মহাবিশ্বের ওপার হতে - বিশু দাস

অলংকরণ - মূল প্রচ্ছদ

দু হাত দূরে নজর চলে না এমন ঘন কুয়াশা। এমনি দিনে দেখা দিলো সেই ভয়াবহ অবস্থা।

সারাটা বিকেল ঘন কুয়াশা সাপের মত পাকিয়ে পাকিয়ে এসে জমা হতে লাগলো গোলা বাড়ীটার চারপাশে। ঘরের মধ্যে কেমন একটা ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। দরজার ফাঁক দিয়ে কুয়াশার রেখা ঘরের ভেতরে এসে নামছে নিঃশব্দ সরীসৃপের মত, তার বিশাক্ত জিভের ছোঁয়া এসে লাগছে মাথার চুলে। ভিজে ভিজে যাচ্ছে চুলগুলো। সার্সিগুলোতে শিশিরের মত জলকনার ধোঁয়াটে আবরণ। বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, আর তেমনি পড়েছে কনকনে ঠাণ্ডা।

রমাপতির দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে চাইলাম আমি। রমাপতি আমার বন্ধু। জানালার দিকে পেছন ফিরে খুব তাড়াতাড়ি কি যেন লিখে যাচ্ছে। লম্বা রোগাটে চেহারা রমাপতির, কিন্তু কাঁধটা অস্বাভাবিক রকমের চওড়া বৃষস্কন্ধ বললেও বুঝি খুব অন্যায় হবে না। পাশ থেকে মুখের রেখাটা বেশ আকর্ষনীয় মনে হয়। প্রশস্ত ললাট, টিকালো নাক, চৌকো গাল-মুখে বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের ছাপ এবং তার সঙ্গে কল্পনা প্রবনতার লক্ষণও স্পষ্ট। মুখটা দেখলেই মনে হয় যেন অতি প্রাকৃত ঘটনার জ্ঞান ওর প্রচুর।

রমাপতি গল্প লেখে। সাধারণতঃ ছোট গল্পই সে লিখে থাকে। নিজের আনন্দের জন্যেই সে লেখে, সমসাময়িক পাঠকদের মনপুতঃ হবে কিনা এসমস্ত চিন্তা অবান্তর বলেই মনে করে। তার সব গল্পেরই বিষয়বস্তু অস্বাভাবিক বস্তু বা ঘটনা। এসব গল্প হয়তো ভালো লাগতো ‘পো’র; ভালো লাগতো হথর্ণের, এ্যামব্রোজ বায়ার্স এর বা ভিলিয়াস দ্য এ্যাদামস্ এর। গল্পগুলো সবই ভয়ঙ্কর দর্শন অমানুষিক মানুষের, অস্বাভাবিক জন্তু জানোয়ারের বা অস্বাভাবিক বৃক্ষের। সুদূর কল্পনায় যার স্থান, সেই সমস্ত অলুক্ষুণে অমঙ্গল সূচক জিনিষ, ভয়াবহতা এবং যে সমস্ত রং, শব্দ বা গন্ধ কোনদিন দেখতে, শুনতে পাওয়া যায় নি কিম্বা নাকে আসেনি কারও সে সব নিয়েই ওর কারবার। ভৌতিক ছায়াচ্ছন্ন, পোকা কিলবিল করা পরিবেশ ওর প্রত্যেকটা গল্পের পটভূমি নির্জন বনের গহনে তাদের নিঃশব্দ সঞ্চারণ, কিম্বা রুক্ষ পর্বতের ধূসর গায়ে, বহু যুগের পুরোনো ভগ্ন প্রাসাদের ফাটলে ফাটলে, বা পুরোনো ঘাটের আনাচে কানাচে তাদের নীরব অস্তিত্ব।

ওর একটা গল্প, “পতঙ্গের জগৎ” পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র কালো আর লাল রংয়ের বাড়ীটার মধ্যে মেঝেতে বসে পাগলের মত অসংলগ্ন চীৎকার শুরু করেছিলো, “আমার প্রিয়া, পদ্মবনের সব পদ্মের সেরা পদ্মটীৱ চেয়েও সুন্দরী।”... ওর ‘অপবিত্র’ গল্পটা সাময়িক পত্রিকায় ছাপা হবার পর তিনশ দশটা চিঠি এসেছিলো স্থানীয় পাঠকদের কাছ থেকে। প্রত্যেকটা চিঠিতে ওকে ধিক্কার দেওয়া হয়েছিলো অমানুষিক কল্পনার জন্যে।

আমি তাকিয়ে আছি, হঠাৎ লেখা থামিয়ে মাথা নাড়লো রমাপতি। “নাঃ, এতে হবে না,” নিজের মনেই বললে। “আমাকে নতুন একটা ভাষা সৃষ্টি করতে হবে। জিনিষটা আমি ঠিক উপলব্ধি করতে পারছি আমার অন্তর্দৃষ্টি, আমার কল্পনা প্রবনতার সাহায্যে কিন্তু সেটা প্রকাশ করার একটা ভাষা যদি পাই—বিদেহী আত্মার ধীর, মন্থর সঙ্কারণ!”

“এটা কি তোমার নতুন কোন ভয়াবহ গল্প?” আমি প্রশ্ন করলাম।

রমাপতি ঘাড় নাড়লো। “আমার কাছে নতুন নয়। বহু বছর ধরে এরা আমার পরিচিত, আমি এদের উপলব্ধি করতে পারি—ভীষণ ভয়াবহ জিনিষ, তোমার গদ্যময় মস্তিষ্কে যার কল্পনা করাও সম্ভব নয়।”

“ধন্যবাদ,” জবাব দিলাম আমি।

“সব মানুষের মস্তিষ্কই গদ্যময়,” রমাপতি ব্যাখ্যা করতে আরম্ভ করলো। “আমি কাউকে আঘাত দিতে চাই না। একটা ভয়াবহতা, রহস্যময় ভয়ঙ্কর প্রহেলিকা চতুর্দিকে ঘিরে রেখেছে সব সময়। আমাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক মহাশূন্য থেকে আগত সেই সর্বনাশা জিনিষগুলো সম্বন্ধে কতটুকু জানতে পারে—কতটুকু উপলব্ধি করতে পারে কেমন করে তারা আমাদের মস্তিষ্কের রসটুকু সব শুষে নিচ্ছে? আমার মনে হয় মাঝে মাঝে ওরা এসে আমাদের মাথার মধ্যে বাসা বাঁধে, তখন আমাদের মস্তিষ্ক উপলব্ধি করতে পারে তাদের অস্তিত্ব, কিন্তু ওরা যখন অক্টোপাশের মত অজস্র বাহু বিস্তার করে নরম মস্তিষ্কটাকে আচড়াতে শুরু করে তখন আমরা পাগল হয়ে উঠি ; জুড়ে দি অসংলগ্ন চীৎকার ; তখন মস্তিষ্কের আর কি প্রয়োজন থাকে, বল?”

“এসব গাঁজা খুরী গল্প তুমি বিশ্বাস কর বুঝি?” আমি প্রশ্ন করলাম।

“তা অবশ্যই করি না!” একটু হেসে জবাব দিলো সে। “তুমি তো জানো কোন কিছুতেই আমার সহজে বিশ্বাস হয় না। আমি কেবল মহাবিশ্ব সম্বন্ধে একজন কবির কল্পনাকে তুলে ধরেছি। ভৌতিক গল্প যদি কেউ লিখতে চায় এবং সেই গল্পের ভয়াবহতা যদি বেচারা পাঠকদের মনে সঞ্চারিত করতে চায় তবে তাকে সব কিছুতেই বিশ্বাস করতে হবে। ‘সবকিছু’ বলতে আমি বোঝাতে চাইছি সব কিছুর মধ্যেই যে অলৌকিকতা আছে তাকে, সেটা সবকিছুর চেয়ে ভয়াবহ এবং অবাস্তব। তাকে বিশ্বাস করতে হবে যে মহাশূন্য থেকে আগত কতকগুলো জিনিষ আমাদের দেহের মধ্যে ঢুকে শোষণ করতে থাকে।”

“কিন্তু মহাশূন্য আগত ঐ জিনিষগুলোকে কেমন করে বর্ণনা করবে যদি তাদের আকার, আয়তন বা বর্ণ সম্বন্ধে কোন ধারনাই না থাকে?”

“তাদের বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব ব্যাপার। আমি সেটাই তো করতে চাইছি কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। হয়তো কোন একদিন কিন্তু, আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে যে তা কোনদিন সম্ভব হবে কিনা। তোমাদের শিল্পীরা হয়তো সামান্য আভাষ”...

“কি আভাষ?” একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম।
“আভাষ দিতে পারবে ভয়ঙ্কর অপার্থিব কিছুর ; একমাত্র সেই জিনিষটা ছাড়া অন্য আর কিছুর সঙ্গে তুলনা করে তাকে বোঝান যাবে না, কারণ পৃথিবীতে তার সঙ্গে তুলনীয় কোন কিছুই নেই।

“কিছুটা অসম্পূর্ণতা যেন থেকেই যায়,” বললো সে, “এমনকি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রহস্য গল্পগুলোরও যেন খানিকটা অসম্পূর্ণতা আছে। মিসেস র‍্যাডক্লিফ, এবং তার গোপন কক্ষ আর রক্তাক্ত অশরীরীরা; ম্যাটুরিন এবং রূপক বর্ণনায়, ফাউস্তএর দুরাত্মা নায়কেরা এর নরকের মুখানসৃতঃ আগুণের শিখা, এ্যাডগার এ্যালেন পো এবং তাঁর গল্পের রক্ত মাখা মৃতদেহগুলো, কালো বেড়াল, ধুক ধুক করা জীবন্ত হৃদযন্ত্র, হথর্ণ এর মানুষের পাপ থেকে উদ্ভুত ভয়াবহতা (মানুষের পাপ গুলো যেন জীবন্ত প্রাণীর মত মাথার মধ্যে শুষে শুষে খায় ), আর বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ রহস্য কাহিনীকার, যেমন এ্যালজিরন ব্ল্যাকউড, আমাদের নিয়ে যান দেবতাদের ভোজ সভায়, আমাদের দেখিয়ে দিতে থাকেন সেই খণ্ডিতোষ্ঠা বৃদ্ধাকে যে কতকগুলো পুরোনো তাস নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, ব্রাম ষ্টোকারের রক্তপায়ী বাদুড় আর নেকড়ের পাল, মধ্যযুগীয় কুসংস্কার আর প্রবাদ, ওয়েলস এর আপাত বৈজ্ঞানিক কল্পনার সমুদ্রের নীচের মৎস মানুষ, চাঁদের বুকে যুবতী কন্যা তাছাড়া আরও অসংখ্য মূর্খ যাঁরা অবিশ্রান্ত ভাবে পত্র পত্রিকার জন্যে ভুতুড়ে গল্প লিখেই চলেছে—তারা অসৎ বা অমঙ্গলের সাহিত্যে কতটুকু দান করেছে?

“আমরা কি রক্তমাংসের গড়া নই? সুতরাং রক্তমাংসর পোকা কিলবিল করা পচনের দৃশ্য চোখের সামনে দেখলে আমরা যে ভয় পাবো এটাতো খুব স্বাভাবিক জিনিষ। অতএব মরা মানুষের গল্প আমাদের মনে যে শিহরণ জাগাবে তাতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। সে দৃশ্য আমাদের মনে ভয়, উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা আনবেই। যে কোন মূর্খও আমাদের মনে সে ভাব জাগাতে পারে-পো তার লেডি আসার বা লিকুয়েসেন্ট ভলডিমারসকে দিয়ে এর বেশী কিছু করতে পারেননি। তিনি কেবল স্বাভাবিক সহজ সরল ভাবালুতাটুকু এনে দিয়েছিলেন পাঠকের মনে, এবং পাঠক তাতে সাড়া দিয়েছে।

“আমরা কি নিষ্ঠুর নির্দয় পূর্ব পুরুষদের বংশধত নেই? এক সময় কি আমরা হিংস্র পশুদের দয়ার ওপর নির্ভর করে গহন বনের ভয়াবহতার মধ্যে দিন কাটাতাম না? কিন্তু তবু আমাদের সাহিত্যে সামান্য একটু অসৎ কিছু দেখলেই আমরা কেঁপে উঠি আমাদেরই অতীতের কোন অন্ধকারময় অধ্যায়ের উল্লেখ দেখলে বিচলিত হয়ে পড়ি। হার পাই, রক্তপায়ী পাখী, বাদুড় আর হিংস্র কুকুর এর রূপান্তর ছাড়া আর কি, যারা আমাদের পূর্ব পুরুষদের একদিন সন্ত্রস্ত করে রাখতে পদে পদে? ঐ উপায়ে মানুষের মনে ভয় জাগানো খুবই সহজ। নরকের দরজায় আগুণের হলকা দেখিয়ে লোককে ভীত করে তোলা সহজ, কারণ আগুণের উত্তাপ মাংস, হাড় সব পুড়িয়ে দিতে পারে, আগুণের ভয়াবহতার কথা কে জানে, কেন ভয় করে এর দাহিকা শক্তিকে? প্রানান্তকর আঘাত, দাহিকা শক্তি সম্পন্ন আগুণ, ভয় জাগানো ছায়া এসবকে মানুষ ভয় করে কারণ ঐ জিনিষগুলো আমাদের পুরুষানুক্রমে অর্জিত স্মৃতির অন্ধকার প্রকোষ্টে লুকিয়ে আছে—এই সমস্ত লেখকরা, যারা একান্ত স্বাভাবিক এবং অতি সামান্য অপ্রীতিকর জিনিষের সাহায্যে আমাদের মনে ভয়ের সঞ্চার করার চেষ্টা করেন তাদের ওপর আমি ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠেছি।”

রমাপতির চোখে মুখে ফুটে উঠলে তীব্র ঘৃনার ভাব।

“ভাবো, এর চেয়ে আরও বেশ ভয়াবহ একটি অবস্থা যদি আসে? মনে কর যদি কতকগুলো অশুভ জিনিষ অন্য কোন এক বিশ্ব জগৎ থেকে আমাদের পৃথিবীকে আক্রমণ করে বসে? ধরো, আমরা তাদের উপলব্ধি করতে পারি না? যদি তাদের দেহের রং এমন হয় যে রং পৃথিবীর মানুষের কাছে অজানা, কিম্বা বর্ণ হীন হয় তাদের চেহারা?

“তাদের আকার যদি এমন হয় যা মানুষের জ্ঞানের বাইরে? যদি তারা চতুর্মাত্ৰিক হয়, পঞ্চমাত্রিক বা যষ্ঠ মাত্রিক হয়? ধরো যদি শত মাত্রিক হয় তারা? মনে কর যদি তাদের কোন আকার বা আয়তন নেই অথচ অস্তিত্ব আছে। তাহলে আমরা কি করতে পারি?

“ওরা যদি আমাদের পক্ষে যন্ত্রনাদায়ক হয় তবেই ওদের অস্তিত্ব আমরা বুঝতে পারবে। কিন্তু সে যন্ত্রনা যদি উত্তাপের বা ঠাণ্ডায় বা যে সমস্ত যন্ত্রণা আমাদের পরিচিত তার কোনটাই না হয়? যদি সেটা নতুন ধরনের যন্ত্রণা হয়? ওরা যদি আমাদের স্নায়ু ছাড়া দেহের অন্য কিছুকে স্পর্শ করে-যদি নতুন কোন রহস্যজনক উপায়ে আমাদের মস্তিষ্কে গিয়ে বাসা বাঁধে? যদি নতুন কোন রহস্যময় অবর্ণনীয় উপায়ে তাদের উপস্থিতি আমরা উপলব্ধি করি? তাহলে আমাদের কিছু করার আছে? আমাদের হাত পা বাঁধা। আমাদের দৃষ্টির বা উপলব্ধির বাইরে যদি হয় তাকে আমরা বাধা দিতে পারবো না। সহস্র মাত্রিক বস্তুকে বাধা দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই। ধরো, মহাশূন্যের যে পথ দিয়ে তারা আমাদের কাছে এসে পৌছাবে সেই শূন্যতাই যদি তাদের খাদ্য হয়!”

পাগলের মত নিজের মনেই বিড় বিড় করতে আরম্ভ করলো, রমাপতি।

“সেই জিনিষের সম্বন্ধেই আমি লিখতে চাইছি। আমার কোন গল্পে সেই নিরাকার নিঃশব্দ গামী জিনিষ গুলো সম্বন্ধে লিখতে চাই, যারা আমাদের মস্তিষ্কের সব রসটুকু শুষে নেয় অতি নির্মম ভাবে। আমি চাই আমার মুখ নির্বোধ পাঠকদের মহাশূন্যের ওপারের অন্য এক জগৎ থেকে আসা বস্তু গুলো দেখতে এবং উপলব্ধি করতে। তাদের আভাষ আমি দিতে পারি সহজেই যে কোন বোকা লোকও পারে কিন্তু আমি চাই তাদের সত্যিকার বর্ণনা দিতে। আমি বর্ণনা দিতে চাই এমন একটা রংয়ের, যে রং রং নয়? যে আকার নিরাকার।

“একজন গনিতজ্ঞ হয়তো সামান্য একটু আভাষ দিতে পারবেন। অদ্ভুত ধরণের বক্ররেখা, কোন্ ইত্যাদি মাঝে মাঝে অঙ্ক পাগল গনিতজ্ঞের চোখের সামনে ভেসে উঠেই মিলিয়ে যায়, তখন তিনি ডুবে থাকেন গভীর চিন্তায়। একথা বললে ভুল বলা হবে যে গনিতজ্ঞরা চতুর্মাত্রিক জগৎ আবিষ্কার করতে পারেন নি। সে জগৎকে তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন মানসচক্ষে, সে জগতের সীমানায় গিয়ে হাজিরও হয়েছেন, কিন্তু পরীক্ষা করে দেখাতে পারেন নি সেটাকে। আমি একজন গনিতজ্ঞকে জানি যিনি ভগবানের নামে শপথ করে বলেছিলেন যে বিশুদ্ধ গনিতের প্রশান্তিময় আকাশে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে তিনি একবার যষ্ঠ মাত্রিক দেশ দেখতে পেয়েছিলেন।

“দুভার্গ্য আমার, আমি গনিতজ্ঞ নই। আমি সামান্য এক মুখ কথাশিল্পী, তাই বহির্জাগতিক সেই বস্তু আমাকে কেবল মুগ্ধই করে।”

ঠিক সেই সময় দরজায় কে যেন জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলো। আমি উঠে গিয়ে খিল খুলে দিলাম। “কি চাই আপনার?” আমি প্রশ্ন করলাম। “ব্যাপার কি?”

“আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত”, পরিচিত কণ্ঠের সাড়া পেলাম। “আমি অন্য আর একজনের সঙ্গে কথা বলতে চাই।”

আমার নিকটতম প্রতিবেশীর রক্ত শূন্য ফ্যাকাশে মুখ দেখেই তাড়াতাড়ি দরজা ছেড়ে এক পাশে সরে দাঁড়ালাম। “ভেতরে আসুন”, সাদর অভ্যর্থনা জানালাম তাকে। “ভেতরে আসুন। আমি রমাপতির সঙ্গে ভুত সম্বন্ধে আলোচনা করছিলাম, আর যাদের কথায় এসে পৌছেছিলাম তাদের সান্নিধ্য খুব আনন্দদায়ক নয়। আপনি হয়তো এবিষয়ে কিছু যুক্তিপূর্ণ মতামত দিতে পারবেন।”

ভদ্রলোক তার দশাসই চেহারা নিয়ে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন। তাঁর দীর্ঘ ছায়ায় অনেক খানি অন্ধকার হয়ে গেলো, মনে হলো যেন খানিকটা অন্ধকার রাত্রি তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এলেন।

একটা সোফা দখল করে আমাদের দিকে ভীত দৃষ্টিতে বার বার চাইতে লাগলেন। রমাপতি যে পাণ্ডুলিপিটা পড়ে শোনাচ্ছিলো সেটা টেবিলের ওপর রেখে চশমাটা মুছতে লাগলো, আর গজ গজ করতে লাগলে আপন মনে। আমার এই বাঞ্ছিত অতিথিকে সে সহ্য করতে পারছিলো না। মিনিট খানেক আমরা চুপ করেই রইলাম, তারপর তিন জনে প্রায় একই সঙ্গে কথা বলে উঠলাম।

“ভয়ঙ্কর রাতটা, আজকের!”

“পাশবিক, তাই না?”

“অমঙ্গল সূচক।”

আমার প্রতিবেশী ভদ্রলোক গুণ গুণ করে বললেন, ”আজ আমি একটা অদ্ভুত দুর্ঘটনার সাক্ষাত পেয়েছিলাম। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঘোড়ার গাড়ী নিয়ে আসছিলাম”—

“ঘোড়ার গাড়ী?” রমাপতি বাধা দিলো কথার মাঝে।

“ওর নিজের ঘোড় আছে,” অধৈর্য হয়ে বললাম আমি। “আপনি বাজার থেকে ফিরছিলেন, তাই না?”

“হ্যাঁ, বাজার করেই ফিরছিলাম”, জবাব দিলেন তিনি। “গাছের মাঝখান দিয়ে পার হবার সময় দেখছিলাম ঘোড়াটার কান দিয়ে কুয়াশার রেখা যেন বেরিয়ে আসছে। দূরের সমুদ্রের বুকে বাতাসের চাপা গর্জন শোনা যাচ্ছে ঠিক সেই সময় ভিজে ভিজে কি যেন আমার মাথায় এসে পড়লো। ভাবলাম, ‘বৃষ্টির জল’। ‘মালগুলো সব ভিজে যায়নি তো আবার।’

আটা ময়দা গুলো ভিজলো কিনা দেখবার জন্যে পিছনের দিকে মুখ ফেরালাম। হঠাৎ গাড়ীর তলা থেকে নরম স্পঞ্জের মত কি যেন একটা জিনিষ মুখে এসে লাগলো আমার। জিনিষটাকে আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে মুখ থেকে সরিয়ে আনলাম।

“জেলির মত চটচটে লাগলো জিনিষটা। জোরে চাপ দিতেই খানিকটা জলীয় পদার্থ আমার হাত গড়িয়ে পড়লো। তখনও এমন অন্ধকার হয়নি যে কিছুই দেখা যাবে না। চতুর্দিকে গোধুলির মত একটা আবছা আলোর আভাষ। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো জমাট কুয়াশা। লম্বা লম্বা গাছগুলো সোজা দাড়িয়ে আছে। একেবারে ডগা পর্যন্ত নজর চলে যায় এমন সোজা। হ্যাঁ যা বলছিলাম, জিনিসটা কি ভালো করে দেখবার চেষ্টা করলাম, আর কি দেখলাম জানেন? যেন কোন প্রানীর কাঁচা যকৃত, কিম্বা পাঁঠার কাঁচা ঘিলু। জিনিষটার মধ্যে ছোট ছোট ছিদ্র ছিলো, কিন্তু প্রানী দেহের যকৃতে তো ওরকম ছিদ্র দেখা যায় না। যকৃত সাধারণতঃ থাকে কাঁচের মত মসৃন।

“জীবনের একটা ভয়াবহ মুহুর্ত এসেছিলো, আমার। ভাবলাম, ‘গাছের ওপর কেউ হয়তো লুকিয়ে বসে আছে।’ বোধ হয় কোনো পাগল বসে বসে কঁচা যকৃত খাচ্ছে। আমার গাড়ীটা দেখে হয়তো ভয় পাওয়ায় তার হাতে থেকে খানিকটা পড়ে গেছে নীচে। কেন জানি না এই ধারনাটাই বদ্ধমূল হলো আমার মনে, কারণ আমার গাড়ীতে মাংসের কোন চিহ্ন ও ছিলো না।”

“ওপরের দিকে চাইলাম। আপনারা তো জানেনই ঐ জঙ্গলের গাছগুলো কেমন লম্বা লম্বা। পরিষ্কার দিনের আলোতেও কোন কোন গাছের মাথা নজরে আসে না। তাছাড়া, কতকগুলো গাছ কেমন যেন বাঁকাচোরা, দেখলে গা ছমছম করে ওঠে।

“যদিও জিনিষটা বোকামী বলেই মনে হবে কিন্তু ঐ গাছগুলোকে দেখলে কুব্জ বৃদ্ধ বলেই মনে হয় আমার। বুঝতে পারছেন, কেমন যেন ভয় জাগানো, অমঙ্গল সূচক। কোন একটা অঘটন ঘটানোর জন্যে যেন তৈরী হয়েই আছে। এই সব বিশ্রী আকারের গাছগুলো আমার কাছে অশুভের ইঙ্গিত বহন করে আনে।

“ওপরের দিকে তাকিয়ে প্রথমে কিছুই দেখতে পেলাম না। কেবল গাছ আর গাছ, কুয়াশা মেখে সাদা হয়ে আছে। গাছের মাথায় ঘন কুয়াশার আবরণ, আকাশের তারা গুলোকে ঢেকে ফেলেছে। হঠাৎ একটা গাছের ওপর থেকে লম্বা সাদা একটা কি যেন স্যাৎ করে নেমে এলো।

“এত তাড়াতাড়ি সেটা নামলো যে ভালো করে দেখতেই পেলাম না। তাছাড়া জিনিষটা এত সূক্ষ্ম যে ভালো করে দেখাই যায় না। জিনিষটা কতকটা হাতের মত। লম্বা, সাদা, শীর্ণ হাতের মত। কিন্তু হাত সেটা নয়। গাছের মত লম্বা হাতের কথা কেউ কোন দিন শুনেছে? জিনিষটাকে হাতের সঙ্গে তুলনা করার ইচ্ছে কেন হলো জানি না, আসলে ওটা লম্বা একটা রেখার মত-তার বা সুতোর মত ক্ষীন। এখনও আমার বিশ্বাস হয় না জিনিষটা আমি সত্যি সত্যি দেখেছিলাম, না আমার কল্পনা? ওটা সুতোর মত সূক্ষ্ম তাও আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি না, তবে ওটার একটা হাত ছিলো। কিম্বা হয়তো ছিলো না! জিনিষটার কথা ভাবলেই মাথাটা কেমন গোলমাল হয়ে যায়, আমার। বুঝলেন, জিনিষটা এত দ্রুত নামলো যে ভালো করে দেখতেই পেলাম না।

“কিন্তু আমার মনে হলো যে যে জিনিষটা পড়ে ছিলো ওপর থেকে সেটারই যেন খোঁজ করছিলো ওটা। মিনিট খানেকের জন্যে সেই লম্বা শীর্ণ হাতটা রাস্তার ওপর দিয়ে আমার গাড়ীর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। বিরাট একটা সাদা হাত আঙ্গুলের সাহায্যে চলছে, আর তার সঙ্গে লাগানো আছে অবিশ্বাস্য রকমের লম্বা বাহু যা ওপরে উঠে গিয়ে কুয়াশাকে স্পর্শ করেছে, কিম্বা হয়তো আকাশের নক্ষত্রের গা ছুঁয়েছে।

“ভয়ে চীৎকার করে উঠেই ঘোড়াটার পিঠে চাবুক কষিয়ে দিলাম, কিন্তু চাবুক মারার কোন প্রয়োজনই ছিলো না। কারণ তার আগেই ঘোড়াটা প্রাণপণে ছুটতে শুরু করে দিয়েছে। এমন জোরে ছুটতে আরম্ভ করেছিলো যে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো এখুনি বুঝি গাড়ী উল্টে যাবে, কিন্তু তবু আমি লাগাম টানলাম না। বরং হাত পা ভেঙ্গে কোন গর্তে পড়ে থাকবো তবু ঐ অভিশপ্ত দীর্ঘ হাতের বিভীষিকা থেকে মুক্তি পেতেই হবে আমাকে।

“জঙ্গলের সীমানা ছেড়ে বাইরে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। মাথার ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগলো। ঠিক কেমন লাগছিলো তা আমি বর্ণনা দিয়ে বোঝাতে পারবে না। মাথার ভেতরে মনে হচ্ছিলো যেন বরফ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি ভীষণ ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গেছিলাম।

“ভাববেন না যে চিন্তা শক্তি লোপ পেয়ে গেছিলো আমার। আমার চতুর্দিকে কি কি ঘটছে সে সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ সচেতন ছিলাম, কিন্তু মাথার ভেতরটা এমন ঠাণ্ডা হয়ে আসছিলো যে যন্ত্রনায় আর্তনাদ করে উঠলাম। মিনিট দুই তিন যদি একটা বরফের টুকরো হাতের তালুতে চেপে ধরে রাখা যায় তাহলে কেমন লাগে? মনে হয় যেন পুড়ে যাচ্ছে, তাই না? সে জ্বালা থেকেও বেশী যন্ত্রনাদায়ক। আমার মস্তিষ্কটা যেন ঘণ্টায় পর ঘণ্টা বরফের মধ্যে চেপে রাখা হয়েছে এমনি মনে হচ্ছিলো। মাথার মধ্যে যেন একটা চুল্লী বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, ঠাণ্ডা, যেন শোঁ শোঁ করে শব্দ হচ্ছে মাথার ভেতর থেকে।

“ভাগ্যকে ধন্যবাদ যে এই অবস্থা বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। মিনিট দশেকের মধ্যেই যন্ত্রনার শেষ হলো, বাড়ীতে গিয়ে যখন উপস্থিত হলাম তখন এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কোন কিছুই নেই আমার মুখে। আয়নার সামনে গিয়ে না দাঁড়ানো পৰ্যন্ত বুঝতেই পারিনি কোন বিপদের মধ্যে পড়তে হয়েছিলো আমাকে। আয়নাতে দেখতে পেলাম মাথার একজায়গায় ছোট একটা ছিদ্র।”

ভদ্রলোক একটু ঝুকে বসলেন সামনের দিকে, তারপর কপালের চুলগুলো সরিয়ে দেখালেন।

“এই দেখুন সেই ক্ষত। দেখে কি মনে হচ্ছে?” মাথার এক পাশে ছোট ছিদ্রটার তলায় আঙ্গুল দিয়ে প্রশ্ন করলেন আমাদের। “গর্তটা দেখে বুলেটের ছিদ্রের মত মনে হবে, কিন্তু রক্তের চিহ্ন পৰ্যন্ত দেখা যায়নি, আর গর্তটার ভেতর দিয়ে অনেকখানি পৰ্যন্ত দেখা যাচ্ছে। বোধহয় মাথার মাঝখান পৰ্যন্ত চলে গেছে ওটা। বেঁচে আছি কেমন করে কে জানে!”

রমাপতি উঠে দাঁড়ালো, তারপর জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ভদ্রলোকের দিকে চইলো।

“মিথ্যে কথা কেন বলছেন আমাদের কাছে,” চীৎকার করে উঠলো সে। “এই গাঁজাখুরী গল্প কেন বলছেন, আপনি? লম্বাহাত, যত সব ধাপ্পা! আপনি সম্ভবতঃ পানোন্মত্ত ছিলেন মশায়—তবু একথা স্বীকার করতেই হয় যে আমি যা করবার জন্যে রক্ত জল করা পরিশ্রম করছি আপনি তাই করেছেন। আমার লেখা মূর্খ পাঠকদের মনে যদি, আপনি যেমন বললেন, তেমনি ভয়াবহতা জাগাতে পারি, যদি আপনার বর্ণনার কথাগুলো ঠিক ঠিক মত লিখতে পারি তবে পৃথিবীর অমর সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার নামও অমর হয়ে থাকবে—আমি পো’র থেকে বড় হবো, হথর্ণের থেকেও বড় হবো। আর আপনি—একটা আস্ত আহাম্মুক, মিথ্যেবাদী...”

ভীষণভাবে প্রতিবাদ জানাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম আমি।

“উনি মিথ্যে কথা বলেননি একটাও,” বললাম আমি। “ভদ্রলোক বিকারগ্রস্থ, ভুল বকছেন। উনি গুলিতে আহত হয়েছেন, কেউ ওঁর মাথায় গুলি করেছে। ক্ষতস্থানটার দিকে তাকিয়ে দেখ। তুমি ওঁকে অপমান করতে পার না, তাই বলে!”

রমাপতির চোখের আগুন নিভে এলো। “মাপ করো,” বললো সে। “তুমি বুঝতে পরেছো না ঐ ভয়াবহ অবস্থাটা আমার লেখার মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে কতখানি ব্যগ্র হয়ে আছি আমি, কিন্তু উনি অনায়াসেই সেই অবস্থাটা উপলব্ধি করে ফেললেন। আগে যদি বলতেন যে এই রকমের একটা জিনিষ বর্ণনা করতে যাচ্ছেন তাহলে গোড়া থেকেই লিখে নিতে পারতাম। অবশ্য উনি জানতেন না যে উনি এমন গুছিয়ে বলতে পারবেন। আকস্মিক একটা অবস্থা এসেছিলো যার জন্যে অমন সুন্দর ভাবে নিজের উপলব্ধিকে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন—আর চেষ্টা করলেও পারবেন না, একথা আমি জোর করেই বলতে পারি। যাই হোক, কিছু মনে করবেন না, যদি অন্যায় কিছু বলে থাকি মার্জনা করবেন। আপনার জন্যে একজন ডাক্তার ডেকে আনবো? আঘাতটা খুব নিরাপদ বলে মনে হচ্ছে না।”

প্রতিবেশী ভদ্রলোক ঘাড় নাড়লেন। না, ডাক্তারের কোন দরকার নেই। আমার মাথার মধ্যে গুলি আটকে নেই—আর এই ছিদ্রটাও বন্দুকের গুলিতে হয়নি। ডাক্তার পর্যন্ত বুঝতে পারলো না যখন যে ক্ষতটা কেমন করে হয়েছে, আমি শুধু হেসেছিলাম। ডাক্তারদের আমি ঘৃণা করি। তাছাড়া, যারা মনে করে আমি মিথ্যে কথা বলছি সেই মূর্খদেরও আমি ঘৃণা করি। দিনের আলোয় আমি নিজের চোখে দেখেছি সেই সাদা শীর্ণ বস্তুটাকে গাছের ওপর থেকে নেমে আসতে, একথা যারা বিশ্বাস করে না তাদের প্রতিও আমার সমান বিতৃষ্ণা আছে।

ভদ্রলোকের অপমানজনক উক্তি শোনা সত্বেও রমাপতি তার ক্ষতস্থানটা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখছিলো। সে বললো, “কোন ধারালো গোল জিনিষ দিয়ে গর্তটা করা হয়েছে, কিন্তু আশ্চর্য লাগছে যে মাংস এতটুকুও ছড়ে বা কেটে যায় নি কোথাও। গুলি বা ছুরি দিয়ে করা হলে মাংস একটু আধটু কাটাকুটী হতোই।”

মাথা ঝুঁকিয়ে আমিও গর্তটা দেখবার জন্যে তৈরী হয়েছি এমন সময় ভদ্রলোক ভীষণ যন্ত্রণায় চীৎকার করে উঠলেন। গলার স্বর বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো তাঁর। আবার তেমনি লাগছে ঠাণ্ডা—চরম ঠাণ্ডা!

রমাপতি চুপচাপ দেখলো। তারপর বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো, “এসব গাঁজাখুরী গল্প আমাকে বিশ্বাস করাতে পারবে না।”

ভদ্রলোক দুহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে ঘরময় ছুটোছুটি করে বেড়াতে লাগলেন তীব্র যন্ত্রনায়। প্রলাপ শোনা যেতে লাগলো, আর সহ্য করতে পারছি না! আমার মাথার ভেতরটা জমে যাচ্ছে। সাধারণ ঠাণ্ডার মত এটা নয়। এটা অনেকটা… হায় ভগবান, এ অনুভূতি জীবনে আর কোনদিন উপলব্ধি করিনি। মনে হচ্ছে মাথার ভেতরে কি যেন কামড়াচ্ছে, কুরে কুরে খাচ্ছে, টুকরো টুকরো করছে ছিঁড়ে। যেন খানিকটা এ্যাসিড ঢেলে দেওয়া হয়েছে মাথার মধ্যে।

আমি তার কাঁধ ধরে ঝাঁকানী দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে দরজার দিকে ছুটে চলে গেলেন।

এখান থেকে আমাকে পালাতেই হবে, যন্ত্রণা কাতর কণ্ঠে বললেন তিনি। জিনিষটা জায়গা খুঁজছে। আমার মাথার মধ্যে স্থান সংকুলান হচ্ছে না ওটার। রাত্রি খুঁজছে—দীর্ঘ অন্ধকার রাত্রি। রাতের আধারে, ওটা চায়, নিমগ্ন হয়ে থাকতে।

একটানে দরজাটা খুলে তিনি কুয়াশার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। রমাপতি জামার হাত দিয়ে কপালটা মুছে নিলো, তারপর ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লো।

পাগল, আপন মনেই বলতে লাগলো। দুঃখজনক পাগলামী। কতকটা ম্যানিয়া গ্রস্থ বলেই মনে হয়। যে গল্পটা ভদ্রলোক বলে গেলেন সে সম্বন্ধে উনি নিজেই সচেতন নন। অপ্রকৃতিস্থ মস্তিষ্কের দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না, এটাকে।

হুঁ, ঠিকই বলছো, আমি সমর্থন জানালাম; কিন্তু ওর মাথায় যে ফুটোটা দেখলাম সেটা সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা?

ওঃ ওটা! রমাপতি বিচিত্র অঙ্গ-ভঙ্গী করলো। যতদূর মনে হয় ফুটোটা বরাবরই আছে—সম্ভবতঃ জন্ম থেকেই আছে।

বাজে কথা, আমি প্রতিবাদ জানালাম। এর আগে ভদ্রলোকের মাথায় কোন ফুটো ছিলো না। আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে উনি গুলির আঘাত পেয়েছেন। কিছু একটা করা দরকার আমাদের। ওঁর চিকিৎসার দরকার। আমি ভাবছি একবার ডাক্তারকে টেলিফোন করবো কি না।

রমাপতি বললো, এ নিয়ে মাথা ঘামানো অনধিকার চর্চা। গর্তটা গুলির আঘাতে হয়নি। আগামী কাল সকাল পর্যন্ত ওঁর কথা ভুলে যাও। পাগলামীটা সাময়িকও হতে পারে; হয়তো কেটে যাবে। তখন আমাদের অযাচিতভাবে নাকগলানোটা ওর পছন্দ নাও হতে পারে। তাছাড়া, পাগলের ব্যাপারে না থাকাই ভালো। আগামী কালও যদি দেখি পাগলামী কমেনি, এবং আবার এসে যদি বিরক্ত করতে আরম্ভ করেন 'তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো যাবে। এর আগে কোনদিন অসংলগ্ন ব্যবহার করতে দেখেছো ওকে?

“না, বরাবরই ওকে প্রকৃতিস্থ এবং স্বাভাবিকই দেখেছি। তোমার কথামত অপেক্ষা করেই দেখি। তবে আমার মনে হচ্ছে ওর মাথার গর্তটা সম্বন্ধে একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে পারবো।

ওর গল্পটা আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছে, বললে রমাপতি। ভুলে যাবার আগেই গল্পটা লিখে রাখতে হবে। অবশ্য উনি যেমন ভাবে বললেন তেমন ভীতিপূর্ণ ভাবে বর্ণনা করতে পারবো না হয়তো কিন্তু রহস্যটা আংশিকভাবে প্রকাশ করতে পারবো আশাকরি।

কলমের ঢাকনীটা খুলে একখণ্ড সাদা কাগজের ওপর খস্ খস্ করে লিখে যেতে লাগলো রমাপতি। এমন সব শব্দ লিখতে লাগলো যা এর আগে কোনদিন শুনিনি। আমার মনে হলো একটু পরেই সমস্ত কাগজটা অপবিত্র হয়ে যাবে। একটা ঔজ্জ্বল্যহীন আলো ঘিরে থাকবে সেটাকে ভৌতিক আলোর শিখা নাচবে কাগজটার চারপাশে ; বিচিত্র ছায়া এসে অন্ধকারে আবৃত করে ফেলবে লেখাগুলোকে। আর সেই অপার্থিব পরিবেশে রমাপতির মাথা থেকে অন্তহীন প্রবাহের মত বেরিয়ে আসতে থাকবে যত দানবিক কল্পনা, যা কাগজের শুভ্র, মসৃণ তলকে কলুষিত করে তুলবে।

আমি শিউরে উঠলাম। দরজাটা বন্ধ করে দিলাম, তাড়াতাড়ি।

কয়েক মিনিট কাগজের ওপর কলমের খস্ খস্ শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দই শোনা গেল না। পরবর্তী মিনিট কয়েক সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগলো—তারপর শুরু হলে ভয়াবহ চীৎকার। চীৎকার না বলে ভয়াবহ কাতরোক্তি বলাই বোধহয় ঠিক হবে।

বন্ধ দুয়ার ভেদ করে ভেসে আসতে লাগলো সেই কাতর ক্রন্দন। সমুদ্র তীরের ঢেউয়ের গর্জন, বাতাসের কলরোল ছাপিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠলো সেই মর্মভেদী শব্দের দ্যোতনা। রাত্রির সহস্র শব্দকে অতিক্রম করে সেই অপার্থিব শব্দ লহরী কুয়াশা ঘেরা, নির্জন ঘরের মধ্যে এসে আমাদের ভীতিব্যাকুল করে তুলতে লাগলো। মাঝে মাঝে মনে হতে লাগলো শব্দটা যেন ঠিক দরজার ওপাশ থেকেই ভেসে আসছে। একটু থেমে থেমে ভেসে আসছে ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নার সেই হৃদয়বিদারী শব্দ। ভালো করে কান পাতলে বোঝা যায় অ-নে-ক দূর থেকে ভেসে আসছে সেটা। আমরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম শব্দটা আসছে বহু দূরের জঙ্গল থেকে।

“নির্যাতিত আত্মার ক্রন্দন”, গুন্ গুন্ করতে লাগলো রমাপতি। “বেচারা হতভাগ্য অভিশপ্ত আত্মা নারকীয় যন্ত্রণা ভোগ করছে।” অপ্রকৃতিস্থের মত সে উঠে দাড়ালো। চোখ দুটো উত্তেজনায় জ্বলতে লাগলো; ঘন ঘন নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে ওঠা নামা করতে লাগলো বুকটা।
আমি ওর কাঁধটা ধরে ঝাঁকানি দিয়ে বললাম, “গল্পের বিষয় বস্তুর সঙ্গে নিজকে এত নিবিড় করে মিশিয়ে দেওয়া তোমার উচিৎ নয়। কোন হতভাগ্য লোক বিপদে পড়েছে। জানি না কি অবস্থায় সে আছে। কোন জাহাজ ডুবী হয়েছে কিনা তাই বা কে বলতে পারে। ব্যাপারটা ঠিক কি আমাকে জানতেই হবে। আমার মনে হচ্ছে বেচারা আমাদের সাহায্য চায়।

আমার কথার পুনরাবৃত্তি করে রমাপতি বলতে লাগলো, “আমাদের সাহায্য ওর দরকার মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, দরকার তো হবেই। একজনকে নিয়ে তো সন্তুষ্ট হবে না। অনন্ত মহাশূন্যতার ভেতর দিয়ে যে ভয়াবহ ক্ষুধা আর তৃষ্ণা নিয়ে এতো দূর ছুটে এসেছে তা কি আর এত সহজে মিটবে! একটা মানুষ যে সে ক্ষিধে মেটাবার পক্ষে যথেষ্ট নয় এ কথা সহজে কল্পনা করা যায়।”

হঠাৎ ওর মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। চোখের আলো নিভে গেলো, গলার স্বর অস্বাভাবিক হয়ে উঠলো। সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগলো ওর।

“আমাকে মাপ কর”, বললো রমাপতি। “তুমি হয়তো ভাবছো একটু আগে যে লোকটা এসেছিলো আমিও তার মত পাগল হয়ে গেছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আমি যখন লিখি তখন নিজেকে আমার গল্পের চরিত্র গুলোর থেকে আলাদা করে ভাবতে পারি না—আমি একাত্ম হয়ে হয়ে যাই ওদের সঙ্গে। অত্যন্ত ভয়াবহ আর অশুভ কতকগুলো জিনিষের বর্ণনা দিয়েছি আমার লেখার মধ্যে, আর যে হৃদয় বিদারী আর্তনাদের কথা লিখেছি তাও ঠিক মিলে যায় অত্যন্ত বিপদগ্রস্থ কোন আর্ত ক্রন্দনের সঙ্গে।

আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি কিন্তু সে সব আলোচনার সময় এখন নেই। বেচারা লোকটা ভীষণ বিপদে পড়েছে” আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম আমি। রমাপতি দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাড়িয়ে কি যেন চিন্তা করছে। আমি আবার বললাম, “আমাদের উচিৎ লোকটাকে সাহায্য করা।”

“নিশ্চয় সাহায্য করা উচিৎ' বলতে বলতে আমার সঙ্গে রান্নাঘরে এসে ঢুকলো রমাপতি।

নিঃশব্দে আগুণ খোঁচাবার লোহার রডটা আর বড় টুপীটা তুলে দিলাম ওর হাতে।

'তাড়াতাড়ি এটা মাথায় দিয়ে নাও” বললাম আমি। “লোকটার আমাদের সাহায্য এক্ষুনি দরকার। তারপর দরজা ঠেলে দুজনেই বেরিয়ে এলাম ঘন কুয়াশা ঢাকা পথে।

কুয়াশাটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ শীর্ণ আঙ্গুল গুলো যেন বুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের মুখের ওপর দিয়ে। শরীরটা পাকে পাকে জড়িয়ে ধরছে সরীসৃপের মত। মাথার ওপর থেকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নেমে আসছে শরীর বেয়ে। এক একবার সরে যাচ্ছে একটু দূরে, পর মুহূর্তেই আবার এসে ঘিরে ধরছে।

একটু দূরে দেখা যাচ্ছে নিস্তব্ধ গোলাবাড়ী থেকে বেরিয়ে আসা আলোর ক্ষীন রশ্মি। পেছনে শোনা যাচ্ছে সমুদ্রের অশান্ত গর্জন, কুয়াশা থেকে সাবধান করে দেওয়ার বাঁশীগুলো বেজে চলেছে একটানা কেমন যেন ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নার সুরের মত মনে হচ্ছে সেই শব্দ। রমাপতি ওভার কোটের কলারগুলো তুলে দিয়ে কান দুটো ঢেকে নিলো। কানের ডগায় শিশির জমে ফোঁটা জল হয়ে ঝরতে লাগলো। চোখ দুটোতে রহস্যময়তার ইঙ্গিতে, চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠেছে।

অনেকক্ষণ ধরে নিঃশব্দে হেঁটে চললাম আমরা দুজনে। জঙ্গলের কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত রমাপতি মুখ খুললো না।

“দরকার হলে আমাদের জঙ্গলের ভেতরেও ঢুকতে হবে”, বললো রমাপতি।

আমি মাথা নেড়ে ওর কথায় সায় দিলাম। “জঙ্গলে না ঢোকবার কোন কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। জঙ্গলটা এমন কিছু বড়ও নয়।”

“ওখান থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন কাজ নয়।”

“তা অবশ্য ঠিক, ওখান থেকে বেরিয়ে আসা এমন কিছু শক্ত নয়। শুনতে পাচ্ছো তুমি ঐ যে শব্দটা?”

সেই ভয়াবহ আর্তনাদ ইতিমধ্যে অত্যন্ত জোরালো হয়ে উঠেছে।

“লোকটা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে”, বললো রমাপতি। “সত্যি লোকটার যন্ত্রনা চরমে উঠেছে। তুমি কি ভাবছো, আমাদের এই পাগলা বন্ধুটি চীৎকার করছে?”

আমিও ঠিক ঐ কথাই ভাবছিলাম সেই মুহূর্তে।

“আমার তো তাই মনে হচ্ছে”, বললাম আমি। “কিন্তু লোকটা পাগল হয়ে থাকলে আমাদের উচিৎ ওকে সাহায্য করা। আরো কিছু লোকজন আমাদের সঙ্গে নিয়ে আসা উচিৎ ছিলো।”

“কিন্তু কেন নিয়ে এলে না বলতো?” চীৎকার করে বলে উঠলো রমাপতি। “ওকে ধরাধরি করে নিয়ে আসবার জন্য ১০-১২ জন লোকেরও দরকার হতে পারে।” সামনের লম্বা গাছ গুলোর দিকে চেয়ে রইলো, তারপর। আমার মনে হলো যে কাজের জন্য আমরা এসেছি সেটাই বুঝি ভুলে বসে আছে রমাপতি।

আমি বললাম, “এটাই হলো সেই জঙ্গল।” কোন রকমে ঢোক গিলে বুকের ধড়ফড়ানিটা একটু কমাবার চেষ্টা করলাম। বোকার মত বললাম, “জঙ্গলটা তেমন বড় নয়।” “হে ভগবান”, কুয়াশা ঢাকা জঙ্গলের দূরতম প্রান্তের থেকে ভেসে আসতে লাগলো যন্ত্রণা কাতর আর্তনাদ। “ওরা আমার মাথার মধ্যে কুরে কুরে খাচ্ছে। হা ভগবান! ”

সেই মুহুর্তে মনে হলো যেন আমি বুঝি পাগল হয়ে যাবো। রমাপতির হাতটা চেপে ধরলাম জোরে।

“চল, আমরা এখান থেকে পালাই,” ভয়ে চীৎকার করে উঠলাম আমি। “আমরা না বুঝে সুঝে বোকার মত চলে এসেছি। এখানে পাগলামী, যন্ত্রণা আর সম্ভবতঃ মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই নেই।”

“তা হতে পারে। কিন্তু এগিয়ে আমাদের যেতেই হবে।”

মুখটা ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে রমাপতির। চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে। কিন্তু ওর প্রচণ্ড সাহস দেখে আমিও যেন অনেকটা শক্তি ফিরে পেলাম।

বেশ, বললাম আমি। চল যাওয়াই যাক, এগিয়ে।

ধীরে ধীরে গাছের তলা দিয়ে এগোতে লাগলাম আমরা দুজনে। আকাশ ভেদ করে উঠে গেছে গাছের মাথাগুলো। পুরু কুয়াশা মেঘে, কেমন যেন একটা অপার্থিব রূপ ধারণ করেছে সেগুলো। মনে হলো যেন গাছগুলোও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। বাঁকা বাঁকা ডালগুলো থেকে কুয়াশা ঝুলে আছে লম্বা লম্বা ফিতের মত। ফিতের মত বলাটা ঠিক হলো কিনা জানি না—বরং বলা উচিৎ কুয়াশার তৈরী সরীসৃপ—বিষাক্ত সরীসৃপ লকলকে জিভ বার করে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠছে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে কোথাও কোথাও গাছের বিশ্রী ছাল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আবের মত উঁচু উচু হয়ে ফুলে আছে এখানে ওখানে। যেন কোন অতি কুৎসিৎ বৃদ্ধকে দেখেছি চোখের সামনে। টর্চের সামান্য আলোটুকু যেন সব অমঙ্গল থেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। কুয়াশার অন্ধকার ভেদ করে যত এগিয়ে যাচ্ছি যন্ত্রণা কাতর আর্তনাদটা যেন ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একটু পরেই কানে এলো ভাঙ্গা ভাঙ্গা সংলাপ, প্রলাপোক্তি বলাই বোধহয় ঠিক। শেষে শোনা যেতে লাগলো ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নার মৰ্ম্মস্পর্শী শব্দ। উঃ, কি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা… ওরা আমার মাথার ভেতর কুরে কুরে খাচ্ছে। অসহ্য ঠাণ্ডা মাথার মধ্যে! আ...আ..আঃ!

রমাপতি আমার হাতটা চেপে ধরে বললো, ওকে আমাদের খুঁজে বার করতেই হবে। এখন আর ফিরে যাবার কোন উপায় নেই।

লোকটাকে যখন খুঁজে পেলাম তখন ও কাত হয়ে পড়ে আছে। দুহাতে মাথাটা চেপে ধরে আছে, সমস্ত শরীরটা কুঁকড়ে অর্ধেক হয়ে গেছে, হাঁটু দুটো বুকের সঙ্গে প্রায় লেগে আছে। নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে লোকটা। আমরা দুজনে ঝুকে পড়ে ওকে ঝাঁকানি দিলাম, কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই।

লোকটা কি মরে গেলো নাকি? বিকারগ্রস্থ রোগীর মত শোনালো নিজের গলাটা। ইচ্ছে হলো দৌড়ে পালাই ওখান থেকে। চারপাশের গাছগুলো যেন আমাদের ঘিরে ফেলতে চাইছে।

কি জানি হতে পারে, বললো রমাপতি। ঠিক বলতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে লোকটা মরে গেছে। রমাপতি লোকটার জামার ভেতরে হাতটা ঢুকিয়ে দিলো। মুহূর্তের জন্য ওর মুখটা হতাশায় ভরে উঠলো। তারপরই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় নাড়লো রমাপতি।

লোকটা বেঁচে আছে। ওকে কোনরকমে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে শুকনো জামা কাপড় পরিয়ে দেওয়া দরকার, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

আমরা দুজনে মিলে ধরাধরি করে অচৈতন্য দেহটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে গাছের সারির ভেতর দিয়ে হেঁটে চললাম। বার কয়েক হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম। কাঁটা ঝোপের খোঁচায় জামা কাপড় ছিড়ে যেতে লাগলো। বড়বড় গাছগুলোর নির্দেশে কাঁটা ঝোপগুলো ছোটছোট হাত বাড়িয়ে টেনে ধরতে লাগলো আমাদের পোষাকগুলো। পথের নির্দেশ দেবার জন্য একটা তারাও দেখা যাচ্ছে না আকাশের গায়ে, টর্চের আলো ও ক্ষীণ হয়ে আসছে, তবু সেই আলোতেই কোনরকমে পথ দেখে জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে লাগলাম আমরা।

জঙ্গলের সীমানা পেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই শুনতে পেলাম একটা বহুদূরাগত চাপা গর্জন। যেন পৃথিবীর ভেতরে অনেক নীচে অনেকগুলো রেল ইঞ্জিন এক সঙ্গে ছুটতে শুরু করছে। কাঁধের বোঝা নিয়ে আর একটু এগোতেই শব্দটা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো।

ওটা কিসের শব্দ? তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করলো রমাপতি। কুয়াশায় আচ্ছাদন ভেদ করেও দেখতে পেলাম ওর মুখটা পাংশু হয়ে উঠেছে ভয়ে আশঙ্কায়।

কি জানি কিছুই বুঝতে পারছিনে, কোন রকমে জবাব দিলাম আমি। ভীষণ ভয়ঙ্কর কিছু ঘটছে বলে মনে হচ্ছে। এ রকম শব্দ আমি জীবনে আর কোনদিন শুনিনি। আর একটু জোরে পা চালাতে পারছো না?

এতক্ষণ ভয় আর উৎকণ্ঠার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছিলো আমাদের, কিন্তু এবার যে শব্দটা ভেসে আসতে লাগলো জঙ্গলের ভেতর থেকে তার কোন তুলনাই চলে না। ওরকম শব্দ আমরা কেউ কোনদিন শুনিনি পৃথিবীতে। চরম উদ্বেগে আমি পাগলের মত চীৎকার করে উঠলাম। আরো জোরে পা চালাও রমাপতি, আরো জোরে! যত তাড়াতাড়ি পারি এই জায়গাটা পার হয়ে যেতেই হবে আমাদের!

এমন সময় লোকটার অসাড় দেহটা মোচড় দিয়ে উঠলো আমাদের কাঁধের ওপর, তারপর তার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো কাটা কাটা কথা : “ওপরের দিকে চেয়ে গাছের মাথাগুলো দেখতে দেখতে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটছিলাম। গাছগুলো এতো লম্বা যে মাথাগুলো প্রায় দেখাই যাচ্ছিলো না। হঠাৎ মনে হলো গাছের ওপর থেকে কি যেন একটা পড়লো আমার কাঁধের ওপর। মনে হলো অতিশীর্ণ একটা পা, পাকাচ্ছে, মোচড় খাচ্ছে কেঁচোর মত। কিন্তু সত্যিকারের পা সেটা নয়— কুয়াশা দিয়ে তৈরী পা। ধীরে ধীরে সেটা আমার মাথার মধ্যে ঢুকে গেলো। আমি গাছগুলোর কাছ থেকে ছুটে পালাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। পা দুটো আমার যেন মাটির সঙ্গে আটকে গেলো। এত বড় জঙ্গলে আমি একা, আমার মাথার সঙ্গে ঢুকে গেছে কুয়াশার সেই পাটা; আর একবার মরিয়া হয়ে পালাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মনে হলো গাছগুলো সব আমাকে ঘিরে ফেলেছে, পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে আমার। মাথায় আমার একটা ফুটো করে ফেলেছে ভেতরে ঢোকবার জন্য। আমার মস্তিষ্কটাই ওর একমাত্র কাম্য। মাথার ভেতর ঢুকে একটু একটু করে শুষে নিচ্ছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি। উঃ বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে মাথার ভেতরটা, মাছির ডাকের মত ক্ষীণ একটা ভোঁ ভোঁ শব্দ করছে জিনিষটা আমার মাথার ভেতরে। আমি জানি, ওটা মাছিও নয়, হাত-পা কিছুই নয়। অশরীরী একটা জিনিষ—কোনো তুলনা আমি খুঁজে পাচ্ছি না জিনিষটার। জিনিষটাকে দেখা যাবে না, আমিও দেখতে বা বুঝতে পারতাম না যদি না ওটা আমার মাথায় ফুটো করে ভেতরে ঢুকে পড়তো। যদি দেখতে পান, বা জিনিষটাকে উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে বুঝবেন যে ওটা আবার কাউকে আক্রমণ করার জন্য তৈরী হচ্ছে—আবার কারও মাথায় ঢুকতে চাইছে, নরম মস্তিষ্কটা কুরে কুরে খাবার জন্য।

আপনি হাঁটতে পারবেন? ও মশায় পারবেন?

রমাপতি ভদ্রলোকের পা দুটো ছেড়ে দিয়ে, জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। বেচারা ঐ ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘেমে উঠেছে, অতবড় বোঝাটা বয়ে আনতে গিয়ে।

লোকটা বললো, পারবো। কিন্তু এখান থেকে পালিয়েও কোন লাভ হবে না আর। ওরা আমার মাথার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আমার আর রক্ষে নেই। আপনারা পালান এখান থেকে, যদি বাঁচতে চান।

চল রমাপতি আমরা দৌড়তে আরম্ভ করি, আর্তনাদের মত শোনালো নিজের গলাটা।

এইটাই হয়তো আমাদের একমাত্র সুযোগ, রমাপতিও চীৎকার করে বলে উঠলো। আপনি আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসুন, বুঝতে পারছেন আমি কি বলছি? ওরা আপনাকে ধরতে পারলে আপনার মাথার মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দেবে, সুতরাং ছুটতে থাকুন। আমাদের পেছন পেছন আসুন!

কুয়াশার ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলো রমাপতি।

চীৎকার করতে করতে দৌড়াতে আরম্ভ করল সে। মৃত্যুর চেয়েও প্রচণ্ড ভয়াবহতা আমাকে এসে ছেয়ে ফেললো। কর্ণবিদারী চীৎকার বেজে চলেছে আমার কানে, কিন্তু মুহূর্তের জন্য আমি চলবার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। তারপর, অন্ধের মত কুয়াশার মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে ছুটতে সুরু করলাম।

হায়, হায়। আমার বন্ধু বোধহয় পড়ে রইল, রমাপতি হঠাৎ চীৎকার করে বলে উঠলো।

আমাদের আবার পিছনে ফিরে যেতে হবে। মৃত্যুই হোক বা তার চেয়ে ভয়াবহ কিছুই আসুক ওকে ফেলে যাওয়া চলবে না কোন মতেই।

আমি পিছন থেকে বললাম, আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি ঠিক আছি। তোমরা থেমে যেও না, ছুটতে থাকো।

দারুণ উৎকণ্ঠায় ছুটে চললাম আমিও। একটু পরেই রমাপতির পাশে এসে পড়লাম। ও হাত বাড়িয়ে আমার হাতটা চেপে ধরে নিলো।

ব্যাপারটা কি বলতো? আমি প্রশ্ন করলাম। কিসের ভয়ে আমরা পালাচ্ছি এখান থেকে?

সেই ভয়াবহ শব্দটা এবার আর শুধু পেছনে নয় চারিদিক থেকে শোনা যেতে লাগলো, তবে আগের মত তত জোরে নয় এখন আর। “তাড়াতাড়ি চলতে আরম্ভ কর, নইলে আর রক্ষে নেই আমাদের!” পাগলের প্রলাপের মত শোনালো রমাপতির গলাটা। “সব বাঁধন ভেঙ্গে ওরা বেরিয়ে আসছে। ঐ যে গুন্ গুন্ শব্দ শোনা যাচ্ছে ওটা আমাদের সাবধান করে দিচ্ছে। আমাদের উপলব্ধি করার শক্তি আছে, তাই বুঝতে পারছি। শব্দটা জোরে হোলে এতক্ষণ আর আমরা এখানে জীবিত অবস্থায় থাকতাম না। জঙ্গলের কাছে ওদের শক্তি বেশী, কিন্তু এতদূর থেকে ও তা আমরা বেশ টের পাচ্ছি। ওরা বোধ হয় পরীক্ষা করে দেখছে কোন দিক দিয়ে বেরোবার পথ পাওয়া যায়। একটু পরেই যখন ওরা পথ খুঁজে পাবে, ছড়িয়ে পড়বে চতুর্দিকে। ওঃ, কোন রকমে যদি একবার গোলাবাড়ীটাতে পৌছে যেতে পারি—

আমরা ঠিক পৌছে যাবো। আমি সাহস দিলাম রামপতিকে। ঘন কুয়াশা ভেদ করে অবিশ্রান্তভাবে ছুটে চলেছি তখনও।

“ভগবান আমাদের সাহায্য করুন, কিন্তু যদি না পৌঁছাতে পারি! আপন মনেই বলে উঠলো রমাপতি। গায়ের কোটটা খুলে ফেলে দিয়েছে। ভিজে জামাটা লেপ্টে গেছে ওর শীর্ণ দেহের সঙ্গে। জমাট অন্ধকারের ভেতর লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটে চলছে সামনের দিকে। অনেকদূরে শুনতে পাচ্ছি সেই লোকটার যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠস্বর। সাবধানী বাঁশীগুলো ইনিয়ে বিনিয়ে বেজেই চলেছে একটানা ; কুয়াশা পাকিয়ে পাকিয়ে নেমে আসছে আমাদের গ্রাস করতে।

গুন গুণ শব্দটা তেমনি একটানা বেজেই চলেছে। এই অন্ধকারের মধ্যে গোলবাড়ীর দরজাটা যে খুঁজে পাবো একথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছে না মন। কিন্তু তবু একসময় আমরা সেটা খুঁজে পেলাম, হোঁচট খেয়ে কোন রকমে ঘরের মধ্যে ঢুকেই আনন্দে চীৎকার করে উঠলাম।

চীৎকার করে উঠলো রমাপতি, দরজাটা বন্ধ করে দাও।

আমি দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।

“এখানে আমরা নিরাপদ বলেই মনে হয়। ওরা এখনও এসে পৌঁছতে পারেনি।”

কিন্তু লোকটার কি হয়েছে বলতো? হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলাম। মেঝের ওপর ভিজে পায়ের দাগ দেখতে পেলাম। দাগগুলো রান্নাঘরের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেছে। রমাপতিও দাগগুলো দেখতে পেয়েছিলো। ওর দু’চোখে একটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠলো।

বিড় বিড় করে বললো, যাক, লোকটা নিরাপদে এসে পৌঁচেছে এখানে। আমার ভয় হয়েছিলো ওর জন্যে। হঠাৎ ওর চোখে মুখে একটা অন্ধকার ছায়া নেমে এলো। রান্নাঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না সেখান থেকে।

কোন কথা না বলে রমাপতি ঘরপার হয়ে সেই অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমি একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। চোখ থেকে জলের ফোঁটাগুলো ঝেড়ে ফেললাম, ভিজে চুলগুলোকে ঠিক করে নিলাম। কয়েক মুহূর্ত বসে, জোরে জোরে নিশ্বাস নিলাম। ঠিক সেই সময়তেই কপাট খোলার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে চমকে উঠলাম। সমস্ত শরীরটা কেঁপে উঠলো। পরক্ষণেই মনে পড়লো রমাপতির সেই আশ্বাস, ওরা এখনও এখানে এসে পৌঁছাতে পারেনি। এখানে আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ।

কেন জানি না রমাপতির কথায় আমি আশ্বস্ত হয়েছিলাম। ও বুঝতে পেরেছিলো যে একটা নতুন এবং অজানিত বিপদ আমাদের তাড়া করেছে, এবং কোন অতিলৌকিক উপায়ে রমাপতি সেই বিপদের গুরুত্ব এবং তার সীমাবদ্ধতাটুকুও বুঝে নিয়েছে।

তবু একথা স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে অন্ধকার রান্নাঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসা ভয়াবহ আর্তনাদটা কানে আসতেই রমাপতির আশ্বাস যেন কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেলাম। চাপা একটা আর্তনাদ, মানুষের গলা দিয়ে যে ওরকম শব্দ বেরোতে পারে বিশ্বাস হতে চায় না। রমাপতির গলাটা আস্তে আস্তে চড়তে লাগলো। আমি বলছি, আপনি ছেড়ে দিন আমাকে! আপনি কি একেবারে উন্মাদ হয়ে গেছেন? শুনুন, শুনছেন, আমরা আপনার জীবন বাঁচিয়েছি! বলুন বাঁচাইনি—লোকটা চীৎকার করতে লাগলো “পা-টা, আমার পা-টা কোথায়!”

রমাপতি রান্নাঘরের থেকে বাইরে আসতেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। পা থেকে মাথা পর্যন্ত রক্তমাখা, মুখটা ছাইয়ের মত সাদা হয়ে উঠেছে।

আপন মনেই গুন গুন করে বলতে লাগলো, “লোকটা একেবারে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। কুকুরের মত চার হাত পায়ে হাঁটছিলো। আমি কাছে যেতেই লাফিয়ে পড়লো আমার ওপর। আর একটু হলে আমাকেই মেরে ফেলতো। কোন রকমে ওকে কাবু করেছি, কিন্তু এমন কামড়ে দিয়েছে আমাকে। মুখে এক ঘুসি মারলাম—অজ্ঞান হয়ে গেলো বেচারা। হয়তো লোকটাকে রাগে খুনই করে ফেলতাম। মনুষত্বটুকুও হারিয়ে ফেলেছে—বাধ্য হয়েই, নিজেকে রক্ষে করার জন্য মারতে হলো ওকে।

রমাপতিকে সোফাতে শুইয়ে দিয়ে আমি ওর পাশে বসলাম, কিন্তু ও আমার সাহায্য নিতে অস্বীকার করলো।

আমার সঙ্গে বক বক করো না! আদেশের সুরে বললো আমাকে। তাড়াতাড়ি একটা দড়ি নিয়ে এসো, আর লোকটাকে বেঁধে ফেল। আবার যদি জ্ঞান ফিরে আসে তাহলে আমাদের কঠিন লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হবে ওর হাত থেকে বাঁচবার জন্যে।

তারপরের ঘটনা আজ আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মত মনে হয়। আবছা আবছা মনে পড়ে, আমি দড়ি নিয়ে রান্নাঘরের ভেতর ঢুকলাম। তারপর বেচারা লোকটার অচৈতন্য দেহটা একটা চেয়ারের সঙ্গে ভালো করে বেঁধে ফেললাম। শেষে, স্নান করে নেবার পর রমাপতির কাটা জায়গাগুলো ভালো করে বেঁধে দিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে আগুনের ধারে বসলাম। মনে পড়ছে, ডাক্তারকে টেলিফোনে খবর পাঠালাম। কিন্তু তারপরে ঘটনাটা ঠিক মত স্মরণে আনতে পারছি না, আজ আর। যতক্ষণ না ডাক্তার এসে পৌছলেন ততক্ষণ যে কিভাবে কাটিয়ে ছিলাম জানি না। দীর্ঘ দেহী, গম্ভীর প্রকৃতির ডাক্তারের সহানুভূতিপূর্ণ চোখ দুটি যেন নূতন আশা জাগালো মনে।

রমাপতিকে পরীক্ষা করে দেখলেন। বললো যে আঘাত এমন কিছু গুরুতর নয়। তারপর সেই লোকটাকে পরীক্ষা করে দেখবার পর গম্ভীর হয়ে গেলেন। আস্তে আস্তে বললেন, ভদ্রলোক অত্যন্ত অসুস্থ। সম্ভবতঃ মাথার রোগ। এক্ষুনি অপারেশান করা দরকার। অবশ্য আপনাদের কাছে খোলাখুলি বলে দেওয়া ভালো যে ওকে বাঁচানো সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না।

ওর মাথায় যে ক্ষত চিহ্নটা দেখছেন ডাক্তারবাবু, ওটা কি গুলিতে হয়েছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

বিস্মিত কণ্ঠে জবাব দিলেন ডাক্তার, আমারও আশ্চর্য লাগছে! অবশ্য ক্ষতস্থানটা দেখে তো মনে হচ্ছে ওটা গুলি লেগেই হয়েছে, কিন্তু এতক্ষণে তো কিছুটা ছোট হয়ে আসা উচিৎ ছিলো গর্তটা। গর্তটা সোজা একেবারে মাথার ভেতরে চলে গেছে। আপনারা বলছেন এ সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। আমি না হয় আপনাদের কথাই বিশ্বাস করলাম, কিন্তু আমার মনে হয়, পুলিশকে এক্ষুনি খবর দেওয়া দরকার। কাউকে না কাউকে নরহত্যার দায়ে পড়তেই হবে, যদি না প্রমাণ হয় যে উনি নিজেই এর জন্যে দায়ী। আপনাদের কথা শুনে আমি তো অবাক হয়ে গেছি। এই অবস্থায় ভদ্রলোক কয়েক ঘণ্টা ধরে ছুটে এখানে এসেছেন এটা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। দেখে মনে হচ্ছে ক্ষতস্থানটাতে ওষুধপত্রও লাগানো হয়েছে আগে। কোথাও কোন রক্তের দাগ পর্যন্ত নেই।

ধীরে ধীরে পায়চারী করতে লাগলেন উনি। “অপারেশন এক্ষুনি করা দরকার—এবং এখানেই। যদিও বাঁচবার আশা কম। সৌভাগ্যবশতঃ কয়েকটা যন্ত্রপাতি আমি সঙ্গে করেই এনেছি। আসুন এই টেবিলটা পরিষ্কার করে ফেলি—আপনি আলোটা ধরে থাকতে পারবেন তো?

মাথা নেড়ে বললাম, চেষ্টা করবো।

বেশ, তাহলেই হবে।

ডাক্তার যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক করতে লেগে গেলেন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম পুলিশকে ফোনে ডাকবো কিনা।

অনেকক্ষণ ভেবে বললাম, আমার বিশ্বাস, লোকটা নিজেই মাথায় গুলি করছে। রমাপতি বললো, অপারেশানটা হয়ে যাওয়া পর্যন্ত পুলিশে খবর দেবার দরকার নেই।

“বেশ!”

“অপারেশন এর পর যদি লোকটা মারা যায় তাহলে ওর মৃতদেহটাকে নিয়ে আর টানা হ্যাঁচড়া করার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।”

ডাক্তার মাথা নাড়লেন। “কথাটা অবশ্য ঠিকই বলেছেন। আগে তো অপারেশানটা হয়ে যাক তারপর ঠিক করা যাবে কি করবো?

রমাপতি কোচ এ বসে বসে হাসছিলো। “পুলিশ আনতে চাইছে, কিন্তু জঙ্গলের ঐ অশরীরী জিনিষ গুলোর বিরুদ্ধে পুলিশ কি করবে?”

ওর কথার মধ্যে কেমন যেন একটা ব্যঙ্গের সুর ছিলো, যেটা আমার কানে লাগলো। একটু আগেই কনকনে ঠাণ্ডা কুয়াশার মধ্যে যে ভয়াবহতা উপলব্ধি করেছিলাম, বৈজ্ঞানিক যুক্তি সম্পন্ন ডাক্তারের সান্নিধ্যে এসে সেটা এখন আর বিশ্বাসই হতে চাইছে না। তাছাড়া, ঘটনাটা মনে করবার চেষ্টা ও করছিলাম না, আর।

ডাক্তার তার যন্ত্রপাতি গুলো থেকে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে ফিস ফিস করে বললেন, “আপনার বন্ধুর জ্বরটা একটু বেশী আছে বোধ হয়, এবং সেই জন্যেই প্রলাপ বকছেন। আপনি এক গ্লাস জল নিয়ে আসুন আমি তাতে জ্বর কমাবার ওষুধ মিশিয়ে দিচ্ছি।”

আমি জল আনতে চলে গেলাম, একটু পরে জল নিয়ে ফিরে এসে দেখি রমাপতি নাক ডেকে ঘুমুতে আরম্ভ করেছে।

“আচ্ছা এবার আসুন” বলেই ডাক্তার আমাকে বাতিটা হাতে গুঁজে দিলেন। “আপনি আলোটা ভাল করে ধরুন, আমি যখন যেদিকে বলবো ঘোরাবেন।”

টেবিলের ওপর শোয়ানো রয়েছে সেই ভদ্রলোকের অচৈতন্য দেহটা। সমস্ত শরীরটা রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। লোকটার একটু আগের অবস্থা চিন্তা করে সারা দেহ কেঁপে উঠলো আমার। ডাক্তার যতক্ষণ কাটাছিটে করবেন ততক্ষণ আমাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে দেখতে হবে। ডাক্তার মাথার খুলিটা খুলে ফেলবেন লোকটার, তারপর কোন অবর্ণনীয় দৃশ্য আমাকে দেখতে হবে কে জানে।

অভ্যস্ত এবং অভিজ্ঞ আঙ্গুল দিয়ে ডাক্তার অজ্ঞান করার ওষুধ দিয়ে দিলেন। আমার মনের মধ্যে একটা অপরাধ বোধ জেগে উঠতে লাগলো ; মনে হলো আমরা একটা কোন জঘন্য অপরাধ করতে চলেছি। লোকটা সেরে উঠলে আমাদের এই কাজটা নিশ্চয়ই সমর্থন করবে না। বরং হয়তো বলবে এর চেয়ে তার কাছে মৃত্যুই ভালো ছিলো। একটা জীবিত মানুষের মস্তিষ্কটা হাত দিয়ে অপরিচ্ছন্ন করে ফেলা সত্যিই ভয়ানক জিনিষ। কিন্তু, তবু ডাক্তারের কাজে বাধা দেওয়া আমার ক্ষমতার বাইরে, এবং সমালোচনার ও উর্ধে। তার জীবিকার নীতি অনুযায়ী ঐ অবস্থায় অপারেশান করাই একমাত্র কর্তব্য।

“আমরা তৈরী। আলোটা একটু নামিয়ে সাবধানে ধরুন।” বললেন ডাক্তার।

তার অভ্যস্ত আঙ্গুলে ছুরিটা যন্ত্রের মত কাজ করে যেতে লাগলো। এক মুহূর্তের জন্য আমি চাইলাম সেদিকে তারপর সঙ্গে সঙ্গেই মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ঐ টুকুর মধ্যেই যা দেখলাম তাতে আমি অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম। মনে হলো অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবো তক্ষুনি। হয়তো ওটা আমার মনের ভুল, কিন্তু অসুস্থ রোগীর মত দৃষ্টি নিয়ে দেওয়ালের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো যেন ডাক্তার ও চরম বিস্ময়ে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর মুখ থেকে কোন শব্দ না বেরোলে ও আমি যেন উপলব্ধি করতে পারছিলাম যে তিনি ভয়ঙ্কর, অবর্ণনীয় একটা কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছেন।

“আলোটা একটু নামিয়ে ধরুন”, বললেন ডাক্তার। তার গলাটা কেমন কর্কশ শোনালো। মনে হলো যেন কণ্ঠনালীর একেবারে শেষ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে কথাগুলো। কথাগুলো শুনে একটা অজানিত ভয় এসে গ্রাস করলো আমাকে। মনে হলো বিরাট একটা প্রতারনা করে ফেলেছি আমি। মাথা না ঘুরিয়েই আমি আলোটা সামান্য একটু নামালাম। ডাক্তারের কাছ থেকে কর্কশ কণ্ঠের একটা ধমক আশা করে রইলাম, কিন্তু তিনি টেবিলের ওপর শোয়ানো লোকটার মতই নীরব হয়ে রইলেন। চোখে না দেখলে ও তার আঙ্গুল গুলোর নাড়াচাড়া শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম।

হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমার হাত কাঁপছে। ইচ্ছে হলো আলোটা নামিয়ে রাখি ; মনে হলো আর ওটা ধরে রাখা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে।

মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার কাজ শেষ হয়ে গেছে ডাক্তার?”

“আলোটা ঠিক করে ধরুন!” দাঁতে দাঁত চেপে আদেশের সুরে বললেন ডাক্তার! “আপনি যদি আলোটা আবার নাড়াচাড়া করেন তাহলে আমি সেলাই করে উঠতে পারবো না। তাহলে এই অবস্থায় রোগীকে রেখেই আমি চলে যাবো, আর লোকটা টেবিলের ওপর পড়ে থেকে পচতে থাকবে। এর জন্য যদি আমার ফাঁসী ও হয় তাতে ও আমি পরোয়া করি না। আমি ভূত প্রেত, ঝাড়াবার ওঝা নই!”

কি করবো ঠিক করে উঠতে পারলাম না। বাতিটা ও ধরে রাখতে পারছি না আর, তার ওপর আবার ডাক্তারের ভীতি প্রদর্শন আমাকে ভীষণ ভাবিয়ে তুলেছে। শেষে মরিয়া হয়ে বলেই ফেললাম।

“আপাততঃ যা করার করুণ। যদি পারেন বেচারাকে বাঁচিয়ে তুলতে চেষ্টা করুণ। লোকটা সত্যিই ভালো।”

কয়েক মুহূর্তের জন্য নীরবতা বিরাজ করতে লাগলো সেখানে। আমি ভাবলাম ডাক্তার বোধ হয় আমার কথায় কর্ণপাত করা প্রয়োজন মনে করলেন না। ভাবলাম হাতের ছুরি, স্পঞ্জ এসব ফেলে দিয়ে এক্ষুনি চলে যাবেন। কিন্তু একটু পরেই আবার ছুরি চালানোর শব্দ পেয়ে বুঝলাম যে তিনি বেচারা লোকটাকে কোন রকমে সারিয়ে তুলতে মনোনিবেশ করেছেন আবার।

মধ্য রাত্রি পার হয়ে যাবার পর এক সময় ডাক্তার আমাকে আলোটা নামিয়ে রাখতে বললেন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলাম, তার পরই যে দৃশ্য দেখলাম তা কোন দিনই ভুলবো না। এইটকু সময়ের মধ্যে মনে হলো ডাক্তারের বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে। চোখের নীচেয় কালচে রেখা পড়েছে। ঠোট ঝুলে পড়েছে, কপালে দেখা দিয়েছে বলিরেখা, যার কোন চিহ্নই ছিলো না কিছুক্ষণ আগে ও। গলার স্বর কেমন কর্কশ এবং ক্ষীন হয়ে গেছে।

“ভদ্রলোক বাঁচবেন না”, বললেন তিনি। “ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই মারা যাবেন। আমি ওর মস্তিষ্কটা স্পর্শ ও করিনি। মানে কিছুই আমি করতে পারিনি। আমি মাথার ভেতরটা দেখেই আবার সঙ্গে সঙ্গে সেলাই করে দিলাম।”

“কি দেখলেন মাথার ভেতর?” ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলাম তাকে।

অবর্ণনীয় একটা ভয়ের ভাব ফুটে উঠলো ডাক্তারের চোখে মুখে। “দেখলাম—আমি দেখলাম”—বলতে বলতে গলা ধরে এলো, সমস্ত শরীর শিউরে উঠতে লাগলো—“দেখলাম—ওঃ সেই জ্বলন্ত গ্লানিময় দৃশ্য আমি বর্ণনা করতে পারছি না—যা দেখলাম—কোন মানুষ যেন সে দৃশ্য কোনদিন দেখে—আমার নিজের মধ্যেও দেখলাম পাশবিকতার ছাপ। আমি চিরকালের জন্য কলঙ্কিত হয়ে গেলাম। আমি দুষিত হয়ে গেছি। এ বাড়ীতে আর আমি থাকতে পারছি না। এক্ষুনি আমার এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার।

দুঃখে হতাশায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন। সমস্ত দেহ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠতে লাগলো।
আপন মনেই গুণ গুণ করতে লাগলেন তিনি, কলঙ্কময় হয়ে গেলাম, আমি। বহুযুগের পুরানে, যে ভয়াবহ গোপন তথ্য মানুষ ভুলে গেছে—কি ভয়ঙ্কর সে দৃশ্য। নিরাকার সেই পাপ; অশরীরী অমঙ্গল।

হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে চারিদিকে চাইতে লাগলেন।

“ওরা এখানে আসবে এই লোকটিকে দাবী করবার জন্য! কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন ডাক্তার। ওদের চিহ্ন এর সারা দেহ আঁকা রয়েছে এবং এরই জন্যে ওরা আসবে এখানে। আপনারা এখানে থাকবেন না। এই বাড়ীটা ধ্বংস হবেই!

নিরাশ চোখে আমি ওঁর দিকে চেয়ে রইলাম। উনি অসংলগ্নভাবে টুপি আর ওষুধের বাক্সটা নিয়ে দরজা পার হয়ে বাইরে চলে গেলেন। ঘন কুয়াশার মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য ছায়ার মত দেখা গেলো তাকে- তারপর তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

পেছন ফিরে চীৎকার করে গেল “আমার সাবধান বানী মনে রাখবেন।”

ইতিমধ্যে রমাপতি ঘুম থেকে জেগে উঠে চোখ রগড়াতে আরম্ভ করেছে।

“এটা একটা ঘৃন্য কৌশল!” আপন মনেই বলতে লাগলো রমাপতি। ইচ্ছে করে জলের সঙ্গে ওষুধ মিশিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলো। ও যদি একবার বুঝতে পারতাম যে গেলাসটাতে।

এখন কেমন বোধ করছো? কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তুমি উঠে হাটতে পারবে, এখন?

তুমিই আমাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিলে, আবার এখন জিজ্ঞেস করছো হাঁটতে পারবে কিনা! তুমি অত্যন্ত অসঙ্গত কাজ করছো। যাই হোক, ব্যাপারটা কি এবার খুলে বলতো।

আমি আঙ্গুল দিয়ে টেবিলের ওপর শোয়ানো লোকটার নিশ্চল দেহটা দেখিয়ে দিলাম, নিঃশব্দে। জঙ্গলটা এখন নিরাপদ, বললাম আমি। ওরা বেচারাকে গ্রাস করে ফেলেছে।

রমাপতি লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে ঝাঁকানি দিলো।

“তুমি কি বলছো?” চীৎকার করে উঠলো সে। “তুমি এসব জানলে কেমন করে?”

আমি বললাম, “ডাক্তারই ওর মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে দেখলেন। তিনি ওর মস্তিষ্কে এমন কিছু দেখলেন যা তঁর দেখা উচিৎ ছিলো না—যা তিনি বর্ণনা পৰ্যন্ত করতে পারলেন না। তবে তিনি বলে গেলেন ওরা আসবে, এরই জন্যে, তার কথা অবিশ্বাস করার কোন কারণ আমি খুঁজে পেলাম না।”

রমাপতি অস্থিরভাবে চীৎকার করে উঠলো, “আমরা এক্ষুনি এখান থেকে পালাব। তোমার ডাক্তার ঠিক কথাই বলেছে। আমরা মারাত্মক বিপদের মধ্যে রয়েছি। বরং ঐ জঙ্গলটা এখন আমাদের পক্ষে নিরাপদ। তোমার লঞ্চটা তো ওখানে বাঁধা আছে!”

“হ্যাঁ, লঞ্চটা ওখানেই আছে?” আমি জবাব দিলাম, ক্ষীন একটা আশা জাগলো মনে।

“কুয়াশাটাই আমাদের পক্ষে সবচেয়ে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে,” বললো রমাপতি। “তবু এখানে এই ভয়াবহ বিপদের মধ্যে না থেকে সমুদ্রে গিয়ে মরাই ভালো।”

বাড়ী থেকে ডক্‌ খুব বেশী দূরে নয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা গিয়ে লঞ্চে উঠে বসলাম। সঙ্গে সঙ্গে লঞ্চের ইঞ্জিন গর্জন করে উঠলো। কুয়াশার সাবধানী বাঁশীগুলো একটানা বেজেই চলেছে, কিন্তু বন্দরের কোথাও সামান্য আলোর চিহ্নও নেই। সামনে দু'ফুট দূরে পর্যন্ত দৃষ্টি চলে না, এমন ঘন কুয়াশা। ঘন অন্ধকারে সাদা কুয়াশার সরীসৃপ গতি আবছা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তার পেছনে বিস্তৃত রয়েছে অনন্ত রাত্রি, আলোকহীন, ভয়াবহতায়পূর্ণ।

রমাপতি বললো, “মনে হচ্ছে মৃত্যু যেন নীরবে প্রতীক্ষা করছে ওখানে।”

ইঞ্জিনটা চালু করতে করতে আমি জবাব দিলাম, “এখানেও কি মৃত্যুর চেয়ে কম ভয়াবহতা অপেক্ষা করে আছে। কোন রকমে পাথরগুলো এড়িয়ে যেতে পারলে হয়। বাতাসের জোর তেমন নেই অবশ্য, তাছাড়া বন্দরের অবস্থানও আমার অজানা নয়।”

রমাপতি বললো, “সাবধানী বাঁশীগুলো অবশ্য আমাদের পথ চিনে নিতে সাহায্য করবে। নিরাপদে সমুদ্রে গিয়ে পড়তে পারলে নিশ্চিত
হবে।

আমি ওর কথায় সায় দিলাম।

“ঝড় উঠলে কিন্তু লঞ্চটা কতক্ষণ ঠিক থাকবে কে জানে। তাহলেও বন্দরে একটু থাকবার ইচ্ছে নেই আমার। বরং সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছাতে পারলে কোন জাহাজ হয়তো আমাদের তুলে নিতে পারে। ঐ অশরীরী জিনিষগুলো যেখানে পৌছাতে পারে সেখানে থাকা আমাদের পক্ষে কোনমতেই নিরাপদ নয়।”

“ওরা কতদূর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তাই বা আমরা জানবো কেমন করে?” আপন মনেই বলতে লাগলো রমাপতি। “মহাশূন্যের অনন্ত দূরত্ব পার হয়ে এসেছে, তাদের কাছে পার্থিব এই দূরত্বটুকু আর কি? সমস্ত পৃথিবী ছেয়ে ফেলতে পারে ওরা। ওরা আমাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলতে পারে।”

আমি চীৎকার করে বললাম, “ওসব আলোচনা পরে করা যাবে। আমরা ওদের সান্নিধ্য থেকে যতদূরে চলে যেতে পারি ততই মঙ্গল। সম্ভবতঃ ওরা এখনও সর্বত্র যাতায়াতের পথ খুঁজে পায়নি! যতক্ষণ ওদের সেই সীমাবদ্ধতাটুকু অটুট থাকবে ততক্ষণই আমরা নিরাপদে পালাবার সুযোগ পাবো।”

খালের ভেতর দিয়ে আস্তে আস্তে চলতে লাগলো আমাদের লঞ্চ। লঞ্চের গায়ে এসে লাগা জলের ছল্ ছল্ শব্দ মন খুশীতে ভরে তুললো। আমি রমাপতিকে ষ্টীয়ারিং হুইলটা ধরতে বললাম।

“ঠিক করে চালাবে,” চেঁচিয়ে বললাম আমি। “এখন আমাদের আর কোন বিপদের সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না!”

মিনিট কয়েক অমি ইঞ্জিনটার ওপর উবুড় হয়ে শুয়ে রইলাম। রমাপতি ধীর গতিতে চালিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো লঞ্চটা। হঠাৎ একসময় আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, “মনে হচ্ছে যেন কুয়াশা একটু একটু করে সরে যাচ্ছে।”

আমি নিঃশব্দে সামনের সীমাহীন অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলাম। এখন অবশ্য কুয়াশাটা আগের মত যন্ত্রনাদায়ক মনে হচ্ছে না আর। পাকিয়ে পাকিয়ে ওঠা কুয়াশার কুণ্ডলী আবছা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। লঞ্চের মুখ ঠিক রেখে, আবার আমি চীৎকার করে বললাম। “ভাগ্য আমাদের ভালো। কুয়াশা আর একটু পরিষ্কার হয়ে গেলেই খালের মুখ দেখতে পাবো। জঙ্গলের দিকে যে আলোটা আছে সেটার দিকে লক্ষ্য রেখো।”

তাড়াতাড়ি উঠে বললাম, “ষ্টিয়ারিংটা আমার হাতে দাও। এইখানে খালটা খুব সরু হয়ে গেছে, কিন্তু আশা করছি এটাও আমরা সফল ভাবেই পেরিয়ে যেতে পারবো।” আনন্দে, উত্তেজনায়, যে ভয়াবহতাকে পিছনে ফেলে এলাম তার কথা আমাদের মনে রইলো না। স্টিয়ারিং হুইলটা ধরে দাঁড়িয়ে চতুর্দ্দিকে চেয়ে হাসতে লাগলাম। অর্ধনিমজ্জিত পাথরগুলো একটু একটু করে এগিয়ে আসতে লাগলো সামনের দিকে।

আমি চীৎকার করে উঠলাম, “আমরা নিশ্চয়ই সফল হবো!”

কিন্তু রমাপতির তরফ থেকে কোন জবাব এলো না। হাঁপানোর আর ঢোক গেলার শব্দ শুনতে পেলাম।

“কি হলো, রমাপতি?” জিজ্ঞেস করতে করতে ওর দিকে মুখ ফেরাতেই দেখলাম ভয়ে কুঁকড়ে গেছে বেচারা। আমার দিকে পিছন ফিরে ছিলো, কিন্তু তবু আমি বুঝতে পারছিলাম কোন দিকে চেয়ে আছে রমাপতি।

অনেক দূরে ছেড়ে আসা তীরভূমিকে সূর্যাস্তের সময়কার উজ্জ্বল রেখার মত মনে হচ্ছে। জঙ্গলে আগুন লেগেছে। লম্বা লম্বা গাছের মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে আগুনের লেলিহান শিখা। ঘন কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। ধোঁয়ার আড়ালে বন্দরের সব আলো গুলো ঢাকা পড়ে গেছে।

আগুন বা ধোঁয়া দেখে যে চীৎকার করে উঠলাম তা নয়। গাছের মাথায় দেখতে পেলাম, সেই বিশাল, নিরাকার আকৃতিটা আকাশের এপাশ থেকে ওপাশ যাতায়াত করছে। সেটা দেখেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলে ভয়ে।

আমি বিশ্বাস করতে চাইলাম না, ভাবতে চেষ্টা করলাম কিছুই আমি দেখিনি। ভাবতে চেষ্টা করলাম, ওই আগুনের আর ধোয়ার সৃষ্টি ঐ মূর্তিটা। হাসবার চেষ্টা করলাম জোর করে, আমার বেশ মনে পড়ছে রমাপতির হাতে চাপ দিয়ে ওকে একটু সাহস দিলাম।

“জঙ্গলটা পুরো পুড়ে ছাই হয়ে যাবে,” আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। “আমি জানি ওরা কেউ রক্ষে পাবে না। ওরা সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে।”

কিন্তু রমাপতি চরম ভয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চীৎকার করে উঠতেই বুঝতে পারলাম যে মূৰ্ত্তিটা ধোয়ার সৃষ্টি একটা আকৃতি মাত্র নয়।

“স্পষ্টভাবে ওটা দেখতে পেলেই আর রক্ষে থাকবে না আমাদের!” রমাপতি কেঁপে উঠলো। “ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি মূৰ্ত্তিটা যেন আকারহীন অবস্থাতেই থেকে যায়!”

গলায় বিরক্তভাব ফুটিয়ে তুলে বললাম, “আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। গাছের মাথায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।”

“মূৰ্ত্তিটার কোন নির্দিষ্ট আকার নেই, তাই তুমি বুঝতে পারছো না। ওটার দিকে তাকানো আমাদের পক্ষে অমঙ্গলজনক! আমাদের এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কই রূপ দেয় নিরাকার জিনিষটাকে। ওটা যখন আমাদের মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ে তখনই একটা রূপ পরিগ্রহ করে সেটা। আর ওটা আমাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করলে মৃত্যুই একমাত্র অবশ্যম্ভাবী ফল হয়ে দাঁড়ায়।”

আমি চীৎকার করে বলে উঠলাম, “জঙ্গলে আগুন লেগেছে! গাছের মাথায় কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। ওখানে অন্ধকার শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই।”

চরম অবিশ্বাস আর ঘৃণার দৃষ্টিতে চাইলাম মূৰ্ত্তিটার দিকে। ওটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগলো। জ্বলন্ত গাছের মাথায় ওটা ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে লাগলো, এবং একটু পরেই বুঝতে পারলাম যে পাখায় ভর করে উড়ছে ওটা।

আপন মনেই গুন গুন করতে লাগলাম আমি, “জিনিষটা অনেকটা বাদুড়ের মত! বিরাট বাদুড় হলদে পাখা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে আগুনের উপর দিয়ে।”

রমাপতির স্বগোতোক্তি শুনতে পেলাম তক্ষুনি, ওটা কি একটা বাদুড় নাকি! অন্ধকারে গড়া বিশাল, নিরাকার একটা বস্তু, কিন্তু ওটা তো বাদুড় বলেই মনে হচ্ছে।”

“না, না!” আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলাম। “ওটা বাদুড় নয়। আমরা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। একটা অশরীরী বস্তু গাছের মাথার ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে, এপাশ থেকে ওপাশ পৰ্যন্ত, কিন্তু ওটা তো ঠিক বাদুড় বলে মনে হচ্ছে না।”

রমাপতি দুহাতে মুখ ঢেকে ভয়ে ফোঁপাতে শুরু করে দিলো। “আমাদের মস্তিষ্কগুলোও ঠাণ্ডা হয়ে যাবে লোকটার মত। ওরা আমার মাথার মধ্যে ঢুকে, মাথার ঘিলুটা কুরে কুরে খাবে।”

“না, না, তা হতে দেবো না,” আতঙ্কে আর্তনাদ বেরিয়ে এলো আমার গলা থেকে। তার আগেই বরং আমি জলে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ
করবো। জলে ডুবে মরার চেয়ে অনেক বেশী ভয়ঙ্কর এই ভয়াবহতা।”

সেই প্রচণ্ড ভয়াবহতার শিকার হয়ে আমরা দুজনে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে লাগলাম। জঙ্গলের মাথায় সেই আকারবিহীন মূৰ্ত্তিটা পরিষ্কার হয়ে উঠতে লাগলো ধীরে ধীরে। বেশ বুঝতে পারলাম আমাদের বাঁচবার আর কোন আশাই নেই। তারপর, হঠাৎ মনে পড়লো একটা উপায় আছে বাঁচবার।

“পৃথিবীর চেয়েও বর্ষিয়ান সেটা” মনে মনে ভাবতে লাগলাম, “সব ধর্মের চেয়েও প্রাচীন। সভ্যতার সূর্যোদয় হবার আগেই মানুষ নতজানু হয়ে প্রার্থনা জানিয়েছে তার কাছে। সব দেশের ধর্মগ্রন্থেই আছে তার উল্লেখ। সেটা হচ্ছে মানুষের প্রথম প্রতীক। হয়তো, সুদূর অতীতে, হাজার হাজার বছর আগে সেটা ব্যবহার করা হোতো—আক্রমণকারীদের তাড়াবার জন্য। আমি সেই জিনিষটাকেই কাজে লাগাবো। ঐ মূৰ্ত্তিটাকে ঠেকাবো আর একটা হেঁয়ালীপূর্ণ জিনিষ দিয়ে।”

হঠাৎ একটা অস্বাভাবিক শান্তি নেমে এলো আমার মনে। এক মিনিট সময়ও নেই হাতে, তার আগেই শেষ হয়ে যাবে আমাদের জীবন, কিন্তু এতটুকু কাঁপলো না আমার বুক। ধীরে ধীরে ইঞ্জিনের নীচে নেমে গেলাম এবং সেখান থেকে হাত মোছবার কিছু ‘জুট’ বার করে আনলাম।

“রমাপতি,” অধৈৰ্য কণ্ঠে ডাকলাম, “দেশলাইটা জ্বালাও তাড়াতাড়ি। বাঁচবার এটাই একমাত্র আশা আমাদের। যত তাড়াতাড়ি পার দেশলাইটা জ্বালাও।”

অবাক চোখে রমাপতি আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর রাত্রির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে পাগলের মত অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।

“দেশলাইটা জ্বালাতে বলছো! দেশলাইয়ের আগুনে কি আমাদের মাথাগুলো সেঁকে নেবো! তা অবশ্য ঠিকই বলেছো, দেশলাইটা জ্বালানো দরকার বইকি।”

“আমার কথা বিশ্বাস কর,” আমি বোঝাবার চেষ্টা করলাম। বিশ্বাস তোমাকে করতেই হবে—কারণ বাঁচবার এটাই একমাত্র উপায়। তাড়াতাড়ি দেশলাইটা জ্বালাও, রমাপতি।”

তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই আমি বুঝতে পারছি না! কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, রমাপতি।

“আমি এমন একটা জিনিষের কথা ভেবেছি যা আমাদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। তুমি দয়া করে দেশলাইটা কেবল জ্বালাও।”

আস্তে আস্তে মাথা নাড়লো রমাপতি। আমি কি করতে যাচ্ছি সে সম্বন্ধে ওকে কিছুই বলিনি, কিন্তু আমার মনের ইচ্ছাটা ওর কাছে অজানা ছিলো না। কারণ মাঝে মাঝে ওর অন্তর্দৃষ্টি অত্যন্ত প্রখর হয়ে ওঠে। অসংলগ্ন হাতে একটাই দেশলাই কাঠি বার করে জ্বালালো সে।

“সাহস রাখো মনে,” বললে রমাপতি। “ওদের বুঝতে দিও না যে তুমি ভয় পেয়েছো। সাহস ভরে প্রতীক চিহ্নটা তুলে ধরো ওপরে।”

জুটগুলোতে জ্বলবার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের ওপরের মূর্ত্তিটা আর ও স্পষ্ট হয়ে দেখা দিলো আমাদের চোখে।

আমি চীৎকার করে উঠলাম, “কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না, আর। আমরা বেঁচে গেছি। আমরা অজেয়।”

জ্বলন্ত জুটগুলোকে তুলে ধরে শরীরের বাঁ কাধ থেকে ডান কাঁধ পর্যন্ত সোজা নিয়ে গেলাম। তারপর কপালের কাছ থেকে হাঁটু পর্যন্ত সোজা নামিয়ে আনলাম।

হঠাৎ রমাপতি আমার হাত থেকে মশালটা কেড়ে নিয়ে নিজের দেহের সামনে ঐ রকম সংকেত আঁকতে লাগলো। তারপর অন্ধকারের পটভূমির ওপরেও ঠিক ঐ রকম সংকেত আঁকলো। গুন্ গুন্ করে উচ্চারণ করতে লাগলো, “রক্ষা কর… রক্ষা কর… রক্ষা কর!”

চোখ বন্ধ করা সত্বেও মূৰ্ত্তিটা যেন আমার চোখের সামনে ভেসে রইলো। বাদুড়ের আকারটা যেন একটু একটু করে মিলিয়ে যেতে লাগলো, আবছা হয়ে আসতে আরম্ভ করলো সেটা, তারপর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লো অনেক দূর পর্যন্ত—চোখ খুলেই দেখলাম সেটা সম্পূর্ণ মিলিয়ে গিয়েছে। চোখের সামনে ভেসে রইলো কেবল জ্বলন্ত জঙ্গল, আর লম্বা লম্বা গাছগুলোর ভৌতিক ছায়া।

ভয় কেটে গেছে, কিন্তু তবু নড়বার চেষ্টা করলাম না। কালো জলের দিকে তাকিয়ে পাথরের মূর্ত্তির মত দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। তারপর মনে হলো মাথার মধ্যে যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেলো। মাথা ঘুরতে আরম্ভ করলো, কোন রকমে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম।

হয়তো পড়েই যেতাম, কিন্তু তার আগেই রমাপতি আমার কাঁধ চেপে ধরে ফেললো। “আমরা বেঁচে গেছি!” চীৎকার করে উঠলো আনন্দে, “আমরা জিতে গেছি।”

আমি বললাম, আমি খুব খুশী হলাম, কিন্তু তখন আনন্দ প্রকাশ করার মত শারীরিক অবস্থা আমার নেই। পা দুটো ভেঙ্গে আসতে লাগলো, মাথাটা ঝুলে পড়লো সামনের দিকে। পৃথিবীর সব দৃশ্য এবং শব্দ অন্ধকারে বিহীন হয়ে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে।

***

ঘরে ঢুকেই দেখি রমাপতি লিখছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, গল্পটা কেমন হচ্ছে?

প্রথমে সে আমার কথায় কোন কানই দিলো না। তারপর মুখ তুলে চাইলো আমার দিকে। ঠোট দুটো ফাঁক হলো কিছু বলার জন্য, কিন্তু মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোলো না। দেখে মনে হলো রমাপতি যেন কত বৃদ্ধ হয়ে গেছে। অনেক শুকিয়ে গেছে তার দেহ, চোখের চারপাশে অজস্র রেখা দেখা দিয়েছে।

না, তেমন ভালো হচ্ছে না, শেষে বললো সে, আমি ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছি না। আরও বহু সমস্যা আছে যা আমাকে প্রলোভিত করে। জঙ্গলের মাথায় যে মূর্ত্তিটা দেখা দিয়েছিলো তার ভয়াবহতাটুকু ঠিকমত গ্রহণ করতে পারিনি।

আমি বসে একটা সিগ্রেট ধরালাম।

বেশ তো তুমি সেই ভয়াবহতার কতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছ বল, বললাম আমি। তিন সপ্তাহ আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে তোমার মুখ থেকে সেই কথা শোনবার জন্য। আমি জানি তুমি এমন অনেক জিনিস জান যা আমাকে বলতে চাও। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাবার সময় লোকটার মাথায়, স্পঞ্জের মত নরম যে জিনিষটা ওপর থেকে পড়েছিলো সেটা কি জিনিষ? কুয়াশার ভেতর দিয়ে পালাবার সময় আমরা যে গোঙানীর শব্দ শুনেছিলাম সেটা কিসের শব্দ? গাছের মাথায় যে মূর্ত্তিটাকে ভেসে বেড়াতে দেখে ছিলাম সেটার অর্থ কি? আর, আমরা যা ভেবেছিলাম যে ভয়াবহতাটা বিস্তৃতি হয়ে পড়বে, তা হলো না কেন? ওটার বিস্তৃতি বন্ধ করলো কে? লোকটার মস্তিষ্কে ঠিক কি ঘটেছিলো বলে তোমার মনে হয়, রমাপতি? গোলাবাড়ীটার সঙ্গে সঙ্গে লোকটার দেহটা ও কি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, না ওরা এসে নিয়ে গেছে? আর জঙ্গলে যে শীর্ণ, কালো, বিকৃত দেহটা দেখছিলাম ওটার কি ব্যাখ্যা তুমি দিচ্ছ? (জঙ্গলে আগুন লাগাবার দুদিন পর জঙ্গলের মধ্যে লোকটার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিলো। মৃতদেহটার গায়ে তখন ও পোড়া মাংসের টুকরে। লেগে থাকতে দেখা গিয়েছিলো, আর মাথার খুলির হাড়টা পাওয়া যায় নি)।

অনেকক্ষণ পর রমাপতি মুখ খুললো আবার। মাথা নীচু করে বসে, নোটবুকটা খুঁটতে লাগলো। শরীরটা ওর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো বারবার। শেষে চোখ তুললো। দুচোখে অব্যক্ত ভীতির চিহ্ন, ঠোঁট দুটো ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে।

হ্যাঁ, আমরা সেই ভয়াবহতা সম্বন্ধে আলোচনা করবো। গত সপ্তাহে আমি এ সম্বন্ধে কিছু বলতে চাইনি। কারণ ভয়টা আমি তখন ও ঠিকমত কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু সেই ঘটনাটা যতক্ষণ পর্যন্ত না লিখে পাঠকদের কাছে তুলে ধরতে পারছি, তাদের যতক্ষণ না সেই ভয়াবহ অবর্ণনীয় অবস্থা উপলব্ধি করাতে পরছি ততক্ষণ আমার মনে শান্তি নেই! আবার, আমি নিজেই যতক্ষণ পর্যন্ত না সন্দেহাতীত ভাবে জিনিষটাকে উপলব্ধি করতে পারছি ততক্ষণ লিখতে ও পারছি না। আশাকরি, আলোচনা করলে আমার সন্দেহটুকুর নিরসন হবে।

তুমি জিজ্ঞেস করছিলে লোকটার মাথায় যে নরম ভিজে জিনিষটা পড়েছিলো সেটা কি। আমার মনে হয় ওটা মানুষের মস্তিষ্ক। অনেকগুলো ফুটো করে মস্তিস্কের নির্যাসটুকু বার করে আনা হয়েছে। আমার বিশ্বাস এই কাজটা করা হয়েছে অত্যন্ত ধীর, মন্থর গতিতে, এবং তারপর সেই শূন্য স্থানটা পূরণ করা হয়েছে ভীতি আর ত্রাস দিয়ে। মনে হয় মানুষের মস্তিষ্কটা ওরা নিজেদের কাজে ব্যবহার করার জন্যেই নিয়ে থাকে ; সম্ভবতঃ কিছু শেখবার প্রয়োজন ওদের। কিম্বা এটা ওদের একটা খেলা ও হতে পারে। তারপর, জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া সেই আধপোড়া মৃত দেহটার কথা জিজ্ঞেস করছিলে না? ওটা ওদের প্রথম বলি, বেচারা জঙ্গলের গোলক ধাঁধায় হারিয়ে গেছিলো, হয়তো। জঙ্গলের গাছপালা গুলো ও একটা বিচিত্র জীবন ধারা প্রাপ্ত হয়েছিলো। যাই হোক, বেচারার মস্তিষ্কটা হারিয়ে গেছিলো। ভয় আর শঙ্কা এসে জমা হয়েছিলো সেখানে। ওরা বেচারার মস্তিষ্কটা নিয়ে হয়তো খেলা করছিলো, তারপর একসময় ফেলে দিয়েছিলো অপ্রয়োজনীয় মনে করে। সেটা এসে পড়েছিলো ঐ যে লোকটাকে আমরা তুলে আনলাম তার মাথায়। লোকটা যে দীর্ঘ শীর্ণ হাতের কথা বলেছিলো সেটা হয়তো হারানো মস্তিষ্কটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। অবশ্য সে হাতটাকে ঠিক হাতের মত আকৃতিতে দেখতে পাইনি, তার বদলে দেখেছিলো সেই বর্ণহীন নিরাকার ভীতিটাকে যা তার মাথার মধ্যে গিয়ে বাসা বেঁধেছিলো এবং তার চিন্তা শক্তিতে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।

যে গোঙানীর শব্দের কথা তুমি বলছিলে এবং সেটা হচ্ছে সেই ভীতি, ওরা চাইছিলো আমরা ওদের উপলব্ধি করি, চাইছিলো বেড়া ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে, চাইছিলো আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে ঢুকে আমাদের চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে। তা প্রায় করে ও ফেলেছিলো। আমরা যদি ঐ লোকটার মত স্পষ্ট করে মূর্ত্তিটাকে দেখতে পেতাম, যেমন সে দেখেছিলো সাদা হাতটাকে তাহলে এতক্ষণ আর আমরা এখানে বসে গল্প করতাম না।

রমাপতি জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। পর্দাটা সরিয়ে জনাকীর্ণ বন্দরের দিকে তাকালো একবার। চাঁদের আলোয় বড় বড় বাড়ীগুলোকে ছায়ার মত দেখাচ্ছে। দূরে আলোকিত তীর রেখার দিকে চেয়ে রইলো। ছোট্ট পাহাড়টাকে অন্ধকারে দেখা যেতে লাগলো কালো স্তুপের মত।

ওরা পরাজিত হলো কেমন করে? চীৎকার করে জিজ্ঞেস করলো রমাপতি। ওরা হয়তো সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলতে পারতো সবকিছু। পৃথিবীর সব কিছুকে গ্রাস করে ফেলতে পারতে ওরা। বড় বড় বাড়ীগুলো সমুদ্রের জলের তলায় চলে যেতো, লক্ষ লক্ষ মানুষের মস্তিষ্ক ওদের পাশবিক ক্ষুধা নিবৃত্ত করতো।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু ভয়াবহতাটা ছড়ালো না কেন?”
রমাপতি বললো—“তা আমি ঠিক বলতে পারবো না। হয়তো ওরা বুঝতে পেরেছিলো যে মানুষের মস্তিষ্ক ওদের বিশেষ কোন উপকারে লাগবে না। হয়তো ওদের প্রয়োজনে লাগতে পারিনি আমরা। হয়তো ওরা আমাদের সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে পড়েছিলো, অপ্রয়োজনীয় মনে করে। তবে এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে আমাদের ঐ সংকেতটাই ওদের ধ্বংসের কারণ হয়েছিলো—কিম্বা মহাশূন্যের পথে ওদের ফিরে যেতে বাধ্য করেছিলো। আমার মনে হয় এর আগেও আর একবার ওরা পৃথিবী অভিযান করেছিলো। হয়তো লক্ষ লক্ষ বছর আগে এসেছিলো ওরা, এবং তখনও পৃথিবী ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলো ঐ সংকেতের ভয়েই। ওরা যখন বুঝতে পারলো এই দীর্ঘ সময় পরেও আমরা সেই সংকেতের ব্যবহার ভুলে যাইনি, তখন ওরা পালাবার পথ পেলো না এখান থেকে। গত তিন সপ্তাহ ধরে ওদের আর কোন অস্তিত্ব টের পাচ্ছি না। আমার ধারণা ওরা চিরকালের মত পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।”

“আমিই তাহলে পৃথিবীকে রক্ষা করেছি চরম সংকটের হাত থেকে!” আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।

“হতে পারে।” বলেই অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চাইলো রমাপতি। “সেজন্যে তোমাকে আমি ক্ষমা করতে পারি। কিন্তু এটা বাহাদুরী করার মত কিছু নয়।”

“আর ঐ লোকটা?” আমি প্রশ্ন করলাম।

“হ্যাঁ, ওর দেহটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমার মনে হয় ওর জন্যেই ওদের আগমন ঘটেছিলো।”

“তুমি কি চাইছে। এ নিয়ে গল্প লিখবে?” হে ভগবান! সমস্ত জিনিষটা এমনই অবিশ্বাস্য, এমনই অশ্রুতপূর্ব, যে আমার নিজেরই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না এখন আর। “তোমার কি মনে হয়, রমাপতি? আমরা কি ঘটনাটা সত্যি সত্যি দেখেছিলাম—না একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম? আমরা কি বাস্তবিকই একটা পুরোনো বাড়ীতে বসে গল্প করছি, আর চতুর্দিকে ঘন কুয়াশা সাপের মত পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে? সত্যিই কি আমরা সেই অভিশপ্ত জঙ্গলের মধ্যে ঢুকেছিলাম? গাছগুলো কি সত্যি সত্যি জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো? সেই হতভাগ্য লোকটাকে কি সত্যিই চার হাত পায়ে নেকড়ের মত হাঁটতে দেখেছিলাম?”

রমাপতি নিঃশব্দে বসে পড়লো। তারপর, জামার হাত গুটাতে শুরু করলো। শেষে ওর শীর্ণ হাতটা আমার দিকে প্রসারিত করে দিলো।

“এই যে কাটা দাগটা দেখছো, এটা সম্বন্ধে তর্কের অবকাশ আছে?” প্রশ্ন করলে রমাপতি। সেই লোকটা যে আমাকে পশুর মত আক্রমণ করেছিলো তারই চিহ্ন এগুলো। এগুলো কি স্বপ্ন? তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করাতে পার যে এগুলো স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়, তাহলে আমি কনুই থেকে পুরো হাতটাই কেটে ফেলতে রাজী আছি।”

জানালার কাছে গিয়ে আমি বাইরের দিকে চেয়ে রইলাম। দূরে বন্দরের আলোগুলো মালার মত দেখা যেতে লাগলো। মনে হলো, পৃথিবীর এইসব ঐশ্বৰ্য কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। সেদিন আমরা যতখানি ভীত হয়েছিলাম ততটা ভয় পাবার কোন কারণ ছিলো বলে আজ আর মনে হয় না। আমি চেষ্টা করবো যাতে রমাপতিকে এই লেখাটা থেকে বিরত করতে পারি। আমরা চেষ্টা করবো সেই ভয়াবহ ঘটনার কথা ভুলে যেতে।

রমাপতির কাছে ফিরে এসে ওর কাঁধে হাত রাখলাম।

“ঐ ঘটনাটা নিয়ে গল্প লেখার মতলব টা তুমি ছাড়ো,” অনুরোধের সুরে বললাম আমি।

“তা কখনোই হতে পারে না!” উঠে দাঁড়িয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে বললো রমাপতি। চোখ দুটো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “তুমি কি মনে কর যখন আমি ঘটনাটার বাখ্যা প্রায় পেয়েই গেছি তখন আমি লেখবার ইচ্ছে ত্যাগ করবো? আমিই প্রথম লিখবো পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ এবং শঙ্কাপূর্ণ গল্প। এর আগে যা কেউ কোনদিন কল্পনাতেও আনতে পারেনি। পাঠকরা পড়তে ভয়ে কুঁকড়ে যাবে। আমি পো’র প্রতিভাকেও ছাড়িয়ে যাবো—আমি সব বড় বড় রহস্য কাহিনীকারদের চেয়ে উচু স্থান দখল করবো।”

“তাদের তুমি ছাড়িয়ে যেতে পার” রাগতকণ্ঠে বললাম আমি। এটা নিছক পাগলামী ছাড়া আর কিছুই নয়, এ সম্বন্ধে তোমার সঙ্গে তর্ক বিতর্ক করা বৃথা। তোমার আমিত্বটা বড্ড বেশী।

আমি তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ মনে হলো ভয়ানক ভীত হয়ে পড়ায় আমি অত্যন্ত বোকার মত কাজ করে ফেলেছি, কিন্তু তবু নামতে নামতে বার বার পেছন ফিরে চাইলাম, কেননা প্রতিমুহূর্তেই মনে হতে লাগলো বিরাট একটা পাথর ওপর থেকে নিঃশব্দে নেমে আসছে আমাকে গুঁড়িয়ে মাটীর সঙ্গে মিশিয়ে দিতে। রমাপতির উচিৎ ঐ ভয়াবহ ঘটনার কথা মন থেকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলা। এ নিয়ে গল্প লিখতে গেলে ও নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে।

তারপর, দিন তিনেক আর রমাপতির সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি আমার।

সেদিন ওর দরজায় গিয়ে কড়া নাড়াতেই কর্কশ গলায় বললো, “ভেতরে এসো।”

ড্রেসিং গাউন আর চটী পরা অবস্থায় দেখলাম রমাপতিকে। ওর চোখ মুখ দেখে ওকে খুবই চিন্তা মগ্ন মনে হলো। আমাকে দেখেই চোখ দুটো মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

প্রায় চীৎকার করেই বলে উঠলো, “আমি জিতেছি, বুঝলে? আমি সেই নিরাকার জিনিষটাকে রূপায়িত করতে সক্ষম হয়েছি, সক্ষম হয়েছি সেই কলঙ্কময় জিনিষটাকে রূপায়িত করতে, যা মানুষের সুদূর কল্পনাতেও আসবে না কোনদিন। সেই অমঙ্গলপূর্ণ ভয়াবহ বস্তু যা মানুষের মস্তিষ্ককে একটু একটু করে কুরে কুরে খায় তাকে আমি রূপ দিয়েছি আমার লেখায়।

আমি বসে একটু দম নেবার আগেই একটা মোটা পাণ্ডুলিপি আমার হাতে তুলে দিলো রমাপতি।

“এটা পড়, প্রায় আদেশের সুরেই বললো সে। বসে পড়তে আরম্ভ কর এক্ষুনি!”

বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে বসলাম। চোখের সামনে জেগে রইলো কতকগুলো টাইপ করা কাগজ, আর সব মুছে গেলো দৃষ্টি পথ থেকে। সত্যিকথা বলতে কি একটা অদম্য কৌতূহল আমার মনে জেগে উঠলো। রমাপতির ক্ষমতা সম্বন্ধে কোনদিন কোন কৌতূহল জাগেনি আমার মনে। কথার মায়াজাল সৃষ্টি করা ওর নখদর্পণে; পাণ্ডুলিপির পাতাগুলোর ওপর দিয়ে একটা অজানিত দীর্ঘশ্বাস বয়ে যাচ্ছে। পৃথিবী থেকে চলে গেছে যারা সেই ভয়াবহ জীবেরা যেন ফিরে আসছে ওর লেখার ভেতর দিয়ে। কিন্তু যে ভয়াবহতা সেদিন আমরা উপলব্ধি করেছিলাম সেটা কি আবার হুবহু ফুটিয়ে তোলা আমার পক্ষে সম্ভব হবে? সেই নিরাকার, ঘৃণ্য জীবগুলোর বর্ণনা দেওয়া কি সত্যিই রমাপতির দ্বারা সম্ভব?

গল্পটা আগে প্রথম থেকে পড়তে সুরু করলাম। আস্তে আস্তে পড়ে যাচ্ছি, মাঝে মাঝে ভয়ে, ঘৃণায় চেয়ারের হাত চেপে ধরছি নিজের অজান্তেই। পড়া শেষ হওয়া মাত্রই রমাপতি আমার হাত থেকে পাণ্ডুলিপিটা একরকম ছোঁ মেরেই নিয়ে নিলো। ও ভাবলে আমি হয়তো পাণ্ডুলিপিটা ছিঁড়ে কুটী কুটী করে ফেলবো।

খুশী ভাবে জিজ্ঞেস করলো, “পাণ্ডুলিপিটা সম্বন্ধে তোমার মত কি?”

আমি বললাম, “এটা অবিশ্বাস্য রকম অভিশপ্ত, অমঙ্গলসূচক! অবর্ণনীয় নারকীয়তার প্রতীক এটা!”

কিন্তু সেই অভিশপ্ত অবস্থাটাকে আমি অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে পরিবেশন করতে পেরেছি, একথা তুমি নিশ্চয়ই মানবে?

আমি নিঃশব্দে ঘাড় নাড়লাম। তারপর বেরোবার জন্য উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, জিনিষ এতো বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপিত করেছে যে এ বিষয়ে আলোচনা করার জন্য আমি আর এখানে থাকতে চাই না। আমি সকাল পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতে চাই। ঘুরে বেড়াতে চাই যতক্ষণ পর্যন্ত না সম্পূর্ণ ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়ছি। যতক্ষণ পর্যন্ত না চিন্তা করার ক্ষমতা বা স্মরণ করার ক্ষমতা ফিরে পাচ্ছি।

রমাপতি চীৎকার করে বলে যেতে লাগলো, “এটা একটা অমর শিল্প!” কিন্তু ততক্ষণে আমি সিঁড়ি পার হয়ে নেমে চলেছি, বাইরে যাবার জন্য।

মাঝরাতে হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠলো। হাতের বইটা রেখে রিসিভারটা নামিয়ে নিলাম।

হ্যালো। কে কথা বলছেন?

আমি, রমাপতি বলছি! রমাপতি যেন চেঁচিয়ে বলছে কথাগুলো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে এসো। ওরা আবার ফিরে এসেছে! আর এবার আগের সেই সংকেতটা কোন কাজই করছে না। আমি সংকেতটা করেও দেখলাম, কিন্তু কোন ফল হলো না। গুন গুন শব্দটা ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। একটা আবছা ছায়াময় মূর্ত্তি—হঠাৎ গলার স্বরটা বন্ধ হয়ে গেলো রমাপতির।

আমি রিসিভারটার সামনে চীৎকার করতে লাগলাম, “ভয় পেওনা, রমাপতি! ওদের কোন রকমেই বুঝতে দিও না যে তুমি ভয় পেয়েছো। বার বার সংকেতটা করতে থাক। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।”

আবার রমাপতির গলা শোনা গেলো, এবার আগের চেয়ে আরও বেশী কর্কশ এবং বেসুরো। মূৰ্ত্তিটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আমার আর করবার কিছুই নেই! সংকেত করার মত শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছি। সংকেতটা করবার অধিকারও আমার নেই আর। আমার আত্মা কলুষিত হয়ে গেছে। আমি শয়তানের পুরোহিত হয়ে গেছি। সেই গল্পটা—হ্যাঁ সেই গল্পটা আমার লেখা উচিৎ হয় নি।”

আমি আবার চীৎকার করে বললাম, “ওদের দেখাবার চেষ্টা কর যে তুমি একটুও ভয় পাওনি!” চেষ্টা আমি করছি! হে ভগবান! মূর্তিটা যে—আর শোনবার জন্য অপেক্ষা করতে পারলাম না। কোটটা হাতে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এলাম পথে। পথের বাঁকটা পার হতেই একটা ঝিমুনির ভাব এসে গেলো আমার মধ্যে। পড়ে যাচ্ছিলাম ; একটা ল্যাম্প পোষ্টকে চেপে ধরে কোন রকমে দাঁড়িয়ে রইলাম। রাস্তা দিয়ে ছুটে যাওয়া একটা ট্যাক্সিকে হাতের ইশারায় ডাকলাম। সৌভাগ্য বশতঃ ড্রাইভার আমাকে দেখতে পেয়েছিলো। গাড়ীটা থামলো; আমি পা টেনে টেনে কোন রকমে গিয়ে দরজা খুলে উঠে বসলাম। “খুব তাড়াতাড়ি” আমি চীৎকার করতে আরম্ভ করলাম। গন্তব্যস্থানের কথা জানিয়ে দিলাম ড্রাইভারকে।

আচ্ছা স্যার। আজকের রাতটা বেশ ঠাণ্ডা তাই না?

হ্যাঁ, ভীষণ ঠাণ্ডা! ওরা মাথার মধ্যে ঢুকে পড়লে আর ও ঠাণ্ডা লাগবে।

ড্রাইভার অবাক হয়ে আমার দিকে চাইলো। হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন। বললো সে। আপনাকে আমি ঠিক মত বাড়ী পৌছে দেবো, স্যার। আপনার কোন চিন্তা নেই।

আমি চুপ করে হেলান দিয়ে বসে রইলাম।

গাড়ী ছুটে চলেছে পূর্ণ গতিতে। আমি ভুলে যেতে চাইছি প্রতীক্ষিত ভয়াবহতার কথা চিন্তা করতে। ভাবতে লাগলাম, রমাপতি হয়তো বিকার গ্রস্থ হয়ে পড়েছে। এত লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে সেই ভয়াবহতাটা ওকেই বা বেছে নিলো কেমন করে? এত এত লোকের মধ্যে ও রমাপতিকেই ওরা ঠাণ্ডা মাথায় বেছে নিয়েছে, একথা বিশ্বাস যোগ্য নয়। এই বিশাল জনতার মধ্যে ওতো সামান্য একটা কনা মাত্র। কেবল মানুষ শিকার করাই যে ওদের উদ্দেশ্য তা নয়। কিন্তু রমাপতি যে বললো, আমি শয়তানের পুরোহিত হয়ে গেছি, সে কথাটার অর্থ কি? ঐ অশরীরীদের
হয়ে শয়তানের পুরোহিত কথাটা বললো কেন? তবে কি ওর গল্পটাই ওকে পৃথিবীতে ওদের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার দিয়েছে?

চিন্তাটা আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মত মনে হলো। আমি মন থেকে ঐ চিন্তাটা দূর করে দিতে চাইলাম। ভাবলাম, “ওদের বাধা দেবার মত সাহস রমাপতির নিশ্চয়ই আছে। ও অন্ততঃ দেখাবে যে ও মোটেই ভয় পায়নি।”

এই যে এসে গেছি, স্যার। আপনাকে আমি সাহায্য করবো? ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো।

গাড়ী থামলে, নামতে নামতে মনে হলো যেন আমি নিজের কবরে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। পকেটে যত খুচরো পয়সা ছিলো সব গুলো মুঠো করে বার করে ড্রাইভারের হাতে দিলাম। লোকটা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো আমার দিকে।

“অনেক বেশী দিয়ে ফেলেছেন, স্যার। এই যে—”

আমি হাত নেড়ে জানালাম, ঠিক আছে। তারপর প্রায় শুনতে পেলাম ড্রাইভারের গলা, “এরকম মাতাল জীবনে কোন দিন আমার নজরে পড়েনি! মাত্র এই সামান্য পথ টুকু নিয়ে আসার জন্য এতগুলো পয়সা দিয়ে ফেললেন ভদ্রলোক, একটা ধন্যবাদ পাবার জন্য ও অপেক্ষা করলেন না।”

নীচের ঘরটা অন্ধকার। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে রমাপতিকে ডাকলাম, আমি এসেছি, রমাপতি! তুমি নীচে আসতে পারবে?

কোন জবাব নেই। প্রায় দশ সেকেও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম, কিন্তু ওপরের ঘর থেকে কোন রকম সাড়া শব্দ নেই।

আমি ওপরে যাচ্ছি! হতাশ কণ্ঠে বললাম আমি। তারপর, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগলো। ভাবলাম এতক্ষণে ওরা রমাপতিকে আক্রমণ করে ফেলেছে, হয়তো। আমার খুব দেরী হয়ে গেলো। বরং না এলেই হে ভগবান, ওটা আবার কি?

অসম্ভব ভীত হয়ে পড়লাম। না, শব্দটা শুনতে কোন ভুলই হয়নি আমার। ঘরের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রনায় কে যেন কাতরাচ্ছে। এটা কি রমাপতির গলা? কয়েকটা অস্ফুট কথাও কানে ভেসে এলো। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে ওঃ! মাথার ভেতরটা ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে। ওঃ, আর ও এগিয়ে আসছে নিঃশব্দে!

সেই মুহূর্তেই ওপরে মেঝেতে এসে পা দিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট কথাগুলো পরিণত হলো আর্তনাদে। ভয়ে এবং উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু ও হারিয়ে ফেললাম। দেহের সামনে, দেওয়ালে এবং বাতাসে সংকেতটা করতে লাগলাম বার বার। সেই জঙ্গলের বিভীষিকা থেকে সেদিন আমাদের রক্ষা করেছিলো যে প্রাচীনতম সংকেত চিহ্নটা সেটাই বার বার আঁকতে লাগলাম। এবার অবশ্য জ্বলন্ত মশাল ছিলো
আমার হাতে। নিরাশা এবং হতাশা এসে বাসা বেঁধেছে মনে। মনে হচ্ছে কোন কিছুই রক্ষা করতে পারবে না, এবার।

প্রায় ছুটে গেলাম দরজার কাছে। বার বার প্রার্থনা জানালাম আমাকে তাড়াতাড়ি গ্রাস করে ফেলে, যন্ত্রনার হাত থেকে মুক্তি দাও, আমাকে।

রমাপতির ঘরের দরজাটা বন্ধ ছিলো। অনেক চেষ্টা করে কম্পিত হাতে কপাটের হাতলটা চেপে ধরলাম। তারপর ধীরে ধীরে দরজাটাকে ভেতরের দিকে ঠেলে খুলতে লাগলাম।

প্রথমেই চোখে পড়লো রমাপতির নিশ্চল দেহটা পড়ে আছে মেঝের ওপর। চিৎ হয়ে পড়ে আছে সে। হাঁটু দুটো ওপর দিকে উঠে এসেছে এবং হাত দিয়ে চেপে রেখেছে এবং হাত দিয়ে চেপে রেখেছে মুখটা। যেন কোন অবর্ণনীয় দৃশ্য দেখা থেকে বিরত থাকতে চাইছে।

ঘরের মধ্যে ঢুকেই আমি চোখ সঙ্কুচিত করে দৃষ্টি সীমা কমিয়ে আনতে চেষ্টা করলাম। মেঝের খানিকটা অংশে সীমাবদ্ধ রইলো আমার দৃষ্টি। ঘরের ভেতরে কোন ভয়াবহ জিনিষ অপেক্ষা করে আছে তা দেখবার মত সাহস আমার হলো না।

চোখ তুলে না চাইলে ও বুঝতে পারলাম একটা অশুভ শক্তি যেন কাজ করছে ঘরের মধ্যে, যার ক্ষমতাকে অগ্রাহ করার শক্তি আমার নেই। আমি বেশ বুঝতে পারলাম যে চোখ তুলে চাইলেই ভয়াবহতাটা আমাকে গ্রাস করতে পারে, কিন্তু তা সত্বেও আমার কোন গত্যন্তর ছিলো না।

ধীরে ধীরে চোখ তুলে ঘরের মধ্যে চাইলাম। মনে হলো যে জিনিষটা ঘরের মধ্যে বিস্তৃত হয়ে আছে তার কাছে আত্মসমর্পণ করলেই ভালো হতো। মুহূর্তের মধ্যে আমার সমগ্র অস্তিত্বকে আচ্ছন্ন করে ফেলতো, সম্পূর্ণ গ্রাস করতো আমাকে, কিন্তু এখন জীবনের কি মূল্য রইলো আমার কাছে? পৃথিবীর সব আনন্দের মাঝে বিরাট একটা বাধার মত হয়ে দাড়িয়েছে সেই শঙ্কাজনক অবস্থাটা। এভাবে বেঁচে থাকার কোন মূল্য নেই আর।

ঘরের ছাত থেকে মেঝে পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে ওরা, ভৌতিক একটা আলো বিকিরণ করছে অবর্ণনীয় সেই আলো—তরল আলো ফোঁটা ফোঁটা করে ঝরে পড়ছে নীচে ঘন আঁঠাল তরল পদার্থের মত। রমাপতির পাণ্ডুলিপিটার চতুর্দিক থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই রহস্যময় আলো।

ঘরের মাঝখানে, পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো ইতস্ততঃ উড়ে বেড়াচ্ছে। পাতাগুলো পুড়ছে সেই অভিশপ্ত আলোতে, তারপর সেই আলোর ধারা সর্পিল গতিতে গিয়ে নিঃশব্দে প্রবেশ করছে আমার বন্ধু রমাপতির মস্তিষ্কে। অবিচ্ছন্ন ধারায় গড়িয়ে পড়ছে সেই আলোর ধারা, আর ওপরে এদিক ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছে সেই রহস্যময় আলোর মালিক।

সেই রহস্যময় আলোর মালিকের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসছে একটা ভয়াবহ শব্দ। নীচে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে যে সংকেত চিহ্নটা কয়েকবার এঁকেছিলাম সেটা এখনও সম্পূর্ণ বিস্মৃত হলাম আমি। আমি ভুলে গেলাম সেই রহস্যময় সংকেত যার সামনে সব আক্রমনকারীই মাথা নত করতে বাধ্য। কিন্তু যখন দেখলাম যে সেই মারাত্মক হলদে আলোর ওপর ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে সেই সংকেত চিহ্ন তখন বুঝলাম, এ যাত্রা রক্ষা পেয়ে গেলাম আমি।

হাঁটু গেড়ে বসে আনন্দে কেঁদে উঠলাম। আলোটা দুলতে লাগলো, আর সেই আলোর মালিক অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগলো চোখের সামনে থেকে।

তারপরই দেওয়াল থেকে, ছাত থেকে, মেঝে থেকে উত্থিত হতে লাগলো আগুনের শিখা শ্বেত শুভ আলোক শিখা। সব কিছু অশুভ, অমঙ্গলকে গ্রাস করে ধ্বংস করে ফেললো চিরকালের মত।

কিন্তু রমাপতি ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে, ওকে আর বাঁচাতে পারলাম না।

‘বিস্ময়’ পত্রিকার ‘সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৭১’ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এই উপন্যাসটি। ‘ধুলোখেলা’-এর সৌজন্যে লেখাটি এবারের সংখ্যায় পাঠকের সামনে আবার নিয়ে এল ‘পরবাসিয়া পাঁচালী’।