অ্যা পয়জন দ্যাট লিভস নো ট্রেস - লুৎফুল কায়সার

সকাল সকাল অফিসে এসে দেখলাম একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন।

মহিলা বেশ বেঁটে আর নাদুস-নুদুস, বেশ দৃষ্টিকটু চেহারা। উনি যে উদ্ভট মাপের জিন্সটা পরে ছিলেন অমন জিন্স আমি কখনও দেখিনি!

বেশ আটো-সাটো একটা ব্লাউজে স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল তাঁর শরীরের ভাঁজগুলো। যেন কেউ তাকে বলে দিয়েছে, “স্তন দেখাও, তবেই না সফলতা!” গোলগাল মুখ আর কালো চুলের সেই ভদ্রমহিলা আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন কোন ভূতকে দেখছেন তিনি।

উনার বয়স চল্লিশ কি ষাট সেটা বোধগম্য হল না, কারণ মেকাপের পুরু স্তর মুখটাকে ঢেকে রেখেছিল।

“আপনি নিশ্চয়ই কিনসে মিলহোন নন?” আমার দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।

“দুঃখিত! কিন্তু ওটা আমারই নাম। ভেতরে আসুন,” অফিসের দরজার তালাটা খুলে ভেতরে ঢুকলাম আমি।

ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকলেন মহিলা, উনাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন বেশ হতাশ হয়েছেন। উনাকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে ঘরের মাঝখানের টেবিলটার অপরপাশে নিজের জন্য রাখা চেয়ারটায় বসলাম আমি। তারপর ঘুরে পেছনের জানালাটা খুললাম।

“আচ্ছা! আমি আসলে আগে আপনাকে দেখিনি, ভেবেছিলাম আপনি একজন পুরুষ হবেন। কিনসে কি মেয়েদের নাম হয়?” সৌজন্যহীন কণ্ঠে বললেন মহিলা।

“নামটা আমার মা রেখেছিলেন। উপাধিটাও উনারই।”

“ওহ। আমার নাম শিরিজ ডুনাওয়ে। সবাই আমাকে ‘সিস’ বলে ডাকে। আচ্ছা, আপনি কতদিন ধরে গোয়েন্দাগিরি করছেন?” কেমন যেন একটা ব্যঙ্গের ভাব ছিল উনার কণ্ঠে।

“দুই বছর পুলিশে চাকরী করেছি। সেখানে কোন সমস্যা হয়নি। তারপরেও যদি আমার ‘মেয়ে’ হওয়াটা আসলেই অনেক বড় সমস্যা হয়, তবে আপনাকে আমি চলেই যেতে বলব। বাজারে তো প্রাইভেট গোয়েন্দার অভাব নেই।”

“আচ্ছা, সমস্যাটা তো বলতেই পারি। অরেঞ্জ কাউন্টি থেকে এসেছি, জায়গাটা বেশ দূরে। আপনি তো সমস্যা শোনার জন্য কোন চার্জ নেন না, তাই না?”

“নাহ। তবে আপনার কেসে যদি আমি হাত দেই তবে আমার ফি প্রতি ঘন্টায় ত্রিশ ডলার। যদি আমার মনে হয় যে আসলেই আমি সেটা সমাধান করতে পারব তবেই সেটা নিই আমি, নতুবা নয়।”

“ঘন্টায় ত্রিশ ডলার! এত কেন?”

“হুম, আইনজীবিরা ঘন্টায় একশো বিশ ডলার করে নেন।”

“তা বটে। কিন্তু উনারা তো সবকিছু আইনগতভাবে দেখেন, তারপর আবার আদালতে যান। কিন্তু আপনার...”

এরপর আর কিছু শুনিনি আমি। ভদ্রমহিলার ঠোঁটের দিকে তাকিয়েছিলাম কিন্তু একটা কথাও যেন কানে ঢুকছিল না। পরিচয়ের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই উনাকে প্রচণ্ডভাবে অপছন্দ করতে শুরু করেছি আমি।

“তা সমস্যাটা আমার বোনকে নিয়ে...” প্রায় সাত-আট মিনিট অযথা বকবক করার পর উনি অবশেষে বললেন, “এই যে এটা দেখুন।” উনি আমার হাতে ‘স্যান্টা তেরেসা’ পত্রিকা থেকে কেটে আনা একটা অংশ দিলেন। একটা মৃত্যুর সংবাদ: ক্রিপসিন মার্গারি, জাস্টিনের মা, ১০ই ডিসেম্বর মারা গেছেন। শেষকৃত্য উইনিংটন কবরস্থানে হবে।

“প্রায় দু-মাস আগের ঘটনা।” বললাম আমি।

“কেউ আমাকে বলেইনি! আমি জানতামই না যদি আমার একজন প্রাক্তন প্রতিবেশী আমাকে এটা কেটে এনে না দেখাত।”

“আচ্ছা, আজই তবে দেখলেন এটা?”

“নাহ! জানুয়ারীতে দেখেছি। কিন্তু প্রচণ্ড ভেঙ্গে পড়েছিলাম। বুঝতেই পারছেন।”

“হুম। তা মার্গারির সাথে শেষ কবে কথা হয়েছিল?”

“হুমম তাও ধরুন আট-দশবছর আগে। বুঝতেই পারছেন আমার মন কতটা খারাপ হয়েছিল!”

“তা বটে। তা আপনার ভাইঝির সাথে কথা বলেছেন?”

“ও একটা ফালতু মেয়ে , মার্গারি কখনওই ওকে নিয়ে খুশি ছিল না,” সাপের মতো হিসিয়ে উঠলেন মহিলা, “আমি গেছিলাম ওর সাথে কথা বলতে। ওকে আমি জিজ্ঞাসাও করলাম, ‘কী করে মারা গেল তোমর মা?’ ও কী উত্তর দিল জানেন? ও বলল, ‘খালা, মায়ের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছিল। ব্যাপারটা দুঃখজনক।’ চিন্তা করুন! আমাদের বংশেই কারও হৃদরোগ নেই...

“আমার মা, বাবা, চাচা, মামা অনেকেই মারা গেছেন। কারও ফুসফুসে সমস্যা, কারও মস্তিষ্কে, কারও ধরুন পায়ুপথে। কিন্তু কেউই হৃদরোগে মারা যায়নি!”

ভদ্রমহিলার কথাগুলো শোনা বিশাল ধৈর্য্যের ব্যাপার। তারপরেও দাঁতে-দাঁত চেপে শুনে গেলাম। আমার আরও কিছু সময় নষ্ট করে অবশেষে থামলেন তিনি।

“আচ্ছা, তা আপনি কি মনে করছেন যে আপনার বোনের মৃত্যু অস্বাভাবিক?” উনার চোখে চোখ রেখে বললাম আমি।

সাথে সাথে নজর সরিয়ে নিলেন মহিলা, তারপর বললেন, “আমার মনে হয় এতে জাস্টিনের হাত আছে।”

“সে কেন এমনটা করবে?”

“মার্গারির একটা বড় ইন্সুর‍্যান্স ছিল। ১৯৬৬ সালে হার্লি বেশ কিছু টাকা ইনসিওর করেছিল। এটা যদি কারণ না হয় তবে আমি ঠিক বলতে পারছি না যে অন্য কী কারণ হতে পারে। তবে আমি নিশ্চিত যে কাজটা জাস্টিনই করেছে।” চেয়ারে হেলান দিলেন ভদ্রমহিলা। বুঝলাম যে তার আর কথা নেই।

“হার্লি কে?”

“মার্গারির স্বামী। ও মারা যাওয়ার পর আমার বোন আর বিয়ে করেনি। ওই পলিসিটার উত্তরাধিকারী জাস্টিনকে করা হয়েছিল, তবে বেঁচে থাকলে মার্গও কিছু টাকা পেত। জাস্টিন কখনওই ভাল ছিল না। ও চারবার জেলে গেছে! এখনও নিয়মিত মদ-গাঁজা খায়। শুধু তাই নয়, এর ওর কাছ থেকে মিথ্যা বলে টাকাও নেয়! এমন মেয়ের পক্ষে এই কাজ করা কি খুব অস্বাভাবিক?”

“ব্যাপারটা কত টাকার?”

“একলাখ ডলারের মতো,” একটু থেমে উনি বললেন, “মার্গারি আর হার্লির দাম্পত্যজীবন কখনওই সুখের ছিল না। জাস্টিনের জন্মের পর থেকে একদম কুকুর-বেড়ালের মতো ঝগড়া করত সারাদিন। ও বড় হওয়ার পর থেকে এসবই দেখে আসছে। আর সেজন্যই সম্ভবত, মা-মেয়ের মধ্যেও সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না ওদের। জাস্টিন তো এটাও বলেছে যে মার্গারির মৃত্যুর দুইমাস আগে থেকে ওরা কথাই বলত না!”

“তারা কি একসাথে থাকত?”

“ছিল আরকী। মৃত্যুর ঠিক কয়েকদিন আগে ওদের মধ্যে প্রচন্ড ঝগড়া হয়েছিল আর জাস্টিন নাকি চলে গেছিল। ও মিথ্যাও বলতে পারে, ও-ই আমার বোনকে খুন করেছে। আজকাল নাকি আমার বোনের গাড়িটাও সেই ব্যবহার করছে! চিন্তা করুন!”

“পুলিশের সাথে কথা বলেছেন?”

“নাহ! আমার হাতে তো কোন প্রমাণ নেই, তাই না?”

“ইন্সুর‍্যান্স কোম্পানীর কী খবর? আপনার বোনের মৃত্যু নিয়ে ওদের সন্দেহ আছে কি? থাকলে কিন্তু ওদেরও তদন্ত করার কথা।”

“আরে ধুর! টাকাটা নাকি তোলা হয়ে গেছে। আর এখন ওরা কোন দায়িত্ব নিতে চাইছে না! আমাকে একগাদা কাগজ ধরিয়ে দিয়েছে!”

“টাকা কখন তোলা হয়েছে?”

“এক সপ্তাহ আগে।”

“হুম,” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমি বললাম, “আমি আসলেই বুঝতে পারছি না মিস ডুনাওয়ে যে আপনাকে আমার কী বলা উচিত...”

“আমাকে সিস বলে ডাকুন। ওটাই আমার ডাকনাম।”

“সিস, আপনি যদি চান যে আমি ব্যাপারটা দেখি তবে আমি তদন্ত করে দেখতে পারি। আর যদি না চান তবে আপনার সময় নষ্ট করার কোন ইচ্ছা আমার নেই।”

“তাই বুঝি?”

“আচ্ছা শুনুন, আমাকে শুধু দুই ঘন্টার টাকা দিন। যদি এর মধ্যে আমি কিছু বের করতে না পারি তবে আমরা ব্যাপারটা আবার আলোচনা করতে পারি।”

“ষাট ডলার?”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা, ভরসা করলাম তবে আপনার ওপর।” এই বলে তিনি ব্যাগ থেকে ষাট ডলার বের করে রাবার ব্যান্ড দিয়ে মুড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন, তারপর কী মনে করে আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললেন। আমি আর কিছু বললাম না! হয়ত তিনি পরে দেবেন এই ভেবে চুপ করে থাকলাম। তিনি জানালেন যে তিনি আজ রাতে এই শহরেই থাকবেন। একটা কাগজে যে মোটেলে উনি থাকবেন তার ফোন নম্বরও লিখে দিলেন। এছাড়া খবরের কাগজের সেই অংশটাও আমায় দিয়ে গেলেন যেখানে তার বোনের মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয়েছিল। আমি বললাম যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উনার সাথে যোগাযোগ করব।

আমি প্রথমে গেলাম স্যান্টা তেরেসা কোর্টইয়ার্ডের হল অফ রেকর্ডসে, সেখানে একটা কাগজ পূরণ করার পর আমি মার্গারি ক্রিসপিনের মৃত্যু সনদের সত্যায়িত কপি পেয়ে গেলাম। সেখানে মৃত্যুর দিন এবং সময় লেখা ছিল, মৃত্যুর কারণে হিসাবে লেখা ছিল “মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্র্যাকশন”। মৃতদেহটির ময়নাতদন্ত করেছেন ডা. ইয়ে। তার মানে যদি সত্যিই হাতা-হাতি বা অন্য কোন কারণে মার্গারি মারা গিয়ে থাকেন তবে সেটা ডাক্তার ধরতে পারেননি! ব্যাপারটা অদ্ভুতই কারণ ভদ্রলোক ডাক্তার হিসাবে বেশ অভিজ্ঞ।

এরপর গাড়ি চালিয়ে গেলাম উইনিংটন ব্লেকের সেই জায়গাতে যেখানে ওই মহিলার মৃতদেহ কবরস্থ করার আগে রাখা হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে সেখানে মি. শ্যারনসন নামে আমার পূর্বপরিচিত একজন লোক ছিলেন। অন্য একটা কেসের ব্যাপারে ভদ্রলোকের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। ধূসর রঙের একটা স্যুট পরেছিলেন তিনি। উনার চেহারাকে ঘিরে ছিল এক অপার্থিব বিষন্নতা, যেন মৃতদেহের সাথে থাকতে থাকতে উনিও নিজেকে তাদের একজন ভাবতে শুরু করেছেন।

আমি যখন উনাকে মার্গ ক্রিসপিনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম তখন তার মুখের সেই বিষন্নতাটা যেন আরও বেড়ে গেল।

“আপনার ওই মহিলার কথা মনে আছে?”

“হ্যাঁ, আছে।” এইটুকু বলে চুপ করে গেলেন তিনি। বোঝাই যাচ্ছিল ব্যাপারটা নিয়ে বেশী আলোচনা করতে চাইছেন না তিনি।

আজকাল কি এনারা নতুন ধরনের কোন শপথ নিয়ে কাজ করছেন নাকি? মানে মৃতদেহের ব্যাপারে বাইরের কাউকে কিছু বলবেন না!

যাইহোক, আমি আবার প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা, ভদ্রমহিলার বোন আমার কাছে এসেছিলেন, উনি সন্দেহ করছেন যে উনার বোনের মৃত্যু অস্বাভাবিক।”

“আমি বলব না যে মৃত্যু অস্বাভাবিক ছিল তবে...” আমার চোখে চোখ রাখলেন ভদ্রলোক, “কিন্তু সন্দেহ জাগানোর মতো ব্যাপার রয়েছে।”

“হুম?”

“উনি উনার মেয়ের সাথে কোন সম্পর্ক রাখছিলেন না। কারও সাথে মিশতেনও না। লোয়ার স্ট্রিটের একটা হোটেলে মদ্যপ অবস্থায় মারা গেছেন তিনি। দুঃখজনক!”

“মানে কী? এমনটা হয়েছে নাকি?”

“হ্যাঁ, পুলিশ ওখান থেকেই তার মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। উনার মেয়ে তো মায়ের মৃত্যুর খবর জানতেই পারত না যদি না স্থানীয় খবরের কাগজে এই নিয়ে খবর না আসত।”

“কোন খবরের কাগজ?”

“আরে ঐ যে শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় যেটা। নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। ওদের একজন বিশেষ সাংবাদিক আছে যে গৃহহীন মানুষদের নিয়ে কলাম লেখে। ওর লেখা ‘নিঃসঙ্গ ভদ্রমহিলার মর্মান্তিক মৃত্যু’ নামক খবরটা ওই মহিলার মেয়ের নজরে আসার পরেই সে ধারণা করে যে এটা তার মা হতে পারে।”

“আচ্ছা, আপনি কি নিশ্চিত যে ভদ্রমহিলার মৃত্যু স্বাভাবিক?”

“হ্যাঁ, সেটা বলতে পারেন।”

“শরীরে কোন জখম বা লড়াইয়ের চিহ্ন?”

“না, তেমন কিছুই না। আমি তো প্রথমে ভেবেছিলাম অতিরিক্ত অ্যালকোহলের কারণে মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু পরে জানলাম যে সমস্যা নাকি তার হৃদয়ে।”

“হুম, ব্যাপারটা রহস্যময় লাগছে না?”

“একদমই না। এর আগেও এমন দেখেছি।”

ভদ্রলোককে আর কোন প্রশ্ন না করে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে বসলাম।

কিছুক্ষণ পরেই পৌঁছলাম ট্রেইলার পার্কে। যেখানে জাস্টিন থাকে।

জাস্টিনের বাড়ির নোংরা দরজাটা দেখেই কেমন যেন হতাশ হয়ে পড়লাম আমি। এই ধরনের মানুষের সাথে কাজ করতে সবসময়ই বেশ বিরক্ত লাগে আমার।

বেশ কিছুক্ষণ নক করার পর দরজাটা এক ইঞ্চির মতো ফাঁক হলো, আর দেখতে পেলাম জাস্টিনের মুখটা।

“কে আপনি?” বিরক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল জাস্টিন।

“আপনি কি জাস্টিন ক্রিসপিন?”

“হ্যাঁ।”

“আশা করি আপনাকে বিরক্ত করছি না। আমার নাম কিনসে মিনহোল। আপনার মায়ের সাথে আমার পরিচয় ছিল। শুনলাম উনি নাকি মারা গেছেন?”

“কার কাছ থেকে শুনলেন?” একটু থেমে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল জাস্টিন।

“সে এক বিরাট কাহিনী। আহা, কত ভালো ছিলেন উনি! এই গত গ্রীষ্মের কথাই ধরুন না। উনি আমাকে উনার বাড়িতে যেতেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। হুট করেই মারা গেলেন উনি, তাই না?”

“হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছিল উনার।”

“আচ্ছা উনাকে না একটা চিঠিও লিখেছিলাম। উনি কি ওটা পেয়েছিলেন? আপনি জানেন কি ব্যাপারটা?”

“না।”

“হে ঈশ্বর! এখন টাকাগুলোর কী হবে?”

“আপনি উনার কাছে টাকা পেতেন?”

“না, উনিই আমার কাছে টাকা পেতেন।”

“আপনি নিশ্চিত?” জাস্টিনের কণ্ঠে সন্দেহ স্পষ্ট।

“আপনার মায়ের নাম মার্গারি ক্রিসপিন, তাই না?”

“হুম,” একটু থেমে বলল জাস্টিন, “তা কত টাকা পেতেন উনি আপনার কাছে?”

“বেশী নয়। ছয়শো ডলার। উনার কাছে চাইতেই উনি আমাকে টাকাটা ধার দিয়েছিলেন। চিন্তা করুন, কত ভালো মানুষ ছিলেন উনি! কয়েকমাস আগে উনাকে টাকাটা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু অর্থাভাবে থাকার কারণে তখন দিতে পারিনি। তারপর হাতে টাকা আসার পর উনাকে চিঠি লেখলাম, কিন্তু উত্তর আর পেলাম না। এখন শুনছি উনি মারা গেছেন!”

চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে রইল জাস্টিন।

“আচ্ছা, এখন কী করতে পারি বলুন তো?” বললাম আমি।

মুহূর্তের জন্য লোভে যেন জ্বলজ্বল করে উঠল জাস্টিনের চোখদুটো, “আপনি চাইলে টাকাগুলো আমাকে দিতে পারেন। আমি তো উনারই মেয়ে।”

“আমি ভাবছিলাম এটা বললে আপনি রাগ করবেন কি না!”

“নাহ রাগ করার কিছু নেই। ভেতরে আসবেন?”

“উচিত হবে কি? আপনাকে দেখে অনেক ব্যস্ত মনে হচ্ছে...”

“কয়েক মিনিট তো কথা বলাই যায়।” এই বলে দরজাটা থেকে সরে দাঁড়াল জাস্টিন।

ভেতরে প্রবেশের পর প্রথমে আমি ভালো করে জাস্টিনকে দেখে নিলাম। মেয়েটার ওজন এই বয়সের একটা মেয়ের যা ওজন হওয়ার উচিত তার চাইতে কমপক্ষে ত্রিশ পাউন্ড বেশী। মাথাতে অল্প একটু বাদামী চুল, বোঝাই যাচ্ছে চুলের প্রতি একদমই যত্নশীল নয় সে। বেঢপ আকৃতির টিশার্টটা পড়ার কারণে ওকে আরও অদ্ভুত দেখাচ্ছিল।

ঘরটাও বেশ অগোছালো ছিল, এদিক ওদিক তাকিয়েই রান্নাঘর দেখতে পেলাম। সেটার অবস্থাও অমনই!

“আপনার মায়ের কি অনেক কষ্ট হয়েছিল?” প্রশ্ন করলাম।

“ডাক্তার বলেছেন তেমন কষ্ট হয়নি। হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মারা গেছেন মা।”

“ব্যাপারটা আপনার জন্য খুবই কষ্টের, তাই না?”

হুট করেই যেন জাস্টিনের মুখটা অপরাধবোধে লাল হয়ে উঠল, সে বলল, “আপনি তো জানেনই যে আমরা আর একসাথে থাকতাম না।”

“তাই? না তো। উনি আমাকে কখনওই খুলে বলেননি। শুধু বলেছিলেন আপনার সাথে তাঁর কিছু সমস্যা আছে।”

“উনি প্রচুর মদ খেতেন। আমি মানা করতাম, মাঝে মাঝে কাকুতি-মিনতিও করতাম। কিন্তু কোনকিছুতেই তাঁকে থামান যায়নি।”

“উনি প্রথমে কোথায় গেছিলেন?”

“প্রথমে সম্ভবত গেছিলেন একটা আশ্রমে। কিন্তু সেখানে তাঁর মতো মদ্যপকে রাখতে রাজি হয়নি সেখানকার কর্তৃপক্ষ।”

“উনি আপনাকে অনেক ভালোবাসতেন।”

“আমি জানি! মদই উনাকে শেষ করে দিয়েছে। যাইহোক এখন আমি উনার জন্য কিছু করতে চাইছি। উনার নামে কোন দাতব্য সংস্থা জাতীয় কিছু। আপনি ভালো কোন নাম বলতে পারেন এমন সংস্থার জন্য?”

“এ. মেরি ক্রিসপিন মেমোরিয়াল ফান্ড।”

“সুন্দর। আমি ভাবছিলাম যে আপনি যে টাকাটা দেবেন সেটা দিয়েই সংস্থার কাজ শুরু করব। এটাই হবে সংস্থাতে কারও প্রথম দান।”

“আচ্ছা আমি গাড়ী থেকে আমার চেকবইটা নিয়ে আসছি।” এই বলে কোনমতে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি।

গাড়ী চালিয়ে একটা ফোনের খোঁজ করতে লাগলাম। কাছেরই একটা পেট্রোলপাম্পে সেটা পেয়েও গেলাম। সিসকে ফোন করলাম।

জাস্টিনের আচরণ অদ্ভুত। কিন্তু এমন কোন প্রমাণ আমি পাইনি যাতে করে ওকে খুনী বলা যায়।

আমার রিপোর্ট শুনে সিস খুশি হতে পারলেন না।

“আপনি তবে তেমন কিছুই খুঁজে পাননি?” বিরক্তকণ্ঠে বললেন তিনি, “কী মনে হয়, পারবেন কেস সমাধান করতে?”

“উমম, এখনও নিশ্চিত নই। তবে জাস্টিনের বিপক্ষে কোন প্রমাণ পাইনি। সে যদি সত্যিই খুনী হয়, তবে সে খুবই চালাক একজন মানুষ। কারণ ডাক্তার কোন অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাননি।”

“আচ্ছা, সম্ভবত আমার বোনকে এমন কোন বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে যেটার কোন চিহ্নই পড়ে থাকে না!”

“কী বলছেন! আমি অপরাধ-বিজ্ঞান নিয়ে বেশ পড়াশোনা করেছি, এমন কোন বিষ নেই। সব বিষেরই কোন না কোন চিহ্ন থাকেই।”

একটু যেন থেমে গেলেন সিস, তারপর আস্তে করে বললেন, “এই পৃথিবীর কতটুকুই বা বিজ্ঞান জানে? সম্ভবত এটা এমন কোন বিষ যেটা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আনা হয়েছে কিংবা ধরুন অন্ধকার মহাদেশ আফ্রিকা থেকে...অথবা এমনই অন্য কোন জায়গা থেকে!”

একটু অবাকই লাগছিল মহিলার চিন্তাধারা দেখে। “তা জাস্টিন এমন বিষ কী করে পাবে? ও তো তেমন কারও সাথে মিশত না।” অবাক হয়ে বললাম আমি।

“সেটা তো আমি বলতে পারি না! আমি কি গোয়েন্দা নাকি? আর আপনি তো প্রতি ঘন্টাতে ত্রিশ ডলার করে পাচ্ছেন এটার জন্য। চিন্তাটা আপনার, আমার নয়!”

“হুম, তা আপনি কী চাইছেন? আমি কেসটা নিয়ে এগোব?”

“শুনুন, আমি আপনাকে ষাট ডলার আরও দেব। কিন্তু আপনাকে জাস্টিনের অপরাধ প্রমাণ করতে হবে আর সে খুনী না হয়ে থাকলে আসল খুনীর সন্ধান দিতে হবে। নইলে আমার ষাট ডলার ফেরত দিন।” এই বলে ফোনটা রেখে দিলেন উনি।

আজব মহিলা! ষাট ডলার উনাকে আমি ফেরত দেব! মানে? উনি তো আমাকে কোন টাকাই দেননি! কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে ফোনবুথেই দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। সিস ডানওয়ে যেমন বিষের কথা বলেছেন অমন কোন বিষ আছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু মহিলা যেভাবে আমার সাথে কথা বলেছেন ব্যাপারটা আমার আত্মসম্মানেও লেগে গেছে। এখন এই কেস সমাধান না করতে পারলে আমি আয়নাতে নিজের মুখ দেখতে পারব না!

আমি আবার গাড়ি চালিয়ে জাস্টিনের বাড়ির সামনে গেলাম। গাড়িটাকে একটু দূরে রেখে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ওর বাড়ির ওপর নজর রাখতে লাগলাম আমি।

একটু পরেই বেরিয়ে এল জাস্টিন। গাছের আড়ালে না লুকালেও চলত। দিন-দুনিয়ার প্রতি মেয়েটার কোন খেয়ালই নেই। একটা সিগারেট খেতে খেতে নিজের গাড়িটাতে উঠে বসল সে। হুম, এটাই তবে ওর মায়ের গাড়িটা।

গাড়িতে করে ওর পিছু নিলাম আমি।

মিলাগো স্ট্রিটে পৌঁছে একটা ব্যাংকের সামনে গাড়িটা পার্ক করল জাস্টিন। গাড়িটাকে এবারও একটু দূরে রেখে ওর একটু পরেই সেখানে ঢুকলাম আমি।

দেখতে পেলাম জাস্টিন ম্যানেজারের সাথে কথা বলছে। একটু পরেই ক্যাশ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল জাস্টিন। একটু পরেই বেশ কয়েকটা টাকার বান্ডিল নিজের হ্যান্ডবাগে ভরে বেশ সাবধানতার সঙ্গে সেটাকে নিয়ে বের হলো সে।

এরপর সে পুরনো রাস্তাতে আবার যেতে লাগল। রাস্তার মধ্যে একবার শুধু থেমেছিল। সে কি টাকাটা রাখতে গিয়েছিল?

এরপর সে আবার ট্রেইলার পার্কের দিকে গাড়ি চালাতে লাগল। আমিও তার পিছু-পিছু যেতে লাগলাম। ব্যাপারটা এতো সহজ যে আমার নিজের অস্বস্তি লাগছিল। ও একবারও পিছে তাকিয়ে দেখছিল না!

স্যান্টা তেরেসার ভ্রমণসংক্রান্ত অধিদপ্তরের সামনে এবার গাড়ি দাঁড় করাল জাস্টিন। একটু পরেই ভবনটার ভেতরে ঢুকল সে। আমিও ঢুকে পড়লাম।

ভেতরে ঢুকে একটা টেবিলের সামনে দাঁড়াল জাস্টিন। কিছুক্ষণ পর এক মহিলা এসে তার সাথে কথা বলতে শুরু করল।

এই প্রথমবারের মতো পিছনে ফিরে তাকাল সে। আমিও প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিলাম। পিছনের একটা টেবিলে সংবাদপত্র পড়ার ভান করতে লাগলাম। একটু পরেই মহিলার সাথে কথাতে মনযোগ দিল। কাগজ পড়ার ভান করতে করতেই তাদের কয়েকটা কথা শুনে ফেললাম আমি। বুঝতে পারলাম যে জাস্টিন বেশ দূরে কোথাও যেতে চাইছে। এটাও জানতে পারলাম যে সেই মহিলার নাম ক্যাথলিন।

একটু পরে মহিলার হাতে কিছু টাকা দিয়ে কয়েকটা কাগজ নিল জাস্টিন। সম্ভবত ওগুলো টিকিট ছিল।

সেখান থেকে বেরিয়ে পাশের একটা দোকানে ঢুকল সে। সেখান থেকে প্লাস্টিকের কয়েকটা ফুলের মালা কিনল সে। উফফ! অতো কদাকার মালা আমি আগে দেখিনি। মেয়েটার পছন্দ খুবই বাজে।

তারপর বেরিয়ে একটা বিউটি স্যালুনে ঢুকল ও। এখানে ঢুকলে সাধারণত মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি আর বের হয় না।

আমি নিজের ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে বারোটা বাজে। সাধারণত এই সময়ে অফিসগুলোতে একজন কর্মচারী কিছুক্ষণের জন্য বিরতিতে যান এবং তার জায়গায় অল্পক্ষণের জন্য দায়িত্ব পালন করেন আরেকজন।

ভ্রমণ অধিদপ্তর ভবনে ঢুকলাম আমি। যা ভেবেছিলাম তাই। সেই মহিলা জায়গায় বসে আছেন আরেকজন স্বর্ণকেশী মহিলা। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন উনি।

“ক্যাথলিন কোথায়?” প্রশ্ন করলাম আমি।

“ও দুপুরের খাবার খেতে গেছে। একটু আগে এলেই ওকে পেতেন। আমি কি কোন সাহায্য করতে পারি?”

“আমি একটু আগেই টিকিট নিয়েছি। তবে উনি যে ভ্রমণসূচীটা আমাকে দিয়েছিলেন সেটা একটু আগেই হারিয়ে ফেলেছি। একটু দিতে পারবেন কি? উনার জন্য অপেক্ষা করার সময় নেই আমার।”

“উমম...এমন তো নিয়ম নেই! ও আসুক, আপনি একটু অপেক্ষা করুন।”

“দেখুন! আমার বাচ্চা অসুস্থ। আমাকে যেতে হবে।”

“হুম, আচ্ছা দিচ্ছি। তবে দয়া করে কাউকে বলবেন না যে আমি এটা আপনাকে দিয়েছি। এটা কাউকে দু-বার দেওয়ার নিয়ম নেই।”

“আরে সে ব্যাপারে কোন চিন্তা করবেন না।”

“আপনার নাম?”

“জাস্টিন ক্রিসপিন।” বললাম আমি।

***

ফোনবুথ থেকে সিসকে ফোন করলাম। কিছুক্ষণ পরেই ফোন ধরলেন মহিলা।

“বিকাল চারটার দিকে জাস্টিন লস অ্যাঞ্জেলস চলে যাচ্ছে, সেখান থেকে মেক্সিকো সিটি।” বললাম আমি।

“পালাচ্ছে শয়তানিটা! আমি জানতাম এমনই হবে।”

“আমাদের হাতে কোন প্রমাণ নেই। তবে ব্যাপারটা খারাপই!”

“ও এখন কোথায়?”

“বিউটি স্যালুনে, চুল ঠিক করাচ্ছে। ওর কাছে অনেক টাকা দেখেছি আমি।”

“ইন্স্যুরান্সের টাকা!”

“সম্ভবত।”

“হুমম! আর কী করেছে ও আজ?”

“প্লাস্টিকের কিছু ফুলের মালা কিনেছে। সম্ভবত ওর মায়ের কবরে দেবে। এছাড়া এগুলো কেনার কোন কারণ দেখি না।”

“উফফফ! আমি আর এসব নিতে পারছি না! নিজের মাকে খুন করেছে ও আর এখন সেই মায়ের কবরেই ফুল দেবে? বেহায়া কোথাকার!”

“শুনুন। পলিসির উত্তরাধিকারী হিসাবে ওরই নাম ছিল। এই ব্যাপারে আপনি এমনিতেও কিছু করতে পারবেন না। যদি না সে খুনী প্রমাণিত হয়।”

“এসব আপনি ভাবতে পারেন! তবে ওকে আমি শাস্তি দেবই!” এই বলে ধপ করে ফোনটা রেখে দিলেন সিস।

হতভম্ব হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। জাস্টিন তখনও বিউটি স্যালুন থেকে বের হয়নি। আমি কল্পনা করতে লাগলাম, ভরা রাস্তাতে একটা টমিগান নিয়ে যদি সিস এসে দাঁড়ান জাস্টিনের সামনে তবে ব্যাপারটা কেমন হবে?

কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পরেও সিসকে আসতে দেখলাম না, জাস্টিনও বাইরে আসেনি।

এই সুযোগে পাশের একটা কফিশপ থেকে এককাপ কফি খেয়ে এলাম। প্রচণ্ড মাথাব্যাথা করছিল, তাই কফিটা না খেলে চলতই না।

বের হয়ে এসে দেখলাম তখনও গাড়িটা রয়েছেই। মানে জাস্টিন স্যালুনের ভেতরেই!

দুটা-পনের’র দিকে বেরিয়ে এল জাস্টিন। ওকে দেখে বড় একটা ধাক্কা খেলাম। চুল একদম ছোট করে ফেলেছে মেয়েটা! মুখে লাগিয়েছে কড়া মেকাপ। ওকে প্রায় চেনাই যাচ্ছিল না। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেল ও।

গাড়িতে উঠে পড়ল জাস্টিন। আমিও আমার গাড়ি নিয়ে তাকে অনুসরণ করে চললাম। আসলে আমি নিজেও জানি না যে কেন এমনটা করছি আমি। সিস আমাকে কোন টাকাই দেননি! উপরন্ত খারাপ ব্যবহার করেছেন! তারপরেও? আচ্ছা, আমি কি নির্লজ্জ? তা হতে পারি।

স্যান্টা তেরেসা বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছিল জাস্টিন। স্বাভাবিক ব্যাপার-স্যাপার। এখন তো পালাতে পারলেই জাস্টিন লালে-লাল!

কবরস্থানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল জাস্টিনের গাড়িটা। আমি দেখলাম গাড়ি থেকে সেই প্লাস্টিকের মালাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। একটু পরেই ভেতরের একটা কবরের ওপর সেই মালাটা রাখল সে। আচ্ছা, কোথাও আবার সিস একটা ছুরি হাতে লুকিয়ে নেই ত? নাহ! কবরস্থানের মতো খোলা জায়গাতে কেউ লুকাতে পারে না।

গাড়িতে ফিরে এসে আবার বিমানবন্দরের দিকে এগিয়ে চলল জাস্টিন।

“আর মাত্র আধা ঘন্টা পরেই বিমানে উঠে পড়বে জাস্টিন! এখনও সিস আসছে না কেন ওকে আটকাতে? আজব তো!” মনে মনে বলে উঠলাম আমি।

কোথায় এখন সিস? উনি কি পুলিশের কাছে গেছেন? আমার মনে হয় না পুলিশ তাকে আর কোন সাহায্য করতে পারবে!

জাস্টিনের পিছে পিছে বিমানবন্দরে ঢুকে পড়লাম আমি। কাউন্টারে কিছু কথা বলেই একটা চেয়ারে এসে বসে পড়ল সে। বেশ অস্থির লাগছিল তাকে। এইবার আর রাখ-ঢাক না রেখে একদম ওর পাশে গিয়ে বসলাম আমি।

“তোমাকে বেশ সুন্দর লাগছে জাস্টিন।” বলে উঠলাম আমি।

আমাকে দেখে বেশ চমকে উঠল সে। তারপর খানিকটা সামলে নিয়ে বিরক্তকণ্ঠে বলল, “এখানে কী করছেন আপনি?”

“তোমার ওপর নজর রাখছি!”

“কেন?”

“তোমার খালা তোমাকে খুঁজছে, উনি যদি তোমাকে পেয়ে যান তবে ব্যাপারটা ভালো হবে না তোমার জন্য। তাই ভাবলাম তোমার কাছেই এসে বসি।”

“আমার তো একজনই খালা ছিল। সিস খালা!”

“ছিল?”

“হ্যাঁ, এখন আর নেই। উনি মারা গেছেন।”

“সে কী কথা!” আকাশ থেকে পড়লাম আমি।

“পাঁচ বছর আগে।” ঠান্ডা গলাতে বলল জাস্টিন।

“ধুর ধুর... ফালতু!”

“ব্যাপারটা ফালতুই! মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ হয়ে মারা গেছিলেন উনি।”

“ধুর ধুর!”

“এটাই সত্য।” আমার চোখে চোখ রেখে বলল সে, “আমার টাকা কই? আপনি না বলেছিলেন যে আমাকে ছয়শো টাকা দেবেন? যেটা নাকি আমার মা আপনাকে দিয়েছিল!”

“বাদ দাও! আচ্ছা, সত্যিই কি তোমার খালা মৃত?”

তখনই মাইক থেকে ঘোষণা এল, “ইউনাইটেড ফ্লাইট ৩৪৪০ এর যাত্রীরা সবাই পাঁচ নম্বর গেট দিয়ে প্রবেশ করুন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এখান থেকে রওনা হব আমরা, আপনাদের জিনিসপত্র নিজ দায়িত্বে নিয়ে আসুন।”

তাড়াতাড়ি সবকিছু গুছিয়ে গেটের দিকে এগোতে লাগল জাস্টিন। আমি অবাক হয়ে চিন্তা করতে লাগলাম, এত টাকা নিয়ে ও সিকুরিটির লোকদের নজর এড়াবে কী করে? তখনই আমার নজর পড়ল ওর স্ফিত কোমড়ের দিকে। বোঝাই যাচ্ছে ওখানে একটা মানিবেল্ট রয়েছে। হুম, তা বটে, সিকুরিটির লোকেরা ত আর ওখানে হাত দেবে না!

ওর পিছনে যেতে যেতে সারাদিনের স্মৃতিগুলো যেন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। সিস এলেন আমার অফিসে। তাঁর বোন এবং বোনের মেয়ের তিক্ত সম্পর্কের ব্যাপারে বললেন এবং এটাও বললেন যে তিনি বোনের মৃত্যুর জন্য তাঁর মেয়েকেই দায়ী মনে করেন। আচ্ছা, এত নিখুঁতভাবে কী করে তিনি সবকিছু জানেন? তিনি না দীর্ঘকাল এদের থেকে দূরে থাকতেন?

আর একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার একটা খুন হওয়া মানুষের মৃতদেহে খুনের কোন চিহ্নই পাবেন না? কী করে এটা সম্ভব!

আসলে কোন খুনই হয়নি!

আচ্ছা!

এই ব্যাপারটা বোঝার সাথে সাথে সবকিছু আমার চোখের সামনে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে এল।

“এই জাস্টিন শোন। আমি বুঝতে পেরেছি তোমার আর তোমার মায়ের ব্যাপারটা।” প্রায় ছুটে গিয়ে জাস্টিনকে ধরলাম আমি।

“তাতে আপনার কী?” হাঁটতে হাঁটতেই বিরক্ত হয়ে জবাব দিল জাস্টিন।

“আমার কিছু না। তবে তোমরা দুজন সবসময়ই একে অপরে টেক্কা দেওয়ার চিন্তাতে ছিলে।”

“কী বলতে চান আপনি?”

“খবরের কাগজে একজন অজ্ঞাত পরিচয়ের মহিলার মৃত্যুর খবর বের হল, আর তুমি গিয়ে দাবী করলে সেটাই তোমার মায়ের মৃতদেহ। তুমি আর তোমার মা সম্ভবত ইনসুর‍্যান্সের টাকাটা ভাগাভাগি করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে। কিন্তু তোমার মায়ের মনে সর্বদাই একটা ভয় ছিল যে হয়ত তুমি তাকে ধোঁকা দেবে! যেটা তুমি দিয়েছ!”

“আপনি জানেন আপনি কী বলছেন?”

“আসলে আমার কাছে যিনি এসেছিলেন তিনি তোমার মা-ই ছিলেন। তোমার মৃত খালার পরিচয় দিয়ে উনি আমাকে তোমার পিছে লাগিয়েছিলেন। কারণ নিজের মৃত্যুর সংবাদ খবরের কাগজে দেখেই উনি বুঝে গেছিলেন যে এটা তোমারই কারসাজি। আর যখনই উনি জানলেন যে তুমি মেক্সিকো চলে যাচ্ছ তখনই উনি বললেন যে তোমাকে উনি দেখে নেবেন। কিন্তু এখনও উনি তোমাকে ধরতে আসেননি! অদ্ভুত না ব্যাপারটা?”

জাস্টিন ততক্ষণে যাত্রীদের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। একজন কর্মচারী ওদের টিকিট দেখছিল। তারপর কাঠের তৈরী একটা গেট পার হতে হচ্ছিল তাদের। সেখানেই মেটাল ডিটেক্টর লাগান ছিল।

“দুঃখিত ম্যাডাম! আপনাকে ত যাত্রী বলে মনে হচ্ছে না, আপনি এখানে কেন?” বিরক্ত কণ্ঠে বলল সেই লোকটা।

“হাহা, মাফ করবেন, আমার খুব কাছের এই বন্ধুকে বিদায় জানাচ্ছি!” এই বলে জাস্টিনের পিছে পিছে আমিও গেট দিয়ে ঢুকে পড়লাম।

আমাকে একদমই পাত্তা না দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল ও। আমি তখনও বলেই চলেছি, “জাস্টিন আমি এখন বুঝতে পেরেছি যে তোমার মা কেন আসেননি! উনি সম্ভবত...”

“যান তো এখান থেকে। আপনার সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছা নেই আমার।”

“উনি টাকা নিয়ে নিয়েছেন জাস্টিন। যখন তুমি মেকাপ করতে ঢুকেছিলে তখন আমি তোমার কোমর দেখে বুঝেছিলাম যে বেল্টটা ছিল না। তার মানে তুমি বেল্টটা গাড়িতেই রেখে গেছিলে। গাড়িটা তো উনারই, তাই না? এই গাড়ির আরেকটা চাবিও সম্ভবত উনার কাছে আছে। আমিও কিছুক্ষণের জন্য কফি খেতে গেছিলাম। উনি সম্ভবত তখনই টাকাগুলো নিয়ে গেছেন। আমার মনে হয় তোমার ওই বেল্টে কিছু পুরনো কাগজ ছাড়া আর কিছুই নেই!”

“হাহা! ভাল ছিল কৌতুকটা। আরেকটা বলুন!”

“আচ্ছা শোন! মেক্সিকো সিটিতে যেও না। ওখানে নামার সাথে সাথে তুমি বুঝতে পারবে যে একজন নিঃস্ব-দরিদ্র ছাড়া আর কিছুই না!”

“যান তো! আমার অনেক কাজ আছে।” এই বলে একটা গেট দিয়ে ঢুকে বিমানের দিকে এগিয়ে গেল সে। সিকুরিটি গার্ডেরা আমাকে আটকে দিল। কারণ ওখানে যাত্রী ছাড়া আর কেউ যেতে পারে না।

আমি সরে গিয়ে একটা বারান্দাতে দাঁড়ালাম। সেখানে বেশ অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত ওরাও আমার মতোই কাউকে বিদায়(!) জানাতে এসেছে।

জাস্টিনকে বিমানের দিকে যেতে দেখলাম। মেয়েটার চালচলন সবসময়ই উগ্র। ওকে একটুও পছন্দ করতে পারিনি আমি।

আমি লক্ষ করেই যেতে লাগলাম। বিমানের প্রায় কাছাকাছি চলে গেছিল জাস্টিন। আর ঠিক তখনই কোন কারণে হোঁচট খেল সে। আপনা-আপনিই তার হাত গিয়ে পড়ল নিজের কোমরে।

অত দূর থেকেও আমি জাস্টিনের মুখে আতঙ্কের এক অদ্ভুত চিহ্ন দেখতে পেলাম। তাড়াতাড়ি নিজের শার্টটা একটু সরিয়ে বেল্টটা বের করে আনল সে।

বেল্টটা খোলার সাথে সাথে ওর মুখ হা হয়ে গেল! আমি বুঝতে পারলাম যে চিৎকার করছে জাস্টিন! ভাগ্যিস আমি ওর সামনে নেই! থাকলে নির্ঘাত কানের পর্দা ফেটে যেত।

মায়ের ভালোবাসা! জিনিসটা আসলেই একটা চিহ্নহীন বিষের মতো। আপনি মনে করছেন আপনার মা কিছুই বোঝেন না, তাকে ধোঁকা দিয়ে আপনি সব করতে পারেন!

আসলে ব্যাপারটা এমন যে আপনার মা ইচ্ছা করেই মাঝে মাঝে আপনার কাছে বোকা হন। তিনি সবই বোঝেন।

আর যদি তিনি আপনাকে শিক্ষা দিতে চান, তবে আপনি শেষ! অনেকটা জাস্টিনের মতো!