শম্ - অদ্রীশ বর্ধন

অলংকরণ - মূল প্রচ্ছদ

প্লুটোর কক্ষপথ ছাড়িয়ে সবে ‘ইলকো’ ক্রুজারটা শুরু করেছে তার আন্তঃনক্ষত্র যাত্রা, ঠিক এমনি সময়ে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে একজন অফিসার খবরটা আনলে কম্যাণ্ডারের কাছে।

“স্যার, আমাদের এক কারিগরের গাফিলতির ফলে তিন নম্বর গ্রহের ওপর ক-৩ টাইপের একটা শম্-কে ফেলে এসেছি। শম্-এর সংগৃহীত সবকিছুই রেখে আসতে হয়েছে ঐ সাথে।”

কম্যাণ্ডারের তিনকোণা চোখগুলো ক্ষণেকের জন্য পল্লবাচ্ছাদিত হলো বটে কিন্তু তারপরই যখন কথা শুরু করলে সে, তখন উত্তেজনার চিহ্নমাত্র পাওয়া গেল না তার কণ্ঠে।

“কি অবস্থায় খাড়া করা হয়েছিল শম্-কে?”

“সবচেয়ে বেশী ব্যাসার্ধ তিরিশ মাইল। ওজন একশো ষাট পাউণ্ড প্লাস মাইনাস পনেরো।”

কয়েক সেকেণ্ড সব চুপচাপ। তারপর কমাণ্ডার বললেন—“ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। হপ্তা কয়েক পরেই তো ফিরে আসব। তখন শম্-কে তুলে নিলেই চলবে। নিজের এনার্জি নিজেই বানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা যারা রাখে সেই মূল্যবান শম্-য়েদের একটিকেও এভাবে আমি হারাতে রাজী নই। আর, যে অপদার্থ লোকটার গাফিলতিতে এই কাণ্ড, তার কঠোর শাস্তি যাতে হয়, সে ব্যবস্থা তুমি করো।” নিরুত্তাপ কিন্তু স্থিরকণ্ঠে আদেশ দিয়ে দিলে কম্যাণ্ডার!

কিন্তু যাত্রা সমাপনান্তে রাইগা গ্রহের কাছাকাছি একটা চ্যাপ্টা আংটির মত মহাকাশ জাহাজের সঙ্গে লড়াই বেঁধে গেল ইলকা’র। আগুন-যুদ্ধ যখন শেষ হলো, তখন দুটো মহাকাশ পোতই রূপান্তরিত হয়েছে তাল তাল গলিত ধাতুতে। রেডিও অ্যাকটিভ ধাতুর তালের মধ্যে ছিল মৃত যোদ্ধাদের লাশগুলো। লাশসমেত ধাতুর পিণ্ডগুলো ঘুরতে শুরু করে দিল আপন আপন কক্ষপথে নক্ষত্রের চারপাশে। এমনই বিরাট সে কক্ষপথ যে শুধু একবার সে পথ পরিক্রমণ করে আসতে লেগে যাবে কয়েক কোটি বছর।

পৃথিবীর ওপর তখন সরীসৃপদের যুগ।

 

মালপত্র আর রসদের শেষ বাক্সটি নামিয়ে নেওয়ার পর কয়েক মিনিট জিরিয়ে নিল দু’জন। তারপর সুকোমল উঠে পড়ল ওর ছোট্ট সী প্লেনে। প্রদীপ হাত নেড়ে বিদায় জানাল ওকে।

চীৎকার করে বললে—“আমার বউয়ের কাছে চিঠিখানা পৌছে দিতে ভুলো না যেন।”

ইঞ্জিনে ষ্টার্ট দিতে দিতে সুকোমল জবাব দিলে সমান স্বরগ্রামে—“যে মুহূর্তে জমি স্পর্শ করবে, সেই মুহূর্তেই ব্যবস্থা করবো হে, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। অন্তত কিছুটা ইউরেনিয়াম খুঁজে বার করার চেষ্টা করো তুমি। খানিকটা পেলেই মনে রেখো, তোমার, তোমার বউ আর ছেলের কপাল ফিরে যাবে এ জন্মের মত। আর, ভালুক-টালুকের সাথে লড়াই করার চেষ্টা না করে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজো। নেহাৎ বেগতিক দেখলে গুলি চালাবে।”

গতিবেগ বৃদ্ধি পায় সী প্লেনের। পুঞ্জ পুঞ্জ ফেনায় তোলপাড় হয়ে ওঠে জলরাশি। তারপরেই জলচর যানটি উঠে পড়ে আকাশে। সামান্য একটু ভয় ভয় লাগে প্রদীপের। পুরো তিনটি হপ্তা ওকে এইখানে, এই পর্বতময় উপত্যকায় থাকতে হবে। কথা বলার সঙ্গী তো দূরের কথা, এমন একটা পোষা প্রাণীও নেই যার সান্নিধ্যে ওকে এই ভয়াবহ নিঃসঙ্গতাবোধ থেকে কিছুটা মুক্তি দিতে পারে। যদি কোন কারণে সী প্লেনটা তুহিন ঢাকা নীল সরোবরে ফিরে যেতে না পারে, তা হলেই ওর মৃত্যু অবধারিত। সঙ্গে প্রচুর খাবার দাবার থাকলেও কোন মানুষের পক্ষে এই দুস্তর ব্যবধান পেরিয়ে, বরফ ঢাকা পর্বত চূড়া লঙ্ঘন করে, কয়েক শো মাইলের মত ধূ ধূ প্রান্তর হেঁটে পাড়ি দিয়ে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এত সাতপাঁচ চিন্তা করারই বা দরকারটা কি? সুকোমল যথাসময়েই পৌঁছে যাবে নীল সরোবরে। এখন প্রদীপের ওপরেই নির্ভর করছে এই অভিযানের সমস্ত ঝুঁকিটা। এ অঞ্চলে সত্যিই যদি কোথাও ইউরেনিয়াম থাকে তো পুরো একুশটা দিন সে পাচ্ছে তা খুঁজে বার করার। কাজেই আবোল তাবোল ভবিষ্যৎ না ভেবে কাজ শুরু করা যাক।

বনে জঙ্গলে পাহাড় পর্বতে দিন কাটানোর অভ্যাস তার অনেকদিনের। কাজেই সবার আগে তার কাজ হলো পাহাড়ের কিনারা থেকে বেরিয়ে আসা একটা ঝুলন্ত চ্যাটালো পাথরের তাকের ওপর নিজের ডেরা বানিয়ে নেওয়া। মাত্র তিন হপ্তার আস্তানা। কাজেই এর চাইতে স্থায়ী আর কিছু করার দরকার নেই। চলনসই মাথা গোঁজবার ঠাঁই একটা হলেই হলো। সকালের সূর্য ততক্ষণে আগুন ঢালা শুরু করেছে। দরদর করে ঘামতে থাকে প্রদীপ। টেনে টেনে রসদ আর মালপত্র এনে জড়ো করে ওর ডেরায়। বেশ ভাল করে ঢাকা দিয়ে রাখে ত্রিপলের আচ্ছাদনে। বড়সড় জানোয়ারের অনুসন্ধিৎসা থেকে আড়াল করে রাখার কোন আয়োজনেই ত্রুটি রাখল না ও। ডিনামাইটগুলোকে রাখলে অন্যদিকে। শ’দুয়েক গজ দূরে সযত্নে ত্রিপল দিয়ে মুড়ে রাখলে যাতে আর্দ্রতা স্পর্শ না করতে পারে। শোওয়ার জায়গায় তো আর ডিনামাইট নিয়ে ঘুমানো যায় না! নেহাৎ বোকা না হলে এ ধরনের সাহস কেউ দেখায় না।

প্রথম দুটো হপ্তা কেটে যায় হু হু করে। উৎসাহিত হওয়ার মত কিছুই পাওয়া গেল না। সম্ভাবনা শুধু একটাই রইল। সময়ও রইল প্রচুর এই একটা সম্ভাবনা নিয়ে অভিযান চালানোর। কাজে কাজেই তৃতীয় হপ্তার শেষাশেষি একদিন সকাল বেলা প্রদীপ রওনা হলো উপত্যকার উত্তর-পূর্ব দিকে খাদের মধ্যে শেষ অনুসন্ধান চালানোর সংকল্প নিয়ে। এ অঞ্চলটা এর আগে সে কোনদিন দেখেনি।

গাইগার কাউন্টার সঙ্গে নেয় ও। রেডিও অ্যাকটিভ মৌলিক পদার্থের হদিশ পেতে গাইগার কাউন্টার অপরিহার্য। ইয়ারফোন লাগিয়ে নেয় কানে। তারপর রাইফেলটা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে পড়ে হন হন করে। এই বিশেষ অভিযানের শুরু অথবা শেষ—যে কোন একটা পরিণতি নির্ধারিত হয়ে যাবে আজকে।

‘৩০-০৬ রাইফেলটা রীতিমত ভারী এবং বন্ধুর পথে বহন করে নিয়ে যাওয়া রীতিমত কষ্টকর। কিন্তু এ জিনিস বর্জন করে পথ চলাও নিরাপদ নয়। এ অঞ্চলের বিশালদেহ ভালুকগুলো আর যাই হোক, খুব উদার নয় এবং বেধড়ক খুন জখম করার জন্যে বিলক্ষণ দুর্নাম আছে তাদের। এই কটা দিনের মধ্যেই গোটা দুয়েক জানোয়ারের ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে তার এই হাতিয়াবের বুলেট বর্ষণে। কয়েকবার তো শুধু রাইফেল তুলতেই বুদ্ধিমান জীবগুলো বুঝে নিয়েছে। অবস্থা খারাপ এবং বিনা বাক্যব্যয়ে সটকান দিয়েছে দৃষ্টিপথ থেকে। ‘২২ পিস্তলটা ভেড়ার চামড়ার হোলষ্টারে রেখে ফেলে যায় আস্তানায়।

যাত্রা শুরুর সময়ে শিষ দিতে থাকে প্রদীপ। আকাশ বেজায় পরিষ্কার।
কুয়াশার চিহ্ন মাত্র নেই আশেপাশে। নীলচে সাদা বরফভূমির ওপর ঝকঝক করছিল জ্বালাময় তপনদেব। গ্রীষ্মের এহেন রূপ তাই উল্লসিত করে তুলেছিল ওর অবসাদক্লিষ্ট অন্তরকে। তন্ন তন্ন করে তল্লাশ করে ইউরেনিয়ামের কণাটুকুও আবিষ্কার করতে পারেনি ও। তবুও আনন্দে মন ভরে ওঠে ওর সুন্দর সকালের স্বচ্ছরূপ দেখে। ওর প্ল্যান ছিল এই : একটা দিন স্রেফ হেঁটে নতুন অঞ্চলে পৌঁছানো। পুরো ছত্রিশ ঘণ্টা সেখানে কাটান এবং প্রত্যেকটা পাথর উল্টে উল্টে অনুসন্ধান চালানো। তারপর ফিরে এসে দুপুরের প্লেনটা ধরা। জরুরী অবস্থায় প্রয়োজনীয় প্যাকেটটা ছাড়া খাবার বা জল সঙ্গে রাখলো না ও। ক্ষিদের দাপট খুব বৃদ্ধি পেলে পথেঘাটে দুএকটা খরগোস মারা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। তাছাড়া নদী নালায় সুস্বাদু মাছও এত বেশী এখানে যে, খাবার বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন মানেই হয় না।

সারাটা সকাল হাঁটল প্রদীপ। মাঝে মাঝে কিট্ কিট্, করে উঠতে থাকে গাইগার কাউন্টার এবং প্রত্যেকবার কিট্ কিট্, শব্দ শুনেই লাফিয়ে ওঠে ও! আশায় আনন্দে দুলে উঠে বুক। কিন্তু প্রতিবারেই ঝিমিয়ে পড়ল কাউন্টারের কিট্-কিটানি। সত্যিকারের তেজস্ক্রিয় কোন জিনিসই নেই এ উপত্যকায়।

এদিকে-সেদিকে একটু আধটু কণা রয়েছে পড়ে—বেশী কিছুই নেই। বাস্তবিকই জায়গা নির্বাচনই হয়েছে ভুল। প্রদীপের হাল্কা মেজাজ বিগড়ে যায়। ফিকে হয়ে আসে ফুর্তির রেশ। কিন্তু এখনও একটা সুযোগ আছে। এই শেষ ছত্রিশ ঘন্টার প্রতিটি মুহূর্ত সে কাজে লাগাবে। দরকার হলে সারা রাত্রি তন্ন তন্ন করে প্রতি ইঞ্চি জমি পরীক্ষা করে দেখবে। তাহলেই এত পরিশ্রম হয়ত সার্থক হতে পারে।

ম্লান হাসিতে বঙ্কিম হয়ে ওঠে ওর ঠোট। দুপুরের সূর্য নিষ্করুণ চোখে তাকিয়ে ছিল প্রদীপের শ্রান্ত অবসন্ন মূর্তির পানে। খাওয়ার সময় হয়েছে। শুধু সময় দেখে নয়, উদরের সংকেত থেকেও প্রদীপ বোঝে, এবার খাওয়ার সময় হয়েছে। এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে এগিয়ে চলে ও মাছ ধরার আশায়। ঠিক এমনি সময়ে ঘাস-নরম একটুকরো জমির ওপর এসে দাঁড়ায় ও এবং যে দৃশ্য চোখে পড়ে ওর, তা এমনই বিস্ময়কর যে তা দেখা মাত্র পদযুগল চকিতে অসাড় তো হয়ই, তারও পরে চোয়ালও ঝুলে পড়ে, হাঁ হয়ে যায় মুখ।

দেখে মনে হোল যেন একটা দারুণ উৎসাহী দানবের কশাইখানার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ও। বিরাট সংগ্রহশালা। শুধু জানোয়ারের দেহ। তিনটে পরিষ্কার সারিতে সাজানো এই দেহ। যতদূর চোখ যায়, ততদূর গেছে এই সারি। আর সে কি জানোয়ার! খুব কাছের দেহগুলো যে হরিণ, ভালুক, পাহাড়ী ভেড়া আর শিয়ালের—তা বোঝা যায়। এক এক ধরনের জানোয়ারের নমুনা আছে একটি—তার বেশী নয়। কিন্তু তারও ওদিকে সারির মধ্যে যে কত বিচিত্র অদ্ভুত প্রাণীর চেহারা চোখে পড়ল, তা সুস্থ মস্তিস্কে কল্পনা করতে পারত না প্রদীপ। কদাকার চেহারা প্রাণীগুলোর, লোমশ এবং তারও পরে রয়েছে নিশার আতংকের মত সারি সারি সরীসৃপ! এই অসাধারণ প্রদর্শনীর সব শেষের জানোয়ারটি দেখামাত্র চিনতে পারল প্রদীপ। শহরের মিউজিয়ামে ঠিক এই জানোয়ারেরই একটা বৃহত্তর নমুনা দেখেছিল প্রদীপ। অবশ্য কংকালের ওপর খড় চামড়া মুড়ে অনেক কায়দা করে একটা কাল্পনিক আকার খাড়া করা হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক দানব জানোয়ারটার।

না, কোন সন্দেহই আর নেই। সারির সবশেষের জানোয়ারটি সেই ষ্টেগোসরই বটে—তবে আকারে অনেক অনেক ছোট। ছোট্ট একটি গাধার চাইতে বড় নয়—এত ছোট!

হতভম্ব হয়ে সারির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকে প্রদীপ। মাঝে মাঝে পেছন ফিরে তাকায় এই বিপুল সংগ্রহশালার পানে। আঁশওলা, নোংরা-হলদেটে একটা টিকটিকির খুব কাছে গিয়ে উঁকি মারতেই চমকে ওঠে প্রদীপ। চোখের পাতাটা কাঁপছে না? তারপরেই আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারে ও। জানোয়ারগুলো মৃত নয় মোটেই! প্রত্যেকেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত। নড়াচড়ার ক্ষমতা এইভাবে কেড়ে নেওয়ার পর সযত্নে তাদের সাজিয়ে রাখা হয়েছে এই সংগ্রহশালায়। কি আশ্চর্য অলৌকিক উপায়ে এহেন কাণ্ড সম্ভব, তা ভাবতেও মাথা ঘুরে যায় প্রদীপের। বিন্দু বিন্দু ঘাম দাঁড়িয়ে যায় ওর কপালে। কত কোটি বছর আগে ষ্টেগোসররা এই উপত্যকায় দাপাদাপি করে বেড়িয়েছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ে ওর। বিচিত্র এই মিউজিয়ামের প্রতিটি জানোয়ারই মোটামুটি একই সাইজের। উদাহরণ স্বরূপ, অনেক চোখ চালিয়েও কোথাও সত্যিকারের বড় আকারের একটা সরীসৃপও চোখে পড়ল না ওর। টিরানোসরাস-এর চিহ্ন নেই কোথাও। ম্যামথও নেই। প্রত্যেকটা নমুনার আকার একটা বড় আকারের ভেড়ার মত। এই গোলমেলে ব্যাপারটা নিয়ে মনে মনে তোলাপাড়া করছে ও, এমন সময়ে পেছন দিকে খস্ খস্ শব্দ শুনে হুশিয়ার হয়ে ওঠে প্রদীপ।

এক সময়ে পারা নিয়ে কাজ করতে হয়েছিল প্রদীপকে। তাই মুহূর্তের জন্যে ওর মনে হয়েছিল তরল-ধাতু পারা দিয়ে আধা-ভর্তি একটা চামড়ার থলে যেন আপনা আপনি গড়িয়ে এসেছে খোলা জায়গাটার মধ্যে। জিনিসটা দেখতে অনেকটা বর্তুলের মতো—অথচ তা পুরোপুরি বর্তুলাকার নয়। গুরুতর তরল পদার্থের যে মন্থর গতি, ঠিক সেই গতিতেই আস্তে আস্তে সরে আসছিল জিনিসটা। কিন্তু তা চামড়া নয় এবং প্রথমে যে দাগগুলো দেখে উৎকট আঁচিল বলে মনে হয়েছিল, কাছাকাছি আসতে দেখা গেল সেগুলো আসলে কতকগুলো অপার্থিব কলকব্জার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। জিনিসটা যে মূলে কি, তা অনুমান করার বিশেষ সময় পায়নি প্রদীপ। কেন না, নিরীহ-দর্শন কদাকার বস্তুটাকে কয়েক সেকেণ্ডের বেশী দেখার সুযোগ পায়নি ও। তারপরেই, বিদকুটে বর্তুলাকার বস্তুটার ভেতর থেকে বিদ্যুৎবেগে বেরিয়ে এসেই ঢুকে গেল কয়েকটা ধাতুর রড—রডের প্রান্তে গোলাকার ফুলে ফুলে লেন্সের মত কয়েকটা জিনিসও ঝিকমিকিয়ে উঠল এবং পরক্ষণেই ঘণ্টায় পাঁচ মাইল বেগে ওর দিকে গড়িয়ে এল জিনিসটা। বস্তুটার অগ্রগতি যে উদ্দেশ্যমূলক এবং সে উদ্দেশ্য যে ওরই পক্ষাঘাতগ্রস্ত দেহ দিয়ে সারিবদ্ধ জানোয়ারদের দল ভারী করা—তা বুঝতে পুরো একটা সেকেণ্ডও লাগল না প্রদীপের। জীবন্ত-মৃত নমুনা সংগ্রহের অভিযানের সর্বশেষ লক্ষ্য সে—এই কথা এর মাথায় আসা মাত্র নিদারুণ আতংকে লাফিয়ে উঠল ওর হৃদযন্ত্র।

অস্ফুট, অবোধ্য চীৎকার করে লাফিয়ে পিছিয়ে এল প্রদীপ এবং এক ঝটকায় অভ্যস্ত ক্ষিপ্রহাতে স্লিং থেকে নামিয়ে নিলে রাইফেল। যে শম্-কে ওরা ফেলে গিয়েছিল পৃথিবীতে—সেই শম্ তখনও প্রায় তিরিশ গজ দূরে। সেই একই মন্থর কিন্তু একঘেয়ে অপরিবর্তনীয় গতিবেগে এগিয়ে আসছিল সে। নিষ্ঠুর পশু যে ভাবে সোজাসুজি তেড়ে এসে আক্রমণ করে তার চাইতেই এ আক্রমণের ধরন অনেকাংশে ভয়াবহ। নিশ্চিন্ত অগ্রগতির মধ্যে এতটুকু তাড়াহুড়ো করার প্রয়াস নেই এবং সেই জন্যেই তা আরও ভয়ংকর।

চকিতে একটা কার্টিজ টেনে নিয়ে চেম্বারে ভরে ফেললে প্রদীপ। তারপর কাঁধের ওপর কুঁদো রেখে দৃষ্টি প্রসারিত করে দিলে মাছি বরাবর। দৃষ্টিপথের অপর প্রান্তে রইল চামড়ার মত জিনিসটা। ঝলমলে সূর্যের নীচে বড় সুন্দর লক্ষ্যবস্তু। ঘোড়া টানার সময়ে নিষ্ঠুর মৃদু হাসি ভেসে ওঠে ওর ঠোঁটের কোণে। ১৮০ গ্রেনের, ধাতুর জ্যাকেট পরা, নৌকো-পুচ্ছ বুলেটগুলোর গতি যে সেকেণ্ডে ২৭০০ ফুট, তাতে আর তার অজানা নয়। এত কাছ থেকে খুব সম্ভব শুধু একটা গর্ত সৃষ্টি করে দফারফা করে ছাড়বে ঐ কদাকার জঘন্য জিনিসটার।

দড়াম! কাঁধের ওপর সেই পরিচিত ধাক্কা। ই-ই-ই-ই! আর্ত সুরে বাতাসের বুক চিরে ছুটে যাওয়ার শব্দ! তার পরেই, যেন নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে ওর। না, সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। মাত্র বিশ গজ দূরে ওর কালান্তকস্বরূপ রাইফেলের বুলেট শম্-এর গায়ে লেগেই ছিটকে বেরিয়ে গেছে।

ক্ষিপ্তের মত আবার কার্তুজ ভরে প্রদীপ। পর পর দুবার অগ্নিবর্ষণ করে। তারপর বোঝে এ কায়দা একেবারেই নিরর্থক। এভাবে ধ্বংস করা যাবে না সামনের ঐ ভয়ংকর জিনিসটাকে। যখন মাত্র ছ ফুট দূরে পৌঁছোলো শম্, তখনও স্পষ্ট দেখতে পেলে আঁচিলের মত স্ফীতিগুলো থেকে লিকলিক করে উঠল চকচকে আঙুলের মত কতকগুলো হুক। আর, সবুজ তরল পদার্থে সপসপে হুলের মত ফাঁপা একটা শলাকা সাপের জিহ্বার মত কিলবিল করে উঠল হুক গুলোর মাঝে।

পেছন ফিরেই উধ্বশ্বাসে দৌড়াতে শুরু করল প্রদীপ।

প্রদীপের তখনকার ওজন ছিল ১৪৯ পাউণ্ড।

সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই বরং সোজা। শম্-এর চলাফেরা দেখে মনে হলো ওর চাইতে বেশী গতিবেগ অর্জন করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। কিন্তু সেদিক দিয়েও যে খুব টেক্কা দিতে পারবে বলে উল্লাস বোধ করতে পারে না প্রদীপ। একনাগাড়ে বিরামবিহীনভাবে এবং কোন রকম মন্থরতা বা দ্রুতির অবকাশ না রেখে পৃথিবীর কোন প্রাণীর পক্ষে ঘণ্টায় পাঁচ মাইল বেগে যাওয়া কয়েক ঘণ্টার বেশী সম্ভব নয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রদীপ বুঝতে পারলে এ বস্তুটি যে শিকারের পেছনে ধাওয়া করে, সে প্রাণীটি হয় ঘুরে এসে লাফিয়ে পড়ে নাছোড়বান্দা বস্তুটির ওপর। অথবা, প্রাণীটি যদি অপেক্ষাকৃত ভীতু শ্রেণীর হয়, তাহলে আতংকে বিহ্বল হয়ে বারবার চক্কর দিতে থাকে একই বৃত্তপথে যতক্ষণ না ক্লান্তিতে অবশ হয়ে লুটিয়ে পড়ছে সে মাটির ওপর। এ জিনিসের খপ্পর থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে একমাত্র ডানাওয়ালা প্রাণীরাই। কিন্তু জমির ওপর যাদের যাতায়াত তাদের পরিণতি শুধু একটিই এবং তা হলো শিহরণ জাগানো ঐ প্রদর্শনী সারির আর একটি নমুনা বাড়ানো। কিন্তু কার জন্যে এই বিপুল সংগ্রহ? কেন? কেন? কেন?

ছুটতে ছুটতে ধীর মস্তিষ্কে একটার পর একটা বোঝা হাল্কা করতে থাকে প্রদীপ। লাল সূর্যের দিকে একবার তাকিয়েই শিউরে ওঠে আসন্ন অমানিশার অন্ধকারের কথা ভেবে। রাইফেলটা নিয়ে মহাদ্বিধায় পড়লো ও। শম্-এর ওপর এ হেন জবর হাতিয়ারেরও কোন জারিজুরি খাটে নি। কিন্তু তবুও তখুনি তখুনি অস্ত্রটা হাতছাড়া করা যে উচিত নয়—এই শিক্ষাই সে পেয়েছে সামরিক স্কুল থেকে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকবে এ রাইফেল তার কাঁধে। যদি নিতান্তই গুরুভার হয়ে ওঠে, তখন উপায়ান্তর না থাকলে বর্জন করা ছাড়া আর কোন উপায়ই নেই। কিন্তু এই ভয়ংকর দৌড় প্রতিযোগিতার ফলাফল যে শেষ পর্যন্ত তারই বিপক্ষে যাবে, তা বুঝতে বিশেষ দেরী লাগে না প্রদীপের। সামরিক শিক্ষা যাই থাকুক, তার্কিক মনটা বারে বারে ওকে হুশিয়ার করে দিতে থাকে—রাইফেলটা একটা বোঝা ছাড়া কিছুই নয়। এ শত্রুকে এ দিয়ে যখন নিধন করা যাবে না, তখন সামরিক শিক্ষাকে আপাতত ভুলে গিয়ে অস্ত্রটাকে নিক্ষেপ করে যে দিকে খুশী। মন স্থির করে ফেলে প্রদীপ। ওজন অসহ্য হয়ে উঠলেই ৩-০৬ কে বিদায় দিতে হবে। কিন্তু এখন রাইফেলটাকে ও ঝুলিয়ে নেয় কাঁধে। গাইগার কাউন্টারকে সযত্নে বসিয়ে রাখে একটা চ্যাটালো পাথরের তাকের ওপর। কিন্তু লম্বা লম্বা পা ফেলায় এতটুকু শৈথিল্য দেখায় না ও।

একটা জিনিস নিশ্চিন্ত। এ দৌড় প্রতিযোগিতার সঙ্গে কচ্ছপ আর খরগোসের দৌড়ের কোন মিল নেই। অন্ধের মত ভয়ের তাড়নায় এ দৌড়োনোর শেষ পরিণতি হলো শ্রান্তিতে অবসন্ন হয়ে, শেষ বিন্দু শক্তিটুকু নিঃশেষিত করে আত্মসমর্পণ করা ঐ মন্থর গতি চলমান চামড়ার থলির খপ্পরে।

বুকভরে নিঃশ্বাস নেয় প্রদীপ। আশপাশে তাকায় যদি কিছু পাওয়া যায়, এই আশায়। এ প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করার কোন সংকেত যদি কোথাও পড়ে থাকে , তারই সন্ধানে ধূর্ত দৃষ্টি বুলোয় চারদিকে। সৌভাগ্যক্রমে উপত্যকার গাছপালাগুলো ছিল খুবই দূরে দূরে। না হলে জঙ্গলের মধ্যে সোজাসুজি দৌড়োনোর কোন সুযোগই পেত না ও।

হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যায় প্রদীপ। যে পথ দিয়ে ও ছুটে চলছে, সেই পথেরই ওপর কাৎ হয়ে ঝুলছে মস্ত একটা পাথরের চাঁই।

ঝুলন্ত পাথরের চাঁই। মতলব কিলবিল করে ওঠে ওর মস্তিষ্কের কোষে কোষে।

টিলাটার ওপর লাফিয়ে উঠে পেছনে তাকায় প্রদীপ। দূরে দেখা যাচ্ছিল ঘাস-সবুজ জমিটা। বিকেলের সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। লম্বা লম্বা ছায়া পড়েছে প্রান্তর-পাহাড়ের ওপর। কিন্তু পাছু-নেওয়া শম্-কে খুঁজে বার করতে বেগ পেতে হয় না ওকে। তখনও সেই একই গতিতে প্রদীপের পদচিহ্ন অনুসরণ করে এগিয়ে আসছিল শম্। যাতনাময় অধীর আগ্রহে জিনিসটার অগ্রগতি লক্ষ্য করতে থাকে ও। ঐটুকু সময়ের মধ্যেই সম্পূর্ণ হয় ওর পর্যবেক্ষণ। যা ভেবেছে তাই! সত্যিই তাই। যদিও অনেক ক্ষেত্রে প্রদীপের পায়ের চিহ্ন সিধে পথ ছেড়ে বেঁকা পথ ধরেছে, ভাল পথ ত্যাগ করে খারাপ পথে বাঁক নিয়েছে—তবুও একগুঁয়ে ভাবে এই আঁকাবাঁকা পদচিহ্নকেই অনুসরণ করে এগিয়ে আসছে শম্। এ দৃশ্য দেখতে যতটুকু সময় গেল, তার চাইতেও অল্পসময়ের মধ্যে স্থির হয়ে গেল ওর পরবর্তী কর্মপন্থা। সময় খুবই অল্প। মাত্র বারো মিনিট। এরই মধ্যে প্রদীপের নবলব্ধ জ্ঞানকে প্রয়োগ করতে হবে জিনিসটার কবল থেকে নিজেকে বাঁচানোর পরিকল্পনায়।

ইচ্ছে করে পা ঘষে ঘষে ঝুলন্ত পাথরটার তলা দিয়ে এগিয়ে যায় প্রদীপ। গজ দশেক যাওয়ার পর ফিরে আসে ঐ পথেই। তারপর তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে টিলার ওপরে একটা খাঁজে। তড়বড় করে উঠে যায় টলমলে পাথরের চাঙরটার ঠিক পেছনে।

সড়াৎ করে বেল্টের খাপ থেকে ছুরীটা টেনে বার করে ও। তারপরেই শুরু হয় মাটি খোঁড়া। বিজ্ঞানসম্মতভাবে কিন্তু অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সাথে চাঙরটার মূল দেশের মাটি আলগা করে দিতে থাকে ও। কয়েক সেকেণ্ড অন্তর অন্তর ভয়ে, উদ্বেগে ঘামতে ঘামতে এক কাঁধ দিয়ে পাথরটায় ঠেলা দিয়ে পরখ করতে থাকে ও। তারপর এক সময়ে, যেন কত যুগ পরে, সামান্য দুলে ওঠে অত বড় চাঙরটা। ছুরীটা সবেমাত্র খাপের মধ্যে ঢুকিয়ে গুঁড়ি মেরে বসে হাপরের মত ও হাঁপাচ্ছে, ঠিক এমনি সময়ে অদূরে একটা পাথরের আড়ালে তার পদচিহ্নের ওপর গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে এল শম্।

একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে প্রদীপ ধূসর বর্তুলাকার থলিটার দিকে। অনিমেষ চোখে দেখতে থাকে এগিয়ে আসছে জিনিসটা। এগিয়ে আসছে যতিহীন একই গতিতে। প্রাণপণে শ্বাস প্রশ্বাস প্রশমিত করার চেষ্টা করে ও। শম্-এর আর কি কি অনুভূতি আছে, সে প্রমাণ এখনও অবশ্য পাওয়া যায় নি। শুধু পায়ের ছাপ অনুসরণ করা ছাড়া নতুন কোন অনুভূতির চিহ্নও দেখা যায় নি তার হাবভাবে। কিন্তু তাহলেও সাবধানের মার নেই। কে জানে হয়তো পুরো একসেট যন্ত্রপাতিতে বোঝাই ওর ভেতরটা। সুযোগ মত যে কোন একটিকে ব্যবহার করা মোটেই আশ্চর্য নয় ও রকম বিদকুটে জিনিসের পক্ষে। চাঙরটার আড়ালে গুটি সুটি মেরে বসে থাকে প্রদীপ। প্রত্যেকটা স্নায়ুতে ছুটতে থাকে চনমনে তড়িৎপ্রবাহ।

কিন্তু শম্-এর কলকৌশলে কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। পদচিহ্ন অনুসরণেই সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে গড়াতে গড়াতে বস্তুটা এসে পড়ে ঠিক চাঙরটার তলায়। যেই আসা, সঙ্গে সঙ্গে বিকট চীৎকার করে শরীরের সর্বশক্তি দু’হাতের মাংসপেশীর মধ্যে এনে এক প্রচণ্ড ঠেলা মারলে প্রদীপ টলমলে পাথরের চাঙরটার ওপরে। হুড়মুড় করে চাঁইটা গড়িয়ে পড়ল ঠিক শম্-এর ওপর। বারো ফুট উঁচু থেকে খসে পড়ল পাঁচ টন ওজনের একটা বিশাল পাথর।

হাঁচর-পাঁচর করে টিলার গা দিয়ে নেমে আসে প্রদীপ। বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে বিশাল পাথরটার দিকে। তারপরে সোল্লাসে এক পদাঘাত করে পাথরটার ওপর—“কি হে, বুঝছো কেমন? সুকোমল ফিরে এলে তোমার ঐ মাংসের বাজার থেকে দু চারটে নমুনা আমরাও নিয়ে যাব ’খন। এবারের অভিযান তাহলে একেবারে বৃথা যাবে না, দেখছি। শয়তান কোথাকার! যে নরক থেকে তোমার আবির্ভাব—সেই নরকের আনন্দই উপভোগ করো এবার।”

তারপরেই, লাফিয়ে পিছিয়ে আসে ও। বিস্ফারিত হয়ে ওঠে দু চোখ, আতংকে অক্ষিকোটর থেকে যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায় প্রত্যঙ্গ দুটি! পাথরের বিশাল চাঁইটা নড়ছে। ধীরে ধীরে পাঁচ টন ওজনের পাথরটা সরে যেতে থাকে তার পদচিহ্নের ওপর থেকে। চোখের সামনেই প্রদীপ দেখতে পায় মাটির একটা স্তর উঠে আসে পাথরটার সঙ্গে। রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে ও। পাথরটা গড়িয়ে পড়ে পাশের দিকে। আর, ধূসর একটা বস্তুর খানিকটা নড়তে দেখা যায় ছোট্ট গর্তটার মধ্যে। আর্ত চীৎকার করে প্রাণ হাতে নিয়ে আবার দৌড়োতে শুরু করে প্রদীপ।

পায়ের ছাপ ধরে যে দিক থেকে এসেছিল, সেই দিকেই পুরো একটা মাইল দৌড়ে গেল ও। তারপর থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে তাকালে পেছন দিকে। বহুদূরে খসে পড়া পাথরটার কাছ থেকে সরে আসা একটা চলমান কালো বিন্দু চোখে পড়ে ওর। ঠিক আগের মত নিয়মিত গতিতে, মন্থর গতিতে, বিরাম বিহীন গতিতে ওরই দিকে এগিয়ে আসছিল বিন্দুটা। ধপাস করে বসে পড়ে প্রদীপ। ছড়ে যাওয়া, মাটি মাখা হাতের চেটোতে চেপে ধরে দুই কপাল।

কিন্তু হতাশার এই ভাব কিন্তু বেশীক্ষণ রইল না। কুড়ি মিনিট বিশ্রাম তো সে পাচ্ছে। চীৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ে ও। যতখানি পারে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে দেহের অবশ সন্ধি আর মাংসপেশীগুলোকে খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ দেয়। তারপর ট্রাউজারের পকেট থেকে বার করে খাবারের জরুরী প্যাকেটটা। দ্রুত হাতে বিস্কুট আর চকোলেট চালান করতে থাকে উদর গহ্বরে। এরপর বরফ-ঠাণ্ডা একটু জল খেলেই নবজীবন লাভ করবে ও। কিন্তু তার আগে তিনটে বেনজেড্রিন বড়ি গিলে ফেলে প্রদীপ। এ ধরনের দৈহিক সংকট কালে কাজে লাগবে বলেই বড়িগুলো সঙ্গে রেখেছিল প্রদীপ। তখনও মোটামুটি দশ মিনিটের পথ পেরোতে বাকী শম্-এর। আবার যাত্রা শুরু করে প্রদীপ। যে অবসাদ হাড়ের ভেতর পর্যন্ত পোঁচেছিল, তার বেশীর ভাগই উড়ে গিয়েছিল এ ক’মিনিটের বিশ্রামে।

পনেরো মিনিট দৌড়োনোর পর প্রায় তিরিশ ফুট উচু একটা খাড়াই পাহাড়ের সামনে এসে পৌঁছোয় প্রদীপ। দু পাশের পথ এমনই খারাপ যে কহতব্য নয়। চোখা চোখা কাঁটা ঝোপ, ছুরীর মত ধারালো পাথরের কিনারা, আর এবড়োখেবড়ো গহ্বর। কোন উপায়ে যদি পাহাড়টার চূড়োয় পৌঁছোনো যায়, তাহলেই কেল্লাফতে। শমকে বাধ্য হয়ে ঘুরে আসতে হবে অন্য দিক দিয়ে। সে ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে পড়বে হতভাগা এবং অনেকগুলো মিনিটও হাতে পেয়ে যাবে প্রদীপ।

সূর্যের দিকে তাকায় ও। লাল টকটকে বিশাল অরুণ দেহ দিগরেখা সবে স্পর্শ করেছে। আর দেরী নয়। চটপট হাত-পা চালাতে হবে এবার। পাহাড়ে চড়ার কোনো অভিজ্ঞতা নেই প্রদীপের। কিন্তু মূল পদ্ধতিগুলো জানা ছিল ওর। প্রত্যেকটা খাঁজ, এবড়ো-খেবড়ো জায়গা আর ছোট কিনারা ধরে টেনেটুনে নিজেকে তুলে আনতে থাকে ও চূড়োর দিকে। পাহাড়ে চড়ার কায়দা কিছুমাত্র না জেনেও অনেকটা তাদের মতই প্রাণের দায়ে উঠে আসতে থাকে প্রদীপ। ছোট্ট ছোট্ট খাঁজগুলোর ওপর হাতের পায়ের চাড়া দিয়ে ধাপে ধাপে দেহটাকে তুলে আনতে থাকে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে।

চূড়োয় পৌছোনোর সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের নীচে গড়িয়ে এসে পৌঁছেলে শম্।

প্রদীপ বুঝলো, আর দেরী করা সঙ্গত নয়। এই মুহূর্তেই এ জায়গা ছেড়ে শটকান দিতে হবে ওকে। আলোর রেশটুকু থাকতে থাকতেই তাকে কাজে লাগাতে হবে এই ক’টি অমূল্য মিনিটকে। এ সময়ে প্রতিটি মুহূর্তের মূল্য যে কতখানি, তা কোন ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা চলে না। তা সত্ত্বেও কৌতুহল আর আশাই ওকে ধরে রাখলে ওখানে। যে মুহূর্তে ঘুরপথে রওনা হবে শম, সেই মুহূর্তে নেমে এসে চম্পট দেবে ও। তাছাড়া, ছিনেজোঁকের মত জিনিসটা হতাশ হয়ে যদি হাল ছেড়ে দেয় তো এইখানেই টেনে ঘুম দিতে পারবে সে।
ঘুম! শরীরের প্রতিটা কোষে কোষে যেন ঘুমের রিমিঝিমি সঙ্গীত বেজে ওঠে! ঘুম! সারা শরীর দিয়ে সে কামনা করতে থাকে এই ঘুমকে।

কিন্তু ঘুরপথে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না শম্-এর। পাহাড়ের নীচে মাত্র কয়েক সেকেণ্ড ইতস্তত করলো সে। তারপরেই অনেকগুলো স্ফীতি খুলে গিয়ে বেরিয়ে পড়লো কতকগুলো ধাতুর প্রত্যঙ্গ। একটার ডগায় লাগানো ছিল লেনস। শূন্যে দুলে উঠল এই প্রত্যঙ্গটি। বিদ্যুৎবেগে নিজেকে টেনে নিলে প্রদীপ কিন্তু বড় দেরীতে। শম্-এর অলৌকিক চোখ নিমেষের মধ্যে দেখে নিয়েছে তাকে, পেয়ে গেছে তার হদিশ।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে চীৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে নিজের ওপরেই গাল পাড়তে থাকে প্রদীপ। মূর্খ! আহাম্মক!

চকিতে সব কটা প্রত্যঙ্গ সেঁধিয়ে গেল ভেতরে। অন্য একটা স্ফীতি থেকে বেরিয়ে এল একটা সরু রড। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় রক্তের মত লাল হয়ে ওঠে রডটা।

তার পরেই, তা সিধে উঠে আসতে থাকে প্রদীপের দিকে। আড়ষ্ট হয়ে রডটার উর্ধ্বগতি লক্ষ্য করতে থাকে ও। সড় সড় করে উঠে এসে রডটার আঁকশির মত ডগাটা আঁকড়ে ধরে পাহাড়ের একটা খাঁজ। ঠিক ওর নাকের নীচেই।

লাফিয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে প্রদীপ। রডটা এর মধ্যেই ছোট হতে শুরু হয়ে গিয়েছিল। শম্-ই টেন নিচ্ছিল চকচকে রডটাকে নিজের ভেতরে। আর, চামড়ার থলির মত বর্তুলাকার জিনিসটা উঠে আসছিল জমি ছেড়ে ওপর দিকে। অজান্তেই ঘড় ঘড় শব্দ বেরুতে থাকে প্রদীপের আতংক-বিহ্বল কণ্ঠ দিয়ে। নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকে ধাতুর আঁকশিটার দিকে। তারপর একটা পা পিছিয়ে নেয় মোক্ষম পদাঘাতের জন্যে।

এবারেও কিন্তু ওর ঐ অভিজ্ঞতাই সংযমী করে তোলে ওকে। লাথি মারা মুলতবী রাখে প্রদীপ। লাথি মারতে গিয়ে কত জনে যে কি শোচনীয়ভাবে হার স্বীকার করেছে, তা তো তার অজানা নয়। অবিবেচকের মত লাথি চালিয়ে পরাজয় স্বীকার করতে রাজী নয় প্রদীপ। শম্-এর এমন খাসা যন্ত্রপাতির সংস্পর্শে ওর দেহের কোন অংশ আনা হবে নেহাতই বোকামো। তার বদলে গাছের শুকনো একটা ডাল তুলে নেয় প্রদীপ। তারপর একটা প্রান্ত ধাতুর আঁকশির ভেতরে গলিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে চাড় দিতে শুরু করে।

মড়-মড়-মড়াৎ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল একটা চোখ ধাঁধানো ঝিলিক—ধবধবে সাদা আর ফিতের মত। শুকনো কাঠের মধ্যে দিয়েও প্রদীপ অনুভব করে সেই প্রচণ্ড শক্তির ধাক্কা—যে শক্তি নিমেষের মধ্যে কাঠের ডগাটা টুকরো টুকরো করে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলে। ধোঁয়া-ওঠা ডাণ্ডাটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় ও—যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে যায় মুখ। অসাড় আঙুলগুলো দুমড়ে মুচড়ে অবরুদ্ধ ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে পিছিয়ে আসে কয়েক পা। মুহূর্তের জন্যে থমকে দাড়ায় ও। পাশের দিকে ফিরে আবার পদযুগল আশ্রয় করে চম্পট দেওয়ার জন্যে। কিন্তু তারপরেই প্রবল জিঘাংসার অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে অধরোষ্ঠে। নিষ্ঠুর সংকল্পে ঝিকমিক করে ওঠে দাঁতের মাড়ি—ঝটিতি স্লিং থেকে নামিয়ে আনে রাইফেলটা। ভালই হয়েছে। এতদূরে শম্-কে এনে উচিত কাজই করেছে প্রদীপ। এবার পাওয়া গেছে তাকে মুঠোর মধ্যে। আশায় উল্লাসে দুলে ওঠে ওর বুক।

জানু পেতে বসে পড়ে প্রদীপ। পড়ন্ত আলোয় মাছি বরাবর তাকিয়ে নিশানা ঠিক করে নেয়—নলচে স্থির হয়ে থাকে আঁকশিটার ওপর। তারপর ফায়ার করে ও। ধপ করে একটা শব্দ হয়। পড়ে গেছে শম্। বাজখাঁই চীৎকার করে ওঠে প্রদীপ। জবর বুলেট এবার পেরেছে তার মর্যাদা রাখতে। বুলেটের কামড়ে শুধু আঁকশিটাই চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে আলগা হয়ে যায় নি, পাহাড়ের গায়ে একটা মস্ত গহ্বরের সৃষ্টি করেছে। হতভাগা শম্-এর সাহস হবে না ধাতুর থাবা দিয়ে পাহাড়ের ঐ অংশটা আবার আঁকড়ে ধরার।

নিচের দিকে তাকায় প্রদীপ। বাস্তবিকই জমির ওপরেই আছড়ে পড়েছে চামড়ার থলির মত জিনিসটা। দাঁত বার করে হেসে ওঠে প্রদীপ। এরপর যতবার ঐ কদাকার জিনিসটা ধাতুর আঁকশি লাগাবে পাথরের খাঁজে ততবার বুলেট বর্ষণে মাটি টের পাইয়ে দেবে সে। দেখা যাক, কতবার আছাড় খাওয়ার ধৈর্য থাকে শম্-এর। বুলেটের তো আর অভাব নেই তার। চাঁদ না ওঠা পর্যন্ত দরকার হলে কয়েক ইঞ্চি দূর থেকেও গুলি চালাতে কসুর করবে না ও। তারপর চাঁদ উঠলে খেলা আরও জমে উঠবে। তাছাড়া ঐ জিনিসটা জড় পদার্থের মত দেখতে হলেও নিশ্চয় বুদ্ধি রাখে যথেষ্ট। শেষ পর্যন্ত নিরর্থক প্রচেষ্টায় বিরতি দিয়ে হয়ত হতভাগা ঘুরপথে রওনা হতে পারে। সেই সুযোগে পায়ের দাগ ঢেকে আত্মগোপন করার পক্ষে একটা রাতই যথেষ্ট।

আর, তারপরেই—দম বন্ধ হয়ে আসে ওর। ক্ষণেকের জন্যে অশ্রুও ছলছল করে ওঠে ক্লান্ত দুই চোখে। অনেক নিচে আবছা অন্ধকারের মধ্যে থেকে কুৎসিত বর্তুলাকার বস্তুটা এবার তিন-তিনটে আঁকশিওয়ালা রড একই সাথে পাঠিয়ে দিচ্ছে ওপর দিকে। হু হু করে উঠে আসছে রডগুলো তার দিকে। তারপর খাঁজটা আঁকড়ে ধরলো তিনটে আঁকশি—প্রত্যেকটি আঁকশির মধ্যে ব্যবধান রইল প্রায় চার ফুট।

রাইফেলটা চট করে কাঁধে তুলল প্রদীপ। ঠিক আছে, উপর্যুপরি গুলি চালিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল সে ক্যাম্পে। আর আজ এসেছে তার এই ক্ষমতার চরম পরীক্ষার দিন। প্রভেদ শুধু এই যে রাতের অন্ধকারে কোনদিন তাকে ক্যাম্পে এ পরীক্ষা দিতে হয়নি।

প্রথম ফায়ারিংটা হলো বেজায় নিখুঁত—গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে উড়তে লাগল পাথর। খসে পড়ল আঁকশিটা। দ্বিতীয় বুলেটটাও মোক্ষম আঘাত হানলে দু’নম্বর আঁকশিটার ওপর। আরও খানিকটা পাথর উড়লো শূন্যে। খসে পড়ল মাঝের আঁকশি। কিন্তু তিন নম্বর আঁকশির দিকে নলচে ফেরাতে না ফেরাতেই প্রদীপ বুঝল বৃথা, সব বৃথা, সে যতবড় বন্দুকবাজই হোক না কেন, এ জিনিসকে জাহান্নমে পাঠানোর ক্ষমতা তার নেই। | প্রথম আঁকশিটা আবার যথাস্থানে চেপে বসেছিল। যত দ্রুতই গুলিবর্ষণ করুক না কেন প্রদীপ, একটা না একটা আঁকশি সব সময়েই আঁকড়ে থাকবে। পাহাড়ের খাঁজ এবং ধীরে ধীরে তুলে নিয়ে আসবে শম্-কে।

রাইফেলটাকে একটা গাছের শাখায় ঝুলিয়ে ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে দৌড়তে শুরু করল প্রদীপ। বহু বছরের কষ্ট সহিষ্ণুতার অভ্যাস থাকার ফলেই এত কষ্টও সে সহ্য করে যেতে পারছে আজ। কিন্তু কোথায় চলেছে সে? এখন সে করবেই বা কি? পেছনের ঐ জঘন্য জিনিসটার গতিরোধ করার মত কোন হাতিয়ারই কি নেই এ দুনিয়ায়?

তখনই মনে পড়ল ডিনামাইটের কথা।

ধীরে ধীরে গতি পরিবর্তন করে শ্রান্ত অবসন্ন প্রদীপ লেকের ধারে তার ক্যাম্পে ফিরে চলল। মাথার ওপর মিটমিটে তারাগুলো ফিকে আলো ফেলে পথ দেখাতে লাগল ওকে। সময়ের সবকিছু হিসেব আর অনুভূতি হারিয়ে ফেলে প্রদীপ। দৌড়োতে দৌড়োতেই নিশ্চয় খাওয়াটা শেষ করেছিল ওকে—কেননা ক্ষিদে তো কই পাচ্ছে না। ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে একটু খেয়ে নিলেই চলবে’খন… না, না, সময় হবে না… একটা বেনজেড্রিন বড়ি খেলেই চলে যাবে। না, না, বড়ি তো ফুরিয়ে গেছে, চাঁদও উঠে এসেছে ওপরে… পেছনেই এসে পড়েছে শম্। শুনতে পাচ্ছে প্রদীপ। একদম পেছনে। খুব কাছে।

মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে আলোজ্বলা চোখগুলো উঁকি মেরে গেল ওর ওপর। ভোরের দিকে একটা ভালুকও পরম অসন্তোষের সঙ্গে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে পেরিয়ে গেল সামনের পথ।

সূর্য ওঠার একটু পরেই লেকের ধারে পৌছোলো প্রদীপ। এত কাছে এসে গিয়েছিল শম্ যে ঘাসপাতার মধ্যে দিয়ে যেন তার আসার সড়সড়ানিও শুনতে পাচ্ছিল ও। টলমল করে উঠল প্রদীপ। মুদে এল দুই চোখ। আচ্ছন্ন ভাবটা ঝেড়ে ফেলার জন্যে নাকের ওপর ছোট ঘুসি মারে ও। চোখ খুলে যায়। চোখের সামনেই দেখতে পায় ডিনামাইটগুলোর আচ্ছাদন। ডিনামাইটের চটচটে ষ্টিকগুলোর দৃশ্য মনে পড়তেই সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে ওঠে ও।

এরপর করণীয় কি? পলতে? না। পায়ের ছাপের ওপর পলতে ডিনামাইট বসিয়ে ঠিক কতখানি সময় পরে তা ফাটানো দরকার—সে হিসেব অতখানি নিখুঁতভাবে করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। দরদর করে ঘাম গড়িয়ে পড়তে থাকে। সারা গা বেয়ে। জামা-কাপড়ও ঘামে মাটিতে চিটচিটে হয়ে উঠেছিল। ঠিক যে মুহূর্তে শম্ এসে পৌছোবে ডিনামাইটের ওপর, সেই মুহূর্তেই দূর থেকে ঘটাতে হবে বিস্ফোরণটা। কিন্তু লম্বা লম্বা পলতে লাগানো সঙ্গত মনে করে না প্রদীপ। কতখানি বেগে পলতে জ্বলবে, তার তো কোন ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। এমনও হতে পারে শম্ ডিনামাইট পেরিয়ে যাওয়ার পর হয়ত ঘটলো বিস্ফোরণ। থুৎনি নেমে আসে দ্রুতস্পন্দিত বুকের ওপর। কি করবে ও? এ সমস্যার সমাধান কি ভাবে করবে ও? তারপরেই ঝাঁকানি দিয়ে মাথা তুললে ও, পিছিয়ে এল কয়েক পা। তখনই চোখে পড়ল .২২ পিস্তলটা। যেখানে রেখে গিয়েছিল, ঠিক সেইখানেই পড়েছিল খুদে হাতিয়ারটা।

কোটরে বসা দুই চোখে এবার বিদ্যুৎ জ্বলে ওঠে।

উন্মাদের মত বাক্সটার মধ্যে স্তুপের মত সাজায় যতগুলো ডিনামাইট ছিল ওর ভাণ্ডারে—সব। আলগা বারুদও ছড়িয়ে দেয় এন্তার। তারপর বাক্সটা নিয়ে গিয়ে বসায় শম্ যে পথে আসছে, সেই পথের ওপর। বিশ গজ দূরেই ছিল ছোট্ট একটা টিলা। টিলার আড়ালে গিয়ে বসে পড়ে ও। সরু একটা খাঁজের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরে পিস্তলের নলচেটা। মারাত্মক ঝুঁকি নিচ্ছে সে। মাত্র বিশ গজ দূরে ঐ ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটলে তাকেও আস্ত পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। কিন্তু জীবন্ত অবস্থায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শম্-এর কশাইখানায় স্থান পাওয়ার চাইতে ডিনামাইটে মৃত্যুও অনেক ভালো।

আড়ষ্ট হয়ে ওঠে ও। এসে গেছে শম্। দূরে পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে গড়ানো বস্তুটা। চামড়ার থলির মত দেখতে হলেও যা চামড়ার থলি নয়। পৃথিবীর কোন বস্তুই নয়। এগিয়ে আসতে থাকে সে নিশ্চিন্ত গতিবেগে ডিনামাইটের স্তুপের দিকে।

শক্ত হয়ে ওঠে প্রদীপের চোয়ালের হাড়। উত্তেজনায়, উদ্বেগে, শ্রান্তিতে, মাথার শিরা উপশিরাগুলো যেন ছিঁড়ে পড়তে চায়। পিঠের ওপর পড়ছিল সকালের সূর্যের উষ্ণ স্পর্শ। একটা পাখী ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। ছপাৎ করে লাফিয়ে ওঠে একটা মাছ লেকের জলে।

আচমকা প্রদীপের অতন্দ্র চোখ খরখরে হয়ে ওঠে। কি মুস্কিল! এত সময় থাকতে এই সময়েই কিনা হতচ্ছাড়া ভালুকটার বেড়ানোর খেয়াল হলো এদিকে। মন্থর গতিতে হেলতে দুলতে পাশের ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসে জানোয়ারটা। এসে দাঁড়ায় ডিনামাইটের কাছে। তারপর সন্দিগ্ধভাবে বার দুয়েক আঘ্রাণ নেয়। মানুষের গন্ধ পেয়েই বুঝি গলার মধ্যে ঘড়ঘড় করতে থাকে কিছুক্ষণ।

আর, উত্তেজনায় কাঠ হয়ে বসে নিঃশব্দে অভিসম্পাত দিতে থাকে প্রদীপ। ভালুকটার কাঁধের ওপর দিয়েই অদূরে দেখা যাচ্ছে গড়ানে জিনিসটা। অব্যাহত গতিতে এগিয়ে আসছে প্রদীপের পদচিহ্ন অনুসরণ করে। এবার ভালুকটারও চোখ পড়ে সেদিকে। তখনও প্রায় বিশ গজ দূরে রয়েছে শম্-এর দেহপিণ্ড। গজরাতে গজরাতে এগিয়ে যায় ভালুকটা। কিন্তু ফুট ছয়েক দূরে আসতেই থমকে দাড়িয়ে যায় শম্। ভালুকটাও দাঁড়ায়। তারপর পেছনের দু’পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে ওঠে সে—সে কি মূর্তি! জিঘাংসা যেন মূর্ত হয়ে ওঠে—দাঁড়িয়ে ওঠে শম্-এর সামনে। রক্তবর্ণ ঠোটের পাশে ঝিলিক দিয়ে ওঠে ভয়াবহ চকচকে দাঁতের সারি। কিন্তু কাজ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না শম্। তাই আমোল না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার তালে গড়িয়ে যায় একদিকে। খেপে যায় ভালুকটা, সরে এসে পথ আটকায়। গজরানিও বাড়তে থাকে। আর তার পরেই থাবা চালালে সে। সারি সারি বল্লমের মত বেঁকানো নখ বসানো মারাত্মক সেই থাবার প্রচণ্ড ঘায়ে গণ্ডারের চামড়াও ফালা ফালা হয়ে যেত। কিন্তু বিস্ফারিত চোখে প্রদীপ দেখলে শুধু খানিকটা ধুলো উড়ে যেতে শম্-এর ধূসর দেহ থেকে।

আচমকা ধাক্কার বেগ সামলাতে না পেরে মাত্র কয়েক ইঞ্চি ছিটকে পড়ে একদিকে—তার বেশী নয়। গতি স্তব্ধ করে সেকেণ্ড কয়েকের মধ্যে সামলে নেয় নিজেকে। তারপর যেন কিছুই হয়নি, এমনি নির্বিকারভাবে আবার গড়াতে শুরু করে আরো বড় চক্কর দিয়ে। অনেকখানি ঘুরে আততায়ীকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতলবে।

কিন্তু জঙ্গলের রাজা কোন লড়াই অসমাপ্ত রেখে যাওয়া পছন্দ করে না। চকিতে, অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় জমির ওপর দিয়ে যেন পিছলে যায় তার অতবড় দেহখানা। তারপর গর্জন করে উঠে লাফিয়ে পড়ে শম্-এর ওপরে, সামনের দুই থাবা দিয়ে সবলে আঁকড়ে ধরে অপার্থিব থলিটাকে। আর ঝকঝকে দাঁতের সারি দিয়ে প্রচণ্ড কামড় বসায় ধূসর বস্তুটার ওপর।

উত্তেজনায় এবার সব ভুলে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে প্রদীপ। মূর্খ! মূর্খ! নিরেট মূর্খ না হলে এভাবে শম্-এর সাথে শক্তির পরীক্ষা করতে কেউ এগোতো না।

ধূসর পটভূমিকায় বিদ্যুৎবেগে ঝলসে উঠল রূপালি ধাতু। একটি মাত্র ধাতু। একটি মাত্র ঝিলিক দেখা গেল। অত্যন্ত দ্রুত এবং মারাত্মক সে ঝিলিক। জঙ্গলাধিপতির গর্জন মুহূর্তের মধ্যে নেমে আসে কাতর গোঁ গোঁ শব্দে। তারপর সেকেণ্ড কয়েক ঘড়ঘড়ানির পর প্রায় এক টন ওজনের বিভীষিকা অবশ হয়ে এলিয়ে পড়ে জমির ওপর। প্রাণহীন সে দেহ। গলাটা কেটে ঠিক দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল। প্রদীপ স্পষ্ট দেখতে পেলে রক্ত মাখা ফলাটা ধোঁয়াটে শম্-এর ভেতরে সেঁধিয়ে গেল নিমেষে। ধুলোর ওপর সামান্য একটু উজ্জ্বল লাল রঙ ছাড়া আর কোন চিহ্নই রইল না তার নিরীহ আকৃতিতে!

ভালুকটার নিষ্প্রাণ দেহ পেরিয়ে এগিয়ে এল শম। এগিয়ে এল প্রদীপের পদচিহ্নের ওপর। আবার শুরু হলো অগ্রগতি। পাথরের আড়ালে মাথা নামিয়ে নেয় প্রদীপ। ঠিক আছে। তবে তাই হোক। জঙ্গলের বিভীষিকাও আজ পরাজিত। কিন্তু ডিনামাইটের ঐ স্তুপ পেরিয়ে…

খুব শান্তভাবে, সাবধানে পিস্তলের ঘোড়া টেনে ধরল প্রদীপ। সংক্ষেপে প্রথমে শোনা গেল বিস্ফোরণের শব্দ। তার পরেই অনেকগুলো অতিকায় অদৃশ্য হাত যেন ঝাঁকানি দিয়ে শূন্যে টেনে তুলেই ছেড়ে দিল তাকে। মুখ থুবড়ে পড়ল প্রদীপ একটা আলকুশীর ঝোপের ওপর। কিন্তু আঘাতের বেদনা বোধ তখন ওর লোপ পেয়েছিল। ওর মনে পড়ে, আকাশের পাখীগুলোও যেন আচম্বিতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এর পরেই কয়েক গজ দূরে ঘাসের ওপর ধপ করে একটা ভারী জিনিস পড়ার শব্দ। তারপর সব চুপ।

মাথা তুললে প্রদীপ… এ রকম অবস্থায় সব পুরুষই যা করে। সারা গায়ে তখনও টনটনে বেদনা। অতিকষ্টে কাঁধ তুলতেই ও দেখতে পেলে… অদূরে মাটিতে সৃষ্টি হয়েছে একটা বিশাল গহ্বর। তখনও ধোঁয়া উঠছিল গহ্বরের ভেতর থেকে। আরও একটা একটা জিনিস দেখলে ও। ফুট দশেক দূরেই ধূসর সাদাটে বস্তুটা চিনতে কোন অসুবিধে হলো না ওর। রেণু-রেণু পাথরে ঢাকা পড়ায় কিম্ভুতকিমাকার দেখতে লাগছিল শম্-কে। প্রদীপের মনে হলো এর কানের রিমঝিম শব্দ এবার বুঝি মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে পড়ছে।

গড়াতে শুরু করে শম্। এগিয়ে আসে সোজা তার দিকে।

পিস্তলের আশায় আশপাশ হাতড়াতে থাকে প্রদীপ। কিন্তু কোথায় পিস্তল বিস্ফোরণের ধাক্কায় কোথায় যে ঠিকরে পড়েছে, খোঁজবারও অবসরও নেই…

মাত্র এক ফুট দূরে এসে গেছে শম্। দুই চোখ মুদে ফেলে প্রদীপ। সমস্ত শরীর হিতশীতল হয়ে যায় ধাতুর তৈরী আঙুলের স্পর্শে। আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরে ওকে, শূন্যে তোলে। বাধা দেওয়ার কোন ক্ষমতা ছিল না প্রদীপের অবশ দেহে। ইঞ্চি কয়েক উঁচুতে তুলে তাই ওর শিথিল শরীরটাকে কয়েকবার অদ্ভুতভাবে ঝাঁকানি দেয় শম্। থর থর করে কেঁপে ওঠে প্রদীপের সর্বাঙ্গ। অপেক্ষা করতে থাকে সেই ভয়ংকর সিরিঞ্জের, যে সিরিঞ্জের ভেতরে আছে নীল রঙের তরল পদার্থ। আর, মনের চোখে দেখতে পায় হলদেটে রঙের একটা টিকটিকির কুঁচকোনো মুখ—চোখের পাতা যার ঈষৎ কম্পমান।

তারপর, নির্বিকারভাবে, কোন রকম রূঢ়তার লক্ষণ না দেখিয়ে ওকে জমির ওপর নামিয়ে দেয় শম্। কয়েক সেকেণ্ড পরে চোখ খুলে ও দেখলে বর্তুলটা গড়াতে গড়াতে সরে যাচ্ছে ওর কাছ থেকে। নির্নিমেষ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে প্রদীপ।

মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তার পরেই সী প্লেনের ইঞ্জিনের শব্দ ভেসে এল ওর ওর কানে। চোখ খোলার পর ও দেখেছিল উদ্বিগ্নমুখে ওর ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুকোমল।

একরাতেই দশ পাউণ্ড ওজন কমে গিয়েছিল প্রদীপের।

[বিদেশী ছায়ায়]
‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার ‘সেপ্টেম্বর-জানুয়ারী ১৯৬৩’ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এই গল্পটি। ‘আশ্চর্য!’-এর সমস্ত লেখার বর্তমান প্রকাশক ‘কল্পবিশ্ব পাবলিকেশানস’-এর সৌজন্যে লেখাটি এবারের সংখ্যায় পাঠকের সামনে আবার নিয়ে এল ‘পরবাসিয়া পাঁচালী’।