ষ করা যায়।

“বাংলায় কল্পবিজ্ঞানে চার ধরণের লেখার সম্ভাবনা দেখি। প্রথমত অবশ্যই ছোটদের জন্য হাল্কা কল্পবিজ্ঞানের লেখা যেখানে বিজ্ঞানের শর্ত, লজিক কোনটাই থাকে না। লজিক ও বিজ্ঞান একটা বড় অংশ বাঙালী পাঠককে দূরে সরিয়ে দেয়। ...এবার, দ্বিতীয় শ্রেণীর লেখায় আসি। এ ধরণের কিছু লেখা খুব কম সংখ্যায় হলেও আমরা শিশু কিশোর পত্রিকা গুলোতে পেয়েছি, যেখানে গল্পের মধ্যে বিজ্ঞান বা কল্পিত বিজ্ঞানে বড় কোন ভুল থাকে না। ...এবার, তৃতীয় শ্রেণীর গল্পের ক্ষেত্রে আসি। শুধুই বড়দের জন্য লেখা কল্পবিজ্ঞানের গল্প। বাংলা সাহিত্যে এর একটা বড় অভাব আছে। ...এবার শেষ বা চতুর্থ শ্রেণীর লেখার কথায় আসি। এক্ষেত্রে গল্পের কেন্দ্রে থাকে বিজ্ঞান।”
―অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী (অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর সাথে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা, শারদীয়া কল্পবিশ্ব, ২০১৮)

পরবাসিয়া পাঁচালী তার জন্মলগ্ন থেকেই ব্যতিক্রমী সাহিত্যচর্চার চেষ্টা করে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। তাই কল্পবিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসির মতো সাহিত্য, যা বাংলায় কিছুটা হলেও অবহেলিত ও ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী, তা নিয়ে চর্চার আগ্রহে পরবাসিয়া পাঁচালীর এই সংখ্যার আয়োজন। বিশেষভাবে আমরা কৃতজ্ঞ, কল্পবিশ্বের অন্যতম দুই সম্পাদক দীপ ঘোষ ও সন্তু বাগের কাছে। এই সংখ্যা করার পথে নানান বিষয়ে সাহায্য করেছেন তাঁরা। আমাদের ইচ্ছে ছিল, ‘আশ্চর্য!’, ‘বিস্ময়’ ও ‘ফ্যানট্যাসটিক’ থেকে তিনটি হারিয়ে যাওয়া লেখা এই সংখ্যায় পুনর্মুদ্রণ করব। সে লেখাগুলি স্ক্যান করে দিয়ে সাহায্য করেছেন সন্তুবাবু। দীপবাবু দিয়েছেন ‘আশ্চর্য!’ ও ‘ফ্যানট্যাসটিক’-এর লেখাগুলির বর্তমান প্রকাশক কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান-এর কাছ থেকে প্রকাশের অনুমতি। এছাড়া আমরা ধন্যবাদ জানাই সমস্ত লেখক ও শিল্পীকে, যাঁদের একের পর এক অসাধারণ কাজে এই সংখ্যা সেজে উঠেছে।

পাঠকদের মতামত এক্ষেত্রে যে খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটা বলাই বাহুল্য। কাজেই ভালো লেগেছে, খারাপ লেগেছে বা মনে দাগ কাটেনি, যে কোনো ধরণের মতামত আমাদের জানাতে ভুলবেন না। তাহলে আর দেরি কীসের, কল্পনার অপরিসীম দুনিয়ায় প্রবেশ করুন। যাত্রা শুভ হোক!

ধন্যবাদান্তে,