একটি মেটাফিজিক্যাল মৃত্যু - নীলাভ বিশ্বাস

অলংকরণ : নীলাভ বিশ্বাস

রাত সাড়ে এগারটা, রাস্তার দুপাশে ঝুপড়ি দোকান বন্ধ। এলোমেলো একটা হাওয়া দিচ্ছে মাঝে মাঝে। কৌশিক একটা সিগারেট ধরিয়ে দাঁড়ালো ব্রিজটার মুখটায়। ধোঁওয়া আর আলোর পেছনে মিটমিট করে জ্বলছে অফিসগুলো, ইউনিটেকের গেটের সামনে রোজকার ভিড়টা আজ নেই। কয়েকজন দাড়িয়ে এদিক ওদিক, চেনা মুখগুলো নেই। কৌশিক চেয়েছিলো এমনটাই, যাওয়ার সময় কথা না বলাই ভালো। সামনে দিয়েই বেরিয়ে গেল দুটো শাটেল, কৌশিক সিগারেটটা শেষ করে ফেলে একভাবে তাকিয়ে আছে। এলোমেলো হাওয়াটা ধোঁওয়াটাকে যেন ধাক্কা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। যেমন ভাবে কৌশিকও জানে না ও কোথায় যাবে। কৌশিকের বয়েস বছর বত্রিশ, বিবাহিত দু'বছর ধরে। তিতলির সাথে আলাপ আগের কোম্পানিতে। কৌশিকের রোজগারও ভালই। নামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় রয়েছে বছর দশেক। নিউটাউনের থ্রি বিএইচকে ফ্ল্যাটে সুখী নিউক্লিয়ার পরিবার! কিন্তু সব গল্পের মত এই গল্পেও অনেক খাদ আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক।

আত্মহত্যা ব্যাপারটা সহজ নয়। অনেক গোছগাছ চাই, পরিকল্পনা চাই। অফিস লাঞ্চে, সকালের বাজারটা শেষ করে, রাতে খাওয়ার পর – পরিকল্পনা করে যাওয়াটা জরুরি। আপনি কীভাবে জীবনের শেষ ট্রেন ধরবেন সেটা আপনাকেই ভাবতে হবে। কৌশিক ব্যাপারটা নিয়ে প্রথম ভাবা শুরু করেছিল একটা বৃষ্টির দিনে। তিতলির মোবাইলটা যেন একটা মারণকাঠি মনে হয়েছিল সেদিন। রাজীবের সাথে ওর মেসেজ গুলো .........। কৌশিক বিষ খেতে চায় না। মেজমাসি মরেছিল বিষ খেয়ে,সারা শরীরটা নীল হয়ে ফুলে গেছিল। গলায় দড়ি দেওয়াটাও ফুলিশ, ঠিক মত ফাঁস না লাগালে মরবে না। রাত বাড়তে থাকে। লোকজন নেই চারপাশে। কৌশিক ব্রিজটা ধরে হাঁটতে থাকে। পকেট থেকে বার করে একটা কাগজ। সুইসাইড নোট।

“নাহ! ঠিকই আছে!” বিড়বিড় করে বলে ওঠে কৌশিক। ব্রিজের মাঝখানটা থেকে ঝাঁপ দেবে কৌশিক। নীচের পাথর ভর্তি রাস্তাটায় পড়বে শরীরটা। মরে যাওয়া উচিত এখান থেকে ঝাঁপ দিলে। অনেক কিছুই ভাবতে থাকে কৌশিক।

“স্যার! পাঁচ মিনিট টাইম হবে? আমাদের একটা প্রডাক্ট ছিল, খুবই ভালো প্রোডাক্ট, যদি দেখতেন...।”

কৌশিক লোকটাকে প্রথমে খেয়াল করেনি, ব্রিজ দিয়েই উঠে এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। এ আবার কোত্থেকে এলো ভাবে কৌশিক।

“না, দাদা! কোন দরকার নেই, আপনি আসতে পারেন।”

“একী বলছেন মিস্টার পাল? দরকার নেই! আপনি এখন যে কাজটা করতে যাচ্ছেন আমি তাতেই সাহায্য করতে এসেছি, আপনার শেষযাত্রা ভালোভাবে হোক এটাই চায় আমাদের কোম্পানি...”

“ম... মানে? আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে? কী বলছেন এসব?”

কৌশিক লোকটাকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। আলো আঁধারির মাঝে দাড়িয়ে সে। কীভাবে জানলো লোকটা এসব। আর সুইসাইডের ব্যাপারটা...

“আজ্ঞে, ওটা আপনার সার্চ ট্রেণ্ড দেখে জেনেছি আমরা স্যার! ভয়ের কিছু নেই। আমরা আপনার সাথেই আছি।”

“কী আবোল তাবোল বকছেন? কে বলল আমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছি?”

“ওই যে বললাম স্যার! আপনার গত দুমাসের সার্চ ট্রেণ্ড। আমাদের অফিসের মিকি বলে নতুন ছোকরা অবশ্য আগেই জানিয়েছিল আমায়। ছোকরা ব্রাইট স্যার! দিব্বি বুঝে গেছিল আপনি চলে যেতে চাইছেন।”

কৌশিক কী বলবে বুঝতে পারে না। পাটা কাঁপতে থাকে ওর। শেষমেশ কি চোর ছিনতাইবাজের হাতে মরতে হচ্ছে তাহলে আজ!

—“কত টাকা চাই বলুন দাদা! দিয়ে দেব। কী চান আপনি?”

লোকটা জিভ কেটে বলল,

—“এমা ছিঃ! কী যে বলেন স্যার। টাকা কেন নেব? আপনি একটু শান্ত হন,আমি আসছি ভারত সরকারের 'নির্বাণ' যোজনা থেকে। আমরা যোজনার হয়ে কাজ করি। ছোটো কোম্পানি স্যার! ভেণ্ডার পেয়েছে কিছুদিন আগে। আপনি আমাদের একশোতম কাস্টোমার, ডিসকাউন্টও পাবেন।”

কৌশিক ‘নির্বাণ’ যোজনার ব্যাপারটা জানত। ইউথানেসিয়া আইনি হওয়ার পর থেকে সরকারি বন্দোবস্ত। যদিও এটার পর থেকে ছোটো অনেক কোম্পানি ব্যাপারটাকে প্রফিট হিসেবে দেখে।

লোকটা ব্যাগ থেকে বার করল একটা মোটা ভি.আর সেট। সঙ্গে লাগানো অসংখ্য তার।

“এটা আমাদের প্রডাক্ট। LMR234, এটা পরে ফেললেই দু'মিনিটে আপনি পেয়ে যাবেন আপনার মনমত আত্মহত্যা। আপনি পছন্দ করতে পারেন প্যাকেজ, এই ক্যাটালগে সব আছে দেখে নিন।”

কৌশিক কাঁপতে থাকা হাতে কাগজটা নিল। বিভিন্ন রকম এর প্যাকেজ। মৃত্যুর সময় আপনি কী দেখতে চান তার বিবরণ। কৌশিক বুঝতে পারেনা কী বলবে, কিন্তু সে তৈরি। লোকটার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে যন্ত্রটার সাহায্যে মরতে ওর কোনও আপত্তি নেই। কৌশিক কাগজটা লোকটার হাতে দিয়ে বলে।

—“আমি তৈরি।”

—“এই তো মিস্টার পাল! তাহলে সেরে ফেলি আমার কাজ। আপনি একটা কাজ করুন এই পোস্টটার পাশে হেলান দিয়ে বসুন। দু'মিনিটের কাজ। কোন অসুবিধাই হবে না। আপানার জন্য সবথেকে ভালো প্যাকেজটাই বেছেছি।”

কৌশিক দমহীন পুতুলের মতই বসে পড়ে। লোকটা দ্রুত ওর সরু হাত দিয়ে যন্ত্রটা কৌশিকের মাথায় পরিয়ে দেয়। তারগুলো পাশে রাখা ল্যাপটপে এর সাথে লাগানো একটা বাক্সতে ঢুকিয়ে দেয় এক এক করে। সবই যেন অনেক আগে থেকেই সাজানো ছিল।

“একদম নড়বেন না স্যার! আমি কিছুক্ষণ এর মধ্যেই প্রসেস চালিয়ে দেব... একী স্যার! কাঁদছেন কেন আপনি? কোনো ভয় নেই। আপনি মরবেন... একশো শতাংশ হলফ করে বলছি। মাঝেমাঝে আমারও থাকতে ইচ্ছে করে না স্যার, কিন্তু টাকা নেই তাই ... যাইহোক এখানে একটা সাইন করে দিন। আপনার কাজ চুকে যাবে।”

কৌশিক সাইন করে দেয়। এলোমেলো হাওয়াটা আবার দিচ্ছে। ঘড়িতে রাত সাড়ে বারোটা বাজে। হঠাৎ করেই ওপরের ল্যাম্পপোস্টের আলোটা নড়ে ওঠে। চারপাশে সব ল্যাম্পপোস্ট এর আলোগুলোই যেন দুলে উঠছে। বুকটা খালি লাগছে।

—“উফ! কেমন যেন হচ্ছে...”

—“স্যার, উত্তেজিত হবেন না। আর কিচ্ছুক্ষণ, তারপর আপনি ওপারে। এবাবা, নামটাই জানানো হয়নি স্যার! আমি নবু, নবু দাস। বাড়ির লোককে জানিয়ে দেব, কোন চিন্তা করবেন না... গুডবাই স্যার! ভালো...”

লোকটা আর কিছু বলছিল, কিন্তু কৌশিক শুনতে পায়নি। কৌশিক এখন শূন্যে ভাসছে। চারপাশে বিভিন্ন রকমের রঙ। একটা চক্রাকার সিঁড়ির মাঝখান দিয়ে যাচ্ছে সে। এরপর শুরু হল বিভিন্ন সুর, তিতলি এসে হাত ধরে নিয়ে গেল একটা সাদা ঘরে। সেখানে আরো অনেক তিতলি, নগ্ন। তারপর একটা সবুজ মাঠে হাঁটতে লাগল কৌশিক, আকাশ এর রঙ অদ্ভুত সবুজ, একটা বিশাল গ্রহ দেখা যাচ্ছে। এ কোথায় এল কৌশিক? কৌশিক হাসতে লাগলো। যন্ত্রটা অদ্ভুত শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। নবু কৌশিকের মাথা থেকে খুলে নিয়ে ব্যাগে ঢোকাল জিনিসটা। মোবাইলটা বেজে উঠল—

“হ্যালো! হ্যাঁ... কাজ হয়ে গেছে। রবিনদাকে বল তো এই রোজ রোজ নাইটটা না দিতে। যতসব...”

সারা রাত হন্যে হয়ে খুঁজে না পেয়ে শেষ অব্দি পুলিশকে ফোন করে তিতলি। ওরাই খুঁজে বার করে কৌশিককে। রাজারহাট ব্রিজের একটা লাম্পপোস্টের সাথে বাঁধা। হসপিটালে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে বোঝা যায় কৌশিক ডিপ কোমায়। সমস্ত শরীর অনুভুতিহীন। হার্ট কাজ করলেও ব্রেন কোনো সাড়া দিচ্ছে না। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেছেন গত কয়েক মাস। পুলিশ এরকম আরও কিছু কেস পেয়েছে। কোনও রকম অ্যাকসিডেন্ট ছাড়াই মানুষ কোমায় চলে যাচ্ছে। ইন্টারপোলের বিশেষজ্ঞরা জানতে পেরেছেন যে কেউ বা কারা মানুষের ব্রেন ম্যাপ নেওয়ার জন্য এই পন্থা নিয়েছে। আর সেই কাজ করার জন্য বেছে নিয়েছে 'নির্বাণ' যোজনার নাম করে প্রতারণা।

কৌশিক ভালই আছে। ডিজিটাল সিমুলেসনে আত্মহত্যা, কেউ কোনোদিন করেনি।