নেপথ্যচারী - এরশাদ বাদশা

অলংকরণ - পিয়াল চক্রবর্তী
এক

পুলিশ লাইন-ডু নট ক্রস; হলদে রিবনে মোড়া মনু বেপারীর একতলা পাকা বাড়ি। পুরো বাড়িটা ঘিরে রেখেছে পুলিশ। রিবনের ওপারে উৎসুক জনতার ভিড়। নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় বাক্য বিনিময় করছে ওরা। তুলসী গ্রামের শান্ত-নিস্তরঙ্গ প্রকৃতির ছায়াঘেরা পরিবেশে অমন অশুভ ঘটনার জড় নিজেদের মতো করে উদঘাটনের চেষ্টা করছে তারা।

গত রাতে মনু বেপারির ছেলেবউ আত্মহত্যা করেছে। লাশটা এখনো ঝুলছে তার শোবার ঘরের সিলিং ফ্যান এর সাথে। ঘরের বাকী জীবিত সদস্যদের অবস্থা হয়েছে সঙ্গীন। আতংকে প্রত্যেকের চেহারা পাণ্ডুর হয়ে গেছে। মুখের রক্ত সরে গিয়ে ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছে। সবচেয়ে করুণ অবস্থা হয়েছে মনু বেপারীর স্ত্রী হাসনা বানুর। পাড়া-প্রতিবেশী কম-বেশি সকলেই অবগত আছে, বউ-শাশুরির মধ্যে সম্পর্কটা ছিল সাপে-নেউলের। শুধু শাশুড়িই নয়, ননদ, দেবর এমনকি স্বামীও মেয়েটার উপর অকথ্য নির্যাতন চালাতো। পুরোধা জুড়ে হাসনা বানু থাকতেন বলেই ভয়টা তার উপর জেঁকে বসেছে সবচেয়ে বেশি।

হাসনা বানুর স্বামী মনু বেপারী গত হয়েছেন এক যুগ আগে। জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন শেয়ালের মতো চতুর ও ধূর্ত একজন মানুষ। জায়গা-জমির প্যাঁচ-ঘোঁচগুলো বেশ ভালোই রপ্ত করেছিলেন। ধূর্ত মগজের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে মোটা দাগে সহায়-সম্পত্তির মালিক বনে গিয়েছিলেন। গ্রামে ভেতরে ভেতরে এমন কথাও চাউর আছে যে, তার অর্জিত বেশিরভাগ ধানি জমিই অন্যের থেকে আত্মসাৎকৃত। সমাজের শালিস কমিটির আমিনের (জায়গা জমি মাপ-জোককারী ব্যক্তি) সহকারী হিসেবে থাকতেন মনু বেপারি। শুরুতেই বুঝে ফেললেন, এ কাজে বমাল হবার সম্ভাবনা শতভাগ। একাগ্রচিত্তে কাজ শিখে যেতে লাগলেন। এক সময় দেখা গেল সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করা গোবেচারা টাইপ মনু বেপারি মাপ-জোকের কাজে ছাড়িয়ে গেছেন তার ওস্তাদকেই। এক সময় নিজেই হয়ে উঠলেন আমিন। ধীরে ধীরে কামাল দেখাতে শুরু করল তার ক্ষুরধার মগজ। বোকা-সোকা, নিরক্ষর অনেক জমির মালিককে আরএস-বিএস খতিয়ানের গোলকধাঁধায় ফেলে হাতিয়ে নিলেন জমি। পথের ফকির বানিয়ে দিলেন অনেককে।

হাসনা বানুও স্বামীর মতো ধুরন্ধর মগজের অধিকারী। তবে লোভ জিনিসটা স্বামীর চেয়ে কয়েকগুণ বেশিই তার। স্বামীর মৃত্যুর পর কঠিন হাতে আগলে রেখেছেন সংসার। বড় ছেলে নুরু বেপারিকে লাগিয়ে দিয়েছেন জায়গা-জমি দেখাশোনার কাজে। কামলা দিয়ে ধানচাষের কাজকর্ম করানো, ফসলের ক্ষেতগুলোর তদারকি সব সেই সামলায়। ছোট ছেলে হারু বেপারিকে কিনে দিয়েছেন গঞ্জে কাপড়ের দোকান। একেবারে শেষের জন কন্যা, নাম সুরাইয়া খাতুন। স্কুল ছুটিয়ে দিয়েছেন তার, ঘরের কাজ-কর্মে হাত বাটাচ্ছে সে। ‘মাইয়া মাইনষের ইসকুলের যাওয়ার কাম নাই’ বলে রুদ্ধ করে দিয়েছেন তার শিক্ষার পথ। সব সন্তানের মাঝেই নিজের ছায়া দেখতে চান হাসনা বানু। অঢেল টাকা আর সহায়-সম্পত্তি; এর বাইরে কোনও কিছু চিন্তা করাও যেন সময়ের অপচয়। এমন সংকীর্ণ ভাবনাটা এখন মনের মধ্যে লালন করে তার সন্তানেরাও।

হাসনা বানুর হিসেবী ও কঠোর নিয়মানুবর্তিতার বিপরীতে পরিবারে ঘটে গেল এক বিপত্তি। ঘটাল তার বড় ছেলে নুরু বেপারি। সোমত্ত জোয়ান ছেলে, রক্তকণিকায় যৌবনের বল্গাহীন ঘোড়াটার ক্রমাগত হ্রেষারব; কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়? চন্দ্রাবতী রাতে হাশেম খাঁর একমাত্র মেয়ে জোবাইদার যৌবন সাগরে ডুব দিতে গিয়ে পাকড়াও হল জনতার হাতে।

গ্রামে হাসনা বানুর শত্রুর অভাব নেই। তবে সেটা সঙ্গত কারণেই। মনু বেপারির কুটিল চক্রে পড়ে যারা জমি-জমা খুইয়েছে, তারাই তক্কে তক্কে ছিল প্রতিশোধের সুযোগের।

নুরু বেপারি জোবাইদার প্রেমে পড়েনি। পড়ার কথাও নয়। হাসনা বানুর নিজ হাতে গড়ে তোলা বৈষয়িক বোধ-বুদ্ধি সম্পন্ন বাস্তববাদি ছেলে সে। হাশেম খাঁর মেয়ে জোবাইদা রুপবতী হলেও তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা শ্রী হীন। বিপরীতে নুরু বেপারি স্বচ্ছল অবস্থাপন্ন ঘরের বড় সন্তান। তুলসী গ্রামে তাকে মেয়েজামাই বানানোর জন্য বনেদি বংশের মেয়ের অভাব নেই। নেহায়েত জৈবিক তাড়না থেকেই রাত্রিবেলা জোবাইদার বেড়ার ঘরে চোরের মতো ঢুকেছিল সে। বৃদ্ধ হাশেম খাঁ সেই সময় বাড়িতে ছিলেন না।

এর আগে ওদের বাড়ির পাশ^বর্তী বিলের সাথে লাগোয়া পুকুরে জোবাইদাকে গোসল করতে দেখেছিল নুরু বেপারি। ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে উপভোগ করেছিল তার নিপুন অঙ্গসৌষ্ঠব। সেই থেকেই শরীরের খিদেটা জ্বালিয়ে মারছিল নুরু বেপারিকে। সেদিন মরিচের ক্ষেতে নিড়ানী আর সেচ দেয়ার কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল তার। ফিরতি পথেই পড়ে হাশেম খাঁর বেড়ার ঘর। কী ভেবে জমির আইল দিয়ে ও পথে নেমে যায় নুরু বেপারি। সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে অন্তর্ধান করেছে। কুপি জ্বালা আলোতে বেড়ার ফুটোতে চোখ রেখে হেঁশেলে জোবাইদাকে দেখতে পেল নুরু। অনুমান করল বুড়ো হাশেম খাঁ হয়তো ঘরে নেই। সুযোগটা লুফে নেয়ার জন্য দরজায় ঠক ঠক বাড়ি লাগাল। ওপাশ থেকে ছিটকিনি খুলতেই সুড়ৎ করে ঢুকে পড়ল নুরু। বেচারি জোবাইদা ভেবে নিয়েছিল তার পিতা ফিরে এসেছে। তাই চটজলদি দরজা খুলে দিয়েছিল। আচমকা নুরু বেপারিকে দেখে আতংকে কুঁকড়ে গেল সে। বলল- ‘মিয়াভাই আফনে! এই রাইতের বেলায়?’

‘তর লাইগ্যা আইছি রে।’ কণ্ঠে কাতরতা ফুটিয়ে তুলে বলল নুরু, ‘কুনু কতা কইছ না। আমার কইলজাডারে ইকটু ঠান্ডা কর।’

‘মাইনে! কী কইবার চান?’ নুরুর মতলব বুঝতে দেরি হয়নি জোবাইদার। কয়েক কদম পিছনে সরে গিয়ে আলুথালু বেশ ঠিক করে নিল সে, বলল ‘মিয়া ভাই বাড়িত যান। কেউ দেইখা ফালাইলে গলায় দড়ি দেওন লাগব আমার।’

‘কেউ দেখবো না। তুই ইতং করিছ না।’ বলেই জোবাইদার উপর হামলে পড়ল কামোন্মাদ নুরু।

ঘূণাক্ষরেও টের পায়নি, তাকে ও বাড়িতে ঢুকতে দেখে দু’জন যুবক। চুপিসারে ঘাপটি মেরে বেড়ার ফুটোতে চোখ রেখে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে ভেতরের ঘটনা। তারা মনু বেপারির হাতে জমি খোয়ানো হারান এবং মান্নান মাঝির ছেলে দীপংকর আর খায়রুল। নিজেদের পিতার কাছে শুনেছে মনু বেপারির চক্রান্তের কথা। তারই ছেলে নুরু বেপারি যখন হাশেম খাঁর বাড়িতে ঢুকল, দুজনেই বুঝতে পারল, প্রতিশোধের ক্ষণ বোধকরি সমাগত। নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ সেরে নিয়ে দীপংকর বাইরে থেকে ছিটকিনি আটকে দিল দরজার। আর খায়রুল ছুটল শালিস কমিটির সভাপতির কাছে। হাশেম খাঁর বাড়ি থেকে মসজিদের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। দৈবক্রমে মসজিদের বাইরের চত্বরে তখন শালিস কমিটির সদস্যরা বসে কোনও একটা শালিসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হন্তদন্ত হয়ে খায়রুল ওখানে পৌছেই হরবড় করে উগড়ে দিল সব। বয়োজোষ্ঠ মানুষরা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইলেও দুয়েকজন যারা কমবয়সী শালিসী ছিলেন, তারা উৎসাহী হয়ে উঠলেন। হবেন নাই বা কেন? এমন চিত্তাকর্ষক ঘটনা কি হামেশা ঘটে?

সালিশীগণের হাতে ধরা পড়ল নুরু। যদিও অপ্রীতিকর এ ঘটনায় জোবাইদার বিন্দুমাত্র দোষ ছিল না। তথাপি, নারী হবার ‘অমার্জনীয় অপরাধের’ কারণে তাকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হল। লজ্জায় হাসনা বানুর মাথা হেঁট হয়ে গেলেও, ছেলের পক্ষ অবলম্বনে কুণ্ঠা বোধ করলেন না তিনি। টাকা-পয়সা কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে শালিস কমিটির বিচারের রায় নিজের পক্ষে নিতে চাইলেও ব্যর্থ হলেন। সালিশিগণ নিজেরাই ঘটনাস্থল থেকে তাকে আটক করেছেন। এ কারণে হাসনা বানুর পক্ষের সালিশি কয়েকজন চাইলেও রায়কে প্রভাবিত করতে সক্ষম হলেন না।

হারান আর দীপংকর নুরু বেপারির বিরুদ্ধে মানুষজনকে উস্কে দেয়ার কাজটা ঠিকমতোই করতে পেরেছিল। তারা চাইছিল, জোবাইদা বউ হয়ে হাসনা বানুর ঘরে যাক। এতে করে, হাসনা বানুর লোভী জিভটা ভোঁতা হয়ে যাবে। গ্রামের মানুষজন খুব ভালো মতোই জানে, নিজের ছেলেকে গ্রামের সব থেকে সমর্থ ও উপযুক্ত পাত্র বলে প্রায়শই তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন হাসনা বানু। ছেলেকে বিয়ে করিয়ে খুব বড়-সড়ো একটা দান মারার চিন্তা আছে তার, সেটা কে না জানে?

হাসনা বানুর বিলাসী স্বপ্নটা মাঠেই মারা গেল। সালিশে নুরুকে দোষী সাব্যস্ত করা হল। ‘নুরু বেপারিকে জোবাইদাকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে হবে’ সালিশে রায় হল। হাসনা বানু জোবাইদাকে পুত্রবধূরূপে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। অনাড়ম্বরে বিয়ে হয়ে গেল নুরু আর জোবাইদার। তবে বিয়ের সাজে শুধু স্বামীর ঘরে যাওয়াই সার হল তার। জুটল না স্বামী-সোহাগ, শাশুড়ির স্নেহ আর দেবর-ননদের মিষ্টি ভালবাসা। কদিন যেতে না যেতেই শুরু হল অকথ্য অত্যাচার। বনেদি বংশের মেয়ে ঘরে এনে নিজের সিন্দুকটা আরো ভারী করার স্বপ্নটা ভেস্তে যাওয়ায় হাসনা বানুর রোষানলে পড়ে গেল জোবাইদা। নীরবে সয়ে গেল অত্যাচার।

এরপর শুরু হল যৌতুকের জন্য চাপ দেওয়া। দু’লাখ টাকা এনে দিতে হবে বাপের বাড়ি থেকে। হাসনা বানুর আদরের ধন ছোট ছেলে হারু বেপারির মোটরসাইকেল লাগবে। গঞ্জে যাওয়া-আসার জন্য একখান বাইক না হলে চলছে না। এমন কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল জোবাইদা। সাফ জানিয়ে দিল তার বৃদ্ধ বাবার পক্ষে এ টাকা জোগাড় করা এক কথায় অসম্ভব। নেমে এল অত্যাচারের খড়গ। সোজা বলে দিলেন হাসনা বানু- দু’লাখ টাকার ব্যবস্থা করতে না পারলে সে যেন বাপের বাড়ি ফিরে যায়। বাধ্য হয়ে বাবাকে জানাল জোবাইদা।

হাশেম খাঁ মেজাজি মানুষ। অল্পতেই ধৈর্য হারান। এ কারণে পিত্রালয়েও খুব একটা সুখে দিন কাটেনি ওর। এটা-সেটা নিয়ে প্রায়শই তার উপর মেজাজ দেখাতেন বাবা। মাঝে মাঝে গায়েও হাত তুলতেন। ছোটবেলায় মাকে হারিয়ছে জোবাইদা। বাবাই ওকে কোলে-পিঠে করে বড় করেছেন। বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ সবসময় মনের মধ্যে কাজ করে ওর। তাই বকাঝকা কিংবা গায়ে হাত তুললেও কখনও বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করেনি।

দু’লাখ টাকার কথা শুনতেই তেল-বেগুনে জ্বলে উঠলেন হাশেম খাঁ। অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করলেন মেয়েকে। পত্রপাঠ জানিয়ে দিলেন, এক কানাকড়িও দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।

শ্বশুর বাড়ি আর বাপের বাড়ি উভয়সংকটে পড়ে ত্রাহি অবস্থা দাঁড়াল বেচারি জোবাইদার। এর ঠিক ছয় দিনের মাথায় আজ জলজ্যান্ত জোবাইদা লাশ হয়ে ঝুলছে সিলিংয়ের সাথে।

দুই

থুক করে একদলা পানের পিক ফেললেন ফতেহ লোহানী। এ থানার ও.সি. তিনি। বদলি হয়ে এসেছেন পাঁচ বছর আগে। সেই থেকে আছেন এখানেই। বেঁটে-খাটো, স্থূল দেহের অধিকারী মানুষটাকে কোনও অ্যাঙ্গেল থেকেই পুলিশ কর্মকর্তা বলে মনে হবে না। সারাক্ষণ পান চিবোচ্ছেন। বাম হাতের আঙ্গুলে পানের বোঁটা। সেটা আগায় চুন রেডি সবসময়। নিজের ইচ্ছেয় দেন-দরবার করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন থেকে বদলি হয়ে এই গ্রামদেশে এসেছেন। যেটা শুনলে লোকের চোখ ‘মাথার তালুতে’ উঠে যায়। এ কী আজব কাহিনী! অজ-পাড়া গাঁ থেকে সবাই শহরে ট্রান্সফারের জন্য ধর্ণা দেয়, আর এ লোক কিনা...

ফতেহ লোহানী সাহেব কোলাহল পছন্দ করেন না। শহরের ধূলি-ধূসর জীবন তাকে টানে না। অঢেল টাকার মালিক হওয়ার খায়েশও তার নেই। কিন্তু তার স্ত্রীর তাতে ঘোর আপত্তি। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া, আরাম-আয়েশের জীবন; এগুলো কি গ্রামে পাওয়া যায়? স্বভাবতই তাকে ওমুখো করানো যায়নি। কিন্তু তাতেও দমে যাননি লোহানী। নিজেই তল্পিতল্পা ঘুচিয়ে রওনা হয়েছেন। পরিবারের জন্য মাসে মাসে ওখান থেকে টাকা পাঠিয়ে দেন। মাঝে মাঝে এসে দেখে যান তাদের।

গ্রামের নিস্তরঙ্গ পেলব প্রকৃতি ভালবাসেন তিনি। ভালোবাসেন দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ, সবুজ ধানের চারা। বুঁদ হয়ে থাকেন ঘন ঘোর বরিষার টুপুর-টাপুর শব্দে। মেঠো পথে সহসাই মোটরসাইকেল থামিয়ে নেমে পড়েন শিশু-কিশোরদের সাথে মাঠে। নবান্নের ফসল ঘরে তোলার পর ন্যাড়া বিলে গ্রাম্য যুবকদের তৈরী মাঠে খেলেন ফুটবল কিংবা ক্রিকেট।

তুলসী গ্রামে অপরাধ তেমন হয় না বললেই চলে। কদাচিৎ চুরি-ডাকাতি কিংবা জমি-জমা সংক্রান্ত ঝগড়া-ঝাঁটি হয়তো থানা পর্যন্ত যায়। কিন্তু খুনের মতো বড়ো দাগের অপরাধ ঘটে না। জোবাইদার আত্মহত্যার ঘটনা গ্রামটাকে মস্ত একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গেল।

‘আপনার কাছে পান হবে খালাম্মা?’ ঠোঁটের ফাঁক বেয়ে পানের পিচকারী কষ বেয়ে পড়ছে ফতেহ লোহানী সাহেবের। শেষ হতে চলা পানের রেশ থাকতে থাকতেই আরেকটা মুখে পুরবার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেই প্রশ্নটা করলেন হাসনা বানুর উদ্দেশে। আতংকে পাথর বনে যাওয়া হাসনা বানু এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে যারপরনাই অবাক হলেন। লোহানী সাহেব হাসনা বানুর চেয়ে বয়সে খুব একটা ছোট হবেন না। তার মুখে খালাম্মা ডাক শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত বোধও করলেন। তবে ও.সি. সাহেব যা চেয়েছেন তা এনে দিলেন দ্রুতই।

পান চিবোতে চিবোতে সিলিংয়ে ঝুলে থাকা লাশটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। সাথে থাকা কনস্টেবলের উদ্দেশে বললেন, ‘নিতাই, মজবুত দেখে একটা চেয়ার নিয়ে এসো।’

চেয়ারে উঠে দাঁড়িয়ে উড়না দিয়ে বানানো ফাঁসটা গভীর মনোযোগে দেখতে লাগলেন। প্রায় তিন মিনিট কেটে যাবার পর যখন মুখ খুললেন, মুখ দিয়ে যেন কথার বদলে বোমাই বেরুল। ‘জোবাইদা আত্মহত্যা করেনি, তাকে খুন করা হয়েছে।’

রুমের মধ্যে উপস্থিত সবার ভেতরটা কেঁপে উঠল। এমনকি কনস্টেবলদেরও। তারাও ভেবে নিয়েছিল, এটা নিছক আত্মহত্যারই ঘটনা। ‘স্যার, কেমন করে বুঝলেন?’ জিজ্ঞেস করল নিতাই।

‘ফাঁসটা দেখে। ভিকটিম আত্মহত্যা করলে ফাঁসটা এরকম থাকত না, যেমনটা আছে। ভাল করে লক্ষ করলে বোঝা যাবে, দ্বিতীয কোনও ব্যক্তি গলায় উড়না প্যাঁচিয়ে প্রথমে হত্যা করেছে, তারপর ঝুলিয়ে দিয়েছে ফ্যানের সাথে। ল্যাসোর মতো লাগছে না এটা।’

কনস্টেবল নিতাই লোহানী সাহেবের কথায় চেয়ারে উঠে পরীক্ষা করল। খুঁটিয়ে দেখার পর তার কাছেও বিষয়টা ধরা পড়ল, ‘ঠিক বলেছেন স্যার! মনে হচ্ছে কেউ জোরে উড়নাটা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে পরে লটকে দিয়েছে ফ্যানের সাথে!’ বলল সে। ‘লাশটা কি নামাবো স্যার?’

‘হুম। দেখো পৃথিবীর কী আজব রীতি। একটু আগেও জলজ্যান্ত মেয়েটাকে জোবাইদা নামে ডাকা হতো। আর চোখ বোঁজার পরে...লাশ।’ গম্ভীর স্বরে বললেন লোহানী। ‘নামাও মেয়েটাকে। পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাও। আমি ঘরের সদস্যদের সাথে কিছুক্ষণ খোশ-গল্প সেরে আসছি।’

তিন

জোবাইদার মৃতদেহ যখন গাড়িতে তোলা হল, ঠিক সেই মুহূর্তে দেখা গেল রিকশা থেকে নেমে বিলাপ করতে করতে আসছেন জোবাইদার পিতা, হাশেম খাঁ। ‘আমার মা মরা মাইয়াডারে বাঁচতে দিল না! হগলে মিল্যা মাইরা ফালাইল!’ চিৎকার করে কথাগুলো বলে বুক চাপড়ে আহাজারি করতে লাগলেন তিনি। লোহানী সাহেবের ইশারায় তাকে সরিয়ে নিল পুলিশ সদস্যরা।

হাশেম খাঁর কথায় লোহানী সাহেবের ধারণাটা পোক্ত হলো। সবার আগে হাশেম খাঁর সাথেই কথা বলবেন বলে ঠিক করলেন তিনি।

‘আমার মাইয়াডারে একবিন্দু শান্তি দ্যায় নাই সার। যৌতুকের লাইগা রাত-দিন মাইয়াডারে অত্যাচার করছে। মা আমার সইতে না পাইরা নিজের জীবন দিয়া দিল।’

হাশেম খাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তেমন কিছু জানা গেল না। মেয়ের শুশুরবাড়ির লোকজনই তাকে যৌতুকের জন্য অত্যাচার করে মেরে ফেলেছে; এর বাইরে তার আর কোনও কিছু বলার নেই।

একে একে সুরাইয়া, হারু বেপারি এবং নুরু বেপারির সাথেও কথা বললেন লোহানী সাহেব। প্রত্যেকেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। তাদেরকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে লোহনী সাহেব খুব ভালো করেই বুঝতে পারলেন, পরিবারের সবাই মেয়েটাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। তবে তাদের কাছ থেকে এমন এক তথ্য বেরুলো, যেটা ঘটনার স্বাভাবিক গতির মোড় সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দিল। তাদের দাবি, জোবাইদাকে তারা ক্রমাগত অত্যাচার করে গেলেও, হত্যা করেনি। সপ্তাহখানেক আগে জোবাইদ কাউকে কিছু না জানিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তারা ধরেই নিয়েছিল, বাপের বাড়ি গেছে সে। আপদ বিদেয় হয়েছে ভেবে খোঁজ নেয়ার গরজও অনুভব করেনি কেউ। যৌতুকের টাকা সহ ফেরত আসবে, এমনটাই ভেবে নিয়েছিল সবাই। গতকাল তারা পাশের গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিল। রাত্রিবেলা যখন ফিরে আসে, দরজা তালা ভাঙ্গা অবস্থায় দেখতে পায়। ডাকাত পড়েছে ভেবে হন্যে হয়ে সিন্দুক কিংবা আলমিরার গহনা, টাকা-পয়সা খোয়া গেছে কি-না দেখার জন্য ব্যতিব্যস্ত হতেই নুরু বেপারির শোবার ঘরে ফ্যানের সিলিংয়ে ঝোলানো জোবাইদার লাশটা দেখতে পায় তারা।

হাসনা বানুর মুখে কাহিনীটা শুনে কিছুটা অবাকই হলেন লোহানী সাহেব। তবে হত্যার দায় এড়াতে এটা মনগড়া কাহিনী কি-না, সেটা জানার আগ পর্যন্ত এটুকু বলে দিলেন, ‘মিথ্যা গল্প ফেঁদে বাঁচার চেষ্টা করলে, সেটা হিতে বিপরীত হবে।’

থানায় মামলা হলো। হাসনা বানুকে প্রধান আসামী করে মামলার বাদী হলেন হাশেম খাঁ। হাসনা বানুর ছেলে-মেয়ে প্রত্যেকইে আসামী করা হলো। গ্রেফতার হলো সবাই। তদন্তভার পড়লো ফতেহ লোহানী সাহেবের উপর।

চার

হাসনা বানুর দেয়া তথ্য যাচাই করে পুরোটাই সত্যি বলে জানা গেল। প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে জানা গেল, এক সপ্তাহ আগে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল জোবাইদা। পাশের গ্রামে যে বাড়িতে বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়েছিল হাসনা বানু ও তার ছেলে-মেয়েরা, সেখানেও তদন্তকারী দলের সদস্যরা খোঁজ নিল। কথা-বার্তা বলে নিশ্চিত হওয়া গেল, হত্যাকাণ্ডের দিন তারা ওখানেই ছিলেন। চিন্তার ভাঁজ পড়ল লোহানী সাহেবের কপালে। পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, সন্ধ্যা সাতটার সময়েই মৃত্যু হয় জোবাইদার। আর হাসনা বানুরা বাড়িতে পৌঁছান রাত নয়টার সময। সেই হিসেবে প্রায় দু’ঘন্টা আগেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে জোবাইদার। সব মিলিয়ে, হাসনা বানুদের অ্যালিবাই মনগড়া নয়, সত্যিই ধরা যায। তাহলে বাড়ির সদস্যরা যদি খুন নাই করে থাকে, কার হাতে প্রাণ গেল জোবাইদার? এক সপ্তাহ আগে বাড়ি ছেড়ে কোথায় গিয়েছিল সে? আর শ্বশুর বাড়িতে হত্যাকাণ্ড যদি নাই ঘটে থাকে, তাহলে মৃতদেহ ওই বাড়িতে নিয়ে গিয়েই বা ঝুলিয়ে দেয়া হলো কেন?

প্রশ্নগুলো লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে উত্তরের আশায়। লোহানী সাহেব ঠান্ডা মাথায় সেগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলেন। প্রথমেই জানা জরুরী, এক সপ্তাহ আগে বাড়ি ছেড়ে কোথায় গিয়েছিল সে। হাশেম খাঁ জানালেন, মেয়ে তার ওখানে যায়নি। জোবাইদার শ্বশুর বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারটা তিনি বিলকুল জানেন না। এটা যে হাসনা বানুর নির্জলা বানানো কথা, সেটা যোগ করতে ভুললেন না।

জোবাইদার বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার সূত্র উপজীব্য করে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিলেন লোহানী সাহেব। জটিল মামলা সমাধানের ক্ষেত্রে যে পন্থাটা অবলম্বন করতে হয়, সেটাই করবেন বলে ঠিক করলেন তিনি। সন্দেহের পাত্রে সবাইকে ঢেলে, একে একে ছাঁকতে হবে। বাদ যাবে না কেউই।

কেসের সাথে জড়িত প্রত্যেকের নাড়ি-নক্ষত্র বের করার জন্য সোর্স লাগিয়ে দিলেন। খুব অল্প সময়ের মাঝেই পেয়ে গেলেন সুফল। হাতে আসল এমন এক তথ্য, যেটা জোবাইদা হত্যা মামলাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ দান করল।

পাঁচ

‘সুধীর, গাড়ি থামা!’ ওসি লোহানী সাহেবের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে কষে ব্রেক চেপে পেট্রল কার থামাল ড্রাইভার সুধীর। তুলসী গ্রাম ছেড়ে মাইল পাঁচেক দূরে জঙ্গলের ভেতর নারী পাচারকারী এক সংঘবদ্ধ দলের আস্তানায় রেইড দিতে যাচ্ছেন লোহানী সাহেব দলবল নিয়ে। ওই দলের এক সদস্যকে পাকড়াও করা মূল উদ্দেশ্য। তার সোর্স জানিয়েছে, জোবাইদা হত্যাকাণ্ডের আগের দিন তাকে তুলসী গ্রামে দেখা গেছে। লোহানী সাহেব আশা করছেন, বিল্লাল নামের ওই লোকটাকে আটক করতে পারলে হয়তো কোনও কিনারা পাওয়া যাবে। এখনো পর্যন্ত জোবাইদা শ্বশুরালয় ছেড়ে কোথায় গিয়েছিল, তার কোনও হদিস বের করতে পারেননি। বিল্লালকে তুলসী গ্রামে দেখা গেছে, কেন যেন তার মনে হয়েছে বিল্লালের সাথে এই কেসের কোনও যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে।

‘স্যার, কোনও সমস্যা?’ হাতের রাইফেলটা পজিশনে রেখে সচকিত কণ্ঠে শুধাল নিতাই।

‘সমস্যা তো বটেই। গাড়িতে উঠার আগে পান নেয়া হয়নি রে, ওই যে পানের দোকান। যা তো, মিষ্টি জর্দা আর ধনিয়ার গুঁড়া দিয়ে জম্পেশ কটা পান নিয়ে আয়।’

ওসি সাহেবের কথা শুনে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল নিতাইয়ের। যেন কেসের আসামী সামনে দিয়ে ছুটে পালাচ্ছে, পান নেয়ার জন্য গাড়ি থামানোর ভঙ্গিটা এমনই ছিল লোহানী সাহেবের। জর্দা সমেত পান যেন সঞ্জীবনী সুধা! যত্তোসব!

পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ভেগে যাওয়ার চেষ্টা করল আস্তানায় থাকা চক্রের সদস্যরা। তবে লোহানী সাহেব মরিয়া। যে কোনও মূল্যে বিল্লালকে আটক করতেই হবে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন; অনেকে পালাতে পারলেও আরো তিনজন সহ বিল্লালকে আটক করতে সক্ষম হলো পুলিশের টিম। দেখা গেল, পায়ের উপর ভর দিয়ে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না বিল্লাল। দশাসই গড়নের আউট ল, নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছে না দেখে অবাকই হলেন লোহানী সাহেব। হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তোলা হল তাদের। ভারী শরীর নিয়ে দৌড়-ঝাঁপে বেশ হাঁপাচ্ছিলেন লোহানী সাহেব। রওনা হবার আগে একটু জিরিয়ে নিলেন।

চলতে শুরু করল গাড়ি। ড্রাইভারের পাশের সিট ছেড়ে পিছনে এসে বসলেন লোহানী সাহেব। একটা পান মুখে পুরে দিয়ে বিল্লালের উদ্দেশে বললেন, ‘পায়ে কী হয়েছে রে তোর?’

‘মচকাইয়া গ্যাছে সার।’

‘কখন?’

‘আইজকা সকালেই।’

‘হুম, দেখি তোর পা-টা।’

ডান পায়ের মচকে যাওয়া গোড়ালীটা দেখাল বিল্লাল। লোহানী সাহেবের অভিজ্ঞ চোখ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে জরিপ করতে লাগল চোটটা। গোড়ালীতে কালশিটে দাগটি দেখে বুঝে নিলেন, আঘাতটা আজকের তো নয়ই, এমনকি তিন-চারদিন আগেরও নয়।

‘বিল্লাল, তোর গোড়ালী মচকেছে আজ থেকে সাতদিন আগে, বিষ্যুদবার রাত নয়টার দিকে।’ আন্দাজে ঢিলটা ছুঁড়ে দিয়েই শকুনের মতো বিল্লালের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে লাগলেন লোহানী সাহেব। যা আশা করছিলেন, ঠিক তাই হলো। ক্ষণিকের জন্য চমকে উঠল বিল্লাল। তবে পরমুহূর্তেই সামলে নিল নিজেকে। তবে সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ সেই সময়টাই যথেষ্ঠ ছিল লোহানী সাহেবের জন্য।

‘ধূর! কী যে বলেন সার। আইজকা সকালে উঁচা পাহাড় থেইকা নামবার গিয়া মচকাইয়া গ্যাছে।’ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল বিল্লাল।

‘হুম। চিন্তার করিস না, গোড়ালী আরেকটা অক্ষত আছে না? থানায় নিয়ে গিয়ে ওইটাও ভেঙে দেয়ার ব্যবস্থা করছি।’ ঠাট্টার সুরে বললেন লোহানী সাহেব। দেখলেন, ভয় গোপন করার চেষ্টায় ঢোঁক গিলল লোকটা।

‘ক্যান? কী করছি আমি?’ সুর চড়িয়ে বলল বিল্লাল।

‘খুন করেছিস। মার্ডার। হাশেম খাঁর মেয়ে জোবাইদাকে।’ ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বললেন লোহানী সাহেব।

তৈরীই ছিল ক্রিমিনালটা। এবার আর এমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। নিরুত্তাপ গলায় বলল, ‘খুন-খারাবি আমার কাম না সার। আপনে ভালা কইরাই জানেন।’

‘খুন করে লাশটা মনু বেপারীর বাড়িতে নিয়ে গেছিস,’ যেন বিল্লালের কথা কানেই যায়নি, এই ভঙ্গিতে বলে চললেন লোহানী সাহেব, ‘তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিস। তারপর মেয়েটার শোবার ঘরের ফ্যানের সাথে তাকেই ঝুলিয়ে দিয়েছিস। লাশটা ঝুলানোর সময়ই হয়তো বেকায়দায় তোর পায়ের গোড়ালী মচকায়।’ লোহানী সাহেবের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বুক পকেটে থাকা মোবাইলটা বেজে উঠল। ‘হ্যাঁ, বলেন ডঃ আজমল’ ফোনটা রিসিভ করে বললেন তিনি। ওদিকের কথা শুনতে শুনতে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তার। ক্রোধে লাল হয়ে উঠল তার শিশুসুলভ মুখখানি। যখন ফোন কাটলেন, তার চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেল বিল্লাল। সাথে থাকা কনস্টেবলরাও বসের হঠাৎ রূপান্তরে চিন্তিত হয়ে উঠল।

‘নিতাই! গাড়ি থামাও!’

ড্রাইভারের পাশে বসা নিতাই বিরক্ত বোধ করল। পান শেষ হয়ে গেছে মনে হয় ওসি সাহেবের। ‘কেন স্যার?’

‘যা বলছি কর!’

গাড়ি থামার পর নামলেন লোহানী সাহেব। হোলস্টার থেকে রিভলভার বের করে সেফটি ক্যাচ অফ করলেন। বাকীরা অবাক হয়ে দেখতে লাগল তাকে। কেউ বুঝে উঠতে পারছে না তার মতলব। তবে বেশিক্ষণ অন্ধকারে রাখলেন না লোহানী সাহেব। ‘নিতাই, বিল্লালরে নামাও গাড়ি থেকে।’

হাতকড়া পরা ক্রিমিনালটাকে নামানো হলো গাড়ি থেকে। পেট্রল কারটা যেখানটায় দাঁড়িয়েছে, সেখানটায় নদীর একটা শাখা বয়ে গেছে। লোহার পাটাতনের একটা ব্রীজের উপর গাড়িটা দাঁড়ানো। ‘নিতাই, বেজন্মাটাকে নদীর দিকে মুখ করে দাঁড় করাও।’

ততক্ষণে ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে বিল্লালের। ওসির মতলব বুঝে নিয়েছে সে। প্রাণপনে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে লাগল। ‘কী করতাছেন আফনে? এনকাউন্টার দিবেন আমারে? আমি কুনু মার্ডার করি নাই!’

‘একটু আগে আমার দেয়া স্টেটমেন্টটায় একটু কারেকশন আছে বিল্লাল।’ ভয় ধরানো ঠান্ডা গলায় বললেন ওসি, ‘জোবাইদাকে তুই খুন করেছিস। তারপর তার লাশটা নিয়ে গিয়েছিস ওর শ্বশুর বাড়িতে। তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিস। মেয়েটার শোবার ঘরে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেবার আগে...’ এখানটায় এসে একটু থামলেন ওসি সাহেব। পরের কথাগুলো বলার সময় ভয়ংকরভাবে কেঁপে গেল তার কণ্ঠস্বর। চিবিয়ে চিবিয়ে, থেমে থেমে উচ্চারণ করলেন, ‘মৃত মেয়েটাকে তুই রেপ করেছিস!’

জোবাইদার লাশ তিনদিন মর্গে ছিল। প্রাথমিক পোস্টমর্টেম রিপোর্টে হত্যার আলামত পাওয়া গেলেও, ধর্ষণের কোনও আলামত ছিল না। সেটা কারো মাথায়ও আসেনি। কিন্তু লোহানী সাহেব কেন যেন সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। তিনি ডিটেইলস পোস্টমর্টেম করার জন্য অনুরোধ করেন। সে মোতাবেক সুরতহাল সম্পন্ন হওয়ার পর জোবাইদার লাশ হস্তান্তর করা হয় হাশেম খাঁকে। দাফন-কাফন সম্পন্ন হয়। রিপোর্ট হাতে আসা মাত্র ডঃ আজমল ফোনে একটু আগে জানান নির্মম লুকানো সত্যটা। হতভাগ্য মেয়েটি মরার পরও নিগৃহীত হলো। তার লাশের সাথেও করা হলো পাশবিক বর্বরতা। যেটা শুনে ক্রোধ সংবরণ করতে পারেননি ফতেহ লোহানী সাহেব।

‘তোর মতো জঘন্য অপরাধীর বেঁচে থাকা মানে মানুষের প্রাণ এবং সম্ভ্রম ঝুঁকিতে থাকা। আমার হাতে প্রথম এনকাউন্টার আজকেই...’ লোহানী সাহেবের কথা শেষ হতে না হতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল অপরাধী বিল্লাল। ‘সার আমারে মাইরেন না সার! আমি সব বলমু সার! আমার জীবন ভিক্ষা দ্যান সার!’

‘খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিস বিল্লাল। থানায় চল। দেখিস, কোন কিছু লুকাছুপি করবি না। নাহলে...’ ইচ্ছে করেই বাক্যটা অসম্পূর্ণ রাখলেন লোহানী।

বাঁচার আশাটা জেগে উঠেছে দেখে হড়বড় করে উঠল বিল্লাল, ‘ঈমানে কইতাছি সার, কিস্যূ লুকামু না!’

ছয়
একদিন পর...
হাশেম খাঁর বাড়ি...

‘আপনি কি পান খান, খাঁ সাহেব?’ ফিক করে দরজা দিয়ে পানের পিক ফেলে বললেন লোহানী।

‘না সাব, ক্যান?’ বাড়িতে পুলিশ দেখে কিছুটা যেন অবাকই হয়েছেন হাশেম খাঁ।

‘থানা থেকে বের হওয়ার সময় পান নেয়ার কথা খেয়াল ছিল না। আমার আবার একটু পর পর পান মুখে না দিলে মাথার জং ছুটে না।’

‘হঠাৎ বিনা খবরে বাড়িতে আইলেন সাব? আমার মাইয়ার খুনের চাজশিট (চার্জশীট) কহন দেবেন? মা মরা মাইয়াডারে হাসনা বানু আর তার ছেলে-পিলেরা মাইরা ফালাইল। এটা তো হগলতেই জানে। আপনেরা ক্যান খামাকা দেরি করতাছেন?’

‘হাশেম খাঁ, আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝি। আপনিই তো মাইয়াডার বাপ, নাকি?’ শেষটায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন যোগ করে দেয়াতে কথাটার মানেই পাল্টে গেল পুরোপুরি। যার উদ্দেশে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে, ধনুক থেকে ছোঁড়া তিরের মতো সোজা গিয়ে তার বুকেই বিঁধেছে। বোঝার বাকি রইল না যখন দেখা গেল হাশেম খাঁর চোখ দুটো টেনিস বলের আকার নিয়েছে। ‘মা..মাইনে? কী কইবার চান আপনে?’

‘কী বলতে চাই, সেটা আপনার চেয়ে ভাল আর কে জানে, খাঁ সাহেব?’ একটু দম নিয়ে শুরু করলেন আবার, ‘একটা কথা কি জানেন খাঁ সাহেব, জোবাইদার খুনের কেসটাই আমার জীবনের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং কেস। এই খুনের তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এমন কিছু লুকানো সত্য, যা কেউই জানতো না। যেমন ধরেন, জোবাইদা আপনার সন্তান না; এই সত্যটা তো আপনি লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। তারপর ধরেন, আপনি যে নারী পাচারকারী; এটা গ্রামের কোনও মানুষ কি বিশ্বাস করবে?’ এটুকু বলে হাশেম খাঁর উপর দৃষ্টি মেলে ধরলেন লোহানী। দেখলেন, হাতে-নাতে ধরা পড়ার পর যেরকম অপ্রস্তুত ভঙ্গি প্রকাশ পায় কোনও অপরাধীর আচরণে, এ মুহূর্তে লোকটাকে সেরকমই দেখাচ্ছে।

 

আবার শুরু করলেন লোহানী, ‘হাসনা বানু আর তার ছেলে-মেয়েরা যে খুনটা করেনি, সেটা আমি শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলাম। তবে খুন না করলেও নারী নির্যাতন আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। সে পরের ব্যাপার। আগেরটা আগেই বলে নিই। আপাতদৃষ্টিতে সোজা কেসটা জট পাকিয়ে গেল, যখন নিশ্চিত হলাম হাসনা বানু আর তার পরিবারের কেউ এ খুনের সাথে জড়িত নয়। এক সপ্তাহ আগে জোবাইদা ঘর ছেড়ে কোথায় গিয়েছিল, সেটারও কোন হদিস বের করতে পারিনি। পারিনি এ কারণে, কারণ আপনাকে আমরা সন্দেহের তালিকায় রাখিনি। তবে যখন কোনও ক্লু পাচ্ছিলাম না, সিদ্ধান্ত নিলাম জোবাইদার পরিচিত সকলের জীবনবৃত্তান্ত ঘাঁটা শুরু করবো, আপনি সহ। ঠিক তখনই খবর পেলাম, জোবাইদা খুন হওয়ার আগেরদিন তুলসী গ্রামে দেখা গেছে কুখ্যাত নারী পাচারকারী বিল্লালকে। আমার কেন যেন মনে হলো, বিল্লালের সাথে এ ঘটনার যোগসূত্র না থেকেই পারে না। হানা দিয়ে আটক করলাম তাকে। ব্যস; কুল-কিনারা না পাওয়া কেসটা তখনই জলবত-তরলং হয়ে গেল।

 

'এ তল্লাটে দু’তিন বছরের ব্যবধানে চারটে মেয়ে নিখোঁজ হয়েছিল বহু আগে। শম্পা, টুনি, আকলিমা আর রোকেয়া। মনে পড়ে খাঁ সাহেব?

বিল্লালদের গ্যাংটার সাথে আপনার দহরম-মহরম ম্যালা বছর ধরে। কিন্তু কেউই বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি। পারবেই বা কেমন করে? যে বেশভূষা আর চালচলন আত্মস্থ করে নিয়েছেন, তাতে করে যে কেউ বিভ্রান্ত হবে। মেয়েগুলোকে আপনিই তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, টাকার বিনিময়ে।

'জোবাইদার মা আজমেরি বেগম ছিলেন বিধবা। আপনার কুনজর পড়ে তার উপর। প্রেমের ফাঁদে আটকে ফেলেন আপনি তাকে। যদিও, মজা নেয়াই আপনার উদ্দেশ্য ছিল।

'বাঁশবাগানে আপত্তিকর অবস্থায় আপনাদের দুজনকে আটক করে শালিস কমিটি। তাদের চাপে পড়ে জোবাইদার মাকে বিয়ে করতে বাধ্য হন আপনি। ঠিক যেমনটি ঘটেছিল নুরু বেপারি আর জোবাইদার বেলায়। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যাকে বলে। তবে উভয় ঘটনায় মা-মেয়ের কোনও দোষ ছিল না। তারা ছিল পরিস্থিতির শিকার।

আজমেরি বেগম বউ হয়ে আপনার ঘরে আসার মাত্র সাত মাসের মাথায় মারা যায়। সকালবেলা পুকুরে তার লাশ ভাসছিল। জ্বিনের আছরে পেয়েছিল বলে ঘটনাটাকে সহজেই ধামাচাপা দিতে পেরেছিলেন আপনি। মোটা টাকার বিনিময়ে বউকে অন্যের বিছানায় পাঠানোর প্রস্তাবে রাজি করাতে না পেরে তাকে পুকুরের পানিতে চুবিয়ে মেরেছেন, এ কথাও সবার অজানাই ছিল। জোবাইদা তখন ছোট্ট।

 

মাতৃহারা জোবাইদাকে আপনি বড় করেছেন। কিন্তু পিতৃস্নেহ জিনিসটা কখনও সে আপনার কাছ থেকে পায়নি। বেচারি জানেও না, তার মায়ের হন্তারকের হাতেই বড় হচ্ছে সে। আর ঘৃণ্য সেই হন্তারক একটা উদ্দেশ্য নিয়েই তাকে পালছিল। গায়ে-গতরে সোমত্ত হয়ে উঠলেই তাকে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া। কিন্তু নুরু বেপারির কারণে তার সেই কুটিল স্বপ্নও ভেঙে গেল। হাসনা বানুর ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে অনিচ্ছসত্ত্বেও তাকে বিদায় করতে হলো।

 

যৌতুকের জন্য শ্বশুর বাড়ির অত্যচারে অতিষ্ঠ হয়ে যখন আপনার কাছে অভাগিনী মেয়েটা সাহায্য চাইল, তখন আবার আপনার ভাঙা খোয়াইশটা জোড়া লাগানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। জোবাইদাকে বললেন, শ্বশুর বাড়ি থেকে পালাতে। তবে নিষেধ করে দিলেন, বাড়ি না আসতে। সদর থেকে একটু দুরে বিল্লালদের শেলটার হাউজে পাঠালেন। তখনই আপনার কুৎসিত চেহারাটা তার সামনে উন্মোচিত হয়।

 

স্বামীর বাড়িতে খেয়ে না খেয়ে, ক্রমাগত শারীরিক এবং মানসিক অত্যচারে মেয়েটা দুর্বলতা এবং ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। শেলটার হাউজে আরেকদফা অত্যচার করা হয় তার উপর। বিক্রির জন্য কিছুতেই তাকে বশ মানানো যাচ্ছিল না। আপনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েটার উপর অত্যাচারের তদারকি করেছেন খাঁ সাহেব।

 

মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর আপনাদের হুঁশ হলো। পানি-টানি ছিটানোর পরও তার জ্ঞান আর ফিরল না। বুঝতে পারলেন, কলুষিত পৃথিবীর মানুষদের হাত থেকে মুক্তি লাভ করেছে হতভাগ্য মেয়েটা। ধড়িবাজ আপনি খাঁ সাহেব, তক্ষুনি এক ঢিলে দুই পাখি মারার পরিকল্পনা আঁটলেন। আপনার কাছে খবর ছিল, হাসনা বানু পরিবার সমেত পাশের গ্রামে নিমন্ত্রণে গেছে। হাসনা বানুর উপর আক্রোশ ছিল আপনার। বিভিন্ন সময় যৌতুকের জন্য আপনাকে অপদস্থ ও নাজেহাল হতে হয়েছে তার হাতে। শোধ নেবার মোক্ষম সুযোগটা কাজে লাগালেন। খুনের দায়ে পুরো পরিবারকে ফাঁসিয়ে দেয়ার চক্রান্ত করলেন।

আপনার কথামতো বিল্লালই লাশটা ওই বাড়িতে নিয়ে যায়। তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। জোবাইদার মৃতদেহটাকে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেয়ার আগে তার ভেতরের পশু প্রবৃত্তিটা জেগে উঠে। জানেন, কী করেছে বিল্লাল জোবাইদার লাশ নিয়ে? অবশ্য জেনেও বা কী করবেন আপনি? বিল্লাল আর আপনার মধ্যে খুব একটা তফাৎ নেই। আপনাদের নরকের কীট বলতেও লজ্জা হয়। তবু আপনার জানার জন্যই বলি, জোবাইদের মৃতদেহের সাথে সঙ্গম করেছে ওই পাষণ্ড!’

 

হাশেম খাঁর দৃষ্টি আনত। ভাঙা-চোরা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে লোহানী সাহেবের সামনে। শেষ কথাটা তাকে কতোটুকু আঘাত করেছে, বোঝা গেল না। কেন না, তার উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে কোনও অনুভূতির ছাপ নেই। রাজ্যের শূন্যতা সেখানে।