গহনে - সায়নদীপা পলমল

অলংকরণ - প্রতিম দাস

ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁইছুঁই, শীতকাল বলে মনে হচ্ছে যেন এখনই রাত নেমেছে ঘনিয়ে। গোটা বাড়িটা নিস্তব্ধ, কোথাও একটা টুঁ শব্দ নেই। বাইরের বসার ঘর থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে ভেতরের ঘরের দিকে এলেন বিনোদ প্রতিহার। নিস্তব্ধতার মধ্যেই আচমকা কয়েক সেকেন্ডের জন্য “আঁহ…” করে একটা শব্দ ভাসল বাতাসে। কয়েক মুহূর্ত থমকে গেলেন বিনোদবাবু, তারপর মুখটা বিকৃত করে ঢুকে পড়লেন একটা নির্দিষ্ট ঘরে। সেখানে একটা দেওয়াল জুড়ে কাঁচের আলমারিতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা বিভিন্ন বিদেশী ব্র্যান্ডের পানীয়। নাহ সেই আলমারির দিকে গেলেন না বিনোদ প্রতিহার, বরং সেই ঘরে থাকা একমাত্র টেবিলটার একটা নির্দিষ্ট ড্রয়ারের লকটা খুললেন চাবি দিয়ে তারপর বের করে আনলেন একটা মোটা স্বচ্ছ কাঁচের বোতল। সেই কাঁচের গায়ে কোনো ব্র্যান্ডের ট্যাগ লাগানো নেই, এ হল একেবারে খাঁটি দেশি জিনিস। যখন মাথার মধ্যে থাকা জটগুলো আরও শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলতে চায় আস্ত মানুষটাকেই তখন দরকার হয় এই জিনিসটার। জটগুলোকে সাময়িক নিষ্ক্রিয় করে দিলেই মগজটা জট খোলার রাস্তাটা খুঁজে পায় সহজে। বোতল থেকে কাঁচের গ্লাসে গাঢ় রঙের পানীয়টা ঢাললেন বিনোদ প্রতিহার, তারপর খুব যত্নে একটা চুমুক দিলেন। প্রথম চুমুকে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল একবার, মাথাটা দুদিকে ঝাঁকিয়ে নিয়ে এবার মরিয়া হয়ে গলায় ঢালতে লাগলেন পানীয়টা। উফফ… ঝামেলা… অনেক ঝামেলা…

একটা অদ্ভুত আওয়াজ করে আচমকা ঘরের আলোটা গেল নিভে। অন্ধকারেই গ্লাসটা ঠক করে নামিয়ে রাখলেন বিনোদবাবু।

“যাহ শ্লা…” এই বলে উঠে দাঁড়িয়ে এগোতে গেলেন তিনি কিন্তু পা’টা টলে গেল। চেয়ারটা ধরে কোনোক্রমে নিজেকে সামলালেন, তারপর হাঁক পাড়লেন, “রোজি… রোজি…”

আশ্চর্য আজ কি রোজি আসেনি! খুট করে একটা শব্দ হল ঘরে, তারপরেই বিনোদবাবুর মনে হল তিনি ছাড়াও ঘরের মধ্যে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি রয়েছে।

“কে... কে তুমি? রোজি?”

উত্তর দিলো না কেউ কিন্তু বিনোদবাবু স্পষ্ট বুঝলেন একটা প্রকান্ড লম্বা কালো ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। পেছনের দিকে পেছানোর চেষ্টা করতে আবার টলিয়ে গেল পা’টা, নেশাটা জোর হয়ে গেছে। ছায়ামূর্তির হাতে আচমকা সাদাটে কী একটা যেন ঝলসে উঠল তারপর মুহূর্তের মধ্যে সেটা নেমে এলো বিনোদবাবুর শরীরের ওপর। একটা আর্ত চিৎকারে কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিস্তব্ধ বাড়িটা কেঁপে উঠল গমগম করে…

“কীরে সাগর কার জন্য অপেক্ষা করছিস?”

“কার জন্য আবার, অঙ্কিতের জন্য। দেখ না আজ ক্লাসেও এলো না আবার অ্যাসাইনমেন্টটার জন্যও আসছে না। ফোনও ধরছে না। এরকম করলে সময়ে শেষ হবে কী করে বলতো? ডিসগাস্টিং!”

“সেকী! তুই তাহলে খবরটা জানিস না?”

“কী খবর?”

“অঙ্কিতের বাবার ওপর কাল মার্ডার এটেম্প হয়েছে।”

“কী বলছিস কী?”

“হ্যাঁ রে। এখন ভেন্টিলেশনে আছে, কী হবে কিছুই বলা যাচ্ছে না।”

“ওহ মাই গড! আমি জানতাম না রে।”

“এই লাইনের লোকেদের শত্রু থিকথিক করে চারিদিকে তাই এরকম হওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়।”

“ধুরর এরকম বলিস না। খবরটা শুনে খুব খারাপ লাগছে।”

“হুঁ।”

ব্যাগটা নিয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে এলো সাগর। খবরটা শোনার পর থেকে মনটা কেমন তেতো হয়ে আছে। অঙ্কিতের সাথে এবার অ্যাসাইনমেন্ট পড়াতে যারপরনাই অখুশি হয়েছিল সে, মনে মনে অনেক শাপশাপান্ত করেছে নিজের ভাগ্যকে। অঙ্কিত প্রতিহার, বড়লোক বাবার অহংকারী ছেলে। অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না যেন ছেলেটার। পড়াশুনোতেও নেহাতই মধ্যম মানের কিন্তু তাও তার অ্যাটিটিউড দেখে মনে হয় যেন কোথাকার কোন টপার, প্রয়োজন ছাড়া কারুর সাথে কথা অবধি বলে না ক্লাসে। এই যে অ্যাসইনমেন্টের জন্য সাগরকেই বারবার ফোন করতে হয় ওকে, অঙ্কিত কিন্তু একবারও ফোন করে না। তবে যাইহোক, যেটা ঘটেছে সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। সাগর দোলাচলে পড়ে গেল, একবার মনে হচ্ছে গিয়ে একবার অঙ্কিতের সাথে দেখা করা উচিৎ আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে কী দরকার বাপু, থাক না। কিন্তু শেষমেশ ছেলেটার সাথে একবার গিয়ে দেখা করবে বলেই স্থির করল সাগর।

সাইকেল নিয়ে যখন প্রতিহার ভিলার সামনে এসে দাঁড়াল সাগর তখন দেখল বাইরের বড় গেটটা হাট করে খোলা রয়েছে। কোনো দারোয়ান চোখে পড়ল না সামনে। সাইকেলটা স্ট্যান্ড করিয়ে রেখে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল সাগর, কিন্তু ঘরে ঢোকার মুখেই হোঁচট খেলো ও।

“তুই এখানে?” প্রশ্নটা করলেন ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা বছর তিরিশের এক যুবক।

“হ্যাঁ, মানে ওই অঙ্কিত।”

“কী হয়েছে তোতলাচ্ছিস কেন?”

“অঙ্কিত আমার বন্ধু।”

“ওহ।”

“দেখা করা যাবে এখন ওর সাথে?”

“হুমম। ভালো করে কথা বলিস।”

ঘাড়টা নেড়ে ঘরের ভেতরে ঢুকতেই মাথাটা ঘুরিয়ে গেল সাগরের, এতো বড় বাড়ি! তাও আবার এমন ডিজাইন করা! এসব তো সিনেমা সিরিয়ালেই দেখতে পাওয়া যায়।

“কী হল কী ভাবছিস?” গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন সেই যুবক।

“অ… অঙ্কিতের রুম কোনটা?”

“বন্ধুর বাড়ি আগে কখনও আসিসনি?”

“না মানে… ঠিক বন্ধু নয়, আসলে...”

সাগরের কথা শেষ হওয়ার আগেই “ওহ”, বলে আঙ্গুল তুলে ইশারা করে সিঁড়ির দিকে দেখাল সে। কাঁপা কাঁপা পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই সামনে যে ঘরটা নজরে পড়ল সাগরের তার দরজায় সোনালী প্লেটের ওপর কালো অক্ষরে বেশ কায়দা করে খোদাই করা, “অঙ্কিত”। মনে মনে বেশ পুলক লাগল সাগরের, ভাবল বাহ্ নিজের রুমের জন্য একটা আলাদা নেমপ্লেট। দারুণ ব্যাপার তো। দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে আওয়াজ ভেসে এলো, “কাম ইন।”

ল্যাচ কী-টা ঘুরিয়ে রুমের ভেতর ঢুকতেই সাগর দেখতে পেল টেবিলের ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে অঙ্কিত।

“অঙ্কিত।” নরম গলায় ডাকল সাগর।

মাথা তুলেই চমকে উঠল অঙ্কিত, “তুই?”

“হ্যাঁ আসলে খবরটা শুনে খুব খারাপ লাগলো, তাই…”

“ওহ আয় বোস।”

রুমের একধারে রাখা ছোটো সোফাটায় গিয়ে বসল সাগর। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে থাকার পর কোনোক্রমে সাগর বলে উঠল, “কী করে হল এসব?”

“জানি না।”

“ওহ। কখন হল?”

“সন্ধ্যেবেলায়।”

“বাড়িতে কেউ ছিলো না?”

“ঠাম্মি ছিলো কিন্তু সে থাকা না থাকা তো সমান।”

“কেন?”

“ঠাম্মির শরীরের নীচের দিকটা প্যারালাইজড। হাঁটা চলা কিছুই করতে পারে না তাই রুমেই থাকে সাধারণত।”

“ওহ। কোনো কাজের লোক...?”

“থাকার তো কথা দুজনের কিন্তু দুজনেই বলছে তাদের আসতে দেরি হয়েছিল। এবার কী বুঝবি বল?”

“আর তোদের গেটে তো কোনো দারোয়ান দেখলাম না!”

“ছিলো একজনই, সকালে পুলিশ নিয়ে গেছে তাকে। অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিল।”

“ওহ। আর কাকিমা বা তুই কেউ বাড়ি ছিলি না?”

“না। মা মাসির বাড়ি গিয়েছিল আর আমি গিয়েছিলাম মুভি দেখতে।”

“মুভি!”

“হুমম। উরি দেখতে হরিতে গিয়েছিলাম।”

“ওহহ, আচ্ছা। তা তোদের বাড়ির ওই দুজন কাজের লোককে পুলিশ কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেনি?”

“দুজন বলতে একজন ঠাম্মার আয়া যে রাতের বেলায় থাকে, রোজি আন্টি। আর অন্যজন আমাদের কুক, বীণাদি।

আর রইল বাকি পুলিশের কথা তো আমি জানি না কী করছে না করছে তারা। কিচ্ছু ভালো লাগছে না আমার।”

“কাকিমা ফেরেননি?”

“নাহ। খবরটা পেয়ে ওখানেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাই মাসি আসতে দেয়নি।”

“হুমম এরকম একটা শকিং খবর পেয়ে নার্ভ স্থির রাখা সত্যিই কঠিন। কাকুর কন্ডিশন এখন কীরকম রে?”

“ব্লিডিং হয়েছে প্রচুর তাই কোমাতে চলে গেছে। এরপর কী হবে জানি না…”

“কাকুকে এই অবস্থায় প্রথম কে দেখতে পেয়েছিল?”

“বীণাদি আর দারোয়ান… একসাথে ঢুকেছিল বোধহয়।”

“ওকে। আর একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

“বল।”

“তোদের বাড়িতে তো দেখলাম চারিদিকে সিসিটিভি লাগানো তাহলে ওর ফুটেজে কিছু পাওয়া যায়নি?”

এবার আর সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো না অঙ্কিত। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর কেমন একটা অদ্ভুত গলায় বলে উঠল, “ওই সিসিটিভির ওপর বাবার খুব কনফিডেন্স ছিল তাই বাড়িতে একজন দারোয়ান রেখেই নিশ্চিন্ত ছিলেন। আর কালকে সেই সিসিটিভিই বিট্রে করল।”

“মানে?”

“মানে কাল ওইসময় পাওয়ার কাট হয়ে গিয়েছিল। ইনভার্টারও চলেনি আর সিসি ক্যামেরাগুলো তো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আরও আগে।”

“মাই গড! তারমানে আততায়ী বেশ আটঘাট বেঁধেই এসেছিল।”

“প্রিপ্ল্যানড না হয়ে কেউ কি সহজে এরকম কাজের ঝুঁকি নেয়…!”

অদ্ভুত স্বরে কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অঙ্কিত।

আজ বইখাতা খুলেও কিছুতেই পড়ায় মন বসতে চাইছে না সাগরের। মাথার মধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত সব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এর আগে তো কত খুন জখমের খবর পড়েছে পেপারে কিন্তু এরকম অনুভূতি হয়নি কখনও। আসলে এতো কাছ থেকে এরকম ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা দেখার অভিজ্ঞতা তো এই প্রথম। তার ওপর আজ কেন না জানি সাগরের মনটা বারবার চলে যাচ্ছে অঙ্কিতের দিকে। আসলে ছেলেটাকে দূর থেকে যতদিন দেখতো ততদিন কেমন একটা বিতৃষ্ণা কাজ করত কিন্তু আজ এক সপ্তাহ একসাথে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে সময় কাটানোর পর ছেলেটার প্রতি একটা অদ্ভুত টান তৈরি হয়েছে সাগরের যেটা ও নিজেও আজকের আগে বুঝতে পারেনি। আজ বিকেলে অঙ্কিতের সাথে কথা বলে আসার পর থেকে মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে ওর জন্য। এমনিতে বিনোদ প্রতিহার শহরের একটা পরিচিত নাম। প্রথম জীবনে একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতো, তারপর সেখান থেকে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে ল্যান্ড বিজনেস শুরু করে আর সেটা ভালভাবে দাঁড়িয়ে যেতেই এখন বেশ কয়েক বছর প্রমোটারীর ব্যবসাও শুরু করেছে। রোমিত সকালে ঠিকই বলেছিল এই লাইনে শত্রু থাকা কোনো বিচিত্র ব্যাপার নয়।

নিজের খেয়ালের মধ্যেই ডুবে ছিল সাগর কিন্তু আচমকা কাঁধের ওপর দুটো ভারী হাত এসে পড়তেই চেয়ার সুদ্ধ নড়ে গেল ও। তাকিয়ে দেখল সমীর এসে দাঁড়িয়েছে, “এরই নাম কি পড়াশুনো?”

“নাহ মানে…”

“আজকের মত ছেড়ে দিতে পারি যদি কোনো কাজের খবর দিস।”

“মানে?”

“তোকে একটা কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলাম ভুলে গেলি?”

“কী কাজ?” অনেক মাথা চুলকেও কিছুতেই সাগর মনে করতে পারল না তার এই গোয়েন্দা দাদা কোন কাজের দায়িত্বটা তাকে দিয়েছিল। সমীর এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে একটা ঢোঁক গিলল সাগর, “ম… মনে পড়ছে না তো কিছু।”

“বলিনি তোকে অঙ্কিত প্রতিহারের সাথে ভালো করে কথা বলতে?”

“ওহ ওটা!” হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সাগর, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল তারমানে সমীর ওকে তখন কথাটা এমনি এমনি বলেনি, এর পেছনে গভীর উদ্দেশ্য ছিল ওর!

সাগরকে চুপ করে থাকতে দেখে খোঁচা দিলো সমীর, “কীরে এরকম ভ্যালভ্যাল করে তাকিয়ে আছিস কেন? কথা বলেছিস?”

“হুঁ? হ্যাঁ বলেছি তো।” গলাটা একবার ঝেড়ে নিয়ে উত্তর দিলো সাগর।

“কী কী কথা হল শুনি। কোনো পয়েন্ট মিস করবি না।”

“বলছি সব কিন্তু তার আগে বল তুই ওখানে কী করছিলি?”

“ঘুরতে গিয়েছিলাম।”

“সত্যিই?”

“হুমম ওটা ঘুরতে যাওয়ারই তো জায়গা বটে… হনুমান কোথাকার! বিনোদ প্রতিহারের দিদি আমাকে অ্যাপয়েন্ট করেছেন, পুলিশের ওপর খুব একটা ভরসা নেই ওনাদের। ওনারা মনে করেন যে বা যারা এই কাজ করেছে তারা পুলিশকে যে কোনো মুহূর্তে ম্যানিপুলেট করতে পারে। সো...”

“ওহ বুঝলাম। ওনার দিদিও কি এখানে থাকেন?”

“বাড়ি এই শহরেই কিন্তু একমাস হল চেন্নাইতে মেয়ের কাছে আছেন।”

“বাব্বা সেখান থেকে তোকে অ্যাপয়েন্ট করল!”

“হুঁ। এতে এতো অবাক হওয়ার কী আছে? এর আগে একটা কেসে ওনাদের হেল্প করেছিলাম তাই ওনারা ভরসা করেন আমাকে।”

“আচ্ছা সে তো হল কিন্তু অঙ্কিতের সাথে তুইও তো কথা বলতে পারতিস, আমাকেই কেন…!”

“প্রথমত ছেলেটা বড্ড চাপা, কথাই বলতে চায় না পরিষ্কার করে। আর দ্বিতীয়ত, বন্ধুর কাছে যা বলতে পারে তা নিশ্চয় বাইরের লোকের কাছে বলবে না।”

“হুঁ ঠিক ঠিক।”

“নে এবার মাইন্ডের রিপিট টেলিকাস্ট অপশনে ক্লিক করে দিয়ে আমাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বল কী কী কথা হলো।”

“বলছি। অঙ্কিত বলল যে…”

“উঁহুঁ এভাবে নয়। তুই কী প্রশ্ন করেছিলি, তার উত্তরে সে কী বলল এভাবে বল সব। কোনো ডিটেল যেন বাদ না যায় তা সে যতই ছোটখাটো মনে হোক।”

মাথা নেড়ে সেভাবেই সব বলতে শুরু করল সাগর আর সমীর মন দিয়ে পুরোটা শুনতে লাগলো চুপচাপ। সাগরের কথা শেষ হতেই সমীর বলে উঠল, “তারমানে নতুন কোনো তথ্য আনতে পারলি না।”

কথাটা শুনে হতাশ হল সাগর। ওর শুকিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে সমীর একটু হেসে বলল, “তবে তোর প্রশ্ন করার স্টাইলটা পছন্দ হয়েছে আমার। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেছিস সব।”

“সত্যিই? তারমানে এবার তোর অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে আমাকে নিতেই পারিস?”

“তাই নাকি? উমম ভাবতে হবে আমার থেকেও জিনিয়াস কাউকে অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নেওয়া যায় নাকি!”

“মানে?”

“শুনলাম কেউ যেন বলেছে আমি যেসব কেসগুলো সলভ করেছি সেগুলো সলভ করা তার বাঁ হাতের কাজ। আরও কী কী যেন সব…”

সমীরের কথাগুলো শুনতে শুনতে জিভ কাটল সাগর, এই মা আর বৌদির পেটে না কোনো কথা থাকে না!

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সমীর। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে গেল, “কাল সকাল ঠিক দশটা পনেরোয় রেডি হয়ে থাকবি। প্যারাডাইস ব্রিকসে যেতে হবে।”

“ইট আবার প্যারাডাইস!”

“হুমম ডাইরেক্ট স্বর্গ থেকে ইমপোর্ট করা ইট।”

“কী যা তা!”

প্যারাডাইস ব্রিকসে যখন পৌঁছালো সাগররা তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় এগারোটা ছুঁয়েছে। এতো কাছ থেকে এর আগে কখনও ইটভাটা দেখেনি সাগর, আজ এই প্রথম। ওই লাল লম্বা গম্বুজের মত জিনিসটা যার মাথা থেকে অনবরত গলগল করে ধোঁয়া বেরিয়ে আকাশে মিশে চলেছে এতদিন সেটা দেখলে ওর মনে অদ্ভুত একটা রোম্যান্টিসিজম কাজ করত কিন্তু আজ সামনে থেকে দেখে গা’টা গুলিয়ে এলো ওর।

“ইশশ... এতো কালো হয় ধোঁয়াটা!” মুখ থেকে ফস করে কথাটা বেরিয়ে গেল সাগরের আর তাতেই ও দেখলো সমীর বাঁ দিকে ভ্রু’টা অদ্ভুত কায়দায় তুলে ওর দিকে তাকালো। চুপ করে গেল সাগর। ইটভাটার চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে ওর মনে পড়ে যাচ্ছিল ছোটবেলায় ওর কেমন একবার ইটের ব্যবসা করার শখ হয়েছিল। বাবার জুতোর খাপের মধ্যে মাটি ভরে ইট বানাবে বলে ঠিক করেছিল কিন্তু শেষমেশ ভেজা মাটির সংস্পর্শে এসে খাপটাই সবার আগে গিয়েছিল ছিঁড়ে।

এহেম এহেম…

আচমকা সমীরের গলাটা কানে যেতেই স্বম্বিৎ ফিরল সাগরের, ও দেখলো একটা ভুঁড়িওয়ালা লোক এসে দাঁড়িয়েছে ওদের সামনে। এই চেহারায় একটা টাইট গেঞ্জি পরার জন্য লোকটাকে ফুটবল ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। এই তাহলে কুলভূষণ দাবে, প্যারাডাইস ব্রিকসের মালিক! পরশু বিকেলের সিসিটিভি ফুটেজে এই লোকটাকেই শেষ দেখা গিয়েছিল বিনোদ প্রতিহারের বাড়িতে ঢুকতে। দারোয়ান মোতিরামও অবশ্য তাই বলেছে। কিন্তু লোকটার বেরোনোর কোনো ফুটেজ নেই কেননা এ ঢোকার কিছুক্ষণ পরেই সিসিটিভিগুলোকে কেউ বন্ধ করে দিয়েছিল।

“হ্যালো মিস্টার দাবে।” করমর্দনের জন্য হাত বাড়ালো সমীর।

মিঃ দাবেও নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, “বলুন স্যার কী হেল্প করতে পারি। কী লাগবে আপনার?”

“আপাতত কয়েকটা ইনফরমেশন।” সমীরের কথাটা শুনেই চোখ দুটো ছোটো হয়ে গেল কুলভূষণ দাবের, “জি?”

“আমার নাম সমীর দাশগুপ্ত। আমি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। আপনার কাছে বিনোদ প্রতিহার সম্পর্কে কিছু জানার ছিলো।” বিনোদ প্রতিহারের নামটা শোনা মাত্রই মিঃ দাবের মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি বললেন, “এ নিয়ে আমি যা বলার আমি পুলিশকে বলেছি, আপনার সাথে আমার কোনো কথা থাকতে পারে না।”

“আমাকে বিনোদবাবুর দিদি এই কেসের তদন্তের ভার দিয়েছেন। সিসিটিভি ফুটেজ আর দারোয়ানের বয়ান অনুযায়ী…”

“আমাকে শেষ ওই বাড়িতে ঢুকতে দেখা গেছে তাই তো? এতেই কি প্রমাণ হয়ে গেল আমি প্রতিহারকে মারতে গিয়েছিলাম।”

“নাহ প্রমাণ হয়তো হয়নি কিন্তু প্রমাণ করতে পুলিশের বেশিক্ষণ লাগবে না। ভুলে যাবেন না আপনি ঢোকার মিনিট কুড়ি পরেই সিসিটিভিগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর বিনোদবাবুর মা স্পষ্ট শুনেছিলেন আপনাদের মধ্যে তুমুল কথা কাটাকাটি হচ্ছিল এবং হয়তো গায়েও হাত তুলতে গিয়েছিলেন আপনি।”

“আপনি কি আমাকে থ্রেট করছেন?”

“আপনার এরকম কেন মনে হল? আমি শুধু সত্যিটা খুঁজে বের করতে চাই। আপনি যদি কিছু নাই করে থাকেন তাহলে আমি থ্রেট করলেও আপনার ভয় পাওয়ার মত তো কিছু নেই।”

“দেখুন সমীরবাবু সেদিন যা হয়েছিল আমি সেসব কোনো কথাই অস্বীকার করছি না। আমাদের প্রফেশনে এরকম হয়েই থাকে আকচার কিন্তু তা বলে আমি ওকে খুন করব! প্রায় প্রতিদিন কারুর না কারুর সাথে আমাদের ঝামেলা হয়ে যায় তা বলে কতজনকে খুন করে ফিরব?”

“সে খবর তো জানি না তবে এখানে যখন এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে তখন সবার আগে সন্দেহটা আপনার ওপরেই যায় বৈকি।”

“অ্যাক্সেলেন্ট। আমার সাথে ওনার একটু ঝগড়া হয়েছিল বলে আপনারা আমাকে সন্দেহ করছেন। কিন্তু যখন সিসিটিভি বন্ধ হয় তখন তো আমি ওনার সঙ্গেই বসেছিলাম ফুটেজে নিশ্চয় পাবেন। তাহলে আমি কী করে কাজটা করতে পারি?”

“আপনি হয়তো…”

“আপনারা আমাকে এভাবে হ্যারাস করছেন আর নন্দুকে ছেড়ে দিচ্ছেন কেন?”

“নন্দু?”

“হাঁ। নন্দগোপাল সেন, প্রতিহারের শালা।”

“ব্যাপারটা কী?”

“সেদিন বিকেলে প্রতিহার যখন হাঁটতে বেরিয়েছিল তখন পার্কের কাছে নন্দুর সঙ্গে ওর খুব ঝগড়া হয়, আমার সেক্রেটারি নিজের চোখে দেখেছে সব।”

“আপনার সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলা যাবে?”

“হাঁ ডেকে দিচ্ছি। এই রজত… রজত।”

কুলভূষণ দাবে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটি বছর পঁচিশের ছেলে। লম্বা, ছিপছিপে চেহারা, চোখে হাই পাওয়ারের একটা চশমা, চশমার ওপারে থাকা চোখ দুটোকে এপাশ থেকে পড়া খুব মুশকিল। সাগরের কেন না জানি মনে হয়েছিল মিঃ দাবের সেক্রেটারিও নিশ্চয় তাঁর মত গোলমটোল কেউ হবে কিন্তু তার জায়গায় এই ছেলেটিকে দেখে ঢোঁক গিলল সে। সমীর মিঃ দাবের দিকে তাকিয়ে বলল, “মিঃ দাবে আপনার যদি আপত্তি না থাকে আমি কি রজতবাবুর সঙ্গে একটু প্রাইভেটে কথা বলতে পারি?”

দু’মিনিট ভেবে নিয়ে দাবে মাথা নাড়িয়ে বললেন, “বলুন।” এই বলে তিনি ভেতরের দিকে চলে গেলেন।

সমীর এবার রজতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “ভালো আছিস?”

চমকে উঠল সাগর। তারমানে দাদাভাই একে চেনে! খানিক চমকে উঠল রজতও, তারপর খুব আস্তে আস্তে বলল, “তুমি আমায় চিনতে পেরেছো!”

“বাহ্ রে তোকে ভোলা যায়! মাউথ অর্গ্যান এখনও বাজাস?”

“নাহ।”

“কেন? ছেড়ে দিলি কেন?”

“আমার মত ছেলের ওসব শখ না রাখাই ভালো। তুমি বলো কী দরকার ছিলো।” এতক্ষণে খানিক স্বাভাবিক শোনালো রজতের গলা।

“আমি এখানে কেন এসেছি সবই তো শুনেছিস আড়ালে দাঁড়িয়ে।”

আরও একবার চমকালো রজত, “তুমি বুঝলে কী করে?”

“এসব না বুঝলে এই করে পেট চালাতে পারতাম না রে।” কৌতুক করে হেসে উঠল সমীর। খানিক অপ্রস্তুতে পড়ে গেল রজত। আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করতে লাগলো, ওর অবস্থা দেখে সমীর ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, “চল চারিদিকটা ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে কথা বলবি।”

“সেদিন বিকেলে আমি স্যারের অফিসে যাওয়ার আগে পিসির জন্য ওষুধ কিনে ফিরছিলাম। তখনই পার্কের ধারে দেখতে পাই বিনোদ প্রতিহার আর নন্দুকে। দুজনে উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিল। মনে হচ্ছিল যেন নন্দু কিছু ব্যাপার নিয়ে শাসাচ্ছে প্রতিহারকে।” ওই জায়গা থেকে সরে আসতেই অনেকটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এবার কথাগুলো বলল রজত, ওখানে হয়তো ভয় পাচ্ছিল যে দাবে ওর কথা শুনছে বা এরকম কিছু।

সমীর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “তুই ওদের কথা শুনতে পেয়েছিলি?”

“নাহ সব কথা শুনতে পাইনি তবে নন্দু দু’বার উত্তেজিত হয়ে গলাটা চড়িয়ে ফেলেছিল আর তাতেই শুনলাম ও বলছে ‘ঝামেলা করবেন না জামাইবাবু, ভালোয় ভালোয় আমার কথা মেনে নিন নয়তো কী করব আমি তা তো আপনি জানেনই।’”

“সরি, বাট তুই কি ওখানে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিলি?”

মাথাটা নামিয়ে নিলো রজত, তারপর কয়েকমুহূর্ত চুপ করে থাকার পর বলল, “আসলে সমীরদা বেশ কিছুদিন ধরে স্যারের সাথে একটা জায়গা নিয়ে প্রতিহারের খুব ঝামেলা চলছিল। তাই আমি সেদিন নন্দুকে আর প্রতিহারকে দেখে…”

“হুমম বুঝতে পেরেছি।”

“তা তুই কি সেদিন তোর স্যারের সঙ্গে বিনোদ প্রতিহারের বাড়ি গিয়েছিলি?”

“না না। আমি স্যারের সাথে কোথাও যাই না বরং স্যার যখন থাকেন না তখন আমি এদিকে কাজ কর্মের তদারক করি।”

“তাহলে কি মিঃ দাবে একাই যান সব জায়গায়?”

“নাহ স্যারের ড্রাইভার কাম অ্যাসিস্টেন্ট একজন আছে, নির্মলদা। সেই যায় সব জায়গায়, তবে সেদিন স্যার একাই গিয়েছিলেন কেননা নির্মলদার বাবা অসুস্থ বলে সে আসেনি সেদিন।”

“আচ্ছা। আর রজত এই নন্দগোপালের সম্বন্ধে কী জানিস?”

“নন্দু প্রতিহারের কোনো দুঃসম্পর্কের শালা হয়। বয়েস এই তোমার মত হবে। আগে প্রতিহারের ডান হাত ছিল কিন্তু কিছুদিন হল নিজে কন্ট্রাক্টারির ব্যবসা শুরু করেছে।”

“ব্যবসার পুঁজি কে দিলো? প্রতিহার?”

“সেটা তো জানি না।”

“আচ্ছা। তুই ওই নন্দুকে কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারবি?”

সমীর আর সাগর যখন নন্দগোপালের বাড়ি পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা নেমেছে ইতিমধ্যেই। রজতের বলা জায়গায় নন্দুকে পাওয়া যায়নি, নন্দুর সাঙ্গপাঙ্গরা বলে সে নাকি অসুস্থ বোধ করছিল তাই আড্ডায় আসেনি আজ। তাদের কাছ থেকেই ওর বাড়ির ঠিকানা নিয়ে সাগররা এসেছে এখানে। ছোটো একতলা একটা বাড়ি, স্থানে স্থানে শ্যাওলা জমেছে তার। খুব একটা যে যত্ন করা হয় না তা এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়। সমীর গিয়ে কলিংবেলের সুইচটা টিপতেই ভেতর থেকে একটা বয়স্ক মহিলা কণ্ঠ ভেসে এলো, “কে রে নন্দু?”

ভ্রুটা কুঁচকে গেল সমীরের। ও নরম গলায় বলল, “না মাসিমা আমি নন্দু নই। ওর এক বন্ধু।”

এবার বাইরের আলোটা জ্বলে উঠল আর তারপরেই বারান্দার গ্রিল গেটের ওপারে বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধা। চশমার ফাঁক দিয়ে সমীরের মুখটা ভালো করে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে বললেন, “তোমায় তো ঠিক চিনলাম না বাবা।”

“আসলে মাসিমা আমি কোনোদিনও আপনাদের বাড়ি আসিনি তাই হয়তো… আমরা স্কুলে একসাথে পড়তাম।” ইচ্ছে করেই মিথ্যে কথাগুলো বলল সমীর।

“ওহ। কিন্তু নন্দু তো এখন বাড়ি নেই।”

“যাহ… আমি তো কালই আবার এখান থেকে চলে যাবো তাই ভেবেছিলাম ওর সঙ্গে দেখা করে যাই কিন্তু…” সমীরের গলায় কৃত্রিম হতাশা ঝরে পড়ল। মহিলা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন, “যদি অপেক্ষা করতে চাও ভেতরে এসে বসতে পারো।” সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবটা লুফে নিয়ে সমীর বলল, “তাহলে তো খুব ভালো হয় মাসিমা। এই ভাই আয়…”

মহিলা কাঁপা কাঁপা হাতে তালাটা খুললেন, ওনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ওনার মনে একটা দ্বিধা কাজ করছে।

বারান্দা পেরিয়ে ঢুকতেই যে ঘরটা সামনে পড়ল সেই ঘরের স্থানে স্থানে পলেস্তারা খসে পড়েছে, চুনকামটাও নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরটার একপাশে একটা তক্তপোষ রাখা, তক্তপোষের একপাশে একটা ছোটো টেবিল। সেই টেবিলের ওপর টুকিটাকি বিভিন্ন জিনিস অগোছালো করে রাখা। আর ঘরটার অন্যদিকে রং ওঠা দুটো চেয়ার। সমীর আর সাগর গিয়ে বসল চেয়ার দুটোয়। নন্দগোপালের মা বললেন, “বোসো তোমরা আমি চা করে আনি।”

“না না চা করতে হবে না মাসিমা, আমরা চা খাই না দুজনেই।” বারণ করে উঠল সমীর।

“ওহ…” এই বলে খানিক ইতস্তত করে তক্তপোষটায় বসলেন নন্দগোপালের মা।

“নন্দু কি ওর সেই জামাইবাবুর কাছে গেছে মাসিমা?” খুব স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল সমীর।

“কোন জামাইবাবু?” অদ্ভুত রুক্ষ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন মহিলা।

“ওই যে যার সঙ্গে ও কাজ করত। কী যেন নাম…!”

“ও আর কাজ করে না তার সঙ্গে।” আগের মতোই রুক্ষ গলায় জবাব দিলেন তিনি।

“ওহ। এখন তাহলে কী করে?”

“নিজে ব্যবসা করছে। আর তোমরা বোধহয় শোনোনি বিনোদকে কেউ খুন করার চেষ্টা করেছে কয়েকদিন আগে। এখন তো তাই নার্সিংহোমে ভর্তি।”

“সেকী! বলেন কী মাসিমা? কে করল এমন?”

“সেটা আমি কী করে জানবো!”

“ওহ এখনও তাহলে কেউ ধরা পড়েনি। তা তাহলে মাসিমা খুব মঙ্গল হয়েছে নন্দু আর ওনার সঙ্গে কাজ করে না বলে, নাহলে দেখতেন ওকেও কত ঝামেলা পোহাতে হত।” সমবেদনার সুরে কথাগুলো বলে উঠল সমীর আর তাতে বোধহয় খানিক হলেও নরম হলেন মহিলা, “সে সুখ কি আর আমাদের কপালে আছে বাবা! নন্দুকে বারবার করে বলেছিলাম ওই লোকটার সংস্পর্শে থাকিস না কিন্তু ও শুনলো না আমার কথা। এখন কাজ ছেড়ে দিয়েও রেহাই নেই, কে যেন মিথ্যেমিথ্যি লাগিয়ে দিয়েছে যে নন্দুর সাথে নাকি বিনোদের ঝগড়া হয়েছিল সেদিন। আর তাতেই…”

“এ বাবা! মুশকিল তো তাহলে…”

“ওই লোকটা মরলেই ভালো, আমাদের সীমার সারা জীবনটা তো শেষ করে দিল। কিন্তু এখন মরলও না পুরোপুরি এদিকে আমার নন্দুকে…”

“সীমা মানে…?”

“সীমা আমার দূর সম্পর্কে ভাইঝি হয়, ওই বিনোদের বউ। খুব লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে ছিল কিন্তু ওই লোকটার সাথে বিয়ে হয়েই… সারাজীবন অন্য মেয়ের সঙ্গে… উফফ এসব কথা বলতেও লজ্জা।” চুপ করে গেলেন নন্দগোপালের মা। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সমীর বলল, “নন্দু তো এখনও এলো না মাসিমা, আজ আমরা তাহলে উঠি পরের বার এলে দেখা হবে নাহয়।” এই বলে মহিলাকে প্রণাম করে বাইরে বেরিয়ে এলো সমীর আর সাগর। কিন্তু একটু এগোতেই দেখলো একটা লোক ওদের দেখে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছে, আর তার সাথে যে মহিলা ছিলেন তিনি মাথার স্কার্ফটাকে আরেকটু ভালো করে ঢেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন দূরেই। লোকটা ওদের সামনে এসেই জোর গলায় বলে উঠল, “কে আপনারা? আমার বাড়িতে কী করছিলেন?”

“আপনিই কি নন্দগোপাল?” জিজ্ঞেস করল সমীর।

“হ্যাঁ আমিই।”

“আপনার খোঁজেই এসেছিলাম। বিনোদবাবুর ব্যাপারে…”

“হেই বিনোদবাবুর ব্যাপারে কী হ্যাঁ? কে আপনারা?”

“আমি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। বিনোদবাবুর দিদি আমাকে এই কেসের তদন্তভার দিয়েছেন। তাই আপনার সাথে কথা বলতে এসেছিলাম।”

“আমার সাথে কীসের কথা শুনি? আমি বহুদিন হল লোকটার সাতে পাঁচে থাকি না। আমি আমার নিজের ব্যবসা শুরু করেছি, আমি আমার ভালো আছি। আপনারা খামোকা এসে ঝামেলা করছেন কেন বলুন তো!”

“সাতে পাঁচে থাকি না বলাটা বোধহয় ঠিক না। সেদিন বিকেলে আপনার সাথে বিনোদবাবুর দেখা হয়েছিল এবং ঝগড়াও হয়েছিল। এম আই রাইট?”

“হেই কে এসব আপনাদের বলছে বলুন তো? দেখা হয়েছিল ঠিক কথা কিন্তু ওসব ঝগড়া টগড়া কিছু হয়নি। আমাকে কেউ ফাঁসাতে এসব কথা বলছে।”

“বলছেন ঝগড়া হয়নি?”

“হ্যাঁ বলছি। সেদিন… ওই আরকি… বাই চান্স দেখা হয়ে গেছিল। আর শুনুন আমার মনে হয় যে আপনাদের আমার নামে এসব বলছে সেই হয়তো আসলে কাজটা করেছে তাই আমার নাম নিয়ে নিজেকে বাঁচাতে চাইছে।”

“আচ্ছা মেনে নিলাম। আরেকটা প্রশ্ন ছিল?”

“কী?”

“আপনি তো নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন শুনলাম তা আপনার ব্যবসা শুরুর জন্য মূলধন কীভাবে জোগাড় হল বলতে পারেন?”

“এর সাথে এই কেসের সম্পর্ক?”

“না এমনিই জিজ্ঞেস করছি।”

“আমি লোন নিয়েছি।”

“ব্যাংক থেকে?”

“না। একজন পরিচিতের কাছ থেকে।”

“কে সে?”

“আমি বলতে বাধ্য নই।”

“ওকে। আসছি। আশা করি আবার দেখা হবে।”

নন্দগোপালের কাছ থেকে সরে গিয়ে হনহন করে হাঁটা লাগলো সমীর, সাগরও ছুটল ওর পেছন পেছন। কিন্তু নন্দগোপালের সঙ্গিনীর কাছাকাছি আসতেই সমীরের গতি একটু মন্থর হল, আর তাতেই মহিলা উল্টো দিকে ঘুরে গেলেন। বলাই বাহুল্য তার মুখ দেখা সম্ভব হলো না। তবে তাঁর আপাদমস্তক একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সমীরের ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠল।

অ্যাসাইনমেন্টের সব পেপার ছড়িয়ে নিয়ে হতাশ মুখে বসেছিল সাগর। গতকালটা তো বেশ সারাদিন দাদার সঙ্গে গোয়েন্দাগিরির স্বপ্নে বিভোর হয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল কিন্তু আজ কলেজে ঢুকতেই আবার বাস্তবের মাটিতে ধপ করে পড়ে গেছে। পরের সপ্তাহেই অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার শেষ দিন এদিকে ওর পার্টনারের অবস্থা তো বলার মত নয়। মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে এখন।

“কী খবর ডিটেকটিভ?” দরজার বাইরে থেকে সাগরের উদ্দেশে কথাগুলো ছুঁড়ে দিলো সমীর। মুখ ফুলিয়ে সাগর তাকালো তার দিকে। সমীর এবার ঘরে ঢুকে বলল, “কী হয়েছে কাগজ ছড়িয়ে কাঁদছিস কেন?”

“আমি মোটেই কাঁদিনি।”

“এই তো কাঁদছিস।”

“ইয়ার্কি করিস না দাদাভাই। আমি খুব প্রবলেমে পড়ে গেছি।”

“কী প্রবলেম?”

“অঙ্কিত এখন কলেজ আসছে না এদিকে নেক্সট উইকে আমাদের জয়েন্ট অ্যাসাইনমেন্টটা সাবমিট করতে হবে। কী হবে জানি না…!”

“বুঝলাম। তা অঙ্কিত কলেজ যাচ্ছে না কিন্তু তুই তো অঙ্কিতের বাড়ি গিয়ে কাজটা করতে পারিস। আফটার অল ওকেও তো কমপ্লিট করতে হবে অ্যাসাইনমেন্ট। আর তাছাড়া তুই গেলে ওরও মনটা ভালো লাগবে।”

“ধুরর… ও একা একাই থাকতে পছন্দ করে। কারুর সাথে মেশে না।”

“তাই নাকি!”

“হুমম।”

“কেন?”

“সেটা জানি না। আগে মনে হত বড়লোক বলে অহংকারী কিন্তু এখন ওকে কিছুটা কাছ থেকে দেখার পর মনে হয় ও আসলে ইন্ট্রোভার্ট। ইন ফ্যাক্ট জানিস তো দাদাভাই সেদিন যখন ওর বাড়ি গেলাম তখন জীবনে প্রথমবার ওকে এতো কথা বলতে দেখলাম।”

“হুমম। আসলে অনেক সময় বড় ধাক্কা পেলে মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসে। ওরও হয়তো সেরকমই… তাই বলছি ওর কাছে যা, তোর কাজও হবে আর ওরও ভালো লাগবে।”

“ঠিক আছে।”

“সেই সাথে একটু চোখ কান খোলা রাখিস ওই বাড়িতে।”

“ইয়েস বস।”

“ইয়েস বস বললেই হবে! গতকাল তো শুধু সঙ্গে গেলি আর ভ্যালভ্যাল করে তাকিয়ে রইলি।”

“আ… আমি অবসার্ভ করছিলাম।”

“তাই নাকি? তা কী অবসার্ভ করলি শুনি? কাকে সন্দেহ হলো?”

“বাহ্ রে সন্দেহের কথা এভাবে বলা যায় নাকি! আমি তো জানিই না সেদিন ওদের বাড়ির লোকগুলোর সাথে কী কী কথা হয়েছে তোর।”

“ঠিক ঠিক। আমি বলতে পারি কার সাথে কী কথা হয়েছে তবে তার আগে তুই বল ওদের বাড়িতে কে কে আছে।”

“ওদের বাড়িতে… ওই তো অঙ্কিত, ওর ঠাকুমা… কাকিমা তো নেই। আর আছে ওর ঠাকুমার আয়া রোজি, রান্নার লোক বীণা, আর দারোয়ান।”

“গুড। তবে আরও একজন আছে।”

“সেটা আবার কে? ওদের বাড়ির ঠিকে কাজের লোক, রমলা। আর অঙ্কিতের ঠাকুমার আয়া হিসেবে সকালে যে কাজ করে তাকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ রাখাই যায় কেননা সে সেদিন সন্ধ্যেবেলা আবার অন্য একজায়গায় কাজ করতে গিয়েছিল, আমি খোঁজ নিয়েছি ভালো করে।”

“ওহ আচ্ছা আচ্ছা। তাহলে এবার বল বাকিদের সাথে কী কথা হল?”

“প্রথম, অঙ্কিতের ঠাকুমা। উনি তো বিশেষ কিছুই বলতে পারেননি শুধু জানিয়েছেন কেউ একজন এসেছিল এবং তার সাথে বিনোদ প্রতিহারের তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। সিসিটিভি ফুটেজ আর দারোয়ান মোতিলালের কথা অনুযায়ী ওটা কুলভূষণ দাবে। এবার রইল মোতিলাল। এর কথাবার্তায় বিস্তর ফাঁক। প্রথমত ও দাবেকে ঢুকতে দেখেছে কিন্তু বেরোবার কথা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি কখন বেরিয়েছে। বারবার উল্টোপাল্টা সময় বলছে, মানে ধরে নেওয়া যেতে পারে ও আসলে দেখেইনি লোকটা কখন বেরিয়েছে। আবার বীণা বলছে সে যখন সন্ধ্যেবেলা ঢোকে তখন গেটের কাছে মোতিলাল ছিল না, বীণা ঘরে ঢুকে মোতিলালকে দেখতে পায় দরজার সামনে। তারপর দুজনে মিলে ভেতরের ঘরে এসে বিনোদ প্রতিহারকে ওই অবস্থায় দেখে। কিন্তু প্রশ্ন হল বীণা বলছে সে যখন গেটের কাছে আসে তখনই চিৎকারটা শুনতে পায়, এদিকে মোতিলাল বলছে সেও চিৎকার শুনেই ভেতরে এসেছিল। তাহলে তো দুজনের একই সময়ে গেটের কাছে থাকার কথা কিন্তু বীণার কথা অনুযায়ী মোতিলাল গেটের কাছে ছিল না।”

“স্ট্রেঞ্জ। আর রোজি?”

“এটাও ভাববার বিষয়। অন্যদিন রোজি বিকেল থাকতেই চলে আসে কিন্তু সেদিন দেখে দেখে তার আসতে সন্ধ্যে সাড়ে আটটা বেজে গেল! কেন?”

“রোজি কী বলছে?”

“সে বলছে সে বাড়িতেই ছিল। তার নাকি ঘুম ভাঙতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল তাই…”

“আর ওই রমলা?”

“একদম সাধারণ একজন মহিলা, এরকম একটা ঘটনায় ঘাবড়ে গেছে স্বাভাবিকভাবেই। সেদিন ওই বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ বাসন ধুয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল। তবে এর কাছ থেকে একটা ইন্টারেস্টিং ইনফরমেশন পেলাম, সেটা হচ্ছে বাড়ির পেছন দরজার কাছে থাকা ক্যামেরাটা সেদিন সকালে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এই নিয়ে বিনোদ প্রতিহার খুব চেঁচামেচি করে। সারানোর জন্য লোকও ডাকে কিন্তু তারা না আসতে রাগে গরগর করতে করতে নাকি কাজে বেরিয়ে যায়।”

“তার মানে ওই পেছনের দরজাটা ব্যবহার করে ঘরে ঢুকেছিল আততায়ী!”

“একদমই তাই।”

“উফফ মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে এবার। মনে হচ্ছে যেন সবাই মিথ্যে কথা বলছে।”

“বুঝলাম। আপাতত ছেড়ে দিলাম তোকে। এখন মাথা ঠান্ডা করে পড়াশুনো কর। রাতে এটা নিয়ে ভাববি আর কালকে যাস অঙ্কিতের কাছে।”

অঙ্কিতের রুমে বসে একটা ফটোফ্রেম নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল সাগর। ছবিটায় ওর মা বাবার সঙ্গে অঙ্কিত, তখন ওর বয়েস বড়জোর দশ বারো হবে। ছবিতেও মুখটা চিরাচরিতভাবে গম্ভীর। আশ্চর্য ছেলেটা কি কখনও হাসে না! তবে দাদাভাই বোধহয় ঠিকই বলেছিল মানুষ বড় ধাক্কা পেলে অনেক সময় পাল্টে যায়। ওর বাবার এরকমটা হওয়ার পর অঙ্কিত খানিকটা হলেও পাল্টেছে নয়তো ওর মুখ থেকে এতো কথা বেরোতে পারে আগে ভাবতেই পারত না সাগর। আজকে নিয়ে পরপর তিনদিন ওর বাড়িতে এলো সাগর, অনেকটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে ছেলেটা। কাকিমাও বাড়ি এসেছেন কাল। কাকিমাই আজ বললেন যে সোমবার থেকে নাকি অঙ্কিত কলেজে যাবে। কথাটা শোনার থেকে বেশ ভালো লাগছে সাগরের কিন্তু সেই সাথে একটা মন খারাপও কাজ করছে। এই তিনদিনে ও কোনো কাজের জিনিস আবিষ্কার করে উঠতে পারেনি এই বাড়িতে। ডিটেকটিভ গল্প পড়ে পড়ে ওর ধারণা হয়েছিল অপরাধী চারিদিকে ক্লু ফেলে রাখে, শুধু চোখ কান খোলা রাখলেই টপ টপ করে সেগুলো তুলে নেওয়া যায়। কিন্তু এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে যে বাস্তব আর গল্পের মধ্যে অনেক ফারাক। সমীর অবশ্য আরও দু’বার এসে ঘুরে গেছে এখান থেকে, কীসব কথাবার্তাও হয়েছে কিন্তু সেগুলো সে বলেনি সাগরকে। এখানে অবশ্য কেউ জানে না ওরা দুজন ভাই বলে, এখানে সাগরের একমাত্র পরিচয় ও অঙ্কিতের বন্ধু। তাই বেশি কৌতূহল দেখিয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না।

অঙ্কিত সেই যে কখন স্নানে গেছে এখনও আসার নাম নেই, ওর এটাচ বাথে জল আসছিল না বলে অন্য কোন বাথরুমে গেছে যেন। বসে বসে বোর হচ্ছিল সাগর। এসাইনমেন্টের পেপারগুলো দেখতে দেখতেও বিরক্তি চলে আসতে উঠে দাঁড়াল ও। অঙ্কিতের রুমটা বেশ বড় আর পরিপাটি করে সাজানো। মনে মনে সাগর ভাবল এরকম বড় রুম পেলে ও-ও গুছিয়ে রাখত ওর জিনিসপত্র। অঙ্কিতের পড়ার টেবিলের ওপর অল্প কয়েকটা বইখাতা রাখা, আর বাকি বইখাতা গোছানো আছে টেবিলের পাশে থাকা কাঁচের দেওয়াল আলমারিতে। আলমারির বইগুলো দেখতে দেখতেই সাগরের নজর গেল আলমারির নীচের তাকটায়। কাঠের স্লাইডিং সেখানে। বাইরে থেকে দেখে তাই বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী আছে। সাগর আস্তে করে একধারের স্লাইডিংটা ঠেলল, মৃদু শব্দ তুলে সরে গেল সেটা। ও দেখলো ভেতরে বিচ্ছিন্ন কাগজ পত্র, পুরোনো ডায়েরি সব অগোছালো করে ঠেসে রাখা। ধুলো জমেছে সেসবের গায়ে। স্লাইডিংটা বন্ধ করতে যাচ্ছিল সাগর কিন্তু তখনই হঠাৎ ওর মনে হল ওসবের মাঝখান থেকে একটা অ্যালবাম উঁকি দিচ্ছে যেন। কৌতূহলবশতঃ এলবামটা টেনে আনল সাগর। তারপর আস্তে করে তার পাতা ওল্টাতেই চমকে উঠল ও, একটার পর একটা পাতা উল্টে যেতে লাগল বিস্মিতভাবে। ওর হাত দুটো কাঁপছিল, কোনোক্রমে মোবাইলের ক্যামেরা অন করে কয়েকটা পাতার ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেল সিঁড়িতে কার যেন পায়ের আওয়াজ আসছে। চটজলদি অ্যালবামটা ঢুকিয়ে স্লাইডিংটা টেনে দিল সাগর, আর তখনই ভ্রু দুটো কুঁচকে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল অঙ্কিত।

“তোকে আমি পনেরো মিনিট দিচ্ছি। কাকে কাকে তোর সন্দেহ হচ্ছে এবং কেন সেটা বল।” ‘ফ্লেভার’ এর প্রাইভেট কেবিনে বসে গরম কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সাগরের উদ্দেশে কথাগুলো বলল সমীর। সাগর একবার আশপাশটা তাকিয়ে নিয়ে বলল, “কিন্তু তার আগে তুই বল আমরা এখানে কী করছি?”

“অপেক্ষা।”

“কার?”

“এলেই দেখবি?”

“সে কি আমাদের সাথে দেখা করতে আসছে নাকি আমরা তার ওপর নজরদারি করতে আসছি?”

“তোর কী মনে হচ্ছে?”

“জানি না।”

“তা বললে তো চলবে না। এটা তো খুব সাধারণ প্রশ্ন।”

“অপেক্ষা করছি?”

“হুমম। তা এবার বল কাকে কাকে সন্দেহ করিস?”

“উমম... নন্দগোপাল?”

“কেন?”

“কেননা ওর বিনোদ প্রতিহারের ওপর রাগ ছিল বোঝাই যাচ্ছে, আর ওই এই বাড়ির সব থেকে ক্লোজ ছিল কাজেই ওর পক্ষে সহজেই বাড়ির ভেতরে ঢুকে কাজ সারা সম্ভব।”

“বুঝলাম, কিন্তু ও ঢুকলে তো ওকে দেখা যেত সিসিটিভিতে।”

“পেছনের সিসিটিভিটা খারাপ ছিল।”

“সেটা খারাপ করল কে? বা যদি এমনিও খারাপ হয়ে থাকে নন্দগোপাল জানলো কী করে সেটা?”

“ও আগেই ওই দারোয়ান আর কুককে মনে হয় হাত করে রেখেছিল। ওরাই হয়তো সব বন্ধ করে দেয়।”

“ভুল।”

“কেন?”

“তুই ভুলে গেলি রজত কী বলেছিল? নন্দগোপাল বিনোদ প্রতিহারকে ব্ল্যাকমেইল করছিল কোনো জিনিস নিয়ে। তাহলে ওর প্রতিহারকে মেরে কী লাভ?”

“হ্যাঁ সত্যিই তো এটা তো ভেবে দেখিনি!”

“রজত ঠিকই শুনেছিল। নন্দ প্রতিহারকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিত নিয়মিত আর তাতেই নিজের ব্যবসাও শুরু করে। তোর মনে আছে আমরা যেদিন ওর বাড়ি গিয়েছিলাম সেদিন ওর সাথে বাইরে একজন মহিলাও ছিল যে আমাদের দেখে মুখ ঢেকে রেখেছিল?”

“হ্যাঁ।”

“সেই মহিলা কে বলতো?”

“বীণা।”

“কী?”

“হুমম। প্রতিহারদের বাড়ির কুক।”

“কী করে বুঝলি? ওর তো মুখ দেখতে পাইনি।”

“হুমম তা অবশ্য পাইনি কিন্তু অন্য উপায়ে বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম মেয়েটা কে। আর তাই পরের দিন ওর সঙ্গে গিয়ে কথা বলি। একটু চাপ দিতেই ভয়ে বলে ফেলে সব।”

“কী করে?”

“যেদিন প্রথম প্রতিহারদের বাড়িতে যাই সেদিন দেখেছিলাম বীণার ব্যাগ থেকে একটা “বি” লেখা নতুন চেন ঝুলছে। চেনটা এতো স্টাইলিশ ছিলো যে সহজেই আমার নজর পড়েছিল ওটার দিকে। আর সেদিন রাস্তাতেও স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোয় ওই চেনটাই ঝকমক করে উঠেছিল তাই বীণার মুখ না দেখতে পেলেও তখনই ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম খানিক। এরপর বীণার সাথে কথা বলে নিশ্চিত হই। নন্দগোপাল তাঁর জামাইবাবুর বিশেষ দুর্বলতাটার কথা জানতো, তাই ছক কষে নিজের প্রেমিকা বীণাকে পাঠায় বাড়ির কুক হিসেবে। বিনোদ প্রতিহার এরপর যথারীতি বীণার প্রতি আকৃষ্ট হয়, হয়তো বীণা এক্ষেত্রে সিডিউসও করেছিল লোকটাকে। যাইহোক, ওদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে নিয়ে নন্দ এবার ব্ল্যাকমেলিং শুরু করে প্রতিহারকে। তবে মজার ব্যাপার ওরা প্রতিহারকে বুঝতে দেয়নি যে বীণা আর নন্দ একসঙ্গে কাজ করছে যাতে ভবিষ্যতে আবার প্রয়োজন হলে কোনো অপকর্ম করা যায়। প্রতিহার ভাবত যে ব্যাপারটা অ্যাক্সিডেন্টালি নন্দর নজরে পড়ে গেছে।”

“বাবা রে! তার মানে বলছিস নন্দগোপাল আর বীণা বাদ সন্দেহের তালিকা থেকে?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে বাকি রইল কে! কুলভূষণ দাবে, দারোয়ান, আর রোজি। আর…”

“যদিও দাবের মোটিফও আছে আর যা কিছু ঘটেছে পরপর তাতে তো প্রথম সন্দেহ ওর দিকেই যায়। কিন্তু ওই লোকটা কি অতো কাঁচা কাজ করবে?”

“তাহলে?”

“দারোয়ান আর রোজি….! কিন্তু মোটিফ?”

“রোজি… কে জানিস?”

“কে?”

“কুলভূষণ দাবের প্রথম স্ত্রী, অবশ্য কোনোদিনও তার স্বীকৃতি পায়নি।”

“মানে?”

“হুমম। কুলভূষণ দার্জিলিং এ থেকে পড়াশুনো করেছে। রোজির সাথে আলাপ ও বিয়ে সেখানেই কিন্তু ভিন্ন ধর্মে বিয়ে যে কুলভূষণের পরিবার মেনে নেবে না তা ও ভালো করেই জানতো আর কিছুদিন পর লোকটা তাই রোজিকে ফেলে পালিয়ে আসে। এখানে এসে যথারীতি আরেকটা সংসার শুরু করে মহা আনন্দে। অন্যদিকে রোজি তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিল। তার একটি মেয়ে হয়। মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাতে থাকে সেখানে। এরপর মেয়ে একটু বড় হওয়ার পর সে কুলভূষণের খোঁজ শুরু করে। লোকটার মনে হয় শুরুর থেকেই রোজিকে ধোঁকা দেওয়ার প্ল্যান ছিল, তাই বাড়ির ঠিকানাও বলেছিল ভুলভাল। রোজি মেয়েকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় লোকটাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে হাজির হয়। এখানে পেট চালানোর জন্য প্রতিহারের মায়ের আয়া হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। আর তাতেই একদিন ওর দেখা হয়ে যায় কুলভূষণ দাবের সঙ্গে। দেখা ঠিক হয়নি, রোজি দেখেছিল স্ত্রী সন্তান নিয়ে মহা আনন্দে বিনোদ প্রতিহারের জন্মদিনের পার্টিতে এসেছিল লোকটা। তখন থেকেই প্রতিশোধ স্পৃহায় ফুঁসতে থাকে রোজি।”

“ওহ মাই গড! কিন্তু তুই এসব জানলি কী করে?”

“একদিন জিজ্ঞাসাবাদ করব বলে আচমকাই গিয়েছিলাম রোজির বাড়ি, রোজি ছিল না কিন্তু ওর মেয়েটার সাথে ভাব জমাই ভালো করে। বিভিন্ন কথার মাঝে বাচ্চা মেয়েটা বলে ফেলে যে তারা তার বাবাকে খুঁজতে এসেছে। আর বাবার একটা ছবিও দেখায় মেয়েটা। যদিও এখনের মত ভুঁড়ি হয়নি তখনও তাও আমার চিনতে ভুল হয়নি কুলভূষণ দাবেকে।”

“কিন্তু তাহলে রোজি বিনোদ প্রতিহারকে মারার চেষ্টা করবে কেন?”

“কে বলল রোজি প্রতিহারকে খুনের চেষ্টা করেছে?”

“তাহলে?”

“মোতিলাল লোকটা নেহাতই সাধাসিধে। সেদিন ওরকম দৃশ্য দেখে তারপর পুলিশের ধমকানিতে ঘাবড়ে গিয়ে লোকটা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিল কিন্তু আমি আস্তে আস্তে ভাব জমিয়ে কথা বলার চেষ্টা করতেই লোকটা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে বসে আমাকে। সে বলে সেদিন কুলভূষণ দাবে ভেতরে ঢোকার কিছু পরেই একটা ছেলে আসে একটা ঠিকানা জানতে। দিয়ে ছেলেটা গল্প করতে লাগে ওর সঙ্গে। গল্প করতে করতে ওকে অফার করে চা খাওয়ার জন্য। সামনেই দোকান তাই চলে যায় মোতিলাল। ছেলেটা মোতিলালকে নিজের বাড়ি বলে একটা গ্রামে এবং আশ্চর্যজনক ভাবে আমি জানতে পারি প্রতিহারদেরও আদি বাড়ি ওই একই গ্রামে।”

“স্ট্রেঞ্জ! তারপর?”

“কিন্তু আমার আবার গ্রামের নামটা শোনামাত্রই মনে হতে থাকে এই গ্রামের কথা আগেও যেন কোথায় শুনেছি। মোতিলালের কাছে জানতে চাই ছেলেটা দেখতে কেমন ছিল। এরপর দুইয়ে দুইয়ে চার… কিছু পুরোনো স্মৃতি আবার তাজা হয়ে ওঠে।”

“কী স্মৃতি?”

“রজত… কলেজে পড়াকালীন জুনিয়র হলেও রজতের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেই সুবাদেই ওর গ্রামের নামটা জেনেছিলাম। আর মোতিলালের বর্ণনা শুনে চোখের সামনে চট করে রজতের চেহারাটাই ভেসে উঠেছিল। ও ওই একটাই ভুল করে বসেছিল সেদিন, মোতিলালকে নিজের আসল গ্রামের নাম বলে।”

“কিন্তু রজতদা কেন বিনোদ প্রতিহারকে খুন করার চেষ্টা করবে?”

“এই ব্যাপারটা তো আমারও মাথায় আসছিল না কিছুতেই। স্মৃতির পাতা হাতড়ে অনেক কষ্টে বিকৃতভাবে রজতের বাবার নামটা মনে পড়ে। আমি এরপর যাই বিনোদ প্রতিহারের মায়ের কাছে। বৃদ্ধা শয্যাশায়ী হলে কি হবে পুরোনো কথা সব স্পষ্ট মনে আছে। আমি নামটা ভুল করে জিজ্ঞেস করি রবিন দাস বলে কাউকে চেনেন কিনা, কিছুক্ষণ ভেবে উনি বলেন রবিন নয় রথিন দাস। তারপর ভেঙে ভেঙে বলেন যে অঙ্কিতের মা একসময় খুব অসুস্থ হয়েছিল তখন রথিন দাশের বোনকে তিনি এনেছিলেন বাড়িতে। এইটুকু বলেই বৃদ্ধা আচমকা কাঁদতে লেগে যান। এরপর ওনার মুখ থেকে আর একটাও শব্দ বের করতে পারিনি। অঙ্কিতের মায়ের কাছ থেকে জানতে পারি ওই মেয়েটি নাকি আচমকাই কাজ ছেড়ে দেশে ফিরে গিয়েছিল কোনো কারণ ছাড়াই। কিন্তু আমার মন বলে সে অকারণে কাজ ছেড়ে যায়নি।”

“তাহলে?”

“এরপর আর কি রজতের কাছে যাই। দেখি ওর মানসিক অবসাদগ্রস্থ পিসিকে। রজত কলেজে খুব ভালো মাউথঅর্গ্যান বাজাতো, শুনেছিলাম ছোটবেলায় ওর পিসি নাকি ওকে কিনে দিয়েছিলেন ওটা। রজতকে দেখেই তখন মনে হত ও খুব ভালোবাসে ওর পিসিকে, আর এতো বছরের কোনো আঁচড় পড়েনি সেই ভালোবাসায়। বরং হয়তো আরও তীব্র হয়েছে সেটা।

“তারমানে কি বিনোদ প্রতিহার ওর পিসির সাথে উল্টোপাল্টা কিছু করেছিল আর তাই রজতদা…?”

“প্রথমটা সত্যি আর দ্বিতীয়টার উত্তর আমি জানি না।

রোজি সম্ভবত দাবের কাছে গিয়েছিল কোনোদিন কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে আসে। আর সেদিনই হয়তো রজত রোজিকে প্রথম দেখে। এরপর আলাপ করে দুজনে প্ল্যান বানাতে শুরু করে। ততদিনে প্রতিহার আর দাবের মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। তাই সুযোগ এসেও যায় একদিন। রোজি ওই বাড়ির ঘাঁতঘোঁৎ সব জেনে ফেলেছিল কাজ করার সুবাদে তাই বাড়ির পেছনের দিকের সিসিটিভিটা ও আগের দিনই রাতেই কাজে এসে কোনো ফাঁকে খারাপ করে রেখেছিল। আর সেদিক দিয়ে ঢুকে সব সিসিটিভির মেইন সুইচ অফ করতে অসুবিধা হয়নি। আমার ধারণা হয় রমলাকে কোনোভাবে ভুল বুঝিয়ে বা টাকা খাইয়ে পেছনের দরজার ছিটকিনিটা খোলা রাখার ব্যবস্থা করেছিল ওরা। এদিকে অতিরিক্ত সুরক্ষা হিসেবে তো মোতিলালকে ব্যস্ত রেখেছিল রজত। কিন্তু…”

“কিন্তু কী?”

“রজতের বক্তব্য অনুযায়ী ও যখন প্রস্তুত হয়ে বাড়িতে ঢোকে তখন আচমকা সব ঘরের আলোগুলো নিভে যায়। এতে ঘাবড়ে যায় রজত, এদিকে শুনতে পায় প্রতিহার জোরে জোরে ডাকছে রোজিকে। রজত ভয়ে পালাতে যায় কিন্তু তার আগেই ধাক্কা খায় কারুর সাথে। এতে ও ভয় পেয়ে আচমকা চিৎকার করে ফেলে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে পালায় সেখান থেকে। আমার মনে হয় মোতিলাল এই চিৎকারটা শুনেই ঘরের দিকে আসে।”

“রজতদা কি সত্যি কথা বলছে? যদি তাই হয় তাহলে আরও কেউ আছে!”

“এসে গেছে।”

“কে?”

“দরজার দিকে দেখ।”

“অঙ্কিত!”

“হুমম। যার অপেক্ষায় ছিলাম।”

সমীর আর সাগরকে একসাথে দেখে সামান্য চমকালেও কাছে এসে একদম স্বাভাবিক গলায় অঙ্কিত বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুই হয়তো পুলিশকে জানাবি। এনার সাথে যে তোর পরিচয় আছে সেটা বুঝতে পারিনি।”

“কী?” অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল সাগর।

“আমি জানি কাল ওই অ্যালবামটা তুই দেখেছিলি। স্লাইডিং এর আওয়াজ পেয়েছিলাম তারপর তুই যাওয়ার পর অ্যালবামটার পজিশন দেখেই বুঝতে পারি।”

“আমি সাগরের মেজো দাদা অঙ্কিত।”

“ওহ আই সি।”

“তুমি কি তাহলে সব বলবে আমায়? আমি কিছুটা জেনেছি কিন্তু বেশিরভাগটাই জানতে পারিনি তাই…”

“আপনি কতটা জানেন?” খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল অঙ্কিত।

গলাটা ঝেড়ে নিয়ে সমীর উত্তর দিলো, “বেশি নয়, শুধু এটুকুই জেনেছি যে ছোটবেলায় তোমার সাথে এমন কিছু হয়েছিল যে তোমাকে একটা ট্রমার মধ্যে নিয়ে চলে যায়। চিকিৎসার পরও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারোনি। যার ফলে কারুর সাথে মিশতে পারো না তুমি, কথা বলতে ভয় পাও। আর আমি যদি খুব ভুল না করি তাহলে সেই তিক্ত অভিজ্ঞতাটা তোমার বাবাকে কেন্দ্র করে। আর তাই অ্যালবামে ওনার ছবিগুলো ওরকম বীভৎস ভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছ তুমি। তাই নয় কি?”

“আমার বয়েস তখন চার মিঃ সেনগুপ্ত, অনলি ফোর। ছোটবেলা থেকেই মা খুব অসুস্থ থাকতো, তাই ঠাম্মি রত্না পিসিকে গ্রাম থেকে এনেছিল মায়ের দেখভাল করতে। তারপর…”

“তারপর কী?” জিজ্ঞেস করল সাগর।

“তারপর একবার মা খুব অসুস্থ হলো। মাকে হস্পিটালাইজড করতে হল। দিয়ে…”

“দিয়ে কী?”

“ঠাম্মি সেদিন মায়ের কাছে ছিল… আমি খেলতে গিয়েছিলাম… কিন্তু খেলায় মন বসছিল না… তাই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম তাড়াতাড়ি।”

“তারপর?”

“বাড়ি ফিরে দেখলাম বাবা রত্না পিসিকে... ফোর্স করে… উফফ… কী বীভৎস সে দৃশ্য… সেদিন জানতাম না ওটা কী হচ্ছে কিন্তু বিশ্বাস করুন মিঃ সেনগুপ্ত রত্না পিসির সেই চিৎকার… আকুতি… উফফ… আজও… আজও আমার কানে বাজে যেন…” দু’হাতে মুখটা ঢেকে নিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল অঙ্কিত। সমীর আস্তে আস্তে হাত রাখল তার পিঠে, “রিল্যাক্স… শান্ত হও অঙ্কিত। শান্ত হও।”

খানিক পরে আস্তে আস্তে মুখ তুলল অঙ্কিত। লাল হয়ে গেছে ওর চোখ মুখ। একটা ন্যাপকিন তুলে নিয়ে মুখটা মুছে সে আবার বলতে শুরু করল, “আমি তখন থেকে বাবাকে ঘৃণা করা শুরু করি, যত বড় হতে থাকি আমার ঘৃণা তত বাড়তে থাকে। একটা উম্যানাইজার… বাবা বলতেও ঘেন্না হয় আমার। আমার মাকে প্রতিনিয়ত ঠকিয়েছে লোকটা। আর আমি ভাবতাম আমার ঠাম্মি ইনোসেন্ট বাট নো শি নিউ এভরিথিং… এভরিথিং। রত্না পিসিকে তড়িঘড়ি গ্রামে পাঠিয়ে আমার ঠাম্মিই, পয়সা দিয়ে ওর দাদার মুখ বন্ধ করে আমার ঠাম্মিই। আই জাস্ট হেট হার। তবে ভগবান ঠাম্মিকে শাস্তি দিয়েছে, আর আমি বাবাকে।” একটু চুপ করে থেকে অঙ্কিত এবার ব্যঙ্গ করে হেসে বলে উঠল, “সবাই ভাবছে আমি বাবাকে মারতে গিয়েছিলাম, অন্ধকারে ভুলভাল ছুরি চালিয়েছি। হাঃ হাঃ আমি লোকটাকে মারতে চাইনি। মেরে দিলে কী হতো! মরে যেতো ছটফট করে বাট আই ওয়ান্টেড হিম টু সাফার… আর তাই আমি লোকটার মিথ্যে দম্ভটাকে কেটে শেষ করে দিয়েছি।” শেষ কথাগুলো দাঁতে দাঁত চিপে বলল ছেলেটা। অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সাগর, এই ছেলেটার মধ্যে এমন আগুন লুকিয়ে আছে কে জানতো!

“মিঃ সেনগুপ্ত আমি জেলে যেতে ভয় পাই না। সেদিন বাড়িতে আরও কেউ এসেছিল। সিসিটিভি গুলো আমি বন্ধ করিনি, বরং ইলেকট্রিক অফ করতে গিয়ে খেয়াল করি যে সেগুলো আগে থেকেই বন্ধ। অবাক লাগে তাও এগিয়ে আসতে গিয়ে ধাক্কা খাই কারুর সঙ্গে। সেই লোকটা ছুটে পালায় কিন্তু আমি পিছিয়ে আসিনি। জেলে যেতে আমি ভয় পাই না… একটুও ভয় পাই না... বরং এতদিন একটা জেলেই বন্দি ছিলাম অবশেষে এখন মুক্ত লাগছে নিজেকে। সো নাও ইউ ক্যান কল দ্য পুলিশ।”

“দাদা”, সমীরের দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় সাগর বলে উঠল, “তুই কি ওকে ধরিয়ে দিবি?”

সমীর কোনো উত্তর না দিয়ে থমথমে মুখে একবার সাগর একবার অঙ্কিতের দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে একটা নম্বর ডায়াল করল। সাগর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল আর অঙ্কিত মাথাটা নামিয়ে নিলো।

“হ্যালো মিসেস সিনহা আয়াম সরি আমি আপনার ভাইয়ের কেসটা সলভ করতে পারলাম না। আই কুইট।

……

পুলিশ চেষ্টা করছে এবার দেখুন কী হয়।”

সমীরের কথাগুলো শুনে চমকে উঠল সাগর আর অঙ্কিত। আর ফোন কানে সমীর ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চোখ টিপল।