বোকাবাক্স - সুস্মিতা কুণ্ডু

অলংকরণ - প্রতিম দাস
এক

বিকেল থেকে আকাশের মুখ ভার। সুধাংশুবাবুরও আকাশের সাথে তাল মিলিয়ে মুখটা ভার ছিল কিন্তু রমলা আদা চা আর একটা কাঁসিতে করে মুড়ি আর ঘরে ভাজা পেঁয়াজি দিয়ে যেতে আর মেজাজটা ততটা তিতকুটে লাগছে না। একমুঠো মুড়ি গালে ফেলে পেঁয়াজিতে কামড় বসালেন। দেওয়াল ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজে খেয়াল হল, খবরের টাইম হয়ে গেছে। রিমোট দিয়ে টি. ভি.-টা অন করলেন সুধাংশুবাবু। বাইরে দুমদাম বাজ পড়ছে, মাঝে মাঝে কাঁচের জানলা দিয়ে আলো ছিটকে আসছে, তারপরই ‘ক্কড়ক্কড়াৎ’।

এ’রকম ওয়েদারে টি.ভি. চালালে খুব রাগ করেন রমলা, কিন্তু সুধাংশুবাবুও কারোর কথা শুনে চলার বান্দা নন। নিজের রিটায়ারমেন্টের পয়সায় কেনা টি. ভি.। নামি কোম্পানির একুশ ইঞ্চির ফ্ল্যাট স্ক্রিন কালার টি. ভি.। বছর দশেক আগে খুব রমরমিয়ে চলত, কিন্তু এখন সব পাতলা পাতলা কী যেন বলে প্লাজমা, এল.ই.ডি. এইসব টি. ভি. এসে এই বড় বাক্সমার্কা যন্ত্রগুলোর দর পড়ে গেছে। সবাই দেওয়ালে ক্যালেণ্ডারের মত প্যাতপ্যাতে ওই টি. ভি.গুলোই ঝোলায়। জায়গা কম লাগে, দেখতেও বাহারী।

রমলার নিষেধকে মোটেও পাত্তা না দিয়ে টি. ভি. চালিয়ে খবর দেখতে বসলেন সুধাংশুবাবু। যত পুরনোই হোক এই টি. ভি.-টা নিয়ে কেউ কাড়াকাড়ি করতে আসে না, রিমোট নিয়ে কেউ টানাটানি করে না। নাতি নাতনী দুটো সারাদিন খেলা আর কার্টুন নিয়ে লড়ছে। এ ঘ্যাঁচ করে ক্রিকেট চালায় তো ও দুম করে টম অ্যান্ড জেরি লাগায়। সন্ধেয় ছেলে শেয়ার মার্কেটের খবর চালালে বৌমা রূপচর্চা বা রান্নার অনুষ্ঠান ঘুরিয়ে দেয়। তার ওপর শাশুড়ি বৌমার অষ্টপ্রহর সিরিয়াল তো লেগেই রয়েছে। বেচারা ক্যালেণ্ডার টি. ভি.-র কী দুর্দশা। তার চে’ বরং এই বাক্সপানা গাবদা টি. ভি.-ই ভালো।

একটা খবরের চ্যানেল লাগিয়ে সবে চা-টায় একটা চুমুক দিয়েছেন ওমনি ভয়ানক জোরালো একটা আলো চমকে উঠল, আর তার কয়েক সেকেন্ড পরেই কানফাটানো শব্দ করে বাজ পড়ল। খুব কাছাকাছিই পড়েছে মনে হয়। বাজ পড়ার সাথে সাথেই টি. ভি. টায় একটা ফটাস করে আওয়াজ হয়ে ছবি চলে গেল। গোটা স্ক্রিন জুড়ে সাদা কালো গুঁড়ি গুঁড়ি পিঁপড়ের মত দানা ঝিরিঝিরি করতে লাগল। সর্বনাশ! বাজ পড়ে পিকচার টিউবটা গেল নাকি ভোগে? রমলা তাহলে আর আস্ত রাখবে না। চা-মুড়ি দিতে এসেও পইপই করে বলে গেছিল টি. ভি.-টা বন্ধ করতে।

সামনের টি-টেবলে চিনামাটির কাপটা আর কাঁসিটা নামিয়ে রেখে সুধাংশুবাবু সুড়সুড় করে এগিয়ে গেলেন টি. ভি. টার সামনে। এদিক সেদিক বেঁকে ঝুঁকে দেখলেন। বেশ ক’বছর আগেও বাড়ির ছাদে সব অ্যান্টেনা থাকত, তাইতে কাক বসলে কিংবা ঘুড়ি আটকালেই এমন দশা হ’ত। কিন্তু এখন তো সে সবের বালাই নেই, প্লাগের মত করে কেবলের তার গোঁজা পেছনে সব। প্রথমে টি. ভি.র মাথায় একটা আলতো চাপ্পড় মারলেন, কোনও লাভ হ’ল না। সেই একরকম ঝিরঝির করতে লাগল। সুধাংশুবাবু তখন কেবলের মোটা কালো তারটা খুলে আনলেন টি.ভি.র পেছন থেকে তারপর পাঞ্জাবির খুঁটটায় তারের মুখের জ্যাকটা একটু থুতু দিয়ে মুছে নিয়ে ফের গুঁজলেন নির্দিষ্ট জায়গাটায়।

দুই

যেই না তারটা গোঁজা ওমনি হঠাৎ করে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গের মত বয়ে গেল শরীরের ভেতর দিয়ে সুধাংশুবাবুর। না, ঠিক কারেন্টের শক লাগার মত নয়, অদ্ভুত একটা কাতুকুতুমার্কা শিরশিরানি। অনুভব করলেন ওঁর শরীরটা কেমন যেন ছোট হয়ে এবং বায়বীয় হয়ে শাঁআআআ করে ঢুকে গেল কেবলের তারটার ভেতর। তারপর তারের ভেতর দিয়ে সেই ওয়াটার পার্কের সুড়ঙ্গ রাইডের মত চোঁ চাঁ করে একদিকে এগিয়েই যেতে লাগলেন প্রবল একটা টানে। হুশ হাশ করে গিয়ে গিয়ে ধপাস করে পড়লেন একটা নরম নরম জায়গায়। সাদা কালো গুঁড়ো-গুঁড়ো দানা-দানা বালির মধ্যে যেন সাঁতার কাটতে লাগলেন। হঠাৎ করে তাকিয়ে দেখলেন চারদিকের কালো দেওয়ালের মাঝে একটা জায়গায় চারচৌকো একটা জানলামত। কোনওমতে সাদা কালো দানার সমুদ্দুরে সাঁতার কাটতে কাটতে এগিয়ে গিয়ে জানলায় চোখ রাখলেন।

এ কী! বাইরে কী দৃশ্য এটা? এটা তো সুধাংশুবাবুর নিজের ঘরটাই। ঐ তো সামনে টেবলটায় চায়ের কাপ আর মুড়ির কাঁসি। টেবলের ওপারে আরামকেদারাটা। ঐ তো দেওয়ালের গায়ে আলনাটায় পায়জামা আর পাঞ্জাবি, রমলার সুতির ছাপা ভাঁজ করা ঝুলছে। তবে কি উনি টি.ভি.-টার ভেতর ঢুকে গেছেন? জানালাটা কি তবে টি.ভি.রই স্ক্রিনটা?

হে ভগবান! এ কী অশৈলী কাণ্ড রে বাবা! জানলাটার গায়ে মুঠোয় করে ঘুঁষি মারতে লাগলেন, ডাকতে লাগলেন যদি ওইপারে ঘরের কোনও মানুষ শুনতে পায়।

এমন সময় রমলা এসে ঢুকলেন ঘরে,

—কী গো? আর দু’টো পেঁয়াজি দেব তোমায়?”

এই বলে হাঁকতে হাঁকতে। ঘরে ঢুকে একটু থমকে গেলেন সুধাংশুবাবুকে দেখতে না পেয়ে।

—“এই তো ছিল লোকটা এখানে, গেল কোথায়? নির্ঘাত ক্লাবে গেছে তাসের আড্ডায়। এই ঝড় বাদলার দিনেও যেতে হবে? বলিহারি নেশা সব বাপু! ওই দ্যাখো টি. ভি. টাও বন্ধ করেনি। কত করে বলি যে বাজ পড়লে টি.ভি.-খানা বন্ধ করবে। একটা কথা শুনবে মানুষটা! সারাটা জীবন জ্বালিয়ে গেল...”

রমলা গজগজ করতে করতে টি.ভি.-টা বন্ধ করার জন্য রিমোট খুঁজতে থাকেন। এই প্রথম রমলার গজগজানি এত মধুর লাগে সুধাংশুবাবুর। কিন্তু রমলা টি.ভি.-র স্ক্রিনে সুধাংশুবাবুকে দেখতে পাচ্ছেন না কেন? নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখেন ওঁর শরীরেরও সাদা কালো দানা-দানা রঙ হয়ে গেছে। ওই জন্যই রমলা টি.ভি.-র সাদাকালো ঝিরিঝিরির মধ্যে আলাদা করে সুধাংশুবাবুকে দেখতে পাচ্ছেন না। এতো আচ্ছা জ্বালা হ’ল! বাড়ির লোক তো বুঝতেই পারবে না যে উনি টি.ভি.-র ভেতর বন্দী। সবাই ভাববে সন্ধেবেলায় উনি ক্লাবে তাস পিটতে গেছেন। টেনশনে সুধাংশুবাবুর মাথার দু’পাশের রগদুটো দপ্ দপ্ করতে লাগলো।

এমন সময় হঠাৎ করে সব অন্ধকার হয়ে গেল, চারপাশে সাদা কালো দানা, জানালাটা, কিচ্ছু নেই। নিকষ কালো অন্ধকার, এমনকি নিজের হাত-পাটাও দেখতে পাচ্ছেন না সুধাংশুবাবু। এবার বেজায় ভয় পেতে শুরু করল। মরেটরে গেলেন না তো? হয়ত সোজা আঁধার কালো নরকে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু সেরকম পাপ তো জীবনে কিছু করেননি যে ঘ্যাঁচ করে নরকবাস হবে। হঠাৎ মনে পড়ল গিন্নি রিমোট খুঁজছিল। তাহলে মনে হয় রমলা টি.ভি.-টা বন্ধ করল, তাই এরকম আঁধার ঘনিয়ে এল। নিশ্চিন্ত হয়ে ছোট্ট করে হাঁপ ছাড়লেন। কিন্তু আসল সমস্যাটা তো রয়েই গেল! টি.ভি.-র বাইরে বেরোবেন কী করে!

তিন

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কী যেন একটা সপাটে লাঠির মত দুম করে এসে পড়ল সুধাংশুবাবুর পিঠে। ওমনি কেমন যেন হালকা গোলার মত শাঁআআ করে আকাশে উড়তে লাগলেন উনি। চারপাশটা আর অন্ধকার নেই। নিচে সবুজ মাঠ, মাথার ওপর নীল আকাশ। লোকজনের চিৎকার ভেসে আসছে। সুধাংশুবাবু পাখির মত আকাশে ভেসে চলেছেন, ডানা নেই এই যা। তারপর আবার শোঁওও করে নিচের দিকে নামতে লাগলেন। ঝুপুস করে গিয়ে পড়লেন কারোর হাতের শক্তপোক্ত তালুতে। তারপর তাঁকে নিয়ে কী উল্লাস আর হই-হুল্লোড়। ও হরি! এ কী কাণ্ড ! সুধাংশুবাবু যে একটা বল হয়ে গেছেন ! লাল টুকটুকে একটা বল। মাঠে সবাই তাঁকে নিয়ে লোফালুফি করছে। তার মানে নির্ঘাৎ নাতি এসে ক্রিকেট খেলা চালিয়েছে এই টিভিতে। বাইরের ক্যালেন্ডার টিভি হয় বাজের ভয়ে বন্ধ আছে নইলে রমলা আর বৌমা নির্ঘাত সিরিয়াল দেখছে, তাই সেখানে চান্স না পেয়ে দাদুর ঘরের টিভিতে হামলা করেছে।

এদিকে কোনও একজন প্লেয়ার একদলা থুতু সুধাংশুবাবুর গায়ে, থুক্কুড়ি লাল বলরূপী সুধাংশুবাবুর গায়ে মাখিয়ে, প্যান্টে

বেশটি করে ঘষে বল করতে শুরু করেছে। সুধাংশুবাবু তো বেজায় ঘেন্নায় নাক সিঁটকোতে গেলেন কিন্তু বলের তো আর নাক নেই তাই সিঁটকানোরও উপায় নেই। তবে নাক নেই বলে কি বিদ্রোহও করতে নেই? খামোখা এত পিটুনি খেতে যাবেন কেন শুনি? সুধাংশুবাবু করলেন কী বোলারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া মাত্রই নিজের খুশি মত গড়ানো শুরু করলেন। শূন্যে ঘুরে আসা ব্যাটের নাগাল টপকে, উইকেটকিপারের পায়ের তলা দিয়ে গলে সারা মাঠময় ছুটোছুটি লাফালাফি গড়াগড়ি শুরু করলেন। এক এক করে ফিল্ডাররা, বোলার, ব্যাটসম্যান দু’খান, মায় আম্পায়ার অব্দি তাঁর পেছনে মানে লাল বলটার পেছনে ছুটতে শুরু করল। সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড।

এমন সময় দূর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল,

—“ভোম্বল! মাস্টারমশাই এসেছেন, শিগগির পড়ার ঘরে যাও।”

বৌমার গলা, নাতির অঙ্কের মাস্টার এসেছে। এবার মুক্তি মিলবে, টিভিটা বন্ধ করবে ভোম্বল। এমন প্রাণ নিয়ে লাফালাফির চেয়ে অন্ধকার ঢের ভালো। কিন্তু সুধাংশুবাবুর কপালটাই মন্দ! নাতি টিভি ছেড়ে যেতে না যেতেই নাতনি টুম্পা এসে রিমোটের দখল নিল। এতক্ষণ দাদার চাঁটির ভয়ে সুবিধে করতে পারেনি। চ্যানেল ঘোরানো মাত্র সুধাংশুবাবু তপ্ত কড়াই থেকে এসে পড়লেন সোজা জ্বলন্ত উনুনে।

চার

এতক্ষণ ক্রিকেটের লাল বল হয়ে শুধু ব্যাটপেটা খাচ্ছিলেন, কিন্তু এখন একটা পাঁশুটে রঙের গোব্দামত বেড়াল তাঁকে গপাৎ করে খেতে আসছে। নাতনি ওই টম এ্যান্ড জেরি না কী বলে, সেইটে চালিয়েছে নির্ঘাৎ। আর সুধাংশুবাবু লাল বল থেকে প্রোমোশন পেয়ে, হয়েছেন বাদামী ইঁদুর জেরি। উফফ্ নাতনিটা একটু সুন্দর পরী হুরী মণ্ডামিঠাইওয়ালা কার্টুন চালাতে পারল না! এখন প্রাণ হাতে করে পাঁই পাঁই করে দৌড়তে হচ্ছে সুধাংশুবাবুকে জেরি অবতারে। বিড়ালটাও বড্ড বজ্জাত, কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। চেয়ারের তলা দিয়ে, টেবলের ওপর দিয়ে সে কী দৌড়। আরেকটু হলেই সুধাংশুবাবুর লেজটা বিড়ালটা কপাৎ করে কামড়ে ধরছিল, তার আগেই উনি সামনের দেওয়ালের গায়ে একটা ফোকরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। জিভ বার করে হ্যা হ্যা করে হাঁপাতে লাগলেন।

বদমাইশ বেড়ালটা এদিকে ফোকরটার বাইরে ওঁত পেতে বসে আছে, বেরনো মুশকিল এখন। বাইরে বার হ’বার নামারকম মতলব ভাঁজতে লাগলেন মনে মনে। টেবিলের ওপর দিয়ে ছোটার সময় নজর করেছেন একটুকরো চিজ রাখা আছে একটা প্লেটের ওপর। গন্ধটা এখনও নাকে ভাসছে, পেটটাও গুড়গুড় করছে। কয়েকগাল মুড়ি এর আধখানা পেঁয়াজি আর কতক্ষণই বা পেটে থাকবে। চোখ বুজে, মাথা ঘামাতে লাগলেন একটা উপায় বার করার জন্য।

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নাকে গরম গরম লুচির গন্ধ ভেসে এল। ব্যাপারটা কী! চিজের গন্ধ লুচির গন্ধে বদলে গেল কী করে! চোখ মেলতেই সুধাংশুবাবু যাকে বলে ‘ভ্যাবাচাকা হাম্বা’ তাই হয়ে গেলেন। ভীষণ সুন্দর সাজানো গোছানো একটা বাড়ির পরিপাটি ডাইনিং টেবলের সামলে নিজেকে আবিষ্কার করলেন। ডাইনিং টেবলের ওপর থরে থরে ফুলকো লুচি সাজানো, সাথে কালোজিরেওয়ালা সাদা আলুর চচ্চড়ি। দেখেই হামলে পড়তে যাচ্ছিলেন সুধাংশুবাবু। হাতটা যেই না বাড়িয়েছেন ওমনি দু’দুটো নারীকণ্ঠ কানে ভেসে এল। একজন বলছে,

—“এটা আলুর চচ্চড়ি হয়েছে? একফোঁটা নুন নেই! বৌমা তোমার বাপের বাড়ি থেকে কি তোমায় কিচ্ছু শিখিয়ে পাঠায়নি? ধোঁকা দিয়ে, আমার অমন সোনার টুকরো ছেলের গলায় মেয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে।”

আরেকটা গলা কানে এল,

—“যেমন দাদা তেমন বোন! একজনকে টিভির সামনে থেকে তুললাম তো অন্যজন এসে বসলেন। যা শিগগির গিয়ে বই নিয়ে বোস। মাআআ! এই ঘরে আসুন, আপনার ছেলে ওই টিভিতে রাজ্যের শেয়ারমার্কেটের খবর চালিয়ে বসেছে। শিগগির আসুন, ‘সোনার সংসার’ শুরু হয়ে গেছে।”

পাঁচ

দ্বিতীয় গলাটা তো বৌমার বোঝাই যাচ্ছে। তার মানে সন্ধে সাড়ে ছ’টা বাজল। বাংলা সিরিয়াল ‘সোনার সংসার’ দেখতে বসবে এবার শাশুড়ি আর বৌমা মিলে। আশ্চর্য! ঝড় বাদলাতে বুড়ো লোকটা কোথায় গেল তাই নিয়ে কারোর মাথাব্যথা নেই। ক্লাবে তাস পিটতে গেছে ধরে নিয়েই সবাই যে যার ফূর্তি করতে ব্যস্ত। সব স্বার্থপর। ছেলে বৌমা নাতি নাতনি সব নাহয় কম বয়স কিন্তু রমলা! তারও একবার বুড়ো বরটার কথা মনে পড়ল না? সুধাংশুবাবু ঝড়বাদলায় টিভি চালালে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় আর নিজে যে সিরিয়াল গিলতে বসেছে তার বেলায় কিছু যায় আসে না? এখন তো কই বাজ পড়ে টিভি খারাপ হয় না।

বেশ হয় যদি আরেকটা বাজ পড়ে টিভিটা ওই রকম ঝিলঝিলিয়ে যায়। আর রমলা সুধাংশুবাবুর মত কেবলের তার বেয়ে টিভিতে ঢুকে পড়েন। জোরদার বদলা নেবেন সুধাংশুবাবু। রমলা লাল টুকটুকে ক্রিকেট বল হ’লে, উনি হবেন ব্যাট। রমলা পিচ্চি ইঁদুর জেরি হলে উনি হবেন টম। এমন জব্দ করবেন বুড়িকে! অবিশ্যি এই টিভির ভেতরের আজব দুনিয়ায় কে যে কী রূপ পাবেন তার কোনও ভরসা নেই। আর টিভির বাকি চরিত্রগুলোও কিছু বুঝতে পারে না। টিভির বাইরের মানুষদের কথা একমাত্র সুধাংশুবাবু ছাড়া আর কেউ শুনতে পায় বলে তো মনে হয় না।

এই যে সামনের আরেকজন মহিলা অনর্গল চেঁচিয়ে চলেছেন তিনি নিশ্চয়ই বাইরে রমলা আর বৌমার গলা শুনতে পাচ্ছেন না। এবার একটু মন দিয়ে সামনের মহিলাকে লক্ষ করলেন সুধাংশুবাবু। জমকালো শাড়ি পরা, গয়নার দোকানের মূর্তিমান বিজ্ঞাপন, কপালে ইয়াব্বড় লাল টিপ! মুখটা চেনা ঠেকছে। ও হো! এ তো সেই ‘সোনার সংসার’ সিরিয়ালের দজ্জাল শাশুড়িটা। এবার নিজের হাত পায়ের দিকে তাকালেন সুধাংশুবাবু। এ কী জ্বালা! তিনি তো ওই দজ্জাল শাশুড়ির ভালোমানুষ গরিব বাড়ির বড়বৌমার চরিত্র হয়ে গেছেন। হা ঈশ্বর! এর থেকে তো লাল বল হয়ে ব্যাটের পিটুনি খাওয়া ভালো ছিল। নিদেনপক্ষে জেরি হয়ে টমের পেটে গেলেও চির শান্তি পেতেন। কিন্তু এখন এই শাশুড়ির বাক্যবাণ সহ্য করতে হবে!

মেজাজটা গরম হতে থাকে সুধাংশুবাবুর। পেটের ভেতরের ছুঁচোগুলোও ডন বৈঠক সেরে এবার মুগুর ভাঁজতে লেগেছে। সুধাংশুবাবু আর সামলাতে না পেরে, হাত বাড়িয়ে টেবলের ওপর থেকে একটা ফুলকোপানা লুচি তুলে, তাইতে করে একখাবলা সাদা আলুচচ্চড়ি মুড়ে নিয়ে, সটান মুখে চালান করে দিলেন। বেশ ভালোই তো হয়েছে আলুচচ্চড়ি, নুন ঝাল সবই ঠিকঠাক। খামোখা ওই দজ্জাল মহিলা অমন করে মুখ করছিলেন বেচারা বৌমাটাকে, থুক্কুড়ি সুধাংশুবাবুকে।

এদিকে বৌমারূপী সুধাংশুবাবুকে খপাৎ করে লুচি খেতে দেখে শাশুড়ি প্রথমে ভড়কে গেলেও তারপর খ্যারখ্যারে গলায় চেঁচাতে শুরু করলেন,

—“এ কী অনাসৃষ্টি কাণ্ড রে বাবা! এ কেমন অলুক্ষুণে মেয়ে! শ্বশুর ভাসুর বর সব না খেয়ে বসে আছে আর উনি পেটপুরে লুচি গিলতে শুরু করলেন। এই রাক্ষসী মেয়েই একদিন আমার ‘সোনার সংসার’ ছারখার করবে, এই আমি বলে দিলুম।”

সুধাংশুবাবু আর সহ্য করতে পারলেন না। টেবিলের ওপর থেকে একটা টমেটো সসের প্লাস্টিকের বোতল তুলে, তার পেটটা টিপে পিচিক পিচিক করে শাশুড়ির গায়ের দামী শাড়িতে লাল সস ছিটিয়ে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আশেপাশের বাকিসব ক্যারেক্টারগুলো থ’ হয়ে গেল। সেই সুযোগে সুধাংশুবাবু হেঁকে হেঁকে বলতে লাগলেন,

—“ও রমলা তুমি শুনছো? এটা আমি গো আমি। সুধাংশু ঘোষদস্তিদার। তোমার আদি অকৃত্রিম বর! ও খোকা, বৌমা! তোমরা শুনতে পাচ্ছো? ভোম্বল টুম্পা কই গেলি? আমি দাদুভাই রে! আমি এই টিভির ভেতর আটকা পড়েছি, কিছু একটা করে আমায় বার করো। ডাক্তার-ওঝা-ইলেকট্রিসিয়ান-কেবলের লোক যাকে পারো ডাকো!”

ছয়

ক্রিকেটের বল আর জেরি অবতারে কথা বলার উপায় ছিল না। মনুষ্য অবতারে আসতেই তাই সুধাংশুবাবু সব কাণ্ড বয়ান করতে লাগলেন। এতখানি বলে দম নিলেন, কই রমলা বা বৌমা কারোর গলা তো আর কানে আসছে না। ওরা কী তবে সুধাংশুবাবুর গলা শুনতে পাচ্ছে না? যতক্ষণ টিভিটা সাদাকালো ঝিরঝির করছিল ততক্ষণ তবু ঐ জানলার মত খুপরিটা দিয়ে নিজের ঘরটা, লোকজনদের দেখতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু যখনই কোনও চ্যানেল লাগাচ্ছে কেউ, সুধাংশুবাবু চারপাশে টিভির দৃশ্যটা ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। শুধু বাড়ির লোকগুলোর গলাটুকুই শুনতে পাচ্ছেন।

খানিকক্ষণ কান খাড়া করে রইলেন, রমলার বা বৌমার গলা পান কি না। কিন্তু নাহ্! কই কেউ কিচ্ছু বলছে না। মাঝখান থেকে টিভির ভেতরের ওঁর শ্বশুরবাড়ির লোকগুলো কীসব গুজগুজ ফিসফাস করছে। এমন সময় কানে এল রমলার গলা,

—“ও বৌমা দ্যাখো দেখি টিভির ছবিটা কেমন তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে। কিছু দেখা যাচ্ছেনা। শোনাও যাচ্ছেনা এমন চ্যাঁ চোঁ করে আওয়াজ হচ্ছে। যত রদ্দির জিনিস কেনার দিকে নজর লোকটার। একটা কেমন সুন্দর ছোট্ট পাতলা প্লাজমা টিভি দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিলে কত জায়গাও বাঁচে। ড্রইং রুমের টিভিটা কত সুন্দর লাগে।”

—“মা আপনার ছেলে তো কত করে বলল বাবাকে, কিন্তু উনি শুনলে তো!”

সুধাংশুবাবুর তো মুখে একগাল মাছি। এত চেষ্টা করে বললেন কথাগুলো আর ওরা নাকি শুনতেই পেল না। এক্ষুনি আবার অন্য চ্যানেলে ঘোরালে সাপ ব্যাঙ চেয়ার টেবিল কী অবতারে জন্ম নেবেন কে জানে! রাগের চোটে কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে সুধাংশুবাবুর। কিন্তু কপাল চাপড়ানোর আগেই কে যেন পেছন থেকে সুধাংশুবাবুর হাতদুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল। সেই ভয়ঙ্কর শাশুড়িরূপী মহিলা ফের আর্তনাদ শুরু করলেন।

—“আমি জানতাম! এরকম কিছুই হবে! পাগল মেয়ে গছিয়ে দিয়েছে আমাদের! আমার সোনার টুকরো ছেলের কপালে শেষে পাগলি জুটল একটা। এ আমার কী সর্বনাশ হ’ল গো! আমার সোনার সংসার ছারখার করে দিল এই ডাইনিটা।”

সুধাংশুবাবু পড়লেন মহা ফাঁপরে। এবার তো এরা সুধাংশুবাবুকে মানে ওই বড় বৌমারূপী মেয়েটিকে ধরে পাগলাগারদে পুরে দেবে। এর বেলা কেউ চ্যানেল বদলাচ্ছে না কেন? কোথায় গেল বাড়ির লোকগুলো সব? এমন সময় হঠাৎ করে একটা চাপা ‘ক্কড়ক্কড়াৎ’ শব্দ কানে ভেসে এল সুধাংশুবাবুর। কানে যেন মধু বর্ষাল। নির্ঘাৎ বাজ পড়েছে, রমলা এবার টিভি বন্ধ করবে নিশ্চয়ই। এতক্ষণ ধরে যা চলছে তার থেকে ওই অন্ধকারই ভালো।

সাত

নাহ্ রমলা টি.ভি. বন্ধ করার আগেই অন্য কাণ্ড হ’ল। আবার সব সেই সাদা কালো ঝিরিঝিরি গুঁড়োতে চারপাশটা ভরে গেল। ঠিক যেমন শুরুতে ঘটেছিল, যখন সুধাংশুবাবু টি.ভি.-র বাইরে বসে টিভি দেখছিলেন। নিজের শরীরের দিকে তাকালেন সেই আগের মত সাদা কালো বুটিতে ভরে গেছে। ফুড়ুৎ করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল সুধাংশুবাবুর। সেই সাথে কানে ভেসে এল রমলার কাতর স্বর,

—“ও খোকা! এদিকে আয়না একবারটি। কী হয়ে গেল টি.ভি.-টা। কেমন ঝির ঝির করতে লাগল বাজ পড়তেই। এইজন্যই সবসময় বজ্রবিদ্যুৎ হ’লে সব কারেন্টের জিনিস বন্ধ করি। এই আপদ বাংলা সিরিয়ালের নেশাতেই এমন দশা হ’ল। এদিকে এই লোকটা ঝড় বাদলায় ক্লাবে তাস পেটাতে গেল। ভালো লাগে না, কিচ্ছু ভালো লাগে না আমার। সংসার ছেড়ে বিবাগী হ’ব এবার। বৌমাআআ কোথায় গেলে তুমি?”

রমলার কথা শুনতে শুনতে সুধাংশুবাবু ভাবেন, তবু মনে পড়েছে রমলার বরের কথা। আর তাস পেটানো! এখন সেই অ্যালিসের মত তাসের রাণীর দেশে চলে না গেলে হয় টিভির ভেতর দিয়ে। অ্যালিস যেমন গর্তের মধ্যে দিয়ে আজব দেশে পৌঁছে গেছিল তেমনি কেবলের তার বেয়ে সুধাংশুবাবুও টি.ভি.-র ভেতরের অদ্ভুত দুনিয়ায় এসে গেছেন।

রমলাকে আরেকবার ডাকার চেষ্টা করতে গিয়ে হঠাৎ করে লক্ষ করলেন সাদা কালো গুঁড়োগুলো একটা ফানেলের মত জায়গার মধ্যে দিয়ে যেমন হড়হড়িয়ে তেল বা জল গড়িয়ে যায় তেমনি করে গলে বেরিয়ে যাচ্ছে। সুধাংশুবাবু সেদিকপানে একটু এগিয়ে গেলেন, হঠাৎ করে পা হড়কে ওই ঘূর্ণির মত জায়গাটায় পড়ে গেলেন। ওমনি আবার সেই স্লিপারে যেমন করে বাচ্চারা হড়কে যায় তেমন করে সড়সড় করে গড়িয়ে যেতে লাগলেন উনি। বেশ খানিকক্ষণ শোঁ শোঁ করে গড়িয়ে দুম করে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন শক্ত একটা মেঝেয়। পিটপিট করে চোখ মেলে দেখলেন, এ তো তাঁর নিজেরও ঘরটা।

“ইয়াহু!” বলে চিৎকার করে উঠলেন সুধাংশুবাবু। টি.ভি.-র ভেতর থেকে অবশেষে বেরোতে পেরেছেন। উফফ অবশেষে! কী সাংঘাতিক বিপদেই না পড়েছিলেন। ফের আরেকবার আনন্দে “হুরররররে” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। টি.ভি.-টার দিতে ফিরে তাকালেন, সাদা কালো গুঁড়ো ঝিরঝির করছে। এক্ষুনি এটাকে বন্ধ করতে হবে, তারপর কেজি দরে বেচে দিতে হবে ভেঙে টুকরো টুকরো করে। রিমোটটা কই? নির্ঘাৎ রমলা রিমোট নিয়েই ঘরের বাইরে খোকাকে ডাকতে গেছে।

—“রমলা! খোকা! বৌমা! শুনছো? ভোম্বল টুম্পা কই গেলি?”

আট

গায়ে একটা ঠ্যালা খেয়ে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল সুধাংশুবাবুর। চোখটা খুলে দেখলেন সামনের টেবিলে রমলা চায়ের কাপ আর এক কাঁসি মুড়ি নামিয়ে রাখছে। মুড়ির ওপর দু’টো পেঁয়াজী। চোখটা রগড়ে ভাবার চেষ্টা করতে লাগলেন কী ঘটছে। রমলার গজগজানি কানে এল,

—“কী হল? ঘুমের ভেতর চ্যাঁচাচ্ছ কেন? একবার বাড়িশুদ্ধু লোককে ডাকছ, একবার বাচ্ছাদের মত হাঁকছ। বলি মাথাটা ঠিক আছে? আর টি.ভি.টা চালিয়ে রেখেই নাক ডাকাচ্ছে। কতবার বলেছি বাজ পড়লে টি.ভি. বন্ধ করবে। কী যে এত খবর দেখার নেশা, বুঝি না।

ওই ওই ওই কী জোরে বাজ পড়ল। একী টিভির ছবিটা এমন ঝিরঝিরিয়ে গেল কেন? বাজ পড়ে কিছু হয়ে গেল না তো! কী মুশকিল!”

এতক্ষণ ভেবলু হয়ে রমলার গজগজানি শুনছিলেন সুধাংশুবাবু। ‘ক্কড়ক্কড়াৎ’ আওয়াজে সম্বিত ফিরল। স্বপ্ন দেখছিলেন নাকি সত্যিই হচ্ছিল সব। সামনে তাকিয়ে দেখলেন রমলা এগিয়ে গিয়ে টি.ভি.-র এদিক ওদিক খুটখাট করছে। প্লাগের তার, কেবলের তার সব টি.ভি. থেকে টেনে খুলতে লেগেছে। সুধাংশুবাবুর চিৎকার করে চোখ বুজে ফেললেন,

—“রমলাআআ! টি.ভি.-তে হাত দিও নাআআআআ!’