মানবী - অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

অলংকরণ - প্রতিম দাস

“নাও, চা-টা ধর। ক’টা বেগুনি ভেজে আনি?” কথাগুলো বলতে বলতে অনিন্দ্যর দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিল সঞ্চারী।

মুম্বাইয়ের পাওয়াই লেকের পাশে অনিন্দ্যর এই ছোট্ট ফ্ল্যাটের ব্যাল্কনি থেকে লেকটার বেশ অনেকটাই দেখা যায়। এখন নভেম্বর মাসের শেষ। লেকের দিক থেকে মিষ্টি হাওয়া আসছে। আজ খুব একটা ভাল মুডে ছিল না অনিন্দ্য। কিন্তু এই বাসন্তী হাওয়া আর সঞ্চারীর মিঠে উপস্থিতি, ঠিক এই মুহূর্তটা যেন স্নায়ুতন্ত্রকে টানটান করে, মন ভাল করে দিল।

“না না... ভাজাভুজি খেতে আজ ভাল লাগছে না। তুমিও বরং চেয়ারটা টেনে এনে বস। মা’কে দেখছি না...”

“মা এই সময় সিরিয়াল নিয়ে মেতে থাকেন তুমি জানো তো! রিমোটে বাংলা চ্যানেল কী করে সেট করতে হয়, আমিই শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছি। ন’টার আগে উঠবেন বলে তো মনে হয় না।”

“তাহলে প্রেমালাপটা একটু বেশিক্ষণ করা যাবে, অভয় দিচ্ছ?”

সঞ্চারী খুব সুন্দর করে হাসল। হাসলে ওর গালে টোল পড়ে, আগে যেন লক্ষ করেনি অনিন্দ্য। পড়ন্ত বিকেলের আলো ওর গালে পড়ে কনট্রাস্ট তৈরি করায় গালের টোলটা নজরে এল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সঞ্চারীর হাতটা বাম হাত দিয়ে চেপে ধরে অনুনয় করল অনিন্দ্য, “এ্যাই, একটা গান কর না।”

“বাংলা, না হিন্দি?

“যা খুশি। বিকেলটা আজ বড় সুন্দর লাগছে।”

কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে একটু ভেবে নিয়ে সঞ্চারী শুরু করে, “দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে, আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাইনে তোমাকে...”

সঞ্চারীর গান যেন কেমন মন উদাস করে, আউল বাউল করে দেয়। গান শেষ হতেই চরম নিস্তব্ধতা। সঞ্চারী কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়। দুজনেই চুপ করে খানিকক্ষণ বসে থাকে। লেকের জলের উপর কালো আকাশ ঝুঁকে আসছে। অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে অনিন্দ্যর ব্যাল্কনিতেও। সঞ্চারী লাইট জ্বালাতে উঠে দাঁড়ায়। অনিন্দ্য ওর কনুইতে টান দিয়ে বসিয়ে দিতে গেলে টাল সামলাতে না পেরে ওর কোলে আছড়ে পড়ে সঞ্চারী। আচমকা এমন পতনের কারণে মানবী হলে হয়তো ব্রীড়ানত হয়ে বলে উঠত, “কী যে কর না! অসভ্য!”

কিন্তু সঞ্চারীকে সেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়নি। ওর প্রোগ্রামে এই ছোট্ট ভুলটা শুধরে নিলে জীবনটা আরও মধুর হয়ে উঠবে, এমনটাই মনে হয় অনিন্দ্যর।

“আচ্ছা সঞ্চারী, এই যে গানের মধ্যে দিয়ে বলে উঠলে - ‘পাইনে তোমাকে...’ তুমি কী সত্যিই আমাকে পাওনি? আমার তো মনে হয় অফিসের সময় ছাড়া যে সময়টুকু জুটিয়ে নিতে পারি, তার সিংহভাগ কেবল তোমায় দিয়ে থাকি। আজ তোমার গানের মধ্যে কেমন যেন করুণ সুর বেজে উঠল। যদিও এটা প্রশংসা করতেই হবে, আগের চাইতে গানগুলো তুমি অনেক ভালো গাও এখন। উচ্চারণের জড়তাও অনেকটাই কেটে গেছে।

“তোমার আগের বউয়ের চাইতেও ভালো?” সঞ্চারীর গলায় ব্যঙ্গের সুর শুনে চমকে উঠল অনিন্দ্য। এই খবরটা ওকে কে দিল? নিশ্চয়ই মা। কোনও মানে হয়! এন্ড্রয়েড বউকে এই সব গোপন কথা না বললেই কি চলছিল না? ধুত্তেরি, মা তো সঞ্চারীর আসল পরিচয় জানেই না! আর কী করেই বা জানবে? অনিন্দ্য তো আর সেকথা ফাঁস করেনি মায়ের কাছে!

ঘটা করে, একেবারে মন্ত্র পড়ে, সাত পাক দিয়ে, উলুধ্বনির হুল্লোড়ে, প্রথম বউ সাগরিকার সাথে অনিন্দ্যর বিয়ে হয়েছিল। তখন সে মুম্বাইতে ছিল না, চাকরি করত কোলকাতায়। বিয়ের ব্যবস্থা তাদের গ্রাম চন্দ্রবোড়ায় হয়নি। একবার বলবার চেষ্টা করেছিল অনিন্দ্য – গ্রামে বিয়ে না করলে ব্যাপারটা ভালো দেখায় না। সাগরিকার বাড়ির লোক একেবারে হা হা করে উঠেছিল। আসলে পৃথিবীটা সূর্যের চারিদিকে যতবার পাক খায়, চন্দ্রবোড়ায় জীবন ততবার পাক খায় না। প্রশাসনিক ঢিলেমিই হোক, বা রাজনৈতিক কারণে - দ্বাবিংশ শতাব্দীর ভারতের শহরগুলোকে টেকনোলজির ম্যারাথন দৌড়ে জিতিয়ে দিলেও, কিছু কিছু গ্রাম যেন এখনো শতাব্দী প্রাচীন ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সভ্যতার আলো এখানে চুপিসারে ঢোকে, জীবন চলতে থাকে গড়িয়ে। চন্দ্রবোড়া ঠিক এমনই একটা গ্রাম।

সাগরিকার সাথে বিয়েটা টেঁকেনি অনিন্দ্যর। আসলে মা ছাড়া আর কেউ ছিল না তার। বাবা তার অল্প বয়সেই চলে যান। একমাত্র ছেলে অনিন্দ্যকে তার মা মানুষ করেন। গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করলেও মনের দিক থেকে তিনি অনেক আধুনিক। সাগরিকার সাথে কোলকাতায় বিয়ে তিনি নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু স্কুলের চাকরি থেকে রিটায়ার করার পরও নিজে চন্দ্রবোড়া ছাড়তে চাইলেন না। মাঝে মধ্যে অনিন্দ্যর কোলকাতার বাসায় এসে থাকতেন ঠিকই, কিন্তু সাগরিকা তাদের জেট স্পিড জীবন সংসারে শাশুড়িকে একেবারেই মেনে নিতে পারেনি।

 

প্রথম স্ত্রীকে ভোলা অত সহজ ছিল না। ওরা দুজনে একই অফিসে কাজ করত। দুজনের প্রেম ছিল যাকে বলে একেবারে দাপুটে প্রেম। ছ’বছর একটানা প্রেম পর্ব চালিয়ে বিয়ের জোড়ে বাঁধা পড়েও সব কেমন যেন দ্রুত শুকিয়ে গেল। একটা ব্যর্থ সম্পর্ক বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই জেনে, দুজনেই সরে গিয়েছিল নিঃশব্দে। সাগরিকা এখন সাগর পাড়ের কন্যা – ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর কুয়ালালামপুরের চাকরির হাতছানিতে সাড়া দিতে সে সময় নেয়নি। পলিমার টেকনোলজির বিশেষজ্ঞ ছিল অনিন্দ্য। তাই সেও মুম্বাইতে পাড়ি দিয়েছিল নতুন এক কোম্পানির ডাকে।

সাগরিকার নামের আদ্যক্ষরের সাথে মিল রেখে অনিন্দ্য তার এন্ড্রয়েড ঘরণী আকিরার নাম রেখেছিল - সঞ্চারী। জাপানে উন্নত পলিমার তৈরির মেশিনের ট্রেনিং নিতে অনিন্দ্যকে তার কোম্পানি জাপান পাঠায়। নাকাগাওয়ার সাথে আলাপ হয় সেখানেই। লোকটা একটু ছিটিয়াল টাইপের ছিল। সে নিজেও ছিল একজন পলিমার টেকনোলজিস্ট। তবে নিজের মাথাখানাকে একদণ্ড শান্তিতে জিরোতে দিত না। রোবটিক্স নিয়ে সঙ্গোপনে গবেষণা করত।

নতজিমা জাপানের একটা ছোট্ট দ্বীপ। নানাও সিটি থেকে সামান্য দূরে। আফটারনুন রিসেসে কফিশপে কফি খেতে খেতে, নাকাগুয়া তার রোবট বানানোর নিজস্ব ল্যাবের গল্প শুনিয়েছিল অনিন্দ্যকে। নিছক কৌতূহলী হয়ে নাকাগাওয়ার ল্যাব দেখতে যেতে চায় অনিন্দ্য আর নাকাগাওয়াও খুব খুশি হয় ওর প্রস্তাবে।

নানাও সিটি থেকে বোটে করে নতজিমা যেতে যেতে এক ছুটির দিনে সে অনিন্দ্যকে শুনিয়েছিল, অন্য রোবট কারিগরির সাথে তার বানানো রোবটের তফাতের কথা। নাকাগাওয়া জানায়, তার তৈরি হিউম্যানয়েডদের সাথে মানুষের শরীরের ফারাক বার করা মুশকিল। কারণ সে উন্নত পলিমার টেকনোলজির সাথে রোবটিক্স মিশিয়ে দৈনন্দিন কাজের সাথী হিসাবে তাদের বানিয়ে থাকে। অনিন্দ্য জানে, একবিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই হিউম্যানয়েড তৈরি করতে শুরু করেছিল জাপান ও অনেক উন্নত ইউরোপিয়ান দেশ। প্রথমে তাদের সাথে যন্ত্রের তফাত খুব বেশি ছিল না। গত তিরিশ বছরে হিউম্যানয়েডদের বিবর্তন হয়েছে রকেট স্পিডে। এখন এই দ্বাবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভারতের যে কোনও শহরে ডোমেস্টিক হেল্প হিসাবে হিউম্যানয়েডরা বেশ জনপ্রিয়। এখন তারা আর খরচা সাপেক্ষ নয়। ভারতেও মুম্বাই দিল্লিতে অনেক রোবট তৈরির কারখানা গজিয়ে উঠেছে। কিন্তু সেসব হিউম্যানয়েডদের আলাদা করে চিনতে পারা যায়। যদি নাকাগাওয়ার কথা সত্যি হয়, তবে কে জানে এরা একদিন মানুষের চেয়ে উন্নত হয়ে উঠবে!

তখন ডিসেম্বরের শেষ দিক। জাপানেও ঠাণ্ডা বেশ জমিয়ে পড়েছে। বোট থেকে নামতেই প্রায় ঠকঠক করে কাঁপছিল অনিন্দ্য। উঁচু নিচু প্রায় নির্জন রাস্তায় গাড়ি হাঁকাতে হাঁকাতে নাকাগাওয়া এলোমেলো কথা বলে চলেছিল। এই দ্বীপটাতে জনসংখ্যা খুব কম দেখা যাচ্ছে। হয়তো সেইজন্যই নাকাগাওয়া এমন দ্বীপ বেছে নিয়েছে তার গবেষণার জন্য। ঠোঁটের কোণে ব্যাঁকা হাসি ঝুলিয়ে সে প্রশ্ন করেছিল, “তুমি বিবাহিত, না এখনো সেসবের সময় পাওনি? সারাক্ষণ কাজ নিয়েই বুঝি ব্যস্ত থাক?”

অনিন্দ্য জানিয়েছিল - সে বিবাহিত, কিন্তু ডিভোর্সি। নাকাগাওয়া খুব উৎসাহিত পড়েছিল, তবে তার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেনি। শুধু বলেছিল, “তাহলে তোমার উপযুক্ত কনের সন্ধান একমাত্র আমিই দিতে পারব বুঝলে হে ভারতবাসী!”

আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসার বিন্দুমাত্র উৎসাহ তখন অনিন্দ্যর ছিল না। সাগরিকাকে ভোলা যায় না। তাই নাকাগাওয়ার অবান্তর কথার কোনও গুরুত্ব দেয়নি সে।

নাকাগাওয়ার কাঠের বাড়িতে বসবার ঘরে খুব উজ্জ্বল আলো জ্বালা ছিল সেদিন। অপূর্ব সুন্দরী এক রমণী এসে আরিগাতো জানিয়ে জাপানের বিখ্যাত সবুজ চায়ের দুটো কাপ নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল। তার গমন পথের লাস্যময়ী ভঙ্গিমা অনিন্দ্যর শরীরে জমিয়ে বসা ঠাণ্ডা যেন অনেকটাই দূরে সরিয়ে দিয়েছিল মুহূর্তে। অনিন্দ্যর চোখের নজর লক্ষ করতে করতে নাকাগাওয়া জোরে জোরে হেসে উঠে বলেছিল, “বলেছিলাম না, একেবারে তোমার মন পসন্দ হবে!”

অনিন্দ্য লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে চায়ের কাপ টেনে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনার মেয়ে বুঝি?”

নাকাগাওয়া সেই কথায় বেজায় ঠা ঠা শব্দে হেসে উঠে কুতকুতে চোখ নাচাতে নাচাতে বলেছিল, “নিজের ক্রিয়েশন... তাই মেয়ে তো বটেই! তবে কী জান, ওকে এমন অপ্সরা বানাবো বলে ট্রায়াল নিতে গিয়ে যা যা করতে হয়েছে, তাতে বাবা মেয়ের সম্পর্ক কতদূর সঠিক, বলা মুশকিল। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, জলদি শেষ করে নাও দেখি, আমি বরং দেখি রাতের খাবারের কী ব্যবস্থা হয়েছে।”

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অনিন্দ্য ভাবছিল, লোকটা তার সাথে মজা করছে না তো? এতটাই পারফেকশন যে মেয়েটি রক্তমাংসের কোনও নারী নয়, তা বোঝার উপায় নেই। ভারতে যেসমস্ত রোবট কর্মীদের দেখা যায়, তারা অনেকটাই যান্ত্রিক। হাঁটা চলায় কাঠিন্য আছে। সেটাই স্বাভাবিক, যতই হোক রোবট যন্ত্র ছাড়া তো আর কিছুই নয়।

যন্ত্র মানবীর সাথে বিয়ের প্রস্তাবে বেজায় হাসি পেল অনিন্দ্যর। যদিও শুনেছে এই জাপানেই নাকি অনেক কাল আগে এক রোবট বানানোর কারিগর, তার নিজের বানানো রোবট রমণীকে বেশ ঢাক ঢোল পিটিয়ে বিয়ে করেছিল। এই দ্বাবিংশ শতাব্দীতেও এই গল্প শুনে লোকে হাসাহাসি করে, যদিও টেকনোলজি আপেক্ষিকভাবে অনেক এগিয়ে। তাই আকিরাকে বিয়ে করে হাস্যস্পদ হয়ে উঠতে পারে অনিন্দ্য। কিন্তু ভিতরে ভিতরে এক তীব্র আকর্ষণও বোধ করছে অনিন্দ্য। জীবনটাকে একটু উল্টে পাল্টে দেখলে মন্দ কী?

মেয়েটি এবার ড্রয়িং রুমে ঢুকে অনিন্দ্যকে বাও করে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, তার কিছু প্রয়োজন আছে কিনা। ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে, তাকে অপলক দেখতে দেখতে অনিন্দ্য ভাবে, নাঃ, কোথাও নিশ্চয়ই কিছু ভুল হচ্ছে। মেয়েটি এবার জাপানিস ভাষায় কিছু বলল। একফোঁটাও বোধগম্য না হওয়ায় অনিন্দ্য বলে, “প্লিস স্পিক ইন ইংলিশ, আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড জাপানিস।”

অনিন্দ্যর কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, নাকাগাওয়া ঘরে ঢুকে পড়ে বলে, “আসলে আমি ওকে ইংরেজিটা এখনো শিখিয়ে উঠতে পারিনি। তুমি চাইলে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খুব কম দিনেই ওকে বাঙলাও শিখিয়ে দিতে পারবে। ওর প্রোগ্রাম মালটিলিঙ্গুয়াল করা আছে, তাই কোনও ভাষাতেই অসুবিধা নেই। তুমি ট্রায়াল নিতে পার।”

এরপর নাগাগাওয়া তার যন্ত্র কন্যাটির সাথে জাপানী ভাষায় মৃদুস্বরে কিছু কথা বলে নিয়ে অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল, “চল, আমরা ডাইনিং হলে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে নিই, রাত অনেক হল।”

নিখুঁত ভাবে মেয়েটির খাবার পরিবেশনের কায়দা এবং প্রয়োজনে হাতের কাছে সব সুন্দর ভাবে বাড়িয়ে দেওয়া দেখে অনিন্দ্য তাকে ভারতে নিয়ে আসবার প্রস্তাব মেনে নেওয়ার কথা বলেই ফেলল। নাকাগাওয়া খুব খুশি হয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে দুপাক নেচে নিল। যন্ত্র মানবীকে অনিন্দ্যর প্রস্তাব জানিয়ে দিতে সে হেসে উঠল, কিন্তু লজ্জা পেল না সম্ভবত।

 

জাপান থেকে ফেরার সময় রীতিমত সাক্ষী সাবুদ সহ কোর্টে দরখাস্ত করে যন্ত্র সুন্দরীকে নিজের বউ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে দেশে নিয়ে এল অনিন্দ্য। এটা তাকে বাধ্য হয়েই করতে হয়েছিল। নাকাগাওয়া সেক্সটয় হিসাবে তার নিজের হাতে গড়ে তোলা হিউম্যানয়েডকে বেচতে রাজি হয়নি। অনিন্দ্যও আর আপত্তি করেনি। রেজিস্ট্রেশনের সময় আকিরার জাপানী নাম বদলে নাম দিয়েছিল – সঞ্চারী।

সঞ্চারীকে মুম্বাইয়ের ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে বাংলা শিখিয়ে নিতে প্রায় বছর খানেক লেগে গিয়েছিল অনিন্দ্যর। তার জিভ জাপানী ভাষা থেকে বাংলায় অভ্যস্ত হতে সময় লাগা স্বাভাবিক ছিল। অবশ্য দেশে ফেরার মাস খানেক পর, ঘটা করে বন্ধুবান্ধব ডেকে পার্টি দিয়ে নিজের দ্বিতীয় বিয়ের সামাজিক স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছিল অনিন্দ্য। ততদিনে সঞ্চারী ভাঙা ভাঙা বাংলা আর ইংরেজি শিখে নিতে পেরেছিল। কিন্তু সঞ্চারীর আচরণে, সে যে মানবী নয়, এই কথাটা কারো গোচর হয়নি।

সঞ্চারীর যৌন আবেদন যে সাধারণ মানবীর চাইতে অনেক বেশি, সেটা বুঝে নিয়ে নাকাগাওয়ার সৃষ্টিকে সে তারিফ না করে পারেনি। সত্যিই সে যে শুধুমাত্র সেক্সটয় হিসেবে গড়ে ওঠেনি, বোঝা যেত তার নিজস্ব ভালোলাগা, বা না লাগাকে বেশ ভালোরকম গুরুত্ব দেওয়া দেখে। অনিন্দ্যর পছন্দ অপছন্দ বুঝে নিতেও সময় লাগেনি তার। সঞ্চারীর বুদ্ধিমত্তা সমাজের আর পাঁচটা সাধারণ যন্ত্র মানবীর চাইতে অনেক আলাদা হয়ে উঠেছিল খুব কম সময়ের মধ্যে। তাই সঞ্চারীর সাথে বছর খানেক ঘর করার পর নিজের মাকে নিয়ে এসেছিল অনিন্দ্য তাদের চন্দ্রবোড়া গ্রাম থেকে। কিন্তু সঞ্চারী যে যন্ত্র মানবী, সেটা মাকে জানাতে দ্বিধা করেছিল অনিন্দ্য। সঞ্চারীকে জানিয়েছিল - ঘুণাক্ষরেও যেন মা জানতে না পারেন সঞ্চারী মানবী নয়, জাপান থেকে বিয়ে করে আনা এক মেয়ে।

দ্বিতীয়বার বিয়ে করবার ব্যাপারটা জানতে পেরে মা বলেছিলেন, “এটা তুই কী করলি অনি? জাপানী মেয়েটার সাথে ঘর করতে পারবি? আমাদের সাথে ওদের তফাত কত জানিস? সাগরিকার সাথেই তোর বনাবনি হল না, এখন...”

“মা, তুমি ভুল করছ। সঞ্চারী খুব ভালো মেয়ে। একেবারে বাঙালি হয়ে গেছে মনে প্রাণে। ওকে বাংলার আদব কায়দা, রান্নাবান্না শিখিয়ে তবে তো তোমাকে ডেকে আনছি! আর আপত্তি তুলো না, আমি টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিচ্ছি, তুমি প্লেনে উঠে পড় দেখি!” উৎসাহ নিয়ে বলেছিল অনিন্দ্য।

মুম্বাইতে অনিন্দ্যর ফ্ল্যাটে ঢুকেই সঞ্চারীর সৌন্দর্য দেখে মা বলেছিল, “এযে একেবারে স্বর্গের দেবী রে! নাঃ, তোর পছন্দের প্রশংসা করতেই হয় অনি।”

মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সঞ্চারীকে প্রণাম করতে দেখে অনিন্দ্য যেমন অবাক হয়েছিল, তেমনিই ওর মা। ইন্টারনেট সার্ফ করে সঞ্চারী বাংলার গ্রাম অঞ্চলের ট্র্যাডিশন কখন রপ্ত করে ফেলেছে - অনিন্দ্যর ব্যস্ত জীবন তা জানতেও পারেনি। তাই মনে মনে খুশি না হয়ে পারেনি।

মুম্বাইতে মায়ের থাকার এক সপ্তাহ কেটে গেল। একদিন অনিন্দ্য ঘরে ঢুকে দেখে ড্রয়িং রুমে মা পা ছড়িয়ে বসে টিভি দেখছে আর সঞ্চারী মায়ের চুলে তেল লাগিয়ে চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দিচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে দেখে অনিন্দ্যর মা যেন একটু লজ্জা পেলেন। বললেন, “বড় লক্ষ্মীমন্ত বউ রে তোর অনি! এত যত্নআত্তি কি আর আমার পেটে সইবে? কে ওকে এসব শেখাল বল দেখি? জিজ্ঞেস করলে কিচ্ছু বলবে না, শুধু মিটমিট করে হাসবে।”

অনিন্দ্য জানে ওর মা অনেক কষ্ট করে ওকে মানুষ করেছেন। একাকী জীবনে এত সুখ চোখে দেখা হয়নি, তাই সুখের প্রতিটি বিন্দু যেন শুষে নিচ্ছেন প্রাণ ভরে।

মাস খানেক কোথা দিয়ে কেটে গেল টের পাননি অনিন্দ্যর মা। ছেলের বউয়ের আদর যত্নে তার চেহারায় চাকচিক্য ফিরে এসেছে, এটাই একদিন ফলাও করে রাতে ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে ছেলেকে জানাচ্ছিলেন। সঞ্চারীর রাঁধা বিউলির ডাল আর আলুপোস্তর প্রশংসা করতে করতে মা বলে উঠল, “এবার অনেকদিন তো হল অনি, আমার টিকিটটা এবার কেটে দে। বাড়ি তো ফিরতে হবে! তোর বউ যা যত্নে রেখেছে তোকে, এবার আর ফিরে গিয়ে চিন্তা হবে না তোর জন্য। তবে তোদের একটা ছেলেপুলে না হলে, সব কেমন বেসুরো লাগছে। সঞ্চারীকে সকালে এই কথা বলায়, ও দেখি কথা না বলে উঠে চলে গেল।”

ব্রহ্মতালুতে তক্ষকের কামড়েও বোধহয় এত যন্ত্রণা হত না, যতটা মায়ের কথায় অজান্তে ঘটে গেল। এই কথাটা কোনোদিন ভেবে দেখার সময় হয়নি অনিন্দ্যর। আশ্চর্য! এই পরম সত্য, বড় আঘাতের - মাকে বোঝানো অসাধ্য। যন্ত্র মানবী মায়ের সেবাযত্ন, অনিন্দ্যর নরম সহচরী হতে পারলেও, মা হওয়ার ক্ষমতা তার নেই। খাওয়া শেষ করে ওয়াশ বেসিনের দিকে যেতে যেতে অনিন্দ্য শুনল - মা বলছেন, “অনি তুইও সঞ্চারীর মতো আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস?”

সেদিন সঞ্চারী যেন একটু বেশিই শরীরী হয়ে উঠেছিল। একটু পরে ঘরের স্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে বলেছিল, “আমি মা হতে চাই।”

সঞ্চারীর চুলে বিলি কাটতে কাটে অনিন্দ্য বলে, “তুমি বুদ্ধিমতী, ভালো করেই জানো তোমার শরীর সন্তান জন্ম দেওয়ার উপযুক্ত নয়। অবুঝ হয়ো না। আর সন্তান ছাড়া আমরা কি কিছু খারাপ আছি?”

“আছি তো! সারাদিন তুমি থাক না। তোমার মাও চলে যাবেন। আমার সময় কাটবে কী করে। তুমি একটা দত্তক নাও বরং।”

“ইউ মীন এডপশন? আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী বাবা ও মা দুজনকেই সন্তান পালনে সমর্থ হতে হবে, তবেই দত্তক নেওয়ার অনুমতি পাওয়া যাবে। যখন তারা আমার বউ একজন হিউম্যানয়েড জানতে পারবে, তখন পারমিশন দেবে না। একটু বোঝার চেষ্টা কর।”

“আর মাকে কী বোঝাবে?”

“সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও।”

অনেক রাত পর্যন্ত সেদিন ঘুম এল না অনিন্দ্যর। সব ঠিকঠাক চলছিল। এবার যেন কোথায় হঠাৎ করে সুর কেটে গেছে। যেন সব বাজনা থেমে যাওয়ার পর গায়ক অবাক হয়ে ভাবছে, পরের লাইনটা যেন কী ছিল?

দু-একবার ভাবল অনিন্দ্য – নাকাগাওয়াকে ফোন করলে কেমন হয়? ওই তো সঞ্চারীর জন্মদাতা। তারপর ওর মন বলল, পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে একজন হিউম্যানয়েড হওয়া সত্ত্বেও সে কেমন মানব গুণের অধিকারী হয়ে উঠেছে, এই ব্যাপারটা নাকাগাওয়াকে বোঝানো অসম্ভব। যন্ত্র মানবী এখন অনিন্দ্যর ঘরণী হয়ে ওঠায় হয়তো ভুলেও গেছে তার জন্মস্থানের কথা। আর তার যন্ত্র বিশারদ পিতা নতুন সৃষ্টি নিয়ে হয়ে গেছে মশগুল।      

 

মায়ের যাবার দিন যত এগিয়ে আসে, ততই সঞ্চারী যেন ঝিমিয়ে পড়ে। কখনো কখনো বাড়াবাড়ি রকম কেয়ারিং হয়ে ওঠে সঞ্চারী। ব্যাপারটা মায়ের নজরেও পড়ে। তিনি সঞ্চারীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, “চলে যাব বলে মন খারাপ করছিস? তোদের একটা ছেলেপুলে হলে তাদের কাঁথা বদলানোর জন্য ঠিক চলে আসব দেখবি। আসলে কী জানিস, নিজের জায়গাটা একেবারে নিজস্ব। তাই, ফিরে তো যেতেই হবে। তবে তোর জন্য আমারও খুব মন খারাপ করবে এবার।”

ফিরে যাওয়ার ঠিক দুদিন আগে অনিন্দ্যর মায়ের পা পিছলে গেল। বাথরুমের সামনের প্যাসেজে জল পড়েছিল, কেউ লক্ষ করেনি। পা স্লিপ করতে না করতে সঞ্চারীর রিফ্লেক্স একশন কাজ করল। দুটো বলিষ্ঠ হাত মায়ের পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিল। অনিন্দ্যর মা একেবারে বেবাক। কী হয়ে গেল বুঝে উঠতে পারলেন না। সেই সময়ে অনিন্দ্য অফিসে ছিল। মাকে পিছলে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে গিয়ে হাতদুটো যথেষ্ট যান্ত্রিক হয়ে উঠেছিল। সঞ্চারীর গায়ের জোর আর ক্ষিপ্রতা তাকে এতটাই অবাক করেছিল, মা নিজেও যেন বিমূঢ় হয়ে গেলেন।

বিকেলে অনিন্দ্য বাড়ি ফিরতে ঘটনাটা খুলে বলতেই অনিন্দ্য জোরে জোরে হেসে উঠে বলেছিল, “এতে অবাক হওয়ার কি আছে? ও জাপানের মেয়ে... মার্শাল আর্ট ওর রক্তে! ভাগ্যিস তুমি পড়ে যাওনি! নইলে এখানেই তিন মাস বিছানায় পড়ে থাকতে হত।”

বিপদ ঘনিয়ে এলো যখন বেডরুমে সঞ্চারী বজ্রপাতের মতো ঘোষণা করল, “আমি মায়ের সাথে যাচ্ছি, চন্দ্রবোড়ায়। মাকে একা পাঠানো ঠিক হবে না। আমি দেখেছি ওনার ব্লাড প্রেশার নিচের দিকে, আর সুগার লেভেল অনেকটা উপরে, যদিও অন্য বায়কেমিকাল...”

অনিন্দ্যর কানে কিছু ঢোকে না। একে তো সঞ্চারীকে একা সে কোথাও ছাড়েনি, তার উপর তার ডাক্তারি তাকে আরও বিস্মিত করে তুলেছে। সে সঞ্চারীর কথা শেষ হতে না হতে বলে, “দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি এত সব জানলে কী করে? ডাক্তার দেখিয়েছিলে?”

“আমি নিজেকে ডাক্তারি প্রশিক্ষন দিয়েছি। আমি এখন কারো নার্ভে সামান্য চাপ দিয়েই বুঝে নিতে পারি তার শারীরিক সমস্যা। হয়তো খানিকটা ফেস রিড করতেও শিখে গেছি। এই যেমন ধর, আমাকে ছেড়ে যে তুমি একটা রাতও থাকতে পারবে না, তোমার মুখ বলে দিচ্ছে। আমাকে যে তুমি কোনোদিন একা ছাড়নি, সেটাও তোমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। কিন্তু আমারও একটা স্বাধীনতা আছে। মায়ের সাথে যাই। একা ফিরে আসব কিছুদিন পর। এটাতে একটা নতুন ট্রায়ালও হয়ে যাবে।”

সর্বনাশ, এতটা উন্নতি যে কোনও যন্ত্র মানবীর হতে পারে - ভাবতেই পারেনি অনিন্দ্য। এই কেস যে নাকাগাওয়ার হাতের বাইরে চলে গেছে, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। আজ সঞ্চারী অনেক জেদি আর আত্মবিশ্বাসী। তাই সহজেই সে অনিন্দ্যকে নিজের দাবী জানিয়ে দিতে দ্বিধা করছে না।

ল্যাপটপ খুলে মায়ের আর সঞ্চারীর ফ্লাইটের টিকিট কেটে ফেলে অনিন্দ্য। যা থাকে কপালে। নিজে যেতে পারলে ভাল হত, কিন্তু সামনেই ওদের অফিসের তত্ত্বাবধানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল সামিট আছে। চন্দ্রবোড়ায় এই সময়ে তার যাওয়া অসম্ভব।

 

মায়ের সাথে সঞ্চারী চলে যাবার পর অনিন্দ্য খানিকটা একা হয়ে গেলেও কাজের মধ্যে ডুবে গিয়ে, সময় যে কখন দুটো পূর্ণিমা দেখে ফেলেছে, জানতেও পারেনি। এদিকে সঞ্চারী গ্রামবাংলার পরিবেশে মুগ্ধ। এখন সে পূর্ণ মানবিক গুণের অধিকারী। শুধু মায়ের অভিযোগ শুনতে হয়, “মেয়েটা মুখে কিচ্ছুটি দেয় না। সারদিন শুধু টোই টোই করে পাড়া বেরিয়ে বেড়ায়। ধানের খেত, আমের বাগান আর পুকুর ধারে ঘুরে বেড়ায়। সঙ্গী জুটিয়ে নিয়েছে গোটা কতক। শহরের মেয়ে বলে তার খাতির খুব। রান্নার এত ভালো হাত বলে পাড়া প্রতিবেশীর মন জয় করে নিয়েছে সহজেই। তাই বলে আমার যত্নে ভাঁটা পড়েনি একটুও।”

মায়ের আনন্দে আনন্দিত হতে পারেনি অনিন্দ্য। বরং কোথায় একটা ভয় এসে হৃদয়ে জুড়ে বসেছিল। অতিরিক্ত মানবীর জীবন যাপন ওর পক্ষে মারাত্মক হতে পারে, সেটা নাকাগাওয়া না বলেও দিলেও অনিন্দ্যর জানা ছিল।

তার শঙ্কা মিথ্যে হল না। এক সপ্তাহ পর অনিন্দ্যর মা ফোন করে জানালেন, সঞ্চারী বিছানা ছেড়ে উঠছে না। কথাবার্তা প্রায় বন্ধ। ডাক্তার দেখানোর কথা বললে উত্তেজিত হয়ে হাতের ইশারায় বারণ করছে। অনিন্দ্যর চন্দ্রবোড়া চলে আসা অত্যন্ত জরুরি।

কাল বিলম্ব না করে রওনা দেয় অনিন্দ্য। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সঞ্চারীর গায়ের চামড়ায় চাকা চাকা দাগ দেখে চমকে ওঠে অনিন্দ্য। একে অজানা অসুখ, তার সাথে পরিচিতজন আর ডাক্তার দেখানোর জন্য মায়ের পিড়াপিড়ি - দুইয়ের দ্বন্দ্বে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে থাকে অনিন্দ্য। তাই আসল ডাক্তার নাকাগাওয়াকে ফোন করে।

সৃষ্টিশীল নাকাগাওয়া ততদিনে তার নতুন সৃষ্টির আনন্দে আকিরাকে প্রায় ভুলে গেছে। নাকাগাওয়ার একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে অনিন্দ্য। সঞ্চারীর সাম্প্রতিক জীবন যাত্রার বিশদ বিবরণে আর অসুখের ধারা শুনে স্কিন পয়েসনিং হয়েছে বলে রায় দেয় সে।

অনিন্দ্য বোঝে কোনও কারণে চন্দ্রবোড়ায় এসে সঞ্চারীর পলিমার নির্মিত চামড়ায় ভয়ঙ্কর কোনও ক্ষতি হয়ে গেছে। হয়তো পুকুরের জলে ডুব দেওয়া একটা কারণ হতে পারে। পুকুরের জলে আর্সেনিক থাকা বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু সঞ্চারীর কম্পিউটার মাথাও পুকুরের জলের ক্ষতিকারক রাসায়নিকের হদিস দিতে পারেনি কেন?

এবার মাকে সব খুলে বলতে হয় অনিন্দ্যকে। একদিনে মা সঞ্চারীকে কতটা ভালবেসে ফেলেছিলেন, তাকে ডুকরে কেঁদে উঠতে দেখে বুঝতে পারে অনিন্দ্য।

“পুকুরের জল আমার মেয়েটাকে কেড়ে নিল। কতবার বারণ করেছি, শোনেনি... আমি জানতাম শহরের মেয়ে, হয়তো সহ্য হবে না। তখন যদি জানতাম, ও রক্ত মাংসের নয়...”

“ভেঙে পড়ো না মা। ভরসা রাখ। বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই, ওকে সারিয়ে তোলা ডাক্তার কেন, ওর জন্মদাতার পক্ষেও সম্ভব নয়। আর্সেনিক পলিমার ভেদ করে ওর সিস্টেমকে ছুঁয়েছে। এখন আর কিচ্ছু করার নেই।”

অনিন্দ্যর হাত ধরে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সঞ্চারী। তার যান্ত্রিক হৃদয় যে মানবিক যন্ত্রণায় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, তার চোখের দৃষ্টি সেই কথা জানিয়ে দিচ্ছে। অনিন্দ্যর চোখের জলে ভেসে যায় সঞ্চারীর পলিমার শরীর। প্রাণের সমস্ত স্পন্দন থেমে যায় ধীরে ধীরে। অনিন্দ্য উঠে গিয়ে বাইরে দাঁড়ায়। সন্ধ্যে নেমে আসছে পৃথিবীর বুকে। পাখিরা ঘরে ফিরে যাচ্ছে। আচ্ছা, সঞ্চারীর জীবনও কি পাখির দলের সাথে উড়ে গেছে? না না, যন্ত্র মানবীর আত্মা থাকে না। কিন্তু হৃদয়?