নৈবেদ্য - পৃথ্বীশ গজী

অলংকরণ - পিয়াল চক্রবর্তী

রাত দশটা বাজতে এখনও মিনিট পাঁচেক বাকি। কিন্তু তার মধ্যেই খালি হয়ে গেছে রাস্তাটা। বেশ জোরেই বাইক চালাচ্ছিল শুভাঞ্জন। এমনিতে রাইপুর জায়গাটা ফাঁকা ফাঁকা। রাত একটু গাঢ় হলেই শুনশান হয়ে যায় এখানকার রাস্তাঘাট।

রাইপুরের আগে শুভাঞ্জনের পোস্টিং ছিল বিশুনগরে। জায়গাটা ভালো নয়। খুন খারাপি লেগেই থাকত। তাই শুভাঞ্জনের ব্যস্ততাও সেখানে ছিল চোখে পড়ার মত। সেদিক থেকে দেখতে গেলে রাইপুরে এসে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে সে।

কাজ বলতে সকাল-বিকেলে কিছু বেআইনি বাইক ধরা।

তবে রাইপুরে বেআইনি বাইকের সংখ্যা কম। তার উপর রোজ বিকেলে পুলিশ যে রায় পেট্রল পাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সে কথাটা জেনে গেছে এখানকার সবাই। গত কয়েকদিন আর একটাও বাইক ধরা পড়েনি। এদিকে মাসও প্রায় শেষ হতে চলল। টার্গেট পুরো না করতে পারলে চাপ আসবে উপর মহল থেকে। শুভাঞ্জন একটা বিকল্প জায়গার কথা ভাবছিল। মাথায় আসছিল না। শেষ পর্যন্ত রাস্তা দেখিয়েছিল সাব-ইন্সপেক্টর রক্তিম, “দাদা, আজ ন’পাড়ায় দিকে চলুন। পুরো রাইপুরে তো ওই একটা জায়গাই জমজমাট। সারপ্রাইজ ভিজিট। কিছু বাইক পেয়ে যাবই।”

রক্তিমের কথা শুনে হাজার ওয়াটের বাল্ব জ্বলে উঠেছিল শুভাঞ্জনের মাথায়। রাগও হয়েছিল নিজের উপর। নয় নয় করেও তো দু’মাস হয়ে গেল এখানে। অথচ একবার মাথাতেও আসেনি ন’পাড়া বাজারের কথাটা!

সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ ওরা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ন’পাড়ার মোড়ে। ওরা বলতে ও, সাব ইন্সপেক্টর রক্তিম, দু’জন কনস্টেবল আর থানার ড্রাইভার অশোক। এই টিমটা নিয়েই ওরা বাইক ধরতে বেরোয় রোজ। অন্য সবাই স্পটে পৌঁছে বাইক ধরার তোড়জোড় করলেও সেই সময় জিপের মধ্যে একলা বসে থাকে অশোক।

ঘণ্টা দুয়েক সময় বিড়ি খেয়ে আর মোবাইল ঘেঁটেই কাটিয়ে দেয় সে।

রায় পেট্রল পাম্প থেকে রাইপুর থানার দূরত্ব মেরেকেটে দেড় কিলোমিটার। কিন্তু ন’পাড়া জায়গাটা পুলিশ থানা থেকে খানিকটা দূরে। অন্যদিনের মত আজও সবাই থানার গাড়িতে চড়ে ন’পাড়ায় দিকে রওনা দিলেও ওদের সাথ দেয়নি শুভাঞ্জন।

সে নিয়ে বেরিয়েছিল তার সদ্য কেনা বুলেট গাড়িটা।

বছর চল্লিশের অকৃতদার মানুষটার একমাত্র শখ বলতে বাইকই।

অন্যদিন রাত নটা বাজলেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে থানার দিকে রওনা দেয় ওরা। কিন্তু আজ কাজ শেষ করতে করতে পৌনে দশটা বেজে গিয়েছিল। বেশিক্ষণ দাঁড়ানোটা শুভাঞ্জনের কথাতেই। বাইকও ধরা গেছে বেশ কয়েকটা। কাজ শেষ হওয়ার পর সবাই যখন গাড়িতে উঠে বসেছে তখন একটা সিগারেট ধরিয়ে সে অশোককে বলেছিল, “তুমি গাড়িটা নিয়ে এগোও অশোক। আমি আসছি।”

আপত্তি করেনি বাকি কেউই। কিন্তু ওই গাড়িটা চোখের আড়াল হতেই আধখাওয়া সিগারেটটা ফেলে দিয়ে নিজের বাইকটা স্টার্ট করেছিল শুভাঞ্জন।

রাতের শুনশান রাস্তায় বিশেষ করে হাইওয়েতে বাইক চালাতে বড় ভালো লাগে তার। কিন্তু আজ তার গন্তব্য হাইওয়ে নয়, ন’পাড়া থেকে একটু এগিয়ে পাঁচকড়ি চন্দ রোড।

ওই রাস্তাতেই তো বাড়ি করবীর!

ছেলেমানুষি খেয়ালটা তার মাথায় এসেছিল আজ দুপুরে, রক্তিমের মুখে ন’পাড়ার নাম শুনে। তবে শুভাঞ্জনের সঙ্গে করবীর যে খুব চেনাশুনা আছে তা কিন্তু নয়। করবীকে সে প্রথমবার দেখেছিল দিন পনেরো আগে। সেদিন সন্ধেবেলায় বাইক ধরা শেষ করে নিজের বাইকটা নিয়ে একটু ঘুরতে বেরিয়েছিল শুভাঞ্জন। হাইওয়েতে পৌঁছতে তখনও খানিকটা রাস্তা বাকি। হঠাৎ তার কানে এসেছিল কয়েকটা পুরুষ কণ্ঠের পৈশাচিক উল্লাস, "কী মাল গো তুমি! আমাদের একটু দেবে না।”

জায়গাটা শুনশান। রাস্তার ধারে বাড়িঘর নেই বললেই চলে। ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি শুভাঞ্জনের। আওয়াজটা আসছে বাঁদিক থেকে। সেদিকে হ্যান্ডলটা ঘোরাতেই তার চোখে পড়ছিল দৃশ্যটা।

একটা ঝোপের সামনে দুটো ছেলে হাত ধরে টানছে একলা এক মহিলার।

বাইকটা নিয়ে সেদিকেই এগিয়ে গিয়েছিল শুভাঞ্জন। তখনও ছেলেগুলো বিশেষ পাত্তা দেয়নি তাকে।

কিন্তু বাইক থেকে নেমে সে ওদের দিকে এগোতেই টনক নড়েছিল ছেলেগুলোর, “এই শালা, পুলিশ। পালা পালা।”

আর দেরি করেনি ওরা। হুড়মুড় করে পালিয়েছিল মেয়েটাকে ফেলে।

সেদিন রাতে শুভাঞ্জনই বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল করবীকে।

বাড়িতে পৌঁছে ওকে ভিতরে ডেকে নিয়েছিল করবী, এক কাপ চা খাওয়ানোর অজুহাতে।

শুভাঞ্জনের কানে বেজে উঠল চায়ের কাপ হাতে মুখোমুখি বসা করবীর কথাগুলো, “কী জানেন তো, এরকম অভিজ্ঞতা রাইপুরে আমার প্রথম। আমি সেই ছোটবেলা থেকেই এখানে আছি। অথচ কোনোদিন...”

যতদূর মনে হয় বাড়িতে আর কেউ নেই। আর সিঁদুরও নেই মেয়েটার সিঁথিতে। খটকা লাগল শুভাঞ্জনের। কারুর ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকতে মোটেও উৎসাহ পায় না সে। কিন্তু করবী তাকে টানছিল। কী অদ্ভুত মায়াবী আর গভীর মেয়েটার চোখ দুটো!

দেখলেই ইচ্ছা করে ডুব দিতে।

হাঁ করে সে তাকিয়েছিল করবীর সেই স্বপ্নমাখা চোখ দুটোর দিকে।

কিন্তু ওর ভিতরে বসে থাকা দায়িত্ববান পুলিশ অফিসারটা কিছুক্ষণ পরেই খোঁচা মেরেছিল তাকে, “আপনি ওদের নামে এফ.আই.আর করুন না। তারপর আমি দেখে নিচ্ছি। লিখিত অভিযোগ না পেলে তো পুলিশ স্টেপ নিতে পারে না।”

হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল করীর কণ্ঠস্বর, “কী হবে? ছেলেগুলোকে চিনিও না। মনে হয় না এখানকার। তবে আমার বিশ্বাস ওরা আর আমার ধারে কাছে ঘেঁষবে না।”

অবাক হলেও কিছু বলার ছিল না শুভাঞ্জনের। চা ততক্ষণে তলানিতে এসে ঠেকেছে। তবুও কাপটা প্লেটে নামিয়ে রেখে সে করবীকে বলেছিল, “তাহলে আমার বলার কিছু নেই। সাবধানে থাকবেন। আর রাতে বাইরে বেরনো যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলবেন। আর আমার নাম্বারটা নিয়ে রাখুন। কোনও অসুবিধা হলে ফোন করবেন।”

রঙচটা পুরনো একটা হ্যান্ডসেট ব্যাগের ভিতর থেকে বার করে সেটাতে শুভাঞ্জনের নাম্বার সেভ করে নিলেও করবী কিন্তু নিজের নাম্বারটা দেয়নি শুভাঞ্জনকে।

তারপর করবী আর ফোনও করেনি তাকে।

তবুও আজ কেন এরকম পাগলামি করছে সে? ভাবতে ভাবতেই বাইক ঘুরিয়ে মেন রোড ছেড়ে পাঁচকড়ি চন্দ রোডে ঢুকে পড়ল শুভাঞ্জন।

ন’পাড়ার দিকে এখনও কিছু লোকজন থাকলেও এই রাস্তাটা একেবারে জনশূন্য। মানুষের আধিপত্য শেষ হতেই পুরো জায়গাটা চলে গেছে কুকুরের দখলে।

তেড়ে না এলেও বাইক দেখে চিৎকার করে উঠল কয়েকটা কুকুর।

ব্যাপারটাকে খুব একটা পাত্তা দিল না শুভাঞ্জন। এত রাত্তিরে এটাই স্বাভাবিক।

একটু এগোলেই করবীর বাড়ি। রাস্তার ডানদিকে বাইকের গতি কমিয়ে শুভাঞ্জন এগোতে লাগল তার গন্তব্যের দিকে। খানিকটা যেতেই দূর থেকে সে দেখতে পেল করবীর বাড়িটা। স্ট্রিট ল্যাম্পের আলো তেরছাভাবে পড়েছে একতলা বাড়িটার পশ্চিমদিকের দেওয়ালে।

সেদিকে দুটো জানলা থাকলেও সেগুলো বন্ধ।

আরও একটু এগিয়ে বাড়িটার সামনে এসে ব্রেক কষল শুভাঞ্জন। করবীদের বাড়িটা যে খুব বড় তা নয়। বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা বারান্দা। গ্রিল দিয়ে ঘেরা। রাস্তার দু’পাশে পরপর অনেকগুলো বাড়ি থাকলেও জায়গাটা ঘিঞ্জি নয়। বাড়িগুলোর মাঝখানে খালি পড়ে রয়েছে অনেকটা করে জায়গা। আশেপাশের কয়েকটা বাড়িতে আলো জ্বললেও শুভাঞ্জন দেখল করবীর বারান্দাটা অন্ধকার। পশ্চিমদিকের জানলা দুটোর মতই বন্ধ করা আছে বারান্দা লাগোয়া ঘরের দরজা আর জানলাটাও। ভিতরে কী হচ্ছে তা বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও দেখে মনে হয় বারান্দার মতই অন্ধকারে ডুবে আছে বাড়িটা।

অন্ধকারে ডুবে থাকা বাড়িটা দেখে মুহূর্তে একবুক হতাশা যেন গিলে ফেলল শুভাঞ্জনকে।

এ কোন মরীচিকা!

কীসের পিছনে ছুটে চলেছে সে?

ঠিক রাত আটটার সময় স্নান সেরে কালো কাপড়টা বুকে জড়িয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল করবী। কাপড়টা বেশ বড়। ঢেকে রেখেছে তার হাঁটু অবধি।

চারিদিকে বিচ্ছিরি রকম গুমোট। তবুও বিকেল চারটে বাজতে না বাজতেই করবী ঘরের সমস্ত জানালা বন্ধ করে দিয়েছিল। আজকের দিনটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ তার জীবনে। নিজের ক্ষমতায় প্রথমবার ঈশ্বরকে জাগিয়ে তুলবে সে। তারপর প্রভুর পায়ে অর্পণ করবে তার প্রথম নৈবেদ্য। ঈশ্বরের পায়ে নৈবেদ্য অর্পণের অধিকার অর্জন করাও কিন্তু সহজ কথা নয়।

কোনও কোনও মানুষ সারা জীবনেও পারে না এই অধিকার অর্জন করতে।

কিন্তু করবী পেরেছে।

মাত্র পাঁচ বছরেই।

তবে এখানেই কিন্তু শেষ নয়। আরও অনেক এগোতে হবে তাকে। প্রভু খুশি হলে এগোতে পারবে করবী।

তার জন্য প্রভুর চাই আরও নৈবেদ্য।

প্রথমে করবী ভেবেছিল বরুণের হৃদপিণ্ডটাই সে অর্পণ করবে প্রভুর পায়ে। বরুণ ছিল তার স্বামী। এখনও করবীকে দুঃস্বপ্নের মত তাড়া করে সেই সময়টা। পেটে বাচ্চা এসেছে শুনেই বরুণ আর তার শাশুড়ি মিলে করবীকে জোর নিয়ে গিয়েছিল ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য। করবীর পেটে ছিল মেয়ে। রিপোর্ট পাওয়ার পর বরুণের মুখখানা দেখেই কু গেয়েছিল করবীর মন।

তার আশঙ্কা সত্যি হয়েছিল। রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে শান্ত অথচ খসখসে গলায় বরুণ তাকে বলেছিল, “ঝরিয়ে ফেলো।”

বরুণকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করেছিল করবী। কিন্তু কিছুতেই মানেনি বরুণ।

নিজের চাকরী নেই। আর বাবার আয় বলতে সামান্য কিছু পেনশন। তবুও অপমানটা হজম করতে পারেনি করবী। চলে এসেছিল বাবার কাছে। তখন এক অদ্ভুত জেদ চেপে বসেছে তাকে।

সে একাই মানুষ করবে বাচ্চাটাকে।

কিন্তু এই লড়াই শুরু হওয়ার আগেই হেরে গিয়েছিল করবী। বরুণের অভিশাপই যেন শেষ করে দিয়েছিল অনাগত প্রাণটাকে।

প্রেগনেন্সির ছ’মাসের মাথায় মিসক্যারেজ হয়ে গিয়েছিল করবীর।

সেই সময়টা ছিল করবীর জীবনের সবথেকে অভিশপ্ত সময়। ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছিল সে। মাথাটাও কাজ করত না ঠিকঠাক। তখন ছিল গরম কাল। প্রচণ্ড গরমে ফুটছিল রাইপুর। তবুও সেই গরম, বুড়ো বাবার নিষেধ আর পাড়ার লোকের টিটকিরি সবকিছু উপেক্ষা করে সে সারাদিন বসে থাকত নদীর ধারে।

বাদ যেত না দুপুরটাও।

কিন্তু এরকমই এক দুপুরে করবীর জীবন বাঁক নিয়েছিল অন্যদিকে। দিনটা কী ছিল এখন আর মনে নেই তার। নদীর ধারে চুপচাপ বসে থাকলেও দরদর করে ঘামছিল সে। তবুও তার চোখ ছিল একনাগাড়ে বয়ে চলা নদীটার দিকে। হঠাৎ তার কানে এসেছিল একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর, “এভাবে বসে থাকলেই কি বাচ্চাটা আবার ফিরে আসবে?”

চমকে উঠে পিছনে তাকিয়েছিল করবী।

পিছনে দাঁড়িয়ে মাঝবয়সী একজন মানুষ। তার পরনে একটা কালো কুর্তা আর লুঙ্গির মত করে পরা কালো ধুতি। মাথাভর্তি চুল আর মুখভর্তি দাড়ি দেখলে তাকে কোনও সাধু বলেই মনে হয়। মানুষটাকে দেখে কেমন যেন খালি হয়ে গিয়েছিল করবীর বুক। বোকার মত সে বলেছিল, “মানে?”

“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে করবী।”

অচেনা লোকের সাথে কথা বলার কোনও উৎসাহ খুঁজে পাচ্ছিল না করবী। তবু আগন্তুক তার নাম জানে দেখে অবাক হয়েছিল সে, “কিন্তু আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে?”

“সব বলব। কিন্তু তার আগে বলো, তুমি কি বরুণের উপর প্রতিশোধ নিতে চাও?”

অচেনা হলেও মানুষটার কাছে কি হদিশ আছে তার মনের গোপনতম ইচ্ছেটারও? অবাক হলেও সত্যি কথাটাই বলেছিল করবী, “কিন্তু সামর্থ্যে কুলিয়ে উঠছে না। ওর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করার মত ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু আপনি কে? এত কথা জানলেন কীভাবে?”

“আমি অমোঘ।” নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন আগন্তুক, “একজন সাধক। কিন্তু এক বিকল্প পথের। আমি এসেছি তোমাকে এই কষ্ট থেকে উদ্ধার করতে।”

অমোঘের কণ্ঠস্বর কোনও এক অজানা যাদুর বলে এবার মধুবর্ষণ করেছিল করবীর কানে। কেমন বিবশ হয়ে গিয়েছিল সে। মুখ ফুটে অস্ফুটে বেরিয়ে এসেছিল শুধু একটাই শব্দ, “কীভাবে?”

“ঈশ্বরের বিপরীতে এক শক্তি আছে। আছে তার সাধন পথও।” খুব শান্ত গলায় নির্জন নদীর তীরে বসে করবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন অমোঘ, “সেই পথের হদিশ পেলে শুধু বরুণের উপর প্রতিশোধ নয়, এই দুনিয়াটাও চলে আসবে তোমার হাতের মুঠোয়।”

বিগত কয়েক বছরে সেই পথের সন্ধানই একটু একটু করে করবীকে দিচ্ছেন অমোঘ।

তাঁকেই নিজের গুরু বলে মেনে নিয়েছে করবী।

অমোঘের আশ্রমে এখন করবীর নিত্য যাতায়াত। মাস দুয়েক আগে নিজের আশ্রমে বসে অমোঘ যখন তাকে বলেছিলেন প্রভুর পায়ে প্রথমবার নৈবেদ্য অর্পণের সময় হাজির, বরুণের উপর পাঁচ বছর ধরে পুষে রাখা রাগটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।

করবী তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল অমোঘকে, “বরুণই হবে আমার প্রথম শিকার।”

“আচ্ছা।” স্মিত হেসেছিলেন অমোঘ, “কিন্তু শর্তটা মনে আছে তো?”

চোয়াল শক্ত হয়ে গেলেও ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলেছিল করবী।

অমোঘের আশ্রম রাইপুর থেকে কিছুটা দূরে বালিনগরে। এখানেই শ্বশুরবাড়ি ছিল করবীর। তবে আশ্রমটাকে শহরের ভিতরে বলা যায় না। শহর থেকে বাইরে, হাইওয়ে ঘেঁষে। আশ্রম থেকে বেরিয়ে কিছুটা হাঁটলে বাসস্ট্যাণ্ড। বালিনগরের প্রান্তিক বাসস্ট্যাণ্ড। করবী গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানে। তখন বরুণের একটা খবর পেতে সে মরীয়া। হঠাৎ যেন প্রভু প্রসন্ন হয়েছিলেন তাঁর উপর। করবী দেখেছিল বাসস্ট্যাণ্ডের দিকে এগিয়ে আসছেন রূপা কাকিমা।

ভদ্রমহিলা ছিলেন করবীর কাকি শাশুড়ি। পুরো শ্বশুরবাড়িতে এই মানুষটাকেই একটু আলাদা লাগত করবীর। করবীকে ভালোবাসতেন কাকিমা। ভদ্রমহিলাও এসে দাঁড়িয়েছিলেন বাসস্ট্যাণ্ডে। সেদিনও করবীকে দেখে হালকা হেসেছিলেন তিনি। হাতে চাঁদ পেয়েছিল করবী। এদিক ওদিক দু’চারটে কথা বলার পরেই আসল কথাটা জিজ্ঞেস করেছিল সে, “কাকিমা, বরুণ কেমন আছে?”

“ও একটা কঠিন নার্ভের রোগে আক্রান্ত।” হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে এসেছিল কাকিমার গলার আওয়াজ, “পাপের ফল। রোগের নামটা এত কঠিন যে আমার জিভে আসে না। কিন্তু বরুণ দিন দিন বিছানায় মিশে যাচ্ছে। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। শরীরটা পচে শেষ হয়ে যেতে যতদিন...”

কাকিমা আর কিছু বলেনি। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়েছিল করবী। অমোঘ যে বারবার বলে দিয়েছেন তাকে, “মনে রেখো করবী। প্রভু কিন্তু কোনও অসুস্থ অথবা সাংঘাতিক চোট আঘাত পাওয়া মানুষের হৃদপিণ্ড নৈবেদ্য হিসাবে গ্রহণ করেন না।"

দমে গেলেও হাল ছাড়েনি করবী। হঠাৎ তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল তড়িৎ পোদ্দারের মুখটা।

সুনেত্রাকে তো পুড়িয়ে মেরেছিল ওই লোকটা!

সুনেত্রা ছিল করবীর কলেজের বান্ধবী। বন্ধুত্বটা বজায় ছিল মাস আট আগে অবধিও, সুনেত্রা মারা যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত। দুর্ঘটনাটা ঘটার আগে সুনেত্রা মাঝে মাঝে ওকে বলত কথাটা, “ও আমাকে মেরে ফেলবে রে। বাবা পণের টাকাটা পুরো মেটতে পারেনি বলে...”

সুনেত্রাকেও করবী আনতে চেয়েছিল অমোঘের কাছে। কিন্তু রাজি হননি অমোঘই, “না করবী। এই রাস্তা সবার জন্যে না। প্রভুর নির্দেশ ছাড়া নতুন কাউকে আমি এই পথে নিয়ে আসতে পারি না।”

সুনেত্রার জন্য কিছুই করতে পারেনি করবী। আর তড়িৎ পোদ্দার লোকটারও ক্ষমতা বিশাল। থানায় এই অফিসারের আগে যে অফিসার ছিল তাকে ঘুষ খাইয়ে এমন একটা চার্জশিট বানিয়েছিল আর একখানা এমন তাবড় উকিল ধরেছিল যে খালাস পেয়ে গিয়েছিল বেকসুর।

প্রথম শিকারটা হাতছাড়া হয়ে গেলেও দ্বিতীয়টা মিস করেনি করবী।

তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম শিকার হিসাবে সে তার নিশানা করেছে ওই তিনটে ছেলেকে যারা সেদিন অমোঘের আশ্রম থেকে ফেরার পথে লুঠতে চেয়েছিল তার ইজ্জত।

তবে সেসব পরের কথা। আজ তড়িৎ পোদ্দারের হৃদপিণ্ডটাই সে নিবেদন করবে প্রভুর পায়ে।

এ কাজ আজ তাকে করতে হবে একলাই। দু’দিন আগে যেমন সে একলা খুন করেছিল তড়িৎ পোদ্দারকে।

সাধনার নিয়ম মেনেই অমোঘ সাথ দেননি তাকে।

কিন্তু তড়িৎ পোদ্দারের বুক কীভাবে চিরতে হবে তা যেমন করবীকে শিখিয়েছিলেন অমোঘ, তেমনই শিখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে প্রভুর পায়ে অর্পণ করতে হবে সেই নৈবেদ্য।

ঘাড় ঘুরিয়ে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাল করবী। সওয়া আটটা বাজে।

তার মানে সময় উপস্থিত।

করবী আর দেরি করল না। এক টানে নিজের কাপড়খানা খুলে পুরো উদোম হল সে।

অমোঘের নির্দেশ যে সেইরকমই।

অন্যদিন এই কালো কাপড়টা শরীরে জড়িয়ে প্রভুর আরাধনায় বসলেও, আজকের দিনে প্রভুর সামনে লজ্জা পাওয়া তার নিষেধ।

সিলিং থেকে ঝুলতে থাকা ল্যাম্পটা বেশ শক্তিশালী। হাল আমলের সিএফএল। তার আলো ছড়িয়ে পড়েছে ঘরটার চারদিকে। বাল্বটা নতুন হলেও ঘরটা কিন্তু বেশ পুরনো। মাথার উপরে ঝুলতে থাকা কড়িকাঠ, নোনাধরা-রংচটা পুরু দেওয়াল আর একটা ছোট্ট জানলা যেন একটা মরীয়া চেষ্টা করছে ফেলে আসা সময়টাকে ধরে রাখতে। বাইরের পৃথিবীর সাথে ঘরটার যোগাযোগ নেই বললেই চলে। কারণ জানলাটা বন্ধ। অনেক উঁচুতে একটা ছোট্ট ঘুলঘুলি আছে বটে, কিন্তু তার চৌহদ্দি পেরিয়ে সূর্যের আলোও যেন ভয় পায় এই ঘরে ঢুকতে।

বাল্বটার নীচেই রাখা আছে একটা প্ল্যাস্টিকের চেয়ার। ঘরটার মতই রংচটা সেই চেয়ারটাও। সেটাতেই বসে আছে করবী। তার চোখ দুটো ঘোলাটে। কাঁধ দুটো ঝুলে পড়েছে নিচের দিকে।

সারা রাত ধরে একটা ভয়ংকর ভবিষ্যতের ভয় তাড়িয়ে বেরিয়েছে তাকে।

তার সাথে লড়াই করতে করতেই সে ক্লান্ত, বিষণ্ণ।

অথচ এমন হওয়ার কথা যে ছিল না একেবারেই।

ঠিক সময়েই ঘর অন্ধকার করে প্রভুর আরাধনায় বসেছিল সে।

মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে আহ্বান জানিয়েছিল প্রভুকে।

অমোঘের কাছ থেকে শেখা মন্ত্রগুলোর উচ্চারণেও কোনও ভুল হয়নি করবীর।

তবু সবকিছু ভুল হতে শুরু করল তার ঠিক পরেই।

করবী গতকাল যেখানে বসেছিল তার পাশের দেওয়ালে, মেঝের ঠিক ওপরে একটা চোরকুঠুরি আছে। অমোঘের নির্দেশমতো নিজের হাতেই সেটা তৈরি করেছিল সে। ওই কুঠুরির মধ্যেই রাখা ছিল প্রভুর নৈবেদ্য। এমনিতে কুঠরিটার সামনে একটা টেবিল রাখে করবী। কিন্তু গতকাল সন্ধেবেলায় সে সরিয়ে দিয়েছিল টেবিলটাকে।

মন্ত্রোচ্চারণ শেষ হতে হতেই কুঠুরিটার দরজার উপরে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় চাপ দিয়ে করবী খুলে ফেলেছিল সেটাকে।

কিন্তু তারপর ভিতরে হাত ঢোকাতেই কেঁপে উঠেছিল করবীর বুক।

কুঠুরিটা খালি!

ভিতরে ধুলো ছাড়া আর কিছু নেই।

ঠিক তখনই একটা উষ্ণ নিঃশ্বাস ছুঁয়েছিল তার কাঁধ।

ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই চমকে উঠেছিল করবী...

তার ঠিক পিছনে জ্বলজ্বল করছে ভীষণ লাল দুটো চোখ!

প্রভু খুশি হলে ধরা দেন সশরীরে, আর রুষ্ট হলে দৃশ্যমান হয় তাঁর চোখ দুটো। অমোঘের কাছে এ’কথা আগেই শুনেছিল করবী। অজানা আশঙ্কায় থিরথির করে কেঁপে উঠেছিল তার নগ্ন শরীরটা। সঙ্গে সঙ্গে তার কানে এসেছিল একটা ধাতব কণ্ঠস্বর, “ওটা আর নেই তোর কাছে। আমার অভিশাপে নিশ্চিহ্ন।”

ভয় পেলেও তখনও পর্যন্ত মাথা ঠাণ্ডাই রেখেছিল করবী। কোনওরকমে সে বলেছিল, “কে... কেন প্রভু?”

“কার হৃদপিণ্ড তুই এনেছিস?” অদ্ভুত ধাতব কণ্ঠস্বরে আবার গমগম করে উঠেছিল ঘরটা, “জানিস না ও ক্যানসার আক্রান্ত।”

আকাশ ভেঙে পড়েছিল করবীর মাথায়। তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সুনেত্রা মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগের সেই ঘটনাটা। ওদের এক পুরনো মাস্টারমশাই তখন খুব অসুস্থ। খবর পেয়ে দুই বান্ধবী গিয়েছিল তাঁকে দেখতে। বিছানার এককোণে বসে হাঁপাতে থাকা বৃদ্ধ মানুষটাকে দেখে ভালো লাগেনি ওদের কারুরই। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্বগতোক্তির মত সুনেত্রা বলেছিল, “এত পাপ করে বেড়ায়, তবু লোকটার শরীরে কোনও রোগ নেই। শুধু ভালো লোকগুলোই ভোগে।”

সুনেত্রা তাকে মিথ্যা কথা বলবে না। রোগটা হয়তো ধরা পড়েছে সুনেত্রা মারা যাওয়ার পরে। তবুও নিজের বোকামির জন্য আঙুল কামড়াতে ইচ্ছা হল করবীর।

প্রিয় বান্ধবী সুনেত্রার কথা আর একবার যাচাই করে নেওয়ার প্রয়োজনই তো বোধ করেনি সে!

এখন সে কী করবে? ডুকরে কেঁদে উঠেছিল করবী। প্রচণ্ড ভয় গ্রাস করতে শুরু করেছিল তাকে...

কিন্তু আর কিছু বলার সুযোগ পায়নি করবী। সেই লাল চোখ দুটো যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনই মিলিয়েও গিয়েছিল হঠাৎই।

শুধু করবীর জন্য রেখে গিয়েছিল এক বুক আশঙ্কা।

সেদিন পাঁজর ভেঙে লাশটার হৃদপিণ্ডটা উপড়ে নিয়ে চলে এসেছিল করবী। প্রচণ্ড উত্তেজনায় বুকের ভিতরটা ক্রমাগত ধড়ফড় করলেও মনে মনে বড় নিশ্চিন্ত ছিল সে। অমোঘ যে আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন তাকে, “ মাত্র কিছুক্ষণ ওইভাবে পড়ে থাকবে লাশটা। তারপর নিজে থেকেই উবে যাবে মেঝেতে পড়ে থাকা রক্ত আর বুকের ক্ষত। ডাক্তার দেখে বলবে হার্ট অ্যাটাক।”

কিন্তু তখন করবী ভুলে গিয়েছিল অমোঘের বলা শেষ কথা দুটো, “তবে সাবধান। শরীরে রোগ বা চোট থাকলে ওই ক্ষত কিন্তু থেকেই যাবে।”

মিলে গিয়েছিল অমোঘের শেষ কথা দুটোই।

পুলিশ যখন উদ্ধার করে তড়িৎ পোদ্দারের লাশ তখনও তাতে দগদগ করছে ক্ষতটা। মেঝেতে চাপ রক্ত।

আর মাঝখান থেকে উধাও তার হৃদযন্ত্রটা!

সুনেত্রা আর নেই। কিন্তু রয়ে গেছে সেই বন্ধুত্বের ইতিহাস। পড়শিদের মুখে সেই বন্ধুত্বের হদিশ পেয়েই পুলিশ হানা দিয়েছিল তার দরজায়।

 

“এই যে মহারানী...”

মেয়েলী অথচ ভীষণ কর্কশ কণ্ঠস্বর আচমকা লাগাম টানল করবীর চিন্তার স্রোতে। মুখ তুলে সে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন মহিলা কনস্টেবল। একটা পুরনো চাদর করবীর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সে বলল, “জড়িয়ে নাও। স্যার আসছেন তোমাকে জেরা করতে। উনিই তোমাকে দিতে বললেন এটা।”

কিছু করার ছিল না করবীর। ছেড়া চাদরটা শরীরে জড়াতে জড়াতেই ফের তার কানে এলো সেই মহিলার কণ্ঠস্বর, “বাইরের লোকের সামনে এরকম বুক খোলা নাইটি পরে কেউ আসে! ব্রাটাও পরেনি। প্যান্টি পরেছে কিনা ভগবানই জানেন! লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বসে আছে। এরকম বেশ্যা মাগি দেখিনি কখনও।”

এবার আর করবীকে নয়, নিজের মনেই কথাগুলো বলতে বলতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে সেই মহিলা।

কিন্তু করবী অনুভব করল অন্য কারুর সামনে না হলেও সে নগ্ন হয়ে গেছে নিজের হৃদয়ের কাছে।

আর এই নগ্নতা বড় লজ্জার।

গতকাল প্রভু অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর বার বার তাঁকে ডাকলেও আর কোনও সাড়া পায়নি করবী। ক্রমশ ভারি হয়ে আসছিল তার ভেতরটা।

পাশের ঘরে রয়েছে তার জামাকাপড়। কিন্তু সেটা পরার কথাও বেরিয়ে গিয়েছিল মাথা থেকে।

মুখটাকে দুটো হাঁটুর মধ্যে গুঁজে চুপচাপ বসেছিল সে।

কতক্ষণ সময় এভাবে কেটে গিয়েছিল তার কোনও হিসাব ছিল না করবীর কাছে। হঠাৎ তার সম্বিৎ ফিরেছিল কলিং বেলের আওয়াজে। কেউ অনেকক্ষণ ধরে বাজিয়ে চলেছে সেটা। একটা ঘোরের মধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছিল করবী। হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়েছিল তার ঠিক পাশে ঝুলতে থাকা নাইটিখানা।

অমোঘের নির্দেশ অনুযায়ী আরাধনায় বসার আগে এই নাইটিটা সে রেখেছিল তার পুজোর বেদীর ঠিক পাশে।

সেটা পরেই দরজা খুলেছিল করবী। দরজার ঠিক সামনে দাঁড়িয়েছিল শুভাঞ্জন নামের সেই পুলিশ অফিসারটা। তার পাশে আরও কয়েকজন পুলিশ। করবী দরজা খুলতেই মুখ খুলেছিল শুভাঞ্জন, “আপনার বান্ধবী সুনেত্রার স্বামী মানে তড়িৎ পোদ্দার অদ্ভুতভাবে খুন হয়েছেন। এই বিষয়ে আমরা আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।”

তার মানে ব্যাপারটা পুলিশের দিকে চলে গেছে! এরকম পরিস্থিতিতে সেটা খুব স্বাভাবিক হলেও পায়ের তলার জমিটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল করবী। কোনও কথা বেরচ্ছিল না তার মুখ থেকে। হঠাৎ তার কানে গিয়েছিল আরও একজনের চিৎকার, “দাদা দেখুন, ওর নাইটিটা সবুজ। আমরা স্পটে যে কাপড়টা পেয়েছি সেটাও তো সবুজই। আর দেখুন, ওই ছেঁড়া জায়গায় আমাদের পাওয়া কাপড়টা কিন্তু আরামসে সেট হয়ে যাবে।”

হঠাৎ করবীর মনে পড়ে গিয়েছিল সেই রাতের কথা। একটু ধ্বস্তাধস্তি হয়েছিল তড়িৎ পোদ্দারের সাথে। তখনই ছিঁড়ে গিয়েছিল তার নাইটির কিছুটা অংশ। ঠিক ডান হাঁটুর উপরে।

ব্যাপারটা সে খেয়াল করেছিল বাড়িতে ফেরার পর। তখন তার ক্ষমতার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

করবী তার সাহস দেখায়নি লাশের কাছে ফিরে যাওয়ার।

এবার ভারি গলায় শুভাঞ্জন বলেছিল, “ফরেনসিক বলছে দু’দিন আগে খুনটা হয়েছে। রাত নটা থেকে দশটার মধ্যে। তখন আপনার বাড়িতে কেউ কিন্তু ছিল না। বাড়ি অন্ধকার ছিল। আমিই এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম।”

সে ফেঁসে গেছে। বুঝতে পরছিল করবী। শুভাঞ্জনের চোখের ইশারায় দু’জন মহিলা কনস্টেবল এগিয়ে এসেছিল তার দিক। কনুই দুটো ধরে কিছুটা কর্কশ স্বরে বলেছিল, “থানায় চলুন।”

 

ভারি বুটের মশমশ আওয়াজে ফের ব্যাহত হয় করবীর চিন্তার স্রোত। সে দেখে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে শুভাঞ্জন, “আমি আপনার কেসটার ইনভেস্টিগেশন করছি। আর কিছুক্ষণ পরেই আপনাকে কোর্টে তোলা হবে। কাল রাতেই তো বলেছি আপনার বিরুদ্ধে আমাদের হাতে অনেক প্রমাণ আছে। এবার বলুন কেন আপনি খুনটা করলেন? সত্যি কথা বললে তবু আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।”

গম্ভীর হলেও কর্কশ নয় শুভাঞ্জনের গলার আওয়াজ।

কিন্তু থই পাচ্ছিল না করবী।

সে বললেই কি আর এই পৃথিবী বিশ্বাস করবে তার অন্ধকার সাধনার কথা!

আসা যেত শহরের ভিতর দিয়ে। কিন্তু এখানে আসার জন্যে হাইওয়েকেই বেছে নিয়েছিল শুভাঞ্জন। একটু ঘুরপথ এবং একটা রেললাইন পেরতে হলেও পড়ন্ত বেলায় তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যাবে এখানে।

আজ আদালতে তোলা হয়েছিল করবীকে। কিন্তু সেখানে নিয়ে যাওয়ার আগে আজ সকালবেলায় তার কথাগুলো শুনে বেশ অবাক হয়েছিল শুভাঞ্জন।

ভগবানের নৈবেদ্য হিসাবে মানুষ বলি দেওয়ার প্রথাটা খুব পুরনো হলেও এই একবিংশ শতাব্দীতে এই ঘটনা!

তার সঙ্গে বেমালুম গায়েব একটা মানুষের হৃদপিণ্ড!

তবে পৃথিবীতে অনেক গোপন তন্ত্রসাধনা আছে যেগুলো সাধারণ মানুষের অজানা। কিন্তু তাই বলে করবী কি পারবে ওই রকম একজন শক্তসমর্থ লোকের বুক চিরে হৃদপিণ্ডটা উপড়ে নিতে?

কাল রাতে করবীর বাড়িতে তল্লাশি করে সেরকম কিছু ধারালো অস্ত্র অথবা তড়িৎ পোদ্দারের হৃদপিণ্ড কোনটাই তো খুঁজে পায়নি সে।

কিছুতেই ঠিক মেলাতে পারছিল না শুভাঞ্জন। তার উপর যেরকম বিধ্বস্ত লাগছিল মেয়েটাকে! আদালতে তো বিচারকের সামনে চিৎকার করে কেঁদেই ফেলল বেচারা, “আমি অন্ধকারের যাত্রী। আমাকে ফাঁসি দিন হুজুর। আমি আর এই পৃথিবীকে দেখতে চাই না।”

আদালতে এরকম নাটক মাঝে মধ্যেই হয়। প্রমাণ ছাড়া এসব কথার কোনও দাম নেই। জেরার সময় ওই একই আর্জি তাকেও জানিয়েছিল করবী। অন্য আসামী হলে এত মাথা ঘামাত না শুভাঞ্জন।

কিন্তু এ যে করবী...

মেয়েটার প্রতি দুর্বলতাটাই বোধহয় ভাবতে বাধ্য করেছিল তাকে।

কোর্ট শেষে করবীকে ফের পুলিশের জিম্মাদারিতে চালান করে দেয়।

নিজের বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল শুভাঞ্জন। তার গন্তব্য করবীর মুখে শোনা অমোঘ নামের সেই সাধুটার কুটির। লোকটাকে পাকড়াও করতে পারলে হয়তো জানা যাবে আসল তথ্য।

 

দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে কুটিরটা। কুটির থেকে একটা মেঠো পথ এঁকেবেঁকে উঠে এসেছে হাইওয়েতে। জায়গাটায় চাষবাস হয় না। তাই শেষ ভাদ্রে সেই মেঠো পথের দু’পাশে ডানা মেলতে শুরু করেছে কাশফুল।

বাইক নিয়ে কিছুদিন আগেও এখানে এসেছিল শুভাঞ্জন। তখন উদ্দেশ্য ছিল লঙ ড্রাইভ। তাই সদ্য গজিয়ে ওঠা কাশফুলগুলো তার মনের ক্যানভাসে নানা রঙের ছবি আঁকলেও কুটিরটাকে পাত্তা দেয়নি সে।

কিন্তু আজ তার গন্তব্য তো ওখানেই। হাইওয়ে ছেড়ে মেঠো রাস্তায় নেমে এলো শুভাঞ্জন। দু’পাশে বাড়তে থাকা কাশের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সাবধানে বাইক চালিয়ে এসে দাঁড়াল কুটিরের সামনে।

হ্যাঁ হুবহু মিলে যাচ্ছে করবীর বর্ণনা। মাটির দেওয়াল, খড়ের ছাউনি আর সামনে ছোট্ট একটা দালান―ঠিক যেমন দেখতে পাওয়া যায় অজ পাড়াগাঁয়ে।

শুভাঞ্জন দেখল কুটিরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।

সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমদিকে। মাটির তৈরি সিঁড়ি দু’খানা বেয়ে শুভাঞ্জন উঠে এল দালানে। তারপর হালকা ধাক্কা মারল দরজায়।

তার হাতের চাপেই খুলে গেল দরজার পাল্লা দুটো।

পরপর দুটো ঘরকে আড়াআড়িভাবে আলাদা করে রেখেছে একটা মাটির দেয়াল। সেই দেওয়ালের মাঝখানে বাইরের দরজার মুখোমুখি রয়েছে আর একটা দরজা। দরজাটা খোলা। তাই একটু হলেও দেখা যাচ্ছে ভিতরের ঘরটাকেও। ভিতরের ঘরেও রয়েছে একটা জানলা।

দরজা দুটোর মুখোমুখি বলেই বাইরে দাঁড়িয়েই শুভাঞ্জন দেখতে পেল জানলাটাকে।

গারদহীন জানলায় পাল্লা থাকলেও সে দুটো খোলা। বেলাশেষের সূর্যের আলো জানলা দিয়ে এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে।

ভিতরে ঢুকে বারবার চারপাশে চোখ বুলিয়েও কিছুই দেখতে পেল না শুভাঞ্জন।

বিফল মনোরথে বাইরে বেরিয়ে আসছিল সে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল কুটিরের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে। সঙ্গে সঙ্গে শুভাঞ্জন চমকে উঠল। ওই তো কুটির থেকে খানিকটা দূরে মাটির উপরে স্পষ্ট হয়ে আছে একজোড়া পায়ের ছাপ।

অন্য কোনও প্রাণীর নয়, মানুষের!

ছাপ দুটো স্পষ্ট হয়ে আছে আধশুকনো কাদার উপরে।

শুভাঞ্জনের মনে পড়ল গতকাল রাতে করবীকে থানায় নিয়ে আসার পরে রাইপুরে শুরু হয়েছিল তুমুল বৃষ্টি। আধশুকনো কাদা মানে তো সেই বৃষ্টি ছুঁয়েছে বালিনগর আর তার আশপাশকেও। আর বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরেই কেউ এসেছিল এখানে।

এরকম কেস তার দশ বছরের পুলিশ জীবনে আগে কখনও দেখেনি শুভাঞ্জন। একটা খুন, গায়েব হৃদযন্ত্র, করবী, একটা অদ্ভুত কাহিনী, অমোঘ নামের একটা লোক, একটা পরিত্যক্ত কুটির আর একজোড়া পায়ের ছাপ...

হাতের কাছে অনেকগুলো ক্লু থাকলেও কিছুতেই সেগুলোকে এক সুতোয় বাঁধতে পারছিল না শুভাঞ্জন।

হঠাৎ তার মাথায় বিদ্যুৎ চমকানোর মত খেলে গেল একটা সম্ভাবনার কথা।

একলা পেয়ে করবীকে ভয় দেখিয়ে অথবা মগজ ধোলাই করে নিজের করা খুনটা তার ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছে না তো অমোঘ নামে লোকটা?

লোকটার নাম মুখে এনে ফেললেও হয়তো ওর ভয়ে কিছুতেই সত্যিটা বলতে চাইছে না করবী।

গারদের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে বেশ অবাক হল করবী।

এর তো এখানে আসার কথা ছিল না কোনও।

গতকাল রাত থেকেই বেশ অদ্ভুতভাবে সময় কেটেছে করবীর। আদালতের নির্দেশে এখনও সে রয়ে গেছে পুলিশের হেফাজতে। গতকাল রাতে আবার এখানে এসেছিল শুভাঞ্জন। বেশ জোরেই সে চেপে ধরেছিল করবীকে, “আপনি ঠিক করে বলুন। অমোঘ খুন করে আপনার নামে দোষ চাপাচ্ছে না তো? সত্যি কথা না বললে আমি আপনাকে বাঁচাতে পারবো না। এরকম নৃশংস একটা খুনের জন্য যাবজ্জীবন নিশ্চিত।”

সুযোগ থাকলেও তখন মিথ্যা কথা বলতে সায় দেয়নি করবীর মন।

পরে সত্যিটা বেরিয়ে আসলে…

বারবার একই প্রশ্নের জবাবে একই উত্তর দিয়েছিল করবী, “না অমোঘ খুন করেনি। করেছি আমিই।”

শেষ পর্যন্ত যেন কিছুটা হতাশ হয়েই ফিরে গিয়েছিল শুভাঞ্জন।

তারপর আজ সকাল হতে না হতেই এই লোকটা!

লোকটার বয়স পঞ্চাশ হলে কী হবে, দেখলে মনে হয় সবে পার করেছেন চল্লিশটা বসন্ত। মাথার পিছনে সামান্য টাক থাকলেও ভদ্রলোকের যা ব্যক্তিত্ব তাতে তার সামনে দাঁড়াতে ভয় পায় আচ্ছা আচ্ছা ক্রিমিনালও।

ভদ্রলোককে বেশ ভালো করেই চেনে করবী।

ইনি অমূল্য ধর। এই অঞ্চলের এক নম্বর ক্রিমিনাল ল-ইয়ার।

কিন্তু ইনি ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

বুঝতে পারছিল না করবী। না চাইলেও তার মনের ভিতরে নতুন করে দগদগ করতে শুরু করেছিল অনেকদিন আগে শুকিয়ে যাওয়া একটা ঘা।

বরুণের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে বলে অমূল্য ধরের কাছেই গিয়েছিল করবী। ভদ্রলোক করবীর দূর সম্পর্কের পিসেমশায়। করবীর মুখ থেকে সব শোনার পর কিছুটা নিরাসক্তভাবেই তিনি বলেছিলেন কথাগুলো, “সবই তো বুঝলাম ফুকু। কিন্তু তুমি আমার ফিসটা জোগাড় করতে পারবে তো?”

অমূল্য ধর যে টাকা ছাড়া কোনও কাজ করে না তা করবী জানত। অত টাকা তার নেই। তবুও আত্মীয় বলেই ভদ্রলোকের কাছে কিছুটা ভালো ব্যবহার আশা করেছিল সে। কিন্তু সে গুড়ে বালি তখনই টের পেতে শুরু করেছিল করবী। কেঁপে গিয়েছিল তার বুক। তবুও গলাটা যতসম্ভব ঠিক রেখে সে বলেছিল, “কত পিসেমশায়?”

“পার হিয়ারিং আট হাজার। আর পার কনসালটেশন হাজার।”

এত টাকা করবীর নেই। সত্যিটা লুকবার কিছু ছিল না। কিন্তু এরপরেই কেমন উদাসী হয়ে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক, “ঠিক আছে তুমি পরে এস। দেখছি।”

পরে আরও কয়েকবার অমূল্য ধরের চেম্বারে গেলেও অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডিঙিয়ে করবী সুযোগ পায়নি ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করার।

সেই মানুষটা আজ এসেছে, দাঁড়িয়েছে তার সামনে। তাকিয়ে আছে তারই দিকে। এরই মধ্যে এক মহিলা কনস্টেবল হাতে একগোছা চাবি নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে এসে খুলে দিল তার সেলের দরজা, “নিন আপনার ল-ইয়ার এসে গেছেন।"

করবীকে অবাক করে দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন অমূল্য ধর। ভদ্রলোকের গলায় আন্তরিকতার ছোঁয়া, “ফুকু গতকাল রাতে জানতে পারলাম পুলিশ তোমাকে অ্যারেস্ট করেছে। সব কথা আমি শুনেছি। তবে তোমাকে এ’নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। আমি তোমার হয়ে কেসটা লড়ব। আর টাকা পয়সা নিয়েও তোমাকে ভাবতে হবে না। আগেরবার তোমার জন্যে কিছু করিনি। পরে নিজের খুব খারাপ লেগেছিল। কিন্তু এবার আর সেই ভুল করছি না। হাজার হোক, তুমি আমার আত্মীয়। আর অমূল্য ধরের রিলেটিভ জেলে পচবে সেটা হয় না।”

এসব কী বলছেন ভদ্রলোক!

পুলিশ বাড়ি থেকে তুলে আনার পরেই প্রভুর উপর বিশ্বাস টলে গিয়েছিল করবীর। কিন্তু অমূল্য ধরের কথা শুনে নতুন করে এলোমেলো হয়ে গেল সবকিছু।

প্রভু কি উদ্ধারের পথ দেখাচ্ছেন তাকে?

“করবী, ও করবী...”

নিজের অবচেতনেই কান খাড়া করল করবী। আধা ঘুমের মধ্যেই সে বুঝতে পারল এই কণ্ঠস্বর অমোঘের।

আজ বিকেলেই করবী জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। চারটে মাস বন্ধ দরজার ওপারে কাটাতে হলেও অমূল্য ধরের প্রখর যুক্তিজালের সামনে পড়ে স্বয়ং বিচারক তাকে মুক্তি দিয়েছেন নির্দোষ বলে ।

করবী ভেবেছিল আগামীকালই যাবে অমোঘের কাছে।

গুরুর কাছে মার্জনা চেয়ে আবার শরণ নেবে প্রভুর।

কিন্তু তার আগে মধ্যরাতে অমোঘ নিজেই চলে এসেছেন তার বাড়িতে।

শেষ পৌষে ঠাণ্ডাটা বেশ কনকনে। বহুদিন পর বাড়ি ফিরে আলমারি খুলে ছাতা পড়া কম্বলটা বার করে সেটাই গায়ে জড়িয়ে শুয়েছিল করবী ।

অমোঘের ডাক শুনে কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল সে।

করবীর পরনে একটা নাইটি। সেটার উপর একটা চাদর জড়িয়ে দরজা খুলে বারান্দায় এসে করবী দেখল বাইরে দাঁড়িয়ে অমোঘ। এই ঠাণ্ডাতেও কোনও পরিবর্তন হয়নি তাঁর পোষাকে। সেই কালো কাপড়। শীতের সময়েও অমোঘকে এই একই পোষাকে আগেও দেখেছে করবী। তাই অবাক না হয়ে সে খুলে দিল গেটের দরজা। সঙ্গে সঙ্গে ওর বারান্দায় উঠে পড়লেন অমোঘ। তারপর করবীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভিতরে চলো। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে করবী।”

অসম্ভব ভারি হয়ে আছে অমোঘের কণ্ঠস্বর। যেন চেনা যায় না ঠিক। একটু হলেও ভয় পেল করবী। তাকে নিয়েই ঘরের ভিতরে ঢুকলেন অমোঘ। তারপর নিজেই বন্ধ করে দিলেন ঘরের দরজা।

শীতকালে রাত বারোটার সময় অমোঘ যে করবীর বাড়িতে এসেছেন সেটা এমনি এমনি নয়। বহুদিন পর আজ তাঁর সাধনায় সাড়া দিয়ে জেগে উঠেছিলেন প্রভু।

করবীকে বলার জন্যেই তিনি কিছু বার্তা দিয়েছেন অমোঘকে।

“বলুন আপনি কী বলতে চান।” একটু যেন কাঁপছে করবীর গলা। মানে কোনোভাবে ভয় পেয়েছে মেয়েটা। কিন্তু ওর প্রতি সহানুভূতি দেখানোর কোনও প্রয়োজন বোধ করলেন না অমোঘ। বরং প্রভুর কথা বলার আগে ভূমিকা হিসাবে শুরু করলেন বাকি দরকারি কথাগুলো, “অমূল্য ধরের কোনও দোষ নেই। ও টাকার জন্য কেসটা লড়েছে।”

ভয় তো মনের কোণে জমা হচ্ছিল আগেই। কিন্তু অমোঘের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল করবী। তবে সে যা ভেবে এসেছে তা কি মিথ্যে!

সত্যিটাকে জানার জন্যে হঠাৎ মরিয়া হয়ে উঠল করবী, “টাকার জন্যে? কী বলতে চাইছেন আপনি?”

কিন্তু অবিচল অমোঘ, “কিন্তু দোষ তো তার যে তাকে সেই টাকাটা দিয়েছে। শাস্তি তার অনিবার্য।”

কিন্তু কে তাকে সাহায্য করেছে? বুঝতে পারল না করবী, “কে... কে আমাকে সাহায্য করেছে?”

“শুভাঞ্জন। শুধু অমূল্য ধরকে তোমার জন্যে নিয়োগ করা নয়, তোমার নামের চার্জশিটটাও সে খুব হালকা করে লিখেছিল। যাতে তুমি ছাড়া পেয়ে যাও। ওই থানার এক কর্মী আমার শিষ্য। তাঁর কাছ থেকেই সব খবর পেয়েছি আমি।”

করবীর আশ্রমে বহুবার গেলেও সেখানে অমোঘ ছাড়া আর কাউকে দেখেনি করবী। ফের অবাক হল সে, “কিন্তু সে কে?”

“সাধনার নিয়ম অনুসারে আর কিছুদিন পরেই সেটা আমি তোমাকে বলতাম। কিন্তু আগেই তুমি দিকভ্রষ্ট।”

যেন সাপের মতই খসখস করছে অমোঘের কণ্ঠস্বর।

কিন্তু কথাগুলো আর ছুঁতে পারল না করবীকে।

বিলকুল চুপ হয়ে গেল সে।

কোনও এক অদৃশ্য শক্তি কেড়ে নিয়েছিল তার কথা বলার ক্ষমতা।

শুভাঞ্জনের হাত আছে তাকে বেকসুর খালাস করাবার পিছনে!

একবার নয়, দু’-দু’বার সে তাকে বাঁচাল নিশ্চিত বিপদের হাত থেকে।

সবকিছু ভুলে মানুষটার প্রতি এক অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল করবীর হৃদয়।

কিন্তু অমোঘ তো চান না এই নীরবতা। তাই আর সময় নষ্ট না করেই তিনি করবীর উদ্দেশে ভাসিয়ে দিলেন প্রভুর দেওয়া বার্তাটা, “শুভাঞ্জন তো তোমায় বাঁচিয়ে দিয়েছে করবী। কিন্তু প্রভুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে। আজ প্রভু জেগে উঠেছিলেন আমার ডাকে সাড়া দিয়ে। তিনিই বলেছেন তার কাজের ফল ভুগতে হবে শুভাঞ্জনকে।”

অমোঘের কথা শুনে হঠাৎ এক অজানা আশঙ্কায় ফের চঞ্চল হয়ে উঠল করবী, “কী... কী শাস্তি হবে শুভাঞ্জনের?”

কিন্তু এবার আরও গভীরে নেমে এল অমোঘের কণ্ঠস্বর, “সেটা আমি তোমায় বলব না করবী ...”

ডান হাতের কবজি উলটে হাতঘড়িটার দিকে তাকাল করবী। বাসের হালকা আলোতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সময়টা। সাড়ে আটটা বাজে।

হিসাবমত দেখতে গেলে প্রায় মিনিট কুড়ি এখানে আটকে আছে বাসটা।

বাসে চড়ে ঘোরাঘুরি করার অভ্যাস খুব একটা নেই করবীর। কিন্তু অমোঘ মাথার উপর থেকে হাত তুলে নেওয়ার পর জীবনটা পুরোপুরি বদলে গেছে তার। এতদিন করবীর জীবন চলত বাবার জমানো কিছু টাকার ইন্টারেস্টে। খুব বেশি নয়। কিন্তু কিছুদিন আগে অবধিও সেই টাকা নিয়ে খুব একটা চিন্তা ছিল না করবীর।

তখন তার দু’চোখে দুনিয়ার মালকিন হওয়ার স্বপ্ন। সঙ্গে ছিল অমোঘের আশ্বাস, “খাওয়া পড়ার জন্য তোমায় চিন্তা করতে হবে না করবী। প্রভু তাঁর ভক্তদের জন্যে ঠিক জুটিয়ে দেন।”

আর আজ…

বাসে বসেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল করবী। অমোঘের হাত মাথার উপর না থাকলে যে কী অবস্থা হতে পারে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে করবী। জিনিষপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে ওই টাকায় কয়েক বছর পর হয়তো মাসের পনেরো দিনও চলবে না।

বাধ্য হয়েই কাজ খুঁজতে বেরিয়েছে সে।

কিন্তু রাইপুর ছোট্ট জায়গা। যতই বেকসুর খলাস পাক খুনের দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া একটা মেয়েকে কাজ দিতে রাজি হয়নি কেউই।

বাধ্য হয়েই কাজের সন্ধানে এখন অন্য জায়গায় যেতে হচ্ছে করবীকে।

কিন্তু সেখানেও কাজ পাওয়া দায়!

আজ করবী গিয়েছিল কেশুরে। একটা স্টোরকিপারের কাজের সন্ধানে।

জায়গাটা রাইপুর থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে।

দোকানের মালিক রাজি হননি অত দূরের কাউকে কাজে নেওয়ার জন্য।

সেখান থেকেই ফিরছিল করবী। কিন্তু হঠাৎ মারাত্মক জ্যামে আটকে গেছে বাসটা।

না এপাশ থেকে কোনও গাড়ি এগোচ্ছে, না ওপাশ থেকে আসছে কোনও গাড়ি।

বাসের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া কিছু করার ছিল না করবীর। কয়েকটা উৎসাহী ছেলে বাস থেকে নেমেছিল।

ঠিকমত খবর না পেলেও তারা এসে বলেছে সামনে নাকি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।

হাইওয়েতে মাঝেমাঝেই দুর্ঘটনা ঘটে। সেটা নিয়ে ভাবতে চাইছিল না করবী। কিন্তু তার ভয় করছিল অন্য কারণে।

রাত বাড়ছে ক্রমশ।

আবার যদি বাস থেকে নেমে বাড়ি ফেরার পথে ফাঁকা রাস্তায় তার উপর চড়াও হয় কয়েকটা ছেলে…

বারবার তো আর শুভাঞ্জন আসবে না।

যা হবে দেখা যাবে। ভাবনাগুলোকে জোর করে তাড়াতে চাইছিল করবী। হঠাৎ আস্তে আস্তে গড়াতে শুরু করল বাসটা। এর পরেই প্রায় দৌড়তে দৌড়তে সেটাতে এসে উঠল কন্ডাক্টর ছেলেটা।

হাঁপাচ্ছে।

চোখেমুখের ভাঁজই বলে দেয় ভয় পেয়েছে খানিকটা।

ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে তারই সামনে। বাসটা চলতে শুরু করার পরেই কী অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে সেটা জানার জন্যে উশখুশ করতে শুরু করেছিল করবীর মন। ছেলেটা একটু দম নেওয়ার পর সে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, “কী অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে ভাই?”

“আর বলবেন না দিদি। আমাদের রাইপুরের ইন্সপেক্টর। ওর বাইককে লরিতে মেরে দিয়েছে। খুব চোট পেয়েছে। একটু আগে অ্যাম্বুলেন্স এসে নিয়ে যাওয়ার পর রাস্তা খালি হল।"

শুভাঞ্জনের চোট! হঠাৎ উথালপাতাল হয়ে গেল করবীর বুকটা, “কী চোট? খুব চোট পেয়েছে নাকি ভাই?”

“হ্যাঁ, দিদি। তবে দেখলাম এখনও বেঁচে আছে। জানি না কী হবে।”

সারাদিন বসে থাকা একটা ইন্টার্ভিউয়ের জন্যে। খাওয়াও হয়নি ভালো করে। একটু আগে অবধিও করবীর পেটের মধ্যে ছুঁচোয় ডন মারছিল। কিন্তু সেই মারাত্মক অনুভূতিটাও হঠাৎ ফিকে হয়ে গেল। করবীর কানে তখন বাজতে শুরু করেছে সেদিন রাতে অমোঘের ছোঁড়া ব্রহ্মাস্ত্রটা, “শুধু শুভাঞ্জনই নয়, তুমিও শাস্তি পাবে করবী।”

সে একলা মানুষ। টাকার জোরও নেই। এর মধ্যে অ্যাকসিডেন্ট হয়ে পড়ে থাকলে…

কথাটা মনে হতেই করবী অনুভব করল মারাত্মক একটা ভয় তীক্ষ্ণ ছুরির মত এসে গেঁথে গেছে তার হৃদপিণ্ডের ঠিক মাঝখানে।

দপ করে জ্বলে উঠেও নিভে গেল প্রদীপটা।

পাশের ঘরে বসে আছে করবী। সে যে তার কুঁড়েঘরের দিকে এগিয়ে আসছে তা ভর সন্ধেবেলাতেও দূর থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন অমোঘ।

যেমন বুঝতে পেরেছিলেন ওই পুলিশ অফিসারের সময়।

সত্যি সেদিনটা খুব খারাপ গিয়েছিল অমোঘের।

খুন করে হৃদপিণ্ড উপড়ে নেওয়ার মত ভয়ংকর একটা কেসে পুলিশ যে করবীকে গ্রেপ্তার করেছে তা তিনি জেনে গিয়েছিলেন তাঁরই শিষ্য এই থানার এক কনস্টেবল অমরের কাছ থেকে।

কেসটা খুব অদ্ভুত বলেই অমর সেটার কথা জানিয়েছিল তার গুরুকে।

কিন্তু তারপরেই সাবধান হয়ে গিয়েছিলেন অমোঘ। মনের ভিতরে জমতে শুরু করেছিল আশঙ্কার কালো মেঘ। হয়তো পুলিশ এবার হানা দেবে তাঁর কুটিরেও।

তাঁর আশঙ্কা যে সত্যি হতে চলেছে তা অমোঘ বুঝতে পেরেছিলেন ওইদিন বিকেলবেলায়, যখন শুভাঞ্জনের বাইক হাইওয়ে ছেড়ে নেমে পড়েছিল মেঠো রাস্তায়। আর সময় নেননি অমোঘ। মন্ত্রবলে গায়েব করে নিয়েছিলেন নিজেকে এবং নিজের ব্যবহার্য সবকিছুকে।

তবে সে নিয়ে এখন আর চিন্তা নেই অমোঘের। প্রভুর কথা মিলে গেছে। শাস্তি পেয়েছে পুলিশ অফিসার। শুভাঞ্জনের দুর্ঘটনাটাই যে করবীকে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে তা অমোঘ জানেন। আসলে ভয় পেয়েছে মেয়েটা। আর তাই তো সে ফিরতে চায় প্রভুর পায়ে।

কিন্তু করবীকে কি আবার এই পথে ফিরিয়ে আনা ঠিক হবে? বিশেষ করে ও যখন সবকিছু বলে দিয়েছে পুলিশকে। দোটানায় পড়ে গিয়েছিলেন অমোঘ। সেদিন শুভাঞ্জনের ভবিতব্য প্রভু তাঁকে বলে দিলেও করবীকে নিয়ে তিনি ছিলেন নীরব। ওর বাড়ি ছেড়ে বেরোবার সময় খানিকটা ভয় দেখানোর জন্যেই অমোঘ তাকে বলেছিলেন কথাটা, “তুমিও শাস্তি পাবে করবী।”

কিন্তু সেই কথাটাই যেন বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে এখন!

মেয়েটাকে বাইরের ঘরে বসিয়ে নিজে ভিতরের ঘরে চলে এসেছিলেন অমোঘ। দরজা বন্ধ করে দিয়ে জ্বালিয়েছিলেন তাঁর সেই জাদু প্রদীপ। মারা যাওয়ার আগে এই প্রদীপ তাঁর হাতে তুলে গিয়েছিলেন গুরু তেজস্বান। প্রদীপটা জীবনের নানা সময়ে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে তাঁকে। তাঁর সিদ্ধান্ত ভুল হলেই লাল হয়ে যায় জ্বলন্ত প্রদীপের শিখা।

কিন্তু তিন তিনবার চেষ্টা করেও প্রদীপে অগ্নিসংযোগ করতে পারলেন না অমোঘ।

“জীবনে সবসময় এই প্রদীপ তোমাকে চালনা করবে ঠিক পথে।” অনেকদিন পর আবার অমোঘের কানে ভেসে উঠল তেজস্বানের বলা কথাগুলো, “তবে একটা সময় আসবে যখন জীবনের একটা চরম সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও দেখবে এই প্রদীপ সাথ দেবে না তোমাকে। তুমি জ্বালাতে চাইলেও বারবার নিভে যাবে এই প্রদীপ। সেই সময় তোমাকেই নিতে হবে সিদ্ধান্ত। তোমার সিদ্ধান্ত ঠিক হলেই যে ক্ষমতার জন্যে তুমি এই সাধন পথে এসেছ তা তোমার করায়ত্ত হবে। তুমি হবে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। শুধু মানুষ নয়, সমস্ত জীবজগত চলবে তোমার ইশারায়। তখন আর এই প্রদীপের কোনও প্রয়োজন থাকবে না তোমার।”

তাঁর গুরু তেজস্বান অধিকারী হয়েছিলেন সেই ক্ষমতার। কিন্তু সেই সময় তার বয়স হয়ে গিয়েছিল অনেক।

সেই ক্ষমতা আর উপভোগ করার আগেই মৃত্যু এসে কেড়ে নিয়েছিল সবকিছু।

কিন্তু অমোঘের বয়স এখন মাত্র পঞ্চান্ন।

ভিতরে ভিতরে এক অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করলেন তিনি।

তবে কি সময় উপস্থিত?

নিজের মনে যুক্তিজালগুলো সাজাতে থাকলেন অমোঘ। সারা পৃথিবীতে এদিকে ওদিকে তাদের পথের অনুসারী কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও ভারতীয় উপমহাদেশে তিনিই হলেন একমাত্র মানুষ, যার রয়েছে গুরু হওয়ার অধিকার। সারা ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাঁর কিছু শিষ্যের মধ্যে করবী সবথেকে কমবয়সী হলেও সাধনপথে ওই ছিল সবথেকে এগিয়ে। এখন সমীকরণ অনেক পালটে গেলেও কয়েকদিন আগেও সে ছিল অমোঘের প্রিয়তম শিষ্যা।

মনে মনে ফের হিসাব করতে শুরু করলেন অমোঘ।

করবী ছাড়া কি কেউ আছে তাঁর অবর্তমানে এই দেশে এই সাধনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য?

অনেক ভেবেও একমাত্র করবীর মুখটাই বারবার অমোঘের চোখের সামনে।

নিজের কলসিটা নিয়ে ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন অমোঘ। আসবাবহীন ঘরের মেঝেতে বসে আছে করবী। তাঁর দিকে তাকিয়ে অমোঘ বললেন, “আমি প্রস্তুত করবী। জল নিয়ে আসছি। তুমি মানসিকভাবে প্রস্তুত তো?”

ঘাড় নাড়ল করবী। ঘরের কোণায় জ্বলতে থাকা কুপির আলোতে অমোঘ দেখলেন প্রচণ্ড খুশিতে লাল হয়ে উঠেছে করবীর ফর্সা গাল দুটো।

কলসিটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন অমোঘ। শেষ শীতে কুয়াশা জমে আছে চারদিকে। কুটিরটাকে পিছনে ফেলে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেলেন অমোঘ। দশ পা হাঁটার পর থামলেন তিনি। একটা নির্দিষ্ট বিন্দুর উপর বসিয়ে দিলেন কলসিটা।

এই কলসি আসলে জাদু কলস। এখানে চারপাশে কোনও পুকুর নেই। আগে তেজস্বান ব্যবহার করতেন এই কলসি। মাটির উপর একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখলেই কলসিটা টেনে নেয় ভূগর্ভস্থ জল।

পুলিসটা এখানে আসার আগের রাতে জল আনতে এখানেই এসেছিলেন অমোঘ।

বৃষ্টিভেজা মাটিতে রয়ে গিয়েছিল পায়ের ছাপ।

তাড়াহুড়োতে তারই একজোড়া আর চোখে পড়েনি অমোঘের, যেটা দেখে ফেলেছিল ওই হারামজাদা পুলিশ অফিসারটা।

কলসিটা মাটিতে রাখতেই জলে ভরে উঠল সেটা। সেটাকে নিয়ে তিনি ফিরে এলেন কুটিরে। করবী তখন বসে আছে ঠায়। কুটিরে ঢুকেই তিনি করবীকে বললেন, “তুমি তৈরি হও করবী।”

নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজাতে ভেজাতে অমোঘ শুনতে পেলেন করবীও বন্ধ করে দিচ্ছে কুটিরের বাইরের দরজা।

ঘরে একটা কুপি জ্বলছে। দেওয়ালের গায়ে ছোট্ট একটা খুপরি মত করা। সেখানেই রাখা আছে কুপিটা। কুপির সামনে কলসিটাকে রাখলেন অমোঘ। তারপর চোখ বন্ধ করে বসে শুরু করলেন মন্ত্রোচ্চারণ।

প্রায় দশ মিনিট পর চোখ খুলে অমোঘ দেখলেন নীলবর্ণ ধারণ করেছে সেই কলসি।

তার মানে জল প্রস্তুত। অমোঘ গলা তুলে ডাকলেন করবীকে, “করবী, তুমি প্রস্তুত হয়ে থাকলে চলে এস। আমি প্রস্তুত।”

কয়েক মিনিটের মধ্যেই করবীর হাতের আলতো ছোঁয়ায় খুলে গেল অমোঘের ঘরের ভেজানো দরজা।

তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল করবী।

একটাও সুতো আর অবশিষ্ট নেই তার শরীরে।

সে সম্পূর্ণ নগ্ন!

পুনর্বাসনের শর্ত এটাই। করবীকে আগেই বলেছিলেন অমোঘ। কেউ যদি দিকভ্রষ্ট হওয়ার পরেও আবার ফিরতে চায় সাধনাতে, তাহলে তাঁকে নগ্ন হয়েই দাঁড়াতে হয় গুরুর সামনে। তারপর গুরু মন্ত্রপূত জল ঢেলে দেন শিষ্যের মাথায়। সেই জল শিষ্যের সমস্ত অঙ্গ ধুয়ে দিলেই তবেই আবার সাধনার উপযোগী হয়ে ওঠে সে।

করবী মেনে নিয়েছে সেই শর্ত। তবুও কুপির আলোয় তাঁকে দেখে নিজের শরীরে একটা অদ্ভুত শিরশিরানি অনুভব করলেন অমোঘ। হাত দিয়ে নিজেকে ঢাকার কোণও চেষ্টা করছে না করবী। তার শরীর মেদহীন। খোলা চুল নেমে গেছে খুব সম্ভবত নিতম্ব অবধি। উন্মুক্ত স্তন দুটো যেন কোনও শঙ্খ। সেই স্তন, পেট, যোনি আর ঊরুতে জমাট বেঁধে আছে যৌবন।

কিছুক্ষণের জন্য সেখানে হারিয়ে গিয়েছিলেন অমোঘ। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল করবীর চোখে। না কোনও লজ্জা নেই সেই চোখ দুটোতে। বরং উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে অমোঘের দিকে।

হুশ ফিরল অমোঘের। একী করছেন তিনি! ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছনোর আগে তিনি যদি হাঁ করে নারী শরীরের সৌন্দর্য উপভোগ করেন তাহলে আর বাকি পাঁচটা মানুষের সাথে তাঁর ফারাক রইল কোথায়!

কলসিটা নিজের হাতে তুলে নিলেন অমোঘ। তারপর সেই জল তিনি ঢেলে দিতে শুরু করলেন করবীর মাথায়।

সেই জলস্রোত কোনও পাহাড়ি ঝর্ণার মতই নামতে শুরু করল করবীর মাথা, বুক, পেট উরু বেয়ে।

কুপির অল্প আলোতেও সেই দৃশ্য সৃষ্টি করল কোনও অপরূপ কবিতার।

...

অপূর্ব সেই সৌন্দর্যের দিকে একবার তাকিয়েও চোখ ফিরিয়ে নিলেন অমোঘ।

রাতটা অমাবস্যার। তবু দূর থেকেই বাড়িটাকে দেখতে পেল করবী। সঙ্গে সঙ্গে একটা আগুন জ্বলে উঠল তার বুকের ভিতরে। সেই অগ্নিশিখা লেলিহান। যেন পুড়িয়ে ফেলবে করবীর সমস্ত অস্তিত্বকে।

নিজের এই অনুভূতিটাকে চেনে করবী। এবারই সে হয়ে উঠবে এক বিশেষ ক্ষমতার অধিকারিণী।

সব সময় না হলেও বছরের কয়েকটা বিশেষ অমাবস্যায় এই ক্ষমতা ধরা দিতে শুরু করেছে তার হাতে।

এর আগেও এই ক্ষমতার অধিকারিণী হয়েছে সে। কিন্তু জেল থেকে বেরোবার পর আজ প্রথমবার।

অমোঘ যে তাকে আবার সাধনপথে ফিরিয়ে নেবেন তা ভাবতে পারেনি করবী। তবে ভবিতব্য বলেও যে কিছু আছে তা চিরকালই মেনে এসেছে সে। সেই ভবিতব্যই হয়তো তাকে টেনে এনেছে এখানে।

বাড়িটা বিশাল। দেখলেই বোঝা যায় কয়েকশো বছর আগে বাংলার কোনও জমিদারের হাতে তৈরি হয়েছিল এই বিশাল তিনমহলা অট্টালিকা।

অন্ধকারে যেটুকু দেখা যায় তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে একসময়ের সেই জৌলুসের আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই এখন। তবে একটা পুকুর এখনও রয়ে গেছে বাড়িটার পিছনে। সেটা দেখতে পেল করবী। পুকুরটা পার করেই জঙ্গল। এতটাই গভীর যে রাত কেন, দিনের বেলাতে ঢুকতেই হয়তো ভয় করবে সেখানে।

করবী দাঁড়িয়েছিল সেই পুকুর আর জঙ্গলের মাঝখানে।

রাইপুর থেকে সীমান্তগড় রাজবাড়ির দূরত্ব কমসে কম চল্লিশ কিলোমিটার। কিন্তু এই ঘোর অমাবস্যার রাতেও সেই দূরত্ব খুব একটা সময় লাগেনি করবীর। অমোঘের শেখানো মন্ত্রের জাদুতে তার শরীরটা পালকের মত হালকা হয়ে গিয়েছিল যাত্রা শুরুর আগে।

প্রায় ঝড়ের বেগে নিজের বাড়ি থেকে এখানে পৌঁছতে আধঘণ্টারও কম সময় লেগেছে করবীর।

তবে সেই মন্ত্রও সেরকম কিছু কাজে লাগত না যদি রাজবাড়িটা সে আগে থেকেই না চিনত। করবীর এক মাসির বাড়ি ছিল সীমান্তগড়ে। মাসি মারা যাওয়ার পর বহুদিন আর যাতায়াত না থাকলেও ছোটবেলায় মা আর বাবার সাথে এখানে বহুবার এসেছে করবী।

তখন এখানে আসলে মেসোর হাত ধরে রাজবাড়ি দেখতে যাওয়া ছিল তার নিয়মিত রুটিন।

রাজবাড়ির বিশালতা বাইরে থেকেই যেন চুম্বকের মত টানত ছোট্ট করবীকে।

আজ সে আবার সেখানে ফিরে এসেছে। করবী অনুভব করল এখনও একইরকম হালকা হয়ে আছে শরীর।

আর অপেক্ষা না করে একলাফে পুকুরটা পার করে ফেলল করবী।

এখন ঠিক তার সামনে ভূতের মত দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা।

বিশাল বাড়িটার দিকে তাকিয়ে করবী নিজের বুকেই হালকা ধুকপুকানি অনুভব করল।

এত বড় বাড়িতে সে ঠিক পারবে তো খুঁজে বার করতে সেই মানুষটাকে?

না হলে তো আর কখনই মিলবে না হিসাবটা...

১০

মেয়েটা আবার ভুল করে ফেলবে না তো?

পলক পড়তে চাইছিল না অমোঘের। এক দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়েছিলেন সামনে দিয়ে বয়ে চলা দৃশ্যগুলোর দিকে। করবী না জানলেও আজ রাতে অমোঘ চোখ রেখেছেন তার গতিবিধির উপর।

কাজটা অমোঘ করছেন নিজের কুটিরে বসেই। তাঁর ঘরের উত্তর দিকের দেওয়ালটায় কোনও জানলা নেই। তেজস্বানের কাছে শেখা এক মন্ত্রের জোরে তিনি এই দেওয়ালটাকেই বানিয়ে নিয়েছেন একটা পর্দা, যেটা কোনও সিনেমার মতই এক এক করে দেখিয়ে চলেছে করবীর কার্যকলাপ।

মেয়েটা এখন পরীর মত ভেসে বেড়াচ্ছে বাড়িটার এই জানলা থেকে সেই জানলা। চৈত্র মাস পড়ে গেছে বলে বাড়িটার অনেক জানলাই খোলা।

অমোঘ জানেন খোলা জানলায় উঁকি মেরে করবী খুঁজে চলেছে তার শিকার।

প্রভুর পায়ে নৈবেদ্য অর্পণের জন্যে।

কিন্তু কোথায় হানা দিয়েছে মেয়েটা? বাড়িটাকে চিনতে পারছিলেন না অমোঘ। সাধনার নিয়ম মেনে গুরু এবং শিষ্যার মধ্যে এবারও কোনও আলোচনা হয়নি শিকার নিয়ে।

কিন্তু অমোঘের দৃঢ় বিশ্বাস এবার আর ভুল করবে না করবী।

অমোঘ দেখলেন বাড়িটার দোতলার একটা জানলার সামনে হঠাৎ আটকে গেছে করবী। সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেল তার হৃদপিণ্ডের গতি।

তার মানে করবী পৌঁছে গেছে শিকারের কাছে।

শরীরটাকে বাঁকিয়ে ছোট্ট করে নিল করবী তারপর খোলা জানলার গারদ বেয়ে ঢুকে পড়ল ঘরে।

এই ঘরটা বাকি বাড়িটার মত অন্ধকার নয়। একটা কম পাওয়ারের আলোতে একটু হলেও হালকা হয়েছে ঘরের অন্ধকার। আর ঘরের একপাশে বিছানাটাতে শুয়ে আছে একজন মানুষ। চৈত্র মাসেও তার শরীর ঢাকা রয়েছে একটা হালকা চাদরে।

ঘরের দরজা ভেজানো। আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেল করবী। তারপর প্রায় বিনা শব্দে খিল তুলে দিল সেই দরজায়।

এই মুহূর্তে তার শিকার ছাড়া আর কেউ দেখতে পাওয়ার কথা নয় করবীকে। কিন্তু সেই মানুষটা এখনও চুপচাপ। খুব সম্ভবত ঘুমোচ্ছে। দরজা ছেড়ে করবী এবার গিয়ে বসল বিছানার উপরে।

পা ফাঁক করে হাঁটু দুটো মানুষটার পেটের দু’পাশ রেখে চেপে ধরল তার মুখ।

এতক্ষণ পর অমোঘ দেখতে পেলেন করবীর শিকারকে।

সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলেন তিনি।

এ মুখ তো তার অপরিচিত নয়। এতো সেই হারামজাদা পুলিশ অফিসারটার যে হানা দিয়েছিল তার কুটিরে।

কিন্তু এই মানুষটা তো এখন অসুস্থ। অমরের কাছেই অমোঘ শুনেছিলেন যে এর শরীরে চোটটাও সাংঘাতিক।

তবে কি সাধনপথের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে দাঁড়িয়ে তিনি করে ফেলেছেন তাঁর জীবনের সবথেকে বড় ভুলটা!

অমোঘ অনুভব করলেন বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে তাঁর কপালে।

এতক্ষণে জেগে উঠেছে করবীর শিকার। প্রথমে করবীকে দেখে চমকে উঠে হাত পা নাড়ার বৃথা চেষ্টা করলেও এখন সে অনেক শান্ত।

নিজের ভবিতব্যের মতই যেন মেনে নিয়েছে এই ঘরে করবীর উপস্থিতি।

করবী তার মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “আমি আপনার কষ্টটা বুঝতে পারছি শুভাঞ্জন। আপনি জানেন না, কিন্তু দুর্ঘটনার সময় আমিও ছিলাম ওখানে।”

কথাগুলো বলেই থেমে গেল করবী। কিন্তু এবার মুখ খুলল শুভাঞ্জন, “কিন্তু আমার কী হল করবী?” ক্ষীণ হলেও স্পষ্ট শুভাঞ্জনের কণ্ঠস্বর, “শিরদাঁড়াটা ভেঙে গেছে। ডান পাটাও কাটা গেল। হাত পা কিছুই নাড়তে পারি না। আমি আর কখনও উঠে দাঁড়াতে পারব না। ডাক্তার একদিন আমার ভাইকে বলছিল। আমি ঘরে শুয়ে থাকলেও স্পষ্ট শুনেছিলাম সব। আমার মত একটা লোক, যার নেশা ছিল বাইক নিয়ে লঙ ড্রাইভ, তারই এই পরিণতি! এই জীবনের থেকে মৃত্যু যে অনেক ভালো করবী।”

শুভাঞ্জনের কথা শুনে হঠাৎ আনমনা হয়ে গেল করবী। পর্দায় ছবিগুলো সিনেমার মত ফুটে উঠলেও কার মনে কি চলছে তা কখনই বলে দেয় না অমোঘের জাদু পর্দা।

তাই করবী কী ভাবছে বুঝতে পারছিলেন না অমোঘ।

কিন্তু করবী তখন পৌঁছে গেছে দু’দিন আগের বিকেলে। সেই সময় নিজের নতুন শিকার খোঁজার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। হঠাৎ রাস্তায় তার দেখা হয়েছিল মিলিদির সাথে। মিলিদি জেলের একজন পুলিশকর্মী। তার কাছ থেকেই সে শুনেছিল শুভাঞ্জনের কথা, “মানুষটা কথায় কথায় এখন নিজের মৃত্যু কামনা করে। ওইভাবে বেঁচে থাকার থেকে সত্যি মরে যাওয়াও ভালো।”

তখনই করবী ঠিক করে নিয়েছিল তার পরের শিকার। শুধু একবার অপেক্ষা করছিল শুভাঞ্জনকে নিজের চোখে দেখার জন্য। সে বলল, “আমি আপনাকে মুক্তি দিতে পারি।”

“কীভাবে?” করবীর কথা শুনে চকচক করে উঠল শুভাঞ্জনের চোখ দুটো।

“যেভাবে মেরেছিলাম তড়িৎ পোদ্দারকে। আপনার জন্যে আমার সাজা হয়নি। আপনার সমস্ত কষ্ট লাঘব করতে চাই আমি।”

“কিন্তু কীভাবে করবী?” স্পষ্ট হলেও আর কোনও উত্তেজনার রেশ নেই শুভাঞ্জনের কণ্ঠস্বরে, “আপনার কাছ তো আর্মস দেখতে পাচ্ছি না।”

“অস্ত্র আছে আমার কাছে, কিন্তু আপনি প্রস্তুত তো?”

“হ্যাঁ করবী।”

শুভাঞ্জনের উত্তর পাওয়ার পরেই করবী উপর দিকে তুলল তার ডান হাতটা, “এই যে আমার অস্ত্র।”

শুভাঞ্জন দেখল করবীর ডান হাতটা হঠাৎ নিতে শুরু করেছে একটা ত্রিশূলের আকার। প্রতিটি আঙুল যেন সেই ত্রিশূলের এক একটা ফলা।

“চোখ বন্ধ করুন শুভাঞ্জন।” এবার ধীর কিন্তু কঠিন গলায় বলল করবী, “আর মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে আপনার সমস্ত কষ্ট।”

অমোঘ দেখলেন কোনও বাধা না দিয়েই চোখ বন্ধ করল শুভাঞ্জন। সামান্য ছটফট করারও চেষ্টা করল না সে।

ঠিক এরপরেই করবীর ডানহাতটা প্রায় ঝড়ের গতিতে নেমে এলো শুভাঞ্জনের বুকের ঠিক মাঝবরাবর।

ঘরের বাইরে থেকে তখন ভেসে আসতে শুরু করেছে এক মহিলার গলার আওয়াজ, “এই ছোড়দা, শিগগির এদিকে আয়। আমি বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখছি দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। অথচ বড়দা তো বিছানা থেকে উঠতে পারে না।”

সবকিছু স্পষ্ট দেখতে এবং শুনতে পেলেও কিন্তু সেই গলার আওয়াজ কানে এল না অমোঘের।

স্বপ্নভঙ্গের প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে শুরু করেছে তার শরীর।

ছ’মাস পর

“যে কাজ অমোঘ পারেনি সেই কাজ করতে কেউ পারবে না।”

অমোঘ নামটা চেনা চেনা লাগছে না!

গাড়ির ভিতরেই নড়েচড়ে বসলেন অমূল্য।

আজ তিনি সীমান্তগড়ে এসেছিলেন এক মক্কেলের হয়ে কোর্টে হাজিরা দিতে। কাজ সেরে নিজের গাড়িতে চেপে ফিরে যাচ্ছিলেন রাইপুরে। হঠাৎ গাড়িটা রেলের ক্রসিঙয়ে একটু থামতেই তাঁর কানে এলো চিৎকারটা। ঘাড় ঘুরিয়ে অমূল্য দেখলেন গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটা অর্ধনগ্ন পাগল। তার গায়ে জমেছে অনেকদিনের নোংরা। স্পষ্ট গোনা যাচ্ছে বুকের পাঁজরগুলো। মাথার চুল আর দাড়িতে অনায়াসে বাসা বাঁধতে পারে যে কোনও পাখি। কোমরের ছোট্ট কাপড়টার অবস্থাও তথৈবচ।

পুরোপুরি ঢাকতে পারেনি লোকটার লজ্জাকেও।

অমূল্যর স্মৃতি নেহাত কমজোরি নয়।

একটু ভাবতেই মনে পড়ে গেল নামটা।

এতো সেই করবীর কেস!

করবীর মুখেই তো নামটা শুনেছিলেন অমূল্য।

করবীর অনুরোধে তিনি কোর্টে একবারও নেননি অমোঘের নাম। তাঁর চেষ্টায় করবী বেকসুর খালাস পেলেও তখনও যে ব্যাপারটা মিটে যায়নি তা অমোঘ টের পেয়েছিলেন মাস ছয়েক আগে এক সকালে।

সেদিন সকালবেলা টিভিতে শুভাঞ্জনের মৃত্যুসংবাদটা দেখেই চমকে উঠেছিলেন তিনি।

কিন্তু আসল চমকটা বাকি ছিল খবরের শেষে। টিভিতে নিউজ অ্যাংকর তখন উত্তেজিত গলায় বলে চলেছে, “মৃত শুভাঞ্জনের দেহের উপর পড়ে থাকতে দেখা গেছে আরও একজন যুবতীর দেহ। শুভাঞ্জনের শরীরে ক্ষত মারাত্মক হলেও কিন্তু কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি যুবতীর শরীরে। কেবল অদ্ভুতভাবে তার ডান হাতের কবজিটা ঢুকে আছে বুকের মাঝবরাবর। আর কবজির চারপাশে নিখুঁতভাবে লেগে আছে বুকের চামড়া। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক হলেও যুবতীর পরিচয় জানার চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।”

সেই যুবতীর পরিচয় বার করতে খুব বেশি সময় লাগেনি পুলিশের। কিন্তু খবরটা শুনেই অমূল্য বুঝতে পেরেছিলেন মৃতার আসল পরিচয়।

করবী ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারে না মেয়েটা।

ট্রেন বেরিয়ে গিয়ে আবার চলতে শুরু করেছে গাড়িটা। পিছনের সীটে হেলান দিয়ে বসলেন অমূল্য।

মনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে তাঁর।

ভাগ্যিস কেউ তাকে ডাকেনি এই কেসে!

কিছু কিছু রহস্য বোধহয় সবার সামনে না আসাই ভালো…

পিছন থেকে পাগলটা চিৎকার করে চলেছে তখনও, “আমি অমোঘ যা পারিনি, তা পারবে না কেউই।”